Saturday 29 October 2022

ফ্রান্স ও জার্মানি… বন্ধু, না প্রতিযোগী?

২৯শে অক্টোবর ২০২২
 
যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির সাথে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফ্রান্সের সাথে জার্মানির দূরত্ব বৃদ্ধিতে ইন্ধন দিলেও, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি প্যারিস ও বার্লিনকে এক করছে। তবে বাণিজ্য ইস্যুতে এক হলেও ইইউএর সমন্বিত নীতি সহজ নয়। কারণ ইউরোপের এই দুই বড় দেশের স্বার্থ যে ভিন্নমুখী, তা দুই দেশের জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা নীতিতে পরিষ্কার।

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে প্যারিসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজের বৈঠকের দিকে তাকিয়ে ছিল পুরো ইউরোপ। ‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে আলোচনার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল উৎসের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে যে, দুই নেতা একমত হয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ইউরোপকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে ।তারা আলোচনা করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তার ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন এক্ট’এর মাধ্যমে কর্পোরেটদের উপর থেকে কর কমিয়ে দিয়ে এবং জ্বালানিতে ভর্তুকি দিয়ে নিজ দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাইছে। শুধু তাই নয়; এই আইনের মাধ্যমে মার্কিন ভোক্তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করা ইলেকট্রিক গাড়ি কেনে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইউরোপের গাড়ি বিক্রি করা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

২৬শে অক্টোবর ফরাসি টিভি চ্যানেল ‘ফ্রান্স ২’এর সাথে সাক্ষাতে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ বলেন যে, ইইউএর উচিৎ ইউরোপের ভোক্তারা যাতে ইউরোপে তৈরি জিনিস কেনে, সেটা অনুপ্রাণিত করে আইন প্রণয়ন করা এবং ইউরোপিয় কোম্পানিগুলির জন্যে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা। তিনি প্রশ্ন করেন যে, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই যখন নিজেদের বাজারকে সুরক্ষা দিচ্ছে, তখন ইইউ কেন মুক্ত বাজার থাকবে? এক সপ্তাহ আগে জার্মান চ্যান্সেলরও বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের নতুন আইন নিয়ে ‘গভীরভাবে’ কথা বলতে হবে। তবে ‘পলিটিকো’ বলছে যে, ইইউ যদি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তাহলে ইউরোপ এবং আমেরিকার মাঝে নতুন করে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। একইদিনে জার্মান কেমিক্যাল কোম্পানি ‘বিএএসএফ’ জার্মানিতে তাদের কর্মকান্ড কমাবার এবং কর্মী ছাটাইয়ের ঘোষণা দেয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় জার্মানিতে গ্যাসের মূল্য ছয় গুণ। তবে ইইউ কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান যে, ইইউ যে পদক্ষেপই নিক না কেন, সেটা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ‘ডব্লিউটিও’র আইনের সাথে যেতে হবে। ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ হবে না ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ের মতো আবারও বাণিজ্য যুদ্ধের মাঝে পতিত হওয়া।

তবে দুই দেশের এই আকাত্মতা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি; বিশেষ করে জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা নীতির বিষয়ে ফ্রান্স এবং জার্মানির বিরোধ এখন পরিষ্কার। অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য ফ্রাঙ্কো-জার্মান মন্ত্রীপরিষদের বৈঠক হঠাৎ করেই আগামী বছরের জানুয়ারিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নিজস্ব স্বার্থ নিয়ে যখন ফ্রান্স ও জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দরকষাকষি করতে চাইছে, তখন সেই স্বার্থের দ্বন্দ্বই জার্মানি এবং ফ্রান্সের সম্পর্কের মাঝে দাগ টেনেছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’ বলছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি সংকটের মাঝে জার্মানি গ্যাসের উপরে ১’শ ৯৭ বিলিয়ন ডলারের ভর্তুকির ঘোষণা দিয়েছে। এবং একইসাথে ইইউএর সদস্য দেশগুলি যখন গ্যাসের মূল্যের উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার কথা বলেছে, তখন জার্মানি তা এড়িয়ে গেছে। এছাড়াও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে সমঝোতা নিয়েও জার্মানির সাথে ফ্রান্সের টানাপোড়েন চলছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে জার্মানি তার সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করার ঘোষণা দিলেও তা ইউরোপিয় নেতাদের খুশি করতে পারেনি। কারণ এই বাজেট বৃদ্ধির সুবিধা পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপিয় বা ফরাসি অস্ত্র না কিনে জার্মানি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান এবং ‘প্যাট্রিয়ট’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনছে।

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইইউএর মূল চালিকাশক্তি হলো ফ্রান্স এবং জার্মানি। এই দুই দেশের মাঝে বিরোধ ইইউএর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্যারিসে দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকও বিশ্লেষকদেরকে খুশি করতে পারেনি। জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফ্রাঙ্কো জার্মান ইন্সটিটিউট’ বা ‘ডিএফআই’এর ডেপুটি ডিরেক্টর স্টেফান সাইডেনডরফ ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, যদিও দুই দেশের মন্ত্রীসভার বৈঠকে খুব বড় কোন সিদ্ধান্ত হয় না, তথাপি এই বৈঠক ইইউএর কর্মকান্ড ঠিকভাবে চলার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৩ সালে প্রথম বৈঠকের পর থেকে ২০২২ সাল ছাড়া আর কখনোই এই বৈঠক বাতিল করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতিতে নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং মনে করতে পারে যে, বাকিরা তাকে অনুসরণ করবে। কিন্তু ইউরোপের ব্যাপারটা আলাদা। এখানে কেউই অপরের কথা চিন্তা না করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ইইউএর সবচাইতে বড় দুই দেশ ফ্রান্স ও জার্মানি আলোচনা করে একটা সমঝোতায় পৌঁছায়; যা বাকি ইউরোপিয় দেশগুলি অনুসরণ করে।

‘ডয়েচে ভেলে বলছে যে, জার্মানি জ্বালানির ব্যাপারে যে ভর্তুকির ঘোষণা দিয়েছে, তা ফ্রান্সকে জানানোটা ছিল একটা সাধারণ ভদ্রতা; কারণ এতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে। অপরদিকে ফ্রান্স স্পেনের সাথে গ্যাস পাইপলাইনের একটা চুক্তি করেছে, যার মাধ্যমে বার্সিলোনা থেকে মার্সেই পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ফ্রান্স ও স্পেনের মাঝে আরেকটা প্রকল্প বাইপাস করা হলো, যা পীরেনিজ পর্বতের মাঝ দিয়ে ফ্রান্স হয়ে জার্মানি পর্যন্ত যেতো। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানিসহ ন্যাটোর ১৫টা দেশ ‘ইউরোপিয়ান স্কাই শিল্ড ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘ইএসএসআই’ নামে একটা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপারে ঐকমতে পৌঁছায়। ফ্রান্সকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে ফ্রান্স ইতালির সাথে যৌথভাবে ‘মামবা’ নামে একটা যৌথ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ডেভেলপ করছে।

যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির সাথে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফ্রান্সের সাথে জার্মানির দূরত্ব বৃদ্ধিতে ইন্ধন দিলেও, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি প্যারিস ও বার্লিনকে এক করছে। তবে বাণিজ্য ইস্যুতে এক হলেও ইইউএর সমন্বিত নীতি সহজ নয়। কারণ ইউরোপের এই দুই বড় দেশের স্বার্থ যে ভিন্নমুখী, তা দুই দেশের জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা নীতিতে পরিষ্কার। স্টেফান সাইডেনডরফ বলছেন যে, জার্মানি চাইছে ইউরোপের ছোট দেশগুলিকে নিজের পক্ষে এনে ফ্রান্সকে বাইপাস করতে। অপরদিকে ফ্রান্স চাইছে যে, জার্মানি ফ্রান্সের নীতির সাথে একমত পোষণ করে ইউরোপের মাঝে সহযোগিতা বৃদ্ধি করুক। ম্যাক্রঁ পুরো ইউরোপের একটা বাজেট, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং কর ব্যবস্থার ব্যাপারে বলছেন। বার্লিনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জার্মান ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড সিকিউরিটি এফেয়ার্স’এর সিনিয়র ফেলো রনইয়া কেমপিন ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, ম্যাক্রঁ সর্বদাই ইইউএর বর্ধিতকরণের বিরোধিতা করেছেন। তিনি ইইউকে ফ্রান্সের প্রভাব বৃদ্ধির পদ্ধতি হিসেবে দেখেছেন। অপরদিকে জার্মানি মনে করেছে ইইউএর বর্ধিতকরণের মাধ্যমে ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

Saturday 22 October 2022

ব্রিটিশ রাজনীতি সংকটের মাঝে কেন?

২২শে অক্টোবর ২০২২
 
ব্রিটেনের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। পশ্চিমা আদর্শকে ফেরি করা ব্রিটেনের রাজনৈতিক সংকটের কারণগুলির মাঝে রয়েছে রাজনৈতিক মেরুকরণ, জনপ্রিয়তা-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, সমস্যাবহুল রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। এই সমস্যাগুলির কারণে অনেকেই দলীয় এবং ব্যক্তিস্বার্থকে রাষ্ট্রের আগে স্থান দিচ্ছে।

রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর খবরটাও এখন অনেক পুরোনো বলে মনে হচ্ছে। ক্ষমতা নেয়ার মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের পদত্যাগের পর অনেকেই ব্রিটিশ রাজনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। মাত্র ছয় বছরের মাঝে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী; এবং ২০১৬ সালে ব্রেক্সিটের পর থেকে লিজ ট্রাস হলেন পদত্যাগ করা চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতায় যাবার সময় ট্রাস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি বাজেট না কমিয়েই কর্পোরেট এবং ধনীদের উপর থেকে কর কমাবেন। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি এবং জ্বালানি সংকটের মাঝে ট্রাসের নীতিগুলি ব্রিটেনের আর্থিক বাজারে ধ্বসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের মূল্য ইতিহাসের সর্বনিম্ন হয়ে যায় এবং ব্রিটিশ সরকারের ঋণ নেবার সক্ষমতাও কমে যায়। ফলশ্রুতিতে ট্রাস তার দলের সদস্যদের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ‘ব্লুমবার্গ’এর প্রধান বার্তা সম্পাদক জন মিকলেথওয়েইট এক আলোচনায় বলছেন যে, ট্রাস নিজেই খেলা শুরু করে কিছুক্ষণ পরেই নিজ গোলপোস্টে বল ঢুকিয়ে আত্মঘাতী গোল করেন; যেটার কোন প্রয়োজনই ছিল না। তবে ব্রিটেনে যা ঘটে, তা বাকি দুনিয়াতে প্রতিফলিত হবার একটা ইতিহাস রয়েছে।

‘এনবিসি’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে, ট্রাস কর্পোরেট কর কমাবার মাধ্যমে ব্রিটেনে বিনিয়োগ বাড়াতে এবং কর্মসংস্থান তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আর্থিক বাজারের প্রশ্ন - ব্রিটিশ সরকার তার ঋণগুলিকে কিভাবে পরিশোধ করবে? ট্রাস তার অর্থমন্ত্রী কোয়ার্টেংকে পদচ্যুত করে জেরেমি হান্টকে তার স্থলাভিষিক্ত করলে হান্ট নীতিকে উল্টে দেন। এরপর এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ট্রাস ক্ষমাও প্রার্থনা করেন। এছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান পদত্যাগ করার পরে ট্রাস তার সমালোচক গ্র্যান্ট শ্যাপসকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেন; যা প্রমাণ করে যে, ট্রাসের কর্তৃত্ব পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে।

লন্ডনের ‘কুইন ম্যারি ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর টিম বেইল ‘এনপিআর’কে বলছেন যে, ট্রাস এবং তার আগের বরিস জনসনের ব্যর্থতার মূলে রয়েছে তাদের অবাস্তব প্রতিশ্রুতি। জনসন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলন যে, তিনি অর্থনৈতিক দুর্দশা ছাড়াই ব্রেক্সিটের বাস্তবায়ন করবেন। অপরদিকে ট্রাস বাজেটের অর্থায়ন নিশ্চিত না করেই কর কর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। লন্ডনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চেঞ্জিং ইউরোপ’এর ডিরেক্টর আনান্দ মেনন ‘এনবিসি’কে বলছেন যে, কনজারভেটিভ পার্টি এবং বাস্তবতা পরস্পরের বন্ধু নয়।

‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস’এর প্রফেসর প্যাট্রিক ডানলীভি ‘এনপিআর’কে বলছেন যে, ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থারও সমস্যা রয়েছে। যেমন প্রধানমন্ত্রী কোন জবাবদিহিতা ছাড়াই যে কাউকে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করতে পারেন। যেমন প্রায় অপরিচিত কোয়াসি কোয়ার্টেংকে ট্রাস অর্থমন্ত্রী নিয়োগ দেন। এছাড়াও কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত করেন পার্টির নেতারা, পার্লামেন্ট সদস্যরা নয়। একারণে তাদের নির্বাচিত নেতারা সাধারণতঃ শ্বেতাঙ্গ, বয়সে প্রবীণ এবং সাধারণের চাইতে বেশি রক্ষণশীল হয়।

২০১৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যামেরন কনজারভেটিভ পার্টির মাঝে দ্বন্দ্ব নিরসনে ইইউ থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে গণভোটের আয়োজন করেন। এর ফলে পুরো রাষ্ট্রে মেরুকরণ শুরু হয়ে যায়। তখন অনেকেই বলেছিলেন যে, ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যায় পড়বে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রেক্সিটের ব্যাপারে যথেষ্ট সোচ্চার থাকলেও এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কনজারভেটিভ পার্টির প্রকৃতপক্ষে ব্রেক্সিটের ব্যাপারে কোন পরিকল্পনাই ছিল না। কয়েক দশক ধরে বাণিজ্যের জন্যে ইউরোপের উপর ব্রিটেনের নির্ভরশীলতা একদিনে মুছে ফেলা সম্ভব ছিল না।

ক্যামেরনের পদত্যাগের পর থেরেসা মে আগাম নির্বাচন ডাকেন, যার মাধ্যমে তার দল পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ হারায়। পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ পার্টির কট্টরপন্থী সদস্যদের প্রতিরোধে ব্রেক্সিটের সুরাহা করতে না পেরে থেরেসা মে পদত্যাগ করেন। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২০১৯ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টিকে বড় বিজয় এনে দেন এবং প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ব্রেক্সিট সম্পন্ন করেন। কিন্তু করোনাভাইরাস বাধা হয়ে দাঁড়ায় জনসনের সামনে। তার সরকারের বিরুদ্ধে মহামারি নিয়ন্ত্রণে ভুল নীতি প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। ‘এনপিআর’ বলছে যে, জনসনকে ডুবিয়ে দেয় তার মিথ্যা কথার ঝুড়ি। গোটা ব্রিটেনের মানুষকে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে গণজমায়েত এড়িয়ে চলতে বলা হলেও জনসন তার লোকজন নিয়ে একাধিক পার্টির আয়োজন করেছিলেন।

ব্রিটেনের রাজনৈতিক কলহ তাদের প্রধান আন্তর্জাতিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের উপরেও প্রভাব ফেলতে পারে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এই ঘটনাগুলি ব্রিটেনের জন্যে যেমন লজ্জাজনক, গণতন্ত্রের জন্যেও তেমনি। ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেশটাকে তার আন্তর্জাতিক বন্ধুদের কাছে অগুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে। তারা কেউ কেউ বলছেন যে, সামনের দিনগুলিতে ব্রিটেনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান হতে পারে; যা ব্রিটেনের মাঝে বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি তুলতে পারে।

২৮শে অক্টোবর কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। পার্টির নেতারাই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করবে; জনগণের ভোট নয়। এর আগে থেরেসা মেএর মতো লিজ ট্রাসকেও নির্বাচন জিতে প্রধানমন্ত্রী হতে হয়নি। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২৫ সালের জানুয়ারির আগে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন ডাকতে বাধ্য নন। তবে বিরোধী দলগুলি এর আগেই নির্বাচন চাইছে। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক এগিয়ে রয়েছেন। তার পিছনে রয়েছেন আরেক মন্ত্রী পেনি মরডন্ট। তবে আটজন কনজারভেটিভ এমপি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যে, তারা বরিস জনসনকেই আবার প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান; যদিও দলের অনেকেই এর বিপক্ষে।

ব্রিটেনের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। পশ্চিমা আদর্শকে ফেরি করা ব্রিটেনের রাজনৈতিক কলহ নিয়ে যখন বিশ্বব্যাপী সমালোচনা হচ্ছে, তখন কনসালট্যান্সি কোম্পানি ‘এরগো’র বিশ্লেষক এড প্রাইস ‘ব্লুমবার্গ’কে বলছেন যে, ব্রিটেনের গণতন্ত্র কাজ করছে বলেই অযোগ্য লোকটা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, লিজ ট্রাসের ক্ষমতাচ্যুত হবার পিছনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বাজার অর্থনীতি। অপরদিকে ‘ব্লুমবার্গ’এর কলামিস্ট জন অথার্স মনে করছেন যে, ব্রিটেনের রাজনৈতিক সংকটের কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হবে। আর সরকারকেও নতুন করে তৈরি করা সমস্যা নিরসণে আরও ঋণ করতে হবে। ‘এনপিআর’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের রাজনৈতিক সংকট যথেষ্ট গভীর; যার কারণগুলির মাঝে রয়েছে রাজনৈতিক মেরুকরণ, জনপ্রিয়তা-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, সমস্যাবহুল রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। এই সমস্যাগুলির কারণে অনেকেই দলীয় এবং ব্যক্তিস্বার্থকে রাষ্ট্রের আগে স্থান দিচ্ছে।

Tuesday 18 October 2022

সৌদিরা কি আসলেই যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীলতা কমাচ্ছে?

১৮ই অক্টোবর ২০২২
 
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মার্কিন অর্থনীতির উপরে অগাধ বিশ্বাসের কারণেই তারা যুক্তরাষ্ট্রে ৮’শ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে; যার বেশিরভাগই দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ। সৌদিরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরে যেতে চায় না; বরং মার্কিন নীতির কারণেই দুই দেশের মাঝে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের জন্ম হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলির জোট ‘ওপেক’ এবং রাশিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ‘ওপেক প্লাস’এর তেলের উৎপাদন কর্তন করার সিদ্ধান্ত এবং এর প্রত্যুত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সৌদিদের প্রতি কঠোর বার্তা অনেক আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। কেউ কেউ প্রশ্ন করা শুরু করেছেন যে, ওয়াশিংটনের সাথে সৌদি রাজ পরিবারের সম্পর্ক শেষ হতে যাচ্ছে কিনা। তবে অনেকেই এখানে যুক্তরাষ্ট্রের উপর সৌদিদের নির্ভরশীলতার শক্ত ভিত্তির দিকে নির্দেশ করছেন।

গত মার্চে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, তারা চীনের সাথে তেলের বাণিজ্য চীনা মুদ্রা ইউয়ানে করার জন্যে চিন্তাভাবনা করছে। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সৌদিরা গত ছয় বছর ধরে চীনের সাথে এব্যাপারে কথা বললেও হঠাৎ করেই তারা ইউয়ানে বাণিজ্য করার জন্যে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। প্যারিসভিত্তিক আর্থিক বাজারের কোম্পানি ‘জেনেরালি গ্রুপ’এর জ্যেষ্ঠ কৌসুলী গুইলাউমে ত্রেসকা ‘ব্লুমবার্গ’কে বলছেন যে, এই ঘটনাগুলি ঘটে যখনই ভূরাজনীতিতে কোন পরিবর্তন আসতে থাকে। সৌদিরা শুধু ওয়াশিংটনের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছে যে, তারা মার্কিনীদের কাছ থেকে আরও কিছু আশা করছে। ‘ব্লুমবার্গ’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিনীদের সাথে সৌদিদের সম্পর্কে টান পড়া শুরু হয়েছে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর থেকে। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যা এবং ইয়েমেনের যুদ্ধের ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসন সৌদিদের সমালোচনায় মুখর থাকার ফলে হোয়াইট হাউজের সাথে সম্পর্কের অবণতি ঘটে। এছাড়াও ইরানের সাথে বাইডেন প্রশাসনের পারমাণবিক চুক্তির আলোচনাকে এগিয়ে নেয়াকেও সৌদিরা ভালো চোখে দেখেনি। তবে সৌদিরা যখন চীনের সাথে বাণিজ্যে ইউয়ান ব্যবহার করার কথা বলছে, তখন সৌদিরা যে সত্যি কথা বলছে না, তার প্রমাণ রয়েছে। প্রথমতঃ সৌদি রিয়ালের মূল্য মার্কিন ডলারের সাথে সমন্বয় করা রয়েছে। এখন যদি ডলারের মূল্য পড়ে যায়, তাহলে সৌদি রিয়ালের মূল্যও পড়ে যাবে। সৌদিরা এত বড় একটা সুবিধা থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নিতে চাইবে না। এছাড়াও সৌদিরা তাদের আর্থিক নীতিকেও মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডারেল রিজার্ভ’এর সাথে সমন্বয় করে চলে।

গত জুনে দুবাই ভিত্তিক পত্রিকা ‘দ্যা ন্যাশনাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সৌদি আরবের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২ সালের শেষে ৫’শ ৮১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে; যা গত এপ্রিল মাসে ছিল প্রায় ৪’শ ৫২ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যের ব্যাপক বৃদ্ধির উপর চড়ে সৌদিরা এই রিজার্ভ তৈরি করার পথে রয়েছে। আর্থিক ব্যবসায়িক কোম্পানি ‘জাদওয়া ইনভেস্টমেন্ট’এর প্রধান অর্থনীতিবিদ আসাদ খান এক লেখায় বলছেন যে, গত এপ্রিল মাস থেকে সৌদিদের রিজার্ভ প্রতিমাসে ৩’শ মিলিয়ন ডলার করে বেড়েছে। মার্চ মাসে এক কোটি ব্যারেল তেল উৎপাদনের ফলস্বরূপ তারা সেই মাসে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার আয় করে। কিন্তু সৌদিদের এই আয় কোথায় যাচ্ছে?

গত মার্চে ‘রয়টার্স’এর এক খবরে বলা হয় যে, সৌদি আরবের বাস্তবিক শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি সরকারি বার্তা সংস্থা ‘এসপিএ’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে সৌদিদের যা বিনিয়োগ রয়েছে, তা তারা বাড়াতে যেমন পারে, কমাতেও পারে। ‘এসপিএ’ বলে যে, যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি আরবের মোট বিনিয়োগ ৮’শ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। চীনের সাথে ইউয়ানে ব্যবসা করার মতো এই হুমকিটাও শুধু মৌখিক বলেই মনে করছেন অনেকে। কারণ এই কথাগুলির পর থেকে সৌদিরা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বিনিয়োগ আরও বাড়িয়েছে। এবং এই বিনিয়োগগুলির বেশিরভাগই দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সৌদিরা যুক্তরাষ্ট্রের উপরে এতটাই নির্ভর করছে যে, তাদের রিজার্ভের প্রায় পুরোটাই তারা রেখেছে মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ সৌদিরা তাদের নিজেদের ভাগ্যকে মার্কিন ডলারের উপরে নির্ভরশীল করেছে।

‘দ্যা ন্যাশনাল’এর অগাস্ট মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সৌদি সরকারের ‘পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড’ বা ‘পিআইএফ’এর যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে। মার্কিন সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সৌদিরা ১৭টা মার্কিন কোম্পানির স্টকে প্রায় ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে চাইছে। নতুন বিনিয়োগ যাচ্ছে ‘গুগল’, ‘মাইক্রোসফট’, ‘জে পি মরগ্যান চেইজ’, ‘স্টারবাকস’, ‘ব্ল্যাকরক’, ‘কস্টকো’, ‘আমাজন’, ‘হোম ডিপো’, ‘বুকিং হোল্ডিংস’, ইত্যাদি কোম্পানিতে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২১এর ডিসেম্বর নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের স্টক এক্সচেঞ্জে মার্কিন কোম্পানিগুলিতে সৌদিদের বিনিয়োগ দাঁড়ায় প্রায় ৫৬ বিলিয়ন ডলারে। গত অগাস্টে মার্কিন রাজস্ব দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, জুন মাসে সৌদি আরবের হাতে মার্কিন সরকারের ট্রেজারি বন্ডের পরিমাণ ১’শ ১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে; যা মে মাসে ছিল ১’শ ১৪ বিলিয়ন ডলার। এর মাঝে সিংহভাগই হলো দীর্ঘমেয়াদী বন্ড।

সৌদিরা যুক্তরাষ্ট্রের উপরে এতটাই নির্ভর করছে যে, তাদের রিজার্ভের প্রায় পুরোটাই তারা রেখেছে মার্কিন ডলারে। ‘সিইআইসি ডাটা’র হিসেবে গত দশ বছর ধরেই সৌদিদের স্বর্ণের রিজার্ভ প্রায় একই জায়গায় রয়েছে; যা প্রায় ৪’শ ৩৩ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। এটা সাইপ্রাস বা বাংলাদেশের স্বর্ণের রিজার্ভের চাইতেও অনেক কম। সংখ্যাটা তাদের গত এপ্রিল মাসের সাড়ে ৪’শ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ১ হাজার ভাগের ১ ভাগেরও কম।

শুধু তা-ই নয়, সৌদি সরকারের এই রিজার্ভ মূলতঃ সৌদি রাজপরিবারের মাঝে ভাগাভাগি করার কারণেই ওঠানামা করে থাকে। ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সৌদি আরবের তেল উৎপাদন কোম্পানি ‘সৌদি আরামকো’র শেয়ারহোল্ডার সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের মাঝে যখন লভ্যাংশ বন্টন করা হয়, তখনই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ওঠানামা করে। যেমন ২০২১ সালে শুধুমাত্র ত্রৈমাসিক লভ্যাংশই ছিল প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার!

অর্থনৈতিকভাবে সৌদিরা তাদের তেলের ব্যবসার আয়ের প্রায় পুরোটাই মার্কিন ডলারে মজুত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ সৌদিরা তাদের নিজেদের ভাগ্যকে মার্কিন ডলারের উপরে নির্ভরশীল করেছে। মার্কিন অর্থনীতির উপরে অগাধ বিশ্বাসের কারণেই তারা যুক্তরাষ্ট্রে ৮’শ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে; যার বেশিরভাগই দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ। সৌদি রিয়ালের মূল্যকে ডলারের মূল্যের সাথে সমন্বয় করা হয় এবং সৌদি আর্থিক নীতি মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিকে অনুসরণ করে করা হয়। এতটা নির্ভরশীলতার মাঝে সৌদিদের ওয়াশিংটন থেকে দূরে চলে যাবার প্রশ্নটা অবান্তরই বটে। সৌদিরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরে যেতে চায় না; বরং মার্কিন নীতির কারণেই দুই দেশের মাঝে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের জন্ম হয়েছে।

Monday 17 October 2022

ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে রাশিয়া কি ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহের ঘাটতিতে রয়েছে?

১৭ই অক্টোবর ২০২২
 
১৫ই অক্টোবর ২০২২। ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপোল শহর থেকে উৎক্ষেপিত সুপারসনিক জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র 'পি-৮০০ ওনিক্স'। রুশদের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ফ্রন্টলাইনের উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। একদিকে এই হামলা যেমন রুশদের ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত নিয়ে প্রশ্নকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে, তেমনি পশ্চিমাদেরকে ‘আইরিস-টি’ এবং ‘ন্যাস্যাম’এর মতো অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি ইউক্রেনকে সরবরাহ করার ছুতো দিয়েছে। 

গত ৮ই অক্টোবর রুশ নিয়ন্ত্রিত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সাথে রাশিয়ার মূল ভূখন্ডকে যুক্ত করা কার্চ সেতুর উপর হামলার পর থেকে ইউক্রেনের বিভিন্ন বেসামরিক কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্থাপনার উপর রুশদের প্রতিশোধমূলক হামলা শুরু হবার পর থেকে অনেকেই প্রশ্ন করা শুরু করেছেন যে, ক্রেমলিনের হাতে আর কত ভূমিতে নিখুঁতভাবে আঘাত করার মতো ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে এবং রুশরা কতদিন এই হামলা চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তবে এই প্রতিশোধমূলক হামলা শুরু হবার আরও আগ থেকেই পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন। ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’ বলছে যে, রুশ ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট এবং ড্রোনগুলি ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামো ছাড়াও ২০টারও বেশি শহর ও বসতির উপরে হামলা চালিয়েছে। ১৪ই অক্টোবর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাংবাদিকদের বলেন যে, ইউক্রেনের বেসামরিক স্থাপনার উপর হামলার জন্যে তিনি দুঃখিত নন। তবে তিনি ঘোষণা দেন যে, আপাততঃ ইউক্রেনের উপর বড় কোন হামলার প্রয়োজন নেই।

ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের সক্ষমতা

মার্কিন ভূরাজনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নিউ লাইন্স ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক জেফ হওন ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’কে বলছেন যে, রাশিয়া প্রথমবারের মতো এতো বড় আকারের হামলা করছে। রুশরা প্রমাণ করতে চাইছে যে, তারা ইউক্রেন জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে আক্রমণ চালাতে সক্ষম। তবে সমস্যা হলো এর মাধ্যমে রুশদের দু’টা সমস্যা সামনে আসছে। প্রথমতঃ এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি বেশিরভাগ সময়েই টার্গেটে আঘাত করতে পারছে না; আর দ্বিতীয়তঃ এগুলিকে শুধুমাত্র বিশেষ কিছু ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায়। কারণ এগুলি যথেষ্ট বড় সামরিক বিনিয়োগ।

রুশ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, রাশিয়ার ভূমিতে নিখুঁতভাবে আঘাত করার মতো দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহ পুরোদমে চালু আছে; কারখানাগুলিও নতুন ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। রুশরা বলছে যে, রুশদের সরবরাহের ঘাটতির ব্যাপারে পশ্চিমাদের দাবি পুরোপুরি অসত্য। তবে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, রুশরা কতগুলি ক্ষেপাণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে বা কতগুলি অবশিষ্ট রয়েছে, সেব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য দেয়নি। এছাড়াও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও কিছুদিন আগেই অস্ত্র উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে একটা আলোচনায় নেতৃত্ব দেন; যা রুশ টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। সেখানেও পুতিনের নির্দিষ্ট করে বলা কোন বক্তব্য দেখানো হয়নি।

ফরাসি প্রেসিডেন্টের প্রাক্তন চিফ অব স্টাফ জেনারেল ক্রিশ্চিয়ান কুয়েজনো ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’কে বলছেন যে, রুশ প্রতিরক্ষা শিল্পের সক্ষমতা রয়েছে বছরে ১’শ থেকে ২’শ ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন করার। ব্যবহার করে ফেলা ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে প্রতিস্থাপন করাটাই চ্যালেঞ্জ। কারণ রুশদের কাছে স্টিল এবং বিস্ফোরক রয়েছে। কিন্তু গাইড্যান্সের জন্যে ইলেকট্রনিক সিস্টেমগুলির সরবরাহ কম রয়েছে রাশিয়ার কাছে। অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে রুশরা ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারছে না। এর ফলে রুশরা তাদের অস্ত্র রপ্তানি কমানো বা স্থগিত করা ছাড়াও ইরান ও উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে সামরিক সরবরাহ নিচ্ছে।

‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’ পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্সের সূত্র ব্যবহার করে বলছে যে, গত ১৮ই সেপ্টেম্বর ইরানের কর্মকর্তারা রাশিয়ার কাছে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করার জন্যে চুক্তি ফাইনাল করে এসেছেন। পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন যে, ইরান রাশিয়ার কাছে ৩’শ কিঃমিঃ পাল্লার ‘ফাতেহ-১১০’ এবং ৭’শ কিঃমিঃ পাল্লার ‘জোলফাঘার’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করছে। এর আগের চুক্তি মোতাবেক ইরান ইতোমধ্যেই রাশিয়ার কাছে ‘মোহাজের-৬’ এবং ‘শাহেদ-১৩৬’ ড্রোন বিক্রি করছে।
 
রুশ 'তুপোলেভ ২২এম' বোমারু বিমানের নিচে তিনটা 'কেএইচ-২২' জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। খোলা সমুদ্রে একটা জাহাজকে টার্গেট করার জন্যে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি রাডার ব্যবহার করে। কিন্তু ভূমির কোন টার্গেটে আঘাত করতে গেলে এই রাডার দিয়ে বোঝা সম্ভব নয় যে কোন বিল্ডিংটা মূল টার্গেট। তাই ভূমির টার্গেটে এগুলির নিখুঁতভাবে আঘাত করার সক্ষমতা খুবই কম। তবে সোভিয়েত আমল থেকে এগুলির মজুত বিপুল। পুরোনো এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবার আগেই রুশরা হয়তো এগুলি ব্যবহার করে ফেলতে চাইছে।

ক্ষেপণাস্ত্রের প্রকার

১০ই অক্টোবর ইউক্রেনের উপর শুরু হওয়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় রুশরা সকল ধরণের ক্ষেপণাস্ত্রই ব্যবহার করেছে। এর মাঝে রয়েছে কৌশলগত বোমারু বিমান থেকে ছোঁড়া ‘কেএইচ-৫৫’ ও ‘কেএইচ-১০১’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র; সমুদ্রে জাহাজ ও সাবমেরিন থেকে ছোঁড়া ‘ক্যালিবর’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র; এবং ভূমি থেকে ছোঁড়া ‘ইসকান্দার’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এছাড়াও রুশরা দূরপাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ‘এস-৩০০’ও ব্যবহার করেছে ভূমির টার্গেটের বিরুদ্ধে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, গত জুন মাসে তারা ইউক্রেনের ক্রিমেনচাক শপিং সেন্টারে হামলার তদন্ত করে দেখেছে যে, রুশরা ‘কেএইচ-২২’ অথবা এর উন্নততর ভার্সনের ‘কেএইচ-৩২’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এগুলি পুরোনো ক্ষেপণাস্ত্র; যেগুলি তৈরি করা হয়েছিল জাহাজ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে।

ভূমি থেকে ভূমির টার্গেটে আঘাত হানার জন্যে রুশদের ডেভেলপ করা ‘ইসকান্দার’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা প্রায় ৪’শ থেকে ৫’শ কিঃমিঃ এবং এগুলি প্রায় ৪’শ ৮০ কেজি থেকে ৭’শ কেজি পর্যন্ত ওয়ারহেড বহণে সক্ষম। ‘সিএসআইএস’ বলছে যে, প্রায় ৩ দশমিক ৮ টন ওজনের এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি টার্গেটের ৬ থেকে ১৬ ফুটের মাঝে আঘাত হানতে পারে। ১৪ই অক্টোবর ব্রিটেনের ‘দ্যা সান’ পত্রিকা রুশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রকাশ করা এক ভিডিও প্রচার করে; যেখানে দেখানো হয় যে, ‘ইসকান্দার’ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হচ্ছে ইউক্রেনকে লক্ষ্য করে। এর আগে ইউক্রেনের ‘প্রাভদা’ বার্তাসংস্থা বলে যে, রুশরা বেলারুশের ভূমি ব্যবহার করে ‘ইসকান্দার’ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করছে। অপরপক্ষে রুশ নৌবাহিনীর ভূমিতে আঘাত হানার ক্ষেপণাস্ত্র হলো ‘৩এম-১৪ ক্যালিবর’। প্রায় সাড়ে ৪’শ কেজি ওয়ারহেড নিয়ে এগুলি ১৫’শ থেকে ২৫’শ কিঃমিঃ দূরে ভূমির লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। সিরিয়াতে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ইসকান্দার’ এবং ‘ক্যালিবর’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ভূমির টার্গেটের জন্যে ডেভেলপ করা হলেও ইউক্রেন যুদ্ধে অনেক ক্ষেপণাস্ত্রই ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলি ভূমির টার্গেটের জন্যে ডিজাইন করা হয়নি।

১৫ই অক্টোবর ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপোল শহর থেকে ধারণকৃত এক ভিডিও সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায় যে, ভূমি থেকে একটা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হচ্ছে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য এবং ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক এইচ আই সাটন বলেন যে, ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণের ধরণ এবং এর পাশের গাড়ির অবস্থান থেকে ধারণা করা যায় যে, এটা খুব সম্ভবতঃ ‘পি-৮০০ ওনিক্স’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র; যা কিনা ‘ব্যাসচন-পি’ ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চিং সিস্টেম থেকে উৎক্ষেপিত হয়েছে। এটা রুশদের সর্বোৎকৃষ্ট সুপারসনিক জাহাজধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যা এখন ভূমির টার্গেটেও আঘাত হানছে। ৩’শ কেজি ওজনের ওয়ারহেড বহণে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা সাড়ে ৪’শ কিঃমিঃএর বেশি এবং এর দ্রুতি শব্দের গতির দুই গুণেরও বেশি। প্রায় ৩ টন ওজনের এই ক্ষেপণাস্ত্র টার্গেটের পাঁচ ফুটের মাঝে আঘাত হানতে সক্ষম। জাহাজ এবং সাবমেরিন থেকে ছোঁড়ার জন্যে তৈরি করা হলেও ২০১৫ সালে এই ক্ষেপণাস্ত্র ভূমি থেকে ‘ব্যাসচন-পি’ লঞ্চিং সিস্টেম থেকে ছোঁড়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে জাহাজের বিরুদ্ধে এই ক্ষেপণাস্ত্র যতটা মারাত্মক, ভূমির টার্গেটের বিরুদ্ধে তা ততটা না-ও হতে পারে। কারণ এগুলির টার্গেটিং সিস্টেম জাহাজ ধ্বংসের জন্যেই ডিজাইন করা; ভূমির টার্গেটের জন্যে নয়।

‘দ্যা ড্রাইভ’ ম্যাগাজিনের প্রতিরক্ষা বিষয়ক সেকশন ‘দ্যা ওয়ারজোন’এর এক লেখায় আকাশ প্রতিরক্ষা বিষয়ের লেখক পিয়টর বুটাউস্কি রুশ দূরপাল্লার বোমারু বিমানের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। রুশ ‘তুপোলেভ-২২এম৩’, ‘তুপোলেভ-৯৫এমএস’ এবং ‘তুপোলেভ-১৬০’ বিমানগুলি ইউক্রেনের পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের সামরিক উৎপাদন ও মেরমত কারখানা, কৌশলগত জ্বালানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক, বিমান ঘাঁটি, রেলওয়ে স্থাপনা, ইত্যাদির উপরে হামলা করে আসছে। পশ্চিমা সামরিক সরঞ্জাম পৌঁছাবার রুটের উপরে এগুলি হামলা করলেও ইউক্রেনের রণাঙ্গনে পশ্চিমাদের অস্ত্রের বিপুল সমারোহ দেখে এই বিমান আক্রমণের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ‘কেএইচ-১০১’ হলো এই বিমানগুলির বহণকৃত ক্ষেপণাস্ত্রের মাঝে সর্বোত্তম। অতি দামী এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সাম্প্রতিক সময়ে কম ব্যবহৃত হচ্ছে। বুটাউস্কির ধারণা রুশদের হাতে খুব বেশি হলে ১’শর মতো ‘কেএইচ-১০১’ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। আর এর উৎপাদন মাসে ৩ থেকে ৪টার বেশি নয়। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সিএসআইএস’ বলছে যে, প্রায় সাড়ে ৪’শ কেজি ওয়ারহেডের এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি প্রায় ২৮’শ কিঃমিঃ দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। অনেক নিচু দিয়ে ওড়ার ফলে এবং স্টেলথ ডিজাইনের কারণে এগুলি সহজে রাডারে ধরা পড়েনা। প্রায় ২ দশমিক ৪ টন ওজনের এই ক্ষেপণাস্ত্রে স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন ব্যবহার করার কারণে এগুলির নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত হানার সক্ষমতা যথেষ্ট। সিরিয়াতে রাশিয়া এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিল।

 
রুশ 'তুপোলেভ-৯৫' বোমারু বিমানের ডানার নিচে মোট আটটা 'কেএইচ-১০১' ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দেখা যাচ্ছে। এটা হলো রুশ বিমানগুলির বহণকৃত ক্ষেপণাস্ত্রের মাঝে সর্বোত্তম। রায় ২ দশমিক ৪ টন ওজনের এই ক্ষেপণাস্ত্রে স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন ব্যবহার করার কারণে এগুলির নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত হানার সক্ষমতা যথেষ্ট। অতি দামী এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সাম্প্রতিক সময়ে কম ব্যবহৃত হচ্ছে।

সোভিয়েত আমলে তৈরি করা পারমাণবিক ওয়ারহেড বহণের জন্যে তৈরি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে প্রচলিত অস্ত্র বহণের জন্যে পরিবর্তন করে ‘কেএইচ-৫৫৫’ হিসেবে সার্ভিসে আনা হয়। ‘সিএসআইএস’ বলছে যে, মার্কিন ‘টোমাহক’ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো দেখতে ‘কেএইচ-৫৫’ ক্ষেপণাস্ত্রের ওজন প্রায় ১২’শ কেজি এবং এগুলি প্রায় ৪’শ কেজি ওয়ারহেড বহণ করতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিঃমিঃ। ২০০৬ সালে ধারণা করা হতো যে, রাশিয়ার হাতে ৮’শ ৭২টা ‘কেএইচ-৫৫’ ক্ষেপণাস্ত্র ছিল।

এছাড়াও রয়েছে ‘তুপোলেভ-২২এম৩’ বিমান থেকে ছোঁড়া প্রায় ৬ টন ওজনের দৈত্যাকৃতির সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘কেএইচ-২২’। সোভিয়েত আমলে তৈরি প্রায় সাড়ে ৩’শ কিঃমিঃ পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রের গতি শব্দের ৩ থেকে ৪ গুণ। এর উন্নততর ভার্সনের ‘কেএইচ-৩২’এর পাল্লা অবশ্য এর প্রায় দ্বিগুণ। ইউক্রেনিয়রা বলছে যে, গত জুন মাসেই রুশরা এহেন প্রায় ২’শ ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। তবে এর আগের তিন মাসে ছুঁড়েছে মাত্র কয়েক ডজন। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ডেভেলপ করা হয়েছিল মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলিকে টার্গেট করার জন্যে। খোলা সমুদ্রে একটা জাহাজকে টার্গেট করার জন্যে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি রাডার ব্যবহার করে। কিন্তু ভূমির কোন টার্গেটে আঘাত করতে গেলে এই রাডার দিয়ে বোঝা সম্ভব নয় যে কোন বিল্ডিংটা মূল টার্গেট। তাই ভূমির টার্গেটে এগুলির নিখুঁতভাবে আঘাত করার সক্ষমতা খুবই কম। তবে সোভিয়েত আমল থেকে এগুলির মজুত বিপুল। পুরোনো এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবার আগেই রুশরা হয়তো এগুলি ব্যবহার করে ফেলতে চাইছে। তবে উন্নততর ‘কেএইচ-৩২’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি রুশরা খুব কমই ব্যবহার করছে। যুদ্ধের আগে রুশদের হাতে খুব বেশি হলে ১’শ থেকে দেড়’শ ‘কেএইচ-৩২’ ক্ষেপণাস্ত্র ছিল।

এছাড়াও গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে রুশ বিমান বাহিনীর ‘মিগ-৩১’ ফাইটার বিমান থেকে ‘৯এস-৭৭৬০ কিনজাল’ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নামে পরিচিত এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি শব্দের ৫ গুণেরও বেশি গতিতে উড়ে ইউক্রেনের অস্ত্রের ভান্ডার, জ্বালানির মজুত এবং কমান্ড সেন্টারে আঘাত হানে। তবে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার আর শোনা যায়নি। ইউক্রেনের ইন্টেলিজেন্সের হিসেবে যুদ্ধের আগে রুশদের হাতে খুব বেশি হলে ৩৫ থেকে ৪০টা ‘কিনজাল’ ক্ষেপণাস্ত্র ছিল। ‘কেএইচ-২২’ বা ‘কিনজাল’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলির গতি ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে হারানোর জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু যেহেতু ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলার মতো তেমন কিছু নয়, তাই এই গতি খুব বেশি যে কাজে লাগছে তা-ও নয়।

ক্ষেপণাস্ত্রের স্বল্পতা ও খরচ

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ বা ‘সিএসআইএস’এর ফেলো ইয়ান উইলিয়ামস ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলছেন যে, ভূমির টার্গেটের বিরুদ্ধে বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার দেখিয়ে দেয় যে, রুশরা ভূমিতে নিখুঁতভাবে আঘাত করার মতো ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহ সমস্যার মাঝে রয়েছে। ‘এস-৩০০’এর মতো বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র যখন ভূমির টার্গেটের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে, তখন একটা বিল্ডিংএর উপরেও সঠিকভাবে আঘাত করার সক্ষমতা এই ক্ষেপণাস্ত্রের থাকবে না। এছাড়াও শত্রুপক্ষের শক্তিশালী অবস্থানগুলি ধ্বংস করার মতো যথেষ্ট শক্তি একটা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের থাকে না।এগুলি এভাবে ব্যবহার করা হলো বাতাসে ছুঁড়ে দিয়ে আশায় বুক বাঁধার মতো। খুব সম্ভবতঃ রুশরা ক্ষেপণাস্ত্রের পুরোনো ভার্সনগুলিকে ব্যবহার করে ফেলতে চাইছে; যাতে করে তাদের অপেক্ষাকৃত আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ টার্গেটের জন্যে জমিয়ে রাখা যায়।
 
রুশ 'ইসকান্দার' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। ‘ইসকান্দার’ এবং ‘ক্যালিবর’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ভূমির টার্গেটের জন্যে ডেভেলপ করা হলেও ইউক্রেন যুদ্ধে অনেক ক্ষেপণাস্ত্রই ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলি ভূমির টার্গেটের জন্যে ডিজাইন করা হয়নি।

ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মূল্য যথেষ্ট। ‘ইউক্রেনিয়ান ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় ইউক্রেনিয় বিশ্লেষক ভলদিমির লান্ডা এবং কন্সটানটিন জিনেনি রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের মূল্যের একটা ধারণা দিয়েছেন। একেকটা ‘কেএইচ-১০১’ ক্ষেপণাস্ত্রের মূল্য প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার; একটা ‘ক্যালিবর’ ক্ষেপণাস্ত্র হলো প্রায় সাড়ে ৬ মিলিয়ন; ‘ইসকান্দার’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মূল্য প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার; ‘পি-৮০০ ওনিক্স’এর মূল্য ১ দশমিক ২৫ মিলিয়ন; ‘কেএইচ-২২’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রায় ১ মিলিয়ন; আর ‘টচকা-ইউ’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মূল্য প্রায় দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার। ‘বিবিসি’র এক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ১০ই অক্টোবর একদিনে রুশরা কমপক্ষে ৮৩টা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইউক্রেনিয়রা বলছে যে, একইদিনে মিকোলায়েভ শহরে ৪৭টা, কিয়েভে ৬০টা, লেভিভে ১৫টা, খারকিভে ২০টা, এবং ওডেসাতে ১৫টা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ‘ইউক্রেনিয়ান ফোর্বস’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, এই এক দিনেই রুশরা প্রায় ৪’শ থেকে ৭’শ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে।

পিয়টর বুটাউস্কি বলছেন যে, রুশদের হাতে বহু বিমান ও পাইলট থাকলেও এগুলি থেকে ছোঁড়ার মতো ক্ষেপণাস্ত্র দিন দিনই কমছে। আর এগুলির উৎপাদন সক্ষমতাও যথেষ্টই সীমিত। ইউক্রেনিয়রা এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলির ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণা করছে। ‘কেএইচ-১০১’ ক্ষেপণাস্ত্রের মাঝে পাওয়া গিয়েছে ‘এসএন-৯৯’ স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন রিসিভার; যা রুশরা আমদানি করে। তবে এরকম অনেক যন্ত্রাংশই খুব উচ্চ প্রযুক্তির নয়। এবং এগুলি বেসামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় বলে রুশরা বিভিন্নভাবে এগুলি পেয়ে যেতে পারে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, কয়েক মাসের মাঝে ব্যবহার করে ফেলা শতশত ক্ষেপণাস্ত্র রুশরা হঠাৎ করেই প্রতিস্থাপন করে ফেলতে পারবে। তৈরি করতে পারা এক জিনিস; আর প্রয়োজনমতো সরবরাহ দিতে পারা আরেক জিনিস।

ইউক্রেনের উপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলাফল

তবে রুশরা বলছে যে, ইউক্রেনের বেসামরিক জনগণের উপর হামলার জন্যে ইউক্রেনই দায়ী। রুশ পার্লামেন্টের কর্মকর্তা এভগেনি পোপভ ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার জন্যে ইউক্রেনের ছোঁড়া বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলির অংশাবশেষ ভূমিতে পড়ে গিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক সিদ্ধার্থ কৌশল ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়েই ‘এস-৩০০’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে। উভয়ের ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেডই একইরকমের ধ্বংসাবশেষ তৈরি করে। কাজেই এব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে ইয়ান উইলিয়ামস মনে করছেন যে, এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ইউক্রেনের হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ ইউক্রেনের শহরগুলিকে রক্ষা করার জন্যে ‘এস-৩০০’ শহরের ভিতরে নয়, বরং শহরের বাইরে থাকার কথা। কাজেই শহরের মাঝখানে ইউক্রেনের ‘এস-৩০০’ ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যাবার সম্ভাবনাও কম।

ইউক্রেনজুড়ে রুশদের হামলার ছুতোয় পশ্চিমারা ইউক্রেনকে এমন কিছু অস্ত্র দেয়া শুরু করেছে, যা তারা এতদিন আটকে রেখেছিল। ১১ই অক্টোবর ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ এক টুইটার বার্তায় ঘোষণা দেন যে, জার্মান বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আইরিস-টি’ ইতোমধ্যেই ইউক্রেনে পৌঁছেছে। আর মার্কিন ‘ন্যাস্যাম’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা আসছে খুব শিগগিরই। ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ন্যাটোর প্রাক্তন উপ-প্রধান জেনারেল মাইকেল ইয়াকোভলেফ বলছেন যে, যখন ফ্রন্টলাইনের রুশ সেনারা সোশাল মিডিয়াতে অভিযোগ করে পোস্ট দিচ্ছে যে, তারা যথেষ্ট পরিমাণে গোলাবারুদের সরবরাহ পাচ্ছে না, তখন রুশ হাই কমান্ডের এই ‘ফায়ারওয়ার্কস’এর কোন সামরিক অর্থ নেই।

কার্চ সেতুর উপর হামলা রাশিয়ার জন্যে বড় কোন ক্ষতি ছিল না। ন্যাটোর প্রাক্তন সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে এই সেতুর উপরে হামলা খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। কার্চ সেতুর উপর হামলাকে ক্রেমলিন প্রেসিডেন্ট পুতিন, তথা রাশিয়ার আত্মসন্মানের উপর হামলা হিসেবেই দেখেছে। এর প্রমাণ ছিল পুরো ইউক্রেনজুড়ে বেসামরিক স্থাপনার উপর প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। জেনারেল মাইকেল ইয়াকোভলেফ বলছেন যে, রুশদের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ফ্রন্টলাইনের উপর কোন প্রভাব ফেলবে না। একদিকে এই হামলা যেমন রুশদের ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত নিয়ে প্রশ্নকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে, তেমনি পশ্চিমাদেরকে ‘আইরিস-টি’ এবং ‘ন্যাস্যাম’এর মতো অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি ইউক্রেনকে সরবরাহ করার ছুতো দিয়েছে। এই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলি রুশ বিমানগুলিকে যেমন ইউক্রেনের আকাশে আরও অনিরাপদ করে তুলবে, তেমনি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের সফলতাকে কমিয়ে দেবে। একইসাথে এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইউক্রেনের জনগণকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও ক্ষেপিয়ে তুলতে সহায়তা দেবে। মোটকথা কার্চ সেতুর উপর হামলার প্রতিশোধস্বরূপ রাশিয়া যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সূচনা করেছে, তা ইউক্রেনের যুদ্ধকে আরও দীর্ঘায়িত করবে।

সূত্রঃ
‘Recent missile attack on Ukraine cost Russia approximately EUR 700 mln’ in Baltic News Network, 11 October 2022
‘3M-14 Kalibr (SS-N-30A)’ in CSIS Missile Threat, updated 07 March 2022
‘9K720 Iskander (SS-26)’ in CSIS Missile Threat, updated 02 August 2021
‘Kh-101 / Kh-102’ in CSIS Missile Threat, updated 31 July 2021
‘Kh-47M2 Kinzhal’ in CSIS Missile Threat, updated 19 March 2022
‘Kh-55 (AS-15)’ in CSIS Missile Threat, updated 02 August 2021
‘P-800 Oniks/Yakhont/Bastion (SS-N-26 Strobile)’ in CSIS Missile Threat, updated 12 August 2021
‘Russia resumes Iskander missile attacks on Ukraine from Belarus – Air Force’ in Ukrainska Pravda, 25 June 2022
‘Russia launches nuclear capable Iskander-M missiles at Ukrainian positions’ in The Sun, 14 October 2022 (https://www.youtube.com/watch?v=gnhdQrvfSNs)
‘Likely #Russian Navy P-800 Oniks cruse missile launched from a Bastion-P (SS-C-5 STOOGE) system’ by H I Sutton, 15 October 2022 (https://twitter.com/CovertShores/status/1581248898412482560)
‘Spotted launch’, 15 October 2022 (https://twitter.com/Cyx_5/status/1581257962437283841)
‘Russia’s Secretive Long-Range Bomber Operations Against Ukraine’ by Piotr Butowski, in The Warzone, 14 September 2022 (https://www.thedrive.com/the-war-zone/russias-secretive-long-range-bomber-operations-against-ukraine)
‘Росія за вихідні випустила по Україні ракет вартістю близько $200 млн. Оцінка Forbes, by Володимир Ланда and Костянтин Гненний, 27 September 2022 (https://forbes.ua/inside/rosiya-za-vikhidni-vipustila-po-ukraini-raket-vartistyu-blizko-200-mln-otsinka-forbes-27062022-6838)
‘Putin has ‘no regrets’ over missile barrage in Ukraine, but says no need for more ‘massive’ strikes for now’ in CNN, 14 October 2022
‘Strikes in Ukraine shine a spotlight on dwindling Russian missile stocks’ in Frace24, 13 October 2022
‘War in Ukraine: Is Russia’s stock of weapons running low?’ in BBC, 14 October 2022
‘EXPLAINER: What’s the state of Russia’s missile arsenal?’ in AP News, 13 October 2022
‘Ukraine gets more air defense pledges as Russia hits cities’ in AP News, 14 October 2022
‘Retired general says Russian forces haven't advanced since World War I’ in CNN, 10 October 2022 (https://www.youtube.com/watch?v=n3GMjwwvmR4)
‘Ukraine war: Iran 'plans to send Russia missiles' as supplies dwindle’ in The Middle East Eye, 16 October 2022

Wednesday 12 October 2022

‘ওপেক প্লাস’এর তেলের উৎপাদন কর্তনের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

১২ই অক্টোবর ২০২২
 
বারাক ওবামার প্রশাসনের সময় থেকে ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি করা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তে সৌদি আরব নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। ওয়াশিংটনের স্বার্থকে উপেক্ষা করেই ‘ওপেক প্লাস’এর তেলের উৎপাদন কর্তন এই ভূরাজনৈতিক ধারাবাহিকতারই অংশ। তবে এটা আবারও প্রমাণ করে যে, মার্কিন নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা এখন কতটা দুর্বল হয়ে গেছে।

গত ১১ই অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘সিএনএন’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, রাশিয়ার সাথে আঁতাত করে জ্বালানি তেলের উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে মূল্য বৃদ্ধি করার জন্যে সৌদি আরবকে মূল্য দিতে হবে। সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ককে নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। জ্বালানি বিষয়ক পত্রিকা ‘অয়েল প্রাইস’এর এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ৫ই অক্টোবর জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলির জোট ‘ওপেক’ এবং তার সাথে রাশিয়া মিলে তেলের উৎপাদন দৈনিক ২০ লক্ষ ব্যারেল কমাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২০ সালের মে মাসে করোনা মহামারির লকডাউনের কারণে ৯৭ লক্ষ ব্যারেল উৎপাদন কর্তনের পর থেকে এটা ছিল সর্বোচ্চ কর্তন। বাজারের সকলে ১০ লক্ষ ব্যারেল কমানো আশা করলেও এর দ্বিগুণ কমাবার সিদ্ধান্ত এসেছে। ‘ওপেক’ এবং রাশিয়া মিলে এই জোট ‘ওপেক প্লাস’ নামে পরিচিত। যদিও রাশিয়া এবং ‘ওপেক’ উভয়েই বলছে যে, ‘টেকনিক্যাল’ কারণে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, ওয়াশিংটন মনে করছে যে, এই সিদ্ধান্তটা পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন রাশিয়ার সাথে একাত্মতা প্রকাশের জন্যে সৌদি আরবের সমালোচনা করেছেন এবং তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে অদূরদর্শীতা বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন যে, সৌদিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা কংগ্রেসের সাথে কথা বলছেন।

মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রধান বব মেনেনডেজ ১০ই অক্টোবর এক বিবৃতিতে সৌদি আরবের সাথে সকল সহযোগিতা বন্ধ করা সহ দেশটাতে অস্ত্র বিক্রি বন্ধেরও আহ্বান জানান। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নির্দিষ্ট করে বলতে রাজি হননি যে, তিনি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবেন। বাইডেন বলেন যে, কয়েক মাস আগে তিনি যখন সৌদি আরব ঘুরে এসেছেন, তখন তার সফরের উদ্দেশ্য ছিল না সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বৃদ্ধিতে রাজি করানো। বরং তিনি সেখানে গিয়েছিলেন সকলকে নিশ্চয়তা দেয়ার জন্যে যে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যাচ্ছে না।

৬ই অক্টোবর মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটদের নেতা চাক শুমার বলেন যে, কংগ্রেস সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সকল রকমের আইনী ব্যবস্থা নিয়েই ভাবছে; যার মাঝে ‘নোপেক’ বিলও রয়েছে। ‘নোপেক’ হলো একটা আইনের খসরা, যার মাধ্যমে তেলের বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ‘অপরাধে’ ‘ওপেক’ সদস্য দেশগুলির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এহেন ব্যবস্থা নেয়া হলে সৌদি রাজপরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা তেল কোম্পানি ‘আরামকো’র শেয়ার কেনাবেচা বাতিল হয়ে যেতে পারে। এতে এই কোম্পানির শেয়ারের মূল্য রাতারাতি শূণ্যের কোঠায় চলে আসবে।

সৌদি আরবের নেতৃত্বে ‘ওপেক’ কেন তেলের উৎপাদন কমালো, তার ব্যাখ্য দিয়েছেন সৌদি আরবের জ্বালানি মন্ত্রী প্রিন্স আব্দুলআজিজ বিন সালমান। তিনি ‘সৌদি টিভি’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, তার দেশ সর্বপ্রথমে তার নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করবে। পশ্চিমা দেশগুলির কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি মূদ্রাস্ফীতি রোধে সুদের হার বাড়িয়েই যাচ্ছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী মন্দার সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে জ্বালানির চাহিদা অনেক কমে যাবে এবং তেলের বাজারে ব্যাপক দরপতন হবে।

 
‘ওপেক’ দেশগুলির অর্থনীতি তেল বিক্রির উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। তেলের দরপতন এই দেশগুলির অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সৌদি আরব তাদের সরকারের বাজেট ঠিক করে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৭৯ ডলার হিসেবে। এর নিচে মূল্য পড়ে গেলে বাজেটে ঘাটতি তৈরি হবে। সাত মাস আগে ১’শ ৩৯ ডলারে মূল্য উঠে গেলেও গতমাসেই সেটা ৮৫ ডলারে নেমে গিয়েছিল; যা কিনা ‘ওপেক’ দেশগুলির জন্যে একটা সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করেছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো এলেন ওয়াল্ড ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডারেল রিজার্ভ’এর সুদের হার বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করেই ‘ওপেক’ হয়তো তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে; যাতে চাহিদা পড়ে গেলে হঠাৎ করে উৎপাদন কমাতে না হয়। ‘ওপেক’ দেশগুলির অর্থনীতি তেল বিক্রির উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। তেলের দরপতন এই দেশগুলির অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ‘ওপেক’ দেশগুলি মারাত্মক সমস্যায় পড়েছিল। সৌদি আরব তাদের সরকারের বাজেট ঠিক করে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৭৯ ডলার হিসেবে। এর নিচে মূল্য পড়ে গেলে বাজেটে ঘাটতি তৈরি হবে। সাত মাস আগে ১’শ ৩৯ ডলারে মূল্য উঠে গেলেও গতমাসেই সেটা ৮৫ ডলারে নেমে গিয়েছিল; যা কিনা ‘ওপেক’ দেশগুলির জন্যে একটা সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করেছে।

বাজার বিশ্লেষক সায়মন ওয়াটকিন্স ‘অয়েল প্রাইস’এর এক লেখায় বলছেন যে, মার্কিন অনুরোধ সত্ত্বেও সৌদিরা তেলের উৎপাদন যে কমাবে, সেটা জানাই ছিল। কারণ বেশ অনেকদিন ধরেই রাশিয়ার সাথে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে সৌদিরা তৎপর রয়েছে এবং চীনও এখন সৌদি তেলের সবচাইতে বড় ক্রেতা। তেলের উৎপাদন কমানো হলে এর তিনটা ফলাফল হবে। প্রথমতঃ ব্যাপক মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি সুদের হার বাড়াতে থাকবে। দ্বিতীয়তঃ রাশিয়ার এতে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে; যা তারা ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করবে। এবং তৃতীয়তঃ আসন্ন মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাইডেনের ডেমোক্র্যাট দল খারাপ ফলফল করবে। এতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা কমে যাবে। ঐতিহাসিকভাবেই ব্যারেল প্রতি ১০ ডলার মূল্যবৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যালনপ্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানির মূল্য গ্যালনপ্রতি ১ সেন্ট বৃদ্ধি পাবার অর্থ হলো কনজিউমারদের পকেট থেকে এক বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের খরচ করার সক্ষমতা কমে যাওয়া। আবার ঐতিহাসিকভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই বছরের মাঝে অর্থনীতি যদি মন্দায় পতিত হয়, তাহলে প্রেসিডেন্টের পুনরায় নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। এবছরের প্রথম ছয় মাসে মার্কিন অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে ছোট হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরব বহুকাল ধরেই তেলের মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছে; যা ওয়াশিংটনের স্বার্থকেই রক্ষা করেছে। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য এবং দেশগুলির নেতৃত্বকে নিরাপত্তা দিয়েছে। কিন্তু বারাক ওবামার প্রশাসনের সময় থেকে ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি করা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তে সৌদি আরব নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। বিশেষ করে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের আক্রমণ থেকে সৌদি আরবের তেলের স্থাপনাগুলিকে রক্ষার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করায় সৌদিদের সাথে ওয়াশিংটনের এতকালের সখ্যতায় ভাটা পড়েছে। একই সূত্রে মানবাধিকার বিষয়ে ওয়াশিংটন থেকে সৌদিদের উপরে চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে। ওয়াশিংটনের স্বার্থকে উপেক্ষা করেই ‘ওপেক প্লাস’এর তেলের উৎপাদন কর্তন এই ভূরাজনৈতিক ধারাবাহিকতারই অংশ। তবে এটা আবারও প্রমাণ করে যে, মার্কিন নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা এখন কতটা দুর্বল হয়ে গেছে।

Sunday 9 October 2022

ক্রিমিয়ার কার্চ সেতুর উপর হামলার গুরুত্ব কতখানি?

০৯ই অক্টোবর ২০২২
 
কার্চ সেতুর উপর হামলা যা দিয়েই করা হোক না কেন, এটা ছিল একটা দুঃসাহসিক অপারেশন। আর ইউক্রেনিয়রা এই হামলার ফল কতটা ভোগ করতে পারবে, তা নির্ভর করছে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর দক্ষতার উপর। পশ্চিমা সরঞ্জামের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল হলেও ইউক্রেনের সেনাদেরকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে যে, তারা রুশ সেনাদের চাইতে অধিকতর দক্ষ।

০৮ই অক্টোবর রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে রাশিয়ার মূল ভূখন্ডের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কার্চ সেতুর একাংশ এক হামলায় ধ্বসে পড়ে। সড়কপথের দু’টা লেনের মাঝে একটা লেনের তিনটা স্প্যান দু’জায়গায় পানিতে পড়ে যায়। একইসাথে এই সেতুর সমান্তরালে রেলসেতুর উপর দিয়ে চলা রেলগাড়ির কয়েকটা তেলের ট্যাঙ্কারে আগুন লেগে যায়; যা পরের দিন পর্যন্ত চলে এবং সেতুর বেশ খানিকটা এতে পুড়ে যায়। রুশ কর্তৃপক্ষ বলছে যে, এই ধ্বংসযজ্ঞ খুব সম্ভবতঃ একটা ট্রাক বোমার মাধ্যমে ঘটানো হয়। সকলেই এই আক্রমণের জন্যে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকেই সন্দেহ করলেও ইউক্রেন সরকার এই হামলার জন্যে দায় স্বীকার করেনি। তবে ইউক্রেনের জনগণ এই হামলাকে উৎসব হিসেবে পালন করছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি সোশাল মিডিয়াতে এক ভিডিও বার্তায় ব্যাঙ্গাত্মকভাবে বলেন যে, ইউক্রেনের আকাশে ঝলমলে সূর্য থাকলেও ক্রিমিয়ার আকাশ মেঘে ঢাকা রয়েছে। আর মেঘে ঢাকা থাকলেও ইউক্রেনিয়রা জানে যে, কি করতে হবে। জেলেন্সকি ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ বলে ঘোষণা দেন যে, ভবিষ্যতে ক্রিমিয়া এবং অন্যান্য দখলীকৃত অংশ ইউক্রেনের হাতে ফেরত আসবে। ব্রিটেনের পত্রিকা ‘দ্যা সান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৮ সালে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি করা এই সেতু রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্যে খুবই গর্বের একটা বিষয় ছিল। যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেন সরকার এই সেতুতে হামলার জন্যে হুমকিও দিয়েছে।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় যে, একটা ২২ চাকার ট্রাক লরির কাছাকাছি বিস্ফোরণের শুরু। রুশ কর্তৃপক্ষের প্রকাশ করা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে, এই ট্রাক সেতুর রুশ প্রান্ত থেকে চেকপয়েন্ট অতিক্রম করছে এবং সেখানে সেনারা ট্রাকটা পর্যবেক্ষণ করছে। রুশরা বলছে যে, এই হামলা খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসবিইউ’এর কাজ। রুশ বিশ্লেষক ইউরি পদোলিয়াকা বলছেন যে, ট্রাকটা খুব সম্ভবতঃ রুশ চালকই চালাচ্ছিলেন। তিনি হয়তো জানতেন না যে, তার ট্রাকে কি ছিল। ইউক্রেনিয়রা হয়তো রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থাকতে পারে। তবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ টনি স্পামার ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’কে বলছেন যে, বোমার উৎস ট্রাক নাও হতে পারে। কারণ ট্রাকে বোমা থাকলে রাস্তার উপর গর্ত তৈরি হতো; সেতুর একাংশ পানিতে পড়ে যেতো না। এরকম ধ্বংসযজ্ঞের জন্যে সেতুর পুরো প্রস্থ জুড়ে আঘাত করতে হবে। দেখে মনে হচ্ছে যে, বোমাটা সেতুর নিচ থেকেই ফাটানো হয়েছে। এটা একটা দৈত্যাকৃতির বিস্ফোরণ ছিল। স্পামারের থিউরির সমর্থক কেউ কেউ সিসিটিভি ফুটেজে বিস্ফোরণের সময় সেতুর নিচে রহস্যজনক জলযানের উপস্থিতি খুঁজে পাচ্ছেন। তবে টনি স্পামারএর মতের সাথে অনেকেই এক হতে পারেননি, যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতুর নিচ থেকে তোলা ছবি সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ সেতুর নিচের দিকে কোন বিস্ফোরণের আলামত দেখা যায় না। কংক্রিটের পিলারগুলি শক্তিশালী হলেও অনেকেই সেতুর স্প্যানগুলির নিচে ধাতুর কাঠামোর হাল্কা কনস্ট্রাকশনের সমালোচনা করেন; যা হয়তো স্প্যানগুলি ধ্বসে পড়তে সহায়তা দিয়েছে।

কেউ কেউ অবশ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ব্যাপারটাও উড়িয়ে দিতে নারাজ। ‘স্কাই নিউজ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর প্রাক্তন ডিরেক্টর মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, এই ঘটনা হয় ইউক্রেনের স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা ঘটিয়েছে, অথবা এটা একটা ক্ষেপণাস্ত্রের কাজ; যা কিনা এই মুহুর্তে ইউক্রেনের হাতে রয়েছে বলে জানা নেই। মোটকথা, বিশ্লেষকেরা কেউই এই মুহুর্তে নিশ্চিত হতে পারছেন না যে, এই ঘটনা কিভাবে ঘটানো হয়েছে। হয়তো প্রকৃত ঘটনা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। এই মুহুর্তে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো যুদ্ধের উপরে এই হামলার প্রভাব কতটুকু হতে পারে।

 
কার্চ সেতু কিছুদিনের মাঝেই হয়তো মেরামত করা হয়ে যাবে। এর আগ পর্যন্ত দক্ষিণের খেরসনের যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ রসদ মারিউপোল এবং বেরদিয়ানস্ক সমুদ্রবন্দর হয়ে সেখান থেকে রেলযোগে মেলিটোপোল হয়ে খেরসন পৌঁছাবে। ক্রিমিয়াতে রসদ পৌঁছাতে মেলিটোপোলের রেল জংশনের গুরুত্ব বাড়ার সাথেসাথে মেলিটোপোলের ১’শ ২০ কিঃমিঃ উত্তরে অবস্থিত জাপোরিজজিয়া বরাবর ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে; যদিও ইউক্রেনিয়রা হয়তো আরও আগেই এই পরিকল্পনা করে থাকতে পারে।

মাইকেল ক্লার্ক বলছেন যে, এই সেতু কিছুদিনের মাঝেই হয়তো মেরামত করা হয়ে যাবে। এর আগ পর্যন্ত দক্ষিণের খেরসনের যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ রসদ মারিউপোল এবং বেরদিয়ানস্ক সমুদ্রবন্দর হয়ে সেখান থেকে রেলযোগে মেলিটোপোল হয়ে খেরসন পৌঁছাবে। এই রেললাইনের একাংশ ইউক্রেনের দূরপাল্লার আর্টিলারি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তখন খেরসনে ইউক্রেনের আক্রমণ আরও শক্তিশালী হবে। রুশরা সামরিক রসদ পরিবহণে সড়কের চাইতে রেলের উপরে বেশি নির্ভরশীল। তবে যেহেতু কার্চ সেতুর রেল অংশটা ধ্বসে পড়েনি; শুধু ক্ষতি হয়েছে কিছুটা, তাই ইউক্রেন খুব বেশি হলে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় পাবে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর জন্যে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিস’ বা ‘সিএসআইএস’এর ফেলো এবং অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল মিক রায়ান এক টুইটার বার্তায় বলছেন যে, কার্চ সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মেলিটোপোল হয়ে স্থলভাগের উপর দিয়ে রেললাইনটা এখন বেশি ব্যবহৃত হবে। আর এর বাইরেও কার্চ প্রণালি পার হবার জন্যে ফেরিও রয়েছে। তবে এই ঘটনার ফলে মেলিটোপোল অধিকারে রাখাটা রুশদের জন্যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো। আর রুশরাও হয়তো একারণে দক্ষিণের দিকে তাদের সেনা মোতায়েন বাড়াতে পারে। এর ফলে যুদ্ধের অন্যান্য ফ্রন্টে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর জন্যে সুযোগ তৈরি হবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো এবং প্রাক্তন মার্কিন ম্যারিন কোর সদস্য রব লী টুইটারে জেনারেল মিক রায়ানএর মতামত সমর্থন করে বলছেন যে, ক্রিমিয়াতে রসদ পৌঁছাতে মেলিটোপোলের রেল জংশনের গুরুত্ব বাড়ার সাথেসাথে মেলিটোপোলের ১’শ ২০ কিঃমিঃ উত্তরে অবস্থিত জাপোরিজজিয়া বরাবর ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে; যদিও ইউক্রেনিয়রা হয়তো আরও আগেই এই পরিকল্পনা করে থাকতে পারে।

২৭শে জুলাই খেরসন এবং ৬ই সেপ্টেম্বর খারকিভের অপারেশন শুরুর পর থেকে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী যুদ্ধের গতিপথের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। খেরসনে ইউক্রেনের অপারেশন শুরুর আগ থেকেই রুশরা পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য ফ্রন্ট থেকে সেনা সড়িয়ে খেরসনে মোতায়েন করে। এর ফলে ইউক্রেনিয়রা যখন খারকিভে অপারেশন শুরু করে, তখন কয়েক দিনের মাঝেই রুশরা কয়েক হাজার বর্গ কিঃমিঃ এলাকা ছেড়ে দিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এখন ইউক্রেনিয়রা আবারও খেরসন অভিমুখে অপারেশনের দিক পাল্টাবার ফলে রুশরাও সেদিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে। এমনই একটা সময়ে কার্চ সেতুর উপর হামলার ঘটনাটা ঘটলো। এতে রুশদের দীর্ঘমেয়াদে কোন ক্ষতি না হলেও রুশ গর্ব এতে যথেষ্টই আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৫ই মে ভ্লাদিমির পুতিন নিজে ট্রাক চালিয়ে ১৭ কিঃমিঃ লম্বা রাশিয়ার দীর্ঘতম সেতুটা উদ্ভোধন করেছিলেন। সেতুর উপর আক্রমণে রুশদের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর নিরাপত্তা দেয়ার সক্ষমতা আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কার্চ সেতুর উপর হামলা যা দিয়েই করা হোক না কেন, এটা ছিল একটা দুঃসাহসিক অপারেশন। আর ইউক্রেনিয়রা এই হামলার ফল কতটা ভোগ করতে পারবে, তা নির্ভর করছে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর দক্ষতার উপর। পশ্চিমা সরঞ্জামের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল হলেও ইউক্রেনের সেনাদেরকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে যে, তারা রুশ সেনাদের চাইতে অধিকতর দক্ষ।

Thursday 6 October 2022

দক্ষিণ এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন কেন?

০৬ই অক্টোবর ২০২২
 
অক্টোবর ২০২২। ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল বাজওয়াকে স্বাগত জানাচ্ছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন। এতকাল যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যে। এখন আবার ভারতকে শাসনে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যখন রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক রাখার কারণে দিল্লীকে মার্কিন কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হচ্ছে, ঠিক তখনই খবর এলো যে, যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন পর হঠাৎ করেই পাকিস্তানের কাছে প্রায় সাড়ে ৪’শ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে সম্মত হয়েছে। ইসলামাবাদের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝে দুই দেশের সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল যখন ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে ক্ষমতাচ্যুত হবার সময় বলেন যে, ওয়াশিংটনের ইচ্ছানুযায়ী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। ইমরান ক্ষমতাচ্যুত হবার এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া গত ৩রা এপ্রিল এক সেমিনারে বলেন যে, ঐতিহাসিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্রই তৈরি করেছে এবং ট্রেনিং দিয়েছে। পাকিস্তানের সেরা সামরিক সরঞ্জামও যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। কথাগুলির প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ডেরেক গ্রসম্যান এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রকে চাইছে; তাদের সাথে চীনের অত ভালো চলছে না। কিন্তু এটা ঘটলে ভারত তা পছন্দ করবে না। গ্রসম্যানের এই কথাগুলিই ছয় মাস পর আলোচিত হচ্ছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা উইলসন সেন্টার’এর দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, ক’দিন আগেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস সাংবাদিকদের বলেন যে, ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী; যারা ভিন্ন ভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাইসের এই কথাগুলি জর্জ বুশ হোয়াইট হাউজে থাকার সময় থেকে দক্ষিণ এশিয়াতে মার্কিন নীতিকে প্রতিফলিত করছে। এই নীতির অধীনে ওয়াশিংটন যখন পাকিস্তানের সাথে কথা বলছে, তখন ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ককে আলাদা রাখছে; আবার ভারতের সাথে যখন কথা বলছে, তখনও পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্কের বিষয়টাকে সেখানে যুক্ত করছে না। এই নীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মির ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে ভারতের সাথে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছে। ইসলামাবাদ এখন বুঝতে পারছে যে, তারা ওয়াশিংটনের কাছ থেকে আশা করতে পারে না যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকেও একইভাবে দেখবে। ২০১৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে নিরাপত্তা সহায়তা দেয়া বন্ধ রেখেছে। এমতাবস্থায় নিরাপত্তা সহায়তা স্থগিত রেখে পাকিস্তানের পুরোনো ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানের উন্নয়নের জন্যে সরঞ্জামাদি বিক্রয় করাটা নতুন নীতির দিকেই ইঙ্গিত দেয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পাকিস্তানের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করার জন্যে ওয়াশিংটনের সমালোচনা করেন। কুগেলম্যান বলছেন যে, এস জয়শঙ্করের প্রতিক্রিয়াটা অবাক করার মতো; যখন এটা পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের চাইতে অনেক বেশি উচ্চতায়। সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াশিংটনের সাথে ইসলামাবাদের সখ্যতা দেখা গেলেও দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ যথেষ্টই অনিশ্চিত। অপরদিকে চীনকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ভারত ওয়াশিংটনের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। যদি দিল্লী থেকে বলা হয় যে, পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়ন ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী, তাহলে ওয়াশিংটনও বলতে পারে যে, মস্কোর সাথে দিল্লীর সম্পর্ক ওয়াশিংটনে স্বার্থের পরিপন্থী। এই ঘটনাগুলি দেখিয়ে দেয় যে, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করতে করতে গেলে ওয়াশিংটনকে আরও সাবধানে এগুতে হবে।

পাকিস্তান বিষয়ে ওয়াশিংটনের নীতি নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্কের সমন্বয়ে গঠিত ‘পাকিস্তান স্টাডি গ্রুপ’এর ৪ঠা অক্টোবরের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে পাকিস্তানকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ পাকিস্তানের অবস্থান হলো দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মাঝখানে এবং পাকিস্তানের সাথে চীন এবং ইরানের সীমানা ছাড়াও দেশটার সাথে রাশিয়ারও সুসম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থের কারণেই তারা পাকিস্তানকে একঘরে করা অথবা সম্পর্ককে পুরোপুরিভাবে কর্তন করতে পারবে না। পাকিস্তান যাতে স্বাভাবিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করে যেতে থাকে, সেটা নিশ্চিত করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের অংশ। সেখানে বলা হচ্ছে যে, যদিও আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান ভিন্ন চশমা দিয়ে দেখতে থাকবে, তদুপরি উভয়ের স্বার্থেই আফগানিস্তানে শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখা এবং সেদেশের মানুষের সমস্যা লাঘবের জন্যে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মাঝে সহযোগিতা চলতে পারে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স অনেক এজেন্ট হারাবার পর পাকিস্তানের মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার প্রভাব ধরে রাখতে পারে। তবে দুই দেশের জনমত সম্পর্কোন্নয়ের ক্ষেত্রে বেশ বড় বাধা। পাকিস্তানের কৌশলগত চিন্তাকে পরিবর্তন করাবার চেষ্টা করার উপর প্রতিবেদনে জোর দেয়া হয়। এই মুহুর্তে চীনের ব্যাপারে পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন নীতি থাকার কারণে প্রতিবেদনে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কৌসুলী হবার জন্যে ওয়াশিংটনকে উপদেশ দেয়া হয়। কারণ সুবিধা প্রদান করা বা হুমকি দেয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানের কৌশলগত দিক পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে প্রতিবেদনে চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার যেন জনগণের সামনে আরও তথ্য উপস্থাপন করে এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে সেক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করা হয়।

পাকিস্তানের পত্রিকা ‘দ্যা এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই প্রতিবেদন এমন সময়ে প্রকাশ করা হলো, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল বাজওয়া ওয়াশিংটন সফর করছেন। আর এর মাত্র এক সপ্তাহ আগেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ওয়াশিংটন ঘুরে এসেছেন।

কুগেলম্যান বলছেন যে, ওয়াশিংটন যেমন পাকিস্তানকে ছাড়তে পারছে না, তেমনি ভারতও রাশিয়াকে ছাড়তে পারছে না। এগুলি ওয়াশিংটন এবং দিল্লীর বাস্তবতার অংশ। এই বাস্তবতা অপছন্দের হলেও মেনে নেয়া ছাড়া গতি নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত নীতির কারণে দিল্লী-মস্কো এবং ওয়াশিংটন-ইসলামাবাদ সম্পর্ক দিল্লী-ওয়াশিংটন সম্পর্কের চাইতে অপেক্ষাকৃত বেশি অনিশ্চয়তার মাঝে পড়বে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি-জিরো মিডিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বার্তা দিয়েছে যে, রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক রেখে চলার একটা মূল্য রয়েছে; যদিও নিশ্চিতভাবেই, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বড় কোন শাস্তি দেবে না। এই কথাগুলির মাঝ দিয়ে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, এতকাল যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যে। এখন আবার ভারতকে শাসনে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে।

Monday 3 October 2022

ষষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার বিমান … প্রতিযোগিতার মাঝেই প্রতিযোগিতা

০৪ঠা অক্টোবর ২০২২
 
মার্কিনীরা মনে করছে না যে তারা প্রযুক্তিতে চীনাদের চাইতে পিছিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের প্রযুক্তিগুলি কে কার আগে কাজে লাগাতে পারে, সেই সক্ষমতা নিয়েই প্রতিযোগিতা হচ্ছে। মার্কিনীরা প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে থাকতে যেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত, চীনারা ততটা নয়। এটা দুই দেশের চিন্তাগত পার্থক্যের কারণেই।

‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সামরিক সক্ষমতা বিষয়ে যে জায়গাগুলিতে প্রযুক্তিগত উতকর্ষতা নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে, তার মাঝে একটা হলো আকাশ প্রযুক্তি। বর্তমানে আকাশ প্রযুক্তির সর্বশেষ হলো পঞ্চম জেনারেশনের ফাইটার বিমান। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘এফ-২২’ এবং ‘এফ-৩৫’ যুদ্ধবিমানকে ইতোমধ্যেই বিশ্বের সেরা ফাইটার বিমান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীন উৎপাদন করছে ‘জে-২০’ এবং রাশিয়া উৎপাদন করছে ‘সুখোই-৫৭’। এর বাইরে চীনাদের একাধিক প্রকল্প রয়েছে; তুরস্কও তাদের নিজস্ব পঞ্চম জেনারেশনের ফাইটার বিমান ডেভেলপ করছে। এখন ইতোমধ্যেই এর পরের জেনারেশন, বা ষষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার জেট নিয়ে কথা শুরু হয়ে গেছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে মার্কিন বিমান বাহিনীর ‘এয়ার কমব্যাট কমান্ড’এর প্রধান জেনারেল মার্ক কেলি বলেন যে, তিনি জানেন না যে, চীনে এই মুহুর্তে কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের প্রস্তুতি ছাড়া আর কি হচ্ছে। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারেন যে, কোন বিষয়টা নিয়ে চীনে কোন কথাই হচ্ছে না। চীনে এই মুহুর্তে ষষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার বিমানের প্রয়োজন নিয়ে কোন আলোচনাই নেই। তবে তিনি বলেন যে, তিনি নিশ্চিত যে, চীনারা এই বিষয়ে সঠিক পথেই রয়েছে। একারণে তিনি মনে করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ প্রতিযোগিদের চাইতে কমপক্ষে এক মাস আগে হলেও ষষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার তৈরি করা।

ফাইটার বিমানের ‘জেনারেশন’এর অর্থ কি?

ষষ্ঠ জেনারেশনের বিমান বলতে আসলে কি বোঝায়? আগে বুঝতে হবে যে, এই ‘জেনারেশন’ ব্যাপারটা আসলে কি। মার্কিন বিমান বাহিনীর এক ডকুমেন্টে লেঃ জেনারেল হক কারলাইল একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, এককটা জেনারেশনের ফাইটার বিমান বলতে কি বোঝানো হচ্ছে। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৫৫ সালের মাঝে ডেভেলপ করা প্রথম জেট ফাইটারগুলিকে (এফ-৮৬, মিগ-১৫) বলা হচ্ছে প্রথম জেনারেশনের ফাইটার। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ সালের মাঝে ডেভেলপ করা দ্বিতীয় জেনারেশনের ফাইটারগুলিতে (মিগ-২১, এফ-১০৬) নতুন তিনটা প্রযুক্তি বা সক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত হয়; এগুলি হলো, সুপারসনিক গতি, বা শব্দের চাইতে বেশি দ্রুততায় ওড়ার সক্ষমতা; বিমানের নিজস্ব রাডার; এবং প্রথম গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র। তৃতীয় জেনারেশনের ফাইটারগুলি (এফ-৪ই, মিগ-২৩, মিরাজ এফ-১) মোটামুটিভাবে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০এর মাঝে ডেভেলপ করা। এগুলিতে প্রথম মাল্টি-রোল কনসেপ্ট অন্তর্ভুক্ত হয়; অর্থাৎ একটা ডিজাইনের বিমানই অনেকগুলি মিশন সফলভাবে সম্পাদন করতে পারবে। একইসাথে বিমানগুলিতে নতুন ধরণের অনেক ইলেকট্রনিক্স অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং প্রথমবারের মতো নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত হানার মতো অস্ত্র বহণের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৭০ থেকে ২০০০ সালের মাঝে ডেভেলপ করা বিমানগুলিকে বলা হচ্ছে চতুর্থ জেনারেশনের ফাইটার বিমান। ‘এফ-১৫’, ‘এফ-১৬’, ‘এফ-১৪’, ‘এফ/এ-১৮’, ‘মিগ-২৯’, ‘সুখোই-২৭’, ‘মিরাজ-২০০০’, ‘টর্নেডো’, ‘রাফাল’, ‘গ্রিপেন’, ’ইউরোফাইটার টাইফুন’সহ আরও অনেক বিমান এই ক্যাটাগরিতে পড়েছে। এগুলিতে ইলেকট্রনিক্সের আরও উন্নয়ন করা হয় এবং নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত হানার ব্যাপারটাকে আরও পাকাপোক্ত করা হয়। একইসাথে আকাশে শত্রুপক্ষের বিমানের সাথে ডগফাইটে সফলতা আনার জন্যে ডিজাইনে অনেক পরিবর্তন আসে। রাডারের সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি করা হয় এবং প্রথমবারের মতো রাডারে ধরা না পড়া ‘স্টেলথ’ যুদ্ধবিমান (এফ-১১৭) তৈরি করা হয়। ২০০০ সালের পরে ডেভেলপ করা পঞ্চম জেনারেশনের যুদ্ধবিমানের মাঝে ইলেকট্রনিক্স এবং সেন্সরের পুরোপুরিভাবে সমন্বয় করা হয়। অর্থাৎ বিমান যেসব তথ্য সংগ্রহ করবে, সেগুলি সমন্বয় করে একত্রে ডিসপ্লে করা হয়। স্টেলথ প্রযুক্তির আরও অনেক উন্নয়ন করা হয়; যাতে করে শত্রুপক্ষের বিমানের চোখে পড়ার আগেই টার্গেটে হামলা করা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়াও এর মাঝে নেটওয়ার্কভিত্তিক যুদ্ধ করার সক্ষমতা দেয়া হয়; যার অর্থ হলো, এই বিমানগুলি নিজ পক্ষের বিভিন্ন ইউনিট, তা বিমান হোক, বা ভূমি বা পানিতেই হোক, সেগুলির সংগ্রহ করা তথ্যকে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সংগ্রহ করবে এবং তা প্রসেস করে যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে; এমনকি অন্যান্য বিমান বা অন্যান্য ইউনিটকে কমান্ড দিতে বা নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে। মোটকথা এই বিমানগুলি অন্যান্য বিমান বা যেকোন ইউনিটের সক্ষমতাকে ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে। তবে এক্ষেত্রে সক্ষমতা অনেকটাই নির্ভর করবে নেটওয়ার্কের সক্ষমতা এবং বিভিন্ন বাহিনীর মাঝে তথ্য আদানপ্রদানের সংস্কৃতির উপরে।

 
ষষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার বিমানের আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা, তা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন। ‘এফ-৩৫’ বিমানের যে সক্ষমতা রয়েছে, সেটাকে পেরিয়ে আরও সক্ষমতার কতটুকু প্রয়োজন রয়েছে? ষষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার বিমানের জন্যে যেসকল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলি পঞ্চম জেনারেশনের উপরে সক্ষমতাকে আসলে কতটুকু বৃদ্ধি করবে? অথচ এগুলি ডেভেলপ করতে এবং তৈরি করতে বিশাল অর্থ গুণতে হবে। 

ষষ্ঠ জেনারেশন বলতে আসলে কি বোঝানো হচ্ছে?

‘ব্রেকিং ডিফেন্স’ বলছে যে, যেসব দেশ ষষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার নিয়ে কাজ করছে, তারা তাদের প্রকল্পকে গোপন রেখেছে। আর এর মাঝে চীনারা তাদের এই প্রকল্পকে সবচাইতে বেশি গোপন রেখেছে। ২০১৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে চীনের ‘চেংডু এরোস্পেস কর্পোরেশন’এর প্রধান ডিজাইনার ওয়াং হাইফেং বলেন যে, চীনারা পরবর্তী জেনারেশনের যুদ্ধবিমানের জন্যে চিন্তাভাবনা করছে; যাতে করে নতুন ধরণের এই বিমান ২০৩৫ নাগাদ চীনা বিমান বাহিনীতে সার্ভিসে আসতে পারে। তিনি চীনাদের ষষ্ঠ জেনারেশন প্রকল্প নিয়ে কিছু না বললেও মার্কিনীদের প্রকল্পে কি কি থাকতে পারে, তার একটা ধারণা দিয়েছেন; এর মাঝে থাকবে ড্রোনের সাথে একটা গ্রুপে কাজ করতে পারা; আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা; স্টেলথ সক্ষমতাকে আরও বৃদ্ধি করা; এবং বিমানের সেন্সরগুলি এমন হবে, যা কিনা কোন নির্দিষ্ট দিক নয়, বরং সকল দিক থেকেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। এছাড়াও লেজার অস্ত্রের সংযোজন, এবং ‘এডাপটিভ ইঞ্জিন’এর ব্যবহার হতে পারে সেই বিমানে।

মার্কিন বিমান বাহিনীর এই প্রকল্পের নাম হলো ‘নেক্সট জেনারেশন এয়ার ডমিন্যান্স’ বা ‘এনজিএডি’ বা ‘এনগ্যাড’। এটা অত্যন্ত জটিল একটা প্রকল্প; কারণ এর মাঝে রয়েছে একটা পাইলট চালিত বিমানের নকশা করা; নতুন ধরণের অস্ত্র ডেভেলপ করা; এমনকি নতুন ধরণের কয়েক প্রকারের ড্রোনেরও ডিজাইন করা। বিমান বাহিনীর সচিব ফ্রাঙ্ক কেনডাল বলছেন যে, এরকম একেকটা বিমানের খরচ কয়েক’শ মিলিয়ন ডলার হয়ে যেতে পারে। যদিও কেনডাল বলছেন যে, মার্কিনীরা এই দশকের মাঝেই এই বিমানের ডেভেলপমেন্ট শেষ করতে পারবে, তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রকল্পই দেরিতে শেষ হওয়ায় কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না যে, এত জটিল একটা প্রকল্প ঠিক সময়মতো শেষ হবে। কাজেই অনেকেই ধারণা করছেন যে, এই দেরির সুবাদেই চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত দূরত্ব কমে আসবে।

জাতীয় নিরাপত্তা ম্যাগাজিন ‘নাইনটিন ফোরটিফাইভ’এর এক লেখায় ব্রেন্ট ইস্টউড প্রশ্ন করছেন যে, ষষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার বিমানের আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা। ‘এফ-৩৫’ বিমানের যে সক্ষমতা রয়েছে, সেটাকে পেরিয়ে আরও সক্ষমতার কতটুকু প্রয়োজন রয়েছে? চীনের সর্বোচ্চ প্রযুক্তির বিমানগুলি আসলে কতটুকু সক্ষম, সেটা সম্পর্কে তো কেউ এখনও তেমন জানেই না। তাহলে কেন বলা হচ্ছে যে, আরও সক্ষম নতুন প্রজন্মের বিমানের প্রয়োজন? আর ষষ্ঠ জেনারেশনের ফাইটার বিমানের জন্যে যেসকল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলি পঞ্চম জেনারেশনের উপরে সক্ষমতাকে আসলে কতটুকু বৃদ্ধি করবে? অথচ এগুলি ডেভেলপ করতে এবং তৈরি করতে বিশাল অর্থ গুণতে হবে। যদি ‘এফ-৩৫’ বিমান দিয়েই আকাশের নিয়ন্ত্রণ নেয়া সম্ভব হয়, তাহলে ষষ্ঠ জেনারেশনের বিমান ডেভেলপ না করে সেই অর্থ দিয়ে আরও বেশি ‘এফ-৩৫’ কেনা প্রয়োজন।

 
চীনারা খুব সম্ভবতঃ তাদের পঞ্চম জেনারেশনের 'জে-২০' বিমানের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই ষষ্ঠ জেনারেশনের বিমান তৈরি করতে চাইছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে তারা কম ঝুঁকিপূর্ণ পথে এগুচ্ছে; যেপথে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ধীরে ধীরে সক্ষমতার ব্যবধান কমাতে পারবে। তাড়াহুড়া নয়, বরং চীনের ধীরে চলার চিন্তাটাই মার্কিনীদের সাথে চীনাদের মূল পার্থক্য। মার্কিনীরা এখন ভবিষ্যতের বিভিন্ন মাইলস্টোনের কথা বলছে। এই মাইলস্টোনগুলিই বলে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে মাইলস্টোনগুলির আগেই সংঘাতের ছুতো খুঁজছে।

মার্কিনীদের সাথে চীনাদের চিন্তাগত পার্থক্য

জেনারেল মার্ক কেলি বলছেন যে, চীনারা মূলতঃ মার্কিনীদেরকেই অনুসরণ করছে। কারণ স্টেলথ সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি করা, কম্পিউটারের প্রসেসিং সক্ষমতা ও তথ্য সংগ্রহ করার সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি করা, এবং নতুন নতুন সিস্টেমকে দ্রুত বিমানের সাথে যুক্ত করে ‘রিপ্রোগ্রাম’ করে নিতে পারার সক্ষমতা – এগুলি মূলতঃ মার্কিনী চিন্তা। যদি এখানে কোন ভিন্নতা থাকে, তা খুবই সূক্ষ্ম। যেমন, চীনারা খুব ধীরে ধীরে একটা ফাইটার বিমান থেকে অন্য ফাইটার বিমান ডেভেলপ করে; যেমনটা তারা করেছিল রুশ ‘সুখোই-২৭’ ও ‘সুখোই-৩০’ বিমান থেকে চীনাদের নিজস্ব ‘জে-১৬’ বিমান ডেভেলপ করার ক্ষেত্রে। অপরদিকে জাতি হিসেবে মার্কিনীরা নতুন কিছু ডেভেলপ করতে গিয়ে বড় আকারের লাফ দেয়। সিঁড়ির বর্তমান ধাপ ছেড়ে দিয়ে পরের ধাপ পুরোপুরি এড়িয়ে সামনের ধাপ ধরার জন্যে সেই লাফ দেয় মার্কিনীরা। চীনারা এধরণের কাজ করে না; তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে বারংবার চেষ্টা করতে থাকে। এর মাঝে দূরের ধাপটা ধরতে গিয়ে কোন সমস্যায় পড়লে তারা কাছাকাছি ধাপটা ধরে ফেলতে পারে।

চীনারা প্রযুক্তির দিক থেকে কখনোই তাড়াহুড়া করেনি। জেনারেল কেলি বলছেন যে, চীনারা সর্বদাই সহজ পথটাকেই বেছে নিয়েছে। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘দ্যা ওয়ার জোন’এর এক লেখায় থমাস নেডউইক বলছেন যে, চীনারা শুধু রুশ ‘সুখোই-২৭’ থেকেই শেখেনি। তারা রুশ ‘সুখোই-৩৫’ বিমান কিনে সেটা নিয়ে গবেষণা করেছে। এর ফলে পঞ্চম জেনারেশনের বিমানের ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম, ‘থ্রাস্ট ভেকটরিং ইঞ্জিন’ এবং অস্ত্রগুলি ডেভেলপ করতে পেরেছে। এভাবেই তারা হয়তো ‘জে-২০’ বিমানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ষষ্ঠ জেনারেশনের বিমান ডেভেলপ করবে।

যুক্তরাষ্ট্র কি আসলেই প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে?

যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, মার্কিনীরা মনে করছে না যে তারা প্রযুক্তিতে চীনাদের চাইতে পিছিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের প্রযুক্তিগুলি কে কার আগে কাজে লাগাতে পারে, সেই সক্ষমতা নিয়েই প্রতিযোগিতা হচ্ছে। মার্কিনীরা প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে থাকতে যেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত, চীনারা ততটা নয়। এটা দুই দেশের চিন্তাগত পার্থক্যের কারণেই। মার্কিন বিমান বাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান জেনারেল কেনেথ উইলসবাক গত সেপ্টেম্বরে সাংবাদিকদের সামনে চীনাদের পঞ্চম জেনারেশনের যুদ্ধবিমান ‘জে-২০’ নিয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন যে, এটা চীনাদের সবচাইতে শক্তিশালী ফাইটার বিমান। এটা নিয়ে মার্কিনীরা খুব বেশি একটা গবেষণার সুযোগ পায়নি। এটা ভালো একটা বিমান। কিন্তু এটা নিয়ে চিন্তা করে রাতের ঘুম নষ্ট করার কোন কারণ নেই। তার ধারণা, মার্কিন পঞ্চম জেনারেশনের বিমানগুলি চীনাদের বিমানের চাইতে অনেক বেশি সক্ষমতার। এর আগে মার্কিন বিমান বাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল চার্লস ব্রাউন চীনা ‘জে-২০’ বিমানের পক্ষে ভালো কিছু মন্তব্য করলেও তিনি বলেন যে, এই বিমান নিয়ে তিনি চিন্তিত নন মোটেই।

জেনারেল মার্ক কেলি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, চীনারা প্রযুক্তির দিক থেকে মার্কিনীদেরকেই অনুসরণ করবে। কিন্তু চিন্তাগত দিক থেকে তারা মার্কিনীদের থেকে ভিন্ন। মার্কিনীরা প্রযুক্তির উপরেই তাদের সকল চিন্তাকে সীমাবদ্ধ করলেও চীনারা তা করছে না। বরং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে তারা কম ঝুঁকিপূর্ণ পথে এগুচ্ছে; যেপথে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ধীরে ধীরে সক্ষমতার ব্যবধান কমাতে পারবে। তাড়াহুড়া নয়, বরং চীনের ধীরে চলার চিন্তাটাই মার্কিনীদের সাথে চীনাদের মূল পার্থক্য। আর এই চিন্তাটা এখন মার্কিনীদের সিদ্ধান্তকে যথেষ্টই প্রভাবিত করছে। মার্কিনীরা এখন ভবিষ্যতের বিভিন্ন মাইলস্টোনের কথা বলছে, যেই মাইলস্টোনগুলি প্রযুক্তি ও সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সমতা এনে দিতে পারে। মার্কিনীরা হয়তো চীনাদের সেই মাইলস্টোনগুলি ধীরে সুস্থে ধরে ফেলা দেখতে চাইছে না। মোটকথা, এই মাইলস্টোনগুলিই বলে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে মাইলস্টোনগুলির আগেই সংঘাতের ছুতো খুঁজছে।



সূত্রঃ

‘China ‘on track’ for 6th-gen fighter, US Air Force needs to get there first: ACC chief’ in Breaking Defense, 26 September 2022

‘5th Generation Fighters’ by Lt. Gen. Hawk Carlisle, USAF (unclassified)

‘China racing for 6th-gen fighter edge over US’ in Asia Times, 01 October 2022

‘China Is Working On Its Own Sixth-Generation Fighter Program: Official’ by Thomas Nedwick, in The Warzone, The Drive, 28 September 2022 (https://www.thedrive.com/the-war-zone/china-is-working-on-its-own-sixth-generation-fighter-program-official )

‘China should ‘worry’ about Taiwan 2027 timeline, J-20 is just ‘OK’ fighter: PACAF chief’ in Breaking Defense, 19 September 2022

‘Do We Really Need 6th-Generation Stealth Fighters?’ by Brent M. Eastwood, in 1945, 22 July 2022 (https://www.19fortyfive.com/2022/07/do-we-really-need-6th-generation-stealth-fighters/)

‘Beyond the F-22 or F-35: What Will the Sixth-Generation Jet Fighter Look Like?’ by Sebastian Roblin, in The National Interest, 21 July 2018

Saturday 1 October 2022

অর্থনৈতিক দৈন্যতা জার্মানদেরকে ইউক্রেনের শরণার্থীদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করাচ্ছে

০২রা অক্টোবর ২০২২
 
২০১৬ সাল। জার্মানিতে ডানপন্থীদের মুসলিম শরণার্থী বিরোধী বিক্ষোভ। ইউরোপে মুসলিম এবং ইউক্রেনিয় খ্রিস্টান শরণার্থীদের ব্যাপারে জনমতে ব্যাপক পার্থক্য থাকলেও জ্বালানির ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মাঝে এখন যেকোন শরণার্থীই বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি মধ্যপন্থায় থাকা রাজনীতিবিদেরাও শরণার্থীদের আটকাতে বলছেন।

গত ২৭শে সেপ্টেম্বর জার্মান ‘ফেডেরাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস’ বলে যে, জার্মানির জনসংখ্যা ২০২২ সালে রেকর্ড সংখ্যক বেড়েছে। এর কারণ ছিল ইউক্রেন থেকে শরণার্থীর ঢল। বর্তমানে দেশটার জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৪০ লক্ষের বেশি। শরণার্থীদের কারণে জার্মানির জনসংখ্যা ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে ৮ লক্ষ ৪৩ হাজার বা ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের পুরো বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ৮২ হাজার। যুদ্ধের আগে সরকারি হিসেবে জার্মানিতে ইউক্রেনিয়দের সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লক্ষ। যুদ্ধ শুরুর পর প্রায় ৯ লক্ষ ৭১ হাজার নতুন শরণার্থীকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, এর আগে ১৯৯২ সালে সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের চাপে জার্মানির জনসংখ্যা ৭ লক্ষ বৃদ্ধি পেয়েছিল। আবার ২০১৫ সালে সিরিয় শরণার্থীর ঢলে দেশটার জনসংখ্যা আরও প্রায় ১০ লক্ষ বৃদ্ধি পায়। আর ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে ইউক্রেন সরকার বেশিরভাগ পুরুষ মানুষকে দেশ ছাড়তে অনুমতি না দেয়ায় জার্মানিতে বেশিরভাগ ইউক্রেনিয় শরণার্থীই হলো নারী ও শিশু। তবে শরণার্থীদের ঢল আসার আগেই জার্মানি শুধু ইউরোপের সবচাইতে ধনীর দেশই ছিল না; সেখানে জন্মহার ছিল অত্যধিক কম এবং অল্প বয়সের মানুষের সংখ্যাও ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক কম। তাই জার্মানির অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে কর্মঠ অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সের মানুষের চাহিদা তৈরি হয়েছিল।

জার্মানিতে শরণার্থীদের নিয়ে সমস্যা বাড়ছে

জার্মানির পশ্চিমের আখেন শহরের ২০ কিঃমিঃ দূরে ছোট একটা এলাকার চিত্র তুলে ধরে ‘ডয়েচে ভেলে’। ৫০ হাজার জনসংখ্যার এই ছোট্ট শহরে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ জন করে শরণার্থী গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কয়েক মাসের মাঝেই সেখানে ৫’শ ৩০ জন শরণার্থী হাজির হয়েছে। এর বাইরেও আরও ২০টা দেশের ৮’শ ৫০ জন শরণার্থীকে সেখানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শহরের খেলাধূলার জিমনেসিয়াম এবং হল রুমে পার্টিশনের ব্যবস্থা করে শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একসময় অনেকেই নিজেদের বাড়িতে শরণার্থীদের থাকতে দিলেও এখন কেউ অগ্রগামী হচ্ছে না। কারণ জ্বালানির মূল্য এতটাই বেড়ে গেছে যে, তারা মনে করছে যে, শরণার্থীদের নিলে তাদের দৈনন্দিন খরচ সক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। শরণার্থীদের মাঝে কেউ কেউ কাজ যোগাড় করতে পারলেও অনেকেই এখনও পারেনি। সাহায্যকারীরা খুবই ব্যস্ত সময় পার করছে। তারা শরণার্থীদের জন্যে ফর্ম পূরণের কাজ ছাড়াও তাদের জন্যে ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করছে; তাদের থাকার জন্যে জায়গা খুঁজে দিচ্ছে; এমনকি তাদের সন্তানদের দেখাশুনা এবং তাদেরকে রান্না করার শিক্ষাও দিচ্ছে।

আখেন শহরের মেয়রও ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন যে, তার শহরে এখন আর কোন শরণার্থী রাখার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। সেখানে ৪ হাজার ইউক্রেনিয় শরণার্থী রাখার পর সকল যায়গা ফুরিয়ে গেছে; যার মাঝে ৮টা জিমনেসিয়াম হলও রয়েছে। আখেন শহরে যুদ্ধের আগেই ইউক্রেনিয়দের একটা বড়সড় গ্রুপ বসবাস করতো; এরা অনেকেই শরণার্থীদেরকে তাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছে। ২০১৬ সালে সিরিয়া এবং আফ্রিকা থেকে আসা ১’শ ২০ জন শরণার্থীর জন্যে শহরের খেলার মাঠে অস্থায়ী বাড়ি তৈরি করা হয়। এই বাড়িগুলি পুরোনো হলেও সেখানে একান্তভাবে বসবাসের সুযোগ থাকায় সকলেই তেমন বাড়ি চায়। শহরের খালি বাণিজ্যিক জায়গাগুলিকে ব্যবহার করে শরণার্থীদেরকে জিমনেসিয়াম থেকে সরিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কারণ সকলেই এখন বুঝতে পারছে যে, যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হবে। শরণার্থীদের সন্তানদের জন্যে শিক্ষা এবং অন্যান্য সেবার ব্যবস্থাও করতে হবে। কিন্তু এই সেবা পেতে এখন শরণার্থীরা সাধারণ জার্মান নাগরিকদের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জন্যে আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করা ছাড়া কোন গতি নেই; নাহলে শান্তিশৃংখলা ব্যাহত হতে পারে। সাহায্যকারীরা বলছেন যে, বেশিরভাগ বাড়িওয়ালাই শরণার্থীদের কাছে বাড়ি দেয়ার কথা শুনলে ফোন রেখে দিচ্ছে। মোটকথা শরণার্থীদের বাসস্থান যোগাড় করতে এখন অনেক বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে।

‘ইউরোনিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জার্মানিতে ইউক্রেনিয় এবং রুশদের মাঝে চলছে সংঘর্ষ; যা জার্মানির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে। একদিকে ইউক্রেনিয়রা বার্লিনের রাস্তায় জার্মানির রুশ গ্যাস আমদানি করার নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। অপরদিকে রুশরা ইউক্রেনিয়দেরকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, জার্মানিতে রুশদের মালিকানায় থাকা ব্যবসা বাণিজ্যেও ভূতুড়ে ফোন আসছে হুমকিসহ। জার্মানিতে রুশদের একটা স্কুলে আগ্নিসন্ত্রাসও হয়েছে বলে বলছে ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’। জার্মান পুলিশ বলছে যে, এপ্রিল মাসে জার্মানিতে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রুশ, ইউক্রেনিয় এবং বেলারুশদের মাঝে ১৭’শ অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে ইউক্রেনিয়দের সংখ্যা ১১ লক্ষ ছাড়িয়ে গেলেও জার্মানিতে ১৯৯০এর দশক থেকেই প্রায় ৩০ লক্ষ রুশ ভাষাভাষী মানুষ বাস করে।

 
২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২২। চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ইস্যুতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। ইউরোপজুড়ে ডানপন্থী রাজনীতির জয়জয়কার দৃশ্যমান হওয়ায় জার্মানির ডানপন্থীরাও এতে আনুপ্রাণিত হয়েছে। নিজেদের দলের কর্মকান্ডের সফলতার চাইতে লিবারাল রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতাই ডানপন্থীদের বেশি সহায়তা দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে, আসন্ন শীতকাল ইউরোপে, তথা জার্মানিতে, পশ্চিমা লিবারাল আদর্শের জন্যে অতি শীতল পরীক্ষা নিয়ে আসতে যাচ্ছে।

শরণার্থীদের ব্যাপারে রাজনীতিবিদেরা তাদের মতামত পাল্টাচ্ছেন

জার্মানির বৃহত্তম বিরোধী দল এঙ্গেলা মার্কেলের মধ্য-ডানপন্থী ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট’ বা ‘সিডিইউ’ দলের প্রধান ফ্রেডরিক মার্জ জার্মান টেলিভিশন ‘বিল্ড টিভি’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থীরা জার্মান সরকারের সামাজিক সহায়তা ব্যবস্থা থেকে সুবিধা ভোগ করতে পর্যটকের মতো আচরণ করছে। ১১ লক্ষের বেশি ইউক্রেনিয় শরণার্থীদের জন্যে শীতকালে ঘর উষ্ণ করার সুবিধা দিলে সেটা জার্মান নাগরিকদের জন্যে অন্যায্য হয়ে যাচ্ছে। কারণ অনেক খেটে খাওয়া জার্মান তাদের জ্বালানি খরচ বহণ করতে পারছে না। ‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জার্মানির অর্ধেক বাড়িঘরই শীতকালে উষ্ণ রাখার জন্যে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে থাকে। এই বাড়িগুলির জন্যে জ্বালানি খরচ কমপক্ষে দ্বিগুণ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ফ্রেডরিক মার্জের কথাগুলির পর দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হলে তিনি এক টুইটার বার্তায় তার মন্তব্যের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মার্জ ক্ষমতাসীন সোশালিস্ট সরকারের শরণার্থী নীতির সমালোচনা করে বলছেন যে, সরকারের কোন সুনির্দিষ্ট নীতি নেই। যে-ই জার্মানিতে আসতে চাইছে, তাকেই সরকার দেশে ঢুকতে দিচ্ছে। সরকারের উচিৎ কঠোরভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া যে, কত শরণার্থী দেশে ঢুকতে পারবে। ‘পলিটিকো’ বলছে যে, মার্জের কথাগুলি বেশ খানিকটা পপুলিস্ট ঘরানার, যা কিনা ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ বা ‘এএফডি’ দলের কথার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে, ‘সিডিইউ’এর চিন্তায় বেশ খানিকটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এতদিন ‘সিডিইউ’ ইউক্রেনিয় শরণার্থীদের ব্যাপারে জার্মান সরকারের নীতিকে সমর্থন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতাকে কাজে লাগাতে ‘সিডিইউ’ হয়তো এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছে না।

‘ইউরোনিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, জার্মানির পূর্ব দিকের ছোট দেশগুলিতেও শরণার্থীদের চাপ অনুভূত হচ্ছে। চেক রিপাবলিক ৪ লক্ষ ৩৯ হাজারের বেশি ইউক্রেনিয় শরণার্থী নিয়েছে; পাশের স্লোভাকিয়া নিয়েছে আরও প্রায় ১ লক্ষ। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে সিরিয়া থেকে শরণার্থী আসা বেড়ে যাওয়ায় তারা তাদের সীমান্তে পাহাড়া বসিয়েছে; যদিও ইইউএর নিয়ম অনুসারে একদেশ থেকে অন্যদেশে যাতায়াতে কোন বাধা থাকার কথা নয়। সমস্যা হলো, যেখানে চেক রিপাবলিকের ৭৫ শতাংশ জনগণ ইউক্রেনের শরণার্থীদের দেশে ঢোকার পক্ষে, সেখানে ২০১৫ সালে সিরিয়া এবং আফ্রিকার মুসলিম শরণার্থীদের দেশে ঢোকার বিরুদ্ধে ছিল ৭০ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ ইউক্রেনের শরণার্থীদেরকে তারা ভাইয়ের মতো দেখলেও মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার মুসলিমদেরকে তারা ভিন্ন চোখে দেখেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে চলেছে। কারণ জীবনযাত্রার খরচ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ায় চেক রিপাবলিকের কট্টর বামপন্থী এবং কট্টর ডানপন্থী দলগুলি রাজধানী প্রাগের রাস্তায় সরকার বিরোধী বিক্ষোভ করেছে। অনেকেই বলা শুরু করেছে যে, সরকার শরণার্থীদেরকে চেক নাগরিকদের তুলনায় বেশি সুবিধা দিচ্ছে। স্লোভাকিয়াতেও অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে চেক রিপাবলিকে মূদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশ; আর স্লোভাকিয়াতে ১৪ শতাংশ; যা কিনা ইউরোপের সর্বোচ্চগুলির মাঝে।

জার্মানিতে ডানপন্থীদের জনসমর্থন বাড়ছে

জার্মানির ‘ডের স্পাইগেল’ পত্রিকা বলছে যে, জার্মানির ১৬টা রাজ্যের মাঝে ১২টা রাজ্য ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছে যে তারা ইউক্রেন থেকে আর কোন শরণার্থী নিতে পারবে না। জার্মান স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলছেন যে, খুব শীঘ্রই সবগুলি রাজ্যই তাদের সক্ষমতার সীমানা অতিক্রম করবে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে ৮শ’ ৭৫ জন শরণার্থী জার্মানিতে প্রবেশ করেছে। অর্থনৈতিক চাপের মাঝে শরণার্থীদের ভার নিতে হিমসিম খাচ্ছে ইউরোপ; বিশেষ করে জার্মানি। এই সুযোগটাই নিচ্ছে জার্মানির কট্টর ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ বা ‘এএফডি’। তবে জার্মানির প্রাক্তন চ্যালেন্সর গেরহার্ড শ্রোডার মনে করছেন যে, ‘এএফডি’র নিজেদের মাঝেই বিভেদ রয়েছে। তিনি ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলছেন যে, দেশের পূর্বাঞ্চলে এই দলের সমর্থকেরা রাশিয়াকে সমর্থন করলেও পশ্চিমাঞ্চলের সমর্থকেরা রাশিয়ার পক্ষে নয়। এমতাবস্থায় তারা সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত কোন আন্দোলন করতে পারবে না। তথাপি জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধির ইস্যুতে ‘এএফডি’র সরকার বিরোধী বিক্ষোভে হাজারো মানুষ যোগ দিচ্ছে। গবেষণা সংস্থা ‘আইএনএসএ’র এক জরিপে বলা হচ্ছে যে, ক্ষমতাসীন চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজএর বামপন্থী সোশালিস্ট দলের পক্ষে জনমত ২৬ শতাংশ থেকে কমে ১৮ শতাংশে নেমে এসেছে; শরীক দল ‘এফডিপি’র অর্ধেক কমে গিয়ে হয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। অপর শরীক দল ‘গ্রিন পার্টি’ও জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। অপরদিকে ‘এএফডি’র সমর্থন ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশে উঠে গেছে; যা কিনা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। অক্টোবর থেকে রাস্তায় বিক্ষোভে ‘এএফডি’র এজেন্ডা হবে ‘আমাদের দেশ আগে’; যা প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’এর সাথে মিলে যায়।

ইউরোপে মুসলিম এবং ইউক্রেনিয় খ্রিস্টান শরণার্থীদের ব্যাপারে জনমতে ব্যাপক পার্থক্য থাকলেও জ্বালানির ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মাঝে এখন যেকোন শরণার্থীই বোঝা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি মধ্যপন্থায় থাকা রাজনীতিবিদেরাও শরণার্থীদের আটকাতে বলছেন। জার্মানির বামপন্থী সোশালিস্ট কোয়ালিশন সরকার জনগণকে আশ্বাস দিতে ব্যার্থ হয়েছে যে জার্মানির নীতি সঠিক পথে রয়েছে। অন্ততঃ সিদ্ধান্তগত দিক থেকে অনিশ্চয়তা এবং নীতিগত দিক থেকে স্বাধীনভাবে চলতে না পারাটা জার্মানির জাতীয় গর্বকে আঘাত করছে। এই সুযোগটাই নিতে চাইছে ডানপন্থী গ্রুপগুলি। মধ্যপন্থী বিরোধী দলগুলিও ডানপন্থীদের শ্লোগানকে পুঁজি করাটাকেই সঠিক বলে মনে করছে। ইউরোপজুড়ে ডানপন্থী রাজনীতির জয়জয়কার দৃশ্যমান হওয়ায় জার্মানির ডানপন্থীরাও এতে আনুপ্রাণিত হয়েছে। নিজেদের দলের কর্মকান্ডের সফলতার চাইতে লিবারাল রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতাই ডানপন্থীদের বেশি সহায়তা দিয়েছে। ২০২০ সালে কট্টর ডানপন্থী দল ‘এএফডি’র মুখপাত্র ক্রিশ্চিয়ান লুথ বলেছিলেন যে, জার্মানির অবস্থা যত খারাপ হবে, ‘এএফডি’র অবস্থান তত শক্ত হবে। বোঝাই যাচ্ছে যে, আসন্ন শীতকাল ইউরোপে, তথা জার্মানিতে, পশ্চিমা লিবারাল আদর্শের জন্যে অতি শীতল পরীক্ষা নিয়ে আসতে যাচ্ছে।