Saturday 25 January 2020

লোহিত সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নতুন মোড়

২৫শে জানুয়ারি ২০২০

  
সোমালিয়ার জলদস্যুতা যেমন প্রায় নিশ্চিহ্ন হবার পথে, তেমনি ইয়েমেনের যুদ্ধও ২০২০ সালেই শেষ হবার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমতাবস্থায় লোহিত সাগর এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাব-এল-মান্ডেব প্রণালীতে সামরিক উপস্থিতি ধরে রাখতে আঞ্চলিক শক্তিগুলি নতুন করে হিসেব কষছে। বিশেষ করে তুরস্কের সাথে সৌদি গ্রুপের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। যার অংশ হিসেবে ‘রেড সী কাউন্সিল’ গঠন করেছে সৌদিরা।


গত ২২শে জানুয়ারি মিশরের সামরিক বাহিনী ঘোষণা দেয় যে, সৌদি আরবের সাথে লোহিত সাগরে মিশর একটা সামরিক মহড়া শুরু করেছে। ‘মরগান ১৬’ নামের এই মহড়ায় উপকূলীয় একটা টার্গেটে হামলার ট্রেনিংসহ কর্মদক্ষতার উন্নয়নের পিছনে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে লোহিত সাগরে মিশর এবং সৌদি আরবের কৌশলগত কর্মকান্ড বেশ গতি পাচ্ছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে জেদ্দার কাছাকাছি লোহিত সাগরে অনুষ্ঠিত হয় ‘রেড ওয়েভ ২’ নামের যৌথ মহড়া। এতে অংশ নিয়েছিল সৌদি আরব, মিশর, জর্দান, সুদান, জিবুতি, ইয়েমেন এবং সোমালিয়া। ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সমুদ্রপথে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা দিনে দিনে গভীর হচ্ছে।

গত ১৫ই জানুয়ারি লোহিত সাগরের উপকূলে বারনিস নামক স্থানে মিশর একটা সামরিক ঘাঁটি উদ্ভোধন করে, যা তারা লোহিত সাগরের সবচাইতে বড় সামরিক ঘাঁটি বলে ঘোষণা দিয়েছে। মিশর বলছে যে, এই ঘাঁটি লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খালের মাঝে জাহাজের প্রবাহের নিরাপত্তা দেবে। সরকারি বরাত দিয়ে ‘ইজিপ্ট ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ বলছে যে, ১৫ হাজার একর এলাকার এই ঘাঁটিতে বিমান ওঠানামার জন্যে ৩ হাজার মিটার লম্বা রানওয়ে রয়েছে এবং জাহাজের জন্যে ১ হাজার মিটার লম্বা এবং ১৪ মিটার গভীরতার জেটি রয়েছে। এই ঘাঁটিতে বিমানবাহী যুদ্ধহাজাহাজ ডকিং করা যাবে। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেন্স’ বলছে যে, এই ঘাটিতে বিমান রাখার জন্যে ১৮টা শক্তিশালী কংক্রিট হ্যাঙ্গার তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ৩৬টা বিমানকে একত্রে রাখা যাবে। এছাড়াও এখানে একটা বেসামরিক বিমানবন্দর এবং বেসামরিক সমুদ্রবন্দরও তৈরি করা হয়েছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি এই ঘাঁটির উদ্ভোধন করেন এবং উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ‘গালফ নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় মিশর এবং আমিরাত একে অপরকে কাছে টেনেছে। এই অনুষ্ঠানে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালেদ বিন সালমানও উপস্থিত ছিলেন।

তবে লোহিত সাগরের কৌশলগত দিক থেকে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে ৬ই জানুয়ারি রিয়াদে। লোহিত সাগর এবং তৎসংলগ্ন আদেন উপসাগরের সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটা কাউন্সিল গঠন করা হয়। এর অংশ হিসেবে সৌদি বাদশাহ সালমান মিশর, জর্দান, এরিত্রিয়া, ইয়েমেন, সুদান, জিবুতি এবং সোমালিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। চুক্তির অংশ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, এর মাধ্যমে জলদস্যুতা, চোরাচালান এবং অন্যান্য হুমকি মোকাবিলায় লোহিত সাগরের দেশগুলির মাঝে সহযোগিতা বাড়বে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ‘কাউন্সিল অব এরাব এন্ড আফ্রিকান কোস্টাল স্টেটস অব দ্যা রেড সি এন্ড দ্যা গালফ অব আদেন’ নামে একটা চার্টারে স্বাক্ষর করেন। তবে সোমালিয়ার ‘রেডিও দালসান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সোমালিয়া থেকে আলাদা হয়ে চলা স্বঘোষিত রাষ্ট্র সোমালিল্যান্ড অঞ্চল চাইছে যে, এই কাউন্সিলে তাদের নামও থাকা উচিৎ ছিল। সোমালিল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল আহমেদ ওমার এলমি এক বার্তায় বলছেন যে, সোমালিল্যান্ড অত্র এলাকার নিরাপত্তার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল রয়েছে। তবে লোহিত সাগরের কোন ব্যাপারে সোমালিল্যান্ডকে বাদ দেয়াটা তারা মেনে নেবেন না। ফরাসী মিডিয়া ‘আরএফআই’এর সাথে এক স্বাক্ষাতে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর গবেষক ক্যামিল লন্স বলছেন যে, সোমালিল্যান্ডের বারবেরাতে আমিরাত সমুদ্রবন্দর তৈরি করা শুরু করার পর থেকেই সোমালিয়ার সাথে আমিরাতের সম্পর্ক শীতল যাচ্ছে। সৌদি আরবও সোমালিল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক রাখে। তবে সোমালিল্যান্ডকে এই কাউন্সিলে রাখলে সোমালিয়াকে রাখা যেত না, এবং এতে কূটনৈতিক সমস্যা হতো। আবার যেহেতু মিশরের সাথে নীল নদে বাঁধ দেয়া নিয়ে ইথিওপিয়ার একটা বিরোধ চলমান, তাই ইথিওপিয়াকে নিলে মিশরকে রাখা যেতো না। সৌদিরা লোহিত সাগরে তুরস্ক, কাতার এবং ইরানের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। সেজন্যে তারা সকলের মাঝে কিছুটা ব্যালান্স করেই চলতে চাইছে।


   
ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই সমুদ্রপথে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা দিনে দিনে গভীর হচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ঘোষণা দেন যে, সোমালিয়া তুরস্ককে সোমালিয়ার উপকূলে তেল অনুসন্ধানের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। মিশর এবং সৌদিদের কাছে এটা হুমকিস্বরূপই ঠেকবে। কারণ তুরস্কের পক্ষে নিজস্ব নৌবাহিনীর নিরাপত্তা ছাড়া সোমালিয়ার উপকূলে তেল অনুসন্ধান সম্ভব হবে না। অর্থাৎ এতে ভারত মহাসাগরে তুরস্কের নৌশক্তির আনাগোনা নিশ্চিত।


আবুধাবির ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’এর প্রাক্তন প্রফেসর আলবদর আলশাতারি আমিরাতের ‘দ্যা ন্যাশনাল’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, লোহিত সাগর দিয়ে যেহেতু পৃথিবীর প্রায় ১০ শতাংশ তেল রপ্তানি হয়, তাই এই অঞ্চল শুধুমাত্র লোহিত সাগরের তীরবর্তী দেশগুলি ছাড়াও বাকিদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। ইয়েমেনের যুদ্ধে লজিস্টিক্যাল সুবিধার জন্যে এরিত্রিয়ার আসাবএর কাছে একটা বড় সামরিক ঘাঁটি করেছে আমিরাত। অন্যদিকে সোমালিয়াতে সোমালিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীকে ট্রেনিং দিতে সেখানে একটা ঘাঁটি করেছে তুরস্ক। আবার সুদানের লোহিত সাগর উপকূলে সুয়াকিন দ্বীপে তুরস্ক নৌঘাঁটি করতে চাইছে বলে অভিযোগ মিশরের। কাতারে ইতোমধ্যেই সামরিক ঘাঁটি করেছে তুরস্ক। এখন লিবিয়ার যুদ্ধেও জড়িয়েছে তুরস্ক। জিবুতিতে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ অনেকগুলি দেশ সামরিক ঘাঁটি করেছে। ইয়েমেনে আল কায়েদার সদস্যদের টার্গেট করতে জিবুতিতে ঘাঁটি করে যুক্তরাষ্ট্র। আর সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যু নিধনের ছুতোয় জিবুতিতে ঘাঁটি করে বাকি দেশগুলি। এরপর ইয়েমেনের যুদ্ধের ছুতোয় সৌদি গ্রুপের দেশগুলি এই এলাকায় ঘাঁটি করে।

ইয়েমেনের যুদ্ধের সময় বেশ কয়েকবার সৌদি এবং আমিরাতের জাহাজ ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে সোমালিয়ার জলদস্যুতা যেমন প্রায় নিশ্চিহ্ন হবার পথে, তেমনি ইয়েমেনের যুদ্ধও ২০২০ সালেই শেষ হবার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমতাবস্থায় লোহিত সাগর এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাব-এল-মান্ডেব প্রণালীতে সামরিক উপস্থিতি ধরে রাখতে আঞ্চলিক শক্তিগুলি নতুন করে হিসেব কষছে। বিশেষ করে তুরস্কের সাথে সৌদি গ্রুপের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। যার অংশ হিসেবে ‘রেড সী কাউন্সিল’ গঠন করেছে সৌদিরা। ২০শে জানুয়ারি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান ঘোষণা দেন যে, সোমালিয়া তুরস্ককে সোমালিয়ার উপকূলে তেল অনুসন্ধানের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এবং এরদোগান বলেন যে, তুরস্ক এখন সেইদিকেই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এরদোগানের কথাগুলি মিশর এবং সৌদিদের কাছে হুমকিস্বরূপই ঠেকবে। কারণ তুরস্কের পক্ষে নিজস্ব নৌবাহিনীর নিরাপত্তা ছাড়া সোমালিয়ার উপকূলে তেল অনুসন্ধান সম্ভব হবে না। অর্থাৎ এতে ভারত মহাসাগরে তুরস্কের নৌশক্তির আনাগোনা নিশ্চিত।

Tuesday 21 January 2020

লিবিয়াতে কি চাইছে ইতালি?

২২শে জানুয়ারি ২০২০

  
গত ৭ই জানুয়ারি ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্টি লিবিয়ার জেনারেল হাফতারের সাথে সাক্ষাৎ করেন; যার ফলাফল যায় ইতালির বিপক্ষে। ‘জিএনএ’এর প্রতিপক্ষ জেনারেল খলিফা হাফতারের অধীন পূর্ব লিবিয়ার ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা ‘এলএনএ’কেও একইসাথে আলিঙ্গন করার ফলে ইতালি এখন দুই কূলই হারাতে বসেছে। ইতালির রাজনীতিবিদদের ব্যাপক সমালোচনা করে বলা হচ্ছে যে, তারা প্রকৃতপক্ষে কূটনীতি বোঝেন না।


গত ৭ই জানুয়ারি ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্টি লিবিয়ার যুদ্ধরত দুই পক্ষকে হঠাত করেই একত্রে আলোচনায় বসাবার চেষ্টা করেন; যার ফলাফল যায় ইতালির বিপক্ষে। ইতালি এতকাল ধরে ত্রিপোলির জাতিসংঘ সমর্থিত ‘গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড’ বা ‘জিএনএ’কে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ‘জিএনএ’এর প্রতিপক্ষ জেনারেল খলিফা হাফতারের অধীন পূর্ব লিবিয়ার ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা ‘এলএনএ’কেও একইসাথে আলিঙ্গন করার ফলে ইতালি এখন দুই কূলই হারাতে বসেছে। ‘জিএনএ’ প্রেসিডেন্ট ফায়েজ আল-সারাজএর দেখা করার আগেই কন্টি হাফতারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই খবর পাবার পর আল-সারাজ কন্টির সাথে দেখা করতেই রাজি হননি। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর রোম অফিসের ডিরেক্টর আরটুরো ভারভেলি বলছেন যে, ইতালির রাজনীতিবিদেরা পররাষ্ট্রনীতির দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেননা; যার ফলাফল এখন দেখা যাচ্ছে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে ইতালির রাজনীতিবিদদের ব্যাপক সমালোচনা করে বলা হয় যে, তারা প্রকৃতপক্ষে কূটনীতি বোঝেন না। ২০১৮ সালে সরকার গঠন করার সময় কন্টি এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইজি ডি মাইও উভয়েরই কূটনীতি বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। আর এর ফলে ইতালি লিবিয়াতে তার প্রভাব হারিয়েছে। ইতালির উগ্র ডানপন্থী নেতা মাত্তেও সালভিনি প্রধানমন্ত্রী কন্টির সমালোচনা করে বলেন যে, কন্টির আসলে কোন যোগ্যতাই নেই। তার সরকারের লোকজন অপেশাদার। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, লিবিয়ার উপর এক আলোচনায় বসার পর ইতালি বুঝতে পারে যে সে একঘরে হয়ে গেছে। আলোচনায় ফ্রান্স, মিশর, গ্রীস এবং গ্রীক সাইপ্রাস, সকলেই হাফতারের পক্ষ নেয়ায় ডি মাইও লিবিয়া বিষয়ে যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান।

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১১ সালে ইউরোপ মুয়াম্মার গাদ্দাফির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আগ্রহী হলেও পরবর্তীতে দেশটাকে যুদ্ধরত বিভিন্ন গ্রুপের হাতে সপে দেয়। লিবিয়ার অস্ত্র আফ্রিকার অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে সহিংসতার জন্ম দেয়, যা বিরাট শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করে। ইউরোপের দেশগুলি লিবিয়াতে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পেছনেই ছুটেছে; একেকজন একেক পক্ষকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু তুরস্ক যুদ্ধে জড়াবার পরপরই পুরো ইউরোপ মনোযোগ দেয়া শুরু করেছে। এখানে যেন নতুন কোন ‘গ্রেট গেম’ শুরু হয়ে গেছে, যা ইউরোপের আশেপাশের অঞ্চলকে অস্থির করছে। তুরস্ক এবং রাশিয়া একত্রে আলোচনায় বসে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেবার পরপরই জার্মানি লিবিয়ায় স্বার্থ আছে এমন সকলকে নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করেছে। ‘জার্মান মার্শাল ফান্ড’এর ব্রাসেলস অফিসের ডিরেক্টর ইয়ান লেসার বলছেন যে, লিবিয়া নিয়ে ইউরোপের চিন্তা করার কারণগুলির মাঝে রয়েছে শরণার্থী, জ্বালানি তেল, নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ। কিন্তু তুরস্ক এবং রাশিয়া লিবিয়াতে অতটা সক্রিয় না হলে লিবিয়া নিয়ে সকলে এতটা ব্যস্ত হয়ে যেত না।

ডাচ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ক্লিগেনডেল ইন্সটিটিউট’এর রিসার্চ ফেলো জালেল হারচাউই বলছেন যে, লিবিয়াতে তুরস্ক এবং রাশিয়া যেভাবে আগ্রাসী কূটনীতি চালাচ্ছে, তাতে ইতালি একেবারেই কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। ইতালিয়ান ইন্টেলিজেন্সএর এক কর্মকর্তা ‘রয়টার্স’কে বলেন যে, ইতালির রাজনীতিবিদেরা তাদের নির্দেশ দিয়েছেন সকল পক্ষের সাথেই যোগাযোগ রাখতে। অর্থাৎ ইতালি সকলকেই একত্রে বন্ধু রাখতে চাইছে। কিন্তু এধরনের চলমান সংঘাতে নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার না করতে পারলে প্রভাব হারানোটাই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন তিনি। শুধু লিবিয়াই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেই ইতালি প্রভাব হারাচ্ছে। বাগদাদে ইরানি জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার পর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও বিশ্বব্যাপী ফোন করে জনমত আদায়ের চেষ্টা করলেও ইতালিতে কারুর সাথেই তিনি কথা বলেননি; যদিও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের পর পশ্চিমা দেশগুলির মাঝে ইতালির সৈন্যসংখ্যাই সবচাইতে বেশি।


  
শরণার্থী সমস্যা ইতালির জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি প্রধান হুমকি। ইতালিয়দের চিন্তায় শরণার্থী সমস্যা এতটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, লিবিয়ায় তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড এর তুলনায় হয়ে গেছে গৌণ। ২০১৭ সালে ইতালির দেয়া প্রায় ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বৈদেশিক সাহায্যের মাঝে ৫৬ শতাংশই গিয়েছে শরণার্থী সমস্যা নিরসনে। 


ইতালির প্রধান ভয় - শরণার্থী

‘আল জাজিরা’র এক লেখায় রোমানা রুবেও এবং রামজি বারুদ বলেন যে, লিবিয়ার ‘জিএনএ’ সরকারের কোস্ট গার্ডের নেতৃত্বে থাকা আব্দ আল-রাহমান বিজা মিলাদএর সাথে ইতালিয়রা কাজ করছে। মিলাদ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যার সম্পর্কে ২০১৭ সালের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিবেদনে বলা হয় যে, তিনি শুধু চোরাকারবারিতেই জড়িত নন, গুলি করে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকা ডুবিয়ে দেয়ার রেকর্ডও রয়েছে তার। ২০১৭এর ফেব্রুয়ারিতে ত্রিপোলির ‘জিএনএ’ সরকারের সাথে অবৈধ অভিবাসী ঠেকার জন্যে ইতালি একটা চুক্তি করে। চুক্তির অধীনে লিবিয়াতে শরণার্থীদের আটক করার জন্যে লিবিয়ার মাটিতেই ক্যাম্প তৈরির জন্যে অর্থায়ন করে ইতালি। মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’এর ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে এই ক্যাম্পের কার্যকলাপকে ‘অমানবিক’ বলে উল্লেখ করা হয়। এই চুক্তি করার জন্যে মিলাদ ইতালির দক্ষিণে সিসিলির কাতানিয়া শরণার্থী শিবিরে গেলে সেখানে অভিবাসীরা তাকে ‘ইতালিয়ান মাফিয়া’ বলে সম্ভোধন করে। অভিবাসন ঠেকাবার ইতালিয় চেষ্টাগুলি নতুন নয়।

২০০৮ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির সময়ে তৎকালীন সিলভিও বারলুসকোনির ইতালি সরকার অভিবাসী ঠেকাতে লিবিয়াকে ৫ বিলিয়ন ডলার দেয়। চিন্তাটা ছিল এমন যে, ইতালির হয়ে লিবিয়াই অভিবাসীদের ঠেকাবে; আর এর সাথে মানবাধিকার লংঘনের ইস্যুগুলি থেকেও ইতালি নিজেকে দূরে রাখতে পারবে। ২০০৯ সালে গাদ্দাফিকে ইতালিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়; আর ২০১০ সালে বারলুসকোনিও লিবিয়া সফর করেন।

শরণার্থী সমস্যা ইতালির জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি প্রধান হুমকি। আফ্রিকার শরণার্থী সমস্যা থেকে বাঁচতে ইতালি আফ্রিকার দেশগুলিকে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং নারীর ক্ষমতায়নে সহায়তা দিচ্ছে। ‘ওইসিডি’র হিসেবে ২০১৭ সালে ইতালির দেয়া প্রায় ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বৈদেশিক সাহায্যের মাঝে ৫৬ শতাংশই গিয়েছে শরণার্থী সমস্যা নিরসনে।

কূটনৈতিক অনভিজ্ঞতা

গত ১৩ই জানুয়ারি আঙ্কারায় ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্টির সাথে লিবিয়া বিষয়ে এক বৈঠকের পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান বলেন যে, ইতালির সাথে তুরস্ক একত্রে চেষ্টা করছে যাতে লিবিয়ার যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হয়। কন্টি বলেন যে, যুদ্ধবিরতি লিবিয়ায় একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুযোগ তৈরি করবে। এর একদিন আগেই তুরস্ক এবং রাশিয়া একত্রে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে খলিফা হাফতার যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে স্বাক্ষর না করেই মস্কো ত্যাগ করেন। লিবিয়া ইস্যুতে তুরস্ক এবং ইতালি উভয়েই ত্রিপোলি-কেন্দ্রিক ‘জিএনএ’এর পক্ষাবলম্বন করছে। তবে ইতালি লিবিয়ার ইস্যুকে ছেড়ে দিতে নারাজ। ১৬ই জানুয়ারি ইতালির প্রধানমন্ত্রী কন্টি লিবিয়ার প্রতিবেশী দেশ আলজেরিয়াতে ছুটে যান লিবিয়ার বিষয়ে কথা বলার জন্যে।

‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর প্যান ইউরোপিয়ান ফেলো মাত্তিয়া গিয়ামপাওলো এক লেখায় বলছেন যে, ইতালিয়দের চিন্তায় শরণার্থী সমস্যা এতটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে, লিবিয়ায় তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড এর তুলনায় হয়ে গেছে গৌণ। ২০১৮ সালে ওয়াশিংটন সফরের সময়ে কন্টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে বড় ধরনের কূটনৈতিক সমর্থন পান। ট্রাম্প ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সমস্যাগুলি সমাধানে ইতালিকে প্রধান বন্ধু হিসেবে সম্ভোধন করেন। কিন্তু সেই সময় থেকে লিবিয়াকে নিয়ন্ত্রণে ইতালির পকেটে শুধু ব্যর্থতাই জমা হয়েছে।

ইতালি লিবিয়াতে কেন?

লিবিয়াতে ইতালির স্বার্থ বহুকাল থেকে। উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া উপকূলে কার্থেজ সাম্রাজ্যের সাথে রোমের বৈরিতা ছিল। পরবর্তীতে সপ্তম শতাব্দীতে উত্তর আফ্রিকার পুরো উপকূল মুসলিমদের অধীন হয়ে গেলে ইতালির সাথে আফ্রিকার বৈরিতা আরও বৃদ্ধি পায়। বর্তমান রাষ্ট্র ইতালির একত্রীকরণ সম্পন্ন হয় ১৮৭১ সালে। নতুন এই দেশ ইউরোপের বাকি দেশগুলির দেখাদেখি নিজেরাও উপনিবেশ খুঁজতে শুরু করে। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ আর ফরাসীদের সাথে সমঝোতা করেই তাদের চলতে হয়েছে। ১৮৮৯ সালে ইতালি পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া এবং এরিত্রিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ১৯১১ সালে লিবিয়া ছিল উসমানি খিলাফতের অধীনে। ইতালিয়রা ইস্তাম্বুলের খলিফার কাছে চরমপত্র দিয়ে লিবিয়া আক্রমণ করে। লিবিয়ার পূর্বে মিশরের দখলে ছিল ব্রিটিশরা; আর পশ্চিমে আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল ফরাসীরা। তাদের সমর্থনেই ইতালি লিবিয়া আক্রমণ করে। ইতালিয়রা লিবিয়ার উপকূলের এলাকাগুলি সহজে দখলে নিতে পারলেও দেশের ভেতরের এলাকাগুলির নিয়ন্ত্রণ নিতে তাদের কয়েক দশক সময় লেগেছিল। এসময়ের মাঝে ইতালিয়রা নৃশংসভাবে লিবিয়ার জনগণের বিদ্রোহ দমন করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিয়দের হাত থেকে ব্রিটিশ আর ফরাসীরা লিবিয়া দখল করে নেয়। ১৯৫১ সালে বর্তমান লিবিয়ার জন্ম হয়। ১৯৫৯ সালে তেলখনি আবিষ্কারের পর থেকে লিবিয়ার নতুন ইতিহাস লেখা শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেন। ২০১১ সালে পশ্চিমা হস্তক্ষেপে গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর লিবিয়া অশান্ত রয়েছে।

২০১১ সালে গাদ্দাফিকে সরিয়ে দেবার পশ্চিমা চেষ্টায় ইতালিও সরাসরি অংশ নেয়। লিবিয়াতে নিজেদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে ইতালির এখন আর গাদ্দাফিকে দরকার নেই। গাদ্দাফি পরবর্তী গৃহযুদ্ধ কবলিত লিবিয়াতে ইতালি এবং বাকি ইউরোপ তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থকে ছেড়ে দেয়নি। ২০১৮ সালে ইতালির সর্ববৃহৎ তেল কোম্পানি ‘ইএনআই’ লিবিয়ার তেলখনিতে বিনিয়োগ করে; এবং তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষায় সেখানকার মিলিশিয়া গ্রুপগুলির সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করে। লিবিয়ার তেল সবচাইতে বেশি রপ্তানি হয় ইতালিতে।

ইতালির অর্থনৈতিক দৈন্যদশা

ইতালির অর্থনীতি থেমে আছে। ২০০৭ সালে ইতালির জিডিপি যা ছিল, এখনও তার কাছাকাছিই আছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, ইতালির রাষ্ট্রীয় ঋণ এখন ২ হাজার ২’শ ৪০ বিলিয়ন ডলার; যা পুরো ইতালির জিডিপির চাইতে ৩০ শতাংশ বেশি। খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকিং সেক্টর; ঋণ দেয়া প্রায় বন্ধ। ইতালির প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সংগঠন ‘কনফিন্ডাসট্রিয়া’র বোর্ড সদস্য পাওলো স্কুডেরি বলছেন যে, ইইউএর নীতির সাথে ইতালির ডানপন্থী সরকারের বিরোধ শুরু হবার পর থেকে ইতালিতে কেউ বিনিয়োগ করতে দুইবার চিন্তা করছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইতালির অর্থনৈতিক দৈন্যদশাই ক্ষমতায় এনেছে ডানপন্থীদের। ইতালির উত্তরাঞ্চলের শিল্পাঞ্চলগুলির চাইতে দক্ষিণাঞ্চলে কম আয়ের এলাকাগুলিতে বেকারত্বের হার সবচাইতে বেশি; যেখানে ডানপন্থীরা শরণার্থী ঠেকানো এবং কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট পাচ্ছে। দক্ষিণের মানুষ চাকুরি হারিয়ে উত্তরের শিল্পাঞ্চলগুলিতে পাড়ি জমাচ্ছে। যথেষ্ট আয়ের অভাবে অনেক মধ্যবয়সীদের পরিবার নেই। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, ২০১৪ সালের পর থেকে ইতালির যুবকদের মাঝে বেকারত্বের হার কমছে। ৪০ শতাংশের অধিক বেকার থেকে তা এখন ৩৩ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। অর্থাৎ প্রতি তিনজন যুবকের মাঝে একজন বেকার। গ্রীসের পর ইইউএর মাঝে এটা সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার। এমতাবস্থায় দক্ষিণে লিবিয়া থেকে শরণার্থীর জোয়ার ইতালির জন্যে বিরাট দুঃসংবাদই বটে।

ইতালির দিকে হাত বাড়িয়েছে তুরস্কের কৌশলগত বন্ধু কাতার। লিবিয়াতে তুরস্কের পাশে কাতারেরও সমর্থন রয়েছে; আবার কাতারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে তুরস্কের সেনারা। ইতালি তার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কাতারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে। ২০শে জানুয়ারি কাতার সফরে গিয়েছেন ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্জিও মাত্তারেলা। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। এর আগে ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে ইতালি সফর করেন শেখ তামিম। আর ২০১৮ সালের এপ্রিলে কাতার সফর করেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী কন্টি। কাতারের নৌবাহিনীর জন্যে ৫ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের ৭টা যুদ্ধজাহাজ তৈরির ক্রয়াদেশ পেয়েছে ইতালি। কাতারে কাজ করছে প্রায় আড়াই’শ ইতালিয় কোম্পানি। অন্যদিকে ইতালির এড্রিয়াটিক সাগরের তীরে তৈরি করা টার্মিনালে কাতার থেকে আমদানি করা এলএনজি অবতরণ করছে। ইতালির ১০ শতাংশ গ্যাসের চাহিদা কাতার পূরণ করছে। ইতালিতে কাতারের বড় বিনিয়োগ রয়েছে আবাসন, হোটেল এবং এভিয়েশন খাতে; যেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। মোটকথা লিবিয়ার সংঘাতে ইতালি, কাতার এবং তুরস্কের এক পক্ষে থাকার একাধিক কারণ রয়েছে।

শান্তি প্রচেষ্টার ভবিষ্যৎ কি?

১৯শে জানুয়ারি বার্লিনে লিবিয়ায় শান্তির বিষয়ে একটা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শুধু শক্তিশালী দেশগুলিই কথা বলেছে; ‘জিএনএ’ এবং ‘এলএনএ’ চুপ থেকেছে। আলোচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর জেষ্ঠ্য বিশ্লেষক ক্লাউডিয়া গাজিনি বলছেন যে, বার্লিন কনফারেন্স দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইউরোপিয়রা আঞ্চলিক শক্তিগুলির সাথে কথা বলে উত্তেজনা প্রশমণে ইচ্ছুক। কিন্তু এই ইচ্ছা কি উত্তেজনা প্রশমণে যথেষ্ট কিনা, তা অনিশ্চিত। ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিন অন ফরেন রিলেনশন্স’এর পলিসি ফেলো তারেক মাগেরিসি ‘আল জাজিরার’কে বলেন যে, এই আলোচনায় বোঝা যাবে যে, হাফতারকে যারা সমর্থন দিচ্ছেন, তারা হাফতারের উপর চাপ সৃষ্টি করার ব্যাপারে কতটা সততা রাখেন।

হাফতার মস্কো থেকে ফেরত এসেছেন যুদ্ধবিরতির চুক্তি না করেই। হাফতার এই আলোচনায় অংশ নেবার আগেই লিবিয়ার তেলখনির উৎপাদন প্রায় বন্ধ করে এসেছেন। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, হাফতারের লোকেরা লিবিয়ার ব্রেগা, রাস লানুফ, হারিগা, জুয়াইতিনা এবং সিদ্রা বন্দরে তেল রপ্তানি করে দিয়েছে। লিবিয়ার তেল উৎপাদন এখন দৈনিক ১২ লাখ ব্যারেল থেকে নেমে মাত্র ৭২ হাজার ব্যারেলে এসে ঠেকেছে। এতে হাফতার তার শক্তিশালী অবস্থানকেই জানান দিয়েছেন। এই তেল বিক্রির অর্থ যাচ্ছে লিবিয়ার ‘ন্যাশনাল অয়েল কর্পোরেশন’ বা ‘এনওসি’এর কাছে, যা কিনা ত্রিপোলির অধীনে। অথচ তেলখনিগুলির নিয়ন্ত্রণ এখন হাফতারের কাছে! তেল বিক্রি বন্ধ করে হাফতার একইসাথে ত্রিপোলির ‘জিএনএ’ সরকারের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং লিবিয়ার তেলের উপর নির্ভরশীল দেশগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে তারা ‘জিএনএ’কে সমর্থন দেয়া বন্ধ করে দেয়। চাপে পরা দেশগুলির শুরুতেই নাম আসবে ইতালির।

২০১৫ সাল থেকে ইউরোপিয়রা ‘অপারেশন সোফিয়া’ নামের একটা মিশনে লিবিয়ার উপকূল পাহাড়া দিতো। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভূমধ্যসাগরে শরণার্থীদের পানিতে ডোবা থেকে বাঁচানো। কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চে ইতালির প্রতিবাদে এই মিশন বন্ধ হয়ে যায়। ইতালি শরণার্থীদের দায়িত্ব নিতে নারাজ ছিল; তাদের কথা ছিল যে, শরণার্থীরা জাহাজ থেকে যেই দেশেই অবতরণ করুক না কেন, সেটা ইতালি হবে না। বার্লিন কনফারেন্সের পর ‘অপারেশন সোফিয়া’ আবারও শুরু করার কথা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, এই মিশন লিবিয়ার উপকূলে অস্ত্রের চালানও আটকাবে। তবে এবারেও ইতালির অবস্থান হবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিশনের মূল লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট আসবে ইতালি থেকেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই অপারেশন চালিত হবে শুধুই সমুদ্রে; লিবিয়ার স্থলসীমানাগুলিতে নয়। অর্থাৎ স্থলসীমানা দিয়ে লিবিয়াতে অস্ত্র ঢোকার পথ খোলাই থাকছে। লিবিয়ার বেশিরভাগ স্থলসীমানা এখন হাফতারের নিয়ন্ত্রণে। 

২০শে জানুয়ারি কাতার সফরে গিয়েছেন ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্জিও মাত্তারেলা। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। ইতালির দিকে হাত বাড়িয়েছে তুরস্কের কৌশলগত বন্ধু কাতার। লিবিয়াতে তুরস্কের পাশে কাতারেরও সমর্থন রয়েছে; আবার কাতারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে তুরস্কের সেনারা। ইতালি তার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কাতারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাইছে। মোটকথা লিবিয়ার সংঘাতে ইতালি, কাতার এবং তুরস্কের এক পক্ষে থাকার একাধিক কারণ রয়েছে।


ইতালি আর কি করতে পারে?

পৃথিবীর ৮ম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়েও ইতালি তার অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে রাজনৈতিক প্রভাবে রূপ দিতে পারেনি। ৮ম বৃহত্তম দাতা দেশ হয়েও ইতালি আফ্রিকার রাজনীতিতে ফ্রান্স বা ব্রিটেনের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবচাইতে শক্তিশালী ১০টা নৌবহরের একটা থাকার পরেও ভূমধ্যসাগরই ইতালির নিয়ন্ত্রণে নেই; অন্যান্য সাগর নিয়ে কথা বলা অমূলক। সেরা ১০টা অস্ত্র রপ্তানিকারক রাষ্ট্রের মাঝে থেকেও ইতালির ভূরাজনৈতিক প্রভাব নগন্য। ১৮৭১ সালে একত্রীকরণের পর থেকে ইতালি কখনোই ইউরোপের অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে পেরে ওঠেনি; ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও রাশিয়ার কাছে ইতালি ‘লিটল ব্রাদার’ থেকেছে সর্বদাই। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ফ্রান্সের পিছনেই থাকতে হয়েছে ইতালিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন এবং ফ্রান্স আফ্রিকাতে তাদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে প্রভাব ধরে রাখতে সচেষ্ট হলেও বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পক্ষাবলম্বন করায় ইতালি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। লিবিয়াও সেভাবেই ইতালির হাতছাড়া হয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।

লিবিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি বেশ জটিল। তবে বার্লিন কনফারেন্স আবারও দেখিয়ে দিল যে, এই সংঘাতে শক্তিশালী দেশগুলির লক্ষ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দ্বারা প্রশিক্ষিত জেনারেল হাফতার মস্কো থেকে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর না করে চলে আসায় সকলেই হাফতারের লক্ষ্য নিয়ে কথা বলছেন। তুরস্ক এবং রাশিয়ার লিবিয়াতে জড়ানো নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও তারা যে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে না, তা এখন নিশ্চিত। ইতালি বুঝতে পারছে যে, হাফতারকে সমর্থন দেয়া ফ্রান্সের সাথে সমঝোতা করে ইইউএর ছাতার নিচে কাজ করা কঠিন হবে।

লিবিয়া ইতালির ভৌগোলিক বাস্তবতা। ভূমধ্যসাগরে শরণার্থীবাহী নৌকাগুলিকে তারা ইতালির ভূখন্ডের চারিদিকে অবরোধের মতো দেখছে। আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে উতপন্ন হওয়া শরণার্থী সমস্যা ইতালির নিয়ন্ত্রণে নয়। আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীরা ইতালির জন্যে জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যু। তাই নিজের নিরাপত্তার জন্যেই লিবিয়ার সরকারকে নিজের পক্ষে রাখতে চাইবে ইতালি। কিন্তু হাফতারের হাতে ত্রিপোলির পতন হলে হাফতার কি ইতালিকে বন্ধু হিসেবে নেবে? বিশেষ করে এতোদিন ধরে ‘জিএনএ’কে সমর্থন দেবার পর হাফতার ইতালিকে কতটা বিশ্বাস করতে পারবেন? একইসাথে লিবিয়ার তেলের সরবরাহ ইতালির জন্যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আর তেলখনিগুলি হাফতারের নিয়ন্ত্রণে থাকলে ইতালিই সবচাইতে বেশি বিচলিত হবে। এই মুহুর্তে ‘জিএনএ’ সরকারকে সমর্থন করে যাওয়া ছাড়া ইতালির হাতে কোন অপশন নেই। ১৯১১ সালে ইস্তাম্বুলের হাত থেকে লিবিয়া ছিনিয়ে নিলেও শতবর্ষ পরে ‘জিএনএ’এর সমর্থক হিসেবে ইতালি শুধুমাত্র তুরস্ককেই তার পাশে দেখতে পাচ্ছে।

Sunday 19 January 2020

চীন-মিয়ানমার ইকনমিক করিডোর – কতটুকু বাস্তব?

১৯শে জানুয়ারি ২০২০

 
চীন মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী কার্যকলাপকে বৈধতা দানে যতটুকু এগুলো, বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মানুষের আস্থা অর্জনে ততটাই পেছালো; যা কিনা রাখাইনে চীনের কৌশলগত কিউক পিউ বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সাথে সাংঘর্ষিক। অর্থনৈতিক দিক থেকে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ উভয়েই চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হলেও অত্র অঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক প্রভাব গুটিকয়েক ব্যক্তির মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে।

   

১৮ই জানুয়ারি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর প্রথম মিয়ানমার সফরের সময় মোট ৩৩টা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হলো; আর এটা হলো এমন সময়ে, যখন অং সান সু কির সরকার রাখাইন প্রদেশের মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালানোর জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রয়েছে। এরকম পরিস্থিতির মাঝেই স্বাক্ষরিত এই সমঝোতাগুলির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ‘চায়না-মিয়ানমার ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিএমইসি’; যার মাঝে রয়েছে রাখাইনের কিউক পিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং সেই বন্দরের সাথে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের কুনমিংএর রেল যোগাযোগ স্থাপন। এছাড়াও চীনের সীমানার কাছাকাছি একটা স্পেশাল ইকনমিক জোন এবং বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াংগনে একটা শিল্পাঞ্চল করার ঘোষণাও এসেছে। তবে ‘সিএমইসি’র বাস্তবতাগুলি আলোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কিউক পিউ থেকে ইতোমধ্যেই গ্যাস এবং তেলের পাইপলাইন চীন পর্যন্ত গিয়েছে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মালাক্কা প্রণালী বাইপাস করে চীনের জ্বালানি চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করছে। এই পাইপলাইন যেভাবে চীনের স্বার্থ পূরণ করছে, তেমনি মিয়ানমারে অনেকেই মনে করছেন যে, কিউক পিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে সেটার সুবিধাও চীনই ভোগ করবে; মিয়ানমার নয়।

মিয়ানমারকে চীন সবসময়ই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জাতিসংঘে, সুরক্ষা দিয়ে গেছে। এমনকি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মুসলিমদের উপর ব্যাপক নির্যাতনের পরেও মিয়ানমারের পাশে থাকে চীন। ‘এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’এর আঞ্চলিক পরিচালক নিকোলাস বেকুয়েলিন বলছেন যে, চীনের সমর্থন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে মুসলিমদের উপর নির্যাতন বৃদ্ধি করতে শক্তি যুগিয়েছে। মিয়ানমারের বেসামরিক নেতা নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অং সান সু কি রাখাইনের মুসলিমদের উপর নির্যাতনকে বৈধতা দিয়ে সারা বিশ্বে ধিক্কার কুড়িয়েছেন।

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, মিয়ানমারের উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রদেশগুলি দেশটাতে চীনা বিনিয়োগের জন্যে সবচাইতে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। একইসাথে উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশে চীনা ঋণের ফাঁদের উদাহরণ তৈরি হয়ে যাওয়ায় মিয়ানমারের কর্মকর্তারা পানিবিদ্যুৎ এবং সমুদ্রবন্দরের চুক্তিগুলিকে মুলতুবি রেখেছিলেন অথবা সেগুলির ব্যাপারে নতুন করে আলোচনার কথা বলেছেন। মিয়ানমারের সর্বউত্তরের কাচিন প্রদেশের প্রভাবশালী ব্যাপটিস্ট কনভেনশনের প্রেসিডেন্ট হাকালাম স্যামসন বলছেন যে, চীন সর্বদাই বলে যে মিয়ানমারে তাদের বিনিয়োগ হলো মিয়ানমারের জনগণের উন্নয়নের জন্য; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা পুরোপুরি অন্যরকম। চীনারা তাদের প্রকল্পগুলিতে শুধু চীনা নাগরিকদেরই চাকুরি দেয়। এমনকি তারা তাদের খাদ্যদ্রব্যও চীন থেকে নিয়ে আসে; মিয়ানমার থেকে কিছুই কেনে না। কাচিন প্রদেশ হলো সেই তিন প্রদেশের একটা, যেগুলি শি জিনপিংএর সফর থেকে বিনিয়োগের প্রস্তাব পাচ্ছে। কাচিন প্রদেশেই ২০১১ সালে মাইতসোন পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প আটকে যায়। কাচিনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান এতে পানির নিচে চলে যেতো; আর উৎপাদিত বিদ্যুৎ রপ্তানি হবার কথা ছিল চীনে। প্রকল্পটা আবারও নেয়া হতে পারে - এই গুজব ছড়িয়ে পড়লে ২০১৯ সালে সেখানে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ।
 
 
অস্থির প্রদেশগুলির মাঝ দিয়ে তৈরি ‘চায়না-মিয়ানমার ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিএমইসি’ প্রথম দিন থেকেই নিরাপত্তাহীন থাকবে। মিয়ানমারের জনগণকে চীন যথেষ্ট নির্ভরশীল করে তৈরি করতে পারেনি, যা কিনা এই করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতো। অন্যদিকে চীনের আগ্রাসী ঋণের বেড়াজালে আটকে যাবার ভয় থেকেও মিয়ানমার বের হতে পারছে না। কিউক পিউ বন্দরের জন্যে দীর্ঘমেয়াদি দরকষাকষি এটাই দেখিয়ে দেয়। 

২০১৮ সালে রাখাইন প্রদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির প্রকল্পকে আলোচনার মাধ্যমে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ থেকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়। রাখাইনের মানুষের অধিকার খর্ব হওয়া ছাড়াও বিশাল ঋণের ফাঁদে ফেলে বন্দরের নিয়ন্ত্রণ দখলের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি হয়। ‘রাখাইন ইকনমিক ইনিশিয়েটিভ’এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ইউ খিন মাউং কি বলছেন যে, চীনা বিনিয়োগ জনগণের জন্যে কল্যাণকর না হলে জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করবে। আর সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিনিয়োগ সর্বদাই ঝুঁকিপূর্ণ। বিচ্ছিন্নতাবাদী শান প্রদেশের পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রী ইউ সোয়ে নিউন্ট লোউইন বলছেন যে, সীমান্ত প্রদেশে সহিংসতার কারণে চীনা বিনিয়োগ কমে গেছে। তিনি শি জিনপিংএর কাছ থেকে শান্তির আশা করছেন। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলির কয়েকটার উপর চীনাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। গ্রুপগুলির নেতারা চীনে আশ্রয় পায়। এমনকি একবার একটা শান্তি আলোচনায় মিয়ানমারের রাজধানী নে পি দোতে পৌঁছাবার জন্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার জন্যে বিমান চার্টার করে দেয় বেইজিং। মিয়ানমারের জাতিগত সহিংসতায় সামরিক সরকার, চীন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলির নেতৃবৃন্দ - এরা সকলেই লাভবান হয়েছে; শুধু সাধারণ জনগণ ছাড়া। মিয়ানমারে চীনের প্রস্তাবিত বিনিয়োগেরও একই চেহারা হতে পারে।

‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতাতে টিকে থাকতে চীন চাইছে কৌশলগত মালাক্কা প্রণালীকে বাইপাস করতে। তবে মালাক্কা প্রণালী যেমন চীনের নিয়ন্ত্রণে নেই, তেমনি বঙ্গোপসাগর চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কাজেই কিউক পিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করা এবং সেই বন্দরের সাথে চীনের সরাসরি রেল সংযোগ তৈরি করার প্রকল্প সর্বদাই অবরোধের হুমকিতে থাকবে। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে চীনারা মিয়ানমারের মুসলিমদের উপর অত্যাচার মেনে নেবার যে নীতিতে এগুচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদে চীনের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করছে। কারণ চীনের বেশিরভাগ জ্বালানিই আসে মুসলিম বিশ্ব থেকে। তদুপরি রাখাইন, কাচিন এবং শান প্রদেশে সহিংসতা বন্ধে চীন কতটুকু অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। অস্থির প্রদেশগুলির মাঝ দিয়ে তৈরি এই করিডোর প্রথম দিন থেকেই নিরাপত্তাহীন থাকবে। মিয়ানমারের জনগণকে চীন যথেষ্ট নির্ভরশীল করে তৈরি করতে পারেনি, যা কিনা এই করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতো। অন্যদিকে চীনের আগ্রাসী ঋণের বেড়াজালে আটকে যাবার ভয় থেকেও মিয়ানমার বের হতে পারছে না। কিউক পিউ বন্দরের জন্যে দীর্ঘমেয়াদি দরকষাকষি এটাই দেখিয়ে দেয়। পরিশেষে, চীন মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী কার্যকলাপকে বৈধতা দানে যতটুকু এগুলো, বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মানুষের আস্থা অর্জনে ততটাই পেছালো; যা কিনা রাখাইনে চীনের কৌশলগত কিউক পিউ বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সাথে সাংঘর্ষিক। অর্থনৈতিক দিক থেকে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ উভয়েই চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হলেও অত্র অঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক প্রভাব গুটিকয়েক ব্যক্তির মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে।

Saturday 18 January 2020

ইন্দোনেশিয়াকে ঘুম থেকে জাগালো চীন?


১৮ই জানুয়ারি ২০২০
চীন যেমন এখানে তার প্রভাব বৃদ্ধিতে পিছপা হবে না, তেমনি ইন্দোনেশিয়াও নতুনা সাগরে চীনের ফিশিং ফ্লীটের হুমকি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না। নতুনার এই বিরোধ হয়তো ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির জন্যে ঘুম থেকে জেগে ওঠার কাজটাই করবে। পূর্বের সাগরের প্রায় সবগুলি কৌশলগত সমুদ্রপথের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া তার পররাষ্ট্রনীতিকে পরিবর্তন করলে এর ভূকৌশলগত প্রভাব সারা বিশ্বে প্রতিফলিত হবে।

দক্ষিণ চীন সাগরে ইন্দোনেশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন নতুনা দ্বীপপুঞ্জের কাছে চীনের সাথে তিন সপ্তাহব্যাপী উত্তেজনার পর ৯ই জানুয়ারি ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনী ঘোষণা দেয় যে, চীনের সকল জাহাজ ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রসীমা ত্যাগ করেছে। ইন্দোনেশিয়ার ‘ম্যারিটাইম সিকিউরিটি এজেন্সি’ বলছে যে, গত ১৯ থেকে ২৪শে ডিসেম্বরের মাঝে কমপক্ষে ৬৩টা চীনা মাছ ধরার জাহাজ চীনা কোস্ট গার্ডের প্রহরায় নতুনার আশেপাশের সমুদ্রে এসে পৌঁছায়, যে সমুদ্রাঞ্চলকে ইন্দোনেশিয়া নিজেদের অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে দাবি করে। অন্যদিকে চীনারাও তাদের স্বঘোষিত ‘নাইন-ড্যাশ লাইন’এর আওতায় এই এলাকায় নিজেদের ‘ঐতিহাসিক অধিকার’ রয়েছে বলে মনে করে। হতচকিত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার নেতৃবৃন্দ জানুয়ারির শুরুতে নতুনার দিকে নৌবাহিনীর দু’টা কর্ভেট প্রেরণ করে। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেনস’ বলছে যে, জানুয়ারির ৬ তারিখ নাগাদ ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী সেখানে আরও ৪টা ফ্রিগেট, একটা সাবমেরিন এবং একটা উভচর পরিবহণ জাহাজ প্রেরণ করে। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার বিমান বাহিনীর ১৬ নম্বর স্কোয়াড্রন থেকে ৪টা ‘এফ-১৬’ ফাইটার বিমান এবং সেনাবাহিনীর ৬’শ সদস্য সেখানে মোতায়েন করা হয়।

৬ই জানুয়ারি দক্ষিণ চীন সাগরের স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের ‘ফায়ারি ক্রস’ দ্বীপ হতে চীনা কোস্ট গার্ডের দু’টা জাহাজ নতুনার পথে যাত্রা করে বলে জানায় ‘ম্যারিন ট্রাফিক’ নামের শিপিং ইন্টেলিজেন্স সংস্থা। জাহাজগুলি খুব সম্ভবতঃ সেখান থেকে জ্বালানি নিয়ে যাত্রা করে। ‘ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজ’এর ‘চায়না ম্যারিটাইম স্টাডিজ ইন্সটিটিউট’এর রায়ান মার্টিনসন বলছেন যে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের মূল ভূখন্ড থেকে দূরবর্তী এলাকাগুলিতে অপারেশন চালাবার জন্যে চীনের দখলে থাকা স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জের এই ঘাঁটিগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ‘অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইন্সটিটিউট’এর গবেষক চার্লি লিয়ন্স জোন্সএর মতে, মনুষ্যনির্মিত এই দ্বীপগুলি চীনের নৌশক্তিকে মূল ভূখন্ড থেকে দূরের এলাকায় প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করছে। ‘ফায়ারি ক্রস’এ চীনারা বিশাল রানওয়ে তৈরি করেছে, যেখানে ফাইটার জেট এবং বড় পরিবহণ বিমান অবতরণ করতে পারবে। তবে তিনি আরও বলছেন যে, চীনারা মূল ভূখন্ড থেকে অতটা দূরে এই ঘাঁটি ধরে রাখার লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জগুলি কতটা মোকাবিলা করতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে।


  
চীনকে না চটানোর নীতিটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়ায় চীনাদের নিয়মিত হুমকিগুলি ইন্দোনেশিয়দের জন্যে প্রায় গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। আর অন্যদিকে চীন নিজের বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। নতুনা দ্বীপপুঞ্জ চীনের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ মালাক্কা প্রণালীর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে। কাজেই চীন যেমন এখানে তার প্রভাব বৃদ্ধিতে পিছপা হবে না, তেমনি ইন্দোনেশিয়াও নতুনা সাগরে চীনের ফিশিং ফ্লীটের হুমকি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না। 


প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা এই উত্তেজনার মাঝে ইন্দোনেশিয়া ৩০শে ডিসেম্বর জাকার্তাতে চীনা রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদলিপি পেশ করে। ‘ভোয়া নিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, চীনের সাথে ইন্দোনেশিয়ার মৎস্য শিকার নিয়ে বিভেদ নতুন নয়। আর ইন্দোনেশিয়াও সাম্প্রতিক সময়ে নতুনা দ্বীপ এলাকায় সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়ার এহেন সামরিক পদক্ষেপ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী কর্মকান্ড ঠেকাতে যথেষ্ট ছিল না। মোটকথা ইন্দোনেশিয়া একেবারেই অপ্রস্তুত ছিল। ৮ই জানুয়ারি নতুনা দ্বীপে ছুটে যান ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। তিনি নতুনার লাম্পা স্ট্রেইট ফিশিং পোর্টে ঘোষণা দেন যে, তিনি সেখানে গিয়েছেন উত্তর নতুনা সাগরের সম্পদের উপর ইন্দোনেশিয়ার সার্বভৌম ক্ষমতা বলবত করতে।

চীনের হুমকি মোকাবিলায় সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত করতে ইন্দোনেশিয়া জরুরি পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে। ‘আইএইচএস জেনস’ জানাচ্ছে যে, ইন্দোনেশিয়া তার নৌবাহিনীর ফ্রান্স থেকে কেনা ১১টা ‘প্যান্থার’ হেলিকপ্টারকে সাবমেরিন ধ্বংসী এবং জাহাজ ধ্বংসী অস্ত্রে সজ্জিত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই হেলিকপ্টারগুলি ক্রয়ের সময়ে শত্রুর জাহাজের উপর সরাসরি হামলার জন্যে উপযোগী অবস্থায় ক্রয় করা হয়নি। একইসাথে নৌবাহিনী ৪টা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ক্রয়ের জন্যে টেন্ডার ডেকেছে। চীনা কোস্ট গার্ডের বিরাট প্যাট্রোল ভেসেলগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দোনেশিয়ার কোস্ট গার্ডের বেশিরভাগ জাহাজই অপেক্ষাকৃত ছোট। তাই নৌবাহিনীর কর্ভেট এবং ফ্রিগেটগুলিকে ডেকে পাঠাতে হয়েছে চীনা কোস্ট গার্ডের জাহাজগুলিকে মোকাবিলার জন্যে। এছাড়াও পূর্ব জাভার পাইতন নৌঘাঁটিতে ৭৬ মিঃমিঃএর একটা কামান বসানো হয়েছে কামান চালনায় নৌবাহিনীর দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে। অর্থাৎ এতকাল কামান চালনাকে বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রের অংশই মনে করা হয়নি।

১৫ই জানুয়ারি দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত নতুনা দ্বীপে সরেজমিন পরিদর্শন করে ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক, আইনী এবং নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী মাহফুদ এমডি বলেন যে, নতুনা দ্বীপে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়াবার লক্ষ্যে ইন্দোনেশিয়ার সরকার সেখানে মৎস্য আহরণ বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে। ‘জাকার্তা পোস্ট’এর এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ১ হাজার কিঃমিঃএর বেশি দূরত্বে অবস্থিত জাভা থেকে ৩৫টা মাছ ধরার জাহাজ নিয়ে আসা হচ্ছে এই অঞ্চলে। এই জাহাজগুলির প্রতিটার ধারণক্ষমতা ৭৫টনের বেশি। সরকার বলছে যে, নতুনার জেলেদের জাহাজগুলি একেবারেই ছোট, যেগুলি চীনাদের সাথে প্রতিযোগিতা করে এই অঞ্চলের সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে একেবারেই অপ্রতুল। একই দিনে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি ভিয়েতনামের হো চিন-মিন সিটিতে এক ঝটিকা সফরে ভিয়েতনামের ‘হাই নাম’ নামের একটা সীফুড কোম্পানির সাথে বৈঠক করে ইন্দোনেশিয়া থেকে বেশি করে মাছ আমদানি করার আহ্বান জানান। উদ্দেশ্য নতুনা সাগরে মাছ আহরণ বৃদ্ধি করে সেই মাছের জন্যে বাজার ধরা। ১৭ই জানুয়ারি জাকার্তায় ম্যারিটাইম এফেয়ার্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট মন্ত্রী লুহুত পাঞ্জাইতান সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া নতুনা দ্বীপে ফিশ প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি করতে ইচ্ছুক।

২০১৭ সালে নতুনা দ্বীপের আশেপাশের অঞ্চলকে নিজের অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করলেও প্রকৃতপক্ষে ইন্দোনেশিয়া তার স্বার্থকে সমুন্নত করতে নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা ছাড়াই এগুচ্ছিল। চীনকে না চটানোর নীতিটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়ায় চীনাদের নিয়মিত হুমকিগুলি ইন্দোনেশিয়দের জন্যে প্রায় গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। আর অন্যদিকে চীন নিজের বাণিজ্যপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। নতুনা দ্বীপপুঞ্জ চীনের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ মালাক্কা প্রণালীর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে। কাজেই চীন যেমন এখানে তার প্রভাব বৃদ্ধিতে পিছপা হবে না, তেমনি ইন্দোনেশিয়াও নতুনা সাগরে চীনের ফিশিং ফ্লীটের হুমকি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না। নতুনার এই বিরোধ হয়তো ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির জন্যে ঘুম থেকে জেগে ওঠার কাজটাই করবে। পূর্বের সাগরের প্রায় সবগুলি কৌশলগত সমুদ্রপথের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া তার পররাষ্ট্রনীতিকে পরিবর্তন করলে এর ভূকৌশলগত প্রভাব সারা বিশ্বে প্রতিফলিত হবে।

Friday 10 January 2020

ইরানের সাথে ‘যুদ্ধের’ ইতি টানলেন ট্রাম্প?

১০ই জানুয়ারি ২০২০

ইরান যেমন ইরাকে তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান চাইছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও ইরাকের নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে নারাজ। তবে সুলাইমানির হত্যাকান্ডের ঘটনায় ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অবস্থানের পক্ষে যুক্তিগুলি দুর্বল হতে থাকবে। আর তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবর্তমানে ইরাকে ইরানের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে তুরস্ক এবং সৌদি আরবের মতো  প্রতিবেশি দেশগুলিকে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি সক্রিয় দেখতে চাইতে পারে।



ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ৯ই জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক ভাষণে বলেন যে, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, ইরান যুদ্ধংদেহী অবস্থান থেকে সরে আসছে। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন বিমান হামলায় ইরানের ‘রেভোলিউশনারি গার্ড কোর’ বা ‘আইআরজিসি’র বিশেষ বাহিনী ‘কুদস ফোর্স’এর কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সুলাইমানির মৃত্যুর পর প্রতিশোধ হিসেবে ইরাকে মার্কিন স্থাপনাগুলিতে হামলা করা হয়েছে বলে জানায় ‘আইআরজিসি’। একইসাথে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের দাবিও তোলা হয়। ‘আইআরজিসি’ আরও বলে যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি আবারও কোন আগ্রাসী কার্যকলাপে জড়ায়, তবে ইরানও তার প্রত্যুত্তর দেবে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি টেলিভিশনে প্রচারিত এক বার্তায় বলেন যে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের চেহারায় চপেটাঘাত করা হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ইরানের এই বার্তাগুলি বলে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের উপর পাল্টা হামলা না করে, তাহলে ইরানও তার সামরিক প্রতিশোধকে এখানেই সীমাবদ্ধ করে ফেলতে চাইছে। আর অন্যদিকে সুলাইমানিকে হত্যার পর থেকেই ট্রাম্প প্রশাসনও উত্তেজনা প্রশমন করতে ইচ্ছুক বলে জানান দিচ্ছিল। ট্রাম্প বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যাকান্ড করেছে যুদ্ধ বন্ধ করতে; যুদ্ধ শুরু করতে নয়। আর ইরাকে মার্কিন স্থাপনায় ইরানের হামলার পরপরই ট্রাম্প রাতের বেলায় এক টুইটার বার্তায় লিখেন যে, ‘সবকিছু ঠিকই আছে’। তিনি আরও বলেন যে, আপাততঃ সব ভালোই ঠেকছে। তিনি পরদিন সকালে একটা বার্তা দেবেন বলে জানান। ট্রাম্প যে রাতের বেলায়ই কোন প্রতিশোধমূলক হামলা থেকে বিরত থেকে ঘুমাতে গিয়েছিলেন, তখনই অনেকে ধারণা করেছিলেন যে, ট্রাম্প হয়তো যা চাইছিলেন তা-ই পেয়েছেন।

ইরাকের সামরিক বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয় যে, ৮ই জানুয়ারি ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে ইরানের সামরিক বাহিনী মোট ২২টি ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। এর মাঝে ১৭টা ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছিল আনবার প্রদেশে অবস্থিত আইন আল-আসাদ ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে। বাকি পাঁচটা ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছিল ইরাকের উত্তরের আরবিল শহরের কাছে মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে। ‘সিএনএন’ বলছে যে, অনেক মার্কিন কর্মকর্তারাই ধারণা করছেন যে, ইরান ইচ্ছে করেই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এমনভাবে টার্গেট করেছে, যাতে মার্কিন সেনারা হতাহত না হয়। তারা বলছেন যে, ইরান হয়তো এমন একটা বার্তা দিতে যাচ্ছিল, যার ফলাফল হিসেবে মার্কিনীরা ব্যাপক সামরিক হামলা থেকে বিরত থাকবে। হোয়াইট হাউজও চাইছে উত্তেজনা প্রশমনের দিকে ঘটনাকে ধাবিত করতে। ইরাকের প্রেসিডেন্ট আদেল আব্দুল মাহদি বলেন যে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরুর আগেই ইরাকের সরকারকে সতর্ক করে দেয় ইরান; আর সেই হিসবে ইরাকিরা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল। মাহদি বলেন যে, ইরান তাদেরকে বলেছে যে, ইরাকে মার্কিন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করেই হামলা করা হবে। আর মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন যে, সেই হিসেবে ইরাকিরা মার্কিনীদেরকে আগেভাগেই সতর্ক করে। ইরান ইচ্ছে করলেই এমন টার্গেটে হামলা করতে পারতো, যেখানে অনেক মার্কিন সেনাকে হতাহত করা যেতো। হামলার আগে থেকে মার্কিনীরা যথেষ্ট সতর্কবার্তা পেয়েছিল, যার মাধ্যমে মার্কিন সেনারা নিরাপদে থাকতে পেরেছে।

‘মিডলবুরি ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর জন্যে ‘প্ল্যানেট’ নামের একটা কোম্পানি বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইরাকে আইন আল-আসাদ ঘাঁটির ছবি তোলে। ‘মিডলবুরি ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক ডেভিড স্মারলার ‘এনপিআর’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, ঐ ঘাঁটিতে কমপক্ষে পাঁচটা স্থাপনা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ধ্বংস হয়েছে। এই স্থাপনাগুলি সম্ভবতঃ বিমান রাখার জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছিল। একই ঘাঁটিতে অন্যান্য স্থাপনা ছিল যেখানে মার্কিন সেনারা বসবাস করতো। ইরান সেসব স্থাপনায় হামলা করেনি। এর অর্থ হতে পারে যে, তারা হয়তো জান নয়, বরং মালের ক্ষয়ক্ষতি চাইছিল। ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর সিনিয়র ফেলো টম কারাকো বলছেন যে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি যথেষ্ট উন্নত এবং এগুলি মোটামুটি নির্ভুলভাবে টার্গেটে আঘাত হানতে পারে। যদি ইরানিরা হতাহতের সংখ্যা বাড়াতে চাইতো, তাহলে তারা অন্য কোন কিছু করতো।

ট্রাম্প তার ভাষণে বলেন যে, আগের মার্কিন প্রশাসন ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি করেছিল; যার অংশ হিসেবে ইরানকে ১’শ ৫০ বিলিয়ন ডলার দেয়া হয়। এই অর্থ ব্যবহার করেই ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্রের বহর তৈরি করেছে। তিনি ব্রিটেন ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া এবং চীনকে আগের পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে আসতে বলেন, যাতে ইরানের সাথে নতুন করে আরেকটা চুক্তি করা যায়। ট্রাম্প আরও বলেন যে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচাইতে বড় তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের কোন দরকার যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তিনি মনে করিয়ে দেন যে, আইসিস স্বাভাবিকভাবেই ইরানের শত্রু। আইসিস এবং আরও কিছু কারণে ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের একত্রে কাজ করা উচিৎ।

আইসিস ধ্বংসের পর থেকে ইরাক এবং সিরিয়াতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের একত্রে কাজ করার ক্ষেত্র কমে গেছে। এমতাবস্থায় ইরানের আঞ্চলিক কর্মকান্ডকে সীমাবদ্ধ করতেই ট্রাম্প ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা কমে যাওয়ায় ইরানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের উপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করার অপশনও কমে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যেকোন সংঘাত ইউরোপ এবং এশিয়ার দেশগুলিকেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। পারমাণবিক চুক্তির ব্যাপারটা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও পারমাণবিক ইস্যুতে শক্তিশালী দেশগুলির সাথে চুক্তি করতে ছাড় দেয়ার মানসিকতা রাখায় ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধিকেই যুক্তরাষ্ট্র বড় সমস্যা হিসেবে দেখছে। ইরান যেমন ইরাকে তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান চাইছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও ইরাকের নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে নারাজ। তবে সুলাইমানির হত্যাকান্ডের ঘটনায় ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অবস্থানের পক্ষে যুক্তিগুলি দুর্বল হতে থাকবে। আর তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবর্তমানে ইরাকে ইরানের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে তুরস্ক এবং সৌদি আরবের মতো প্রতিবেশি দেশগুলিকে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি সক্রিয় দেখতে চাইতে পারে। 

Monday 6 January 2020

যুক্তরাষ্ট্র কি ইরাক ছাড়ছে?

৬ই জানুয়ারি ২০২০
সুলাইমানির মৃত্যু যদি ইরাকে মার্কিন অবস্থানকে দুর্বল করে, এবং শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরাক ছাড়তে বাধ্য হয়, তাহলে ইরাক এবং সিরিয়াতে যে ভূরাজনৈতিক শূণ্যস্থান তৈরি হবে, সেটা কেউ না কেউ পূরণ করতে চাইবে। তবে ইরাকের জনগণ ইরানকে এই অবস্থানে দেখতে না-ও চাইতে পারে; কারণ তারা চাইছে না যে ইরাকের পুরো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে চলে যাক। এক্ষেত্রে ইরানের বিকল্প হিসেবে ইরাকের উত্তর এবং দক্ষিণের দুই আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক এবং সৌদি আরবের আবির্ভাবের সম্ভাবনা রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের একার বদলে কয়েকটা শক্তির মাঝে ইরাককে বিভক্ত দেখতে চাইবে।

৫ই জানুয়ারি ইরাকের পার্লামেন্টে একটা ভোট অনুষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা বের করে দেবার ইচ্ছা ব্যাক্ত করা হয়। তবে এই সমঝোতার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ইরাকের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আদেল আব্দুল মাহাদি বলেন যে, তার দেশ থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবার জন্যে একটা টাইমলাইন ঠিক করে ফেলা দরকার। তবে ইরাক থেকে মার্কিন সেনাদের সরাতে এমন একটা আইন লাগবে, যা বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর একইসাথে মার্কিন সেনাদেরকে এক বছরের নোটিস দিতে হবে। বর্তমানে ইরাকে ৫ হাজার ২’শর মতো মার্কিন সৈন্য রয়েছে। এতকাল যাবত ট্রাম্প প্রশাসন ইরাকের রাজনীতিবিদদের বোঝাতে পেরেছে যে, ইরাকে মার্কিন সেনাদের প্রয়োজন রয়েছে। এমনকি ইরান-সমর্থিত গ্রুপগুলিও আইসিস দমনে ইরাকে মার্কিন সেনা রাখার পক্ষে ছিল। কিন্তু ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ড কোরের ‘কুদস ফোর্স’এর কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সুলাইমানিকে বাগদাদ বিমানবন্দরে বিমান হামলার মাধ্যমে হত্যা করার পর ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের দাবি আরও জোরদার হয়েছে।

‘দ্যা ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো মাইকেল নাইটস বলছেন যে, ইরাকে বহু রাজনীতিবিদ রয়েছে যারা কিনা ইরাকে মার্কিন সেনাদের অবস্থানের উপর নিজেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার টিকিয়ে রেখেছেন। এই গ্রুপগুলি ইরানের প্রভাবকে ব্যালান্স করার জন্যে ইরাকে মার্কিন সেনা চাইছে। আর ঠিক একারণেই ২০১৮ সালে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবার পিছনে তিনদফা আন্দোলনের পরেও ব্যাপারটার কোন সুরাহা করা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে আলোচনা এবং আইনের ড্রাফট তৈরির মাঝে যেকোন ইস্যুই হারিয়ে যেতে পারে। ইরাকে একটা আইনকে পিছিয়ে দেবার এতো বেশি পদ্ধতি রয়েছে যে, এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে দেশটা থেকে মার্কিন সেনা সরাবার জন্যে প্রকৃতই কোন আইন পাস করা যাবে। আর ইরাকের বর্তমান অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর অধীন সরকার সাংবিধানিকভাবে কতটুকু ক্ষমতাবান, সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরাকের করা এক্সিকিউটিভ এগ্রিমেন্ট বাতিল করতে পারবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়। আর ৫ই জানুয়ারির ভোটাভুটির সময় পার্লামেন্টে সুন্নি এবং কুর্দী গ্রুপগুলির অনেক প্রতিনিধিই উপস্থিত ছিলেন না। ট্রাম্পের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রাক্তন কর্মকর্তা কার্সটেন ফনটেনরোজ বলছেন যে, যে শিয়া নেতারা ভোট দিয়েছেন, তাদের জন্যে বিপক্ষে ভোট দিয়ে নিরাপদে রাস্তায় হাঁটা কঠিন ছিল; কারণ ভোটাভুটি হয়েছে প্রকাশ্যে। গোপন ভোটাভুটিতে ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো।

তবে সুলাইমানির হত্যাকান্ড সকলকেই কাঁপিয়েছে। এমনকি সুলাইমানির হত্যাকান্ডে যেসব রাজনীতিবিদ সুবিধা পাবেন, তারাও মার্কিন বাহিনীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এদের মাঝে রয়েছেন ইরাকের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল-সদর। সদর পার্লামেন্টে দেয়া এক বক্তব্যে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলেন। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিনীরা চাইছে ইরাকিদের সামনে একটা অপশন তুলে ধরতে – হয় তোমরা যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নাও, নতুবা ইরানকে। কিন্তু বেশিরভাগ ইরাকির জন্যে ব্যাপারটা অতটা পরিষ্কার নয়। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের সরকারকে উৎখাতের পর ইরাকের নতুন সরকার গঠনে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান একত্রে কাজ করেছে। পরবর্তীতে আইসিসের আবির্ভাবের পরও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান একত্রে কাজ করেছে। ইরাকি এক কর্মকর্তা বলছেন যে, সুলাইমানি না থাকলে হয়তো বাগদাদ আর আরবিল শহরের পতন হয়ে যেতো। তবে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইরাকের বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপগুলিকে সরকারি নিরাপত্তা কাঠামোর মাঝে নিয়ে আসতে।

ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে আনা হবে কিনা, সেব্যাপারে মার্কিনীদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন যে, সুলাইমানির হত্যার পর ইরাকে মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা কঠিন পরীক্ষার মাঝে পড়েছে। তারা বলছেন যে, ট্রাম্পের উচিৎ ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, সেটা তিনি বাস্তবায়ন করবেন। ‘ডিফেন্স প্রাইয়রিটিজ’এর পলিসি ডিরেক্টর বেঞ্জামিন ফ্রীডম্যান বলছেন যে, আজ হোক কাল হোক, ইরাকের সমস্যা ইরাকীদেরকেই সমাধান করতে হবে। এটা ইরাকীরা জানে; মার্কিনীরাও সেব্যাপারে একমত। যেব্যাপারে সকল বিশ্লেষকেরাই মোটামুটিভাবে একমত তা হলো, ইরাকে মার্কিন কর্মকান্ড আগের চাইতে কমিয়ে ফেলতে হতে পারে। ইতোমধ্যেই হামলার কারণে ইরাকে মার্কিন প্রশিক্ষণ কর্মকান্ডকে কমিয়ে আনা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক কার্ক সোওয়েল বলছেন যে, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মাহাদি এবং প্রেসিডেন্ট বারহাম সালিহ মার্কিন সমর্থিত লোক হলেও এই মুহুর্তে অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে তাদের পক্ষে মার্কিন স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে পারাটা আরও কঠিন হয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকের রাস্তায় আন্দোলনের সময় সরকারি দুর্নীতির সাথে সাথে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও কথা বলেছে জনগণ। এতে অনেকের সাথে ইরান-সমর্থিত গ্রুপগুলিও চিন্তিত হয়েছে। গত মে মাসের নির্বাচনে মুকতাদা আল-সদরএর গ্রুপ সবচাইতে বেশি ভোট পেয়েছিল। সদরই মার্কিন সেনাদের ইরাক থেকে সরানোর ব্যাপারে পার্লামেন্টে কথা বলেছেন। মাইকেল নাইটস বলছেন যে, সদরকে সুলাইমানির সমর্থক বলা না গেলেও সদরই মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারটাকে তুলে ধরে সুলাইমানির মৃত্যুকে বেশি ব্যবহার করতে পারবেন।

সুলাইমানির মৃত্যু যদি ইরাকে মার্কিন অবস্থানকে দুর্বল করে, এবং শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরাক ছাড়তে বাধ্য হয়, তাহলে ইরাক এবং সিরিয়াতে যে ভূরাজনৈতিক শূণ্যস্থান তৈরি হবে, সেটা কেউ না কেউ পূরণ করতে চাইবে। তবে ইরাকের জনগণ ইরানকে এই অবস্থানে দেখতে না-ও চাইতে পারে; কারণ তারা চাইছে না যে ইরাকের পুরো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে চলে যাক। এক্ষেত্রে ইরানের বিকল্প হিসেবে ইরাকের উত্তর এবং দক্ষিণের দুই আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক এবং সৌদি আরবের আবির্ভাবের সম্ভাবনা রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের একার বদলে কয়েকটা শক্তির মাঝে ইরাককে বিভক্ত দেখতে চাইবে।


Sunday 5 January 2020

নতুন বছর কি যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ দিয়ে শুরু হচ্ছে?

৪ঠা জানুয়ারি ২০২০

সুলাইমানির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও মার্কিন পদক্ষেপ এসেছে বহু দেরিতে। যুক্তরাষ্ট্রে সুলাইমানির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচকেরা সকলেই সুলাইমানিকে শত্রু আখ্যা দিয়েছে। এরপরও ট্রাম্পের বা তার আগের সরকারগুলি এতকাল সুলাইমানির অপরাধগুলিকে মেনে নিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করেনি।


নতুন বছরের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্য কেঁপে উঠলো এক সংবাদে। ইরানি রেভোলিউশনারি গার্ড কোর বা ‘আইআরজিসি’র বিশেষ বাহিনী ‘কুদস ফোর্স’এর কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সুলাইমানি বাগদাদে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হন। ‘বিবিসি’ বলছে যে, ‘আইআরজিসি’র বিদেশে অপারেশনগুলি দেখাশোনা করে ‘কুদস ফোর্স’। যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, সুলাইমানিকে তারা টার্গেট করেছে কারণ সুলাইমানির নির্দেশেই ২৭শে ডিসেম্বর ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে এক হামলায় এক মার্কিন নাগরিক নিহত হয়। পহেলা জানুয়ারির এক টুইট বার্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা এবং কিরকুকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার জন্যে ইরানকে সরাসরি দায়ি করেন। এবং একইসাথে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে হামলা এবং মার্কিন নাগরিক হত্যার জন্যে ইরানকে বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে; আর এটা কোন সতর্কবার্তা নয়, বরং এটা একটা হুমকি! ৩১শে ডিসেম্বর মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার জের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের ‘কাতাইব হিযবুল্লাহ’ নামের ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ার উপর হামলা করে; যার ফলশ্রুতিতে ২৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। আর নিহত ব্যক্তিদের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের শেষে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা করে বিক্ষুব্ধ জনতা।

‘সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’র ফেলো এবং প্রাক্তন মার্কিন উপ-সহকারি প্রতিরক্ষা সচিব এন্ড্রু এক্সাম বলছেন যে, কাসেম সুলাইমানি এমন এক ব্যক্তি, যিনি ছিলেন ইরানের আঞ্চলিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নের মূল ব্যক্তি। সুলাইমানি ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়াসহ আরবি ভাষাভাষি এলাকাগুলিতে ইরানের প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সিরিয়া এবং ইরাকের গৃহযুদ্ধের সময় সুলাইমানি একবার ছুটে যেতেন সিরিয়াতে; আবার ছুটে যেতেন ইরাকে – যখন তাকে যেখানে বেশি দরকার হতো, তিনি সেখানেই হাজির হতেন। এক্সামের ধারণা, ইরানে আর এমন দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি নেই যার মাধ্যমে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সুলাইমানিকে সরিয়ে দেবার সাথেসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের প্রতিযোগিতাটা প্রক্সি যুদ্ধের গন্ডি পেরিয়ে সরাসরি যুদ্ধে রূপ নিলো। তিনি বলছেন যে, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল দূত ব্রেট ম্যাকগার্ক মার্কিন টিভি চ্যানেল ‘এমএসএনবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, মার্কিন জনগণ পছন্দ করুক আর না করুক, এখন বুঝে নিতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এখন ইরানের যুদ্ধাবস্থা চলছে। তিনি আরও বলেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব এশিয়াতে তার শক্তিকে একত্রিত করার কাজ করলেও সুলাইমানির হত্যাকান্ডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আবারও মধ্যপ্রাচ্যে ফেরত আসতে বাধ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল; কারণ সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ‘ব্ল্যাক হোল’এর মতো তার সম্পদ হারাচ্ছিল। এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন শক্তি উঠিয়ে নেয়াটা খুব কঠিন হয়ে যাবে। একইসাথে ইরাকীরাই এখন যুক্তরাষ্ট্রকে দেশ ছাড়তে বলবে, যেটার কারণে ইরাকে একটা শূণ্যস্থান তৈরি হতে পারে।

ইরান কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যুত্তর দেবে, সেই প্রশ্নের উত্তরে ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রেসিডেন্ট ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, ইরান অবশ্যই এখন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব, অথবা পররাষ্ট্র সচিব বা ভাইস প্রেসিডেন্টের উপর হামলা করবে না; কারণ সেটা করলে ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব ক্ষমতা হারাতে বসবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে ইরান প্রথমেই ইরাকের ভেতরে মার্কিন টার্গেটগুলিকেই বেছে নেবে। কিন্তু সুলাইমানি এতদিন ধরে ইরাকসহ বাকি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের যে প্রক্সিগুলিকে তৈরি করেছিলেন, সুলাইমানির মৃত্যুর সাথে সাথে তারাও নেতৃত্বহীন হয়ে হারিয়ে যাবে। তদুপরি এই সংঘাত আরও গভীর হবার সম্ভাবনা অবশ্যই বৃদ্ধি পেলো। ব্রেমার বলছেন যে, ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার জন্যে যথেষ্ট কারণ ইতোমধ্যেই পেয়েছিলেন, যেগুলিকে তিনি কাজে লাগাননি। যেমন, ইরান মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করেছে, পারস্য উপসাগরে তেলের ট্যাঙ্কারে হামলা এবং সৌদি তেলের খনিতে হামলার জন্যেও যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে দায়ি করেছিল। কিন্তু ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি এবং দূতাবাসে হামলা হয়তো ট্রাম্পকে নীতি পরিবর্তন করতে প্রণোদনা যুগিয়েছে।

‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সুলাইমানির হত্যাকান্ডে সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়লেও বড় কোন যুদ্ধ হবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই; কারণ বড় যুদ্ধে ইরানের তেলের স্থাপনাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যাবে, যা অবরোধের শিকার ইরানের অর্থনীতির জন্যে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। তাই ইরান খুব সম্ভবতঃ কুদস ফোর্সের তৈরি করা প্রক্সিগুলি ব্যবহার করেই প্রত্যুত্তর দেবে। ২০০৩ সাল থেকে সুলাইমানি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইস্রাইলের টার্গেট লিস্টে থাকলেও এবারই প্রথম তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, কারণ ট্রাম্পের হয়তো মনে হয়েছে যে, ঝুঁকির চাইতে এর পুরষ্কার বেশি। অর্থনৈতিক অবরোধ এবং জনগণের আন্দোলনে ইরান হয়তো এতটাই দুর্বল হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ইরান এখন কৌশলগত হুমকি নয়। ‘সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসি’র ডিরেক্টর কামরান বোখারি ‘সিবিসি’র সাথে সাক্ষাতে বলেন যে, ওসামা বিন-লাদেন বা বাগদাদির হত্যাকান্ড থেকে সুলাইমানির হত্যাকান্ড আলাদা; কারণ সুলাইমানি একটা রাষ্ট্রের কর্মকর্তা। আর সুলাইমানি যে পদ্ধতিতে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন বা ইয়েমেনে যুদ্ধ করছিলেন, ইরান সেগুলিতেই পারদর্শী; সম্মুখ সমরে নয়। আর একজন ব্যক্তির জন্যে ইরান অতবড় ঝুঁকি নেবে না। আইসিসের পতনের পর সুলাইমানির মাধ্যমে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল। অন্যদিকে ঘটনার সুবিধা নিলেও নিজেদের স্বার্থকে ছাপিয়ে রাশিয়া এবং চীন ইরানকে সমর্থন দেবে না। আর ইরানও এমন কিছু করবে না, যাতে রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপের সমর্থন মিলিয়ে যায়।

সুলাইমানির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও মার্কিন পদক্ষেপ এসেছে বহু দেরিতে। যুক্তরাষ্ট্রে সুলাইমানির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচকেরা সকলেই সুলাইমানিকে শত্রু আখ্যা দিয়েছে। আর ট্রাম্প বলেছেন যে, নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা ছিল সুলাইমানির বিকৃত আসক্তি! অথচ এরপরও ট্রাম্পের বা তার আগের সরকারগুলি এতকাল সুলাইমানির অপরাধগুলিকে মেনে নিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করেনি। এই হত্যার ঘটনায় তেলের বাজার ইতোমধ্যেই গরম হয়েছে, যা কিনা তেল রপ্তানিকারক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করবে। আর একইসাথে নির্বাচনের আগেভাগে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে কাজ করবে।