Sunday 4 November 2018

যেকারণে মিয়ানমারের উচিৎ বাংলাদেশের প্রভাব বলয়ে থাকা



০৫ নভেম্বর ২০১৮

মিয়ানমার বাংলাদেশের ভৌগোলিক বাস্তবতা। মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তার অবস্থান সেখানে। রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমার থাকুক আর না থাকুক, এই ভূখন্ডের অবস্থান এখানে থাকবেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না সৃষ্টিকর্তা কিছু করবেন। বাংলাদেশের যেকোন জাহাজ ভারত মহাসাগরে যেতে চাইলে তাকে মিয়ানমারের হাজার মাইলের উপকূলের পাশ ঘেঁসে যেতে হবে। এতবড় উপকূলে অবস্থিত রাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের নীতির সাথে একাত্মতা প্রকাশ না করে, তবে তা বাংলাদেশের জন্যে হুমকিস্বরূপ হবে। এই রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। আর সেই সামরিক শক্তি যদি তেমন কিছু না-ও হয়ে থাকে, তবুও সেই রাষ্ট্র হুমকিস্বরূপ হতে পারে। কারণ ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী কোন রাষ্ট্র যখনই জানবে যে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের উত্তেজনা রয়েছে, তখনই তারা মিয়ানমারকে ব্যবহার করতে চাইবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।

ভারতের অবস্থান

মিয়ানমারের উত্তর-দক্ষিণ বরাবর উপকূল বঙ্গোপসাগরের পূর্ব দিকের নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিরাপত্তাও এই উপকূলের উপরে নির্ভরশীল। ভারতের উপকূল থেকে আন্দামান এবং নিকোবর অনেক দূরে। দ্বীপ হবার কারণে আন্দামান এবং নিকোবর সর্বদাই বঙ্গোপসাগরের উপকূলের উপরে নির্ভরশীল থাকবে। তবে অবস্থানের কারণে এই দ্বীপগুলি মিয়ানমার এবং সুমাত্রার উপরেই বেশি নির্ভর করবে সর্বদা। বর্তমানে এই দ্বীপগুলি ভারতের অধীনে থাকায় তা ভারতের জন্যে একটা লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জ। মিয়ানমারের সহায়তা না পেলে কোন জরুরি সময়ে ভারত এই দ্বীপগুলির নিরাপত্তা দিতে সমস্যায় পড়তে পারে। একারণে ভারতের সর্বদাই লক্ষ্য থাকবে মিয়ানমারকে নিজের পক্ষে রাখতে। কাজেই মিয়ানমারে বাংলাদেশ এবং ভারতের স্বার্থ সাংঘর্ষিক।

চীনের অবস্থান

মিয়ানমারের পূর্বে রয়েছে চীন। চীন তার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানাকে নিরাপদ রাখতে মিয়ানমারে প্রভাব রাখতে চায়। কিন্তু এটা সবারই জানা যে মিয়ানমারে চীনের অবস্থান ভারতকে বিচলিত করে। মিয়ানমারের উপকূলে চীনের অবস্থান যেমন ভারতের কাছে চীনের একটা সামরিক নৌঘাঁটির মতো ঠেকে, ঠিক তেমনি চীনের কাছেও মিয়ানমারে ভারত এবং পশ্চিমা দেশগুলির বিনিয়োগকে চীনের জন্যে হুমকিস্বরূপ দেখা হয়। মিয়ানমারের সাথে ভারতের স্থলসীমানা থাকায় ভারত সেই সীমানার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ভোগে। এমতাবস্থায় মিয়ানমারে চীনের প্রভাব ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির জন্যে হুমকি।

মিয়ানমার যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চায়, তাহলে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। মিয়ানমার যেহেতু বাংলাদেশের সীমানায়, কাজেই সেই ভূখন্ডকে ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি Subversion এর মতো কর্মকান্ড চালাতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১০ লক্ষ মুসলিম শরণার্থীকে ঠেলে পাঠাবার মতো ঘৃণ্য কার্মকান্ড মিয়ানমার থেকে আসা কৌশলগত হুমকিকেই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একইসাথে সেদেশের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ব্যবহার করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি।

যা হতে হবে...

মিয়ানমারকে বুঝতে হবে যে, তারা চীনকে সেদেশে প্রভাব খাটাতে দিলে ভারত বিচলিত হয়ে মিয়ানমারের উপরে চাপ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে মিয়ানমার যদি ভারতকে সেদেশে প্রভাব খাটাতে দেয়, তাহলে চীন তার উপরে চাপ সৃষ্টি করবে। আর চীনের জন্যে মিয়ানমারের উপরে চাপ সৃষ্টি করা বেশ সহজ; কারণ দু’দেশের মাঝে রয়েছে লম্বা স্থলসীমানা এবং সেই সীমানা অঞ্চলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরের জনগোষ্ঠির বিচ্ছিন্নতাবাদী চেষ্টায় চীন সহায়তা দেবে। এতে দুই পক্ষের চাপের মাঝে মিয়ানমারের রাষ্ট্রচালনা বাধাগ্রস্ত হবে।

মিয়ানমারকে বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশই এক্ষেত্রে মিয়ানমারকে নিরাপত্তা দিতে পারে। মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রভাব বলয়ে থাকলে ভারত এবং চীন মিয়ানমারে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না।

চীনকে বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তার করলে চীনের সীমানায় সমস্যা হবে না। কারণ বাংলাদেশ মিয়ানমারকে ভারতের কাছে বিক্রি করবে না। আর মিয়ানমারের উপকূলে চীনের অর্থনৈতিক স্থাপনার নিরাপত্তা চীনের নৌবাহিনীর পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ চীনের সবচাইতে কাছের নৌঘাঁটি দক্ষিণ চীন সাগরে, যা কিনা বঙ্গোপসাগর থেকে ইন্দোচীন, মালয় উপদ্বীপ, থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমার দ্বারা বিভাজিত। তবে বাংলাদেশের পক্ষে মিয়ানমারের উপকূলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বেশ সহজ। মিয়ানমারের স্থলসীমানায় চীনের জন্যে প্রভাব রাখা সহজ হলেও মিয়ানমারের উপকূলে প্রভাব ধরে রাখাটা চীনের জন্যে বেশ চ্যালেঞ্জিং; যেটা বাংলাদেশের জন্যে আবার সহজ।

ভারতকে বুঝতে হবে যে, মিয়ানমার বাংলাদেশের হেফাজতে থাকলে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ নিরাপদ থাকবে। কারণ বাংলাদেশ মিয়ানমারকে চীনের কাছে বিক্রি করবে না। আর সেক্ষেত্রে মিয়ানমারে চীনের সাথে রেষারেষি নিয়ে ভারতকে মাথা ঘামাতে হবে না।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বুঝতে হবে যে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের পক্ষে সম্ভব একমাত্র বাংলাদেশের প্রভাব বলয়ে থেকে। দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করার পরেই যে শুধু নিরাপত্তার ব্যাপারটি তারা ধরতে পারবেন, এমনটা হওয়া কারুর জন্যেই মঙ্গলকর হবে না। মিয়ানমারের ভৌগোলিক বাস্তবতা হলো দেশটা বাংলাদেশ ভারত এবং চীনের মাঝে রয়েছে। এই ভৌগোলিক বাস্তবতা থেকে মিয়ানমারের রেহাই পাওয়া সম্ভব না হলেও সেদেশের রাজনৈতিক নেতৃবর্গের শাসনক্ষমতার বাস্তবতা পরিবর্তিত হতেই পারে। সেই বাস্তবতা পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত বাস্তবতাও যাতে অনিশ্চিত না হয়ে যায়, সেজন্যেই তাদেরকে ঢাকার সাথে সখ্যতা বজায় রেখে চলা উচিৎ।

বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রকে নিজ ভূখন্ড এবং জনগণকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করতে দেবার মতো বাস্তবতা মিয়ানমারের থাকা উচিৎ নয়। এই বাস্তবতা মিয়ানমারের জনগণ এবং সেদেশের নেতৃবৃন্দ কারুর জন্যেই মঙ্গলকর নয়। কাজেই সেই বাস্তবতা একইসাথে বর্জনীয় এবং পরিবর্তনীয়। রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের অস্তিত্ব, সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কদের শাসনক্ষমতা এবং তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা শুধুমাত্র বাংলাদেশের ছায়াতলেই রয়েছে।




Friday 17 August 2018

সামরিক কাজে বেসামরিক জাহাজ? - ফকল্যান্ডস থেকে শিক্ষা

১৮ই অগাস্ট ২০১৮
 
১৯৮২ঃ যাত্রীবাহী ক্রুজ লাইনার 'এসএস ক্যানবেরা' ফকল্যান্ড যুদ্ধ শেষ করে দেশে ফেরত এসেছে। জাহাজের উপরে হেলিপ্যাডের উপরে একটা হেলিকপ্টার দেখা যাচ্ছে। বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী জাহাজকে রিকুইজিশন করে ব্রিটিশরা সৈন্য পরিবহণ করেছিল। এই জাহাজগুলি ছাড়া ব্রিটিশদের পক্ষে ফকল্যান্ড যুদ্ধে জেতা সম্ভব ছিল না।


লাক্সারি লাইনারে সৈন্য পরিবহণ

১৯৮২ সালের ২রা এপ্রিল আর্জেন্টিনা ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। ব্রিটিশ সরকার প্রায় সাথে সাথেই ফকল্যান্ডস পুনর্দখল করতে পরিকল্পনা শুরু করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ই এপ্রিল এবং ২৭শে এপ্রিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী ফকল্যান্ড যুদ্ধের জন্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে পাঠানোর অনুরোধ করে। ব্রিটিশ সরকার এই ব্রিগেডকে পাঠাবার অনুমতি দেয় ২রা মে। এই ইউনিটকে সেখানে পাঠাবার সবচাইতে ভালো পদ্ধতি হিসেবে নতুন কোন পরিবহণ জাহাজ রিকুইজিশন করার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ৩রা মে ব্রিটিশ সরকার শিপিং কোম্পানি কুনার্ড লাইন-এর মালিকানায় থাকা লাইনার জাহাজ ‘এসএস কুইন এলিজাবেথ ২’-কে রিকুইজিশন করে। মাত্র ১৯ ঘন্টা পরেই জাহাজটার ভূমধ্যসাগর ভ্রমণে যাবার কথা ছিল। ২৯৩ মিটার লম্বা ৬৭ হাজার টনের বিশাল এই জাহাজটা ছিল সমুদ্রের বিলাসবহুল মার্সিডিস গাড়ির মতো! ম্যান কোম্পানির তৈরি ১০,৬২৫ কিলোওয়াটের ৯টা ইঞ্জিন জাহাজটাকে সর্বোচ্চ ৩৪ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলার সক্ষমতা দেয়। তবে এর স্বাভাবিক গতি ছিল ২৮ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল, যা বেশিরভাগ যুদ্ধজাহাজের চাইতে বেশি বা কমপক্ষে সমতুল্য। ৫ই মে জাহাজটাকে ভসপার থর্নিক্রফট শিপইয়ার্ডে পাঠানো হয় কিছু মডিফিকেশনের জন্যে। জাহাজের উপরে পেছনের সুইমিং পুল এবং সামনের ডেকের উপরে দুইটা হেলিডেক তৈরি করা হয়। জাহাজের মাঝ দিয়ে জ্বালানি পরিবহণের জন্য লম্বা পাইপলাইন বসানো হয়। পাইপলাইনের মাধ্যমে অন্য জাহাজ থেকে তেল নিয়ে ইঞ্জিনরুম পর্যন্ত নেবার ব্যবস্থা করা হয়। জাহাজের পাবলিক লাউঞ্জগুলিকে সেনাদের থাকার ডরমিটরিতে রূপান্তর করা হয়। জাহাজের পুরো দৈর্ঘ্যের প্রায় চার ভাগের এক ভাগকে স্টিল প্লেটিং-এর মাধ্যমে শক্তিশালী করা হয়। এন্টি-ম্যাগনেটিক কয়েল স্থাপনের মাধ্যমে ম্যাগনেটিক মাইন থেকে জাহাজকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। জাহাজের সাথে জাহাজের ৬৫০ জন ক্রু ফকল্যান্ডে যাবার জন্যে স্বেচ্ছায় নাম লেখায়। মাত্র এক সপ্তাহের মডিফিকেশনের কাজ করার পর ১২ই মে ৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ৩,২০০ সৈন্যকে নিয়ে এই জাহাজ রওয়ানা হয়। যখন জাহাজ রওয়ানা হয়, তখন জাহাজের তিনটা বয়লারের মাঝে মাত্র একটা কাজ করছিল। বাকি দুইটাকে যাত্রাপথে মেরামত করে নেয়া হয়। যাত্রাপথে জাহাজটার রাডার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং জাহাজের কোন বাতি যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়, তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে কেউ জাহাজটাকে খুঁজে না পায়। মডার্ন কোন ন্যাভিগেশন এইড ছাড়াই জাহাজটা দক্ষিণ আটলান্টিকে পৌঁছায়।
 
 
লাক্সারি ক্রুজ লাইনার 'কুইন এলিজাবেথ-২'-এর ডেকের উপরে সৈন্যরা ব্যায়াম করছে। পিছনে হেলিপ্যাডের উপরে দুইটা হেলিকপ্টার দেখা যাচ্ছে। ব্রিটিশ সেনারা কল্পনায়ও ভাবেনি যে এরকম লাক্সারি জাহাজে চেপে তারা কখনও যুদ্ধ করতে যাবে। জাহাজের ক্রুরাও ভাবেনি যে তারা কখনও সেনা পরিবহণ করবে।


সামরিক কাজে বেসামরিক জাহাজ

যে নিয়মের মাধ্যমে এই বেসামরিক জাহাজগুলি ব্রিটিশ সরকার রিকুইজিশন বা চার্টার করেছিল, তা পরিচিত ছিল ‘শিপ টেকেন আপ ফ্রম ট্রেড’ বা স্টাফট নামে, যা ১৯৮২ সালের ৪ঠা মে (ফকল্যান্ড দখলের দুই দিন পর) ইস্যু করা হয়। ‘স্টাফট’এর বদৌলতে ব্রিটিশ সরকার যেকোন জাহাজ রিকুইজিশন করতে পারবে। এর আগে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা বেসরকারি জাহাজ কাজে লাগিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার নিয়ম করেছিল যে, শুধুমাত্র ব্রিটিশ ফ্ল্যাগের জাহাজই রিকুইজিশন করা হবে এবং ব্রিটিশ ক্রুরাই এসব জাহাজ চালাবে। ‘কুনার্ড কাউন্টেস’-কে রিকুইজিশন করা হয়েছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের পরে – ১৯৮২ সালের অক্টোবরে – ৬ মাসের জন্যে। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসেনশন দ্বীপ পর্যন্ত সৈন্যদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয় এই জাহাজে। কারণ ফকল্যন্ডের পোর্ট স্ট্যানলি বিমান বন্দরকে তখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কয়েক মাসের ব্যবধানে ব্রিটিশ সরকার ৩৩ জন মালিকের কাছ থেকে ৫৪টা জাহাজ রিকুইজিশন করেছিল। এই জাহাজগুলিকে এমন হতে হয়েছিল, যাতে করে তারা বহুদূরের সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে পারে এবং খারাপ আবহাওয়ায় সমস্যা না হয়। দক্ষিণ আটলান্টিকের খারাপ আবহাওয়ার আবার বেশ খ্যাতি রয়েছে। এই ৫৪টা জাহাজে ১ লক্ষ টন মালামাল, ৪ লক্ষ ১০ হাজার টন জ্বালানি তেল, ৯ হাজার সৈন্য এবং ৯৫টা বিমান বহন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ রয়াল নেভির জাহাজগুলিতে যা বহণ করা সম্ভব ছিল, তা ফকল্যন্ড মিশনের জন্যে যথেষ্ট ছিল না। লম্বা মিশনে খারাপ আবহাওয়ায় সৈন্য এবং রসদ পরিবহণের জন্যে যাত্রীবাহী ওশান লাইনার জাহাজগুলিকেই বেশি উপযুক্ত মনে হয়েছিল ব্রিটিশদের। ‘কুইন এলজাবেথ-২’ জাহাজটা যতক্ষণে দক্ষিন আটলান্টিকে পৌঁছেছিল, ততদিনে যুদ্ধ বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ সেনারা ইতোমধ্যেই ফকল্যান্ডে নেমেছে। ‘কুইন এলিজাবেথ-২’ ফকল্যান্ডের উপকূলে সৈন্য নামায়নি; নামিয়েছিল ফকল্যান্ডের কাছাকাছি সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে, যা কিনা সেবছরের ২৫শে এপ্রিল ব্রিটিশরা দখল করে নিয়েছিল। সেখান থেকে অন্য জাহাজে করে ফকল্যান্ডে নামানো হয় সৈন্যদের। ‘কুইন এলিজাবেথ’এর মতো আরও কিছু জাহাজ রিকুইজিশন করা হয়েছিল।


ক্রুজ লাইনার 'এসএস ক্যানবেরা'র ডেকের উপর থেকে সেনাবাহিনীর মর্টার উড়িয়ে নিচ্ছে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর সী-কিং হেলিকপ্টার। ডেকের উপরে কনটেইনারে অনেক অস্ত্র এবং রসদ বহণ করা হয়েছিল। ব্রিটিশদের নৌ, বিমান, সেনা, ম্যারিন ও বেসামরিক সকলে একত্রে কাজ করেছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়।
  

জাহাজ থেকে জাহাজে সৈন্য ট্রান্সফার

ভূমধ্যসাগর থেকে ফেরা যাত্রীবাহী জাহাজ এসএস ক্যানবেরা (৪৫ হাজার টন) ৬ই এপ্রিল ব্রিটেনে এসে পৌঁছায়। এই জাহাজের ৪০০ ক্রু ছিল এশিয়ান, যাদেরকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন একজন রয়াল নেভাল রিজার্ভের অফিসার। জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার ওঠা-নামার জন্যে হেলিডেক বসানো হয়। ৯ই এপ্রিল ৪০তম ও ৪২তম কমান্ডো, রয়াল মেরিন এবং ৩য় প্যারা ব্যাটালিয়নকে নিয়ে জাহাজটা দক্ষিণ আটলান্টিকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সেখানে ব্রিটিশ অধীনে থাকা এসেনশন দ্বীপে দুই সপ্তাহ মহড়া দেয়া হয় এবং ফকল্যান্ডে সৈন্য নামাবার জন্যে জাহাজটাকে রেডি করা হয়। ২১শে মে ফকল্যান্ডের উপকূলে গিয়ে ২ হাজার সৈন্যকে নামিয়ে দেয় জাহাজটা। এরপর জাহাজটা আড়াই হাজার মাইল দূরের সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে গিয়ে ‘কুইন এলিজাবেথ-২’ জাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়া সৈন্যদের তুলে নেয়। ক্যানবেরার সাথে ‘নরল্যান্ড’ এবং ‘আরএফএ স্ট্রমনেস’ বাকি সেনাদের পরিবহণ করে। এই সেনাদেরকে ক্যানবেরা এবং বাকি জাহাজগুলি আবারও ফকল্যান্ডে নামিয়ে দেয় ২রা জুন। ল্যান্ডিং ক্রাফট, জাহাজের নিজস্ব বোট এবং ১০০টা হেলিকপ্টার লিফটের মাধ্যমে এই সেনাদের সেখানে নামানো হয়। সৈন্য নামাবার সময় ক্যানবেরার আশেপাশের রয়াল নেভির যুদ্ধজাহাজগুলিকে আর্জেন্টাইন যুদ্ধবিমানগুলি হামলা করেছে, কিন্তু ক্যানবেরায় বোমা পড়েনি একটাও। আর্জেন্টাইনরা ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার-ফ্রিগেটগুলিকে হামলা করতেই বেশি আগ্রহী ছিল; সাপ্লাই বা ট্রুপ-ক্যারিয়ারগুলিকে নয়। ব্রিটিশরা নিশ্চিত ছিল যে, ক্যানবেরায় বোমা পড়লেও সাড়ে ৩৫ ফুট ড্রাফটের এই জাহাজ ফকল্যান্ডের উপকূলের অগভীর পানিতে ডুববে না। যুদ্ধের শেষে ১৫ই জুন ৪,০০০-এরও বেশি আর্জেন্টাইন যুদ্ধবন্দীদের পরিবহণ করে জাহাজটা। এই কাজ শেষে রয়াল মেরিন সেনাদের ১১ই জুন আবারও দেশে ফেরত নিয়ে আসে।
  

রো-রো ফেরি 'এমভি নরল্যান্ড'-এর পেছনের ভেহিকল র‍্যাম্প দেখা যাচ্ছে। এই র‍্যাম্প ব্রিটিশদের ল্যান্ডিং ক্রাফট থেকে অনেক উঁচু থাকায় জাহাজ থেকে গাড়িগুলি ল্যান্ডিং ক্রাফটে নামানো যাচ্ছিলো না। ব্রিটিশরা একসময় সব বাণিজ্যিক জাহাজ তৈরির সময় ভবিষ্যতে সামরিক ব্যবহারের কথা চিন্তা করতো। কিন্তু আদর্শিক চিন্তার ক্ষয়ের কারণে ব্রিটিশরা ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় ব্যাপক সমস্যার মুখে পড়েছিল।

সৈন্যের সাথে অস্ত্র এবং রসদ

৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ৩,৯৬১ জনের সেনাদলের ৩৫ দিনের অপারেশনের জন্যে দরকার ছিল ১,০৮৪ টন গোলাবারুদ, ১,১৪৭ টন রসদপাতি, ২০১৫টা গাড়ি এবং ১৯টা হেলিকপ্টার। এত্তসব জিনিস নেবার জন্যে তো আরও জাহাজ দরকার। ২৬ হাজার টনের ‘এমভি নরল্যান্ড’ রিকুইজিশন করা হয় ১৭ই এপ্রিল। এটা ছিল একটা রো-রো ফেরি। এতে দ্বিতীয় প্যারা ব্যাটালিয়ন এবং নেভাল এভিয়েশনের ৮০০ জন সেনাকে পরিবহণ করা হয়। জাহাজের ডিজাইন অবশ্য ব্রিটিশদের জন্যে সুবিধার ছিল না। ব্রিটিশরা তাদের লজিস্টিক ল্যান্ডিং শিপ-গুলির সাথে মেক্সিফ্লোট নামের পন্টুনের মতো কিছু ল্যান্ডিং ক্রাফট বহন করেছিল। এগুলির উপর ট্যাঙ্ক, আর্মার্ড ভেহিকল এবং অন্যান্য গাড়ি তুলে দিয়ে উপকূলে নামানো হতো। নরল্যান্ড একটা রো-রো ফেরি হলেও এই জাহাজের ভেহিকল র‍্যাম্প মেক্সিফ্লোটগুলির উচ্চতা পর্যন্ত নামতোই না। অর্থাৎ এই জাহাজে গাড়ি বহন করলে মেক্সিফ্লোটে সেই গাড়ি নামাবার কোন উপায় নেই। কিন্তু ব্রিটিশদের উপায় ছিল না, কারণ সুবিধামত জাহাজ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রতি চারটা জাহাজ ইন্সপেকশনের পর একটা মাত্র জাহাজ রিকুইজিশনের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল।
  

'আটলান্টিক কনভেয়র' জাহাজের উপরে উড়ছে ব্রিটিশ রয়াল নেভির সী-হ্যারিয়ার বিমান। এই বিমানগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল যুদ্ধে। এই জাহাজটা ১৪টা হ্যারিয়ার বিমান বহন করে মূলতঃ অক্সিলারি বিমানবাহী জাহাজের কাজ করেছিল।


বাণিজ্যিক জাহাজে যুদ্ধবিমান পরিবহণ

‘পিএন্ডও লাইন’এর সাড়ে ৫ হাজার টনের ‘এমএস এল্ক’ রো-রো ফেরি বহন করেছিল ১০০টা গাড়ি, ২ হাজার টন এমুনিশন এবং আরও কয়েক’শ টন রসদপাতি। ৮টা লাইট ট্যাঙ্কও নেয়া হয় এতে। হেলিপ্যাড বসানো হয় যাতে ৩টা সী-কিং হেলিকপ্টার বহন করা যায়। ৪,২০০ টনের ‘এমএস ইউরোপিক ফেরি’ রিকুইজিশন করা হয় ১৯শে এপ্রিল। এতে হেলিপ্যাড যুক্ত করা হয় সেনাবাহিনীর ৪টা হেলিকপ্টার বহন করার জন্যে; সৈন্য, গাড়ি এবং রসদও নেয়া হয় এতে। ১৯,০০০ টনের রো-রো ফেরি ‘এমএস বল্টিক ফেরি’ ৫ম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ১০৫ জন সৈন্যের সাথে ১,৮৭৪ টন রসদপাতি নিয়েছিল। এছাড়াও জাহাজটার উপর হেলিপ্যাড বসানো হয় এবং সেনাবাহিনীর তিনটা হেলিকপ্টার বহন করা হয় এতে। এই জাহাজের সিস্টার শিপ ‘এমএস নরডিক ফেরি’কেও রিকুইজিশন করা হয়। ‘কুনার্ড’এর ১৫ হাজার টনের কনটেইনার জাহাজ ‘এসএস আটলান্টিক কনভেয়র’ এবং ‘এসএস আটলান্টিক কজওয়ে’-কে রিকুইজিশন করা হয় ১৪ই এপ্রিল। জাহাজদু’টিতে বেশকিছু পরিবর্তন করে বিমান পরিবহণের জন্যে উপযুক্ত ক্রয়া হয়েছিল। বিমান ছাড়াও অনেক জ্বালানি এবং গোলাবারুদ নেয় জাহাজদু’টি। ‘আটলান্টিক কনভেয়র’ বহণ করছিল নৌবাহিনীর ৬টা ওয়েসেক্স হেলিকপ্টার এবং রয়াল এয়ার ফোর্সের ৫টা চিনুক হেলিকপ্টার। এসেনশন দ্বীপে এসে জাহাজটা নৌবাহিনীর ৮টা এবং বিমান বাহিনীর ৬টা হ্যারিয়ার বিমান নেয়। ফকল্যান্ডের কাছাকাছি এসে হ্যারিয়ার বিমানগুলিকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর একটা চিনুক হেলিকপ্টার ইতোমধ্যেই এসেনশন দ্বীপে নেমে গিয়েছিল। ২৫শে মে আর্জেন্টাইন নৌবাহিনীর সুপার এটেনডার্ড বিমানের ছোঁড়া এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে জাহাজটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আগুনে ৬টা ওয়েসেক্স, ৩টা চিনুক এবং একটা লিঙ্কস (অন্য জাহাজ থেকে আসা) হেলিকপ্টার পুরো অঙ্গার হয়। অপরদিকে আটলান্টিক কনভেয়রের সিস্টার শিপ আটলান্টিক কজওয়ে ১৪ই মে রওয়ানা দিয়ে নৌবাহিনীর ৮টা সী-কিং এবং ২০টা ওয়েসেক্স হেলিকপ্টার বহন করে ২৭শে মে ফকল্যান্ডের কাছাকাছি পৌঁছায়। যুদ্ধের মাঝে এই জাহাজের উপরে ৪,০০০ বার হেলিকপ্টার অবতরণ করে এবং ৫০০ বিমানে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও মিসাইল হামলার শিকার রয়াল ফ্লিট অক্সিলারির লজিস্টিক ল্যান্ডিং শিপ ‘স্যার গালাহ্যাড’ এবং ‘স্যার ট্রিসট্রাম’-এর ১৭০ জন ক্রুকে এই জাহাজ আশ্রয় দেয়। সাড়ে ১১ হাজার টনের কন্টেইনার জাহাজ ‘এমভি কন্টেন্ডার বেজান্ট’ ৯টা ওয়াস্প, ৩টা চিনুক হেলিকপ্টার এবং ৪টা হ্যারিয়ার বিমান নিয়ে যখন ফকল্যান্ড পৌঁছায়, তখন যুদ্ধ শেষ। এই জাহাজটা রয়াল নেভি পরবর্তীতে রেখে দেয় ‘আরএফএ আরগাস’ নামে। ২৮ হাজার টনের কনটেইনার জাহাজ ‘এমভি এস্ট্রোনমার’-এ বেশকিছু পরিবর্তন করা হয় ১৩টা হেলিকপ্টার বহণ করার জন্যে। এই জাহাজটাও যুদ্ধ শেষে পৌঁছায়, এবং এটাকেও রয়াল নেভি সার্ভিসে নিয়ে নেয় ‘আরএফএ রিলায়ান্ট’ নামে। এই জাহাজটাই ১৯৮৪ সালে বৈরুত থেকে ৫,০০০ ব্রিটিশ নাগরিক এবং সৈন্যকে উদ্ধার করে।
 





অয়েল রিগ সাপোর্ট শিপ 'স্টেনা ইন্সপেক্টর'কে রয়াল নেভি ফকল্যান্ড নিয়ে গিয়েছিল রিপেয়ার শিপ হিসেবে। জাহাজটার এতটাই কাজে লেগেছিল যে, ব্রিটিশরা পরবর্তীতে জাহাজটাকে সার্ভিসে নিয়ে নেয় 'আরএফএ ডিলিজেন্স' নামে।

সব জাহাজই কাজে লাগে

ব্রিটিশরা ৩টা যাত্রীবাহী লাইনার, ৮টা রো-রো ফেরি, ৫টা কনটেইনার জাহাজ, ৭টা কার্গো জাহাজ, ১৫টা ট্যাংকার এবং আরও ৮টা সাপোর্ট জাহাজ রিকুইজিশন ও চার্টার করেছিল। এই ৪৬টা বাণিজ্যিক জাহাজের মাঝে অনেকগুলিতেই হেলিপ্যাড বসানো হয়েছিল – সবগুলি যাত্রীবাহী লাইনার, রো-রো ফেরি, কনটেইনার জাহাজ; ৭টা কার্গো জাহাজের মাঝে ৩টা, এবং ৮টা সাপোর্ট শিপের মাঝে ৩টা। ১৫টা বাণিজ্যিক ট্যাঙ্কারের মাঝে ২টাকে সমুদ্রে রিফুয়েলিং-এর জন্যে যন্ত্র বসানো হয়েছিল। আবার অনান্য সকল জাহাজকেও মাঝ সমুদ্রে জ্বালানি গ্রহণ করতে পারার জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছিল। অনেক জাহাজে যাত্রাপথেও মডিফিকেশনের কাজ চলছিল। অন্যদিকে রয়াল নেভির অধীনে মোট ৬৮টা জাহাজ ফকল্যান্ড মিশনে গিয়েছিল - ২টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ২টা ডক ল্যান্ডিং শিপ, ৮টা ডেস্ট্রয়ার, ১৫টা ফ্রিগেট, ৩টা প্যাট্রোল ভেসেল, ৬টা সাবমেরিন, ৩টা সার্ভে জাহাজ (ব্যবহৃত হয়েছিল হসপিটাল জাহাজ হিসেবে), ৫টা ফিশিং ট্রলার (ব্যবহৃত হয়েছিল মাইনসুইপার হিসেবে), ১০টা রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার, ৬টা লজিস্টিক ল্যান্ডিং শিপ, ৫টা সাপ্লাই শিপ, ১টা হেলিকপ্টার সাপোর্ট শিপ, ২টা ওশান টাগবোট। ২টা ডেস্ট্রয়ার, ২টা ফ্রিগেট, ১টা লজিস্টিক ল্যান্ডিং জাহাজ, ১টা কনটেইনার জাহাজ, ১টা ইউটিলিটি ল্যান্ডিং ক্রাফট, ২৪টা হেলিকপ্টার ও ১০টা ফাইটার বিমান হারায় ব্রিটিশরা। প্রতিটা জাহাজই সেখানে কাজে লেগেছিল। ডুবে যাওয়া বা আঘাতপ্রাপ্ত জাহাজকে আশেপাশের জাহাজগুলি সহায়তা দিয়েছে; আগুন নিভাতে সহায়তা দিয়েছে; তাদের ক্রুদের পানি থেকে তুলে নিয়েছে। এছাড়াও জাহাজগুলি হেলিকপ্টারগুলিকে রিফুয়েলিং করেছে; ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ ও বিমানগুলিকে রিপেয়ার করতে সহায়তা দিয়েছে; খাবার-দাবার ও রসদ সরবরাহ করেছে; মেডিক্যাল সাপোর্ট দিয়েছে; সৈন্যদের রেস্টহাউজ হিসেবে কাজ করেছে; কুরিয়ার বা ডেসপ্যাচ ভেসেল হিসেবেও কাজ করেছে।

ফকল্যান্ড যুদ্ধ থেকে এই আলোচনা সাপেক্ষে কিছু শিক্ষনীয় রয়েছে।

- ব্রিটিশ নৌবহরের দুর্বলতা - বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তিশালী নৌবহর ব্রিটেন ততদিনে হারিয়েছে। ব্রিটিশ রয়াল নেভির জাহাজগুলিতে যতো সৈন্য পরিবহণ করা সম্ভব ছিল, তা দিয়ে ফফল্যান্ডস-এর মতো ছোট দ্বীপও পূনর্দখল করা ছিল কঠিন। তাই বেসামরিক বাণিজ্যিক জাহাজের উপরেই নির্ভর করছে হয়েছিল ব্রিটেনকে।

- ব্রিটিশদের আদর্শিক চিন্তার দুর্বলতা - ব্রিটিশদের আদর্শিক চিন্তার দুর্বলতা আরও বহু আগে থেকেই প্রকাশ পেয়েছিল। ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় সেটা আরও কঠিনভাবে সামনে আসলো। ব্রিটিশ এডমিরালটি সকল জাহাজের ডিজাইন নিয়ন্ত্রণ করতো। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটেন শত-শত বাণিজ্যিক জাহাজকে রিকুইজিশন করে নৌবাহিনীতে নিয়েছিল। সেটা তারা পেরেছিল, কারণ প্রতিটা জাহাজের ডিজাইন করা হতো ভবিষ্যতের যেকোন সামরিক দরকারের কথা চিন্তা করে। কিন্তু ১৯৮২ সালে ব্রিটেন বেসামরিক জাহাজ রিকুইজিশন করতে গিয়ে দেখলো যে, বেশিরভাগ জাহাজই সামরিক ব্যবহারের অনুপযোগী। যেগুলিকে সামরিক কাজের জন্যে নির্বাচিত করা হয়েছিল, সেগুলিরও ছিল ব্যাপক সমস্যা। ফকল্যান্ডে বাণিজ্যিক পরিবহণ জাহাজ থেকে সৈন্য নামাতে গিয়ে তাদের এই সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতে হিমসিম খেতে হয়েছিল।
 
রয়াল নেভির সার্ভে শিপ 'এইচএমএস হেরাল্ড' ও এর ২টা সিস্টার শিপ ফকল্যান্ড গিয়েছিল হসপিটাল শিপ হিসেবে। যুদ্ধে যেকোন জাহাজই কাজে লাগানো সম্ভব - এটার ভালো উদাহরণ এটি।


- যুদ্ধের সময়ে যেকোন জাহাজই কাজে লাগে। কিছু জাহাজ ফকল্যান্ডের আশেপাশে প্যাট্রোল এবং ইন্টেলিজেন্স যোগাড়ের জন্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। ৪টা সার্ভে জাহাজকে মডিফাই করে হসপিটাল শিপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। অয়েল প্ল্যাটফর্মের সাপোর্ট জাহাজগুলি অত্যন্ত ভালো ফ্লোটিং ওয়ার্কশপ বা রিপেয়ার শিপ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। ৫টা বাণিজ্যিক ফিশিং ট্রলারকে রিকুইজিশন করে সোনার বসিয়ে নেয়া হয়েছিল মাইনসুইপিং-এর কাজে।

- বেসামরিক জাহাজ যে সহজেই সামরিক কাজে লাগানো সম্ভব, তা আবারও প্রমাণ হলো ফকল্যান্ডের যুদ্ধের সময়। যাত্রীবাহী লাইনারগুলিকে সহজেই ট্রুপ ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা গেছে। কনটেইনার জাহাজগুলিকে কিছুটা পরিবর্তন করে বিমান পরিবহণ করানো হয়েছে। এমনকি কোন ধরনের মডিফিকেশন ছাড়াও একটা জাহাজ সামরিক কাজে ব্যবহার হতে পারে। যেমন – ফকল্যান্ডের কাছাকাছি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজগুলিকে জ্বালানি ও রসদ সরবরাহ করা; আক্রান্ত বা ডুবন্ত যুদ্ধজাহাজকে অগ্নি নির্বাপণে সহায়তা দেয়া ও সেসব জাহাজের ক্রুদের আশ্রয় দেয়া, ইত্যাদি।

- হেলিকপ্টার অপারেশনের গুরুত্ব - বিমান/হেলিকপ্টার নৌ-অপারেশনের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হলো আবারও। বাণিজ্যিক প্রায় সকল জাহাজকেই মডিফাই করা হয়েছিল ফকল্যান্ডের জন্যে। প্রধান মডিফিকেশন ছিল হেলিপ্যাড বসানো। জাহাজে বহণ করা সৈন্য এবং রসদ জাহাজ থেকে ওঠা-নামানো জন্যে হেলিকপ্টার ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ বাহন। আর ফকল্যান্ডের উপকূলে হেলিকপ্টার অপারেশনের সময় এই জাহাজগুলি ক্রমাগত হেলিকপ্টারগুলিকে জ্বালানি সরবরাহ করেছিল এবং দরকারে মেইনটেন্যান্স/রিপেয়ারের ব্যবস্থা করেছিল।
 


কনটেইনার জাহাজ 'এমভি কন্টেন্ডার বেজান্ট' ১২টা হেলিকপ্টার ও ৪টা হ্যারিয়ার বিমান নিয়ে ফকল্যান্ডে গিয়েছিল। এই জাহাজটা পরবর্তীতে রয়াল নেভি সার্ভিসে নিয়ে নেয় এভিয়েশন সাপোর্ট শিপ হিসেবে, যা এখন 'আরএফএ আরগাস' নামে চলছে।


- অক্সিলারি বিমানবাহী জাহাজ - বাণিজ্যিক কনটেইনার জাহাজগুলিতে বহণ করা হ্যারিয়ার বিমানগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই জাহাজগুলি অক্সিলারি বিমানবাহী জাহাজের কাজ করেছিল। এই বিমানগুলি জাহাজের হেলিপ্যাড থেকে উড়ে গিয়ে বিমানবাহী জাহাজগুলিতে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধে হারানো হ্যারিয়ারগুলির প্রতিস্থাপক ছিল এগুলি। বিমানবাহী জাহাজ ‘হার্মিস’ সর্বোচ্চ বহন করেছিল রয়াল নেভির ১৬টা সী-হ্যারিয়ার, বিমান বাহিনীর ১০টা হ্যারিয়ার জিআর-৩, আর ১০টা সী-কিং হেলিকপ্টার। ‘ইনভিনসিবল’ বহন করেছিল ১২টা সী-হ্যারিয়ার এবং ১০টা সী-কিং হেলিকপ্টার। ডুবে যাওয়া কনটেইনার জাহাজ ‘আটলান্টিক কনভেয়র’ নিয়ে এসেছিল নৌবাহিনীর ৮টা, আর বিমান বাহিনীর ৬টা হ্যারিয়ার। ডুবে যাবার আগেই বিমানগুলি বিমানবাহী জাহাজে ট্রান্সফার করা হয়েছিল। আর্জেন্টিনার ১২০-এর উপর ফাইটার বিমানের বিরুদ্ধে এগুলিই ছিল ব্রিটিশদের ভরসা। হ্যারিয়ারগুলি ২১টা আর্জেন্টাইন বিমান ভূপাতিত করেছিল।

আরও পড়ুনঃ
আর্জেন্টিনা কি পারবে?

Wednesday 8 August 2018

লাক্সারি ইয়ট, নাকি প্রাইভেট নৌবাহিনী?

০৮ অগাস্ট ২০১৮

সমাজের কিছু লোকের হাতে অত্যধিক পরিমাণ সম্পদ চলে যাবার ফলে লাক্সারি ইয়টের মতো জাহাজের আবির্ভাব হয়েছে। এখন এর সাথে যুক্ত হচ্ছে ইয়ট সাপোর্ট ভেসেল। হল্যান্ডের ডামেন শিপইয়ার্ডের তৈরি এমনই এক জাহাজ ৬৭ মিটার লম্বা 'গারচন' (ছবিতে সামনের জাহাজ), যা পিছনের সুপারইয়টকে সহায়তা দেয়াই এর কাজ।  



সম্পদের অসম বন্টনের নেপথ্যে... 

সমাজের কিছু মানুষের হাতে এখন বিপুল পরিমাণ সম্পদ। পুঁজিবাদ সমাজের কিছু লোকের হাতে সকল সম্পদ তুলে দিয়ে বিশ্বব্যাপী চরম দারিদ্র্যের জন্ম দিয়েছে। এই সম্পদশালী লোকগুলি এখন তাদের সম্পদ দিয়ে কি করবে, তা বুঝে উঠতে হিমসিম খাচ্ছে। একটা মানুষ কতোই বা খেতে পারে; কয়টা জামা বা জুতা কিনতে পারে? হ্যাঁ, অনেকগুলি বাড়ির মালিক সে হতে পারে। একসময় সে চাইবে তার বাড়িটিকে আরও বিলাসিতায় ভরে ফেলতে। কিন্তু সেই বিলাসিতার তো কোন শেষ নেই। পাঁচ-তারকা স্ট্যান্ডার্ডের উপরে কোন কিছু থাকলে সেটাও তার দরকার। গাড়ি তো এখন অনেকেরই আছে; তার দরকার সবচাইতে দামি গাড়িটা। সেটাও একসময় তার ইচ্ছাকে খুশি করতে পারবে না। কেউ কেউ প্রাইভেট বিমান কিনেছে। হ্যাঁ, যাতায়াতের সুবিধার জন্যে তো অবশ্যই। তবে এখানে নিজের স্ট্যাটাসটাও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অনেকের কাছেই। নিজের বিজনেস জেটে করে ভ্রমণের সময়ে অতিথিদের মনে দাগ কাটার সকল চেষ্টাই তার থাকে। মান-ইজ্জত বলে তো কথা!

আরও কিছু লোক যাচ্ছে সমুদ্রের মাঝে; জাহাজ কিনছে সে। পাঁচ-তারকা হোটেলকে এবার সে নিয়ে গেছে সমুদ্রের মাঝে। সেই জাহাজে অতিথিদের আপ্যায়ন করে সন্মান কুড়াবার চেষ্টা তার। জাহাজগুলির মাঝেও সবচাইতে ভালো এবং সবচাইতে বড়টা তার চাই; সবচাইতে বেশি বিলাসবহুল। বিলাসিতার আবার শেষ নেই। জাহাজের উপরে হেলিকপ্টার তো স্বাভাবিক ব্যাপার। স্পীডবোটে রাইড; সেইলিং বোট চালনা; মাছ ধরা; জেট-স্কি চালনা; প্যারা গ্লাইডিং; স্কুবা ডাইভিং। এর সাথে যোগ হয়েছে সাবমেরিন! পানির নিচের জগত নিজ চোখে দেখার জন্যে এই সাবমেরিন। কিছু জাহাজে ল্যান্ডিং ক্রাফট বা হভারক্রাফটও থাকছে, যাতে করে গাড়ি বা মোটর সাইকেল নিয়ে জাহাজ থেকে স্থলে অবতরণ করা যায়। কিছু জাহাজে ছোটখাটো ফ্লাইং বোট বহণ করা হচ্ছে। এতসব যানবাহন এবং যন্ত্রপাতির জন্যে যে টেকনিক্যাল জ্ঞান এবং রক্ষণাবেক্ষণ দরকার, তার জন্যে তার জাহাজে স্পেশালিস্ট লোকজন বহণ করতে হচ্ছে। এতকিছু এক জাহাজে ঢোকানো অনেক সময় বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। বোট, সাবমেরিন, হেলিকপ্টার – এগুলির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্যে যে জাহাজ সে কিনেছে, সেই জাহাজে যদি সারাদিন যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ঠুকঠাক খুটখাট শব্দ হতে থাকে, তাহলে সেটাকে বরং ওয়ার্কশপ বলাই ভালো। তদুপরি, এতোসব যন্ত্রপাতি দিয়ে ডেকের উপরটা ভরে ফেললে ডেকের উপরে আরাম করে বসার স্থানটাও তো কমে যাচ্ছে। কেউবা আবার নিজের অফিসটাকেও সাথে নিতে চাচ্ছেন; অফিসের স্টাফসহ। অর্থাৎ তার পুরো জীবনটাকেই জাহাজে চড়িয়ে সে তার সাথে নিতে চাচ্ছে। একের ভিতরে সব চাইতে গেলে অনেক প্রশ্নের উত্তর তাকে দিয়ে আসতে হবে।
  
 
মাইক্রোসফটের কো-ফাউন্ডার পল এলেনের ১২৬ মিটার লম্বা ১০ হাজার টনের এক্সপ্লোরার ইয়ট 'অক্টোপাস'। জাহাজটায় রয়েছে দুইটা হেলিডেক। পিছনের হেলিডেকের সাথে রয়েছে বিরাট এক হ্যাঙ্গার, যার ভেতরে দুইটা হেলিকপ্টার রাখা যায়। হেলিডেকের নিচে রয়েছে ডক, যার ভেতরে কয়েকটা স্পীডবোট এবং ল্যান্ডিং ক্রাফট রাখা যায়। এডভেঞ্চারার গোছের মানুষদের প্রবৃত্তিকে খুশি করতে এধনের ইয়টে কি রাখা হয়নি? 


কিছু লোক তাদের প্রবৃত্তিকে খুশি করতে অজানাকে খুঁজে বেড়াতে চায়। যেমন - এন্টার্কটিকা ভ্রমণ, পানির নিচে প্রাচীনকালে ডুবে যাওয়া জাহাজ খুঁজে বের করা, দুর্গম অঞ্চলের জীবজন্তু দেখতে যাওয়া, গুপ্তধনের সন্ধান করা, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া, ইত্যাদি। এই ভ্রমণগুলি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে সূর্যস্নানের মতো নয়। যারা এগুলি পছন্দ করে, তাদেরকে এডভেঞ্চারিস্ট বলছে অনেকে। এসব কর্মকান্ডে প্রযুক্তির আধিক্য বেশি এবং যন্ত্রপাতি যথেষ্টই লাগছে সেখানে। কাজেই তাদের জাহাজগুলিতে বহু পদের যন্ত্রপাতি রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ঠুকঠাক-খুটখাট শব্দও সয়ে নিচ্ছে সে। তবে যথেষ্টই বিলাশবহুল এগুলি। এধরনের জাহাজগুলিকে ‘এক্সপ্লোরার ইয়ট’ বলা হচ্ছে। তবে যেসব জাহাজে এতসব যন্ত্রপাতি রাখা হচ্ছে না, তাদেরও কিন্তু ইচ্ছের কমতি নেই। তারাও যন্ত্রপাতি চাইছেন তাদের প্রবৃত্তিকে খুশি করতে; তবে খুটখাট শব্দও চাইছেন না। মার্কেটাররাও কম যায় না। তারা এধরনের ক্রেতাদের খুশি করতে আরেক ধরনের জাহাজ তৈরি করার চিন্তা করলো; এর নাম দেয়া হলো ‘ইয়ট সাপোর্ট ভেসেল’। এর কাজ হলো মূল ইয়ট (মাদার ইয়ট)-এর সাথে সাথে যাওয়া এবং যন্ত্রপাতি বহণ, দরকারে অতিরিক্তি ক্রু বা অতিথিদের নেয়া, অফিস স্টাফদের নেয়া, যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ করা, জ্বালানি, অন্যান্য সাপ্লাই ও স্পেয়ার পার্টস বহণ করা, মূল ইয়টের দরকারের জিনিসগুলি বহণ করা, এবং আরও অনান্য লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট দেয়া। তবে এধরনের জাহাজের সবচাইতে বড় কাজ হলো মূল ইয়টের নিরাপত্তা দেয়া।

ডাচ শিপবিল্ডার ডামেনের তৈরি করা ইয়ট সাপোর্ট ভেসেল 'গেম চেঞ্জার'। ৬৯ মিটার লম্বা এই জাহাজের এর হেলিডেকের নিচে রয়েছে হ্যাঙ্গার। আর এর ডেকের উপরে রয়েছে কয়েক ধরনের স্পীডবোট এবং একটা সাবমেরিন। জাহাজের পিছন দিকে রয়েছে ডাইভিং সাপোর্ট রুম, যার সাথে ১২ জন স্কুবা ডাইভারের সরঞ্জামাদি রয়েছে; সাথে রয়েছে ডিকম্প্রেশন চেম্বার। এধরনের জাহাজগুলি কিছু মানুষের হাতে প্রাইভেট নৌবাহিনী দিয়ে দিচ্ছে। 


লাক্সারি ইয়টের নিরাপত্তা

যারা এসব ইয়টের মার্কেটিং করছে, তাদের চিন্তার মাঝে এই নিরাপত্তা ব্যাপারটাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। এতো বিত্তশালী এই ব্যাক্তির বিত্তের সাথে সাথে নিজের নিরাপত্তার শঙ্কাও বেড়েছে। তাই বিরাট একটা বিশালবহুল ইয়টকে সমুদ্রে নিয়ে গেলে সেই জাহাজের নিরাপত্তার কথা তাকে আলাদাভাবে চিন্তা করতে হচ্ছে। বিশেষতঃ সমুদ্রে জলদস্যু দ্বারা আক্রান্ত হলে তিনি কি করবেন? নিরাপত্তাও এখন কেনাবেচার বিষয়। বিশ্বের বহু প্রান্তে অবসরপ্রাপ্ত সেনারা এখন ভাড়াটে সেনা হিসেবে খাটছেন। এরা এই ‘ইয়ট সাপোর্ট ভেসেল’এ স্থান নিচ্ছেন মূল লাক্সারি ইয়ট বা মাদার ইয়টের নিরাপত্তা দিতে। তারা স্পীডবোট, হেলিকপ্টার, সাবমেরিন, ল্যান্ডিং ক্রাফট, হোভারক্রাফট, ফ্লাইং বোট, ইত্যাদি চালাচ্ছেন এবং সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। জাহাজগুলির ক্রু-ই শুধু নয়, জাহাজের ডিজাইন এবং কন্সট্রাকশনও মিলিটারি গ্রেডের। এসব জাহাজে কি কি দেয়া হচ্ছে, তার একটা ফিরিস্তি দিলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

- কিছু জাহাজে শুধু হেলিকপ্টার ল্যান্ডিং প্যাডই নয়; হেলিকপ্টার রাখার জন্যে হ্যাঙ্গারও দেয়া হচ্ছে। সেখানে হেলিকপ্টার মেইনটেন্যান্স-এর সুবিধাও থাকছে। আগুস্টা এডব্লিউ-১০৯ বা ইউরোকপ্টার ইসি-১৩৫ হেলিকপ্টার এসব জাহাজে দেখা যাচ্ছে নিয়মিত। বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনীও এধরনের হেলিকপ্টার ব্যবহার করে থাকে।

- ছোটবড় বিভিন্ন প্রকারের ৪-৫টা স্পীডবোট এসব জাহাজে থাকছেই। স্পীডবোটগুলির মাঝে মিলিটারি গ্রেডের ইন্টারসেপ্টর বোটও থাকছে, যা কিনা স্পেশাল ফোর্সের সেনারা ব্যবহার করে।

- সাবমেরিন থাকছে অনেক ক্ষেত্রেই। কখনো কখনো মনুষ্যবিহীন সাবমেরিনও থাকছে, যা কিনা অতি-গভীর সমুদ্র থেকে ভিডিও পাঠাতে পারে।

- স্কুভা ডাইভার অপারেশনের জন্যে সকল ব্যবস্থা দেয়া হচ্ছে। ডজনখানেক স্কুবা অপারেট করতে পারার মতো যন্ত্রপাতি দিচ্ছে কেউ কেউ। ডিকম্প্রেশন চেম্বারও দেয়া হচ্ছে ডাইভারদের জন্যে। স্কুবা ডাইভারদের অভিজ্ঞতা শেয়ারের জন্যে বড়সড় রুম দেয়া হচ্ছে ডিজিটাল ডিসপ্লে-সহ, যাতে পানির নিচে ধারণ করা ভিডিও শেয়ার করতে পারে সবাই।

- কিছু ক্ষেত্রে ছোট ফ্লাইং বোট রাখা হচ্ছে এই ইয়ট সাপোর্ট ভেসেলে। এর ডানাগুলি গুটিয়ে ডেকের উপরে স্বল্প জায়গায় রেখে দেয়া যায়।

- গাড়ি বা মোটরসাইকেল রাখা হচ্ছে কিছু জাহাজে। দরকার বিশেষে ল্যান্ডিং ক্রাফট বা হোভারক্রাফটের মাধ্যমে এই যানবাহন উপকূলে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। ক্রাফটগুলি বেশিরভাগ সময়েই জাহাজের ডেকের উপরে বহণ করা হচ্ছে।

- স্পীডবোট, সাবমেরিন, ল্যান্ডিং ক্রাফট, হোভারক্রাফট, ফ্লাইং বোট, ইত্যাদি ডেকের উপর থেকে পানিতে নামাবার জন্যে শক্তিশালী ক্রেন রাখা হচ্ছে ডেকে।

- কিছু জাহাজের পিছন দিকে ডক থাকছে, যেখানে পাম্পের মাধ্যমে পানি পাম্প করে ডুকিয়ে দেয়া যায় আবার বেরও করে দেয়া যায়। বোটগুলি পানিতে নামাতে হলে বা পানি থেকে তোলার দরকার হলে পাম্প করে পানি ঢোকানো হয়। তবে এধরনের ডক থাকে মূলতঃ বড় এক্সপ্লোরার ইয়টগুলিতে।

- জাহাজের ডিজাইন মিলিটারি গ্রেডের। এগুলির গতি ঘন্টায় ২০ নটিক্যাল মাইল থেকে ২৮ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত থাকছে। সবধরনের আবহাওয়ায় এগুলি চলমান রাখা সম্ভব হচ্ছে।

- জাহাজগুলির ইলেকট্রনিক্স এবং কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি একেবারেই অত্যাধুনিক এবং মিলিটারি গ্রেডের। জাহাজগুলির ব্রিজ যেকোন মিলিটারি জাহাজের ব্রিজের মতোই মনে হবে।

- ৪ হাজার থেকে ৯ হাজার নটিক্যাল মাইল এসব জাহাজের পাল্লা, যা কিনা একে লম্বা সময় সমুদ্রে থাকার পথ খুলে দিয়েছে।

হল্যান্ডের শিপবিল্ডিং কোম্পানি ডামেন সাম্প্রতিককালে মিলিটারি জাহাজ তৈরি করে বেশ নাম করেছে। তাদের কয়েকটা ডিজাইন বহু দেশের কাছে বিক্রি হয়েছে। তাদের প্যাট্রোল বোটগুলি বিভিন্ন কোম্পানির কাছেও বিক্রি হয়েছে, যারা সামুদ্রিক বিভিন্ন স্ট্রাকচারের নিরাপত্তা দিতে সেগুলিকে ব্যবহার করে। সেসব জাহাজের ডিজাইন পরিবর্তন করেই ইয়ট সাপোর্ট ভেসেলের ডিজাইন করা হয়েছে। অর্থাৎ মিলিটারি জাহাজকেই তারা ‘সুগার-কোট’ করে বিক্রি করছে। ডজনখানেক ইয়ট সাপোর্ট ভেসেল ইতোমধ্যেই বিক্রি করেছে ডামেন। অন্যরাও বানাচ্ছে। জাহাজগুলিতে কোন সমস্যা ছাড়াই একটা শক্তিশালী স্পেশাল ফোর্স ইউনিট বহণ করা সম্ভব; তাদের হেলিকপ্টার, স্পীডবোট, ডাইভিং গিয়ার, ইত্যাদিও সাথে রাখা যাবে। খুব বেশি একটা মডিফিকেশন ছাড়াই এতে বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্র বহণ করা সম্ভব। ড্রোনও অপারেট করা সম্ভব; যার জন্যে যথেষ্ট স্থান এসব জাহাজের বেশ কয়েকটাতেই রয়েছে।

সুপার ইয়ট 'গোল্ডেন শ্যাডো'। এর পেছনে দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা স্পীডবোট এবং একটা সী-প্লেন। পরিবর্তিত বিশ্বের পরিবর্তিত নিয়মে ইয়ট-মালিকদের হাতে থাকা সম্পদ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার হবার মতো। তাই পুঁজিবাদের এই ক্ষয়িষ্ণু সময়ে পরিবর্তনের হাইওয়েতে এদের রাজনৈতিক সচেতনতা হয়ে দাঁড়াবে বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যে উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।


পরিবর্তিত বিশ্বে ইয়টের মালিকদের স্থান 

ধনকুবের ব্যক্তিরা তাদের প্রবৃত্তিকে খুশি করতে গিয়ে যুদ্ধাস্ত্র নির্মাতাদের জন্যে নতুন বাজারের সৃষ্টি করেছে। নিজের একটা প্রাইভেট আর্মি, প্রাইভেট নেভি এবং প্রাইভেট এয়ার ফোর্স তারা চাইতেই পারে। তবে দরকারবিশেষে তাদের এই মিলিটারি প্ল্যাটফর্মগুলি কোথায় কি করবে, সেটাই হবে মূল পরীক্ষা। মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরের উপদেষ্টা পরিষদ ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল-এর এক প্রতিবেদনে (Global Trends 2025: A Transformed World) ২০২৫ সালের মাঝে কি কি দেখা যেতে পারে, তার একটা ভবিষ্যদ্বানী করার চেষ্টা করা হয়েছে –

“A global multipolar system is emerging with the rise of China, India, and others.

The relative power of nonstate actors— businesses, tribes, religious organizations, and even criminal networks—also will increase. ... By 2025 a single “international community” composed of nation-states will no longer exist. Power will be more dispersed with the newer players bringing new rules of the game while risks will increase that the traditional Western alliances will weaken…. The United States will remain the single most powerful country but will be less dominant…. Shrinking economic and military capabilities may force the US into a difficult set of tradeoffs between domestic versus foreign policy priorities.”



মার্কিন চিন্তাবিদেরা যে ব্যাপারটাকে তুলে ধরেছে তা হলো, বিশ্বের একচ্ছত্র ক্ষমতা সুপারপাওয়ার আমেরিকার হাত থেকে ছুটে গিয়ে অনেকের মাঝে ভাগ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য শক্তিরও আবির্ভাব হতে পারে। বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংস্থার হাতে প্রচুর সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়ায় এরা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে অর্থ ছাড়াও কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ পুঞ্জীভূত হবে। নিজেদের প্রাইভেট বাহিনী এবং এদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র এসকল সম্পদের মাঝে থাকবে। নিজেদের প্রবৃত্তিকে খুশি করতে গিয়ে এরা বৈশ্বিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হতে পারে। পরিবর্তিত বিশ্বের পরিবর্তিত নিয়মে এদের হাতে থাকা সম্পদ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার হবার মতো। তাই পুঁজিবাদের এই ক্ষয়িষ্ণু সময়ে পরিবর্তনের হাইওয়েতে এদের রাজনৈতিক সচেতনতা হয়ে দাঁড়াবে বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্যে উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।




Tuesday 31 July 2018

একটা বিমান বাহিনী কিভাবে তৈরি হয়?

হিটলার ইয়ুথ-এর ছেলেরা বিমানের মডেল বহন করছে। জার্মানিতে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে পাইলট ট্রেনিং-এর এক বিরাট প্রকল্প নেয়া হয়, যার নেতৃত্ব দেয় হিটলার ইয়ুথ-এর ফ্লাইং ডিভিশন। এদের ট্রেনিং-এর কারণে পরবর্তীতে খুব তাড়াতাড়ি জার্মান বিমান বাহিনীর ভিত গড়ে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। 
০১ অগাস্ট ২০১৮




একটা বিমান বাহিনী তৈরি হয় তিনটা জিনিসের যোগসূত্রে – ম্যান, মেশিন এবং ডকট্রাইন। রাষ্ট্রের বিমান বাহিনী এই তিনের সমন্বয় ঘটাবে সেই রাষ্ট্রের চিন্তার উপরে ভিত্তি করে। এই পুরো ব্যাপারটার সবচাইতে ভালো উদাহরণ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কয়েকটা বিমান বাহিনীর ভিত কি করে গঠন করা হয়েছিল, তা আলোচনায় আনা যেতে পারে।

পাইলট ট্রেনিং-এর ভিত গড়ে দেয়া হয় যেভাবে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অনেক আগ থেকেই জার্মানরা অল্প বয়সের ছেলেদের (১৪ বছর থেকে শুরু) মাঝে আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতা দিতে থাকে। ১৯৩৩ সালে এডলফ হিটলার ক্ষমতায় আসীন হবার পর নাজি পার্টির ‘হিটলার ইয়ুথ’ উইং-কে আরও শক্তিশালী করা হয়। হিটলার ইয়ুথের একটা ফ্লাইং ডিভিশন তৈরি করা হয়, যারা অল্প বয়সের ছেলের রিক্রুট করে গ্লাইডার ডিজাইন ও তৈরি করা এবং গ্লাইডারের মাধ্যমে ফ্লাইং ট্রেনিং দিতো (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানির কোন বিমান বাহিনী রাখা নিষেধ ছিল, কিন্তু গ্লাইডারের ব্যাপারে কোন নিষেধ ছিল না) এবং বেসিক এরোনটিক্যাল ট্রেনিং-ও দিতো। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সারা জার্মানি জুড়ে বহু গ্লাইডার ক্লাব গড়ে ওঠে। ১৯৩২ সালে নাজি পার্টিরও একটা ফ্লাইং কোর (ন্যাশনাল সোশালিস্ট ফ্লাইং কোর বা এনএসএফকে) তৈরি করা হয়। ১৯৩৫ সালে হিটলার অফিশিয়ালি ভার্সাই চুক্তির অবমাননা করে জার্মান বিমান বাহিনী বা লুফতওয়াফে-এর গোড়াপত্তনের ঘোষণা দেবার সময় জার্মানদের কাছে ইতোমধ্যেই অনেক যুবকের একটা পুল রেডি হয়ে ছিল, যাদের বেশ সহজেই ট্রেনিং-এ নিয়ে নেয়া যেতো। পাইলট ট্রেনিং-এর সময় কমে গিয়েছিল তাদের।এনএসএফকেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক ধরনের ইভেন্টের আয়োজন করে অল্প বয়সের ছেলের মাঝেফ্লাইং-এর একটা সংস্কৃতি তৈরি করার উদ্দেশ্যে, যেমন – বিমানের মডেলের ফ্লাইট প্রতিযোগিতা (যাদের বয়স একটু কম ছিল), গ্লাইডার ফ্লাইটের প্রতিযোগিতা (যাদের বয়স একটু বেশি ছিল), ইত্যাদি। ‘ফ্লাইং ডে’ নামের কিছু ইভেন্টও চলতো। ১৯৩৬ সালের এরকম এক ইভেন্টে ১,৫৫০ জন ছেলে অংশগ্রহণ করেছিল। প্রতিযোগিতাতে দেখা হতো যে কার তৈরি মডেল বিমান কতদূর পর্যন্ত উড়তে পারে। এদের অনেককেই লুফতওয়াফের বিমান তৈরির কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়; অনেককে বিমান বাহিনীর বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা দেয়া হয়।এনএসএফকে-এর কার্যকলাপের কারণে জার্মানি যখন ১৯৪০ সালে ব্রিটেনের সাথে আকাশযুদ্ধে (ব্যাটল অব ব্রিটেন) অবতীর্ণ হয়, তখন জার্মানদের ভালো পাইলটের অভাব হয়নি।
   
  
 
জার্মান বিমান বাহিনীর ডাইভ বম্বার জুঙ্কার্স-৮৭ 'স্টুকা'। এধরনের বিমান শুধু জার্মানরাই তৈরি করেছিল। জার্মান বিমান বাহিনীর ডকট্রাইন ছিল সেনাবাহিনীকে সহায়তা দেয়া, যাতে সেনাবাহিনী ভার্সাই চুক্তির প্রতিশোধ নিয়ে সারা ইউরোপ দখল করতে পারে। একারণে জার্মান বিমানগুলি ছিল স্বল্প পাল্লার এবং অপেক্ষাকৃত হাল্কা।  

বিমান বাহিনীর দাপ্তরিক ভিত (ডকট্রাইন)

১৯৩৩ সালের মার্চে হিটলার ‘এয়ার মিনিস্ট্রি’ গঠন করে হেরমান গোরিং-কে এর দায়িত্বে দেন; তার ডেপুটি করা হয় এরহার্ড মিলচ-কে। গোরিং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বিমান বাহিনীর প্রথিতযশা পাইলট ছিলেন। এয়ার মিনিস্ট্রির মূল কাজ ছিল জার্মান বিমান বাহিনীর প্রতিষ্ঠা এবং এর জন্যে দরকারি সকলকিছু করা। নতুন বিমান ডিজাইন এবং তৈরি করার দায়িত্বও ছিল এই মিনিস্ট্রির। সকল বিমানের ডিজাইন করা হয়েছিল বেসামরিক বিমানের নাম করে।

এখানে ডকট্রাইনাল কিছু ব্যাপার আলোচনা না করলেই নয়।

- জার্মান বিমান বাহিনীর বেশিরভাগ লোক এসেছিল সেনাবাহিনী থেকে। তাই তাদের চিন্তায় সেনাবাহিনীর সহায়তাটা ছিল প্রবল। জার্মান বিমানগুলি ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের সহায়ক মাত্র। জার্মানরা দুই ইঞ্জিনের উপরে বিমান তেমন একটা তৈরি করতো না, যেগুলি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেশি ভেতরে বোমা ফেলার জন্যে যেতো না। এর পেছনে মূল চিন্তাটা ছিল ভার্সাই চুক্তির প্রতিশোধ নেয়া এবং সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পুরো ইউরোপ দখল করে বিশ্বের সবচাইতে শক্তিধর জাতি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া। ইউরোপের পুরো স্থলভাগের কর্তৃত্ব নেয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

- অপরদিকে ব্রিটিশ-মার্কিনিরা স্ট্রাটেজিক বম্বিং নিয়ে চিন্তা করেছিলো। তারা কয়েক হাজার মাইল দূরে জার্মান অর্থনৈতিক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল গুরুত্বপূর্ণ টার্গেটে বোমা ফেলার উদ্দেশ্যে বিমান ডিজাইন করেছিল। তাই তাদের ল্যাঙ্কাসটার, স্টার্লিং, বি-১৭, বি-২৪ বোমারু বিমানগুলি ছিল চার ইঞ্জিনের এবং অনেক বড়; তাদের পি-৫১, পি-৪৭ ও পি-৩৮ ফাইটারগুলিকেও বেশি তেল বহণ করে বোমারু বিমানের সাথে বহুদূর যাবার জন্যে ডিজাইন করা হয়েছিল।

- তবে ব্রিটিশ-মার্কিন এই ডকট্রাইন ১৯৪১ সালের পরে কার্যকারিতা পেয়েছিল। অন্যদিকে জার্মানরা যুদ্ধ শুরুর আগেই তাদের ডকট্রাইন তৈরি করে ফেলেছিল এবং তাদের বিমানগুলি সেভাবেই ডিজাইন করেছিল।

- জার্মান বিমান বাহিনীর মেশারস্মিট-১০৯ ও ফকে-উলফ-১৯০ ফাইটার এবং হাইঙ্কেল-১১১, জুঙ্কার্স-৮৮ ও ডর্নিয়ার-১৭ বম্বারগুলি ছিল স্বল্প-পাল্লার। তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিমান ছিল জুঙ্কার্স-৮৭ ‘স্টুকা’, যা ডাইভ-বম্বিং-এর জন্যে ব্যবহৃত হতো। মিত্রবাহিনীর এমন কোন বিমানই ছিল না।

- ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সে আবার ‘ডে হাভিলান্ড মসকিটো’ এবং ‘ব্রিস্টল বিউফাইটার’এর মতো দুই ইঞ্জিনের বিমানকে দ্রুতগামী বোমারু বিমান হিসেবে ব্যবহার করেছিলো, যা কিনা নিচু দিয়ে উড়ে টার্গেটের উপরে হামলা করতো। দ্রুত সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বোমা ফেলে দ্রুত প্রস্থান করাই ছিল এগুলির কাজ। কাজটা ছিল চোরাগুপ্তা ধরনের। 
  

মার্কিন বিমান বাহিনীর বি-১৭ স্ট্র্যাটেজিক বম্বার। মার্কিন ডকট্রাইন ছিল দূরপাল্লার ভারী বোমারু বিমানের সাহায্যে জার্মান অর্থনৈতিক এবং শিল্পের কাঠামোকে ধ্বংস করা, যাতে করে যুদ্ধ শেষে দুনিয়ার ক্ষমতায় পশ্চিমাদের হাতেই থেকে যায়। 



- আবার ব্রিটিশ বিমান বাহিনী জার্মানিতে বোমা ফেলতো রাতের বেলা; কোন ফাইটার এসকর্ট ছাড়া। অন্যদিকে আমেরিকানরা দিনের বেলায় বোমা ফেলতো ফাইটার এসকর্ট সহ। দিনের বেলায় বোমা ফেলতে যে শক্তির দরকার, তা রয়াল এয়ার ফোর্স যোগাড় করতে পারেনি। তাই তারা রাতের অন্ধকারের আড়ালেই কাজ করতে চেয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকানরা যেহেতু নতুন সুপারপাওয়ার হবার পথে, তাই তারা দিনের বেলায় শক্তি প্রদর্শনের দিকেই বেশি আগ্রহী ছিল।

- সোভিয়েতরা তৈরি করেছিল ৩৬ হাজার ইলিউশিন-২/ইলিউশিন-১০ ‘স্টুরমোভিক’ ট্যাঙ্ক ডেস্ট্রয়ার, যা জার্মান আর্মার্ড ফর্মেশনকে যুদ্ধক্ষেত্রে হারাবার জন্যে তৈরি করা হয়েছিল। বিশাল স্থলবাহিনী ব্যবহার করেই তার পূর্ব ইউরোপসহ জার্মানি নিজেদের দখলে নিয়ে সেখানে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করেছিল।

- জাপানি মিতসুবিসি এ৪এম, জি৪এম, জি৩এম এবং অন্যান্য বেশিরভাগ বিমান ছিল হাল্কা গড়নের, তবে যেন প্রচুর তেল নিতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলির দূরত্বকে মাথায় রেখে এগুলি ডিজাইন করা হয়েছিল। তাই এগুলি হাল্কা অস্ত্র বহণ করতো এবং তেমন একটা গুলি হজম করতে পারতো না। তবে সিঙ্গাপুরের কাছে রয়াল নেভির দুইটা ব্যাটলশিপকে জাপানি বিমান যখন ডুবিয়ে দেয়, তখন জাপানিদের দূর-পাল্লার বিমান বানাবার ডকট্রাইনের সাফল্যই কিন্তু সামনে আসছিলো। তবে সেটা পরবর্তীতে আরও শক্তিশালী মার্কিন বিমানের সামনে ভস্ম হয়ে যায়।

- জার্মান বিমান বাহিনী এবং সোভিয়েত বিমান বাহিনী তৈরি হয়েছিলো যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে জেতানোর জন্যে। জাপানি বিমানগুলিকে ডিজাইন করা হয়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের কৌশলগত খনিজগুলিকে আয়ত্বে আনার চিন্তা থেকে। অন্যদিকে ব্রিটিশ-মার্কিন বিমান বাহিনী তৈরি হয়েছিল জার্মানির অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তিকে পঙ্গু করে দেবার জন্যে, যাতে পরবর্তীতে বিশ্ব-কর্তৃত্ব পশ্চিমাদের হাতেই থাকে। আর ব্রিটিশ-মার্কিনীদের পার্থক্য ছিল দিবা-রাত্রে। আমেরিকানরা দিনের আলোতে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে জানিয়ে দিল যে ব্রিটিশদের আজ যুদ্ধ জিততে রাতের অন্ধকারের আশ্রয় লাগে; কারণ ব্রিটিশ সামাজ্যে আজ আর সূর্য ওঠেনা! সূর্য এখন আমেরিকানদের!

বিশ্বযুদ্ধের মাঝে বিমান বাহিনীগুলির ভিত গড়তে গিয়ে এই ডকট্রাইন ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রগুলি তাদের চিন্তাকে এই ডকট্রাইনের মাধ্যমে প্রকাশ করে। যার চিন্তা যেমন হবে, তার বিমানের ডিজাইনও তেমনই হবে। আর তার পাইলটদের ট্রেনিং-ও তেমনই হবে।

জার্মান বিমান বাহিনীর ট্রেনিং প্রসেস

যুদ্ধেরপ্রথম কয়েক বছরে (১৯৪২-এর আগ পর্যন্ত) জার্মান পাইলটদের ট্রেনিং ছিল নিম্নরূপ-

- ৬ মাসের জন্যে রিক্রুট ট্রেনিং ডিপো (ফ্লিজার এরসাতজ আবটাইলুং)-এ পাঠানো হতো। অনান্য বিমান বাহিনীর বুট-ক্যাম্পের মতো এটা। এখানে শারীরিকভাবে প্রস্তুত করা ছাড়াও আকাশযুদ্ধের উপরে কিছু লেকচার দেয়া হতো।

- এরপর দুই মাসের জন্যে পাইলটদের ‘ফ্লুগান ওয়ার্টার কোম্পানি’ নামের ইউনিটে পাঠানো হতো, যেখানে সাধারণ এরোনটিক্যাল বিষয়ের উপরে শেখানো হতো।

- এরপর পাইলটদের প্রাথমিক বা এলিমেন্টারি ফ্লাইং স্কুল (এ/বি শুলে)-এ পাঠানো হতো, যেখানে ক্লেম-৩৫, ফকে উলফ-৪৪ এবং বুকার-১৩১ প্রশিক্ষণ বিমানে ওড়া শেখানো হতো। এরোডাইনামিক্স, এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, এলিমেন্টারি ন্যাভিগেশন, মিটিওরোলজি, ফ্লাইং প্রসিজার এবং মোর্স রিসিভিং-এর উপরে ট্রেনিং নেবার পরে ‘এ২’ লাইসেন্স দেয়া হতো।

- আর ‘বি’ লাইসেন্স পাবার জন্যে পাইলটদের হাইয়ার পার্ফরমেন্স বিমানে যেমন – আরাদো-৬৬, গোথা-১৪৫, আরাদো-৭৬, জুঙ্কার ডব্লিউ-৩৩ ও ডব্লিউ-৪৪ ভারি বিমান, দুই ইঞ্জিনের ফকে উলফ এফডব্লিউ-৫৮ অথবা পুরোনো বিমান, যেমন হাইঙ্কেল-৫১, আরাদো-৬৫ বা হেনশেল-১২৩ বিমানে ট্রেনিং দেয়ার জন্যে পাঠানো হতো। ১০০ থেকে ১৫০ ঘন্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতার পর ‘বি-২’ ট্রেনিং শেষে পাইলটদের পাইলটস লাইসেন্স এবং পাইলটস উইং দেয়া হতো।

- ফাইটার এবং ডাইভ বম্বার ট্রেনিং-এর জন্যে এই লাইসেন্স পাবার পর ঐ স্পেশালিস্ট ইউনিটে পাঠানো হতো। দুই ইঞ্জিনের

- ফাইটার, বম্বার এবং রেকনাইসেন্স বিমানে ট্রেনিং-এর জন্যেও আলাদা স্পেশালিস্ট ইউনিটে পাঠানো হতো। এসব স্কুলে ছয় মাসের ট্রেনিং-এ ৫০ থেকে ৬০ ঘন্টা ওড়ার পরে ‘সি’ বা এডভান্সড পাইলটস লাইসেন্স দেয়া হতো। বম্বার পাইলটদের অপারেশনাল বিমানের পুরোনো ভার্সনে (হাইঙ্কেল-১১১, জুঙ্কার্স-৫২, জুঙ্কার্স-৮৬, ডর্নিয়ার-১৭) ট্রেনিং দেয়া হতো। এই ট্রেনিং শেষে পাইলটরা দিনে বা রাতে মোটামুটি দক্ষতার সাথে বিমান চালাতে পারতো, ইন্সট্রুমেন্ট ফ্লাইং-এ অল্প কিছু ট্রেনিং হতো তার এবং ভালো আবহাওয়ায় সিম্পল ক্রস-কান্ট্রি ন্যাভিগেশন ফ্লাইট চালাতে পারতো।

- ‘সি’ স্কুলের পরে দুই ইঞ্জিনের ফাইটার পাইলটদের স্পেশালিস্ট ইউনিটে পাঠানো হতো এবং বাকিরা বম্বার ও রেকনাইস্যান্স ইউনিটে যেতো, যেখানে আরও ৫০ থেক ৬০ ঘন্টা ওড়ার প্রশিক্ষণ পেতো সে। স্পেশালিস্ট ট্রেনিং-এ লেটেস্ট ডিজাইনের বিমানে কম্বাইন্ড ক্রু ট্রেনিং দেয়া হতো এবংরাতের বেলায় ও খারাপ আবহাওয়ায় ন্যাভিগেশন ট্রেনিং-এ বেশি গুরুত্ব নিয়ে শিক্ষা পেতো।

- স্পেশালিস্ট ট্রেনিং-এর পর ক্রুরা একত্রেই থাকতো এবং একত্রে তাদের কোন অপারেশনাল ইউনিটে পাঠানো হতো। কিছু পাইলটকে অবজার্ভার ট্রেনিং-এ আরও নয় মাসের জন্যে পাঠানো হতো, যেখানে তারা ব্লাইন্ড ফ্লাইং এবং ন্যাভিগেশনে আরও স্পেশালিস্ট হয়ে উঠতো। এরা বোমারু বিমান বা রেকনাইস্যান্স বিমানের ক্যাপ্টেন হতো। যুদ্ধের মাঝে ১৯৪২ সালের পর থেকে অবজার্ভার ট্রেনিং-এর গুরুত্ব কমতে কমতে ১৯৪৪ সাল নাগাদ ৫ মাসের ট্রেনিং-এ এসে ঠেকে।

- স্পেশালিস্ট ট্রেনিং শেষে পাইলটদের বিভিন্ন অপারেশনাল গ্রুপের অধীনে অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিটে (এরগেনজুং সাইনহাইটেন) দেয়া হতো। এখানে তারা ঐ ইউনিটের অপারেশনাল ট্যাকটিক্যাল মেথডগুলি শিখতো।



প্রথম দিন থেকে এই অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিটে আসতে একজন ফাইটার বা ডাইভ বম্বার পাইলটের ১৩ মাসের মতো সময় লাগতো, যার মাঝে তার ১০০ থেকে ১৫০ ঘন্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা হতো। আর বম্বার ও রেকনাইস্যান্স পাইলটের লাগতো ২০ মাস সময়, যার মাঝে তার ২২০ থেকে ২৭০ ঘন্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা লাগতো। ১৯৪২ সালের আগ পর্যন্ত লুফতওয়াফের এই ট্রেনিং প্রসেসই ছিল। ১৯৪২ সাল থেকে সোভিয়েত ফ্রন্টের চাপে পুরো ট্রেনিং প্রসেসই ভেঙ্গে পড়ে।
   
  
জার্মান বিমান বাহিনীর সেরা পাইলটের অভাব ছিল না। বহু পাইলটের নামের পাশে প্রচুর 'কিল' যোগ হয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল - যুদ্ধের শুরুতে জার্মান বিমান বাহিনীর ট্রেনিং এবং বিমানের মান অপেক্ষাকৃত ভালো থাকা এবং সুনির্দিষ্ট ডকট্রাইন অনুযায়ী অপারেট করা। জার্মানরা অনেক আগ থেকেই তাদের ট্রেনিং অপারেশন চালাবার ফলে যুদ্ধের শুরুর দিকে ভালো পাইলটের অভাব হয়নি তাদের। 
 

জার্মান ট্রেনিং-এর অবনতি এবং ধ্বংস

১৯৪১ সালের ২২শে জুন জার্মানরা সোভিয়েত ইউনিয়নে হামলা করে। প্রথম ছয় মাসে তারা ২,২০০ পাইলট হারায়। এর পরে ১৯৪২ সালের প্রথম ছয় মাসেও প্রায় একই সংখ্যক পাইলট হারায় তারা। এর মাঝে আবার সোভিয়েত ফ্রন্টে জার্মান সেনাবাহিনীর কিছু ইউনিট আটকে পড়ার কারণে তাদেরকে আকাশ থেকে সাপ্লাই দিতে দুই ইঞ্জিনের ট্রেনিং প্রোগ্রাম থেকে বিমান এবং প্রশিক্ষকদের রুশ ফ্রন্টে পাঠানো হয়। এরপর থেকে যুদ্ধে চাপে সেই বিমান এবং প্রশিক্ষকদের আর ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। আর রুশ ফ্রন্টে যুদ্ধের কারণে যখন জ্বালানি তেলের সরবরাহের উপরে চাপ পড়ে, তখন ট্রেনিং ইউনিটেই জ্বালানি তেলের বরাদ্দ কমানো হয় সবচাইতে বেশি। এসময় আধাআধি ট্রেনিংপ্রাপ্ত ‘এ’ এবং ‘বি’ টাইপের লাইসেন্সধারী পাইলটের একটা আধিক্য তৈরি হয় এবং অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিটে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলটের ক্রাইসিস দেখা দেয়। ১৯৪২ সালের জুলাই-এ পাইলট ট্রেনিং-এর ডিরেক্টর জেনারেল কুয়েল লুফতওয়াফের প্রধান রাইখমার্শাল হেরমান গোরিং-এর কাছে গিয়ে আসছে মহাবিপদের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, ‘সি’ টাইপের ট্রেনিং-এর অবস্থা শোচনীয় অবস্থায় ঠেকেছে। গোরিং শর্টকাট সমাধান খুঁজতে গিয়ে পুরো ‘সি’ টাইপ ট্রেনিং প্রোগ্রাম-ই বাদ দিয়ে দেন এবং এই ট্রেনিং নেবার জন্যে পাইলটদের সরাসরি অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিটে পাঠিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিটে ‘সি’ টাইপের ট্রেনিং দেবার জন্যে যথেষ্ট বিমান এবং প্রশিক্ষক না থাকায় তাদের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে ওঠে। অপারেশনাল ট্রেনিং ইউনিট এই চাপ নিতে না পেরে অপারেশনাল গ্রুপের কাছে ট্রেনিং-এর জন্যে পাইলট পাঠাতে থাকে। ফলশ্রুতিতে মারাত্মক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেখানে বম্বার এবং রেকনাইস্যান্স পাইলটদের পার্ফরমেন্স খুব খারাপ হয়ে যেতে থাকে।

১৯৪৪ সালের শুরুতে জার্মান অপারেশনাল ফাইটার ইউনিটগুলিতে মাত্র ১৬০ ঘন্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা নিয়েই পাইলটরা যোগদান করতে থাকে। অথচঃ ঐ একই সময়ে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্স এবং আমেরিকার আর্মি এয়ার ফোর্সে ফাইটার পাইলট হতে দ্বিগুণেরও বেশি ঘন্টা উড্ডয়নের প্রয়োজন হতো। ১৯৪৪-এর প্রথম ৬ মাসে জার্মান ফাইটারের ইন্টারসেপ্টর ইউনিটিগুলি ২,০০০-এরও বেশি পাইলট হারায়। দিনের বেলায় মার্কিন বোমারু বিমানের সাথে আসা পি-৫১ ফাইটারগুলি জার্মান বিমান বাহিনীর যেকোন ফাইটারের চাইতে ভালো ছিল। এর উপরে মার্কিন পাইলটের মান তখন যথেষ্ট ভালো। অন্যদিকে জার্মান পাইলটদের ট্রেনিং-এর অবস্থা দিনকে দিন আরও খারাপ হচ্ছিল। ১৯৪৪-এর মাঝামাঝি সময়ে ‘বি’ ট্রেনিং ইউনিটগুলি বাদ দিয়ে দেয়া হয় এবং সকল পাইলটকে মাত্র ১১২ ঘন্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতাসহ অপারেশনাল ইউনিটে পাঠানো হতে থাকে। আর ঐ বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ জ্বালানি স্বল্পতায় এলিমেন্টারি এবং স্পেশালিস্ট ট্রেনিং প্রসেস বাদ দিয়ে সকলকে ফ্রন্টলাইনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

হিটলার ইয়ুথ ফ্লাইটের শেষ দিনগুলি

হিটলার ইয়ুথের ফ্লাইং ডিভিশনের সদস্যদের ১৯৪৩ সাল থেকে বিমান-ধ্বংসী কামান চালাতে নিয়োগ দেয়া হয়; তাদের সাথে বহু বেসামরিক নাগরিককেও এই ট্রেনিং দেয়া হয়, কারণ সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত সকলকেই তখন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। যেসব ছেলেরা বয়সে একটু বড় ছিল, তারা কামান চালনা করতো, আর কম বয়সের ছেলেরা ফিজিক্যাল কমিউনিকেশন (কুরিয়ার) এবং সার্চলাইট চালনার কাজ করতো। বোমা হামলায় যোগাযোগ ধ্বংস হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। তখন এই ছেলেরাই যোগাযোগ সচল রাখতো। আকাশে মার্কিন বিমান বাহিনীর নতুন ডিজাইনের ফাইটারের (পি-৫১, পি-৪৭ এবং পি-৩৮) কাছে জার্মান ফাইটারগুলি হেরে যাচ্ছিল। তখন এই কম বয়সীদের বাহিনীর চালনা করা বিমান-ধ্বংসী কামানগুলি অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধে একেবারে শেষের দিকে মেশারস্মিট এমই-২৬২ এবং হাইঙ্কেল এইচই-১৬২ নামের জেট ফাইটারগুলি তৈরি করা শুরু হয়েছিল। হাইঙ্কেল-১৬২-এর নাম দেয়া হয়েছি ‘পিপলস ফাইটার’ (ভোকস যাগের), এবং এই বিমান চালনার জন্যে অল্প বয়সের ছেলের ট্রেনিং দেয়া শুরু করা হয়েছিল। হাইঙ্কেলের বিমানটা যথেষ্ট ভালো একটা ফাইটার হলেও মাত্র ৩২০টা ফাইটার যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর জন্যে যথেষ্ট ছিল না। আর তখন জার্মান বিমান বাহিনীর পাইলটের মান ছিল একেবারেই নিম্নমানের। তদুপরি, অনেক ক্ষেত্রেই বিমান পাওয়া গেলেও চালানোর পাইলট পাওয়া যায়নি! অর্থাৎ ম্যান এবং মেশিনের মাঝে সমন্বয় ভেঙ্গে পড়েছিল।
    
  
মার্কিন বিমান বাহিনীর পাইলট ক্যাপ্টেন ফ্রেড ক্রিশ্চেনসেন (১৯৪৪)। তার পি-৪৭ বিমানে অঙ্কিত ২২টা স্বস্তিকার মানে হলো তিনি ২২টা জার্মান বিমান ভূপাতিত করেছেন। মার্কিনীরা তাদের সবচাইতে ভালো পাইলটদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো নতুন পাইলট ট্রেনিং দেবার উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে জার্মান পাইলটদের সর্বোত্তমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করেছিল। তাদের অভিজ্ঞতা নতুনদের মাঝে খুব কমই গিয়েছিল।  
 

জার্মান পাইলটের মান

জার্মান ফাইটার পাইলটদের একটা নাম হয়ে গিয়েছিল ‘কিল’-এর সংখ্যার জন্যে। ২,৫০০ পাইলট কমপক্ষে ৫টা বিমান ভূপাতিত করার দাবি করে। ১০০টার বেশি বিমান ভূপাতিত করার পাইলটের সংখ্যা ছিল ১০৩। ৪০ থেকে ১০০ ‘কিল’-এর দাবি ছিল ৩৬০ জন পাইলটের। ২০ থেকে ৪০ ‘কিল’এর দাবি ছিল ৫০০ জন পাইলটের। ৪৫৩ জন ফাইটার (দিনের বেলার ফাইটার) পাইলটকে ‘নাইটস ক্রস অব দ্যা আয়রন ক্রস’ পুরষ্কার দেয়া হয়েছিল; আরও ৮৫ জন নাইট ফাইটার পাইলট (১৪ জন ক্রু-সহ) একই সন্মান পেয়েছিল। যুদ্ধের শুরুতে এটাই ছিল জার্মানির সর্বোচ্চ সামরিক সন্মান। জার্মান বিমান বাহিনী যুদ্ধে মোট ৭০ হাজার বিমান ভূপাতিত করার দাবি করে; যার মাঝে ৪৫ হাজার ছিল সোভিয়েত, আর ২৫ হাজার ছিল ব্রিটিশ-মার্কিন। ১৮ হাজার ৬০০-এর মতো জার্মান পাইলট যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে। 

জার্মান বিমান বাহিনীর সাথে রয়াল এয়ার ফোর্স এবং মার্কিন বিমান বাহিনীর ট্রেনিং-এর দৈর্ঘ্যের একটা তুলনাচিত্র। যেখানে যুদ্ধের শুরুতে ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জার্মানরা ব্রিটিশ এবং মার্কিন ট্রেনিং-এর চাইতে বেশি লম্বা ট্রেনিং নিতো, সেখানে পুরো চিত্রই পাল্টে যায় ১৯৪২-৪৩ সালে। যুদ্ধের শেষের দিকে জার্মানরা ভালো বিমান তৈরি করতে পারলেও সেগুলি চালাবার মতো পাইলটই তাদের ছিলনা। 


জার্মান পাইলটদের ‘কিল’এর এই দাবি পশ্চিমা ঐতিহাসিকেরা অনেকেই প্রশ্ন করেছেন। তবে এর স্বপক্ষে যুক্তিও রয়েছে যথেষ্ট। প্রথমতঃ যুদ্ধের প্রথম দিকে জার্মান পাইলটের মান ছিল অন্যদের চাইতে অনেক ভালো, কারণ তারা অনেক আগ থেকেই পাইলট তৈরি করে আসছিল। যেমন যুদ্ধের শুরুতে প্রচন্ড চাপের মুখে ব্রিটেনের রয়াল এয়ার ফোর্সের পাইলটেরা মাত্র ১৬০ ঘন্টা উড্ডয়নের অভিজ্ঞতা নিয়েই জার্মান বিমান বাহিনীকে মোকাবিলা করতে গিয়েছিল। ১৯৪১ সালের পর থেকে এই ট্রেনিং-কে ৩২০ ঘন্টার উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে রুশ বিমান বাহিনীর ট্রেনিং-এর অবস্থাও ছিল খুবই খারাপ।দ্বিতীয়তঃ পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধপ্রস্তুতির কারণে জার্মান বিমান বাহিনী যুদ্ধের শুরুতে বেশ ভালো মানের ফাইটার তৈরি করতে পেরেছিল। অন্যদিকে অন্য দেশগুলি ছিল একেবারেই প্রস্তুতিহীন; তাই তাদের শুরুর দিকের বিমানগুলি ছিল নিম্নমানের। তৃতীয়তঃ যেখানে ব্রিটিশ-আমেরিকান সেরা পাইলটদেরকে দেশে ফেরত নিয়ে আসা হতো নতুন পাইলটদের ট্রেনিং দেবার জন্যে, সেখানে জার্মান বিমান বাহিনীর শ্রেষ্ঠ পাইলটদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত রাখা হয়েছিল তারা মারা যাবার আগ পর্যন্ত। ব্রিটিশ-মার্কিন পাইলটেরা তাদের অভিজ্ঞতা নতুনদের মাঝে বিতরণ করে পাইলট তৈরিতে সহায়তা করেছিল। অন্যদিকে জার্মান পাইলটদের অভিজ্ঞতা নতুনদের মাঝে ততটা যায়নি।

জার্মান বিমান বাহিনীর ডকট্রাইনগত সমস্যা

জার্মান পাইলট ট্রেনিং এবং বিমান নির্মান শিল্প তাদের রাষ্ট্রের চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। কারণ তাদের চিন্তায় যেখানে সেনাবাহিনী দ্বারা সারা ইউরোপ দখলের দিকে লক্ষ্যস্থির ছিল, সেখানে অনেকগুলি শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে একত্রে যুদ্ধ করতে পারার মতো ট্রেনিং কাঠামো তাদের থাকা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা ছিল শুধুই স্বপ্ন। রাশিয়া, ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত জনবল, খনিজ সম্পদ, ভূমি, শিল্প এবং অর্থনৈতিক শক্তির সাথে পেরে ওঠা জার্মানির একার পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিলনা। তাই সকলের সাথে একত্রে লড়তে গিয়ে তাদের ট্রেনিং কাঠামো এবং বিমান নির্মাণ শিল্প ভেঙ্গে পড়েছিল। একইসাথে এতগুলি ফ্রন্টে একত্রে যুদ্ধ করার জন্যে দরকারি খনিজ সম্পদের জোগান তারা দিতে অক্ষম ছিল।
     
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের মাটিতে পাইলট ট্রেনিং-এর জন্যে যথেষ্ট এয়ারফিল্ড এবং ট্রেনিং বিমান না থাকায় বেশিরভাগ পাইলট ট্রেনিং-এর আয়োজন করা হয় ব্রিটেনের বাইরে। ঐ এলাকাগুলি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে থাকায় পাইলটরা তেমন কোন চাপ ছাড়াই ট্রেনিং নিতে পেরেছিল। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সালের মাঝে পাইলট ট্রেনিং এতটাই সাফল্যজনক ছিল যে, ১৯৪৪ সাল থেকে পাইলট ট্রেনিং কমিয়ে দেয়া হয়েছিল! 
  

ব্রিটিশ অভিজ্ঞতা

যুদ্ধের প্রথম দিকে ব্রিটিশরা জার্মানদের সাথে পেরে উঠছিল না একেবারেই। তারা তাদের পাইলট ট্রেনিং-এর জন্যে ৯টা দেশের উপরে নির্ভর করেছিল। পাইলট ট্রেনিং-এর জন্যে যথেষ্ট সংখ্যক এয়ারফিল্ড ব্রিটেনে ছিল না। এরপরেও ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫-এর মাঝে মোট ১৫৩টা ফ্লাইং স্কুলে ১৪,৪০০ পাইলটকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল ব্রিটেনে। মোট ট্রেনিংপ্রাপ্ত ১ লক্ষ ১০ হাজার ৬০০ পাইলটের মাঝে এই সংখ্যা মাত্র ১৩%। সর্বোচ্চ সংখ্যক ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল কানাডার ৯২টা স্কুলে– ৫৪,১০০, যা কিনা মোট ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাইলটের ৪৯%। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিং পেয়েছিল ১১,৮০০ জন (১১%), অস্ট্রেলিয়াতে ট্রেনিং পেয়েছিল ১০,৫০০ জন (৯%), দক্ষিণ আফ্রিকা এবং রোডেশিয়াতে মোট ১৪,৮০০ জন (১৩%), নিউজিল্যান্ডে ৪,২০০ জন (৪%), ভারতে ৭০০ জন এবং মধ্যপ্রাচ্যে ১০০ জন। ব্রিটেনের সাহায্যকারী এই দেশ/অঞ্চলগুলি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে ছিল বিধায় সেখানে পাইলটরা মোটামুটি শান্তিতেই ট্রেনিং নিতে পেরেছে। এভাবে ট্রেনিং নেবার জন্যে যথেষ্ট ভালো ফ্লাইং কন্ডিশনও ব্রিটিশরা পেয়েছিল; কাজেই ট্রেনিং-এ আবহাওয়ার কারণে সময়ক্ষেপণ ছিল কম। অন্যদিকে জার্মান পাইলটরা মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমানের হামলার মাঝেই ট্রেনিং নিচ্ছিল।

ব্রিটেনের আকাশে যখন জার্মান বিমান হামলা করছিল (ব্যাটল অব ব্রিটেন), তখন ব্রিটিশদের পাইলটের ব্যাপক ঘাটতি ছিল; চাপের মুখে পাইলটের মানও ছিল অতি সাধারণ। কিন্তু ১৯৪৩ সাল থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাইলটের সারপ্লাস পরিলক্ষিত হচ্ছিল। বিমানের মান ভালো হচ্ছিল, আর ভালো বিমান চালাতে পাইলটের ট্রেনিং-এর মানও ভালো হতে হতো। যুদ্ধের প্রথমে পরিলক্ষিত ক্ষতির চাইতে পরবর্তীতে ক্ষতির পরিমাণ কমতে থাকে; কাজেই বদলি পাইলটের দরকারও আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৪৪ সালের শুরু থেকে পাইলট ট্রেনিং-এর হার কমিয়েই দেয়া হয়! অর্থাৎ যুদ্ধ জেতার জন্যে যথেষ্ট সংখ্যক ভালো পাইলট ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সালের মাঝেই তৈরি করে ফেলা সম্ভব হয়েছিল! শেষের দেড় বছর শুধু যুদ্ধ শেষ করতে ব্যবহৃত হচ্ছিল।

ব্রিটেনের কোন হিটলার ইয়ুথ ছিল না; তবে ব্রিটিশরা যুদ্ধ প্রস্তুতিও বন্ধ করেনি একেবারে। রয়াল এয়ার ফোর্সের রেগুলার পাইলটরা দুই বছরের ট্রেনিং পেতো আরএএফ কলেজে। এছাড়াও আরও বেশি সংখ্যক পাইলট তৈরি হতো এক বছরের শর্ট সার্ভিস ট্রেনিং-এর মাধ্যমে। এদের ট্রেনিং হতো ফ্লাইং ট্রেনিং স্কুলে। ১৯২৫ সাল থেকে আরও একট নতুত ধাপে পাইলট ট্রেনিং শুরু হয় – স্পেশাল রিজার্ভ স্কোয়াড্রন এবং অক্সিলারি স্কোয়াড্রন। এদেরকে সপ্তাহান্তে পার্ট টাইম ট্রেনিং দেয়া হতো। তবে ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৯-এর মাঝে এই প্রোগ্রামগুলিকে ত্বরান্বিত করা হয়। ১৯৩৬ সালে ট্রেনিং কমান্ড এবং আরএএফ ভলান্টিয়ার রিজার্ভ গঠন করা হয়। এরা বেসামরিক ফ্লাইং স্কুলগুলিতে ট্রেনিং নিতো। ছুটির দিনে এরা বিমান ওড়াতো এবং সন্ধ্যায় অনান্য ক্লাসে প্রশিক্ষণ নিতো। এদেরকে পরবর্তীতে বিমান বাহিনীতে নেয়া অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। তারপরেও যুদ্ধ শুরুর সময় (১৯৩৯ সালে) যথেষ্ট এয়ারফিল্ড, ট্রেনিং বিমান এবং প্রশিক্ষকের অভাবে বেশি সংখ্যক পাইলট তৈরি করা যাচ্ছিলো না। তবে এই কাঠামোটাই ১৯৪১ সাল থেকে ব্যবহার করে পাইলট ট্রেনিং-এ ব্যাপক সাফল্য পাওয়া গিয়েছিল।
   
 
শ্রীলঙ্কা বিমান বাহিনীর এফ-৭ যুদ্ধবিমান। দেশটির গৃহযুদ্ধের শুরুতে বিমান বাহিনীতে পাইলট ছিল ৪০ জনেরও কম। এমতাবস্থায় নতুন বিমান কিনলেও তা চালাবার জন্যে পাইলট ছিল না তাদের। তাই অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশী ভাড়া করা পাইলট দিয়ে চালাতে হয়েছিল তাদের। 
 

আরও কিছু উদাহরণ

১৯৮০-এর দিকে মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদ (কেউ কেউ বলে চাদ) ব্রিটেন-ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্রের ধস্তাধস্তির মাঝে পড়ে গৃহযুদ্ধে পতিত হয়। তখন শাদের একনায়ক ইদ্রিস দেবি, যিনি ফরাসীদের কাছে পাইলট ট্রেনিং নেবার কারণে বিমান বাহিনীর গুরুত্ব বুঝতেন। তিনি শাদের বিমান বাহিনী তৈরি করার লক্ষ্যে আগানো শুরু করেন। কিন্তু যেহেতু নিজের দেশের কোন পাইলটই নেই, তাই ভাড়াটে পাইলট দিয়েই তিনি শাদের বিমান বাহিনী তৈরি করেন। আজও শাদের বিমান বাহিনী বিদেশী পাইলটের উপরে বেশ নির্ভরশীল।

শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ শুরুর সময়ে শ্রীলঙ্কার বিমান বাহিনীতে তেমন কোন সংখ্যক পাইলটই ছিল না। তাই বিদেশী ভাড়া করা পাইলটের উপরেই নির্ভর করতে হয়েছে তাদের। ১৯৮৫ সালে যখন শ্রীলঙ্কা ইতালি থেকে Siai Marchetti বিমান কেনে, তখনও তাদের মোট পাইলটের সংখ্যা ছিল ৪০-এরও কম। এই সংখ্যক পাইলট দিয়েই তাদের এটাক এয়ারক্রাফট, পরিবহণ বিমান এবং হেলিকপ্টার অপারেট করতে হয়েছিল।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ‘কিলো ফ্লাইট’ তৈরি করতে বাংলাদেশের হাতে ছিল ৩ জন বিমান বাহিনীর পাইলট এবং ৬ জন বেসামরিক পাইলট। এই সবগুলি উদাহরণেই একটা ব্যাপার নিশ্চিত, আর তা হলো – পাইলটের স্বল্পতা এতটাই ছিল যে, আরও বেশি সংখ্যক বিমান পেলেও সেগুলি ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না।

আর এই তিন উদাহরণের প্রত্যেকটাই অন্য দেশে তৈরি বিমানের উপরে নির্ভরশীল ছিল বিধায় ঐ দেশগুলি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।

এই দীর্ঘ আলোচনাকে সংক্ষেপে বলতে গেলে –

- একটা বিমান বাহিনীকে গড়তে গেলে প্রথমেই তার ডকট্রাইন স্থির করতে হবে, যা কিনা সেই রাষ্ট্রের চিন্তার উপরে নির্ভরশীল। সেই চিন্তাটা যেমন, তার বিমানের ডিজাইন, ফর্মেশন এবং ট্রেনিং হবে তেমনি।

- ট্রেনিং এমন একটা ব্যাপার, যার একটা দফারফা না করে কোন যুদ্ধ করাটা বোকামি। পাইলট তৈরি করতে সময় লাগে। সেটা হিসেবে না এনে যুদ্ধে গেলে আধাআধি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের উপরে নির্ভর করতে হতে পারে। এদের হাতে ভালো অস্ত্র দিলেও এর উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত হবে না।

- যথেষ্ট সংখ্যক ও নিরাপদ এয়ারফিল্ড এবং এয়ারস্পেস ছাড়া ভালো ট্রেনিং-এর আশা করা যায় না।

- অভিজ্ঞদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে নতুনদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। অভিজ্ঞদের ভালো যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করে কিছু সাফল্য পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ হারতে হতে পারে।

- ট্রেনিং অনেক অল্প বয়সে শুরু করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। অল্প বয়সের ছেলেদের মানসপটে পাইলট হবার আকাংক্ষা যে ভালোমতো তৈরি করতে পারবে, তার বিমান বাহিনী ততো শক্তিশালী হবে।

- বেসামরিক জনগণের পাইলট ট্রেনিং-এ ভূমিকা থাকলেও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাই হবে মূল বিষয়। রাষ্ট্রের চিন্তা বিমান বাহিনীর ডকট্রাইন এবং ট্রেনিং প্রসেসে প্রতিফলিত হবে।

- অন্য দেশের তৈরি বিমানের উপরে নির্ভরশীল হতে হলে ঐ দেশের ডকট্রাইনই মেনে চলতে হবে; এভাবে নিজেদের ডকট্রাইন হবে স্বল্প মেয়াদী, যাকে ডকট্রাইন বলাটাই ভুল হবে

Saturday 28 July 2018

যুদ্ধ এক – অস্ত্র অনেক, কেন?

২৮শে জুলাই ২০১৮


  
ডিঙ্গো নামের এই কুকুর-পরিবারের প্রাণীটি অস্ট্রেলিয়ার স্থলভাগে সবচাইতে ভয়ংকর স্তন্যপায়ী প্রাণী। অস্ট্রেলিয়াতে বনের রাজা হতে হলে ডিঙ্গো হলেই চলবে, যদিও সুন্দরবনে হতে হবে টাইগার বা আফ্রিকায় হতে হবে লায়ন।


বনের রাজা কে?


অস্ট্রেলিয়া একটা মহাদেশ হলেও তা মূলতঃ একতা বিশাল দ্বীপ; এবং বাকি দুনিয়া থেকে সমুদ্র দ্বারা আলাদা। অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে মারাত্মক প্রাণী কোনটা – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কুমীর, হাঙ্গর, সাপ, জেলিফিশ, আক্টোপাস, মৌমাছি, মাকড়ষা, পিঁপড়া, ইত্যাদির নাম আসবে। এখানে স্থলভাগের বড় কোন জন্তুর নাম আসবে না সহজে, কারণ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সবচাইতে ভয়ঙ্কর স্তন্যপায়ী প্রাণী হলো ডিঙ্গো নামের কুকুর-পরিবারের একটা জন্তু। ফেরাল ক্যাট নামের একটা বিড়াল আছে, যা পাখি ধরে খায়। কিন্তু সেখানে বড় কোন বিড়াল নেই – যেমন বাঘ বা সিংহ বা চিতা বা লেপার্ড। সেখানে বনে রাজা বড় কোন পশু নয়। ডিঙ্গোর মতো প্রাণী আফ্রিকা বা আমাজন বা সুন্দরবনে হয়তো টিকতে পারবে না; তবে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তাকে হারাবার কেউ নেই। একেকটা জঙ্গলের বাস্তবতা একেক রকম। মূলকথা, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বনের রাজা হতে টাইগার বা লায়ন হবার দরকার নেই। এই হিসেবটা জঙ্গলের বাইরের জঙ্গলেও প্রচলিত। কারণ সবগুলি একই সৃষ্টির অংশ।
 
   
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইউরোপের আকাশে ব্রিটিশ হকার হারিকেন বিমানগুলি খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঠিকই চালিয়ে নিয়েছিল। এই বিমানের গতি (ঘন্টায় ৫৩১ কিঃমিঃ) জাপানি জেরো ফাইটারের কাছাকাছি ছিলো (৫৩৩ কিঃমিঃ থেকে ৫৬৫ কিঃমিঃ)।


বিশ্বযুদ্ধে আকাশের রাজত্ব কে করেছে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একেক যুদ্ধক্ষেত্রে একেক ধরনের যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হয়েছিল। ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে জার্মান বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যেসব ব্রিটিশ-মার্কিন যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হয়েছিল, জাপানের সাথে যুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সেগুলি মোতায়েন করা হয়নি। জার্মান বিমান বাহিনীর মূল ফাইটার বিমান ছিল মেশারস্মিট বিএফ-১০৯, যে বিমানের সর্বোচ্চ গতি একসময় ঘন্টায় ৪৭০ কিঃমিঃ থাকলেও খুব দ্রুতই পরের ভার্সনের বিমানগুলির গতি ৫৬০ কিঃমিঃ পার হয়ে ৬২৪ কিঃমিঃ, এমনকি ৭২৯ কিঃমিঃ পর্যন্ত যায়। বিএফ-১০৯-এর সাথে আরেকটা ফাইটার বিমান ফকে-উলফ এফডব্লিউ-১৯০ প্রচুর তৈরি করা হয়েছিল, যার গতি ৬৫০ কিঃমিঃ থেকে ৬৮৫ কিঃমিঃ পর্যন্ত ছিল। এই বিমানগুলিকে মোকাবিলা করার জন্যে ব্রিটিশদেশ হকার হারিকেন বিমানগুলির গতি ছিল ৫১৯ কিঃমিঃ থেকে ৫৩১ কিঃমিঃ পর্যন্ত; অর্থাৎ জার্মান বিমানগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ হেরে যাবার সম্ভাবনা এর ছিল বেশি। ব্রিটিশরা তাই দ্রুত সুপারম্যারিন স্পিটফায়ার বিমানের উৎপাদন বাড়িয়েছিল, যার গতি ছিল ঘন্টায় ৬০২ কিঃমিঃ থেকে ৭২১ কিঃমিঃ পর্যন্ত। কিন্তু স্পিটফায়ারগুলি যথেষ্ট সংখ্যায় তৈরি করতে সময় লেগেছিল। স্পিটফায়ারের কারখানাগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে করতে যে সময় লেগেছিল, সেসময়ে হারিকেনগুলিই ঠেকনা দিয়েছিল। যখন স্পিটফায়ারগুলি যথেষ্ট সংখ্যায় পাওয়া যেতে থাকলো, তখন হারিকেনগুলিকে অন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয় – যেমন আফ্রিকা এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।

প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের মূল যুদ্ধবিমান ছিল মিতসুবিসি এ-৬এম ‘জেরো’। এর গতি ৫৩৩ কিঃমিঃ থেকে ৫৬৫ কিঃমিঃ-এর মতো ছিল; অর্থাৎ ৬০০ কিঃমিঃ-এর নিচে। ব্রিটিশরা এই যুদ্ধক্ষেত্রে হারিকেনগুলিকে পাঠিয়েছিল আর মার্কিনীরা পাঠিয়েছিল কার্টিস পি-৪০ (৫২০ কিঃমিঃ থেকে ৫৬৩ কিঃমিঃ), বেল পি-৩৯ এয়ারাকোবরা (৬১২ কিঃমিঃ), গ্রুম্মান এফ-৪এফ ওয়াইল্ডক্যাট (৫৩৩ কিঃমিঃ) এবং গ্রুম্মান এফ-৬এফ হেলক্যাট (৬১২ কিঃমিঃ)। পরবর্তীতে ভট এফ-৪ইউ কর্সেয়ার বিমানগুলি (৬৭১ কিঃমিঃ থেকে ৭১৮ কিঃমিঃ) গতিকে আরও এগিয়ে নেয়। কর্সেয়ার ছাড়া বাকি বিমানগুলির গতি ছিল ৬৫০ কিঃমিঃ-এর নিচে; তবে তারপরেও বিমানগুলি জাপানি জেরো ফাইটারের সাথে যুদ্ধ করে জিততে পারতো। অন্যদিকে ৬৫০ কিঃমিঃ ইউরোপের যুদ্ধ জেতার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। মার্কিনীরা ইউরোপে তিনটা ফাইটার বিমান ব্যবহার করেছিল – নর্থ আমেরিকান পি-৫১ মাসট্যাং (৬২৪ কিঃমিঃ থেকে ৭০৩ কিঃমিঃ), রিপাবলিক পি-৪৭ থান্ডারবোল্ট (৬৯০ কিঃমিঃ থেকে ৬৯৭ কিঃমিঃ) এবং লকহিড পি-৩৮ লাইটনিং (৬৩৬ কিঃমিঃ থেকে ৬৭৬ কিঃমিঃ)। এই বিমানগুলির গতি ছিল মোটামুটিভাবে ৬৫০ কিঃমিঃ থেকে ৭০০ কিঃমিঃ-এর মতো। আর তাই এই বিমানগুলি জার্মান বিমান বাহিনীর বারোটা বাজাতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল।
   
  
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত কার্টিস পি-৪০ বিমান। এই বিমানে ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয়েছিল ১,২০০ হর্সপাওয়ারের রাইট, অথবা ১,০৫০ থেকে ১,২০০ হর্সপাওয়াররের প্র্যাট এন্ড হুইটনি, অথবা ১,১৫০ হর্সপাওয়ারের এলিসন, অথবা ১,৩০০ থেকে ১,৩২৫ হর্সপাওয়ারের প্যাকার্ড। অর্থাৎ যে ইঞ্জিন পাওয়া গিয়েছিল, সেটাই ব্যবহৃত হয়েছিল এতে। বেশি শক্তিশালী (১,৫০০ থেকে ২,০০০ হর্সপাওয়ার) ইঞ্জিনগুলি ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রের বিমানগুলির জন্যে দেয়া হচ্ছিলো।  


ইঞ্জিনের উৎপাদন বনাম বিমানের উৎপাদন

পি-৫১-এ ব্যবহৃত হয়েছিল ১,৫২০ থেকে ১,৬৫০ হর্সপাওয়ারের এলিসন ইঞ্জিন; পি-৪৭-এ ব্যবহৃত হয়েছিল ২,০০০ থেকে ২,৫৩৫ হর্সপাওয়ারের প্র্যাট এন্ড হুইটনি ইঞ্জিন; আর পি-৩৮-এ ব্যবহৃত হয়েছিল ১,২২৫ থেকে ১,৬০০ হর্সপাওয়ারের দুইটা এলিসন ইঞ্জিন। বাকি বিমানগুলিতে ব্যবহৃত হয়েছিল – পি-৪০ (১,২০০ হর্সপাওয়ারের রাইট, অথবা ১,০৫০ থেকে ১,২০০ হর্সপাওয়াররের প্র্যাট এন্ড হুইটনি, অথবা ১,১৫০ হর্সপাওয়ারের এলিসন, অথবা ১,৩০০ থেকে ১,৩২৫ হর্সপাওয়ারের প্যাকার্ড), পি-৩৯ (১,১৫০ থেকে ১,৩২৫ হর্সপাওয়ারের এলিসন), এফ-৬এফ (২,০০০ থেকে ২,২০০ হর্সপাওয়ারের প্র্যাট এন্ড হুইটনি), এফ-৪ইউ (২,০০০ থেকে ২,৩০০ হর্সপাওয়াররের প্র্যাট এন্ড হুইটনি)। এখান থেকে যা পরিষ্কার হয় তা হলো, বিমানের ইঞ্জিনের উৎপাদনের সাথে বিমানের উৎপাদনের একতা সমন্বয় ঘটানো হয়েছিল। সবগুলি মডেলের ইঞ্জিন একই সংখ্যায় তৈরি করা যায়নি। কর্মক্ষমতা বাড়ানোটা যুদ্ধের সময়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে যায়। সেটা ধরে রাখতেই এক প্রকারের ইঞ্জিন বা এক প্রকারের বিমান তৈরি করা হয়নি। আর একারণেই ইউরোপে মার খাওয়া বিমান এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভালোই চালিয়ে নেয়া গিয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সবচাইতে মারাত্মক প্রাণীর মতোই। ইউরোপে বনের রাজা হতে গতি দরকার ছিল ৬৫০ কিঃমিঃ থেকে ৭০০ কিঃমিঃ; অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরে ৫৫০ কিঃমিঃ থেকে ৬০০ কিঃমিঃ-ই ছিল যথেষ্ট। একই যুদ্ধ; বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র!

http://www.airliners.net/photo/Mali-Air-Force/Embraer-A-29B-Super-Tucano-EMB-314/4115817
এমব্রায়ার-৩১৪ সুপার টুকানো বিমানগুলি আফ্রিকার বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে যেতে পারে, যদিও এশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে সুপারসনিক জেট বিমানের কাছে তা কিছুই নয়। মোটকথা যুদ্ধের সময় সকল যুদ্ধক্ষেত্রে সমহারে শক্তি মোতায়েন করা সম্ভব হবে না। তাই যেসব যুদ্ধাস্ত্র একেবারে বাতিল মনে হবে, সেটারও ব্যবহার দেখা যাবে অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে।
   

হিসেব পুরোনো হলেও সর্বদাই কার্যকর

যুদ্ধ যে সময়েই হউক না কেন, এই হিসেবগুলি থাকবেই। পুরোনো ইঞ্জিনগুলির উৎপাদন হঠাতই পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে নতুন ইঞ্জিন তৈরি করা যাবে না। তাই পুরোনো ইঞ্জিন উৎপাদন চলবে; সেকারণে পুরোনো বিমানের উতপাদনও চলবে। যারা যুদ্ধ করবে, তারাও এই ব্যাপারটাকে খেয়ালে রাখবে। যে যুদ্ধক্ষেত্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে বেশি শক্তিশালী এবং অপেক্ষাকৃত দামি বিমানগুলি দেয়া হবে। বাকিগুলিতে কম শক্তিশালী বিমান দিয়েই চালিয়ে নেয়া হবে।

আজকের এশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে হয়তো মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড হবে এফ-১৮ বা এফ-১৬ বা এফ-১৫। অন্যদিকে আফ্রিকায় এফ-৭, এফ-৫, মিরেজ-৩ বিমানগুলিও খারাপ করবে না। এমনকি এমব্রায়ার-৩১৪ সুপার টুকানো বা এয়ার ট্রাক্টর এটি-৮০২ বা আইওম্যাক্স আর্কেঞ্জেলের মতো প্রপেলার বিমানও চালিয়ে নেবে স্থানবিশেষে। শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে যতদিন পর্যন্ত এলটিটিই-এর হাতে বিমান-ধ্বংসী মিসাইল পড়েনি, ততোদিন শ্রীলঙ্কার বিমান বাহিনী ইতালির সিয়াই মার্চেট্টি এসএফ-২৬০ এবং আর্জেন্টিনার আইএ-৫৮ পুকারার মতো বিমান দিয়েই চালাচ্ছিল। প্রথম মিসাইল হামলার পর থেকে শ্রীলংকার বিমান বাহিনী ইস্রাইলের আইএআই কাফির, রাশিয়ার মিগ-২৭ এবং চীনের এফ-৭ জেট বিমান কেনে।  


 
ক্যামেরুন নৌবাহিনীর চীনা নির্মিত প্যাট্রোল বোট CNS Le Ntem (P-108)। এই জাহাজের সামনে রয়েছে ৭৬ মিঃমিঃ কামান, যা কিনা ৪৭ মিটার একটা বোটের জন্যে বেশ শক্তিশালী কামান। আফ্রিকার গিনি উপকূলে ৭৬ মিঃমিঃ কামান একটা শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্র। মিসাইল থাকলে তো আরও বেশি। এই কামানের কারণে একটা প্যাট্রোল বোটও গুরুত্বপূর্ণ একটা যুদ্ধজাহাজ। সকল যুদ্ধক্ষেত্রে রাজা হতে সমান শক্তির দরকার হয় না। তাই এক যুদ্ধ; অনেক যুদ্ধক্ষেত্র। এক যুদ্ধ; অনেক অস্ত্র।

নৌ অস্ত্রের ক্ষেত্রেও একই হিসাব চলবে। একস্থানে যেখানে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মাঝে প্রতিযোগিতা হবে, সেখানে অন্যখানে প্যাট্রোল বোটই বনে যাবে রাজা। সেখানে কোন প্যাট্রোল বোটে কতো মিঃমিঃ ক্যালিবারের কামান রয়েছে, সেখানে প্রতিযোগিতা হবে। ৭৬ মিঃমিঃ কামান থাকলে উপরে থাকা যাবে; ১০০ মিঃমিঃ কামান আরও উপরে তুলবে; ১২৭ মিঃমিঃ কামান রাজা বানাবে! আর কারো কাছে মিসাইল থাকলেও সে হবে সেই বনের রাজা! সাপ্লাই কম থাকায় সে মিসাইল গুণে গুণে ব্যবহার করবে। ৩০ মিটার-৫০ মিটার জাহাজের মাঝে ১০০ মিটারের জাহাজ হবে কমান্ডশিপ। জাহাজে হেলিকপ্টার থাকলে তা হবে ট্রাম্পকার্ড।

মোটকথা যুদ্ধের সময় সকল যুদ্ধক্ষেত্রে সমহারে শক্তি মোতায়েন করা সম্ভব হবে না। তাই যেসব যুদ্ধাস্ত্র একেবারে বাতিল মনে হবে, সেটারও ব্যবহার দেখা যাবে অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে। এবং যেহেতু কৌশলগত কারণে সেই যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা যাবে না, তাই যুদ্ধ চালিয়ে নিতে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী অস্ত্রই সেখানে চলবে।

এক যুদ্ধ; অনেক যুদ্ধক্ষেত্র। এক যুদ্ধ; অনেক অস্ত্র। সময় ভিন্ন; হিসেব এক।

Saturday 7 July 2018

ব্রিটেন যেভাবে ব্রাজিলের জন্ম দিয়েছিল


ব্রাজিলের প্রথম পতাকা - ১৮২২ সাল। রাজা পেদ্রোর অধীনে ব্রাজিলের এই পতাকার সবুজ এবং হলুদ রঙ রাজা এবং রানীর পর্তুগীজ এবং অস্ট্রিয়ান রাজবংশের রঙ থেকে নেয়া। ব্রাজিলের আজকের পতাকাতেও এই রঙ চলছে। 
 
৭ই জুলাই ২০১৮

ব্রাজিল বিশ্ব মানচিত্রের বড় একটি দেশ। আমাজন নদী এবং আমাজন জঙ্গলের দেশ ব্রাজিল। ৮৫ লক্ষ বর্গ কিঃমিঃ-এর চেয়েও বড় ব্রাজিলের এলাকা, যা প্রায় ৫৮টা বাংলাদেশের সমান! ২১ কোটির মতো এর জনসংখ্যা, যা পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম জনবহুল দেশ। ২,১৪০ বিলিয়ন ডলারের এর অর্থনীতি, যা পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম। তবে ১০,২২৪ মার্কিন ডলারের মাথাপিছু আয় অনেক দেশের চাইতেই কম। ৫ কোটিরও বেশি মানুষ সেখানে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। তবুও ব্রাজিল প্রযুক্তিগত দিক থেকে বেশ এগিয়ে। দেশটি পৃথিবীর নবম বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুতকারী দেশ। এর প্রতিরক্ষা ইন্ডাস্ট্রির খ্যাতি রয়েছে বিশ্বব্যাপী। ব্রাজিল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হাল্কা অস্ত্র রপ্তানিকারক। ব্রাজিলের বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এমব্রায়ার বিমান তৈরি করে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে। ব্রাজিলের সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৩ লাখের কিছু বেশি। তবে রিজার্ভ ১৩ লাখেরও বেশি। ২৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট পৃথিবীর ১১ বৃহত্তম। ৬০ হাজার নাবিকের ব্রাজিলিয়ান নৌবাহিনী পৃথবীর সবচাইতে বড় নৌবাহিনীগুলির একটি। ফ্রিগেট-কর্ভেট-ওপিভি মিলিয়ে এসকর্ট জাহাজ রয়েছে ১৪টা, সাবমেরিন ৫টা, বড় আকারের উভচর যুদ্ধজাহাজ ৫টা। ৭৭ হাজার সেনার বিশাল বিমান বাহিনীতে স্বল্প ক্ষমতার ৯০টা হাল্কা ফাইটার এবং ৩১টা প্রপেলার কাউন্টার ইন্সারজেন্সি বিমান ছাড়া বাকিটা মূলত ১৩০টা পরিবহণ বিমান, ৯৪টা হেলিকপ্টার এবং ১৭৫টা প্রশিক্ষণ বিমান।

এতবড় দেশ; এতবড় অর্থনীতি; প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ব রাজনীতিতে ব্রাজিলের নাম এতো কম শোনা যায় কেন? হ্যাঁ, ‘ব্রিকস’ নিয়ে কিছুদিন বেশ হৈচৈ হলেও সেটা এখন ফাইলবন্দীই বলা চলে। ব্রাজিলের এই বাস্তবতা বুঝতে ব্রাজিলের জন্মের দিকে তাকাতে হবে। তার জন্মই বলে দেয় যে ব্রাজিল কি করবে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকায় অবতরণের পর থেকে ইউরোপিয়রা আমেরিকায় নিজেদের দখলদারিত্ব কায়েমের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, তার মাঝে অগ্রগামী ছিল পর্তুগীজরা। তারা দক্ষিণ আমেরিকায় বর্তমান ব্রাজিলের উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ১৮০৭ সাল পর্যন্ত ব্রাজিল পর্তুগালের একটা বড় উপনিবেশের ভূমিকাই পালন করেছে। তবে হিসেব পাল্টে যায় রাজা ষষ্ঠ জনের সময়কালে।

ষষ্ঠ জন (ষষ্ঠ জোয়াও) পর্তুগাল এবং ব্রাজিলের অধিকর্তা হন বটে, তবে ন্যাপোলিয়নের আবির্ভাবে তার ভাগ্যে উত্থান-পতন চলতে থাকে। ফরাসী-স্প্যানিসরা পর্তুগাল আক্রমণ করলে ব্রিটিশদের নিরাপত্তায় জন ব্রাজিলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। 
  

পর্তুগালের রাজা, নাকি ব্রাজিলের রাজা?

পর্তুগালের প্রিন্স ষষ্ঠ জন (ষষ্ঠ জোয়াও)-এর জন্ম ১৭৬৭ সালে। দেশ চালাচ্ছিলেন তার মা প্রথম মারিয়া। তবে ১৭৮৬ সাল থেকে রানী মারিয়ার মানসিক সমস্যা সকলের সামনে দৃশ্যমান হতে থাকে। সেই একই বছর তিনি তার স্বামী তৃতীয় পিটারকে হারান। ১৭৮৮ সালে মারিয়ার বড় ছেলে হোজে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে জন হয়ে যায় সিংহাসনের পরবর্তী প্রার্থী। ১৭৯২ সালে পর্তুগীজ রাষ্ট্রীয় লোকজনের সিদ্ধান্তে ১৭ জন ডাক্তার একত্রে রানীকে রাজ্য চালানোর জন্যে মানসিকভাবে অযোগ্য ঘোষণা করেন। তারা জনকে ক্ষমতা নিতে বলে। ২৫ বছর বয়সে জন পর্তুগালের ‘প্রিন্স রিজেন্ট’ বা নায়েব উপাধি নিয়ে দেশ শাসন শুরু করেন।

তখন ফরাসী বিপ্লবের পরপর ইউরোপ অস্থির। ব্রিটেন ইউরোপে রাজতন্ত্রের পূনপ্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর; পর্তুগাল ও স্পেন তার সাথে রয়েছে। চতুর্দিকে যুদ্ধ চালাচ্ছে ফ্রান্সের রেভোলিউশনারি সরকার। ফ্রান্স-স্পেনের সীমান্তে তখন চলছে যুদ্ধ। ১৭৯৫ সালে স্পেন ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে হেরে গেলে ভূরাজনীতিতে বড়সড় পরিবর্তন হয়। স্পেন ফ্রান্সের সাথে শান্তি চুক্তি করে ফ্রান্সের দলে ভিড়ে গেলেও ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে বলে পর্তুগাল চুক্তি করেনি; তারা ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মাঝে নিরপেক্ষ থাকার নীতি নেয়। এই নীতি পর্তুগালকে বাঁচাতে পারেনি। ১৭৯৯ সালে ন্যাপোলিয়ন ফ্রান্সে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নিলে পর্তুগালের উপর কালো ছায়া নেমে আসে। ন্যাপোলিয়ন স্পেনকে বাধ্য করেন পর্তুগালকে আল্টিমেটাম দিতে, যাতে পর্তুগালের ব্রিটেনের সংগ পরিত্যাগ করে। ১৮০১ সালে ফ্রান্সের সমর্থনে স্পেন পর্তুগাল আক্রমন করে আলোচনার টেবিলে বসাতে বাধ্য করে।

জন সকল দিক থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তার স্ত্রী কারলোটা জোয়াকিনা ছিলেন স্প্যানিস রাজবংশের। তিনি চাইছিলেন তার স্বামী জনকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে সিংহাসন নিয়ে নিতে। ফ্রান্স এবং স্পেনের চাপের মুখে জন ব্রিটেনের সাথে গোপনে চুক্তি করেন। চুক্তি মোতাবেক ফ্রান্স-স্পেন যদি পর্তুগালে হামলা করে বসে, তাহলে ব্রিটিশরা পর্তুগালের রাজপরিবারকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ব্রাজিলে চলে যেতে সহায়তা করবে। ১৮০৭ সালের অক্টোবরে খবর আসে যে ফরাসী সেনাবাহিনী পর্তুগালের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ১৬ই নভেম্বর ব্রিটিশ রয়াল নেভির একটা স্কোয়াড্রন সাত হাজার সৈন্য নিয়ে লিসবন বন্দরে এসে পৌঁছায়। ফরাসী জেনারেল জঁ-আন্দোশে জুনো ৩০শে নভেম্বর লিসবন পৌঁছে দেখেন যে পর্তুগীজ রাজপরিবার তল্পিতল্পাসহ জাহাজে উঠে পালিয়েছে। পর্তুগীজ জনগণ এটা মেনে নিতে পারেনি যে তাদের নেতা এভাবে তাদের ছেড়ে যাবেন। ১৫টা জাহাজে বেশ কয়েক হাজার মানুষ গাদাগাদি করে উঠে রওয়ানা দেয়। এই সংখ্যা কত ছিল সেটা কেউ সঠিক বলতে না পারলেও সেটা ১৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে।

ষষ্ঠ জন-এর কোর্ট, রিও ডি জানেইরো, ব্রাজিল। জন তল্পিতল্পা সহ ব্রাজিলে পালিয়ে যাবার পর রাষ্ট্র পরিচালনার সকলকিছু ব্রাজিলের মাটিতে তৈরি করতে হয়েছিল। ১৩ বছর রিও থেকে শাসন করার পরে জন পর্তুগালে চলে গেলেও নতুন রাষ্ট্র ব্রাজিলের ভিত ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে।
  

ব্রাজিল – নতুন রাষ্ট্র তৈরির ভিত যেভাবে হলো

ব্রাজিল তখন ছিল পর্তুগীজ উপনিবেশ। এর মূল শহর রিও ডি-জানেইরো, যার জনসংখ্যা ছিল ৭০ হাজারের মতো। সেখানে রাজপরিবারসহ পুরো সরকারের সংকুলান হবার কোন অবস্থাই ছিল না। রাতারাতি শহরের বিরাট সংখ্যক বাড়িঘর দখল নিয়ে নেয়া হয়। রাজপরিবার এবং সম্ভ্রান্ত লোকজনের থাকার ব্যবস্থা করা হয় কোনরকমে। বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে রিও-তে। বহু অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার, ক্যান্টনমেন্ট ছাড়াও মিলিটারি একাডেমি, অপেরা হাউজ, মেডিক্যাল স্কুল, অস্ত্র কারখানা, প্রিন্টিং প্রেস, ইত্যাদি গড়ে উঠে। হঠাত উচ্চবংশীয় মানুষের ঢল আসায় দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকে হু-হু করে। তবে সবচাইতে বড় যে ব্যাপারটি হয় তা হলো, রিও যেখানে ছিল একটা ঔপনিবেশিক শহর, সেটা মুহুর্তের মাঝে হয়ে যায় একটা রাষ্ট্রের রাজধানী শহর। রিও-তে রাজধানী স্থানান্তর হওয়ায় সেখানে প্রায় সোয়া তিন লাখেরও বেশি ক্রীতদাসের আগমণ ঘটে। জন রিও-তে নেমেই ব্রাজিলের বন্দরগুলিকে ‘ওপেন’ ঘোষণা দেন, যার মাধ্যমে ব্রাজিলে ব্রিটিশ জাহাজের অবতরণ সহজ হয়ে যায়। রিও-তে জন-এর অবতরণের কারণেই ব্রাজিল পর্তুগাল থেকে আলাদা হবার জন্যে প্রস্তুত হয়। নতুন দেশের নামকরণ করা হয় ‘ইউনাইটেড কিংডম অব পর্তুগাল, ব্রাজিল এবং এলগার্ভেস’। বলাই বাহুল্য যে দেশের নামকরণ ব্রিটিশদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।


  
১৮০৭ সালে ন্যাপোলিয়নের ফ্রান্সের আক্রমণ থেকে রাজপরিবারকে রক্ষা করতে রাজা ষষ্ঠ জন তল্পিতল্পাসহ পর্তুগাল থেকে পালিয়ে যান। তাদের সহাহতা দেয় ব্রিটিশ রয়াল নেভি। ব্রাজিলের মাটিতে নেমেই জন ব্রিটেনকে বাণিজ্যিক এবং সামরিক সুবিধা দিতে থাকেন। একারণেই দক্ষিণ আমেরিকার স্প্যানিস উপনিবেশ ব্রিটিশরা ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করলেও ব্রাজিলকে ভাঙ্গেনি। তবে ব্রাজিলকে পর্তুগাল থেকে আলাদা করে দক্ষিণ আমেরিকার সবচাইতে বড় রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করেছে।  


ব্রিটিশরা যেভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলো

একই সময়ে ব্রিটিশরা তখন আর্জেন্টিনাসহ দক্ষিণ আমেরিকায় বাকি স্প্যানিস উপনিবেশগুলিকে স্পেন থেকে আলাদা করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল। জন-এর স্প্যানিস স্ত্রী কারলোটা এবার আর্জেন্টিনায় স্প্যানিস উপনিবেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেন এবং জনকে বাধ্য করেন উরুগুয়েতে যুদ্ধে (১৮১৭-১৮২১) অংশ নিতে। ব্রিটিশরা এসময়ে ব্রাজিলের সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে গায়ানার উপকূলের কিছু এলাকা দখল করে নেয় এবং ব্রাজিলের সাথে অযাচিত পদ্ধতিতে একচেটিয়া বাণিজ্য করে।

১৮১৫ সালে ন্যাপোলিয়নের পতন এবং ১৮১৬ সালে পর্তুগীজ রানী মারিয়ার মৃত্যুর পরে পর্তুগীজ রাষ্ট্রীয় লোকজন জনকে পর্তুগালে ফেরত আসার জন্যে চাপ দেয়। ১৮২১ সালের জুলাই মাসে জন ব্রাজিল থেকে লিসবনে এসে পৌঁছান। তিনি প্রায় ১৩ বছর ব্রাজিলে কাটান। তিনি এখন পর্তুগালের রাজা। ব্রাজিল ত্যাগের আগেই পর্তুগাল এবং ব্রাজিলে লিবারাল গোষ্ঠী ব্যাপক ক্ষমতা অর্জন করে এবং রাজার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কর্তন করে। সেসময় পর্তুগালের শাসনভার ন্যাস্ত ছিল ব্রিটিশ সামরিক অফিসার মার্শাল উইলিয়াম কার বেরেসফোর্ড। জন পর্তুগালে ফেরত যাবার পর প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশদের ছায়াতলেই তাকে থাকতে হয়েছে।

ব্রাজিলের রাজা পেদ্রোর অভিষেক অনুষ্ঠান, ১৮২২ সাল। পর্তুগালের সংবিধানের উপরে শপথ নিতে পেদ্রোকে বাধ্য করা হয়। পর্তুগালের সাথে ব্রাজিলের সম্পর্কও কর্তন হয়ে যায়নি অত সহজে। পেদ্রোর কন্যা পরবর্তীতে পর্তুগালের রানীও হন। তাদের সূত্রেই ১৯১০ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের শেষ রাজার শাসন চলেছিল।
 

ব্রাজিল – নতুন দেশ, নতুন রাজা, নতুন পতাকা

জন তার ছেলে পেদ্রোকে রিও-তে রেখে আসেন এবং বলে আসেন যে, পেদ্রো যেন ব্রাজিলের রাজা হয়ে যান; নাহলে অন্য কেউ পেদ্রোর স্থান নিয়ে নেবে। ব্রাজিলের জনগণ এতদিন রাষ্ট্রের মূলে থাকার সুবিধা পেয়েছে। এখন তারা রাজার পর্তুগালে চলে যাওয়াটা ভালোভাবে দেখেনি। ব্রাজিলে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা মূলত সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। তারা পেদ্রোকে রাজা হিসেবে রেখে ১৮২২ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পর্তুগালের সংবিধানের উপরে শপথ নিতে পেদ্রোকে বাধ্য করা হয়।

ব্রাজিলের জন্যে নতুন পতাকা নির্ধারিত হয়। পতাকার সবুজ জমিন এসেছে রাজা পেদ্রোর ব্রাগাঞ্জা বংশ (হাউজ অব ব্রাগাঞ্জা) থেকে আর হলুদ রঙ এসেছে পেদ্রোর স্ত্রী অস্ট্রিয়ার প্রিন্সেস মারিয়া লিওপোলডিনা-এর হ্যাপসবার্গ বংশ থেকে। ১৮৮৯ সালে ব্রাজিলিয়ান রিপাবলিক ঘোষণার আগ পর্যন্ত ব্রাজিলের এই পতাকাই থাকে। তবে ১৮৭০ সালে পতাকার মাঝের ১৯টি তারা থেকে ২০টি তারা করা হয় ব্রাজিলের রাজ্যের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে। ব্রাজিল রিপাবলিকের পতাকায় ২১টি তারা স্থান পায়, যা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একই থাকে। তবে ১৮৮৯ সালের নভেম্বরে কয়েকদিনের জন্যে আরেকটা পতাকার ডিজাইন আনা হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার আদলে তৈরি করা হয়েছিল। ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব ব্রাজিল’এর সেই পতাকা প্রতিযোগিতায় টেকেনি; বরং সেই পুরোনো ব্রাজিল রাজের পতাকাকেই পরিবর্তন করে নিয়ে নতুন পতাকা আঁকা হয়। ব্রাজিলের জনগণের মূল এখনও সেই পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়া-সহ ইউরোপের বাকি দেশগুলি। ঊনিশ এবং বিংশ শতকে ইউরোপ থেকে বহু মানুষ ব্রাজিলে এসে বসবাস শুরু করেছে। তাদের আকর্ষণ করেছে ব্রাজিলের ইউরোপিয়ান ভিত। তাদের কাছে ব্রাজিল হয়ে ওঠে বিষুবীয় অঞ্চলের ইউরোপ। ব্রাজিলের পতাকায় কেউ কেউ মানচিত্র বসাতে চেয়েছিল। সেটা সফল না হলেও পতাকায় ‘সাউদার্ন ক্রস’ তারকামন্ডলী এঁকে দিয়ে বলে দেয়া হয়েছে যে, ব্রাজিলের উপস্থিতি শুধুমাত্র দক্ষিণ গোলার্ধেই থাকবে।

ব্রাজিল রিপাবলিকের পতাকা (১৮৮৯-১৯৬০ সাল)। এই পতাকায় তারার সংখ্যা ছিল ২১টি। পরবর্তীতে আরও দুইবার পতাকাতে পরিবর্তন আনা হয় ২২তম এবং ২৩তম প্রদেশের কারণে। তবে সবুজ এবং হলুদ বহাল রাখা হয়, যা ব্রাজিল রাজের রাজবংশের প্রতিনিধিত্ব করে। 
 

ব্রিটেন যেভাবে ব্রাজিল তৈরি করেছে

পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়া উভয়েই বেশিরভাগ সময়ে ব্রিটেনের সাথে থেকেছে। তারা হয় ফ্রান্স বা রাশিয়া বা জার্মান আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে ব্রিটেনের সাথে থেকেছে। ব্রিটেন ইউরোপে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্সকে নিয়ন্ত্রণ করতে পর্তুগাল এবং অস্ট্রিয়াকে ব্যবহার করেছে। পরবর্তীতে জার্মানিকে নিয়ন্ত্রণ করতেও একই কাজ করেছে। ব্রাজিলের পর্তুগাল থেকে আলাদা হওয়াটা ব্রিটেনকেই সুবিধা দিয়েছে সবচাইতে বেশি। ন্যাপোলিয়ন ব্রিটেনের সাথে সারা বিশ্বে যুদ্ধে জড়িয়েছেন ঠিকই; তবে ব্রিটেনই এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছিল। ন্যাপোলিয়নের উত্থান ছিল এক ব্যক্তির উত্থান। স্পেনের সাথে যুদ্ধের সুবাদে পুরো ল্যাটিন আমেরিকার বাণিজ্যই ব্রিটেন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। পর্তুগালের রাজাকে রিও-তে বসিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের ভিত তৈরি করা, আর্জেন্টিনায় ব্রিটিশ সৈন্য নামিয়ে পুরো স্প্যানিস দক্ষিণ আমেরিকায় বিদ্রোহ উস্কে দেয়া, অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ প্রিন্সেসের সাথে ব্রাজিলের হবু রাজা পেদ্রোর বিয়ের ব্যবস্থা করে ব্রিটেনের বন্ধু অস্ট্রিয়ার জনগণকে দক্ষিণ আমেরিকায় আসতে আগ্রহী করে তোলা – এগুলি সকলই ছিল সুপারপাওয়ার হিসেবে ব্রিটেনের কর্মকান্ড। ব্রাজিলে পর্তুগালের রাজা, স্পেনে জন্ম নেয়া পর্তুগালের রানী এবং অস্ট্রিয়ার প্রিন্সেসের আগমনের ফলে ব্রাজিলের জনসংখ্যা বাকি ল্যাটিন আমেরিকার চাইতে অনেক বেড়ে যায়। আরও এসেছে ইতালি এবং জার্মানি থেকে। ১৮৮০ থেকে ১৯৬৯-এর মাঝে মোটামুটি ৯০ বছরে পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি এবং জার্মানি থেকে ৪১ লাখেরও বেশি লোক ব্রাজিলে এসেছে। এছাড়াও অন্যান্য দেশ থেকে এসেছিল সাড়ে ১০ লাখ মানুষ। ব্রাজিল হয়ে ওঠে ল্যাটিন আমেরিকার সবচাইতে জনবহুল দেশ। ব্রাজিল কোনভাবে ভেঙ্গে ছোটও হয়নি। অন্যদিকে স্প্যানিসদের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলি অনেকগুলি দেশে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় সেগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। আবার পর্তুগালের সাথে ব্রাজিলের সম্পর্কও কর্তন হয়ে যায়নি অত সহজে। পেদ্রোর কন্যা পরবর্তীতে পর্তুগালের রানীও হন। তাদের সূত্রেই ১৯১০ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের শেষ রাজার শাসন চলেছিল।


১৮৮৯ সালের নভেম্বরে কয়েক দিনের জন্যে 'ইউনাইটেড স্টেটস অব ব্রাজিল'এর পতাকা। বলাই বাহুল্য যে এই পতাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার আদলে তৈরি করা। এই পতাকা ব্রাজিলকে নিয়ে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ।


ল্যাটিন আমেরিকায় ব্রিটিশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব

ল্যাটিন আমেরিকায় এই কর্মকান্ডের মাঝে ব্রিটেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকে ব্রিটেনের কাছ থেকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কলম্বিয়া, পেরু, বলিভিয়া এবং ব্রাজিলে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হতে থাকে, যা তাকে ব্রিটেনের সামনে দাঁড় করায়। পানামকে যুক্তরাষ্ট্র নিজ হাতে তৈরি করেছে পানাম খাল তৈরি করার নিমিত্তে। এই খালের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূলের মাঝে সামুদ্রিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। অন্যদিকে ব্রিটেন ক্যারিবিয়ান সাগরে কিছু দ্বীপ দখলে রেখে এই অঞ্চলের সমুদ্র বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে চেয়েছে। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিজেদের হাতে রেখে ম্যাজেলান প্রণালীর সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। চিলিকে নিজেদের অধীনে রেখে পুরো ল্যাটিন আমেরিকার উপরেই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করেছে।



ব্রাজিলের জন্ম ব্রিটেনের নীতির মাঝ দিয়ে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার বেশিরভাগ শক্তি হারিয়েছে বটে, তবে একেবারে মৃত হয়ে যায়নি। এখনও ব্রিটিশরা প্রভাবের জন্যে মার্কিনীদের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ল্যাটিন আমেরিকার বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ-মার্কিনীরা। ব্রাজিল আকারে বড় হলেও সুপারপাওয়ারের রাজনীতির শিকার। কারণ সুপারপাওয়ারের হাতেই তার জন্ম হয়েছিল প্রায় দু'শ বছর আগে। কিন্তু দু'শ বছর পরেও ব্রাজিল সুপারপাওয়ারের দিকেই চেয়ে থাকে। বিশ্বরাজনীতিতে ব্রাজিলের পদচারণা সুপারপাওয়ারের ইচ্ছার ব্যাতিরেকে নয়। 


আরও পড়ুনঃ
ভেনিজুয়েলা-কলম্বিয়া-ইকুয়েডরের পতাকা একইরকম কেন?
আর্জেন্টিনা কি পারবে?