Tuesday 31 January 2023

ইরানের অস্ত্র কারখানায় ড্রোন হামলা আঞ্চলিক উত্তেজনায় নতুন মাত্রা

৩১শে জানুয়ারি ২০২৩

২৮শে জানুয়ারি ২০২৩। ইরানের ইসফাহান শহরে অস্ত্রের কারখানায় ড্রোন হামলা। এই হামলার মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিলো নিঃসন্দেহে।


গত ২৮শে জানুয়ারি ইরানের মধ্যাঞ্চলের শহর ইসফাহানের একটা ‘ওয়ার্কশপে’ ড্রোন হামলা হয়েছে বলে ইরানের সরকারি গণমাধ্যমে বলা হয়। ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, মোট তিনটা ড্রোন কারখানায় হামলা করে; যার মাঝে দু’টাকে ভূপাতিত করা হয়। একটা ড্রোন তার বহনকৃত বোমা কারখানার উপরে ফেলতে সক্ষম হয়। তবে এতে কারখানার ছাদের উপর সামান্য ক্ষতি ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইরানের টেলিভিশনে কারখানার ছাদের ভিডিও প্রকাশ করে হাল্কা ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয় এবং একইসাথে ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়; যেগুলি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত ড্রোনের সদৃশ। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘ইরনা’ জানাচ্ছে যে, ড্রোনগুলি ছিল ‘কোয়াড কপ্টার’; যেগুলি হলো চারটা পাখা দ্বারা ওড়া ছোট আকারের ড্রোন। এগুলি সাধারণতঃ স্বল্প দূরত্ব থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে চালানো হয়। অর্থাৎ এই ড্রোনগুলি ইরানের বাইরে থেকে উড়ে আসেনি। কেউ এখন পর্যন্ত হামলার দায় স্বীকার না করলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, ইস্রাইল এই হামলা করেছে। অনেকেই ধারণা করছেন যে, ইসফাহানের এই কারখানায় খুব সম্ভবতঃ ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্রের যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করা করা।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২২এর অক্টোবরে ইরানের টেলিভিশনে কিছু ব্যক্তির বক্তব্য প্রকাশ করা হয়; যেখানে বলা হয় যে এই বক্তব্য ছিল আটককৃত কুর্দি বিদ্রোহী গ্রুপ ‘কোমালা’র সদস্যদের, যারা কিনা ইস্রাইলের ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘মোসাদ’এর ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং তারা ইসফাহান শহরে সামরিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করছিলো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে এরূপ ঘটনার গুরুত্ব বেড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ইরানের কুর্দী বংশোদ্ভূত মহিলা মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুরো ইরানজুড়ে চলছে সহিংসতা। আর ইতোমধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে ইরান সুইসাইড ড্রোন সরবরাহ করায় ইরানকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা এবং পারমাণবিক প্রকল্পে কাজ করা গবেষকদের হত্যার জন্যে অনেকেই ইস্রাইলকেই দায়ী মনে করছেন। ইরানের সরকার পারমাণবিক প্রকল্পে ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে ইস্রাইলের পক্ষ থেকে ইরান-বিরোধী বক্তব্য যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইস্রাইলের যৌথ মহড়ার পরিধিও বেড়েছে। এখানে আজেরবাইজানের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আজেরবাইজান ইরানের প্রতিবেশী দেশ এবং ইস্রাইলের সাথে আজেরবাইজানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ইরানিরা বারংবার অভিযোগ করেছে যে, ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স আজেরবাইজানকে ব্যবহার করে ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালাচ্ছে। 

ড্রোনগুলি সাধারণতঃ স্বল্প দূরত্ব থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে চালানো হয়। অর্থাৎ এগুলি ইরানের বাইরে থেকে উড়ে আসেনি। আজেরবাইজান ইরানের প্রতিবেশী দেশ এবং ইস্রাইলের সাথে আজেরবাইজানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ইরানিরা বারংবার অভিযোগ করেছে যে, ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্স আজেরবাইজানকে ব্যবহার করে ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালাচ্ছে।


ইসফাহানে ড্রোন হামলার একদিন আগেই তেহরানে আজেরবাইজানের দূতাবাসে হামলা হয়। আজেরবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ২৭শে জানুয়ারি সকাল ৮টার সময় এক ব্যাক্তি স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের মাধ্যমে দূতাবাসে হামলা করে। এতে দূতাবাসের নিরাপত্তা প্রধান নিহত হন এবং এবং আরও দু’জন নিরাপত্তারক্ষী আহত হন। সোশাল মিডিয়া ‘টেলিগ্রাম’এ প্রকাশ করা ভিডিওতে দেখা যায় যে, এক অস্ত্রধারী ব্যক্তি হঠাৎ করেই দূতাবাসের মুখে গাড়ি পার্ক করে বন্দুক নিয়ে হামলা করে। পরবর্তীতে দূতাবাসের ভেতরে তার সাথে কর্মকর্তারা তাকে ধরে ফেলে। ভিডিওতে কোন শিশু দৃশ্যমান না হলেও তেহরানের পুলিশ প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন রাহিমি ইরানি বার্তা সংস্থা ‘তাসনিম’কে বলেন যে, আক্রমণকারী ব্যক্তি তার দু’জন শিশু সন্তানকে নিয়ে দূতাবাসে এসেছিলেন। তিনি বলেন যে, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, ব্যাপারটা ছিল ব্যাক্তিগত এবং পারিবারিক কলহ। তবে আজেরবাইজানের বিবৃতি বলছে যে, এই ঘটনা মোটেই পারিবারিক কলহ ছিল না। ঘটনার অনেক আগে থেকেই ইরানের অভ্যন্তরে আজেরবাইজান-বিরোধী কর্মকান্ডের ফলে আজেরবাইজানের পক্ষ থেকে তেহরানে তাদের দূতাবাসের নিরাপত্তা বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়েছিল। ইরানিরা সেই দাবি আমলে না নেয়ায় এখন আজেরবাইজান দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তেহরানের হামলার পর যে দেশগুলি আজেরবাইজানকে সমবেদনা জানিয়েছে, তার মাঝে ইস্রাইল ছিল সর্বাগ্রে।

‘ইউরেশিয়ানেট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তেহরানে হামলার কয়েক ঘন্টার পরেই বাকুতে ইস্রাইলের রাষ্ট্রদূত জর্জ ডীক এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, তার সাথে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিকমাত হাজিইয়েভের সাথে অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। তেহরানে আজেরি দূতাবাসে হামলার আগে থেকেই আজেরবাইজান-ইরান সম্পর্কে উত্তেজনা চলছিল। ২০২০ সালে নাগোর্নো কারাবাখের যুদ্ধের সময় আজেরবাইজান অভিযোগ করে যে, ইরান আর্মেনিয়াকে জ্বালানি এবং অন্যান্য সহায়তা দেয়। অপরদিকে তেহরান দুশ্চিন্তায় রয়েছে যে, আজেরবাইজান তাদের নাখচিভান ছিটমহলকে মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত করার জন্যে যে করিডোর আর্মেনিয়ার কাছে দাবি করছে, সেটা ইরানের সাথে আর্মেনিয়া এবং রাশিয়ার স্থলযোগাযোগের পথকে হুমকির মাঝে ফেলতে পারে। এছাড়াও ইরানের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ জাতিগতভাবে আজেরি হওয়ায় তা তেহরান এবং বাকুর মাঝে দড়িটানাটানির কারণ হয়েছে। তেহরানে আজেরবাইজানের দূতাবাসে হামলার পর আজেরবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইরানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বলা হয় যে, এই ঘটনার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও চাপের মাঝে পড়বে। ২০২২এর নভেম্বরে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ এক অনুষ্ঠানে বলেন যে, তার সরকার আজেরবাইজান এবং আজেরবাইজানের বাইরে সকল আজেরিদের সেকুলার জীবনযাত্রাকে রক্ষার চেষ্টা করবে; এমনকি ইরানের অভ্যন্তরে যে আজেরিরা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রেও। আলিইয়েভ ইরানের অভ্যন্তরের আজেরিদেরকে ‘আজেরবাইজানের জনগণ’ বলে আখ্যা দেন।

তেহরানে আজেরি দূতাবাসে হামলার পর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, আজেরবাইজান কখনও একা নয়। ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ঐতিহাসিকভাবেই আজেরবাইজান তুরস্কের সবচাইতে কাছের বন্ধু। নাগোর্নো কারাবাখ যুদ্ধে আজেরিদের বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল তুরস্ক এবং ইস্রাইল। তুরস্ক আবার আঞ্চলিকভাবে ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী। তদুপরি, ইরান সর্বদাই অভিযোগ করে আসছে যে, আজেরবাইজান ইরানের অভ্যন্তরের আজেরিদের মাঝে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাকে উস্কে দিচ্ছে। একইসাথে ইরান সন্দেহ করে যে, ইরানের অভ্যন্তরে ইস্রাইলের ইন্টেলিজেন্স কাজ করার জন্যে আজেরবাইজানকে ব্যবহার করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ইসফাহান অস্ত্র কারখানায় হামলা মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিলো নিঃসন্দেহে।

Saturday 28 January 2023

আফ্রিকাকে ঘিরে চীন, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ঘনীভূত হচ্ছে

২৮শে জানুয়ারি ২০২৩

জানুয়ারি ২০২৩। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট রামাফোসার সাথে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফ্রিকার দেশগুলির সমর্থন না পেয়ে ২০২৩ সালে বাইডেন প্রশাসন যে আফ্রিকার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, তা নিশ্চিত। তবে রাশিয়া এবং চীনের যৌথ প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করাটা যে খুব সহজ হবে না, সেব্যাপারেও সকলেই একমত। আফ্রিকার দেশগুলিকে নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন হয়তো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে তার আদর্শিক অবস্থান থেকে বেশ খানিকটা সরে আসতে বাধ্য হবেন।

মাত্র কিছুদিন হলো চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং আফ্রিকার পাঁচটা দেশ ভ্রমণ করেছেন। আর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের মাত্র একদিন পরই সেখানে হাজির হয়েছে মার্কিন বাণিজ্য সচিব জ্যানেট ইয়েলেন। এছাড়াও জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি লিন্ডা থমাস গ্রীনফিল্ড পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানা সফরে গিয়েছেন। ‘এনপিআর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই বলছেন যে, আফ্রিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রশাসন আফ্রিকার দিকে খুব একটা তাকায়নি। এখন জো বাইডেনের প্রশাসন আফ্রিকায় তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করায় ব্রতী হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন ডিসিতে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই বৈঠকে নীতি বিষয়ক কোন দিকনির্দেশনা ছিল না; বরং আফ্রিকার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সেতু তৈরিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে যে, ২০২৩ সালে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজে এবং তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসও আফ্রিকা সফর করতে পারেন। তবে বর্তমানে আফ্রিকার সাথে মার্কিন বাণিজ্য যতটুকু, চীনের সাথে আফ্রিকার বাণিজ্য তার চারগুণ! মার্কিনীরা চীনা ঋণের ফাঁদের কথা বললেও চীনের বিপরীতে তারা আফ্রিকাকে কি দিতে পারে সেটা পরিষ্কার করতে পারেনি। অপরদিকে আফ্রিকার দেশগুলি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিমা চাপের মুখে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক কর্তনের ক্ষেত্রেও আগ্রহী হয়নি।

‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা অস্বীকার করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকাতে রুশ এবং চীনা প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে; যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আফ্রিকার দেশগুলি যখন রুশদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন ওয়াশিংটন আফ্রিকার দেশগুলির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। মার্কিনীরা বলছে যে, তারা বাণিজ্য, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা বিষয়েই আফ্রিকার দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নে বেশি আগ্রহী। মার্কিন বাণিজ্য সচিব জ্যানেট ইয়েলেন আফ্রিকা সফরের সময় বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত নয়; শুধুমাত্র আফ্রিকার সাথে সম্পর্ক আরও গভীর করতে আগ্রহী। কিন্তু আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের চেয়ারপার্সন মুসা ফাকি মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, পশ্চিমা দেশগুলি একসময় আফ্রিকাকে উপনিবেশ হিসেবে শাসন করেছে। আফ্রিকানরা এখন সকলের সাথেই সহযোগিতা করতে চায়; যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আফ্রিকানদের স্বার্থকে সন্মান করবে। চীনের সাথে আফ্রিকার সহযোগিতা এই চিন্তাগুলির উপরেই স্থাপিত।

তবে শক্তিশালী দেশগুলি আফ্রিকাকে নিয়ে প্রতিযোগিতা বরং বাড়িয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার সামরিক বাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, আগামী ১৭ থেকে ২৭শে ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে ভারত মহাসাগরে রাশিয়া এবং চীনের সাথে এক যৌথ নৌমহড়ার আয়োজন করা হয়েছে। ‘মোসি-২’ নামের এই মহড়াটা ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বার্ষিকীকে স্পর্শ করবে। ‘সিবিএস নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই এই মহড়ার ব্যাপারে তার উদ্বেগ জানিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি পান্ডর সমালোচকদের বক্তব্যের প্রত্যুত্তরে বলেন যে, এটা শুধু কিছু বন্ধু দেশের সাথে মহড়া মাত্র। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের দেশ ব্রিটেন, চীন, নাইজেরিয়া, এমনকি এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় বলেন যে, এই মহড়াটা পুরোপুরি স্বচ্ছতা বজায় রেখে করা হচ্ছে এবং মহড়া সম্পর্কে সকল তথ্যই আগে থেকেই দেয়া হয়েছে। রুশ বার্তা সংস্থা ‘তাস’ বলছে যে, এই মহড়ায় একটা রুশ যুদ্ধজাহাজ প্রথমবারের মতো সর্বাধুনিক ‘হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র’ বহণ করবে।

‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর ডেপুটি ডিরেক্টর পলিন ব্যাক্স ‘সিবিএস’কে বলছেন যে, এই মহড়ার পরিকল্পনা বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই করা হয়েছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে এই মহড়া কিছুটা ভিন্নরকম। কূটনৈতিক জটিলতা এড়াতে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়তো অন্য কোন দিন দেখতে পারতো।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর গবেষক ক্যামেরন হাডসন ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, যদিও মার্কিনীরা বলছে যে, তারা শুধুমাত্র আফ্রিকার উন্নয়নের সহযোগী হতে চায়, প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা এর চাইতে আরও জটিল। উন্নয়ন সহযোগিতা এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে আলাদা করা যাবে না। মার্কিনীরা একদিকে যেমন চাইছে যে, আফ্রিকার দেশগুলি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন এবং রাশিয়ার প্রভাবকে এড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হোক, তেমনি তারা আফ্রিকায় রুশ এবং চীনা কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। হাডসন প্রশ্ন করছেন যে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন আফ্রিকা সফর করতে গেলে গণতন্ত্রকে তুলে ধরার যে আদর্শিক ব্রত তিনি দেখিয়েছিলেন সেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখবেন কিনা। আফ্রিকার দেশগুলি যখন গণতন্ত্র থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি কি আফ্রিকার সরকারগুলির সরাসরি সমালোচনা করবেন, নাকি জাতিসংঘে আফ্রিকার দেশগুলির সমর্থন পেতে আপাততঃ সমালোচনাকে পিছনের সারিতে রাখবেন?

‘মরগ্যান স্ট্যানলি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনারা তাদের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘বিআরআই’এর আওতায় বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এর মাঝে চীনারা বেশ শক্তভাবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলাবার নীতিতে অটল রয়েছে। চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গাং আফ্রিকা সফরের সময় বলেন যে, কোন দেশের অধিকার নেই আফ্রিকার দেশগুলিকে কোন বিশেষ পক্ষালম্বন করার জন্যে চাপ দেয়ার। আফ্রিকার হওয়া উচিৎ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র; শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নয়।

‘এনপিআর’ বলছে যে, আফ্রিকার সাধারণ জনগণ আফ্রিকাকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে ভালো চোখে দেখছে না। কিন্তু যখন আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশই বাইরের সহায়তার উপর নির্ভরশীল, তখন এই মহাদেশকে নিয়ে যে শক্তিশালী দেশগুলির মাঝে প্রতিযোগিতা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফ্রিকার দেশগুলির সমর্থন না পেয়ে ২০২৩ সালে বাইডেন প্রশাসন যে আফ্রিকার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, তা নিশ্চিত। তবে রাশিয়া এবং চীনের যৌথ প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করাটা যে খুব সহজ হবে না, সেব্যাপারেও সকলেই একমত। আফ্রিকার দেশগুলিকে নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন হয়তো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে তার আদর্শিক অবস্থান থেকে বেশ খানিকটা সরে আসতে বাধ্য হবেন।

Friday 20 January 2023

যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইল থেকে ইউক্রেনে আর্টিলারি শেল পাঠাচ্ছে কেন?

২১শে জানুয়ারি ২০২৩
 
আর্টিলারি শেলের সরবরাহের ঘাটতি পূরণে যুক্তরাষ্ট্র তার স্টক থেকে যোগান দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর অর্থ হলো, ওয়াশিংটন অন্য কোথাও ঝুঁকি নিয়ে সরবরাহ নিশ্চিত করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা যে শুধু আর্টিলারি শেল নিয়ে, তা কিন্তু নয়। মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পে সরবরাহকারীর সংখ্যা অত্যধিকভাবে কমে যাওয়ায় এবং দক্ষ শ্রমিকের স্বল্পতা দেখা দেয়ায় মার্কিন সামরিক উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে।

গত ১৭ই জানুয়ারি ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে মার্কিন এবং ইস্রাইলি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলে মজুত করা তাদের গোলাবারুদের একাংশকে ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। খুবই কম আলোচিত এই মজুত যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলের মাটিতে রেখেছিল মধ্যপ্রাচ্যে ভবিষ্যৎ কোন সম্ভাব্য যুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে। জরুরি প্রয়োজনে ইস্রাইলেরও এই মজুত থেকে গোলাবারুদ ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষই ব্যাপকভাবে আর্টিলারি গোলা ব্যবহার করছে। যার ফলশ্রুতিতে উভয় পক্ষই গোলাবারুদের স্বল্পতায় পড়েছে। এমতাবস্থায় কার গোলাবারুদের স্টক আগে শেষ হয়, সেটার উপরেই নির্ভর করছে যুদ্ধে কে এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকবে।

গোলাবারুদের স্বল্পতার কারণে ইউক্রেন বাধ্য হয়েছে পশ্চিমা ডিজাইনের আর্টিলারির উপরে নির্ভরশীল হতে। এখন পশ্চিমা দেশগুলি ইউক্রেনকে আর্টিলারি গোলা দিতে গিয়ে নিজেদের স্টকই কমিয়ে ফেলেছে। একইসাথে মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলি এখনও তত দ্রুতগতিতে আর্টিলারি গোলা উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে না। ইউক্রেন প্রতিমাসে ৯০ হাজার আর্টিলারি শেল ব্যবহার করছে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের যৌথ উৎপাদন ক্ষমতার দ্বিগুণ! ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইস্রাইলে মজুত করা গোলাবারুদ থেকে ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে। ইউক্রেনকে প্রতিশ্রুত ১০ লক্ষ আর্টিলারি শেলের অর্ধেকের কিছু কম আসছে এই দুই দেশের মজুত থেকে। ওয়াশিংটনের এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন মার্কিন অস্ত্র নির্মাণ সক্ষমতার সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরছে, তেমনি দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইস্রাইলের মতো দেশগুলি, যারা কিনা এতদিন ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে রাশিয়ার সাথে সরাসরি শত্রুতা করতে চাইছিলো না, তাদেরকেও এখন ইউক্রেন যুদ্ধের অংশ হতে বাধ্য করলো।

ইস্রাইলি গবেষণা সংস্থা ‘মিতভিম’এর প্রধান নিমরড গোরেন ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে বলছেন যে, ইস্রাইল থেকে আর্টিলারি শেল সরিয়ে ফেলার মার্কিন সিদ্ধান্তে ইস্রাইলের খুব বেশি কিছু বলার নেই। কারণ এই অস্ত্রগুলির মালিক যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে ইউক্রেনকে শুধুমাত্র মানবিক সহায়তা দেয়ার ইস্রাইলি সিদ্ধান্তে কোন পরিবর্তন আসেনি। ইস্রাইলের মধ্যপন্থীরা ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানাচ্ছে; অপরদিকে ডানপন্থীরা সাবধানে কথা বলছে। ইস্রাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলি কোহেন ইতোমধ্যেই বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে কম কথা বলার নীতিতে রয়েছে। ‘ইস্রাইলি ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইস্রাইলের ‘ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ’এর জ্যেষ্ঠ গবেষক আরকাদি মিলমান বলেন যে, রাশিয়া এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নাও নিতে পারে। ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্তের কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইস্রাইল ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো। তবে এর কারণে রাশিয়ার সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক নষ্ট হবার সম্ভাবনা নেই।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘সিএনএ’এর ডিরেক্টর মাইকেল কফম্যান ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, আর্টিলারি শেলের সরবরাহের ঘাটতি পূরণে যুক্তরাষ্ট্র তার স্টক থেকে যোগান দিতে বাধ্য হচ্ছে। এর অর্থ হলো, ওয়াশিংটন অন্য কোথাও ঝুঁকি নিয়ে সরবরাহ নিশ্চিত করছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, তারা গোলাবারুদের মজুত পুনরায় পরিপূর্ণ করবে এবং জরুরি প্রয়োজনে অতি দ্রুত গোলাবারুদ সরবরাহ করবে। মার্কিন কংগ্রেসের রিসার্চ সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইস্রাইল ২০০৬ সালে হিযবুল্লাহ এবং ২০১৪ সালে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন মজুত থেকে আর্টিলারি শেল ব্যবহার করেছিল। ইস্রাইলিরা দুশ্চিন্তায় রয়েছে যে, তারা ইউক্রেনকে সহায়তা দিলে রাশিয়া সিরিয়াতে রুশ সামরিক শক্তিকে ইস্রাইলের বিপক্ষে ব্যবহার করতে পারে। বর্তমানে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইরানি টার্গেটে ইস্রাইলি হামলার বিরুদ্ধে রাশিয়া কিছু করা থেকে বিরত থাকছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ইউক্রেনে গোলাবারুদ সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কোরিয়রা ইস্রাইলের মতো ততটা বাধা দেয়নি। তারা একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদের স্বল্পতা পুষিয়ে নিতে ১ লক্ষ আর্টিলারি শেল বিক্রি করার জন্যে চুক্তি করেছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা যে শুধু আর্টিলারি শেল নিয়ে, তা কিন্তু নয়। ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনকে ৭ হাজার ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্টকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শেষ করে ফেলেছে। একইসাথে কাঁধের উপর থেকে ছোঁড়া ‘স্টিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মজুতের প্রায় এক-চতুর্থাংশও ইউক্রেনকে সরবরাহ করা হয়েছে। ‘স্টিংগার’এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘রেথিয়ন’ বলছে যে, কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে এই ক্ষেপণাস্ত্রের উৎপাদন পুনরায় শুরু করতে। ২০২০ সালে পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পে সরবরাহকারীর সংখ্যা অত্যধিকভাবে কমে যাওয়ায় এবং দক্ষ শ্রমিকের স্বল্পতা দেখা দেয়ায় মার্কিন সামরিক উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়েছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু যন্ত্রাংশ এখন হাতে গোণা কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করে; যা কিনা পুরো ব্যবস্থাকেই হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে যে, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনের এই সমস্যা শুধু ইউক্রেনকে সরবরাহ নয়, ভবিষ্যতে তাইওয়ানকে জরুরি সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। বিশেষ করে কম্পিউটার চিপ সরবরাহের জটিলতা কাটিয়ে উঠতে অনেক বেশি সমস্যায় পড়তে হবে।

গত ১১ই জানুয়ারি মার্কিন নৌবাহিনীর সচিব কার্লোস ডেল টরো সাংবাদিকদের বলেন যে, আগামী ছয় মাস বা এক বছরের মাঝে মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্প যদি তাদের উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি করতে সক্ষম না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এর কিছুদিন আগেই মার্কিন নৌবাহিনীর এডমিরাল ড্যারিল কাউডল এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন যে, অতি শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করবে, নাকি নিজেকে শক্তিশালী করবে? তিনি আরও বলেন যে, তিন বছর ধরেই প্রতিরক্ষা শিল্পের সরবরাহকারীরা করোনা মহামারির দোহাই দিয়ে সরবরাহ পিছাচ্ছে; যা মেনে নেয়া কষ্টকর। সরবরাহের সমস্যাগুলি এমন সময়ে আসছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে একটা শত্রুকে মোকাবিলা করছে; আর অপরদিকে আরেকটা সম্ভাব্য শত্রু প্রস্তুত হচ্ছে, যেরকম শত্রু মার্কিনীরা আগে কখনও দেখেনি। এরকম পরিস্থিতিতে অস্ত্র সরবরাহ পিছিয়ে যাওয়া জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি। এডমিরাল কাউডল মূলতঃ রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন সহায়তা দিতে গিয়ে চীনকে মোকাবিলায় দুর্বলতা নিয়ে কথা বলেছেন। বিশ্বের সবচাইতে বড় সমরশক্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেন যথেষ্ট অস্ত্র নেই।

Tuesday 10 January 2023

ইউক্রেনের জন্যে পশ্চিমা ট্যাংক … কত বড় ঘটনা এটা?

১০ই জানুয়ারি ২০২৩
 
ফরাসি সেনাবাহিনীর 'এএমএক্স-১০আরসি' 'হাল্কা ট্যাংক'। ইউক্রেনকে ফ্রান্সের ‘হাল্কা ট্যাংক’ এবং ব্রিটেনের সম্ভাব্য ‘চ্যালেঞ্জার-২’ ট্যাংক দেয়ার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং জার্মানির উপরে চাপ সৃষ্টি করবে। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মিলিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের ইউক্রেনকে ট্যাংক দেয়ার পক্ষে সমর্থন জার্মানিকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলবে; কারণ এতে জার্মানি রাশিয়াকে তার নিরাপত্তার প্রতি প্রধানতম হুমকি হিসেবে ঘোষণা দিতে বাধ্য হবে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ গত ৪ঠা জানুয়ারি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকির সাথে ঘন্টাখানেক ফোনালাপের পর ফরাসি প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে বলা হয় যে, ফ্রান্স ইউক্রেনকে ‘হাল্কা ট্যাংক’ দিতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি একই দিনে এক টুইটার বার্তায় ‘হাল্কা ট্যাংক’ দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানান। পরদিন ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে, ফ্রান্স ইউক্রেনকে ‘এএমএক্স-১০আরসি’ নামের সাঁজোয়া যান দিচ্ছে; যা ফরাসিরা ‘হাল্কা ট্যাংক’ নামে আখ্যা দিয়ে থাকে। ফ্রান্সের এই ঘোষণার পর থেকে একদিকে যেমন ট্যাংকের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, তেমনি পশ্চিমা আর কোন কোন দেশ ফ্রান্সের উদাহরণ অনুসরণ করতে পারে, তা নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা কল্পনা।

ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ফ্রান্সের ‘লে মন্ড’ পত্রিকা বলছে যে, ‘এএমএক্স-১০আরসি’ সাঁজোয়া যানগুলি ১০৫মিঃমিঃ কামান দ্বারা সজ্জিত। এর বর্ম পদাতিক বাহিনীর হাল্কা অস্ত্রের আঘাত সহ্য করতে পারে। তবে ট্যাংকের ‘ট্র্যাক’এর পরিবর্তে এর রয়েছে ৬টা রাবারের চাকা। ১৯৮১ সাল থেকে সার্ভিসে আসা ২’শ ৪৫টা গাড়ি বর্তমানে ফরাসি সেনাবাহিনীতে ‘জাগুয়ার’ নামের আরেকটা সাঁজোয়া গাড়ি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। তবে গত চার দশকে এই গাড়িগুলিকে আরও উন্নত প্রযুক্তি দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। ইউক্রেনের পক্ষ থেকে গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘এম-১ আব্রামস’ এবং জার্মানির ‘লেপার্ড-২’ ট্যাংক চাওয়া হচ্ছে। ফ্রান্স এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে ‘সীজার’ স্বয়ংচালিত আর্টিলারি, ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘ক্রোটেইল’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে। একইসাথে ফ্রান্স নিজ দেশে ২ হাজার ইউক্রেনিয় সেনাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

‘বিজনেস ইনসাইডার’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ফরাসি ‘এএমএক্স-১০আরসি’ সাঁজোয়া গাড়িগুলি ট্যাংকের মতো অতটা শক্তিশালী বর্ম দ্বারা সজ্জিত নয়। আর এর কামানও অন্যান্য ট্যাংকের ১২০মিঃমিঃ বা ১২৫মিঃমিঃ কামানের চাইতে অপেক্ষাকৃত স্বল্প ক্ষমতার। ১৬ টন ওজনের এই ‘হাল্কা ট্যাংক’ ভালো রাস্তায় প্রায় ৬০ কিঃমিঃ গতিতে চলতে সক্ষম। অপরদিকে মার্কিন ‘আব্রামস’ ট্যাংকগুলি প্রায় ৭০ টন ওজনের এবং সেগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রে সচল রাখার জন্যে বেশ জটিল সাপ্লাই চেইনের প্রয়োজন হয়। ‘এএমএক্স-১০আরসি’ গাড়িগুলি বিপক্ষের ট্যাংক ধ্বংস করার জন্যে তৈরি হয়নি। বরং শত্রুর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে দ্রুত সড়ে পড়ার জন্যে ডিজাইন করা হয়েছে। তবে অন্যান্য সাঁজোয়া যানের সাথে ‘এএমএক্স-১০আরসি’র পার্থক্য হলো, যেখানে অন্যান্য গাড়িগুলি ৩০ মিঃমিঃ বা ৪০ মিঃমিঃ কামান বহণ করে, ‘এএমএক্স-১০আরসি’ বহণ করে ১০৫ মিঃমিঃ কামান। এই কামান শত্রুর ট্যাংক এবং অন্যান্য সাঁজোয়া যান ধ্বংস করতে সক্ষম; আর এই কামানের জন্যেই ফরাসিরা হয়তো এগুলিকে ‘হাল্কা ট্যাংক’ বলছে।

১৯৭০এর দশকের প্রযুক্তির এই ‘হাল্কা ট্যাংক’গুলি ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে ফ্রান্স এবং ইউক্রেন উভয়েই এই গাড়িগুলিকে যে ‘হাল্কা ট্যাংক’ বলছে, তা বেশ গুরুত্ববহ। পশ্চিমা দেশগুলি এখনও ‘আব্রামস’এর মতো ট্যাংক ইউক্রেনকে দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এর ফলে ইউক্রেনকে সোভিয়েত ডিজাইনের ট্যাংকের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে; যার বেশগুলি আবার যুদ্ধের মাঝে রুশদের হাত থেকে দখল করা। ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্তের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সাঁজোয়া যান দিতে রাজি হয়েছে। ফ্রান্সের ঘোষণার পরপরই ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র ‘এম-২ ব্র্যাডলি’ এবং জার্মানি ‘মারডার’ সাঁজোয়া যান দেয়ার ঘোষণা দেয়। এই গাড়িগুলিতে চাকার স্থলে রয়েছে ‘ট্র্যাক’। এগুলি ফরাসি গাড়িগুলি থেকে আরও ভারি হলেও এগুলির কামান তত শক্তিশালী নয়। তবে এগুলি ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে সক্ষম।

 
জার্মান সেনাবাহিনীর 'লেপার্ড-২' ট্যাংক। ইউরোপের ইতিহাস বলে যে, জার্মানি এবং রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি সামরিক অবস্থান ইউরোপকে ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে ফেলেছে। জার্মানির উপরে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের এহেন চাপ সৃষ্টি ইইউএর অস্তিত্বকে যেমন প্রশ্নের মাঝে ফেলতে পারে, তেমনি ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তাকেও অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে দিতে পারে।

এদিকে পশ্চিমা সূত্রের বরাত দিয়ে গত ৯ই জানুয়ারি ব্রিটেনের ‘স্কাই নিউজ’ বলে যে, ব্রিটেন কয়েক সপ্তাহ ধরেই ইউক্রেনকে নিজেদের সেনাবাহিনীর ১০টার মতো ‘চ্যালেঞ্জার-২’ ট্যাংক দেয়ার কথা চিন্তা করছে। ১৯৯৪ সালে সার্ভিসে আসা এই ট্যাংকগুলি প্রায় ৬২ টন ওজনের এবং এর রয়েছে শক্তিশালী ১২০ মিঃমিঃ কামান। তবে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও এব্যাপারে চুপ রয়েছে। এই ট্যাংকগুলি যুদ্ধক্ষেত্রে বড় কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারবে না। তবে তা ট্যাংকের ব্যাপারে পশ্চিমা সিদ্ধান্তহীনতাকে পরিবর্তন করতে সহায়তা দেবে। এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য হলো অন্যান্য ন্যাটোভুক্ত দেশ, বিশেষ করে জার্মানিকে তার ‘লেপার্ড’ ট্যাংকগুলি এবং যুক্তরাষ্ট্রকে তার ‘আব্রামস’ ট্যাংকগুলি দিতে প্রভাবিত করা। জার্মানি ছাড়াও পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড এবং স্পেন জার্মান ‘লেপার্ড’ ট্যাংক ব্যবহার করে। পোল্যান্ড এবং ফিনল্যান্ড ইউক্রেনকে এই ট্যাংক দিতে ইচ্ছুক হলেও এগুলিকে পুনরায় রপ্তানি করতে গেলে জার্মানির অনুমতি প্রয়োজন। জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে ৯ই জানুয়ারি বলা হয় যে, ইউক্রেনকে জার্মানি ট্যাংক দেয়ার কথা চিন্তা করছে না। গত বছর ব্রিটিশ সরকার পোল্যান্ডকে ১৪টা ‘চ্যালেঞ্জার-২’ ট্যাংক দেয়; যাতে করে পোল্যান্ড ইউক্রেনকে তাদের বহরে থাকা সোভিয়েত ডিজাইনের ‘টি-৭২’ ট্যাংকগুলি দিয়ে দিতে পারে। তবে প্রাক্তন ব্রিটিশ ট্যাংক কমান্ডার কর্নেল হেমিশ ডে ব্রেটন গর্ডনের মতে, ‘চ্যালেঞ্জার’, ‘লেপার্ড’ বা ‘আব্রামস’এর মতো ট্যাংকগুলি সোভিয়েত ডিজাইনের ট্যাংক থেকে অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে সুরক্ষিত, নির্ভরযোগ্য এবং দ্রুতগামী। এগুলি ইউক্রেনকে দেয়ার অর্থ হলো, রুশদের কাছে বার্তা দেয়া যে, পশ্চিমারা ইউক্রেনকে যেকোনকিছুই দিতে প্রস্তুত।

ইউক্রেনকে ফ্রান্সের ‘হাল্কা ট্যাংক’ এবং ব্রিটেনের সম্ভাব্য ‘চ্যালেঞ্জার-২’ ট্যাংক দেয়ার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং জার্মানির উপরে চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই জার্মানি রাশিয়ার সাথে সরাসরি সংঘাত এড়াতে ইউক্রেনকে বড় কোন সহায়তা দেয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে। রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করার ব্যাপারেও জার্মানি সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল। ফ্রান্সও নীতিগতভাবে জার্মানির কাছাকাছিই থেকেছে। তবে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মিলিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের ইউক্রেনকে ট্যাংক দেয়ার পক্ষে সমর্থন জার্মানিকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলবে; কারণ এতে জার্মানি রাশিয়াকে তার নিরাপত্তার প্রতি প্রধানতম হুমকি হিসেবে ঘোষণা দিতে বাধ্য হবে। ইউরোপের ইতিহাস বলে যে, জার্মানি এবং রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি সামরিক অবস্থান ইউরোপকে ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে ফেলেছে। জার্মানির উপরে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের এহেন চাপ সৃষ্টি ইইউএর অস্তিত্বকে যেমন প্রশ্নের মাঝে ফেলতে পারে, তেমনি ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তাকেও অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে দিতে পারে।