Monday 30 August 2021

ইউরেশিয়া ... আফগানিস্তানের পর

৩০শে অগাস্ট ২০২১

ছবিঃ নভেম্বর ২০২০। কাতারের দোহায় তুর্কমেনিস্তানের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় বসেছেন তালিবান প্রতিনিধিরা। তুর্কমেনিস্তান চাইছে তার বিশাল প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদকে দক্ষিণ এশিয়াতে বিক্রি করতে। আর আফগানিস্তান চাইছে এই লক্ষ্যে তুর্কমেনিস্তানকে একটা করিডোর দিতে।


আফগানিস্তানের উত্তরপূর্বের বাদাখশান প্রদেশ একসময় পৃথিবী বিখ্যাত ছিল কিছু দামী পাথরের জন্যে। নীল রঙের এই পাথরগুলির নাম লাপিস লাজুলি। মধ্যযুগে এই পাথর ইউরোপে রপ্তানি হতো; যেখানে এই পাথর গুঁড়ো করে ‘আলট্রাম্যারিন’ নামে একপ্রকারের নীল রঙ তৈরি করা হতো। এই রঙ দামি পেইন্টিংএ ব্যবহার করা হতো। আফগানিস্তান থেকে ইউরোপ পর্যন্ত যাবার প্রাচীন বাণিজ্যপথটাকে উপজীব্য করেই বর্তমানে আফগানিস্তান থেকে তুরস্ক পর্যন্ত ‘লাপিস লাজুলি করিডোর’ নামে একটা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করা হচ্ছে। এই করিডোরের মাধ্যমে শুধু আফগানিস্তান নয়, আফগানিস্তানের পূর্বে দক্ষিণ এশিয়াকে স্থলপথে যুক্ত করা হবে ইউরোপের সাথে। একইসাথে এই করিডোর প্রাচীন ‘সিল্ক রোড’এর উপরে তৈরি চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’ প্রকল্পের সাথে যুক্ত হবে। এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো আফগানিস্তান; যেখানে এখন তালিবানরা ক্ষমতা নিয়েছে। গত ১৫ই অগাস্ট কাবুলে মার্কিন দূতাবাস হেলিকপ্টারের মাধ্যমে খালি করার পর এই বিশাল কৌশলগত করিডোরের ভবিষ্যৎ কি হবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। একইসাথে আলোচনা হচ্ছে আফগানিস্তানের ঘটনাগুলি এই করিডোরের উপর অবস্থিত দেশগুলিকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

আফগানিস্তান থেকে তুর্কমেনিস্তান

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘জেমসটাউন ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় মধ্য এশিয়া বিশ্লেষক প্রাক্তন মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা পল গোবল বলছেন যে, আফগানিস্তানের যুদ্ধে তালিবানের বিজয় এবং সেখান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে রাশিয়া এবং চীনসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলি বিচলিত হয়েছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সবগুলিই কঠোর একনায়কোচিত শাসনের অধীনে থাকায় এবং প্রতিটা দেশেই দীর্ঘমেয়াদী ইসলামী আন্দোলন থাকার কারণে রাশিয়া এবং চীন নিজেদের অবস্থানকে নতুন করে সাজাতে চাইছে। চীনের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুট গিয়েছে মধ্য এশিয়ার মাঝ দিয়ে। আর মধ্য এশিয়া থেকে চীনের জ্বালানির একটা বড় অংশ আসে। এছাড়াও চীনের আরেকটা বড় চিন্তা হলো শিনজিয়াং বা উইঘুর প্রদেশকে নিয়ে। মুসলিম অধ্যুষিত এই প্রদেশে চীনা সরকারের নিপীড়ন যখন চলমান, তখন চীনারা দুশ্চিন্তায় রয়েছে যে, আফগানিস্তানে তালিবানদের বিজয় চীনের মুসলিমদেরকে অনুপ্রাণিত করবে কিনা। রাশিয়া ইতোমধ্যেই আফগানিস্তানের উত্তরে তাজিকিস্তান এবং কিরগিজস্তানে নিজেদের সামরিক অবস্থানকে সুসংহত করতে শুরু করেছে এবং ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’ বা ‘সিএসটিও’র অধীনে থাকা মধ্য এশিয়ার চারটা দেশের সাথে যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করেছে। এই দেশগুলির সীমান্ত নিরাপত্তাকে আরও শক্তিশালী করতে সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া। রাশিয়ার মূল ফোকাসই হলো সামরিক নিরাপত্তা। তবে এখানে রাশিয়ার সবচাইতে বড় দুর্বলতা হলো মধ্য এশিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ দেশ তুর্কমেনিস্তান তার জন্মের পর থেকেই ‘নিরপেক্ষতা’র নীতিতে এগুবার কারণে দেশটা রাশিয়ার নেতৃত্বে তৈরি হওয়া ‘সিএসটিও’র সদস্য নয়। তাই রাশিয়া চাইছে যে, তুর্কমেনিস্তান ‘সিএসটিও’র সদস্য হিসেবে নাম লিখিয়ে নিক এবং রুশ সহায়তা নিয়ে আফগানিস্তানের সাথে দেশটার প্রায় ৭’শ কিঃমিঃ সীমানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক।

তবে তুর্কমেনিস্তান থেকে পুরোপুরি ভিন্নরকম খবর আসছে। ২০২০এর নভেম্বরেই কাতারের রাজধানী দোহাতে তুর্কমেন কর্মকর্তারা তালিবান প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছেন। কাবুলের মার্কিন দূতাবাস খালি করার তিন দিন পর ১৮ই অগাস্ট আফগানিস্তানের উত্তরের শহর মাজার ই-শরীফে তুর্কমেনিস্তানের কনসাল বালখ প্রদেশের তালিবানদের নতুন প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাত করেন। তুর্কমেনিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই আলোচনাকে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ এবং গঠনমূলক বলে উল্লেখ করা হয়। এতে দুই দেশের সম্পর্ককে ভ্রাতৃসুলভ বলেও বলা হয়। একই দিনে আফগানিস্তানের পশ্চিমের শহর হেরাতেও তুর্কমেনিস্তানের প্রতিনিধির সাথে তালিবান প্রতিনিধির সাক্ষাত হয়। ১৮ই অগাস্ট তুর্কমেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, আফগানিস্তানের সাথে সীমান্তে রাস্তা এবং রেললাইন খোলা রয়েছে এবং সেখানে স্বাভাবিক কর্মকান্ড চলছে। ‘ইউরেশিয়ানেট’এর এক প্রতিবেদনে তুর্কমেনিস্তানের সাথে আফগানিস্তানের এই ‘হৃদ্যতাপূর্ণ’ সম্পর্ককে উভয় পক্ষের বাস্তববাদী চিন্তার ফলাফল বলা হচ্ছে। এদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী মধ্য এশিয়ার চারটা দেশ ঘুরে এসেছেন। তিনি আফগানিস্তানের আশেপাশের সকল দেশকে তালিবানদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে অনুরোধ করেছেন। ১৭ই অগাস্ট তালিবান প্রতিনিধি সুহাইল শাহীন ব্রিটেনের ‘স্কাই নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান এবং ভারত পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে কথা বলেন, যা ‘টিএপিআই’ বা ‘টাপি’ পাইপলাইন বলে পরিচিত। একইসাথে তুর্কমেনিস্তানের সাথে রেলযোগাযোগ প্রকল্পকেও তিনি প্রাধান্য দেবার কথা বলেন। এগুলির কর্মযজ্ঞ খুব শীঘ্রই শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সুহাইল শাহীন আফগানিস্তানকে মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মাঝে সেতু বলে আখ্যা দেন। এছাড়াও এবছরেই তালিবান প্রতিনিধি তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাদ ঘুরে আসেন এবং তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত বিদ্যুৎ রপ্তানির জন্যে গ্রিডলাইন প্রকল্পের কথাও আলোচনা করেন বলে বলছে জ্বলানি বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘আপস্ট্রিম’।

তুর্কমেনিস্তান চাইছে তার বিশাল প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে। এই লক্ষ্যে দেশটার নেতৃত্ব শুধু চীনের বাজারের উপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না। ‘টাপি’ পাইপলাইনের মাধ্যমে তুর্কমেনিস্তানের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের ‘গালকাইনিশ’ খনি থেকে পাকিস্তান এবং ভারত পর্যন্ত বছরে ৩৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার বা বিসিএম গ্যাস রপ্তানির চিন্তা করা হচ্ছে। এই গ্যাসের ৫ বিসিএম পাবে আফগানিস্তান; বাকি ২৮ বিসিএম সমভাবে বন্টিত হবে পাকিস্তান এবং ভারতের মাঝে। এই প্রকল্পে ১৮’শ ৪০ কিঃমিঃ পাইপলাইনের মাঝে প্রায় ১৬’শ কিঃমিঃ থাকবে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে। এর শেষ প্রান্ত থাকবে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সীমান্ত শহর ফাজিলকাতে। তুর্কমেনিস্তানের আরেকটা প্রকল্প হলো কাস্পিয়ান সাগর, ককেশাস এবং তুরস্ক হয়ে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে রাশিয়া এবং ইরানের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। তবে এতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে রাশিয়া এবং ইরানকে বাইপাস করে তুর্কমেন গ্যাস ইউরোপে রপ্তানি হবে।
 
ছবিঃ আজেরবাইজানের আলাত সমুদ্রবন্দর। আজেরবাইজান এই বন্দর তৈরি করেছে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সাথে যুক্ত হবার জন্যে। তুর্কমেনিস্তানের রেললাইন এবং সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আফগানিস্তান এই বন্দরের সাথে যুক্ত হয়েছে।


কাসপিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে তুরস্ক এবং ইউরোপে

তুর্কমেনিস্তানের পশ্চিমে রয়েছে কাসপিয়ান সাগর। স্থলবেষ্টিত একটা হ্রদ হলেও এটাকে সাগর বলেই আখ্যা দেয়া হয়। তবে এটাকে আইনগতভাবে হ্রদ বলা হবে, নাকি সাগর বলা হবে, সেব্যাপারে এর উপকূলবর্তী পাঁচটা দেশের মাঝে বিরোধ ছিল। রাশিয়া এবং প্রাক্তন সোভিয়েত রিপাবলিক কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং আজেরবাইজান কাসপিয়ানকে সাগর বলতে চাইছিল; ইরান বলতে চাইছিল এটা একটা হ্রদ। ইরান চাইছিল এই ‘হ্রদ’এর পুরোটা আই পাঁচ দেশের মাঝে সমভাবে বন্টন করে দেয়া হোক। এতে এক দেশ আরেক দেশের অংশে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু রাশিয়া এতে রাজি ছিল না। কারণ এতে রাশিয়ার কাসপিয়ান সাগরের নৌবহর পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যেতো। শেষ পর্যন্ত দুই দশক আলোচনার পর ইরান রাশিয়ার সিদ্ধান্তই মেনে নিতে বাধ্য হয়। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ‘হ্রদ’ ঘোষণা না দেয়ায় ইরানই হয়তো এই চুক্তিতে কিছু হারিয়েছে। তবে চুক্তিতে যেহেতু বলা হয়েছে যে, স্বাক্ষরকারী পাঁচ দেশ ব্যতীত কাসপিয়ানে আর কোন দেশের সামরিক অবস্থান থাকবে না, সেদিক থেকে ইরান হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। অপরদিকে তুর্কমেনিস্তান এবং আজেরবাইজান ‘সাগর’ ঘোষণায় খুশি হয়েছে। কারণ এতে তারা পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলিকে কাসপিয়ানের তলদেশ দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন তৈরি করতে ডাক দিতে পারবে। অর্থাৎ তুর্কমেনিস্তান তার বিশাল গ্যাস সম্পদ আজেরবাইজান, জর্জিয়া এবং তুরস্ক হয়ে ইউরোপে রপ্তানি করতে পারবে।

স্থলবেষ্টিত তুর্কমেনিস্তান সমুদ্র নিয়ে চিন্তা শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। তাদের উদ্দেশ্য হলো মধ্য এশিয়ার অন্যান্য স্থলবেষ্টিত দেশগুলিকে তুর্কমেনিস্তানের মাধ্যমে তুরস্ক, ইউরোপ এবং ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করা। এই লক্ষ্যে ২০১৩ সালের অগাস্টে তুর্কি সহায়তায় তুর্কমেনিস্তান কাসপিয়ান সাগরের তীরে তুর্কমেনবাশি সমুদ্রবন্দর তৈরি শুরু করে। ২০১৮ সালের মে মাসে তুর্কমেন প্রেসিডেন্ট গুরবাঙ্গুলি বারদিমুহামেদভ প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার খরচে নির্মিত এই সমুদ্রবন্দর উদ্ভোধন করেন। প্রায় সমান্তরালে আরেকটা প্রকল্পে হাত দেয় তুর্কমেনিস্তান। দেশটার পূর্বে আফগানিস্তানের সীমান্ত পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। তিন বছরের মাঝে তুর্কমেনিস্তান নিজেদের অংশের লাইনের নির্মাণ শেষ করে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরের ৩০ কিঃমিঃ লাইন নির্মাণ শুরু করে। এই লাইন উদ্ভোধন করা হয় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। এর মাধ্যমে আফগানিস্তান যুক্ত হয়ে যায় কাসপিয়ান সাগরে তুর্কমেনবাশি সমুদ্রবন্দরের সাথে। এছাড়াও কাজাখস্তানও কাসপিয়ানের উপকূলে আকটাউ বন্দরের ১’শ কিঃমিঃ দক্ষিণে কুরিক রেল ফেরি টার্মিনাল চালু করে ২০১৬ সালে। ‘কাসপিয়ান নিউজ’ বলছে যে, এই বন্দর তৈরি করার সময় নির্মাতারা খেয়াল রাখছিলেন কাসপিয়ানের ওপাড়ে আজেরবাইজানের আলাত বন্দরের দিকে; যাতে করে কুরিকের রেলগাড়িগুলি আলাতে ওঠানামা করা যায়।


ছবিঃ অগাস্ট ২০২১। তুরস্কের সহায়তায় নির্মিত তুর্কমেনিস্তানের অত্যাধুনিক কর্ভেট ‘দেনিজ খান’। কাসপিয়ান সাগরের মাঝ দিয়ে তৈরি করা অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহণ করিডোরগুলির নিরাপত্তা দিতেই এই যুদ্ধজাহাজ তৈরি করা হয়। তবে এর মাধ্যমে কাসপিয়ান সাগরে চলমান অস্ত্র প্রতিযোগিতাও সামনে চলে আসছে।
 

কাসপিয়ানের পূর্বে তুর্কমেনিস্তান এবং কাজাখস্তানের সাথে যুক্ত হবার জন্যে কাসপিয়ানের পশ্চিমে আজেরবাইজান নতুন সমুদ্রবন্দর তৈরিতে হাত দেয় ২০১০ সালে। রাজধানী বাকুর ৭০ কিঃমিঃ দক্ষিণে আলাতে এই বন্দরে রেল ফেরি টার্মিনাল তৈরি হয় ২০১৪ সালে; গাড়ির টার্মিনাল তৈরি হয় ২০১৬ সালে। ২০১৮ সালের মে মাসে আজেরি প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ এই সমুদ্রবন্দর উদ্ভোধন করেন। এই বন্দরের মাধ্যমে তুর্কমেনবাশি বন্দর থেকে আসা রেলের বগি, ট্রাক এবং কনটেইনার আজেরবাইজানে প্রবেশ করবে। তুর্কমেনিস্তানের গ্যাস ব্যবহার করে তৈরি করা রাসায়নিক সারের অর্ধেক আজেরবাইজানের মাধ্যমে রপ্তানি হচ্ছে। তাই আজেরবাইজান আলাত সমুদ্রবন্দরে ২৫ লক্ষ টন প্রসেসিং সক্ষমতার একটা ফার্টিলাইজার টার্মিনাল তৈরি করছে।

মধ্য এশিয়ার সাথে তুরস্ক এবং ইউরোপের যোগাযোগের সর্ব পশ্চিমের প্রকল্প হলো আজেরবাইজানের বাকু থেকে জর্জিয়ার তিবলিসি হয়ে তুরস্কের কার্স পর্যন্ত রেললাইন। ‘বিটিকে’ নামে পরিচিত এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তুরস্কের সমর্থনে নেয়া এই প্রকল্পে আর্মেনিয়াকে বাইপাস করা হয়। ২০০৮ সালে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করে বসলে প্রকল্প পিছিয়ে যায়। অবশেষে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে ৮’শ ২৬ কিঃমিঃ লম্বা এই রেললাইন চালু হয়। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো একটা মালবাহী রেলগাড়ি চীন থেকে ইউরোপের চেক রিপাবলিকের প্রাগ স্টেশনে পৌঁছায়। এই রেলগাড়ি চীনের শিয়ান প্রদেশ থেকে কাজাখস্তান হয়ে কাসপিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে আজেরবাইজান পৌঁছে। এরপর ‘বিটিকে’ রেললাইন ব্যবহার করে তুরস্কের রেললাইনে পৌঁছায়; সেখান থেকে সহজেই ইউরোপে পৌঁছে যায়। ‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কিঃমিঃ এই পথ রেলগাড়িটা পাড়ি দেয় ১২ দিনে। পুরো রুটে রেলগাড়িটা রাশিয়াকে বাইপাস করে।
 
কাসপিয়ান সাগরের এই সমুদ্রপথকে নিরাপত্তা দিতে আজেরবাইজান এবং তুর্কমেনিস্তান উভয়েই নৌবাহিনী তৈরিতে মনোনিবেশ করেছে। রাতারাতি তৈরি হওয়া তুর্কমেন নৌবাহিনীতে ক’দিন আগেই যুক্ত হয়েছে ৯১ মিটার লম্বা একটা কর্ভেট বা ছোট আকারের ফ্রিগেট ‘দেনিজ খান’; যা কিনা কাসপিয়ান সাগরের সর্বাধুনিক যুদ্ধজাহাজ। এর আগে তুর্কমেনিস্তানের জন্যে শিপইয়ার্ড তৈরি করে দেয় তুরস্কের ‘দিয়ারসান’ কোম্পানি। তাদের সহায়তায় তুর্কমেন নৌবাহিনী ২০১২ সাল থেকে মিসাইল সজ্জিত ১০টা ৫৬ মিটার লম্বা প্যাট্রোল বোট এবং ৬টা মিসাইল বোট তৈরি করে। কাসপিয়ানের অপর পাড়ে আজেরবাইজান ইস্রাইলের সহায়তায় তৈরি করেছে মিসাইল সজ্জিত ৬টা ৬২ মিটার লম্বা ‘তুফান ক্লাস’ প্যাট্রোল ভেসেল এবং ৬টা ‘শালদাগ’ ছোট প্যাট্রোল বোট। মাত্র এক দশকের মাঝেই এই দুই দেশ শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তুলে; যার ফলশ্রুতিতে কাসপিয়ানে চলছে একটা অস্ত্র প্রতিযোগিতা; যেখানে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হলো তুরস্ক এবং ইস্রাইল।
 
ছবিঃ ‘লাপিস লাজুলি করিডোর’, যা তুরস্ক থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তুরস্ক, আজেরবাইজান, তুর্কমেনিস্তান এবং পাকিস্তানের লক্ষ্য এতে যুক্ত হওয়া; তালিবানরাও একই লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের রেখে যাওয়া পরিকল্পনাগুলিই মধ্য এশিয়া তথা ইউরেশিয়াতে বাস্তবায়িত হতে চলেছে। এই প্রকল্পগুলির ভূরাজনৈতিক ফলাফল হিসেবে ইউরেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। আফগানিস্তানের ঘটনাগুলি একারণেই চীন থেকে রাশিয়া এমনকি তুরস্ক এবং ইউরোপ পর্যন্ত পুরো ইউরেশিয়াতে প্রতিফলিত হচ্ছে।


তুর্কমেনিস্তানের গ্যাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূকৌশলগত পরিকল্পনা

ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ এবং উত্তরের বিশাল দেশ রাশিয়াকে পুরোপুরি বাইপাস করে চীন থেকে ইউরোপ পর্যন্ত রেল করিডোর তৈরি করা ছিল একটা বিরাট পরিকল্পনা। এর পিছনে তুরস্ক এবং চীনের বড় সহায়তা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাটাই ছিল মূখ্য। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে যে, চীনের সাথে ইউরোপের যোগাযোগ যেন রাশিয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়। এর সমান্তরালে তুর্কমেনিস্তানের মাঝ দিয়ে একটা রেল করিডোর তৈরি করা হয়েছে আফগানিস্তানের সীমানা পর্যন্ত। এর মাধ্যমে তুরস্কের সাথে আফগানিস্তান রেলপথে যুক্ত হয়েছে। পাকিস্তান চাইছে এই রেল করিডোরের সাথে যুক্ত হতে।

রেল করিডোর ছাড়াও আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তুর্কমেনিস্তানের বিশাল গ্যাসের ভান্ডার। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এই গ্যাস ‘টাপি’ পাইপলাইনের মাধ্যমে পাকিস্তান এবং ভারতে রপ্তানি হোক, যাতে মধ্য এশিয়ায় চীনের প্রভাব কমে আসে। আবার যুক্তরাষ্ট্র চাইছে তুর্কমেনিস্তানের গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছাক। এতে রাশিয়ার গ্যাসের উপর ইউরোপের নির্ভরশীলতা কমে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে যে, গ্যাস বিক্রি করার মাধ্যমে একদিকে রাশিয়া ইউরোপের উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর যেসকল অর্থনৈতিক অবরোধ দিচ্ছে, তা এই গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

পল গোবল বলছেন যে, মধ্য এশিয়াতে রাশিয়া এবং চীন উভয়েই স্থিতিশীলতা চাইলেও তাদের লক্ষ্য আলাদা। চীন মধ্য এশিয়া থেকে তার গ্যাস সরবরাহের যেমন নিরাপত্তা চায়, তেমনি মধ্য এশিয়া হয়ে ইউরোপ যাবার রেলপথেরও নিরাপত্তা চায়। মধ্য এশিয়াতে স্থিতিশীলতা চাওয়াটা চীনের একটা অর্থনৈতিক লক্ষ্য। অপরদিকে রাশিয়া তার দক্ষিণের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি নিয়ে চিন্তায় রয়েছে সর্বদা। তাই মধ্য এশিয়ার দেশগুলির নিরাপত্তাজনিত দিকটাই রাশিয়ার জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তালিবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতা নেবার সাথেসাথেই মস্কো এবং বেইজিংএ তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে আস্তত্ব করেছে। তথাপি রাশিয়া এবং চীনের দুশ্চিন্তা পুরোপুরি চলে যায়নি। অপরিকে তুর্কমেনিস্তানকে নিয়ে রাশিয়া চিন্তিত হলেও তুর্কমেনিস্তান কিন্তু আফগানিস্তানের মাঝে তার সুযোগই দেখতে পারছে। কারণ তালিবানরা প্রথম থেকেই বলছে যে, তারা আফগানিস্তানের মাঝ দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন, রেললাইন এবং বিদ্যুৎ গ্রিডলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নে ইচ্ছুক। মধ্য এশিয়াকে দক্ষিণ এশিয়ার সাথে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত করাটাই এখন তালিবানরা লক্ষ্য হিসেবে বলছে; যা কিনা তাদের বাস্তবতা মেনে নেবার চিন্তাতাকেই তুলে ধরে। একই লক্ষ্য তুরস্ক, আজেরবাইজান, তুর্কমেনিস্তান এবং পাকিস্তানের; আর তা হলো 'লাপিস লাজুলি করিডোর'এর সাথে যুক্ত হওয়া। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের রেখে যাওয়া পরিকল্পনাগুলিই মধ্য এশিয়া তথা ইউরেশিয়াতে বাস্তবায়িত হতে চলেছে। এই প্রকল্পগুলির ভূরাজনৈতিক ফলাফল হিসেবে ইউরেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। আফগানিস্তানের ঘটনাগুলি একারণেই চীন থেকে রাশিয়া এমনকি তুরস্ক এবং ইউরোপ পর্যন্ত পুরো ইউরেশিয়াতে প্রতিফলিত হচ্ছে।

Saturday 28 August 2021

কাবুল এয়ারলিফট মার্কিনীদের সামরিক কাজে বেসামরিক বিমান ব্যবহারের গুরুত্বকে সামনে নিয়ে এলো

২৮শে অগাস্ট ২০২১

ছবিঃ ২০০৩ সাল। কুয়েতে মার্কিন সেনাবাহিনীর ৪র্থ পদাতিক ডিভিশনের সেনারা বেসামরিক বিমান থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সেনারা কুয়েত থেকে ইরাকের অভ্যন্তরে সামরিক মিশনে অংশ নেয়। ২০০১ সালের পর থেকেই মার্কিন বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলি অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলছে বলে তারাও বিশ্বব্যাপী মার্কিন সরকারের কাজ পাবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছে। বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক অপারেশন কমতে থাকলে মার্কিন এয়ারলাইন্সগুলিও আয় থেকে বঞ্চিত হবে। মার্কিন সামরিক বাহিনী এবং বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা উভয়কেই টিকিয়ে রেখেছে গত তিন দশক ধরে। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে উভয়েই এখন সমস্যার মাঝে পড়েছে।



গত ২২শে অগাস্ট মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নাগরিক এবং মার্কিনীদের সহায়তা করা আফগানদের সরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সিভিল রিজার্ভ এয়ার ফ্লিট’ বা ‘সিআরএএফ’কে কার্যকর করার আদেশ দেন। ‘সিআরএএফ’এর অধীনে ১৮টা বেসামরিক বিমানকে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের অধীনে আনা হয়। সামরিক পত্রিকা ‘ডিফেন্স ওয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইতিহাসে মাত্র তৃতীয়বারের মতো মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ জরুরি সামরিক মিশনে ‘সিআরএএফ’কে ব্যবহার করছে। মার্কিন পরিবহণ দপ্তরের সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘সিআরএএফ’ হলো এমন একটা প্রকল্প, যার মাধ্যমে মার্কিন বেসামরিক বিমান সংস্থাগুলি স্বেচ্ছায় নিজেদের বহরের প্রতিশ্রুত বিমানের মাঝে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ বিমান যেকোন সময় মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করতে দেবে। প্রতিটা বিমানই যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত হতে হবে এবং প্রতিটা বিমানের জন্যে কমপক্ষে ৪ জন ক্রু থাকতে হবে। মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে খেয়াল রাখে যেন এয়ারলাইন্সগুলি তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করার সক্ষমতা ধরে রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ‘ট্রান্সপোর্টেশন কমান্ড’এর সাথে চুক্তি অনুযায়ী বিমান সংস্থাগুলি স্বেচ্ছায় বিমান দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের পণ্য এবং মানুষ পরিবহণের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাবে।

‘সিআরএএফ’ আসলে কি জিনিস?

মার্কিন সামরিক বাহিনীর ‘এয়ার মোবিলিটি কমান্ড’এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হিসেবে দেখা যায় যে, ২০২১ সালের অগাস্টে ‘সিআরএএফ’এর অধীনে ২৪টা এয়ারলাইন্সের ৪’শ ৫০টা বিমান তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মাঝে ৪’শ ১৩টা বিমান রয়েছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অপারেশনে। যার মাঝে ২’শ ৬৮টা বিমান রয়েছে দূরবর্তী রুটের জন্য; আর ১’শ ৪৫টা রয়েছে কাছাকাছি রুটের জন্যে। এছাড়াও ৩৭টা বিমান রয়েছে মার্কিন মূল ভূখন্ডে পরিচালনার জন্যে। তবে এই সংখ্যাগুলি প্রায় প্রতিমাসেই পরিবর্তিত হচ্ছে।

১৯৫১ সালের ডিসেম্বরে ‘সিআরএএফ’এর জন্ম। এর মাত্র কয়েক বছর আগেই বার্লিন এয়ারলিফটের সময় কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই বেসামরিক বিমান ব্যবহার করে বার্লিনে জরুরি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পরিবহণ করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ২৪শে জুন থেকে ১৯৪৯ সালের ১২ই মে পর্যন্ত ১৫ মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের বার্লিন অবরোধের সময় ২ লক্ষ ৭৮ হাজার ফ্লাইটে ২৩ লক্ষ ২৬ হাজার টনেরও বেশি মালামাল পরিবহণ করা হয়; যার ৭৬ শতাংশ পরিবহণ করেছিল মার্কিনীরা; ২৩ শতাংশ করেছিল ব্রিটিশরা। এই ঘটনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ‘দ্যা ড্রাইভ’ ম্যাগাজিনের এই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বর্তমানে আফগানিস্তান মিশনের জন্যে প্রথম পর্যায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে; যার মাধ্যমে কোন একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে জরুরি দরকারে বিমান ব্যবহার করা হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা হলো কোন অঞ্চলে বড় কোন যুদ্ধাবস্থা মোকাবিলা করা; যা বিমানের সংখ্যাকে অনেক বাড়িয়ে নেবে। আর তৃতীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা হলো যদি বৈশ্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে যা করা হবে। দরকার বিশেষে কিছু বিমান ২৪ ঘন্টা; কিছু ৪৮ ঘন্টা; আর কিছু ৭২ ঘন্টার মাঝে ব্যবহারের উপযোগী করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এর আগে দু’বার ‘সিআরএএফ’কে কার্যকর করা হয়েছিল। তবে ‘সিআরএএফ’এর বিমানগুলি বিভিন্ন সময়ে সামরিক মহড়ায় এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মিশনে নিয়মিতই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ১৯৯০ সালে প্রথম ইরাক যুদ্ধের সময় এবং ২০০৩ সালে দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি মোতায়েন করার জন্যে প্রতিরক্ষা দপ্তর ‘সিআরএএফ’কে কার্যকর করেছিল। মার্কিন সরকারের ‘ডিফেন্স টেকনিক্যাল ইনফর্মেশন সেন্টার’এর ওয়েবসাইটে ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯০ সালে ‘অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড’ এবং ‘ডেজার্ট স্টর্ম’এর জন্যে ‘সিআরএএফ’এর ৭৭টা যাত্রীবাহী বিমান এবং ৩৯টা কার্গো বিমান কার্যকর করা হয়। এই বিমানগুলি মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো এবং সেখান থেকে ফেরত নিয়ে আসা সেনাদের ৬০ শতাংশ এবং মোট পণ্য পরিবহণের ২৫ শতাংশ পরিবহণ করে। এটা ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ের মিশন। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ ছিল প্রথম পর্যায়ের অপেক্ষাকৃত ছোট মিশন। মার্কিন বিমান বাহিনীর ‘এয়ারফোর্স ম্যাগাজিন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বিভিন্ন সময়ে ‘সিআরএএফ'’র বেসরকারি বিমানগুলি মার্কিন সামরিক মিশনের ৫০ শতাংশ জনবল এবং কার্গো পরিবহণ করে আসছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর চাইছে যে, বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক ঘাঁটি কমিয়ে আনার সাথেসাথে ‘সিআরএএফ’এর পিছনে খরচও যেন কমে আসে। কারণ এই খরচ এখন বাৎসরিক প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ শুরু করলে ‘সিআরএএফ’এর বিমানের ব্যবহার ভীষণভাবে বেড়ে যায়। মার্কিন এয়ারলাইন্সগুলি মার্কিন সরকারের কাজ পাবার উপরে অনেকাংশেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মার্কিন সরকার নিয়ম পরিবর্তন করে বলে দেয় যে, এয়ারলাইন্সগুলির কমপক্ষে ৬০ শতাংশ আয় আসতে হবে বাণিজ্যিক পরিবহণের মাধ্যমে; বাকি ৪০ শতাংশ সরকারি কাজের মাধ্যমে আসতে পারে। মোট ২৪টা এয়ারলাইন্স ‘সিআরএএফ’এর আওতায় থাকলেও প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র পাঁচটা কোম্পানি; যেগুলি হলো, যাত্রী পরিবহণের জন্যে ‘আমেরিকান এয়ারলাইন্স’, ‘ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স’, ‘ডেল্টা এয়ারলাইন্স’; আর কার্গো পরিবহণের জন্যে ‘ফেডএক্স’ ও ‘ইউনাইটেড পার্সেল সার্ভিস’। মার্কিন সরকারের নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের জন্যেই বেশি বিমান চাওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য হবে দু’টা সেনা ব্রিগেডকে যেন তার সকল রসদসহ এক সপ্তাহের মাঝে দুনিয়ার যেকোন স্থানে মোতায়েন করা যায়; অথবা কোন জনহিতকর কাজে যেন ব্যবহার করা যায়। আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দর থেকে মানুষ সরিয়ে নেয়াটা এমনই একটা প্রথম পর্যায়ের মিশন। 


ছবিঃ ২০০৪ সাল। বেসামরিক বিমানে ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরছে মার্কিন সেনারা।

 
আফগানিস্তানের মিশনে বেসামরিক বিমানের ব্যাপক ব্যবহার

প্রতিরক্ষামন্ত্রী অস্টিনের আদেশ অনুযায়ী ‘আমেরিকান এয়ারলাইন্স’, ‘এটলাস এয়ার’ এবং ‘ডেল্টা এয়ারলাইন্স’ তিনটা করে বিমান দেবে; ‘অমনি এয়ার’ এবং ‘হাওয়াইয়ান এয়ারলাইন্স’ দেবে দু’টা করে বিমান; আর ‘ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স’ দেবে চারটা বিমান। এই বিমানগুলি আফগানিস্তানে যাবে না; বরং সেগুলি কাবুল থেকে মার্কিন সামরিক পরিবহণ বিমানে করে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিতে নিয়ে আসা মানুষদেরকে আমেরিকা বা ইউরোপ বা অন্যান্য দেশে নিয়ে যাবে। ২২শে অগাস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাংবাদিকদের বলেন যে, গত ১৫ই অগাস্টে কাবুলে মার্কিন দূতাবাস খালি করার পর থেকে তখন পর্যন্ত প্রায় ২৮ হাজার মানুষকে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। ‘দ্যা ড্রাইভ’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই কাজে ‘সিআরএএফ’ কার্যকর করার আগেই অনেক বেসরকারি পরিবহণ বিমান চার্টারের মাধ্যমে ব্যবহার করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর। ‘মিলিটারি টাইমস’এর সম্পাদক হাওয়ার্ড আল্টম্যান ২১শে অগাস্টের এক টুইটার বার্তায় জানাচ্ছেন যে, ২৪ ঘন্টায় কাবুল থেকে ৩৮টা বিমান উড্ডয়ন করে, যার মাঝে ৬টা ছিল ‘সি ১৭’ সামরিক পরিবহণ বিমান; আর ৩২টা ছিল বেসামরিক চার্টার বিমান।

‘সিএনবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আদেশ দেয়ার দিনই ‘ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স’এর প্রথম বিমানটা জার্মানির ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট হান’ বিমানবন্দর থেকে কাতারে ‘আল উদাইদ’ মার্কিন সামরিক ঘাঁটির দিকে রওয়ানা হয়। এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা বলছেন যে, বিমানগুলিতে সম্ভবতঃ ডায়াপার, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পণ্য এবং কিছু কাপড় ভরে নিচ্ছেন তারা যাত্রীদের দরকারের জন্য। ‘ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স’ তাদের ‘বোয়িং ৭৭৭ ৩০০’ বিমান ব্যবহার করছে; এগুলির একেকটা ৩’শ ৫০ জন যাত্রী বহণ করতে পারে। এই মিশনগুলির জন্যে বিমানের ক্রুদেরকে বেশি পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে। ‘ডেল্টা এয়ারলাইন্স’এর কর্মকর্তারা বলছেন যে, তারা বিভিন্ন রুটে বর্তমানে ওড়া বিমানগুলিকে ব্যবহার করছে না; বরং যে বিমানগুলি বসে ছিল, সেগুলিই ব্যবহার করছে। একারণে তাদের স্বাভাবিক ফ্লাইট শিডিউলে কোন পরিবর্তন হবে না। তবে ‘আমেরিকান এয়ারলাইন্স’ তাদের শিডিউল ফ্লাইট থেকেই বিমান সরিয়ে নিচ্ছে এই মিশনের জন্যে। অপরপক্ষে ‘এটলাস এয়ার’ মূলতঃ একটা কার্গো ক্যারিয়ার; যারা এমনিতেই নিয়মিতভাবে মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্যে মালামাল পরিবহণ করে থাকে। কোম্পানির যাত্রীবাহী বিমানগুলির মাঝে রয়েছে ‘বোয়িং ৭৪৭ ৪০০’ বিমান, যেগুলি ৩’শ ৭৪ জন যাত্রী বহণে সক্ষম; আর ‘বোয়িং ৭৬৭ ৩০০’ বিমানগুলি বহণ করতে পারে ২’শ ১৫ জন। ‘সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্স’ এই প্রকল্পের অংশ না হলেও তারা এই প্রকল্পে অংশ নেবার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে মূল ভুখন্ডে বিভিন্ন বিমানবন্দরের মাঝে পরিচালনার জন্যে স্বাভাবিক ফ্লাইট ব্যাহত না করে বসে থাকা বিমানগুলিকে ব্যবহার করবে।

হোয়াইট হাউজের বরাত দিয়ে ‘সিএনএন’ বলছে যে, ১৫ই অগাস্ট থেকে ২৭শে অগাস্ট পর্যন্ত মোট ১ লক্ষ ৯ হাজার ২’শ মানুষকে কাবুল থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ ‘সিআরএএফ’ কার্যকর করার দিন থেকে পাঁচ দিনে প্রায় ৭১ হাজার মানুষকে সরিয়ে আনা হয়েছে। পেন্টাগন বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে ভার্জিনিয়ার ফোর্ট পিকেট এবং নিউ মেক্সিকোর হলোম্যান এয়ার ফোর্স বেইসকে তৈরি করা হচ্ছে আফগানিস্তানের শরণার্থীদের রাখার জন্যে। ২৩শে অগাস্ট মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান সাংবাদিকদের বলেন যে, মার্কিন সরকার কাবুল বিমানবন্দরের অপারেশনের জন্যে তালিবানদের সাথে সর্বদাই সমন্বয় করে চলছে। কাবুল বিমানবন্দর পর্যন্ত মানুষদের সহজে পৌঁছার জন্যে তারা রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা চ্যানেলগুলি ব্যবহার করে তালিবানদের সাথে আলোচনা করে চলেছেন। তিনি বলেন যে, ৩১শে অগাস্টের মাঝে যেসকল মার্কিন নাগরিক আফগানিস্তান ছাড়তে ইচ্ছুক, তাদের সকলকেই সরিয়ে নেয়া সম্ভব। তবে এর এক সপ্তাহ আগেই পেন্টাগন বলে যে, কাবুলে থাকা মার্কিন নাগরিকদের বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছাবার নিশ্চয়তাই মার্কিনীরা দিতে পারছে না; যদিও কাবুলে এই মুহুর্তে কয়েক হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে।

কাবুল এয়ারলিফট দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মার্কিন সামরিক বাহিনী বিশ্বব্যাপী তাদের অবস্থানকে ধরে রাখতে বেসরকারি বিমান বহরের উপর কতটা নির্ভরশীল। বিশেষ করে গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ মার্কিনীদেরকে বেসামরিক বিমান বহরের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল করে ফেলেছে। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পরিবহণ কর্মকান্ডের প্রায় অর্ধেক এই বেসামরিক বিমান বহরগুলিই করছে; যেকারণে বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক মিশনের পরিবহণ খরচ হিসেবে ‘সিআরএএফ’এর জন্যে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের খরচ যোগাতে হিমসিম খাচ্ছে পেন্টাগন। একইসাথে ২০০১ সালের পর থেকেই মার্কিন বিমান পরিবহণ সংস্থাগুলি অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলছে বলে তারাও বিশ্বব্যাপী মার্কিন সরকারের কাজ পাবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছে। এই কোম্পানিগুলির মার্কিন সরকারি কাজের উপর নির্ভরশীলতা কমাতেই নিয়ম করে বলে দেয়া হয়েছে যে, এয়ারলাইন্সগুলির আয়ের ৪০ শতাংশের বেশি সরকারি কাজের উপর নির্ভরশীল থাকতে পারবে না। কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হবার পর এয়ারলাইন্সগুলির অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। ইতোমধ্যেই ‘সিআরএএফ’এর বিমানের সংখ্যা ২০১৪ সালে ৫’শ ৫২ থেকে ২০২১ সালে ৪’শ ৫০এ নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক অপারেশন কমতে থাকলে মার্কিন এয়ারলাইন্সগুলিও আয় থেকে বঞ্চিত হবে। মার্কিন সামরিক বাহিনী এবং বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা উভয়কেই টিকিয়ে রেখেছে গত তিন দশক ধরে। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে উভয়েই এখন সমস্যার মাঝে পড়েছে।

Thursday 26 August 2021

আলজেরিয়া এবং মরক্কোর দ্বন্দ্ব ... এখন কেন?

২৬শে অগাস্ট ২০২১
পশ্চিম সাহারার অবস্থান উল্টোদিকে মরক্কোর দক্ষিণে; যেখানে ব্যস্ত থেকে জিবরালটার থেকে দূরে রয়েছে মরক্কোর সেনাবাহিনী। জিবরালটারের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবাণিজ্যপথ মরক্কোর পররাষ্ট্রনীতি থেকে দূরে থাকবে ততদিন, যতদিন পশ্চিম সাহারার দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখবে ইউরোপ এবং আলজেরিয়া। এই দ্বন্দ্ব তুরস্ক এবং ইস্রাইলের মত দেশগুলিকেও যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় পশ্চিম আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় টেনে আনছে। একইসাথে এই দ্বন্দ্বের কারণে মরক্কো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখার জন্যে একটা ‘দরজা’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।



গত ২৪শে অগাস্ট আলজেরিয়ার সরকার মরক্কোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রামদানি লামামরা সাংবাদিকদের বলেন যে, মরক্কো আলজেরিয়ার কর্মকর্তাদের উপর ‘পেগাসাস’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে গোয়েন্দাগিরি করছে। একইসাথে মরক্কো আলজেরিয়ার অভ্যন্তরে একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপকে সমর্থন দিচ্ছে এবং পশ্চিম সাহারার ব্যাপারে মরক্কো যে প্রতিশ্রুতিগুলি দিয়েছে, সেগুলি তারা রাখছে না। লামামরা বলেন যে, মরক্কো কখনোই আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ বন্ধ করেনি। আলজেরিয়ার এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মরক্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক টুইটার বার্তায় বলে যে, আলজেরিয়ার এই সিদ্ধান্ত দুঃখজনক এবং অহেতুক। ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, দুই দেশের মাঝে সীমানা ১৯৯৪ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। এর আগে দুই দেশের দ্বন্দ্বে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হলেও ১৯৮৮ সালে তা আবারও পূর্বাবস্থায় আনা হয়েছিল। তবে সেই সময় থেকে এবারই প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হলো। মরক্কো দুই দেশের মাঝে সীমানা খুলতে চাইলেও নিরাপত্তার কথা বলে আলজেরিয়া সীমানা বন্ধ রেখেছে।

এর এক সপ্তাহ আগেই আলজেরিয়ার সরকার বলে যে, সেদেশে ভয়াবহ দাবানলে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগানোর পিছনে দু’টা গ্রুপ জড়িত; যাদেরকে আলজেরিয়া কিছুদিন আগেই সন্ত্রাসী বলে ঘোষণা দিয়েছে। আলজেরিয়ার পূর্বাঞ্চলে কাবাইলি অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘এমএকে’ এই দুই গ্রুপের একটা। এই গ্রুপকে মরক্কো এবং ইস্রাইল সহায়তা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করে আলজেরিয়ার সরকার। দাবানলে ঐ অঞ্চলই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আলজেরিয়া সরকার আগুন লাগাবার এবং একজন নিরপরাধ মানুষকে দোষী অপবাদ দিয়ে গণপিটুনি দিয়ে খুন করে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে; যাদের কয়েকজন নিজেদেরকে ‘এমএকে’এর সদস্য বলে স্বীকার করে। আলজেরিয়ার টেলিভিশনে তাদের স্বীকারোক্তি প্রচার করা হয়। একইসাথে নিরপরাধ গায়ক জামাল বেন ইসমাইলের মৃত্যুকে সরকারের সিদ্ধান্তের পিছনে জনসমর্থন আদায়ে ব্যবহার করা হয়।

এর আগে গত ১৮ই জুলাই আলজেরিয়ার সরকার মরক্কো থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয়। অভিযোগ ছিল যে, নিউ ইয়র্কে মরক্কোর রাষ্ট্রদূত ওমর হিলালি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের এক বৈঠকে আলজেরিয়ার বিচ্ছন্নতাবাদীদের পক্ষে কথা বলেছেন। হিলালি বলেন যে, যদি পশ্চিম সাহারার জনগণের নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকারের ব্যাপারে আলজেরিয়া এতটা সোচ্চার থাকে, তাহলে তাদের নিজেদের দেশে কাবাইলি অঞ্চলের জনগণকেও নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার দেয়া উচিৎ। হিলালির কথাগুলি দুই দেশের বহু বছরের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে। ১৯৭০এর দশক থেকেই মরক্কোর দক্ষিণে পশ্চিম সাহারা অঞ্চলে ‘পলিসারিও ফ্রন্ট’ স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করছে। পলিসারিওকে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে আলজেরিয়া। অপরদিকে মরক্কো এই অঞ্চলকে নিজের অঞ্চল বলে মনে করে। ১৯৯১ সালে যুদ্ধ শেষ হলেও অনেক বছর ঠান্ডা থাকার পর ২০২০ সালের শেষ দিকে পশ্চিম সাহারার ইস্যু আবারও গরম হয়ে উঠতে শুরু করে, যখন গত নভেম্বরে পলিসারিও ঘোষণা দেয় যে, তারা আবারও সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে যাচ্ছে। এরপর অবশেষে গত ডিসেম্বরে ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম সাহার উপর মরক্কোর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়।
 
ইইউ বলে যে, মরক্কোর সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর সহায়তাতেই শরণার্থীরা স্প্যানিশ ছিটমহলে ঢুকে পড়ে; উদ্দেশ্য ছিল স্পেনের উপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা। অনেকেই মনে করেছেন যে, স্পেনের সেউতা ছিটমহলে শরণার্থীদের প্রেরণ করা ছিল মূলতঃ পশ্চিম সাহারার পলিসারিওর নেতাকে স্পেনে ঢুকতে দেয়ার প্রতিশোধমূলক কর্মকান্ড।


মরক্কোর সাথে আলজেরিয়া নতুন করে দ্বন্দ্ব এমন এক সময়ে এলো, যখন ইউরোপের সাথে মরক্কোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। গত ১০ই জুন ইইউ পার্লামেন্টে পাস করা এক রেজোলিউশনে বলা হয় যে, গত মে মাসে মরক্কোর মূল ভুখন্ডে স্প্যানিশ ছিটমহল সেউতাতে ১০ হাজার শরণার্থী ঢুকে যাবার পিছনে মরক্কো সরকারের হাত ছিল। ইইউ বলে যে, মরক্কোর সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর সহায়তাতেই শরণার্থীরা স্প্যানিশ ছিটমহলে ঢুকে পড়ে; উদ্দেশ্য ছিল স্পেনের উপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা। অনেকেই মনে করেছেন যে, স্পেনের সেউতা ছিটমহলে শরণার্থীদের প্রেরণ করা ছিল মূলতঃ পশ্চিম সাহারার পলিসারিওর নেতাকে স্পেনে ঢুকতে দেয়ার প্রতিশোধমূলক কর্মকান্ড।

পলিসারিওর সাথে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় মরক্কোর পক্ষে থেকেছে এবং প্রচুর অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের উত্তেজনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কিনছে মরক্কো। গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোর কাছে ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির প্রতিশ্রুতি দেয়। এই অস্ত্রের মাঝে ছিল ৪টা ‘এমকিউ ৯ রীপার’ অস্ত্রবাহী ড্রোন এবং লেজার গাইডেড বোমা। ‘ডিফেন্স ওয়ার্ল্ড’ বলছে যে, ২০১৯এর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোর কাছে ২৪টা ‘এএইচ ৬৪ এপাচি’ এটাক হেলিকপ্টার এবং প্রায় আড়াই হাজার ‘টো ২এ’ এন্টিট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই চুক্তির মূল্যমান ছিল ৪ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। এর মাঝে ‘ম্যান আনম্যানড টিমিং’ নামে একটা প্রযুক্তিও বিক্রি করা হচ্ছে; যার মাধ্যমে এপাচি হেলিকপ্টারের পাইলট একটা ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং ড্রোনের পাঠানো ভিডিও সরাসরি দেখতে পাবে। এর মাধ্যমে মরক্কোর সামরিক সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। এর আগে ২০১৯এর মার্চে যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোকে ২৫টা নতুন ‘এফ ১৬’ যুদ্ধবিমান বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়াও গত এপ্রিলে মরক্কো তুরস্কের ‘বায়কার মাকিনা’ কোম্পানির কাছ থেকে ৭০ মিলিয়ন ডলারে ১৩টা ‘বায়রাকতার টিবি ২’ ড্রোন কিনছে বলে বলা হয়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্যামুয়েল রামানি ‘ডিফেন্স নিউজ’কে বলছেন যে, গত এপ্রিল মাসে মরক্কো প্রথমবারের মতো ড্রোন ব্যবহার করে পলিসারিওর উপর হামলা করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক একত্রে মরক্কোর সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। একইসাথে ইস্রাইলের সাথে মরক্কোর সম্পর্ক স্বাভাবিক হবার কারণে ইস্রাইলও হয়তো মরক্কোকে সামরিক সহয়তা দেবে; বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তি দিয়ে।

মরক্কোর কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। মরক্কোর উত্তরে রয়েছে কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিবরালটার প্রণালি। সেউতা ছিটমহলের অবস্থানও ঠিক তার দক্ষিণে। অপরদিকে পশ্চিম সাহারার অবস্থান উল্টোদিকে মরক্কোর দক্ষিণে; যেখানে ব্যস্ত থেকে জিবরালটার থেকে দূরে রয়েছে মরক্কোর সেনাবাহিনী। জিবরালটারের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবাণিজ্যপথ মরক্কোর পররাষ্ট্রনীতি থেকে দূরে থাকবে ততদিন, যতদিন পশ্চিম সাহারার দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখবে ইউরোপ এবং আলজেরিয়া। এই দ্বন্দ্ব তুরস্ক এবং ইস্রাইলের মত দেশগুলিকেও যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় পশ্চিম আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় টেনে আনছে। একইসাথে এই দ্বন্দ্বের কারণে মরক্কো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখার জন্যে একটা ‘দরজা’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

Tuesday 17 August 2021

আফগান বিপর্যয়ে বৈশ্বিক নেতৃত্ব ফিরে পাবার শেষ আশাটুকু হারালো যুক্তরাষ্ট্র

১৮ই অগাস্ট ২০২১

কাবুলের মার্কিন দূতাবাসের উপর মার্কিন হেলিকপ্টারের ছবিগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কাছে তেমন কিছু না হলেও তা যে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বের গোড়ায় আঘাত করেছে, তা সেদেশের নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে বলেই তারা কেউই চার দশকের মাঝে সবচাইতে মারাত্মক এই বিপর্যয়ের দায় নিতে চাইছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরা আরও আগ থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা কমাচ্ছে। কাবুলের বিপর্যয় সেই সিদ্ধান্তকে আরও দৃঢ়তা দিলো কেবল। প্রকৃতপক্ষে আফগান বিপর্যয় যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বশীল অবস্থানে ফিরে আসার শেষ আশাটুকুও কেড়ে নিল।


১৬ই অগাস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তানের পরিস্থিতির ব্যাপারে মুখ খুলেছেন। এক বক্তব্যে তিনি বলেন যে, তিনি ২০০৯ সালে বারাক ওবামা প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে আফগানিস্তানে অতিরিক্ত সেনা প্রেরণের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি আরও বলেন যে, যদিও সেনা সরাতে গিয়ে অনেক সমস্যার পড়তে হয়েছে, তথাপি সেনা সরিয়ে নেবার জন্যে কোন ভালো সময় কখনোই ছিল না। তিনি বলেন যে, গত এক সপ্তাহের ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসাটা সঠিক সিদ্ধান্তই ছিল। যে যুদ্ধে আফগানরা নিজেরাই নিজেদের জন্যে যুদ্ধ করতে রাজি নয়, সেখানে মার্কিন সেনাদের যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করাটা উচিৎ নয়। তিনি আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির জন্যে দায় পুরোপুরিভাবে নিজের কাঁধে নিতে চাননি। তিনি বলেন যে, আফগানিস্তানে মার্কিন মিশন কখনোই দেশ গড়ার জন্যে ছিল না। তিনি ক্ষমতায় এসে তালিবানদের সাথে চুক্তির ফলাফলটুকু পেয়েছেন; কারণ সেই চুক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় করা হয়েছিল। তিনি হলেন চতুর্থ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন; এবং তিনি পঞ্চম কোন প্রেসিডেন্টের কাছে এই দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চান না। তবে সকলে বাইডেনের সাথে একমত হতে পারেননি। রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাকনেল এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, আফগানিস্তান হলো একটা চরম বিপর্যয়। বাইডেন প্রশাসনের আফগানিস্তান থেকে সরে আসার জন্যে তা যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদার উপরেই দাগ ফেলে দিয়েছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, অনেক মার্কিনীদের কাছেই কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের উপর মার্কিন হেলিকপ্টার ওড়ার ঘটনাটা ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের লজ্জাজনক পলায়নের স্মৃতিকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে; বাইডেন সেসময় একজন নব নির্বাচিত সিনেটর ছিলেন।

‘ভয়েস অব আমেরিকা’ বাইডেনের বক্তব্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং সংস্থার প্রতিক্রিয়া যোগাড় করেছে। কংগ্রেসের রিপাবলিকান দলের প্রধান কেভিন ম্যাকার্থি বলছেন যে, কয়েক দশকের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে মারাত্মক পররাষ্ট্রনীতি বিপর্যয়ে ছয় দিন চুপ থাকার পর বাইডেন মুখ খুলেছেন। তার বক্তব্য সৈন্য সরাবার বিপর্যয়ের কারণে মার্কিন জনগণকে রক্ষা করতে না পারা, হাজারো সেনাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া এবং সন্ত্রাসবাদের হুমকি বেড়ে যাবার বিষয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়না। আরেক রিপাবলিকান লিন্ডসে গ্রাহাম বলছেন যে, বাইডেন আফগানিস্তানে বিপজ্জনক এবং অপমানজনক পথে হেঁটেছেন; এর জন্যে তিনি নিজেকে ছাড়া কাউকেই দোষ দিতে পারেন না। ডেমোক্র্যাট দলের প্রধান স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বাইডেনকে সমর্থন করে বলেন যে, শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং মার্কিন সেনাদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে আনার জন্যে একাগ্র ভূমিকার জন্যে প্রেসিডেন্ট প্রশংসার দাবিদার। মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট’এর ফেলো ক্যাথারিন জিমারম্যান বলছেন যে, তালিবান আফগানিস্তানে ইসলামিক আমিরাত প্রতিষ্ঠার ফলে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রয়েছে মানবাধিকার, এই কথাগুলি অন্তসারশূণ্য হয়ে গেলো। ‘ফ্রিডমওয়ার্কস’এর প্রেসিডেন্ট এডাম ব্র্যান্ডন বলছেন যে, আফগানিস্তানের এই পরিস্থিতির জন্যে শুধুমাত্র বাইডেনকে দায়ী করা যাবে না। কংগ্রেসের সামনে যেসকল সামরিক এবং ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছেন, তাদেরকেও দায়ী করতে হবে।

‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, একমাস আগেই বাইডেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, তালিবানরা পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেবে, এটা প্রায় অসম্ভব। তবে এবারের ভাষণে তিনি স্বীকার করেন যে, আফগানিস্তানের ঘটনাগুলি তারা যতটা দ্রুত আশা করেছিলেন, তার চাইতে বেশি দ্রুত ঘটেছে। বাইডেনের সাথে সুর মিলিয়েই ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জ্যান্স স্টলটেনবার্গ বলেন যে, আফগানিস্তানে ন্যাটোর সেনারা চিরকালের জন্যে যায়নি। তবে তালিবানরা যত দ্রুত আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, তা তাদেরকে অবাক করেছে। তিনি তালিবানদের এই সাফল্যের পিছনে আফগান রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই দায়ি করেন। ‘বিবিসি’ আরও বলছে যে, মার্কিন জনমত বলছে যে, বেশিরভাগ জনগণই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পক্ষে। ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ বা ‘সিএসআইএস’এর এনথনি করডেসম্যান বাইডেনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলেন যে, আফগানিস্তানে যত সময়ই যুক্তরাষ্ট্র থাকুক না কেন, সেখানে কার্যকর একটা গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না; এই ব্যাপারটাকে তিনি বেশ শক্তিশালীভাবেই তুলে ধরেছেন। একই ধরনের কথা বলেছেন ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর সিনিয়র ফেলো চার্লস কুপচান। তিনি বলেন যে, ছয় মাস, এক বছর বা দুই বছর সময় দিলেই ফলাফল পরিবর্তিত হয়ে যেতো, এমন কোন প্রমাণ নেই। ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর সিনিয়ন ফেলো আরন ডেভিড মিলার বলছেন যে, বাইডেন যে একটা বিষয় সম্পর্কে তার দায় স্বীকার করেছেন তা হলো, তারা বুঝতে পারেননি যে তালিবানরা এতটা সহজে পুরো আফগানিস্তান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে।

‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রধান মার্কিন চিন্তাবিদ ইয়ান ব্রেমার বাইডেনের সমালোচনা করে বলছেন যে, বাইডেন তার বক্তব্যে কেন আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া উচিৎ সেটার শক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আফগানিস্তানে মারাত্মক কতগুলি ব্যর্থতার ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি। ব্রেমার বলছেন যে, ১৯৭৯ সালে ইরানে মার্কিন দূতাবাসের জিম্মি হবার পর থেকে চার দশকে এটা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সবচাইতে ভয়াবহতম পররাষ্ট্রনীতির বিপর্যয়। এখানে ব্যর্থতাগুলির প্রথমে থাকবে সামরিক এবং ইন্টেলিজেন্সের ব্যর্থতা। যখন বাইডেন আফগানিস্তান ত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা বলেছিলেন যে, আফগান সেনাবাহিনী তালিবানদের বিরুদ্ধে দুই থেকে তিন বছর যুদ্ধ করতে পারবে। অথচ যখন তালিবানরা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে, তখন ইন্টেলিজেন্সের কর্মকর্তারা বলেন যে, আফগান সেনাবাহিনী মাত্র দুই থেকে তিন দিন টিকবে! ব্রেমার বলছেন যে, তিনি তার ক্যারিয়ারে এতবড় ইন্টেলিজেন্স ব্যর্থতার কথা কখনোই শোনেননি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ বছর ধরে প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে যে আফগান সেনাবাহিনী তৈরি করেছে, তা যুদ্ধ করতে রাজি হয়নি! আর দুই দশক ধরে প্রশিক্ষণ দেবার পরেও এই সেনাদের সক্ষমতা এবং মনোবল সম্পর্কে তারা নিশ্চিত ছিলেন না! দ্বিতীয়তঃ সমন্বয়ের ব্যর্থতা। পশ্চিমা দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সাথেসাথে আফগানিস্তানে গিয়েছে এবং যুদ্ধ করে জীবনও দিয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তান ত্যাগের সময় যুক্তরাষ্ট্র একাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যখন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত কাবুলে রয়ে গিয়েছেন, তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত কাবুল ছেড়ে গিয়েছেন। তৃতীয়তঃ পরিকল্পনার ব্যর্থতা। ছয় হাজার সেনাকে একবার আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়ে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ড থেকে কয়েক হাজার সেনাকে উড়িয়ে নিয়ে আসা এবং আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের সহায়তা করা হাজারো আফগানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে না পারা খুবই বাজে ধরনের পরিকল্পনার ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। পুরো ব্যাপারটাই শেষ মার্কিন সেনা দেশ ছাড়ার আগেই করা যেতো। আর চতুর্থতঃ গণযোগাযোগের ব্যর্থতা। ৮ই জুলাই বাইডেন বলেছিলেন যে, তালিবানের পক্ষে পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়া প্রায় অসম্ভব। বাইডেন আরও বলেছিলেন যে, ১৯৭৫ সালে সায়গনে মার্কিন দূতাবাসের ছাদের উপর থেকে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেবার মতো কোন পরিস্থিতিই কাবুলে নেই। ব্রেমার বলছেন যে, বাইডেনের এই কথাগুলি স্বল্প সময়ের মাঝেই ভুল প্রমাণিত হবার পরেও মার্কিম কর্মকর্তারা বলছিলেন যে, তারা সাফল্যের সাথে কর্মসম্পাদন করেছেন। শুধু তাই নয়, এরকম একটা দুর্যোগ পরিস্থিতিতে বাইডেন ক্যাম্প ডেভিডের অবকাশকেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন এবং সেসময় বাইডেনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা কেউই তার সাথে ছিলেন না। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সাথে কথা বলছিলেন অনলাইনে। আর এতবড় একটা দুর্যোগের পর মুখ খুলতে বাইডেন নিঃসন্দেহে অনেক বেশি সময় নিয়েছেন।

ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, বাইডেনের সিদ্ধান্তের পিছনে যথেষ্ট জনসমর্থন রয়েছে। কারণ রাজনৈতিক মতামত দিতে অপারগ সাধারণ আমেরিকানরা আফগানিস্তানের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চান না। তবে কাবুল ছেড়ে আসার সময় যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে তা ১৯৭৯ সালের তেহরান দূতাবাসের বিপর্যয়কেও ছাড়িয়ে যাবে। এবং তা বাইডেনের প্রেসিডেন্সিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলতে পারে। এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কাবুলের ঘটনাগুলি হয়তো বড় কোন প্রভাব ফেলবে না; তবে আন্তর্জাতিকভাবে এর ফলাফল হবে মারাত্মক। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরা হয়তো মনে করতে শুরু করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তার আগের নেতৃত্বশীল অবস্থানে ফিরে এসেছে; তারা এখন ধরেই নেবে যে, যুক্তরাষ্ট্র আসলে একা একাই সিদ্ধান্ত নেবে এবং কাজ করবে; অন্য কারুর সিদ্ধান্ত তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুক্তরাষ্ট্র একটা অনির্ভরযোগ্য বন্ধু। পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি হারালো। রাশিয়া এবং চীন এখন অন্যান্য দেশের কাছে আরও নির্ভরযোগ্যভাবে বলতে পারবে যে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা রাখে না। এমতাবস্থায় বিশ্বের অনেক দেশই যুক্তরাষ্ট্রের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল থাকতে চাইবে না।

আফগানিস্তানের ব্যাপারে মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের ব্যর্থতা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হারাবার ক্ষেত্রে মার্কিন ইন্টেলিজেন্সের দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যৎবাণী পুরোপুরিই সত্যি হতে চলেছে। কাবুলের মার্কিন দূতাবাসের উপর মার্কিন হেলিকপ্টারের ছবিগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কাছে তেমন কিছু না হলেও তা যে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বের গোড়ায় আঘাত করেছে, তা সেদেশের নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে বলেই তারা কেউই চার দশকের মাঝে সবচাইতে মারাত্মক এই বিপর্যয়ের দায় নিতে চাইছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরা আরও আগ থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা কমাচ্ছে। কাবুলের বিপর্যয় সেই সিদ্ধান্তকে আরও দৃঢ়তা দিলো কেবল। প্রকৃতপক্ষে আফগান বিপর্যয় যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বশীল অবস্থানে ফিরে আসার শেষ আশাটুকুও কেড়ে নিল।

Sunday 15 August 2021

তালিবান... আবার?

১৬ই অগাস্ট ২০২১ 
১৫ই অগাস্ট হেলিকপ্টার দিয়ে মার্কিন দূতাবাস খালি করার ভিডিও চিত্র দেখা যাচ্ছিল সকল টেলিভিশন চ্যানেলে। ছবিগুলি বিশ্বব্যাপী মার্কিন প্রভাব কমার উদাহরণ হিসেবেই প্রতিফলিত হবে। তবে আলোচনার টেবিলে বসে যুক্তরাষ্ট্র যে ব্যাপারগুলি নিশ্চিত করেছে তার মাঝে রয়েছে আইনের ব্যাপারে তালিবানকে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি করানো এবং আন্তর্জাতিক সীমানা অমান্য করে খিলাফত ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকা। হেরে গিয়েও যুক্তরাষ্ট্র তালিবানদেরকে দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত করিয়ে নিয়েছে। তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাক্ষার জন্যে যথেষ্ট নাও হতে পারে। 


১৫ই অগাস্ট মার্কিনীদের জন্যে যেমন ভুলে যাবার মতো দিন হিসেবে থাকবে, আফগানিস্তানের তালিবানদের জন্যেও ঠিক একইভাবে মনে রাখার মতো দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। হেলিকপ্টার দিয়ে মার্কিন দূতাবাস খালি করার ভিডিও চিত্র দেখা যাচ্ছিল সকল টেলিভিশন চ্যানেলে। অনেকেই এর সমান্তরাল টানছিলেন ১৯৭৫ সালের ২৯শে এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন থেকে মার্কিন দূতাবাস খালি করার ঘটনার সাথে। ছবিগুলি বিশ্বব্যাপী মার্কিন প্রভাব কমার উদাহরণ হিসেবেই প্রতিফলিত হবে। অনেকেই অবাক হচ্ছেন এই ভেবে যে, আফগান সেনাবাহিনী প্রায় কোন যুদ্ধ ছাড়াই কিভাবে তালিবানদের হাতে পুরো দেশ ছেড়ে দিল। আর একইসাথে অনেকেই আলোচনা করছেন তালিবানদের চিন্তাধারা, নীতি এবং কর্মকান্ড নিয়ে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, তালিবানদের হাতে আফগান সেনাবাহিনীর পরাজয় প্রায় জানাই ছিল; তবে এটা কতটা দ্রুত হতে পারে, সেব্যাপারে কেউই নিশ্চিত ছিলেন না। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, আফগান সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা কাগজেকলমে ৩ লক্ষের মতো হলেও প্রকৃতপক্ষে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের আয় বৃদ্ধি করার জন্যে সেনাসদস্যের সংখ্যা বেশি দেখাতো। আফগান সেনারা এতটাই কম বেতন পেত যে, তারা তাদের অস্ত্র এবং যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দিয়ে সংসার চালাতো। কোন দরকার ছাড়াই বেশি বুলেট ব্যবহার করতো এবং বুলেটের খোসাগুলি ব্জারে বিক্রি করে দিতো। আফগান সেনাবাহিনীর অস্ত্র এবং যন্ত্রপাতি তালিবানরা আফগান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করেছে। এমতাবস্থায় আফগান সেনাবাহিনীর অস্ত্রসস্ত্র নয়, বরং তাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছাশক্তিটাই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্ততঃ গত কয়েকদিনের খবরে এটা পরিষ্কার যে, এই ইচ্ছাশক্তি পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল আফগানিস্তানের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির উপর।

মার্কিন কূটনীতিবিদ জালমেই খলিলজাদ আফগানিস্তানের একাধিক টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাতে বলেছেন যে, এই তালিবান আগের তালিবান নয়; তারা অনেক পরিবর্তিত হয়েছে; বিশেষ করে নারী শিক্ষা, বাকি বিশ্বের সাথে সম্পর্ক এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিকে থাকতে দেবার ক্ষেত্রে তারা তাদের আগের ভুলগুলি বুঝতে পেরেছে। তবে পশ্চিমা দুনিয়ার অনেকেই খলিলজাদের সাথে একমত নন। তারা মনে করছেন যে, তালিবানরা পশ্চিমা আদর্শ বাস্তবায়ন থেকে বহুদূরে রয়েছে। যেমন, তারা এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় মানুষের উপর প্রচুর করের বোঝা চাপাচ্ছে; স্কুল বন্ধ করে দিচ্ছে; সরকার পরিচালনায় নারী সদস্য রাখছে না; ইত্যাদি। তালিবানরা দোহা আলোচনায় কোন নারী সদস্য বা সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি রাখেনি বলেও পশ্চিমারা অভিযোগ করেছে। দোহাতে তারা সেকুলার আইনের স্থানে কিছু শরীয়াহ আইন বাস্তবায়নের কথা বলার কারণেও পশ্চিমারা নাখোশ হয়েছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, তালিবানরা যে ব্যাপারটাতে সবচাইতে বেশি অদূরদর্শিতা দেখিয়েছে তা হলো, আফগানিস্তানের জন্যে নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য দেখাতে না পারা। সরকার পরিচালনা, সেবা দেয়া, অথবা আইনের শাসন বাস্তবায়নের কোন পরিকল্পনাই তারা দেখাতে সক্ষম হয়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দেশ পুনর্গঠন, ইত্যাদি কোন বিষয়েই তারা নির্দিষ্ট কোন দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি।

তালিবান মনে করছে যে, তারা সারা দুনিয়ার মুসলিমদের মাঝে সবচাইতে আলাদা; কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে হারিয়েছে এবং তাদেরকে দেশ ছাড়ার জন্যে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে। তবে তালিবানরা রাজনৈতিক লক্ষ্যের ব্যাপারে অপরিপক্বতা দেখিয়েছে। জালমেই খলিলজাদ তালিবানদের পরিবর্তিত হবার কথা বলেছেন, কারণ তালিবান আলোচনার মাধ্যমে ছাড় দেবার প্রবণতা দেখিয়েছে। হেরে যাবার পর যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা ডাকার কোন অধিকারই ছিল না; অথচ তারপরেও তালিবানরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় বসেছে। তালিবানরা তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে রাশিয়া এবং চীনের সাথে আলোচনা করে তাদেরকে আস্বস্ত করেছে। এই ব্যাপারগুলি ১৯৯০এর দশকের তালিবান থেকে পুরোপুরিভাবে আলাদা। ‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বর্তমানের তালিবান মিডিয়া এবং প্রযুক্তির ব্যাপারে যথেষ্ট পরিবর্তিত। তারা নিয়মিতভাবে তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ডের ছবি এবং ভিডিও মিডিয়াতে দিচ্ছে; বিভিন্ন ইস্যুতে মিডিয়াতে বিবৃতি দিচ্ছে; ফেইসবুক পেইজ আপডেট দিচ্ছে ঘনঘন। তালিবানরা পুরো আফগানিস্তান জুড়ে সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, সবগুলি শহরই তাদের হাতে এসেছে শান্তিপূর্ণভাবে। তারা কাবুলে ঢোকার আগেও বারংবার ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা কোন রক্তপাত ছাড়াই ক্ষমতা হস্তান্তর চায়। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির দেশ ছেড়ে পালাবার পর তালিবান যোদ্ধারা আফগান প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে প্রবেশ করে। সেখানে তারা লাইভ টেলিভিশনের সামনেই প্যালেসের হস্তান্তর সম্পন্ন করে এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেয়।

তালিবানরা বলছে যে, তারা ইসলামিক আমিরাত তৈরি করতে যাচ্ছে। তারা শরীয়াহর কিছু আইন বাস্তবায়নও করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তবে আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক বাউন্ডারিগুলি মেনে নিয়ে তারা মূলতঃ জাতিরাষ্ট্রের চিন্তাকেই ভিত হিসেবে তুলে ধরেছে। জুলাই মাসে মস্কোতে তালিবান প্রতিনিধিরা গিয়েছিলেন রাশিয়াকে চিন্তামুক্ত করতে যে, তালিবানরা আফগানিস্তানের সাথে উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানের সীমানা মেনে চলবে। একই মাসে মোল্লা আব্দুল গনি বারাদারের নেতৃত্বে আফগান দল বেইজিং ঘুরে এসেছে চীনাদেরকে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে। চীনারা যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান প্রস্থানে নিজেদের বিরক্তি প্রকাশ করেছে। তাদের প্রধান দুশ্চিন্তা ছিল আঞ্চলিক নিরাপত্তা। এমতাবস্থায় তালিবান প্রতিনিধিদের বেইজিং গমন চীনের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই মোল্লা বারাদারকেই পাকিস্তান সরকার ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আটক করেছিল যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে। আবার ২০১৮ সালে এই বারাদারকেই পাকিস্তান ছেড়ে দিয়েছে কাতাদের রাজধানী দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় নেতৃত্ব দেবার জন্যে। পাকিস্তানই তালিবানকে রাজি করিয়েছে হেরে যাওয়া শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় বসতে। আর এর মাধ্যমে তালিবান তাদের ছাড় দেয়ার মানসিকতা দেখাতে থাকে। ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বারাদারকে ২০ বছরের যুদ্ধের অবিসংবাদিত বিজয়ী বলে আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু এখানে পাকিস্তানের ভূমিকাটা নিঃসন্দেহে সামনে চলে আসে এবং পাকিস্তানের উপর স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানের নির্ভরশীলতাকে তুলে ধরে। আলোচনার টেবিলে বারাদারের ভূমিকা পশ্চিমাদের কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যে ব্যাপারগুলি নিশ্চিত করেছে তার মাঝে রয়েছে আইনের ব্যাপারে তালিবানকে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি করানো এবং আন্তর্জাতিক সীমানা অমান্য করে খিলাফত ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকা। হেরে গিয়েও যুক্তরাষ্ট্র তালিবানদেরকে দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত করিয়ে নিয়েছে। তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাক্ষার জন্যে যথেষ্ট নাও হতে পারে।

Thursday 12 August 2021

মাদাগাস্কার ... দুই শতকের ব্রিটিশ ফরাসি দ্বন্দ্ব

১২ই অগাস্ট ২০২১
ছবিঃ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর সাথে মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোএলিনা। রাজোএলিনা মাদাগাস্কারে ফ্রান্সের স্বার্থকে দেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তার বিরোধীরাও যে ব্রিটিশ মার্কিন স্বার্থ দেখেছে, তার প্রমাণও যথেষ্ট। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন দূরে থাকুক দেশটার ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্বের কারণে বড় শক্তিদের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নিমজ্জিত রয়েছে দেশটা। বহুকাল ধরে এখানে মূল খেলোয়াড় ফ্রান্স এবং ব্রিটেন থাকলেও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, এবং আরও বিভিন্ন দেশ যুক্ত হয়েছে।


আফ্রিকার দক্ষিণ পূর্ব উপকূলের পাশে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপ মাদাগাস্কার; যা মালাগাসি বলেও পরিচিত। ২ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের দেশটা রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত রয়েছে। কারণ গত ২০শে জুলাই দেশটার প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোএলিনাকে হত্যা করার একটা ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে গেছে বলে দেশটার সরকারি কর্মকর্তারা বলেন। ছয় ব্যক্তিকে এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়; যার মাঝে দু’জন ফরাসি নাগরিক। গ্রেপ্তারকৃতদের মাঝে দু’জন ফরাসি সামরিক বাহিনীতে কাজ করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। অনেকেই বলছেন যে, এই ঘটনার পিছনে বিদেশী হাত রয়েছে। মাদাগাস্কারে রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন নয়; এবং সেখানে বিদেশী হস্তক্ষেপও নতুন নয়। দেশটার ইতিহাস জুড়েই রয়েছে বিদেশী ইন্ধনে রাজনৈতিক পালাবদল। তবে আফ্রিকার উপকূলের দরিদ্র এই দেশটার ব্যাপারে অন্যান্য দেশের এত আগ্রহই বা কেন?

মাদাগাস্কারকে নিয়ে ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব

‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক লেখায় কেনিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক নানজালা নিয়াবোলা প্রশ্ন করছেন যে, মাদাগাস্কার আসলে উপনিবেশিক সময় পার করতে পেরেছে কিনা। তার বিশ্লেষণে দুই দশক ধরে ফ্রাঙ্কোফাইল বা ফরাসি প্রভাবে থাকা গ্রুপের সাথে এংলোফাইল বা ব্রিটিশ-মার্কিন গ্রুপের মাঝে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে। তবে তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, এই দ্বন্দ্ব মূলতঃ দুই শতক ধরে ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের মাঝে চলা ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। ২০০২ সালের নির্বাচনে জেতা প্রেসিডেন্ট রাভালোমানানা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মাদাগাস্কারের জন্যে প্রচুর সহায়তা পান। অপরদিকে রাভালোমানানাকে উৎখাত করতে যেয়ে ২০০৯ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাজোএলিনা ফরাসি দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফরাসি বার্তাসংস্থা ‘এএফপি’ বলছে যে, ফরাসিরা জাতিসংঘের নির্দেশনাতেই রাজোএলিনাকে রক্ষা করেছিল। দূতাবাসের বাইরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাভালোমানানার শতশত সমর্থক বিক্ষোভ করে। নিয়াবোলা বলছেন যে, দু’শ বছর ধরে মাদাগাস্কারের ভাগ্য ঠিক হয়েছে পশ্চিমা রাজধানীগুলিতে।

ঊনিশ শতক থেকে মাদাগাস্কারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফরাসি আর ব্রিটিশদের প্রতিযোগিতা ভীষণ আকার ধারণ করে। ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার জঁ লাবোরদা মাদাগাস্কারের রাজ্যের প্রধান ইঞ্জিনিয়াররূপে নিয়োগ পেয়ে যান এবং রাজ পরিবারের জন্যে রাজধানী এনটানানারিভোতে কাঠ দিয়ে ‘রোভা প্যালেস’ তৈরি করে দেন। এর প্রতিযোগিতায় স্কটিশ মিশনারি জেমস ক্যামেরন পাথর দিয়ে প্যালেস নির্মাণ করে দেন। আরেকজন ফরাসি ব্যবসায়ী জঁ ফ্রাঁসোয়াঁ ল্যামবার্ট মাদাগাস্কারের রাজার সাথে একটা বাণিজ্য চুক্তি করেন, যা পরবর্তীতে মাদাগাস্কারকে ফরাসিদের পদানত করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। ইউরোপিয় মিশনারিদের প্রভাবে ১৮৬৯ সালে মাদাগাস্কারের রাজা খ্রিস্টধর্মকে রাজ্যের অফিশিয়াল বিশ্বাস বলে ঘোষণা করেন। ইউরোপিয়রা দেশটার শিক্ষা ব্যবস্থা ডিজাইন করে। দেশটার সেনাবাহিনীকে ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্ব নেয় ব্রিটিশরা; উদ্দেশ্য ছিল ফরাসিরা যাতে মাদাগাস্কারের নিয়ন্ত্রণ নিতেনা পারে। ব্রিটিশ আইনের আদলে মাদাগাস্কারের আইন তৈরি করা হয়। আদালতগুলিও তৈরি করা হয় ইউরোপিয় আদলে। ১৮৮৩ সালে ল্যাম্বার্ট চার্টার ভঙ্গ করার ছুতো দেখিয়ে ফরাসিরা মাদাগাস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ প্রায় ১৩ বছর ধরে চলে। দ্বীপের উত্তরে কিছু এলাকা দখল করে সেখানে ফরাসিরা দিয়েগো সুয়ারেজ নৌঘাঁটি তৈরি করে। আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে রাজধানী এনটানানারিভো থেকে সমুদ্রে যাবার প্রধান দুই সমুদ্রবন্দর তোয়ামাসিনা এবং মহাজঙ্গ গোলাবর্ষণ করে ফরাসি নৌবাহিনী। তাতেও কাজ না হওয়ায় সেনাবাহিনী প্রেরণ করে রাজধানী এনটানানারিভোর উপর ভারি আর্টিলারি দিয়ে গোলাবর্ষণ করে রানী তৃতীয় রানাভালোনাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে ফরাসিরা। ১৮৯৬ সালে ফরাসিরা মাদাগাস্কারকে উপনিবেশ ঘোষণা করে এবং রাজ পরিবারকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। এভাবে মাদাগাস্কার পুরোপুরিভাবে ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে আসে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হাতে ফ্রান্সের পতন হবার পর ব্রিটিশরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ফরাসিদের অধীনে থাকা এলাকাগুলির নিয়ন্ত্রণ নিতে সচেষ্ট হয়। যুক্তি ছিল যে, জার্মানরা এগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। ১৯৪২ সালে জাপানিরা মাদাগাস্কারে অবতরণ করতে পারে এই ছুতোয় ব্রিটিশরা মাদাগাস্কার দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা ফরাসিদের হাতে দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলেও যুদ্ধ শেষেই ১৯৪৭ সালে মাদাগাস্কারে স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন শুরু হয়। ফরাসিরা শক্ত হাতে এই বিদ্রোহ দমন করে এবং এর প্রায় এক দশক পর মালাগাসিরা শান্তিপূর্ণভাবে ফরাসিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৬০ সালে মাদাগাস্কারকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফরাসিরাই দেশটার প্রথম প্রেসিডেন্ট ফিলিবার্ট সিরানানাকে নিয়োগ দেয়। ১২ বছর তিনিই দেশ শাসন করেন। তার সময়ে ফ্রান্সের নাগরিকেরাই মাদাগাস্কারের গুরুত্বপূর্ণ অফিসসমূহ নিয়ন্ত্রণ করতো। এর ফলশ্রুতিতে দেশটাতে ব্যাপক আন্দোলন দানা বাঁধে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত অনেকগুলি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা যায় নৌবাহিনীর অফিসার দিদিয়ের রাতসিরাকার কাছে। রাতসিরাকা পড়াশোনা করেন প্যারিসে এবং ফরাসি নৌবাহিনীতেই তার ক্যারিয়ার শুরু হয়। তিনি দেশটাকে আপাতদৃষ্টে সমাজতন্ত্রের দিকে ধাবিত করলেও কিছুদিনের মাঝেই তিনি প্রমাণ করেন যে, তিনি ইউরোপকে কখনোই ছেড়ে যাননি। অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ার পর বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফএর কাছ থেকে ঋণও পায় মাদাগাস্কার। ১৯৯২ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা হারালেও ১৯৯৬ সালে তিনি আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসেন।
ছবিঃ মাদাগাস্কারের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রাভালোমানানা। মাদাগাস্কারকে ফরাসি প্রভাবের নেতৃত্ব থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে রাভালোমানানার পিছনে বিশ্ব ব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট বিনিয়োগ রয়েছে। ২০০২ সালে রাভালোমানানা প্রেসিডেন্ট হন। তবে ২০০৭ সাল থেকেই তিনি ফরাসি সমর্থিত প্রার্থী রাজোএলিনার ব্যাপক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হন।


একুশ শতকে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

২০০১ সালের নির্বাচনে রাজধানী এনটানানারিভোর মেয়র মার্ক রাভালোমানানা ক্ষমতায় আসেন। রাভালোমানানা গরীব ঘর থেকে উঠে আসা একজন প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান; যেখানে মাদাগাস্কারের প্রয়ায় সকল রাজনীতিবিদেরাই মূলতঃ ক্যাথোলিক। মাদাগাস্কারের প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ মূলত ব্রিটিশদেরই প্রতিষ্ঠা করা। তিনি তার পড়াশোনা করেন প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের চালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার এনজিওগুলির সুবাদে তিনি ইউরোপে পড়াশোনা করেন। দেশে ফিরে তিনি ডেইরির ব্যবসা করেন এবং বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণের সুবাদে মাদাগাস্কারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীদের একজন বনে যান। ইউরোপিয় এবং আমেরিকানরা তার ব্যবসায় ব্যাপক বিনিয়োগ করে। তার রাজনৈতিক আকাংক্ষা প্রকাশ পেতে থাকার পরেই রাতসিরাকার সরকারের সাথে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। রাভালোমানানা ১৯৯৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজধানী এনটানানারিভোর মেয়র হন। এরপর ২০০১ সালে ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট হন। হেরে যাওয়া রাতসিরাকা পেয়েছিলেন ৩৬ শতাংশ ভোট। ২০০৬ সালে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার সময় তিনি ৫৫ শতাংশ ভোট পান। তার ব্যবসায়িক শক্তিকে তিনি নির্বাচনে পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করেন। অনেকেই মনে করেন যে, রাভালোমানানা মাদাগাস্কারকে ফরাসি প্রভাব থেকে বের করে ব্রিটিশ মার্কিন বলয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলেন।

তবে এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ান আন্দ্রি রাজোএলিনা। বিলবোর্ড ব্যবসায়ী রাজোএলিনা তার ব্যবসায়িক শক্তিকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে ঢোকেন। ২০০৭ সালে ‘ভিভা’ টেলিভিশন কিনে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি রাজধানী এনটানানারিভোর মেয়র বনে যান। ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট রাভালোমানানা ‘ভিভা’ টেলিভিশন বন্ধ করে দেন। কিছুদিনের মাঝেই রাজোএলিনা মাদাগাস্কারের বিরোধী রাজনীতিবিদদের একত্রিত করে হাজারো মানুষকে রাস্তায় আন্দোলনে নামান। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে এক জনসভায় রাজোএলিনা ঘোষণা দেন যে, তিনি এখন থেকে মাদাগাস্কারের নেতৃত্ব দেবেন। মার্চ মাসে সেনাবাহিনী রাজোএলিনার পক্ষ নিলে প্রেসিডেন্ট রাভালোমানানা ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে আশ্রয় নেন। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, দক্ষিণ আফ্রিকার এক রেডিওর সাক্ষাৎকারে রাভালোমানানা অভিযোগ করেন যে, রাজোএলিনার মাধ্যমে ফ্রান্স মাদাগাস্কারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে রাভালোমানানা প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ফরাসি রাষ্ট্রদূত গিলদাস লে লিডেককে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

রাজোএলিনা ক্ষমতা নিলেও ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন’ বা ‘এইউ’ এবং ‘সাউদার্ন আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি’ বা ‘এসএডিসি’ এটাকে অভ্যুত্থান বলে আখ্যা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র তার মাদাগাস্কার দূতাবাস খালি করতে শুরু করে। আইএমএফ মাদাগাস্কারের ঋণ মুলতুবি করে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, মোজাম্বিকের রাজধানী মাপুতোতে ‘এসএডিসি’র মধ্যস্ততা মেনে নিতে বাধ্য হন রাজোএলিনা; তিনি হন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট। গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্ট হবার বয়স ৪০ বছর থেকে নামিয়ে ৩৫ করা হয়, যাতে রাজোএলিনা পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। তবে রাভালোমানানার পক্ষের গ্রুপের বাধার কারণে রাজোএলিনা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। ২০১৪ সালে রাজোএলিনার সমর্থনে হেরি রাজাওনারিমামপিয়ানিয়া ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট হন। তবে ২০১৮ সালে রাজোএলিনা নির্বাচনে অংশ নেন। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ব্রিটিশ এবং মার্কিনীদের পছন্দের প্রার্থী রাভালোমানানা। প্রথম ধাপে ৩৯ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ধাপে ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে রাজোএলিনা প্রেসিডেন্ট হন। রাভালোমানানা পেয়েছিলেন ৪৪ শতাংশ ভোট।

মাদাগাস্কারে ফরাসি প্রভাব এখনও প্রবল

‘ওয়ার্ল্ড কালচার এনসাইক্লোপেডিয়া’র এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ঊনিশ শতক থেকেই মাদাগাস্কারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ফরাসি সংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। দেশটার মানুষ মালাগাসি ভাষায় কথা বললেও ১৮৯৬ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক সময়ের প্রভাবের কারণে দেশটার অফিশিয়াল ভাষা হলো ফরাসি। বিভিন্ন সময়ে ফরাসি ভাষাকে সরিয়ে দেবার অনেক চেষ্টাই বিফলে গেছে।

‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৪৭ সালে মাদাগাস্কারের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ফরাসিরা বিদ্রোহীদের উপরে প্রচন্ড নির্যাতন চালায়; যার ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে অনেকে। প্রায় ৯০ হাজার মানুষ সেই আন্দোলনে ফরাসি এবং তাদের ঔপনিবেশিক সেনাদের হাতে মৃত্যুবরণ করে। অত্যাচারের শারীরিক ক্ষত নিয়ে বেঁচে ছিল বাকিরা। অনেকেই মনে করছেন যে, ৬০ বছর পরেও ফ্রান্সের হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি মাদাগাস্কার। ‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস’এর ২০১৮ সালের গবেষণায় ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিস’এর ওমার গার্সিয়া পনসা এবং ‘প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি’র লেনার্ড ওয়ান্টচেকন ১৯৪৭ সালের ফরাসি অত্যাচারের প্রভাব খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। তারা বলেন যে, ১৯৪৭ সালের ফরাসি অত্যাচারের কারণে মাদাগাস্কারের জনগণের মাঝ থেকে কথা বলার সাহস হারিয়ে গেছে। অর্থাৎ মাদাগাস্কারের জনগণের সংস্কৃতিটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। মানুষের মনে যুদ্ধে অংশ নেয়া বীরদের স্মৃতি নয়, বরং ফরাসি বর্বরতাটাই গেঁথে গেছে।

মাদাগাস্কারের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের প্রায় সকলেই ফ্রান্সে পড়াশোনা করেছেন; নতুবা ফ্রান্সের সাথে তাদের ব্যবসা রয়েছে; নতুবা ফ্রান্সের কোন সংস্থার অধীনে তারা কাজ করেছে। দেশটার স্বাধীনতার ৬১ বছরের মাঝে ৪৮ বছর ক্ষমতা ছিল মাত্র চারজন প্রেসিডেন্টের হাতে। ১২ বছর ক্ষমতায় থাকা দেশটার প্রথম প্রেসিডেন্ট ফিলিবার্ট সিরানানা ফ্রান্সে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৫০এর দশকে ফরাসি পার্লামেন্টে মাদাগাস্কারের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা নেয়া প্রেসিডেন্ট দিদিয়ের রাতসিরাকা ছিলেন ফরাসি নৌবাহিনীর অফিসার। তার বাবাও ফরাসি উপনিবেশের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এরপর বাকি ১৫ বছর ভাগাভাগি করেছেন ব্রিটিশ মার্কিনপন্থী রাভালোমানানা এবং ফরাসি প্রভাবে থাকা রাজোএলিনা।
ছবিঃ ভাস্কো দা গামার ভারত মহাসাগরে আসার পথ। ১৯৭০এর দশকের পর থেকে সুয়েজ খালের অপারেশন স্বাভাবিক থাকার কারণে যারা ভাস্কো দা গামার অতিক্রম করা আফ্রিকার দক্ষিণের এই সমুদ্রপথের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন, তারা সুয়েজ খালে কনটেইনার জাহাজ ‘এভার গিভেন’এর আটকে যাবার পর বাস্তবতায় ফিরেছেন। তবে গত কয়েক দশকে দক্ষিণ আমেরিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার সাথে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধিও এই সমুদ্রপথকে ব্যস্ত করেছে।



মাদাগাস্কারের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

মাদাগাস্কার একটা দরিদ্র দেশ; যার মাথাপিছু গড় আয় ১৮’শ ডলারেরও কম। তৈরি পোষাক, মাছ, মসলা, ইত্যাদি দেশটার রপ্তানি পণ্য। বেশিরভাগ শিল্পপণ্য, ভোগ্যপণ্য এবং খাদ্যদ্রব্য আমদানি করেই চলে তাদের। একসময় সবচাইতে বেশি বাণিজ্য ফ্রান্সের সাথে হলেও এখন চীনাদের কাছ থেকেই তারা সবচাইতে বেশি আমদানি করে থাকে। তবে ফ্রান্স এখনও মাদাগাস্কারের পণ্যের সবচাইতে বড় ক্রেতা। দেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় রয়েছে বলে বলছে বিশ্বব্যাংক। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন দূরে থাকুক দেশটার ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্বের কারণে বড় শক্তিদের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নিমজ্জিত রয়েছে দেশটা। বহুকাল ধরে এখানে মূল খেলোয়াড় ফ্রান্স এবং ব্রিটেন থাকলেও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, এবং আরও বিভিন্ন দেশ যুক্ত হয়েছে।

১৪৯৮ সালে আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে ভাস্কো দা গামার ভারত মহাসাগরে আসার সাথেসাথেই দক্ষিণ আফ্রিকার আশেপাশের অঞ্চলগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। কারণ এটাই ছিল ইউরোপ থেকে ভারত মহাসাগরে আসার পথ। এই পথের উপরে যেকোন বাণিজ্য, লজিস্টিক্যাল বা সামরিক ঘাঁটি ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে পর্তুগীজরা পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার, তাঞ্জানিয়া ও কেনিয়ার উপকূলে উপনিবেশ স্থাপন করে। ডাচরা দক্ষিণ আফ্রিকায় বসতি স্থাপন করে ১৬৫২ সালে। ১৭১৫ সালে ফ্রান্স মাদাগাস্কারের পূর্বে মরিশাস দ্বীপ দখল করে। ১৮০৬ সালে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধের ছুতোয় ব্রিটিশরা দক্ষিণ আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে। এরপর ১৮১০ সালে ব্রিটিশরা ফরাসিদের কাছ থেকে মরিশাস পুনর্দখল করে। লা রিউনিয়ন দ্বীপ দখল করলেও পরে তা ছেড়ে দেয়; যা আজও ফ্রান্সের হাতে রয়েছে। ১৮৮৬ সালে ফরাসিরা মোজাম্বিক চ্যানেলে কমোরুস দ্বীপ দখল করে। আর শেষ পর্যন্ত ১৮৯০এর দশকে ফরাসিরা মাদাগাস্কার দখল করে। ততদিনে অবশ্য সুয়েজ খাল তৈরি হয়ে যাওয়ায় আফ্রিকা ঘুরে বাণিজ্যপথের গুরুত্ব কমে আসে।

১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ হলে সুয়েজ খাল বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আট বছর বন্ধ থাকে এই খাল। এসময়ে ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে যাতায়াত করা সকল বাণিজ্য এবং যুদ্ধজাহাজ দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে যাতায়াত করে। ২০২১ সালের ২৩শে মার্চ ‘এভার গিভেন’ নামের বিশাল কনটেইনার জাহাজ সুয়েজ খালে আটকে গেলে প্রায় এক সপ্তাহের জন্যে খাল বন্ধ হয়ে যায়। এসময়ে অনেক জাহাজ খালের দু’পাশে আটকে থাকে; কিছু জাহাজ দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে যাত্রা করে। এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, সুয়েজ খালের আশেপাশে যেকোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে সমুদ্রপথের গুরুত্ব বেড়ে যেতে পারে। এই মুহুর্তে দক্ষিণ আমেরিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার সাথে চীনের সমুদ্র বাণিজ্যপথ হলো এটা।

মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোএলিনাকে হত্যাচেষ্টা আফ্রিকার দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকেই তুলে ধরে। এই ঘটনা এমন সময়ে ঘটলো, যখন দ্বীপ দেশটার অদূরে মোজাম্বিকের কাবো দেলগাদো অঞ্চলে মুসলিম বিদ্রোহ দমনে বিভিন্ন দেশের সেনারা অবতরণ করছে। মোজম্বিকের উপকূলের গ্যাস খনিগুলি নতুন করে অত্র অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়ালেও সমুদ্রপথ হিসেবে এর গুরুত্ব সবসময়েই প্রধান ছিল। ১৯৭০এর দশকের পর থেকে সুয়েজ খালের অপারেশন স্বাভাবিক থাকার কারণে যারা ভাস্কো দা গামার অতিক্রম করা আফ্রিকার দক্ষিণের এই সমুদ্রপথের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন, তারা সুয়েজ খালে কনটেইনার জাহাজ ‘এভার গিভেন’এর আটকে যাবার পর বাস্তবতায় ফিরেছেন। তবে গত কয়েক দশকে দক্ষিণ আমেরিকা এবং পশ্চিম আফ্রিকার সাথে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধিও এই সমুদ্রপথকে ব্যস্ত করেছে। দু’শ বছরের ব্রিটিশ ফরাসি দ্বন্দ্বে এখন আরও অনেকেই জড়িত।

Tuesday 10 August 2021

মোজাম্বিকের সহিংসতা ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে

১১ই অগাস্ট ২০২১
জুলাই ২০২১। মোজাম্বিকের পথে রুয়ান্ডার সেনারা। গ্যাস নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ছাড়াও মোজাম্বিক চ্যানেলের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগাল, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও অনেক দেশ এখন এই সংঘাতের অংশ; প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ্য। আফ্রিকার দেশগুলি এখানে সেনা মোতায়েন করলেও এই মিশনের অর্থনৈতিক ভার বহণের শক্তি বেশিরভাগেরই নেই; যা বলে দেয় যে, এই দেশগুলি মূলতঃ বড় শক্তিগুলির উপরেই নির্ভরশীল থাকবে।


পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের চলমান গৃহযুদ্ধে রুয়ান্ডার সেনারা বড় বিজয় পেয়েছে। মোজাম্বিক সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করতে আসা মধ্য আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার সেনারা গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বন্দর শহর মোচিমবোয়া দা প্রাইয়া পুনর্দখল করেছে বলে এক টুইটার বার্তায় জানায় রুয়ান্ডার সামরিক বাহিনী। মোজাম্বিকের উত্তরে মুসলিম অধ্যুষিত কাবো দেলগাদো প্রদেশে ২০১৭ সাল থেকে চলছে সহিংসতা। বার্তা সংস্থাগুলি বলছে যে, এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে কমপক্ষে ৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং ৮ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, মোজাম্বিকের সেনাবাহিনী এই যুদ্ধের জন্যে একেবারেই প্রস্তুত নয়; তথাপি নিজ দেশে বিদেশী সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে মোটেই রাজি ছিল না মোজাম্বিক সরকার। তবে যুদ্ধের বাস্তবতার কাছে হার মেনে গত ১০ই জুলাই ১ হাজার রুয়ান্ডার সেনার প্রথম দলকে মোতায়েনের অনুমতি দেয় মোজাম্বিক সরকার। অবতরণের পর থেকেই রুয়ান্ডার সেনারা সরাসরি যুদ্ধে নামে এবং তারা সাফল্য পাচ্ছিলো বলে খবর আসছিল। বিদ্রোহী গ্রুপগুলি ২০২০এর অগাস্টে মোচিমবোয়া দা প্রাইয়া শহর দখল করে নিয়েছিল। এখন শহরটার পুনর্দখলের পর প্রশ্ন উঠছে যে, এই সাফল্য কতটা স্থায়ী।

‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, বিদ্রোহীরা খুব সম্ভবতঃ শহর ছেড়ে পালিয়েছে; যার অর্থ হলো, তারা গ্রামাঞ্চলে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখবে এবং আবারও কখনও সুযোগ পেলে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। এটা ভাবলে ভুল হবে যে, বিদ্রোহীদের যুদ্ধ করার সক্ষমতা ধ্বংস হয়ে গেছে। ‘ডয়েচে ভেলে’ আবার মনে করিয়ে দিয়েছে অত্র অঞ্চলে রুয়ান্ডার সেনা মোতায়েনের ভূরাজনৈতিক জটিলতা। মোজাম্বিক হলো ‘সাউদার্ন আফ্রিকা ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি’ বা ‘এসএডিসি’ নামের আঞ্চলিক সংগঠনের সদস্য। ‘এসএডিসি’ যখন মোজাম্বিকে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল, ঠিক সেসময়েই রুয়ন্ডার সেনারা মোজাম্বিকে নামতে শুরু করে; যা কিনা ‘এসএডিসি’ পছন্দ করেনি। রুয়ান্ডা ১৬ সদস্যের ‘এসএডিসি’র সদস্য নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘সিগনাল রিস্ক’এর নিরাপত্তা বিশ্লেষক রায়ান কামিংস বলছেন যে, রুয়ান্ডার সাথে মোজাম্বিকের সামরিক চুক্তি হয়েছিল ২০১৮ সালে। কাজেই মোজাম্বিকে রুয়ান্ডার সেনা মোতায়েনে অবাক হবার কিছু নেই। মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্ট ফিলিপ নাইয়ুসি বলেন যে, রুয়ান্ডার সেনারা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামি প্রশংসিত হয়েছেন। তবে কামিংস বলছেন যে, রুয়ান্ডার সেনারা ‘এসএডিসি’র নেতৃত্ব মানবে না; তবে ‘এসএডিসি’ এবং ইইউএর সাথে সমন্বয় করে চলবে। মোজাম্বিক চাইছে ‘এসএসডিসি’র সেনারা যেন মোজাম্বিক সরকারের নিয়ন্ত্রের বাইরে চলে না যায়।

‘এসএডিসি’ ১৫ই জুলাই মোজাম্বিকে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২১শে জুলাই থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার স্পেশাল ফোর্সের সেনারা মোজাম্বিকে নামতে শুরু করে। ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, ২৮শে জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সাইরিল রামাফোসা মোট ১ হাজার ৪’শ ৯৫ জন সেনা মোজাম্বিকে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসের এই মিশনে প্রায় ৬৬ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে জানান রামাফোসা। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সকলে এত খরচ করে মোজাম্বিকে সেনা মোতায়েনের পক্ষপাতি নন; বিশেষ করে দেশটার অর্থনীতি যখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলে যখন রাস্তায় ২৫ হাজার সেনা মোতায়েন করতে হয়েছে। বিরোধী দল ‘ডেমোক্র্যাটিক এলায়েন্স’এর কোবুস মারাইস বলছেন যে, এই মিশন তিন মাসের বেশি স্থায়ী হলে তো খরচ তো আরও বেড়ে যাবে। তিনি সেনা হতাহত হবার আশংকা প্রকাশ করে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে মোতায়েন করা সেনাদের কথা মনে করিয়ে দেন। সেখানে বাঙ্গুইএর যুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার ১৫ জন সেনা নিহত হয়েছিল।

‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২৬শে জুলাই বতসোয়ানার ২’শ ৯৬ জন সেনা বিমানে করে মোজাম্বিকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ২৭শে জুলাই এঙ্গোলার পার্লামেন্টে ২০ জন সেনা এবং একটা সামরিক পরিবহণ বিমান মোজাম্বিকে প্রেরণের জন্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিন মাসের এই মিশনে এঙ্গোলার প্রায় ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার ডলার খরচ হবে বলে বলেন এঙ্গোলার মন্ত্রী ফ্রানচিস্কো পেরেইরা ফুরতাদো। ২৯শে জুলাই জিম্বাবুয়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অপা মুচিংগুরি কাশিরি জানান যে, জিম্বাবুয়ে মোজাম্বিকে ৩’শ ৪ জন সেনা পাঠাচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা মোজাম্বিকের এনজিও ‘আইএমডি’র রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডারসিও আলফাজিমা বলছেন যে, ‘এসএডিসি’র কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সংঘাত যেন মোজাম্বিকের সীমানা পেরিয়ে আশেপাশের দেশগুলিতে চলে না যায়।
মোজাম্বিকের কাবো দেলগাদোর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা অনেক পুরাতন; যার সমাধান কেউ দেয়নি। বিশাল গ্যাসের খনির কাজ শুরু হবার পরপরই এখানে সহিংসতা শুরু হয়। এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণে সহিংসতার পরিবেশ আরও আগ থেকেই প্রস্তুত হয়েই ছিল। তবে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা এখানে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করেছে। 


মোজাম্বিকে প্রায় চার বছর ধরে যুদ্ধ চললেও সেনা মোতায়েনের ব্যাপারটা হঠাতই সামনে আসে গত মার্চে, যখন কাবো দেলগাদোর সর্বউত্তরে তাঞ্জানিয়ার সীমানার কাছে পালমা শহর বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। মাত্র ২’শ বিদ্রোহী সেনা শহরটা দখল করলেও শহরটা ফরাসি তেল কোম্পানি ‘টোটাল’এর প্রকল্পের কাছাকাছি হওয়ায় কোম্পানি তাদের কর্মকান্ড থামিয়ে দেয়। কাবো দেলগাদো মোজাম্বিকের সবচাইতে দরিদ্র এলাকা, যেখানে ৫৩ লক্ষ মুসলিমের বাস। মার্কিন সরকারের হিসেবে এই অঞ্চলেরই উপকূলে পাওয়া গিয়েছে প্রায় ১’শ ৮০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিটের বিশাল গ্যাস খনি। ফরাসি কোম্পানি ‘টোটাল’এর নেতৃত্বে এখানে ২০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল এলএনজি প্ল্যান্টের কর্মকান্ড চলমান। ইতালিয়ান কোম্পানি ‘এনি’ এবং মার্কিন কোম্পানি ‘এক্সন মোবিল’ও এখানে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। তবে সকলেই তাকিয়ে আছে ‘টোটাল’এর প্রকল্পের সাফল্যের দিকে। মোজাম্বিকের প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি পর্তুগাল ইতোমধ্যেই মোজাম্বিকের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও প্রশিক্ষণে যুক্ত হয়েছে; ইইউও জড়িত হতে যাচ্ছে।

মোজাম্বিকের কাবো দেলগাদোর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা অনেক পুরাতন; যার সমাধান কেউ দেয়নি। বিশাল গ্যাসের খনির কাজ শুরু হবার পরপরই এখানে সহিংসতা শুরু হয়। এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণে সহিংসতার পরিবেশ আরও আগ থেকেই প্রস্তুত হয়েই ছিল। তবে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা এখানে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করেছে। গ্যাস নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ছাড়াও মোজাম্বিক চ্যানেলের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগাল, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও অনেক দেশ এখন এই সংঘাতের অংশ; প্রত্যেকেরই রয়েছে ভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ্য। আফ্রিকার দেশগুলি এখানে সেনা মোতায়েন করলেও এই মিশনের অর্থনৈতিক ভার বহণের শক্তি বেশিরভাগেরই নেই; যা বলে দেয় যে, এই দেশগুলি মূলতঃ বড় শক্তিগুলির উপরেই নির্ভরশীল থাকবে।

Sunday 8 August 2021

ব্যাক্তিস্বাধীনতার ফরাসি সংজ্ঞা আসলে কি?

০৮ই অগাস্ট ২০২১

ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। নবীকে অপমান করাটা ব্যক্তিস্বাধীনতার মাঝে পড়লেও প্রেসিডেন্টকে অপমান করাটা রাষ্ট্রের কাছে অপরাধ হিসেবে ঠেকেছে। রাষ্ট্রের অঙ্গগুলি, তথা সরকার, আদালত এবং জনগণের মাঝে চিন্তার দৃশ্যমান ফারাক ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ এবং দুর্বল করে ফেলছে।


চার সপ্তাহ ধরে ফ্রান্সের রাস্তায় হাজারো মানুষের বিক্ষোভ। ৭ই অগাস্ট ফ্রান্স জুড়ে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ প্রতিবাদ করেছে। তাদের দাবি হলো ফরাসি সরকারের করোনাভাইরাস ‘হেলথ পাস’এর ঘোষণা বাতিল করা। ফরাসি সরকারের প্রজ্ঞাপণ অনুযায়ী জনগণকে বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যেতে হলে বা গণপরিবহণে উঠতে হলে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত, এই মর্মে একটা ‘হেলথ পাস’ দেখাতে হবে। এরপর গত ২৯শে জুলাই ফরাসি সরকারের আরেক নির্দেশনায় বলা হয় যে, জনগণকে যেকোন পর্যটন স্থানে বা ৫০ জনের বেশি জমায়েত হয় এমন কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতে হলে ‘হেলথ পাস’ দেখাতে হবে। এর আগে থেকেই সিনেমা হল, কনসার্ট হল, থিম পার্কের মতো স্থানে পাস লাগছে। ৯ই অগাস্ট থেকে যেকোন বার, রেস্তোরাঁ বা শপিং মলে যেতে হলে অথবা দূরপাল্লার বিমান, রেলগাড়ি বা বাসে ভ্রমণ করতে হলে এই পাস লাগবে। এই পাসে এমন তথ্য থাকতে হবে, যাতে বহণকারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নয়, সেব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। এতে ভ্যাকসিন নেবার সার্টিফিকেট ছাড়াও মুচলেকা থাকবে যে, গত ৪৮ ঘন্টার মাঝে করোনা পরীক্ষায় তিনি নেগেটিভ ফলাফল পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি গত ৬ মাসের মাঝে করোনায় আক্রান্ত হননি; অথবা আক্রান্ত হয়ে থাকলেও গত ১৫ দিনের আগেই তিনি সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন। ফরাসি সরকারের এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত, সেব্যাপারে যেমন আলোচনা চলছে, তেমনি এর মাধ্যমে ফ্রান্সের ব্যক্তিস্বাধীনতার সংস্কৃতি কতটা আক্রান্ত হয়েছে, সেটাও আলোচনায় আসছে।

গত ৫ই অগান্সট ফ্রান্সের সর্বোচ্চ আদালতে রায় দেয়া হয় যে, ফরাসি সরকারের ‘হেলথ পাস’এর সিদ্ধান্ত সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। একইসাথে আদালত এই সিদ্ধান্তও দেয় যে, ফ্রান্সের পার্লামেন্টে পাস করা আইনের মাধ্যমে জনগণের উপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে, তা মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে “ব্যালন্সে রেখেছে”; অর্থাৎ এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হবার বিষয়ে খুব বেশি চিন্তিত হবার কিছু নেই। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’ বলছে যে, প্যারিসে আদালতের বাইরে কয়েক’শ মানুষ এই রুলিংএর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদকারীরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘হেলথ ডিক্টেটরশিপ’ বা ‘স্বাস্থ্যবিষয়ক একনায়কতন্ত্র’ বলছে। একজন প্রতিবাদকারী জুলিয়েন বেইলি বলছেন যে, তিনি ভ্যাকসিন নিয়েছেন। তবে ভ্যাকসিন নেবার ব্যাপারটা হওয়া উচিৎ ছিল স্বেচ্ছায়; সরকারের চাপে পড়ে নয়। তিনি আশংকা করে বলেন যে, কিছুদিন পর হয়তো সকল কর্মকান্ডের জন্যে ‘কিউআর কোড’ দেখাতে হবে। এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর নজিরবিহীন আঘাত।

নতুন আইনে রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে ‘হেলথ পাস’ লাগবে। রেস্তোরাঁ মালিকরা বলছেন যে, ক্রেতাদের পাস আছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তো রেস্তোরাঁর হতে পারে না। হাসপাতালে রুগীকে দেখতে গেলেও পাস লাগবে; অথবা অতি জরুরি নয় এমন কোন মেডিক্যাল সেবা নিতে গেলেও। স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য। তবে আদালত এই আইনের মাঝে কিছু অংশ বাতিল করেছে; যেমন সরকার চেয়েছিল যে, ‘হেলথ পাস’ না থাকলে চাকুরিদাতা কর্মচারীকে হঠাত করেই বরখাস্ত করতে পারবে; যা আদালত অনুমোদন দেয়নি। তবে অনেক মানুষের সাথে কাজ করতে হয় এমন কোন চাকুরিতে থাকলে চাকুরিদাতা তার কর্মচারিকে বরখাস্ত করতে পারবে। ফরাসি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট মনটেইন’এর করা এক জনমত জরিপে বলা হচ্ছে যে, ফ্রান্সের ৩৭ শতাংশ জনগণ ‘হেলথ পাস’এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের পক্ষে রয়েছে; অন্যদিকে ৪৮ শতাংশ রয়েছে বিপক্ষে। অর্থাৎ একটা বড় সংখ্যক মানুষ এই আইনের বিপক্ষে। আর ৫২ শতাংশ জনগণ প্রতিবাদকারীদের বিপক্ষে নয়। ফরাসি সরকারের হিসেবে দেশের ৫৪ শতাংশ জনগণের এখন পর্যন্ত করোনার টিকা দেয়া সম্পন্ন হয়েছে।

ফ্রান্সে ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এমন একটা সময়ে, যখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর ব্যাঙ্গাত্মক ছবি বিলবোর্ডে ছাপাবার কারণে মামলা হয়েছে। গত ২৮শে জুলাই বিলবোর্ডের ব্যবসায় থাকা মিশেল অঙ্গে ফ্লোরি এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, ফরাসি প্রেসিডেন্টের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে টুলঁ শহরের পুলিশ ডেকে পাঠিয়েছে। তিনি ফ্রান্সকে ‘ম্যাক্রনিয়া’ আখ্যা দিয়ে বলেন যে, এই দেশে নবীকে অপমান করে ছবি আঁকলে সেটাকে ‘স্যাটায়ার’ হিসেবে মেনে নেয়া হয়, কিন্তু প্রেসিডেন্টকে একনায়ক বললে ‘ব্লাসফেমি’ হয়ে যায়। ম্যাক্রঁ যে বিলবোর্ডের ব্যাপারে চিন্তিত, ‘ইউরোনিউজ’ তার বর্ণনা দিয়ে বলছে যে, সেখানে ম্যাক্রঁর একটা ছবিকে পরিবর্তিত করে হিটলারের মতো করে দেখানো হয়েছে এবং ম্যাক্রঁর দলের লোগো পরিবর্তিত করে হিটলারের নাজি পার্টির স্বস্তিকা লোগোর মতো করে আঁকা হয়েছে। এর সাথে লেখা হয়েছে যে, “সকলে আদেশ মান্য কর; ভ্যাকসিন নাও”। টুলঁ শহরে ঢোকার পথে রাস্তার পাশেই দু’টা বিলবোর্ডে ম্যাক্রঁর এই ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শিত হয়।

ফ্লোরি এমন একটা ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছেন, যা শুধু ব্যক্তিস্বাধীনতা নয়, ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় চিন্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফ্রান্সের সেকুলার চিন্তাকে রক্ষা করার কথা বলে সেদেশের মুসলিম জনগণকে আইন করে ইসলাম পালনে বাধা দেয়া হচ্ছে। গত জুলাই মাসে ফরাসি সরকারি সংস্থা ‘এসজি সিআইপিডিআর’এর এক টুইটার বার্তায় নতুন করে সেকুলারিজমের উপর একটা মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করার কথা ঘোষণা দেয়া হয়। অনেকেই মনে করছেন যে, এর মাধ্যমে ফ্রান্সের মুসলিম জনগণকে রিপাবলিককে কিভাবে ভালোবাসতে হবে, সেটা শিক্ষা দেয়া হবে। গত ডিসেম্বরে ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমারিন এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ফরাসি রিপাবলিকে মানুষ আল্লাহর ইবাদত করতে পারবে এবং রিপাবলিককে ভালোবাসতে পারবে। কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যেও আল্লাহ রিপাবলিকের উপরে নয়।

ফ্রান্সের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাদের রাষ্ট্রীয় চিন্তাকে রক্ষা করতে ক্রমাগতভাবেই জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। একারণেই ফ্রান্সের বড় একটা অংশ এখন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগুলিকে একনায়কোচিত বলে আখ্যা দিচ্ছে। মুসলিমদের ইসলাম পালনের বিরুদ্ধে সরকারের সিদ্ধান্তগুলির পরপরই এখন ‘হেলথ পাস’এর ইস্যু নিয়ে জনগণের মাঝে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। ফ্লোরি যেভাবে বলেছেন যে, নবীকে অপমান করাটা ব্যক্তিস্বাধীনতার মাঝে পড়লেও প্রেসিডেন্টকে অপমান করাটা রাষ্ট্রের কাছে অপরাধ হিসেবে ঠেকেছে। রাষ্ট্রের অঙ্গগুলি, তথা সরকার, আদালত এবং জনগণের মাঝে চিন্তার দৃশ্যমান ফারাক ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ এবং দুর্বল করে ফেলছে।

Sunday 1 August 2021

তিউনিসিয়া… গণতন্ত্রের সাফল্যের গল্প?

০৮ই অগাস্ট ২০২১

যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ একইসাথে সাইয়েদের সমালোচনা করা থেকে বিরত থেকেছে, যা ‘এননাহদা’ এবং তুরস্কের মাঝে সম্পর্কোন্নয়নকে নিরুৎসাহিত করছে। লিবিয়াতে তুরস্কের হস্তক্ষেপ পশ্চিমারা মেনে নিলেও তিউনিসিয়ার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আরব বসন্তের পর তিউনিসিয়ার তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক সফলতা’ নয়, বরং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাই দেশটার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদর্শিক চিন্তার বাস্তবয়নের চাইতে ভূকৌশলগত নিরাপত্তাই এখন পশ্চিমা দেশগুলির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


গত ২৫শে জুলাই তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ প্রধানমন্ত্রী হিচেম মেচিচিকে বরখাস্ত করে পার্লামেন্ট স্থগিত করেন। পার্লামেন্টে সবচাইতে বড় দল মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী ‘এননাহদা পার্ট’র নেতা স্পিকার রাচেদ ঘানুচি এই ঘটনাকে অভ্যুত্থান বলছেন। এছাড়াও ‘হার্ট অব তিউনিসিয়া’, ‘আত্তায়ার’ এবং ‘আল কারামা’ দলগুলিও এটাকে অভ্যুত্থান বলছে। প্রাক্তন একনায়ক বেন আলির সমর্থক সেকুলার ‘ফ্রি দেস্তুরিয়ান পার্টি’ কোন মন্তব্য করেনি। অপরদিকে পার্লামেন্টে ২’শ ১৭ আসনের মাঝে ১৫ আসন নিয়ে থাকা ‘চাব’ দল প্রেসিডেন্টকে সরাসরি সমর্থন করেছে। প্রেসিডেন্টের পক্ষে এবং বিপক্ষে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। এমতাবস্থায় আরব বসন্তের সফল গণতন্ত্র বলে আখ্যা দেয়া তিউনিসিয়া কতটা সফল, সেটা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা।

‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তিউনিসিয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক বিবৃতি নির্ভর করেছে কে ইসলামিক দলগুলির কতটা পক্ষে বা বিপক্ষে, সেটার উপর। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলি তিউনিসিয়ার ঘটনায় কি বলবে, তা তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। ২৬শে জুলাই যুক্তরাষ্ট্র তিউনিসিয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং স্থিতিশীলতার আহ্বান জানায়। তবে এই ঘটনা একটা অভ্যুত্থান ছিল না, সেব্যাপারে কোন কথা বলেনি। তিউনিসিয়ার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স তিউনিসিয়ায় আইনের শাসন কায়েমের স্বপক্ষে জোর দেয় এবং সকল রাজনৈতিক দলকে সহিংসতা বর্জন করতে বলে। ইইউ একইসাথে সকল দলকে সংবিধান মেনে চলতে বলে এবং সহিংসতা এড়াতে অনুরোধ করে। জার্মান সরকারের মুখপাত্র সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, এটাকে অভুত্থান বলার ইচ্ছে তাদের নেই। তারা বার্লিনে তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলবেন বলে বলেন। মিশরের সরকার তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে ‘ব্রাদারহুড সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে আখ্যা দেয়। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান তিউনিসিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে দেশটার নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন আশা করেন। শুধুমাত্র তুরস্কই তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্টের সরাসরি সমালোচনা করেছে। ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’র মুখপাত্র ওমের চেলিক এক টুইটার বার্তায় তিউনিসিয়ার ঘটনাকে অভ্যুত্থান বলে আখ্যা দেন। ‘একে পার্টি’র সাথে তিউনিসিয়ার ‘এননাহদা পার্টি’র সম্পর্ক বরাবরই ভালো; যা কিনা ‘ফ্রি দেস্তুরিয়ান পার্টি’সহ অনেকে তিউনিসিয়াতে তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বলে দেখে। লিবিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের হস্তক্ষেপের পর থেকে এই আলোচনা তিউনিসিয়াকে বিভক্ত করেছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি জিরো মিডিয়া’র এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, তিউনিসিয়ার মানুষ মনে করছে যে, বর্তমানের রাজনীতিবিদেরা আগের একনায়ক বেন আলি সরকারের রাজনীতিবিদদের মতোই দুর্নীতিবাজ। তারা সকলেই গণতন্ত্রের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাধারণ নাগরিকদের জন্যে উন্নততর জীবন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পার্লামেন্টে অনেকগুলি দল থাকার কারণে ভঙ্গুর কোয়ালিশনের মাধ্যমে রাজনীতিবিদেরা দেশ চালিয়েছেন; যার ফলশ্রুতিতে পার্লামেন্টে সিদ্ধান্তহীনতা এবং জনজীবনে অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেয়া দিয়েছে; এবং পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপরেই জনগণের আস্থা ধ্বসে পড়েছে। গত এক বছর ধরেই তিউনিসিয়ার জনগণ থেকে থেকে রাস্তায় নেমেছে। রাস্তায় মানুষের সংখ্যা গত এক দশকের মাঝে ছিল সর্বোচ্চ। স্থবির অর্থনীতি, বাড়তে থাকা অসমতা, অপ্রতুল জনসেবা এবং চাকুরির সুযোগ কমে যাওয়া মানুষের অসন্তোষের মূল কারণ ছিল। মহামারি শুরু হবার আগেই তিউনিসিয়াতে যুবকদের মাঝে বেকারত্বের হার ছিল ৩৬ শতাংশ! খুব স্বাভাবিকভাবেই তরুণরাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। তিউনিসিয়ার অর্থনীতিতে পর্যটন একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে বহু মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। মহামারির কারণে তা পুরোপুরি ধ্বসে পড়েছে। তিউনিসিয়া থেকে হাজারো মানুষ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ওপাড়ে ইতালিতে যাচ্ছে; উদ্দেশ্য ইউরোপে কাজ খোঁজা। ২০২০ সালে এরকম অভিবাসী প্রত্যাশীর সংখ্যা পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে।

‘ভোক্স’ ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাতে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’এর সিনিয়র ফেলো সারাহ ইয়ার্কিস তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক কলহের একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় তিউনিসিয়ার একনায়ন জেইন এল আবেদিন বেন আলি সরকারের পতন হলে সেদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের আবির্ভাব হয়। পার্লামেন্টে মাত্র এক চতুর্থাংশ আসন নিয়ে সবচাইতে বড় দল ‘এননাহদা’ পার্টি; যারা মূলতঃ মুসলিম ব্রাদারহুডের চিন্তা বহণ করে। গত এক দশকে তারা সর্বোচ্চ ভোট পেলেও সরকার গঠন করার জন্যে তাদেরকে কোয়ালিশনে যেতে হয়েছে। তাদের বিরোধী হিসেবে রয়েছে প্রাক্তন একনায়ক বেন আলির সমর্থকদের দল ‘ফ্রি দেস্তুরিয়ান পার্টি’, যারা ফ্রান্সের সাথে তিউনিসিয়ার সুসম্পর্কের পক্ষে। আবির মুসির নেতৃত্বে থাকা এই দল পুরোপুরি সেকুলার এবং ‘এননাহদা’র মতো ইসলামিক দলের পুরোপুরি বিপক্ষে। এছাড়াও সেখানে রয়েছে ‘আল কারামা কোয়ালিশন’; যারা ইসলামিক দল এবং তারা মনে করে যে ‘এননাহদা’ যথেষ্ট ইসলামিক নয় এবং রাষ্ট্রে ইসলামের অস্তিত্ব নিয়ে ‘এননাহদা’ যথেষ্ট চিন্তিত নয়। প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ আবার কোন দলের অংশ নন। তিনি প্রথম থেকেই ‘এননাহদা’র বিপক্ষে থাকলেও তিনি পুরোপুরি সেকুলার দলগুলির অংশও নন। তিউনিসিয়ার রাজনীতিতে ইসলামিক দল বনাম পুরোপুরি সেকুলার দলগুলির প্রতিযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমদিকে পার্লামেন্টের দলগুলির মাঝে সমঝোতা করে কোয়ালিশন করার প্রবণতা থাকলেও পরবর্তীতে পার্লামেন্টারিয়ানরা হাতাহাতি মারামারি শুরু করে। একারণেই আবির মুসির নেতৃত্বে চরম সেকুলার ‘ফ্রি দেস্তুরিয়ান’ এবং ‘আল কারামা’র মতো ইসলামিক দল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে।

ভূমধ্যসাগর উপকূলে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্যপথের উপর অবস্থিত তিউনিসিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। লিবিয়ার যুদ্ধে তুরস্কের জড়াবার পর থেকে তিউনিসিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। তিউনিসিয়ার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স এখানে তুরস্কের প্রভাব দেখতে চায় না। সেকারণে প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদের ক্ষমতা নেয়াটা ফ্রান্সের কাছে চিন্তার বিষয় নয়, বরং ‘এননাহদা’র সমর্থকদের রাস্তায় দেখতে চাইছে না ফ্রান্স। তবে এখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ একইসাথে সাইয়েদের সমালোচনা করা থেকে বিরত থেকেছে, যা ‘এননাহদা’ এবং তুরস্কের মাঝে সম্পর্কোন্নয়নকে নিরুৎসাহিত করছে। লিবিয়াতে তুরস্কের হস্তক্ষেপ পশ্চিমারা মেনে নিলেও তিউনিসিয়ার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আরব বসন্তের পর তিউনিসিয়ার তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক সফলতা’ নয়, বরং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাই দেশটার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদর্শিক চিন্তার বাস্তবয়নের চাইতে ভূকৌশলগত নিরাপত্তাই এখন পশ্চিমা দেশগুলির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।