Tuesday 23 December 2014

রাইজিং সান ওভার দ্যা ইন্ডিয়ান ওশান!

২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

বিখ্যাত মানুষের ছেলেমেয়েদের মানুষ হতে না পারার উদাহরণ অনেক আছে। কিন্তু শিক্ষিত মানুষেরা সাধারণত তাদের সন্তানদের স্বল্পশিক্ষিত করে রাখতে চান না। এই ব্যাপারটা যখন পুরো সমাজের মাঝে সঞ্চালিত হয়, তখন দেখা যায় যে একটা শিক্ষিত সমাজের মাঝে জন্ম নেয়া শিশুরা সবাই ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। ঠিক একইভাবে, সমাজের সর্বোচ্চ শিক্ষার পরিধি যখন বেশ সমৃদ্ধ হয়, তখন সেই সমাজে জন্ম নেয়া এবং শিক্ষা নেয়া মানুষের শিক্ষার পরিধিও বাড়ে। উর্ধগামী একটা সমাজে জন্মানো শিশুরা উর্ধে ওঠার জন্যেই প্রস্তুতি নিতে থাকে। যেই সমাজ সর্বদা নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে নিজেদের জীবনব্যবস্থাকে উন্নত করেছে, সেখানে উন্নতির মাপকাঠি সবসময় উর্ধগামী হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এক জিনিশ দু'বার আবিষ্কার করার দরকার হয় না; একবার করা হলে পরমুহূর্ত থেকেই সেটার উন্নততর কিছু একটা তৈরির জন্যে গবেষণা শুরু হয়ে যায়। এভাবে সমাজে জ্ঞানের পরিধি দিন দিন বাড়তেই থাকে। আর একবার একটা পর্যায়ে পৌঁছে যাবার পরে পিছনে আর ফিরে তাকাতে হয় না। এই জ্ঞানের পরিধি একেকটা সমাজের ক্ষেত্রে একেক রকম বলেই কেউ এগিয়ে অথবা কেউ পিছিয়ে আছে। আর যে একবার এগিয়ে যায়, তাকে নতুন করে কিছু উদ্ভাবন করতে হয় না। যুদ্ধ-বিগ্রহ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পিছিয়ে পড়লেও সেখানে জ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়ে না। দুর্যোগের পরপরই আবারো ঠিক যেখানে থেমেছিল, সেখান থেকেই শুরু হয় তাদের জ্ঞানের অগ্রযাত্রা। সমাজের চিন্তাধারার ক্ষেত্রেও এই ব্যাপরটাই হয়। একবার এগিয়ে গেলে কেউ পিছনে ফিরে যেতে চায় না; এটাই নিয়ম। এতগুলি কথা কেন লিখলাম? এখন সে কথাতেই আসি।


আইজেএন হোসো তৈরি হয় ১৯২২ সালে। জাপানের তৈরি প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ। তখনকার সময় এই জাহাজ প্রমাণ দিয়েছিল জাপান কতদূর এগিয়েছে। বহুবছর এধরনের জাহাজ বানাবার চর্চা না থাকলেও এই জ্ঞান একেবারে গিলে ফেলার নয়।

৯০ বছরের ইতিহাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিরা আমেরিকা এবং তার মিত্রদের কাছে হেরে গিয়েছিল। যুদ্ধের আগেই অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল যে আমেরিকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পাওয়ারকে জাপানের পক্ষে টেক্কা দেওয়া সম্ভব ছিল কিনা। জাপানি নৌবাহিনী প্রধান ইসোরোকু ইয়ামামোতো নিজেই বিশ্বাস করেননি যে জাপান আমেরিকাকে যুদ্ধে হারাতে পারবে। তবু সেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার আগে জাপান তাদের জ্ঞান-বুদ্ধির ক্ষেত্রে একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যেটার উপরে ভর করেই তারা সাহস পেয়েছিল আমেরিকার মতো সম্পদশালী দেশের বিরূদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার। সম্পদের ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলেও সেসময় জ্ঞান-বুদ্ধিতে জাপানিরা আমেরিকা থেকে খুব বেশি একটা পিছিয়ে ছিল বললে ভুল হবে। জাপানি রাজকীয় নৌবহরের প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'আইজেএন হোশো' অপারেশনে আসে ১৯২২ সালে। মার্কিন প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ইউএসএস ল্যাংলি' সার্ভিসে আসে ১৯২০ সালে। ১৯১২ সালে ল্যাংলি তৈরি হয়েছিল কয়লাবাহী জাহাজ হিসেবে; পরে সেটাকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজে রূপ দেওয়া হয়। অন্যদিকে হোসো প্রথম থেকেই ডিজাইন করা হয়েছিল বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ হিসেবে। ব্রিটিশদের প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'এইচএমএস আর্গাস' অপারেশনাল হয়েছিল ১৯১৮ সালে। সেসময় এ ধরনের জাহাজ ছিল এই দেশগুলির জ্ঞান-বুদ্ধির শিখরের প্রমাণ। ব্যাপারটা আজও তাই। প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের একটা পর্যায়ে পৌঁছাতে না পারলে এধরনের জাহাজ তৈরির চিন্তা করাটাই কঠিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রমাণ করেছিল যে এধরনের জাহাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রদর্শনে কতটা অপরিহার্য। আর একারণেই যুদ্ধে হেরে যাবার পরে জাপানিদের এধরনের জাহাজ বানানোর ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমেরিকানরা জাপানিদের সংবিধান তৈরি করে দিয়েছিল এই ব্যাপারগুলিকে মাথায় রেখেই। তারা জানতো যে জ্ঞান-বুদ্ধিতে জাপান এমন একটা পর্যায়ে উঠে গেছে যে আটকে রাখা না হলে খুব শিগগিরই জাপানি ডকইয়ার্ডগুলি আবারো বিমানবাহী জাহাজ তৈরি শুরু করবে। জাপানিরা আরেকটা যুদ্ধ চায়নি বলেই আমেরিকানদের তৈরি করা সংবিধান মেনে চলেছে এতকাল।

জাপানি নৌবহরের ১৪,০০টনের 'ওসুমি-ক্লাস'-এর এই জাহাজগুলি প্রথম জানান দেয় জাপানের 'যুদ্ধ-বিরোধী' সংবিধানের অবাস্তবতার
সাংবিধানিক পরিবর্তন

সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে জাপান তাদের প্রতিরক্ষার জন্যে আমেরিকার উপরেই নির্ভর করেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন সেনা, নৌ, বিমান ও ম্যারিন বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি জাপানেই। শীতল যুদ্ধের পর থেকে আমেরিকানরা পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে - প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে - বেশি ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় জাপান থেকে তাদের সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগটাই সরিয়ে নিয়েছে; এখনো নিচ্ছে। তারা পরিবর্তিত বিশ্বে জাপানকে তাদের নিরাপত্তার অংশীদার মেনে নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানকে আরও বেশি সক্রিয় হবার পেছনে মত দিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপাখ্যান ভুলে তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাপানকে আরও বেশি অগ্রগামী ভূমিকা নিতে বলছে। শীতল যুদ্ধের পর থেকে এই অঞ্চলে মার্কিন নীতিতে চীনের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় জাপানের সাহায্য মার্কিনীদের জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আর সারা বিশ্বে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত সম্পদের উপরে যে চাপ পড়েছে, সেটা কমিয়ে কমিয়ে আনতেও জাপানের সক্রিয় হাত দেখতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সক্রিয়তার অংশ হিসেবে জাপান তাদের 'প্যাসিফিস্ট' সংবিধানে পরিবর্তন আনতে পিছপা হচ্ছে না। এই পরিবর্তন কারো কারো কাছে দরকারী মনে হলেও প্রতিবেশী চীন এবং কোরিয়াকে তাদের বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত মনে করিয়ে দিচ্ছে।

১৯,০০০টনের ‘হাইয়ূগা-ক্লাস’-এর দু’টি জাহাজ তৈরি করার সময় অনেকেই আওয়াজ তুলেছিলেন, কিন্তু জাপানি নৌবাহিনী কথার মারপ্যাঁচে বেরিয়ে গিয়েছে আবারো

চুপি চুপি যা হয়েছে

সংবিধানের পরিবর্তন তো মাত্র হলো। এর আগের কিছু ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়। যে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের কথা দিয়ে আলোচনার শুরু, সেই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজেই ফেরত যাচ্ছি। এই ধরনের জাহাজ একটা 'এগ্রেসিভ প্ল্যাটফর্ম' হিসেবে পরিচিত। সাধারণত দূরদেশে যুদ্ধ করার দরকার হয় যাদের, তাদেরই এধরনের জাহাজের প্রয়োজন বেশি। তার মানে হলো, যাদের আন্তর্জাতিক নীতি যতটা এগ্রেসিভ, বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের প্রয়োজনীয়তাও তাদের কাছে বেশি। পাওয়ার প্রজেকশনের এটা মোক্ষম অস্ত্র। এক্ষেত্রে অর্থনীতি অবশ্য বড় একটা ভূমিকা রাখে, কারণ এই ধরনের জাহাজ যথেষ্ট দামী। আর এগুলিকে অপারেট করার বার্ষিক খরচও অনেক অর্থনীতির ধরাছোঁয়ার বাইরে। ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ এবং ইটালিয়ানরা ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনীর মালিক। পররাষ্ট্র নীতির কারণেই এই দেশগুলি আগের চাইতে বেশি ঝুঁকছে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের দিকে। এই ধরনের জাহাজের বেশ কাছাকাছি কিছু জাহাজ রয়েছে উভচর অভিযান চালাবার জন্যে, যেই জাহাজগুলি দেখতে অনেক ক্ষেত্রেই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো, যদিও বাস্তবে সেটা নয়। তবে যেটা বাস্তব তা হলো এই জাহাজগুলি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতোই এগ্রেসিভ প্ল্যাটফর্ম। এর আগে একটা পোস্টে এই জাহাজগুলি নিয়ে লিখেছিলাম, তাই এখানে সেগুলি নিয়ে লিখছি না। তবে জাপানের কথা হচ্ছে বিধায় কথা না বলেও পারছি না। সংবিধানকে পাশ কাটিয়েই জাপান ১৯৯৫ সাল থেকে নৌবাহিনীর জন্যে কিছু জাহাজ বানিয়েছে; যেমন - ১৪,০০০ টনের ‘ওসুমি-ক্লাস’-এর ‘ল্যান্ডিং ট্র্যান্সপোর্ট ডক'। এই ক্লাসের তিনটি জাহাজ বানাবার পরে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল,কারণ জাহাজগুলি দেখতে ছোটখাটো বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো। জাপান তখন বলেছিল যে এগুলি ‘ল্যান্ডিং শিপ ট্যাঙ্ক’;জাপান থেকে দূরে ব্যবহারের জন্য নয়। এরপরে ২০০৬ সালে বানানো শুরু করে ১৯,০০০টনের ‘হাইয়ূগা-ক্লাস’-এর দু’টি জাহাজ;যেগুলিও বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো। এরপরে ২০১২ সালে শুরু হয়েছে ২৭,০০০টনের ‘ইজুমো-ক্লাস’-এর দু’টি জাহাজের কাজ। আগে বানানো যেকোন জাহাজের চাইতে এগুলি অনেক অনেক বড়! এবারেও জাপানি নৌবাহিনীর ওই একই কথা - এগুলি আসলে 'হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার'। এরই মাঝে জাপানি নৌবহরে যুক্ত হয়েছে ১৫,০০০টনের ৩টি ও ২৫,০০০টনের দু’টি সরবরাহ বা সাপ্লাই জাহাজ। উপরে বর্ণিত এত্ত বড় বড় জাহাজের বিতর্কের গভীরে এই সাপ্লাই জাহজগুলি হারিয়েই গেছে। খুব কম লোকই প্রশ্ন করেছে যে এই জাহাজগুলি কি বানানো হয়েছে জাপানের উপকূল প্রহরায় সহায়তা দিতে,নাকি ভারত মহাসাগর পর্যন্ত পাহারা দিতে? এই সাপ্লাই জাহাজগুলি জাপানি নৌবাহিনীর পা অনেক লম্বা করে দিয়েছে। অনেকেই বলবে যে জাপানের সম্পূর্ণ বাণিজ্য সমুদ্র-নির্ভর; কাজেই নৌবাহিনীর দূর দেশে যেতে হতেই পারে - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপান ঠিক যে কথাগুলি ব্যবহার করেছিল নিজেদের নৌশক্তি বৃদ্ধির সময়। চীন যেমন তার তেলের জন্যে এবং অনেক বাণিজ্যের জন্যে মালাক্কা প্রণালী এবং ভারত মহাসাগরীয় সমুদ্রপথের উপরে নির্ভরশীল, ঠিক তেমনি জাপানিরাও একই সমুদ্রপথের উপরে নির্ভরশীল। আর দু'টি দেশের মাঝে সম্পর্ক আজকাল তেমন মধুর যাচ্ছে না। চীনা নৌবাহিনী আজকের আলোচনার অংশ নয়, তাই এখানে চীন নিয়ে বেশি কিছু লিখলাম না। তবে এটা বলতে বাধা নেই যে চীনারাও মালাক্কা প্রণালীর বদলি কোন সাপ্লাই রুট খুঁজতে খুঁজতে ভারত মহাসাগর তথা বঙ্গোপসাগরের দিকেই তাকাচ্ছে। কাজেই দু'টি দেশের জাতীয় নিরাপত্তাই তাদেরকে হাজির করছে ভারত মহাসাগরে। চীনের জন্যে এটা নতুন হলেও জাপানের জন্যে কিন্তু নতুন নয়।
০৯ এপ্রিল ১৯৪২ঃ জাপানি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের বিমান ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস হার্মিস-এর উপরে বিমান হামলার পর ডুবে যাচ্ছে হার্মিস। এই জায়গাটা শ্রীলংকার কাছাকাছি।


অতীতেও যুদ্ধ দেখেছে ভারত মহাসাগর

১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে জাপানী নৌবহরের সবচাইতে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের বহর ভারত মহাসাগরে ব্রিটিশ নৌবহরের খোঁজে ঢুঁ মেরে যায়। মাত্র কয়েক দিনের এই ভিজিটে ছয়টি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের এই নৌবহর শ্রীলঙ্কার কলম্বো এবং ত্রিঙ্কোমালীসহ বঙ্গোপসাগরের আশেপাশে হামলা চালায়। ব্রিটিশদের একটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজসহ ৮টি যুদ্ধজাহাজ ও ২৩টি বাণিজ্য জাহাজ এই হামলায় ডুবে যায়; ধ্বংস হয় ৪০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান। এখানে বলা গুরুত্বপূর্ণ যে জাপানিদের এই নৌবহর এসেছিল সদ্য অধিকৃত ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) থেকে, সরাসরি জাপান থেকে নয়। মানে এখানে সাপ্লাই ঘাঁটি হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে জাপানিরা ব্যবহার করেছিল। যুদ্ধের বাকি সময়ে আর কোন শক্তিশালী জাপানি নৌবহর এই দিকে আসেনি ঠিকই কিন্তু জাপানি সাবমেরিনগুলি পুরো ভারত মহাসাগরেই বিচরণ করেছে এবং অনেক জাহাজ ডুবিয়েছে। এই ঘাঁটিগুলি না থাকলে ভারত মহাসাগরে অভিযান চালানো জাপানিদের জন্যে কঠিন হতো। এখানেই নৌবাহিনী 'পা লম্বা' করার কথাটা এসে যাচ্ছে, যেটা উপরে উল্লেখ করেছিলাম। সাপ্লাই জাহাজের সহায়তায় কোন ঘাঁটি ছাড়াই ভারত মহাসাগরে অনেকদূর পর্যন্ত টহল দেওয়া সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত মহাসাগরে জাপানি নৌবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট - ব্রিটিশ সমুদ্রপথের ক্ষতিসাধন করা, যেটা মূলত জাপানি সাবমেরিনগুলি করার চেষ্টা করেছে। জাপানের তেল, লোহা, এলুমিনিয়াম, রাবার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই যেত প্রধানত মালেশিয়া-ইন্দোনেশিয়া এলাকা থেকে। তাই ভারত মহাসাগর তাদের জন্যে ছিল অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজকের কথা চিন্তা করলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। জাপান এবং চীন উভয়েরই বেশিরভাগ তেল আসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। কাজেই বর্তমানে উভয়েই এই এলাকার উপরে ভীষণভাবে নির্ভরশীল। কাজেই এই দুই দেশের এই এলাকায় এসে প্রতিদ্বন্দিতামূলক অবস্থানে আসার চিন্তা করাটা অমূলক হবে না।

২৭,০০০টনের 'ইজুমো-ক্লাস'-এর দু'টি জাহাজ তৈরি হচ্ছে। অনেকেই অনেক কিছুর গন্ধ পাচ্ছেন। কিন্তু প্যাসিফিস্ট সংবিধান আর নেই। কাজেই এখন কোন কিছুরই ছুতো নেই আর।

সমুদ্রপথের ঝুঁকি ও নিরাপত্তা

উপরে জাপানি নৌবাহিনীর বর্তমান কয়েকটি জাহাজের কথা বলেছি যেগুলি অনেককে ভাবাচ্ছে। কিন্তু কেন ভাবাচ্ছে, সেটাও বোঝার ব্যাপার রয়েছে। এই জাহাজগুলি কিন্তু বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ নয়; এগুলির কোনটি থেকেই ফিক্সড উইং বিমান ওঠানামা করতে পারবে না; শুধু হেলিকপ্টার ওঠানামা করবে। তাহলে কেন চিন্তিত সবাই? কারণ এই জাহাজগুলি একে একে সবার ধৈর্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। ২৭,০০০টনের 'ইজুমো-ক্লাস' জাহাজগুলি তারা একবারে তৈরি করেনি; ধীরে ধীরে জাহাজের আকার বাড়িয়েছে। প্রতিবারেই কথা উঠেছে; আর প্রতিবারেই কথার মারপ্যাঁচে জাপানিরা বের হয়েছে সেখান থেকে। এভাবে গুটি গুটি পায়ে এগুনোর পুরোটাই হয়েছে জাপানের প্যাসিফিস্ট সংবিধান বহাল থাকা অবস্থায়। আর সাম্প্রতিক সময়ের সাংবিধানিক পরিবর্তন এ অবস্থায় কতটা প্রভাব ফেলে সেটাই দেখার বিষয়। জাপানি নৌবহর পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী নৌবহরের একটি। চারটা বিরাট 'হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার' ও তিনটা 'ডক ল্যান্ডিং শিপ' ছাড়াও তাদের ডেস্ট্রয়ার এবং ফ্রিগেট রয়েছে ৪৩টি। এই বহর কতটা বড়, সেটার ধারণা দিচ্ছি অন্য নৌবহরের আকৃতির ধারণা দিয়ে - ব্রিটিশ রয়েল নেভির ডেস্ট্রয়ার এবং ফ্রিগেট রয়েছে ১৯টি, ফ্রান্সের রয়েছে ২১টি, স্পেনের রয়েছে ১১টি, ইটালির রয়েছে ১৫টি। আর এই এলাকার কাছাকাছি চীনের রয়েছে কমপক্ষে ৬৫টি, কোরিয়ার ২২টি, আর ভারতের রয়েছে ২৪টি। ডেস্ট্রয়ার এবং ফ্রিগেট হচ্ছে এই যুগে সমুদ্রে কর্তৃত্ব করার প্রধান অস্ত্র। এগুলিকে সাহায্য করার জন্যে ছোট ফ্রিগেট বা কর্ভেটেরও গুরুত্ব থাকে। এগুলি সমুদ্রপথ পাহাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে এসকর্ট করা পর্যন্ত সকল কার্যক্রমে জড়িত থাকে; একেবারে ওয়ার্কহর্স যাকে বলে আরকি। যার সমুদ্রপথ যত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে, সে এই ধরনের জাহাজ তত বেশি রাখতে চাইবে - এটাই স্বাভাবিক। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে কে নিজের সমুদ্রপথকে ভবিষ্যতে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে, সেটাই দেখার ব্যাপার হচ্ছে।

২৫,০০০টনের 'মাশু-ক্লাস'-এর এই সাপ্লাই জাহাজগুলি জাপানি নৌবহরের পা অনেক লম্বা করবে।

এখানেই জ্ঞান-বুদ্ধি

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সে কথা দিয়েই শেষ করবো। জ্ঞান-বুদ্ধির ক্ষেত্রে একটা পর্যায়ে জাপান পৌঁছে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই। সেখান থেকে অনেক কিছুই শিক্ষা নিয়েছে তারা। আমরা এখনও প্যাসিফিস্ট জাপানের চেহারাটাই দেখতে বেশি ভালোবাসি। তাই বিশ্বযুদ্ধের শিক্ষা বলতে আমরা হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসস্তূপকেই মনে করি। স্ট্র্যাটেজিক শিক্ষা নিয়ে কোন চিন্তাই আমাদের মনে আসে না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এই যে আমাদেরকে কোন চিন্তা না দিয়েই জাপান পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী নৌবহরের একটি তৈরি করেছে। এই বহর তৈরি করতে অর্থনৈতিকভাবেও তাদেরকে তেমন বেগ পেতে হয়নি; সামরিক ক্ষেত্রে জিডিপি-এর মাত্র ১% খরচ করছে জাপান। ভারত করছে ২.৫%; কোরিয়া ২.৮%। জাপান আগামীকালই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে না পারলেও তারা চাইলে সেটা তুলনামূলকভাবে অল্প সময়েই অর্জন করতে পারবে। হাজার হোক, ৯২ বছর আগে যারা এই ধরনের জাহাজ তৈরি করেছে, তাদের জন্যে খুব বেশি কষ্ট হবার কথা নয়। এখানেই সেই জ্ঞান-বুদ্ধির কথা আসছে। নতুন করে খুব কম জিনিসই তাদের উদ্ভাবন করতে হবে। আর বিমানবাহী জাহাজের কাছাকাছি গোছের কিছু জাহাজ বানিয়ে ফেলে অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও তারা ঘাটতি কমিয়ে এনেছে। এখন শুধু গুরুত্ব বুঝে এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো।

তবে এগুলির মানে এই নয় যে আগামীকালই আমরা যুদ্ধ দেখতে শুরু করবো। বরং আরও একটা স্নায়ু যুদ্ধের আবির্ভাব হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যেখানে ফোকাল পয়েন্ট হবে ভারত মহাসাগর। চীনের সাথে সাথে 'রাইজিং সান'-কে ভারত মহাসাগরে আবির্ভূত হতে দেখলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। অর্থনৈতিকভাবে চীন এবং জাপান যেভাবে দক্ষিণ এশিয়াতে প্রতিযোগিতাতে লিপ্ত হয়েছে, তাতে স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে গরম এই এলাকার তাপমাত্রা আরও কয়েক ডিগ্রী বেড়ে গেছে। সকলেই অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেই ফুল স্টপ দিয়ে দিচ্ছেন। তাপমাত্রা বাড়লে সেখানে যে পেশী শক্তির আবির্ভাব শুরুর সম্ভাবনাও তৈরি হয়, সেটা অনেকেই মাথায় রাখেননি। হয়তো জাপানের বহু যুগের প্যাসিফিস্ট চিন্তাধারা তাদের চিন্তাকে মুহূর্তেই ঠান্ডা করে দিচ্ছে। তবে সেই ঠান্ডা চিন্তা থেকে বের হবার সময় এখনই।

রাইজিং সান ওভার দ্যা ইন্ডিয়ান ওশান; ফারেনহাইট রাইজিং!

Friday 12 December 2014

সুন্দরবনের তেলে সন্বিত ফিরবে আমাদের?

১২ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র হুমকির মুখে ফেলেও যদি আমাদের সন্বিত ফেরে আরকি




মাত্র কিছুদিন আগেই গত অগাস্টে মাওয়ার কাছে পিনাক-৬ লঞ্চডুবির সময় একটা ইমার্জেন্সিডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির কথা বলেছিলাম। এরপরে আবার অক্টোবর মাসে ঢাকা কারওয়ান বাজার বাণিজ্যিক এলাকার বিএসইসি ভবনে দ্বিতীয়বারের মতো আগুন লাগলো মনে করিয়ে দিল সেই একই কথা। কিন্তু এই একই কথা কতবার মনে করিয়ে যেতে হবে, সেটাই এখন প্রশ্ন। ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট যে একটা আলাদা কাজ, সেটাই এখনো আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। ঠিক এই কারণেই রিসোর্স জোগার করতে করতেই আমাদের মূল্যবান সময় অপচয় হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো এভাবে ঝরে যাচ্ছে নিষ্পাপ প্রাণ, কখনো বা ধংস হয়ে যাচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যতা। সুন্দরবনের তেলবাহী জাহাজের দুর্ঘটনা আমাদের বহুকাল চোখে ঠুলি পড়ে থাকার ফলাফল মাত্র।

গোপালগঞ্জের ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র, যার জন্যে ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সুন্দরবনের মাঝ দিয়ে। গ্যাসের অপ্রতুলতায় বিদ্যুত উতপাদনে ফার্নেস অয়েলের উপরে নির্ভরতা বাড়ছে। আর একই সাথে বাড়ছে নদীপথ এবং পরিবেশের উপরে হুমকি।


তেল কাহিনী

ফার্নেস অয়েল বা হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও) হলো অপরিশোধিত তেল শোধন করার পরে প্রাপ্ত অনেকগুলি তেলের মধ্যে একটি। রিফাইনারিতে অপরিশোধিত তেল প্রসেস করলে সবচেয়ে হাল্কা তেলগুলি প্রথমে একে একে আলাদা হয়ে যায় - যেমন কেরোসিন, পেট্রোল, ডিজেল। ঘনত্বের হিসাবে এগুলিকে ১ নম্বর থেকে ৬ নম্বর তেল পর্যন্ত ক্লাসিফাই করা হয়, যেখানে ১ নম্বর হলো সবচাইতে হাল্কা আর ৬ নম্বর হলো সবচাইতে ভারি। ফার্নেস অয়েল হচ্ছে ৬ নম্বর তেল, যেটা একেবারে গাদের মতো। এটার নিচে থাকে শুধু আলকাতরা। প্রথম দিকের তেলগুলি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দিলেও আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে যায়। আর অন্যদিকে ৬ নম্বর তেল গরম না করলে পাইপের মধ্যে দিয়ে নেওয়াই যায় না। এসব কারণে উপরের দিকের তেলগুলি ছোট যানবাহনে ব্যবহার করা গেলেও নিচের দিকের তেলগুলি তাপ দেওয়া ছাড়া যেহেতু ব্যবহার করা যায় না, তাই সেগুলি শুধুমাত্র বড় ইঞ্জিনের জন্যে প্রযোজ্য - যেমন পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং বড় জাহাজ। এই তেলে অত্যন্ত ক্ষতিকর সালফারের পরিমাণ অনেক বেশি। সালফার বেশি থাকার কারণে একে হাই সালফার ফুয়েল অয়েলও (এইচএসএফও) বলে। আর ব্যবহারের ক্ষেত্র কম হওয়ার কারণে এই তেলের দামও কম। কিছুদিন আগেই বিপিসি ২০১৫ সালের জন্য বিদেশ থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানির চুক্তি করেছে, যেখানে অপেক্ষাকৃত কম সালফারের লো সালফার ফুয়েল অয়েলের আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনে ডুবে যাওয়া জাহাজটিতে ছিল হাই সালফার ফুয়েল অয়েল, যা এটা নিয়ে যাচ্ছিল গোপালগঞ্জের পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্যে। মংলা বন্দরে যেসব সমুদ্রগামী জাহাজ ভিড়ছে, সেগুলিও কিন্তু এই ফার্নেস অয়েলেই চলে। জাহাজের ভিতরে একেবারে তলায় পড়ে থাকে বলে এই তেলকে বাংকার তেলও বলে। একেকটি জাহাজে শুধুমাত্র নিজের চলার জন্যেই এরকম প্রচুর পরিমাণ তেল থাকে। কাজেই এই ধরনের দুর্ঘটনা বারে বারে ঘটার সম্ভাবনা কেউই উড়িয়ে দিতে পারবে না। কিছুদিন আগেও আরও একটি জাহাজ দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল; কিন্তু সেটা সিমেন্ট ক্লিংকারবাহী হবার কারণে পরিবেশের উপরে সেটার প্রভাব কম। কিন্তু বিদ্যুত উতপাদনের গুরুত্ব বাড়ার সাথে সাথে জ্বালানি তেলের গুরুত্বও যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে তেলবাহী জাহাজের দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। গ্যাসের রিজার্ভ কমে যাবার কারণে তেল-পুড়ানো পাওয়ার প্ল্যান্টের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। গাদের মতো এই ফার্নেস অয়েল জাহাজ ছাড়া পরিবহণ খুবই দুরূহ। কাজেই অচিরেই জাহাজের সংখ্যা কমানোর কোন পদ্ধতি দেখি না। এটা মোটামুটি ঠিক যে আমরা আমাদের ভাগ্যের উপরেই চড়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমরা শুধু দোয়া করছিলাম যেন বড় কোন দুর্ঘটনা না হয়। কিন্তু এভাবে আমরা নিজেদের কদিন বাঁচাতে পারি, সেটার উত্তর আজ আমরা পেয়ে গেছি।

সুন্দরবনের মাঝ থেকে এই ২৩-তলা সমান উঁচু সাইলো বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। এই স্থাপনা এখানে জন্ম দেবে নতুন কর্মযজ্ঞের। এই স্থাপনা সুন্দরবনের কফিনে শেষ পেরেকগুলির মধ্যে একটি।


পসুর নদী - আর. আই. পি.

দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান শহর খুলনা এবং যশোর তৈরি হবার পিছনে সুন্দরবনের পসুর নদীর উপরে সমুদ্রবন্দরের গুরুত্বই সবচাইতে বেশি। সমুদ্রবন্দরের স্থান নাব্যতার কারণে বারে বারে পরিবর্তন হলেও সেটা পসুর নদীর উপরেই রয়েছে। এই নদীটা সুন্দরবনকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। প্রতিদিন এখানে জাহাজ আসছে মালামাল নিয়ে। এই বন্দরের উপরে নির্ভর করেই এখানে গড়ে উঠেছে কয়েকটি সিমেন্ট কারখানা। পসুর নদীতে যত জাহাজ চলে, তার সবচাইতে বেশি হলো ক্লিংকারবাহী জাহাজ। মংলার উত্তরে এই একই নদীর উপরে রামপালে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র এখানে কয়লাবাহী জাহাজের আনাগোনার সূচনা করবে। প্রতিদিন ১০,০০০ টন কয়লার যোগান দিতে কি-রকম সংখ্যক জাহাজের এই নদী ব্যবহার করতে হবে, তা সহজেই অনুমেয়। মংলা বন্দরের সাথেই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) তৈরি করছে ১ লক্ষ টন ক্ষমতার ফুয়েল ডিপো। খুলনায় তৈরি হচ্ছে নতুন তেলভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট। এগুলি তেলবাহী জাহাজের আসাযাওয়া আরও বাড়াবে। এখন পর্যন্ত মংলায় তৈরি হয়েছে তিনটি এলপিজি বটলিং প্ল্যান্ট; আরও তৈরি হতে যাচ্ছে। খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে রেলপথ, যা কর্মযজ্ঞ বাড়াবে বৈ কমাবে না। মংলা বন্দরের উপরে নির্ভরশীল তিনটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা বা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড) - সৈয়দপুর, ঈশ্বরদী এবং মংলা। এগুলির ব্যবসার পরিধি বাড়ছে; তাই বাড়ছে কনটেইনার জাহাজের সংখ্যা। বড় কনটেইনার জাহাজ বন্দরের জেটিতে আনার জন্যে করা হচ্ছে ড্রেজিং। সরকারের সিদ্ধান্তে মংলা বন্দর দিয়ে খাদ্য আমদানীর একটা বড় অংশ এখন আসছে। কাজেই বেড়েছে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজের সংখ্যা। মংলা বন্দরের ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে জয়মনিরখোল এলাকা হলো অফিশিয়ালি সুন্দরবনের বাউন্ডারি। এখানেই শেলা নদী মুখ, যার দক্ষিণ পাড়ে গহীন বন আর উত্তর পাড়ে তৈরি হচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তরের ৫০,০০০ টন ধারণক্ষমতার বিশাল অত্যাধুনিক সাইলো (খাদ্য গুদাম)। মংলা থেকে জয়মনিরখোল পর্যন্ত কিছুই ছিল না; রাস্তার অবস্থা ছিল করুন; নদী-খালের উপরে ছিল না সেতু। এই সাইলো নির্মাণের কারণে এখানে বিদ্যুত লাইন বসানো ছাড়াও তৈরি হচ্ছে রাস্তা এবং সেতু। এই অবকাঠামো এখানে জন্ম দেবে নতুন কর্মযজ্ঞের। এখানকার প্রায় পুরো এলাকাতেই এখন সাইন বোর্ডের বন্যা। এখানে খুলনা শিপইয়ার্ড-এর দ্বিতীয় ইউনিটসহ একাধিক জাহাজ নির্মাণ শিল্প বসার কথা রয়েছে। মোটকথা, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে শুরু করে জয়মনিরখোল পর্যন্ত পুরো এলাকাটাই খুব দ্রুত শিল্পাঞ্চলে রূপ নিতে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা সুন্দরবন রক্ষায় পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে গেছি প্রায়। কাজেই সুন্দরবন রক্ষায় যা চোখের পানি ফেলার, তা এখনি ফেলে নেওয়া ভালো হবে। 

ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষত্র পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দরকে মংলার প্রতিদ্বন্দী হিসেবে তৈরি করে দিতে পারতো, এবং একই সাথে সুন্দরবনকে বাঁচার একটা সুযোগ করে দিতে পারতো, যদি আমাদের পলিসিমেকাররা বরিশাল-পটুয়াখালী এলাকাকে খুলনা-যশোরের সাথে ব্যালান্স করার কথা চিন্তা করতে পারতেন।


পায়রা বন্দর - সুন্দরবনের রক্ষাকর্তা হতে পারে কি?

চেষ্টা করলে হয়তো রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র, খাদ্য অধিদপ্তরের সাইলো আর বিপিসি-র ফুয়েল ডিপো পায়রা সমুদ্রবন্দরের পাশে করা যেতে পারতো। এই কয়েকটি স্থাপনা মংলা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্যকে পায়রায় স্থানান্তর করতো। সরকারী সিদ্ধান্ত খুব সহজেই জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে পসুর নদী থেকে সরিয়ে বরিশাল-পটুয়াখালী এলাকায় নিয়ে আসতে সক্ষম। এক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন সহ যেসব জটিলতা তৈরি হতো, তা হয়তো সদিচ্ছা থাকলে উতড়ানো সম্ভবও হতো। ভোলার শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্র এবং নির্মাণাধীন বিদ্যুত কেন্দ্র যথেষ্ট সাহায্য করতো এক্ষেত্রে। পটুয়াখালীতে চীনের সহায়তায় তৈরি হচ্ছে আরও একটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র। কয়েক বছরের মাঝে পদ্মা সেতু তৈরি হইয়ে গেলে সেটা পায়রার জন্যে তৈরি করতো আরও সুযোগের। এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি দাঁড়াতো - মংলা এবং পায়রা বন্দরের ব্যালান্স নিয়ে। একটির উত্থান অপরটির অবনতি ডেকে আনতো। বরিশাল-পটুয়াখালীকে প্রাধান্য দিতে হতো খুলনা-যশোরের উপর। সেই সিদ্ধান্তের জন্যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা কতটুকু প্রস্তুত ছিলেন, সেটা চিন্তা করার বিষয়। সুন্দরবনকে রক্ষা করাটা আমাদের পলিসিমেকারদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মাঝে পড়ে বলে মনে হয়নি কখনো। পায়রাকে নিয়ে এগুনো গেলে পসুরকে পুরোপুরি রক্ষা হয়তো করা যাবে না; তবে স্যালাইন দিয়ে কিছুদিন বেশি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলেও হতে পারে।

বিএসইসি ভবনে আবারো আগুন লাগে অক্টোবর ২০১৪। ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে আমাদের শিক্ষা পুরো হয়েছে কি?


দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলতে কি শুধু বন্যা-জলোচ্ছ্বাস বোঝায়?

শুরুতেই বলছিলাম ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট-এর কথা। আমাদের দেশে দুর্যোগের সংজ্ঞা যে খুব ছোট, সেটা সুন্দরবনে জাহাজডুবির পরে সেখানে বিআইডব্লিউটিএ-এর কর্মকর্তাদের অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে দেখেই বোঝা গেছে। ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট বলতে এখনো বন্যা-ঝড়ের মাঝেই আমরা আটকে আছি। মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ যে একেবারে কম ভয়াবহ নয়, সেটা আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হবার কারণে আমরা সেইদিকেই চোখ রেখেছি সর্বদা। আর অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার কারণে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের সম্ভাবনাও অপেক্ষাকৃত কম ছিল। তবে গত দুই দশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে দ্রুত অগ্রগতির সাথে সাথে যেসব ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলির জন্যে আমরা নিজেদের তৈরি করতে পারিনি। নদীতে জাহাজের সংখ্যা আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গেছে, কিন্তু তার সাথে পাল্লা দিয়ে তৈরি হয়নি মনিটরিং এজেন্সিগুলি। জাহাজ তৈরি হচ্ছে যথেচ্ছভাবে, যাত্রী নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত, ফিটনেসবিহীন জাহাজ চলছে, নদীর পানি দূষণ করছে জাহাজের বর্জ্য, নদীর মাঝে পার্ক করে রাখা হচ্ছে জাহাজ, সঠিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই চলছে জাহাজ, চলাচলের সময় ঠিক করে দেয়ার পরেও কেউ মানছেনা কেউ দেখার নেই। কাজেই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। আর দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়লেও সেটার জন্যে প্রস্তুতি নেই আমাদের। এটা ঘটলে এদের দায়িত্ব; ওটা ঘটলে ওদের দায়িত্ব - এগুলি ছেড়ে দায়িত্ব একজনকেই দিতে হবে। তাকে দিতে হবে পলিসি এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাকআপ। দুর্যোগের সময় ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সিকে ক্ষমতা দিতে হবে অন্য যেকোন রিসোর্স ব্যবহার করতে পারার। বিদ্যুত উতপাদন ও সঞ্চালন, গ্যাস সঞ্চালন, পানি সরবরাহ, সড়ক, রেল এবং নদীপথের গুরুত্বপূর্ণ রুট, স্টেশন ও সেতু, বন্দর ব্যবস্থাপনা, টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ ও সাইবার সিকিউরিটি, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও স্ট্র্যাটেজিক স্থাপনা, পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান, প্রধান পর্যটন কেন্দ্র - এগুলি সবকিছুই ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই, আবার ডিসাসটার ম্যানেজমেন্টের চিন্তার ভেতরেও আনতে হবে। এর যেকোনটির ক্ষতিই দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। আর এই হুমকি যে কারুর কাছ থেকেই আসতে পারে- সেটা দেশের ভেতরেও হতে পারে, এমনকি বাইরেও হতে পারে। কাজেই এগুলিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। 

দেশের প্রতিটি স্থাপনা এখন টাকার অঙ্কে অনেক মূল্যবান। দেশের প্রতিটি মানুষের মূল্য অনেক বেশি; এখন আমরা আর ফকিরের দেশ নই - একেকটা মানুষ দেশের অর্থনীতিতে তাদের জীবদ্দশায় অনেক অবদান রাখে। একেকটি মানুষ একেকটি জীবন্ত কারখানা। এদের প্রত্যেকের অবদানের উপরেই দেশের অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত। কাজেই তাদের জীবনের মূল্য যেমন দিতে হবে, তেমনি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনারই নিরাপত্তা দিতে হবে। তৈরি রাখতে হবে ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সিকে, যাতে যেকোন দুর্যোগ সবচাইতে দ্রুততার সাথে মোকাবিলা করা যায়; মানুষের জানমালের সর্বনিম্ন ক্ষতির মাঝেই যেন দুর্যোগ ম্যানেজ করা যায়। আর বেঁচে থাকার পরিবেশ না থাকলে বেঁচে থাকারি বা মানে কি? আস্তাকুঁড়ে বসবাসের কোন মানে হয় না। অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে আমরা পরিবেশের দিকে না তাকালে অচিরেই এদেশ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অব্যবহার্য হয়ে পড়বে। আর সেটার জন্যে দায়ী থাকবো আমরাই। নিজেদের সন্তানদের বিদেশ পাঠিয়ে দায়মুক্তির চাইতে বরং আমাদের ভাবা উচিত সন্তানদের এই দেশে বসবাসের জন্যে নিজেদের দায়িত্বটুকু কিভাবে আমরা পালন করতে পারি।

Saturday 8 November 2014

ব্লু ইকনমি ও আমাদের হারাতে বসা নদীমাতৃকতা

০৮ নভেম্বর ২০১৪


নদীমাতৃক বাংলাদেশ বলা হলেও সেই নদীমাতৃকতার কতটুকু আজ অবশিষ্ট আছে, সেটা সত্যিই হিসেব কষে দেখতে হবে। এই দেশের শতশত নদ-নদীর বহুবিধ অবদানের কথা অস্বীকার করে আমরা এখন প্রায় কাদা বা ধূলা-মাতৃক দেশে রূপান্তরিত হয়েছি। এদেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনে নদ-নদীর যথেষ্ট প্রভাব ছিল বলেই আমরা নিজেদের নদীমাতৃক দেশ বলতে পেরেছি বহুকাল (এখনও বলি অবশ্য)। শুধুমাত্র অনেক নদী থাকার জন্যেই নয়; নদীর গুরুত্বকে অন্তরের মাঝে অনুভব করতে পারার কারণেই আমরা নিজেদের নদীমাতৃক বলেছি। এখানে 'মাতৃ' বা 'মাতা' বলে কথা। আত্মিক বন্ধন না থাকলে তো মাতা হতে পারে না। আমি উপড়ে যে প্রশ্নটি উত্থাপন করেছি আমাদের নদীমাতৃকতা নিয়ে, সেটার উতপত্তি এই মাতৃত্বের আত্মিকতার অভাববোধ থেকেই। এখন আর নদীর আর্তনাদ আমাদের কাঁদায় না; সুখের সাথী হিসেবে নদীকে পাই না কাছে। শুধু কষ্টের কারণ হিসেবেই নদী আমাদের সামনে অবির্ভূত হচ্ছে প্রতি নিয়ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় আমরা নদীর সাথে আমাদের আত্মিক বন্ধন ফিরে পাবার চেষ্টা করলে সেটা কি পাগলের প্রলাপ হবে? মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা ঠিক হয়ে যাবার পর থেকে যেই "সমুদ্র অর্থনীতি" বা "ব্লু ইকনমি"-এর কথা বলা হচ্ছে, সেটার সাথে আমাদের নদীমাতৃকতার সম্পর্কটা কোথায়? সেটাই বের করার একটা ছোট্ট প্রয়াস চালাচ্ছি এখানে।

মানুষের জীবকার উপরে যেই জিনিসটি অনেক প্রভাব বিস্তার করে থাকবে, সেটি যে অন্য যেকোন কিছুর চাইতে বেশি গুরুত্ববহ হবে, তা আর বলে দিতে হবে না। বাংলাদেশের মানুষের জীবকার উপরে এদেশের নদনদীগুলিরও সেই একই রকম প্রভাব বিদ্যমান ছিল বহুকাল। সেই প্রভাব কমলেও এখনও আছে বললে পুরোপুরি ভুল না হবেনা, কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে একটু না ঘাটালে অনেক বড় একটা বিষয়কে আমরা উপেক্ষা করে যাবো। উজানের প্রতিবেশী দেশে অভিন্ন নদীর উপরে বাঁধের পর বাঁধ দেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের নদনদীর উপরে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে, তা থেকেই আমাদের নদনদীগুলির সেই প্রভাব হারানোর সূত্রপাত। আর সেই কমে যাওয়া গুরুত্বের নদনদীগুলির শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা কিন্তু আমরাই করেছি। নদীগুলিকে মেরে এই শূণ্যস্থান কি দিয়ে পূরণ হলো, সেটা বের করাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

উজানে বাঁধ দেওয়ায় নদীতে না আছে পানি, না আছে প্রাণীজ সম্পদ, না চালানো যায় নৌকা। এই নদীর সাথে মাতৃকতার আত্মিক বন্ধন কতটুকু, সেটা ভেবে দেখার মতো।

নদী কি প্রতিবন্ধকতা?

পানির অপর নাম জীবন। বেঁচে থাকার তাগিদেই নদীর মরুকরণ দেখে আমরা খুঁড়েছি মাটি; পেয়েছি পানি। সেই পানি শুধু পানই করিনি, শস্য ফলাতেও ব্যবহার করেছি। যেই নদী ছিল একসময়কার বাংলার যাতায়াতের সবচাইতে সহজ মাধ্যম, সেই নদীতে হাজার হাজার কিলোমিটার চর পড়তে থাকায় আমরা নদীর উপর দিয়ে তৈরি করলাম সেতু; বানালাম সড়ক পরিবহণ নেটওয়ার্ক। নদীতে পানি কমার সাথে সাথে নদীর প্রাণীজ সম্পদেরও ঘাটতি পড়তে লাগলো; আমরা যেন ভুলেই যেতে বসেছিলাম - মাছে-ভাতে বাঙ্গালী। আজ বেঁচে থাকার বেশিরভাগ কর্মকান্ডের জন্যেই আমরা নদীর উপরে নির্ভশীলতা কমাতে পারলেই যেন বেঁচে যাই। শুধুমাত্র দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকার মানুষ ছাড়া বাকিরা প্রায় সবাই নদীপথের চাইতে নদীর উপর দিয়ে উড়াল দিয়ে তৈরি করা পথে যাতায়াতেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পথিমধ্যে এমন কোন নদী যদি পরে, যেটা উড়াল দিয়ে পার হওয়া যায় না, সেটাকে আমরা উটকো ঝামেলা হিসেবেই দেখি। নদনদী এখন বছর বছর কূল ছাপিয়ে বন্যারই অন্য নাম মাত্র। ভয়াল নদীভাঙ্গন হয়ে উঠলো নদীর হুঙ্কারের প্রতিধ্বনি। নদনদী হলো কষ্ট; যাকে ছাপিয়ে যেতে পারলেই যেন আমাদের শান্তি। সেই আত্মিক বন্ধনের পরিসমাপ্তি এখানেই। তবে এই লেখার পরিসমাপ্তি এখানেই নয়; বরং শুরু। মনস্তাত্বিকভাবে নদীর সাথে বিচ্ছেদের পর থেকেই আমরা হয়ে গেলাম স্থলজ প্রাণী। এমন না যে আমরা আগে জলজ ছিলাম; কিন্তু পানির সাথে বসবাসের সাথে সাথে আমাদের চিন্তাধারাও পানির সাথেই দোল খেত। সেই চিন্তাধারা এখন পানি থেকে অনেক দূরে সরে আসায় পানিতে আমাদের চোখে শুধু বন্যাই দেখি। দেশের বেশিরভাগ মানুষ সমুদ্র থেকে দূরে বসবাস করায় পানির সাথে সৃষ্ট এই দূরত্ব বিশেষ গুরুত্ব বহণ করে। আমাদের চিন্তা চেতনা থেকে পানিকে আমরা প্রায় বাদই দিতে বসেছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই চিন্তাধারা সামষ্টিকভাবে আমাদের পিছিয়ে দেবার জন্যে একটা বিরাট বাধা তৈরি করেছে। সমুদ্র অর্থনীতির বাস্তবায়নের পথে এটি একটি বিষাক্ত কাঁটা!

"পানিশিক্ষা"

অর্থনৈতিক উন্নতির সিঁড়ি বাইতে হলে সমুদ্রের দিকে আমাদের হাত বাড়াতেই হবে - এই কথাটা আজ সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু যে জাতি তাদের হাজার বছরের পানির ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি, তাদেরকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেললে তার ডুবে যাবার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে। ঢেউয়ের উপরে ভাসতে না জানলে ঢেউকে কাজে লাগাবার প্রশ্নই ওঠে না। অর্থনৈতিক অবস্থার আরও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব বাধা সরানোর পেছনে আমাদের আজ থেকেই উঠে পড়ে লাগতে হবে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই "পানিবিমূখতা"। এই বাধা সরানোর উপায় একটিই - আজ থেকেই সকলকে "পানিশিক্ষা"-য় শিক্ষিত করা। পানির সাথে বসবাসের সেই পুরোনো গল্পটা আবার নতুন করে বলতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ের পানি বিষয়ক সাফল্যের কথা মনে করিয়ে দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। কারণ তাতে পরবর্তী প্রজন্ম খাপছাড়াভাবে আলাদা আলাদা দিক থেকে পানিকে চিনবে; একটিমাত্র তীখন দূরদৃষ্টি দিয়ে চিনবে না। ফোকাস না থাকলে ভিত্তি গড়া সম্ভব নয়। আর টেকসই উন্নয়নের জন্যে ভিত্তি হতে হবে শক্ত।

নদীমাতৃকতা আসলে একটা সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে শুধু নদী নিয়ে রচনা লিখলেই হবে না; নদীমাতৃকতাকে ঘিরে মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটাতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে আনতে হবে হাতে কলমের সম্পৃক্ততা। পানি, নদী ও সমুদ্র গবেষণাতে আসতে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এখানে শুধুমাত্র মিষ্টি কথা বলেই কাউকে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব নয়; তাদের দেখাতে হবে সত্যিকারের আশা; তৈরি করতে হবে 'রোল মডেল', যাদেরকে অনুসরণ করে নতুনেরা প্রবেশ করবে। গবেষণাতে নতুন প্রজন্মকে এনে আমরা অন্তত ভবিষ্যতের পরিকল্পনাকারীদের জন্য একটা দিকনির্দেশনা দিয়ে যেতে পারি। আমাদের ছেড়ে যাওয়া কাজ যেন তারা করে নিতে পারে খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই। নতুনদের দেখাতে হবে আশা; যেটার শুরু করতে হবে একেবারে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই থেকেই। এটা হবে "পানিশিক্ষা"-এর শুরুটা এখানেই হতে হবে।


নৌকা বাইচের মতো খেলাগুলিকে আমরা দেশের মানুষের কতটুকু কাছে নিয়ে যেতে পেরেছি? ভবিষ্যতে যারা দেশের হাল ধরবে, তাদেরকে কি এই খেলা আকর্ষণ করতে পেরেছে?

 খেলাধূলার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে যত সহজে আকৃষ্ট করা যায়, অন্য কোন মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। পানির উপরে নির্ভর খেলাগুলিকে সামনে নিয়ে আসাটা এই "পানিশিক্ষা"-এর গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হতে পারে। সাঁতার এবং নৌকাবাইচের যে কত ধরন রয়েছে সারা দুনিয়াতে; আমরা ক'টা ধরনকে উঠিয়ে আনতে পেরেছি? আমাদের যেই প্রজন্ম ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দেবে, তাদেরকে এই খেলা আকৃষ্ট করতে পেরেছে কি? ক্রিকেট খেলাতো প্রায় সবাই দেখছে; নৌকাবাইচ দেখেছে কতজন? পালতোলা নৌকা চালাতে পারে কতজন? 'সেইলিং' নামে যে একটা খেলা আছে দুনিয়াতে সেটা কি আমরা জানি?

এই "পানিশিক্ষা"-কে আমরা এখন থেকেই যদি গুরুত্ব দেওয়া শুরু না করি, তাহলে একটা সময় আসবে যখন আমরা অনেকদূর এগিয়েও পিছিয়ে যাবো; কারণ কোন এক সময়ে আমরা দূরদৃষ্টি নিয়ে কাজ করিনি। ভবিষ্যতের ব্লু ইকনমি বা ম্যারিটাইম নেশন যেই ধারণার প্রতিষ্ঠার কথাই বলি না কেন, মনস্তাত্বিক দিক থেকে নিজেদেরকে তৈরি করতে না পারলে প্রকৃতপক্ষে এগুলি শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। ভুলে গেলে চলবে না যে বাকি বিশ্বও থেমে নেই। এখানে অন্যদের চাইতে বেশি গতিতে না চলতে পারলে নিজেদের তুলনামূলকভাবে স্থবিরই মনে হবে।

Sunday 21 September 2014

ডিফেন্স জার্নালিজমঃ আমরা কোথায়?

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪

সামরিক বাহিনীর কাছাকাছি গিয়ে সাংবাদিকতা করতে হলে বাহিনীর আস্থা অর্জন করতে হবে। আস্থার অভাব থাকলে খবরের একটা গুরুত্বপূর্ণ উতস সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে জবাবদিহিতা।




বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে; অনেক ভালো কিছু হয়েছে; আবার অনেক খারাপ কিছুও চোখের সামনে চলে আসছে। আমি সবার পা মাড়ানোর চেষ্টায় যাবো না; শুধু একদিকেই যাবো - প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সাংবাদিকতা। এই বিষয়টাতে আসলে এখনো দেশে কোন ভালো সাংবাদিকের আগমণ ঘটেনি। এটা খুবই স্পেশালাইজড একটা বিষয়, তাই খুব সহজে এক্ষেত্রে ভালো লোক চলে আসবে, এটা চিন্তা করাটাও খুব একটা সমিচীন নয়। তবে এখানে একটা বড় ব্যাপার হলো দূরদৃষ্টি। খোলামনে সামনে দেখতে পারার ক্ষমতা কিন্তু অনেক কিছুকেই পালটে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন এটা দিতে পারে, তা হলো শেখার আগ্রহ। মায়ের পেট থেকে বের হয়েই কেউ কোন বিষয়ে এক্সপার্ট হয়ে যায় না; শিখতে শিখতেই হয়। আমার মনে হয় এই শেখার আগ্রহতেও ঘাটতি রয়েছে এই ধরনের সাংবাদিকতায়। যারা এসব বিষয়ে লিখছেন বা রিপোর্ট করছেন, তাদের লেখা দেখে মনে হয় যে কেউ জোর করে তাদের সেগুলি লেখাচ্ছে। নিজের ইচ্ছা না থাকলে কোন কিছু নিয়েই ভালো কোন পর্যায়ে পোঁছানো সম্ভব নয়। তেমনই কয়েকটি সাংবাদিকতার উদাহরণ নিয়ে আজকের এই লেখা। তাহলে এই লেখার সাথে জাতীয় নিরাপত্তার সম্পর্ক কি? বিরাট সম্পর্ক! বহু মানুষ এইসব লেখা পড়ে প্রভাবিত হবে। আর যদি বি-গ্রেডের লেখা পড়ে কেউ প্রভাবিত হয়, আর সেটা যদি জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক কোন লেখা হয়, তাহলে সেটা আসলেই চিন্তিত হবার বিষয়। 

কাটতির অপব্যবহার!

সেদিন একটা বিশাল কাটতির পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখলাম বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন ক্রয় নিয়ে লেখা হয়েছে। এরকম রিপোর্ট আমরা এর আগেও বেশ কিছু দেখেছি। রিপোর্টটির ভাষ্য ছিল কিছুটা সামরিক বাহিনী বিমুখ। সেটা কি খারাপ কিছু? বিমুখ হতেই পারে; কেউ হয়তো যুদ্ধাস্ত্র কেনাটা পছন্দ না-ই করতে পারেন। তাতে সমস্যা দেখি না। দুনিয়ার সব যায়গাতেই এধরণের মানুষ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিছুটা অন্যদিক থেকে দেখতে হবে। পত্রিকার প্রথম পাতায় কোনরকম একটা রিপোর্ট করলে কিছু বলতেই হয়। রিপোর্ট কতটুকু দায়সাড়া ছিল, সেটার প্রমাণ মেলে একটা ছোট্ট তথ্য থেকে। রিপোর্টে লেখা হয়েছে যে নৌবাহিনী সাবমেরিন পাচ্ছে ২০১৮ সালে। কিন্তু অল্প একটু গুগল সার্চ করলেই তো সে জানতে পারতো যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রী, উপদেষ্টা এবং নৌবাহিনী প্রধান আলাদা আলাদাভাবে ২০১৪ সালেই বলেছেন যে আমরা সাবমেরিন পেতে যাচ্ছি ২০১৫ সালে। রিপোর্টে সবথেকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সাবমেরিনের বয়স - ২৪ বছর এবং এর মূল্য - ১৫০০ কোটি টাকা। আর একইসাথে সাবমেরিন কেনাটা জরুরি কিনা সেটা প্রশ্ন করা হয়েছে। আর এই প্রশ্নের উত্তর উদ্ঘাটন করতে উদ্ভট সব সাক্ষাতকারের আবির্ভাব ঘটেছে, যেখানে বীজ বপন করা হয়েছে সন্দেহের। বিষয়টা সম্পর্কে জানেন এমন কোন লোকের সাথে কথা বলা হয়নি, অথবা বলা হয়েছে যে সেটা সম্ভব হয়নি। রিপোর্টার সাবমেরিন কি ও কেন - সেটা আসলেই জানেন না। এবং সেটার উত্তর খোঁজার খুব একটা ইচ্ছেও তার ছিল বলে মনে হয়নি। (সাবমেরিন কেন দরকার সেটা আগের একটা পোস্টে লিখেছি, তাই আজকে আর লিখছি না।) তাই একটা ভাসা-ভাসা ধারণা নিয়ে রিপোর্ট শুরু করে ওভাবেই শেষ করেছেন তিনি। এখানে উল্লেক্ষ্য যে এর আগেও আমরা এধরনের দায়সাড়া রিপোর্ট দেখেছি। আরেকটি ইংরেজি পত্রিকায় লেখা হয়েছিল যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবমেরিন চীন বা আমেরিকা থেকে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আমেরিকা থেকে হতেই পারে। কিন্তু এখানে বাগড়া হলো 'অফ দ্যা শেলফ' সাবমেরিন। এর মানে কি? এর মানে হচ্ছে যেটি অলরেডি তৈরি এবং ব্যবহারে আছে; মানে নতুন করে বানাতে হবে না। একটা নতুন সাবমেরিন বানাতে ৪-৫ বছর লেগে যাবে এবং দামও বেশি হবে। একটা অফ দ্যা শেলফ' সাবমেরিন এখনই পাওয়া যাবে। এখানে যে ব্যাপারটা রিপোর্টার একেবারেই জানেন না তা হচ্ছে গত ৫০ বছরে আমেরিকা পারমাণবিক সাবমেরিন ছাড়া আর কোন সাবমেরিন বানায়নি। তাহলে বাংলাদেশ কি আমেরিকার কাছে তাদের পারমাণবিক অফ দ্যা শেলফ' সাবমেরিন আশা করছিলো?? ঠিক এই ব্যাপারটাই পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে আমি তুলে ধরার পরে তারা উত্তর দিলেন যে তারা অফ দ্যা শেলফ' সাবমেরিনের কথা বলেছেন, নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের কথা বলেননি। পরিষ্কার বোঝা গেল যে পত্রিকার সংশ্লিষ্টদের অফ দ্যা শেলফ'-এর অর্থ জানা নেই! কাজেই আমার পরবর্তী কমেন্টের কোন উত্তর তাদের কাছে ছিল না। 

জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়গুলি নিয়ে কোন ধরনের আগ্রহ না থাকলে সেক্ষেত্রে সাংবাদিকতার কোন মানেই হয় না। কোন বিষয়ে আগ্রহ না থাকলে সেই বিষয়ে বেশিদূর যাওয়া কোনদিনই সম্ভব নয়।


মৃত্যুঞ্জয় মজুমদার

এই পত্রিকাগুলিকে বারংবার লেখা হচ্ছে যে জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের সাথে কেউ কথা বলছেন না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই একই সামরিক সদস্যরা কি করে বিদেশী ডিফেন্স ম্যাগাজিনে বহুল তথ্য দিয়ে সাক্ষাতকার দিচ্ছেন? সমস্যাটা তাহলে অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তার নয়; অন্য কোথাও। একটা উদাহরণ দিই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যখন হোয়াইট হাউজ-এ সাংবাদিক সন্মেলনে কথা বলেন, তখন তিনি প্রত্যেক সাংবাদিককে নাম ধরে ডাকেন। অর্থাৎ মার্কিন রাষ্ট্রপতির সাথে ওই সাংবাদিকদের একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই তারা প্রেসিডেন্টের সাথে বারংবার কথা বলতে পারবেন। তারা জানেন কি করে একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হয়। তারা এ-ও জানেন যে এই সম্পর্কে একবার চির ধরলে তাদের সংবাদ পাবার একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান তাদের জন্যে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের দেশে সামরিক বাহিনীর লোকেদের সাথে সাংবাদিকদের সেই সম্পর্কটা হয়নি। সম্পর্কোন্নয়নে কারুরই শক্ত ভূমিকা ছিল না কখনো। আর এই ধরনের বি-গ্রেডের রিপোর্টের কারণে এই সম্পর্ক যদি উন্নতির পথে যাওয়া শুরুও করে, তবু মুখ থুবড়ে পড়বে। যে মানুষটা আপনার বিষয় সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান রাখেন না এবং অসংলগ্ন প্রশ্ন করে আপনাকে বিব্রত করার চেষ্টায় থাকবেন তার সাথে আপনি কখনোই কথা বলতে চাইবেন না। আন্তর্জাতিক ডিফেন্স জার্নালিস্ট মৃত্যুঞ্জয় মজুমদারকে নৌবাহিনী প্রধান সাক্ষাত দিয়েছেন কিছুদিন আগেই, যেখানে তিনি নৌবাহিনীর বর্তমান অবস্থা থেকে শুরু করে ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়েও বিষদ আলোচনা করেছেন। আসলে মজুমদার নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন বলেই নৌবাহিনী প্রধান তাকে সময় দিয়েছেন; গভীরে গিয়ে আলোচনা করেছেন, যদিও তিনি বাংলাদেশী নন। তিনি এমন কিছু তথ্য তার সাথে শেয়ার করেননি যাতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এই ধরনের সাক্ষাতকার নেওয়ার মতো যোগ্যতা আমাদের দেশের বর্তমান কোনো সাংবাদিকের নেই। 

সামরিক বাহিনীর সাথে বেসামরিক মানুষের পার্থক্য আসলে খুব বেশি কিছু নয়। উভয়েই রক্তমাংসের মানুষ। সেতুবন্ধন খুব বেশি দূরে কখনোই ছিল না। শুধু ইচ্ছার অভাব।


আসলেই কি এতটাই দূরত্ব?

এখানে মার খেয়ে যাচ্ছে জবাবদিহিতা। ডিফেন্সের বড় বড় কেনাকাটার ব্যাপারে স্বচ্ছতা থাকছে না। আমাদের নেই কোন প্রতিরক্ষা নীতি। কাজেই কোন জিনিসটা কেন কেনা হচ্ছে, সেটার কোন আলোচনা নেই। আমাদের পার্শবর্তী ভারতে সাবমেরিন ফ্লিটের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছেতারা সবাই চাচ্ছেন দেশের প্রতিরক্ষা জোরদার হোক; তাই সবাই মতামত দিতে চাচ্ছেন। এভাবে তাদের জবাবদিহিতা বাড়ছে। অপরদিকে আমাদের দেশে ডিফেন্স সাংবাদিকতার প্রসার না হওয়ায় আমরা আরও পিছিয়ে যাচ্ছি। সাংবাদিকের প্রথম প্রশ্নই যদি হয় টাকা-পয়সা নিয়ে, তাহলে তারা যে পিছিয়ে যাবেন সেটা বলে দিতে হবে না। প্রথম প্রশ্ন শুনেই তারা দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন। আমার বহু বছরের বাজার গবেষণার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি যে একটা মানুষকে যদি তার আয় বা টাকা-পয়সা সম্পর্কে কোন কথা জিজ্ঞেস করতে হয়, তাহলে সেটা করতে হয় সবশেষে; কারণ সেখানেই ইন্টারভিউ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর বদ্ধ দুয়ারের দু'পাশে বসে সম্পর্ক হয় না। কিন্তু দেশের স্বার্থে এইক্ষেত্রে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমরা আজকাল মাঝে মধ্যে সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদেরকে টেলিভিশনের টক শো-তেও দেখেছি। সিভিলিয়ান পোষাকে তাদেরকে আসলেই অন্যান্য সাধারন মানুষের মতনই লেগেছে। দেশের উচ্চ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আজকাল অনেক সামরিক অফিসারদের দেখা যায়। তাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে আমার আলাপও হয়েছে। প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে যে তারা আমাদেরই মতো রক্তমাংসের মানুষ। আমরা যেভাবে চিন্তাভাবনা করি, তারাও একই রকম। সামরিক বাহিনী মানেই ব্যারাকের বাইরের দুনিয়া থেকে আলাদা - এটা আজকাল একেবারেই বলা যাবে না। এটা ইন্টারনেটের যুগ। অনেকেই সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ব্যারাকের বাইরে দেখতে চান না; আবার এও অভিযোগ করেন যে তারা বেসামরিক মানুষকে বোঝেন না এবং সুযোগ পেলেই ছোট করে দেখার চেষ্টায় থাকেন। কিন্তু যদি তা-ই হবে, তাহলে সামরিক বাহিনীর অফিসাররা বিজনেস ডিগ্রী নিয়ে চাকুরি ছেড়ে বেসরকারি দুনিয়ায় যাবার প্রচেষ্টায় থাকতেন না। তারা যদি 'সুপেরিয়র'ই হতেন, তাহলে তারা বেসামরিক 'ইনফেরিয়র' জীবনে যাবার চেষ্টায় রত থাকতেন না। ঐ যে বলেছি, তারাও রক্ত-মাংসের মানুষ; তারাও তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবেন; তাদের সন্তানদের কোন স্কুলে পড়াবেন সেটা নিয়ে ভাবেন; ভবিষ্যত নিয়ে ভাবেন। সামরিক আর বেসামরিক এই দুনিয়ার মাঝে ব্রিজ তৈরিটা খুব কঠিন নয়। এখানে বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে পদ্মা ব্রিজ বানাতে হবে না; ছোট্ট একটা কালভার্টই যথেষ্ট।


আমাদের মৃত্যুঞ্জয় কোথায়?

দেশের জন্যেই সামরিক বাহিনী - এটা সকলেরই অনুধাবন করাটা জরুরি। দেশের মানুষ যেমন তাদের কষ্টার্জিত অর্থের বিনিময়ে টিকিয়ে রাখছে এই বাহিনী, ঠিক তেমনি এই দেশের মানুষের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখার গুরু দায়িত্ব পড়েছে এই বাহিনীর উপরেই। একে অপরকে ছাড়া চলতে পারে না। এই চিরসত্যগুলিকে মনে করিয়ে দেবার জন্যেই দরকার জবাবদিহিতা। আর তাতেই দেশের মানুষ আর সামরিক বাহিনীর মাঝে তৈরি হবে সেই সেতু, যেই সেতুর প্রকৃতপক্ষে কোন দরকারই পড়তো না যদি আমাদের রাজনীতিকেরা গত ৪৩ বছর ধরে ঠিক কাজটি করতেন। এখন আর পেছনে ফিরে যাবার সময় নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলির মতো আমরাও চাই সামরিক আর বেসামরিক সমাজের মাঝে কোন বিভক্তি না থাকুক। এই বিভক্তি সবসময়ই দেশকে করেছে দুর্বল; আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দীদের সুযোগ দিয়েছে আমাদের ঘাড়ের উপরে চড়ে বসতে। তাদের এই অশুভ প্রয়াসকে সমূলে উতপাটনের জন্যেই আমাদের এই সেতু তৈরি করতে হবে। এই সেতুর নির্মাতা হতে হবে এমন একজন (বা একাধিক) যিনি সবাইকে অন্তত সন্মান করতে জানেন। বেসামরিক নাগরিকদের অধিকার বুঝতে পারাটাও হতে হবে তার বাধ্যতামূলক যোগ্যতা। আর সামরিক বিষয়ে জ্ঞান থাকাটা হবে তার অতিরিক্ত যোগ্যতা। আমরা দেখতে চাই যে আমাদের বাহিনী প্রধানেরা মৃত্যুঞ্জয় মজুমদারদের সাক্ষাতকার দেবার চাইতে আমাদের দেশের সাংবাদিকদের সাক্ষাতকার দিতেই যেন বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

Wednesday 3 September 2014

জাতীয় নিরাপত্তা মানেই কি সামরিক কোন কিছু?

http://www.dailymail.co.uk/news/article-2632719/US-Official-China-cited-cyber-espionage-case.html
ওয়াং ডং নামের এই ব্যাক্তি চীনা সামরিক বাহিনীর সদস্য। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তাকে খুঁজছে হ্যাকিং-এর জন্যে। এফবিআই বলছে যে ওয়াং এবং তার হ্যাকার গ্রুপ কয়েকটি মার্কিন প্রাইভেট কোম্পানীর সিস্টেমে হ্যাকিং করে চীনা কোম্পানীগুলিকে সহায়তা করেছে। অনৈতিক হলেও চীনারা দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে সবার উপরে।

 ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪



জাতীয় নিরাপত্তা বলতে আমরা মোটামুটি সবসময়ই মনে করি এটা বোধহয় সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত কোনকিছু। হয়তো বহির্শত্রু থেকে দেশকে সামলে রাখাটাই এর মূলকাহিনী। কিন্তু এটা আমরা চিন্তা করে দেখি না যে বহির্শত্রুর আক্রমণ ঠেকানো কেনো গুরুত্বপূর্ণ। বহির্শত্রু আসলে আমাদের কি করতে পারে? আর সেটাতে আমাদের কি কি ক্ষতি হতে পারে? এই রকম ক্ষতি কি বহির্শত্রুর আক্রমণ ছাড়াও হতে পারে? সেটা একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যাপারটা আসলে কি। তাহলে একটু গভীরে যাবার চেষ্টা করি ব্যাপারটা নিয়ে। 

http://joequinn.net/2014/04/12/putin-having-way-too-much-fun-with-eu-and-usa-over-ukraine/
রাশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত গ্যাস পাইপলাইনের নেটওয়ার্ক। ইউরোপের জ্বালানী সরবরাহের একটা বিরাট অংশ আসে রাশিয়া থেকে। ইউক্রেন সঙ্ঘাত নিয়ে রাশিয়া-ইউরোপের দ্বন্দে রাশিয়া এগিয়ে থাকছে এই অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে। এই পাইপলাইনগুলিই এখন রাশিয়ার রক্ষাকবচ।


ঢাল-তলোয়ারের সংজ্ঞা পরিবর্তন?  
কোন বহির্শত্রু যখন আমার দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থানে হস্তক্ষেপ করবে, আমরা তখন স্বভাবতই আমাদের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সচেষ্ট হবো। স্বাধীনভাবে নিজেদের দেশকে চালাতে না পারলেই তো স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্ন উঠবে; ঠিক কিনা? তার মানে বহির্শত্রুর আক্রমণে স্বাধীনভাবে দেশ চালানো হুমকির মুখে পড়বে। তাহলে শুধু বহির্শত্রুর আক্রমণেই কি দেশের স্বাধীন পরিচালনা বিঘ্নিত হতে পারে, নাকি অন্য কারণেও হতে পারে? কোন একটা পরিস্থিতিতে আমাদের দেশ যদি অন্য কোন দেশ বা কোন গোষ্ঠি বা সংস্থার সাথে এমন কোন চুক্তি করতে বাধ্য হয়, যার শর্ত মোতাবেক আমরা ভবিষ্যতে ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছুই করতে পারবো না তাহলে কি দেশের স্বার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে না? যদি পড়ে, তাহলে এই ধরণের হুমকি থেকে দেশকে রক্ষা করার উপায় কি? এখানেই ঢাল তলোয়ারের সংজ্ঞা নিয়ে চিন্তার ব্যাপার রয়েছে। সবক্ষেত্রেই যে অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে দেশের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে তা নয়। বরং অস্ত্র ব্যবহার করার আগেই যেন যুদ্ধ হেরে বসে না থাকি, সেটাও চিন্তা করতে হবে। একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ দেওয়া যাক। রাশিয়া এখন ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে নির্বিঘ্নে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুখে মুখে বললেও রাশিয়াকে ইউক্রেন থেকে দূরে রাখতে পারছে না। রাশিয়ার সামরিক শক্তি এখন সেই সোভিয়েত যুগের সাথে তুলনীয় নয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের গুরুত্বকে অনেকটা উপরে উঠিয়েছে। বর্তমানে প্রায় সারা ইউরোপ রাশিয়া থেকে লম্বা পাইপলাইনের মাধ্যমে পাওয়া জ্বালানীর উপরে নির্ভর করছে। এই জ্বালানীর যোগান হঠাত বন্ধ হয়ে গেলে রাশিয়ার চাইতে ইউরোপই বেশি বিপদে পড়বে। কাজেই এখানে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি অর্থনৈতিক ভারসাম্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। রাশিয়া সামরিক দিক থেকে যেটা পারেনি, সেটা অর্থনীতির মারপ্যাঁচে পুষিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার উদ্ধৃত্ত জ্বালানী সম্পদ এক্ষেত্রে শুধু অর্থনৈতিকভাবেই তাদের উপকৃত করেনি, কৌশলগত দিক থেকে রাশিয়ার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে। 

অর্থনীতিই সর্বোচ্চ স্বার্থ 
অর্থনীতি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থ। একটি দেশ তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ চীনের কথা বলা যেতে পারে। চীনা কম্পিউটার হ্যাকারদের অত্যাচারে যুক্তরাষ্ট্রের ত্রাহি অবস্থা। আমেরিকানদের মতে এই হ্যাকার গোষ্ঠী চীনের সামরিক বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একারণে মার্কিন সরকারের এজেন্সিগুলি চীনা সামরিক বাহিনীর প্রযুক্তি বিভাগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে চিনহিত করেছে; তাদের ছবিসহ পোস্টার ছাপিয়েছে। এই হ্যাকারগোষ্ঠী কিন্তু ক্রেডিট কার্ড বা টেলিকম কোম্পানি থেকে টাকা চুরির লক্ষ্যে হ্যাকিং করে না। এই গোষ্ঠীর কাজ হচ্ছে চীনারা যেসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে, সেসব ক্ষেত্রে চীনকে এগিয়ে নেয়া। কিছুদিন আগে খবরে এলো যে চীনা হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক হাসপাতালের সিস্টেমে হ্যাকিং করে সেখান থেকে অনেক তথ্য চুরি করেছে। হ্যাকাররা এমনই সব তথ্য চুরি করেছে, যা ব্যবহার করে চীনা মেডিকেল কোম্পানিগুলি আমেরিকার মার্কেটে আমেরিকান কোম্পানির সাথে পাল্লা দিয়ে আরও ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারে। কাজেই এই তথ্য যুদ্ধ আসলেই হেলা-ফেলার ব্যাপার নয়। এখানে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা জড়িত। চীনা হ্যাকাররা এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখেছে। হয়তো চীনা সামরিক বাহিনীও সেখানে জড়িত। কিন্তু এরা সকলেই চেষ্টায় রয়েছে দেশের স্বার্থকে উপরে তুলে ধরতে; সেটা ন্যায়সম্মত হোক আর না হোক। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এখন জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে হাসপাতালের কম্পিউটারও ঢুকে গেল। হয়তো আগে থেকেই ছিল; তবে এখন গুরুত্বের দিক দিয়ে সেটা কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল আরকি। 

http://usatoday30.usatoday.com/news/nation/story/2011-09-07/How-9-11-changed-us-IV-Have-terrorists-won/50303168/1
যুক্তরাষ্ট্রে আল কায়েদার হামলার পর থেকে নিরাপত্তা অনেক ক্ষেত্রেই জোরদার করা হয়েছে। এই নিরাপত্তা বেষ্টনির ভেতরে নিয়ে আসা বেশিরভাগ স্থাপনাই কিন্তু বেসামরিক। আসলে বেসামরিক জীবনযাত্রার নিরাপত্তা বিধানই সামরিক লক্ষ্য।


বেসামরিক নাকি অগুরুত্বপূর্ণ? 
শুধু হাসপাতাল কেন? আরও অনেক কিছুই মার্কিন সিকিউরিটি লিস্টে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। ৯/১১-এর আল কায়েদার হামলার পরে যুক্তরাষ্ট্র শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে দেশের বহু বেসামরিক স্থাপনাকে প্রতিরক্ষা বলয়ের মাঝে নিয়ে আসার জন্য। বিমান পরিবহণের কথা তো নতুন করে বলার কিছু নেই। বিমানবন্দরে  প্রতিটি বিমানে দেওয়া হয়েছে সাদা পোষাকের এয়ার মার্শাল। এনথ্রাক্স জীবানু হামলার পরে ডাক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছিল তারা। রাসায়নিক সার, গ্যাস সিলিন্ডার, শিল্পে ব্যবহার্য বিস্ফোরক, ইত্যাদি বিপজ্জনক দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে বহু ধরণের নতুন নিয়ম-নীতির প্রচলন করা হয়েছিল। কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করে মানুষকে গুটি বসন্তের টীকা দেওয়া হয়েছিল। বিমান বন্দর, ব্যবসা কেন্দ্র, গুরুত্বপূর্ণ সেতু, সমুদ্র বন্দর, রেল স্টেশন, পানি শোধনাগার, বিদ্যুত কেন্দ্র, বাঁধ, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নেওয়া হয়েছিল কঠিন নিরাপত্তা ব্যাবস্থা। এগুলি সব-ই বেসামরিক স্থাপনা, কিন্তু এগুলির কারণেই সেই দেশের অর্থনীতি সচল ছিল। সামরিক স্থাপনাগুলির চাইতে এগুলির গুরুত্ব বেশি বৈ কম নয়। তাই সর্বশক্তি দিয়ে তারা তাদের অর্থনৈতিক সম্পদকে নিরাপত্তা দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একটু বেশিই করে ফেলেছে। আর বেশি বলেই সমালোচনা করবো কেন? আমাদের দেশে রপ্তানিমূখী গার্মেন্টস শিল্পে বিশৃংখলা তৈরির অনেক চেষ্টা চলেছে। শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন না দেওয়া থেকে শুরু করে মনুষ্য-সৃষ্ট দুর্ঘটনা, এমনকি কারখানায় অগ্নি সংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু আমরা এসব ক্ষেত্রে ২৪ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করা এই শিল্পের বিন্দুমাত্র নিরাপত্তা দিতে পারিনি, অতিরিক্ত করা তো দূরে থাক। ষড়যন্ত্রকারীদের ধরতে পারিনি; শ্রমিক অসন্তোষ নিভাতে পারিনি; দিতে পারিনি শ্রমিকের জীবনের মূল্য। অর্থনীতির এতবড় সেক্টরকে আমরা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি; জাতীয় নিরাপত্তাকে ছেড়ে দিয়েছে সৃষ্টিকর্তার হাতে!  

ব্যবসায়িক তথ্যের নিরাপত্তা 
তবে জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে আসলে বেশি বলে কোন কিছু নেই। কিছু না ঘটলে সবাই বলে যে অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর কিছু ঘটে গেলে সবাই বলতে থাকে কিছুই করা হয়নি। এই কিছু করার ক্ষেত্রটা অনেক বিশাল। সবসময় এটার গুরুত্ব বোঝাও কঠিন। যেমন পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের পরে পাটের উপরে নতুন করে গবেষণার দুয়ার খুলে গেছে। যদিও অনেকেই জানে যে বেশ কিছু গবেষণা অনেকটা এগিয়েছে, কিন্তু কি ধরণের গবেষণা হচ্ছে সেটা নিয়ে কেউই কথা বলতে নারাজ। কেন? কারণ পাটের বাজারে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দীর অভাব নেই। বর্তমানে পাটের কয়েকটি পেটেন্ট-এর জন্যে বাংলদেশ আবেদন করেছে। যেগুলি পেয়ে গেলে বাংলাদেশকে রয়ালটি না দিয়ে কেউ পাটের উপরে বিশেষ কিছু কাজ করতে পারবে না। আমাদের গবেষণার বিষয় আমাদের প্রতিদ্বন্দীরা আগেভাগে থেকে জেনে ফেললে এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক ক্ষতির একটা কারণ হতে পারে। বর্তমানে পাটের সাথে বাংলাদেশের ৭০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাণিজ্য জড়িত, যা এখন খুব ছোট মনে না হলেও পাটের ভবিষ্যত সম্ভাবনার কাছে নিতান্তই নস্যি। ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে পাটজাত পণ্য আমাদের গার্মেন্টস-নির্ভর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে ব্যালান্স করতে পারবে। আর এই গবেষণার নিরাপত্তার উপরে নির্ভর করছে আমাদের অর্থনীতির বিরাট এক সম্ভাবনা আর বহু মানুষের কর্মসংস্থান। আমাদের প্রতিদ্বন্দীরা কেউ এখানে গোয়েন্দাগিরি করছে না, সেটা কখনোই বলা যায় না। বড় বড় দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি তাদের দেশের বড় বড় প্রাইভেট কোম্পানিগুলিকে বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। এইসব তথ্য আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় কোম্পানিগুলির টিকে থাকার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/55094/%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A7%81-%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A1
বাংলাদেশের গরুর বাজার প্রায় পুরোপুরিভাবে ভারতের সাথে সীমান্ত বাণিজ্যের উপরে নির্ভরশীল। এই গরুর সরবরাহের উপরেই গড়ে উঠেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি শিল্প, যা গত বছর ১.৩ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। সীমান্তে বিএসএফ-এর অমানবিক আচরণের পরেও গরু ব্যবসা তো আর বন্ধ করা যাচ্ছে না।


বাণিজ্য নির্ভরশীলতাও কি নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে? 
অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা যে সময়মত কতটা গুরুত্ববহ হয়ে যায়, সেটার জন্য আগে বর্ণিত রাশিয়ার গ্যাস পাইপলাইনের কথা বলা যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতীয় গরুর কথা বলা যায়। এই গরু আমাদের দেশে শুধুমাত্র প্রোটিনের চাহিদাই পূরণ করে না। গরুর চামড়ার উপরে নির্ভর করছে আমাদের ১.৩ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাণিজ্য। আমদের দেশ এখনো যেহেতু গরু মোটাতাজাকরণ ব্যবসায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়নি, তাই এই ভারতীয় গরুর উপরেই আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে। সীমান্তে এই ব্যবসাকে ঘিরে কত মানুষ যে ভারতের ট্রিগার-হ্যাপি বিএসএফ সদস্যদের হাতে মারা পড়েছে, তার হিসেব নেই। তারপরেও আমরা এখানে জিম্মি হয়ে থাকছি। আমরা প্রতিবাদ করলেও বলতে পারছি না যে ভারত থেকে আর গরু আনবো না। অন্যদিকে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় পুরোটাই ইউরোপ-নির্ভর। কোন কারণে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা বা ইউরোপের সাথে এদেশের রাজনৈতিক কোন্দলে আমাদের রপ্তানি বাজারে বিরাট প্রভাব পড়তে পারে। যার ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে। ইউরোপে মন্দার কারণে এদেশের অনেক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এর প্রভাব ছিল সবচাইতে বেশি। উঠতি এই শিল্পে প্রচুর বিনিয়োগের ঠিক পরপরেই একনাগারে কয়েক বছর একটিও বিদেশী জাহাজের অর্ডার পায়নি। এমতাবস্থায় হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাতীয় নিরাপত্তার অংশ। এই সময়ে দেশী জাহাজের অর্ডার অনেক গুণ বেড়ে যাওয়ায় এই শিল্প সমূহ ধংসের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল। ভিয়েতনামের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে আমাদের চাইতে আরও অনেক বেশি বিনিয়োগ হয়েছিল। তাই তাদের ক্ষতির পরিমাণ আমাদের চাইতে বহুগুণ বেশি ছিল। 

http://bdn24x7.com/?p=196087
জনশক্তি রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট একটা ভূমিকা রাখে। ১৪ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স মুখের কথা নয়। আমাদের বেশিরভাগ নাগরিক কর্মরত আছেন মধ্যপ্রাচ্যে, যেখানে কিছুদিন পরপরই চলছে সংঘাত। এসবের যের ধরে মাঝে মধ্যেই এসব কর্মজীবি মানুষকে দেশে পালিয়ে আসতে হচ্ছে। পড়ছে অর্থনীতির উপরে চাপ।


কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা 
যেকোন বাণিজ্যে ক্ষতি বেশি হবে যদি সেখানে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ হয়। এক্ষেত্রে অর্থের ব্যাপারটা আসলে সবচেয়ে ছোট। চিন্তা করে দেখুন এমন কোন শিল্পের কথা যেখানে হাজার হাজার মানুষ বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। তাদের উপরে নির্ভরশীল হয়েছে তাদের পরিবার। এমন শিল্প যেখানে অনেক প্রতিভাবান তরুন তাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করেছে বিশেষ কোন বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্যে, যাতে সে সেই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের একজন অংশীদার হতে পারে। একটা বিরাট শিল্পের ধ্বসে জনশক্তির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়াটা সবচাইতে কঠিন। আর বাংলাদেশ যেহেতু ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, তাই এদেশের জনশক্তির নিরাপত্তা দেখাটা দেশের সরকারের সবচাইতে জনগুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে একটি। আর জনশক্তির কথা বলতে গেলে বিদেশে এদেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করাটা দেশের অভ্যন্তরের চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ দেশে যে হারে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, তা আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্যে এখনো অপ্রতুল। দেশের অর্থনীতিতে বিদেশ থেকে পাঠানো প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের এই রেমিট্যান্স বাজার বিশাল এক ভূমিকা রাখে। এখানেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশ কোন একটি বা দুটি দেশের উপরে খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে কিনা। মধ্যপ্রাচ্যের উপরে বরাবরই আমাদের জনশক্তি রপ্তানি নির্ভরশীল। কিন্তু এখানে প্রায় সবসময়ই কোন না কোন আন্তর্জাতিক বিবাদ লেগেই আছে। অগণতান্ত্রিক এই দেশগুলিতে বড় ধরণের পরিবর্তন হলেই আমাদের কর্মসংস্থান বাজারের উপরে ব্যপক চাপ পড়ে যায়। আবার এইসব দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নও অনেক গুরুত্ব বহন করা শুরু করে। বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং-এর বিরূদ্ধে দেশে বা বিদেশে যেকোন কর্মকান্ড এক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে। এখানে ভুলে গেলে চলবে না যে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে আমাদের প্রতিদ্বন্দী দেশগুলি বসে নেই। তারা কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের কয়েকগুণ দ্রুতগতিতে জনশক্তি রপ্তানি করছে; বন্ধ করে দিচ্ছে আমাদের রপ্তানির পথ। দক্ষ জনশক্তির দিক থেকে তারা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। দক্ষ জনশক্তির চাহিদা যেমন বেশি, তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সও তেমনি বেশি হয়। কাজেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারাটা হয়ে যাচ্ছে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু। গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং ইন্সটিটিউট এবং শিক্ষা কেন্দ্রগুলিকে ঠিকমতো চালানোটা কারো চোখে পড়বে না। কিন্তু কোন ধরণের অনাকাংক্ষিত বিশৃংখলায় যদি এসব গুরুত্ববহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হঠাত অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখন কিন্তু সেখানে সবার চোখ যাবে। কিন্তু গার্মেন্টস সেক্টরে বিশৃংখলা দেখা দেয়ার পরও আমরা ভুলে গেছি যে সেখানে ৪০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব সেক্টরে নজরদারি রাখাটা জাতীয় নিরাপত্তার একটা অংশ।  

http://janatarnews24.com/detail.php?sid=%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B2&id=2094
জাটকা ইলিশ ও মা ইলিশ ধরা বন্ধ করতে কোস্ট গার্ড সহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ইলিশ অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে এই ধরণের অপারেশন বিরাট ভূমিকা রাখছে। জলদস্যুদের দেশে জেলেদের নিরাপদ রাখারও জোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু তারপরেও এই চেষ্টা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/industry-business/2013/11/29/25635
অবরোধের কারণে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ঘাটে আটকে আছে সারি সারি ট্যাঙ্ক লরি। এই বন্দর অকেজো হয়ে গেলে গোটা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের চাষাবাদ ব্যাহত হয়; দেখা দেয় উতপাদন ঘাটতি। এই বন্দর সচল রাখা জাতীয় নিরাপত্তার অংশ।


আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার কিছু ইস্যু 
নজরদারিতে রাখার মতো অনেক বিষয়ের মাত্র কয়েকটি বিষয় উপরে উল্লেখ করেছি; আরও অনেক রয়েছে। চিন্তা করে দেখুন তো চট্টগ্রাম বন্দর, যেখান দিয়ে দেশের ৯০% বাণিজ্য হয়, সেখানে কোন কারণে এক সপ্তাহ সকল কাজ বন্ধ হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে কতটা ক্ষতি হতে পারে? বন্দরের মুখে ডুবে যাওয়া জাহাজ, নদীর নাব্যতা, শ্রমিক অসন্তোষ, ইত্যাদি যেকোন সমস্যাই বন্ধের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। অথবা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোন একটি ব্রিজ এক সপ্তাহের জন্যে অকার্যকর হয়ে পড়লে ঢাকা এবং এর আশেপাশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব কতটুকু পড়বে? বেশিরভাগ বড় বড় ব্রিজ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট দ্বারা সুরক্ষিত। কিন্তু ব্রিজগুলির টেকনিক্যাল সিকিউরিটি কিন্তু এর রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত ইঞ্জিনিয়ারদের উপরে। একইভাবে যদি প্রাকৃতিক বা মনুষ্য-সৃষ্ট কোন কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি এবং মাওয়া কেওড়াকান্দি ফেরি একসাথে অকার্যকর হয়ে পড়ে, তাহলে ঢাকার সাথে দেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে; শত শত কোটি টাকার মাছ ও সবজি নষ্ট হবে পথিমধ্যে, আর ঢাকায় এগুলির মূল্য হবে সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে শুষ্ক মৌসুমে এই ফেরি রুটের নিরাপত্তা চলে যায় নদী খননের জন্য ড্রেজার চালনা করা ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে। একইভাবে, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি নৌবন্দর হলো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের চাষাবাদে ব্যবহৃত ডিজেল তেল (সেচ ও জমি চাষ) ও রাসায়নিক সারের চাবিকাঠি। প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে মানিকগঞ্জ থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত নৌপথে নাব্যতা ভয়াবহ কমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে তেল ও সার নিয়ে আসা জাহাজগুলি বাঘাবাড়ি পৌঁছার আগেই আটকে যায়। ড্রেজিং চলে দিনরাত; তারপরেও নৌরুটের বিপদ কাটে না; রাতের বেলায় চলে ডাকাতের উপদ্রব; নজরদারী বাড়াতে হয় পুলিশের। এখানে তেল ও সার পৌঁছাতে দেরী হওয়া মানে বছর শেষে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্য উতপাদনে বিরাট ঘাটতি। তিস্তা নদীতে সেচের জন্যে পানি না থাকাও একই রেজাল্ট দেবে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভারতের সাথে তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তির বাস্তবায়ন। আরও একটি উদাহরণ হলো দেশে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ যে সময় (এপ্রিল ও অক্টোবরের কিছু সময়), সে সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের শত শত কিলোমিটার নদী পাহাড়া দেওয়া। কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী ও পুলিশ এসময়ে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেও হিমসিম খায় ইলিশ ধরা বন্ধ করতে গিয়ে। এই একটি মাছ ইলিশ এদেশের জিডিপি-তে ১% অবদান রাখে; বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে; কর্মসংস্থান দেয় ৪.৫ লক্ষ জেলেরসময়মত ইলিশ ধরা বন্ধ না রাখতে পারলে এই সম্পদ বেশিদিন টেকানো সম্ভব হতো না। গভীর সমুদ্রে বিদেশী ট্রলারের মাছ চুরি রোধ করাটাও একই ধরনের গুরুত্ব বহণ করে। আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবার পরে নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করাটা এখন তাই একটি জাতীয় ইস্যু। আরেকটি ইস্যু রয়েছে জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্পের পরিবেশগত দিক ও শ্রমিক নিরাপত্তাএই শিল্পের উপরে নির্ভর করে গোটা দেশের নির্মাণ শিল্প (রড, বার, এঙ্গেল); বেশিরভাগ যাত্রীবাহী লঞ্চ ও ছোট জাহাজ (বালুবাহী বার্জ, কার্গো জাহাজ, মালামালবাহী লোহার নৌকা) তৈরি শিল্প;  ফাউন্ড্রি শিল্প (টিউব ওয়েল, পানির পাম্প, ধান মাড়ানি মেশিনের যন্ত্রাংশ, ইত্যাদি); বাস-ট্রাকের বডি তৈরির শিল্প; এমনকি পুরোনো জাহাজ ভেঙ্গে পাওয়া নানা যন্ত্রপাতি ও আসবাব এগুলিরও নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। এসব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির একটা বিশাল অংশ জাহাজ-ভাঙ্গা শিল্পের উপরে নির্ভর করে। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন জাহাজ মালিকেরা যে আমাদের এই শিল্পে শ্রমিকের নিরাপত্তাহীনতাকে ভ্রু কুঁচকে দেখছে, সেটা আমরা জানি কি? আমাদের দেশ থেকে স্ক্র্যাপ জাহাজ চীন ও ভারতে যেতে থাকলে আমরা মহা বিপদে পরে যাবো। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সহ সেক্টরটিকে সবসময় নজরদারির মাঝে রাখাটা জরুরি। আর বিদ্যুত, গ্যাস, তেল শোধনাগার, ইত্যাদির গুরুত্ব বোঝাবার নেই। এগুলি যে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তা কাউকে বলে বোঝাতে হবে না। 

http://www.arthosuchak.com/archives/66685/%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%A8-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%AE%E0%A6%A7%E0%A7%81-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B9/
সুন্দরবন থেকে আহরণ করা হচ্ছে মধু। দেশের অর্থনীতি ও জলবায়ুর উপরে সুন্দরবনের বিরাট এক ভূমিকা রয়েছে। এই বনকে ধ্বংস হতে দেওয়া আর নিজেরদের কবর রচনা করা একই কথা। জাতীয় নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সুন্দরবন রক্ষা করা।

http://bangladeshfirst24.com/news/%E0%A6%AB%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%BF/
বাজারের মাছে ফরমালিন পরীক্ষা করা হচ্ছে। একটি জাতিকে সারাজীবনের জন্যে পঙ্গু করে দেবার জন্যে তাদের একটি জেনারেশনকে ধারাবাহিকভাবে বিষ খাওয়াতে পারলেই যথেষ্ট। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ জাতীয় নিরাপত্তার অংশ।


কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও কিছু কিছু ব্যাপার দীর্ঘমেয়াদে দেশের অনেক ক্ষতি করতে পারে। তাই সেসব দিকে সবসময় খেয়াল রাখা জরুরি। যেমন মাদক চোরাচালান রোধ করা। মাদক দেশে অবাধে আসতে দিলে একটা পুরো জেনারেশন ধ্বংস হয়ে যাবে; যারা একসময় দেশের জন্যে সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে যাবে। এরপর রয়েছে খাদ্যে ভেজাল ও দূষন রোধ করা। একটা পুরো জাতিকে পঙ্গু করে ফেলার জন্যে তাদের শিশুদের প্রতিদিন কিছু কিছু করে বিষ খাওয়ালেই হবে; তারা সারাজীবনে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পুরো জাতির পুষ্টির চাহিদা পূরণ করাটাও একইভাবে জরুরি। সময়মত দেশের একটি জেনারেশনের ভিটামিন ও প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা না গেলে সেই জেনারেশন থেকে মেধাসম্পন্ন বা সুস্বাস্থ্যের নাগরিক তৈরি করা যাবে না; যাবে না শক্তিশালী দেশ তৈরি করা। নদনদীর সম্পদ, সামুদ্রিক সম্পদ, বনজ সম্পদ এগুলি দেশের জন্যে অনেক বড় আশীর্বাদ। এগুলি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করাও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

এত কথা? বুঝে কয়জন? 
তাহলে এটা বোঝা যাচ্ছে যে দেশের নিরাপত্তা দেওয়া মানে দেশের আর্থ-সামাজিক সবদিক দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই নিরাপত্তা দিতে শুধু অস্ত্র দিয়ে হবে না। এখানে দেশের সব ধরনের সম্পদই কাজে লাগতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশের মানবসম্পদ। দেশের স্বার্থ দেশের মানুষকে বোঝার শক্তি দিতে হবে। কারো একার পক্ষে দেশের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়; সকল নাগরিককেই এখানে দরকার। সকল নাগরিকের মাঝে আবার দেশের নেতৃস্থানীয় মানুষের দায়িত্ব সবচাইতে বেশি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দেশের স্বার্থ বুঝতে পারার ঘাটতি আমাদের সকলের মাঝেই রয়েছে।