Tuesday 29 March 2022

ইউক্রনের যুদ্ধ কি সত্যিই গণতন্ত্র রক্ষার জন্যে লড়াই?

২৯শে মার্চ ২০২২

ইউক্রেনের যুদ্ধকে বাইডেন গণতন্ত্রের লড়াই তকমা দেয়ায় পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা ভুল ধরেছেন। কিন্তু সেটাও তো বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দৈন্যতাকে আলোচনায় নিয়ে এসে বিকল্পের সন্ধান করার অনুপ্রেরণা যোগায়। সেক্ষেত্রে পুতিনের ক্ষমতায় থাকা উচিৎ বা অনুচিত এই কথাগুলি আলোচনায় এনে মিডিয়া গণতন্ত্রের সমস্যাগুলিকে আড়াল করে আসল আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছে; যা হলো, এই বিশ্ব পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলা উচিৎ কি উচিৎ নয়। যদি উচিৎ হয়, তাহলে কার নেতৃত্ব জাতীয় স্বার্থ জ্বলাঞ্জলি দিয়ে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ বাস্তবায়িত হবে; আর যদি উচিৎ না হয়, তাহলে কোন ব্যবস্থা এর বিকল্প হওয়া উচিৎ?

গত ২৭শে মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ সফরের সময় তার ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে বলেন যে, ‘ঈশ্বরের কসম! এই লোকটা ক্ষমতায় থাকতে পারে না!’ কথাগুলি বলার প্রায় সাথেসাথেই হোয়াইট হাউজ থেকে বলা হয় যে, বাইডেন অবশ্যই পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার কথা বলছিলেন না। বাইডেনের অভ্যন্তরীণ সমালোচকেরা বলতে শুরু করেছেন যে, বাইডেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করতে চাইছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ এই সুযোগে বলেন যে, এটা দায়িত্বশীল বক্তব্য নয়। বরং তিনিই এর চাইতে ভালো কূটনীতি চালাতে পারেন। তবে অনেকেই পুতিনের ক্ষমতায় না থাকার ব্যাপারে বাইডেনের কথাগুলিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করলেও তারা হয়তো খেয়াল করছে না যে, এর আগে বাইডেন যখন ইউক্রেনের যুদ্ধকে গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, সেটার গুরুত্ব ছিল আরও সুদূরপ্রসারী।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রধান ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, বাইডেন হয়তো তার লিখিত ভাষণের বাইরেই আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিলেন যে, পুতিনের ক্ষমতায় থাকা উচিৎ নয়। সেটা হয়তো আবেগের কথাই ছিল। এর গুরুত্ব কিছুটা কমই হবে; কারণ পুতিনকে প্রতিস্থাপিত করার মতো সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। এই একই যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সাথে সংঘর্ষ এড়াবার জন্যে ইউক্রেনের উপর ‘নো-ফ্লাই জোন’ করতে বা ইউক্রেনকে রক্ষা করতে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করতে চাইছে না। কথাগুলি বরং ক্রেমলিনের তথ্যযুদ্ধে সহায়তা দেবে। তবে এর আগে যখন তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধকে গণতন্ত্রের জন্যে যুদ্ধ বলেছেন, তখন সেটা আবেগতাড়িত হয়ে বললেও এর ছায়া পড়বে বিশ্বব্যাপী। বাইডেন বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটা নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রয়োজন। রাশিয়াকে ‘জি২০’ বের করে দেয়া উচিৎ। বাইডেন সম্ভবতঃ ইউক্রেনের যুদ্ধের গুরুত্বকে বাড়াবার জন্যেই গণতন্ত্র বাঁচাবার সংগ্রাম বলেছেন। কিন্তু তার বোঝা উচিৎ ছিল যে, বিশ্বের বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নেই। ১’শ ৪১টা দেশ জাতিসংঘে রাশিয়ার নিন্দা করলেও শুধুমাত্র ধনী দেশগুলি রাশিয়ার উপর অবরোধের পক্ষে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা নিরপেক্ষ থেকেছে; চীন পুরোপুরিভাবে রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে। বাইডেন অবশ্যই চাইবেন না রাশিয়া এবং চীনের সাথে একটা ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হোক; কারণ এতে সকলেই, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখন বিশ্বের সামনে গণতন্ত্রের মডেল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামনের নির্বাচনে যেই হারবে সেই বলবে যে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। বাইডেনের কথাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব কমাতে ইন্ধ্বন যোগাবে।

ওবামা প্রশাসনের সময়কার মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিআইএ’র প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত প্রধান মাইকেল মোরেল মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল ‘সিবিএস’কে বলেন যে, বাইডেন যখন বলেন যে, পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হবে, সেটা ছিল একটা মস্তবড় ভুল, যা তার উপরে কেউ চাপিয়ে দেয়নি। এতে নিজ দেশে পুতিনের হাত শক্তিশালী হয়েছে। এতে পুতিনের বিরুদ্ধে যেকোন বিরোধীদের একত্রিত হওয়াটা কঠিন হয়ে যায়। কোন রুশ নাগরিকই চাইবে না যে, রাশিয়া প্রধান শত্রু দেশের প্রেসিডেন্ট বলে দিক যে, তার নেতৃত্ব কেমন হওয়া উচিৎ। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হওয়া উচিৎ আরও ছোট পরিসরে; অর্থাৎ দাবি হওয়া উচিৎ রাশিয়ার ইউক্রেন ছাড়ার; এবং রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করার যাতে করে পুতিন এহেন কাজ আবারও না করেন। গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের কথাগুলি চীনাদেরকে রাশিয়ার কাছে নিয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, মার্কিনীদের অনেক বন্ধু রয়েছে যারা একনায়ক; এদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দাঁড়ানোটা তখন কঠিন হয়ে যায়।

ভারতীয় মিডিয়া ‘এনডিটিভি’র এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, বাইডেনের গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করার কথাগুলি কতটা সততার উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত; এবং কতটা দ্বিমুখী নীতি এখানে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ার হাইড্রোকার্বনের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্র এখন সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকছে। কারণ নিজের দেশে জ্বালানির মূল্যের স্বল্প বৃদ্ধিও বাইডেন প্রশাসনের জন্যে ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। অথচ এর আগে সৌদি আরবের মানবাধিকার ইস্যুতে, বিশেষ করে ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যার ঘটনায়, বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবের উপর চাপ প্রয়োগ করেছে। এরপর রয়েছে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো, যার উপর যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। অথচ এখন জ্বালানির বিকল্প খুঁজতে গিয়ে একটা উচ্চপদস্থ মার্কিন প্রতিনিধিদল ভেনিজুয়েলার রাজধানী কারাকাস ঘুরে এসেছে। ‘এনডিটিভি’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের মাঝে সাংঘর্ষিক অবস্থান নতুন নয়; তবে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে তার পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রাখার কথা বলেছেন। যদিও অনেকেই বলেছেন যে, এটা মূলতঃ চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যেই বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন।

গত ডিসেম্বরে বাইডেনের ডাকা গণতন্ত্র শীর্ষবৈঠকের মাঝে আমন্ত্রিত দেশগুলির ৩০ শতাংশেরই গণতান্ত্রিক আদর্শ রক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এমনকি ভারতীয় সরকারের গণতান্ত্রিক রেটিংও সাম্প্রতিক সময়ে নিম্নগামী ছিল। ‘এনডিটিভি’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে এটা হাস্যকর যে এই একই যুক্তরাষ্ট্র মাত্র কয়েক মাস আগেই আফগান জনগণকে তালিবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। বহুকাল যাবতই যুক্তরাষ্ট্র মিশর, সৌদি আরব, বাহরাইন, আরব আমিরাত এবং অন্যান্য দেশের অগণতান্ত্রিক সরকারগুলিকে সমর্থন দিয়ে গেছে। পৃথিবী দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবার কারণে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতে বাধ্য হয়েছে। যখন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন হামলার নিন্দা প্রস্তাবে রুশ ভেটো দেয়ার সমালোচনা করছে, তখন তারা ভুলে যাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একসময় গ্রেনাডা, নিকারাগুয়া এবং পানামার উপর মার্কিন হামলা এবং লেবাননে ইস্রাইলের আগ্রাসনের নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। ইয়েমেন, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য দেশের মানুষজন মার্কিন সরবরাহকৃত অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত মার্কিন বন্ধুদের দ্বারা হামলার শিকার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে, কোন একটা দেশ মিথ্যা কারণ দেখিয়ে অন্য দেশে আগ্রাসন চালাতে পারে না। অথচ হাস্যকর যে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রচুর মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছে। ‘এনডিটিভি’ বলছে যে, এটা বাস্তব সত্য যে, পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয় একটা দেশের জাতীয় স্বার্থ দ্বারা; গণতন্ত্রের আকাশকুসুম চিন্তা দ্বারা নয়, যদিও অনেকে সেটাই চাইতে পারে। ভারতীয় কর্মকর্তারাও বলছেন যে, ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়াকে সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্তটা ভারত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই তার জাতীয় স্বার্থেই নিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে বাইডেন যখন বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রয়োজন, তখন তিনি বর্তমান বিশ্ব অব্যবস্থায় সুপারপাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটা বিকল্প সমাধান তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ইউক্রেনের যুদ্ধকে বাইডেন গণতন্ত্রের লড়াই তকমা দেয়ায় পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা ভুল ধরেছেন। এতে মার্কিন বন্ধুরাও ব্যাপক সমালোচনা করছে। কিন্তু সেটাও তো বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দৈন্যতাকে আলোচনায় নিয়ে এসে বিকল্পের সন্ধান করার অনুপ্রেরণা যোগায়। সেক্ষেত্রে পুতিনের ক্ষমতায় থাকা উচিৎ বা অনুচিত এই কথাগুলি আলোচনায় এনে মিডিয়া গণতন্ত্রের সমস্যাগুলিকে আড়াল করে আসল আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছে; যা হলো, এই বিশ্ব পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলা উচিৎ কি উচিৎ নয়। যদি উচিৎ হয়, তাহলে কার নেতৃত্ব জাতীয় স্বার্থ জ্বলাঞ্জলি দিয়ে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ বাস্তবায়িত হবে; আর যদি উচিৎ না হয়, তাহলে কোন ব্যবস্থা এর বিকল্প হওয়া উচিৎ?

ইউক্রেন যুদ্ধ… রুশ কৌশলে বড় পরিবর্তন?

২৯শে মার্চ ২০২২

কিয়েভের বাইরে বুচায় রুশ সামরিক গাড়ির ধ্বংসস্তূপ। রাশিয়া এখন বাধ্য হচ্ছে একটা করে টার্গেট নিয়ে এগুতে। বর্তমানে দক্ষিণের মারিউপোল শহর এখন তাদের ফোকাস; এরপর তারা খুব সম্ভবতঃ খারকিভের দিকে মনোযোগ দেবে। এরপর তারা হয়তো নীপার নদী বরাপর উত্তর দিকে ধাবিত হয়ে খারকিভের সাথে মিলিত হতে চেষ্টা করবে, যাতে করে ডনবাসে ইউক্রেনের সকল বাহিনীকে ঘিরে ফেলা যায়। যদি রুশরা খারসন শহর ধরে রাখতে পারে, তাহলে তারা হয়তো একটা যুদ্ধবিরতির দিকে যেতে পারে, যার মাঝে ডনবাস থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত যোগাযোগের নিয়ন্ত্রণ রুশদের হাতে থাকবে।

একমাস যুদ্ধের পর গত ২৫শে মার্চ রুশ নেতৃত্ব বলছে যে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে তাদের সামরিক মিশনের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। ঘোষণায় বলা হচ্ছে যে, রুশরা এখন পূর্বের ডনবাস অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করবে। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর রাফায়েল লস ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ইউক্রেনের সেনারা রুশ সাপ্লাই লাইনগুলিকে চাপের মাঝে রেখেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তারা রুশ বাহিনীকে ঘিরে ফেলার অবস্থায়ও নিয়ে গেছে। এমতাবস্থায় রুশরা হয়তো তাদের সামরিক অপারেশনকে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করছে; যাতে করে তাদের ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়। তবে তারা যদি ডনবাসকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে তারা অবশ্যই কিয়েভের উপর নতুন করে ফোকাস দেবে। কৌশল পরিবর্তনের ঘোষণা হয়তো স্বল্প মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্যে সন্মান বাঁচাবার চেষ্টা হতে পারে। তবে তিনি গত দু’বছরে ইউক্রেন নিয়ে যেধরনের মন্তব্য করেছেন, তাতে এটা নিশ্চিত যে, ইউক্রেন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। পুতিন বলেছেন যে, ইউক্রেনিয়ানদের পরিচয় রুশ পরিচয় থেকে আলাদা নয়। এমতাবস্থায় পুতিন নিশ্চিতভাবে দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেনের উপর চাপ অব্যাহত রাখবেন।

‘ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন’এর প্রফেসর এগলায়া স্নেতকভ বলছেন যে, গত একমাসের যুদ্ধে মনে হচ্ছে যে, রুশরা প্রায় তিন বা চারটা ভিন্ন স্ট্র্যাটেজি বা বড় পরিসরে কৌশল নিয়ে এগিয়েছে। এই কৌশলগুলি হয়তো এখন সফল হচ্ছে না বলেই পূর্ব ইউক্রেনের সাথে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করাটা এখন তাদের জন্যে মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যোগাযোগের লজিস্টিক্যাল দিকটা হয়তো রুশদের জন্যে ব্যবস্থাপনা করা অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ হতে পারে। এই মুহুর্তে রুশ জনগণও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভ্লাদিমির পুতিনের উপর দোষারোপ না করে পশ্চিমাদের উপর দোষারোপ করছে। কাজেই জনমত হয়তো এখনও পুতিনের সাথেই রয়েছে, যদিও রুশ শীর্ষ নেতৃত্বের মাঝে একটা বোধ এসেছে যে, প্রাথমিকভাবে যে লক্ষ্য নিয়ে তারা এগিয়েছে, সেটা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে হয়তো জনগণ প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু সেটা যুদ্ধের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান নয়। আর এই মুহুর্তে পুতিনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করার মতো কেউ রয়েছে বলেও মনে হয় না; যদিও পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে সময় লাগে না।

মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিআইএ’র প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল ডেভিড পেট্রেয়াস কানাডার টেলিভিশন চ্যানেল ‘সিবিসি’কে বলছেন যে, রাশিয়ার সামরিক অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল রাজধানী কিয়েভ দখল করা, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং একটা রুশ সমর্থিত সরকারকে তার স্থলাভিষিক্ত করা। তবে এখন পর্যন্ত রুশরা কিয়েভের বাইরে অবস্থান করছে, খারকিভকেও ঘিরে ফেলতে পারেনি, যদিও তারা দক্ষিণে কিছু সফলতা পেয়েছে; যেমন মারুউপোলকে ঘিরে ফেলেছে, ডনবাসের নিয়ন্ত্রণের কাজেও তারা বেশকিছু এগিয়েছে। দক্ষিণের এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেবার পর তারা হয়তো সৈন্য সরিয়ে উত্তর এবং পূর্বের এলাকাগুলিতে মোতায়েন করতে পারে। কমপক্ষে ৭ জন জেনারেল পদের সেনা কর্মকর্তার নিহত হবার খবর পাওয়া যায়; তাদের ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার সেনাও হয়তো নিহত হয়েছে। রাশিয়ার নিজস্ব অর্থনীতিও মারাত্মক সমস্যায় পতিত। এমতাবস্থায় তারা ইউক্রেনের সাথে কোন একটা সমঝোতার মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ করতে চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা হয়তো বলতে পারে যে, ২০১৪ সালে দখলকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সাথে ডনবাস অঞ্চলের সরাসরি স্থলপথ নিশ্চিত হয়ে গেলেই অপারেশনের লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যাবে। তারা হয়তো ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর ওডেসা দখলের চেষ্টাটাও বাদ দিতে পারে।

 

ডাচ অনলাইন সামরিক ম্যাগাজিন ‘ওরিক্স’এর স্টাইন মিতজার এবং তার দল ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে হিসেব করেছেন যে, যুদ্ধে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি কমপক্ষে কত হতে পারে। রুশরা এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২ হাজার সামরিক গাড়ি হারিয়েছে; যার মাঝে প্রায় ১ হাজার ধ্বংস হলেও প্রায় ৭’শ ৩৫টা ইউক্রেনিয়ানরা দখল করেছে। এই গাড়ির মাঝে ৩’শ ১৫টা ছিল ট্যাংক; যেগুলির মাঝে ১’শ ৪০টা ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; আর বাকি ১’শ ৭৫টা ইউক্রেনিয়ানরা দখল করেছে, অথবা রুশরা ফেলে চলে গেছে। এছাড়াও রুশরা কমপক্ষে ৬’শ ১৫টা অন্যান্য সাঁজোয়া যান; ৬১টা ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি; ৬৩টা ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; ৬৪টা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; ১’শ ৪৪টা আর্টিলারি ও রকেট; ১৭টা যুদ্ধবিমান; ৩৫টা হেলিকপ্টার; ১৬টা মনুষ্যবিহীন ড্রোন; ৩টা যুদ্ধজাহাজ; আরও ৭’শ ৬টা সামরিক গাড়ি; ইত্যাদি আরও অনেক কিছু হারিয়েছে। অপরদিকে ইউক্রেন হারিয়েছে কমপক্ষে ৫’শ ৭৪টা গাড়ি; যার মাঝে রয়েছে ৭৯টা ট্যাংক; ১’শ ৪৯টা অন্যান্য সাঁজোয়া যান; ৫১টা ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র; ৪৭টা আর্টিলারি ও রকেট; ২১টা বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র; ১২টা যুদ্ধবিমান; ১টা হেলিকপ্টার; ৯টা মনুষ্যবিহীন ড্রোন; ১৩টা যুদ্ধজাহাজ; ২’শ ১৮টা অন্যান্য সামরিক গাড়ি; ইত্যাদি আরও অনেক কিছু।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র সিনিয়র ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, রাশিয়া এখন বাধ্য হচ্ছে একটা করে টার্গেট নিয়ে এগুতে। বর্তমানে দক্ষিণের মারিউপোল শহর এখন তাদের ফোকাস; এরপর তারা খুব সম্ভবতঃ খারকিভের দিকে মনোযোগ দেবে। এরপর তারা হয়তো নীপার নদী বরাপর উত্তর দিকে ধাবিত হয়ে খারকিভের সাথে মিলিত হতে চেষ্টা করবে, যাতে করে ডনবাসে ইউক্রেনের সকল বাহিনীকে ঘিরে ফেলা যায়। যদি রুশরা খারসন শহর ধরে রাখতে পারে, তাহলে তারা হয়তো একটা যুদ্ধবিরতির দিকে যেতে পারে, যার মাঝে ডনবাস থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত যোগাযোগের নিয়ন্ত্রণ রুশদের হাতে থাকবে। তবে নীপার নদী বরাবর কোন অপারেশনই সহজ হবে না; ইউক্রেনিয়ানরা এটাকে প্রবলভাবে প্রতিহত করতে চাইবে। আপাততঃ তারা অন্যদিকে গুরুত্ব দিলেও ভবিষ্যতে তারা রাজধানী কিয়েভের দিকে মনোযোগ দেবে। যারা এই মুহুর্তে যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষপাতি, তারা হয়তো কিয়েভের নেতৃত্বকে দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়ার কাছে কিছু সুবিধা ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক থাকবে। অপরদিকে ইউক্রেনের নেতৃত্ব মনে করবে যে, রুশদের আপাততঃ লক্ষ্য ছোট করে আনার অর্থ হলো নিজেদের বৃহত্তর উচ্চাকাংক্ষাগুলিকে ভবিষ্যতের জন্যে জিইয়ে রাখা। তবে প্রশ্ন হলো যে, পশ্চিমারা এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে কতটা একমত হতে পারবে।

Thursday 24 March 2022

ইউক্রেনের আকাশে তুর্কি ড্রোনগুলি কতটুকু সফল?

২৪শে মার্চ ২০২২

রুশ অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কমদামি ধীরগতির ড্রোনের সফলতা দেখিয়ে দেয় যে, কোনকিছুই অজেয় নয়। তুর্কি ড্রোনের সফলতা নিশ্চিত করলো যে, সামনের দিনগুলিতে ইউক্রেনের আকাশে আরও বিভিন্ন আকারের এবং ধরণের ড্রোন দেখা যাবে; যার মাঝে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি সুইসাইড ড্রোনও থাকবে।

 
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই বেশকিছু ভিডিও সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে আকাশ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ভূমিতে বেশকিছু গাড়ির ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই ভিডিও ফুটেজগুলি ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর ড্রোন থেকে তোলা। তুরস্কের সরবরাহ করা ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোনগুলি ইউক্রেনের জন্যে অনলাইন প্রচারণার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ভাসিল বোদনার সোশাল মিডিয়াতে এরকমই একটা ভিডিও শেয়ার করেন এবং শিরোনামে লেখেন ‘মাশাআল্লাহ’! এছাড়াও ইউক্রেনিয়ানরা ‘বায়রাকতার’ নামে একটা গান রচনা করেছে। এই গানের ভিডিওতে ড্রোনের ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে। গানটা ইউক্রেন রেডিওতেও প্রচার করা হয়েছে। তবে এই ড্রোনগুলি প্রকৃতপক্ষে কতটুকু কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকেই।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র বিশ্লেষক জ্যাক ওয়াটলিং ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলছেন যে, তুর্কি ড্রোনগুলির ইউক্রেনে সাফল্য পাবার কোন অর্থই নেই। কারণ এই ড্রোনগুলি মধ্যম উচ্চতায় উড্ডয়ন করে, এদের ইলোকট্রোম্যাগনেটিক সিগনেচার যথেষ্ট বড় এবং এগুলির রাডার ক্রস সেকসেনও যথেষ্ট বড়। রুশদের বেশ শক্তিশালী একটা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, যা এই ড্রোনগুলিকে সহজেই ভূপাতিত করার কথা। এছাড়াও ইউক্রেনের ভূমিও বেশ সমতল; যেখানে পাহাড় বা অন্য কোন ভৌগোলিক বাধা না থাকার কারণে রাডারের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। তার ধারণা রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজেদের প্রস্তুতি শেষ করার আগেই এই ড্রোনগুলি আকাশে উড়ে সাফল্য পেয়েছে। তিনি বলছেন যে, ইউক্রেনের বিমান বাহিনী তুর্কি ড্রোনগুলিকে বেশ নিচু দিয়ে ওড়াচ্ছে; এরপর আক্রমণের ঠিক আগে উপড়ে উঠে সুবিধাজনক টার্গেটে হামলা করছে। তবে সামনের দিনগুলিতে রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজেদের শৃংখলা খুঁজে পেলে এই ড্রোনগুলির ওড়ার জায়গা সীমিত হয়ে আসবে। ইউক্রেনের বিমান বাহিনীকেও আরও সাবধান হতে হবে যে, তারা কোথায় কখন এই ড্রোনগুলিকে ব্যবহার করবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর ডিরেক্টর আরন স্টাইন বলছেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই ড্রোনগুলি উড়তে থাকবে, ততক্ষণ এগুলির একটা প্রচারণা মূল্য থাকবে। হাই ডেফিনিশনে বিমান হামলা দেখা যাবার কারণে এই ড্রোন ফুটেজগুলি আকর্ষণ ক্ষমতা বেশি। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৯ সালে তুর্কি কোম্পানি ‘বায়কার’ তাদের ড্রোনগুলি ইউক্রেনের কাছে বিক্রি শুরু করে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি এগুলির ডেলিভারি শুরু হয়। সেবছর অগাস্ট মাসে রাজধানী কিয়েভের রাস্তায় প্যারেডে ড্রোনগুলি প্রদর্শিত হয়। এর আগে সিরিয়া, লিবিয়া এবং ককেশাসের নাগোর্নো কারাবাখে এই ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোনগুলি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল। কিন্তু সেসব যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এবার ইউক্রেনের যুদ্ধে ব্যাপারটা পুরোপুরিভাবে আলাদা। রাশিয়া একটা বড় শক্তি এবং তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী বলেই সকলে মনে করেন। একারণেই পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা ইউক্রেনে ড্রোনগুলির সাফল্য দেখে বুঝে উঠতে পারছেন না যে ব্যাপারটা কি করে সম্ভব হচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হবার পর ৩রা মার্চ ইউক্রেন সরকার ঘোষণা দেয় যে, তারা তুরস্ক থেকে ড্রোনের নতুন একটা চালান পেয়েছে। তবে তারা ড্রোনের সংখ্যা বলেননি। তুর্কি কর্মকর্তারা রুশদের রক্তচক্ষু এড়াতে ঘোষণা দেন যে, একটা তুর্কি বেসরকারি কোম্পানি চুক্তি অনুযায়ী ডেলিভারি দিয়েছে। আর এরকম ড্রোন শুধু ইউক্রেন নয়, দুনিয়ার অনেক দেশেই বিক্রি করেছে তুর্কিরা। সঠিক সংখ্যা জানা না থাকলেও অনেকেই বলছেন যে, ২০ থেকে ৫০টার মতো ‘বায়রাকতার’ ড্রোন তুর্কিরা এপর্যন্ত ইউক্রেনকে সরবরাহ করেছে।

 
অগাস্ট ২০২১। কিয়েভের রাস্তায় তুর্কি 'বায়রাকতার টিবি-২' ড্রোন। অন্ততঃ শক্তিশালী রুশ বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে পশ্চিমারা যখন ইউক্রেনকে কোন বিমান দিচ্ছে না, তখন এই ড্রোনগুলিই রুশদের উপরে বিমান হামলার স্বাদ দিচ্ছে এবং ইউক্রেনিয়ানদের অনলাইন প্রচারণার কেন্দ্রে থাকছে। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা এই ড্রোনগুলি যে ইউক্রেনে কোনরূপ সাফল্য পেতে পারে, সেটা বিশ্বাসই করেননি।

মার্কিন মিডিয়া ‘এনবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং ড্রোন যুদ্ধের উপর বইএর লেখক ডেভিড হ্যাম্বলিং বলছেন যে, এই ড্রোনগুলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিমানের মতো। মাত্র ১’শ ১০ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিনচালিত এই ড্রোনগুলি অতি সহজেই টার্গেট করতে পারার কথা। সবচাইতে অবাক ব্যাপার হলো ড্রোনের ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, রুশ বিমানধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এই ড্রোনগুলি ধ্বংস করে ফেলছে! অথচ এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাগুলিই ড্রোন ভূপাতিত করার সবচাইতে ভালো অস্ত্র হবার কথা ছিল। এছাড়াও রুশ ইলেকট্রনিক জ্যামিং ব্যবস্থাও বেশ ভালো। সেগুলিও তো এই ড্রোনগুলিকে অকার্যকর করে ফেলার কথা। তিনি বলছেন যে, পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা খুব সম্ভবতঃ রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সক্ষমতাকে বড় করে দেখেছেন। হ্যাম্বলিং বলছেন যে, আর কিছু না হোক, অন্ততঃ রুশ ফাইটার বিমান দিয়েও তো এই ড্রোনগুলিকে ভূপাতিত করা যেতো। হয় রুশরা নিজেদের কাজে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে; অথবা ইউক্রেনিয়রা নতুন কোন ট্যাকটিকস খুঁজে পেয়েছে কার্যকর হামলার জন্যে।

সুইজারল্যান্ডের ‘ইটিএইচ জুরিখ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মাউরো গিলি ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, যেহেতু এহেন ড্রোনগুলিকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহজেই টার্গেট করতে পারে, তাই এগুলিকে রক্ষা করার জন্যে ইলেকট্রনিক জ্যামারের সমন্বয়ে কাজ করাটা জরুরি। লিবিয়াতে অবশ্য রুশরা বেশকিছু তুর্কি ড্রোন ভূপাতিত করেছিল। ইউক্রেনে এদের সাফল্য বলে দিচ্ছে যে, হয়তো রুশরা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাথে না নিয়ে এগুচ্ছে। এটা অসম্ভব নয়, কারণ রুশরা বেশ বড় রকমের লজিস্টিক্যাল সমস্যার মাঝে রয়েছে। অথবা এমনও হতে পারে যে, ইউক্রেনিয়ানরা অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক জ্যামার হাতে পেয়েছে।

এই ড্রোনগুলি পুরো যুদ্ধকে কতটা প্রভাবিত করবে, সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে ড্রোনগুলি আন্তর্জাতিক অস্ত্রের বাজারে তুরস্কের অবস্থানকে আরও উপরে উঠিয়েছে। একেকটা তুর্কি ‘বায়রাকতার’ ড্রোনের মূল্য প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার; যা আকাশে ওড়া যেকোন বিমানের মূল্যের তুলনায় কিছুই নয়। অন্ততঃ শক্তিশালী রুশ বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে পশ্চিমারা যখন ইউক্রেনকে কোন বিমান দিচ্ছে না, তখন এই ড্রোনগুলিই রুশদের উপরে বিমান হামলার স্বাদ দিচ্ছে এবং ইউক্রেনিয়ানদের অনলাইন প্রচারণার কেন্দ্রে থাকছে। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা এই ড্রোনগুলি যে ইউক্রেনে কোনরূপ সাফল্য পেতে পারে, সেটা বিশ্বাসই করেননি। রুশ অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কমদামি ধীরগতির ড্রোনের সফলতা দেখিয়ে দেয় যে, কোনকিছুই অজেয় নয়। তুর্কি ড্রোনের সফলতা নিশ্চিত করলো যে, সামনের দিনগুলিতে ইউক্রেনের আকাশে আরও বিভিন্ন আকারের এবং ধরণের ড্রোন দেখা যাবে; যার মাঝে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি সুইসাইড ড্রোনও থাকবে।

Wednesday 23 March 2022

ইউক্রেন যুদ্ধ… তুরস্ক আসলে কার পক্ষে?

২৩শে মার্চ ২০২২

২৮শে ফেব্রুয়ারি তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেন যে, তুরস্ক ১৯৩৬ সালের মনট্রিউ কনভেনশন মেনে চলছে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিংকেন কাভুসোগলুকে মনট্রিউ কনভেনশনকে সমুন্নত রাখার জন্যে এবং এর সপক্ষে বক্তব্য দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। কনভেনশন মেনে রুশ যুদ্ধজাহাজের জন্যে বসফরাস বন্ধ করে দেয়া ছাড়াও ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মাঝে আলোচনায় মধ্যস্ততা করার আগে তুরস্ক মার্কিন সমর্থন এবং উপদেশ নিয়েছে; যদিওবা মাত্র কয়েক মাস আগেই রাশিয়া থেকে ‘এস-৪০০’ ক্রয়ের ‘অপরাধে’ যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর অবরোধ দিয়েছে।

২৪শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরু করার দিনই ইউক্রেন তুরস্ককে বসফরাস এবং দার্দানেলিস প্রণালি রুশ জাহাজের জন্যে বন্ধ করে দেয়ার আহ্বান জানায়। এর চারদিন পর ২৮শে ফেব্রুয়ারি তুরস্ক বসফরাস এবং দার্দানেলিস প্রণালিকে সকল রাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজের জন্যে বন্ধ ঘোষণা করে। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু সাংবাদিকদের বলেন যে, তুরস্ক ১৯৩৬ সালের মনট্রিউ কনভেনশন মেনে চলছে। সেই অনুযায়ী তুরস্ক যখন কোন যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিচ্ছে, তখন তার অধিকার রয়েছে যুদ্ধে অংশ নেয়া পক্ষগুলির যুদ্ধজাহাজকে বসফরাস এবং দার্দানেলিস প্রণালি পার হতে বাধা দেয়ার। যদি কোন যুদ্ধজাহাজ কৃষ্ণ সাগরে নিজের ঘাঁটিতে ফেরত যায়, তবে সেক্ষেত্রে তুরস্ক কোন বাধা দেবে না। কাভুসোগলু বলেন যে, এর আগে রুশ সরকার তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিল যে, তুরস্ক মনট্রিউ কনভেনশন মেনে চলবে কিনা। তুরস্কের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল যে, তুরস্ক সেই কনভেনশন কঠোরভাবে মেনে চলবে। ‘নেভাল নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তুর্কি সরকার কনভেনশনের ‘আর্টিকেল ১৯’ অনুযায়ী যুদ্ধরত পক্ষগুলিকে যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে নিষেধ করেছে। তবে সকল দেশের যুদ্ধজাহাজ যাওয়া বন্ধ করার জন্যে তারা খুব সম্ভবতঃ ‘আর্টিকেল ২১’এর সরণাপন্ন হয়েছে; যেখানে বলা হয়েছে যে, তুরস্ক যদি যুদ্ধের হুমকির মাঝে পড়ে, তাহলে তারা বসফরাস বন্ধ করে দিতে পারে। তুরস্কের এই সিদ্ধান্তের পরপরই মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিংকেন কাভুসোগলুর সাথে ফোনালাপ করেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, ব্লিংকেন কাভুসোগলুকে মনট্রিউ কনভেনশনকে সমুন্নত রাখার জন্যে এবং এর সপক্ষে বক্তব্য দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ইউক্রেনকে সহায়তা দানের জন্যেও ব্লিংকেন তুরস্ককে ধন্যবাদ দেন। ইউক্রেনে রুশ সামরিক হামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই তুরস্কের গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে গেছে। যুদ্ধের আগে তুরস্কের সাথে যাদের দ্বন্দ্ব চলছিল, তাদের অনেকেই তুরস্ক সফর করেছেন; যা দেখিয়ে দেয় যে, যুদ্ধ অত্র অঞ্চলের বাস্তবতাকে কতটা পরিবর্তন করেছে।

৪ঠা মার্চ মার্কিন উপপররাষ্ট্র সচিব ওয়েন্ডি শেরমান তুরস্ক সফর করে তুর্কি প্রেসিডেন্টের প্রধান উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিনএর সাথে বৈঠক করেন। ‘আনাদোলু এজেন্সি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বৈঠকে উভয় পক্ষ যুদ্ধ বন্ধে আলোচনার জন্যে যৌথ প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করতে একমত হয়। কালিন বলেন যে, তুরস্ক যুদ্ধরত দুই দেশের মাঝে মধ্যস্ততা করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়াও দু’পক্ষ সিরিয়া, লিবিয়া এবং আফগানিস্তানের শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনা করে; এবং ইস্রাইলের সাথে তুরস্কের ও তুরস্কের সাথে আর্মেনিয়ার সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারেও আশা ব্যক্ত করা হয়।

 
৪ঠা মার্চ মার্কিন উপপররাষ্ট্র সচিব ওয়েন্ডি শেরমান তুরস্ক সফর করে তুর্কি প্রেসিডেন্টের প্রধান উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিনএর সাথে বৈঠক করেন। এটা পরিষ্কার যে মাত্র কিছুদিন আগেও যখন উসমানি খিলাফতের স্বপ্নে বিভোর তুর্কিদের আবেগের বাস্তবতাকে পুঁজি করে এরদোগান তুরস্ককে আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধের বাস্তবতাকে পুঁজি করে তিনি তার অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে লুকাবার চেষ্টা করে ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে নিজের অবস্থানকে কিছুটা হলেও শক্তিশালী করতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইস্রাইল, জার্মানি, ন্যাটো এবং গ্রিস সেই পরিবর্তিত বাস্তবতাকে ব্যবহার করেই তুরুস্কের সাথে আলোচনা করছে।


ইউক্রেন ও রাশিয়ার মাঝে আলোচনায় মধ্যস্ততা করার প্রচেষ্টা চালানোর জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাবার পর ১০ই মার্চ তুরস্কের আনতালিয়াতে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রথম বৈঠকের পর তুরস্কের গুরুত্ব যেন আরও একধাপ বেড়ে যায়! ১১ই মার্চ ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টলটেনবার্গ তুরস্ক সফর করে আসেন। ন্যাটোর এক সংবাদ বার্তায় বলা হচ্ছে যে, স্টলটেনবার্গ সফরকালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথে সাক্ষাৎ করে ন্যাটোর মাঝে তুরস্কের বিশেষ ভূমিকার প্রশংসা করেন। একইসাথে তিনি ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মাঝে আলোচনায় তুরস্কের মধ্যস্ততাকে এবং ইউক্রেনকে তুরস্কের সহায়তা দেয়াকে স্বাগত জানান।

স্টলটেনবার্গের তুরস্ক সফরের দুই দিনের মাথায় ১৩ই মার্চ আঙ্কারা যান গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিস। তুর্কি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর ইকনমিকস এন্ড ফরেন পলিসি স্টাডিজ’এর প্রেসিডেন্ট সিনান উলগেন ‘এএফপি’কে বলছেন যে, উভয় দেশের জন্যেই এই মুহুর্তে নিজেদের মাঝে নতুন করে কোন দ্বন্দ্ব একেবারেই অনভিপ্রেত। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর ফেলো আসলি আয়দিনতাসবাস বলছেন যে, উভয় দেশের নেতৃত্বই বুঝতে পারছে যে, তাদের আশেপাশের বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে গেছে। মাত্র তিন মাস আগেও ইউরোপিয় নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ এরকম ছিল না।

যদি মিতসোতাকিসের আঙ্কারা সফর নতুন কিছু ঠেকে, তাহলে আরও অবাক হবার কথা এর পরদিন ১৪ই মার্চ জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজের তুরস্ক সফরের খবরে। এক যৌথ সংবাদ সন্মেলনে শোলজ বলেন যে, দুই দেশ ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ্বের ব্যাপারে একমত এবং উভয় দেশই ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়েছে। তিনি বসফরাস প্রণালি সকল যুদ্ধজাহাজের জন্যে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে তুরস্ককে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তবে একইসাথে তিনি তুরস্কের সাথে দ্বন্দ্বের দিকগুলি, যেমন, মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং জার্মান নাগরিকদের বিরুদ্ধে তুরস্কের বিভিন্ন পদক্ষেপের ব্যাপারেও কথা বলেন। অপরদিকে এরদোগান মনে করিয়ে দেন যে, রাশিয়ার সাথে তুরস্কের বর্তমানে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রয়েছে, যা তারা ৫০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

 
৯ই মার্চ তুরস্ক সফরে আসেন ইস্রাইলের প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান সংবাদ সন্মেলনে এই সফরকে ঐতিহাসিক এবং দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্র বলে আখ্যা দেন। তিনি বিশেষ করে দুই দেশের মাঝে জ্বালানির ব্যাপারে সমঝোতার উপর গুরুত্ব দেন।


ইউক্রেন এবং রাশিয়ার প্রথম আলোচনার আগের দিন ৯ই মার্চ তুরস্ক সফরে আসেন ইস্রাইলের প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান সংবাদ সন্মেলনে এই সফরকে ঐতিহাসিক এবং দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্র বলে আখ্যা দেন। তিনি বিশেষ করে দুই দেশের মাঝে জ্বালানির ব্যাপারে সমঝোতার উপর গুরুত্ব দেন। সেই লক্ষ্যে সামনের দিনগুলিতে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ইস্রাইল সফর করবেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমনে দুই দেশের গুরুত্ব দেয়ার উপর জোর দেন। এছাড়াও তিনি দুই দেশের মাঝে মতভেদের বিষয়গুলিকে পারস্পরিক সন্মান ও খোলা মনের মাধ্যমে সুরাহা করার আশা ব্যক্ত করেন।

‘আল মনিটর’ বলছে যে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এহেন নীতি পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্তগুলির পিছনে রয়েছে অর্থনৈতিক দুর্দশা, যা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এছাড়াও ২০২৩ সালে রয়েছে তুরস্কের নির্বাচন, যেখানে ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’ যথেষ্ট শক্তিশালী বিরোধী গ্রুপের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, তুরস্ক ইউক্রেন যুদ্ধে এমন একটা অবস্থানে আছে, যা কৌশলগতভাবে সমর্থন করা গেলেও নৈতিক দিক থেকে অসমর্থনযোগ্য। লেখায় আরও বলা হচ্ছে যে, তুরস্ক রাশিয়ার সাথে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলতে চাইছে, যাতে প্রথমতঃ তুরস্কের গ্যাস সরবরাহ যেন ব্যাহত না হয়, এবং দ্বিতীয়তঃ সিরিয়াকে স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে যেন রাশিয়াকে পাশে পাওয়া যায়। আবার ইউক্রেনকেও তুরস্ক সমর্থন দিয়ে গেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোন সরবরাহ করেছে, যেগুলি রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু সাফল্যও পেয়েছে। এই কথাগুলিতে এটা পরিষ্কার যে, তুরস্ক কোন নীতি নয়, বরং স্বার্থকে বুঝে বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। একারণেই ১৯৩৬ সালের মনট্রিউ কনভেনশন মেনে রুশ যুদ্ধজাহাজের জন্যে বসফরাস বন্ধ করে দেয়া ছাড়াও ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মাঝে আলোচনায় মধ্যস্ততা করার আগে মার্কিন সমর্থন এবং উপদেশ নিয়েছে; যদিওবা মাত্র কয়েক মাস আগেই রাশিয়া থেকে ‘এস-৪০০’ ক্রয়ের ‘অপরাধে’ যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর অবরোধ দিয়েছে। এটা পরিষ্কার যে মাত্র কিছুদিন আগেও যখন উসমানি খিলাফতের স্বপ্নে বিভোর তুর্কিদের আবেগের বাস্তবতাকে পুঁজি করে এরদোগান তুরস্ককে আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন সংঘাতে জড়িয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধের বাস্তবতাকে পুঁজি করে তিনি তার অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে লুকাবার চেষ্টা করে ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে নিজের অবস্থানকে কিছুটা হলেও শক্তিশালী করতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইস্রাইল, জার্মানি, ন্যাটো এবং গ্রিস সেই পরিবর্তিত বাস্তবতাকে ব্যবহার করেই তুরুস্কের সাথে আলোচনা করছে।

Tuesday 22 March 2022

ইউক্রেন যুদ্ধ কি জার্মানির নীতির পরিবর্তন করিয়েছে?

২২শে মার্চ ২০২২

২৭শে ফেব্রুয়ারি জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ জার্মান পার্লামেন্ট বুন্দেস্টাগএ নতুন প্রতিরক্ষা নীতির ঘোষণা দেন। শোলজের নতুন প্রতিরক্ষা নীতি প্রকৃতপক্ষে আলদা কোন নীতি নয়। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জার্মানি শিশুমাত্র! ইউক্রেনের যুদ্ধ জার্মানির বাস্তবতা পরিবর্তন করে দিয়েছে; যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া বড় ভূমিকা নিয়েছিল এবং জার্মানি ছিল নিছক দর্শক। জার্মানি সেই পরিবর্তিত বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াবার চেষ্টা করছে মাত্র।

 
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর তিন দিন পর গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ জার্মান পার্লামেন্ট বুন্দেস্টাগএ নতুন প্রতিরক্ষা নীতির ঘোষণা দেন। তিনি বলেন যে, ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে জার্মানি নতুন এক যুগে প্রবেশ করলো। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জার্মান সরকারের এই অবস্থান অনেককেই অবাক করেছিল; কারণ বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই জার্মান সরকারকে সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষ না নেবার এবং আরও কঠোরভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ না করার ব্যাপারে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। শোলজ বলেন যে, সাম্প্রতিক ঘটনা এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে তার সর্বশেষ আলোচনার পর তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, রুশ প্রেসিডেন্ট একটা নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাইছেন; এবং এই মুহুর্তে গণতন্ত্র এবং শান্তি রক্ষার জন্যে ইউরোপের প্রয়োজন নিজেদের প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করা।

শোলজ এবছরেই জার্মান সামরিক বাহিনীকে আধুনিকীকরণ করার জন্যে ১’শ বিলিয়ন ইউরো বা ১’শ ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দেন। একইসাথে তিনি সামনের বছরগুলিতে জার্মান প্রতিরক্ষা বাজেটকে জিডিপির ২ শতাংশের উপরে তোলারও আশ্বাস দেন। ন্যাটো সদস্য হিসেবে জার্মানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা তাদের জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করবে। কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশের মতো জার্মানি সেই টার্গেটের ধারেকাছেও যায়নি। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আগের চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের ১৬ বছরের শাসনামলে জার্মানি রাশিয়ার সাথে সাবধানে সম্পর্ক রেখে চলেছে। বিশেষ করে রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত বল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইনের ব্যাপারেও দুই দেশের মাঝে সমঝোতা মার্কেলের আমলেই হয়েছিল। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় মার্কেল প্রতিরক্ষা খরচ বাড়াবার ব্যাপারে মার্কিন চাপকে উপেক্ষা করেছিলেন। মাত্র কিছুদিন আগ পর্যন্তও জার্মানি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দানে বিরত ছিল। জার্মানি বলছিল যে, তারা যেকোন যুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহ না করার নীতিতে অটল থাকবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানি তার সেই নীতি থেকে সরে এসে ইউক্রেনকে অস্ত্র দেবার ঘোষণা দিয়েছে।

মার্কিন মিডিয়া ‘এনবিসি’ বলছে যে, মার্কেল রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ভালো রেখে জার্মানির সামরিক বাজেট কমিয়ে রেখেছিলেন। এখন অনেকেই তার ভূমিকাকে ভিন্ন চোখে দেখছে। থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন্স’এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড্যানিয়েলা শোয়ার্জার বলছেন যে, ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নেবার পরে মার্কেল রাশিয়ার উপর হাইড্রোকার্বনের জন্যে নির্ভরতা কমাননি, বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইনকে সমর্থন দিয়েছেন। ‘ইউরোস্ট্যাট’এর হিসেবে ২০১০ সালে জার্মানির ৩৬ শতাংশ গ্যাস আসতো রাশিয়া থেকে; ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় ৬৫ শতাংশে।

নতুন প্রতিরক্ষা নীতির মাঝে কিছু ব্যাপারকে ওলাফ শোলজ পরিষ্কার করেছেন। জার্মানি সামনের দিনগুলিতে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলিতে জার্মান সামরিক অবস্থানকে আরও সুসংহত করবে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথভাবে জার্মানির যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের চুক্তি রয়েছে, সেটার আঙ্গিকে তাদের পারমাণবিক আক্রমণের জন্যে ব্যবহৃত ফাইটার বিমানের বহরকে আরও উন্নত করবে। ড্রোন ক্রয় করা ছাড়াও তার সরকার ফ্রান্সের সাথে যৌথভাবে ৬ষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার বিমান এবং ট্যাংক ডেভেলপ করবে বলে বলেন তিনি। শোলজ বলেন যে, পুতিনকে অতীতে ফিরে যেতে না দিয়ে তার মতো ‘যুদ্ধবাজ’কে সীমানার মাঝে আটকে ফেলার প্রশ্ন এখন ইউরোপের সামনে। রুশ হাইড্রোকার্বনের উপর নির্ভরশীলতাকে দ্রুত কমিয়ে ফেলার জন্যে চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। বৈশ্বিক বাজার থেকে আরও গ্যাস কিনে, যত দ্রুত সম্ভব দু’টা নতুন এলএনজি টার্মিনাল তৈরি করে এবং নিজেদের কয়লা এবং গ্যাসের মজুত বাড়িয়ে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি। তবে এর পরেও ২০৪৫ সালের মাঝে জার্মানিকে ‘কার্বন নিউট্রাল’ করার জলবায়ুগত প্রতিশ্রুতিতে বহাল থাকতে চান তিনি।

 
জ্বালানির নতুন সরবরাহকারী খুঁজতে কাতার সফরে জার্মান অর্থমন্ত্রী হাবেক। জলবায়ুর উপর জোর দেয়া ‘গ্রিন পার্টি’র নেতা জার্মান মন্ত্রী হাবেক এখন জলবায়ুকে ভুলে গিয়ে হাইড্রোকার্বন আমদানি করতে এলএনজি টার্মিনাল তৈরি করছেন; আর রাশিয়ার অগণতান্ত্রিক সরকারকে রুখতে কাতার ও আমিরাতের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রশ্ন ভুলে গিয়ে সেখান থেকে জ্বালানি আমদানি করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

জার্মান অর্থমন্ত্রী রবার্ট হাবেক ‘ডয়েশল্যান্ডফুঙ্ক’ রেডিওকে বলেন যে, আগামী শীতের আগে জার্মানি গ্যাসের নতুন সরবরাহকারী না পেলে এবং রুশ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে জার্মানিতে বাড়ি গরম করার জন্যে এবং কারখানা চালু রাখার জন্যে যথেষ্ট গ্যাস থাকবে না। এই লক্ষ্যেই তিনি গ্যাসের নতুন সরবরাহকারী খুঁজতে কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে এসেছেন। তরলীকৃত গ্যাস এবং ‘গ্রিন হাইড্রোজেন’ নিয়ে এই দুই দেশের সাথে আলোচনায় বড় বড় জার্মান কোম্পনিগুলিও অংশ নেয়। জার্মান কোম্পানি ‘থাইসেন ক্রুপ’এর প্রধান নির্বাহী মার্টিনা মার্জ এই সফরে জার্মান মন্ত্রীর প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, কাতার বর্তমানে ইইউএর ৩০ শতাংশ তরলীকৃত গ্যাসের সরবরাহ দিলেও জার্মানি আমদানিকারক নয়। কারণ রুশ গ্যাসের উপর নির্ভর করে জার্মানি এলএনজি টার্মিনাল তৈরি করেনি। হাবেক আশা করছেন যে, পাঁচ বছরের মাঝে জার্মানি দু’টা টার্মিনাল তৈরি করতে পারবে।

ড্যানিয়েলা শোয়ার্জার বলছেন যে, শোলজের নতুন প্রতিরক্ষা বিনিয়োগের একটা বড় অংশ নতুন কোন নীতির জন্যে নয়, বরং এতকাল মার্কেলের সময়ে জার্মানির প্রতিরক্ষা বাজেট কম রাখার ব্যাপারটাকে ব্যালান্স করতে। এই অর্থের মাধ্যমে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় থাকা জার্মানির সামরিক বাহিনীর উন্নয়ন করা হবে। অপরদিকে এলএনজি টার্মিনালের অভাবে রুশ গ্যাসের বিকল্প হিসেবে কাতার এবং আমিরাত থেকে গ্যাস এবং হাইড্রোজেন আমদানি করাও রাতারাতি সম্ভব হচ্ছে না। সেই সময় পর্যন্ত জার্মানিকে ভ্লাদিমির পুতিনের দিকেই হয়তো চেয়ে থাকতে হবে। ‘ডয়েচে ভেলে’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জলবায়ুর উপর জোর দেয়া ‘গ্রিন পার্টি’র নেতা জার্মান মন্ত্রী হাবেক এখন জলবায়ুকে ভুলে গিয়ে হাইড্রোকার্বন আমদানি করতে এলএনজি টার্মিনাল তৈরি করছেন; আর রাশিয়ার অগণতান্ত্রিক সরকারকে রুখতে কাতার ও আমিরাতের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রশ্ন ভুলে গিয়ে সেখান থেকে জ্বালানি আমদানি করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। চ্যান্সেলর শোলজের নতুন প্রতিরক্ষা নীতি প্রকৃতপক্ষে আলাদা কোন নীতি নয়। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জার্মানি শিশুমাত্র! ইউক্রেনের যুদ্ধ শোলজ এবং হাবেকের জন্যে বাস্তবতা পরিবর্তন করে দিয়েছে; যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া বড় ভূমিকা নিয়েছিল এবং জার্মানি ছিল নিছক দর্শক। জার্মানি সেই পরিবর্তিত বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াবার চেষ্টা করছে মাত্র।

Friday 18 March 2022

ইউক্রেনের কাদায় আটকে গেছে রুশ সেনাবাহিনী?

১৯শে মার্চ ২০২২

ইউক্রেনের কাদায় আটকে যাওয়া রুশ ট্যাংক ফেলে দিয়ে গেছে রুশ সেনারা। যেহেতু পুতিন এই আবহাওয়ার সমস্যাগুলিকে একেবারেই আগ্রাহ্য করেছেন, তার অর্থ হলো তিনি নিশ্চয়ই ইউক্রেনের প্রতিরোধ করার সক্ষমতাকে একেবারেই নিচু করে দেখেছেন; আর রুশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ সক্ষমতাকেও যথেষ্ট বড় করে দেখেছেন। রুশ সেনাবাহিনী হয়তো সামনের দিনগুলিতে সিরিয়ার অভিজ্ঞতাগুলিকেই কাজে লাগাতে চাইবেন। সেটা বাস্তবায়িত হলে শহরের ভিতরে হাতাহাতি লড়াই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।

 
ইউক্রেন যুদ্ধের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধের শেষ পরিণতি কি হবে, সেব্যাপারে কেউই নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছে না। দেশটার পূর্বের শহর খারকিভের যুদ্ধ পরিস্থিতির বর্ণনা কঠিন সংঘাতের কথা বলছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রুশ সেনারা সেখানে আর্টিলারি শেল এবং রকেট নিক্ষেপ করছে; আর ইউক্রেনের সেনারা পশ্চিমাদের সরবরাহ করা ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করে সেগুলির খালি বাক্স দিয়ে উঁচু স্তূপ তৈরি করছে। যুদ্ধের প্রথম ক’দিনে ইউক্রেনের সেনারা হতবিহ্বল ছিল; তারা ঠিক বুঝতে পারছিলো না যে, তারা কি করবে। তবে তিন সপ্তাহ যুদ্ধের পর তারা মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। ইউক্রেনের সরকারি হিসেবে ১৬ই মার্চ পর্যন্ত খারকিভে মোট ২’শ ৩৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। তবে যে ব্যাপারটা কারুরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না, তা হলো গভীর পুরু কাদার স্তর। হাঁটতে গেলেই কাদার মাঝে ডুবে যায় জুতা। শীতের শেষে বরফ গলতে শুরু করলেই এই কাদার ব্যাপারটা সামরিক অপারেশনের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, রুশ বাহিনীর অনেক গাড়ি, এমনকি ট্যাংক এবং সাঁজোয়া যানও অত্যন্ত গভীর কাদার মাঝে আটকে যাচ্ছে। ইউক্রেনের সেনাদের প্রতিরোধ সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই কাদার ব্যাপারটা রুশদেরকে যুদ্ধের ফলাফল নিশ্চিত করতে বাধা দিচ্ছে।

‘এএফপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বরফ গলার পর ইউক্রেনের পাকা রাস্তা ছাড়া বাকি সকল রাস্তাই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গিয়েছে। গত দু’শ বছরে ন্যাপোলিয়ন এবং হিটলারের অধীনে সেনাবাহিনীকে কাদার সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। বছরে দু’বার এই এলাকার রাস্তাগুলি কাদায় ভরে যায়। সাধারণ মানুষ এই কাদাকে বলে ‘রাসপুতিতসা’। পশ্চিমারা অনেকেই এই কাদাকে সন্মান করে ‘জেনারেল মাড’ বলে থাকে। যুদ্ধের আগে পশ্চিমা বিশ্লেষকদের অনেকেই ধারণা করছিলেন যে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো আবহাওয়ার কথা চিন্তা করে ইউক্রেনে অপারেশনের সময় পিছিয়ে দেবেন। ২০২১এর নভেম্বরেই ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, বসন্তের কাদা রুশ অপারেশনের সময় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্লেষকেরা পুতিনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে না পারলেও আবহাওয়ার ব্যাপারে তাদের আগাম সতর্কবার্তা পুরোপুরি সঠিক ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধের আগে ‘ইউএস ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর স্পেনসার মেরেডিথ এক লেখায় বলেন যে, ইউক্রেনের সেনারা যদি পাকা রাস্তাগুলি ধ্বংস করে ফেলে, তাহলে বসন্তের শুরুতে রুশ সেনাদের চলাচল খুবই কঠিন হবে। ইউক্রেনের সামরিক বিশ্লেষক মাইকোলা বেলেস্কভ বলছেন যে, অনেক ক্ষেত্রেই রুশ সেনারা মাঠের মাঝে তাদের ট্যাংক এবং অন্যান্য গাড়ি আটকে যাবার পর পায়ে হেঁটে রওয়া দিতে বাধ্য হয়েছে। এই অবস্থাটা আরও খারাপ হবে যখন আবহাওয়া আরও একটু উষ্ণ হবে এবং এর সাথে বৃষ্টি যুক্ত হবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, মার্চের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু হয়ে তিন থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত এই কাদার অবস্থা চলে। সাবেক ফরাসি সামরিক অফিসার মিশেল গোইয়া বলছেন যে, কাদার কারণে রুশ জেনারেলরা হয়তো বাধ্য হবে তাদের বাহিনীকে মূল রাস্তাগুলির উপর সীমাবদ্ধ রাখতে। এর ফলশ্রুতিতে রুশ গাড়িগুলির ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হামলার শিকার হবার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে।

 

মার্কিন মিডিয়া ‘এনবিসি’ বলছে যে, ইউক্রেনের দক্ষিণের শহর মারিউপোলে একটা ভবনের উপর বড় করে লেখা ছিল ‘চিলড্রেন’, যা স্যাটেলাইট ছবিতে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিলো। কিন্তু গত ১৬ই মার্চ এই ভবনটা রুশরা বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। শহরের নেতৃস্থানীয়রা বলছে যে, ভবনে অনেক নারী এবং শিশু ছিল। বিশ্লেষকেরা কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন যে, হয়তো তার সেনাবাহিনী যখন কাদায় আটকে গেছে, খাদ্য ও জ্বালানি স্বল্পতার মাঝে পতিত হচ্ছে, এবং সেনাদের মাঝে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, তখন ইউক্রেনের জনগণের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে পুতিন চেচনিয়া এবং সিরিয়ার অমানবিক কৌশলের দিকেই দৃষ্টি দেবেন।

‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোন একটা দেশের জন্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ট্যাংক ধ্বংসী অস্ত্র পেয়েছে ইউক্রেন। এর মাঝে রয়েছে ব্রিটিশদের সরবরাহ করা ৩ হাজার ৬’শ ১৫টা ‘এনএলএডব্লিউ’ বা ‘এন’ল’ স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র; জার্মানি দিচ্ছে ১ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র; নরওয়ে ২ হাজার; সুইডেন ৫ হাজার; আর যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে অজানা সংখ্যক জ্যাভেলিন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। এর বাইরেও আরও দেশ ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়েছে। ব্রিটেনের ‘এন্ড্রুজ ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ফিলিপস ওব্রায়েন বলছেন যে, অনেক দেশই নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত খালি করে ইউক্রেনকে সরবরাহ করেছে। এগুলি যোগ হয়েছে ইউক্রেনের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে। ‘এন’ল’ এবং ‘জ্যাভেলিন’ উভয় ক্ষেপণাস্ত্রই ট্যাঙ্কের উপর থেকে হামলা করে, যেখানে বর্ম সবচাইতে কম থাকে। ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের উপর ভর করে প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইট ‘ওরিক্স’ বলছে যে, রুশরা কমপক্ষে ২’শ ১৪টা ট্যাংক হারিয়েছে; সব ধরনের মিলিয়ে গাড়ি হারিয়েছে ১২’শ ৯২টা। ইউক্রেন হারিয়েছে কমপক্ষে ৬৫টা ট্যাংক এবং মোট ৩’শ ৪৩টা গাড়ি।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডার্টমাউথ কলেজ’এর প্রফেসর জেসন লাইল এক টুইটার বার্তায় বলছেন যে, যুদ্ধে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর চারটা ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা রয়েছে – ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, ‘স্টিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, কাদার প্রতিরোধ ‘রাসপুতিতসা’ এবং সোশাল মিডিয়া দিয়ে প্রচারণা চালনার জন্যে ‘টিকটক’। ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর পাভেল ফেলগেনহাউয়ার বলছেন যে, ইউক্রেনে কেউ কেউ ‘জ্যাভেলিন’ ক্ষেপণাস্ত্রকে ‘সেইন্ট জ্যাভেলিন’ ডাকতে শুরু করেছে! আর অনেকেই মনে করছেন যে, যেহেতু পুতিন এই আবহাওয়ার সমস্যাগুলিকে একেবারেই আগ্রাহ্য করেছেন, তার অর্থ হলো তিনি নিশ্চয়ই ইউক্রেনের প্রতিরোধ করার সক্ষমতাকে একেবারেই নিচু করে দেখেছেন; আর রুশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ সক্ষমতাকেও যথেষ্ট বড় করে দেখেছেন। ফেলগেনহাউয়ার বলছেন যে, রুশ সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ জেনারেল সিরিয়াতে যুদ্ধ করেছেন। সেখানে আলোপ্পো এবং হমস শহরে মারাত্মক বোমা হামলার পাশাপাশি শহরের ভিতরে যুদ্ধ করার জন্যে সেনাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। তারা হয়তো সামনের দিনগুলিতে সেই অভিজ্ঞতাগুলিকেই কাজে লাগাতে চাইবেন। সেটা বাস্তবায়িত হলে শহরের ভিতরে হাতাহাতি লড়াই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে।

Tuesday 15 March 2022

ইউক্রেন যুদ্ধ … দুই সপ্তাহ ধরে রুশ বিমান বাহিনী নিরুদ্দেশ!

১৫ই মার্চ ২০২২

 

রুশদের অত্যাধুনিক 'সুখোই ৩৪' বোমারু বিমানকে সাধারণ আনগাইডেড বোমা বহণ করতে দেখা যাচ্ছে। অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন যে, রুশদের ‘প্রিসিশন গাইডেড মিউনিশন’ বা ‘পিজিএম’ বা নিখুঁতভাবে আঘাতে সক্ষম গোলাবারুদএর ঘাটতি রয়েছে। 


ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে অনেকেই মনে করেছিলেন যে, রুশ বিমান বাহিনী খুব দ্রতই ইউক্রেনের আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। কিন্তু যুদ্ধের দুই সপ্তাহেও রুশ বিমান বাহিনীর আনাগোণা বেশ কমই দেখা গেছে বলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসা বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হচ্ছে। রুশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের পত্রিকা ‘ক্রাসনায়া জুয়েজদা’র এক লেখায় রুশ বিমান বাহিনীর উপপ্রধান লেঃ জেনারেল সের্গেই দ্রোনভ বলেন যে, এবছরের মাঝে রুশ বিমান বাহিনী ‘সুখোই ৩৫’, ‘সুখোই ৩০’, ‘সুখোই ৫৭’ এবং ‘সুখোই ৩৪’সহ ৬০টারও বেশি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২০এর মাঝে তারা ৪’শ ৪০টা নতুন যুদ্ধবিমান এবং কয়েক হাজার মনুষ্যবিহীন ড্রোন পেয়েছে। কিন্তু দ্রোনভের কথাগুলি ইউক্রেনের আকাশে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়নি; যেখানে রুশ দ্রুতগামী ফাইটার বিমানগুলিকে বেশ কমই উড়তে দেখা গেছে; সেটাও মূলতঃ একটা বা দু’টা বিমান হিসেবে, একেবারে কম উচ্চতায় এবং রাতের বেলায়। যুদ্ধের প্রথম মুহুর্তেই রুশ ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ইউক্রেনের বিমান ঘাঁটি, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাডার এবং বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে টার্গেট করে ছোঁড়া হয়। ‘দ্যা ইকনমিস্ট’ বলছে যে, মার্কিন ইন্টেলিজেন্স ছাড়াও ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনও কর্মক্ষম রয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর হিসেবে রুশ বিমান বাহিনীতে রয়েছে প্রায় দেড় হাজার যুদ্ধবিমান; ইউক্রেনের রয়েছে ১’শরও কম। রুশরা ইউক্রেনের সীমানার কাছাকাছি প্রায় ৩’শ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করলেও সেগুলির কতটুকু সফল ব্যবহার হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে।

খারকিভ শহরের ৬ই মার্চের এক সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, দু’টা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মতো বস্তু আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে বড় আকারের বিস্ফোরণ তৈরি করেছে। লন্ডনের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক থমাস উইদিংটন এই ভিডিওটা দেখে বলছেন যে, প্রথম ক্ষেপণাস্ত্রটা খুব সম্ভবতঃ টার্গেট মিস করেছে; তবে দ্বিতীয়টা সরাসরি আঘাত করেছে। একই ঘটনার আরেকটা ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, আকাশ থেকে একটা বিমান জ্বলন্ত অবস্থায় ভূপাতিত হচ্ছে। এই ঘটনাটা খুব সম্ভবতঃ মধ্যম পাল্লার রাডার নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রের কাজ ছিল; হয়তো ‘বুক’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। এসব ক্ষেপণাস্ত্রের নিয়ন্ত্রক রাডার থেকে বাঁচার জন্যেই রুশ বিমানগুলি খুব সম্ভবতঃ নিচু দিয়ে উড়ছে। তবে এভাবে একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে তারা আরেকটা সমস্যার জন্ম দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ইউক্রেনকে ‘স্টিংগার’ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে। ইনফ্রারেড নিয়ন্ত্রিত এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি কাঁধের উপর থেকে ছোঁড়া যায়, যা নিচু দিয়ে ওড়া বিমানের ইঞ্জিনের তাপকে টার্গেট করে। এই একই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ১৯৮০এর দশকে আফগান মুজাহিদরা ৩’শ সোভিয়েত হেলিকপ্টার এবং ১’শ ফাইটার বিমান ধ্বংস করে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রকাশ করা একটা ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, একটা ‘স্টিংগার’ ক্ষেপণাস্ত্রের দ্বারা একটা ‘এমআই ৩৫’ এটাক হেলিকপ্টার ধ্বংস হচ্ছে।

 

ইউক্রেনের 'স্টিংগার' ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত হচ্ছে রুশ 'এমএই ৩৫' এটাক হেলিকপ্টার। নিচু দিয়ে উড়ে রুশ বিমানগুলি হয়তো মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের হাত থেকে বাঁচবে, কিন্তু স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের শিকারে পরিণত হবে; যেগুলি এখন মার্কিনীরা ইউক্রেনিয়ানদের সরবরাহ করছে।


রুশদের ‘পিজিএম’এর সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে কি?

রুশ বিমানগুলির নিচু দিয়ে ওড়ার আরেকটা কারণ থাকতে পারে; তা হলো বিমানগুলির বহণকৃত গোলাবারুদ। সাম্প্রতিক সময়ে রুশ বিমান বাহিনী বেশকিছু ‘প্রিসিশন গাইডেড মিউনিশন’ বা ‘পিজিএম’ বা নিখুঁতভাবে আঘাতে সক্ষম গোলাবারুদ পেলেও এগুলির ব্যবহার এখনও খুব বেশি নয়। ব্রিটিশ থিংকট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক এক লেখায় বলছেন যে, সিরিয়াতেও রুশ বিমান বাহিনী ব্যাপক হারে সাধারণ আনগাইডেড বোমা এবং আনগাইডেড রকেট ব্যবহার করেছে। বেশিরভাগ ‘পিজিএম’ ব্যবহার করেছিল রুশ ‘সুখোই ৩৪’ বোমারু বিমানগুলি। কিন্তু সেগুলিও অনেক ক্ষেত্রেই আনগাইডেড গোলাবারুদ ব্যবহার করেছে। এর মাধ্যমে ধারণা করা যেতে পারে যে, রুশ বিমান বাহিনীর খুব বেশি পাইলট ‘পিজিএম’এর ব্যাপারে জ্ঞান রাখে না। আর হয়তো তাদের ‘পিজিএম’এর সরবরাহ এবং মজুদও খুব একটা বড় নয়। ইউক্রেনের চেরনিহিভ শহরে একটা ‘সুখোই ৩৪’ বোমারু বিমানের ধ্বংসাবশেষের সাথে সাধারণ আনগাইডেড বোমা দেখা যায়। রুশ রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার ছবিগুলিতেও ‘সুখোই ৩৪’ বিমানে আনগাইডেড বোমা শোভা পেয়েছে। চেরনিহিভ এবং খারকিভ শহরেও অবিস্ফোরিত আনগাইডেড বোমা পাওয়া গেছে। তবে রুশদের ‘পিজিএম’ কম ব্যবহার করার আরেকটা সম্ভাব্য কারণ দেখাচ্ছেন মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সিএনএ’এর বিশ্লেষক মাইকেল কফম্যান। তিনি বলছেন যে, হয়তো রুশরা সামনের দিনগুলিতে ব্যবহারের জন্যে অথবা আরও বড় কোন যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ‘পিজিএম’ জমিয়ে রাখছে। আনগাইডেড বোমা ব্যবহারের ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার বর্ণনা দিচ্ছেন ‘রয়াল এরোনটিক্যাল সোসাইটি’র টিম রবিনসন। তার মতে এখন রুশ পাইলটদের সামনে দু’টা পথ খোলা রয়েছে। প্রথমতঃ নিচু দিয়ে উড়ে স্বল্প পাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের শিকার হওয়া; অথবা দ্বিতীয়তঃ দূর থেকে আনগাইডেড বোমা ছোঁড়া; যাতে টার্গেটে আঘাত করার সম্ভাবনা অনেকটাই কম হবে।

ডাচ প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইট ‘ওরিক্স’এর বিশ্লেষক স্টাইন মিতজার এবং অন্যান্যরা সোশাল মিডিয়া খুঁজে প্রথম দুই সপ্তাহ পর্যন্ত ১১টা রুশ যুদ্ধবিমান, ১১টা হেলিকপ্টার এবং ২টা ড্রোন ধ্বংসের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। সে সময় পর্যন্ত ইউক্রেনের সরকার দাবি করেছে যে, তারা মোট ৩৯টা যুদ্ধবিমান এবং ৪০টা হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছে। ‘কিংস কলেজ লন্ডন’এর রব লী মনে করছেন যে, যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহে ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস না করতে পারাটা রাশিয়ার জন্যে একটা মস্তবড় ভুল ছিল। এর ফলশ্রুতিতে রুশ বিমানগুলি নির্বিঘ্নে ইউক্রেনের আকাশে টহল দিতে সক্ষম হবে না। রুশ বোমারু বিমানগুলিও সেনাবাহিনীকে সহায়তা দিতে সক্ষম হবে না। সার্ভেইল্যান্স এবং আগাম ওয়ার্নিং দেয়া বিমানগুলিকেও এক্ষেত্রে দূরে অবস্থান করতে হবে; যার ফলশ্রুতিতে ইন্টেলিজেন্স প্রবাহে ঘাটতি পড়বে।

ভূপাতিত একটা রুশ 'সুখোই ৩৪' বোমারু বিমানের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হচ্ছে। রুশ বিমান বাহিনীর পাইলটদের ট্রেনিং যথেষ্ট কিনা, তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। 'পিজিএম' যদি কমও থাকে, তাহলে আকাশ নিয়ন্ত্রণকারী ফাইটার বিমানের তো ওড়ার কথা ছিল। হয়তো রুশ জেনারেলরা রুশ বিমান বাহিনীর এই দুর্বলতাগুলিকে ইউক্রেনের আকাশে দেখাতে চাইছেন না; কারণ এতে করে বাইরের বিশ্বের কাছে রুশদের সক্ষমতার যে ছবিখানা রয়েছে, তার সাথে বাস্তবতার দূরত্ব চোখে পড়বে।


নির্বিচার বোমাবর্ষণ আসছে কি?

কানাডার ‘রয়াল মিলিটারি কলেজ’এর প্রফেসর ওয়াল্টার ডর্ন মার্কিন মিডিয়া ‘সিবিএস’কে বলছেন যে, যদি রুশরা ইউক্রেনের আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতো, তাহলে সেটা ভালোভাবেই বোঝা যেতো। কারণ তখন রুশ সেনাবাহিনী খুব সহজেই বিমানবাহিনীকে তাদের সহায়তায় ডাক দিতে পারতো; এবং তখন বিমান হামলায় ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়তো। ‘রুসি’র জাস্টিন ব্রঙ্ক রুশ বিমান বাহিনীর কম কার্যক্ষমতার কিছু ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। রুশ সেনাবাহিনীর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে বিমান বাহিনীর বিমানগুলির সমন্বয় খুবই খারাপ বোঝা যাচ্ছে। কারণ সেনাবাহিনীর গাড়িগুলি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাল্লার বাইরে অপারেট করছে। এমনকি রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার রাডারগুলি অনেক ক্ষেত্রেই বেকার বসে ছিল; যেসময় ইউক্রেনের তুর্কি নির্মিত ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোনগুলি রুশ সেনাবাহিনীর ক্ষতিসাধন করেছে। সিরিয়ার যুদ্ধে রুশরা হয়তো তাদের একটা বড় অংশ ‘পিজিএম’ ব্যবহার করে ফেলেছে। যার ফলশ্রুতিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করা বেশিরভাগ বিমানই হয়তো সাধারণ আনগাইডেড বোমা দ্বারা সজ্জিত হয়েছে। ‘পিজিএম’ ব্যবহার করার জন্যে ‘টার্গেটিং পড’ বা একধরণের ইলেকট্রনিক ক্যামেরা সজ্জিত টার্গেটিং সিস্টেম দরকার হয়; যেগুলি রুশদের কতগুলি রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এগুলি ছাড়া সাধারণ বোমা দিয়ে ইউক্রেনের শহরাঞ্চলে আক্রমণ করতে গেলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং হত্যাযজ্ঞ হবে নিঃসন্দেহে। সেটা করার আগে রুশ বিমান বাহিনী হয়তো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। এধরণের বাছবিচার ছাড়া বোমাবর্ষণ রুশরা সিরিয়ার আলেপ্পো এবং হমস শহরে করেছিল। ব্রঙ্ক মনে করছেন যে, ইউক্রেনেও সেরকমই কিছু অপেক্ষা করছে।

তবে ‘পিজিএম’ না থাকলেও আকাশ নিয়ন্ত্রণকারী ফাইটার বিমানগুলি তো অপারেট করার কথা। রুশ বিমান বাহিনীর কাছে বর্তমানে ৮০টার মতো অত্যাধুনিক ‘সুখোই ৩৫এস’ ফাইটার বিমান এবং ১’শ ১০টার মতো ‘সুখোই ৩০এসএম২’ ফাইটার বিমান রয়েছে। ব্রঙ্ক বলছেন যে, এই বিমানগুলির তো ইউক্রেনের আকাশ থেকে ইউক্রেনের বিমান বাহিনীকে মুছে ফেলার কথা। তার ধারণা, হয়তো রুশ বিমান বাহিনীর বিমানগুলি রুশদের নিজস্ব বিমান প্রতিরক্ষার সাথে সমন্বয় করে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে অপারেট করতে সক্ষম নয়। কারণ এধরণের অপারেশনে পশ্চিমাদের মাঝেও নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নিজেদের বিমান ভূপাতিত হবার বহু উদাহরণ রয়েছে। এধরণের অপারেশনে দক্ষ হতে গেলে যথেষ্ট ভালো সমন্বয় ছাড়াও চমৎকার যোগাযোগ এবং নিয়মিত ট্রেনিংএর প্রয়োজন। কিন্তু তারপরেও ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর ক্ষুদ্র সম্পদের বিরুদ্ধে এই বিমানগুলিকে ব্যবহার না করাটা সত্যিই আশ্চর্যজনক।

হয়তো রুশ পাইলটরা যথেষ্ট ট্রেনিংএর সুযোগ থেকে বঞ্চিত। খুব একটা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও বিভিন্ন রুশ প্রতিবেদন থেকে ধারণা করা যায় যে, রুশ পাইলটরা গড়ে এক বছরে ১’শ থেকে ১’শ ২০ ঘন্টা ওড়ার সুযোগ পায়। এর মাঝে পরিবহণ বিমানও রয়েছে, যেগুলি সাধারণতঃ ফাইটার বিমানের চেয়ে বেশি সময় ওড়ে। কাজেই রুশ ফাইটার পাইলটরা হয়তো বছরে ১’শ ঘন্টার কমই পায় ওড়ার জন্যে। অপরদিকে মার্কিন এবং ব্রিটিশ ফাইটার পাইলটরা ১’শ ৮০ থেকে ২’শ ৪০ ঘন্টা ওড়ার পরেও, এবং সিমুলেটরে যথেষ্ট সময় কাটাবার পরেও বলছে যে, তাদের দক্ষতা কমে যাচ্ছে। কাজেই গত এক দশকে কয়েক’শ নতুন যুদ্ধবিমান রুশ বিমান বাহিনীতে যুক্ত হলেও তাদের পাইলটদের সেগুলিকে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। এমতাবস্থায় ব্রঙ্ক মনে করছেন যে, রুশ জেনারেলরা হয়তো রুশ বিমান বাহিনীর এই দুর্বলতাগুলিকে ইউক্রেনের আকাশে দেখাতে চাইছেন না; কারণ এতে করে বাইরের বিশ্বের কাছে রুশদের সক্ষমতার যে ছবিখানা রয়েছে, তার সাথে বাস্তবতার দূরত্ব চোখে পড়বে।

রুশ বিমান বাহিনীর সক্ষমতা ভ্লাদিমির পুতিনের সময় যথেষ্টই বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সক্ষমতাকে যাচাই করার একটা পরীক্ষাগার ছিল সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র। যদি সক্ষমতাগুলি সেখানে পরীক্ষিত হয়, তাহলে দুর্বলতাগুলিও বেরিয়ে আসবে; সেটাই স্বাভাবিক। রুশ বিমান বাহিনীর পাইলটদের ট্রেনিং নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর। বিশেষ করে নিখুঁতভাবে টার্গেটে হামলা করার জন্যে ‘পিজিএম’এর উপর দক্ষতার যেমন ঘাটতি রয়েছে, তেমনি কেউ কেউ বলছেন যে, ‘পিজিএম’এর সরবরাহেও ঘাটতি থাকতে পারে। অন্ততঃ সিরিয়ার শহরগুলিতে নির্বিচার আনগাইডেড বোমা নিক্ষেপ করে রুশরা পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্সের এই সন্দেহটাকেই আরও শক্তিশালী করেছে। তথাপি ইউক্রেন যুদ্ধে রুশদের বিমান বাহিনীর যথেষ্ট ব্যবহার না করার কারণ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা মোটেই একমত নয়। তবে তারা ইউক্রেনের যুদ্ধে সামনের দিনগুলিতে সিরিয়ার মতো নির্বিচার বোমাবর্ষণের ব্যাপারে যে ভবিষ্যৎবাণী করছেন, তা যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে রুশদের ব্যাপারে তাদের সন্দেহগুলি আরও শক্ত ভিত পাবে। এই মুহুর্তে পশ্চিমাদের ভুল প্রমাণিত করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ রুশরা দেখাতে পারেনি; যা কিনা ইউক্রেনের যুদ্ধে রুশদের সাফল্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

Sunday 13 March 2022

ইউক্রেন যুদ্ধ … বৈশ্বিক খাদ্যসংকট ধেয়ে আসছে!

১৩ই মার্চ ২০২২

কেউ কেউ মনে করছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি মিশরকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু তারা একইসাথে মিশরের নিজস্ব কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলছেন। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বই যখন করোনা মহামারি এবং সাম্প্রতিক জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ভয়াবহ সমস্যার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের মিশরসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষাকর্তা হবার ধারণাটা অবাস্তবই বটে। বাম্পার ফলনের বছরেও কোটি কোটি মানুষ যখন না খেয়ে থাকছে, তখন তা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশ্বিক বন্টন ব্যবস্থার অসারতাকেই তুলে ধরে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ২০১১ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠেছে। যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহ আগের তুলনায় ১০ই মার্চ নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে গমের মূল্য ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন কৃষি দপ্তরের হিসেবে রাশিয়া বিশ্বের সবচাইতে বড় গম রপ্তানিকারক দেশ; ইউক্রেন হলো এক্ষেত্রে চতুর্থ। ‘ওইসি’র হিসেবে ২০১৯ সালে রাশিয়া এবং ইউক্রেন মিলে বিশ্বের মোট রপ্তানিকৃত গমের সাড়ে ২৫ শতাংশ সরবরাহ করেছিল। আর এই দুই দেশ গোটা বিশ্বের গম এবং বার্লি রপ্তানি বাজারের এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে থাকে। ইউক্রেন ভুট্টা এবং সূর্যমুখী তেলেরও বড় জোগানদাতা। এছাড়াও এই দুই দেশ বিশ্বের রাসায়নিক সারের একটা বড় উৎস। যুদ্ধটা যেভাবেই শেষ হোক না কেন, করোনা মহামারির ঠিক পরেই এই যুদ্ধের ফলে বিশ্বের বহু দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের ‘কমিটি অন ওয়ার্ল্ড ফুড সিকিউরিটি’র প্রধান গ্যাব্রিয়েল ফেরেরো ডে লোমা ওসোরিও ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলছেন যে, করোনা আসার আগেই বিশ্বে ৬৬ কোটির বেশি মানুষ খাদ্যাভাবের মাঝে ছিল। করোনার পর এটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটিতে।

ইউক্রেনের অনেক বন্দরেই অপারেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে; আজভ সাগর অঞ্চলে জাহাজ চলাচলই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওলেগ উসতেনকো ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক লেখায় বলছেন যে, ইউক্রেনে গম চাষ শুরুর সময় হলো মার্চের প্রথম ১০ দিনের মাঝে; আর গমের চারা রোপণ শেষ করতে হবে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহের আগেই। যুদ্ধের জন্যে যেহেতু মার্চের অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে, তাই স্বাভাবিক হিসেবে গমের চাষ এবছরে আর সম্ভব হবে না। গম চাষে সবচাইতে উপযোগী অঞ্চলগুলিতেই এখন যুদ্ধ চলছে। আর অদূর ভবিষ্যতে মাইন এবং অবিস্ফোরিত গোলাবারুদ না সরিয়ে এই অঞ্চলে চাষাবাদ করা যাবে না।

জাতিসংঘের ডে লোমা ওসোরিও বলছেন যে, বাংলাদেশ তাদের মোট গম আমদানির অর্ধেকই রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে আনতো। তবে ‘এরাব নিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এর চাইতেও বড় হুমকির মাঝে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলি, যারা মূলত কৃষ্ণ সাগরের অপেক্ষাকৃত কমদামি খাদ্যশস্যের উপরেই নির্ভর করেছে এতোদিন। অত্র অঞ্চলের লেবানন, মিশর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন এবং সুদানের মতো দেশগুলিতে গম থেকে তৈরি খাদ্যই প্রধান খাদ্য। এই দেশগুলি আরও আগ থেকেই মূল্যস্ফীতি, অর্থসংকট এবং সংঘাতের কারণে খাদ্যঘাটতির মাঝে ছিল। লেবাননের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন যে, তাদের গমের মজুত খুব বেশি হলে একমাস টিকবে। দেশটার ৬০ শতাংশ গম আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। বৈরুতের রাস্তায় অনেকেই রুটির জন্যে আটা মজুত করার উদ্দেশ্যে অন্যান্য খাবার তৈরি ও বিক্রি করা বন্ধ করে দিয়েছে। বৈরুতের এক গবেষণা সংস্থার প্রধান রিয়াদ সাদে মনে করছেন যে, এমন একটা সময় চলে এসেছে, যখন মানুষ রুটির জন্যে বিদ্রোহ করতে পারে। অপরদিকে ইয়েমেন তাদের চাহিদার ৯০ শতাংশ গমই আমদানি করে; তাই সেখানে মারাত্মক দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধ এবং খরার কারণে দেশটায় দুর্ভিক্ষের অবস্থা চলছে কয়েক বছর ধরে। সিরিয়তে গৃহযুদ্ধের পর থেকে জাতিসংঘের হিসেবে ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম’এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডেভিড বীসলি বলছেন যে, অর্থাভাবে তারা সিরিয়াতে ৮০ লক্ষ মানুষের জন্যে খাবার রেশন অর্ধেক করেছেন; আরও কমানো হবে। ঠিক ঐ মুহুর্তেই ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হলো। ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে তারা তাদের অর্ধেক গমের সরবরাহ আসতো।



মিশরে ২০২০এর এপ্রিল থেকে ২০২১এর ডিসেম্বরের মাঝে সেখানে ৮০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে গমের মূল্য ৫০ শতাংশ বেড়েছে। মিশর হলো বিশ্বের সবচাইতে বড় গম আমদানিকারক দেশ। ‘এসএন্ডপি গ্লোবাল’এর হিসেবে গত জানুয়ারিতে মিশর ৩৫ লক্ষ টন গম কিনেছে। তাদের ৮০ শতাংশ গমই ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে এসেছে। দেশটার হাতে এই মুহুর্তে ৪ মাসের গম মজুত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট সিসির সরকার ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছে যে, তারা রুটির উপর ভর্তুকি কমিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে। অবস্থাটা মিশরের অর্থনীতির জন্যে অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করেছে বলে বলছেন ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর অর্থনীতিবিদ মাইকেল টানচুম। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তুরস্কে খাবার তেলের মূল্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে; আর জনগণ সূর্যমুখী তেল মজুত করতে শুরু করেছে। যুদ্ধরত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে তুরস্কের ৭০ শতাংশ খাবার তেল আসে।

‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, তিউনিসিয়ার প্রায় অর্ধেক আমদানিকৃত গম আসে ইউক্রেন থেকে। গমের মূল্য সেখানে ১৪ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। সেদেশে সরকার রুটির মূল্য নির্ধারণ করলেও সকলেই মনে করছেন যে, তাদের জীবনের উপর মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়বেই। মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, ঋণের বোঝার কারণে তিউনিসিয়ার অর্থনীতি আরও আগ থেকেই ধুঁকে চলছিল। ‘ডব্লিউএফপি’র মুখপাত্র আবীর এতেফা বলছেন যে, এবছরে বিশ্বে চাহিদার চাইতে বেশি গম উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে যেখান থেকে গম আসতে হবে, তাতে সময় এবং পরিবহণ খরচ উভয়ের উপরেই চাপ পড়বে। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চল বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে; যার মূলেই রয়েছে ধ্বসে পড়া অর্থনীতি; বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। এতেফা বলছেন যে, খাদ্যনিরাপত্তা ব্যাহত হলে জনগণের মাঝে অস্থিরতা এবং সহিংসতার আশংকা বৃদ্ধি পাবে। ইউক্রেন যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটা সংঘাতের সৃষ্টি করছে। মাইকেল টানচুম মনে করছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি মিশরকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু তিনি একইসাথে মিশরের নিজস্ব কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলছেন। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বই যখন করোনা মহামারি এবং সাম্প্রতিক জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ভয়াবহ সমস্যার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের মিশরসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষাকর্তা হবার ধারণাটা অবাস্তবই বটে। বাম্পার ফলনের বছরেও কোটি কোটি মানুষ যখন না খেয়ে থাকছে, তখন তা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশ্বিক বন্টন ব্যবস্থার অসারতাকেই তুলে ধরে।

Saturday 12 March 2022

'আফগানিস্তানের পর...'

 ১২ই মার্চ ২০২২

আলহামদুলিল্লাহ!
আমার ষষ্ঠ বই প্রকাশিত হলো।

'আফগানিস্তানের পর... - কাবুল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পলায়ন এবং এর ভূরাজনৈতিক ফলাফল' 



বই-এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা এই বর্ণনা থেকে পাওয়া যাবে -


-----------------------------------------------------------------------------------------------


"২০২১এর শেষ ছয় মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান থেকে পলায়ন ছিল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ইউরেশিয়াতে শুরু হয়েছে শূণ্যস্থান পূরণের প্রতিযোগিতা; পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে পাবে কিনা, তা নিয়ে নিশ্চিত নয়; মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মতো জনবিরোধী কাজে নিমজ্জিত হয়েছে; মার্কিন বন্ধুরা যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতে পারছে না। আফগানিস্তান থেকে পলায়নের ঘটনা অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তির যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তার অনেকটুকুই নিঃশেষ করে ফেলেছে।

করোনা মহামারিতে পরীক্ষামূলক সমাধানকে জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক দৈন্যতা পশ্চিমা জীবনব্যবস্থার অধীন বিশ্বকে করেছে দিশেহারা। ধনী হয়েছে আরও ধনী; দরিদ্র হয়েছে আরও বেশি দরিদ্র। পুঁজিবাদের বিদায় ঘন্টা বাজলো বলে! এর সাথে পশ্চিমা রাজনৈতিক ব্যবস্থাও হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারেরাই মানুষের ধর্মীয় অধিকার, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার কেড়ে নিচ্ছে। গণতন্ত্র মানুষের জীবনের সমাধান তো দিতেই পারেনি, বরং গণতান্ত্রিকভাবেই নতুন সমস্যাগুলির সৃষ্টি হয়েছে। ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নিয়োগই যে গণতন্ত্র নয়, সেটা এখন যেন কেউই জানেন না। প্রতিনিধি নিয়োগ নয়, বরং প্রতিনিধিদের তৈরি করা আইন নিয়েই যে সমস্যা, সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা"।

-----------------------------------------------------------------------------------------------

 




আপডেটঃ ১৬ই মার্চ ২০২২

বইটি এখন  রকমারি ডট কমে পাওয়া যাচ্ছে।

 https://www.rokomari.com/book/231858/afghanistaner-por---

 

এছাড়াও বইটি কুরিয়ারের মাধ্যমে ডেলিভারির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যারা অর্ডার করতে ইচ্ছুক, তারা নিচের ফেসবুক পেইজে পুরো ঠিকানা এবং ফোন নম্বরসহ 'ইনবক্স' করুন। পেমেন্ট করতে হবে বিকাশে। ডেলিভারি চার্জ ফ্রি। অর্থাৎ বইএর মূল্যের বাইরে কোন চার্জ দিতে হবে না।  


https://www.facebook.com/k360bd/ 

-----------------------------------------------------------------------------------------------
 
লেখক - আহমেদ শরীফ

প্রকাশক - মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম, ড্রিমস পাবলিকেশনস, টাঙ্গাইল

প্রথম প্রকাশ - ফেব্রুয়ারি ২০২২ 

প্রচ্ছদ - তৌহিদুল ইসলাম

বিন্যাস ও অলংকরণ - মোঃ আবদুর রহিম

মুদ্রণ - প্রিন্টটেক প্রিন্টিং প্রেস

পৃষ্ঠা সংখ্যা - ৩৪০; হার্ড কভার 

মূল্য - ৯০০/- (নয়শত টাকা মাত্র) 

ISBN : 978-984-35-2023-4
 -------------------------------------------------------------------------------
 











 
 
লেখকের প্রথম পাঁচটা বই না পেয়ে থাকলে এই লিঙ্কগুলি থেকে ঘুরে আসুন - 
 

'বঙ্গোপসাগর আসলে কার? বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান'
 
'যুক্তরাষ্ট্রের পর... সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থার হাতছানি' 

Sunday 6 March 2022

ইউক্রেন যুদ্ধে শরণার্থী চ্যালেঞ্জ ইউরোপের জাতিগত বিদ্বেষকে সামনে নিয়ে আসছে

০৬ই মার্চ ২০২২

 
‘ইউরোপিয়ান’ শব্দটা একটা কোড হয়ে গিয়েছে। জনগণ কোন সংঘাত নিয়ে মাথা ঘামাবে, সেটার মাপকাঠিও হয়ে গেছে সেটা। সিরিয়া, সোমালিয়া বা অন্যান্য স্থানের ভয়াবহ সংঘাতগুলি পশ্চিমা মিডিয়াতে সেভাবে উঠে আসেনি; যেভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধ উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকানদের ক্রীতদাস হিসেবে রাখা এবং ইউরোপিয়দের হাতে আফ্রিকার উপনিবেশ তৈরির সেই ইতিহাসগুলিই যেন ইউক্রেনের যুদ্ধের মাঝে নতুন করে দেখা দিচ্ছে। একুশ শতকেও ইউরোপের চিন্তায় জাতিগত বিদ্বেষ শক্তভাবে প্রোথিত রয়েছে।


গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরু করার পর থেকে বিদেশীরা ছাড়াও বহু ইউক্রেনিয়ান দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ২৬শে ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতিদিন দেড় লাখের বেশি মানুষ দেশ ছেড়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে ৬ই মার্চ পর্যন্ত আনুমানিক ১৪ লক্ষাধিক মানুষ ইউরোপের দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছে। এর মাঝে সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ গিয়েছে পোল্যান্ডে; হাঙ্গেরিতে দেড় লক্ষ; মলদোভায় ১ লাখের বেশি; স্লোভাকিয়ায় ১ লাখ; রোমানিয়ায় ৬৩ হাজার; রাশিয়ায় ৫৩ হাজার। এছাড়াও আরও অন্যান্য দেশে গিয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৩৪ হাজারের মতো। যুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝে এই শরণার্থী চ্যালেঞ্জ ইউরোপের গভীর কিছু সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসেছে।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, পোল্যান্ডে বহু স্বেচ্ছাসেবক সীমান্ত অঞ্চলে আসতে শুরু করেছে ইউক্রেনিয় শরণার্থীদের জন্যে পরিবহণ ও থাকার ব্যবস্থা করার জন্যে। স্বেচ্ছাসেবীরা খাবার, চা এবং পানি নিয়ে শরণার্থীদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সোশাল মিডিয়াতে হাজারো মানুষ শরণার্থীদের সহায়তা দেবার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শরণার্থীদের জন্যে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টারও কমতি নেই। শরণার্থীদের ব্যাপারে পোলিশ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের মহানুভবতায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। কারণ গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে পোলিশ আইনশৃংখলা বাহিনী বেলারুশের সীমানায় মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীদেরকে জোরপূর্বক দেশে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল। সীমান্ত অঞ্চলে মানবিক সহায়তা এবং সাংবাদিকদের পৌঁছাতে বাধা দেয়া হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে শতশত মানুষ খোলা আকাশের নিচে থাকতে বাধ্য হয়। প্রচন্ড ঠান্ডায় বেশ ক’জন মৃত্যুবরণও করেছিল। এনজিও ‘গ্রুপা গ্রানিকা’র আনা আলবোথ বলছেন যে, সীমান্ত এলাকায় তারা এতো বেশি খাবার এনে রেখেছিলেন যে, খাবার নষ্ট হচ্ছে। কারণ তাদের আশানুরূপ সংখ্যক শরণার্থী আসেনি। শরণার্থীদের জন্যে চাকুরি, ইউক্রেনিয় ভাষার শিক্ষক এবং ক্লাসরুপে কমপিউটারের ব্যবস্থা করা কষ্টসাধ্য হতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন ৫ই মার্চ পোল্যান্ড সফরকালে বলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের মানবিক সহায়তা হিসেবে ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন সহায়তার জন্যে চেষ্টা করছে হোয়াইট হাউজ।

অপরদিকে ২৬ লক্ষ জনগণের ছোট্ট দেশ মলদোভার প্রধানমন্ত্রী নাতালিয়া গাভরিলিতা জাতিসংঘকে আরও সহায়তা দিতে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলছেন যে, ৬ই মার্চ পর্যন্ত মোট ২ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ ইউক্রেন থেকে মলদোভায় ঢুকেছে। এর মাঝে ১ লক্ষ ২০ হাজার এখানে রয়েছে গেছে; যাদের মাঝে ৯৬ হাজার ইউক্রেনিয়। তিনি বলেন যে, মলদোভার মতো ছোট দেশের জন্যে এটা অনেক বড় সংখ্যা।

এদিকে গত ৩রা মার্চ দেশটার উগ্র ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান সীমান্ত শহর বেরেগসুরানিতে সাংবাদিকদেরকে বলেন যে, তার দেশ জানে কারা অভিবাসী, আর কারা শরণার্থী। অভিবাসীদেরকে থামিয়ে দেয়া হবে; তবে শরণার্থীদের ঢুকতে দেয়া হবে। অরবান এতদিন যাবত শরণার্থীদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর নীতিতে ছিলেন। ২০১৫ সালে শরণার্থী ঠেকাতে হাঙ্গেরি সরকার সার্বিয়ার সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছিল। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে অরবানের সরকার শরণার্থীদেরকে দেশে ঢুকতে বাধা দিতে নতুন আইন করেছিল। এখন সরকারি সমর্থনে পুরো হাঙ্গেরি থেকে মানবিক সহায়তা দিতে জনগণ সীমান্ত অঞ্চলে আসছে। 


‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মাত্র ছয় সপ্তাহ আগেই পোল্যান্ডের বেলারুশ সীমানায় সিরিয়া, ইরাক এবং আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের ঠেকাতে দেয়াল তৈরি করা হচ্ছিলো। অথচ এখন হঠাত করেই ইউরোপ তার সীমানা খুলে দিয়েছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলছেন যে, শরণার্থীদের আসতে কোন সমস্যা নেই। ইইউ মনে করছে যে, প্রায় ৪০ লক্ষ শরণার্থী ইউক্রেন থেকে আসতে পারে; যা হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচাইতে বড় শরণার্থী সমস্যা। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন রেফেউজিস এন্ড এক্সাইলস’এর ডিরেক্টর ক্যাথারিন উলার্ড বলছেন যে, কতবড় পরিবর্তনই না হয়েছে! তিনি বলছেন যে, ২০১৫ সালে ১০ লক্ষ সিরিয় শরণার্থীর মাঝে কোন দেশকে কতজন রাখতে দেয়া হবে, তা নিয়ে ইইউএর সদস্য দেশগুলির মাঝে মারাত্মক রাজনৈতিক বিরোধ তৈরি হয়েছিল। ইইউএর দেশগুলি এবারে ইউক্রেনিয় শরণার্থীদের কমপক্ষে ১২ মাসের থাকার ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছেছে। এর মাঝে শরণার্থীদের বাসস্থান, স্বাস্থ্য সুবিধা, শিক্ষা এবং চাকুরির ব্যাপারেও ঐকমত্য হয়েছে। উলার্ড বলছেন যে, ইইউএর দেশগুলির পরিষ্কার দু’মুখো নীতি দৃশ্যমান। ২০১৫ সালে পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরি সিরিয় শরণার্থীদের ঠেকাতে তাদের দক্ষিণের সীমানায় দেয়াল তুলেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দেশগুলির অভিবাসন নীতি নির্ভর করেছে ধর্ম, জাতি এবং শরণার্থীদের উৎস দেশের উপর। এই ব্যবস্থা যথেষ্টই পক্ষপাতদুষ্ট।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, পোল্যান্ডের সীমানায় আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত থেকে আসা শরণার্থীদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে; কারণ তারা ইউক্রেনের নাগরিক নন। শরণার্থীদের কেউ কেউ বলছেন যে, তাদের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হয়েছে। ইউক্রেনের লেভিভ রেলস্টেশনে এক আফ্রিকান মহিলাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয় এই বলে যে, শুধু মহিলারাই ট্রেনে উঠতে পারবে! পোলিশ সাহায্য সংস্থা ‘গ্রুপা জাগরানিকা’র স্বেচ্ছাসেবক জ্যান মস বলছেন যে, মেদিকা শহরে শরণার্থীদের ঢোকার সময় তাদেরকে জাতি ভিত্তিতে আলাদা করা হচ্ছিলো। পোলিশ এবং ইউক্রেনিয়দেরকে গাড়ির লাইনে অতি দ্রুততার সাথে যাবার ব্যবস্থা করা হচ্ছিলো। অথচ অন্যদেরকে পায়ে হেঁটে তিন ধাপ পেরিয়ে ঢোকানো হচ্ছিলো, যা ১৪ থেকে ৫০ ঘন্টা পর্যন্ত লাগছিলো।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর এক লেখায় সিনিয়র ফেলো রাশাওন রে বলছেন যে, শ্বেতাঙ্গদের জন্যে ‘ইউরোপিয়ান’ শব্দটা একটা কোড হয়ে গিয়েছে। জনগণ কোন সংঘাত নিয়ে মাথা ঘামাবে, সেটার মাপকাঠিও হয়ে গেছে সেটা। সিরিয়া, সোমালিয়া বা অন্যান্য স্থানের ভয়াবহ সংঘাতগুলি পশ্চিমা মিডিয়াতে সেভাবে উঠে আসেনি; যেভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধ উঠে এসেছে। করোনাভাইরাসের টেস্ট, চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিন পাবার ক্ষেত্রেও কোন জাতি বা দেশের মানুষদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, তা সকলেই দেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকানদের ক্রীতদাস হিসেবে রাখা এবং ইউরোপিয়দের হাতে আফ্রিকার উপনিবেশ তৈরির সেই ইতিহাসগুলিই যেন ইউক্রেনের যুদ্ধের মাঝে নতুন করে দেখা দিচ্ছে। রাশাওন রেএর কথায় পরিষ্কার যে, একুশ শতকেও ইউরোপের চিন্তায় জাতিগত বিদ্বেষ শক্তভাবে প্রোথিত রয়েছে।