Monday 26 June 2023

‘ওয়াগনার’-কান্ডের ভূরাজনৈতিক ফলাফল কি হতে পারে?

২৭শে জুন ২০২৩

রুশ শহর রস্টোভের রাস্তায় প্রিগোজিনের 'ওয়াগনার' বাহিনীর ট্যাংক। ভ্লাদিমির পুতিন ‘ওয়াগনার’এর বিদ্রোহকে ১৯১৭ সালের গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। ১৯১৭ সালের সেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই; এবং তা গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে বেশ কয়েক মাস লেগেছিলো। যেটা এখন দেখতে হবে তা হলো, আগামী কয়েক মাসের মাঝে ‘ওয়াগনার’কে উদাহরণ ধরে রুশ বাহিনীর অন্যান্য অংশ থেকে কি কি দাবি উত্থাপিত হয়।

গত ২৩শে জুন রাশিয়ার ভাড়াটে সামরিক বাহিনী ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন ঘোষণা দেন যে, তার সেনারা সুবিচার আদায়ের লক্ষ্যে মার্চ শুরু করেছে। ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন থেকে সরে গিয়ে তারা রুশ শহর রস্টোভের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং মস্কো অভিমুখে রওয়ানা দেয়। এর মাঝে রুশ বিমান বাহিনী তাদেরকে টার্গেট করে বোমাবর্ষণ করে। মাত্র ২৪ ঘন্টার মাথায় প্রিগোজিন ঘোষণা দেন যে, তিনি তার বাহিনীকে ইউক্রেনে ফিরিয়ে নিচ্ছেন এবং বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্ততায় রাজি হয়ে তিনি রাশিয়া ছেড়ে বেলারুশে চলে যাচ্ছেন। ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর এক দিনের এই নাটক কেনই বা ঘটলো এবং এর ফলাফলগুলিই বা কেমন হবে, সেব্যাপারে নিশ্চিত হতে যে আরও অনেকদিন লাগবে, তাতে সকলেই একমত। তথাপি ঘটনার ব্যাপারে অনেকেরই কিছু বিশ্লেষণ এবং মতামত রয়েছে, যা আলোচনায় আসছে।

‘ওয়াগনার গ্রুপ’ আলোচনায় আসলো কিভাবে?

মার্কিন ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’এর এক লেখায় জর্জ ফ্রীডম্যান প্রশ্ন করেছেন যে, ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে কি করছিলো? একটা ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের কর্মকান্ড একেবারেই আলাদা। সেখানে তারা নিয়মিত সেনাবাহিনীর সমান্তরালে যুদ্ধ করেছে। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনকে পরাজিত করতে না পারার কারণেই ‘ওয়াগনার’এর মতো ভাড়াটে যোদ্ধাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করতে হয়েছিল; যা কিনা পরবর্তীতে দ্বন্দ্ব এবং বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছে। ‘ওয়াগনার’কে কাজে লাগানোটাই ছিল বড় সমস্যা।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র এক লেখায় সামরিক বিশ্লেষক জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ‘ওয়াগনার’কে রুশ নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করেছে; যেখানে তারা রুশ রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হয়ে কাজ করেছে। তবে এই বাহিনীতে রুশ সামরিক বাহিনী এবং সামরিক ইন্টেলিজেন্স ‘জিআরইউ’এর সদস্যরা কাজ করেছে। আর ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে তারা এমন একটা বাহিনী মোতায়েন করতে পেরেছিল, যা কিনা অনেক ক্ষেত্রেই রুশ সেনাবাহিনীর চাইতে বেশি কার্যকর ছিল। রুশ বিচার বিভাগের সহায়তাতেই ‘ওয়াগনার’ সাজাপ্রাপ্ত আসামীদেরকে এই বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। মোটকথা রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র ‘ওয়াগনার’কে সকল ধরণের সহায়তা দিয়েছে। আর এই সহায়তার ক্ষেত্রে প্রথমেই ছিলেন ‘জিআরইউ’এর জেনারেল ভ্লাদিমির স্তেপানোভিচ আলেক্সেইয়েভ। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছের লোক ইউরি কোভালচুক এবং সের্গেই কিরিয়েঙ্কো ‘ওয়াগনার’ তৈরির সপক্ষের চিন্তাগুলিকে সাজিয়েছিলেন। তবে রাশিয়ার ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘এফএসবি’ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই বাহিনীকে ব্যবহারের বিপক্ষে ছিল। এই দুই গ্রুপকে ঠান্ডা করতে গিয়ে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ‘ওয়াগনার’ সেনাদের মোতায়েন করার পর দু’টা ভিন্ন কমান্ড কাঠামো গঠন করতে হয়েছিল।

‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন কেন এই কাজটা করলেন, সেটার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন ‘কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টার’এর সিনিয়র ফেলো তাতিয়ানা স্তানোভায়া। টুইটারে এক বিশ্লেষণে তিনি বলছেন যে, প্রিগোজিনের বিদ্রোহ রাশিয়ার সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা ছিল না। ক্রেমলিনের শক্তিধর ব্যাক্তিদের চাপের মুখে তিনি ইউক্রেনে একঘরে হয়ে পড়েছিলেন এবং ‘ওয়াগনার’কে টিকিয়ে রাখা তার জন্যে কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো। তিনি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিলেন; যাতে করে ‘ওয়াগনার’এর কাজ, নিরাপত্তা এবং অর্থায়নের ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চয়তা তিনি পেতে পারেন। তিনি ইউক্রেনে তার সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের ব্যাপারটাকে তুলে ধরে তার দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন। তবে আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, তার অবদানগুলির কারণে তিনি এই সমস্যা থেকে বেঁচে বের হয়ে আসতে পেরেছেন; কিন্তু রাশিয়াতে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বিনিময়ে।

প্রিগোজিনের বিদ্রোহ রাশিয়ার সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা ছিল না। ক্রেমলিনের শক্তিধর ব্যাক্তিদের চাপের মুখে তিনি ইউক্রেনে একঘরে হয়ে পড়েছিলেন এবং ‘ওয়াগনার’কে টিকিয়ে রাখা তার জন্যে কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো। তিনি ইউক্রেনে তার সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের ব্যাপারটাকে তুলে ধরে তার দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন। তবে আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, তার অবদানগুলির কারণে তিনি এই সমস্যা থেকে বেঁচে বের হয়ে আসতে পেরেছেন; কিন্তু রাশিয়াতে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বিনিময়ে।

ইউক্রেন যুদ্ধের উপরে কি প্রভাব পড়বে?

‘পলিটিকো’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধে গত শীতে যখন ইউক্রেনিয়রা পাল্টা আক্রমণ করে খারকিভ এবং খেরসন পুনর্দখল করে নেয়, তখন ক্রেমলিন যুদ্ধক্ষেত্রে দুর্বল অবস্থানগুলিকে শক্তিশালী করতে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর সদস্যদের মোতায়েন করে। শীতের মাঝে ‘ওয়াগনার’ সদস্যরা যখন ফ্রন্টলাইন ধরে রেখেছিল, তখন রুশরা নতুন সেনা এবং রসদ যোগাড় করতে পেরেছিল। এছাড়াও বাখমুতের যুদ্ধে ‘ওয়াগনার’ সেনারা বড় ভূমিকা রেখেছিল।

২৪শে জুন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি এক বার্তায় বলেন যে, এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, রুশ নেতৃত্ব কোনকিছুরই নিয়ন্ত্রণে নেই। একদিনের মাঝে তারা অনেকগুলি শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এবং দেখিয়ে দিয়েছে যে, রাশিয়ার শহর এবং অস্ত্রের ভান্ডার দখল করে নেয়াটা কত সহজ।

তবে জেলেন্সকি ‘ওয়াগনার’এর ঘটনা থেকে কতটা সুবিধা নিতে পারবেন, তা প্রশ্নবিদ্ধ। ‘রুসি’র রাজনৈতিক বিশ্লেষক মার্ক গ্যালিয়টি ‘ইন মস্কোস শ্যাডো ১০৫’ নামের এক নিয়মিত পডকাস্ট বিশ্লেষণে বলছেন যে, এই ঘটনায় ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে বড় কোন পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয়না; কারণ অন্ততঃ এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে রুশ সেনাদের মাঝে অস্ত্র ছেড়ে দেবার বা যুদ্ধ থেকে সরে আসার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এছাড়াও ‘ওয়াগনার’কে থামাবার জন্যে যেহেতু কোন রুশ ইউনিটকে ইউক্রেন থেকে সরাবার প্রয়োজন হয়নি, তাই এই ঘটনার সরাসরি সুবিধা ইউক্রেন খুব কমই পাবে। বরং প্রিগোজিনের কারণে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে নেতৃত্বের কোন সমস্যা যদি হয়ে থাকে, সেটা এখন নেই; যা ইউক্রেনকে খুশি করার কথা নয়।

ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণ কি দুর্বল হলো?

‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের অধীন ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর সদস্যরা যেভাবে রুশ জমি দখল করে ফেলতে পারলো, মস্কোর ২’শ কিঃমিঃএর মাঝে পৌঁছে গেলো, এবং জনগণের সমর্থন পেলো, তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে দিচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার খুব শক্ত ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়। রস্টোভ শহরে ‘ওয়াগনার’এর পক্ষে মানুষের সমর্থন দেখিয়ে দেয় যে, ক্রেমলিনের ক্ষমতাধর প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কমান্ডার জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভএর উপর জনগণের আস্থা কমে গেছে। অপরদিকে মার্ক গ্যালিয়টি বলছেন যে, যদিও বেশিরভাগ বিশ্লেষকেরাই বলবেন যে, এই ঘটনার মাধ্যমে পুতিনের নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, তথাপি ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে খুব সম্ভবতঃ এর চাইতে ভালো কিছু করার ছিলো না; কারণ একদিকে তিনি সমস্যাটার সমাপ্তি টেনেছেন এবং একইসাথে প্রিগোজিনকে কিনে নিয়েছেন। কারণ ‘ওয়াগনার’ বনাম রুশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ পুরো রাষ্ট্রের জন্যে মারাত্মক হতো। বিশেষ করে ক্রেমলিন নির্দেশ দিলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রুশ ভাড়াটে বাহিনীর উপর গুলি করতে কতটা প্রস্তুত ছিলো, সেটা বরং পুতিনের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো।

ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে খুব সম্ভবতঃ এর চাইতে ভালো কিছু করার ছিলো না; কারণ একদিকে তিনি সমস্যাটার সমাপ্তি টেনেছেন এবং একইসাথে প্রিগোজিনকে কিনে নিয়েছেন। কারণ ‘ওয়াগনার’ বনাম রুশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ পুরো রাষ্ট্রের জন্যে মারাত্মক হতো। বিশেষ করে ক্রেমলিন নির্দেশ দিলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রুশ ভাড়াটে বাহিনীর উপর গুলি করতে কতটা প্রস্তুত ছিলো, সেটা বরং পুতিনের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতো।

তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলছেন যে, প্রিগোজিন খুব সম্ভবতঃ পুতিনের কঠোর বক্তব্য আশা করেননি। কারণ তিনি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীর ভূমিকা নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। মার্ক গ্যালিয়টি বলছেন যে, শেষ পর্যন্ত এটা মনে হয়নি যে, রুশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ব্যাপক হারে ‘ওয়াগনার’এ যোগ দিয়েছিলো। হয়তো সেটা প্রিগোজিনের সরে দাঁড়ানোর পিছনে একটা কারণ হতে পারে। মস্কোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীগুলিকে ‘ওয়াগনার’ পরাজিত করতে পারতো কিনা, সেখানেও সন্দেহ রয়েছে। কারণ যদিও রুশ সেনাবাহিনী ‘ওয়াগনার’এর মতো দ্রুতগামী কোন বাহিনী নয়; তথাপি সেনাবাহিনীর ভারি অস্ত্রের বিরুদ্ধে ‘ওয়াগনার’এর হাল্কা বাহিনী কতটুকু সফল হতো, তা প্রশ্নবিদ্ধ। আর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রিগোজিন কি করতেন, সেটা কি নিশ্চিত? তবে জনগণের একটা বড় অংশ ‘ওয়াগনার’কে থামাবার চেষ্টা করেনি; যা কিনা রাষ্ট্রের নেতৃত্বের দুর্বলতা তুলে ধরে। তথাপি প্রশ্ন থেকেই যায়, রুশ ইন্টেলিজেন্স ‘এফএসবি’ কি করছিলো? নিঃসন্দেহে এখানে ‘এফএসবি’র কাজে ঘাটতি ছিলো কিনা, তা খতিয়ে দেখার ব্যাপার হবে। তবে পুতিনের নেতৃত্বের অধীনে ‘এফএসবি’কে ব্যার্থতার জন্যে খুব বড় কোন খেসারত না-ও দিতে হতে পারে। কারণ এর আগেও ‘এফএসবি’ অনেক ভুল করলেও পুতিন তাদের কিছু করেননি।

গ্যালিয়টি বলছেন যে, প্রিগোজিন ১৯৯০এর দশক থেকেই ক্রেমলিনের সমর্থন পেয়ে ধাপে ধাপে উঠে এসেছেন। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রিগোজিন ব্যাক্তিগতভাবে লাভবান হলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে ক্রেমলিনেরই ইচ্ছার ফলাফল। এটা অসম্ভব নয় যে, প্রিগোজিন বেলারুশে বসে আফ্রিকায় ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড পরিচালনা করবেন। কারণ আফ্রিকাতে রুশ প্রভাব ধরে রাখার পিছনে ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আর রুশ সরকারের সমর্থন রয়েছে বলেই অনেক ক্ষেত্রে ‘ওয়াগনার’ সফলতা পেয়েছে। সমস্যা পুতিনের নিজেরই সৃষ্টি। কারণ তিনি প্রিগোজিনের সাথে রুশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের দ্বন্দ্বকে চলতে দিয়েছেন। আর এই দ্বন্দ্ব বাজে আকারে পরিণত হবার আগেই তিনি হস্তক্ষেপ করতে ব্যার্থ হয়েছেন।

জর্জ ফ্রীডম্যান প্রশ্ন করছেন যে, ‘ওয়াগনার’এর কারণে যদি ধরে নেয়া হয় যে, পুতিন দুর্বল হয়েছেন, তাহলে এই দুর্বল হওয়ার অর্থ প্রকৃতপক্ষে কি, সেটা দেখতে হবে। যদি তার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়, তার অর্থ হলো, তিনি খুব সহজেই কোন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিতে পারবেন না। আর যদি তার নির্দেশনা দেয়ার সক্ষমতা কমে যায়, তাহলে রুশ সামরিক বাহিনীর কমান্ড ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু এর অর্থ দাঁড়াবে অন্য কেউ পুতিনকে তার স্থান থেকে সরিয়ে দেবে। অথচ এখন পর্যন্ত এমন কোন ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে না যে কিনা পুতিনকে সরাবার মতো অবস্থানে এসেছে। আর এরকম কেউ না আসার আগ পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না যে মাত্র একদিনের ব্যার্থ অভ্যুত্থানে পুতিন দুর্বল হয়েছেন। জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, একদিক দিয়ে চিন্তা করলে রুশ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের উপরে পুতিনের নিয়ন্ত্রণ আরও বেড়ে গেলো। কারণ ক্রেমলিনের কোন দলই বেঁচে থাকার জন্যে পুতিনকে ছাড়া শক্তিশালী নয়।

রাশিয়া এবং ইউক্রেনে ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড শেষ হয়ে গেছে; যদিও বাকি বিশ্বে হয়তো তা এখনও বিদ্যমান। এমনও হতে পারে যে, প্রিগোজিনের সাথে ক্রেমলিনের শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তিই হয়েছে। তবে শোইগু নিঃসন্দেহে ‘ওয়াগনার’কে রাশিয়াতে থাকতে দেবেন না। সংস্থাটার ইউনিটগুলি হয়তো রুশ সামরিক বাহিনীর মাঝে বিলীন হয়ে যাবে।

বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার অবস্থান দুর্বল হবে কি?

তাতিয়ানা স্তানোভায়া মনে করছেন যে, প্রিগোজিনকে হয়তো পুতিন ছেড়ে দিয়েছেন এই শর্তে যে, তিনি বেলারুশে চুপচাপ থাকবেন। তবে মার্ক গ্যালিয়টি বলছেন যে, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, রাশিয়া এবং ইউক্রেনে ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড শেষ হয়ে গেছে; যদিও বাকি বিশ্বে হয়তো তা এখনও বিদ্যমান। এমনও হতে পারে যে, প্রিগোজিনের সাথে ক্রেমলিনের শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তিই হয়েছে। তবে শোইগু নিঃসন্দেহে ‘ওয়াগনার’কে রাশিয়াতে থাকতে দেবেন না। সংস্থাটার ইউনিটগুলি হয়তো রুশ সামরিক বাহিনীর মাঝে বিলীন হয়ে যাবে।

বিশ্বব্যাপী কোন কোন দেশে ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর কর্মকান্ড রয়েছে, তার একটা তালিকা তুলে ধরেছে ‘ডয়েচে ভেলে’। ইউক্রেনে ২০১৪ সালে সর্বপ্রথম ‘ওয়াগনার’এর সদস্যদের দেখা যায় রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দপ্তরের হিসেবে প্রিগোজিনের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার সদস্য ছিল। বিদ্রোহের সময় তিনি নিজেই বলেছিলেন যে, তার সাথে ২৫ হাজার সদস্য রয়েছে। বাখমুতের যুদ্ধে এই গ্রুপের সদস্যরা বড় ভূমিকা রেখেছিল; যেখানে অনেকেই ছিল সাজাপ্রাপ্ত আসামি অথবা সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া সেনাসদস্য। ২০১৫ সাল থেকে ‘ওয়াগনার’এর সদস্যরা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে বলে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে; কারণ গ্রুপের কিছু সদস্য একনায়ক বাশার আল-আসাদের বিরোধীদের হাতে নিহত হয়েছে। গৃহযুদ্ধের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে সেখানে ৫ হাজারের বেশি ‘ওয়াগনার’ সদস্য ছিল বলে ধারণা করা হয়; যাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

তবে ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড সবচাইতে বেশি ছড়িয়ে রয়েছে আফ্রিকাতে; যেখানে গ্রুপের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে ব্যাপক। উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে ‘ওয়াগনার’ জড়িয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ত্রিপোলি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত জেনারেল খলিফা হাফতারের অধীনে ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’র পক্ষে ‘ওয়াগনার’ সদস্যরা নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ করছে বলে জানা যায়। একসময় প্রায় ২ হাজারের মতো ‘ওয়াগনার’ সদস্য লিবিয়াতে ছিল। এখান থেকেই সুদানসহ আফ্রিকার অন্যান্য দেশে ‘ওয়াগনার’এর কর্মকান্ড ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন কর্মকর্তারা অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, সুদানে ‘ওয়াগনার’এর সদস্যরা সেদেশের সামরিক শাসকদের সহায়তায় খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।

২০২১ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির ক্ষমতা নেয়া সামরিক শাসকেরাও ‘ওয়াগনার’কে সেদেশে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। জাতিসংঘ অভিযোগ করছে যে, মালির সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগী হিসেবে ‘ওয়াগনার’ সেখানে মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত। এছাড়াও মধ্য আফ্রিকার দেশ সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকেও রয়েছে ‘ওয়াগনার’এর শক্ত অবস্থান। এবছরের ফেব্রুয়ারিতে সেদেশে রুশ রাষ্ট্রদূত এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ১ হাজার ৮’শ ৯০ জন রুশ সামরিক উপদেষ্টা সেখানে কাজ করছে। ‘ওয়াগনার’এর সদস্যরা সেখানে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ফস্টিন আরসাঞ্জএর নিরাপত্তায় কাজ করছে। এর বিনিময়ে ‘ওয়াগনার’ সেদেশের খনিজ সম্পদের ভাগ পেয়েছে বলে বলছেন কেউ কেউ। এছাড়াও ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ২০১৯ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ‘ওয়াগনার’ কাজ করছে। সেদেশের স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদেরকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছে ‘ওয়াগনার’।

‘ওয়াগনার’এর পর কি?

জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, কাউকে কাউকে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, পুরো ব্যাপারটাই ছিল একটা বানানো ষড়যন্ত্র। যদি তা-ই হয়, তাহলে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট, রুশ জেনারেল স্টাফ, পুতিনের অফিসের স্টাফ, এবং ‘ওয়াগনার’এর কিছু লোককেও এই প্রকল্পে যুক্ত করতে হবে। এতগুলি ব্যক্তি যদি এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানে, তাহলে সেটা গোপন থাকার প্রশ্নই আসে না। অপরদিকে মার্ক গ্যালিয়টি বলছেন যে, মার্কিন ইন্টেলিজেন্স জুনের মাঝামাঝি থেকেই ‘ওয়াগনার’এর ব্যাপারে বিদ্রোহের মতোই কিছু একটা আশা করছিলো বলে শোনা যাচ্ছে; যা প্রকৃতপক্ষে অবাস্তব নয়। কারণ ইন্টেলিজেন্স সংস্থাগুলি সর্বদাই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা ধারণা রাখার চেষ্টা করে। এটাকে আলাদাভাবে দেখার কিছু নেই।

‘রুসি’র জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ‘ওয়াগনার গ্রুপ’এর উৎপত্তি একটা চিন্তা থেকে; যার মাঝে রয়েছে বাণিজ্যিক সংস্থার নিজস্ব বাহিনী তৈরি করা; যেমন ‘গ্যাজপ্রম’ এবং ‘রসকসমস’ তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করছে। এগুলির বিশেষত্ব হলো, সংস্থাগুলি বিশ্বব্যাপী তাদের আয় থেকেই এই বাহিনীগুলিকে চালাবে। সমস্যা হলো, অর্থায়নের জন্যে এই বাহিনীগুলি রুশ সরকারের উপরে সরাসরি নির্ভরশীল না থাকায় এগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্যে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সমরাস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে; যা কিনা প্রিগোজিনের ‘ওয়াগনার’এর সাথে দ্বন্দ্বের কারণ হয়েছে।

‘পলিটিকো’ বলছে যে, পুতিন তার ভাষণে ‘ওয়াগনার’এর বিদ্রোহকে ১৯১৭ সালের রুশ গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা দিয়েছেন, যখন বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ছিল রাশিয়া। তবে এখানে আরও ভালো উদাহরণ ছিল ১৯৯১ সালের অগাস্টে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গরবাচেভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা; যখন কট্টরপন্থীরা গরবাচেভের সংস্কারের বিরোধিতা করেছিল। তবে সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় সমাজতান্ত্রিক সরকারের উপর জনগণের আস্থা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল; যার ফলশ্রুতিতে কয়েক মাসের মাঝে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ‘ওয়াগনার’এর একদিনের বিদ্রোহ হয়তো রুশ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উপর ভ্লাদিমির পুতিনের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে দিয়েছে; কিন্তু তা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্যার সমাধান দেয়নি। সেখানে যথেষ্ট সক্ষম একটা বাহিনীর অভাব থেকেই যাচ্ছে; যা কিনা যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার জয়লাভ করাকে চ্যালেঞ্জের মাঝে ফেলছে। পুতিন ‘ওয়াগনার’এর বিদ্রোহকে ১৯১৭ সালের গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। ১৯১৭ সালের সেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই; এবং তা গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে বেশ কয়েক মাস লেগেছিলো। যেটা এখন দেখতে হবে তা হলো, আগামী কয়েক মাসের মাঝে ‘ওয়াগনার’কে উদাহরণ ধরে রুশ বাহিনীর অন্যান্য অংশ থেকে কি কি দাবি উত্থাপিত হয়।

Saturday 17 June 2023

‘আইএমএফ’এর ছোবলে দিশেহারা নাইজেরিয়ার জনগণ

১৭ই জুন ২০২৩

নাইজেরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট তিনুবু সর্বদাই ছিলেন ব্যবসা-বান্ধব একজন রাজনীতিবিদ। প্রেসিডেন্ট হবার পর তার স্বাগত বক্তব্যে তিনুবু ঘোষণা দেন যে, তিনি দেশটার মুদ্রা বিনিময় হারকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেবেন। পশ্চিমা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে জাতীয় মুদ্রা নাইয়ারাকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেয়ার কারণে জনগণকে আমদানি করা খাদ্য বহুগুণ বেশি মূল্যে ক্রয় করতে হবে। ফলস্বরূপ, ‘আইএমএফ’এর উপদেশ মেনে নাইজেরিয়ার ব্যবসা-বান্ধব সরকার এখন জনগণকে কষ্ট সহ্য করতে বলছে।


গত ১৪ই জুন আফ্রিকার সবচাইতে বড় জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির দেশ নাইজেরিয়ার সরকার দেশের জাতীয় মুদ্রা নাইয়ারা-র উপর থেকে সকল নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে সেটাকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে একদিনের মাঝে ডলারের বিপরীতে নাইয়ারা-র মূল্য প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গিয়ে ইতিহাসের সর্বনিম্ন ডলারপ্রতি ৭’শ ৫৫তে গিয়ে দাঁড়ায়। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন যে, এতে দেশের জনগণের উপর স্বল্পমেয়াদে কষ্ট বয়ে নিয়ে আসলেও দীর্ঘমেয়াদে তা নাইজেরিয়ার জন্যে ভালো হবে। নাইজেরিয়ার জাতীয় মুদ্রার মূল্য এতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করতো। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি করা দ্রব্যের জন্যে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মূল্য অপেক্ষাকৃত উচ্চতর রেখেছিল; যাতে করে আমদানি করা দ্রব্য সাধারণ মানুষের ক্রমক্ষমতার মাঝে থাকে। নাইজেরিয়া আমদানি করা গমের উপরে যথেষ্ট নির্ভরশীল; যা ডলারের বিনিময়ে আমদানি করা হয়।

পশ্চিমা সংস্থাগুলি বলছে যে, নতুন নীতির ফলে নাইজেরিয়ায় বিনিয়োগ বাড়বে এবং অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠা করবে। সাম্প্রতিক সময়ে নাইজেরিয়া ব্যাপক মূল্যস্ফীতি এবং মারাত্মক বেকারত্ব সমস্যার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। ‘আফ্রিকা নিউজ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্সি কোম্পানি ‘প্রাইস ওয়াটারহাউজ কুপার্স’ বা ‘পিডব্লিউসি’র নাইজেরিয়া অফিসের বিশ্লেষক তাইয়ো ওইয়েদেলে বলছেন যে, ডলারের বিপরীতে ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার রাখার ফলে এতকাল বাজারে সকল ব্যবসায়ীদের জন্যে একরকম অধিকার নিশ্চিত হয়নি। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অফিশিয়াল বিনিময় হারে ডলার বিক্রি করতে বাধ্য থাকতো; এবং একইসাথে দেশের বাইরে থেকে ডলার বিনিয়োগ আনতে পারছিলো না। মারাত্মক ডলার সংকটের ফলে নাইজেরিয়ায় ব্যবসা করা বিদেশী কোম্পানিগুলি তাদের আয় করা অর্থ দেশের বাইরে নিতে পারছিলো না। শুধুমাত্র বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলিই সাড়ে ৪’শ মিলিয়ন ডলারের আয় নাইজেরিয়ার বাইরে নিয়ে যেতে পারছে না। একারণেই নাইজেরিয়াতে বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

নাইজেরিয়ার নতুন মুদ্রানীতিকে স্বাগত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ‘আইএমএফ’। ১৬ই জুন ‘আইএমএফ’এর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, বহুদিন ধরে নাইজেরিয়ার মুদ্রা ব্যবস্থার ব্যাপারে ‘আইএমএফ’এর যে উপদেশ ছিল, সেটার বাস্তবায়নের কারণে সংস্থাটা দেশের সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে এবং এই নীতি বাস্তবায়নে সরকারকে সহায়তা দেবে ‘আইএমএফ’। নাইজেরিয়ার এনজিও ‘সেন্টার ফর দ্যা প্রোমোশন অব প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজেস’ বা ‘সিপিপিই’এর প্রতিষ্ঠাতা মুদা ইউসুফ এক বিবৃতিতে এই নীতির সমর্থন জানিয়ে বলেন যে, এতে বিনিয়োগ, পুঁজি এবং কর্মসংস্থান বাড়বে এবং ব্যবসা-বান্ধব পরিস্থিতি তৈরি হবে।

প্রেসিডেন্ট বোলা তিনুবু সর্বদাই ছিলেন ব্যবসা-বান্ধব একজন রাজনীতিবিদ। ‘বাজ নাইজেরিয়া’ বলছে যে, ১৯৫২ সালে লেগোসের বড় ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নেয়া এই রাজনীতিবিদ ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান পড়াশোনার জন্যে। সেখানে স্কুল শেষ করে ১৯৭৯ সালে হিসাবরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি নেন। পাস করে বিভিন্ন মার্কিন কোম্পানিতে কাজ করে ১৯৮৩ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি ‘মোবিল’এ কাজ শুরু করেন। ১৯৯১ সালে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ৪০ বছর বয়সে তিনি তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। লেগোস রাজ্যের গভর্নর ছাড়াও তিনি সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এবছরের পহেলা মার্চ তিনুবু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২৯শে মে প্রেসিডেন্ট হবার পর তার স্বাগত বক্তব্যে তিনুবু ঘোষণা দেন যে, তিনি দেশটার মুদ্রা বিনিময় হারকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেবেন।

এর ঠিক দুই দিন আগে ‘বিজনেস ইনসাইডার আফ্রিকার’ এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, নাইজেরিয়াতে ‘আইএমএফ’এর প্রতিনিধি আরি আইসেন এক ভার্চুয়াল আলোচনায় বলেন যে, নাইজেরিয়ার মূল সমস্যা হলো, সরকার কর থেকে যত আয় করছে, তার চাইতে বেশি ব্যয় করছে; যেকারণে ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে দেশটা যদি আয়ের অধিক ব্যয় করতে থাকে, তাহলে কোন একদিন দাতারা ঋণের অর্থ ফেরত চাইবে, অথবা নতুন ঋণ দেয়া বন্ধ করে দেবে।

পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তেল রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমসিম খাচ্ছে নাইজেরিয়া। ‘অবজারভেটরি অব ইকনমিক কমপ্লেক্সিটি’ বা ‘ওইসি’র হিসেবে নাজেরিয়া ২০২১ সালে প্রায় ৫৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য এবং প্রায় ৫ বিলয়ন ডলারের সেবা রপ্তানি করেছিল। এর বিপরীতে দেশটা একইবছর প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য এবং প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারের সেবা আমদানি করে। ৫০ বিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত খনিজ তেল ও গ্যাস রপ্তানি করলেও নাইজেরিয়া প্রায় সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলারের পরিশোধিত তেল আমদানি করে। এছাড়াও দেশটা বিপুল পরিমাণ ডলার ব্যায়ে গম, গাড়ি, ঔষধ, যন্ত্রপাতি, ইত্যাদি আমদানি করে। বিদেশী ব্যবসায়িক সেবা, ব্যক্তিগত ভ্রমণ এবং পরিবহণ সেবা খাতে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর নাইজেরিয়া থেকে চলে যাচ্ছে। এছাড়াও এপ্রিল মাসে কনসাল্টিং কোম্পানি ‘কেপিএমজি’ বলে যে, দেশটার বেকারত্বের হার ২০২২ সালে যেখানে ছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ, তা ২০২৩ সালে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪১ শতাংশে ঠেকবে। তারা বলে যে, শিল্পায়ন না হওয়ায় এবং ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ না বাড়ায় বেকারত্বের সমস্যা থেকেই যাবে।

উপনিবেশ না হয়েও ঔপনিবেশিক নীতি যেন ছাড়ছে না নাইজেরিয়াকে। রেকর্ড মূল্যে জ্বালানি তেল রপ্তানি করলেও দেশটা এখন ব্যাপকভাবে ঋণগ্রস্ত। পরিশোধিত জ্বালানি এলপিজি রপ্তানি করে নাইজেরিয়রা নিজেদের বাসাবাড়িতে রান্নার জন্যে আমদানি করা পরিশোধিত কেরোসিন তেল ব্যবহার করে। শিল্পায়ন না হওয়ায় বেকারত্বের হার আকাশচুম্বী। ‘আফ্রিকা নিউজ’ বলছে যে, নতুন প্রেসিডেন্ট বোলা তিনুবু দেশের অর্থনীতিকে ঘোরাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর গডউইন এমেফিয়েল এবং অর্থনৈতিক ও আর্থিক দুর্নীতি দমন সংস্থার প্রধান আব্দুলরশীদ বাওয়া-কে পদচ্যুত ও গ্রেপ্তার করেছেন, এবং জ্বালানির উপর থেকে ভর্তুকি সরিয়ে নিয়েছেন। এতে ‘আইএমএফ’ খুশি হলেও পরিবহণ খরচ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জেনারেটরের খরচ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন পশ্চিমা প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে জাতীয় মুদ্রা নাইয়ারাকে বাজারের উপরে ছেড়ে দেয়ার কারণে জনগণকে আমদানি করা খাদ্য বহুগুণ বেশি মূল্যে ক্রয় করতে হবে। ফলস্বরূপ, ‘আইএমএফ’এর উপদেশ মেনে নাইজেরিয়ার ব্যবসা-বান্ধব সরকার এখন জনগণকে কষ্ট সহ্য করতে বলছে। পশ্চিমা ঋণের শর্তে নিষ্পেষিত পশ্চিম আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ নাইজেরিয়ার অর্থনৈতিক দৈন্যতা আঞ্চলিক ভূরাজনীতিকে প্রভাবিত করবে নিঃসন্দেহে।

Monday 12 June 2023

ইউক্রেন কি রাশিয়া ও তুরস্কের মাঝে গ্যাস পাইপলাইনে হামলার চেষ্টা করছে?

১৩ই জুন ২০২৩

১১ই জুন ২০২৩। রুশ গোয়েন্দা জাহাজ ‘প্রিয়াজোভিয়ে’র উপর ইউক্রেনিয় বোটের হামলার সময় বোটগুলির উপরে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। রুশ গোয়েন্দা জাহাজের উপর এই হামলা সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিতীয়বার ঘটলো। রুশ জাহাজের উপরে হামলার স্থানগুলি ‘তুর্ক-স্ট্রিম’ এবং ‘ব্লু-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনের ওপর; যা পুরো ব্যাপারটাকে ঘোলাটে করে ফেলেছে।


গত ১১ই জুন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের টেলিগ্রাম সোশাল মিডিয়ার এক পোস্টে বলা হয় যে, তারা কৃষ্ণ সাগরে একটা রুশ সামরিক জাহাজের উপরে ইউক্রেনের সুইসাইড ড্রোন বোটের হামলা প্রতিহত করেছে। ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপোল বন্দর থেকে ৩’শ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে রুশ গোয়েন্দা জাহাজ ‘প্রিয়াজোভিয়ে’র উপর ৬টা দ্রুতগামী ড্রোন বোট হামলা করে। সেসময় জাহাজটা কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সাগরের নিচ দিয়ে যাওয়া ‘তুর্ক্স-স্ট্রিম’ এবং ‘ব্লু-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনের নিরাপত্তা প্রদানের কাজে নিয়োজিত ছিল বলে বলা হয়। এছাড়াও রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, ঠিক সেসময় মার্কিন কৌশলগত গোয়েন্দা ড্রোন বিমান ‘আরকিউ-৪ গ্লোবাল হক’ কৃষ্ণ সাগরের মাঝামাঝি দিয়ে উড়ছিলো। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২০ সালে চালু হওয়া ‘তুর্ক্স-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইন ইউক্রেনকে বাইপাস করে কৃষ্ণ সাগরের তলদেশ ও তুরস্ক হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি করে। অপরদিকে ‘ব্লু-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া তুরস্কে গ্যাস রপ্তানি করে থাকে। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই গ্যাস পাইপলাইনের উপরে যেকোন সংঘাতের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট।

রুশ গোয়েন্দা জাহাজের উপর এই হামলা সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিতীয়বার ঘটলো। গত ২৪শে মে আরেকটা গোয়েন্দা জাহাজ ‘আইভান খুরস’এর উপর তিনটা ইউক্রেনিয় ড্রোন বোট হামলা করে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বার্তায় বলা হয় যে, হামলার সময় জাহাজটা সমুদ্র তলদেশের গ্যাস পাইপলাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তুরস্কের অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাঝে বসফরাস প্রণালি থেকে ১’শ ৪০ কিঃমিঃ উত্তর-পূর্বে অবস্থান করছিলো। সেই হামলা রুশরা প্রতিহত করার কথা বলে এবং একটা ড্রোন বোট ধ্বংস করার সপক্ষে একটা ভিডিও প্রকাশ করে। তবে ইউক্রেনিয় সামরিক বাহিনী একটা ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে ড্রোন বোট থেকে ধারণ করা ফুটেজ দেখানো হয়। এই ভিডিওতে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, অন্ততঃ একটা ড্রোন বোট ‘আইভান খুরস’ জাহাজের পিছনে বাঁ দিকে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে হামলার পর জাহাজটার সেভাস্তোপোল বন্দরে ফিরে আসার ছবি সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশ হলে বিশ্লেষকেরা ধারণা করেন যে, জাহাজটা খুব সম্ভবতঃ তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি অথবা রুশরা খুব দ্রুতই ক্ষতির অংশটা মেরামত বা রং দিয়ে ঢেকে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

ইউক্রেনিয়দের প্রকাশ করা ভিডিওর ফলশ্রুতিতে কিছু পশ্চিমা বিশ্লেষক তাদের যুক্তি থেকে সরে আসতে বাধ্য হন; যারা বলেছিলেন যে, হয়তো রুশরা নিজেরাই ইউক্রেনিয়দের নাম দিয়ে এই হামলা করে থাকতে পারে। তারা মানতে পারছিলেন না যে, তুরস্কের মতো একটা ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে ঢুকে একটা রুশ জাহাজের উপরে ইউক্রেনিয়রা হামলা করতে পারে। একইসাথে জায়গাটা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা সমুদ্র উপকূল থেকে প্রায় ৪’শ কিঃমিঃ দূরে। এতটা দূরত্ব পার হয়ে একটা জাহাজের উপরে হামলা করার সক্ষমতা ইউক্রেনের আছে কিনা, তা নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলেন। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য এবং ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক এইচ আই সাটন ‘কোভার্ট শোরস’ নামে তার ওয়েবসাইটে এক বিশ্লেষণে বলেন যে, এই হামলা ইউক্রেন করেছে এটা প্রমাণ করতে পারলে রুশরা বলতে পারবে যে, ইউক্রেনিয়রা ‘তুর্ক-স্ট্রিম’ এবং ‘ব্লু-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনের উপরে হামলা করতে চাইছে।

পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স সহায়তা ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে ৪’শ কিঃমিঃ দূরে গভীর সমুদ্রে একটা চলমান জাহাজ খুঁজে বের করে আক্রমণ করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেহেতু কৃষ্ণ সাগরে পশ্চিমা গোয়েন্দা বিমান সর্বদাই কাজ করছে এবং ইউক্রেনকে ইন্টেলিজেন্স সরবরাহের মাধ্যমে সহায়তা দিচ্ছে, কাজেই এটা সন্দেহের উর্ধ্বে নয় যে, ইউক্রেনিয় এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকতে পারে। এর আগে বল্টিক সাগরের তলদেশে ‘নর্ড স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র যেমন জার্মানিকে হামলাকারী কে ছিল, সেব্যাপারে চুপ থাকতে বাধ্য করতে পেরেছিল, সেটা ‘তুর্ক-স্ট্রিম’এর উপর নির্ভরশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে করতে গেলে দু’টা ন্যাটো সদস্য দেশ তুরস্ক এবং হাঙ্গেরির সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে।

অনলাইন ম্যাগাজিন ‘দ্যা ড্রাইভ’এর সামরিক সেকশন ‘দ্যা ওয়ার জোন’এর এক লেখায় হাওয়ার্ড অল্টম্যান বলেন যে, ‘আইভান খুরস’এর উপর হামলা করা বোটগুলি রুশ নৌঘাঁটি সেভাস্তোপোলের উপর হামলায় ব্যবহার করা বোটগুলি থেকে আলাদা। ২০২২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে এবং ২০২৩এর মার্চের সেই হামলাগুলিতে ব্যবহৃত বোটগুলি ঘন্টায় প্রায় ৮০ কিঃমিঃ বেগে ছুটতে পারতো। প্রায় আড়াই লক্ষ ডলার ব্যয়ে সেই বোটগুলি তৈরি করার জন্যে গত নভেম্বরে জনগণের কাছ থেকে অর্থ চাওয়া হয়েছিল।

ইউক্রেনিয় ড্রোনগুলি যদি সর্বোচ্চ ৮০ কিঃমিঃ গতিতেও ছোটে, তাহলেও ইউক্রেনের উপকূল থেকে রুশ জাহাজ ‘আইভান খুরস’এর উপরে হামলা করতে কমপক্ষে ৫ ঘন্টা লাগার কথা। এই লম্বা সময় পর একটা চলমান জাহাজকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে ইউক্রেনিয়দেরকে ভিন্ন ইন্টেলিজেন্স উৎস খুঁজতেই হবে। তুর্কি ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষক ইয়োরুক ইশিক টুইটারে এক বিশ্লেষণে দেখান যে, ২৪শে মে রুশ জাহাজ ‘আইভান খুরস’এর উপর হামলার সময় কৃষ্ণ সাগরের আকাশে ব্রিটিশ ‘আরসি-১৩৫ডব্লিউ রিভেট জয়েন্ট’ গোয়েন্দা বিমান দু’টা ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’ ফাইটার বিমানের প্রহড়ায় উড়ছিল। একইসাথে আকাশে ছিল মার্কিন গোয়েন্দা ড্রোন ‘আরকিউ-৪বি গ্লোবাল হক’। রুশ টেলিগ্রাম চ্যানেল ‘রাইবার’এর এক বিশ্লেষণে বলা হয় যে, কৃষ্ণ সাগরের উপর এত গোয়েন্দা কর্মকান্ড এবং একই দিনে ‘আইভান খুরস’এর উপর হামলার মাঝে হয়তো যোগসাজস থাকতে পারে। হাওয়ার্ড অল্টম্যান এই মতের সাথে একমত না হলেও তিনি প্রশ্ন করেন যে, প্রায় ৪’শ কিঃমিঃ দূরে ইউক্রেনিয়রা কিভাবে এই হামলা করতে পারলো? ইউক্রেনের কাছাকাছি আরও বহু রুশ জাহাজ ছিল; সেগুলির উপর হামলা না করে এত দূরের চলমান টার্গেটের উপর এত ছোট বোট দিয়ে কিভাবে হামলা করা সম্ভব? হয়তোবা এখানে অন্য কোন ‘মাদারশিপ’এর ব্যবহারও থাকতে পারে।

রুশ জাহাজের উপরে হামলার স্থানগুলি ‘তুর্ক-স্ট্রিম’ এবং ‘ব্লু-স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনের ওপর; যা পুরো ব্যাপারটাকে ঘোলাটে করে ফেলেছে; যদিও পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা অনেকেই মানতে নারাজ যে, রুশ গোয়েন্দা জাহাজগুলি গ্যাস পাইপলাইনের নিরাপত্তা দিচ্ছে। তথাপি মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ইয়র্কটাউন ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো স্টিফেন ব্রাইয়েন এক লেখায় সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে, পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স সহায়তা ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে ৪’শ কিঃমিঃ দূরে গভীর সমুদ্রে একটা চলমান জাহাজ খুঁজে বের করে আক্রমণ করা সম্ভব কিনা। যেহেতু কৃষ্ণ সাগরে পশ্চিমা গোয়েন্দা বিমান সর্বদাই কাজ করছে এবং ইউক্রেনকে ইন্টেলিজেন্স সরবরাহের মাধ্যমে সহায়তা দিচ্ছে, কাজেই এটা সন্দেহের উর্ধ্বে নয় যে, ইউক্রেনিয় এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকতে পারে। ব্রাইয়েনএর মতে, এর আগে বল্টিক সাগরের তলদেশে ‘নর্ড স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র যেমন জার্মানিকে হামলাকারী কে ছিল, সেব্যাপারে চুপ থাকতে বাধ্য করতে পেরেছিল, সেটা ‘তুর্ক-স্ট্রিম’এর উপর নির্ভরশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে করতে গেলে দু’টা ন্যাটো সদস্য দেশ তুরস্ক এবং হাঙ্গেরির সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে।

Friday 9 June 2023

রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইউক্রেন-সমর্থিত হামলার গুরুত্ব কতটুকু?

০৯ জুন ২০২৩

২৫শে মে, ২০২৩। উত্তর ইউক্রেনে রুশ বিদ্রোহী গ্রুপ ‘রাশান ভলানটিয়ার কোর’এর সংবাদ সন্মেলন। সরকারিভাবে মার্কিনীরা রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলাকে সমর্থন না করলেও মার্কিন চিন্তাবিদদের কথায় এটা পরিষ্কার যে, ওয়াশিংটনে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার পক্ষে জোরালো সমর্থন তৈরি হয়েছে। রুশ উগ্রপন্থী ‘নিও-নাজি’ গ্রুপকে ইউক্রেনিয়দের ব্যবহার করা সম্পর্কে মার্কিন চিন্তাবিদেরা বলছেন যে, ইউক্রেনিয়রা নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে এরকম গ্রুপগুলিকে ব্যবহার করতেই পারে; যেখানে চিন্তার ভিত্তিটা হলো, ‘আমার শত্রুর শত্রু হলো আমার বন্ধু’।

গত ২২শে মে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, দু’টা রুশ বিদ্রোহী গ্রুপ ইউক্রেন থেকে রাশিয়া অভ্যন্তরে হামলা করে কিছু অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। ২৪শে মে রুশ বিদ্রোহী গ্রুপ ‘ফ্রিডম অব রাশিয়া লিজিয়ন’ গ্রুপের নেতা ইলিয়া পনোমারেভ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’কে দেয়া এক সাক্ষাতে ‘লিজিয়ন’এর চারটা এবং ‘রাশান ভলানটিয়ার কোর’এর একটা ব্যাটালিয়ন এই হামলায় অংশ নিচ্ছে বলে বলেন। তিনি বলেন যে, তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য হলো রাশিয়ার বর্তমান নেতৃত্বকে ক্ষমতাচ্যুত করা। এই মুহুর্তে তাদের সামরিক লক্ষ্য হলো ইউক্রেনিয় বাহিনীকে গ্রীষ্মকালীন আক্রমণে সহায়তা দিতে রুশ বাহিনীকে ভিন্ন দিকে ধাবিত করা। তিনি স্বীকার করেন যে, তাদের বাহিনী ইউক্রেনিয় বাহিনীর অংশ; তবে তাদের বাহিনীর সকলেই রুশ নাগরিক। ‘ন্যাশনাল রিপাবলিকান আর্মি’ নামের এক রুশ বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা রুশ চিন্তাবিদ আলেক্সান্ডার দুগিনের কন্যাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রুশ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং যারা মস্কোতে ড্রোন হামলা করেছে, তাদের সাথেও তার গ্রুপের যোগাযোগ রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

২৫শে মে রুশ বিদ্রোহী গ্রুপ ‘রাশান ভলানটিয়ার কোর’ উত্তর ইউক্রেনের সুমি এলাকায় রুশ সীমান্তের কাছে এক সংবাদ সন্মেলন ডাকে। ডেনিস নিকিতিন নামে তাদের নেতা সাংবাদিকদের বলেন যে, তার অনুগত সেনারা রাশিয়ার অভ্যন্তরে সীমান্তবর্তী একটা শহর দখলে নিয়েছে। তিনি নিজেকে উগ্র ডানপন্থী বলে আখ্যা দেয়াকে সমস্যা মনে করেন না; তবে নিজেকে ‘নিও-নাজি’ আখ্যা দেয়ার ক্ষেত্রে তার দ্বিমত রয়েছে। এই দলের সদস্যরা দখল করা রুশ সাঁজোয়া যান প্রদর্শন করে এবং বলে যে, পুরো ইন্টারনেট এই খবরে ভরে যাবে; যা তাদের একটা সফলতা। তবে ‘সিএনএন’ বলছে যে, এই বাহিনীর সকল সদস্যই ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং তাদের রয়েছে ইউক্রেনিয় সামরিক পরিচয়পত্র। যদিও তারা বলছে যে, তারা ইউক্রেনিয় সামরিক বাহিনীর সহায়তা ছাড়াই এই মিশন পরিচালনা করছে, তথাপি তা বিশ্বাস করাটা কষ্টকর। শুধু তা-ই নয়, মার্কিন নির্মিত ‘এমর‍্যাপ’ সাঁজোয়া গাড়ি এই হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা বলছে যে, তারা এসকল গাড়ি খোলা বাজার থেকে কিনেছে।

ক্রেমলিনের কর্মকর্তারা বেশ শান্ত থেকেই এই পরিস্থিতির উপরে বক্তব্য দিচ্ছে। ৩রা জুন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সরকারি টেলিভিশনে এসে রুশ কর্মকর্তাদেরকে বলেন যে, তারা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করবেন। তিনি বিশেষ করে উল্লেখ করেন যে, কিছু লোক রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খারাপ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। ‘সিএনএন’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খাপ করার যে কথাটা পুতিন বলছেন, ঠিক সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে রুশ গ্রুপগুলি; যারা ইউক্রেনের সহায়তা নিয়ে ইউক্রেনের সরবরাহ করা অস্ত্র এবং গাড়ি ব্যবহার করে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করছে। একইসাথে রাশিয়ার অভ্যন্তরে চলছে ড্রোন হামলা। রুশ মিডিয়ার বরাত দিয়ে ‘পিবিএস’ বলছে যে, ইউক্রেনিয় হামলার কারণে সীমান্তবর্তী বেলগোরদ অঞ্চল থেকে হাজারো মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের সীমানা থেকে বহুদূরে তেল শোধনাগার, পাইপলাইন, অস্ত্রাগার এবং রেলওয়ে জংশনের উপরে হামলা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং পোল্যান্ডের সরবরাহকৃত কমপক্ষে চারটা ‘এমর‍্যাপ’ সাঁজোয়া যান রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও বেলজিয়াম এবং চেক রিপাবলিকে তৈরি রাইফেল এবং যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ‘এটি-৪’ ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী রকেটও তাদের হাতে দেখা গেছে। কমপক্ষে দু’টা ‘এমর‍্যাপ’ রুশদের হাতে পড়েছে বলে সোশাল মিডিয়ার পোস্ট থেকে জানা যাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলাকে সমর্থন করেনা। বেলজিয়ামের কর্মকর্তারা তাদের দেয়া অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি; আর চেক রিপাবলিক ও পোলিশ প্রতিরক্ষা দপ্তর মন্তব্য করতে চায়নি।

মার্কিন নির্মিত 'এমর‍্যাপ' সাঁজোয়া যান; যা কিনা রাশিয়ার বেলগোরদ এলাকায় রুশদের হাতে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে তৈরি অস্ত্র ও সরঞ্জামাদি রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে; যদিও সরকারিভাবে পশ্চিমা দেশগুলি রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার সমর্থন করছে না।

ইউক্রেনের প্রাক্তন উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলিনা ফ্রোলোভা ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, তিনি মনে করেন না যে, রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করা এই গ্রুপগুলির হাতে পশ্চিমাদের সরবরাহ করা অস্ত্র যুদ্ধকে আরও বড় করতে পারে। লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনিয় যখন জীবন ঝুঁকির মাঝে রয়েছে, তখন যুদ্ধের পরিধি বৃদ্ধির কিছু নেই; বরং সেক্ষেত্রে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা যুদ্ধের পরিধিকে কমাতে সহায়তা করবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার’এর ডিরেক্টর জেনিফার কাফারেলা ‘পিবিএস’এর সাথে সাক্ষাতে বলছেন যে, রাশিয়ার ভিতর এই হামলাগুলি খুবই ছোট; কিন্তু সেগুলি রুশদেরকে বিচলিত করতে পেরেছে এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে। এর মাধ্যমে রুশ জনগণকে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, রাশিয়া এখনও যুদ্ধে জিততে পারেনি; এমনকি হেরেও যেতে পারে। তবে রাশিয়ার অভ্যন্তরে সাপ্লাই ডিপোগুলির উপরে ইউক্রেনিয় হামলাগুলির গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি। এই মুহুর্তে ক্রেমলিনের সামনে চ্যলেঞ্জ হলো, রুশ জনগণকে আস্বস্ত করা এবং সীমিত সামরিক সক্ষমতাকে সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা এবং একইসাথে ইউক্রেনিয়দের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণকে প্রতিহত করা।

সরকারিভাবে মার্কিনীরা রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলাকে সমর্থন না করলেও মার্কিন চিন্তাবিদদের কথায় এটা পরিষ্কার যে, ওয়াশিংটনে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলার পক্ষে জোরালো সমর্থন তৈরি হয়েছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক ‘সিএনএন’এর সাথে সাক্ষাতে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলাকে সমর্থন করে বলেন যে, এই হামলার মাধ্যমে রুশ জনগণকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, রাশিয়া এখন একটা যুদ্ধের মাঝে রয়েছে। এবং ইউক্রেনিয়রা নিজেদের উপরে হামলা থেকে বাঁচতে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করবেই; এবং এক্ষেত্রে রুশ জনগণকে এই যুদ্ধ বন্ধে চেষ্টা করতে হবে। রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা ইউক্রেনের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণের সাথে কৌশলগতভাবে যুক্ত। মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল স্টিভ এন্ডারসন ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, রাশিয়ার ভেতরে এই হামলা ইউক্রেনের জন্যে একটা বড় অপারেশনাল বিজয়; কারণ এর ফলে রুশরা হয়তো ইউক্রেনের অভ্যন্তরে মোতায়েন করা ২ লক্ষ রুশ সেনার মাঝ থেকে কিছু সেনাকে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মোতায়েন করতে বাধ্য হবে। রুশ উগ্রপন্থী ‘নিও-নাজি’ গ্রুপকে ইউক্রেনিয়দের ব্যবহার করা সম্পর্কে জেনিফার কাফারেলা বলছেন যে, ইউক্রেনিয়রা নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে এরকম গ্রুপগুলিকে ব্যবহার করতেই পারে; যেখানে চিন্তার ভিত্তিটা হলো, ‘আমার শত্রুর শত্রু হলো আমার বন্ধু’।

Sunday 4 June 2023

সংযুক্ত আরব আমিরাত কি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিন্ন পথে চলেছে?

০৪ঠা জুন ২০২৩

এপ্রিল ২০২৩। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল ধাফরা সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন 'এ-১০ থান্ডারবোল্ট' যুদ্ধবিমান। চার দশকের পুরোনো এই বিমানগুলিকে যখন রিটায়ার করা হচ্ছে, তখনই এগুলিকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। অপরদিকে অত্যাধুনিক সকল যুদ্ধবিমানকে হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে অথবা ইউরোপে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মোতায়েন করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিমান বাহিনী সর্বমোট আড়াই স্কোয়াড্রন বিমান মোতায়েন রাখার টার্গেট রেখেছে। একেকটা স্কোয়াড্রনে ১২টা করে যুদ্ধবিমান থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে থাকবে সর্বমোট ৩০টা বিমান।

গত ৩১শে মে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, দু’মাস আগে দেশটা মধ্যপ্রাচ্যে এবং এর আশেপাশের অঞ্চলে নিরাপত্তায় নিয়োজিত যৌথ নৌ বহর ‘কম্বাইন্ড ম্যারিটাইম ফোর্সেস’ বা ‘সিএমএফ’ থেকে নিজেদের নাম সরিয়ে নিয়েছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, আমিরাতের এই সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়; যা অত্র অঞ্চলের নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পারে। ‘সিএমএফ’এর অধীনে অঞ্চলটা একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক নৌ বাণিজ্যের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পথ, তেমনি ২০১৯ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মাঝে উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে বেশ কিছু বাণিজ্যিক জাহাজের উপরে হামলা হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমিরাত ‘সিএমএফ’এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সদস্য দেশ।

‘সিএমএফ’ কি এবং এর উদ্দেশ্য কি?

‘সিএমএফ’এর ওয়েবসাইট বলছে যে, ২০০১ সালে স্থাপিত এই সংস্থাটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত কয়েকটা যৌথ নৌবহরের সমন্বয়; যার মাঝে রয়েছে ওমান উপসাগর ও ভারত মহাসাগরে নিরাপত্তা দেয়া ‘কম্বাইন্ড টাস্ক ফোর্স ১৫০’ বা ‘সিটিএফ-১৫০’, চোরাচালান দমনে কাজ করা ‘সিটিএফ’-১৫১’, পারস্য বা আরব উপসাগরে নিরাপত্তা দেয়া ‘সিটিএফ-১৫২’, লোহিত সাগর ও আদেন উপসাগরে নিরাপত্তা দেয়া ‘সিটিএফ-১৫৩’ এবং ম্যারিটাইম নিরাপত্তা বিষয়ক ট্রেনিং উইং ‘সিটিএফ-১৫৪’। পুরো ‘সিএমএফ’এর কমান্ডার হলেন মার্কিন নৌবাহিনীর একজন ভাইস এডমিরাল; এবং তার ডেপুটি হলেন ব্রিটিশ রয়াল নেভির একজন কমোডোর। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ‘সেন্ট্রাল কমান্ড’এর অধীনে ৫ম নৌবহরের কমান্ডারই এই যৌথ বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে থাকেন। আর এই পুরো বাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স হলো বাহরাইন। এর সদস্যসংখ্যা এখন ৩৮। ‘সিএমএফ’এর সদস্য দেশগুলির মাঝে রয়েছে - মধ্যপ্রাচ্যের ১০টা দেশ - বাহরাইন, মিশর, ইরাক, জর্দান, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন; আফ্রিকার ৩টা দেশ - জিবুতি, কেনিয়া, সেইশেল; ভারত মহসাগরের দেশ ভারত ও পাকিস্তান; পূর্ব এশিয়ার ৬টা দেশ - মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান; ওশেনিয়ার অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড; ইউরোপের ১২টা দেশ - ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, গ্রিস, নরওয়ে, তুরস্ক; এবং আমেরিকার ৩টা দেশ - যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রাজিল।

তবে একই অঞ্চলের বা অঞ্চলের বাইরের কিছু উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্র এই বাহিনীতে নাম লেখায়নি, যেখন ইরান, রাশিয়া এবং চীন। যৌথ এই বাহিনীর বেশিরভাগ দেশই যুক্তরাষ্ট্রের খুবই কাছের বন্ধু। এই বাহিনীতে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশ রয়েছে ১৪টা। বাহিনীর ১২টা ইউরোপিয় দেশ এবং এশিয়ার কিছু দেশ মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির উপরে নির্ভরশীল। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ছাড়া এই বাহিনীতে নাম লেখানো বেশিরভাগ দেশই ‘সিএমএফ’এর অধীনে সর্বদা সামরিক জাহাজ মোতায়েন রাখে না। তবে অদ্য অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশই নিজেদের নৌবাহিনীর জাহাজ দিয়ে এই বাহিনীতে অংশ নেয়। অর্থাৎ ‘সিএমএফ’এর মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলি নিজেদের সামরিক শক্তি তেমন একটা মোতায়েন না করেই আঞ্চলিক দেশগুলির সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক পত্রিকা ‘আল মনিটর’ ব্যাখা দিয়ে বলছে যে, এই যৌথ নৌবহরের সদস্য দেশগুলি যখন সম্ভব হয় তখন তাদের জাহাজ বা বিমান দিয়ে অংশ নেয়; অন্য সময় সেগুলি অন্য কোন দরকারি কাজে অংশ নেয়ার জন্যে এই অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ছাড়া এই বাহিনীতে নাম লেখানো বেশিরভাগ দেশই ‘সিএমএফ’এর অধীনে সর্বদা সামরিক জাহাজ মোতায়েন রাখে না। তবে অদ্য অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশই নিজেদের নৌবাহিনীর জাহাজ দিয়ে এই বাহিনীতে অংশ নেয়। অর্থাৎ ‘সিএমএফ’এর মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলি নিজেদের সামরিক শক্তি তেমন একটা মোতায়েন না করেই আঞ্চলিক দেশগুলির সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করে তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে আমিরাতের অসন্তোষ

‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, গত ২৭শে এপ্রিলে এবং ৩রা মে ইরানিরা দু’টা তেলবাহী জাহাজ দখল করে নেয়; যার মাঝে ছিল ‘নিওভি’ নামের একটা জাহাজ, যা কিনা দুবাই থেকে আমিরাতের ফুজাইরাহ বন্দরে যাচ্ছিলো। ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আমিরাতের ‘সিএমএফ’ ছাড়ার কেন্দ্রে রয়েছে এই ইস্যুর ব্যাপারে হতাশা; কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইরানের হুমকির ব্যাপারে কোন কিছু করতে ব্যার্থ হয়েছে। তবে আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের কোন সমস্যা হয়নি; বরং মিডিয়া এই ব্যাপারটাকে ভুল দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ‘রাইস ইউনিভার্সিটি’র ‘বেকার ইন্সটিটিউট ফর পাবলিক পলিসি’র ফেলো ক্রিশ্চিয়ান আলরিকসেন ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলিকে রক্ষা করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র উদাসীন ভূমিকা নিয়েছে বলে আবু ধাবিতে অনেকেই মনে করছেন। তবে মার্কিন সামরিক বাহিনীর পত্রিকা ‘স্টারস এন্ড স্ট্রাইপস’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন কর্মকর্তা মনে করিয়ে দেন যে, আমিরাতিরা বলছে যে, তারা দুই মাস আগেই ‘সিএমএফ’ ছেড়ে গেছে; কিন্তু ইরানিরা তো দু’টা জাহাজ দখল করেছে সেই সময়ের অনেক পর।

‘আল মনিটর’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, হরমুজ প্রণালিতে দু’টা জাহাজ ইরানিরা দখলে নেবার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ঘোষণা দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র অত্র অঞ্চলে সামরিক টহল বৃদ্ধি করবে। গত ৩রা মে ‘নিওভি’ নামের জাহাজটা যখন ইরানিরা দখলে নিচ্ছিলো, তখন মার্কিন একটা ড্রোন বিমান আকাশ থেকে তা অবলোকন করছিলো। কিন্তু মার্কিনীরা বলছে যে, তারা জাহাজের নাবিকদের কাছ থেকে সহায়তার কোন আবেদন পাননি। এর আগে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা তিনবার আমিরাতের উপর ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা করে। এর মাঝে শেষের দু’টা হামলা ছিল আমিরাতে অবস্থিত মার্কিন ‘আল ধাফরা’ সামরিক ঘাঁটির উপরে। এটা ছিল আমিরাতের ভূমিতে হুথিদের প্রথম আক্রমণ। আমিরাতিদের যথেষ্ট অনুরোধ সত্ত্বেও ঘটনার এক মাসেরও বেশি সময় পর যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর একটা ডেস্ট্রয়ার এবং ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান পাঠায়; যার একটা উদ্দেশ্য ছিল সেখানে মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা দেয়া। মার্কিনীদের এই সিদ্ধান্ত আমিরাতিদের খুশি করতে পারেনি। ২০২১ সালে মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরিয়ে নেয় এবং তারা নৌবাহিনীর শক্তিও কমিয়ে নিয়েছে। পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলছেন যে, রাশিয়া এবং চীনের হুমকিকে মোকাবিলা করতেই যুক্তরাষ্ট্রকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে ফেলায় তা অত্র অঞ্চলের দেশগুলির মাঝে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে।

‘কিংস কলেজ, লন্ডন’এর এসোসিয়েট প্রফেসর আন্দ্রেয়াস ক্রীগ ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, আবু ধাবির চোখে যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবেই আঞ্চলিক নিরাপত্তার নিশ্চায়ক হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে জানান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। একারণে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা চাপের মাঝে রয়েছে। আমিরাত একারণে নিজেদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না; যতটুকু সম্ভব তারা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে চাইছে। আমিরাতিরা দেখাতে চাইছে যে, তারা একটা সার্বভৌম দেশ; যারা যেকোন যৌথ বাহিনীতে স্বেচ্ছায় ঢুকতে বা বের হতে পারে। একইসাথে আমিরাতিরা যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও রাশিয়া এবং চীনের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। তারা বরং ওয়াশিংটনকে বার্তা দিতে চাইছে যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আমিরাত গুরুত্বপূর্ণ; এবং দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমিরাতের একটা শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে।

জানুয়ারি ২০১৮। আমিরাতি সেনাদের সাথে মার্কিন সেনাদের যৌথ সামরিক মহড়া। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমিরাতের সামরিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়নি। আর আমিরাত এখনোও মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এছাড়াও আমিরাতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী সামরিক চুক্তি রয়েছে।


আমিরাত কি যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে যাচ্ছে?

‘আল মনিটর’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আমিরাত যে ‘সিএমএফ’ ছেড়ে যাচ্ছে, সেটা তারা যুক্তরাষ্ট্রকে অফিশিয়ালি জানায়নি। মার্কিন ৫ম নৌবহরের মুখপাত্র কমান্ডার টিম হকিন্স বলছেন যে, তার জানা মতে এখনও আমিরাত ‘সিএমএফ’এর সদস্য হিসেবে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমিরাতের সামরিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়নি। মার্কিন ‘সেন্ট্রাল কমান্ড’এর ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, গত ২২শে মে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব আমিরাতের বাহিনীর মাঝে ‘ইনট্রেপিড মেভেন ২৩-৩’ নামে একটা সামরিক মহড়া শেষ হয়েছে। এতে ১’শ জন মার্কিন ম্যারিন সেনা ও নৌসদস্যের সাথে আমিরাতি বাহিনীর ‘প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড’ এবং ‘জয়েন্ট এভিয়েশন কমান্ড’এর সেনারা অংশ নেয়। এছাড়াও ‘আল মনিটর’ বলছে যে, এক সপ্তাহ আগেই মার্কিন নৌবাহিনীর একটা ডেস্ট্রয়ার আমিরাতি নৌবাহিনীর একটা জাহাজের সাথে ওমান উপসাগরে ‘পাসেক্স’ মহড়ায় অংশ নিয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা চাইছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করুক।

আমিরাত এখনোও মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। ২০০১ সালের ‘৯-১১’এর ঘটনার পরপরই ২০০২ সালের ২৫শে জানুয়ারি থেকে যুক্তরাষ্ট্র আমিরাতের ‘আল ধাফরা’ সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করে আসছে। ‘মিলিটারি ডট কম’ বলছে যে, ১৯৯০এর দশক থেকেই মার্কিনীরা গোপনে এই ঘাঁটি ব্যবহার করে আসছিলো; এবং শুধুমাত্র ২০১৭ সালের অগাস্টে যুক্তরাষ্ট্র এই ঘাঁটি ব্যবহার করার কথা স্বীকার করে। আফগানিস্তান এবং ইরাকে মার্কিন সামরিক অভিযান চালাতে এই ঘাঁটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। মার্কিন সামরিক সূত্র বলছে যে, মার্কিন বিমান বাহিনীর রিফুয়েলিং ট্যাংকার, এয়ারবোর্ন রাডার বিমান, কৌশলগত গোয়েন্দা বিমান ছাড়াও ফাইটার বিমান ও কৌশলগত গোয়েন্দা ড্রোন বিমান এই ঘাঁটি ব্যবহার করেছে। বর্তমানে এই ঘাঁটিতে মার্কিন বিমান বাহিনীর ‘৩৮০তম উইং’এর অধীনে বেশকিছু মার্কিন সামরিক সদস্য রয়েছে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন। মার্কিন বিমান বাহিনীর ওয়েবসাইট বলছে যে, এখানে বর্তমানে ‘এমকিউ-৯ রীপার’ ড্রোন মোতায়েন রয়েছে।

এছাড়াও আমিরাতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী সামরিক চুক্তি রয়েছে। ২০১৭ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ‘ডিফেন্স কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট’ বা ‘ডিসিএ’ নামে এই চুক্তি মূলত ১৯৯৪ সাল থেকে চালু থাকলেও সেবারই প্রথম এই চুক্তি জনসন্মুখে আনা হয়। এই চুক্তির মাঝে যৌথ সামরিক মহড়া ছাড়াও রয়েছে স্পেশাল ফোর্সের সহযোগিতা এবং আমিরাতের সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম জমা করে রাখার ব্যবস্থা। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র বড় কোন সামরিক মিশন শুরু করলে আমিরাতের ঘাঁটিতে রেখে দেয়া যুদ্ধ সরঞ্জাম দিয়েই মার্কিন সেনারা যুদ্ধ করবে। ‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, দুই দশকে আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের বড় সামরিক অভিযানগুলিতে সরাসরি সহযোগিতা করেছে; যার মাঝে রয়েছে আফগানিস্তান, লিবিয়া, সোমালিয়া, বসনিয়া, কসোভো, ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়াতে সামরিক মিশন। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিতে এক দশকের উপরে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন রেখেছিল আমিরাতিরা।

জুন ২০১৯। আরব আমিরাতের নেতা মোহাম্মদ বিন জায়েদের সাথে বৈঠক করছেন ব্রিটিশ সামরিক উপদেষ্টা লেঃজেঃ লরিমার। ব্রিটিশরা অনেকেই বলেন যে, ব্রিটেন কখনোই মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যায়নি। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের এই ক্ষুদ্র দেশগুলির প্রত্যেকটাতেই ব্রিটিশ নাগরিকেরা সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছে। অর্থাৎ এই দেশগুলির উপর ব্রিটেনের প্রভাব এখনও যথেষ্ট; যদিও ব্রিটেন এই দেশগুলির নিরাপত্তা দিতে সক্ষমতা হারিয়েছে বহু আগেই।


আরব আমিরাতের উপর ব্রিটেনের প্রভাব

১৯৭১ সালের ২রা ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্ম হয়। ঊনিশ শতক থেকেই ব্রিটেন পারস্য উপসাগরে নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করে এবং উপসাগরের সকল বন্দরে নিজেদের পক্ষের লোক তৈরি করে। ভারতে অবস্থিত ব্রিটিশ নৌবাহিনী পারস্য উপসাগরে নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলের উপরে প্রভাব বিস্তার করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফত ধ্বংসের পর ব্রিটেন এই অঞ্চলে সৌদি আরব এবং ইরাকসহ অনেকগুলি দেশ তৈরি করে। একইসাথে পারস্য উপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলগুলিকে সেই দেশগুলির অন্তর্গত না করে আলাদা আলাদা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তৈরি করে; যার মাঝে ছিল কুয়েত, বাহরাইন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলি ইরাক, সৌদি আরব এবং ইরানের হুমকির কারণে ব্রিটেনের সামরিক সহায়তার উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়। ওমানও ছিল ব্রিটেনের নিরাপত্তার উপরে নির্ভরশীল। এই রাষ্ট্রগুলিকে রক্ষার ছুতোয় ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্যে বেশ কয়েকবার সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছিল। তবে ১৯৫৬ সালে মিশরে মার্কিন সমর্থিত সরকার সুয়েজ খালকে সরকারিকরণ করার পর ব্রিটেন সুয়েজ খালের পূর্বের সকল সামরিক ঘাঁটি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটেন ১৯৬১ সালে কুয়েত এবং ১৯৭১ সালে বাহরাইন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্ম দেয়। সেই বছরই ব্রিটেনের সামরিক বাহিনী মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যায় এবং নতুন মার্কিন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

তবে ব্রিটিশরা অনেকেই বলেন যে, ব্রিটেন কখনোই মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যায়নি। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের এই ক্ষুদ্র দেশগুলির প্রত্যেকটাতেই ব্রিটিশ নাগরিকেরা সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছে। অর্থাৎ এই দেশগুলির উপর ব্রিটেনের প্রভাব এখনও যথেষ্ট; যদিও ব্রিটেন এই দেশগুলির নিরাপত্তা দিতে সক্ষমতা হারিয়েছে বহু আগেই। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ব্রিটেন ঘোষণা দেয় যে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে তাদের সামরিক নৌঘাঁটি তৈরি করতে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে বাহরাইনে ‘জুফাইর’ নামের এই ঘাঁটি উদ্ভোধন করা হয়। ২০১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দেয় যে, তারা ওমানের দুকমে আরেকটা নৌঘাঁটি খুলতে যাচ্ছে। এই ঘাঁটিগুলির উপরে নির্ভর করে ব্রিটিশ রয়াল নেভি পারস্য উপসাগরে একটা নৌ স্কোয়াড্রন মোতায়েন রেখেছে; যার মাঝে রয়েছে একটা ফ্রিগেট, একটা রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার, তিনটা মাইন ধ্বংসকারী জাহাজ এবং বড় আকারের একটা মাইন ওয়ারফেয়ার কমান্ড জাহাজ।

মার্কিন নৌবাহিনীর ৫৫ মিটার লম্বা 'সাইক্লোন-ক্লাস' প্যাট্রোল জাহাজ। যুক্তরাষ্ট্র বেশ অনেকদিন ধরেই পারস্য উপসাগরে ১০টা এরকম প্যাট্রোল জাহাজ মোতায়েন রেখেছিল। ছোট, তবে শক্তিশালী এই জাহাজগুলি নিয়মিতভাবেই ইরানের ‘আইআরজিসি’ নৌবাহিনীর বোটগুলির সাথে উত্তেজনায় লিপ্ত হতো। তবে তিন দশকের পুরোনো এই জাহাজগুলির সর্বশেষ দু’টা ডিকমিশনিং করা হয় গত এপ্রিল মাসে। এগুলির স্থলে যুক্তরাষ্ট্র আর কোন নতুন যুদ্ধজাহাজ সেখানে মোতায়েন করেনি।


মধ্যপ্রাচ্যে নামমাত্র সামরিক শক্তি রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র

মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ রয়াল নেভির স্কোয়াড্রনের চাইতে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি খুব একটা বড় নয়। যুক্তরাষ্ট্র বেশ অনেকদিন ধরেই পারস্য উপসাগরে ১০টা ৫৫ মিটার লম্বা ‘সাইক্লোন-ক্লাস’ প্যাট্রোল জাহাজ মোতায়েন রেখেছিল। ছোট, তবে শক্তিশালী এই জাহাজগুলি নিয়মিতভাবেই ইরানের ‘আইআরজিসি’ নৌবাহিনীর বোটগুলির সাথে উত্তেজনায় লিপ্ত হতো। তবে তিন দশকের পুরোনো এই জাহাজগুলির সর্বশেষ দু’টা ডিকমিশনিং করা হয় গত এপ্রিল মাসে। এগুলির স্থলে যুক্তরাষ্ট্র আর কোন নতুন যুদ্ধজাহাজ সেখানে মোতায়েন করেনি। এর ফলে পারস্য উপসাগরে স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শুধুমাত্র ৬টা ছোট আকারের ৪৬ মিটার লম্বা ‘সেন্টিনেল-ক্লাস’ কোস্ট গার্ড প্যাট্রোল বোট এবং ৪টা মাইন ধ্বংসকারী জাহাজ রয়েছে। এগুলিকে সহায়তা দেয়ার জন্যে রয়েছে হেলিকপ্টার বহনে সক্ষম একটা ফ্লোটিং বেইস জাহাজ ‘লুইস বি পুলার’। মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি কম বলে নিয়ম ভেঙ্গে মার্কিন ম্যারিন কোরের একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এই জাহাজের কমান্ডার। উপসাগরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে এই জাহাজগুলির সাথে কিছুদিনের জন্যে যুক্ত হয় মার্কিন নৌবাহিনীর একটা ডেস্ট্রয়ার। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে ঘটা করে ঘোষণা দিয়ে একটা সাবমেরিন প্রেরণ করে। আগের সকল নিয়ম ভঙ্গ করে সাবমেরিনটা সুয়েজ খাল অতিক্রম করে। সাধারণতঃ মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন কখনও জানান দিয়ে কোথাও যায় না। অর্থাৎ সাবমেরিন মোতায়েনের বিষয়টা ছিল নিতান্তই তথ্যযুদ্ধের একটা অংশ।

শুধু নৌশক্তিই নয়; যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার বিমান শক্তিও কমিয়ে ফেলছে। গত মার্চে মার্কিন বিমান বাহিনী তাদের মধ্যপ্রাচ্য অপারেশনের জন্যে কংগ্রেসের সামনে বাজেট পেশ করে। এতে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার কমিয়ে ৭ বিলিয়ন ডলার বাজেট দেয়া হয়। বিশ্বব্যাপী তাদের অপারেশ চালাতে মার্কিন বিমান বাহিনীর বাজেট হলো ৭০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাজেটের মাত্র ১০ শতাংশ তারা মধ্যপ্রাচ্যে খরচ করছে। অপদিকে বিমান বাহিনী চীনকে নিয়ন্ত্রণে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুয়াম এবং নর্দার্ন মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের ঘাঁটি গড়তে বেশি খরচ করতে চাইছে। তিন বছরে মার্কিন বিমান বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বাজেট ৩০ শতাংশ কমিয়ে ফেলেছে।

গত মার্চে মার্কিন বিমান বাহিনী কংগ্রেসের এক শুনানিতে বলে যে, এপ্রিল মাসে মধ্যপ্রাচ্যে ‘এ-১০ থান্ডারবোল্ট’ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হচ্ছে। ‘এয়ার এন্ড স্পেস ফোর্সেস ম্যাগাজিন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চার দশকের পুরোনো এই বিমানগুলিকে যখন রিটায়ার করা হচ্ছে, তখনই এগুলিকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। অপরদিকে অত্যাধুনিক সকল যুদ্ধবিমানকে হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে অথবা ইউরোপে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মোতায়েন করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিমান বাহিনী সর্বমোট আড়াই স্কোয়াড্রন বিমান মোতায়েন রাখার টার্গেট রেখেছে। একেকটা স্কোয়াড্রনে ১২টা করে যুদ্ধবিমান থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে থাকবে সর্বমোট ৩০টা বিমান। ২০২২এর নভেম্বরে মার্কিন বিমান বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে অত্যাধুনিক ‘এফ-২২’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করলেও তা ছিল স্বল্প সময়ের জন্যে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি আরও কম। কয়েক বছর ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর কোন প্রথম সাড়ির ইউনিট মোতায়েন রাখা হচ্ছে না। দ্বিতীয় সাড়ির ন্যাশনাল গার্ড এবং রিজার্ভ সেনাদের দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর মূল যুদ্ধ সক্ষমতা হলো ‘টাস্ক ফোর্স স্পারটান’ নামের ছোট একটা বাহিনী। গত নভেম্বর মাসে এই বাহিনীর কমান্ডার হন পেনসিলভানিয়া ন্যাশনাল গার্ডের অন্তর্ভুক্ত ২৮তম পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার। এর আগে এই বাহিনী ছিল যথাক্রমে কানসাস ন্যাশনাল গার্ডের ৩৫তম পদাতিক ডিভিশন, ভার্জিনিয়া ন্যাশনাল গার্ডের ২৯তম পদাতিক ডিভিশন এবং টেক্সাস ন্যাশনাল গার্ডের ৩৬তম ডিভিশনের অধীনে।

মার্চ ২০২৩। 'বানি ইয়াস' নামে আমিরাতের জন্যে ফরাসিদের তৈরি করা 'গোউইন্ড-ক্লাস'এর কর্ভেট। যুক্তরাষ্ট্র যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের সামরিক শক্তি কমিয়ে ফেলছে, তখন আমিরাত একদিকে যেমন আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে সমঝোতার পথ দেখছে, তেমনি নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছে। শুধু তা-ই নয়, বহুদিনের শত্রুতা ভুলে গিয়ে আমিরাতিরা তুরস্ক থেকে ড্রোন কিনেছে।


আমিরাতিরা নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে

যুক্তরাষ্ট্র যখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের সামরিক শক্তি কমিয়ে ফেলছে, তখন আমিরাত একদিকে যেমন আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে সমঝোতার পথ দেখছে, তেমনি নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছে। গত ডিসেম্বরে আমিরাতি নৌবাহিনীর জন্যে ৪টা ‘ফালাজ-৩-ক্লাস’এর ফাস্ট প্যাট্রোল ভেসেল তৈরি করা শুরু হয়েছে। গত মার্চে আমিরাতি নৌবাহিনী ঘোষণা দেয় যে, তারা ইন্দোনেশিয়া থেকে ১৩ হাজার টনের একটা বড় আকারের উভচর যুদ্ধজাহাজ অর্ডার করেছে। এর আগে ২০১৯ সালে আমিরাতি নৌবাহিনী ফ্রান্স থেকে ২টা ‘গোউইন্ড-ক্লাস’এর কর্ভেট অর্ডার করে; যার প্রথমটা গত মার্চে সমুদ্রে ট্রায়াল শুরু করেছে। ২০২২ সালে আমিরাত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ৯৬টা ‘টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’ বা ‘থাড’ নামের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র কেনে।

শুধু তা-ই নয়, বহুদিনের শত্রুতা ভুলে গিয়ে আমিরাতিরা তুরস্ক থেকে ড্রোন কিনেছে। গত সেপ্টেম্বরে খবর প্রকাশিত হয় যে, আমিরাতিরা তুরস্ক থেকে ২০টা ‘বায়রাকতার টিবি-২’ অস্ত্রবাহী ড্রোন ডেলিভারি পেয়েছে; যা কিনা মোট ২ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ১’শ ২০টা ড্রোন অর্ডারের অংশ। আর সবচাইতে বড় সিদ্ধান্তটা ছিল যখন ২০২১এর ডিসেম্বরে আমিরাতিরা ১৯ বিলিয়ন ডলার খরচে ফ্রান্স থেকে ৮০টা ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান অর্ডার করে। অনেকেই মনে করছেন যে, আমিরাতে চীনা কোম্পানিকে ‘ফাইভ-জি’ প্রযুক্তির টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কের কাজ দেয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র যখন আমিরাতকে ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তখনই আমিরাত এই সিদ্ধান্ত নেয়। আমিরাতের এই সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশটার সম্পর্কের অবনতির কথা আলোচিত হতে থাকে।

আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি পারস্য উপসাগরের নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে একেবারেই অপ্রতুল। মাঝে মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার একটা যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে; অথবা এক জোড়া দূরপাল্লার বোমারু বিমান মধ্যপ্রাচ্যের উপর দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। নৌবাহিনীর সক্ষমতা কমিয়ে ফেলায় সেটার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে ২০টার মতো ড্রোন বোট। বিমান বাহিনী মোতায়েন করেছে চার দশকের পুরোনো ‘এ-১০’ যুদ্ধবিমান; যেগুলি ইতোমধ্যেই রিটায়ার করা শুরু হয়েছে। এই সামরিক শক্তি এবং সাময়িক মহাড়াগুলি আমিরাতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্র দেশগুলিকে নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্ত করে পারেনি।

জন্মের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্র এই দেশগুলি একটা পশ্চিমা শক্তির (প্রথমে ব্রিটেন; পরে যুক্তরাষ্ট্র) উপর নির্ভরশীল থেকেই বাঁচতে শিখেছে। এছাড়াও তাদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্রিটিশ নাগরিকেরা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে এই দেশগুলির নীতি লন্ডনের ভূরাজনৈতিক চিন্তা থেকে আলাদা হতে পারেনি। জনসংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় আমিরাত নিজেদের নিরাপত্তা দিতে বিদেশী ভাড়াটে সেনার উপরে নির্ভর করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার দায়িত্বও তাদেরকেই নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাক। কারণ এই মুহুর্তে চীন এবং রাশিয়ার বিপক্ষে মোতায়েন করা সামরিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করতে অপারগ; তাই দ্বিতীয় সাড়ির সামরিক শক্তি দিয়েই তারা কাজ চালাতে চাইছে। এমতাবস্থায় আমিরাত যখন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নীতির উপর চাপ সৃষ্টি করছে, তখন বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিকে ব্যালান্স করেই ওয়াশিংটনকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি কোথায় কতটুকু মোতায়েন থাকবে, সেই সিদ্ধান্তের উপর আমিরাতের ব্রিটিশ ঘরানার চিন্তার প্রভাব কিছুটা হলেও পড়বে। একইসাথে তা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নগামী প্রভাবকে তলানিতে নিয়ে ঠেকাবে।




সূত্রঃ
‘U.A.E. Says It Exited U.S.-Led Naval Force’ in The Wall Street Journal, 31 May 2023
‘UAE declares withdrawal from naval alliance, but US says otherwise’ in Stars & Stripes, 31 May 2023
‘US not notified yet of UAE's withdrawal from Gulf maritime coalition’ in Al-Monitor, 31 May 2023
‘UAE withdraws from US-led maritime coalition’ in Al-Jazeera, 31 May 2023
‘UAE says it has stopped taking part in U.S.-led Gulf maritime coalition’ in Reuters, 31 May 2023
‘Combined Maritime Forces (CMF)’ (https://combinedmaritimeforces.com/)
‘US pulls missile batteries from Middle East’ in DW, 19 June 2021
‘Exercise Intrepid Maven 23.3 Concludes in the United Arab Emirates’ in US Central Command, 02 June 2023 (https://www.centcom.mil/MEDIA/NEWS-ARTICLES/News-Article-View/Article/3414558/exercise-intrepid-maven-233-concludes-in-the-united-arab-emirates/)
‘380th Air Expeditionary Wing Fact Sheets’ in US Air Forces Central (https://www.afcent.af.mil/Units/380th-Air-Expeditionary-Wing/Fact-Sheets/Article/445043/380th-air-expeditionary-wing/)
‘380th Air Expeditionary News (https://www.afcent.af.mil/Units/380th-Air-Expeditionary-Wing/News/Tag/95930/al-dhafra-air-base/)
‘US to deploy fighter jets, Navy destroyer to UAE after missile attacks’ in Al-Monitor, 02 February 2022
‘The US and UAE forge a new path on defense [Commentary]’ by Danny Sebright in Defense News, 18 May 2017
‘British bordering practices in the Middle East before Sykes-Picot: giving an edge to zones’ by Richard Schofield in Egypte/Monde arabe, 18-2018
‘Britain and the Gulf Sheikhdoms, 1820-1971’ by James Onley in Center for International and Regional Studies, Georgetown University School of Foreign Service in Qatar, 2009
‘UK builds first permanent Middle East base for 40 years’ in BBC, 01 November 2015
‘Multi-million pound joint venture announced between Britain and Oman’ in UK.GOV (https://www.gov.uk/government/news/multi-million-pound-joint-venture-announced-between-britain-and-oman)
‘Operation Kipion’ in Royal Navy (https://www.royalnavy.mod.uk/news-and-latest-activity/operations/red-sea-and-gulf/operation-kipion)
‘Last Cyclone Patrol Ships Leave U.S. Navy, Many Will Serve in Foreign Forces’ in USNI News, 26 April 2023
‘New Coast Guard Cutters arrive in Bahrain’ in Defense Visual Information Distribution Service, 23 August 2022
‘Watch: U.S. Navy Ships In Tense Encounter With Iranian Military Speedboats’ by NBC News, 21 June 2022 (https://www.youtube.com/watch?v=ctcprlGxedY)
‘US B-52 Bombers Fly Over Middle East Amid Tensions With Iran’ in Voice of America, 05 September 2022
‘U.S., Partner Aircrews Conduct Middle East Presence Patrol’ in US Department of Defense, 09 June 2022
‘Two US B-52 bombers fly across Middle East, CENTCOM announces’ in Al-Arabiya News, 11 November 2022
‘Air Force may shrink Middle East presence, proposed budget cut shows’ in Air Force Times, 14 March 2023
‘A-10s Headed to CENTCOM to Bolster Air Force Presence’ in Air & Space Forces Magazine, 23 March 2023
‘Alaska-Based F-22s Deploy to CENTCOM Amid Iran Threat’ in Air & Space Forces Magazine, 02 November 2022
‘U.S. Navy Ships Supports UAE Pilot Training in Arabian Gulf’ in US Fleet Forces Command, 23 February 2023 (https://www.usff.navy.mil/Press-Room/News-Stories/Article/3312577/us-navy-ships-supports-uae-pilot-training-in-arabian-gulf/)
‘US Deploys Guided-Missile Submarine Amid Tensions With Iran’ in Voice of America, 08 April 2023
‘Task Force Spartan Crisis Response Task Force trains in Kuwait’ in Army Reserve, 11 May 2023
‘28th ID assumes command of Task Force Spartan mission’ in Pennysylvania National Guard, 22 November 2022
‘35th Infantry Division assumes authority of Task Force Spartan’ in Defense Visual Information Distribution Service, 20 March 2022
‘29ID assumes authority of Task Force Spartan’ in Virgina National Guard, 23 July 2021
‘Western allies join US' experimental drone task force in Middle East’ in Al-Monitor, 11 January 2023
‘ADSB begins construction of UAE Navy’s Falaj 3-class ship’ in Naval Technology, 03 January 2023
‘UAE Procures LPD from Indonesian Shipbuilder PT PAL’ in Naval News, 06 March 2023
‘Despite Biden's assurances, Middle East militaries are buying their own weapons to take on Iran at sea and in the air’ in Business Insider, 22 September 2022
‘U.S. to resupply Saudi and UAE missile defense systems’ in Reuters, 03 August 2022
‘Exclusive: Turkey sells battle-tested drones to UAE as regional rivals mend ties’ in Reuters, 21 September 2022
‘UAE receives first batch of Turkish armed drones’ in Al-Monitor, 21 September 2022
‘UAE buys record 80 French Rafale jets in $19bn arms deal’ in Al Jazeera, 03 December 2021
‘New Gowind Corvette for the UAE Starts Sea Trials’ in Naval News, 23 March 2023

Friday 2 June 2023

তুর্কি-মার্কিন সম্পর্ক… নির্ভরশীলতার খেলা

০২রা জুন ২০২৩

তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে পরিবর্তন করা 'এফ-১৬ ওজগুর', যা পুরোনো 'ব্লক-৩০' ভার্সনের 'এফ-১৬' পরিবর্তন করে করা হয়েছে। তুরস্ক ‘ব্লক-৩০’ ভার্সনের বিমানগুলিকে পরিবর্তন করতে পারলেও ‘ব্লক-৫০’ বিমানগুলিকে পরিবর্তন করার জন্যে ‘সোর্স কোড’ যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে দেয়নি। একারণেই এই বিমানগুলির জন্যে ‘ভাইপার আপগ্রেড কিট’ চাইছে তুরস্ক। অতএব, যুক্তরাষ্ট্রের উপরে তুরস্কের নির্ভরশীলতা এখনই কেটে যাচ্ছে না এবং একইসাথে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির উপর মার্কিন প্রভাবও চলে যাচ্ছে না।


গত ২৯শে মে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানকে নির্বাচন বিজয়ে অভিনন্দন জানাতে ফোন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আলাপের বিষয়বস্তু তুলে ধরে বাইডেন সাংবাদিকদের বলেন যে, এরদোগান এখনও তুরস্কের জন্যে ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান নিয়ে কথা বলতে চান। তবে ওয়াশিংটন চাইছে সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি। বাইডেন এরদোগানকে বলেন যে, তারা এক সপ্তাহ পর আবারও কথা বলবেন। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই প্রথম বাইডেন সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি এবং তুরস্কের জন্যে ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানের ইস্যুদু’টাকে একত্রে নিয়ে এসে কথা বললেন। তবে হোয়াইট হাউজ এবং তুর্কি সরকারের বিবৃতিতে ‘এফ-১৬’ নিয়ে কথা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়নি। হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব ক্যারিন জঁ-পিয়েরে সাংবাদিকদের বলেন যে, এখানে কোন শর্তের ব্যাপার নেই। প্রেসিডেন্ট বাইডেন সর্বদাই তুরস্কের কাছে ‘এফ-১৬’ বিক্রির ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে আগ্রহী ছিলেন। একই দিনে সুইডেন সফরকালে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অস্বীকার করেন যে, তার সরকার সুইডেনের ইস্যুর সাথে ‘এফ-১৬’ ইস্যুকে যুক্ত করেছে। তবে ‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, গত জানুয়ারিতে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেন যে, তুরস্ক যদি সুইডেনকে ন্যাটো সদস্য হতে দেয়, তাহলে মার্কিন কংগ্রেস তুরস্কের ‘এফ-১৬’ ক্রয়ের ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার ২০২২এর মে মাসে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটো জোটের সদস্যপদের জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করে। ন্যাটোর চুক্তি অনুযায়ী সকল সদস্য দেশের অনুমতি মিললেই কেবল নতুন কোন দেশ ন্যাটোর সদস্যভুক্ত হতে পারবে। এই দুই দেশের সদস্যপদ পাওয়া ঝুলে যায় তুরস্ক এবং হাঙ্গেরির বিরোধিতার কারণে। তবে শেষ পর্যন্ত এবছরের এপ্রিলে উভয় দেশের সমর্থনের পর ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্যভুক্ত হয়; যদিও তুরস্কের বিরোধিতার কারণে সুইডেনের সদস্যপদ ঝুলে যায়। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২১এর অক্টোবরে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৪০টা নতুন ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান এবং পুরোনো ‘ব্লক-৫০’ ভার্সনের ৭৯টা ‘এফ-১৬’এর জন্যে ‘ভাইপার আপগ্রেড কিট’ চায়। এই পুরো চুক্তির মূল্য প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার।

তুরস্কের সামনে বড় বাধা হলো মার্কিন কংগ্রেস। কংগ্রেসের ক্ষমতা রয়েছে বড় ধরণের সামরিক বিক্রয়ে বাধা দেয়ার। কংগ্রেস চায় তুরস্ক প্রতিবেশী দেশ গ্রিসের সাথে সম্পর্কন্নোয়ন করুক, উত্তর ইরাকে সেনা অভিযান বন্ধ করুক, যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছানুযায়ী রাশিয়ার উপরে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করুক এবং তার মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন করুক। গত ৩০শে মে সিনেটর মেনেনডেজ সাংবাদিকদের বলেন যে, তুরস্ককে ‘এফ-১৬’ দেয়ার আগে দেখতে হবে যে, তুরস্ক ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলি এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে কিনা। মেনেনডেজ বাইডেন প্রশাসনকে ‘এফ-১৬’ বিক্রির ব্যাপারটাকে স্থগিত রাখতে বলেছেন। তার কথায়, পররাষ্ট্র সচিব ব্লিনকেন তাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, হোয়াইট হাউজ তার কথা শুনবে।

গত এপ্রিলে ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্যে সমর্থন দেয়ার দুই সপ্তাহ পর মার্কিন কংগ্রেস অপেক্ষাকৃত ছোট আড়াইশো মিলিয়ন ডলার মূল্যের তুরস্কের পুরোনো ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানগুলির জন্যে সফটওয়্যার আপগ্রেড বিক্রির প্রকল্পে অনুমতি দেয়। তবে তুরস্ক এখনও সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির বিরোধী; কারণ আঙ্কারা মনে করে যে, সুইডেন তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা ‘পিকেকে’কে আশ্রয় এবং সমর্থন দিচ্ছে; যাদেরকে তুরস্ক সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। তবে ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর ফেলো আসলি আয়দিনতাশবাশ ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, এরদোগান যদিও সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তিকে কাজে লাগাতে চাইছেন, তথাপি তিনি বাস্তববাদী। খুব সম্ভবতঃ জুলাই মাসের ন্যাটো বৈঠকের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত একটা নাটকীয়তা দেখা যাবে। এমনকি হয়তো বৈঠকের রাত্রেই দেখা যাবে তুরস্ক সুইডেনের ব্যাপারে সন্মতি দিয়েছে।

তবে তুরস্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জেমস জেফরি ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে বলছেন যে, ‘এফ-১৬’ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক এখন বেশ জটিল এবং তা মূলতঃ আদান-প্রদানের মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। আঙ্কারার সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা, আঞ্চলিকভাবে ইরানের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অপরদিকে ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক হাওয়ার্ড আইসেনস্টাটএর মতে, রাশিয়া থেকে ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করাটা ওয়াশিংটনের সাথে আঙ্কারার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচাইতে কন্টকময় অধ্যায়। কিছুদিন আগেই তুর্কি মিডিয়াতে বলা হয় যে, তুরস্ক তার ‘এস-৪০০’ ব্যবস্থাগুলিকে বাইডেন প্রশাসনের অনুরোধ সত্ত্বেও ইউক্রেনে পাঠাতে অস্বীকার করেছে।

তুরস্কের বিমান বাহিনীর মূল স্তম্ভই হলো ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান। ২০১৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া থেকে ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার ‘অপরাধে’ তুরস্ককে ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রকল্প থেকে বহিষ্কার করলে তুরস্ক বিপদে পড়ে যায়। কারণ এর ফলশ্রুতিতে আগামী কয়েক বছরের মাঝেই পুরোনো ‘এফ-১৬’ বিমানগুলিকে প্রতিস্থাপন করার মতো কোন যুদ্ধবিমান তুরস্কের কাছে থাকবে না।

২০২২ সালের জুন মাসে তুরস্কের ‘সাভুনমা সানায়িএসটি’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, তুরস্ক তার ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানগুলির জন্যে ‘ওজগুর’ নামক উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে। আর ‘তুরডেফ’এর গত মে মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ইতোমধ্যেই পরিবর্তিত ‘এফ-১৬ ওজগুর’ তুর্কি বিমান বাহিনীকে ডেলিভারি দেয়া হয়েছে। গত ১৮ই মে তুর্কি মিডিয়া ‘এনটিভি’কে দেয়া এক সাক্ষাতে তুরস্কের সামরিক শিল্পের প্রধান ইসমাঈল দেমির বলেন যে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৫টা পুরোনো ‘ব্লক-৩০’ ভার্সনের ‘এফ-১৬’এর মিশন কম্পিউটারসহ মোট ১৪টা বড় রকমের পরিবর্তন করে এগুলিকে প্রায় তুর্কি বিমান বানিয়ে ফেলা হবে। শুধু তা-ই নয়, এই পরিবর্তন শেষে বিমানগুলিতে তুরস্কের নিজস্ব ‘মুরাদ এইএসএ’ রাডার সংযুক্ত করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পর এই বিমানগুলি তুরস্কের নিজস্ব ‘আতমাকা’ জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘গেজগিন’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহণ করতে পারবে। তথাপি এভিয়েশন ম্যাগাজিন ‘এভিয়াসি অনলাইন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তুরস্ক ‘ব্লক-৩০’ ভার্সনের বিমানগুলিকে পরিবর্তন করতে পারলেও ‘ব্লক-৫০’ বিমানগুলিকে পরিবর্তন করার জন্যে ‘সোর্স কোড’ যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে দেয়নি। একারণেই এই বিমানগুলির জন্যে ‘ভাইপার আপগ্রেড কিট’ চাইছে তুরস্ক। অতএব, যুক্তরাষ্ট্রের উপরে তুরস্কের নির্ভরশীলতা এখনই কেটে যাচ্ছে না এবং একইসাথে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির উপর মার্কিন প্রভাবও চলে যাচ্ছে না।