Wednesday 29 September 2021

মধ্য এশিয়াতে তুরস্ক ও পাকিস্তানের কৌশলগত সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে

৩০শে সেপ্টেম্বর ২০২১

ইরানের কর্মকর্তারা কাস্পিয়ান সাগরীয় অঞ্চলে তুরস্ক এবং পাকিস্তানের সামরিক অবস্থানকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। মধ্য এশিয়ার ‘লাপিস লাজুলি করিডোর’ বরাবর তুরস্কের এবং পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে।


সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক এবং পাকিস্তানের কৌশলগত সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমা সৈন্য চলে যাবার পর থেকে তালিবানদের অধীনে আফগানিস্তানকে বিভিন্নভাবে সমর্থন দেবার ক্ষেত্রে পাকিস্তান এবং তুরস্কের কৌশলগত সহযোগিতা চোখে পড়ছে। তবে এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটা দেশের নামও উল্লেখ করার মতো; যার নাম কাতার। প্রায় একইসাথে মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে পাকিস্তান থেকে তুরস্ক পর্যন্ত ‘লাপিস লাজুলি’ নামের একটা কৌশলগত পরিবহণ নেটওয়ার্ক ডেভেলপ করে ভূমধ্যসাগরকে মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে ভারত মহাসগরের সাথে যুক্ত করে তার নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষেত্রেও মধ্য এশিয়ার দেশ আজেরবাইজান এবং তুর্কমেনিস্তানের নাম সামনে আসছে।

গত জুন এবং জুলাই মাসে তুরস্কে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো যৌথ সামরিক মহড়া ‘আনাতোলিয়ান ঈগল ২০২১’। তুরস্কের বিমান বাহিনীর অফিশিয়াল বিবৃতি অনুযায়ী এই মহড়ার উদ্দেশ্য ছিল অংশগ্রহণকারী দেশগুলির জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকে একে অপরের সাথে সমন্বয় করা। এবং একইসাথে সত্যিকারের যুদ্ধাবস্থায় যৌথ অপারেশনে অভ্যস্ত হওয়া। এটা ছিল মূলতঃ চারটা দেশের বিমান বাহিনীর একটা মহড়া। তুরস্ক এই মহড়া অনেকদিন ধরেই আয়োজন করে চলেছে। তবে সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই মহড়ার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। মহড়ায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ৫টা ‘জেএফ ১৭’ ফাইটার বিমান অংশ নেয়। এর সাথে মহড়ায় অংশ নেয় আজেরবাইজানের রুশ নির্মিত ২টা ‘মিগ ২৯’ বিমান এবং ২টা ‘সুখোই ২৫’ যুদ্ধবিমান। তুরস্কের পক্ষ থেকে ৩৮টা ‘এফ ১৬’ বিমান, একটা ‘আনকা এস’ ড্রোন এবং একটা ‘কেসি ১৩৫’ রিফুয়েলিং বিমান অংশ নেয়। তবে পুরো মহড়ার সবচাইতে আলাদা অংশগ্রহণকারী ছিল কাতারি বিমান বাহিনীর ৪টা ফরাসি নির্মিত ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান। এর ফলে তুর্কি এবং পাকিস্তানি ফাইটার পাইলটরা প্রথমবারের মতো ফরাসি ‘রাফাল’ ফাইটার জেটের বিরুদ্ধে একটা সত্যিকারের মহড়ায় অংশ নেয়। পাকিস্তানের মূল আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ফ্রান্স থেকে ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান কিনেছে। অপরদিকে তুরস্কের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিসও ফ্রান্স থেকে ‘রাফাল’ বিমান পাচ্ছে। এই যৌথ মহড়ার ব্যাপারে ভারত এবং গ্রিস উভয় দেশের বিশ্লেষকেরাই দুশ্চিন্তা দেখিয়েছেন। কারণ এর মাধ্যমে তুরস্ক এবং পাকিস্তান উভয়েই ‘রাফাল’ বিমানের সক্ষমতা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা অর্জন করতে পারবে।

শুধু মহড়াই নয়। জুন মাসে কাতারের সাথে তুরস্কের একটা আলাদা চুক্তি তুর্কি পার্লামেন্টে পেশ করা হয়, যার মাধ্যমে কাতারি বিমান বাহিনীর ৩৬টা বিমান এবং প্রায় আড়াই’শ সদস্য তুরস্কে ট্রেনিং নেবে। ‘মিডলইস্ট আই’ বলছে যে, গত মার্চেই তুর্কি সামরিক বাহিনীর জেনারেল ইয়াসার গুলার কাতারিদের সাথে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী কাতারি বিমান বাহিনী পাঁচ বছরের জন্যে তুরস্কে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। প্রতিবারের প্রশিক্ষণের আগে দুই মাসের একটা আগাম খবর দেবে কাতারিরা। ডকুমেন্টে বলা হয় যে, এর মাধ্যমে দুই দেশের মাঝে সামরিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তুরস্কের আকাশসীমা এবং বন্দরসমূহ ব্যবহার করে কাতারিরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবে। প্রতিবেদনে আরও মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ২০১৭ সাল থেকে কাতারের উপর সৌদি গ্রুপের অবরোধ আরোপের পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে সেসসম্য় থেকেই কাতারে তুরস্কের একটা সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পেও কাতারিরা বিনিয়োগ করেছে এবং তুরস্কের পর্যটন ও রিয়েল এস্টেট খাত ছাড়াও বিভিন্ন খাতে কাতার ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। তবে তুরস্কের মাটিতে কাতারিদের বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ নতুন কিছু নয়। ১৯৯০এর দশক থেকে শুরু করে এক দশকের বেশি সময় ধরে ইস্রাইলি বিমান বাহিনী তুরস্কের পাহাড়ি অঞ্চলকে আকাশ প্রশিক্ষণের জন্যে ব্যবহার করে। উভয় পক্ষ একে অপরের বিমান এবং কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে। সেই হিসেবে গ্রিক বিশ্লেষকদের মতে, তুর্কিরা কাতারের ‘রাফাল’ ফাইটার বিমান সম্পর্কে গভীর ধারণা পেতেই কাতারি বিমান বাহিনীর বিমানকে নিজ দেশে প্রশিক্ষণে দেখতে চায়। এতে তুর্কিরা ফরাসি বিমান সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারবে।

 

অপরদিকে তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের কৌশলগত সহযোগিতা আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় সেপ্টেম্বর মাসে। ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে আজেরবাইজানের রাজধানী বাকুতে শুরু হয় ত্রিদেশীয় আরেকটা যৌথ মহড়া। ‘থ্রি ব্রাদার্স ২০২১’ নামের এই মহড়া আরেকটা দিকনির্দেশনা দেয়। আজেরবাইজানের স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার লেঃ জেনারেল হিকমাত মিরজাইয়েভ তুর্কি এবং পাকিস্তানের স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের নিজ দেশে স্বাগত জানান। তিন দেশের কাছাকাছি সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করতে জেনারেল মিরজাইয়েভ আর্মেনিয়ার সাথে ৪৪ দিনের যুদ্ধের প্রথম থেকেই তুরস্ক এবং পাকিস্তানের পুরোপুরি সমর্থনের কথা উল্লেখ করেন। প্রায় তিন দশকের আর্মেনিয় দখলদারিত্বের পর আজেরিরারা নাগোর্নো কারাবাখের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ শহরসহ প্রায় ৩’শ বসতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়; যখন উভয় পক্ষ রুশ মধ্যস্ততায় যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়। জেনারেল মিরজাইয়েভ তিন দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক নিরাপত্তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তুর্কি লেঃ কর্নেল কুরসাত কনুক এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লেঃ কর্নেল আমির শাহজাদ দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এই সামরিক সম্পর্কের গুরুত্বকে তুলে ধরেন।

তুরস্কের ‘কাদির হাস ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর মিতাত চেলিকপালা তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি’র সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, এই মহড়ার মাধ্যমে তুরস্ক এবং আজেরবাইজানের কৌশলগত অবস্থানকে মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে আফগানিস্তান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তুরস্ক এবং পাকিস্তানের মাঝে সামরিক এবং কৌশলগত সম্পর্ককে আরও শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করতেই আজেরবাইজানের মাধ্যমে দেশদু’টাকে আরও কাছাকাছি আনা হচ্ছে। অপরদিকে আজেরবাইজানের ‘এডিএ ইউনিভার্সিটি’র ফারিজ ইসমাঈলজাদে বলছেন যে, এই মহড়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে পরিবহণ করিডোর, যার মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। যদিও এই মহড়া কোন বিশেষ দেশকে টার্গেট করে হচ্ছে না, তথাপি আর্মেনিয়ার মতো কোন দেশ যদি আবারও অত্র অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে, তবে তার জন্যে এই মহড়া হবে একটা হুমকি। তবে ইরানের কর্মকর্তারা কাস্পিয়ান সাগরীয় অঞ্চলে তুরস্ক এবং পাকিস্তানের সামরিক অবস্থানকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। মধ্য এশিয়ার ‘লাপিস লাজুলি করিডোর’ বরাবর তুরস্কের এবং পাকিস্তানের প্রভাব বৃদ্ধি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে।

Tuesday 14 September 2021

গণতন্ত্রের ‘পোস্টারচাইল্ড’ আবি আহমেদ কি ইথিওপিয়াকে জোড়া লাগাবেন বা ভাংবেন?

১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২১

ছবিঃ জাতিগত নিধনের যে নীতি নিয়ে আবি এগিয়েছেন, তাতে ইথিওপিয়া রাষ্ট্রের ভিতটাকেই তিনি নড়বড়ে করে ফেলেছেন। উভয় পক্ষই এখন সামরিক সমাধানের দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি কোন প্রকারে সেখানে যুদ্ধবিরতি হয়ও, ঘটে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতনের স্মৃতিগুলি ভুলে গিয়ে তারা এগুতে পারবে কি?


ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধ এখন নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। ২০২০এর নভেম্বরে শুরু হওয়া এই গৃহযুদ্ধ খুব তাড়াতাড়িই শেষ হবে বলে আশা করেছিলেন ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট আবি আহমেদ। কিন্তু সেটা তো হয়ই নি, বরং তিগ্রেরা নিজেদের অঞ্চল পুনরাধিকার করে আশেপাশের আমহারা এবং আফার অঞ্চলেও ঢুকে পড়েছে। এর উপর তিগ্রেরা এখন একা নয়। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে দেশটার সবচাইতে বড় জাতি অরোমো। ‘অরোমো লিবারেশন আর্মি’র প্রধান কুমসা দিরিবা বলছেন যে, তাদের মাঝে একটা ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে; আর তা হলো তারা একই শত্রুর মোকাবিলা করছে। বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আবি আহমেদ ইথিওপিয়ার রাজধানীতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার যে চেষ্টা করছিলেন, তা পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশটার অনেক অঞ্চলই এখন বিকেন্দ্রীকরণ চাইছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পশ্চিমা কূটনীতিবিদ বলছেন যে, এই সংঘাত দেশটার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করতে যাচ্ছে।

১০ মাস পরেও যুদ্ধ শেষ হবার লক্ষণ নেই

‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর উইলিয়াম ডেভিসন ‘আল জাজিরা’র সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, তিগ্রেরা চাইছে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের শর্তে আলোচনায় বসতে এবং একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে। অরোমোরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার কারণে তিগ্রেদের সাথে তাদের যুক্ত হবার গুরুত্ব অনেক। তবে তারা তিগ্রেদের মতো সামরিকভাবে সক্ষম কিনা, সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, তা হচ্ছে এই যুদ্ধের শেষ কোথায়, তা কেউই বলতে পারছে না।

অগাস্টে আবি আহমেদ একদিনের ঝটিকে সফরে তুরস্ক ঘুরে এসেছেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথে দেখা করে প্রতিরক্ষা এবং আর্থায়ন বিষয়ে দু’টা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির সকলকিছু প্রকাশ করা না হলেও অনেকেই ধরে নিচ্ছেন যে, আবি হয়তো তুর্কি ড্রোন কেনার জন্যেই আঙ্কারা গিয়েছিলেন। ডাচ সামরিক বিশ্লেষণধর্মী ওয়েবসাইট ‘ওরিক্স’ বলছে যে, ইতোমধ্যেই ইথিওপিয়াতে ইরান এবং ইস্রাইলের অস্ত্র দেখা গিয়েছে। হয়তো সেখানে তুরস্কের ড্রোনের আবির্ভাব সময়ের ব্যাপার মাত্র।

ইথিওপিয়ার স্থিতিশীলতা পার্শ্ববর্তী সোমালিয়ার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সোমালিয়াও ইথিওপিয়ার মতো ফেডারেল রাষ্ট্র। সোমালিয়াতে রয়েছে তুরস্কের বিরাট সামরিক ঘাঁটি। তুর্কিরা সোমালি সেনাদের ট্রেনিং দিচ্ছে। একারণে ‘হর্ন অব আফ্রিকা’য় স্থিতিশীলতা তুরস্কের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। তুর্কিরা উভয় দেশেই ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। তুর্কি ড্রোনগুলি এর আগে সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজেরবাইজানে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন সম্ভব করেছিল। হয়তো ইথিওপিয়াতেও সেই প্রচেষ্টাই করবে তারা।

 

যুদ্ধ কিভাবে শেষ হতে পারে?

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় প্রাক্তন মার্কিন কূটনীতিবিদ চার্লস এ রে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, আবি আহমেদ ১০ই অগাস্ট সাধারণ জনগণকে দলে দলে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়ার আবেদন জানান। এই ঘোষণা শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করে না। এর আগে তার সরকার জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। কিন্তু তিগ্রেরা সেটাকে আমলে নেয়নি। আবি আহমেদ তিগ্রে অঞ্চলে কোনরূপ মানবিক সাহায্য যেতে দিচ্ছেন না। এতে যুদ্ধপিড়ীত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছাবার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা তিনি নিজেই ভাংছেন। আবিএর সরকার মনে করছে যে, ত্রাণের সাথে তিগ্রে অঞ্চলে অস্ত্রও পৌঁছে যাবে। ইথিওপিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত অরেলিয়া ব্রাজীল এবং ডেভিড শিনএর সাথে কথা বলে এবং অন্যান্য কূটনীতিবিদদের বক্তব্য শুনে তিনি ইথিওপিয়ার যুদ্ধ বন্ধের একটা ফর্মূলা দেবার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের উচিৎ হবে তিগ্রে অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছতে দেয়া এবং বাণিজ্যিক কর্মকান্ড পুনরায় শুরু করার ব্যবস্থা নেয়া। যদি সরকার এটা বাস্তবায়ন করে, তাহলে তিগ্রেদের উচিৎ হবে আফার অঞ্চল থেকে সরে আসা এবং সামরিক কর্মকান্ড থামিয়ে দেয়া। অন্যান্য আঞ্চলিক মিলিশিয়াদেরও উচিৎ হবে যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনায় বসা। একইসাথে এরিত্রিয়ারও উচিৎ হবে ইথিওপিয়ার অভ্যন্তর থেকে তাদের সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়া। চার্লস রেএর প্রস্তাবগুলি আপাত দৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও দুই পক্ষকে রাজি করানোর কাজটা কে করবে, তা নিশ্চিত নয়। আবি আহমেদ একসময় মার্কিন সরকারি সহায়তা সংস্থা ‘ইউএসএআইডি’এর প্রধান সামানথা পাওয়ারের সাথে দেখা করতে পর্যন্ত রাজি হননি। প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধের গতিপথ জাতিগত নিধন ছাড়া আর কোনদিকেই যায়নি; যা সেখানকার জনগণের উপর অবর্নণীয় নির্যাতন নিয়ে এসেছে।

‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে মানবাধিকার সংস্থা ‘এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’এর জেষ্ঠ্য উপদেষ্টা ডোনাটেলা রোভেরা তিগ্রে যুদ্ধে মারাত্মক মানবাধিকার লংঘনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, এই ঘটনা যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই চলছে এবং উভয় পক্ষই যৌন নির্যাতনকে একটা এজেন্ডা নিয়ে লড়ছে। শত্রু জাতির সর্বোচ্চ ক্ষতি এবং অপমান করাই যেন এখানে মূল উদ্দেশ্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন যে, নয় মাসের যুদ্ধের পরেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন কথাসর্বস্বই থাকছে, তখন তা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মারাত্মক একটা উদাহরণ তৈরি করছে। ‘ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন’এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মার্টিন প্লাউট মন্তব্য করছেন যে, তিগ্রেতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারগুলি কয়েকজন কমান্ডো বা অবাধ্য ইউনিটের উপর চাপিয়ে দিলে ভুল করা হবে। এই অপরাধগুলি এতটাই ব্যাপক যে, এটা বুঝতে বাকি থাকে না যে, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে অনুমতিক্রমেই এই কর্মকান্ড চালানো হচ্ছে। তিনি গণহত্যার কর্মকান্ডের জন্যে ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট আবি আহমেদ এবং এরিত্রিয়ার প্রেসিডেন্ট ইসাইয়াস আফওয়ের্কিকে সরাসরি দায়ী করেন। তিনি বলেন যে, যৌন নিপীড়ণকে একটা কৌশল ধরে নিয়ে এগুচ্ছে ইথিওপিয়া সরকার। গত নভেম্বরে যুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিন পরেই ‘ইউএস ইন্সটিটিউট অব পিস’এর ভবিষ্যৎবাণীকে টেনে এনে তিনি বলেন যে, নয় মাস পর মনে হচ্ছে যে, রাষ্ট্র হিসেবে ইথিওপিয়ার স্থায়িত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এটা নিশ্চিত না হলেও এটা এখন একটা সম্ভাবনা।

 
ছবিঃ ডিসেম্বর ২০১৯। গণতন্ত্রের ‘পোস্টারচাইল্ড’ আবি আহমেদ নোবেল পুরষ্কার নিচ্ছেন। অনেক আগে থেকেই আবি আহমেদের কলঙ্কগুলি বোঝা যাচ্ছিলো, কিন্তু পশ্চিমারা হয় সেগুলি দেখেনি অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছে। পশ্চিমারা তাকে খোলা চেক দিয়েছে এবং এরপর চুপ করে থেকেছে। কারণ তাকে দিয়ে বিভিন্ন আদর্শিক প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল পুরো আফ্রিকার জন্যে পশ্চিমা গণতন্ত্রের একটা উদাহরণ তৈরি করার জন্যে।


গণতন্ত্রের ‘পোস্টারচাইল্ড’

‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, পশ্চিমারা কিভাবে আবি আহমেদকে ভুল বুঝে নোবেল পুরষ্কার দিয়েছে এবং সারা বিশ্বের কাছে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে লস এঞ্জেলেসএর ‘ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া’র বাস্কেটবল স্টেডিয়ামে আবি আহমেদকে বিশাল সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। সেই সংবর্ধনার আয়োজনের দায়িত্ব পড়েছিল ইথিওপিয়ার কূটনীতিক বেরহানে কিদানেমারিয়ামএর উপর। তিনি দুই দশক আগে থেকে আবি আহমেদকে চেনেন, যখন আবি ইথিওপিয়ার সামরিক ইন্টেলিজেন্সে কাজ করতেন। তবে কিদানেমারিয়ামের আরেকটা পরিচয় হলো তিনি একজন তিগ্রে। তিনি লস এঞ্জেলেসএর অনুষ্ঠানের শুরুতে স্টেজে উঠেছিলেন আবিএর ওঠার আগে। তখন গ্যালারি থেকে চিৎকার করে বলা হয় ‘তিগ্রেয়ান তুমি পোডিয়াম থেকে নেমে যাও’। তাকে আরও কিছু গালাগাল শুনতে হয়। কিন্তু আবি আহমেদ পোডিয়ামে উঠে এই গালাগালের ব্যাপারে কোন কিছুই বলেননি। কিদানেমারিয়াম মধ্যাহ্ন ভোজের সময় যখন আবিকে জিজ্ঞেস করেন যে, আবি কেন এই গালাগালের প্রতিবাদ করলেন না, তখন আবি বলেন যে, ‘এখানে তো শুদ্ধ করার কোনকিছু ছিল না’।

‘সিএনএন’ বলছে যে, অনেক আগে থেকেই আবি আহমেদের সমস্যাগুলি বোঝা যাচ্ছিলো, কিন্তু পশ্চিমারা হয় সেগুলি দেখেনি অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছে। পশ্চিমারা তাকে খোলা চেক দিয়েছে এবং এরপর চুপ করে থেকেছে। ‘আদ্দিস স্ট্যান্ডার্ড’এর প্রধান সম্পাদক সেদালে লেমা বলছেন যে, নোবেল পুরষ্কার পাবার পর আবি মনে করেছিলেন যে, তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন। আবিকে নোবেল পুরষ্কার দেবার ক’দিন পরে লেমা এক লেখায় বলেন যে, যে কাজটার জন্যে তাকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ এরিত্রিয়ার সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করা, সেই কাজটা তিগ্রেয়ানদেরকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। ‘তিগ্রেয়ান পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা ‘টিপিএলএফ’ তিন দশক কঠোর হস্তে ইথিওপিয়া শাসন করেছিল; যাদের পরে আবিএর উত্থান হয়। ‘টিপিএলএফ’এর নেতৃত্বে ইথিওপিয়া এরিত্রিয়ার সাথে বহুবছর যুদ্ধ করেছে। আবি ক্ষমতায় এসেই ‘টিপিএলএফ’এর ক্ষমতা কর্তন করা শুরু করেন। বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ সায়ত্বশাসন চাইতে শুরু করলে আবি কঠোর ভূমিকা নিতে থাকেন। যুদ্ধের মাঝেই আবি আহমেদ নির্বাচন ডেকে বিরাট জয় পান; গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দলগুলি নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে। অনেকেই বলছেন যে, আবি এমন একটা পরিস্থিতি পেয়েছেন, যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তিনি সেই পরিস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে কোনকিছুই করতে পারবেন না। তাই যেসকল সংস্কারের কথা তিনি বলেছেন, সেগুলির বাস্তবায়ন কতটা বাস্তব, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

কেন আবি?

আবি আহমেদের আগে অনেকেই ইথিওপিয়াতে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। পশ্চিমাদের খুশি করার জন্যে সকল কিছুই তিনি বলেছেন। বিনিময়ে সেই সন্মানও তাকে পশ্চিমারা দিয়েছে। গণতন্ত্রের ‘পোস্টারচাইল্ড’ আবি আহমেদের কলঙ্কগুলি পশ্চিমারা খুব সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে। কারণ তাকে দিয়ে বিভিন্ন আদর্শিক প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল পুরো আফ্রিকার জন্যে পশ্চিমা গণতন্ত্রের একটা উদাহরণ তৈরি করার জন্যে। কিন্তু জাতিগত সংঘাতের পটভূমিকে তারা পুরোপুরিভাবে ভুলে গিয়েছে; যা কিনা আদর্শিক সংস্কার বাস্তবায়নকে প্রথম দিন থেকেই অবাস্তব করে ফেলেছিল। তথাপি কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ‘হর্ন অফ আফ্রিকা’ অঞ্চলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে ইথিওপিয়ার নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমা দেশগুলির জন্যে অপরিহার্য। গ্রেট পাওয়ার প্রতিযোগিতার মাঝে আবিএর অধীনে একটা পশ্চিমা ধাঁচের সরকার সর্বদা পশ্চিমাদের স্বার্থই দেখবে; এটাই ছিল কৌশলগত চিন্তা। আর তাই দশ মাস ধরে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে গণহত্যা এবং যৌন নির্যাতন করার পরেও পশ্চিমারা কথাসর্বস্বই থেকেছে। আবিএর দেয়া অবরোধে তিগ্রেতে চলছে দুর্ভিক্ষ। গণতন্ত্রের ‘পোস্টারচাইল্ড’ আবি আহমেদের জন্যে পশ্চিমাদের এই নিরবতাই যেন সর্বোচ্চ সন্মান!

কিন্তু যুদ্ধের বাস্তবতা আবিকে সামরিক সহায়তার জন্যে দ্বারে দ্বারে নিচ্ছে; কারণ যত সহজে তিনি এই যুদ্ধের সমাপ্তি টানবেন বলে মনে করেছিলেন, তা তার ধারেকাছেও ছিল না। সামরিক সহায়তা দেবার ক্ষেত্রে ইরান, ইস্রাইল এবং তুরস্কের নাম আসছে এক্ষেত্রে। কিন্তু সেই সহায়তাগুলি কি যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করার জন্যে যথেষ্ট হবে? তবে জাতিগত নিধনের যে নীতি নিয়ে আবি এগিয়েছেন, তাতে ইথিওপিয়া রাষ্ট্রের ভিতটাকেই তিনি নড়বড়ে করে ফেলেছেন। উভয় পক্ষই এখন সামরিক সমাধানের দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি কোন প্রকারে সেখানে যুদ্ধবিরতি হয়ও, ঘটে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতনের স্মৃতিগুলি ভুলে গিয়ে তারা এগুতে পারবে কি?

Monday 13 September 2021

ভারত এবং ইরান কি চাইছে আফগানিস্তানে?

১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২১

ছবিঃ কাবুলে পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স প্রধান প্রধান জেনারেল ফাইজ হামীদ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানের ফলাফলস্বরূপ ভারত এবং ইরান উভয়েই পাকিস্তানকে বাইপাস করতে গিয়ে রাশিয়াকে পাশে পেতে চাইবে। কিন্তু রাশিয়াও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন কোন কর্মকান্ডকে সমর্থন দেবে না, যা কিনা পুরো অঞ্চলকে অস্থির করতে পারে। কারণ কাবুলের ইন্টেলিজেন্স বৈঠকের পর এটা এখন পরিষ্কার যে, আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ এখন কার হাতে।


গত ১১ই সেপ্টেম্বর, ৯/১১এর বিশ বছর পূর্তিতে কাবুলে তালিবান সরকারের শপথ নেবার সাইডলাইনে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছিল। পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স প্রধান জেনারেল ফাইজ হামীদ আঞ্চলিক ইন্টেলিজেন্স প্রধানদের একটা আলোচনায় ডাক দেন। যদিও অফিশিয়ালি কোনকিছু বলা হয়নি, তথাপি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু উৎস থেকে জানা যাচ্ছে যে, তার আমন্ত্রণ তালিকায় ছিল চীন, রাশিয়া, ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান। পাকিস্তানের ‘সামাআ টিভি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, অংশগ্রহণকারীরা একমত পোষণ করেন যে, আফগানিস্তানের সমস্যাগুলি আফগানিস্তানের উপর ছেড়ে দেবেন না তারা। ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ বলছে যে, দীর্ঘমেয়াদে অঞ্চলিক শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তারা কথা বলেছেন। তবে পত্রিকাটা আরও বলে যে, আফগানিস্তানের আশরাফ ঘানি সরকারের বিরুদ্ধে তালিবানদের সফলতার পিছনে পাকিস্তানের সরাসরি সহায়তা ছিল।

কিন্তু যে ব্যাআপারটা মিডিয়াগুলি আলোচনা করেনি তা হলো, আলোচনায় ভারতের কোন স্থান ছিল না; যদিও ভারত বহু বছর ধরে মার্কিন সমর্থনে তালিবানদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করেছে। আফগানিস্তান নিয়ে ভারতের আলাদা কৌশল তৈরি হয়েছিল পাকিস্তানকে সঙ্কুচিত করার। তবে সেটা যে মার্কিন সমর্থনের কারণেই সম্ভব ছিল, তা এখন পরিষ্কার। কারণ এখন ভারতীয়রা আফগানিস্তানের কোন ব্যাপারেই আগের মতো নিশ্চিত নয়।

অপরদিকে ইরান ইন্টেলিজেন্স আলোচনায় আমন্ত্রিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের ভেতর থেকে নিয়মিতভাবে তালিবান বিরোধী বক্তব্য এসেছে। একইসাথে পাকিস্তান বিরোধী বক্তব্যও এসেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাব্দোল্লাহিয়ান সেপ্টেম্বর মাসেই ভারত সফরে যাবেন বলে বলা হচ্ছে। তার সফরে আফগানিস্তানে ইরান এবং ভারতের ভূমিকা আলোচিত হতে পারে বলে বলছে ভারতীয় মিডিয়া ‘দ্যা প্রিন্ট’। তাই আফগানিস্তানের ব্যাপারে এই দুই দেশের অবস্থান কেমন হবে, তা এখন আলোচ্য বিষয়।

ভারত তালিবানকে সমর্থনই দেবে… কিন্তু কেন?

আফগানিস্তানে তালিবানদের ক্ষমতা নেবার ব্যাপারে ভারতীয় মিডিয়া স্ববিরোধী রিপোর্টিং করেছে। তারা কেউ কেউ তালিবান বিরোধী খবর প্রচার করতে গিয়ে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরতেও পিছপা হয়নি। ভারতীয় মিডিয়া ‘দ্যা ওয়্যার’ বলছে যে, গত ৭ই সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের উত্তর পূর্বের পাঞ্জশির উপত্যকায় তালিবানরা আহমেদ মাসুদের অনুসারী বিদ্রোহী গ্রুপের বিরুদ্ধে বিজয় আর্জনের ঘোষণা দেবার সাথেসাথে ভারতের ‘রিপাবলিক টিভি’ বলে যে, পাঞ্জশিরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তালিবানদের পক্ষে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। প্রতিবেদনে তারা একটা ভিডিও প্রচার করে, যা তারা লন্ডন থেকে প্রচারিত আফগানিস্তানভিত্তিক মিডিয়া ‘হাসতি টিভি’র কাছ থেকে পেয়েছে বলে উল্লেখ করে। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এই খরব এবং ভিডিও পুরোটাই ছিল মিথ্যা। কিন্তু এই খবর ভারতের বেশিরভাগ মিডিয়াতে প্রচার করা হয়। ‘টাইমস নাউ নাভভারত’ এবং ‘জী হিন্দুস্তান’ ঐ একই ভিডিওখানা প্রচার করে। ফারান জেফরি নামের একজন অনলাইন নিরাপত্তা বিশ্লেষক এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, ৬ই সেপ্টেম্বর ‘হাসতি টিভি’র প্রচার করা ঐ ফুটেজ প্রকৃতপক্ষে ‘আরমা ৩’ নামের একটা ভিডিও গেম থেকে নেয়া হয়েছে। আর ঐ ফুটেজে দেখানো বিমান হলো মার্কিন বিমান বাহিনীর ‘এ ১০ ওয়ার্থগ’ বিমান। আরেকটা ফুটেজ প্রচার করে ‘টিভি ৯ ভারতবর্ষ’; এবং বলে যে, এটা পাঞ্জশিরের যুদ্ধে পাকিস্তানের জড়িত থাকার প্রমাণ। ‘ইউকে ডিফেন্স জার্নাল’এর এক লেখায় বলা হয় যে, ঐ ফুটেজ ধারণ করা হয়েছে ব্রিটেনের ওয়েলসের পাহাড়ি এলাকায়। ‘ম্যাক লুপ’ নামের ঐ জায়গাটা এখন একটা পর্যটন স্থান; সেখানে অনেক মানুষ যায় খুব কাছে থেকে ব্রিটিশ ও মার্কিন বিমান বাহিনীর বিমানের প্রশিক্ষণ মহড়া দেখতে এবং ছবি তুলতে। এই রিপোর্টিংগুলি থেকে পরিষ্কার যে, ভারতীয় মিডিয়ার একাংশ তালিবানদের পছন্দ করেনা বিধায় তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা খবর ছড়িয়েছে। আবার ভারতীয় মিডিয়ার আরেকাংশ সেই মিথ্যা তথ্যকে জনসন্মুখে উন্মোচিত করেছে।

 
ছবিঃ মস্কো, মার্চ ২০২১। তালিবান প্রতিনিধিরা আফগানিস্তানের অন্যান্য নেতাদের সাথে শান্তি আলোচনায়। ভারতীয় কর্মকর্তারা ২০২০ সাল থেকেই তালিবানদের সাথে আলচনায় বসছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগের পর আফগানিস্তানের বাস্তবতা মেনে নিয়েই ভারতীয়রা এগিয়ে যেতে চাইছে। এক্ষেত্রে উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং বাস্তববাদীরা উভয়েই বলছেন তালিবানদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে।


ভারতীয় চিন্তাবিদেরা বাস্তবতাকে ধরেই এগুচ্ছে। ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ বা ‘ওআরএফ’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর কাতারের দোহায় তালিবানদের সাথে আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। এতে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভারতের ভুমিকা বেশ বড় হয়েছিল বলে বলা হয়। তবে তখনও মার্কিনীরা আফগানিস্তান ছেড়ে যায়নি। গত অগাস্টে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীর পলায়নের পর ‘ওআরএফ’ সেই ব্যাপারটাকে নিয়েই এগিয়ে যাবার কথা বলে। সিনিয়র ফেলো মায়া মিরচানদানি এক লেখায় বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগের পর ভারতকে ঠিক করতে হবে যে, তারা কি ছোট কারণে তালিবানকে ঘৃণা করে যাবে, নাকি চীন ও পাকিস্তানের কাছে আফগানিস্তানকে ছেড়ে না দিয়ে ফাঁকা স্থান পূরণ করবে।

ভারতের প্রথম সাড়ির মিডিয়াতে উগ্র জাতীয়তাবাদী লেখাও দেখা যাচ্ছে। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’তে এক লেখায় ভারতীয় লেখক সুনীল সরন ভারত সরকারকে তালিবানদের পক্ষ নিতে বলছেন। কারণ তালিবানদের এই সরকার বাস্তববাদি চিন্তার সরকার। তার কথায় যেহেতু পাকিস্তান একটা দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হবে না কখনোই, তাই ভারতের উচিৎ হবে পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলা। আর এতে সহায়তা করতে পারে আফগানিস্তান। তিনি বলেন যে, ভারতের উচিৎ হবে তালিবানদেরকে পক্ষে নিয়ে এসে পাকিস্তানের খাইবার পুখতুনওয়ালা অঞ্চল আফগানিস্তানের সাথে জুড়ে দেয়ার জন্যে আফগানদের সহায়তা করা। ভারত সরকার আফগানিস্তানের উন্নয়নে ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে; যদিও এটা ভারতীয়দের কাছে পরিষ্কার ছিল যে, মার্কিনীরা যুদ্ধ জিততে পারছে না। তবে তিনি মার্কিনীদের হারের জন্যে পাকিস্তানকে দায়ী করেন। আফগানিস্তান পুননির্মাণে যে বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে, তার একটা অংশ ভারত দিতে পারে। ভারত না আসলে চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য রাষ্ট্র সেই স্থান নিয়ে নেবে। এতদিন ভারত তালিবানদের বিরুদ্ধে লড়াই করা মার্কিনীদের পুতুল সরকারকে সহায়তা দিলেও বর্তমানে তালিবানরা ভারতের তৈরি করে দেয়া অবকাঠামোই ব্যবহার করছে।

তবে সকলে আবার অতটা উগ্র চিন্তা ধারণ করছেন না। আরেক ভারতীয় মিডিয়া ‘দ্যা কুইন্ট’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে অবস্থান নিতে ভারতের হয়তো রাশিয়ার উপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে আফগানিস্তানে ভারতকে স্থান দিতে রাশিয়া কতটা আগ্রহী হবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। যদিও রুশরা চায় যে, আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভারতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকুক, তথাপি ইসলামাবাদকে ক্ষেপিয়ে রাশিয়া ভারতকে টেনে নিয়ে আসবে না; কারণ তালিবানদের উপর ইসলামাবাদের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। তবে রাশিয়ার সহায়তায় ভারত তালিবানদের সাথে আলোচনায় বসতে পারে বলে সেখানে বলা হচ্ছে। একইসাথে চীন এবং ইরানের সাথেও আলোচনায় বসার জন্যে বলা হয়। তবে তালিবানদের স্বীকৃতি দেয়া ভারতের জন্যে অত্যন্ত কঠিন হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগের পর আফগানিস্তানের বাস্তবতা মেনে নিয়েই ভারতীয়রা এগিয়ে যেতে চাইছে। এক্ষেত্রে উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং বাস্তববাদীরা উভয়েই বলছেন তালিবানদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে। আফগানিস্তানে কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ছেড়ে আসা ভারতীয়দের জন্যে কঠিন ছিল। আর এতকাল আফগানিস্তানে থেকে তালিবানদের বিরুদ্ধে সহায়তা দেয়ার পর এখন সেখানে পাকিস্তানের প্রভাবে তালিবানদের নিয়ন্ত্রণ দেখাটা তাদের জন্যে পীড়াদায়ক হয়েছে। তাদের মিডিয়াতে তালিবানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়াবার প্রবণতা ভারতীয়রা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করেছে। যাদের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে তারা এতটা আগ্রহী, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা খবর ছড়ানো কেন? জুন মাসেই কাতারি কূটনীতিকের বরাত দিয়ে ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ বলে যে, ভারতীয় কর্মকর্তারা তালিবানের সাথে আলোচনা করছে।

ইরান … শিয়াদের রক্ষা করবে, নাকি বাস্তবতা মেনে নিয়ে এগুবে?

গত ৬ই সেপ্টেম্বর ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাঈদ খতিবজাদেহ সাংবাদিকদের বলেন যে, পাঞ্জশির উপত্যকায় বিমান হামলার যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা ইরান সরকার কঠোরতম ভাষায় নিন্দা জানাচ্ছে। এখানে কোন বিদেশী হস্তক্ষেপ রয়েছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। যেটা এখন পরিষ্কার তা হলো, খতিবজাদেহ যে ‘খবর’এর উপর ভিত্তি করে এই মন্তুব্য করেছিলেন, তার পুরোটাই ছিল মিথ্যা খবর। উল্টো পাঞ্জশিরে তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তাজিকরাই বলেছে যে, তাজিকিস্তানে পালিয়ে যাওয়া আফগান বিমান বাহিনীর বিমানগুলি তাজিকিস্তানের বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করে তালিবানদের উপর বিমান হামলা চালিয়েছে।

৭ই সেপ্টেম্বর ইরানের পার্লামেন্টের এক বদ্ধদুয়ার বৈঠকে দেশটার রেভোলিউশনারি গার্ড কোর বা ‘আইআরজিসি’র প্রধান এসমাইল ঘানি আফগানিস্তানের ব্যাপারে ইরানের কৌশল তুলে ধরেন। পার্লামেন্ট সদস্যদের কথায় তিনি আফগানিস্তানে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সরকারের ব্যাপারে ইরান সরকারের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। আফগানিস্তানের শিয়াদের জন্যে ইরানের সমর্থনের ব্যাপারেও তিনি কথা বলেন এবং যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে শিয়াদের সাথে সুন্নিদের দ্বন্দ্ব দেখতে চায় বলে মন্তব্য করেন। একইসাথে ঘানি এও বলেন যে, ইরানের উচিৎ হবে আফগানিস্তানে নিজেদের অবস্থান শক্ত করা যাতে সেখানে সুন্নিদের সাথে শিয়াদের দ্বন্দ্ব প্রতিহত করা যায়। আফগানিস্তানে ইরানের অবস্থানের ব্যাপারে ‘আইআরজিসি’ ছাড়াও লিবারালরাও কথা বলছেন।

ইরানের লিবারাল পত্রিকা ‘সার্ঘ’এর এক লেখায় বলা হয় যে, ইরানের সরকারি মিডিয়াতে পাঞ্জশির যুদ্ধকে খুব একটা বড় গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়নি। এছাড়াও তালিবানদের অধীনে কাবুলের জীবনযাত্রাকে একেবারেই স্বাভাবিক হিসেবে তুলে ধরা হয়। পত্রিকাটা বলে যে, কট্টরপন্থীরা আহমেদ মাসুদকে এড়িয়ে গেছে। আফগানিস্তানে ইরানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হোসেইন জাফারিয়ান বলেন যে, কট্টরপন্থীরা মাসুদের চরিত্র হনন করেছে। মাসুদ ইরানের সমর্থন চেয়ে না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চেয়েছেন। এক টুইটার বার্তায় ‘ইউনিভার্সিটি অব তেহরান’এর প্রফেসর সাদেঘ জিবাকালাম বলেন যে, সিরিয়াতে বাশার আল আসাদের সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ইরান এবং রাশিয়া ৫ লক্ষ সিরিয়কে হত্যা করেছে। কিন্তু পাঞ্জশিরে হত্যাকান্ড বন্ধ করায় কিছুই করেনি; যেখানে ফারসি ভাষাভাষী শিয়া হাজারা সম্প্রদায়ের লোকেরাও ছিল। ইরানের ‘রিফর্মস ফ্রন্ট’এর বিবৃতিতে বলা হয় যে, আফগানিস্তান এবং পাঞ্জশিরে জাতিগত হত্যাযজ্ঞের সম্ভাবনা রয়েছে। এবং তারা সরকারকে একটা ‘দুর্যোগকালীন টাস্কফোর্স’ গঠন করার অনুরোধ জানায়, যার কাজ হবে আফগান নীতি নিয়ে কূটনৈতিক কাজ করা।

 
ছবিঃ সিরিয়াতে যুদ্ধ করা আফগানিস্তানের শিয়া হাজারাদের থেকে রিক্রুট করা ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’এর সদস্যরা। যদিও ইরান নিয়মিতই বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে শিয়াদের সাথে সুন্নিদের দ্বন্দ্ব দেখতে চায়, তথাপি ইরানই চেয়েছে শিয়াদের মাঝ থেকে রিক্রুট করা ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’কে আফগান সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাতে। এখন কাবুলে সরকার পরিবর্তনের কারণে এই প্রকল্প তেহরানের নেতৃত্বের কাছে বাস্তবতা বিবর্জিত ঠেকছে।


ইরানে কেউ কেউ দাবি তুলেছিল যে, হাজারাদের মাঝ থেকে রিক্রুট করা ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’কে তালিবানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হোক। ২০১৪ সালে এই সংস্থাকে তৈরি করা হয়েছিল সিরিয়ার যুদ্ধে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে। তবে ৭ই সেপ্টেম্বর ইরানের সরকারের মুখপাত্র ‘ফার্স নিউজ এজেন্সি’র এক লেখায় পাল্টা যুক্তি দেয়া হয় যে, মাত্র ১৫ হাজার ‘ফাতেমিউন’ প্রায় ১ লক্ষ তালিবানের বিরুদ্ধে কিই বা করতে পারে। উল্টো এতে শিয়াদের সাথে সুন্নিদের বড় আকারের যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। সিরিয়া আর আফগানিস্তানের বাস্তবতা ভিন্ন। সিরিয়াতে ইরান একটা ক্ষমতাসীন সরকারের অনুরোধে হস্তক্ষেপ করেছে; এবং সেখানে শিয়াদের এবং ইরানের প্রতি হুমকি মোকাবিলায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে। একইসাথে ‘ফার্স’ বলছে যে, ইয়েমেনে হুথিদের সহায়তা দেবার জন্যে ২০১৫ সালে সৌদি সামরিক হস্তক্ষেপের পর থেকে ইরান সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছে। তবে পাঞ্জশিরের যুদ্ধে অংশ নেয়া বিদ্রোহীরা অথবা তালিবান, কোন পক্ষই আফগান জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না বলে সেখানে বলা হয়।

ইরানের বাস্তবতা যে কতটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে, তা বোঝা যাবে ২০২০ সালে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের ‘টিওএলও নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে, ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’কে আফগান সেনাবাহিনীর সহায়তায় আইসিসের বিরুদ্ধে মোতায়েন করা যেতে পারে। অথচ এখন সেই ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’এর আকার তালিবানদের তুলনায় ছোট বলে বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে ইরান সরকার। তালিবানদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে সরাসরি হস্তক্ষেপের পক্ষে লবিং করছে লিবারালরা। তবে কট্টরপন্থীরা সেতুলনায় ধীরে চলার পক্ষপাতি। উভয় পক্ষই আফগানিস্তানে শিয়াদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখার পক্ষে কথা বললেও কট্টরপন্থীরা সামরিক হস্তক্ষেপ না করে বরং কূটনৈতিকভাবে এগুবার পক্ষে।

ভারত এবং ইরান হঠাত করেই রূড় বাস্তবতার মাঝে পরে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র যতদিন আফগানিস্তানে অবস্থান করেছে, ততদিন ইরান এবং ভারত উভয়েই আফগানিস্তানে নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিল। যদিও ইরান নিয়মিতই বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে শিয়াদের সাথে সুন্নিদের দ্বন্দ্ব দেখতে চায়, তথাপি ইরানই চেয়েছে শিয়াদের মাঝ থেকে রিক্রুট করা ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’কে আফগান সেনাবাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধ করাতে। এখন কাবুলে সরকার পরিবর্তনের কারণে এই প্রকল্প তেহরানের নেতৃত্বের কাছে বাস্তবতা বিবর্জিত ঠেকছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানের ফলাফলস্বরূপ উভয় দেশই পাকিস্তানকে বাইপাস করতে গিয়ে রাশিয়াকে পাশে পেতে চাইবে। কিন্তু রাশিয়াও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন কোন কর্মকান্ডকে সমর্থন দেবে না, যা কিনা পুরো অঞ্চলকে অস্থির করতে পারে। কারণ কাবুলের ইন্টেলিজেন্স বৈঠকের পর এটা এখন পরিষ্কার যে, আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ এখন কার হাতে।

Sunday 12 September 2021

ইউক্রেন … আফগানিস্তানের পর…

১২ই সেপ্টেম্বর ২০২১

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট দলদিমির জেলেনস্কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার সিদ্ধান্ত ইউক্রেনকে বিচলিত করেছে এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সাথে থাকবে, সেব্যাপারে তারা নিশ্চিত হতে পারছে না। আর বাইডেন প্রশাসনের নীতি পাল্টাবার কারণে ইউক্রেন আরও বেশি সন্দিহান হয়েছে ওয়াশিংটনের দীর্ঘমেয়াদি সমর্থনের ব্যাপারে। এরূপ অবস্থায় ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নগামী প্রভাবকে কিছুটা হলেও প্রতিস্থাপিত করার জন্যে অন্যান্য শক্তিদের সুযোগ সৃষ্টি হবে; যার মাঝে ব্রিটেন এবং তুরস্ক অন্যতম।


ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছেন। অনেকেই এতে ইউক্রেনের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ব্যাপারে আশা দেখলেও এই সফর ছিল সমস্যায় পরিপূর্ণ। বাইডেন জেলেনস্কিকে বলেন যে, গত বছরের ৪’শ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার পর এবছর আরও ৬০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ‘বিবিসি’ বলছে যে, দুই বছর আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেলেনস্কির কাছে শর্ত দিয়েছিলেন যে, যদি ইউক্রেন সরকার ঘোষণা দেয় যে, মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে প্রার্থী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, তাহলে জেলেনস্কি ট্রাম্পের সাথে দেখা করতে পারবেন এবং সামরিক সহায়তা পাবেন। জেলেনস্কি ট্রাম্পের কথা না শুনলেও বাইডেনের দেখা পাওয়াটা জেলেনস্কির জন্যে মোটেও সহজ হয়নি। জেলেনস্কির সফরে বাইডেনের সাথে সাক্ষাৎ দুইবার পিছাতে হয়েছিল; কারণ বাইডেন মার্কিনীদের কাবুল ছেড়ে আসার শেষ মুহুর্তটা তদারকি করতে ব্যস্ত ছিলেন। জেলেনস্কি ‘বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কঠিন সময়ে’ তাকে সাক্ষাৎ দেবার জন্যে বাইডেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ‘বিবিসি’ বলছে যে, অন্যান্য বিশ্ব নেতার মতো জেলেনস্কিও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ছেড়ে আসাটা বিশ্বব্যাপী মার্কিনীদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কি বার্তা বহণ করবে। আর কতটাই বা বিশ্বাস করা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধুদের রক্ষা করবে?

জেলেনস্কির যুক্তরাষ্ট্র গমনের আগেই মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর সিনিয়র ফেলো স্টিভেন পাইফার এক লেখায় বলেন যে, ইউক্রেনের উচিৎ যুক্তিযুক্ত আশা নিয়ে ওয়াশিংটন যাওয়া। তিনি বলছেন যে, বাস্তবতা হলো, ন্যাটো রাশিয়াকে এড়িয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাই ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ পাবার ব্যাপারে আশা করলে ভুল করবে। ন্যাটো সদস্যপদ পাবার জন্যে যেসকল শর্ত রয়েছে, সেগুলি ইউক্রেন পূরণ করতে থাকুক। পরবর্তীতে যখন একটা সুযোগ সৃষ্টি হবে, তখন ইউক্রেন সদস্যপদের দাবি তুলতে পারবে। কিয়েভের নেতৃত্বকে বুঝতে হবে যে, ওয়াশিংটনের সাথে বার্লিন বা ব্রাসেলসের দ্বন্দ্ব ইউক্রেনের জন্যে ভালো হবে না। যদিও রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত বল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে তৈরি হওয়া ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইনের কারণে ইউক্রেনই সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে। বরং ইউক্রেন বলতে পারে যে, ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইনকে রাশিয়া যেন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারে, সেই লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি যেন ইউক্রেনের পক্ষে থাকে। ইউক্রেনের জ্বালানি নিরাপত্তা নিরসনে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। আর ইউক্রেনের বাজার উন্মুক্তকরণ, আইনের শাসন কায়েম, ব্যবসায়ীদের প্রভাব কর্তন এবং দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসতে পারলেই জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রে তার সমর্থক পাবেন।

 

রুশ আমেরিকান সাংবাদিক ভ্লাদিস্লাভ দাভিদজন ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, এই সাক্ষাৎ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বের দিক থেকে জার্মানিকে ইউক্রেনের উপর স্থান দেবার পর। ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইন তৈরির উপর বাইডেন প্রশাসন আর কোন নিষেধাজ্ঞা না দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউক্রেনকে বাইপাস করে তৈরি করা এই পাইপলাইন ইউক্রেনের জন্যে অনেক বড় ইস্যু। এতে ইউক্রেনের জ্বালানি নিরাপত্তা ব্যহত হবে। তবে যে ব্যাপারটা নিয়ে ইউক্রেনিয়ানরা সবচাইতে বেশি চিন্তিত তা হলো আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চলে আসার ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইউক্রেনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কি বয়ে আনবে। আফগানিস্তান থেকে সরে আসার সময় বাইডেন আফগানদের উপরেই দোষ দিয়েছিলেন, যে আফগানরা নিজেদের জনগণকে রক্ষা করার জন্যে যুদ্ধ করেনি। ইউক্রেনিয়ানরা এই ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখেনি।

দাভিদজন বলছেন যে, ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি নিয়ে অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করলেও বাইডেন প্রশাসনের শুরুতেই আফগানিস্তান থেকে অপরিকল্পিতভাবে সরে আসাটা অনেক বড় একটা পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা। ইউক্রেনে অনেকেই মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলি থেকে অব্যাহতি নিয়ে রাশিয়ার সাথে সংঘাত কমিয়ে ফেলতে চাইছে; যাতে করে তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে মোকাবিলা করা সহজ হয়। ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সন্দিহানরা ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেবার ব্যাপারে ন্যাটোর দুর্বল বক্তব্যকে তুলে ধরছেন। প্যারিস এবং বার্লিনকে পক্ষে না পেয়ে বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান করার ব্যাপারটা নিয়ে এগুতে চাইছে না। কারণ ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেয়াটা রাশিয়া হুমকি হিসেবে দেখতে পারে। গত জুনে বাইডেন এবং পুতিনের শীর্ষ বৈঠকের ঠিক আগে আগে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্যে ১’শ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা স্থগিত করে। ওয়াশিংটন বলছে যে, মার্কিন সহায়তা পাবার জন্যে যেসকল সংস্কার করার শর্ত দেয়া হয়েছিল, সেগুলি পূরণে ইউক্রেন যথেষ্ট যত্নবান নয়। অপরদিকে ইউক্রেনিয়ানরা মনে করছে যে, দেশের একটা অংশ যখন অন্য দেশের দখলে রয়েছে আর সেখানে কয়েক হাজার ইউক্রেনিয়ান যুদ্ধে নিহত হয়েছে, তখন তাদের কাছে জাতীয় নিরাপত্তা দূর্নীতির চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ওবামা প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে বাইডেন ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হবার পর তার সিদ্ধান্তগুলির ব্যাপারে ভলদিমির জেলেনস্কি সাবধানে পা ফেলবেন। বাইডেন বলেছেন যে, আফগানিস্তান থেকে সরে আসার পর যুক্তরাষ্ট্র তার ভবিষ্যতের হুমকিগুলি মোকাবিলা করায় মনোযোগী হতে পারবে; যার মাঝে রয়েছে রাশিয়া। তবে জেলেনস্কি ফিরে গিয়ে দেখতে চাইবেন যে, কার্যক্ষেত্রে তা কতটুকু। ইউক্রেনের পত্রিকা ‘ইউক্রেনস্কা প্রাভদা’ এক সম্পাদকীয়তে বলছে যে, যেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কথা উঠেছিল যে, তিনি রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ভালো করতে চাইছিলেন, সেই ট্রাম্পের কাছ থেকেই বর্তমানের চাইতে বেশি সমর্থন পেয়েছে ইউক্রেন।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় পূর্ব ইউরোপ বিশ্লেষক ভ্লাদিমির সকর বলছেন যে, আগে থেকেই মানা করে দেয়া থাকলেও জেলেনস্কি ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদের ইস্যুটা বাইডেনের সাথে আলোচনায় তুলেছেন। এবং পরবর্তীতে ইউক্রেনের মিডিয়াকে তিনি বলেন যে, তিনি যথেষ্ট সময় নিয়ে ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পাবার জন্যে শর্তসমূহ নিয়ে কথা বলেছেন। জেলেনস্কি ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইনের ব্যাপারেও কথা বলেছেন; এবং তিনি বলেছেন যে, এই পাইপলাইনের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের নীতি তাদের নিজেদের অন্যান্য নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। জেলেনস্কি তার জনগণকে বলেছেন যে, বাইডেন তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করলে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপ করবে। কিন্তু মার্কিন দিক থেকে এব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা আসেনি। হয়তো এটা দুই দেশের মাঝে আরও একটা ভুলবোঝাবুঝি। কিয়েভকে প্রমাণ করতে হবে যে, ইউক্রেনকে সমর্থন দেয়াটা ইউরো আটলান্টিক স্বার্থের জন্যে অত্যাবশ্যকীয়; এবং ইউক্রেন নিজে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হবার জন্যে যথেষ্ট শক্তিশালী।

ইউক্রেনের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের শর্তযুক্ত সহায়তা কিয়েভের নেতৃত্বকে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প খুঁজতে অনুপ্রাণিত করবে। গত বছর অক্টোবরে ব্রিটেন ইউক্রেনের সাথে রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে। এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশ নিয়মিতভাবে কৌশলগত আলোচনায় বসবে এবং ব্রিটেন থেকে ইউক্রেনে রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়ন করার সুযোগ থাকবে। এরপর গত জুন মাসে ব্রিটেন ইউক্রেনের নৌবাহিনীর উন্নয়নে সহায়তা দেবার জন্যে এক চুক্তি করে। প্রায় একই সময়ে ব্রিটিশ রয়াল নেভির একটা যুদ্ধজাহাজ রাশিয়ার দখলকৃত ক্রিমিয়ার কাছাকাছি রুশ নৌবাহিনীর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে একটা স্বল্প সময়ের উত্তেজনাও তৈরি করতে সক্ষম হয়। ব্রিটেন ছাড়াও ইউক্রেনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করছে তুরস্ক। গত ৭ই সেপ্টেম্বর তুরস্কের ‘আরএমকে ম্যারিন’ শিপইয়ার্ডে ইউক্রেনের নৌবাহিনীর জন্যে একটা কর্ভেট তৈরি করা শুরু হয়। ইউক্রেনের নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল ওলেকসি নাইঝপাপা সেই অনুষ্ঠানে বলেন যে, তুরস্কের সাথে সকল চুক্তি নির্ধারিত সময়ের মাঝে বা নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়েছে। উদারহরণস্বরূপ তিনি তুরস্কের ‘বায়রাকতার টিবি ২’ মনুষ্যবিহীন বিমান ড্রোনের কথা উল্লেখ করেন; যেগুলি বর্তমানে ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছে। ২০২০ সালের অক্টোবরে খবরে প্রকাশ করা হয় যে, ইউক্রেন তুরস্কের কাছ থেকে ৪৮টা ড্রোন কেনার পরিকল্পনা করছে। এর মাত্র কয়েক মাস পরেই এবছরের এপ্রিলে ‘বায়রাকতার টিবি ২’ ড্রোন ইউক্রেনের পূর্বের ডনবাস অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে উড়তে থাকে। আর জুলাই মাসে ইউক্রেনের নৌবাহিনী প্রথম ড্রোনগুলির ডেলিভারি হাতে পায়। এভাবে নিরাপত্তা ইস্যুতে অতি দ্রুত ডেলিভারি দেয়ার মাধ্যমে তুরস্ক ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সহযোগী হবার চেষ্টা করছে। ইউক্রেনের সামরিক কর্মকর্তারাও তাদের কথায় সেই ব্যাপারটাকেই তুলে ধরছেন।

ভলদিমির জেলেনস্কি যেসব ইস্যুকে ওয়াশিংটন নিয়ে যেতে চাইছিলেন, সেসব কোন ইস্যুই বাইডেন প্রশাসন আলোচনা করতে চাইছিলো না। ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন ইস্যু ওয়াশিটনের কাছে বার্লিনকে বন্ধু হিসেবে ধরে রাখার ইস্যু। আবার ন্যাটোকে কার্যকর রাখার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্স এবং জার্মানির ইচ্ছাকে এড়িয়ে যেতে পারছে না। তাই ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ সোনার হরিণই থেকে যাচ্ছে। তদুপরি ন্যাটো সদস্যপদ পাবার নিশ্চয়তা না দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সংস্কারের উপর চাপ দিচ্ছে, যা কিনা কিয়েভের নেতৃত্বকে অবাক করছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার সিদ্ধান্ত ইউক্রেনকে বিচলিত করেছে এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র যে ইউক্রেনের সাথে থাকবে, সেব্যাপারে তারা নিশ্চিত হতে পারছে না। আর বাইডেন প্রশাসনের নীতি পাল্টাবার কারণে ইউক্রেন আরও বেশি সন্দিহান হয়েছে ওয়াশিংটনের দীর্ঘমেয়াদি সমর্থনের ব্যাপারে। এরূপ অবস্থায় ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নগামী প্রভাবকে কিছুটা হলেও প্রতিস্থাপিত করার জন্যে অন্যান্য শক্তিদের সুযোগ সৃষ্টি হবে; যার মাঝে ব্রিটেন এবং তুরস্ক অন্যতম।

Saturday 11 September 2021

৯/১১… মার্কিনীরা কি বুঝতে পারছে যে সাম্রাজ্যের খেলা শেষ?

১১ই সেপ্টেম্বর ২০২১

দুই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা যুদ্ধে জয়ের কারণে নেতৃত্বশীল অবস্থানে ছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলি বড় শক্তির মাঝে একটা। গায়ের জোর দিয়ে তো বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া যায় না। অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় হিমসিম খাচ্ছে; আর ভূরাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখন একটা অনির্ভরযোগ্য সুপারপাওয়ার। হয়তো ব্রিটিশদের মতোই মার্কিনীরাও বুঝতে পারছে যে, সাম্রাজ্যের খেলা শেষ!


 ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া ঘটনার জের এখনও দুনিয়া বয়ে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিনীরা দুই দশক পরেও সেই ঘটনা নিয়ে কথা বলছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ঘটনার পর থেকেই ৯/১১এর ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই ষড়যন্ত্র বলে মনে করতে থাকে। সোশাল মিডিয়াতে অনেকেই বলতে থাকে যে, ঘটনাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডীপ স্টেট’এর লোকজন ঘটিয়েছে। এর পিছনে সেই দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছু তথ্য উপাত্ত নিয়েই অনলাইনে পোস্ট দিতে থাকে মানুষ; যা আজও চলছে। অনেকেই মনে করেন যে, জেট ফুয়েলের মাধ্যমে স্টিলের বীম গলিয়ে ফেলা সম্ভব নয়; যার ফলশ্রুতিতে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ১’শ তলা দু’টা ভবন ধ্বসে পড়ে বলে বলা হয়েছিল। এরপর রয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কিছু দূরে অবস্থিত ৪৭ তলা ‘৭ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’এর ধ্বসে পড়া। ১’শ তলা ভবনগুলি ধ্বসে পড়ার কয়েক ঘন্টা পর এই ভবনটা ধ্বসে পড়ে। ‘বিবিসি’র তৎকালীন প্রতিনিধি জেইন স্ট্যানলি টেলিভিশনে লাইভ রিপোর্টে বলেন যে, ‘৭ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’ ধ্বসে পড়েছে। অথচ রিপোর্টারের পিছনে তখনও পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিলো যে, ভবনটা দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়াও পেন্টাগন ভবনে বিমান আঘাত হেনেছে বলে বলা হয়; সেখানে ভবনে তৈরি হওয়া ছোট্ট ফুটো দিয়ে একটা বিমানের পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সেখানে বিমানের ডানা বা বিমানের বডির কিছুই ছিল না। অনেকেই সন্দেহ করেছে যে, সেখানে বিমানের স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়াও আরও অনেকগুলি যুক্তিতর্কের অবতারণা হয় সেদিনের ঘটনাকে ঘিরে। ‘বিবিসি’ তাদের প্রতিবেদনে মার্কিন সরকার এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির বিভিন্ন প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে; যেগুলি এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেয় বলে দাবি করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনও মার্কিন জনগণের একটা অংশ রাষ্ট্র এবং মিডিয়ার এই ব্যাখ্যাগুলিকে মেনে নিচ্ছে না। “৯/১১ ট্রুথ” মুভমেন্ট নামে একটা আন্দোলন এখনও সেই ঘটনাগুলির ব্যাপারে সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে পোস্ট দিচ্ছে এবং সত্যিকারের ঘটনা জনগণকে জানাবার জন্যে দাবি করছে।

‘ইউএসএ টুডে’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ৯/১১এর ঘটনা পশ্চিমা দুনিয়াকে এক লক্ষ্যে টেনে এনেছিল। কিন্তু এখন কোনকিছুই তাদেরকে এক রাখতে পারছে না। যে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সকল দলই একমত তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র এখন গুরুত্বপূর্ণ আদর্শের ব্যাপারে পুরোপুরিভাবে বিভক্ত। বিশ বছর কেন, দশ বছর আগেও ক্যাপিটল হিলে হামলা চিন্তার বাইরে ছিল। আর এখন মার্কিন এটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড বলছেন যে, শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীরা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যে সবচাইতে বড় হুমকি। ‘পিউ রিসার্চ’এর এক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর থেকে মার্কিন রিপাবলিকানদের মাঝে মিডিয়ার উপর বিশ্বাস ৭০ শতাংশ থেকে কমে ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ ডেমোক্র্যাটদের মাঝে ৮০ শতাংশই মিডিয়াকে বিশ্বাস করছে। ভ্যাকসিনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মাঝে অনেকেই রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলিকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সামাজিক এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ এখন ইতিহাসে সবচাইতে মারাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। বৈচিত্র্যকে একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ভিত বলে মনে করা হতো। কিন্তু এখন রাজনৈতিক মেরুকরণ একটা রোগের মতো যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘বিবিসি’র উত্তর আমেরিকা সম্পাদক জন সোপেল এক লেখায় বলছেন যে, ৯/১১এর বিশ বছর পূর্তিতে ‘ইউনাইটেড স্টেটস’ এখন ‘ডিজইউনাইটেড স্টেটস’ হয়ে গেছে।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, গত দুই দশকে আফগানিস্তান এবং ইরাকের যুদ্ধে ৭ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা এবং ১ হাজারের বেশি মার্কিনীদের বন্ধু দেশের সেনা মৃত্যুবরণ করেছে। ‘ব্রাউন ইউনিভার্সিটি’র ‘কস্ট অব ওয়ার’ প্রকল্পের হিসেবে যুদ্ধাহত সেনাদের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৬ হাজার বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে! এটা যুক্তরাষ্ট্রের দশ বছরের সামরিক বাজেটের সমান! এখন পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ বেড়ে উঠছে সিকিউরিটি ক্যামেরার নিচে; মানুষের ব্যক্তিগত যোগাযোগের উপর এখন নজরদারি হচ্ছে। বড় এবং ছোট শহরগুলির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ব্যাপক সামরিক যন্ত্রপাতি দেখে সেটা সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্যবহার করা হবে, এই যুক্তি দেয়া কঠিন। সরকারি অফিসগুলি এখন দূর্গের মতো; বিমানবন্দরগুলি এখন নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা।

প্রেসিডেন্ট বুশ যুদ্ধ আরম্ভ করলেও পরবর্তী সকল প্রেসিডেন্টই চেয়েছিলেন মার্কিন সেনাদের দেশের ফিরিয়ে নিয়ে আনতে। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ পশ্চিমা বিশ্বের মাঝে একাত্মতা তৈরি হবার যে আশা জেগেছিল, তা এখন জাতীয়তাবাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ওবামা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ‘বিশ্বের পুলিশম্যান’ থাকার ভূমিকা ছেড়ে দিতে চাইছিল। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ আরও বলছে যে, ৯/১১এর পর বিশ্ব ব্যবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল, তা এখন পুরোপুরিভাবে ভেস্তে গেছে অর্থনৈতিক মন্দা এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর।

‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ বলছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন তার বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণকে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছিল; যেন ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন খুব বেশি কিছু একটা ছিল না। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭০এর মাঝে তারা বিশ্বব্যাপী মোট ৩৪টা সামরিক মিশন চালিয়েছিল। একটা বৈশ্বিক শক্তির পক্ষে তার শক্তির অবক্ষয় মেনে নেয়া কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সরে এসে চীনের দিকে মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু চীন তো সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। চীনারা একটা জাতীয়তাবাদী বড় অর্থনৈতিক শক্তি; যারা মার্কিনীদের নিজস্ব উঠানেই বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে কমাচ্ছে।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে রাশিয়া এবং চীন যেমন প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাও বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করছে। ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ বলছে যে, দুই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা যুদ্ধে জয়ের কারণে নেতৃত্বশীল অবস্থানে ছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলি বড় শক্তির মাঝে একটা। গায়ের জোর দিয়ে তো বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া যায় না। অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় হিমসিম খাচ্ছে; আর ভূরাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখন একটা অনির্ভরযোগ্য সুপারপাওয়ার। হয়তো ব্রিটিশদের মতোই মার্কিনীরাও বুঝতে পারছে যে, সাম্রাজ্যের খেলা শেষ!

Tuesday 7 September 2021

গিনি অভ্যুত্থান ... ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন

০৭ই সেপ্টেম্বর ২০২১

ছবিঃ গিনির অভ্যুত্থানের নেতা লেঃ কর্নেল মামাদি দুমবুইয়া। প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ হবার কারণে গিনিতে ফ্রান্সের প্রভাব যথেষ্ট। বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ ফ্রান্সের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছে অথবা ফ্রান্সের অধীনে কাজ করেছেন। ফরাসি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ এবং সামরিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে ফ্রান্স হয়তো তার প্রভাব কিছুটা হলেও ধরে রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু ব্যাপক গনঅসন্তোষের মাঝে জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকাটা যেমন কঠিন, তেমনি তা খুব সহজেই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্যে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে; যা পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে।


পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনিতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে বলে খবর আসছে। ৫ই সেপ্টেম্বর গিনির রাজধানী কোনাক্রিতে কয়েক ঘন্টার বন্দুকযুদ্ধের পর সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা ক্ষমতা নিয়েছে বলে সরকারি টেলিভিশনে বলা হয়। টিভিতে প্রচারিত বিবৃতিতে নয়জন সেনাকে দেখা যায়, যাদের কেউ কেউ জাতীয় পতাকায় মোড়ানো ছিল। তারা বলছে যে, প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডেকে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং দারিদ্র্যের জন্যে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। নিজেদেরকে ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর রেকনসিলিয়েশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট’ আখ্যা দিয়ে তারা সংবিধান বাতিল ঘোষণা করে। ৮৩ বছর বয়সী প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার পিছনে গ্রুপটার নেতৃত্ব দিয়েছেন লেঃ কর্নেল মামাদি দুমবুইয়া। একটা ভিডিওতে প্রেসিডেন্ট কন্ডেকে একটা সোফার উপর জিন্স এবং টিশার্ট পড়ে খালি পায়ে বসে থাকতে দেখা যায়। অভ্যুত্থানকারীরা দেশটার স্থলসীমা এবং বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করেছে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত কালুম উপদ্বীপে সরকারি অফিস এবং প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস ঘিরে ফেলেছে সেনারা। ‘বিবিসি’ বলছে যে, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাচ্যুত হবার খবরে বিরোধী দলীয় সমর্থকেরা রাস্তায় উল্লাস করে। তারা বলছে যে, প্রেসিডেন্ট কন্ডের সময়ে তারা অনেক কষ্ট করেছেন। কেউ কেউ জামা খুলে ‘দুমবুইয়া’ নামে শ্লোগান দিচ্ছে। বিরোধী দলীয় নেতা মামুদু নাগনালেন বারি ‘বিবিসি’কে বলেন যে, তিনি ভারাক্রান্তভাবে খুশি। তিনি আশা করছেন যে, সেনারা বেসামরিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

‘বিবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, অভ্যুত্থানকারীরা জনপ্রিয় কথাগুলিই এখন বলছে। বর্তমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান লেখার কথায় অনেকেই খুশি হবে। তবে সামরিক অভ্যুত্থানকারীরা পরবর্তীতে তাদের প্রতিশ্রুতি কতটা রাখবে, তা নিশ্চিত নয়। গত এক বছরের মাঝে পশ্চিম আফ্রিকায় এটা চতুর্থ অভ্যত্থান প্রচেষ্টা। এর আগে মালিতে দু’বার এবং নিজেরএ একবার অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়। আবার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে গিনি এবং আইভোরি কোস্টে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সংবিধান পরিবর্তন করিয়েছেন নির্বাচনে অংশ নিতে। এতে পশ্চিম আফ্রিকায় গণতন্ত্রের অবস্থা আরও করুন হলো বলে বলা হচ্ছে সেখানে।

গিনির ইতিহাস ... সামরিক অভ্যুত্থানই যেখানে স্বাভাবিক

গিনিতে বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ১৯৫৮ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট হন আমহেদ সেকু তুরে। টানা ২৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৮৪ সালে প্রেসিডেন্ট তুরেএর মৃত্যু হলে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেন লানসানা কন্টে। ফরাসি সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষিত কন্টে টানা ২৪ বছর ক্ষমতা ধরে রাখেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে কন্টে দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর মৃত্যবরণ করেন। একই দিনে আরেকটা সামরিক অভ্যুত্থানে ক্যাপ্টেন মুসা দাদিস কামারা ক্ষমতা দখল করেন। দাদিস এর আগে জার্মানিতে লম্বা সময়ের জন্যে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তবে এক বছরের মাথায় ২০০৯এর ডিসেম্বরে দাদিস তার সেনাদের গুলিতে আহত হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। দাদিসের স্থান নেন মরক্কোতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অফিসার সেকুবা কোনাতে। তিনি ২০১০ সালে নির্বাচনের আয়োজন করে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তৎকালীন মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম ফিতজগেরাল্ড কোনাতের পক্ষে মার্কিন সরকারের সমর্থনও জ্ঞাপন করেন। নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন প্রবীন রাজনীতিবিদ আলফা কন্ডে। কন্ডের পুরো বেড়ে ওঠা ছিল ফ্রান্সে এবং কয়েক দশক তিনি গিনির বাইরে ছিলেন। ১৯৯১ সালে দেশে ফেরত এসে তিনি একনায়ক লানসান কন্টেএর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়েন। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি বিরোধী দলের রাজনীতি করে যান। ১৯৯৯ সালে কন্ডে গ্রেপ্তার হন এবং দুই বছর পর রাজনীতি ত্যাগ করার মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। চার বছর ফ্রান্সে থাকার পর তিনি আবারও দেশে ফেরত আসেন। তৎকালীন সামরিক নেতৃত্বের সাথে কন্ডে সম্পর্ক খারাপ করেননি। ২০১০ সালের নির্বাচনে প্রথম রাউন্ডে মাত্র ১৮ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকার পরেও দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সেলু দালেইন দিয়ালো প্রথম রাউন্ডে ৪০ শতাংশ ভোট পেলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে যান।
 

আলফা কন্ডে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে দেশটার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন। ২০১৫ সালে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগের মধ্যে দিয়ে তিনি আবারও নির্বাচনে জেতেন। ২০১৬ সালে ব্রিটিশ অস্ট্রেলিয়ান মাইনিং কোম্পানি ‘রিও টিন্টো’র সাথে কন্ডেএর সরকারের অর্থ আদানপ্রদানের খবর ছড়িয়ে পড়লেও কন্ডে সেযাত্রায় সমস্যা এড়াতে পারেন। তবে ২০১৯ সালে সংবিধান পরিবর্তন করে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে দাঁড়াবার চেষ্টা করার পর রাস্তায় ব্যাপক আন্দোলন দেখা দেয়। প্রায় শ’খানেক মানুষের মৃত্যু হয় সেই আন্দোলনে। এই আন্দোলন দমনে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা অংশ নেন। ২০২০ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে আলফা কন্ডে আবারও জয়ী হন। হেরে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী সেলু দালেইন দিয়ালো কারচুপির অভিযোগ করে আন্দোলনের ডাক দেন। আন্দোলনে কমপক্ষে ১২ জন নিহত হবার খবর পাওয়া যায়।

প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডে সেনাবাহিনীর ‘স্পেশাল ফোর্সেস গ্রুপ’এর নেতৃত্ব দেবার জন্যে ২০১৮ সালে মামাদি দুমবুইয়াকে ডেকে নিয়ে আসেন। দুমবুইয়া ছিলেন ফরাসি সামরিক বাহিনীর ‘ফরেন লিজিয়ন’এর একজন সদস্য। ফরাসি মিডিয়া ‘আরএফআই’ বলছে যে, সেখানে তার লম্বা ক্যারিয়ারে তিনি ফ্রান্সের সামরিক একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করা ছাড়াও আফগানিস্তান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, জিবুতি এবং আইভোরি কোস্টে বিভিন্ন সামরিক মিশনে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি ইস্রাইলের সামরিক একাডেমিতে এবং সেনেগাল ও গ্যাবনেও প্রশিক্ষণ পান। ৪১ বছর বয়স্ক দুমবুইয়ার সামরিক ক্যারিয়ার ১৫ বছরের উপর। ফরাসি মিডিয়া তাকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব এবং সামরিক কৌশলের বিশেষজ্ঞ বলে আখ্যা দিচ্ছে। একইসাথে তার ইউনিটের লাল টুপি জনগণের মাঝে একটা শক্তিশালী প্রভাব রাখে বলে বলছে ফরাসিরা।

সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলকে গিনির জনগণ কিভাবে দেখবে? তারা ইতোমধ্যেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডের স্বরূপ দেখে ফেলেছে। পার্শ্ববর্তী সেনেগালে বসবসরত গিনির নাগরিক মালিক দিয়াল্লো তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলছেন যে, প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডে জোর করে তৃতীয়বারের মত নির্বাচন করেছিলেন। তার আসলে ক্ষমতায় থাকার অধিকারই ছিল না। আরেকজন মামাদু সালিউ দিয়াল্লো বলছেন যে, সামরিক অভ্যুত্থান ভালো জিনিস নয়। কিন্তু গিনির জনগণের আর কি করার ছিলো? প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি বয়স্ক; যিনি গিনিয়ানদেরকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন না এবং তিনি ক্ষমতাও ছাড়তে চান না। তবে ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, অভ্যুত্থানকারীরা জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে; কারণ সামরিক বাহিনী এখনোও বিভক্ত। প্রেসিডেন্টের সমর্থকেরা পাল্টা কিছু করতে পারে।

গিনি কেন গুরুত্বপূর্ণ

আটলান্টিক মহাসরের পাড়ের দেশ গিনির জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৪ লক্ষ; যার প্রায় ৮৫ শতাংশই মুসলিম। তবে দেশটা সবসময় সেকুলার নেতৃত্বই দেখেছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডে ৪৯ বছর পর ২০১৬ সালে ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পূনস্থাপন করেন। ১৯৬৭ সালে গিনি ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। তবে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য রয়েছে। পার্শ্ববর্তী সেনেগালের রাজধানী দাকার থেকে গিনিতে ইস্রাইলের কূটনৈতিক তৎপরতা চলে। খনিজ সম্পদে ভরপুর গিনি তার বক্সাইট খনির জন্যে বিখ্যাত। বক্সাইট থেকে এলুমিনিয়াম তৈরি হয়। ‘কেপিএমজি গ্লোবাল মাইনিং ইন্সটিটিউট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, গিনির খনিতে রয়েছে ৭’শ ৪০ কোটি টন বক্সাইট; যা কিনা পুরো দুনিয়ার বক্সাইট রিজার্ভের ২৬ শতাংশ। এছাড়াও সেখানে রয়েছে ৪’শ কোটি টন লৌহ খনি; স্বর্ণ এবং হীরকও কম নয়। এছাড়াও সেখানে ইউরেনিয়ামের খনি রয়েছে বলেও বলা হচ্ছে। ‘ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে’র ২০২১ সালের জানুয়ারির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গিনি ২০২০ সালে ৮ কোটি ২০ লক্ষ টন বক্সাইট উৎপাদন করেছে; যা কিনা সারা দুনিয়ার বক্সাইট উৎপাদনের ২২ শতাংশ। গিনির স্বাধীনতার পর গিনির বক্সাইট খনির মূল নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মার্কিন কোম্পানিগুলির হাতে। তবে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ‘রিও টিন্টো’র শেয়ার রয়েছে খনিতে। তথাপি ‘রিও টিন্টো’ গিনিতে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হিমসিম খেয়েছে।

গিনির অর্থনীতি খনিগুলির উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ‘ওইসি ওয়ার্ল্ড’এর হিসেবে ২০১৯ সালে দেশটা প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে এবং প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। রপ্তানি পণ্যের মাঝে ৯৩ শতাংশই হলো বক্সাইট এবং স্বর্ণ। সবচাইতে বড় আমদানিকারক হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং চীন। আমিরাত কিনছে স্বর্ণ; চীন কিনছে বক্সাইট। ভারতও সেখান থেকে স্বর্ণ আমদানি করে। গিনির আমদানির ৩৯ শতাংশই আসে চীন থেকে। পুরো ইউরোপের সাথে যত বাণিজ্য হয়, চীনের সাথে বাণিজ্য হয় তার চাইতে বেশি।
 
ছবিঃ গিনির বক্সাইট খনি। গিনির অতি গুরুত্বপূর্ণ বক্সাইট খনির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একটা কৌশলগত প্রতিযোগিতা সবসময়েই বিদ্যমান। প্রচুর খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও গিনির জনগণ খুবই দরিদ্র। তাদের অভিযোগ অনেক। গিনির নেতৃত্ব কখনোই জনগণের কথা চিন্তা করেনি।


ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নাইজেরিয়ার নেতৃত্বে পশ্চিমা আফ্রিকার আঞ্চলিক সংস্থা ‘ইকনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস’ বা ‘একোওয়াস’এর পক্ষ থেকে গিনির উপর অবরোধ আরোপের হুমকি দেয়া হয়। আফ্রিকান ইউনিয়নও বলছে যে, তারা সঠিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে আলোচনা করবে। যুক্তরাষ্ট্র এই অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানায় যে, এই ঘটনার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বন্ধু দেশগুলির জন্যে গিনির জনগণকে সহায়তা দেয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে। এতে দেশটার শান্তি, উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে বলে বলা হয়। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক টুইট বার্তায় বলা হয় যে, ফ্রান্স এই ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছে এবং প্রেসিডেন্ট কন্ডেএর শর্তহীন মুক্তি চাইছে। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুতেরেজও প্রেসিডেন্টের মুক্তি দারি করেন।

প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ হবার কারণে গিনিতে ফ্রান্সের প্রভাব যথেষ্ট। বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ এবং সামরিক নেতৃবৃন্দ ফ্রান্সের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছে অথবা ফ্রান্সের অধীনে কাজ করেছেন। বর্তমান অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া মামাদি দুমবুইয়া ফরাসি সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষিত এবং ফ্রান্সের অধীনেই বহু বছর ধরে বিভিন্ন দেশে সামরিক মিশনে গিয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডেও বহু বছর ফ্রান্সেই থেকেছেন। যদিও বর্তমানে গিনির অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ এবং চীন ও আমিরাতের বাজারের উপর নির্ভরশীল, তথাপি ফরাসি ভাষাভাষী পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলকে ফ্রান্স এখনও নিজের অঞ্চলই মনে করে। গিনির অতি গুরুত্বপূর্ণ বক্সাইট খনির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একটা কৌশলগত প্রতিযোগিতা সবসময়েই বিদ্যমান। একারণেই অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি ‘রিও টিন্টো’ সেখানে শক্ত ভিত গাড়তে কঠিন সময় পার করছে। যেহেতু গিনির ইতিহাসে সামরিক অভ্যুত্থান একটা স্বাভাবিক বিষয়, তাই শক্তিশালী দেশগুলি গিনির সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের দিক থেকে নিয়ন্ত্রণ চায়। সাহেলের মালি, নিজের এবং বুরকিনা ফাসোতে সংঘাত বন্ধে হিমসিম খাচ্ছে ফ্রান্স। আইভোরি কোস্টের নিয়ন্ত্রণও নড়বড়ে। এর উপর সেখানে তুরস্ক, নাইজেরিয়া, মরক্কো সহ অনেক দেশের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে ব্যালান্স করা ফরাসিদের জন্যে কঠিন কাজ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ফরাসি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ এবং সামরিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে ফ্রান্স হয়তো তার প্রভাব কিছুটা হলেও ধরে রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু প্রচুর খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও গিনির জনগণ খুবই দরিদ্র। তাদের অভিযোগ অনেক। গিনির নেতৃত্ব কখনোই জনগণের কথা চিন্তা করেনি। এহেন পরিস্থিতিতে ব্যাপক গনঅসন্তোষের মাঝে জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকাটা যেমন কঠিন, তেমনি তা খুব সহজেই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্যে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে; যা পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে।