০৯ই সেপ্টেম্বর ২০২২
ছয় মাস পরেও আকাশে ডগফাইট চলছে কেন?
‘দ্যা ড্রাইভ’ ম্যাগাজিনের সামরিক সেকশন ‘দ্যা ওয়ার জোন’এর এক লেখায় সামরিক বিশ্লেষক থমাস নিউডিক আলোচনা করেন যে, ইউক্রেনের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ডনবাস এলাকায় এখনও আকাশে দুই পক্ষের ফাইটার বিমানের মাঝে ডগফাইট চলছে। তিনি ইউক্রেনে অবস্থানরত ‘দ্যা ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর সাংবাদিক ম্যাথিউ লাক্সমুরএর টুইটারে পোস্ট করা একটা ভিডিওর বিশ্লেষণ করছিলেন। গত ১৯শে অগাস্ট পোস্ট করা এই ভিডিওতে দেখানো হয় যে, একটা ‘সুখোই’ ফাইটার বিমান থেকে একত্রে দু’টা আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হচ্ছে। দুইজন ফাইটার পাইলটের মতামতের উপর ভর করে নিউডিক যে ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়েছেন তা হলো, ক্ষেপণাস্ত্রগুলি আকাশে আরেকটা বিমানের বিরুদ্ধে ছোঁড়া হয়েছে। যদিও সাংবাদিক লাক্সমুর বলেছেন যে, ইউক্রেনের পোকরোভস্ক শহরের উপরে এই ডগফাইট চলার সময় আকাশে দু’টা বিমান দেখা গিয়েছিল, ভিডিওতে অবশ্য একটা বিমানই দেখা যায়। আর যদিও তিনি বলছেন যে, দেখা যাওয়া বিমানটা ইউক্রেনের, তথাপি এটা সন্দেহ করা যেতে পারে; কারণ এই উচ্চতায় ইউক্রেনের যেকোন যুদ্ধবিমান রুশ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেটে পরিণত হবে। তবে এই বিমানটা ইউক্রেনিয় হোক আর রুশ হোক যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, ছয় মাস যুদ্ধের পরেও রাশিয়া ইউক্রেনের আকাশের উপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি; বা সামরিক ভাষায় ইউক্রেনের আকাশে রাশিয়া ‘এয়ার সুপেরিয়রিটি’ বলবত করতে পারেনি।
নিরাপত্তা ম্যাগাজিন ‘নাইনটিন ফোরটি-ফাইভ’এর এক লেখায় সামরিক বিশ্লেষক সেবাস্টিয়ান রোবলিন মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, যুদ্ধের শুরুতে যখন ইউক্রেনের হাতে ছিল সর্বসাকুল্যে ১’শ ১০টা যুদ্ধবিমান; আর রাশিয়ার কাছে ছিল ১২’শ যুদ্ধবিমান, তখন কেউই চিন্তা করেনি যে, ছয় মাস পরেও ইউক্রেনের আকাশে দুই পক্ষের বিমান উড়বে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সন্মুখীন হবার পর উভয় পক্ষই এখন তাদের বিমান পরিচালনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি ভূমিতে অবস্থিত টার্গেটে আক্রমণের উপর সীমাবদ্ধ রেখেছে।
কার কত ক্ষতি হয়েছে?
ডাচ সামরিক ওয়েবসাইট ‘ওরিক্স স্পিঊনকপ’এর স্টাইন মিতজার এবং তার দল ‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স’এর মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির একটা হিসেব রাখছে। তাদের হিসেবে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার কমপক্ষে ৫১টা ফাইটার বিমান ধ্বংস হয়েছে; যার মাঝে বেশিরভাগই হলো এটাক এয়ারক্রাফট ‘সুখোই-২৫’ (২১টা), ‘সুখোই-৩৪’ (১০টা) এবং মাল্টিরোল ফাইটার ‘সুখোই-৩০এসএম’ (১০টা)। এছাড়াও রুশরা কমপক্ষে ৪৯টা হেলিকপ্টার হারিয়েছে; যার মাঝে রয়েছে ‘এমআই-৮’ (১২টা) পরিবহণ হেলিকপ্টার; ‘কেএ-৫২’ (১৬টা), ‘এমআই-২৮’ (৭টা), ‘এমআই-৩৫এম’ ও ‘এমআই-২৪পি’ (৮টা) এটাক হেলিকপ্টার। অপরপক্ষে ইউক্রেন হারিয়েছে কমপক্ষে ৪১টা ফাইটার ও প্রশিক্ষণ বিমান; যার মাঝে সর্বোচ্চ হলো ১১টা ‘মিগ-২৯’ ফাইটার, ১১টা ‘সুখোই-২৪এম’ এটাক ফাইটার, ৯টা ‘সুখোই-২৫’ এটাক ফাইটার। এছাড়াও ইউক্রেন কমপক্ষে ১৪টা হেলিকপ্টারও হারিয়েছে।
সেবাস্টিয়ান রোবলিন বলছেন যে, এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন উৎস বলছে যে, বেশিরভাগ বিমানই ভূমি থেকে গোলা নিক্ষেপের ফলে ভূপাতিত হয়েছে। হাতে গোণা কয়েকটা বিমানের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সেগুলি ডগফাইটে ভূপাতিত হয়েছে; বাকিগুলির দাবি থাকলেও নিশ্চিত করে বলা কঠিন। উভয় পক্ষের বিমানগুলিই শত্রুপক্ষের শক্তিশালী বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। যেকারণে তাদের বিমানগুলির কার্যক্রম নির্দিষ্ট কিছু এলাকার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এর অর্থ হলো ইউক্রেনিয়দের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেখানে ভালো, সেখানে রুশরা আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। ঠিক একারণেই এখনও ইউক্রেনের বিমান বাহিনী আকাশে বিমান ওড়াতে পারছে এবং সংখ্যার দিক থেকে বহুগুণে শক্তিশালী রুশদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতেও সক্ষম হচ্ছে।
‘ওরিক্স স্পিঊনকপ’এর হিসেবে রুশরা কমপক্ষে ১’শ ২৪টা মনুষ্যবিহীন ড্রোন হারিয়েছে। এর মাঝে বেশিরভাগই হলো ‘ওরলান ১০’ (৮১টা), যেগুলি ১৫ কেজি ওজনের ক্যাটাগরির ছোট ড্রোন। এর চাইতেও ছোট ‘এলেরন-৩’ ড্রোন তারা হারিয়েছে ১৩টা; আর অপেক্ষাকৃত কিছুটা বড় ৩১ কেজি ওজনের ‘ওরলান-৩০’ ড্রোন হারিয়েছে ৩টা। ইউক্রেনও কমপক্ষে ৩৪টা ড্রোন হারিয়েছে; যার মাঝে সবচাইতে বেশি হলো তুর্কি ‘বায়রাকতার টিবি-২’ এটাক ড্রোন।
এছাড়াও উভয় পক্ষই একটা বড় সংখ্যার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হারিয়েছে। রুশরা বিভিন্ন প্রকারের কমপক্ষে ৭১টা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা হারিয়েছে; যার মাঝে সবচাইতে বেশি হলো ৫ কিঃমিঃ পাল্লার ‘৯কে৩৫ স্ট্রেলা-১০’ (১৩টা), ১৮ কিঃমিঃ পাল্লার ‘পান্তশির এস-১’ (১০টা), ১২ কিঃমিঃ পাল্লার ‘৯এ৩৩০ টর’ (৮টা), এবং ৪২ থেকে ৫০ কিঃমিঃ পাল্লার ‘৯এ৩১৭ ও ৯এ৩৯এম-১ বুক’ (১২টা)। ১৪টা বিভিন্ন প্রকারের রাডার এবং ১৪টা বিভিন্ন প্রকারের জ্যামারও রয়েছে রুশ ক্ষয়ক্ষতির মাঝে। অপরপক্ষে ইউক্রেনও বিভিন্ন প্রকারের কমপক্ষে ৪৫টা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা হারিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ইউক্রেনের ক্ষতি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি হয়েছে। কারণ তারা কমপক্ষে ২৪টা দূরপাল্লার ‘এস-৩০০’ ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার হারিয়েছে। এর সাথে ২২টা বিভিন্ন প্রকারের রাডারও রয়েছে।
ইউক্রেনের এত ক্ষতির পরেও রাশিয়া কেন আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি?
ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর বেশিরভাগ ফাইটার বিমান এবং একটা বড় সংখ্যক বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার পরেও রুশরা ইউক্রেনের আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখানেই পুরো যুদ্ধের শিক্ষণীয় ব্যাপারগুলি রয়েছে। ‘ব্রেকিং ডিফেন্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধের প্রথম দুই মাসেই যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ১৪’শর বেশি ‘স্টিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে। এছাড়াও ব্রিটিশরাও ‘স্টার স্ট্রীক’ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি নিচ দিয়ে ওড়া বিমানের জন্যে মারাত্মক হুমকি। রাশিয়ার ধ্বংস হওয়া ৪৯টা হেলিকপ্টারের মাঝে কতগুলি ‘স্টিংগার’ বা ‘স্টার স্ট্রীক’ ক্ষেপণাস্ত্রের শিকার, তা জানা না গেলেও এটা অনুমেয় যে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলির উপস্থিতি রুশদেরকে আরও সাবধান হতে বাধ্য করেছে। বিভিন্ন ওপেন সোর্স ভিডিওতে নিচ দিয়ে ওড়া রুশ হেলিকপ্টারগুলিকে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হতে দেখা গিয়েছে।
একদিকে ইউক্রেন বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহ পেয়েছে পশ্চিমা দেশগুলির কাছ থেকে; আবার বিভিন্ন উৎস থেকে নানা প্রকারের মনুষ্যবিহীন ড্রোন পেয়েছে, যা কিনা শত্রুর উপর তাদের নিখুঁতভাবে টার্গেটিং করা সম্ভব করে দিয়েছে। এছাড়াও তারা বিভিন্ন বাণিজ্যিক উৎস থেকে স্যাটেলাইট ছবি পেয়েছে; যা ব্যবহার করে ইউক্রেনিয়রা রুশদের সামরিক অবস্থানসমূহের উপর নজরদারি করতে সক্ষম হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিনীদের সরবরাহকৃত ‘হিমারস’ দূরপাল্লার আর্টিলারি রকেট রুশদের রসদ সরবরাহের উপর মারাত্মক প্রভাব রাখতে পেরেছে ভালো ইন্টেলিজেন্সের সুবাদেই। এছাড়াও নিখুঁত ইন্টেলিজেন্স পাবার ফলে ইউক্রেনিয়রা রুশদের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে টার্গেট করে হত্যা করেছে; যা কিনা রুশদের যুদ্ধক্ষেত্রের নেতৃত্বকে সমস্যায় ফেলেছে।
আকাশ শক্তি এখন শুধুমাত্র বৃহৎ শক্তিদের হাতেই নয়
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক বিশ্লেষণে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে আকাশ শক্তির ব্যাপারে কিছু শিক্ষা বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। ইউক্রেনের আকাশ যুদ্ধ নিয়ে কাউন্সিলের অনেকজন বিশ্লেষকের লেখার উপর ভিত্তি করে করা এই বিশ্লেষণে কয়েকটা বিষয়কে হাইলাইট করা হয়।
প্রথমতঃ এতকাল আকাশ এবং মহাকাশ যুদ্ধের বিভিন্ন অংশ, যেমন – আর্থিক, সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত, এবং বৈজ্ঞানিক সক্ষমতার দিক দিয়ে দেখলে শুধুমাত্র বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলিকেই সক্ষম বলে মনে করা হতো। ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আকাশ ও মহাকাশের অনেক সক্ষমতাই এখন বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে; যেকারণে এহেন সক্ষমতা এখন অনেক ছোট এবং মধ্যম সাড়ির দেশের হাতেই চলে এসেছে। যেসব দেশের হাতে মহাকাশ সক্ষমতা নেই, তারাও এখন বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের কাছ থেকে ছবি পেয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুই এখন সামরিক এবং বেসামরিক দুই জায়গাতেই ব্যবহৃত হয়; যা কিনা অপেক্ষাকৃত কম খরচেই পাওয়া যাচ্ছে।
অপেক্ষাকৃত কম খরচায় তৈরি তুর্কি ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোনগুলি মোটামুটি কর্মসম্পাদন করে ফেলতে পারছে। এগুলি হারালেও ক্ষতি কম; কারণ অপেক্ষাকৃত স্বল্প খরচেই তা প্রতিস্থাপন করে ফেলা যাচ্ছে। এগুলির অনেক যন্ত্রাংশই বেসামরিক খাতে ব্যবহৃত হয়; তাই খরচ যেমনি কম, তেমনি সরবরাহও সহজ।
দ্বিতীয়তঃ গত কয়েক দশকের মাঝে পশ্চিমারা রাডারে ধরা না পড়া স্টেলথ যুদ্ধবিমান, তথ্যের দিক থেকে এগিয়ে থাকা এবং নিখুঁতভাবে টার্গেটের উপর হামলা করার সক্ষমতার উপর ভর করে সংখ্যার ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলো। মনে করা হচ্ছিল যে, প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে থাকতে পারলে সংখ্যার দিক থেকে কম থাকলেও চলবে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, পুরো ব্যাপারটাই এখন উল্টো দিকে হাঁটছে। এখন বরং আকাশে অপেক্ষাকৃত কম খরচের জিনিসগুলি বেশি সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে; যেগুলি কিছু হারালেও সংখ্যার দিক থেকে খুব বড় ক্ষতি হচ্ছে না।
আকাশের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়াটা যথেষ্ট কষ্টের কাজ; এতে ক্ষয়ক্ষতি হয় যথেষ্ট। ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ভূমিতে অবস্থিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সংখ্যাধিক্যের কারণে উভয় পক্ষের কেউই আকাশের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হচ্ছে না। কাজেই ভবিষ্যতে কে কত দ্রুত নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সক্ষম হয়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। অপেক্ষাকৃত দামী মনুষ্যচালিত এবং অপেক্ষাকৃত কমদামি মনুষ্যবিহীন বিমানের মাঝে কোনটা থাকবে, আর কোন থাকবে না, সেটা নিয়েও অনেক কথা চলছে আরও আগে থেকেই।
তৃতীয়তঃ বৈশ্বিকভাবে কে কতটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারছে, সেটার উপর নির্ভর করছে যে কে কতটা সম্পদ যুদ্ধের সময়ে কাজে লাগাতে সক্ষম হবে। এর মাঝে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এবং জনগণও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এদিক দিয়ে দুনিয়াতে এগিয়ে থাকলেও বেসরকারি সংস্থা, বন্ধু দেশ এবং ব্যবসায়িক সংগঠনের সাথে মার্কিনীদের কিছু দূরত্ব রয়ে গেছে।
চতুর্থতঃ আকাশ যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইন্টেলিজেন্স অপারেশন, সাইবার আক্রমণ এবং ইলেকট্রনিক জ্যামিংএর মতো কাজগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলি দেখা যায় না। অথচ এগুলি প্রতিপক্ষের আকাশ নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে দিতে সক্ষম। ইউক্রেন যুদ্ধে জনসন্মুখে এসেছে প্রধানতঃ ড্রোনের ফুটেজগুলি; যেগুলি প্রচারণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য, উভয় ক্ষেত্রেই ইউক্রেন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কারণে তা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে অনেক বড় সহায়তা দিয়েছে।
পঞ্চমতঃ ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, প্রযুক্তিগত কারণে সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর কাজের পরিধি একত্রে মিলে যাচ্ছে। এই দুই বাহিনীর কাজের মাঝে অনেক ক্ষেত্রেই পার্থক্য করা যাচ্ছে না। ভূমি থেকে ভূমিতে দূরবর্তী টার্গেটে হামলা করা এখন আরও সহজ হয়েছে। দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং দূরপাল্লার আর্টিলারি ব্যবহারের কারণে সেনাবাহিনী অনেক ক্ষেত্রেই বিমান বাহিনীর সহায়তা ছাড়াই টার্গেট ধ্বংস করে ফেলতে পারছে। একারণে বিমান বাহিনীর কাছ থেকে যখন আকাশের নিয়ন্ত্রণ আশা করা হচ্ছে, তখন এও আশা করা হচ্ছে যে, বিমান বাহিনী নিচু দিয়ে ওড়া শত্রুপক্ষের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনগুলিকে ধ্বংস করবে। অর্থাৎ অপেক্ষা নিচু দিয়ে ওড়া এই টার্গেটগুলিকেও আকাশ নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে ধরতে হবে। এই নিচু দিয়ে ওড়া জিনিসগুলির সাথে যখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যুক্ত হবে, তখন নতুন ধরণের নেটওয়ার্ক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে; যেখানে বিমান বাহিনীর দায়িত্বের সাথে অন্যান্য বাহিনীর দায়িত্ব দ্বন্দ্বে জড়াতে পারে।
মার্কিন বিমান বাহিনী – পুরোনো ধারণা ছেড়ে দেয়া কঠিন
‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’ তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর সামরিক কর্মকর্তাদের ডেকে তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চায়। মার্কিন বিমান বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ লেঃ জেনারেল ক্লিনটন হাইনোট এক আলোচনা অনুষ্ঠানে কাউন্সিলের কিছু নতুন ধারণার সাথে মোটামুটি সম্মতি পোষণ করেন। বিশেষ করে আকাশ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তিনি নতুন করে চিন্তা করার কথাও বলেন। হাইনোট বলেন যে, যদি আকাশ কারুর নিয়ন্ত্রণেই না থাকে, তাহলে সেটা কোন একটা পক্ষকে অপারেশনাল এবং কৌশলগত দিক থেকে এগিয়েও দিতে পারে। তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন যে, চীন তাইওয়ানের ব্যাপারে যে পরিকল্পনা করছে, সেখানে তাইওয়ানের আশেপাশের সমুদ্র, তাইওয়ানের উপর আকাশ এবং ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে। যদি চীন এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম না হয়, তাহলে হয়তো তাইওয়ান চীনা আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হতে পারে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে তাইওয়ানের আকাশের নিয়ন্ত্রণ কারুর হাতে না থাকলে তাইওয়ানের জন্যে অনেক বড় সুবিধা হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এটা তাইওয়ানের জন্যে ডিটারেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে, যদি চীন মনে করে যে তারা তাইওয়ানের আকাশকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে না। জেনারেল হাইনোট আকাশ নিয়ন্ত্রণের উচ্চ খরচের উল্লেখ করে বলেন যে, এর চাইতে কম খরচে শত্রুকে আকাশের নিয়ন্ত্রণ নেয়া থেকে বিরত রাখা যেতে পারে।
কিন্তু জেনারেল হাইনোটের সাথে বিমান বাহিনীর প্রাক্তন জেনারেল ফিলিপ ব্রীডলাভ পুরোপুরিভাবে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন যে, আকাশের নিয়ন্ত্রণ যদি মার্কিনীদের হাতে না থাকে, তাহলে মার্কিন সামরিক সদস্যরা বিপদের মাঝে পড়বে। তিনি উল্লেখ করেন যে, তার পরিবারের পাঁচ সদস্য বর্তমানে সামরিক বাহিনীতে রয়েছে। তিনি কখনোই চাইবেন না যে তার পরিবারের সদস্যরা এমন কোথাও যুদ্ধ করতে যাক, যেখানে আকাশের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নেই। জেনারেল ব্রীডলাভের মতো অনেকেই যে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত চিন্তাটার বিরুদ্ধে যেতে চাইবে না, সেব্যাপারে অবশ্য জেনারেল ক্লিনটন হাইনোট আগেই শতর্কবাণী দিয়েছিলেন। আর বিমান বাহিনীতে মনুষ্যচালিত এবং মনুষ্যবিহীন বিমানের ব্যবহারের ব্যাপারটাও বেশ সংবেদনশীল। কারণ বিমান বাহিনী পাইলটদের মাঝে বাহিনীর একটা পরিচয় দেখতে পায়; যা কিনা মনুষ্যবিহীন বিমানের মাঝে তারা দেখতে পায় না।
আকাশ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে মার্কিন বিমান বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের দ্বিমত থাকলেও ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতিগুলি কাজে লাগাবার ব্যাপারে খুব বেশি বিরোধ নেই। বিমান বাহিনীর প্রাক্তন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা লেঃ জেনারেল ভেরালিন জেমিসন ‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স’ ব্যবহারের পক্ষে কথা বলেন। তিনি বলছেন যে, প্রকৃতপক্ষে এধরনের তথ্যের ব্যবহার কয়েক দশক আগেই শুরু হয়েছে। এর মূল কারণ হলো মানুষের হাতে স্মার্ট ফোন এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তি চলে আসার ফলে বিপুল পরিমাণে তথ্য এখন খোলা বাজারেই পাওয়া যাচ্ছে। এই তথ্যগুলি কোন গোপন অপারেশনের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হচ্ছে না। আর বিগত বছরগুলিতে এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে অনেকেই বিশ্লেষক হয়ে গিয়েছে। ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষণ এখন কোন গোপন বিষয় নয়।
ইউক্রেন যুদ্ধে অনেকগুলি প্রযুক্তিই প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত না হলেও সেগুলি কিভাবে কোথায় ব্যবহার করা হবে এবং এর ফলাফল কিরকম হতে পারে, তার কিছু নতুন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। আর রাশিয়ার মতো একটা বড় শক্তি এই যুদ্ধে জড়িত থাকার ফলে এধরণের প্রযুক্তিগুলি ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় কিভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, সেটার ব্যাপারে কিছু শিক্ষা এই যুদ্ধ থেকে আসছে। বিশেষ করে আকাশের নিয়ন্ত্রণ না নিয়েও আকাশকে নিজের পক্ষে রাখা সম্ভব, তা ইউক্রেন যুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। একইসাথে ড্রোনের মতো প্রযুক্তিগুলি সেনা এবং বিমান বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকাগুলির মাঝে আবারও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। তবে সম্ভবতঃ সবচাইতে বড় শিক্ষা হলো, আকাশ ব্যবহার করে যুদ্ধ করতে হলে কাউকে বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্র হতে হবে না। পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিভিন্ন সামরিক প্রযুক্তিকে বাণিজ্যিকিকরণের কারণে অনেক উন্নত প্রযুক্তিই এখন মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে; যা কিনা একসময় শুধুমাত্র বৃহৎ রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীই তৈরি এবং ব্যবহার করতে পারতো। এই ব্যাপারটা ‘এয়ার সুপেরিয়রিটি’ বা আকাশ নিয়ন্ত্রণের চিন্তাটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে; যা এখন মার্কিন সামরিক চিন্তাবিদদেরকে বিভক্ত করছে।
আগা গোড়া ইউক্রেনকে গ্লোরিফাই করে লেখা। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ইউক্রেন তার ভূমি হারাচ্ছেই। ইউক্রেনে ন্যাটো বাহিনী ২০১৪ থেকেই অপারেশনাল। তাই ইউক্রেন যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তার পুরো কৃতিত্ব ন্যাটোর।
ReplyDeleteআর বাণিজ্যিক সহায়তা পাবার কথা ফলাও করে বলছেন। সেটাও আমেরিকার অনুমতি ছাড়া পাবা সম্ভব না।
নিরপেক্ষ তথ্য প্রকাশের আহবান জানাচ্ছি।
আশা করবো কমেন্ট করার আগে এই ব্লগে কি ধরণের লেখা রয়েছে, সেগুলি বিবেচনা করে কমেন্ট করবেন।
Deleteনিচে এই ব্লগ থেকে দু'টা ছোট্ট প্যারা তুলে দেয়া হলো...
"যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই জানে যে, ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে রুশ বাহিনীকে ইউক্রেন থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব নয়; তবে দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়াকে ইউক্রেনে আটকে রাখা সম্ভব। ট্যাংক, আর্টিলারি এবং যুদ্ধবিমান সরবরাহ করে হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের কোন আশা ইউক্রেনকে দেখাতে ইচ্ছুক নয় যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ রুশ বাহিনীর ইউক্রেন ত্যাগই চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র! বিশ্বব্যবস্থা ধরে রাখতে হিমসিম খাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানে মূল লক্ষ্য হলো চীনকে নিয়ন্ত্রণ। এমতাবস্থায় চীনের সমর্থনে ইউক্রেনে হেরে যাওয়া বা জিতে যাওয়া রাশিয়া নয়; অথবা ন্যাটো সীমানায় যুদ্ধংদেহী রাশিয়াও নয়; বরং ইউক্রেনের কাদায় লম্বা সময়ের জন্যে আটকে যাওয়া রাশিয়াই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অধিক শ্রেয়।"
https://koushol.blogspot.com/2022/04/does-usa-really-want-ukraine-to-win-against-russia.html
"প্রকৃতপক্ষে বাইডেন যখন বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রয়োজন, তখন তিনি বর্তমান বিশ্ব অব্যবস্থায় সুপারপাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটা বিকল্প সমাধান তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ইউক্রেনের যুদ্ধকে বাইডেন গণতন্ত্রের লড়াই তকমা দেয়ায় পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা ভুল ধরেছেন। এতে মার্কিন বন্ধুরাও ব্যাপক সমালোচনা করছে। কিন্তু সেটাও তো বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দৈন্যতাকে আলোচনায় নিয়ে এসে বিকল্পের সন্ধান করার অনুপ্রেরণা যোগায়। সেক্ষেত্রে পুতিনের ক্ষমতায় থাকা উচিৎ বা অনুচিত এই কথাগুলি আলোচনায় এনে মিডিয়া গণতন্ত্রের সমস্যাগুলিকে আড়াল করে আসল আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছে; যা হলো, এই বিশ্ব পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলা উচিৎ কি উচিৎ নয়। যদি উচিৎ হয়, তাহলে কার নেতৃত্ব জাতীয় স্বার্থ জ্বলাঞ্জলি দিয়ে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ বাস্তবায়িত হবে; আর যদি উচিৎ না হয়, তাহলে কোন ব্যবস্থা এর বিকল্প হওয়া উচিৎ?"
https://koushol.blogspot.com/2022/03/is-ukraine-war-really-fight-for-democracy.html