Sunday 31 October 2021

বেলারুশ কি ইইউএর বিরুদ্ধে ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ চালাচ্ছে?

৩১শে অক্টোবর ২০২১

পশ্চিমা চিন্তার স্তম্ভ মানবাধিকার ইইউএর সদস্য রাষ্ট্রগুলির শরণার্থী বিরোধী জাতীয়তাবাদী চিন্তার কাছে হার মেনেছে। পোল্যান্ডের পার্লামেন্টে গণতান্ত্রিকভাবেই শরণার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রাশিয়ার সমর্থনে বেলারুশ ইউরোপের দুর্বলতাকেই উস্কে দিচ্ছে; যাকে ইইউ বলছে ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ। ইউরোপের লিবারাল গণতান্ত্রিক আদর্শ দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে; আর এর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে উগ্রবাদী জাতীয়তাবাদী চিন্তা। লিবারাল চিন্তার উৎসস্থলে এই দুর্যোগ ধ্বসে পড়া বিশ্বব্যবস্থারই প্রমাণ মাত্র।

 পূর্ব ইউরোপের দেশ বেলারুশের সাথে ইইউএর যখন উত্তপ্ত সম্পর্ক চলছে, তখন ইইউএর অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো ইইউএর সাথে শরণার্থী ব্যবহার করে ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। আর এই যুদ্ধে লুকাশেঙ্কোর প্রধান সমর্থনকারী হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অপরদিকে ইইউএর পূর্ব সীমানার দেশ লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং পোল্যান্ড শরণার্থীদের আটকাতে তাদের সীমানায় দেয়াল তৈরিতে উদ্যত হয়েছে; এবং এব্যাপারে তারা ইইউএর সহায়তা চাইছে।

‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর সাথে সাক্ষাতে ইইউএর স্বরাষ্ট্র কমিশনার ইয়ালভা জোহানসন বলেন যে, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো মানুষকে আগ্রাসনের জন্যে ব্যবহার করছেন। তিনি দাবি করেন যে, বেলারুশের উপর ইইউএর অবরোধগুলি তাকে আঘাত করছে বলেই তিনি এখন মরিয়া হয়ে দ্বন্দ্বের দিকে ধাবিত হতে বাধ্য হচ্ছেন। ‘ইউরোনিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২০ সালে বেলারুশের নির্বাচনে জেতার পর থেকেই ইইউএর সাথে লুকাশেঙ্কো সরকারের সম্পর্ক খারাপের দিকে যেতে থাকে। ইইউ থেকে নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং এরপর থেকে বেলারুশের রাস্তায় প্রতিবাদ শুরু হয়। ইইউ লুকাশেঙ্কো সরকারের উপর অবরোধ আরোপ করে এবং দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। বেলারুশ সরকার ‘রায়ান এয়ার’এর একটা বিমানকে মিনস্ক বিমানবন্দরে নামতে বাধ্য করে এবং বিমানের অভ্যন্তর থেকে এক সাংবাদিককে বের করে এনে গ্রেপ্তার করে। গত অগাস্টে টোকিও অলিম্পিক থেকে পালানো বেলারুশ এথলেট ক্রিস্টসিনা সিমানুস্কায়াকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় ইইউএর সদস্য দেশ পোল্যান্ড; যা বেলারুশের সাথে দেশটার সম্পর্ক খারাপ করে। তবে এক সংবাদ সন্মেলনে লুকাশেঙ্কো অস্বীকার করেন যে, তিনি শরণার্থীদেরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন যে, বেলারুশ কাউকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে না; তবে তারা যদি বেলারুশকে শর্তের মাঝে ফেলে, তাহলে বেলারুশ প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, তার দেশের রাশিয়া, চীন বা ইইউএর মতো সম্পদ নেই।

 

তবে বেলারুশ থেকে আসা শরণার্থীর চাপে প্রতিবেশী দেশ লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। পোল্যান্ডও তার সীমান্ত অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং প্রায় ৬ হাজার সেনা সীমানায় মোতায়েন করে। লাটভিয়া এবং পোল্যান্ড উভয় দেশই তাদের সীমান্তরক্ষী এবং সামরিক বাহিনীকে শক্তি ব্যবহার করে শরণার্থীদের বেলারুশে ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা প্রদান করেছে। পোল্যান্ডের পার্লামেন্টে বিল পাশ করে সাড়ে তিন’শ মিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে বেলারুশের সাথে ৪’শ কিঃমিঃ সীমানা বরাবর দেয়াল তোলার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। পোলিশ সরকার বলছে যে, এবছরেই তারা বেলারুশ থেকে শরণার্থী ঢোকার চেষ্টার ২৩ হাজার প্রচেষ্টাকে তালিকাভুক্ত করেছে। লিথুয়ানিয়াও বেলারুশের সীমানায় কাঁটাতাদের বেড়া দেয়া শুরু করেছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের এক বিবৃতিতে এই বেড়া দেয়াকে ‘ভালো চিন্তা’ বলে আখ্যা দেয়া হয়। তবে ইইউ এই প্রকল্পে কোন অর্থায়ন করবে না বলে বলা হয়। লিথুয়ানিয়া সরকার ইইউএর কাছ থেকে এব্যাপারে সহায়তা চেয়েছে।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, শরণার্থীদের মূল স্রোত আসছে ইরাকের উত্তরের কুর্দী অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে। ইরাক, সিরিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে শরণার্থীরা ১৪ থেকে ১৭ হাজার ডলার খরচ করে মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে সেখানে পৌঁছাচ্ছে। প্রথমে এবছরের অগাস্টে বাগদাদ থেকে সরাসরি শরণার্থীরা বেলারুশে আসতে থাকে। এরপর ইইউএর চাপের মুখে ইরাক সরকার সরাসরি ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে ইরাক থেকে শরণার্থীরা দুবাই, লেবানন, সিরিয়া, জর্দান, তুরস্ক, ইত্যাদি দেশ হয়ে বেলারুশে আসতে থাকে। অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, বেলারুশ সরকার মিনস্ক বিমানবন্দর থেকেই শরণার্থীদের সরাসরি পোল্যান্ডের সীমানায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইইউএর সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হবার পর থেকে বেলারুশ সরকার ভিসা ইস্যু করার দায়িত্ব বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির হাতে দিয়ে দেয়। এই এজেন্সিগুলি বিভিন্ন উপায়ে শরণার্থীদের বেলারুশে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে থাকে।

 

বেলারুশের সীমানার সমস্যার এক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর এসোসিয়েট ফেলো সামানথা ডে বেনডার্ন। বেলারুশের বিতর্কিত নির্বাচনের এক বছরের মাথায় ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা বেলারুশের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য পটাশ, অপরিশোধিত তেল, এবং আরও কিছু পণ্যের উপর অবরোধ দেয়। একইসাথে বেলারুশের উপর ব্রিটেনের অর্থবাজার থেকে অর্থ যোগানের উপরও অবরোধ দেয়া হয়। এর পাল্টা হিসেবে লুকাশেঙ্কো মধ্যপ্রাচ্য থেকে শরণার্থী ঢোকার পথ খুলে দেন। বেনডার্ন বলছেন যে, এটা হলো একধরনের ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ, যা শরণার্থীদেরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ইইউ এবং ন্যাটোর পূর্ব সীমানায় উত্তেজনা সৃষ্টি করা ছাড়াও মিত্র দেশগুলির মাঝে বিরোধের জন্ম দিতে চাইছে। নতুন শরণার্থী সমস্যার কারণে পূর্ব ইউরোপে শরণার্থী বিরোধী মনোভাবকে আরও বেশি উস্কে দিতে পারে এবং অভিবাসন বিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপগুলিকে শক্তিশালী করতে পারে। এই ব্যাপারটা ইতোমধ্যেই জার্মানি এবং সুইডেনে দেখা গেছে; যেখানে সমাজের সমস্যার জন্যে উগ্র ডানপন্থীরা শরণার্থীদের দায়ী করছে। একইসাথে তা উগ্র জাতীয়তাবাদ, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং ইইউ বিরোধী চিন্তার জন্ম দিয়েছে। রাশিয়া বহুদিন ধরেই চাইছে ইউরোপে ডানপন্থীদের উত্থান হোক; যা ইইউ এবং ন্যাটোকে দুর্বল করবে। বেনডার্ন মনে করেন না যে, এই ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ বেলারুশের পক্ষে মস্কোর অনুমতি ছাড়া করা সম্ভব।

মানবাধিকার সংস্থাগুলি পোল্যান্ড এবং বেলারুশ উভয় দেশের বিরুদ্ধেই আশ্রয়প্রার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগে মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ করেছে। ইতোমধ্যেই প্রচন্ড শীত এবং অন্যান্য সমস্যায় পড়ে কমপক্ষে আটজন শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়। পশ্চিমা চিন্তার স্তম্ভ মানবাধিকার ইইউএর সদস্য রাষ্ট্রগুলির শরণার্থী বিরোধী জাতীয়তাবাদী চিন্তার কাছে হার মেনেছে। পোল্যান্ডের পার্লামেন্টে গণতান্ত্রিকভাবেই শরণার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রাশিয়ার সমর্থনে বেলারুশ ইউরোপের দুর্বলতাকেই উস্কে দিচ্ছে; যাকে ইইউ বলছে ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধ। লিবারাল গণতান্ত্রিক দেশগুলি যখন শরণার্থীর ঢল ঠেকাতে দেয়াল তুলছে এবং সামরিক বাহিনী ব্যবহার করছে, তখন বেলারুশে লিবারাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার দাবি তুলে লুকাশেঙ্কো সরকারের উপর অবরোধ আরোপ পরস্পরবিরোধীই বটে। ইউরোপের লিবারাল গণতান্ত্রিক আদর্শ দিনে দিনে দুর্বল হচ্ছে; আর এর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে উগ্রবাদী জাতীয়তাবাদী চিন্তা। লিবারাল চিন্তার উৎসস্থলে এই দুর্যোগ ধ্বসে পড়া বিশ্বব্যবস্থারই প্রমাণ মাত্র।

Saturday 30 October 2021

মার্কিন নৌবাহিনী কেন চিংড়ি নিয়ে গবেষণা করছে?

৩১শে অক্টোবর ২০২১

নতুন জেনারেশনের নিঃশব্দে চলা রুশ সাবমেরিনগুলিকে মোকাবিলা করা এখন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের গুরুদায়িত্ব। গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন নৌবাহিনী আটলান্টিকে ‘টাস্ক গ্রুপ গ্রেহাউন্ড’ নামে রুশ সাবমেরিন খোঁজার মিশন শুরুর ঘোষণা দেয়। এই একই ধারাবাহিকতায় এখন মার্কিন নৌবাহিনীর গবেষকেরা সমুদ্রের নিচে আড়ি পেতে চিংড়ির ‘কট কট’ শব্দ শুনছেন।

 
সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন নৌবাহিনী সমুদ্রের নিচে চিংড়ির ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কিছু চিংড়ি পানির নিচে ‘কট কট’ শব্দ তৈরি করে। একসময় সমুদ্রের নাবিকেরা মনে করতো যে, এই শব্দ হয়তো ঢেউয়ের তৈরি, অথবা পানির নিচের আগ্নেয়গিরির শব্দ, অথবা পানির তোড়ে নুড়ি পাথর নড়ার শব্দ। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নৌবাহিনী যখন সোনার যন্ত্র দিয়ে জার্মান সাবমেরিন খুঁজতে গিয়ে এই শব্দের ঝড়ের মাঝে পড়ে, তখনই তারা নড়েচড়ে বসে। ‘ঊডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইন্সটিটিউশন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া’র ‘ডিভিশন অব ওয়ার রিসার্চ’এর গবেষকেরা এই শব্দের উৎসকে চিংড়ি পর্যন্ত নিতে সক্ষম হয়েছিল। এই গবেষণার ফলাফল হিসেবে নৌবাহিনীর সোনার অপারেটরদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল যাতে করে তারা বুঝতে পারে কোন শব্দটা চিংড়ির। একটা চিংড়ির একটা শব্দ প্রায় ২’শ ২০ ডেসিবল পর্যন্ত হতে পারে; যা একটা বন্দুকের গুলির শব্দের চাইতেও বেশি! মার্কিন সামরিক সদস্যদের ম্যাগাজিন ‘স্যান্ডবক্স’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটা প্রকল্প ২০২০ সালে দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছেছে; যার মাঝ দিয়ে তারা কিছু সেন্সর ডেভেলপ করা শুরু করছে। এই সেন্সরগুলি চিংড়ির তৈরি করা শব্দ রেকর্ড করে বিশ্লেষণ করবে। বিশ্লেষণে যদি বুঝতে পারা যায় যে, চিংড়িগুলির কাছাকাছি কোন সাবমেরিন রয়েছে, তাহলে উপকূল বা জাহাজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কবার্তা পৌঁছে যাবে।

বৈজ্ঞানিক ম্যাগাজিন ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ চিংড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা দিচ্ছে। ‘স্ন্যাপিং শ্রিম্প’ বা ‘পিস্তল শ্রিম্প’ নামের এক প্রকারের ক্ষুদ্র সামুদ্রিক চিংড়ি রয়েছে, যেগুলির একটা থাবা থাকে অনেক বড় আকারের; প্রায় নিজেদের শরীরের অর্ধেক। এই থাবাগুলি যখন তারা বন্ধ করে, তখন বেশ জোরে শব্দ হয়। সমুদ্রে কিছু স্থানে এই চিংড়িগুলি তাদের বড় আকারের কলোনি তৈরি করে। সেসব কলোনিতে অনেক সময়েই চিংড়িগুলি সকলে একত্রে থাবা দিয়ে শব্দ করতে থাকে। এরকম সময় কেউ যদি সেখানে সমুদ্রের নিচে সোনার যন্ত্র ব্যবহার করে, তবে চিংড়ির শব্দ ছাড়া কোনকিছুই সে শুনতে পাবে না এবং তার সকল কাজই ব্যাহত হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক সময়েই আটলান্টিকের তলদেশে চিংড়ির কলোনির বিকট শব্দের কারণে মিত্র বাহিনীর জাহাজগুলিকে জার্মান সাবমেরিন খুঁজে পেতে বেগ পেতে হতো। তবে মাত্র ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ‘সায়েন্স’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় জার্মানির মিউনিখের ‘টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি’র প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষক বারবারা শ্মিতজ এই চিংড়িগুলি কিভাবে শব্দ তৈরি করে, সেটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন। চিংড়ির থাবা বন্ধ করার সময় সেখান থেকে অতি দ্রুত বের হওয়া পানির জেটের সাথে বুদবুদ বের হয়ে আসে এবং শব্দ উৎপন্ন করে। এই পানির জেটের গতি ব্যবহার করে চিংড়ি নিজের শিকারকে হত্যা করে। পুরো ব্যাপারটা পানির নিচে গুলি করার মতো কাজ করে! বিজ্ঞানীরা একইসাথে চিংড়ির এই বিচিত্র কর্মের কারণও ব্যাখ্যা করছেন। চিংড়িরা মূলতঃ এই শব্দের মাধ্যমে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ করে। একইসাথে আক্রমণকারী কোন প্রাণীকে শব্দ করে ভয় দেখিয়ে তারা নিজেদের এলাকাকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। চিংড়ির এই কর্মকান্ডটাই মার্কিন নৌবাহিনীর গবেষকদের আকৃষ্ট করেছে। গতবছর ‘সেন্টার ফর ক্লাইমেট সিকিউরিটি’র এক লেখায় বলা হয় যে, ২০২০ সালের ‘ওশান সায়েন্স মিটিং’এ প্রকাশ করা একটা গবেষণায় বলা হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে সমুদ্রের পানির তাপমাত্র যখন বাড়ছে, তার সাথে এই চিংড়িগুলির শব্দ করার ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে মাছ ধরার জাহাজগুলি যেমন সোনার ব্যবহার করতে সমস্যা পড়বে, তেমনি মার্কিন নৌবাহিনীর সমুদ্রের নিচের মাইন এবং সাবমেরিন খোঁজার মতো কর্মকান্ডও সমস্যায় পড়বে।

সোনার যন্ত্র দিয়ে পানির নিচে ভূপৃষ্ঠের ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি তৈরি করা যায়; আবার পানির নিচে চলমান যেকোন জিনিসকে খুঁজে পাওয়া যায়; যেমন মাছ বা সাবমেরিন বা মাইন বা অন্য যেকোন বস্তু। ‘একটিভ সোনার’ একটা শব্দ তরঙ্গকে পানির নিচে ছুঁড়ে দেয়; যা কোন জিনিস থেকে প্রতিফলিত হয়ে আবার ফিরে আসে। এই ফিরে আসা শব্দ শুনে তরঙ্গের পরিমাপ থেকে পানির নিচে যেকোন বস্তুর দূরত্ব পরিমাপ করা যায়। আরেক প্রকার সোনার হলো ‘প্যাসিভ সোনার’; যা শব্দ তৈরি না করে বরং কান পেতে শব্দ শোনে। পানির নিচে তৈরি হওয়া যেকোন শব্দকে সেই যন্ত্র শুনে বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করে সেটা কি জিনিস এবং কতটুকু দূরে বা গভীরে রয়েছে। সমুদ্র যুদ্ধে সাবমেরিনের ব্যবহার শুরু হবার পর থেকেই সোনার যন্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে গেছে। কারণ একটা সাবমেরিন পানির নিচে ডুব দিলে তাকে পানির উপর থেকে আর দেখা যায় না এবং সোনার যন্ত্র ছাড়া তখন সেটাকে খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন।

 
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর ‘পারসিসটেন্ট একুয়াটিক লিভিং সেন্সর’ বা ‘প্যালস’ নামের এক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পে গবেষকেরা বুঝতে চেষ্টা করছেন যে, সমুদ্রের নিচে ড্রোন সাবমেরিনের মতো মানুষের তৈরি কোন বস্তু কাছাকাছি দেখলে প্রাণীকূল সেটাকে কিভাবে দেখে? এছাড়াও বেশিরভাগ রীফ অঞ্চলেই এই চিংড়ি থাকে। শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানে হাইড্রোফোন বসিয়ে রাখলেই শব্দ রেকর্ড করা যাবে।

‘ডিসকভার’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন সামরিক গবেষণা সংস্থা ‘ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি’ বা ‘ডারপা’র গবেষকেরা মনে করছেন যে, এসকল চিংড়ির শব্দ শুনে সমুদ্রের নিচে শত্রুর নৌবাহিনীর মনুষ্যবিহীন ড্রোন সাবমেরিন খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এধরনের ড্রোনগুলি প্রায় শব্দবিহীন হয় বলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন সকলেই ড্রোন সাবমেরিন ডেভেলপ করছে, যেগুলির কোন কোনটা আবার পারমাণবিক ওয়ারহেডও বহণ করতে সক্ষম। আর আটলান্টিকে রুশ সাবমেরিনের আনাগোণাও অনেক বেড়েছে। ২০১৮ সালে রুশ নৌবাহিনীর কর্মকর্তা সের্গেই স্টারশিনভ দাবি করেন যে, তাদের সাবমেরিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের নৌঘাঁটির খুব কাছে গিয়ে ঘুরে এসেছে; কিন্তু কেউ তাদেরকে খুঁজে পায়নি।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর ‘পারসিসটেন্ট একুয়াটিক লিভিং সেন্সর’ বা ‘প্যালস’ নামের এক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পে গবেষকেরা বুঝতে চেষ্টা করছেন যে, সমুদ্রের নিচে ড্রোন সাবমেরিনের মতো মানুষের তৈরি কোন বস্তু কাছাকাছি দেখলে প্রাণীকূল সেটাকে কিভাবে দেখে? তারা কি কোন বিশেষ শব্দ করে, অথবা আলোকছটা তৈরি করে কিনা, অথবা ভিন্নভাবে চলাচল করে কিনা। প্রকল্পে কাজ করা মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘রেথিয়ন’এর গবেষক এলিসন লাফারিয়ের বলছেন যে, এই চিংড়িগুলিকে কাছে থেকে শুনলে প্রায় ১’শ ৯০ ডেসিবল শব্দ পাওয়া যাবে। অথচ এসব শব্দ উৎপাদন করতে কোন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে না। এছাড়াও বেশিরভাগ রীফ অঞ্চলেই এই চিংড়ি থাকে। শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানে হাইড্রোফোন বসিয়ে রাখলেই শব্দ রেকর্ড করা যাবে। লাফারিয়ের বলছেন যে, তারা সমুদ্রের নিচের ‘বায়োলজিক্যাল সাউন্ডস্কেপ’ বা সকল প্রাণীকূলের একত্রে তৈরি করা শব্দ নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা দেখছেন যে, সাধারণ সময়ে শব্দ কিরকম হয়; আর পানির নিচে কোন সাবমেরিন জাতীয় জিনিস চলাচল করলে শব্দ কি ধরনের হয়।

 
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আটলান্টিক আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এটাও অবশ্য মার্কিন নীতিরই ফলাফল। রুশ আন্তমহাদেশীয় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এখন মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিহত করা সম্ভব। তাই রাশিয়া তার সাবমেরিন প্রযুক্তিকে আরও এগিয়ে নিয়ে নতুন নতুন অস্ত্র ডেভেলপ করায় মনোনিবেশ করেছে; যেগুলি বর্তমান মার্কিন প্রযুক্তিকে বাইপাস করে যুক্তরাষ্ট্রের উপর পুনরায় হুমকি সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।

‘প্যালস’ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক লোরি এডোরনাটো বলছেন যে, সামুদ্রিক প্রাণীগুলিকে ব্যবহার করতে পারলে সেটা বেশ বিচক্ষণতার কাজ হবে; কারণে এতে খুব কম খরচেই এবং তেমন একটা লজিস্টিক্যাল সমস্যায় না পড়েই সার্বক্ষণিকভাবে পানির নিচে সার্ভেইল্যান্স চালনা করা সম্ভব হবে। ‘ডারপা’ বলছে যে, ‘রেথিয়ন’ কোম্পানি ছাড়াও ‘নর্থরোপ গ্রুমান’ কোম্পানির অধীনে আরেকটা গ্রুপ চিংড়ির শব্দ ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক ইমেজ তৈরি করা নিয়ে কাজ করছে। তৃতীয় আরেকটা গ্রুপ ‘ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভার্সিটি’তে ‘গোলিয়াথ গ্রুপার’ নামে একটা বায়োলজিক্যাল সেন্সর ব্যবহার করছে। ‘স্যান্ডবক্স’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে রুশ এবং চীনা সাবমেরিনগুলি অনেক বেশি শব্দহীন করে তৈরি করা হচ্ছে। আর মহাসমুদ্রে এই সাবমেরিনগুলিকে খুঁজে বের করাও খুব কঠিন হয়ে গেছে। কিছুদিন আগেই পেন্টাগন একটা মানচিত্র প্রকাশ করে। সেখানে দেখানো হয় যে, সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যাওয়া ফাইবার অপটিক কেবলের লাইনগুলির কাছাকাছি দিয়েই রুশ এবং চীনা যুদ্ধজাহাজগুলির আনাগোণা বেশি। মার্কিন নৌবাহিনীর ‘দ্বিতীয় নৌবহর’এর কমান্ডার ভাইস এডমিরাল এন্ড্রু ঊডি লুইস বলছেন যে, নতুন বাস্তবতা হলো যে, মার্কিন উপকূল ছাড়লেই তাদের নাবিকেরা এখন প্রতিযোগিতাপূর্ণ এলাকায় অপারেট করবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজগুলি এখন আর নিরাপদে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে ঘুরতে পারবে না বা অত সহজেই আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যেকোন স্থানে যেতে পারবে না।

রুশ সাবমেরিনের আনাগোণা প্রতিহত করার লক্ষ্যেই ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে মার্কিন নৌবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল এবং উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে তাদের ‘দ্বিতীয় নৌবহর’ কার্যকর করে। ২০১১ সালে রুশ হুমকি কমে যাবার হিসেবে এই নৌবহরের কর্মকান্ড বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আটলান্টিক আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এটাও অবশ্য মার্কিন নীতিরই ফলাফল। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মূল ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে রাশিয়ার সাথে কৌশলগত আলোচনা বন্ধ করে দেয়। আর ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এসব কারণে দুর্বল অবস্থানে পড়ে যাওয়া রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে মরিয়া হয়ে উঠে। রুশ আন্তমহাদেশীয় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এখন মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিহত করা সম্ভব। তাই রাশিয়া তার সাবমেরিন প্রযুক্তিকে আরও এগিয়ে নিয়ে নতুন নতুন অস্ত্র ডেভেলপ করায় মনোনিবেশ করেছে; যেগুলি বর্তমান মার্কিন প্রযুক্তিকে বাইপাস করে যুক্তরাষ্ট্রের উপর পুনরায় হুমকি সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। নতুন জেনারেশনের নিঃশব্দে চলা রুশ সাবমেরিনগুলিকে মোকাবিলা করা এখন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের গুরুদায়িত্ব। গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন নৌবাহিনী আটলান্টিকে ‘টাস্ক গ্রুপ গ্রেহাউন্ড’ নামে রুশ সাবমেরিন খোঁজার মিশন শুরুর ঘোষণা দেয়। এই একই ধারাবাহিকতায় এখন মার্কিন নৌবাহিনীর গবেষকেরা সমুদ্রের নিচে আড়ি পেতে চিংড়ির ‘কট কট’ শব্দ শুনছেন।

সুদানে অভ্যুত্থান মূলতঃ পশ্চিমা হস্তক্ষেপেরই ফলাফল

৩০শে অক্টবর ২০২১

ওয়াশিংটন আপাততঃ সুদানের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধাচরণ করলেও সুদানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দেখিয়ে দেয় যে, মার্কিনীরা সুদানের সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক কখনোই কর্তন করেনি। ওমর আল বশির ক্ষমতায় থাকার সময়েই যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের সমর্থনকারী দেশের তালিকা থেকে সুদানের নাম সরিয়ে নেয়। বিনিময়ে সুদান মানবাধিকার বিষয়ে সুদানের কিছু আইন পরিবর্তন করে। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনেই সৌদি আরব সুদানকে তেল সরবরাহসহ আর্থিক সহায়তা দিতে থাকে।

 
গত ২৫শে অক্টোবর আফ্রিকার দেশ সুদানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটার চরমভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব অর্থহীন হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সুদানের মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্জয় ২০১৯ সালে একনায়ক ওমর আল বশিরের সরকারের পতনের পিছনে নেতৃত্ব দেয়া জোট ‘ফোর্সেস অব ফ্রিডম এন্ড চেইঞ্জ’ বা ‘এফএফসি’কে মানুষের কাছে হেয় করেছে। ২০১৯ সালের অগাস্টে দেশ পরিচালনার জন্যে ‘এফএফসি’এর মনোনীত পাঁচজন এবং সেনাবাহিনীর মনোনীত পাঁচজন সদস্য মিলে ‘সভেরেইন কাউন্সিল’ গঠন করেছিল। তবে দুই বছরের মাঝে ‘এফএফসি’র নেতৃবৃন্দ দেশটাকে কোনরূপ দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনার কথা বেশ কিছুদিন আগ থেকেই শোনা যাচ্ছিল। ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রতিশ্রুত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আগেই এই অভ্যুত্থানকে শুধু সুদানের অভ্যন্তরীণ আঙ্গিক থেকে নয়, বরং দেশটা আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে।

সুদানের দুই রাজনৈতিক দল গত ২রা অক্টোবর একটা নতুন জোট গঠন করে। মিনি মিনাউইএর নেতৃত্বে ‘সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট’ এবং জিবরিল ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ‘জাস্টিস এন্ড ইকুয়ালিটি মুভমেন্ট’ এই জোট গঠন করে। এই দলগুলি ২০২০এর অক্টোবরে সুদান সরকারের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এরপর থেকে উভয় নেতাই এতদিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। মিনাউই বলেন যে, তারা চান যে, ‘এফএফসি’র নেতারা তাদের কথা শুনবেন। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, এর ফলে ‘এফএফসি’এর বিভাজন আরও গভীর হয়। এই দুই রাজনৈতিক দল মূলতঃ দারফুর অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন; যারা বশির সরকারের সময় আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের জন্যে যুদ্ধ করেছে। ‘এফএফসি’র মাঝে আরও রয়েছে দক্ষিণ সুদানের সীমানায় অবস্থিত কুরদুফান অঞ্চলের বিদ্রোহী দল ‘সুদান পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট নর্থ’। এছাড়াও রয়েছে দারফুরের ওয়াহিদ আল নূরএর নেতৃত্বে ‘সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট’এর আরেক অংশ। অস্ত্র নিয়ে সংগ্রাম করা এই দলগুলি একত্রে ‘সুদান রেভোলিউশনারি ফ্রন্ট’ নামে ‘এফএফসি’র মাঝে ছিল। এই আঞ্চলিক বিদ্রোহী গ্রুপগুলি সুদানের ভৌগোলিক অখন্ডতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই গ্রুপগুলিকে আঞ্চলিক এবং পশ্চিমা শক্তিরা সরাসরি বা প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছে। সবচাইতে বড় উদাহরণ ছিল দক্ষিণ সুদান, যা সুদান থেকে আলাদা হয়ে যায় পশ্চিমা মদদে।

‘এফএফসি’র আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ‘ন্যাশনাল কনসেনসাস ফোর্সেস’; যাদের মূল নেতৃত্ব ছিল জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলির হাতে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সাদিক আল মাহদির প্রতিষ্ঠা করা ‘ন্যাশনাল উম্মা পার্টি’র সাথে কোয়ালিশনে ছিল বামপন্থী ‘সুদানিজ বাথ পার্টি’, ‘সুদানিজ কমিউনিস্ট পার্টি’ এবং হাসান আল তুরাবির প্রতিষ্ঠা করা ‘পপুলার কংগ্রেস পার্টি’। এই দলগুলি বরাবরই পশ্চিমা, বিশেষ করে ইউরোপের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছে। ১৯৮৯ সালে সাদিক আল মাহদির সরকারকে উৎখাত করেই ওমর আল বশির ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর থেকে মাহদি বশির সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। ‘এফএফসি’তে আরও অংশীদার ছিল বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সমন্বয়ে গঠিত ‘সুদানিজ প্রফেশনালস এসোসিয়েশন’ এবং আরও কিছু নারীবাদী সংগঠন; যেগুলি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মাপকাঠিতে ইউরোপ থেকে সরাসরি সমর্থন পেয়েছে।

সুদানের অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে পশ্চিমা নীতি থেকে আলাদা করে দেখা যাবে না। এবছরের ২৯শে জুন ‘ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড বা ‘আইএমএফ’এর প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা এবং বিশ্বব্যাংকের প্রধান ডেভিড ম্যালপাসের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, সংস্থাগুলির শর্ত হিসেবে সুদান তার নিজস্ব মুদ্রার মূল্যমান পুনর্নিধারণ করার পর বিশ্বব্যংকের ঋণ শোধ করে। এতে তিন দশক পর বিশ্বব্যংকের সাথে সুদানের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিশ্বব্যংকের শর্ত মানার পুরষ্কার হিসেবে ‘আইএমএফ’ দেশটার ২৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ মওকুফ করে। এই মওকুফ সামনের দিনগুলিতে ৫০ বিলিয়ন ডলার বা দেশটার মোট বৈদেশিক ঋণের ৯০ শতাংশ ছাপিয়ে যাবে। তবে ঋণ মাফের শর্ত হিসেবে মুদ্রামান কমিয়ে ফেলায় সুদানে মুদ্রাস্ফীতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধগতির সাথে যুক্ত হয় চরম বেকারত্ব; যা কিনা জনগণকে দেশটার রাস্তায় নামায়। সুদানের বিরোধী রাজনীতিবিদেরা এই অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে বশিরের সরকারকে উৎখাতে সফলতা পেলেও সেই একই অসন্তোষ বেসামরিক ও সামরিক যৌথ নেতৃত্বকে অর্থহীন করেছে।

ওমর আল বশির ক্ষমতায় থাকার সময়েই যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের সমর্থনকারী দেশের তালিকা থেকে সুদানের নাম সরিয়ে নেয়। বিনিময়ে সুদান মানবাধিকার বিষয়ে সুদানের কিছু আইন পরিবর্তন করে। দক্ষিণ সুদানের তেলখনিগুলি সুদান থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর থেকেই সুদানের অর্থনীতি বিপদে পড়ে। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনেই সৌদি আরব সুদানকে তেল সরবরাহসহ আর্থিক সহায়তা দিতে থাকে। ইয়েমেনের যুদ্ধে সুদান সৌদিদের পক্ষে সৈন্যও প্রেরণ করে। গত এপ্রিলে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘোষণা দেয় যে, কৃষিখাতে তারা এবছর সুদানকে ৪’শ মিলিয়ন ডলার দেবে। এই সহায়তা মূলতঃ ৩ বিলিয়ন ডলারের মূল সহায়তার অংশ। সুদান সরকারের বরাত দিয়ে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ বলে যে, এর মাঝে সাড়ে ৭’শ মিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যেই সুদান পেয়ে গেছে; যার মাঝে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্যে ৫’শ মিলিয়ন ডলারের পুঁজি। দুই বছর আগের আরও দেড় বিলিয়ন ডলারের অনুদানও নিশ্চিত করা হয়। ‘আরব নিউজ’ বলছে যে, অভ্যুত্থানে সৌদিরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং তারা সকল পক্ষকে আলোচনার টেবিলে দেখতে চায়।

ওয়াশিংটন আপাততঃ সুদানের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধাচরণ করলেও সুদানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দেখিয়ে দেয় যে, মার্কিনীরা সুদানের সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক কখনোই কর্তন করেনি। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো ক্যামেরন হাডসন এক লেখায় সুদানের সমস্যার জন্যে সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরি দায়ী করেন। তার কথায়, সুদানের সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বোকা বানিয়েছে’; যা বারংবার হতে দেয়া যায় না। তিনি অবশ্য সুদানের অর্থনীতিতে ‘আইএমএফ’ এবং বিশ্বব্যাংকের চাপিয়ে দেয়া শর্তের ফলাফলগুলি ঠিকই এড়িয়ে যান। তবে আরবের মার্কিন বন্ধু দেশগুলির সুদানের সাথে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, সুদানের অভ্যুত্থানে মিশর, সৌদি বা আমিরাত যেন সরাসরি সমর্থন না দেয়, সেজন্য ওয়াশিংটন যথেষ্ট কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। সুদানের রাজনীতিতে ইউরোপের প্রভাবের কথাও তিনি আলোচনায় আনেননি; যা বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে পরিপূর্ণতা দেয় না।



Friday 29 October 2021

চীনা হাইপারসনিক অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে কতটুকু হুমকি?

২৯শে অক্টোবর ২০২১

চীন এবং রাশিয়ার হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপের কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। মার্কিনীরাই আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এর ফলশ্রুতিতে রাশিয়ার সাথে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চুক্তি অর্থহীন হয়ে যায় এবং রাশিয়া নিরাপত্তাহীনতার মাঝে পড়ে যায়। একারণেই রাশিয়া হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপ করায় মনোযোগী হয়। চীনারাও সেই একই পথে এগুচ্ছে। হাইপারসনিক অস্ত্র নিয়ে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই লাগামহীন প্রতিযোগিতা ধ্বসে পড়া বিশ্বব্যবস্থারই একটা প্রমাণ মাত্র।

 
মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল ‘এনবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০ লক্ষ সেনার পৃথিবীর সবচাইতে বড় সামরিক বাহিনী থাকলেও চীনের যে ব্যাপারটা নিয়ে এখন মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা চিন্তিত, তা হলো চীনের ডেভেলপ করা অস্ত্রসমূহ, যা কিনা মার্কিন সামরিক প্রতিরক্ষ্যা ব্যুহকে ভেদ করতে পারে। পেন্টাগনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, চীনারা এই গ্রীষ্মে দু’টা হাইপারসনিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। তবে চীনারা এখন পর্যন্ত একটা পরীক্ষার কথা স্বীকার করেছে; তাও আবার তারা বলছে যে, সেটা ছিল চীনাদের বেসামরিক মহাকাশ গবেষণার অংশ। মার্কিনীরা ভীত যে, এই অস্ত্র সামনের দিনগুলিতে হয়তো পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণ করতে সক্ষম হবে। শব্দের গতির চাইতে কমপক্ষে ৫ গুণ বেশি গতিসম্পন্ন এই অস্ত্র বর্তমানের মার্কিন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে সক্ষম হতে পারে। গত ২৭শে অক্টোবর বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’এর সাথে এক সাক্ষাতে সর্বোচ্চ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল মার্ক মিলি বলেন যে, চীনারা হাইপারসনিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে, যা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। তিনি বলেন যে, এই পরীক্ষা ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশে ‘স্পুতনিক’ স্যাটেলাইট প্রেরণের মতো অত গুরুত্ববহ না হলেও এর খুব কাছাকাছি; তাই মার্কিনীরা এর উপর কড়া নজর রাখছে। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘স্পুতনিক’ স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণের পর মার্কিনীরা প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে উঠে পড়ে লেগেছিল। ‘এনবিসি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন কর্মকর্তাদের কথায় এটা বোঝা যাচ্ছে যে, মার্কিনীরা চীনাদের এই অগ্রগামিতার ব্যাপারে প্রস্তুত ছিল না। মার্কিনীরা নিজেরাও হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপ করছে। কিন্তু মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘রেথিয়ন’এর প্রধান নির্বাহী বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র হাইপারসনিক অস্ত্রের দিক থেকে চীনের থেকে কয়েক বছর পিছিয়ে আছে।

ওয়াশিংটন এবং বেইজিং থেকে হাইপারসনিক অস্ত্রের ব্যাপারে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আসছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র হলো প্রথম রাষ্ট্র, যারা হাইপারসনিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে। তারা এখনও সেগুলি ডেভেলপ করছে, এমনকি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে চাইছে। একইসাথে তারা ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে তাদের পারমাণবিক ‘ট্রায়াড’ উন্নততর করছে। পারমাণবিক ‘ট্রায়াড’ হলো ভুমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য, সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য এবং আকাশ থেকে ছোঁড়া তিন প্রকারের পারমাণবিক অস্ত্রের ডিটারেন্ট। ওয়াং ওয়েনবিন বলেন যে, চীনের সাধারণ মহাকাশ গবেষণা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বারংবার নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা এটা করেছে ‘চীনা হুমকি’র চিন্তাটাকে সামনে নিয়ে আসার জন্যেই। ২৭শে অক্টোবর পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কারবি সাংবাদিকদের বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তার বাজেটের ভেতরেই বাস্তবসম্মতভাবে নিজেদের হাইপারসনিক অস্ত্রের সক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে এবং এই সক্ষমতা ডেভেলপ করার পথে তারা এগিয়ে যাচ্ছে।

 
হাইপারসনিক অস্ত্র একটা গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা হলেও এটা একেবারে নতুন কিছু নয়। এবং যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডের বিরুদ্ধে পারমাণবিক হামলার সক্ষমতা চীনের বর্তমানেই রয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা চীনাদের হুমকিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করছে। এর মূল উদ্দেশ্য আসলে মার্কিন হাইপারসনিক অস্ত্রের প্রকল্পের জন্যে বাজেট জোগাড় করা। তথাকথিত ‘সন্ত্রাস’এর হুমকি কমে যাওয়ায় মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলি এখন নতুন বাজেট চাইছে।

১৯শে অক্টোবর ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলেছিল যে, গত অগাস্টে চীন হাইপারসনিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। এতে বলা হয় যে, ক্ষেপণাস্ত্রটা প্রথমে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে, এরপর সেটা গ্লাইড করে ভূমির দিকে নেমে আসে। ব্যাপারটা এমন কিছু উন্নততর সক্ষমতাকে দেখায়, যা মার্কিন কর্মকর্তাদেরকে অবাক করেছে। ‘আর্মস কনট্রোল এসোসিয়েশন'এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড্যারিল কিম্বাল ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, এই অস্ত্র যেহেতু খুবই দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং এটাকে আগে থেকে খুঁজে পাওয়াও যেহেতু কঠিন হতে পারে, তাই এগুলি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্যে পূর্বাভাষের সময় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়কে কমিয়ে দেবে। তবে যেহেতু প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই অস্ত্র মহাকাশের কক্ষপথ ঘুরে এসেছে, তাই এটা আরও একটা নতুন উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডীন চেং বলছেন যে, এই প্রতিবেদন যদি সঠিক হয়, তাহলে প্রশ্ন করতে হবে যে, মহাকাশে প্রেরিত যেকোন চীনা স্যাটেলাইটই গোপনে পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণ করছে কিনা। এই গ্রীষ্মে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে যে, চীনারা তাদের পশ্চিমের মরু অঞ্চলে এক’শরও বেশি আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার বা ‘সাইলো’ তৈরি করা শুরু করেছে। ডীন চেং বলছেন যে, চীনারা সাম্প্রতিক সময়ে গত চার বা পাঁচ দশকের তুলনায় নিজেদের আন্তমহাদেশীয় কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতাকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এক বছরের কম সময়েই চীনারা কমপক্ষে আড়াই’শ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ড্যারিল কিম্বাল মনে করছেন যে, বেশি দুশ্চিন্তার ব্যাপার হতে পারে যদি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ডেভেলপ করতে গিয়ে পূর্ব এশিয়াতে লাগামহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কারণ সেখানে চীন এবং জাপানের মাঝে সামরিক উত্তেজনা রয়েছে; কোরিয় উপদ্বীপেও রয়েছে; আবার চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝেও উত্তেজনা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়াও হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপ করছে বলে খবর আসছে। কেউ কেউ উত্তর কোরিয়ার এই প্রযুক্তির উৎসের সাথে চীনের সম্পর্ক খুঁজলেও খুব সম্ভবতঃ এই প্রযুক্তি কোরিয়রা নিজেরাই ডেভেলপ করেছে।

তবে কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, চীনের হাইপারসনিক অস্ত্রের ডেভেলপমেন্টকে আরও বড় পরিসরে দেখতে হবে। ‘ডয়েচে ভেলে’র সাথে সাক্ষাতে ‘ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্র্যাসি’র সিনিয়র ডিরেক্টর ব্র্যাডলি বাউম্যান বলছেন যে, প্রথমতঃ এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা হলেও এটা একেবারে নতুন কিছু নয়। এবং দ্বিতীয়তঃ যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডের বিরুদ্ধে পারমাণবিক হামলার সক্ষমতা চীনের বর্তমানেই রয়েছে। তবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মহাকাশে প্রেরিত রকেটে বহণ করা স্পেস শাটলের মতো, যা গ্লাইড করে ভূমিতে নেমে আসতে পারবে। বেশিরভাগ মার্কিন রাডার যখন উত্তর মেরুর উপর নজর রাখছে, তখন চীনারা দক্ষিণ মেরুতে রকেট পাঠিয়ে সেখান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র গ্লাইড করতে পারবে; এতে তা রাডারে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে বাউম্যান মনে করছেন যে, চীনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায় না নেমে যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ নিজেদের পারমাণবিক ‘ট্রায়াড’কে আরও উন্নত করা; মহাকাশে ক্ষেপণাস্ত্র খোঁজার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা; এবং ‘বুস্ট ফেইজ’এ বা উৎক্ষেপণের সময় ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দেয়ার প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা। তিনি মনে করছেন যে, সবচাইতে বড় দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, চীনাদের সাথে কোন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চুক্তি না থাকায় তারা লাগামহীনভাবেই নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে; যা মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদেরকে বিচলিত করছে। তবে বাউম্যান বলছেন যে, প্রতিদ্বন্দ্বীরা যতক্ষণ পর্যন্ত কোন রাষ্ট্রকে চাপের মাঝে না ফেলে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে আলোচনায় বসতে চায় না। কাজেই এক্ষেত্রে নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতাকে উন্নত করার মাধ্যমেই মস্কো এবং বেইজিংএর অস্ত্র প্রকল্পগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিনীদের মাঝে অনেকেই বুঝতে পারছেন যে, মার্কিন কর্মকর্তারা চীনাদের হুমকিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করছে। বিদায়ী মার্কিন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল জন হাইটেন সাংবাদিকদের বলেন যে, গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র নয়বার হাইপারসনিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে; অপরপক্ষে চীনারা একই সময়ে শতশত হাইপারসনিক পরীক্ষা চালিয়েছে। মার্কিন সংস্থা ‘ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টস’এর ক্যামেরন ট্রেসি এক লেখায় ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, পারমাণবিক অস্ত্র ডেভেলপ করলেও সেগুলি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। নিজেদের স্বার্থেই একে অপরকে কেউ ধ্বংস করতে চায়না বলেই চার দশকের ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত এবং মার্কিনীরা একে অপরকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়নি। এই একই চিন্তা এখনও বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে জেনারেল মিলি নিজেই তার কথায় বলেছেন যে, মার্কিনীরা চীনাদের প্রত্যুত্তরে নিজেদের সামরিক অবস্থানকে পরিবর্তন করবে। এর অর্থ হলো প্রতিরক্ষায় ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক টাইলার রোগোওয়ে এক টুইটার বার্তায় বলছেন যে, মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা যেভাবে চীনের হাইপারসনিক অস্ত্র নিয়ে চিৎকার করছেন, তা থেকে পরিষ্কার যে, তারা আসলে চীনের ব্যাপারে একটা ভীতির জন্ম দিতে চাইছেন। এর মূল উদ্দেশ্য আসলে মার্কিন হাইপারসনিক অস্ত্রের প্রকল্পের জন্যে বাজেট জোগাড় করা। ট্রেসি বলছেন যে, তথাকথিত ‘সন্ত্রাস’এর হুমকি কমে যাওয়ায় মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলি এখন নতুন বাজেট চাইছে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলির স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টার ব্যাপারে ক্যামেরন ট্রেসি এবং টাইলার রোগোওয়ের কথাগুলি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘রেথিয়ন’এর প্রধানের কথাতেও প্রতিফলিত হয়েছে, যিনি মার্কিন হাইপারসনিক প্রকল্পকে চীনাদের থেকে কয়েক বছর পিছিয়ে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। চীনারা বলছে যে, মার্কিনীদের উচিৎ অন্য রাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা ডেভেলপ করার ব্যাপারে সহনশীল আচরণ করতে। প্রকৃতপক্ষে চীন এবং রাশিয়ার হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপের কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। ২০০১ সালের পর থেকে মার্কিনীরাই আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। মার্কিনীরা বলছে যে, উত্তর কোরিয়ার মতো কোন ‘অবাধ্য রাষ্ট্র’ যদি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে হবে। এর ফলশ্রুতিতে রাশিয়ার সাথে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চুক্তি অর্থহীন হয়ে যায় এবং রাশিয়া নিরাপত্তাহীনতার মাঝে পড়ে যায়। একারণেই রাশিয়া হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপ করায় মনোযোগী হয়। চীনারা জানে যে, মার্কিনীদের পারমাণবিক ‘ট্রায়াড’কে চীনারা প্রতিহত করতে না পারলেও চীনা ‘ট্রায়াড’কে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিহত করতে পারবে; একারণেই চীনারাও সেই একই পথে এগুচ্ছে। হাইপারসনিক অস্ত্র নিয়ে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই লাগামহীন প্রতিযোগিতা ধ্বসে পড়া বিশ্বব্যবস্থারই একটা প্রমাণ মাত্র।

Thursday 28 October 2021

মার্কিন ম্যারিন কোর কেন তাদের ট্যাংকগুলি ফেলে দিচ্ছে?

২৮শে অক্টোবর ২০২১

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে দুই দশক ধরে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্র সারা মুসলিম বিশ্বে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ম্যারিন সেনাদেরও মোতায়েন করেছিল। ম্যারিনদের বিশেষ সক্ষমতা সর্বদাই ছিল উভচর অপারেশন; যা থেকে তারা বহুকাল দূরে থেকেছিল। এখন তারা সমুদ্রে ফেরত আসছে ঠিকই, কিন্তু ব্যাপক পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে। দুই দশক ধরে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসী’ দমন অভিযানে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ করার পর মার্কিনীরা হঠাত করেই চীনাদেরকে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে শুরু করেছে।


চীনকে মোকাবিলায় মার্কিন ম্যারিন কোর নিজেদের কাঠামোকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করছে। গত বছরের মার্চ মাসে ম্যারিন কোর ঘোষণা দেয় যে, তারা তাদের সংস্থাকে আগের মতো সমুদ্রকেন্দ্রিক বাহিনী হিসেবে দেখতে চাইছে। ২০২১এর ২৩শে ফেব্রুয়ারি ম্যারিন কোরের প্রধান জেনারেল ডেভিড বারজার মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিনের নিকট একটা মেমো লেখেন। সেখানে তিনি বলেন যে, ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের হুমকি মোকাবিলা করতে গেলে অত্র অঞ্চলে অবস্থিত ২৭ হাজার ম্যারিন সদস্যদেরকে বড় ধরনের উন্নয়ন এবং কাঠামোগত পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে যেতে হবে। জেনারেল বারজারের মেমোর বরাত দিয়ে ‘ডিফেন্স নিউজ’ জানাচ্ছে যে, ম্যারিন কোর নতুন করে ‘ম্যারিন লিটোরাল রেজিমেন্ট’ গঠন করতে চাইছে; যেগুলি গুয়াম দ্বীপ, জাপান এবং হাওয়াই দ্বীপে অবস্থান করবে। সেখান থেকে এই ইউনিটগুলি নৌবাহিনীর ছোট আকারের উভচর জাহাজে চেপে বিভিন্ন দ্বীপাঞ্চলে মোতায়েন করা হবে। এই মিশনে এই রেজিমেন্টগুলির সাথে জাহাজে থাকবে নিজস্ব সার্ভেইল্যান্স ড্রোন, নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা, এবং তারা একইসাথে বহণ করবে জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, যা কিনা চীনা নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলিকে দূরে রাখবে। ম্যারিন কোরের এই ইউনিটগুলি চীনা ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান বাহিনীর পাল্লার মাঝে থেকেই অপারেট করবে। এরকম একেকটা ‘লিটোরাল রেজিমেন্টে’ ১৮’শ থেকে ২ হাজার ম্যারিন সেনা থাকবে।

এর আগে ২০২০এর সেপ্টেম্বরে জেনারেল বার্জার এক কনফারেন্সে তার পরিকল্পনার পিছনে চিন্তার স্তম্ভগুলি উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, নতুন হুমকি মোকাবিলায় ইন্দোপ্যাসিফিকে ম্যারিন সেনারা গত ৭০ বছর ধরে যেভাবে অপারেট করেছে, সেভাবে অপারেট করলে চলবে না। কারণ ম্যারিন সেনাদের এখন একইসাথে বহু স্থানে অবস্থান নিতে হবে, এবং সেটাও অনেক বড় এলাকা জুড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং কোরিয়ান যুদ্ধের পর থেকে মার্কিন নৌবাহিনী এবং ম্যারিন সেনাদের লক্ষ্য কোরিয় উপদ্বীপে অবস্থান নিয়ে সম্ভব দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করা। কিন্তু চীনের উত্থানের সাথেসাথে সেই হিসেব পরিবর্তিত হয়ে গেছে এবং আগামী ১০ বছর বা ২০ বছরের জন্যে সেই কৌশল মোটেই সমীচিন নয়। ‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হচ্ছে যে, ইন্দোপ্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী এবং ম্যারিন কোরের বেশিরভাগ শক্তিই রয়েছে জাপানে। জাপানের ইয়োকোসুকা থেকে অপারেট করে মার্কিন নৌবানীর একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এবং তার সাথের ক্রুজার ও ডেস্ট্রয়ারগুলি। এছাড়াও নৌবাহিনীর উভচর জাহাজের বাহিনী অপারেট করে সাসেবো বন্দর থেকে। ‘থার্ড ম্যারিন এক্সপিডিশনারি ফোর্স’এর ১৮ হাজার ম্যারিন সেনা অবস্থান করছে জাপানের দক্ষিণের ওকিনাওয়া দ্বীপে। অনেকেই সমালোচনা করছেন যে, নৌবাহিনী এবং ম্যারিন সেনাদের এতবড় বাহিনীকে চীনের এত কাছাকাছি এলাকায় অল্প কিছু স্থানের মাঝে জড়ো করে রাখা হয়েছে। এধরনের স্থায়ী ঘাঁটিগুলি খুব সহজেই চীনা ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমারু বিমানের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। ২০২০ সালে মার্কিন সরকারের প্রকাশিত ‘চায়না মিলিটারি পাওয়ার’এ বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে জাপান এবং গুয়াম দ্বীপে চীনাদের আক্রমণ করার সক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে। জাপানে মার্কিন ঘাঁটিগুলি এখন চীনা মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মাঝে। চীনাদের ‘এইচ ৬কে’ বোমারু বিমানগুলি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে গুয়াম দ্বীপ আক্রমণ করতে পারবে। এছাড়াও ‘ডিএফ ২৬’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেও চীনারা গুয়ামে হামলা করতে সক্ষম। জেনারেল বারজার বলছেন যে, চীনাদের এই সক্ষমতাগুলি মোকাবিলা করতেই মার্কিন সেনাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোতায়েন করতে হবে, যাতে চীনারা নির্দিষ্ট করে কোথাও টার্গেট করতে সক্ষম না হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পুরো ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন বন্ধু দেশগুলিকে তাদের সাথে রাখতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। জেনারেল বারজার ২০২০এর জুলাই মাসে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সদস্যদের সামনে তার পরিকল্পনাগুলির প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, নতুন পরিকল্পনায় ট্যাংকের দরকার নেই; দরকার দূরপাল্লার নিখুঁত ক্ষেপণাস্ত্র। 

ম্যারিনরা মনে করছে না যে, ছোট্ট দ্বীপগুলিকে দখলে নিতে ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতে হবে। আর চীনারাও হয়তো এই দ্বীপগুলি দখলে রাখতে ট্যাংক ব্যবহার করবে না। আর আর্টিলারি কামান ব্যবহার করার জন্যেও এই দ্বীপগুলি অতি ক্ষুদ্র। তবে ম্যারিনরা তাদের ‘হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম’ বা ‘হিমারস’কে অতি গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করবে। ‘প্রিসিশন স্ট্রাইক মিসাইল’ বা ‘পিআরএসএম’ প্রকল্পের অধীনে এই রকেট সিস্টেমের রকেটগুলিকে আরও উন্নত করে এগুলির পাল্লা এবং নিখুঁতভাবে আঘাত করার সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি করা হচ্ছে।


মার্কিন সামরিক ম্যাগাজিন ‘মিলিটারি ডট কম’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জেনারেল বারজারের পরিকল্পনা অনুসারে ম্যারিন কোরের খরচ কমানো হচ্ছে; যা বিনিয়োগ করা হবে নতুন সক্ষমতা অর্জনে। ট্যাংক ব্যাটালিয়নগুলি বাতিল করে দেয়ায় শতশত ম্যারিন সেনা হয় ইন্টেলিজেন্স, সাইবার বা লজিস্টিকসে নাম লেখাচ্ছে, অথবা সেনাবাহিনীতে চলে যাচ্ছে, অথবা চাকুরি থেকে অবসরে যাচ্ছে। প্রায় ১৩’শ ম্যারিনকে তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। ২০৩০ সাল নাগাদ ম্যারিন কোরের সদস্যসংখ্যা ১২ হাজার কমিয়ে ১ লক্ষ ৭৪ হাজারে নামিয়ে আনা হবে। ‘নেভি লীগ অব দ্যা ইউনাইটেড স্টেটস’এর পত্রিকা ‘সী পাওয়ার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ম্যারিন কোর তাদের পদাতিক ব্যাটালিয়নের সংখ্যা ২৪ থেকে ২১ নামিয়ে আনা ছাড়াও আর্টিলারি কামানের ব্যাটারির সংখ্যা ২১ থেকে মাত্র ৫টায় নামিয়ে আনবে। উভচর যানের কোম্পানির সংখ্যা ৬ থেকে ৪এ নামিয়ে আনা ছাড়াও হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রনের সংখ্যাও কমিয়ে আনা হবে। এছাড়াও ম্যারিন কোরের প্রতিটা ‘এফ ৩৫বি’ এবং ‘এফ ৩৫সি’ স্টেলথ ফাইটার স্কোয়াড্রনে ১৬টা বিমানের পরিবর্তে থাকবে মাত্র ১০টা বিমান।

বেঁচে যাওয়া অর্থ থেকে ম্যারিন কোর দূরপাল্লার নিখুঁত ক্ষেপণাস্ত্র, উন্নততর গোয়েন্দা সক্ষমতা, মনুষ্যবিহীর ড্রোন এবং শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করবে। চীনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বা দক্ষিণ চীন সাগর এবং পূর্ব চীন সাগরে ‘ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন’এর দ্বীপগুলি বেশ ছোট। ম্যারিনরা মনে করছে না যে, এই ছোট্ট দ্বীপগুলিকে দখলে নিতে ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতে হবে। আর চীনারাও হয়তো এই দ্বীপগুলি দখলে রাখতে ট্যাংক ব্যবহার করবে না। আর আর্টিলারি কামান ব্যবহার করার জন্যেও এই দ্বীপগুলি অতি ক্ষুদ্র। তবে ম্যারিনরা তাদের ‘হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম’ বা ‘হিমারস’কে অতি গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করবে। ‘প্রিসিশন স্ট্রাইক মিসাইল’ বা ‘পিআরএসএম’ প্রকল্পের অধীনে এই রকেট সিস্টেমের রকেটগুলিকে আরও উন্নত করে এগুলির পাল্লা এবং নিখুঁতভাবে আঘাত করার সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এছাড়াও ম্যারিন কোরের জন্যে নৌবাহিনীর ‘এনএসএম’ জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘টোমাহক’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ভার্সন ডেভেলপ করা হচ্ছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ব্যবহার করে ম্যারিনরা চীনের আশেপাশে সকল গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করছে।

 

নিজস্ব চিন্তার জোরে নয়, বরং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার চাপেই যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে নিজেদের সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে। প্রথমবারের মতো ছোট ছোট দ্বীপ এবং তৎসংলগ্ন দ্বীপাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের ‘অতি শক্তিশালী’ নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী নয়, বরং ম্যারিন কোরের সেনাদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে। কোরিয়া, জাপান, গুয়ামের ঘাঁটি এবং বিশাল বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ও উভচর জাহাজগুলি এখন চীনা ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থেকে নিরাপদ নয়; তাই তারা এখন ম্যারিন কোরের সেনাদের ছোট ছোট দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে পিছনে গিয়ে অবস্থান নিতে চাইছে।


জেনারেল বারজারের পরিকল্পনার সমালোচনাও হচ্ছে। মার্কিন নৌবাহিনীর প্রাক্তন সচিব জিম ওয়েব মত দিচ্ছেন যে, এই পুনর্গঠনের মাধ্যমে ম্যারিন কোরের কর্মকান্ডকে একেবারেই চীন কেন্দ্রিক করে ফেলা হচ্ছে; যেন তারা দক্ষিণ চীন সাগর ছাড়া আর কোথাও যুদ্ধ করবেই না। ওয়েব নিশ্চিত নন যে, এই যুদ্ধটাই একমাত্র যুদ্ধ হিসেবে মার্কিনীদের নেয়া উচিৎ কিনা। তিনি মনে করেন না যে, চীনারা ম্যারিন কোরের সক্ষমতাকে পেরিয়ে গেছে।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টানন্যাশনাল স্টাডিজ’ বা ‘সিএসআইএস’এর এক লেখায় জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক কানসিয়ান বলছেন যে, ম্যারিন কোরের এই পরিকল্পনায় ঝুঁকি কম নয়। ভবিষ্যৎটা কেমন হবে, সেটা এখন যেমন মনে হচ্ছে, তা যদি সামনের দিনগুলিতে অন্যরকম মনে হয়? অথবা এখন যেসব কনসেপ্ট ম্যারিন কোন ডেভেলপ করছে বিভিন্ন মহড়ার মাধ্যমে, তা যদি ভবিষ্যতে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে যতটা সহজ মনে হয়েছিল, ততটা না হয়? অর্থাৎ ম্যারিন কোর তাদের ভবিষ্যৎবাণী সঠিক হবার উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। এছাড়াও বৈশ্বিকভাবে জরুরি প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক মিশনে জড়াতে হয়, যেখানে বিভিন্ন বাহিনী প্রেরণ করতে হয়। ম্যারিন কোরকে এভাবে পরিবর্তন করে ফেললে মার্কিনীদের বৈশ্বিক অবস্থান ধরে রাখতে বাকি বাহিনীগুলিকে চাপের মাঝে পড়তে হবে।

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে দুই দশক ধরে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্র সারা মুসলিম বিশ্বে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ম্যারিন সেনাদেরও মোতায়েন করেছিল। ম্যারিনদের বিশেষ সক্ষমতা সর্বদাই ছিল উভচর অপারেশন; যা থেকে তারা বহুকাল দূরে থেকেছিল। এখন তারা সমুদ্রে ফেরত আসছে ঠিকই, কিন্তু ব্যাপক পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে। দুই দশক ধরে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসী’ দমন অভিযানে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ করার পর মার্কিনীরা হঠাত করেই চীনাদেরকে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে উত্থানে থাকা চীন এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলে মনে করছে মার্কিনীরা; যদিও এশিয়ার মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রই বাইরের শক্তি। এতকাল কোরিয়া উপদ্বীপে নিজেদের স্বার্থ ধরে রাখার ছুতোয় মার্কিনীরা জাপান এবং কোরিয়াতে ব্যাপক সামরিক শক্তি মোতায়েন রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান সক্ষমতা মার্কিনীদের এই অবস্থানকে হুমকির মাঝে ফেলে দিয়েছে। নিজস্ব চিন্তার জোরে নয়, বরং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার চাপেই যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে নিজেদের সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে। প্রথমবারের মতো ছোট ছোট দ্বীপ এবং তৎসংলগ্ন সমুদ্রাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের ‘অতি শক্তিশালী’ নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী নয়, বরং ম্যারিন কোরের সেনাদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে। কোরিয়া, জাপান, গুয়ামের ঘাঁটি এবং বিশাল বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ও উভচর জাহাজগুলি এখন চীনা ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র থেকে নিরাপদ নয়; তাই তারা এখন ম্যারিন কোরের সেনাদের ছোট ছোট দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে পিছনে গিয়ে অবস্থান নিতে চাইছে।

Wednesday 27 October 2021

ব্রিটেন কেন সামরিক প্রযুক্তি যোগাড়ে উঠেপড়ে লেগেছে?

২৭শে অক্টোবর ২০২১

ছবিঃ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর 'ব্ল্যাক হরনেট ন্যানো' ড্রোন। নিজের দুর্বলতাগুলিকে ব্রিটেন জয় করতে চাইছে ‘এআই’ প্রযুক্তির মাধ্যমে। ড্রোনের ঝাঁক, ফাইটার ড্রোন, গোয়েন্দা স্যাটেলাইট, লেজার অস্ত্র, কথা বলা ক্ষেপণাস্ত্র, মনুষ্যবিহীন বোট বা সাবমেরিন, ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই ব্রিটেন ‘এআই’এর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু ‘এআই’ ডেভেলপ করতে গিয়ে ব্রিটেনের যে জিনিসটা প্রথমেই দরকার তা হলো মেধা। সারা বিশ্ব থেকে মেধা আকর্ষণ করে ব্রিটেন ‘এআই মাস্টার্স’এর প্রফেশনাল তৈরি করতে চাইছে।

 
ব্রেক্সিটের পর ব্রিটিশ সরকার তাদের বৈশ্বিক কৌশল নির্ধারণ করার পর থেকে পুরো ব্রিটেন জুড়ে শুরু হয়েছে কর্মযজ্ঞ। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পুরো ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী বর্তমানে গবেষণা প্রকল্পের মাঝে ডুবে গেছে। ছোট আকৃতির মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান, মনুষ্যবিহীন গাড়ি বা পানির নিচের যান, ইত্যাদি এই গবেষণার মাঝে রয়েছে; যার কিছু রয়েছে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্যে; কিছু থাকবে অস্ত্রসজ্জিত। ২০২০এর নভেম্বরে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার জেনারেল নিক কার্টার ‘স্কাই নিউজ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, ২০৩০ সালের মাঝে তারা যে সামরিক বাহিনী তৈরি করতে চাইছেন, যেখানে বড় সংখ্যক স্বয়ংচালিত অথবা দূর নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন যে, ১ লক্ষ ২০ হাজার সদস্যের সেনাবাহিনীর মাঝে ৩০ হাজারই হয়তো রোবোট হতে পারে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটেন তার সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে করতে হিমসিম খাচ্ছে। ৮২ হাজার সেনার টার্গেটের তুলনায় বর্তমানে সেনা রয়েছে ৭৪ হাজারেরও কম। এখন টার্গেটকে ৭৫ হাজারের নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শূণ্যস্থানগুলির কিছু হয়তো পূরণ করা হতে পারে। তবে সেখানেও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ অনেকেই এখনও মনে করছেন যে, রোবোট হয়তো মানুষ খুন করার সিদ্ধান্ত দিতে এবং নিজে খুন করতে পারে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, রোবোটের হাতে গুলি করার সিদ্ধান্ত দেয়া হবে না। তথাপি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী এখন উন্নততর প্রযুক্তির মালিক হতে দিনরাত কাজ করতে শুরু করেছে; যেন তাদের হাতে সময় খুব বেশি একটা নেই। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ সরকার লক্ষ্য স্থির করেছে যে, ২০৩০ সালের মাঝে তারা ব্রিটেনকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বৈশ্বিক ‘সুপারপাওয়ার’ দেখতে চায়।

হাইপারসনিক এবং লেজার অস্ত্র ডেভেলপ করছে ব্রিটেন

গত মার্চে ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ব্রিটিশ সরকার তাদের নতুন নীতিপত্রে নতুন ধরনের অস্ত্র ডেভেলপ করতে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার বাজেট রেখেছে; যার মাঝে থাকবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং লেজার অস্ত্র। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন যখন হাইপারসনিক অস্ত্র ডেভেলপে বেশ এগিয়ে গেছে, তখন ব্রিটেনই এখানে সর্বশেষ খেলোয়াড় হিসেবে যোগ হতে চলেছে। হাইপারসনিক অস্ত্র হলো শব্দের পাঁচ গুণ বা তার চাইতেও বেশি দ্রুত চলা অস্ত্র। সাধারণ ব্যালিস্টক ক্ষেপণাস্ত্র অনেক উঁচু দিয়ে আক্রমণ করে বিধায় তা আগে থেকে দেখা যায় এবং দূরে থাকা অবস্থাতেই আটকানো যায়। কিন্তু হাইপারসনিক অস্ত্র বায়ুমন্ডলের মাঝ দিয়েই বেশিরভাগ সময় চলে বলে এটাকে আটকানো খুবই কঠিন। এধরনের অস্ত্র বা এর ইঞ্জিন ডেভেলপ করা কঠিন হলেও আরও বড় সমস্যা হলো, এত দ্রুত চালিত হলে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ক্ষেপণাস্ত্রের রাসায়নিক উপাদানগুলি পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। বাকিদের থেকে পিছিয়ে থাকলেও ব্রিটিশরা বলছে যে, তারা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’ ব্যবহার করে এর ডেভেলপমেন্ট দ্রুত এগিয়ে নিতে পারবে।

গত ১৪ই সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ সরকার ১’শ মিলিয়ন ডলার বাজেটে তিনটা প্রকল্পের কাজে হাত দেয়। ‘ডিরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন’ নামে আখ্যা দেয়া এই প্রকল্পগুলিকে সাধারণ মানুষ লেজার অস্ত্র বলেই চেনে। প্রকল্পগুলির দু’টা ব্যবহার করবে লেজার রশ্মি; বাকিটা ব্যবহার করবে ‘রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি’। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, ‘থালেস’ কোম্পানির নেতৃত্বে একটা কনসোর্টিয়াম একটা লেজার অস্ত্র তৈরি করে সেটা ব্রিটিশ রয়াল নেভির ‘টাইপ ২৩’ ফ্রিগেটের উপর পরীক্ষা করবে। ‘থালেস’এর নেতৃত্বে আরেকটা কনসোর্টিয়াম উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি ব্যবহার করে একটা অস্ত্র তৈরি করবে, যা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটা ট্রাকের উপর বসানো হবে। তৃতীয় প্রকল্পটা ‘রেথিয়ন’ কোম্পানির নেতৃত্বে একটা কনসোর্টিয়ামকে দেয়া হয়েছে; যারা আরেকটা লেজার অস্ত্র ডেভেলপ করে একটা সাঁজোয়া যানের উপর বসাবে। এই অস্ত্রগুলির মূল লক্ষ্য হবে শত্রুর ড্রোন বিমানগুলিকে টার্গেট করে ধ্বংস করা। প্রকল্পের কাজ ২০২৩ থেকে ২০২৫এর মাঝে শেষ হবে।

 
ছবিঃ ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন ধরনের মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান এবং গাড়ি পরীক্ষা করছে। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ অফিসার জেনারেল নিক কার্টার বলছেন যে, ২০৩০ সালের মাঝে তারা যে সামরিক বাহিনী তৈরি করতে চাইছেন, যেখানে বড় সংখ্যক স্বয়ংচালিত অথবা দূর নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন যে, ১ লক্ষ ২০ হাজার সদস্যের সেনাবাহিনীর মাঝে ৩০ হাজারই হয়তো রোবোট হতে পারে।

ড্রোন, ড্রোন এবং আরও ড্রোন

তবে শত্রুর ড্রোন ভূপাতিত করাই নয়, নিজেদের ড্রোন ডেভেলপ করার পিছনেও মনোযোগ দিয়েছে ব্রিটেন। সামরিক ম্যাগাজিন ‘আর্মি টেকনলজি’ বলছে যে, ২০১৯এর মার্চ মাসে ব্রিটিশ ড্রোন ডেভেলপার কোম্পানি ‘ব্লু বেয়ার’ ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের নতুন এক প্রকল্পের কাজ পায়; যার মাধ্যমে তারা ছোট ও মাঝারি আকৃতির ড্রোনের ঝাঁক ডেভেলপ করা শুরু করে। এর উদ্দেশ্য হলো এই ড্রোনগুলিকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে কাজে লাগানো; এবং একইসাথে শত্রুপক্ষের আকাশ ছেয়ে ফেলে সিদ্ধান্তহীনতার জন্ম দেয়া, যাতে তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাকে ছেড়ে কাকে টার্গেট করবে, সেটা ঠিক করতে না পারে। ছোট ড্রোনগুলি একদিকে যেমন স্বপক্ষের মানুষের জীবনের প্রতি হুমকি কমাবে, তেমনি হেলিকপ্টার বা এরকম কোন বিমানের স্থলাভিষিক্ত হয়ে অনেক কম খরচে মিশন সম্পাদন করবে। ড্রোনগুলি যেহেতু অনেক কম শব্দ উৎপন্ন করে, তাই সেগুলি খালি চোখে আকাশে খুঁজে পাওয়াও অপেক্ষাকৃত কঠিন হবে। ২০১৮ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ‘আর্মি ওয়ারফাইটিং এক্সপিরিয়েন্স ২০১৮’ মহড়ায় এটা প্রমাণিত হয় যে, সেনারা ছোট আকারের ড্রোন ব্যবহার করে বনভূমি এলাকায় শত্রুর লুকিয়ে থাকা অসম্ভব করে ফেলতে পারে।

শুধু ছোট ড্রোনের ঝাঁকই নয়, ব্রিটিশ সরকার ২০২১এর জানুয়ারিতে ‘প্রজেক্ট মসকিটো’ নামে একটা ড্রোন প্রকল্প শুরু করে। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, ৪১ মিলিয়ন ডলারের বাজেটের এই প্রকল্পে নেতৃত্ব দেবে ব্রিটিশ কোম্পানি ‘স্পিরিট এরোসিস্টেম’ এবং সাথে থাকবে ‘নর্থরোপ গ্রুমান’। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো ২০২৩ সালের মাঝে একটা ড্রোন ফাইটার বিমান ডেভেলপ করা, যা কিনা ‘লয়াল উইংম্যান’ কনসেপ্টকে এগিয়ে নেবে। এই কনসেপ্টের মাধ্যমে একটা মনুষ্যবিহীন ড্রোন ফাইটার একটা মনুষ্যচালিত ফাইটার বিমানের সাথে একত্রে কাজ করবে এবং একে অপরের কাজকে সহায়তা করবে। ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাইক উইগস্টন বলছেন যে, ব্রিটিশরা এক যুগান্তকারী দিকনির্দেশনা নিয়ে এগুচ্ছে, যার মাধ্যমে ড্রোনের ঝাঁক, ‘মসকিটো’র মতো মনুষ্যবিহীন ড্রোন ফাইটার, ভবিষ্যতের মনুষ্যচালিত ফাইটার ‘টেমপেস্ট’ মিলে যুদ্ধক্ষেত্রের হিসেবকেই পরিবর্তিত করে ফেলবে।

 
ছবিঃ ব্রিটিশ ব্যবসায়ী রিচার্ড ব্র্যানসনের 'বোয়িং ৭৪৭' বিমান থেকে রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানো হচ্ছে। স্বল্প খরচে স্যাটেলাইট পাঠানোর এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করছে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেই মহাকাশে গোয়েন্দা স্যাটেলাইট প্রেরণ করতে চাইছে।

গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের জগতে পা রাখছে ব্রিটেন


শুধু ড্রোন থেকেই নয়; ব্রিটিশরা চাইছে মহাকাশ থেকেও নিজেদের গোয়েন্দাগিরি বৃদ্ধি করতে। এতকাল মহাকাশের ইন্টেলিজেন্সের জন্যে ব্রিটিশরা প্রায় পুরোপুরিভাবে মার্কিনীদের উপরেই নির্ভরশীল ছিল। একটা স্যাটেলাইট ডেভেলপ করে সেটাকে মহাকাশে প্রেরণ করার বাজেট ব্রিটিশ অর্থনীতির জন্যে কঠিন ব্যাপার ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তির অগ্রগামিতার কারণে ব্রিটিশদের সামনে এক নতুন দুয়ার খুলে গেছে। ব্রিটিশ বিলিয়নায়ার ব্যবসায়ী রিচার্ড ব্র্যানসন ২০২১এর জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একটা ‘বোয়িং ৭৪৭’ বিমান ব্যবহার করে স্যাটেলাইটসহ একটা রকেট মহাকাশে প্রেরণ করেন। তার কোম্পানি ‘ভার্জিন অরবিট’ বিমানটাকে পরিবর্তিত করে একটা হাল্কা রকেট বহনের উপযোগী করে। ভূমি থেকে উৎক্ষেপিত না হবার কারণে রকেটটা অনেক ছোট। প্রযুক্তিগত কারণে এখন অনেক ছোট স্যাটেলাইট তৈরি সম্ভব হচ্ছে বিধায় এই ছোট রকেট দিয়েই স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ করা যাচ্ছে। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২০ সালের মে মাসে আরও একবার চেষ্টা করে বিফল হয়েছিল ‘ভার্জিন’। বিমানের নিচে বহণযোগ্য এই রকেটগুলি ব্যবহার করে ব্রিটিশরা সামরিক ইন্টেলিজেন্স স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ করতে চাইছে। এই স্যাটেলাইটগুলি ছোট আকারের এবং ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থেকে ভূমির হাই রেজোলিউশন ছবি তুলতে পারবে। ব্রিটেন এধরনের স্যাটেলাইট ডেভেলপ করে বন্ধু দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে। গত মে মাসে ‘ভার্জিন অরবিট’ ঘোষণা দেয় যে, তারা ব্রিটেনের কর্নওয়াল থেকে তাদের মহাকাশ অপারেশন শুরু করার জন্যে কাজ শুরু করেছে। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ইউরোপের মাটি থেকে মহাকাশে স্যাটেলাইট প্রেরণ করা হবে। এভাবে রিচার্ড ব্র্যানসনের বাণিজ্যিক প্রকল্পকে ব্রিটিশরা সামরিক ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি এগিয়ে নিতে ব্যবহার করবে। ব্রিটিশ সরকার স্কটল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে আরেকটা ‘স্পেসপোর্ট’ ডেভেলপ করার পরিকল্পনাতেও হাত দিয়েছে, যেখানে ভূমি থেকে রকেট উতক্ষেপণ করা যাবে।

প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘সিফোরআইএসআরনেট’এর সাথে এক সাক্ষাতে ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাইক উইগস্টন বলছেন যে, ব্রিটিশ সরকার চাইছে ‘লো আর্থ অরবিট’এ স্থাপনের যোগ্য ছোট স্যাটেলাইট; যেগুলি কি বহণ করবে বা মহাকাশে কোথায় স্থাপিত হবে বা কি লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে, তা ব্রিটিশরা নিজেরাই ঠিক করতে পারবে। একইসাথে তারা অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মাঝেই এই স্যাটেলাইটগুলি মহাকাশে প্রেরণ করতে পারবে। এর মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোন স্থানে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্রিটিশ সরকার নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স স্যাটেলাইট ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব স্পেস কমান্ড তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ করা জনগণকে একত্রে আনার ব্যবস্থা করেছে। এরা মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই কাজ করছিল এবং এদের স্যাটেলাইটের ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। মহাকাশে ব্রিটেনের বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই বেসরকারি খাতে হবে; সরকার এক্ষেত্রে সহায়তা দেবে মাত্র। সামরিক বাহিনী মহাকাশে ব্রিটেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলির নিরাপত্তা দেবে।

এবছরের জুলাই মাসে ব্রিটিশ সরকার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিতে নতুন এক প্রকল্প শুরু করে। ব্রিটেনের সামরিক গবেষণা সংস্থা ‘ডিফেন্স সায়েন্স টেকনলজি ল্যাবরেটরি’ বা ‘ডিএসটিএল’ প্রায় ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এর মাধ্যমে আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় একটা ক্ষেপণাস্ত্র আরেকটা ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। ব্রিটিশ সরকার বলছে যে, এতে ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তাদের টার্গেটের গুরুত্ব অনুসারে কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। বর্তমানে ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি শুধুমাত্র যেখান থেকে ছোঁড়া হয়েছে, যেমন বহণকারী যুদ্ধবিমানের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম। ‘কোঅপারেটিভ স্ট্রাইক ওয়েপন্স টেকনলজি ডেমোনস্ট্রেটর’ নামে আগামী দুই বছর ধরে এই প্রকল্প চলবে।

সমুদ্রে প্রযুক্তি ডেভেলপ করছে রয়াল নেভি

ব্রিটিশ রয়াল নেভি গত মার্চ মাসে মনুষ্যবিহীন প্যাট্রোল বোট ‘ম্যাডফক্স’এর ডেলিভারি পেয়েছে। রয়াল নেভির প্রযুক্তিগত গবেষণা সংস্থা ‘নেভিএক্স’এর অধীনে পরিচালিত হওয়া এই প্রকল্পে ‘এল থ্রি হ্যারিস’ কোম্পানির ‘মাস্ট ১৩’ বোটকে ব্যবহার করে ১৮ মাস ধরে পরীক্ষা করা হয়। এবছরের শেষে ব্রিটিশ নৌবাহিনী আরেকটা মনুষ্যবিহীন বোটের ডেলিভারি পাবে। ‘নেভাল টেকনলজি’ ম্যাগাজিন বলছে যে, এই বোটগুলি নৌবাহিনী ছাড়াও রয়াল ম্যারিনের সদস্যরা ব্যবহার করবে। ‘নেভিএক্স’এর প্রধান কমান্ডার এন্টনি ক্র্যাব বলছেন যে, পরীক্ষামূলক এই কর্মকান্ডগুলি বলে দেবে যে, সামনের দিনগুলিতে রয়াল নেভির ‘টাইপ ২৬’ এবং ‘টাইপ ৩১’ ফ্রিগেটের উপর এধরণের প্রযুক্তিগুলি কিভাবে মোতায়েন হবে।

এছাড়াও রয়াল নেভি ২০১৯ সালে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক সেক্টরের সাথে পার্টনারশিপের মাধ্যমে প্রযুক্তি ডেভেলপ করার কাজে হাত দিয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘ইউকে ডিফেন্স সলিউশন্স সেন্টার’ বা ‘ইউকেডিএসসি’ এই প্রকল্পে বেসামরিক সংস্থা ‘সাবসী ইউকে’ এবং ‘ন্যাশনাল সাবসী রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর সাথে এই কাজ বাস্তবায়ন করছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, এর মাধ্যমে বেসামরিক এবং সামরিক গবেষকেরা সমুদ্রের নিচে কাজ করার প্রযুক্তিগত উতকর্ষতা নিয়ে কাজ করবে। এই প্রযুক্তির মাঝে থাকবে রোবোটিক্স, মনুষ্যবিহীণ যন্ত্রপাতি এবং ডিজিটাল যোগাযোগ। এতে বেসামরিক এবং সামরিক গবেষকেরা একে অপরের কাছ থেকে শিখবে। ‘ইউকেডিএসসি’এর ওয়েবসাইট বলছে যে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে পানির নিচে বিভিন্ন সেন্সর ব্যবহার এবং সেগুলি থেকে ডাটা সংগ্রহ ও স্টোর করা ছাড়াও সেই ডাটা যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য করা হবে। তাছাড়া পানির নিচে অপারেশন চালনা করার অভিজ্ঞতাও এই প্রকল্পের মাধ্যমে শেয়ার করা সম্ভব হবে। ‘সাবসী ইউকে’ হলো ব্রিটেনের সমুদ্রের নিচে প্রযুক্তি ডেভেলপ করার সর্বোন্নত সংস্থা। এরা মূলতঃ তেল গ্যাস আহরণের কাজে সহায়তা দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রের মাঝে বায়ু বিদ্যুৎ উতপাদন এবং সেগুলির ব্যবস্থাপনা তাদের একটা বড় কাজ হয়ে গেছে।

 
ছবিঃ ব্রিটিশ রয়াল নেভি এবং রয়াল ম্যারিনের জন্যে ডেভেলপ করা মনুষ্যবিহীন বোট 'ম্যাডফক্স'। সামরিক প্রযুক্তিতে আগামী এক দশকে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার যে টার্গেট নিয়ে এগুচ্ছে ব্রিটিশ সরকার, তার ভিত্তি মূলতঃ ব্রিটেনের শিক্ষা সেক্টরে। শিক্ষা সেক্টরে ব্রিটেনের প্রধান ফোকাস হলো ‘এআই’, যা ডেভেলপ করতে গেলে ব্রিটিনের নিজস্ব মেধা যথেষ্ট নয়; বরং সারা বিশ্বের সেরা মেধাগুলিকে ব্রিটিশ পতাকাতলে আনতে হবে। কিন্তু যেখানে পশ্চিমা আদর্শই মারাত্মক সমস্যায় জর্জরিত রয়েছে, সেখানে সেই আদর্শিক সমস্যার বেড়াজাল পেরিয়ে অন্যের সম্পদ ব্যবহার করে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ তার বৈশ্বিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে কতটা সফলতা পাবে, তা প্রশ্ন করা যেতেই পারে।



সারা বিশ্বের সেরা মেধা ব্যবহার করে নেতৃত্ব দিতে চাইছে ব্রিটেন

ব্রিটেনের প্রযুক্তি ডেভেলপ করার একেবারে মূলে রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’। ব্রিটেন ‘এআই’এর উপর নির্ভর করেই প্রযুক্তির শিখরে পৌঁছাতে চাইছে। মার্কিন বা চীনা বাজেটের তুলনায় ব্রিটেনের প্রযুক্তি বাজেট কিছুই নয়। ব্রিটেন তার বর্তমান সামরিক বাহিনীকে আকারে ছোট করে অর্থ বাঁচাচ্ছে; আর সেই অর্থ বিনিয়োগ করছে নতুন প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে। কিছু ক্ষেত্রে, যেমন হাইপারসনিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্রিটেন পিছিয়ে আছে। এই দুর্বলতাগুলিকে ব্রিটেন জয় করতে চাইছে ‘এআই’ প্রযুক্তির মাধ্যমে। ড্রোনের ঝাঁক, ফাইটার ড্রোন, গোয়েন্দা স্যাটেলাইট, লেজার অস্ত্র, কথা বলা ক্ষেপণাস্ত্র, মনুষ্যবিহীন বোট বা সাবমেরিন, ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই ব্রিটেন ‘এআই’এর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে চাইছে। কিন্তু ‘এআই’ ডেভেলপ করতে গিয়ে ব্রিটেনের যে জিনিসটা প্রথমেই দরকার তা হলো মেধা।

ব্রিটিশ সরকারের ওয়েবসাইট বলছে যে, সারা বিশ্ব থেকে মেধা আকর্ষণ করে ব্রিটেন ‘এআই মাস্টার্স’এর প্রফেশনাল তৈরি করতে চাইছে। ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিশেষ ‘সেন্টার’ তৈরি করে তারা পরবর্তী জেনারেশনের ‘এআই পিএইচডি’ তৈরি করবে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হয় ‘এলান টুরিং ইন্সটিটিউট’এর ‘এআই’ রিসার্স ফেলোশিপ; যা এখন এখন সকলের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়েছে। ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কমপক্ষে ২’শ ‘এআই’ মাস্টার্স ছাত্রকে নিজস্ব অর্থে পড়াচ্ছে ‘ডিপ মাইন্ড’, ‘কোয়ান্টাম ব্ল্যাক’, ‘সিসকো’ এবং ‘ব্রিটিশ এরোস্পেস সিস্টেমস’এর মতো কোম্পানিগুলি। ১৬টা ‘ইউকে রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন এআই সেন্টার্স ফর ডকটরাল ট্রেনিং’এ ১ হাজার ছাত্রকে পড়ার সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকারের এই প্রকল্পগুলি বলে দিচ্ছে যে, সামরিক প্রযুক্তিতে আগামী এক দশকে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার যে টার্গেট নিয়ে এগুচ্ছে ব্রিটিশ সরকার, তার ভিত্তি মূলতঃ ব্রিটেনের শিক্ষা সেক্টরে। শিক্ষা সেক্টরে ব্রিটেনের প্রধান ফোকাস হলো ‘এআই’, যা ডেভেলপ করতে গেলে ব্রিটিনের নিজস্ব মেধা যথেষ্ট নয়; বরং সারা বিশ্বের সেরা মেধাগুলিকে ব্রিটিশ পতাকাতলে আনতে হবে। ব্রেক্সিট পরবর্তী ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সর্বদাই ব্রিটেনের নিজস্ব সম্পদকে ছাপিয়ে গেছে। তবে অন্যান্য রাষ্ট্র এবং অঞ্চলের সম্পদ ও মেধা ব্রিটেন নিজস্ব জাতীয় স্বার্থে কতটা ব্যবহার করতে পারবে, তা নির্ভর করছে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় ব্রিটেনের আদর্শিক নেতৃত্ব নিতে পারার সক্ষমতার উপর। কিন্তু যেখানে পশ্চিমা আদর্শই মারাত্মক সমস্যায় জর্জরিত রয়েছে, সেখানে সেই আদর্শিক সমস্যার বেড়াজাল পেরিয়ে অন্যের সম্পদ ব্যবহার করে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ তার বৈশ্বিক আকাংক্ষা বাস্তবায়নে কতটা সফলতা পাবে, তা প্রশ্ন করা যেতেই পারে।

Saturday 23 October 2021

তুরস্ক কি আফ্রিকাতে সামরিক শক্তি হিসেবে রূপ নিচ্ছে?

২৩শে অক্টোবর ২০২১

এরদোগানের কাছে তুর্কি জনগণের আবেগকে জাগিয়ে রাখাটাই ক্ষমতায় টিকে থাকার ফাউন্ডেশন। তবে তুর্কি জনগণের আবেগকে ব্যবহার করতে গিয়ে তুরস্ক তার নীতিকে যতটা বহির্মুখী করবে, ততই আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিদের সাথে প্রতিযোগিতার মাঝে পড়বে। আফ্রিকা তুরস্কের জন্যে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে বড় শক্তিদের সাথে প্রতিযোগিতায় তুরস্ক নিজেদের জন্যে আলাদা জায়গা করে নিতে চাইছে। তুরস্কের ড্রোনগুলি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এতে ফ্রান্সের দুশ্চিন্তাই হবে সবচাইতে বেশি; কারণ ঔপনিবেশিক শক্তিদের মাঝে দুর্বল হয়ে পড়া ফ্রান্সেরই প্রভাব হারাবার ভয়ে থাকবে সবচাইতে বেশি।

 
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান পশ্চিম আফ্রিকার তিন দেশ এঙ্গোলা, টোগো এবং নাইজেরিয়া ঘুরে এসেছেন। এর মাধ্যমে ৩০টা দেশ ভ্রমণ করে তিনি আফ্রিকায় সবচাইতে বেশি দেশ ভ্রমণকারী রাষ্ট্রনায়ক হলেন। নাইজেরিয়া এবং এঙ্গোলার জ্বালানি ও খনিজ সম্পদে তুর্কি বিনিয়োগ এবং দেশগুলির সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধির খবরগুলিই মিডিয়াতে এসেছে বেশি। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, আফ্রিকাতে তুরস্কের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলেও তা এখনও ইউরোপের সাথে বাণিজ্যের তুলনায় কিছুই নয়। তবে আফ্রিকায় তুরস্কের কর্মকান্ড বৃদ্ধির ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়; রয়েছে অন্য কোথাও। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি জিরো মিডিয়া’র এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, তুরস্ক আফ্রিকাতে বড় শক্তিগুলির সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতা না করে নিজেদের জন্যে কিছু জায়গা বের করে নিয়েছে; যেখানে তারা বেশ সাফল্য পাচ্ছে। তুরস্কের সবচাইতে বড় সুবিধা হলো, তারা ফ্রান্স, ব্রিটেন বা বেলজিয়ামের মতো উপনিবেশিক শক্তি নয়; এমনকি বর্তমান যুগের বড় শক্তিগুলির একটাও তারা নয়। একইসাথে তুরস্ক নিজেদেরকে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মতো আগ্রাসী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে না।

আফ্রিকায় তুরস্কের মূল লক্ষ্য কি ড্রোন বিক্রি?


‘মিডলইস্ট আই’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তুর্কি প্রেসিডেন্টের আফ্রিকায় তিন দেশ সফরের ঘটনা তুর্কি মিডিয়াতে খুব কমই এসেছে। বরং পত্রিকাগুলি সরকারি প্রেসনোটকেই মূলতঃ হাইলাইট করেছে; যার মাঝে মূল বক্তব্য ছিল আফ্রিকায় তুরস্কের মানবকল্যাণমূলক কর্মকান্ড এবং উপনিবেশিকতা বিমুখ দিকনির্দেশনা। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত দুই দশকে আফ্রিকাতে তুরস্ক তার কূটনৈতিক মিশনের সংখ্যা ১২ থেকে ৪৩শে উন্নীত করা হয়েছে; বাণিজ্য ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে; বিনিয়োগ ১’শ মিলিয়ন ডলার থেকে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে; ৬ হাজার আফ্রিকান ছাত্র তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপে পড়ছে। ‘টারকিশ এয়ারলাইন্স’ আফ্রিকার ৩৯টা দেশের ৬০টা গন্তব্যে যাচ্ছে; যার মাধ্যমে আফ্রিকা এবং বাকি বিশ্বের মাঝে হাব হয়ে যাচ্ছে ইস্তাম্বুল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকার কিছু অংশে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং বিভিন্ন দেশে তুর্কিদের তৈরি মনুষ্যবিহীন ড্রোনের বাজার তৈরি হওয়ায় বিশ্লেষকেরা প্রশ্ন করছেন যে, আফ্রিকায় তুরস্ক তার কৌশল পরিবর্তন করে আঞ্চলিক খেলা পরিবর্তন করার মতো অবস্থানে যাবার চেষ্টা করছে কিনা। জার্মানির ‘ইউনিভার্সিটি অব বেইরিউথ’এর গবেষক ইব্রাহিম বাকির আব্দুলাই মনে করছেন যে, সোমালিয়া, লিবিয়া এবং পশ্চিম আফ্রিকায় তুরস্কের ভূমিকা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, তুরস্ক আফ্রিকা জুড়েই তার প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।

সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের তৈরি ড্রোন সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজেরবাইজানে ব্যাপক সাফল্য পাবার পর তুর্কিরা প্রচুর ড্রোনের অর্ডার পেতে শুরু করেছে। ইউক্রেন এবং পোল্যান্ডের কাছে তুর্কি ড্রোন বিক্রয়ের খবর এসেছে। মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তান প্যারেডে তুর্কি ড্রোন দেখিয়েছে; কিরগিজস্তানও একই ড্রোন অর্ডার করেছে বলছে। এমনকি ব্রিটিশরাও এতে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়াতে তুর্কি ড্রোন বিক্রি হয়েছে, যদিও এই মুহুর্তে তিউনিসিয়ার ক্ষমতা নেয়া প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। মরক্কোতেও তুরস্কের ড্রোন বিক্রি হয়েছে; যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল পশ্চিম সাহারা নিয়ে মরক্কো এবং আলজেরিয়ার মাঝে ব্যাপক বিরোধ রয়েছে। তুরস্ক দুই দেশের সাথেই সম্পর্ক রেখে চলেছে। ‘আফ্রিকান ইন্টেলিজেন্স’ খবর দিচ্ছে যে, মোজাম্বিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত রুয়ান্ডার সেনবাহিনী তুর্কি ড্রোন কেনার চিন্তা করছে। কিছুকাল আগ পর্যন্তও তুর্কিরা রুয়ান্ডায় কিছু বড় অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করছিল; এখন সেখানে প্রতিরক্ষাও যোগ হলো। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, অফিশিয়ালি ঘোষণা না আসলেও ইথিওপিয়াও তুরস্কের কাছ থেকে ড্রোন কেনার ব্যাপারে একমত হয়েছে। ইথিওপিয়া বর্তমানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তিগ্রে অঞ্চলের সাথে প্রায় এক বছর ধরে ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে আছে। ইথিওপিয়াতে তুরস্কের বড় রকমের বিনিয়োগ রয়েছে টেক্সটাইল সেক্টরে। দেশটার বড় বড় অবকাঠামোর কাজও তুর্কিরা করছে। নাইজেরিয়াও তার উত্তরাঞ্চলে বোকো হারামের সাথে যুদ্ধে তুর্কি ড্রোন ব্যবহার করতে চাইছে। এঙ্গোলাও তুর্কি ড্রোনের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে।

আঙ্কারার ‘ফরেন পলিসি সেন্টার’এর ফেলো এমরে চালিসকান বলছেন যে, তুরস্ক মূলতঃ মাঝারি আকৃতির ব্যবসাগুলিতে বিনিয়োগ করেছে; বড় আকারের ব্যবসায় নয়। অর্থাৎ আফ্রিকার সাথে তুরস্কের ব্যবসার প্রসার আসলে খুব বড় কিছু নয়। তবে প্রতিরক্ষা খাতে বিক্রির ব্যাপারগুলি আলাদা; কারণ এর মাঝে থাকে অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তির আদানপ্রদান এবং গভীরতর সহযোগিতা। অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, তুরস্ক কি আফ্রিকাতে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা রাশিয়ার প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করছে কিনা। তারা বলছেন যে, লিবিয়াতে এবং আজেরবাইজানে তুর্কি ড্রোন যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পেরেছিল। লিবিয়ার যুদ্ধে পরিবর্তন আনার পরপরই তুরস্ক আফ্রিকাতে শুধুমাত্র মানবিক সহায়তা প্রদানকারী থেকে সামরিক শক্তিতে পরিণত হতে শুরু করে। চালিসকান বলছেন যে, লিবিয়াকে কেন্দ্র করেই আশেপাশের দেশগুলিতে তুরস্ক সামরিক শক্তি হতে চাইছে। তবে লিবিয়ার বাইরে সামরিক ঘাঁটি রাখার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা তুরস্কের নেই। অপরদিকে চীনারা অস্ত্রও বিক্রি করছে; আবার বিশাল আকারের ঋণও দিচ্ছে।

ইস্তাম্বুলের ‘ইয়েদিতেপে ইউনিভার্সিটি’র এসিসট্যান্ট প্রফেসর ভোলকান ইপেক বলছেন যে, তুরস্কের আফ্রিকায় যাওয়া দেখিয়ে দেয় যে, তারা তাদের আশেপাশের দেশের মাঝে আর কূটনৈতিক কর্মকান্ডকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চাইছে না। এক্ষেত্রে ইউরোপিয় শক্তিদের তুলনায় তুরস্ক এগিয়ে আছে; কারণ তুরস্কের কোন ঔপনিবেশিক ইতিহাস নেই।

 
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুহারি। তুরস্ক তার নিজের জন্যে একটা আলাদা স্থান করে নিতে চাইছে। আরও শক্তিশালী কূটনীতির দিকে যেতে চাইছে তুরস্ক; যেখানে আফ্রিকার দেশগুলি তুরস্কের সাথে পার্টনারিশিপে নিজেরাও লাভবান হবে। উদাহরণস্বরূপ, নাইজেরিয়া চাইছে তার এলএনজির জন্যে বাজার খুঁজতে; যেখানে তুরস্ক এগিয়ে এসেছে নাইজেরিয়ার গ্যাস অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে।

তুরস্ক আফ্রিকাতে কার সাথে প্রতিযোগিতা করছে?

‘জি জিরো মিডিয়া’ বলছে যে, আফ্রিকাতে তুরস্কের কর্মকান্ড যার জন্যে সবচাইতে বেশি হুমকির সৃষ্টি করেছে, সে হলো ফ্রান্স। পশ্চিম আফ্রিকায় তুরস্কের অবস্থানের ব্যাপারে সবচাইতে বিরক্ত ফ্রান্স। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ সরাসরিই বলেছেন যে, তুরস্ক আফ্রিকাতে ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। ফরাসি মিডিয়াতে এরদোগানের আফ্রিকা সফরে সাধারণ বাণিজ্যের তুলনায় ড্রোন বাণিজ্যকেই বেশি হাইলাইট করা হয়েছে। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর এক প্রতিবেদনে আফ্রিকাতে তুরস্কের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে; কারণ তুর্কি মুদ্রা লিরা এখন যথেষ্টই দুর্বল; মুদ্রাস্ফীতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে; দেশটার ব্যাংকিং সেক্টরের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এমতাবস্থায় ডিসেম্বর মাসে ইস্তাম্বুলে তুরস্ক আফ্রিকা শীর্ষ বৈঠককে কতটুকু স্বার্থক করা সম্ভব? ইতালির ‘ইউনিভার্সিটি অব জেনোয়া’র ফেডেরিকো ডনেলি বলছেন যে, প্রতিবারই আফ্রিকার সাথে তুরস্কের শীর্ষ বৈঠক তুর্কিদের নতুন নীতিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এখন নতুন যে দিকটাকে তুর্কিরা গুরুত্ব দিচ্ছে, তা হলো নিরাপত্তা। ড্রোন বিক্রির মাধ্যমে তুর্কিরা আফ্রিকার দেশগুলির সাথে একরকমের দরকষাকষিতে যেতে পারছে; কারণ পশ্চিমাদের ড্রোনগুলির চাইতে কমদামি হলেও তুর্কি ড্রোনগুলির কর্মক্ষমতা যথেষ্ট। আফ্রিকার দেশগুলির নিরাপত্তার জন্যে এই ড্রোনগুলি বড় সুবিধা দিচ্ছে।

ইস্তাম্বুলের সাংবাদিক বারসিন ইনান্স বলছেন যে, এরদোগানের আফ্রিকা সফর তুরস্কের চাইতে ইউরোপেই বেশি আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। ইউরোপিয় মিডিয়াতে এব্যাপারে যত বিতর্ক হচ্ছে, তা তুরস্কে প্রায় কখনোই দেখা যায় না। তুরস্কের আফ্রিকা নীতিতে পরিবর্তন এরদোগানের আগেই শুরু হলেও সকলে এব্যাপারে এরদোগানকেই ক্রেডিট দিচ্ছেন। তুরস্কের জ্বালানি উৎসকে আরও শক্ত ভিত দিতে তুরস্ক নাইজেরিয়া থেকে এলএনজি আমদানিতে গুরুত্ব দিতে চাইছে। এই ব্যাপারটা যতটা না হাইলাইট হয়েছে, তার চাইতে ড্রোন বিক্রি নিয়েই কথা হচ্ছে বেশি। নাইজেরিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট নাজিম আনিমাশাউন মনে করেননা যে তুরস্ক আফ্রিকাতে কাউকে প্রতিস্থাপিত করতে চাইছে। তিনি বলছেন যে, তুরস্ক তার নিজের জন্যে একটা আলাদা স্থান করে নিতে চাইছে। আরও শক্তিশালী কূটনীতির দিকে যেতে চাইছে তুরস্ক; যেখানে আফ্রিকার দেশগুলি তুরস্কের সাথে পার্টনারিশিপে নিজেরাও লাভবান হবে। উদাহরণস্বরূপ, নাইজেরিয়া চাইছে তার এলএনজির জন্যে বাজার খুঁজতে; যেখানে তুরস্ক এগিয়ে এসেছে নাইজেরিয়ার গ্যাস অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে। যখন পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলি নিজেদের কর্মকান্ড কমিয়ে ফেলতে চাইছে, তুরস্ক ঠিক সেখানেই নিজেদের জায়গা করে নিতে চাইছে। তুর্কি সাংবাদিক বারসিন ইনান্স বলছেন যে, ইস্তাম্বুলে আসন্ন আফ্রিকা শীর্ষ বৈঠক খুব সহজেই অন্যান্য ইস্যুর নিচে পড়ে যেতে পারে। কারণ তুরস্কের আশেপাশে সিরিয়া, রাশিয়া, ইরাক, ইরান, গ্রিসসহ আরও অনেক ইস্যু রয়েছে; যেগুলি যেকোন সময় সামনে চলে আসতে পারে এবং সেই ইস্যুগুলিকেই মিডিয়া আফ্রিকার চাইতে বেশি গুরুত্ব দিতে পারে। এমনকি তুরস্কে বড় কোন ইস্যু তৈরি না হলেও হয়তো আফ্রিকা শীর্ষ বৈঠক তুর্কি মিডিয়াতে অতবড় হেডলাইন হবে না। তুরস্কের আফ্রিকা নীতি সরকারের কাছে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণ জনগণের কাছে ততটা নয়। তবে তুর্কি ব্যবসায়ীরা আফ্রিকার ব্যাপারে যথেষ্টই আগ্রহী। তুর্কি চিন্তাবিদদের মাঝেও খুব কম সংখ্যক আফ্রিকা নিয়ে কথা বলছেন।

তুর্কিরা তাদের উসমানি খিলাফতের ইতিহাসের স্বপ্নে বিভোর। তাই উসমানি সময়ে তুর্কিদের প্রভাবের মাঝে থাকা এলাকাগুলিকেই তুরস্ক টার্গেট করছে। এরদোগানও তুর্কি জনগণের এই আবেগকে কাজে লাগাতে চাইছেন। তবে আফ্রিকা এখনও তুর্কিদের চিন্তায় বেশ ছোট। আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় তুরস্ক এখন সর্বদাই সিরিয়া, রাশিয়া, ককেশাস, ইরাক, ইরান, গ্রিস, ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে জর্জরিত; যা কিনা তুর্কি মিডিয়াকে আফ্রিকার ব্যাপারে অনাগ্রহী রেখেছে। এর মাঝে তুরস্কের অর্থনীতি চলছে ধুঁকে ধুঁকে। তুর্কি লিরার ব্যাপক দরপতন এবং মারত্মক মূল্যস্ফীতিই জনগণকে ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্যে যথেষ্ট; যা কিনা সামনের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হবে। এমতাবস্থায় এরদোগানের কাছে তুর্কি জনগণের আবেগকে জাগিয়ে রাখাটাই ক্ষমতায় টিকে থাকার ফাউন্ডেশন। তবে তুর্কি জনগণের আবেগকে ব্যবহার করতে গিয়ে তুরস্ক তার নীতিকে যতটা বহির্মুখী করবে, ততই আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিদের সাথে প্রতিযোগিতার মাঝে পড়বে। আফ্রিকা তুরস্কের জন্যে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে বড় শক্তিদের সাথে প্রতিযোগিতায় তুরস্ক নিজেদের জন্যে আলাদা জায়গা করে নিতে চাইছে। তুরস্কের ড্রোনগুলি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এতে ফ্রান্সের দুশ্চিন্তাই হবে সবচাইতে বেশি; কারণ ঔপনিবেশিক শক্তিদের মাঝে দুর্বল হয়ে পড়া ফ্রান্সেরই প্রভাব হারাবার ভয়ে থাকবে সবচাইতে বেশি।

Friday 22 October 2021

‘অকাস’ চুক্তির যে ব্যাপারটা নিয়ে কেউ কথা বলছে না…

২২শে অক্টোবর ২০২১


 
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে স্বাক্ষরিত ‘অকাস’ কৌশলগত চুক্তির মাঝে যে ব্যাপারটা মিডিয়াতে বেশি হাইলাইট হয়েছে, তা হলো অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা। তবে অনেকেই হয়তো খেয়াল করেনি যে, এই চুক্তির আরও কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সাইবার নিরাপত্তা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’ এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। পারমাণবিক সাবমেরিনের পরিকল্পনার কারণে ফ্রান্সের কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়ার ডিজেল সাবমেরিন কেনার বড় রকমের চুক্তিও বাতিল হয়ে যায়। ফ্রান্স এই চুক্তির ব্যাপারে একেবারেই অবগত না থাকার কারণে এবং নিজেদের সাবমেরিন বিক্রির চুক্তি বাতিল হবার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পাঠায়। এমনকি ফরাসিরা এই চুক্তিকে ফ্রান্সের পিছন থেকে ছুরি মারার সাথেও তুলনা করে। ফ্রান্সের সাথে কূটনৈতিক এই দ্বন্দ্ব কিছু সময়ের জন্যে আন্তর্জাতিক হেডলাইন কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু কখনোই সাইবার নিরাপত্তা এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হাইলাইট হয়নি। কিছু কৌশলগত বিশ্লেষকেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, চুক্তির এই অংশটা চীনের সাথে প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের জন্যে অনেক বড় পদক্ষেপ ছিল।

মার্কিন সেনাবাহিনীর সাইবার কমান্ডের প্রাক্তন প্রধান কৌশলী নিকোল কামারিলো এবং ব্রিটিশ সরকারের ‘ডিজিটাল সার্ভিস’এর ডেপুটি ডিরেক্টর অলিভার লুইস সামরিক ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক লেখায় বলছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার সাথে সাবমেরিনের চুক্তিটা ছিল আরও বড় কর্মকান্ডের জন্যে ‘ডাউনপেমেন্ট’; উন্নততর প্রযুক্তি ডেভেলপ করার পিছনে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধুদের প্রতিশ্রুতি। এই প্রযুক্তির মাঝে রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং আরও কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি, যেখানে পশ্চিমারা এখন চীনাদের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতার মাঝে রয়েছে। তারা যুক্তি দিচ্ছেন যে, নতুন যুগের ডিটারেন্স বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, বোমারু বিমান বা সাবমেরিনের উপরে তেমন নির্ভরশীল নয়; বরং সেখানে মূল নির্ভরশীলতা থাকবে সফটওয়্যারের শক্তি, দ্রুতি এবং টিকে থাকার সক্ষমতার উপর। চীনা সরকার এই ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার জন্যেই প্রচুর বিনিয়োগ করছে এবং তাদের কাছে ১’শ ৪০ কোটি মানুষের বিশাল ডাটাবেস তো রয়েছেই। চীনারা বেসরকারি খাতকেও সামরিক প্রযুক্তি ডেভেলপ করতে বলছে।

কামারিলো এবং লুইস বলছেন যে, চীনা কর্মকান্ডকে মোকাবিলা করার জন্যে পশ্চিমাদেরকে ‘এআই’ ডেভেলপ করায় সহযোগিতা বাড়ানো ছাড়াও সম্ভব সবচাইতে বড় ডাটাবেস যোগাড় করতে হবে; যার মাঝে তারা ‘এআই’কে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। তবে পশ্চিমারা যেখানে চীনাদের থেকে এগিয়ে আছে, তা হলো ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স জোট; যার মাঝে অকাসের যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে রয়েছে কানাডা এবং নিউজিল্যান্ড। লেখকেরা বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের ইন্টেলিজেন্স সহযোগিতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিকে পরাজিত করেছিল। এরপর ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ‘ফাইভ আইজ’ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জিততে সহায়তা দিয়েছে। আর বর্তমানে ইন্টেলিজেন্স জোগাড় এবং বিশ্লেষণ পুরোটাই যেহেতু ডিজিটাল ডোমেইনে হয়ে থাকে, তাই সেখানে নেটওয়ার্কে যুক্ত সেন্সর, ‘এআই’এর এলগোরিদমের মাধ্যমে ডাটা প্রসেসিং ইত্যাদি অতি গুরুত্বপূর্ণ। ‘এআই’ ব্যবহার করা না হলে তা সাইবার আক্রমণের শিকার হবে; আর এটাকে রক্ষা করা না গেলে ‘এআই’এর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে চলে যাবে। কামারিলো এবং লুইস প্রস্তাব দিচ্ছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বন্ধু দেশগুলিকে পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে সকলেই বুঝতে পারে যে, ‘এআই’ প্রকৃতপক্ষে ভালো কাজে ব্যবহার হবে; মানুষকে নিয়ন্ত্রণের কাজে নয়। আর মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ‘এআই’ কাজ করবে না কখনোই।

অস্ট্রেলিয়ার নীতিগত ফোরাম ‘ইস্টএশিয়া ফোরাম’এর এক লেখায় ‘স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি’র গবেষক আরজান তারাপোর বলছেন যে, ‘অকাস’ চুক্তি ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স জোটকে ছাপিয়ে উন্নততর প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এবং ইন্ডাস্ট্রিকে একত্রে নিয়ে এসেছে। সামরিক প্রযুক্তি শেয়ার করাটা নতুন নয়; তবে কিছু প্রযুক্তি অন্যগুলি থেকে একটু বেশিই দামি। যেমন পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা যুদ্ধের চরম পর্যায়ে শুধুমাত্র ব্রিটেনের সাথে শেয়ার করেছে। এখন বেশ কয়েক দশক পর তারা একই প্রযুক্তি অস্ট্রেলিয়াকে দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু কেন? কারণ ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স জোটের মাধ্যমে এই দেশগুলি ইন্টেলিজেন্স জোগাড় এবং শেয়ার করার জন্যে বহুকাল ধরে যৌথ সিস্টেম, সংস্থা ও প্রসেস ডেভেলপ করেছে। ‘ফাইভ আইজ’এর পার্টনারদেরকেই ওয়াশিংটন বিশ্বাস করছে; কারণ ওয়াশিংটন ‘অকাস’এর মাধ্যমে এমন সকল প্রযুক্তি শেয়ার করতে যাচ্ছে, যা কিনা তারা তাদের সবচাইতে কাছের ইন্টেলিজেন্স পার্টনারদের সাথেই শেয়ার করবে। ‘এআই’, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং সাইবার প্রযুক্তিই সামনের দিনগুলিতে ইন্টেলিজেন্স সক্ষমতার সর্বসন্মুখে থাকবে। আরজান তারাপোর বলছেন যে, ফ্রান্স এই ‘ফাইভ আইজ’এর অংশ না থাকার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সকে ‘অকাস’এ রাখতে চায়নি।

তারাপোর প্রস্তাব দিচ্ছেন যে, ‘অকাস’কে যদি আঞ্চলিক পার্টনারদের কাছে আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে হয়, তাহলে ফ্রান্স এবং ভারতের মতো বন্ধুদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রযুক্তি এবং ডাটা শেয়ার করতে হবে। এই দেশগুলি’ ‘অকাস’এর মাঝে না থকলেও এদের গুরুত্ব অনেক। ‘অকাস’ সকল কিছু করতে পারবে না। তাই বিভিন্ন আঞ্চলিক গ্রুপিংএর সাথে ‘অকাস’কে একত্রে কাজ করতে হবে। একেকটা গ্রুপিং একেক উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে। যেমন ‘কোয়াড’ ব্যবহৃত হবে আঞ্চলিক সহযোগিতার ‘নিউক্লিয়াস’ হিসেবে। ফ্রান্স এবং ভারতের নিজস্ব সামরিক শক্তি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রভাবের আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা ‘অকাস’ ব্যবহার করতে পারে। একারনেই তারাপোর ‘অকাস’কে ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে মনোনিবেশ করতে বলছেন। তবে তিনি বলছেন যে, ‘অকাস’এর পুরো ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ আলাদা।

সবশেষে ‘অকাস’ চুক্তির ভিত্তি নিয়ে কথা বলেছেন কামারিলো এবং লুইস। তারা বলছেন যে, ১৯৪১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের মাঝে স্বাক্ষরিত ‘আটলান্টিক চার্টার’ই হলো এই দুই দেশের সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। এবছরের জুন মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেই একই চার্টারের একটা পরিবর্তিত ভার্সন স্বাক্ষর করেন। মুক্ত, গণতান্ত্রিক সমাজের আদর্শকে দুনিয়াব্যাপী প্রচার করা ছাড়াও তাদের প্রযুক্তিগুলিকে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির মাধ্যমে নিজেদের হাতে ধরে রাখা এবং সাইবার হামলা প্রতিহত করার মতো চিন্তাগুলির ভিত সেই চার্টারের মাঝেই রয়েছে।

বিশ্লেষকদের এই কথাগুলি থেকে পরিষ্কার যে, ‘অকাস’ সাম্প্রতিক সময়ে স্বাক্ষরিত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত চুক্তি। ইংরেজি ভাষাভাষী ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডার মাঝেই গড়ে উঠেছে সেই ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স জোট, যাকে পুঁজি করেই সামনের দিনগুলিকে ‘অকাস’ প্রযুক্তিগত দিক থেকে দুনিয়াতে এগিয়ে থাকতে চাইছে। এই প্রযুক্তির সর্বসন্মুখে রয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’; যাকে সমর্থন যোগাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং নিরাপত্তা দেবে সাইবার প্রযুক্তি। ‘আকাস’ চুক্তির মূলেই রয়েছে এই প্রযুক্তিগুলি; যা সামনের দিনগুলিতে প্রতিরক্ষা খাতে অতি গুরুত্বপূর্ণ হবে; যদিও মিডিয়াতে পারমাণবিক সাবমেরিনের কথাই বেশি প্রচারিত হয়েছে। অতি সংবেদনশীল এই প্রযুক্তিগুলিকে যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র তার সবচাইতে কাছের ‘বিশেষ’ গ্রুপের সাথেই শেয়ার করতে চাইছে। আর নিজেদের এই ‘বিশেষ’ গ্রুপের মাঝে ফান্স এবং ভারতের মতো দেশগুলিকে ঢুকতে না দিলেও ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাকি দেশগুলিকেও তাদের সাথে রেখে তাদের কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে।

Thursday 21 October 2021

‘আসিয়ান’এর অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করছে ‘অকাস’ চুক্তি

২১শে অক্টোবর ২০২১


 

‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং আস্ট্রেলিয়ার মাঝে কৌশলগত চুক্তি ‘অকাস’ স্বাক্ষরিত হবার পর থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক জোট ‘এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস’ বা ‘আসিয়ান’এর সদস্য দেশগুলির মাঝে সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দিয়েছে। জোটের সদস্য মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া যখন বলছে যে, এই চুক্তির ফলে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছের রাষ্ট্র ফিলিপাইন এই চুক্তিকে সমর্থন দিয়েছে।

গত ১২ই অক্টোবর মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসামুদ্দিন হুসেইন পার্লামেন্টকে বলেন যে, মালয়েশিয়ার মূল লক্ষ্য হলো চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে শক্তির ব্যালান্স যাই থাকুক না কেন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে রক্ষা করা। ‘আসিয়ান’এর সদস্য রাষ্ট্রদের চিন্তার মাঝে একটা সমঝোতাই কেবল এই দুই শক্তিশালী দেশকে মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে। জাপানের মিডিয়া ‘এনএইচকে’ বলছে যে, গত ১৭ই সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইসমাঈল সাবরি ইয়াকব অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনকে বলেন যে, ‘অকাস’ চুক্তি দক্ষিণ চীন সাগরে অন্যান্য শক্তিকে আরও আগ্রাসী ভূমিকা নিতে উস্কে দিতে পারে। একই দিনে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে, অত্র অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে ইন্দোনেশিয়া ভীষণভাবে চিন্তিত। মার্কিন সামরিক পত্রিকা ‘স্ট্রারস এন্ড স্ট্রাইপস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ১৬ই সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লী সিয়েন লুং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বলেন যে, এই চুক্তি আঞ্চলিক শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে সহায়তা করবে এবং আঞ্চলিক কাঠামোকে সমর্থন দেবে। পরদিন ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডেলফিন লরেনজানা অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার ডাটনকে ফোন করে বলেন যে, অস্ট্রেলিয়ার অধিকার রয়েছে তার সাবমেরিন প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার; ফিলিপাইনও তার নিজস্ব অঞ্চলকে রক্ষা করতে সক্ষমতা তৈরি করছে। ২৩শে সেপ্টেম্বর ভিয়েতনামের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লে থি থু হাং নির্দিষ্ট না করেই বলেন যে, সকল রাষ্ট্রই শান্তি, স্থিতিশীলতা, সহযোগিতা এবং উন্নয়ন চায়। অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক প্রযুক্তি কেনা নিয়ে তিনি বলেন যে, পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহার হতে হবে শান্তিপূর্ণ এবং তা আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগতে হবে।

থাইল্যান্ডের ‘চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর থিতিনান পংসুধিরাক ‘ব্যাংকক পোস্ট’এর এক লেখায় মত দিচ্ছেন যে, ‘অকাস’ চুক্তি চীনকে যেমন উস্কে দেবে, তেমনি ‘আসিয়ান’কে আরও বিভক্ত করবে। একইসাথে এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন সরবরাহ করলে ইইউ এবং জাপানসহ অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলিও চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়ে যাবে। পংসুধিরাকের সাথে একমত নন থাইল্যান্ডের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কাভি চংকিত্তাভর্ন। একই পত্রিকার এক লেখায় তিনি বলছেন যে, একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন অত্র অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে; এখন করছে চীন। তিনি বলেন যে, ‘আসিয়ান’ যদি সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে না পারে, তবে সংস্থার আকাত্মতায় সমস্যা হবে। গত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা বলছে যে, ‘আসিয়ান’এর সক্ষমতা রয়েছে টিকে থাকার। এর আগেও বিভিন্ন ইস্যুতে এর সদস্য দেশগুলির কেউ কেউ ভিন্ন পথে হাঁটার চেষ্টা করেছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সংস্থায় ভাঙ্গন ধরাতে পারেনি।

নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে কাজ করা মার্কিন নিরাপত্তা বিশ্লেষক পল বিউকানান ‘স্টারস এন্ড স্ট্রাইপস’কে বলছেন যে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি চিন্তিত যে, দক্ষিণ চীন সাগর, মালাক্কা প্রণালি, মালয় দ্বীপপুঞ্জ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় পারমাণবিক শক্তির আনাগোনা আরও দেশকে পারমাণবিক শক্তির দিকে আকর্ষণ করতে পারে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশগুলি, যেগুলি এই মুহুর্তে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে না, তারাও এব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। এই পুরো ব্যাপারটা সংঘাতের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ চীন তার আঞ্চলিক অবস্থানকে ধরে রাখতে চেষ্টা করবে এবং চাপের মুখে তার শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে।

সিঙ্গাপুরের সরকারি গবেষণা সংস্থা ‘ইসেয়াস ইউসোফ ইসহাক ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো উইলিয়াম চুং এবং শ্যারন সেয়া ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, যখন ‘আসিয়ান’এর বাইরের দেশগুলি অত্র অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছে, তখন বোঝা যায় যে, চীনা আগ্রাসী তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণে ‘আসিয়ান’ ব্যর্থ হয়েছে। ‘আসিয়ান’ মনে করছে যে, ‘কোয়াড’এর মতো জোট তৈরি হওয়া মানেই চীনকে আরও খেপিয়ে তোলা। তারা ‘আসিয়ান’এর শক্ত নেতৃত্ব দাবি করেন এবং বর্তমান নেতৃত্বের সমালোচনা করেন। ‘আসিয়ান’এর বর্তমান চেয়ারম্যান ব্রুনাইএর কার্যকলাপকেও তারা বিবৃতিসর্বস্ব বলে আখ্যা দেন। একইসাথে সংস্থার মাঝে এখন অনেক বিষয়েই বিরোধ; যার ফলশ্রুতিতে শুধু ছাড় দিয়েই চলতে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে শীর্ষ বৈঠকে আমন্ত্রণ না জানানো হলেও তার একজন প্রতিনিধিকে সন্মেলনে আসার অনুমতি দেয়া হয়। একারণেই বাইডেন প্রশাসন ‘আসিয়ান’এর সমঝোতার জন্যে অপেক্ষা না করে সিঙ্গাপুর এবং ভিয়েতনামের মতো সদস্যদেশগুলির সাথে আলাদাভাবে সম্পর্ক তৈরি করছে। লেখকেরা বলছেন যে, দিন শেষে ‘আসিয়ান’ হয়তো কোনমতে চালিয়ে নেবে; কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, ‘আসিয়ান’এর বয়স হয়েছে।

‘অকাস’ চুক্তি ‘আসিয়ান’এর মতো একটা সংস্থার অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার চীনকে নিয়ন্ত্রণের নীতিতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে বাধ্য করছে এক পক্ষ নিতে। কিন্তু এই দেশগুলি অর্থনৈতিকভাবে অনেকাংশেই চীনের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও আরেক বাস্তবতার মাঝে রয়েছে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। পূর্ব এশিয়ার প্রায় সবগুলি কৌশলগত সমুদ্রপথই এই দেশগুলির মাঝ দিয়ে গিয়েছে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে যে কোন সম্ভাব্য সংঘাতে এই দেশগুলির উঠানই হয়ে উঠবে যুদ্ধক্ষেত্র। চীনের বেশি কাছে অবস্থিত হওয়ায় ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনামের কাছে যখন চীনের হাত থেকে সমুদ্রসীমা উদ্ধার মূল লক্ষ্য, তখন মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া তাদের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমাকে সংঘাতমুক্ত দেখতেই বেশি আগ্রহী। অর্থাৎ সংস্থার সদস্যদেশগুলির জাতীয় লক্ষ্য এখন সংস্থার সাথে একাত্মতা প্রকাশকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। একারণেই যুক্তরাষ্ট্র অত্র অঞ্চলে ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম এবং সিঙ্গাপুরের সাথে আলাদা সম্পর্ক তৈরিতে আগ্রহী হয়েছে। এমতাবস্থায় মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া নিজস্ব কৌশলগত দিকনির্দেশনা খুঁজবে। একইসাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবার সাথেসাথে অত্র অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে নতুন খেলোয়াড় যোগ হবে এবং নতুন নতুন কৌশলগত জোট তৈরি হবে।

Wednesday 20 October 2021

বঙ্গোপসাগরে পশ্চিমা শক্তি প্রদর্শনের আসল উদ্দেশ্য কি?

২০শে অক্টোবর ২০২১

বঙ্গোপসাগরে 'এক্সারসাইজ মালাবার ২০২১'। চীনারা এখন পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে কোন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ কেন, একটা বিমানও মোতায়েন করতে সক্ষম হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হলো, বঙ্গোপসাগরে এতসব বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মহড়া কাকে টার্গেট করে? এটা কি শুধু চীনকে নিয়ন্ত্রণের জন্যেই? যে চীনের বঙ্গোপসাগরে একটা প্যাট্রোল বোটও নেই? নাকি দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থিতিশীল দেখতে চাওয়াটা ইন্দোপ্যাসিফিককে নিয়ন্ত্রণে রাখার বড় কৌশলের মাঝেই একটা অপশন?

 
কয়েক মাস ধরে পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রগুলি দাপিয়ে বেড়ানোর পর শক্তিশালী দেশগুলির যুদ্ধজাহাজগুলি মোটামুটিভাবে অক্টোবরের শুরু থেকেই বঙ্গোপসাগরে জড়ো হতে থাকে। প্রথমে আসে জাপানি নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কাগা’ এবং ডেস্ট্রয়ার ‘মুরাসামে’। শ্রীলংকার ‘দ্যা আইল্যান্ড’ পত্রিকা বলে যে, ২রা অক্টোবর জাহাজদু’টা তিন দিনের জন্যে কলম্বো বন্দরে ভিড়ে। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকা বলে যে, ৬ই অক্টোবর থেকে ৮ই অক্টোবর জাপানি জাহাজগুলি ভারতীয় নৌবাহিনীর সাথে আরব সাগরে মহড়া দেয়। ‘জিমেক্স’ নামে আখ্যায়িত এই মহড়ায় ভারতীয় নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ‘কোচি’ ফ্রিগেট ‘তেগ’, একটা ‘পি ৮আই’ প্যাট্রোল বিমান এবং ‘মিগ ১৯কে’ ফাইটার বিমান অংশ নেয়। জাপানের পর বঙ্গোপসাগরে হাজির হয় মার্কিন নৌবাহিনীর দৈত্যাকায় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কার্ল ভিনসন’। এর সাথে ছিল ক্রুজার ‘লেক শ্যাম্পলেইন’ এবং ডেস্ট্রয়ার ‘স্টকডেইল’। প্রায় একইসাথে বঙ্গোপসাগরে ঢোকে অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘বালারাট’ এবং সাপ্লাই জাহাজ ‘সিরিয়াস’। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং আস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর এই জাহাজগুলির উদ্দেশ্য ছিল ‘এক্সারসাইজ মালাবার ২০২১’। মহড়ার আরেক অংশগ্রহণকারী হলো ভারত। এই মহড়ার প্রথম ধাপ এবছরের অগাস্টে প্রশান্ত মহাসাগরে হয়ে গেছে; অক্টোবর মাসের ১২ থকে ১৫ তারিখ ছিল মহড়ার দ্বিতীয় ধাপ। ভারতের পক্ষ থেকে অংশ নেয় ডেস্ট্রয়ার ‘রণবিজয়’, ফ্রিগেট ‘সাতপুরা’, ‘পি ৮আই’ প্যাট্রোল বিমান এবং একটা সাবমেরিন। এই চারটা দেশ হলো সাম্প্রতিক সময়ে গঠন করা ‘কোয়াড’ কৌশলগত জোটের অংশ। সরাসরি না বলা হলেও সব মিডিয়াতেই বলা হচ্ছে যে, এই জোটের উদ্দেশ্য হলো ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করা।

অস্ট্রেলিয়ার ফ্লোটিলা কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল মার্ক হ্যামন্ড বলেন যে, এই মহড়ার মাধ্যমে তাদের যৌথ সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে; যার মাধ্যমে তারা ইন্দোপ্যাসিফিককে মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রাণবন্ত রাখবেন। মার্কিন নৌবাহিনীর চিফ অব নেভাল অপারেশন্স এডমিরাল মাইক গিলডে বলছেন যে, মুক্ত ইন্দোপ্যাসিফিকের শক্তিশালী ঘাঁটি হলো ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব। তিনি আরও বলেন যে, কেউ যেন ভুল না করে যে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে কাছের কৌশলগত বন্ধুদের একটা। ‘কোয়াড’এর কোন ঘোষণাতেই বলা হয়নি যে, এই জোট চীনকে মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে। তবে ভারতীয় মিডিয়ায় এই মহড়ার লক্ষ্য কি, তা কোন রাখঢাক না রেখেই প্রচার করা হয়। মূলতঃ চীনকে টার্গেট করেই এই মহড়া দেয়া হয় বলে উল্লেখ করে ‘টাইমস নাউ নিউজ’। বেইজিং ‘কোয়াড’ জোটের কর্মকান্ডের খেয়াল রাখছে বলে বলা হয়। গত মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘কোয়াড’ শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিলে চীনা সরকার ভারতকে পশ্চিমাদের চিন্তার ফাঁদে না পড়ার আহ্বান জানায়।

 
ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'কুইন এলিজাবেথ' এবং 'সিএসজি২১'। ব্রিটিশরা বলছে যে, ইন্দোপ্যাসিফিককে মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং উন্নত রাখতে ভারত অতি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাসের জন্মদাতা ব্রিটেন অবশ্যই জানে যে দিল্লী সরকারের উগ্রবাদী কর্মকান্ড পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থির করতে পারে। তারপরেও কেন দিল্লীকে এতটা আলিঙ্গন? 

ব্রিটিশরা কেন ‘মালাবার’এর বাইরে?

ব্রিটিশ রয়াল নেভিও একই সময়ে একই এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান নেয়। ১১ই অক্টোবর সিঙ্গাপুরে অবস্থান নেয় ব্রিটিশ রয়াল নেভির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’। কিন্তু জাহাজটা আপাততঃ ভারত মহাসাগরে ঢোকা থেকে বিরত থাকে। তবে এই জাহাজের নেতৃত্বে ‘ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ২১’ বা ‘সিএসজি২১’ ফ্লিটের অংশ ফ্রিগেট ‘কেন্ট’কে পাঠানো হয় বঙ্গোপসাগরে। ১৪ই অক্টোবর জাহাজটা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ঢোকে। ভারতীয় মিডিয়া ব্রিটিশদের পরিকল্পনার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না। ১২ই অক্টোবর ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকা মার্কিন এডমিরাল গিলডের বরাত দিয়ে বলে যে, ‘মালাবার’ মহড়া আরও বড় হবে কিনা, তা নির্ভর করবে ‘কোয়াড’ সদস্যদের সিদ্ধান্তের উপর। এর আগে ৩০শে সেপ্টেম্বর ‘টাইমস নাউ নিউজ’ বলে যে, ব্রিটিশ রয়াল নেভি ‘মালাবার’ মহড়ায় যুক্ত হবার জন্যে প্রস্তাব দিয়েছে। যদি ব্রিটেন এর অংশ হয়, তবে এর নাম হবে ‘এক্সারসাইজ ম্যারিন প্যাট্রোল’। এটা বাস্তবে রূপ নিলে প্রকৃতপক্ষে তা হবে ‘অকাস প্লাস টু’। অর্থাৎ সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মাঝে স্বাক্ষরিত ‘অকাস’ কৌশলগত চুক্তির দেশগুলির সাথে ভারত এবং জাপানকেও যুক্ত করা হবে। ভারতীয়রা চিন্তা করতে থাকে যে, যেহেতু অক্টোবর মাসেই ব্রিটিশ রয়াল নেভির সাথে ভারতীয়দের একটা বড় মহড়া রয়েছে; তদুপরি তাদের অপর বন্ধু দেশ ফ্রান্স এবং রাশিয়া এব্যাপারটাকে কিভাবে দেখবে? মোটকথা, রয়াল নেভির ‘মালাবার’ মহড়ায় অংশ নেয়ার প্রস্তাব ভারতীয়দের বিচলিতই করেছিল। ‘কোয়াড’এ ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ অস্ট্রেলিয়া সদস্য হিসেবে রয়েছে। ব্রিটেন হয়তো এতেই খুশি থাকবে। কারণ এতে ব্রিটেন ‘কোয়াড’এর শক্তি প্রদর্শনের বাইরে গিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারবে। যেমনটা তারা করেছে ‘মালাবার’এর সময় চট্টগ্রামে তাদের ফ্রিগেট ‘কেন্ট’কে পাঠিয়ে।

‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ জানাচ্ছে যে, ‘মালাবার’ শেষ হবার প্রায় সাথেসাথেই ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’ বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। এই জাহাজের গ্রুপ ভারতীয় তিন বাহিনীর সাথে মহড়ায় অংশ নেবে। ভারতীয় তিন বাহিনীর সাথে মহড়া এর আগ পর্যন্ত শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সাথে হয়েছে। ব্রিটেন এখানে নতুন করে নাম লেখাতে যাচ্ছে। এই মহড়া চলবে অক্টোবরের ২১ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত ভারতের পশ্চিম উপকূলে আরব সাগরে। ভারতে ব্রিটিশ হাই কমিশনার এলেক্স এলিস বলছেন যে, ইন্দোপ্যাসিফিককে মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং উন্নত রাখতে ভারত অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন যে, ভারতে ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের সফর দুই দেশের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধিকে দেখিয়ে দেয়। ব্রিটেনের ফার্স্ট সী লর্ড এডমিরাল টনি রাডাকিন বলছেন যে, দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মহড়া কৌশলগত বন্ধুত্বকে আরও গভীর করবে।

আসল টার্গেট কে?

এতসব মহড়ার আয়োজন যদি চীনকে টার্গেট করেই হয়ে থাকে, তবে কিছু প্রশ্ন এসেই যায়। বঙ্গোপসাগর বা আরব সাগরে এখন পর্যন্ত চীনের কোন নৌঘাঁটি হয়নি। জিবুতিতে চীনা ঘাঁটিতে স্থায়ীভাবে কোন যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন নেই। চীনের যুদ্ধজাহাজ ভারত মহাসাগরে আসছে ঠিকই, কিন্তু তারা মার্কিন বা ব্রিটিশদের মতো শক্তি প্রদর্শনের ধারেকাছেও আসতে পারেনি। চীনারা এখন পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে কোন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ কেন, একটা বিমানও মোতায়েন করতে সক্ষম হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হলো, বঙ্গোপসাগরে এতসব বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মহড়া কাকে টার্গেট করে? ভারত মহাসাগরে মাঝে মাঝে সফরে আসা চীনা নৌবাহিনীর জাহাজগুলি কি মার্কিন, ব্রিটিশ বা ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের বহরকে হুমকির মাঝে ফেলছে?

‘কোয়াড’ সদস্যরা চীনের হুমকির কথা বলছে। কিন্তু ইন্দোপ্যাসিফিককে ‘মুক্ত’ রাখার কথা বলে বিশাল সামরিক শক্তির প্রদর্শন তো ভীতি প্রদর্শন ছাড়া কিছুই নয়। আর ভারতকে অপরিহার্য কৌশলগত বন্ধু বলে আখ্যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন উগ্রবাদী মোদি সরকারের মুসলিম নির্যাতনের ব্যাপারে চুপ করে থাকছে। বিজেপি সরকারের আসামে লাখো বাঙ্গালী মুসলিমদের বাস্তুচ্যুত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে স্থান দেয়া পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে কি অর্থ বহণ করে সেটা দিল্লীর হিন্দুত্ববাদী সরকার যেমন জানে, তেমনি জানে লন্ডন এবং ওয়াশিংটন। একইসাথে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাসের জন্মদাতা ব্রিটেন অবশ্যই জানে যে দিল্লী সরকারের উগ্রবাদী কর্মকান্ড পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থির করতে পারে। তারপরেও কেন দিল্লীকে এতটা আলিঙ্গন? এটা কি শুধু চীনকে নিয়ন্ত্রণের জন্যেই? যে চীনের বঙ্গোপসাগরে একটা প্যাট্রোল বোটও নেই? নাকি দক্ষিণ এশিয়াকে অস্থিতিশীল দেখতে চাওয়াটা ইন্দোপ্যাসিফিককে নিয়ন্ত্রণে রাখার বড় কৌশলের মাঝেই একটা অপশন? চীনকে নিয়ন্ত্রণ, নাকি ইন্দোপ্যাসিফিককে নিয়ন্ত্রণ? পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থা এখন ক্রান্তিলগ্নে। তাই ভূরাজনৈতিক সমীকরণে শুধু চীন নয়, পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাব্য বিকল্পকেও রাখতে হবে। কারণ চীন নয়, বরং পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার প্রতি হুমকিটাই যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনকে ইন্দোপ্যাসিফিকে এতটা আগ্রাসী আচরণ করাচ্ছে।