Sunday 29 March 2020

করোনাভাইরাস পশ্চিমা সমাজের বৈষম্যকে কমাবে নাকি বাড়াবে?

২৯শে মার্চ ২০২০

   
করোনা ঝড়ের আগেই পশ্চিমা সমাজব্যবস্থা নিম্নবিত্তদের উপেক্ষা করেছিল; এখন সেই বৈষম্যের ফলাফলই চোখে পড়ছে।

 
ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, ব্রিটেনের অর্থনৈতিকভাবে সর্বনিম্ন স্তরের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ স্তরের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল হতে ৯ বছর কম! ব্রিটেনের উচ্চবিত্ত এলাকাগুলি থেকে যাত্রা করে নিম্নবিত্ত এলাকার দিকে যেতে থাকলেই গড় আয়ুষ্কাল এক বছর করে কমতে থাকে। খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে হৃদরোগে মৃত্যুর হার উচ্চবিত্তদের চাইতে তিনগুণ বেশি। ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট এবং বক্ষব্যাধিও নিম্নবিত্তদের মাঝে অনেক বেশি। পেনসনে থাকা ১৯ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে। করোনাভাইরাস এখন এই বৈষম্যের বাস্তবতার সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছে। উবার ড্রাইভার, ডেলিভারি সার্ভিসে থাকা মানুষগুলি, বিভিন্ন কারখানার কর্মী, পরিচ্ছন্নকর্মীদের মতো কম আয়ের মানুষগুলি একাধারে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ঝুঁকিতে যেমন পড়ছে, তেমনি অর্থনৈতিক দিক থেকেও দুর্যোগের মাঝে পতিত হতে যাচ্ছে।

‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রে কিছু মানুষ ব্যাপক মুনাফা করে নিজেদের পকেট ভরেছে; অন্যদিকে নিজেদের অর্থনৈতিক ঝুঁকিগুলিকে জনগণের কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ব্যাঙ্কগুলিকে জনগণের করের অর্থে বাঁচানো হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে ব্যাঙ্কগুলি ক্ষতি থেকে তো বের হয়েছেই; তাদের মুনাফা হয়েছে আকাশচুম্বী। অথচ পুরো সমস্যার কেন্দ্রেই ছিল ব্যাঙ্কগুলির দায়িত্বজ্ঞানহীন ঋণ ব্যবসা এবং জনগণের লগ্নীকৃত অর্থকে ব্যবহার করে জুয়া খেলা। অন্যদিকে বেশিরভাগ খেটে খাওয়া করপ্রদানকারী নাগরিকের জীবনে বিন্দুমাত্র উন্নতি আসেনি। অনেকেরই বাড়িঘর কেড়ে নেয়া হয়েছে। কম বেতনভোগী মানুষের অবস্থা সবচাইতে খারাপ হয়েছিল। এবারেও মানুষের অবস্থা খারাপের দিকে চলেছে; তবে এর গতি অনেক বেশি দ্রুত। ‘গোল্ডমান সাক্স’এর হিসেবে এপ্রিল থেকে জুনের মাঝে মার্কিন অর্থনীতি ২৪ শতাংশ কমতে পারে। আর ‘মরগ্যান স্ট্যানলি’ বলছে যে, এটা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।

মার্কিন সরকারের অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজে ভাগ বসাবার জন্যে বিভিন্ন কারখানার মালিক গ্রুপ, বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘বোয়িং’, এয়ারলাইন্স, রেস্টুর‍্যান্ট, হোটেল চেইন, ট্রাভেল অপারেটর, কয়লা খনির মালিক, মদ উৎপাদক কোম্পানি, ইত্যাদি বাণিজ্য গ্রুপগুলি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার এবং শীর্ষ এক্সিকিউটিভরাই বরাবর সুবিধা পেয়েছে; উৎপাদন বৃদ্ধি বা গবেষণালব্ধ কাজে বিনিয়োগ হয়নি। এছাড়াও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে ২ কোটি মানুষ চিকিৎসা ভাতা পায় না। লক্ষ লক্ষ নাগরিকের জন্যে চিকিৎসা সেবা সুলভ নয়। ‘মায়ামি হেরাল্ড’এর ফেব্রুয়ারি মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীন ফেরত এক আমেরিকান ফ্লুএর লক্ষণ দেখা যাবার পর একজন দায়িত্ববান নাগরিকের মতো ফ্লোরিডার হাসপাতালে যান করোনাভাইরাসের টেস্ট করাতে। টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসলেও কয়েক সপ্তাহ পর তার কাছে ৩ হাজার ২’শ ৭০ ডলারের একটা মেডিক্যাল বিল চলে আসে। তার ইন্সুর‍্যান্স কোম্পানি বলছে যে, তিনি সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪’শ ডলার ইন্সুর‍্যান্স বাবদ পেতে পারেন; বাকিটা তার নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, তার হেলথ ইন্সুর‍্যান্স রয়েছে; অনেকের আবার সেটাও নেই। ‘ইউনাইটেড স্টেটস সেনসাস ব্যুরো’র ২০১৮ সালের হিসেবে ২ কোটি ৭৫ লক্ষ মানুষ, বা যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে ৮ শতাংশ জনগণের হেলথ ইন্সুর‍্যান্সই নেই। এটা ২০১৭ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ বা ২ কোটি ৫৬ লক্ষ; অর্থাৎ এক বছরের মাঝেই ১৯ লক্ষ মানুষ হেলথ ইন্সুর‍্যান্স থেকে ঝরে পড়েছে। এর পুরোটাই হয়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আগেই। ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস’এর এক সম্পাদকীয়তে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে ইন্সুর‍্যান্সএর মাঝে থাকা ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম ইন্সুর‍্যান্স পেয়ে থাকে। মেডিক্যাল খরচার অনেকটাই তাদের নিজ পকেট থেকে দিতে হয়।

উপরন্তু, মার্কিন সেক্রেটারি অব হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিসেস এলেক্স আজার বলছেন যে, করোনাভাইরাসের কোন ভ্যাকসিন বের হলেও সেটার সুবিধা সকলে পাবে, এই নিশ্চয়তা তিনি দিতে পারছেন না। মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘গ্যালাপ’এর ২০১৯ সালের এক জরিপে বলা হচ্ছে যে, জরিপে অংশ নেয়া জনগণের ১৩ শতাংশ বলছেন যে, গত ৫ বছরের মাঝে তাদের পরিচিত কেউ না কেউ অর্থের অভাবে চিকিৎসা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করেছেন। এর মাঝে শ্বেতাঙ্গ মানুষের মাঝে এই হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ; আর অশ্বেতাঙ্গদের মাঝে তা ছিল ২০ শতাংশের বেশি; অর্থাৎ দ্বিগুণ! বার্ষিক ১ লক্ষ ডলারের বেশি আয়ের মানুষের মাঝে এই হার ছিল ৯ শতাংশ; আর ৪০ হাজার ডলারের কম আয়ের মানুষের মাঝে ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ; অর্থাৎ দ্বিগুণ!

‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ফেইসবুক, গুগল ও টুইটারএর মতো কোম্পানিগুলি নিজেদের কর্মচারীদেরকে বাড়ি থেকে কাজ করতে বলেছে। কিন্তু হোটেল ও রেস্টুর‍্যান্টে ওয়েটারের কাজ বা সুপারস্টোরে সেলসম্যানের কাজ বা বাড়িতে পণ্য পৌঁছে দেয়ার কাজ তো আর বাড়িতে বসে করা যাবে না। কলেজ পাস উচ্চশিক্ষিত মানুষের অনেকেই বাড়ি থেকে কম্পিউটারে কাজ করতে পারছে; অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত মানুষের অনেকেই কাজের অভাবে বাড়িতে বসে দিন কাটাচ্ছে। সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা মানুষগুলির অনেকের জন্যেই মানুষের সংস্পর্শে আসাটা বাঞ্ছনীয়। আর করোনাভাইরাসের কারণে এই মানুষগুলি রোগের শিকারও হচ্ছে বেশি; আবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে এরাই উপার্জন ছাড়া বাড়িতে বসে থাকছে। শুধু তা-ই নয়, ‘দ্যা আটলান্টিক’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, কম আয়ের জনগণ বাস করছে গাদাগাদি করে; যার ফলে তাদের মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকছে।

করোনাভাইরাস পশ্চিমা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যকে সরাসরি আঘাত করেছে। এর ফলশ্রুতিতে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে নিম্ন আয়ের মানুষগুলি, যাদের হেলথ ইন্সুর‍্যান্স নেই বা থাকলেও তা অপ্রতুল। উচ্চবিত্ত এবং উচ্চশিক্ষিত জনগণের মাঝে অনেকেই বাড়িতে থেকে কাজ করে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষগুলি আশাহীন হয়ে পড়েছে। তাদেরকে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বড় বড় কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার এবং এক্সিকিউটিভদের সাথে। করোনা ঝড়ের আগেই পশ্চিমা সমাজব্যবস্থা নিম্নবিত্তদের উপেক্ষা করেছিল; এখন সেই বৈষম্যের ফলাফলই চোখে পড়ছে।


Sunday 22 March 2020

সারাবিশ্ব আজ যুদ্ধাবস্থায়; বাংলাদেশ কি করবে?

২৩শে মার্চ ২০২০


ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্রিটেনকে যুদ্ধাবস্থায় নিয়ে যাবার ঘোষণা দেন। ব্রিটিশ ইঞ্জিন ম্যানুফ্যাকচারার ‘রোলস রয়েস’ এবং কন্সট্রাকশন যন্ত্রপাতির ম্যানুফ্যাকচারার ‘জেসিবি’কে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যায় থাকা রুগীদের জন্যে ‘ভেন্টিলেটর’ যন্ত্র বানাবার অনুরোধ করেন তিনি।


পশ্চিমা বিশ্বে যুদ্ধাবস্থা

১৪ই মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্রিটেনকে যুদ্ধাবস্থায় নিয়ে যাবার ঘোষণা দেন। তিনি ব্রিটিশ ইঞ্জিন ম্যানুফ্যাকচারার ‘রোলস রয়েস’ এবং কন্সট্রাকশন যন্ত্রপাতির ম্যানুফ্যাকচারার ‘জেসিবি’কে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যায় থাকা রুগীদের জন্যে ‘ভেন্টিলেটর’ যন্ত্র বানাবার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন যে, তাদের পিতামহরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমস্ত জাতীয় সম্পদকে যুদ্ধের পিছনে নিয়োজিত করেছিল। আজকে তাদের জেনারেশন করোনাভাইরাসের মতো অন্য ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। [১] ‘রোলস রয়েস’এর এক মুখপাত্রকে এধরনের কাজ করা সম্ভব কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, সরকার নিজেদের পরিকল্পনা করলে তারা নিজেদের সাধ্যমতো সরকার এবং দেশকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। [৩] ২২শে মার্চ মার্কিন ‘ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিসট্রেশন’ বা ‘এফডিএ’ ঘোষণা দেয় যে, তারা ‘ভেন্টিলেটর’ যন্ত্র তৈরি করার জন্যে মার্কিন সরকারের যেসকল বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা শিথিল করতে যাচ্ছে, যাতে করে নতুন কিছু কোম্পানি ‘ভেন্টিলেটর’ তৈরি করার জন্যে এগিয়ে আসতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘ফোর্ড’, ‘জেনারেল মোটরস’ এবং ‘টেসলা’কে ‘ভেন্টিলেটর’ এবং অন্যান্য মেটাল প্রডাক্ট অতি দ্রুত বানানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। দেখা যাক গাড়ি নির্মাতারা কতটুকু সক্ষম! ‘আমেরিকান হসপিটাল এসোসিয়েশন’এর হিসেবে করোনাভাইরাসের কারণে ৯ লক্ষ ৬০ হাজার মার্কিন নাগরিককে ‘ভেন্টিলেটর’ দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হতে পারে। [২] ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নিজেদেরকে যুদ্ধাবস্থায় উপনীত করেছে। এর অর্থ হলো, তারা নিজেদের জাতীয় সম্পদের সবকিছু বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিয়োজিত করেছে। এক্ষেত্রে তারা শুধু বিপদ অনুধাবনই করেনি; এমতাবস্থায় কি করতে হবে, সেটা দ্রুত নির্ধারণ করেছে। পশ্চিমা আদর্শিক রাষ্ট্রগুলির আদর্শ সাম্প্রতিক সময়ে যতটাই দুর্বল হোক না কেন, কঠিন সময়ে তাদের কর্মদক্ষতাকে ব্যবহার করতে পারার মতো কাজগুলি বলে দেয় যে, তারা এখনও আদর্শিক শক্তি।

মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘জেনারেল মোটরস’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কামান এবং ট্যাঙ্ক তৈরি করেছিল। আর আজকে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তারা চীনের ‘সাইক মোটরস’এর সাথে যৌথভাবে চীনের লিউঝৌ শহরে সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরিতে মনোনিবেশ করেছে। শুধু তাই নয়, একসময় যেসকল কারখানা আইফোন, কসমেটিকস বা কেমিক্যাল তৈরি করতো, তারা এখন সার্জিক্যাল মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং মেডিক্যাল সাপ্লাই তৈরি করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। [৩] ১৫ই মার্চ ফ্রান্সের লাক্সারি গুডস ম্যানুফ্যাকচারার ‘এলভিএমএইচ’, যারা ‘লুই ভুইতঁ’, ‘ক্রিশ্চিয়ান দিয়র’ ও ‘গিভেঞ্চি’র মতো ব্র্যান্ডগুলির মালিক, তারা ঘোষণা দেয় যে, পারফিউম এবং কসমেটিক্স তৈরির কারখানাগুলি এখন থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করবে। ‘এলভিএমএইচ’ তাদের এক বার্তায় বলে যে, যত বেশি সম্ভব মানুষকে সুরক্ষা দিতেই চেষ্টা করছে তারা। কোম্পানির মুখপাত্র ‘ফরচুন’ ম্যাগাজিনের সাথে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, ‘হাইড্রো এলকোহলিক জেল’ তৈরির জন্যে সকল সক্ষমতাই তাদের রয়েছে এবং তারা প্রথম সপ্তাহেই ১২ টন তৈরি করার চিন্তা করছে এবং ১৬ই মার্চ থেকেই তারা উৎপাদনে নেমে গিয়েছে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘এলভিএমএইচ’ তাদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ফরাসী কর্তৃপক্ষকে দিচ্ছে, যারা বিভিন্ন হাসপাতালে এগুলি দেবার ব্যবস্থা নিচ্ছেন। [৩] মদ তৈরির কোম্পানিগুলিও নেমেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে; কারণ এলকোহল উৎপাদন করার কারণে তাদের জন্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করাটা বেশ সহজ। [৬]

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘জনতার যুদ্ধ’এর ডাক দেন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে আড়াই হাজার চীনা কোম্পানি মাস্ক তৈরিতে নেমেছে! ‘এপল’এর ডিভাইসের ম্যানুফ্যাকচারার ‘ফক্সকন’ ফেব্রুয়ারির শুরুতে ঘোষণা দেয় যে, নতুন চালু করা ‘আইফোন’ কারখানায় তারা মাস্ক তৈরি করবে। বর্তমানে চীনে মাস্ক তৈরি করা আড়াই হাজার কোম্পানির মাঝে ৭’শ রয়েছে টেকনলজি কোম্পানি, যার মাঝে রয়েছে ‘ফক্সকন’, ‘শাওমি’ এবং ‘অপ্পো’।

 

চীনে যুদ্ধাবস্থা

তবে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীন প্রথম যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করেছিল। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘জনতার যুদ্ধ’এর ডাক দেন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে আড়াই হাজার চীনা কোম্পানি মাস্ক তৈরিতে নেমেছে! ‘এপল’এর ডিভাইসের ম্যানুফ্যাকচারার ‘ফক্সকন’ ফেব্রুয়ারির শুরুতে ঘোষণা দেয় যে, নতুন চালু করা ‘আইফোন’ কারখানায় তারা মাস্ক তৈরি করবে। চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘সিনোপেক’ তাদের একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিকে ফেস মাস্ক এবং অন্যান্য মেডিক্যাল সাপ্লাইয়ের কাঁচামাল তৈরির জন্যে প্রস্তুত করে ফেলে। [৩] তারা জানুয়ারিতে পলিপ্রোপাইলিন বা পিপি এবং পলিভিনাইল ক্লোরাইড বা পিভিসির দু’টা প্ল্যান্ট তৈরি করে। মার্চের শুরুতে তারা বেইজিংএ দৈনিক ৪ টন ক্ষমতার ‘মেল্ট ব্লোউন নন উভেন ফ্যাব্রিক’ তৈরির দু’টা প্রোডাকশন লাইন প্রস্তুত করে, যা দিয়ে প্রতিদিন ১২ লক্ষ ‘এন ৯৫’ ‘রেসপিরেটর’ মাস্ক বা ৬০ লক্ষ সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরি করা যাবে। [৫] আর ১৩ই মার্চ চীনা ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির কোম্পানি ‘বিওয়াইডি’ ঘোষণা দেয় যে, তারা এখন দৈনিক ৫০ লক্ষ মাস্ক এবং ৩ লক্ষ বোতল জীবাণুনাশক তৈরি করছে। তারা তাদের এই উৎপাদনযজ্ঞ শুরু করে ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে। তারা এই উৎপাদনের জন্যে এমন কিছু কাজ দুই সপ্তাহের মাঝেই করে ফেলে, যা কিনা সাধারণভাবে দুই মাস লাগার কথা। তারা এক সপ্তাহের মাঝেই মাস্ক তৈরির যন্ত্র এবং প্রসেস ডেভেলপ করে ফেলে। একইসাথে তারা মেডিক্যাল গ্রেডের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ডেভেলপ করে ফেলে ৬ দিনের মাঝে; যা তারা উহানের হাসপাতালগুলিকে ৮ দিনের মাথায় সরবরাহ করে! শুধু তাই নয়, তারা প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ১০টা মাস্ক তৈরির যন্ত্র তৈরি করতে থাকে! এর ফলে প্রতিদিন তাদের উৎপাদনক্ষমতা ৩ থেকে ৫ লক্ষ ইউনিট বাড়তে থাকে! ফেব্রুয়ারির শুরুতে পুরো চীনের মাস্ক তৈরির ক্ষমতার চার ভাগের একভাগ ছিল ‘বিওয়াইডি’এর। [৪]

করোনাভাইসের সংক্রমণ শুরু হবার আগে চীনের মাস্ক তৈরির সক্ষমতা ছিল দৈনিক ২ কোটি পিস। ২৯শে ফেব্রুয়ারি নাগাদ তা ১১ কোটি ৬০ লক্ষে পৌঁছায়। এই কোটি মাস্কের মাঝেই একটা গল্প বলছে ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’। গুয়াংঝুতে অবস্থিত লিউ ফ্যামিলির কারখানায় গত ১০ বছর ধরেই তৈরি হচ্ছিল ডায়াপার এবং বেবি প্রডাক্ট। ফুজিয়ান প্রদেশে তাদের কারখানায় ১’শ লোক কাজ করতো; যেখানে তারা প্রতিদিন ২ লক্ষ মাস্ক তৈরি করা শুরু করে। যদিও সিদ্ধান্তটা বাণিজ্যিকই ছিল; তথাপি সরকার বিভিন্ন সাবসিডি, ট্যাক্স বেনেফিট, ইন্টারেস্ট ফ্রি লোন, ইত্যাদি সহায়তা দেয়ায় কাজ সহজ হয়ে যায়। অস্ট্রিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ‘আনদ্রিতস’এর ‘ওয়েট ওয়াইপস’ তৈরির যন্ত্রের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। তাদের চীন অফিসের প্রেসিডেন্ট থমাস স্মিটসএর মতে, চীনের সবচাইতে বড় ব্যাপার হলো গতি। যখন কারুর দৌড়াবার প্রয়োজন হয়, তখন সে জানে যে কি করে দৌড়াতে হয়! [৫] চীনা ‘জে ২০’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘চেংডু এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপ’ তাদের কারখানার কিছু অংশকে মাস্ক তৈরি প্রোডাকশন লাইন ডিজাইনে কাজে লাগায়। ‘দ্যা সিচুয়ান ডেইলি’ বলছে যে, কোম্পানির ২’শ ৫৮ জন ইঞ্জিনিয়ার মাত্র ৩ দিনের মাঝে একটা এসেম্বলি লাইন ডেভেলপ করে ফেলে, যা তৈরির জন্যে ১২’শ কম্পোনেন্ট দরকার ছিল। [৫] বর্তমানে চীনে মাস্ক তৈরি করা আড়াই হাজার কোম্পানির মাঝে ৭’শ রয়েছে টেকনলজি কোম্পানি, যার মাঝে রয়েছে ‘ফক্সকন’, ‘শাওমি’ এবং ‘অপ্পো’। ইতালি সরকার বলে যে, তারা চীনের কাছ থেকে ১ হাজার ‘ভেন্টিলেটর’, ২০ লক্ষ মাস্ক, ১ লক্ষ ‘রেস্পিরেটর’, ২ লক্ষ প্রোটেকটিভ স্যুট এবং ৫০ হাজার করোনাভাইরাস টেস্টিং কিট আমদানি করছে। [৫]


বাংলাদেশ এতকাল কতটা উন্নয়ন করেছে, তার পরীক্ষা হবে আজ! বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সক্ষমতা যদি এই রোগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা না যায়, তাহলে গত দুই দশকের সকল অর্থনৈতিক অগ্রগতি মুহুর্তের মাঝে ধূলায় মিশে যাবে! বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পে দুনিয়ায় এতটা এগিয়ে থাকার পরেও ‘পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট’ বা ‘পিপিই’ তৈরি করতে পারবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মাল্টিবিলিয়ন ডলারের এই ইন্ডাস্ট্রি দুর্যোগের সময় অথর্ব হয়ে বসে থাকবে, এটা মেনে নেয়া যায়না।



বাংলাদেশের জন্যে করণীয়

বাকি বিশ্বের যুদ্ধাবস্থার উদাহরণ যদি এখনই বাংলাদেশের জন্যে উদাহরণ হিসেবে না আসে, তাহলে অতি শীঘ্রই দেশ মহাবিপদের মাঝে পতিত হতে পারে। সকলকিছুর জন্যেই চীনের সরণাপন্ন হওয়াটা সকল দেশের জন্যেই জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেটা প্রকাশ পায় উহানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝ দিয়ে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে যে, এই মুহুর্তে জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে তাদের কি করতে হবে। ইতালি অসহায়ের মতো চীনের দিকেই তাকিয়েছে। এই ভাইরাস মোকাবিলায় ইতালি কতটা অপ্রস্তুত ছিল, তা বোঝাই যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জন্যে করণীয় কাজগুলি সহজেই অনুমেয়। যুদ্ধাবস্থায় যা যা করা দরকার তাই করতে হবে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা শুধু ‘যুদ্ধাবস্থা’ উচ্চারণ করেই থেমে যাবেন, তা হতে পারে না। বাকি বিশ্বের অবস্থা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এই ভাইরাস কি করতে সক্ষম। এর থেকে শিক্ষা না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

এই রোগের প্রথম দিক হলো এটা ভীষণ ছোঁয়াচে। কোয়ার‍্যান্টাইন হলো ছোঁয়াচে রোগের বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিরোধ। কিন্তু সেই ব্যাপারটা মানা হয়নি একেবারেই। আক্রান্ত দেশগুলি থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছে বাংলাদেশে। আক্রান্ত এলাকা ত্যাগ করে অন্য এলাকায় রোগ ছড়িয়ে দেয়া ইসলাম বহির্ভূত কাজ। রাসূল (সাঃ) বলেন,

“প্লেগ শাস্তির প্রতিক। মহীয়ান গরীয়ান আল্লাহ তায়ালা তা দ্বারা তাঁর বান্দাদের কতিপয় ব্যক্তিকে পরীক্ষায় ফেলেছেন। তাই কোনো অঞ্চলে এর প্রভাবের খবর পেলে, তোমরা সেথায় যেয়ো না এবং কোনো অঞ্চলে অবস্থানকালে সেখানে প্লেগ লক্ষ্য করলে সেখান থেকে পালিয়ে যাবে না”। মুসলিম ৫৬৬৬-(৯৩/…)

আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সাঃ)-কে প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, উত্তরে তিনি বলেনঃ “এটি এক ধরনের আযাব। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের প্রতি ইচ্ছা করেন, তাঁদের উপর তা প্রেরন করেন। আর আল্লাহ তায়ালা তাঁর মু’মিন বান্দাগনের উপর তা রহমত করে দিয়েছেন। অতএব কোনো ব্যক্তি যখন প্লেগ রোগে আক্রান্ত যায়গায় সাওয়াবের আশায় ধৈর্যধারন করে অবস্থান করে এবং অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, আল্লাহ তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন তা-ই হবে, এছাড়া আর কোনো বিপদ তার উপর আসবে না, তাহলে সে একজন শহীদের সমান সাওয়াব পাবে’” বুখারী ৩৪৭৪, ৫৭৩৪, ৬৬১৯।


দেশের মাঝে যে এলাকায় এই রোগ দেখা দেবে, সেই এলাকাটাকে কোয়ার‍্যান্টাইন করা যেতে পারে। তবে এই কাজ করতে রাষ্ট্রের সকল শক্তি নিয়োগ করতে হবে। পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনীকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় মোতায়েন করে এই কোয়ার‍্যান্টাইন কার্যকর করা যেতে পারে। কোয়ার‍্যান্টাইনের সময় ঐ এলাকায় খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দরকারি রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিতে হবে। এই কাজে যারা নিয়োজিত থাকবে, তাদেরকে দরকারমতো ‘পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট’ বা ‘পিপিই’, জীবাণুনাশক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, ইত্যাদি দিতে হবে।


দ্বিতীয়তঃ এই রোগের এখনও নিশ্চিত কোন চিকিৎসা নেই। কাজেই আপাততঃ কোয়ার‍্যান্টাইন করা ছাড়া কোন প্রতিরোধই নেই এর বিরুদ্ধে। যেহেতু আক্রান্ত দেশগুলি থেকে ইতোমধ্যেই লাখো মানুষ ডেকে নিয়ে আসার মতো মারাত্মক ভুল হয়েই গেছে, তাই সেব্যাপারে এখন কথা বলার কিছু নেই। তবে দেশের মাঝে যে এলাকায় এই রোগ দেখা দেবে, সেই এলাকাটাকে কোয়ার‍্যান্টাইন করা যেতে পারে। তবে এই কাজ করতে রাষ্ট্রের সকল শক্তি নিয়োগ করতে হবে। পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনীকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় মোতায়েন করে এই কোয়ার‍্যান্টাইন কার্যকর করা যেতে পারে। কোয়ার‍্যান্টাইনের সময় ঐ এলাকায় খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দরকারি রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিতে হবে। এই কাজে যারা নিয়োজিত থাকবে, তাদেরকে দরকারমতো ‘পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট’ বা ‘পিপিই’, জীবাণুনাশক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, ইত্যাদি দিতে হবে।

এখন পর্যন্ত নিশ্চিত প্রতিষেধক নেই বলে রুগীকে সুস্থ্য হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেবা দিয়ে যেতে হবে। বাকি বিশ্বের হিসেব দেখলে বোঝা যাবে যে, এই রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই সুস্থ্য হয়ে ওঠে। আগে থেকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম না হলে সে নিশ্চিতভাবেই সুস্থ্য হয়ে যায়। কাজেই একজন মানুষ আক্রান্ত হলে তার কোয়ার‍্যান্টাইন ‘মিলিটারি প্রিসিশন’এর মাধ্যমে করতে হবে, যাতে অন্য কারুর মাঝে না ছড়ায়; বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা রয়েছে, তাদের সংস্পর্শে যাতে কিছুতেই না আসে, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। পশ্চিমা মূল্যবোধের মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা ইতালি এবং বাকি ইউরোপের জন্যে কি বয়ে এনেছে, তা এখন সকলেরই জানা। এসময় কোন প্রকারের দুর্বলতা সারা জাতির জন্যে মহাদুর্যোগ বয়ে আনতে পারে।

তৃতীয়তঃ যেহেতু এই রোগ শ্বাসপ্রশ্বাস, হাঁচি কাশির মাধ্যমে ছড়ায়, তাই এই রোগ প্রতিরোধে ফ্রন্টলাইনে থাকবে ‘পিপিই’, জীবাণুনাশক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, ইত্যাদি। পশ্চিমা বিশ্ব এবং চীন যেভাবে যুদ্ধাবস্থায় উপনীত হয়েছে, বাংলাদেশকেও সেটাই করতে হবে। যদি সেটা না-ই করা সম্ভব হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধুর ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল... তোমাদের যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো” কথাগুলি মূল্যহীন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ এতকাল কতটা উন্নয়ন করেছে, তার পরীক্ষা হবে আজ! বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সক্ষমতা যদি এই রোগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা না যায়, তাহলে গত দুই দশকের সকল অর্থনৈতিক অগ্রগতি মুহুর্তের মাঝে ধূলায় মিশে যাবে! বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্পে দুনিয়ায় এতটা এগিয়ে থাকার পরেও ‘পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট’ বা ‘পিপিই’ তৈরি করতে পারবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মাল্টিবিলিয়ন ডলারের এই ইন্ডাস্ট্রি দুর্যোগের সময় অথর্ব হয়ে বসে থাকবে, এটা মেনে নেয়া যায়না।

জীবাণুনাশক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার এমন কোন জিনিস নয় যে এটা তৈরি করা যাবে না।জীবাণুনাশক হিসেবে ব্লিচিং পাউডার বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। একটা বড় এলাকা জীবাণুমুক্ত করতে হলে ব্যাপক পরিমাণে ব্লিচিং পাউডারের দরকার হবে। বাংলাদেশে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড বা কস্টিক সোডা ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট আছে বেশ কয়েকটা। ‘ক্লোর এলকালি প্ল্যান্ট’ বলে পরিচিত এই কারখানাগুলি ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইট বা ব্লিচিং পাউডার তৈরি করে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করাটাও খুব কঠিন নয়। এলকোহল বেইজড হ্যান্ড স্যানিটাইজারে মূলতঃ ব্যবহৃত হয় ইথাইল এলকোহল অথবা আইসোপ্রোপাইল এলকোহল। আর একলোহল ছাড়া স্যানিটাইজারে ব্যবহৃত হয় বেনজালকোনিয়াম ক্লোরাইড। [৭] বাংলাদেশের কর্পোরেট হাউজগুলি কি সারাজীবন মুনাফার পিছনেই ছুটবে, নাকি দুর্যোগের সময় ‘ইউনিলিভার’এর মতো মাল্টিন্যাশনালের হাতে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ছেড়ে দিয়ে পালাবে?

‘এন ৯৫’ মাস্ক এবং ‘ভেন্টিলেটর’ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কঠিন জিনিস। কিন্তু এটাই কি সময় নয় নিজেদের সক্ষমতাকে দেখাবার? এখন না দেখালে কখন দেখাবে? পশ্চিমা বাজার ধরে অর্থ উপার্জনের জন্যে বাংলাদেশের কর্পোরেট হাউজগুলি দুনিয়ার সর্বশেষ প্রযুক্তি আমদানি করেছে। আজকে মানুষের জীবন বাঁচাতে সেটা করতে কেন কার্পণ্য করবে? সক্ষমতা থাকার পরেও যারা এসময় মানুষের পাশে দাঁড়াবে না, তারা একসময় সকলকিছু হারাবে। আর আল্লাহও তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ যাদেরকে সক্ষমতা দিয়েছেন, তাদেরকে সবচাইতে বেশি জবাবদিহিতা করতে হবে।

“অনন্তর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে (জবাবদিহি) ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস”। (সূরা আন নাযিয়াত‌, আয়াত: ৪০)



----------------------------
[১] ‘UK coronavirus: Boris puts industry on war footing to build ventilators amid outbreak’, Express, 15 March 2020
[২] ‘GM, Tesla tackle ventilator shortage amid coronavirus pandemic’, USA Today, 22 March 2020
[৩] ’Masks and hand sanitizer replace iPhones and perfume: Firms redeploy factories to make coronavirus supplies’, Fortune, 17 March 2020
[৪] ‘BYD Opens World’s Largest Face Mask Manufacturing Plant’, BYD Global Press Release, 13 March 2020
[৫] ‘Coronavirus: China’s mask-making juggernaut cranks into gear, sparking fears of over-reliance on world’s workshop’, South China Morning Post, 12 March 2020
[৬] ’Distilleries Race to Make Hand Sanitizer Amid Coronavirus Pandemic’, The New York Times, 19 March 2020
[৭] ‘Fact check: No, hand sanitizer won't harm your pets if they lick your hand after you use it’, USA Today, 20 March 2020


Saturday 21 March 2020

করোনাভাইরাস পশ্চিমা পুঁজিবাদকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে!

২১শে মার্চ ২০২০

 
জীবনরক্ষাকারী রিএজেন্ট, ওষুধ ও যন্ত্রের উপর মালিকানার স্বাধীনতা এবং যেকোন দ্রব্য যেকোন মুনাফায় বিক্রি করার মতো চিন্তাগুলি করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক দুর্যোগের মাঝে পশ্চিমা মানবাধিকারের চিন্তার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, যা কিনা পশ্চিমা সভ্যতার মূলেই আঘাত করছে।



১১ই মার্চ মার্কিন ‘ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন’ বা ‘এফডিএ’এর কমিশনার স্টিফেন হান মার্কিন কংগ্রেসকে বলেন যে, ‘এফডিএ’ জানে যে, নভেল করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার জন্যে যেসকল কেমিক্যাল বা রিএজেন্ট দরকার, সেগুলির সরবরাহের উপর চাপ পড়েছে। মেডিক্যাল ম্যাগাজিন ‘মেডটেক ডাইভ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রিএজেন্ট সরবরাহকারী কোম্পানি ‘কিয়াজেন’ বলছে যে, তারা করোনাভাইরাসের ভীষণ চাহিদার কারণে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হিমসিম খাচ্ছে। মার্কিন চাহিদা বাড়ার কারণে কোম্পানিটা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যন্ডের জার্মানটাউনে তাদের উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। ‘কিয়াজেন’ হলো মেডিক্যাল গবেষণার জন্যে কেমিক্যাল ও রিএজেন্ট সরবরাহকারী কোম্পানি, যাদের বাৎসরিক আয় দেড় বিলিয়ন ডলারের উপর। এর হেডকোয়ার্টার্স হলো নেদারল্যান্ডস ও জার্মানিতে; এবং এর কর্মচারীর সংখ্যা ৫ হাজারের মতো। ‘ইয়াহু ফিনান্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত ছয় মাসে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে মেডিক্যাল কোম্পানিগুলির স্টকের মূল্য যেখানে ৪ শতাংশ কমেছে, সেখানে ‘কিয়াজেন’এর শেয়ারের মূল্য বেড়েছে ১৪ শতাংশ। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের কারণে স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যাপক দরপতনের মাঝেও এর মূল্য বেড়েছে।

মার্কিন ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’ বা ‘সিডিসি’ করোনাভাইরাসের টেস্টিং কিটের জন্যে ছয়টা রিএজেন্টের নাম উল্লেখ করেছে, যার মাঝে ‘কিএম্প ডিএসপি’, ‘এজেড ১’ এবং ‘কিএকিউব’ তৈরি করছে ‘কিয়াজেন’। এর বাইরেও কোম্পানিটা ‘কিএসট্যাট ডিএক্স’ নামের একটা টেস্ট কিট বাজারে ছেড়েছে। ‘সিডিসি’র অনুমতিপ্রাপ্ত বাকি তিনটা রিএজেন্ট হলো ‘রোশ’ কোম্পানির ‘ম্যাগনা পিউর এলসি’, ‘ম্যাগনা পিউর কমপ্যাক্ট’ এবং ‘ম্যাগনা পিউর ৯৬’। ব্যাবসায়িক ম্যাগাজিন ‘ইনভেস্টর্স বিজনেস ডেইলি’ এক প্রতিবেদনে বলছে যে, মার্কিন ‘এফডিএ’এর কাছ থেকে করোনাভাইরাসের টেস্টিংএর জন্যে পণ্য সরবরাহের অনুমতি পাবার পর ১৩ই মার্চ ‘রোশ’এর শেয়ারের মূল্য এক দিনেই ১৩ শতাংশ বেড়ে যায়। ‘রোশ’ বা ‘ফ্রিতস হফম্যান লা রোশ’ ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত একটা বহুজাতিক মেডিক্যাল কোম্পানি, যার হেডকোয়ার্টার্স হলো সুইজারল্যান্ডে। এর বাৎসরিক আয় প্রায় ৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং কর্মচারীর সংখ্যা ৯৪ হাজারের উপর। অন্যদিকে এই রিএজেন্টগুলি মার্কিন বাজারে সরবরাহের অনুমতি পেয়েছে ‘ইনটেগ্রেটেড ডিএনএ টেকনলজিস’ এবং ‘বায়োরিসার্চ টেকনলজিস’ নামের দু’টা মাত্র কোম্পানি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সংস্থা ‘দ্যা ইন্টারসেপ্ট’ বলছে যে, করোনাভাইরাসের আতঙ্ক শুরুর পর থেকে প্রভাবশালী ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কগুলি মেডিক্যাল কোম্পানিগুলির উপর করোনাভাইরাসের ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির জন্যে চাপ দিচ্ছে। এমনই একটা কোম্পানি হলো ‘গিলিয়াড সাইন্সেস’। ১৯৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত এই বায়োটেকনলজি কোম্পানির বাৎসরিক আয় ২২ বিলিয়ন ডলার এবং কর্মচারী ১১ হাজারের মতো। ‘গিলিয়াড’এর ডেভেলপ করা ‘রেমডেসিভির’ নামক এন্টিভাইরাল ড্রাগ ‘ডেঙ্গু’, ‘ওয়েস্ট নাইল’ ভাইরাস, ‘জিকা’ ভাইরাস, ‘মার্স’ ভাইরাস এবং ‘সার্স’ ভাইরাসের চিকিৎসার জন্যে ব্যবহৃত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথায়, এই ‘রেমডেসিভির’ই হলো একমাত্র ওষুধ যেটা করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা গেলে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই কথা বলার সাথেসাথেই গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি ‘গিলিয়াড’এর শেয়ারের মূল্য এক দিনে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে গিয়ে ২০১৮ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ মূল্যে পৌঁছায়। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ‘গিলিয়াড’এর বাজারমূল্য ১২ বিলিয়ন ডলার বেড়ে যায়। ‘ব্যাংক অব আমেরিকা’র বিশ্লেষকদের মতে, ‘রেমডেসিভির’ বিক্রি করে কোম্পানিটার এককালীন আড়াই বিলিয়ন ডলার আয় আসতে পারে।
  
 
ইতালির এক তরুন ইঞ্জিনিয়ার ক্রিশ্চিয়ান ফ্রাকাসি হাসপাতালে ‘ভেনচুরি’ ভালভ নামে পরিচিত একটা যন্ত্রের অপ্রতুলতার কথা শুনে ‘থ্রিডি প্রিন্টার’এর সাহায্যে যন্ত্রটার ১’শটা কপি করার ব্যবস্থা করেন। এই যন্ত্রের প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘ইন্টারসার্জিক্যাল’এর কাছ থেকে যন্ত্রটার ব্লুপ্রিন্ট চাওয়া হলে তারা তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলে যে, এই যন্ত্রের স্বত্ব শুধুমাত্র তাদের কোম্পানির এবং অন্য কারুর এই যন্ত্র কপি করাটা বেআইনী। কোম্পানিটা এমন এক সময়ে তার যন্ত্রের ডিজাইন দিতে অস্বীকৃতি জানালো, যখন বাস্থ্যসেবা, ওষুধ এবং যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার মাঝে সর্বোচ্চ কত বয়স পর্যন্ত রুগীকে চিকিৎসা দেয়া হবে, সেব্যাপারেও ডাক্তারদের চিন্তা করতে বলা হয়েছে।




অন্যদিকে বিপুল সখ্যক আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে অক্সিজেন দেবার জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইতালির এক তরুন ইঞ্জিনিয়ার ক্রিশ্চিয়ান ফ্রাকাসি এবং তার সহযোগী আলেসান্দ্রো রোমাইওলি ইতালির উত্তরে মিলানের কাছাকাছি চিয়ারি শহরের এক হাসপাতালে ‘ভেনচুরি’ ভালভ নামে পরিচিত একটা যন্ত্রের অপ্রতুলতার কথা শুনে ‘থ্রিডি প্রিন্টার’এর সাহায্যে যন্ত্রটার ১’শটা কপি করার ব্যবস্থা করেন; আর এই কাজের জন্যে খরচ হয় নামমাত্র; যেখানে এই যন্ত্রের অরিজিনাল ভার্সনের মূল্য কয়েক হাজার ডলার। হাসপাতালের ডাক্তাররা বলছেন যে, কপি করা মূল্যহীন এই যন্ত্র মুমুর্ষু রোগীর জন্যে অমূল্য সেবা দিচ্ছে। এই যন্ত্রের প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘ইন্টারসার্জিক্যাল’এর কাছ থেকে যন্ত্রটার ব্লুপ্রিন্ট চাওয়া হলে তারা তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলে যে, এই যন্ত্রের স্বত্ব শুধুমাত্র তাদের কোম্পানির এবং অন্য কারুর এই যন্ত্র কপি করাটা বেআইনী। ১৯৮২ সালে স্থাপিত হওয়া ‘ইন্টারসার্জিক্যাল’এর হেডকোয়ার্টার্স হলো ব্রিটেনে। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় আক্রান্ত রুগীদের জন্যে কোম্পানিটা বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে থাকে। বর্তমানে এর কর্মচারী ৩ হাজারের বেশি। কোম্পানিটা এমন এক সময়ে তার যন্ত্রের ডিজাইন দিতে অস্বীকৃতি জানালো, যখন ইতালির কলেজ ‘এসআইএএআরটি’ স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধ এবং যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার মাঝে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে যাদের বাঁচার সম্ভাবনা বেশি, শুধু তাদেরকেই চিকিৎসা দেবার জন্যে গাইডলাইন দিয়েছে। এমনকি সর্বোচ্চ কত বয়স পর্যন্ত রুগীকে চিকিৎসা দেয়া হবে, সেব্যাপারেও ডাক্তারদের চিন্তা করতে বলেছে।

রিএজেন্ট, ওষুধ বা যন্ত্রপাতি ছাড়াও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সকলকিছুরই মারাত্মক স্বল্পতা চলছে। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই চলছে ব্যবসা এবং মুনাফার দৌরাত্ম। সামরিক পত্রিকা ‘এয়ারফোর্স টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, মার্কিন বিমান বাহিনীর এক প্রাক্তন সদস্য ১৭ হাজার বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করেন। তারই মতো আরেকজন সাড়ে ৩ ডলার দামে ২ হাজার জীবনরক্ষাকারী কিট নিনে ৪০ ডলার করে বিক্রি করেছেন। ‘এনবিসি নিউজ’ আড়াই’শ মেডিক্যাল কর্মীর উপর করা এক গবেষণার ফলাফলের বরাত দিয়ে বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে বহু মেডিক্যাল কর্মী কোন মাস্ক বা জীবাণুনাশক ছাড়াই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন। ‘পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট’ বা ‘পিপিই’ এখন মারাত্মক স্বল্পতায় রয়েছে। চাকুরি হারাবার ভয়ে নিজের নাম পরিচয় গোপন করা মিশিগানের এক নার্স বলছেন যে, তার মনে হয় না যে তাদের হাসপাতাল তাদের ব্যর্থতার কারণ; বরং পুরো ব্যবস্থাটাই এখন ব্যর্থ! মিশিগানের নার্সের মন্তব্য পুঁজিবাদের গোড়ার সমস্যাকেই তুলে ধরে। জীবনরক্ষাকারী রিএজেন্ট, ওষুধ ও যন্ত্রের উপর মালিকানার স্বাধীনতা এবং যেকোন দ্রব্য যেকোন মুনাফায় বিক্রি করার মতো চিন্তাগুলি করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক দুর্যোগের মাঝে পশ্চিমা মানবাধিকারের চিন্তার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, যা কিনা পশ্চিমা সভ্যতার মূলেই আঘাত করছে।

Sunday 15 March 2020

যুক্তরাষ্ট্রের পর...


১৫ই মার্চ ২০২০











আলহামদুলিল্লাহ!
আমার তৃতীয় বই প্রকাশিত হলো।
 
'যুক্তরাষ্ট্রের পর... সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থার হাতছানি'
 












বই-এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা এই বর্ণনা থেকে পাওয়া যাবে -


-----------------------------------------------------------------------------------------------

"বিশ্ব এখন প্রস্তুত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-পরবর্তী ভূরাজনৈতিক কাঠামোর জন্যে। কেমন হবে সেই বিশ্ব? কে হবে এর নিয়ন্ত্রক? যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব ধরে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে এবং তাদের প্রক্সিগুলির উপর নির্ভর করছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর করছে তুরস্ক, সৌদি আরব, আমিরাত এবং মিশরের উপর। পশ্চিম আফ্রিকাতে ফ্রান্সের নেতৃত্বকেই মেনে চলছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকায় ভারতকে কাছে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পূর্ব এশিয়ায় চীনকে ব্যালান্স করতে জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপাইনকে ব্যবহার করছে তারা। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ এখন আর নিরঙ্কুশ নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাই এখন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানের ভয়ে ভীত; বিশেষতঃ অজনপ্রিয় অত্যাচারী শাসকেরা।

পশ্চিমা শক্তি ব্রিটেন চেষ্টা করছে এই সুযোগে নিজের প্রভাব বাড়িয়ে নিতে। কিন্তু ব্রেক্সিটের চাপই যেখানে ব্রিটিশ জনগণ নিতে পারছে না, সেখানে স্কটল্যান্ডের গণভোটকে কিভাবে নেবে তারা? ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শোষণের স্মৃতিগুলিও মুছে যায়নি। ইউরেশিয়ার শক্তি রাশিয়া এবং চীন আদর্শিক শক্তি নয়। প্রযুক্তি এবং অর্থনীতিই এদের শক্তির ভিত; আদর্শ নয়। তাই রুশ এবং চীনা জাতীয়তাবাদ যে বিশ্বের নেতৃত্ব নিতে পারবে, তা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়না। তুরস্ক চেষ্টা করছে ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’এর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু সেকুলার আদর্শের মাঝে থেকে ইসলামের নেতৃত্ব নিতে গেলে সেই নেতৃত্ব পশ্চিমা সেকুলারদের হাতেই যাবে। তথাপি এই ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’এর মূলে রয়েছে মুসলিম বিশ্বের জনগণের আদর্শিক নেতৃত্বের আকাংক্ষা, যা পশ্চিমাদের দৃষ্টিকে এড়ায়নি। এই আকাংক্ষাই পশ্চিমাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সামনের দিনের ভূরাজনৈতিক ভরকেন্দ্রটা কোথায় হবে।" 


-----------------------------------------------------------------------------------------------

আপডেট ২৪শে জুলাই ২০২০

বইখানা এখন 'রকমারি ডট কম'এ পাওয়া যাচ্ছে। 
https://www.rokomari.com/book/202000/juktorashtrer-por--- 

----------------------------------------------------------------------------------------------- 


এছাড়াও বইটি কুরিয়ারের মাধ্যমে ডেলিভারির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যারা অর্ডার করতে ইচ্ছুক, তারা নিচের ফেসবুক পেইজে পুরো ঠিকানা এবং ফোন নম্বরসহ 'ইনবক্স' করুন। পেমেন্ট করতে হবে বিকাশে। ডেলিভারি চার্জ ফ্রি। অর্থাৎ বইএর মূল্যের বাইরে কোন চার্জ দিতে হবে না।  

https://www.facebook.com/k360bd/


------------------------------------------------------------------------------------- 








লেখক - আহমেদ শরীফ

প্রকাশক - মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম, ড্রিমস পাবলিকেশনস, টাঙ্গাইল

প্রথম প্রকাশ - ফেব্রুয়ারি ২০২০

প্রচ্ছদ - তৌহিদুল ইসলাম

মুদ্রণ - ওমাসিস প্রেস, কাঁটাবন, ঢাকা

পৃষ্ঠা সংখ্যা - ৩৪৭; হার্ড কভার 

মূল্য - ৯০০/- (নয়শত টাকা মাত্র) 

ISBN : 978-984-34-9063-6
 -------------------------------------------------------------------------------
লেখকের প্রথম বই দু'টা না পেয়ে থাকলে এই লিঙ্ক থেকে ঘুরে আসুন - 
 

'বঙ্গোপসাগর আসলে কার? বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান'

Saturday 14 March 2020

করোনাভাইরাসের মাঝে তেল-যুদ্ধ – আসল টার্গেট যুক্তরাষ্ট্র?

১৪ই মার্চ ২০২০

    
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মাঝে সৌদি এবং রুশদের তেলের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ঋণগ্রস্ত তেলের কোম্পানিগুলিকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। করোনাভাইরাসের অনিশ্চয়তার মাঝে সকলেই নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় দেখতে চাইছে; এতে অন্য কারুর ক্ষতি হোক বা না হোক। বাজার হিস্যা দখলের সাথেসাথে ভূরাজনৈতিক প্রভাবের হিস্যার মাঝেও ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। উত্তরপূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকায় ভাইরাসের আক্রমণ যে ভূরাজনৈতিক ভূমিকম্পের সূচনা করেছে, তেল-যুদ্ধ তার একটা ফলাফল মাত্র।



৯ই মার্চ আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের বাজার মূল্য একদিনে ৩০ শতাংশের বেশি কমে যায়। ১৯৯১ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকে এটা ছিল তেলের বাজারে একদিনের সর্বোচ্চ ধ্বস। এই ধ্বসের একটা কারণ ছিল বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে তেলের চাহিদা পড়ে যাওয়া। তবে এর সাথে যোগ হয়েছে সৌদি আরব এবং রাশিয়ার মাঝে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে সমঝোতায় না পৌঁছানো। গত ৬ই মার্চ ভিয়েনায় এক বৈঠকে সৌদি কর্মকর্তারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় রুশদেরকে তেলের উৎপাদন কমাতে অনুরোধ করেন। এই প্রস্তাবে রাশিয়া রাজি না হওয়ায় সৌদিরা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে উৎপাদন ১ কোটি ২৩ লাখ ব্যারেলে ওঠানো এবং বিশেষ ক্রেতাদের জন্যে ২০ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ মূল্য কর্তনের ঘোষণা দেয়। ‘ব্লুমবার্গ’ এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে, সৌদিদের কমদামি তেলের বাজার ধরতে উত্তরপূর্ব এশিয়ার ক্রেতারা ব্যর্থ হবার ফলে এটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে সৌদিদের তেলের বাজার হতে যাচ্ছে ইউরোপ, যা কিনা রুশ তেলের মূল বাজার। উত্তর এশিয়ার ক্রেতারা লাইট ক্রুড চাইলেও সৌদিরা তাদেরকে মিডিয়াম ও হেভি ক্রুড কেনার অফার দেয়। এতে এশিয়রা বাধ্য হয় সৌদিদের তেলের অফার ছেড়ে দিতে। অন্যদিকে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ায় সৌদিরা মিডিয়াম ক্রুডের সরবরাহ বাড়াচ্ছে।

‘গোল্ডমান সাকস’এর বিশ্লেষকেরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন যে, তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ২০ ডলারে নেমে যাবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তেলের বাজারে ধ্বসের সাথেসাথে তেল কোম্পানিগুলির শেয়ারের মূল্যেও ব্যাপক দরপতন হয়েছে। দু’দিন পর ১১ই মার্চ সৌদি তেল কোম্পানি আরামকো ঘোষণা দেয় যে, তারা তাদের তেলের উৎপাদন ২০২০ সালের মাঝেই বাড়িয়ে দৈনিক ১ কোটি ৩০ লাখ ব্যারেল করবে। একইসাথে আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানিও ঘোষণা দেয় যে, তারা এপ্রিল মাসে তাদের উৎপাদন ১০ লাখ ব্যারেল বাড়িয়ে ৪০ লাখ ব্যারেল করবে। ‘ব্লুমবার্গ’ জানাচ্ছে যে, ইরাক এবং নাইজেরিয়াও তেল উৎপাদন বাড়াবার ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দিয়ে ‘সিএনএন’ বলছে যে, তেলের মূল্যের এই যুদ্ধের মাঝে সকলেই চাইবে যে করেই হোক তেলের বাজারে নিজস্ব হিস্যা বাড়িয়ে নিতে। গত তিন বছর ধরে সৌদিরা রুশদের সাথে সমঝোতা করে তেলের বাজারে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু এখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সমঝোতা শেষ হয়ে যাওয়ায় সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান বাজার হিস্যা ধরতে অত্যন্ত আক্রমণাত্মক একটা কৌশল নিয়েছেন।

‘জেপি মরগ্যান’এর বিশ্লেষক যোসেফ লুপটন এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, তেলের মূল্য কমায় তেলের ব্যবহারকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সুবিধা হবে। তবে সেদেশের তেল কোম্পানিগুলির যেগুলি শেইল অয়েলের ব্যবসায় রয়েছে, সেগুলি সমস্যায় পতিত হতে পারে। তিনি সৌদিদের লক্ষ্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, সৌদিরা বাজারে তেলের বন্যা বইয়ে দিতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলিকে চাপে ফেলার জন্যে। ২০১৫-১৬ সালের দিকে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১১০ ডলার থেকে ৩০ ডলারে নেমে গেলে সেবারেও শেইল অয়েল ইন্ডাস্ট্রি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছিল; বিনিয়োগ চলে গিয়েছিল; চাকুরি হারিয়েছিল বহু মানুষ। এখন মার্কিন শেইল ইন্ডাস্ট্রি আগের চাইতে আরও শক্ত অবস্থানে থাকলেও পূর্বে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হওয়ায় মার্কিন ব্যাংকগুলি সেখানে আরও বিনিয়োগ করতে আর রাজি নয়। আবার তেলের বাজারে ধ্বসের সাথেসাথে শেয়ার বাজারে যেমন ধ্বস নেমেছে, তেমনি তেল কোম্পানিগুলির বন্ডগুলিও ব্যাপকভাবে মূল্য হারাচ্ছে। ‘জেপি মরগ্যান’ বলছে যে, ২০২০ সালের দ্বিতীয়াংশে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৪০ ডলার এবং ২০২১ সালে ৫০ ডলারে উঠলেও ২০২১ সালে প্রায় ২৪ শতাংশ তেলের কোম্পানির বন্ড খেলাপি হয়ে যেতে পারে।
  
বিশ্বের সবচাইতে বড় তেলের ব্যবহারকারী যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়েছে মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল ব্যবহার করেছে, যা সারা দুনিয়ার তেল ব্যবহারের প্রায় ২০ শতাংশ। দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত, অনুষ্ঠান বা খেলাধূলার আসরে যাতায়াত কমতে থাকলেই তেলের চাহিদায় ধ্বস আসতে থাকবে।
  

‘সিএনএন’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, সৌদিরা তেলের মূল্যের যুদ্ধে নেমে ঘোষণা দিচ্ছে যে, প্রথমতঃ সৌদিরা নিয়ন্ত্রণ না করে তেলের বাজারকে মুক্ত বাজার হিসেবে চলতে দিলে বিপর্যয় নেমে আসবে। সুতরাং বিশ্বকে সৌদিদের এই নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে হবে। আর দ্বিতীয়তঃ তেলের মূল্য যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির তেলের উৎপাদন খরচ সর্বনিম্ন হওয়ায় তারাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে। বিশেষ করে মার্কিন শেইল অয়েলের চাইতে তারা অনেক কমে বিশ্বকে তেল দিতে সক্ষম।

তেলের বাজারের পত্রিকা ‘অয়েল প্রাইস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যদিও কেউকেউ ধারণা করছিলেন যে, চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসার সাথেসাথে তেলের বাজারে চাহিদার অবস্থার হয়তো উন্নতি হবে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, বিশ্বের সবচাইতে বড় তেলের ব্যবহারকারী যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়েছে মাত্র। মার্কিন ‘এনার্জি ইনফরমেশন এডমিনিস্ট্রেশন’এর হিসেবে ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল ব্যবহার করেছে, যা সারা দুনিয়ার তেল ব্যবহারের প্রায় ২০ শতাংশ। এর সাথে তুলনামূলকভাবে চীন ব্যবহার করেছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ব্যারেল তেল। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সাথেসাথে মানুষ বাড়ির বাইরে যাওয়া কমিয়ে দেবে; অর্থাৎ মানুষের যাতায়াত কমতে শুরু করবে। মার্কিন ক্রীড়াঙ্গনের মধ্যমনি বাস্কেটবল, আইস হকি এবং বেইসবল লীগ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আদালত, অনুষ্ঠান বা খেলাধূলার আসরে যাতায়াত কমতে থাকলেই তেলের চাহিদায় ধ্বস আসতে থাকবে।

‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’ বলছে যে, তেলের মূল্য যুদ্ধের মাঝ দিয়ে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের শেইল অয়েলের ইন্ডাস্ট্রিকে টার্গেট করেছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘হাডসন ইন্সটিটিউট’এর থমাস দুস্তারবার্গ ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মাঝে সৌদি এবং রুশদের তেলের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক ঋণগ্রস্ত তেলের কোম্পানিগুলিকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্লেষকদের কথায় এটা নিশ্চিত যে, করোনাভাইরাসের অনিশ্চয়তার মাঝে সকলেই নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় দেখতে চাইছে; এতে অন্য কারুর ক্ষতি হোক বা না হোক। বাজার হিস্যা দখলের সাথেসাথে ভূরাজনৈতিক প্রভাবের হিস্যার মাঝেও ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। উত্তরপূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকায় ভাইরাসের আক্রমণ যে ভূরাজনৈতিক ভূমিকম্পের সূচনা করেছে, তেল-যুদ্ধ তার একটা ফলাফল মাত্র।

Saturday 7 March 2020

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ইতালি - ‘সিক ম্যান অব ইউরোপ’, নাকি আদর্শিক চ্যালেঞ্জ?

৭ই মার্চ ২০২০

 
মানবাধিকার, মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো পশ্চিমা আদর্শের ভিতগুলিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে করোনাভাইরাস। এগুলি পুরো পশ্চিমা বিশ্বের জন্যে চ্যালেঞ্জ হলেও ইতালি হয়তো সেক্ষেত্রে সবচাইতে বড় উদাহরণ হিসেবে সামনে আসছে।


৬ই মার্চ ইতালিয় কর্মকর্তারা ঘোষণা করেন যে, ২৪ ঘন্টায় ইতালিতে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইতালিতে করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের পর থেকে এটা একদিনে মৃতের সর্বোচ্চ সংখ্যা। এর আগের দিন মৃত্যু হয়েছিল ২৮ জনের। এখন পর্যন্ত মোট ১’শ ৯৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে ইতালিতে; আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ৬’শ জনেরও বেশি। চীনের বাইরে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে ইতালিতেই। ইতালি সরকার সকল স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় ১০ দিনের জন্যে বন্ধ ঘোষণা করেছে। আর এক মাসের জন্যে সকল পেশাদার খেলা দর্শকবিহীন মাঠে অনুষ্ঠিত হবে বলে বলা হয়েছে। ‘বিবিসি’ জানাচ্ছে যে, ইতালির উত্তরের কোদোনিয়ো শহরে মৃতদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান করারও অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। ইতালির ‘ইল মেসাজেরো’ পত্রিকা বলছে যে, ঠান্ডা লাগার কারণে ৮৩ বছর বয়সী পোপ ফ্রান্সিসকেও করোনাভাইরাসের পরীক্ষার সন্মুখীন হতে হয়েছে; যদিওবা তিনি আক্রান্ত নন। তবে এর কারণে তার কর্মপরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছে। ‘দ্যা সান’ পত্রিকা বিভিন্ন রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলছে যে, ইতালি সরকার চুম্বন, আলিঙ্গন এবং করমর্দনের মতো সামাজিক আচরণগুলির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করার চিন্তা করছে। করোনাভাইরাসের কারণে ইতালিতে স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছাড়াও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক জটিলতা, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, এমনকি সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধও চলে আসছে, যা কিনা পুরো দেশের, এবং একইসাথে ইউরোপের জীবনযাত্রাকেই চ্যালেঞ্জ করছে।

ইতালির জাতীয় স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট বলছে যে, ইতালিতে মৃত ব্যক্তিদের গড় বয়স ছিল ৮১; বেশিরভাগ মানুষেরই বয়স ছিল ৬৩ থেকে ৯৫ বছরের মাঝে। সবচাইতে কম বয়সী মৃতের বয়স ছিল ৫৫ বছর; যিনি অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। সরকারি হিসেব বলছে যে, আক্রান্তদের মাঝে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যা কিনা বিশ্বের সকল দেশের মাঝে সর্বোচ্চ হার। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইতালির জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বৃদ্ধ হওয়ায় করোনাভাইরাসে মৃতের হার কমানোটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মিলানের ‘সাক্কো’ হাসপাতালের ডিরেক্টর প্রফেসর মাসিমো গাল্লি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইতালি হলো বৃদ্ধ মানুষের দেশ। অসুস্থ্য বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা এখানে খুবই বেশি। ইতালির মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি; আর সেই গড় আয়ুই এখন করোনাভাইরাসে মৃতের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তুসকানি, পুইলিয়া, সিসিলি এবং সার্দিনিয়াসহ ইতালির ২০টা অঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এর মাঝে উত্তরের লোমবার্ডিতেই বেশিরভাগ আক্রান্ত ব্যক্তি সনাক্ত হয়েছে। ইতালির বাকি অঞ্চলের আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে বেশিরভাগই গত কয়েক সপ্তাহের মাঝে লোমবার্ডি ঘুরে এসেছিলেন। তবে গাল্লি বলছেন যে, এটা নিশ্চিত নয় যে এই ভাইরাস চীন থেকেই এসেছে; অন্য কোন দেশ হয়েও ইতালিতে এই ভাইরাস ঢুকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ তিনি একজন ব্রিটিন নাগরিকের কথা বলেন, যিনি সিঙ্গাপুর থেকে ফ্রান্সে গিয়ে তার পরিচিতদেরকে সংক্রমিত করেছিলেন। প্রফেসর গাল্লি আরও বলেন যে, অনেকেই ‘কোয়ার‍্যান্টিন’ বা পৃথকীকরণ করায় বেশি শক্ত পদক্ষেপ নেবার জন্যে ইতালির সমালোচনা করেছেন। উত্তরের অনেক অঞ্চলেই যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে ইতালি সরকার। তারপরেও রোগের সংক্রমণ কমানো সম্ভব হয়নি। ইউরোপের খোলা সীমানাগুলিকেও চাপের মাঝে ফেলেছে করোনাভাইরাস। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’ আরও বড় প্রশ্ন রেখেছে। পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকারের হাতে খুব কম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে কর্তন করে করোনাভাইরাসের মতো রোগের সংক্রমণ কমানো সম্ভব কিনা।

‘সিএনবিসি’র এক প্রতিবেদনে ইতালিকে ‘সিক ম্যান অব ইউরোপ’ বা ইউরোপের রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বলা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২০ সালে ইতালির অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলবে বলেই সকলে আশা করেছিল। ইতালি সরকারের পরিসংখ্যান দপ্তর জানুয়ারি মাসে বলেছিল যে, এবছর প্রবৃদ্ধি দশমিক ২ শতাংশের বেশি হবে না। দেশটার ব্যাংকিং খাত এখনও ব্যাপক সমস্যার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে; সেখানে ব্যাবসা বাড়ানোর জন্যে ঋণ পাওয়া কঠিন। এর উপর এখন যোগ হয়েছে করোনাভাইরাসের কারণে ইতালি উত্তরের শিল্পাঞ্চলগুলির অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। তার সাথে রয়েছে প্রিয়জনদের হারাবার বেদনা এবং অসুস্থ্যদের ব্যাপক চিকিৎসা ব্যয়। ইতালি সরকার এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যবসাগুলির জন্যে কর কমানো এবং কর প্রদানে ক্রেডিটের ব্যবস্থা করছে; আর রোগী সনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় অর্থায়ন বাড়াচ্ছে। এসব মিলিয়ে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার প্রণোদনা দেবার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এই অর্থায়ন ইতালির বাজেট ঘাটতিকে আরও চাপের মাঝে ফেলবে। বাজেট ঘাটতি কমাবার বাধ্যবাধকতা নিয়ে ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে ইতালির ডানপন্থী সরকারের বিতন্ডা চলছে আরও আগ থেকেই। তবে আপাততঃ ইতালির সরকারের খরচা বৃদ্ধিকে ইইউ মেনে নিলেও সামনের দিনগুলিকে বাধা দিতে পারে। কারণ এই প্রণোদনা মানবিক নয়, বরং অর্থনৈতিক। অর্থাৎ এই প্রণোদনা ইতালির শিল্পদ্রব্যগুলিকে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে বাকি ইউরোপের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে সহায়তা দেবে। ইউরোপের বাকি দেশগুলিও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। কিন্তু ইতালির মতো অর্থনৈতিকভাবে ‘সিক ম্যান অব ইউরোপ’এর উপর করোনাভাইরাসের প্রভাব বাকি ইউরোপের দেশগুলির চাইতে বেশি হতে পারে।

বেশি গড় আয়ু এখন আর গর্ব করার বিষয় থাকছে না। বেশি বয়সের জনসংখ্যাই ইতালির ভাইরাস সংক্রমণকে অন্যদের থেকে বেশি ভয়াবহ করেছে। অন্যদিকে অসুস্থ্য মানুষের মানবাধিকার প্রতিযোগিতা করছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির বাজারে টিকে থাকার চাহিদার সাথে। অর্থনৈতিকভাবে ‘সিক ম্যান অব ইউরোপ’ হবার কারণে ইতালির সরকার আর্থিক প্রণোদনা দেবার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাগুলিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে, যারা প্রণোদনাকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপের মুক্ত বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চেষ্টা করবে। আবার একইসাথে ব্যাপক ‘কোয়ার‍্যান্টিন’ বা পৃথকীকরণ ছাড়াও জীবনযাত্রার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে; কারণ তা ইউরোপের মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করছে। মানবাধিকার, মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো পশ্চিমা আদর্শের ভিতগুলিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে করোনাভাইরাস। এগুলি পুরো পশ্চিমা বিশ্বের জন্যে চ্যালেঞ্জ হলেও ইতালি হয়তো সেক্ষেত্রে সবচাইতে বড় উদাহরণ হিসেবে সামনে আসছে।

Thursday 5 March 2020

ইদলিবের যুদ্ধ সিরিয়ায় ইরানের অবস্থানকে দুর্বল করছে

০৫ই মার্চ ২০২০
 
 
সুলাইমানির হত্যার পর একটা দুর্বল অবস্থানে থেকে ইরানের পক্ষে আলোচনায় মধ্যস্ততা করাটা কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাশিয়া এবং তুরস্কের ভূরাজনৈতিক খেলায় ইরানের কোন ভূমিকাই নেই। এমতাবস্থায় শুধুমাত্র সিরিয়ার যুদ্ধকে ব্যবহার করে ইরানের পক্ষে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব নয়। কাসেম সুলাইমানি-পরবর্তী সময়ের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক হিসেবনিকেশে ইরানের দুর্বলতর অবস্থানের সুযোগ অনেকটাই তুরস্ক নেবে।
 

ইরানের ‘ক্বোম নিউজ’এর বরাত দিয়ে ‘রেডিও ফারদা’ জানাচ্ছে যে, সিরিয়ার ইদলিবে ৩৪ জন তুর্কি সেনা নিহত হবার পর তুর্কিদের প্রতিশোধমূলক আক্রমণে সিরিয় সেনাদের সাথেসাথে ২১ জন ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া নিহত হয়। এই সেনাদের রিক্রুট করা হয়েছিল আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে। এর মাঝে ১৮ জন ছিল পাকিস্তানের ‘জেইনাবিউন ব্রিগেড’এর, আর ৩ জন ছিল আফগানিস্তানের ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’এর। পহেলা মার্চ ইরানের শিয়াদের পবিত্র শহর ক্বোমএ এই ২১ জনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। হিযবুল্লাহর ১৪ জন সদস্যও ইদলিবে নিহত হয়েছে, যাদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। ২৯শে ফেব্রুয়ারি ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথে ফোনালাপ করেন। ফোনালাপে তিনি ২০১৮ সালের আস্তানা আলোচনার ছায়ায় তুরস্ক এবং রাশিয়াকে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানান। পরদিন পহেলা মার্চ সিরিয়াতে ইরানের ‘মিলিটারি এডভাইজরি সেন্টার’ বা ‘এমএসি’র এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ইরানিরা তুর্কিদের টার্গেট না করলেও তুর্কিরা ইরানিদেরকে টার্গেট করছে। একইসাথে বিবৃতিতে হুমকি দিয়ে বলা হয় যে, তুর্কিদের জেনে রাখা উচিৎ যে, তারা ‘এমএসি’র অস্ত্রের পাল্লার মাঝেই রয়েছে। এতে আরও বলা হয় যে, ইচ্ছে করলেই ইরানিরা তুর্কিদের উপর প্রতিশোধ নিতে পারতো; কিন্তু নেয়নি। বিবৃতির শেষে বলা হয় যে, যতদিন সিরিয়াতে সন্ত্রাসীরা থাকবে, ততদিন ইরান সিরিয়াতে থাকবে। ‘এমএসি’র এই ঘোষণা অনেককেই অবাক করেছে; কারণ প্রায় কেউই এতকালে ‘এমএসি’র নাম শোনেনি। তুর্কি মিডিয়া ‘ইয়েনি সাফাক’এর ৪ঠা মার্চের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে লন্ডনভিত্তিক প্রেস মনিটরিং সংস্থা ‘মিডলইস্ট মনিটর’ বলছে যে, ইরান ইদলিবের কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর সারাকিবে ‘আল কুদস ফোর্স’এর ২ হাজার সেনা প্রেরণ করেছে; আর সারাকিবের দক্ষিণে মা’রাত আল নুমানে ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’এর সদস্যরা পৌঁছেছে ২’শ গাড়িতে করে। হিযবুল্লাহও সারাকিবে তাদের যোদ্ধাদের পাঠিয়েছে।

ইদলিবের যুদ্ধ পরিস্থিতি - ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০২০

  

‘জার্মান ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড সিকিউরিটি এফেয়ার্স’এর ফেলো হামিদরেজা আজিজি ওয়াশিংটনভিত্তিক আরবের পত্রিকা ‘আল মনিটর’এর এক লেখায় বলছেন যে, ইদলিবের যুদ্ধে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের মৃত্যু যুদ্ধকে আরও বেশি জটিল করে তুলেছে। ইরান এতকাল সিরিয়ার যুদ্ধে তার জড়িত থাকার ব্যাপারটাকে প্রচার না করলেও এখন সে আর তা গোপন রাখতে চাইছে না। সিরিয়ার দামাস্কাস আর আলেপ্পোর মাঝে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর চলে যাওয়া ‘এম ৫’ হাইওয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়াটা ইরানের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা লক্ষ্য বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এই হাইওয়ের সাথে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী লাতাকিয়া থেকে আসা ‘এম ৪’ হাইওয়ে মিশেছে সারাকিব শহরে, যা কিনা ইতোমধ্যেই চলমান ইদলিবের যুদ্ধের মাঝে দু’বার হাতবদল হয়েছে। ২০১৮ সালে সিরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার সময় রাশিয়ার ভূমিকাকে মেনে নিয়েছিল ইরান। কিন্তু এবারে সিরিয়ার বাশার সরকারকে রক্ষা করতে যথেষ্ট চেষ্টা না করায় ইরান কিছুটা অসন্তুষ্ট। ইরানিরা ধারণা করছে যে, রাশিয়া এবং তুরস্কের মাঝে সম্ভবতঃ একটা সমঝোতা হয়েছে, যা কিনা সন্মুখে আসেনি। ‘রাশান ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স কাউন্সিল’এর নন-রেসিডেন্ট বিশেষজ্ঞ ম্যাক্সিম সুচকভের মতে, রাশিয়া এবং তুরস্কের সম্পর্কের মাঝে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, তুরস্কের মাঝ দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে রুশ তেল ও গ্যাস সরবরাহের সহযোগিতা, রুশ সহায়তায় আক্কুইউতে তুরস্কের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, এবং রুশ ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ। এই প্রকল্পগুলি দুই দেশের জন্যে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেই তুলনায় সিরিয়ার যুদ্ধ দুই দেশকে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবার জন্যে যথেষ্ট নয়।



জেনারেল কাসেম সুলাইমানির (ডানে) সাথে সিরিয়াতে আফগান শিয়াদের ‘ফাতেমিউন ব্রিগেড’এর নেতা আলিরেজা তাভাসোলি (মাঝে)। তাভাসোলি সিরিয়ার দেরাতে যুদ্ধে নিহত হন; আর সুলাইমানি বাগদাদ বিমানবন্দরে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন
ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত আরবের পত্রিকা ‘দ্যা এরাব উইকলি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, সিরিয়ার বিষয়ে এর আগে আস্তানা এবং সোচিতে যে সমঝোতা হয়েছিল, তাতে শান্তি ধরে রাখার মূল নিশ্চয়তা দানকারী ছিল রাশিয়া, তুরস্ক এবং ইরান। কিছুদিন আগ পর্যন্তও ব্যাপারটা এমন থাকলেও এখন তা পরিবর্তন হচ্ছে। কারণ ইদলিবের সংঘর্ষ থামাবার ব্যাপারে আলোচনাতে শুধুমাত্র আঙ্কারা এবং মস্কোর নামই শোনা যাচ্ছে; তেহরান এক্ষেত্রে অনুপস্থিত। ইউফ্রেতিসের পূর্বাঞ্চলের ব্যাপারে আলোচনাতে উপস্থিত ছিল তুরস্ক, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র; সেখানেও ইরান ছিল অনুপস্থিত। সিরিয়াতে কাজ করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে যে ম্যান্ডেট দিয়েছিল, ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তা ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের সাথে সাথে সরিয়ে নেন। সেসময় থেকেই সিরিয়াতে ইরানি সশস্ত্র গ্রুপগুলি ইস্রাইলসহ অন্য যেকোন বিরোধী শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হবার ভয়ে রয়েছে। ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও এই গ্রুপগুলিকে দুর্বল করছে। এই পুরো ব্যাপারটা তেহেরানের জন্যে আরও কঠিন হয়ে যায় নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহে ইরানি জেনারেল কাসেম সুলাইমানির হত্যাকান্ডের পর। ইরানের ‘আইআরজিসি’র ‘আল কুদস ফোর্স’এর এই কমান্ডার সিরিয়াতে ইরান সমর্থিত বাহিনীরগুলিকে একত্রে ধরে রাখার জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা তার হত্যার পরই বোঝা যাচ্ছে। সিরিয়াতে সেনাবাহিনী এবং হিযবুল্লাহর কাজগুলি এখন কিছু কমান্ডারের ব্যক্তিগত চেষ্টার ফলাফল; তেহেরানের সমর্থিত কোন সমন্বিত পরিকল্পনার অংশ নয়, যা কিনা সুলাইমানি নিশ্চিত করতেন। সুলাইমানি তেহেরানে সরাসরি যোগাযোগ না করেও অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। সিরিয়ার আকাশের নিয়ন্ত্রণ মস্কোর হাতে; তাই মস্কোর সাথে লিয়াঁজো রক্ষাও তিনিই করতেন। ইদলিবই হলো সুলাইমানিকে হারাবার পর সিরিয়াতে ইরানের জন্যে প্রথম চ্যালেঞ্জ।

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, ধ্বংসাত্মক মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও এর ফলশ্রুতিতে দেশব্যাপী জনবিক্ষোভ, নিজভূমে লিবারাল এবং কনজার্ভেটিভদের মাঝে দ্বন্দ্ব, লেবানন ও ইরাকে ব্যাপক জনরোষের মুখে ইরানের প্রভাবের ক্ষয়ে যাবার সম্ভাবনা ছাড়াও আঞ্চলিকভাবে ইস্রাইল, তুরস্ক এবং সৌদি গ্রুপের আগ্রাসী কর্মকান্ডে ইরান যথেষ্টই ক্ষতির মুখে পড়েছে। এমনই এক সময়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ইদলিবের ব্যাপারে আলোচনার জন্যে রাশিয়া এবং তুরস্কের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন। রাশিয়া এবং তুরস্ক উভয়েই ইরানের বর্তমান দুর্বল অবস্থানের ব্যাপারে অবগত। তুর্কিরা সিরিয়াতে রুশ টার্গেটে হামলা করা থেকে বিরত থাকলেও ইরানি টার্গেট সেখান থেকে বাদ পড়ে যায়নি। অপরদিকে রুশরা তুর্কিদেরকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্যে ডাকলেও সেখানে ইরানকে যোগ দেবার জন্যে বলেনি। সুলাইমানির হত্যার পর একটা দুর্বল অবস্থানে থেকে ইরানের পক্ষে আলোচনায় মধ্যস্ততা করাটা কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাশিয়া এবং তুরস্কের ভূরাজনৈতিক খেলায় ইরানের কোন ভূমিকাই নেই। এমতাবস্থায় শুধুমাত্র সিরিয়ার যুদ্ধকে ব্যবহার করে ইরানের পক্ষে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব নয়। কাসেম সুলাইমানি-পরবর্তী সময়ের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক হিসেবনিকেশে ইরানের দুর্বলতর অবস্থানের সুযোগ অনেকটাই তুরস্ক নেবে।