Wednesday 26 May 2021

গাজা যুদ্ধ ... ইস্রাইলের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ালো হামাসের বিজয়

২৬শে মে ২০২১
হামাসের কাছে থাকা মোট রকেটের সংখ্যা নিরূপণ যেমন ইস্রাইলের নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ, তেমনি ‘আয়রন ডোম’এর উপর নির্ভরশীল থাকার সত্ত্বেও এবং রাজনৈতিকভাবে অসমর্থনযোগ্য ব্যাপক বিমান হামলায় শতশত ফিলিস্তিনি হত্যার পরেও ইস্রাইলিদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক না হওয়া এবং হতাহত পুরোপুরি বন্ধ না করতে পারা ইস্রাইলের দুর্বলতা তুলে ধরে। এবারের গাজার যুদ্ধ বলে দিচ্ছে যে, মান্ধাতার প্রযুক্তির ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইস্রাইলের যুদ্ধ জেতা শুধু কঠিনই নয়, বরং যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে ইস্রাইলকে আশেপাশের দেশগুলির সহযোগিতার উপরেই বেশি নির্ভরশীল হতে হবে। অর্থাৎ নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই ইস্রাইল তার আশেপাশের দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নে এগুবে।


গাজা যুদ্ধের সময় ভিডিও ছড়াতে থাকে, যেখানে দেখা যাচ্ছিল যে, রাতের আকাশে একদিক থেকে উড়ছে ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাসের রকেট; আর অপর দিক থেকে উড়ছে ইস্রাইলের প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র, যা কিনা ‘আয়রন ডোম’ নামের একটা ব্যবস্থার অংশ। যুদ্ধ শেষ হবার আগেই প্রশ্ন উঠেছে যে, এই ‘আয়রন ডোম’এর কর্মক্ষমতা আসলে কতটুকু। এই ব্যবস্থার সক্ষমতার উপর ইস্রাইলের আকাশ প্রতিরক্ষাই ব্যবস্থাই শুধু নির্ভর করছে না, ইস্রাইলের আশেপাশের দেশগুলি ইস্রাইলের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ করার ব্যাপারে কতটা আশাবাদী হতে পারে, তাও নির্ভর করবে। সে হিসেবে এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট।

ইস্রাইলি পত্রিকা ‘জেরুজালেম পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘আয়রন ডোম’এর দুর্বলতা সবসময়েই ছিল। এর আগের যুদ্ধগুলিতে ‘আয়র ডোম’ হামাসের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ রকেট ধ্বংস করতে পেরেছিল। তবে ইস্রাইলি ইন্টেলিজেন্সের কর্মকর্তারা সর্বদাই জানতেন যে, লেবাননের হিযবুল্লাহ মিলিশিয়াদের সক্ষমতা রয়েছে দিনে এক হাজার রকেট ছোঁড়ার। সেটা করতে পারলে নিশ্চিতভাবেই ‘আয়রন ডোম’এর সক্ষমতার সীমা পরিসীমা পরীক্ষা হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, ইস্রাইলি হিসেবে হিযবুল্লাহর হাতে রয়েছে দেড় লক্ষাধিক রকেট; যার মাধ্যমে তারা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। অপরদিকে ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধে হামাস ৫০ দিনে ৪ হাজার রকেট ছুঁড়েছিল। একদিনে সর্বোচ্চ দু’শ রকেট ছুঁড়েছিল তারা। আর এক’শর বেশি রকেট তারা ছুঁড়তে পেরেছিল খুব বেশি হলে দুই সপ্তাহ। কিন্তু এবারের যুদ্ধে হামাস কয়েক মিনিটের মাঝে শতাধিক রকেট ছুঁড়তে পেরেছে; যা এর আগে শোনা যায়নি। তদুপরি হামাসের কাছে কতগুলি রকেট রয়েছে, সেটার উপরেই নির্ভর করবে যে, যুদ্ধ কতদিন স্থায়ী হতে পারে। কাজেই সবচাইতে বড় প্রশ্ন হলো, হামাসের রকেটের সংখ্যার ব্যাপারে ইস্রাইলের ইন্টেলিজেন্সের ধারণা সঠিক কিনা। আর একারণেই ইস্রাইলের হিসেব কষতে হবে যে, তারা হামাস বা হিযবুল্লাহর বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ কতদিন চালিয়ে নিতে সক্ষম হবে। অথবা কত দ্রুত তাদেরকে সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে হবে রকেট হামলা থামাতে। কারণ ইস্রাইলের ব্যাপক বিমান হামলা হামাসের রকেট হামলা থামাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।


 
‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, এই যুদ্ধ হচ্ছে সর্বশেষ প্রযুক্তির বিরুদ্ধে মান্ধাতার প্রযুক্তির। দশ বছর আগে ‘আয়রন ডোম’ ডেভেলপ করেছিল ‘রাফায়েল এডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস’। এতে রয়েছে বেশকিছু রাডার রয়েছে; যেগুলি প্রতিপক্ষের রকেট দেখা মাত্রই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনুষ্যবিহীন লঞ্চার থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে সেগুলিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে। এই ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, কোন রকেটগুলি ইস্রাইলের জনবসতিতে আঘাত হানতে পারে, এবং সেই হিসেবে সেগুলি ধ্বংসে ‘তামির’ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়। একটা লঞ্চারে ২০টা করে ‘তামির’ ক্ষেপণাস্ত্র থাকে। একেকটা ক্ষেপনাস্ত্রের পাল্লা ৪০ কিঃমিঃ এবং মূল্য ২০ হাজার ডলার থেকে ১ লক্ষ ডলারের মাঝে। অপরদিকে হামাসের রকেটগুলি স্টিল এবং এলুমিনিয়ামের পাইপের সাথে স্টিলের পাখা জুড়ে দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এই রকেটের জ্বালানি হলো রাসায়নিক সার এবং গলানো চিনি। রকেটের ওয়ারহেডগুলিও বাড়িতে তৈরি করা। বেশিরভাগ রকেটই স্বল্পপাল্লার ‘কাসাম’। রকেটগুলি ধাতুর কাঠামো থেকে ছোঁড়া হয় এবং এদের কোন গাইড্যান্স সিস্টেম নেই। এগুলির ওজন ৩৬ কেজি থেকে ৯০ কেজি পর্যন্ত এবং পাল্লা ৩ কিঃমিঃ থেকে ৩২ কিঃমিঃ পর্যন্ত। দু’জন ব্যক্তিই এগুলি ছোঁড়ার জন্যে যথেষ্ট। এগুলির খরচ মাত্র কয়েক’শ ডলারের বেশি নয়। এই রকেটগুলির সক্ষমতা নেই বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি করার; বরং এগুলির উদ্দেশ্য হলো ইস্রাইলকে অনিরাপদ করা এবং ইস্রাইলিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে তাদেরকে লুকাতে বাধ্য করা। তবে এবারে হামাসের উদ্দেশ্য ছিল ‘আয়রন ডোম’এর সর্বোচ্চ সক্ষমতা বের করা এবং পুরো ব্যবস্থাকে ব্যাতিব্যস্ত করে ফেলা। ‘তামির’ ক্ষেপণাস্ত্র ইউনিটের ক্ষেপণাস্ত্র ফুরিয়ে গেলে হতাহতের সংখ্যা বেরে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘আয়রন ডোম’এর প্রধান দুর্বলতা হলো, অতি কম সক্ষমতার রকেট ধ্বংস করতে অতি উচ্চ সক্ষমতার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, হামাসের একটা রকেট খুব বড় কোন ক্ষতি করার সক্ষমতা না রাখলেও ইস্রাইলিরা এর প্রত্যুত্তরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে; যেটাকে তাদের এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যায়সংগত প্রমাণ করতে হচ্ছে। ১৩ জন ইস্রাইলিকে হত্যার বিপরীতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ২’শ ৪৮ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করাকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করা কঠিন। এছাড়াও রকেট উৎক্ষেপণ বন্ধ করতেও ইস্রাইলকে ফিলিস্তিনিদের উপর ব্যাপক বিমান হামলা, এমনকি সেনাবাহিনীর হামলা করতে হচ্ছে। আবার ‘আয়রন ডোম’এর ফাঁকফোঁকড় দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া রকেট যদি ইস্রাইলিদের হতাহতের কারণ হয়, তাহলে সেটাও ইস্রাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যে চ্যালেঞ্জ।

‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, যুদ্ধের এক পর্যায়ে হামাস মাত্র ৩০ মিনিটের মাঝে ৭০টা রকেট নিক্ষেপ করেছিল। একসময় হামাস পাঁচ মিনিটে ১’শ ৩৭টা রকেট ছোঁড়ার দাবিও করে। বেশিরভাগ রকেট স্বল্পপাল্লার হলেও কিছু রকেট ৭৫ কিঃমিঃ দূরে তেল আভিভেও পৌঁছেছে; যা ইস্রাইলিদের বিচলিত করেছে। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, পুরো যুদ্ধে হামাস ৩ হাজার ৭’শর বেশি রকেট ছুঁড়েছে। তবে রকেটের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় ৯০ শতাংশ রকেট ধ্বংস করা গেলেও বাকি ১০ শতাংশও কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে একেবারে কম নয়। ইস্রাইলের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা এবারের যুদ্ধের দিকে যে কড়া নজর রেখেছে, তা নিশ্চিত। হামাসের কাছে থাকা মোট রকেটের সংখ্যা নিরূপণ যেমন ইস্রাইলের নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ, তেমনি ‘আয়রন ডোম’এর উপর নির্ভরশীল থাকার সত্ত্বেও এবং রাজনৈতিকভাবে অসমর্থনযোগ্য ব্যাপক বিমান হামলায় শতশত ফিলিস্তিনি হত্যার পরেও ইস্রাইলিদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক না হওয়া এবং হতাহত পুরোপুরি বন্ধ না করতে পারা ইস্রাইলের দুর্বলতা তুলে ধরে। এবারের গাজার যুদ্ধ বলে দিচ্ছে যে, মান্ধাতার প্রযুক্তির ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইস্রাইলের যুদ্ধ জেতা শুধু কঠিনই নয়, বরং যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে ইস্রাইলকে আশেপাশের দেশগুলির সহযোগিতার উপরেই বেশি নির্ভরশীল হতে হবে। অর্থাৎ নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই ইস্রাইল তার আশেপাশের দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নে এগুবে।

Sunday 23 May 2021

ভারতে করোনা সংক্রমণের ভূরাজনৈতিক ফলাফল

২৪শে মে ২০২১

ভারতের করোনা মহামারি একদিকে যেমন দেশটার দুর্বল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে আরও দুর্বল করছে, তেমনি বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন সরবরাহের অপ্রতুলতা সৃষ্টি করে চীনের ভ্যাকসিন কূটনীতির জন্যে জায়গা করে দিচ্ছে। দুর্বল ভারতকে দিয়ে চীনকে ব্যালান্স করতে যুক্তরাষ্ট্র যে হিমসিম খাবে, তা বলাই বাহুল্য। এতে কৌশলগত দিক থেকে ওয়াশিংটনের উপর দিল্লীর নির্ভরশীলতা তৈরি হলেও পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুর সবচাইতে কঠিন সময়ে যথেষ্ট সহায়তা দিতে না পারাটা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জকে কঠিনতর করবে।


করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ভারতের ভয়াবহ অবস্থার চিত্র যখন প্রতিফলিত হচ্ছে বিশ্বমিডিয়াতে, তখন কেউ কেউ এই সংক্রমণের ভূরাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছেন। ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি জিরো মিডিয়া’তে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সরকার ভারতের মহামারির ব্যাপারে যতটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ব্রাজিলের ব্যাপারে তার ধারেকাছেও নয়। এর কারণ খুঁজতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের কৌশলগত গুরুত্বের দিকে তাকাতে হবে।

২০২০এর অগাস্টে ভারতের সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয় যে, এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভারতের অর্থনীতি প্রায় ২৪ শতাংশ কমে গিয়েছিল; যা কিনা বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলির মাঝে সর্বোচ্চ। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি কমেছিল সাড়ে ৯ শতাংশ; আরা জাপানের কমেছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে ভারত সরকার সর্বপ্রথম জিডিপির পরিসংখ্যান প্রকাশ শুরু করার পর থেকে এটা অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ধ্বস। লকডাউনের কারণে লাখ লাখ দিনমজুর কাজের অভাবে শহরগুলি ছেড়ে পালিয়েছে। এই মানুষগুলি অনেকক্ষেত্রেই ভারতের জিডিপির পরিসংখ্যানের বাইরে রয়েছে। ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিথারামান গত অগাস্টে ভারতের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্যে করোনাভাইরাসকে দায়ী করে বলেন যে, এটা সৃষ্টিকর্তার কারণে হয়েছে। তবে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ভারতের অর্থনীতি মহামারির আরও আগে থেকেই ধুঁকে ধুঁকে চলছিল। ২০১৯এর অগাস্টে বলা হয়েছিল যে, দেশটাতে গাড়ি বিক্রি ৩২ শতাংশ কমেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২৪ সাল নাগাদ দেশটার অর্থনীতিকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৫ হাজার বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার যে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন, সেই স্বপ্ন এখন বেশ দূরবর্তীই মনে হচ্ছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর এক লেখায় ‘জন্স হপকিন্স স্কুল অব এডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর প্রফেসর ড্যানিয়েল মার্কি ভারতে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের কৌশলগত ফলাফল ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। ২০২০ সালের শেষের দিকে এবং ২০২১এর শুরুতে অনেকেই মনে করতে শুরু করেছিলেন যে, ভারত খুব সম্ভবতঃ করোনার সবচাইতে খারাপটা দেখে ফেলেছে। এখন ভাইরাসের নতুন ধরনের সংক্রমণ এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে এই আশা পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে। বাইডেন প্রশাসন তাদের চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলে ভারতের সাথে সহযোগিতাকে মূল স্তম্ভগুলির একটা হিসেবে দেখছে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দিয়ে চীনকে ব্যালান্স করতে চাইছে, তাই ভারতের স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তার ভিত্তি মানবিক নয়; কৌশলগত। হিমালয়ের পাদদেশে চীনের সাথে উত্তেজনা যখন সমাধানহীন অবস্থায় রয়ে গেছে, তখন ভারতে করোনার মারাত্মক সংক্রমণের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। প্রফেসর মার্কি মনে করছেন যে, ভারতের দুর্বল মুহুর্তেকে চীন যদি ব্যবহার করতে চায়, তাহলে একইসাথে কয়েকটা চ্যালেঞ্জের চাপে পড়ে নতুন দিল্লীতে নীতিগত ভুল হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। আর এসময়েই যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ ভারতকে নীতিগত সহায়তা দিয়ে কৌশলগত দিক থেকে শক্তিশালী করা।

বার্তাসংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, করোনার ভারে নুয়ে পড়ে ভারত যখন তার ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি রাখতে হিমসিম খাচ্ছে, তখন সারা বিশ্ব চীনের ভ্যাকসিনের উপর নির্ভরশীল হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের ‘সিনোফার্ম গ্রুপ’এর ভ্যাকসিনকে স্বীকৃতি দেবার পর বিশ্বব্যাপী চীনের ভ্যাকসিনের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন অনেকেই। এছাড়াও চীনের ‘সিনোভ্যাক বায়োটেক’এর ভ্যাকসিনও খুব শিগগিরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি পেতে পারে। ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর সিনিয়র ফেলো ইয়ানঝং হুয়াং বলছেন যে, চীন শুধুমাত্র ভ্যাকসিনের সবচাইতে বড় রপ্তানিকারকই হতে যাচ্ছে না, কিছু দেশের জন্যে চীনের ভ্যাকসিন ছাড়া কোন পথই খোলা থাকছে না।

এমতাবস্থায় চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের নিজের জন্যে ক্রয় করা ‘এসট্রাজেনেকা’র ৬ কোটি ডোজ অন্য দেশগুলিকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এবং একইসাথে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘মডার্না’, ‘ফাইজার’ এবং ‘জনসন এন্ড জনসন’এর ভ্যাকসিন উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধির জন্যে জোর দিচ্ছে ওয়াশিংটন। তবে অন্যান্য দেশের ভ্যাকসিন ফ্যাক্টরিগুলিকে কার্যকর করার জন্যে মার্কিন কোম্পানিগুলির ডেভেলপ করা ভ্যাকসিনের উপর থেকে কপিরাইট স্বত্ব উঠিয়ে নেবার ব্যাপারে কথা বললেও এখনও সেব্যাপারে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বাইডেন সরকার। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ২৪ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরি করলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশকে ভ্যাকসিন দেবার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কৃপণতা দৃষ্টিকটু। রপ্তানি বন্ধ করার আগ পর্যন্ত ভারত পৃথিবীর প্রায় এক’শ দেশে ব্রিটেনের অক্সফোর্ডের ডেভেলপ করা ‘এসট্রাজেনেকা’র ৬ কোটি ৭০ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন রপ্তানি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় গড়ে ওঠা ‘কোভ্যাক্স’ চেষ্টার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিশ্বের গরীব দেশগুলিতে পৌঁছেছে, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের নিজের জন্যে তৈরি ২৪ কোটি ভ্যাকসিনের তুলনায় কিছুই নয়। ‘কোভ্যাক্স’ ভারতের ‘সেরাম ইন্সটিটিউট’এর ফ্যাক্টরির উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল।

পশ্চিমা গবেষকেরা বলছেন যে, চীনের ভ্যাকসিনের কর্মক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশ কম। হংকংএর ‘সিটি ইউনিভার্সিটি’র এসোসিয়েট প্রফেসর নিকোলাস থমাসএর মতে, চীনারা মধ্যম মেয়াদে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে পারবে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলি যদি উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়, তাহলে তারা চীনা ভ্যাকসিনের দুর্বল কর্মক্ষমতাকে ব্যবহার করে ভূরাজনৈতিক প্রভাব পুনরুদ্ধার করতে পারবে। অপরদিকে বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যবহার করতে চীনারা সকল চেষ্টাই করছে। চীনের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’এর এক লেখায় যুক্তরাষ্ট্রকে কটাক্ষ করে বলা হয় যে, ভারতের সবচাইতে খারাপ সময়ে ওয়াশিংটন ভারতকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পশ্চিমারা ভারতের কাছাকাছি গিয়েছে ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্যে; এই সম্পর্ক ঠুনকো এবং অগভীর।

ভারতের করোনা মহামারি একদিকে যেমন দেশটার দুর্বল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে আরও দুর্বল করছে, তেমনি বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন সরবরাহের অপ্রতুলতা সৃষ্টি করে চীনের ভ্যাকসিন কূটনীতির জন্যে জায়গা করে দিচ্ছে। দুর্বল ভারতকে দিয়ে চীনকে ব্যালান্স করতে যুক্তরাষ্ট্র যে হিমসিম খাবে, তা বলাই বাহুল্য। এতে কৌশলগত দিক থেকে ওয়াশিংটনের উপর দিল্লীর নির্ভরশীলতা তৈরি হলেও পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুর সবচাইতে কঠিন সময়ে যথেষ্ট সহায়তা দিতে না পারাটা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জকে কঠিনতর করবে।

Monday 17 May 2021

ইস্রাইলকে সরাসরি সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করছে

১৭ই মে ২০২১
জো বাইডেন এবং বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, ২০১০। বাইডেন নেতানিয়াহুকে ফোন করে বলেছেন যে, ইস্রাইলের নিজেকে রক্ষা করার অধিকারের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত সমর্থন রয়েছে। কিন্তু বাইডেনের কথাগুলি এর আগে অনেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টই বলে গেছেন। 


১৬ই মে পর্যন্ত ফিলিস্তিনের উপর ইস্রাইলী হামলায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১’শ ৮৮ জন নিহত হয়েছে। অপরদিকে ইস্রাইল বলছে যে, কয়েক হাজার ফিলিস্তিনী রকেট ছোঁড়ায় ১০ জন ইস্রাইলী নিহত হয়েছে। মার্কিন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বারংবারই বলছেন যে, ইস্রাইলের আত্মরক্ষা করার অধিকারের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত সমর্থন রয়েছে। ইস্রাইলের বিন্দুমাত্র সমালোচনা করা থেকে দূরে থেকেছে বাইডেন প্রশাসন। ১৫ই মে হোয়াইট হাউজ থেকে বলা হয় যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দ্বিতীয়বারের মতো ইস্রাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাথে কথা বলেছেন এবং ইস্রাইলের নিজেকে রক্ষা করার পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের কথা বলেন। এর আগে ১২ই মে বাইডেন গাজায় ইস্রাইলী বিমান হামলার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, হামাসের রকেট হামলা ঠেকাতেই ইস্রাইল হামলা করছে। ইস্রাইলের অধিকার রয়েছে আত্মরক্ষা করার। তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, তিনি আশা করছেন যে, খুব শিগগিরই এই সহিংসতার অবসান ঘটবে। অপরদিকে জাতিসংঘে ইস্রাইলী হামলা বন্ধ করার রেজোলিউশন আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, প্রতিবছর ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দেয়ার কারণে ইস্রাইলের নীতির উপর যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তবে তারা বলছে যে, ইস্রাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘শর্তহীন’ সমর্থন নতুন নয়। ইস্রাইলের কোন আগ্রাসনকেই মার্কিনীরা দোষারোপ করেনি। ইস্রাইলের জন্ম থেকে মার্কিন সমর্থনের একটা টাইমলাইন দিয়েছে তারা।

১৯৪৮ থেকে ২০১৮ ... ইস্রাইলী আগ্রাসনে মার্কিন সমর্থন

১৯৪৮ সালের মে মাসে ব্রিটিশরা ইস্রাইল রাষ্ট্র তৈরি করে; আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান প্রায় সাথেসাথেই নতুন ইহুদি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেন। ১৯৬৭ সালে ইস্রাইল যখন পার্শ্ববর্তী মিশর, জর্দান, সিরিয়া এবং ইরাক আক্রমন করে বসে এবং বড় আকারের ভূমি নিজের দখলে নিয়ে নেয়, তখনও ইস্রাইল মার্কিন সমর্থন পায়। এই যুদ্ধের চার বছর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন বলেন যে, কোন রাষ্ট্রের আশপাশ যখন শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, তখন সেই দেশকে আগ্রাসী হিসেবে আখ্যা দেয়াটাকে তিনি সমর্থন করেন না। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইস্রাইলের কাছ থেকে দখলীকৃত জমি পুনরুদ্ধারে আশেপাশের দেশগুলি ১৯৭৩ সালে ইস্রাইল আক্রমণ করে বসে। সেসময় যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলকে বিমানে করে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন কংগ্রেসকে বলেন যে, ইস্রাইলকে দেয়া মার্কিন সমর্থন যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সহায়তা করেছিল। ১৯৮২ সালে ইস্রাইল লেবানন আক্রমণ করে। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগ্যান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, পরিস্থিতি অনেক জটিল থাকার কারণেই তার সরকার ইস্রাইলী আগ্রাসনকে ধিক্কার জানায়নি অথবা ইস্রাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করা বন্ধ করেনি। তবে তিনি অস্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইস্রাইলকে আগ্রাসী হওয়ার জন্যে ‘সবুজ বাতি’ দিয়েছে। এরপর ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ সালের মাঝে প্রথম ইন্তিফাদা চলে। ইস্রাইলী বাহিনী ফিলিস্তিনীদের উপর চরম নির্যাতন চালিয়ে যায়। কিন্তু সেসময় রেগ্যান সরকার ইস্রাইলের জন্যে সর্বোন্নত সামরিক প্রযুক্তি উন্মুক্ত করে দেয়। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ লেবাননের ক্বানায় জাতিসংঘের শরণার্থী শিবিরে ইস্রাইলী বোমা হামলায় ১’শর বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ইস্রাইলকে সমর্থন দিয়ে যান। মার্কিন ইহুদি লবি গ্রুপের সাথে কথা বলতে গিয়ে ক্লিনটন যুক্তি দেন যে, লেবাননের শরণার্থী শিবিরের শিশুরা হিযবুল্লাহর রিক্রুটমেন্টের শিকার; যাদেরকে ইস্রাইলে হামলার জন্যে প্রস্তুত করা হয়। কাজেই ইস্রাইলের অধিকার রয়েছে নিজেকে রক্ষা করার।
 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং ইস্রাইলের ডানপন্থী নেতা আরিয়েল শ্যারন। ক্লিনটন যুক্তি দেন যে, লেবাননের শরণার্থী শিবিরের শিশুরা হিযবুল্লাহর রিক্রুটমেন্টের শিকার; যাদেরকে ইস্রাইলে হামলার জন্যে প্রস্তুত করা হয়। কাজেই ইস্রাইলের অধিকার রয়েছে নিজেকে রক্ষা করার।


২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ইস্রাইলের ডানপন্থী নেতা আরিয়েল শ্যারন দলবলসহ আল আকসা মসজিদের ভেতর প্রবেশ করলে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সূচনা হয়। ইস্রাইল গাজা এবং পশ্চিম তীরে বোমা হামলা চালাতে থাকে; আর জবাবে ফিলিস্তিনীরা বিভিন্ন স্থানে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। সংঘর্ষে ৩ হাজার ফিলিস্তিনি এবং ১ হাজার ইস্রাইলির মৃত্যু হয়। ২০০১ সালের পর থেকে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সহযোগী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জুনিয়র ইস্রাইলকে নতুনভাবে সহায়তা দিতে থাকেন। বুশ ঘোষণা দেন যে, ফিলিস্তিনি সরকার যতদিন সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে যাবে, ততদিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে না। ২০০৮ সালের ২৭শে ডিসেম্বর গাজাতে ইস্রাইলের ‘অপারেশন কাস্ট লেড’ শুরু হয়। ২২ দিনের এই হামলায় ‘এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’এর হিসেবে ১৪’শ মানুষের মৃত্যু হয়; যার বেশিরভাগই ছিল সাধারণ বেসামরিক নাগরিক। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ পুরো ঘটনার জন্যে হামাসকে দায়ী করেন। এরপর ২০১২ সালের নভেম্বরে হামাসের নেতা আহমেদ জাবারিকে হত্যার পর গাজায় হামলা শুরু করে ইস্রাইল। এতে ১’শর বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইস্রাইলকে সমর্থন দিয়ে বলেন যে, নিজেদের সীমানার বাইরে থেকে তার দেশের উপর রকেট হামলা হলে কোন রাষ্ট্রেরই সহ্য করার কথা নয়। কাজেই ইস্রাইলের অধিকার রয়েছে নিজেকে রক্ষা করার। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে গাজাতে ১০ দিনের বিমান হামলার পর ইস্রাইলী সেনাবাহিনী গাজার ভেতরে প্রবেশ করে। জাতিসংঘের হিসেবে ১৫'শর বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক এই হামলায় নিহত হয়; যার মাঝে ৫’শ জনের বেশি ছিল শিশু। ১৮ই জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ইস্রাইলী প্রথানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে ফোন করে মার্কিন সমর্থনের কথা জানান। তিনি আবারও বলেন যে, ইস্রাইলের অধিকার রয়েছে নিজেকে রক্ষা করার। ২০১৮ সালে গাজাতে প্রতিবাদ করার সময় কয়েক ডজন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করার পর ইস্রাইলকে সমর্থন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একইসময়ে মার্কিন দূতাবাস তেল আভিভ থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে স্থানান্তর করা হয়; যার ফলে আরও ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। অথচ সেসময় হোয়াইট হাউজ থেকে বলা হয় যে, ইস্রাইলের পুরো আক্রমণের দায় ছিল হামাসের। ইস্রাইলের অধিকার রয়েছে নিজেকে রক্ষা করার।

বাইডেন বাস্তবতাকে মেনে নেবেন, নাকি আদর্শকে রক্ষা করবেন?

ইস্রাইলের প্রতি জো বাইডেন সরকারের শর্তহীন সমর্থন ডেমোক্র্যাট শিবিরে ভাঙ্গন ধরাতে পারে বলে আশংকা করছেন অনেকে। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, ‘প্রগ্রেসিভ’ এবং ‘লিবারাল’ প্রভাবশালী বামপন্থী গ্রুপগুলি বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকারকে সমর্থন দেবার পক্ষপাতি নয়। এদের মাঝে বিভিন্ন ইহুদী লিবারাল গ্রুপও রয়েছে। এই গ্রুপগুলির নেতাদের মাঝে রয়েছে বার্নি স্যান্ডার্স; যাদের সমর্থনের কারণেই বাইডেন নির্বাচন জিতেছেন, যেক্ষেত্রে এর আগে হিলারি ক্লিনটন বিফল হয়েছিলেন। ইস্রাইলের লবি গ্রুপগুলি বলছে যে, বর্তমানে ওয়াশিংটনে ইহুদী লবিস্টরা বেশিরভাগই লিবারাল এবং ইস্রাইলের আগ্রাসী আচরণের বিরোধী। এই গ্রুপগুলি বলছে যে, ইস্রাইলের জন্ম থেকেই ফিলিস্তিনী জনগণকে বাস্তুহারা করা হয়েছে। এই লোকগুলিকে বাড়ি ফিরতে না দিলে দীর্ঘমেয়াদে এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। ইস্রাইলী লবিস্টরা বলছে যে, এই লিবারাল ইহুদীদের কাছে ইস্রাইলের জন্যে সমর্থন না চেয়ে কৌশল পরিবর্তন করা উচিৎ। ওয়াশিংটনে ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টান গ্রুপগুলিকে টার্গেট করলেই বরং বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো মাইক পেন্স বা মাইক পম্পেওএর মতো ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টানরা ডেমোক্র্যাট দলের নন। তদুপরি এরকম ব্যক্তিদের অনেক মার্কিন অঙ্গরাজ্যে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। পরবর্তী মধ্যবর্তী নির্বাচনে জিততে হলে বাইডেনকে সেসব রাজ্যে জিততে হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং ইস্রাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, ২০১৩। ইস্রাইলকে বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রই টিকিয়ে রেখেছে; যেকারণে ইস্রাইলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এতটা গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াশিংটনে ইস্রাইলের ব্যাপারে নীতি পরিবর্তনের কোন লক্ষণ দেখা না গেলেও যেটা পরিষ্কার তা হলো, ওয়াশিংটনের নীতি এখন অভ্যন্তরীণ কলহে জর্জরিত। অভ্যন্তরীণ বিভেদের কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যে, তারা আদর্শকে ধরে রাখবেন, নাকি বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আদর্শের ব্যাপারে ছাড় দেবেন? ইস্রাইলকে সরাসরি সমর্থন দিয়ে বর্তমান বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বৈশ্বিক আদর্শিক নেতৃত্ব ধরে রাখা সম্ভব নয়।


মার্কিন কংগ্রেসের প্রগ্রেসিভ রাজনীতিবিদ আলেক্সান্দ্রিয়া অস্কার কর্তেজ বাইডেন সরকারের সমালোচনা করে টুইটার বার্তায় বলছেন যে, মার্কিন সমর্থনেই ইস্রাইল ফিলিস্তিনিদের উপর হামলা চালাচ্ছে। ইস্রাইলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন দিতে গিয়ে বাইডেন মানবাধিকারকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, ‘প্রগ্রেসিভ’ গ্রুপগুলির সাথে নির্বাচনের সময় অনেক কাজ হয়েছে এবং নীতি নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে বাইডেন প্রশাসনের। কিন্তু এখন ‘হানিমুন’ শেষ! বহু দশক ধরেই বাইডেনকে ইস্রাইলীরা বন্ধু হিসেবে দেখেছে। ওয়াশিংটনে বাইডেনকে ক্যাথোলিকদের মাঝে ইস্রাইলের সবচাইতে বড় বন্ধু হিসেবে দেখা হতো। ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো কারমিয়েল আরবিট বলছেন যে, ইস্রাইলের ব্যাপারে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে হয়তো ডেমোক্র্যাটদের মাঝে বিভেদ থাকতে পারে। কিন্তু সেখানে ইস্রাইলের ব্যাপারে নীতিগত কোন বিরোধ নেই। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউএস মিডলইস্ট প্রজেক্ট’এর প্রধান ড্যানিয়েল লেভি বলছেন যে, যদিও মার্কিন রাজনীতিতে ইস্রাইলের বিশেষ স্থান পরিবর্তন হবার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, তথাপি রাজনীতির জটিলতা সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। মার্কিন সিনেট এখন পুরোপুরি বিভক্ত। কামালা হ্যারিসের উপর বাইডেনের বিভিন্ন এজেন্ডা নির্ভর করছে; তাই হ্যারিসের ভোটটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

ইস্রাইলকে বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রই টিকিয়ে রেখেছে; যেকারণে ইস্রাইলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এতটা গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াশিংটনে ইস্রাইলের ব্যাপারে নীতি পরিবর্তনের কোন লক্ষণ দেখা না গেলেও যেটা পরিষ্কার তা হলো, ওয়াশিংটনের নীতি এখন অভ্যন্তরীণ কলহে জর্জরিত। ট্রাম্পের মতো ডানপন্থীদের ঠেকাতে বাইডেন প্রশাসনের জন্যে বামপন্থী ‘প্রগ্রেসিভ’ ও ‘লিবারাল’ বন্ধুদের প্রয়োজন রয়েছে। অথচ ডানপন্থী খ্রিস্টানদের ভোট না পেলে বাইডেনের পক্ষে ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হবে। ডানপন্থীদের খুশি করতে গিয়ে বাইডেন যদি মানবাধিকারের মতো আদর্শিক ব্যাপারে ছাড় দেন, তাহলে বামপন্থীদেরকে নিজের সাথে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ বামপন্থীরাই বর্তমানে আদর্শিক ব্যাপারগুলিকে ধরে রেখেছে। বাইডেনকে এখন এমন এক বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা এর আগের কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টকেই করতে হয়নি। এর আগে সকলেই ইস্রাইলকে সরাসরি সমর্থন দিয়ে গেছেন; কাউকেই কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। কিন্তু এখন অভ্যন্তরীণ বিভেদের কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে যে, তারা আদর্শকে ধরে রাখবেন, নাকি বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আদর্শের ব্যাপারে ছাড় দেবেন? ইস্রাইলকে সরাসরি সমর্থন দিয়ে বর্তমান বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বৈশ্বিক আদর্শিক নেতৃত্ব ধরে রাখা সম্ভব নয়।

Tuesday 11 May 2021

ফিলিস্তিনে নতুন করে সহিংসতার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

১১ই মে ২০২১
ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্বের নিষ্ক্রিয়তা এবং ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ মুসলিম বিশ্বে নেতৃত্বহীনতার অভাবকে প্রকটভাবে সামনে নিয়ে এসেছে; যা বিশ্বব্যাপী মুসলিমদেরকে বড় কোন পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হতে অনুপ্রাণিত করবে। ইস্রাইলের সাথে ফিলিস্তিনীদের সংঘাত যত মারাত্মক আকার ধারণ করতে থাকবে, মুসলিম বিশ্বেও পরিবর্তনের আকাংক্ষা ততটাই প্রবল হতে থাকবে।



রমজান মাসে ফিলিস্তিনে উত্তেজনা চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৯ই এবং ১০ই মে গাজা উপত্যকায় ইস্রাইলী বিমান হামলায় কমপক্ষে ২২ জন নিহত হয়েছে বলে বলছেন গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ কেদ্রা। নিহতদের মাঝে ৯জন শিশুও রয়েছে। এছাড়াও ১’শ ৬ জন আহত হয়েছে; যার মাঝে কিছু লোকের অবস্থা গুরুতর। বিমান হামলার প্রতিবাদে গাজার সরকারে থাকা হামাস ১৩ কিঃমিঃ দূরে আশকেলন এলাকায় রয়েট হামলা করে। ইস্রাইলী সরকার ঘোষণা দেয় যে, ফিলিস্তিনী গ্রুপগুলি ইস্রাইলের উপর রকেট হামলা করার পর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তারা গাজায় বিমান হামলা শুরু করেছে। এর আগে ফিলিস্তিনীরা রকেট হামলা করেছিল আল আকসা মসজিদে ইস্রাইলী পুলিশের হামলার পর। গাজায় বিমান হামলার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে সংঘাত আরও ঘনীভূত হলো।

রমজান মাসের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনে উত্তেজনা শুরু হয়। মুসল্লীরা জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে রাতের বেলায় তারাবির নামাজ আদায়ের জন্যে আসতে থাকলে ইস্রাইলী পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পূর্ব জেরুজালেমের দামাস্কাস গেট এলাকায় ইস্রাইলী পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে বাধা প্রদান করতে থাকলে সেখানে নিয়মিত সংঘর্ষ চলে। এর সাথে সাথে ফিলিস্তিনী এলাকায় উগ্র জাতীয়তাবাদী ইহুদী ‘জায়নিস্ট’দের এক মিছিল শুরু হয়; যাকে কেন্দ্র করে আরও সংঘর্ষ চলে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেম ইস্রাইলের দখলে আসার বার্ষিকীতে ‘জেরুজালেম দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে ‘জায়নিস্ট’রা এই মিছিলের আয়োজন করে। ৭ই মে রজমান মাসের শেষ জুমআর নামাজ আদায় করতে আসা মুসল্লীদের উপর ইস্রাইলীরা বাধা দেয়। পরদিন ৮ই মে হাজার হাজার মুসল্লী আল আকসা মসজিদে লাইলাতুল কদরের রাতে নামাজ পড়তে আসলে ইস্রাইলী হামলা শুরু হয়। ফিলিস্তিনী হাসপাতালের বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ জানায় যে, দামাস্কাস গেট এলাকায় প্রতিবাদকারীদের সাথে ইস্রাইলী বাহিনীর সংঘর্ষে প্রায় শ’খানেক ফিলিস্তনী আহত হয়। এর আগের রাতেও ইস্রাইলী পুলিশের হামলায় প্রায় ২’শ ফিলিস্তিনী আহত হয়। ফিলিস্তিনী রেড ক্রিসেন্টের বরাত দিয়ে ‘আল জাজিরা’ জানায় যে, শুক্রবারের সংঘর্ষে এক ব্যক্তি চোখ হারিয়েছে এবং দুইজন মস্তিষ্কে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বেশিরভাগ মানুষই ইস্রাইলী রাবার বুলেট ও স্টান গ্রেনেডের আঘাতে মুখমন্ডল এবং চোখে আঘাত পেয়েছে।

এছাড়াও প্রায় মাসখানেক ধরেই ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহ এলাকায় দখলকৃত জমিতে ইহুদীদের অবৈধ বসতি স্থাপন এবং ফিলিস্তিনীদের নিজেদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত করা নিয়ে উত্তেজনা চলছে। সেই এলাকার চারটা পরিবার উতখাতের শিকার হয়ে অনেক বছর আগে ইস্রাইলের আদালতের সরণাপন্ন হয়েছিল। এই পরিবারগুলি ১৯৪৮ সালে ইস্রাইলী দখরদারিত্বের কারণে বাড়িঘর হারিয়ে ১৯৫৬ সালে শেখ জাররাহ এলাকায় বসতি স্থাপন করে। এই এলাকার তৎকালীন নিয়ন্ত্রক জর্দান এবং জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংতস্থা এই ব্যবস্থা করে দেয়। ইহুদী বসতি স্থাপনকারীরা আদালতে বলে যে, এই এলাকা প্রথম থেকেই ইহুদীদের জমি ছিল। সাম্প্রতিককালে ইস্রাইলের জেলা আদালত বলে যে, ফিলিস্তিনী পরিবারগুলিকে হয় এই এলাকা ছাড়তে হবে, নতুবা ইহুদীদেরকে জমির মালিক মেনে নিয়ে তাদেরকে ভাড়া প্রদান করবে। এই রায়কে কেন্দ্র করেই চলা উত্তেজনার সাথে যুক্ত হয়েছে আল আকসায় নামাজ আদায় করার সময়কার উত্তেজনা। ‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ফিলিস্তিনী প্রতিবাদকারীরা বলছেন যে, আজকে শেখ জাররাহ থেকে মানুষকে উৎখাত করছে; কালকে অন্য এলাকা থেকেও ফিলিস্তিনীদের উৎখাত করবে। একারণেই তারা প্রতিবাদ করছেন। ৭ই মে ইস্রাইলী পুলিশ শেখ জাররাহ এলাকায় শতশত প্রতিবাদকারীর যাবার পথে বাধা সৃষ্টি করে। প্রতিবাদকারীরা ব্যারিকেডের বাইরেই ইফতার করে এবং অবস্থান ধর্মঘট করে। তবে এই প্রতিবাদ প্রতিদিন শান্তিপূর্ণ ছিল না। ৬ই মে পুলিশ অবস্থান ধর্মঘট পালনকারীদের উপর জলকামান, স্টান গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করে। এতে ৩০ জন আহত হওয়া ছাড়াও ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। শেখ জাররাহ এলাকার বাসিন্দারা মোবাইলে ছবি তুলে সোশাল মিডিয়াতে দিচ্ছে; যেখানে দেখা যাচ্ছে যে ইহুদী দখলদারিরা অস্ত্রসহ টহল দিচ্ছে। সোশাল মিডিয়ার ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, ইফতার করার সময় ফিলিস্তিনীদের উপর ইস্রাইলীরা হামলা করছে। ১০ই মে ইস্রাইলের সুপ্রিম কোর্টের রায় দেবার কথা থাকলেও তা আদালত এক মাসের জন্যে পিছিয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে সংঘাতের কারণটা রয়েই যাচ্ছে।

আল আকসা মসজিদে দুই দিনের ইস্রাইলী পুলিশী হামলার পর ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক টেলিভিশন ভাষণে ঘোষণা দেন যে, ইস্রাইল কোন ‘উগ্রবাদী’ গ্রুপকে শান্তি নষ্ট করতে দেবে না। ‘জেরুজালেম দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে নেতানিয়াহু এই ভাষণ দিচ্ছিলেন। অধিকৃত এলাকায় ইহুদী বসতি স্থাপনের চেষ্টার বিরুদ্ধে যেকোন চাপ প্রয়োগকে প্রতিহত করার কথা বলেন তিনি। ইস্রাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় যে, পূর্ব জেরুজালেমে জমি নিয়ে কিছু লোকের ব্যক্তিগত কলহকে ফিলিস্তিনিরা জাতীয় ইস্যু হিসেবে তৈরি করে জেরুজালেমে সহিংসতা তৈরি করছে।

৮ই মে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, রাশিয়া এবং জাতিসংঘ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জর্দান, মিশর, তুরস্ক, তিউনিসিয়া, পাকিস্তান, কাতার, বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন এই ঘটনায় ইস্রাইলের নিন্দা করেছে। ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ঘটনার নিন্দা করে জাতিসংঘের জরুরি অধিবেশন দাবি করেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মুখপাত্র রুপার্ট কোলভিল সাংবাদিকদের বলেন যে, শেখ জাররাহ এলাকায় ইস্রাইলের জোরপূর্বক উৎখাত অভিযান বন্ধ করতে আহ্ববান জানাচ্ছে জাতিসংঘ।

ইস্রাইলকে পশ্চিমা বিশ্বের প্রচ্ছন্ন ও সরাসরি সমর্থন চলছে ইস্রাইলের জন্মলগ্ন থেকেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির নেতৃবৃন্দও বিভিন্ন সময়ে ইস্রাইলের সাথে শান্তি চুক্তি করেছে; যাদের মাঝে রয়েছে মিশর ও জর্দান। তুরস্ক প্রথম থেকেই ইস্রাইলের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রেখে চলেছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে সৌদি গ্রুপের অন্তর্গত সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মরক্কোর সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ। অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলি আরবদের সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ব্যাপারটাতে ‘নিরপেক্ষ’ থাকার চেষ্টা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন সরকারের নির্বাচন জয়ের ব্যাপারটা নিশ্চিত হবার সাথেসাথেই আরব দেশগুলি এবং ইস্রাইল নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। তাদের কাছে ইস্যু হলো বাইডেন সরকারের সাথে ইরানের পারমাণবিক চুক্তির আলোচনা পুনরায় শুরুর সম্ভাবনা। আরব দেশগুলির সাথে ইস্রাইলের সম্পর্ক উন্নয়নের ফলাফলস্বরূপ ফিলিস্তিনে, বিশেষ করে অধিকৃত এলাকায় ইস্রাইলী আগ্রাসন যে বাড়বে, তা মোটামুটি জানাই ছিল। ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলির নেতৃত্বের নিষ্ক্রিয়তা এবং ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ মুসলিম বিশ্বে নেতৃত্বহীনতার অভাবকে প্রকটভাবে সামনে নিয়ে এসেছে; যা বিশ্বব্যাপী মুসলিমদেরকে বড় কোন পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হতে অনুপ্রাণিত করবে। ইস্রাইলের সাথে ফিলিস্তিনীদের সংঘাত যত মারাত্মক আকার ধারণ করতে থাকবে, মুসলিম বিশ্বেও পরিবর্তনের আকাংক্ষা ততটাই প্রবল হতে থাকবে।

Friday 7 May 2021

ব্রিটিশ সামরিক শক্তির ভবিষ্যৎ কি?

০৭ই মে ২০২১
ছবিঃ জিবরালটারের অদূরে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ‘ফোর্দ’। নতুন সমন্বিত নীতিপত্রে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের কূটনৈতিক মিশনগুলিকে প্রতিরক্ষা এটাশের সংখ্যা বাড়ানো হবে। পররাষ্ট্র কর্মকান্ডে প্রতিরক্ষা স্টাফদের সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি করা হবে। বিদেশে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলিকে আরও শক্তিশালী করা হবে। জিবরালটার এবং সাইপ্রাস ছাড়াও ওমান, সিঙ্গাপুর এবং কেনিয়াতে ব্রিটেন তার সামরিক অবস্থানকে আরও সুসংহত করবে।



ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সরকার সরকার আগামী এক দশকের কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রকাশ করার পর থেকেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। গত ২২শে মার্চের ‘গ্লোবাল ব্রিটেন ইন এ কম্পিটিটিভ এইজ’ শীর্ষক এক প্রকাশনার মাঝে ব্রিটিশরা নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, উন্নয়ন সহায়তা এবং পররাষ্ট্রনীতিকে সমন্বিত করেছে। অর্থাৎ প্রতিরক্ষা নীতিকে অন্য নীতি থেকে আলাদা করে দেখছে না তারা। ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়টাকে ব্রিটিশরা একটা সুযোগ হিসেবে দেখতে চাইছে। নীতিপত্রে বলা হচ্ছে যে, বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন, বিশেষ করে ইন্দোপ্যাসিফিক দুনিয়ার ভূরাজনৈতিক এবং ভূঅর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশরা ২০৩০ সাল পর্যন্ত তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনেছে। এই বাস্তবতাতেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাকে এগিয়ে নিতে সম্পূর্ণ জাতীয় শক্তিকে তারা ব্যবহার করতে চাইছে। ‘দ্যা ইকনমিস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৬ সালে ব্রেক্সিটের জন্যে আয়োজন করা গণভোটের কিছু সময় পর থেকেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাটা সামনে আসতে থাকে। নতুন এই নীতিপত্রের মাধ্যমে এই চিন্তাটাকে ভিত্তি দেয়া হলো।

প্রতিরক্ষার বাইরেও তারা অনেক বিষয়কে জাতীয় নিরাপত্তার শক্তিশালী অংশ হিসেবে দেখছে; যার মাঝে রয়েছে ব্রিটিশদের প্রযুক্তিগত উতকর্ষতা, ইন্টেলিজেন্স, নিরাপত্তা, কূটনীতি বিষয়ে শক্তিশালী বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক, বৃহৎ আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার, শক্তিশালী সাইবার সক্ষমতা, সকল গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে নিজেদের শক্তিশালী উপস্থিতি, পরিবেশ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যের দিক থেকে দুনিয়ার নেতৃত্বশীল অবস্থান, ইত্যাদি। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের কেন্দ্রেই রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডা। ইন্দোপ্যাসিফিকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্রিটেন এই দেশগুলিকে সহায়তা করবে। এছাড়াও ভারতকেও এই কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি হিসেবে দেখছে ব্রিটেন। তবে অনেকেই বলছেন যে, এই নীতিতে ব্রিটিশ সামরিক শক্তিকে খর্ব করা হচ্ছে। অপরদিকে ব্রিটিশ সরকার বলছে যে, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামরিক শক্তির বাইরে অন্যান্য বিষয়কেও হিসেবে আনতে হবে; কারণ বর্তমান বাস্তবতা আগের মতো নেই।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর প্রতিটা অংশই কর্তন করা হচ্ছে; বিশেষ করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আকার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে যাওয়ায় এর মাধ্যমে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব, তা নিয়েই প্রশ্ন করছেন অনেকে। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, এই পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মাঝে সেনাবাহিনীর আকার সাড়ে ৭২ হাজারে নামিয়ে আনা হবে; যা কিনা ১৭১৪ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। বর্তমানে এটা ৭৬ হাজারে রয়েছে; আর এর পিছনে কারণ হলো ৮২ হাজার সেনার টার্গেট বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। নতুন রিক্রুট যেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি বর্তমান সেনাদেরও ধরে রাখা যাচ্ছে না। বাহিনীর রিক্রুটমেন্টের যা অবস্থা, তাতে এর আকার এমনিতেই সাড়ে ৭২ হাজারে চলে আসবে; কাউকে ছাটাই করতে হবে না। এছাড়াও সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কগুলির প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। বাকি থাকা ১’শ ৪৮টা ট্যাঙ্কের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করতে খরচ হবে প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনী কার বিরুদ্ধে মোতায়েন হবে?

নীতিপত্রে বলা হচ্ছে যে, সেনাবাহিনীর পদাতিক সেনাদেরকে ৪টা ডিভিশনের মাঝে পুনর্বিন্যাস করা হবে। বর্তমানের একটা পদাতিক ব্যাটালিয়ন বাতিল করে দেয়া হবে; অন্যদিকে সেনাবাহিনীর স্পেশাল অপারেশনস ব্রিগেডের অধীনে একটা নতুন রেনজার রেজিমেন্ট তৈরি করা হবে। এর মাধ্যমে প্রচলিত যুদ্ধের দরকারের চাইতে স্পেশাল ফোর্সের দরকারকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষা করার জন্যে একটা আলাদা ব্যাটালিয়ন তৈরি করা হচ্ছে; যা কিনা বাহিনীর প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ সহায়তা দেবার উদ্দেশ্যে একটা ‘সিকিউরিটি ফোর্স এসিসট্যান্স’ ব্রিগেড তৈরি করা হবে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলির সামরিক শক্তিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির সাথে সমন্বিত করার প্রচেষ্টাকে আরও এগিয়ে নেয়া হবে। বিশ্বব্যাপী যেকোন স্থানে দ্রুত মোতায়েনের উদ্দেশ্যে ১৬তম এয়ার এসল্ট ব্রিগেড এবং ১ম কমব্যাট এভিয়েশন ব্রিগেড নিয়ে ‘গ্লোবাল রেসপন্স ফোর্স’ গঠন করা হচ্ছে। ১৬তম এয়ার এসল্টে রয়েছে বিমানে পরিবহণ করার মতো প্যারাশুট সেনারা; আর ১ম কমব্যাট এভিয়েশনে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের এটাক হেলিকপ্টার। ৬ষ্ঠ ডিভিশনের কাজ হবে সাইবার যুদ্ধ, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, ইনফরমেশন যুদ্ধ এবং অন্যান্য অপ্রচলিত সক্ষমতা। সেনাবাহিনীর ৩য় এবং ১ম ডিভিশনকে পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। এগুলি সেনাবাহিনীর বড় ইউনিট হলেও এগুলি নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম আলোচনা হয়েছে নীতিপত্রে। পুরোনো সরঞ্জাম সরিয়ে প্রায় ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নতুন প্রযুক্তির সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। ‘আইএইচএস জেন্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৪৪টা মাল্টিপল রকেট আর্টিলারি পাঁচ বছরের মাঝে প্রযুক্তিগতভাবে আপগ্রেড করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ২০২৫ সাল নাগাদ এগুলি ১’শ ৫০ কিঃমিঃ দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারবে। এছাড়াও ২০২৪ সালের মাঝে একই সিস্টেম ব্যাবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপ করা ‘প্রিসিসন স্ট্রাইক মিসাইল’ ছোঁড়া সম্ভব হবে; যার পাল্লা হবে প্রায় ৫’শ কিঃমিঃ।

সেনাবাহিনীর বর্তমানের ২’শ ২৭টা ‘চ্যালেঞ্জার ২’ ট্যাঙ্ক থেকে কমিয়ে ১’শ ৪৮টায় নামিয়ে আনা হচ্ছে; যেগুলি ১ম ডিভিশনের অধীনে থাকবে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’ বা ‘রুসি’র এক লেখায় রিসার্চ ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন যে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী একটা ডিভিশন বিশ্বব্যাপী মোতায়েন করার সক্ষমতা রাখতে চাইছে। এই একটা ডিভিশনের ২টা রেজিমেন্টে মোট ১’শ ১২টা ট্যাঙ্ক থাকবে। কিন্তু যেহেতু মেরামত এবং মেইনটেন্যান্সের জন্যে কিছু ইউনিট ওয়ার্কশপে থাকবে, তাই ১’শ ৪৮টা ট্যাঙ্কের মাঝ থেকে ১’শ ১২টাকে অপারেশনে রাখা বেশ কঠিন হবে। আর যুদ্ধ করতে গিয়ে এর মাঝ থেকে কিছু যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে সেগুলি প্রতিস্থাপন করাও কঠিন হয়ে যাবে। কোন রিজার্ভও রাখা সম্ভব হবে না। এছাড়াও ওয়াটলিং বলছেন যে, এই ট্যাঙ্কগুলি মূলতঃ দরকার হবে ইউরোপের পূর্ব সীমানা রক্ষার্থে। একসময় ইউরোপে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলি সোভিয়েত সীমানার কাছে ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই ঘাঁটিগুলি রুশ সীমানা থেকে প্রায় ২ হাজার কিঃমিঃ দূরে। ট্যাঙ্কগুলির এই দূরত্ব পাড়ি দেবার জন্যে রয়েছে মাত্র ৭১টা ট্যাঙ্ক ট্রান্সপোর্টার। তদুপরি শ’খানেক ‘এএস ৯০’ সেলফ প্রোপেল্ড আর্টিলারিও এই ট্রান্সপোর্টারগুলিকেই বহণ করতে হবে; যা পুরোপুরি অবাস্তব। আর রুশ সীমানার সাথে দূরত্ব কমাতে হলে ঘাঁটিগুলিকে সরিয়ে পোল্যান্ডে নিতে হবে; যা কিনা যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। ওয়াটলিং বলছেন যে, ব্রিটিশ সরকারকে হয় ট্যাঙ্কের সংখ্যা বাড়াতে হবে; নতুবা ট্যাঙ্কের চাইতে হাল্কা আর্মার্ড ভেহিকলের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আগে ঠিক করতে হবে যে, তারা সেনাবাহিনীকে দিয়ে কি করাতে চান। ওয়াটলিংএর কথাগুলিতে যে ব্যাপারটা স্পষ্ট তা হলো, ব্রিটেন ইউরোপের স্থলসীমানাকে ব্যাপক হুমকির মাঝে দেখছে না। ব্রিটিশ চিন্তাবিদেরা কি আসলেই রাশিয়ার সাথে স্থলযুদ্ধের আশঙ্কা করেন? আর ব্রিটিশদের এই চিন্তার সাথে তাদের প্রধান কৌশলগত সহযোগী যুক্তরাষ্ট্র কতটা সহমত?

রয়াল নেভি ছোট হচ্ছে; কিন্তু সক্ষমতা বাড়বে... কিভাবে সম্ভব?

ব্রিটিশ রয়াল নেভি বর্তমানে পূর্বের ছায়ামাত্র; তদুপরি এর উপর আসছে আরও কর্তন। বর্তমানের ১৯টা ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ার থেকে আগামী ১৮ মাসের মাঝে ১৭টা জাহাজে কমিয়ে আনা হচ্ছে। ১৩টা ‘টাইপ ২৩’ ফ্রিগেটের মাঝে দু’টাকে ডিকমিশনিং করে ফেলা হচ্ছে। ‘নেভাল টেকনলজি’ ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাতে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল টনি রাডাকিন বলছেন যে, তারা নৌবাহিনীর বেশকিছু জাহাজ বিশ্বব্যাপী স্থায়ীভাবে মোতায়েন করতে চাইছেন। এতে করে বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ অবস্থান ধরে রাখতে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক জাহাজ লাগবে। উদাহরণস্বরূপ তিনি ব্রিটিশ ফ্রিগেট ‘মনট্রোজ’এর কথা বলেন, যা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ীভাবে অবস্থান করছে। কিছুদিন পরপর এই জাহাজের ক্রু পরিবর্তন করা হচ্ছে। মেইনটেন্যান্সের কাজগুলিও মধ্যপ্রাচ্যেই করে নিচ্ছে তারা। এবছরেই রয়াল নেভির দৈত্যাকৃতির বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’ স্থায়ীভাবে মোতায়েন হচ্ছে ইন্দোপ্যাসিফিকে। এছাড়াও একটা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল মোতায়েন রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে; আরেকটা রয়েছে মধ্য আমেরিকার ক্যারিবিয়ানে। আর মার্চ মাসেই আরেকটা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ‘ট্রেন্ট’ মোতায়েন করা হয় জিবরালটারে। এই জাহাজটা ভূমধ্যসাগর এবং পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষা করবে। আরও দু’টা প্যাট্রোল ভেসেল সবেমাত্র কমিশনিং করা হয়েছে, যেগুলি ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করা হবে। এই প্যাট্রোল ভেসেলগুলি এমন সব এলাকায় মোতায়েন করা হবে, যেখানে হুমকি অপেক্ষাকৃত কম। এতে করে দামি ফ্রিগেটগুলিকে বেশি প্রতযোগিতাপূর্ণ এলাকায় মোতায়েন করা যাবে।

নীতিপত্রে বলা হচ্ছে যে, ‘বে ক্লাস’এর একটা উভচর সাপোর্ট জাহাজকে পরিবর্তন করে উপকূলীয় অঞ্চলে যুদ্ধ করার নতুন সক্ষমতা দেয়া হবে। এতে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা থাকবে এবং জাহাজটাকে স্থায়ীভাবে দূরবর্তী কোন একটা সমুদ্রে মোতায়েন করা হবে। নতুন এক ধরনের সক্ষমতা তৈরি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে সমুদ্রের নিচে সাবমেরিন ক্যাবলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। মাইন ধ্বংসকারী জাহাজগুলিকে নতুন প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় সক্ষমতা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হবে।

আর এডমিরাল রাডাকিন বলছেন যে, ব্রিটিশরা ৮টা ‘টাইপ ২৬’ এবং ৫টা ‘টাইপ ৩১’ ক্লাসের যে ফ্রিগেটগুলি তৈরি করছে, সেগুলি অনেক রকমের কাজ করতে পারবে। তিনি উদাহরণস্বরূপ বলেন যে, ‘টাইপ ২৬’ ফ্রিগেটগুলি ১৪টা কনটেইনার বহণ করতে পারে। একেকটা কনটেইনারের ভেতর বিভিন্ন মিশনের সরঞ্জাম নেয়া যাবে; যেমন, লেজার অস্ত্র, মাইন ধ্বংস করার সরঞ্জাম, থ্রিডি প্রিন্টার সহ মিনি ফ্যাক্টরি, একটা দূতাবাসের পুরো অফিস, মেডিক্যাল সরঞ্জাম, আকাশ বা পানিতে বা পানির নিচ দিয়ে চলা ড্রোন, ইত্যাদি। এভাবে একটা জাহাজ অনেকগুলি বিশেষায়িত জাহাজের কাজ করতে পারবে; অর্থাৎ কম সংখ্যক জাহাজ দিয়ে তারা কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন, তাই শুধু নয়, নতুন জাহাজগুলি অনেক নতুন সক্ষমতাকে বাহিনীর সাথে যুক্ত করবে। প্রতিটা জাহাজ, সাবমেরিন এবং নাবিক তথ্য সংগ্রহের কেন্দ্র হওয়া ছাড়াও ইন্টেলিজেন্স স্টেশন হিসেবে কাজ করবে এবং বহু ধরনের প্রযুক্তির বহণকারী হবে। একইসাথে তারা স্পেশাল ফোর্সের কর্মকান্ডকে সহায়তা দেবে। এডমিরাল রাডাকিন রয়াল নেভির এই চিন্তাগুলিকে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ বলে বলেন।

তবে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ হিসেবে ব্রিটিশরা বিশ্বব্যাপী তাদের অবস্থান ধরে রাখতে অন্য দেশের উপর নির্ভর করছে। যেমন, ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে রক্ষার জন্যে যেসব জাহাজ সাথে থাকবে, তার মাঝে থাকবে একটা মার্কিন ডেস্ট্রয়ার এবং একটা ডাচ ফ্রিগেট। এছাড়াও বিমানবাহী জাহাজের ডেকের উপরে ব্রিটিশ ‘এফ৩৫’ বিমানের সাথে থাকবে মার্কিন ম্যারিক কোরের ‘এফ৩৫’ বিমান। ২০২০ সালে ক্যারিবিয়ান, আর্কটিক, বল্টিক এবং ভূমধ্যসাগরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাথে ছিল অন্যান্য দেশের নৌবাহিনীর জাহাজ। গত মার্চ মাসে আর্কটিকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘ল্যাংকাস্টার’এর সাথে ছিল নরওয়ের ফ্রিগেট ‘থর হেয়ারডাল’। এছাড়াও মার্চে বল্টিক সাগরে দু’টা ব্রিটিশ ফ্রিগেট এবং একটা সাপ্লাই জাহাজের সাথে ছিল লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া এবং সুইডেনের কয়েকটা সামরিক ইউনিট।
ছবিঃ রয়াল এয়ার ফোর্সের ‘সি ১৩০’ পরিবহণ বিমান। ব্রিটিশ সরকার এরকম সবগুলি বিমান রিটায়ার করতে যাচ্ছে। ব্রিটেন মনে করছে না যে, ২০৩০ সালের মাঝে বড় কোন সামরিক মিশনে তাকে জড়াতে হবে। তাই ট্যাঙ্ক এবং সামরিক বিমানের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পিছপা হচ্ছে না তারা।



ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের লক্ষ্য কি হবে?

ব্রিটিশ সরকার এর আগে বলেছিল যে, তারা মোট ১’শ ৩৮টা ‘এফ ৩৫বি’ স্টেলথ বিমান কিনবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যেগুলি কিনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের উপর থেকে উড়তে সক্ষম। এবারের পরিকল্পনায় তারা বলছে যে, এখন পর্যন্ত যে ৪৮টা বিমান তারা ডেলিভারি পেয়েছে, সেগুলির পর তারা আরও ক্রয় করবে। কিন্তু তারা বলছে না যে, সেই সংখ্যা ১’শ ৩৮ পর্যন্ত যাবে কিনা। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মন্ত্রী জেমস হিপ্পি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে তিনি বলেন যে, ব্রিটেন কয়েকটা দেশের সহযোগিতায় নিজস্ব স্টেলথ ফাইটার ‘টেমপেস্ট’ ডেভেলপ করছে। ভবিষ্যতে রয়াল এয়ার ফোর্স কেমন হবে, তা নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। ব্রিটিশরা যে ‘এফ ৩৫বি’ বিমান ক্রয় করছে, তা মার্কিন ম্যারিন কোরও ক্রয় করছে। ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলছেন যে, ব্রিটিশরা যদি নির্দিষ্ট করে না বলে যে, তারা কতগুলি ‘এফ ৩৫বি’ ক্রয় করতে যাচ্ছে, তাহলে তা এই বিমানের নির্মাতা ‘লকহীড মার্টিন’কে যেমন শান্ত করবে না, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রকেও অস্বস্তিতে রাখবে। মাত্র ৪৮টা ‘এফ ৩৫বি’ দিয়ে ব্রিটিশরা তাদের বিশ্বব্যাপী সক্ষমতাকে ধরে রাখতে পারবে না, কারণ এই বিমানগুলি সবসময় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের উপরেই থাকবে; এর বাইরে মোতায়েনের জন্যে আর কোন স্টেলথ বিমান তাদের হাতে থাকবে না। ব্রিটিশ সরকার খুব সম্ভবতঃ অর্থায়নের ক্ষেত্রে নিজেদের ‘টেমপেস্ট’ স্টেলথ বিমান ডেভেলপমেন্টকে ‘এফ ৩৫বি’ বিমান মোতায়েনের উপর অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ব্রঙ্ক বলছেন যে, ব্রিটিশ সরকার ১’শ ৩৮টা ‘এফ ৩৫বি’ কিনতে পারবে কিনা, তা নিয়ে প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল। কিন্তু ‘টেমপেস্ট’কে ঘিরে ব্রিটিশ আকাংক্ষা বলছে যে, ব্রিটিশরা শেষ পর্যন্ত খুব সম্ভবতঃ ৬০ থেকে ৭২টা ‘এফ ৩৫বি’ কিনতে পারবে। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, ২০১৮ সালে ‘টেমপেস্ট’এর মডেল উন্মোচিত করার সময় অনেকেই প্রশ্ন করেছিল যে, ‘এফ ৩৫বি’ বিমান ক্রয় করে এর সমান্তরালে আরেকটা নতুন বিমান ডেভেলপ করার মতো অর্থায়ন ব্রিটিশ সরকার পাবে কিনা। আগামী চার বছরের জন্যে ব্রিটিশ সরকার ‘টেমপেস্ট’ প্রকল্পে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার কথা বলছে। এই প্রকল্পের ফলে ইতোমধ্যেই ১৮’শ প্রযুক্তিগত কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে এবং এর মাধ্যমে আরও ১৮ হাজার বর্তমান কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা বেড়েছে।

রয়াল এয়ার ফোর্স তাদের মূল ফাইটার বিমান ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’এর ‘ট্রানশ ১’ ভার্সনের সবচাইতে পুরোনো ২৪টা বিমান ২০২৫ সালের মাঝে সার্ভিস থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। বিমান বাহিনীর চিফ অব স্টাফ এয়ার চিফ মার্শাল মাইক উইগস্টন বলছেন যে, পুরোনো বিমানগুলির চাইতে নতুন ‘ট্রানশ ২’ এবং ‘ট্রানশ ৩’ ভার্সনের বিমানগুলির সক্ষমতা বহুগুণে বেশি। কাজেই পুরোনো বিমানগুলি রিটায়ার করিয়ে দিলে তাতে বিমান বাহিনীর সক্ষমতায় কোন পরিবর্তন আসবে না। পুরোনো বিমানগুলি বর্তমানে ট্রেনিংএর জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাতটা ‘টাইফুন’ স্কোয়াড্রনের মাঝে একটা কাতারি বিমান বাহিনীর সাথে যৌথভাবে অপারেট করা হবে। ‘আইএইচএস জেন্স’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রয়াল এয়ার ফোর্স মোট ১’শ ৩১টা ‘টাইফুন’ বিমান অপারেশনে রাখতে চাইছে। তবে তারা বলছে যে, পুরোনো ‘ট্রানশ ১’ বিমানগুলি সফটওয়্যার সীমাবদ্ধতার কারণে শুধু ব্রিটেনের আকাশ প্রতিরক্ষার কাজ করে; যার ফলে অপেক্ষাকৃত নতুন মাল্টিরোল বিমানগুলিকে বিশ্বব্যপী মোতায়েন করা যাচ্ছে। ‘ট্রানশ ১’ বিমানগুলিকে আপগ্রেড করতে খরচ অনেক বেশি হবে বিধায় এগুলিকে আগের মতোই রেখে দেয়া হয়েছিল।

ব্রিটিশ সরকার বিমান বাহিনীর ‘সি ১৩০’ পরিবহণ বিমানগুলিকেও বাদ দিচ্ছে ২০২১ সালের মাঝে। বর্তমানে এধরণের ১৪টা বিমান রয়েছে রয়াল এয়ার ফোর্সে। এই বিমানগুলির মেইনটেন্যান্সের দেখাশুনা করতো ‘মার্শাল এরোস্পেস এন্ড ডিফেন্স গ্রুপ’। কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন যে, ব্রিটিশরা বিমানগুলিকে বাদ দিলে বেশ কিছু কর্মী কর্মসংস্থান হারাতে পারে। ‘সি ১৩০’ বিমানের কাজগুলি চালিয়ে নেবে নতুন ‘এ ৪০০এম’ এবং ‘সি ১৭’ পরিবহণ বিমান। এছাড়াও ব্রিটিশ সরকার আগাম সতর্কীকরণ ও আকাশ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ৩টা ‘ই ৩ডি সেন্ট্রি’ বিমানকে ২০২১ সালেই রিটায়ার করিয়ে দিচ্ছে। এই বিমানগুলি প্রকৃতপক্ষে ‘বোয়েইং ৭০৭’ বিমানের উপর বড় আকৃতির অত্যাধুনিক রাডার। এগুলিকে ২০২৩ সালে প্রতিস্থাপন করবে ‘ই ৭এ ওয়েজটেইল’ বিমান। ‘ওয়েজটেইল’ বিমানগুলি ‘বোয়েইং ৭৩৭’ বিমানের উপর ভিত্তি করে তৈরি। বাজেট কমাবার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ৫টা ‘ওয়েজটেইল’ বিমান থেকে কমিয়ে এখন ৩টা বিমান ক্রয় করছে। পুরোপুরিভাবে নতুন বিমান তৈরি না করে পুরোনো বিমান পরিবর্তন করে এগুলি তৈরি করা হবে। ‘ফ্লাইট গ্লোবাল’ বলছে যে, এর ফলে দুই বছরের জন্যে ব্রিটেনের আকাশসীমা রক্ষা করার জন্যে কোন সতর্কীকরণ বিমান থাকবে না। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, আগাম সতর্কবার্তা পাবার জন্যে তারা শুধুমাত্র বিমানের উপর নির্ভর করবে না। তারা ২০২২ সাল থেকে গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের আকাশসীমায় প্রতিপক্ষের বিমান ঢোকার আগেই আগাম সতর্ক করতে পারবে।
ছবিঃ গত নভেম্বরে উদ্ভোধন হলো ব্রিটেনের ‘ন্যাশনাল সাইবার ফোর্স’। সাইবার প্রতিরক্ষাকে নীতিপত্রে অতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সাইবার সক্ষমতা বাড়াবার কারণ হিসেবে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বলছেন যে, একুশ শতকে আকাশ থেকে বোমা ফেলার চাইতে সাইবার হামলা বা ‘এআই’ ও ড্রোনএর যথেচ্ছ ব্যবহার বেশি হুমকির সৃষ্টি করবে। সেকারণেই তারা সাইবার এবং ‘এআই’ ছাড়াও বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে চাইছে।



বৈশ্বিক কৌশলগত অবস্থানকে আরও সুসংহত করতে চায় ব্রিটেন

নতুন সমন্বিত নীতিপত্রে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের কূটনৈতিক মিশনগুলিতে প্রতিরক্ষা এটাশের সংখ্যা বাড়ানো হবে। পররাষ্ট্র কর্মকান্ডে প্রতিরক্ষা স্টাফদের সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি করা হবে। বিদেশে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলিকে আরও শক্তিশালী করা হবে। জিবরালটার এবং সাইপ্রাস ছাড়াও ওমান, সিঙ্গাপুর এবং কেনিয়াতে ব্রিটেন তার সামরিক অবস্থানকে আরও সুসংহত করবে। সেনাবাহিনীতে ট্যাঙ্কের সংখ্যা কমালেও জার্মানিতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবস্থান শক্ত করতে সরঞ্জাম স্টোরেজে বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। ন্যাটোর অংশ হিসেবে ব্রিটেন বল্টিক সাগরের দেশগুলিতে এবং পোল্যান্ডে তার নৌবাহিনীকে নিয়মিত মোতায়েন করবে এবং বিমান বাহিনী বল্টিকের আকাশে প্যাট্রোল অব্যহত রাখবে। এই কাজগুলি মূলতঃ রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যেই করা হবে। বলকান, মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন এবং ইন্দোপ্যাসিফিকের দেশগুলিকে সামরিক সহায়তা দেবার কথাও বলা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনের ঘাঁটি, স্পেশাল ফোর্সেস, সাইবার প্রতিরক্ষা, সামরিক ইন্টেলিজেন্স, সামরিক তথ্যের নিরাপত্তা, এবং বিশ্বব্যাপী তাদের সামরিক অপারেশন সমন্বয় করার জন্যে রয়েছে ‘স্ট্র্যাটেজিক কমান্ড’। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী সকল সামরিক কর্মকান্ডকেই তারা কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখছে। এই কমান্ডের অধীনে সাইপ্রাস, ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জ, জিবরালটার এবং ভারত মহাসাগরে দিয়েগো গার্সিয়ায় স্থায়ী ঘাঁটি পরিচালিত হয়। গত নভেম্বরে এই কমান্ডের অধীনে ‘ন্যাশনাল সাইবার ফোর্স’ উদ্ভোধন করা হয়। ‘স্ট্র্যাটেজিক কমান্ড’এর প্রধান জেনারেল প্যাট্রিক স্যানডার্স ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বলেন যে, যারা ব্রিটেনের ক্ষতি করতে চায়, তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা এবং অবকাঠামো অচল করা বা ধ্বংস করে দেবার সক্ষমতা ব্রিটিশ সাইবার ফোর্সের রয়েছে। ‘স্কাই নিউজ’ বলছে যে, জেনারেল স্যানডার্স না বললেও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো বলতে প্রতিপক্ষের বিদ্যুৎ গ্রিড, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই ও বিল্ডিংকেই বোঝানো হয়েছে। জেনারেল স্যানডার্স তার বক্তব্যে ব্রিটিশ সাইবার নেটওয়ার্কের উপর প্রতিনিয়ত হামলার ব্যাপারটাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বিমান বাহিনীর ব্রিটেনের উপর হামলার সাথে তুলনা করেন। তিনি বলেন যে, ব্রিটিশ সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে প্রতিদিন ৬০টা বড় রকমের হামলা প্রতিরোধ করে থাকে।

সাইবার প্রতিরক্ষাকে নীতিপত্রে অতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘হারভার্ড কেনেডি স্কুল’এর ‘বেলফার সেন্টার’এর গবেষণায় ব্রিটেন বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী সাইবার রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরেই ব্রিটেনের স্থান। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল নিক কার্টার বলেন যে, বর্তমানে সাইবার যুদ্ধ থেকে শুরু হয়ে কোন একটা সংঘর্ষ সর্বাত্মক যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে। সাইবার যুদ্ধের গুরুত্ব বোঝাতে ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় ‘মাইক্রোসফট’ কোম্পানিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি সায়মন মেহডিয়ান স্টাফেল চেষ্টা করেছেন। তিনি বলছেন যে, বেসামরিক অর্থনীতি থেকে এখন প্রতিরক্ষাকে আলাদা করাটাই কঠিন। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলছেন যে, ২০১২ সালে চালু হওয়া একটা গেমিং সফটওয়্যার তৈরির ব্যবসা এখন সামরিক বাহিনীর জন্যে বহু ধরনের সফটওয়্যার তৈরি করছে। তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টর এত দ্রুত ডেভেলপ করছে যে, এখন প্রতিরক্ষা বাজেটের উপর ভিত্তি করে কর্মক্ষমতা নির্ধারণের সীমাবদ্ধ চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি বলছেন যে, নির্দিষ্ট বাজেটের মাঝে যতটা সম্ভব সক্ষমতা ক্রয় করার চিন্তা এখন অতীত। কারণ শুধু বাজেট বাড়িয়ে সাইবারস্পেসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা করতে হবে।

‘ফিনানশিয়াল টাইমস’এর এক আলোচনা অনুষ্ঠানে জেনারেল স্যানডার্স বলেন যে, সাইবার সক্ষমতা বাড়াতে তিনি বেসামরিক জনগণের মাঝ থেকে দক্ষ ব্যক্তিদেরকে মধ্যম বা উঁচু সাড়ির সামরিক পদে সরাসরি নিয়োগ দিতে চান। এরকম ব্যক্তিরা যেকোন সময় সামরিক সার্ভিসে ঢুকতে পারবে; আবার বের হয়ে যেতেও পারবে। তিনি ইস্রাইলের রিক্রুটিং ব্যবস্থাকে হিংসা করেন; কারণ তারা বাধ্যতামূলক সামরিক সার্ভিস ব্যবহার করে অনেক বড় জনগোষ্ঠী থেকে সাইবার বিশেষজ্ঞ রিক্রুট করতে পারে। তিনি বলেন যে, উচ্চ বেতনের বেসরকারি চাকুরির সাথে এই কাজের একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। সামরিক বাহিনীতে এই ব্যক্তিরা কোন গেমের এভাটার নয়, বরং সত্যিকারের শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবে; যা অন্য কোথাও সম্ভব নয়। সাইবার শক্তি ধরে রাখার ক্ষেত্রে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মাঝে রয়েছে ব্রিটেন। ‘ডিপার্টমেন্ট অব কালচার, মিডিয়া এন্ড স্পোর্ট’এর হিসেবে ২০২০ সালে ব্রিটেনে সাইবার সেক্টরে ১০ হাজার দক্ষ জনবলের ঘাটতি ছিল। ব্রিটিশ ইলেকট্রনিক ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘জিসিএইচকিউ’ বর্তমানে ‘নিউরোডাইভার্স’ বা মানসিক প্রতিবন্ধীদের মাঝ থেকে সাইবার সক্ষমতার ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ‘জিসিএইচকিউ’এর সফলতাকে অনুসরণ করতে চাইতে সামরিক বাহিনী।

এছাড়াও গত ১২ই মার্চ ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দেয় যে, এবছরের মাঝেই ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘এআই’এর সক্ষমতা বাড়াবার জন্যে একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তারা। ব্রিটিশ ডিজিটাল সেক্রেটারি অলিভার ডাউডেন বলেন যে, ‘এআই’এর মূল ফোকাস হবে এর ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে বৃদ্ধি করা, এর সঠিক ডেভেলপমেন্টের দিকে আগানো এবং দক্ষ জনবল তৈরি করা। গত জানুয়ারিতে ব্রিটিশ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা ‘এআই কাউন্সিল’ একটা ‘এআই রোডম্যাপ’ তৈরি করে।
ছবিঃ ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর উপর যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত ‘এফ ৩৫বি’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান। প্রযুক্তিগত দিক থেকে ব্রিটেন এখন অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। অন্য দেশের সম্পদ ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করার প্রচেষ্টা আপাতঃদৃষ্টিতে চতুর মনে হলেও পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক চিন্তার অধঃপতনের মাঝে এর সফলতার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।


গ্লোবাল ব্রিটেনের কৌশলগত চিন্তা

ব্রিটেন মনে করছে না যে, ২০৩০ সালের মাঝে বড় কোন যুদ্ধে তাকে জড়াতে হবে। বরং ছোটখাটো আঞ্চলিক সংঘাতই তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ। স্পেশাল ফোর্সের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের সমর্থনে নৌবাহিনীর নতুন সাপোর্ট জাহাজ এই কৌশলেরই অংশ। তাই ট্যাঙ্ক এবং সামরিক বিমানের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পিছপা হচ্ছে না তারা। একইসাথে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তায় ব্রিটেন কমনওয়েলথের সদস্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে একত্রে নিয়ে কাজ করতে চাইছে। এছাড়াও তার কূটনৈতিক সক্ষমতা বাড়াবার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে অন্য দেশের সামরিক সক্ষমতাকেও নিজেদের পক্ষে কাজ করাতে চাইছে তারা। সামরিক সহায়তা দেবার মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপ এবং ইন্দোপ্যাসিফিকের দেশগুলিকে তাদের কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজে লাগাচ্ছে তারা। অপরদিকে সাইবার সক্ষমতা বাড়াবার কারণ হিসেবে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বলছেন যে, একুশ শতকে আকাশ থেকে বোমা ফেলার চাইতে সাইবার হামলা বা ‘এআই’ ও ড্রোনএর যথেচ্ছ ব্যবহার বেশি হুমকির সৃষ্টি করবে। সেকারণেই তারা সাইবার এবং ‘এআই’ ছাড়াও বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে চাইছে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থার সুযোগ নিতে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর বিশ্বব্যাপী অবস্থানকে আরও সুসংহত দেখতে চাইছে তারা। ইন্দোপ্যাসিফিকে নতুন করে সামরিক ঘাঁটি তৈরি এবং তাদের একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করাটা এই কৌশলেরই অংশ। তবে ব্রিটেনের সমস্যা তার অপ্রতুল সম্পদ। ইন্দোপ্যাসিফিকে মোতায়েন করা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের এসকর্ট হিসেবে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ছাড়াও থাকবে ডাচ এবং মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। জাহাজের ডেকে যে ‘এফ ৩৫বি’ যুদ্ধবিমান থাকবে, তার কিছু ব্রিটিশ; বাকিগুলি মার্কিন ম্যারিন কোরের। সামরিক বাহিনীতে কাজ করাবার জন্যে যথেষ্ট জনবল খুঁজে পাচ্ছে না ব্রিটেন। আবার নিজেদের আদর্শিক চিন্তাকে সমুন্বত রাখতে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে কাউকে সামরিক বাহিনীতে কাজ করতে বাধ্যও করতে পারছে না তারা। প্রযুক্তিগত দিক থেকে ব্রিটেন এখন অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। অন্য দেশের সম্পদ ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করার প্রচেষ্টা আপাতঃদৃষ্টিতে চতুর মনে হলেও পশ্চিমা বিশ্বের আদর্শিক চিন্তার অধঃপতনের মাঝে এর সফলতার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।

Sunday 2 May 2021

আফগানিস্তান ... যুক্তরাষ্ট্রের পর...

০২রা মে ২০২১


২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলীকে পুঁজি করে প্রায় দুই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে। সেই সামরিক অভিযান শেষ করার বহু চেষ্টার পর অবশেষে গত ১৪ই এপ্রিল আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন এবং পশ্চিমা সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ঘোষণা মোতাবেক আগামী ১১ই সেপ্টেম্বরের মাঝে সকল সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হবে। মার্কিনীদের আফগানিস্তান ত্যাগের সম্ভাব্য ফলাফল কি হতে পারে, তা নিয়ে ব্যাপক জল্পনা কল্পনা চলছে।

শান্তি প্রতিষ্ঠার কোন নিশ্চয়তা না দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান ছাড়তে হচ্ছে। ‘কাবুল ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ফাইজ জালান্দ ‘সিজিটিএন’কে বলছেন যে, শান্তি আলোচনা চললেও বাস্তবিকপক্ষে আফগানিস্তানে কোন শান্তি নেই। আলোচনার টেবিলে এগিয়ে থাকার জন্যে সকল পক্ষই আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে। তিনি মনে করছেন না যে, শান্তি প্রক্রিয়ায় খুব বেশি একটা আশা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রায়নের নামে দুর্নীতিবাজ এবং অপরাধপ্রবণ লোকদের উপর বিনিয়োগ করেছে। আফগানরা বেশিরভাগই তালিবানের পক্ষে না থাকলেও আফগান সরকারকে সমর্থন দেয় না। আর যুদ্ধের মাঝে গণহত্যা ও মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজ করার কারণে তারা মার্কনীদেরকেও বিশ্বাস করে না। আফগান রাজনীতিবিদ ইহসানুল্লাহ সেদিকের মতে দেশটাতে বহু রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে ক্ষমতা দখলের জের ধরে নতুন করে গৃহযুদ্ধ লাগতে পারে। আর মার্কিনী সেনারা তো আফগানিস্তানের মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে সন্মান করার জন্যে প্রশিক্ষিতই হয়নি। তাদের সমর্থিত সরকারও আফগান সাধারণ জনগণ এবং তালিবানের মাঝে কোন পার্থক্য খুঁজে পায়নি। গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র আফগান জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সরকার দিতে পারেনি। জাতিসংঘের হিসেবে ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১২ই এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেসের তিনজন রিপাবলিকান সদস্য মাইকেল ওয়াল্টজ, লিজ চেনি এবং স্কট ফ্রাঙ্কলিন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেনের কাছে এক চিঠিতে লেখেন যে, মার্কিন ইন্টেলিজেন্স বারংবার সাবধান করেছে যে, মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ালে তালিবান এবং অন্যান্য অস্ত্রধারী গ্রুপগুলি নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করবে।

মার্কিন সহায়তা ছাড়া আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতা কতদূর?

মার্কিনীরা আফগানিস্তান ছেড়ে যাবার পর আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী কতদিন নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকেই। বাইডেন সরকারের কাছে অবশ্য এর উত্তর রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন ‘এবিসি’ টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাতে বলেন যে, মার্কিন সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে যাবার পর আফগান সামরিক বাহিনী শহরাঞ্চলগুলি ধরে রাখার সক্ষমতা রাখে। এটা যথেষ্ট শক্তিশালী একটা বাহিনী। আর মার্কিনীরা আফগানদের বিভিন্ন সহয়াতা দিতে থাকবে। তবে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন বাহিনী থাকা অবস্থাতেই আফগানিস্তানের বিশাল এলাকা তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আফগান সেনাবাহিনীর অনেক সেনাসদস্যই অনেক বছর ধরে নিজেদের গ্রামে ফেরত যেতে পারছে না; কারণ তালিবানরা সেই গ্রামগুলির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আফগান সেনাবাহিনী যথেষ্ট দুর্নীতিপরায়ণ এবং ইতোমধ্যেই প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিরুদ্দেশ হয়েছে। কাগজে কলমে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৩ লাখের বেশি হলেও বাস্তবে তা অনেক কম। কারণ অনেক অফিসার মৃত বা অনুপস্থিত অফিসারদের বেতন ভোগ করছে। এছাড়াও সামরিক অপারেশনে উচ্চ হতাহতের সংখ্যা এবং নতুন রিক্রুট পেতে হিমসিম খাওয়ায় বাহিনীর সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে কমপক্ষে ২’শ ৮৭ জন সেনা নিহত এবং ১’শ ৮৫ জন সেনা আহত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৯ থেকে ১০ জন আফগান সেনা প্রাণ হারাচ্ছে। ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে যেখানে সাড়ে ৩ হাজার পশ্চিমা সেনা নিহত হয়েছে, সেখানে প্রায় ৬৬ হাজার আফগান সেনা প্রাণ হারিয়েছে। বহু সেনা আহত অবস্থায় বেঁচে আছে। বেসামরিক মানুষ হতাহতের তো হিসেবই নেই। আফগানিস্তানের উত্তরে উজবেক ও তাজিক জাতিগোষ্ঠির লোকদের মাঝ থেকে পুশতুন তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে বেশি রিক্রুট পাওয়া যেতো। কিন্তু একসময় যেখানে মাসে ৩ হাজার রিক্রুট পাওয়া যেতো, তা এখন মাসে ৫’শতে দাঁড়িয়েছে। অতি কম বেতনে ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজে অনেকেই নাম লেখাতে চাইছে না। সরকারি কর্মকর্তারা এবং বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বেতনের একটা বড় অংশ নিজেদের পকেটে পুরে নিচ্ছেন। শুধুমাত্র অতি দরিদ্র লোকেরাই সামরিক বাহিনীতে নাম লেখাচ্ছে। বাইডেনের সিদ্ধান্তের বহু বছর আগ থেকেই মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, এত উচ্চ হতাহতের সংখ্যা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে আফগানিস্তান ধরে রাখা সম্ভব নয়। বিভিন্ন ইউনিটে গোলাবারুদের সরবরাহও যথেষ্ট অপ্রতুল। এদের বিপক্ষে রয়েছে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তালিবান; যাদের বেশিরভাব অস্ত্রই আফগান সরকারকে মার্কিনীদের সরবরাহ করা। যুদ্ধের মাঝে অনেক সময়েই আফগান সামরিক অফিসাররা নিজেদের অবস্থান তালিবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে পিছু হটেছে। অনেকেই বাহিনী ছেড়ে পালিয়েছে।

আফগান সামরিক বাহিনীতর জন্যে রিক্রুট পাওয়া কঠিন হওয়ায় বিভিন্ন আঞ্চলিক জাতিগত ও রাজনৈতিক গ্রুপের অধীন মিলিশিয়াগুলির গুরুত্ব বেড়ে যাচ্ছে। এই মিলিশিয়াগুলি সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরকেও রিক্রুট করছে। ক্ষয়ক্ষতি এবং মেইনটেন্যান্স সাইকেলের মাঝে পড়ে আফগান বিমান বাহিনীর অনেক বিমানই কর্মক্ষম অবস্থায় নেই। কম বিমান সার্ভিসে থাকায় শুধুমাত্র স্পেশাল ফোর্সের সেনাদেরকে আকাশ থেকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। আফগান বাহিনীর হাতে কিছু ড্রোন থাকলেও তা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ব্যাতীত বাকি স্থানে মোতায়েন করা সম্ভব হচ্ছে না। আফগান বিমান বাহিনীর বিমানগুলি ডাক দেবার পর যতক্ষণে সাড়া দিচ্ছে, ততক্ষণে তালিবানরা এলাকা ছেড়ে গেছে। আর তখন বিমান হামলা নয়; বরং দরকার এয়ার এম্বুল্যান্স।

এছাড়াও আফগানরা এবং মার্কিনীরা একে অপরকে কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি। মার্কিন সেনারা নিয়মিতভাবেই আফগান সেনাদের হাতে হতাহত হয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, আফগান সেনাদের মার্কিনীরা সর্বদাই দ্বিতীয় সাড়ির বাহিনী হিসেবে দেখেছে। এই সেনারা এতটাই কম বেতন পায় যে, তাদের রাইফেলের মূল্য তাদের কয়েক মাসের বেতনের সমান। এমনকি একই মিশনে আহত হবার পর মার্কিন সেনারা বিশ্বমানের মেডিক্যাল সুবিধা পেলেও আফগান সেনাদের দেয়া হয়েছে নিম্নমানের সেবা। আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনীর পিছনে মার্কিনীরা ৭০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রসস্ত্র এবং ট্রেনিং খরচ করেছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু বাহিনীর করুন দশা দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে, সেই অর্থ আসলে কোথায় ব্যয় হলো। আফগান বাহিনীকে প্রতিশ্রুত সামরিক গাড়ির বেশিরভাগই সরবরাহ করা হয়নি। সেনা কমান্ডাররা কালোবাজার থেকে স্নাইপার রাইফেল কিনছে। সেনারা দরকারের বেশি বুলেট ছুঁড়ছে; যাতে করে বুলেটের খোসাগুলি বিক্রি করে কিছু আয় করা যায়। বিভিন্ন ইউনিটে সোভিয়েত আমলের সাঁজোয়া যান দিয়েই কাজ সাড়ছে আফগান সেনারা। সেনারা অনেকেই তাদের নাইট ভিশন গিয়ার বিক্রি করে দিয়েছে অর্থের জন্যে। আর অপরদিকে সেই নাইট ভিশন গিয়ার কাজে লাগিয়েই তালিবানরা রাতের বেলায় হামলা করছে আফগান বাহিনীর উপর। এত করুন দশাতেও আফগান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল ইয়াসিন জিয়া বলছেন যে, তারা বেঁচে থাকার কোন না কোন পদ্ধতি বের করবেন।

মার্কিনীদের আফগান বন্ধুদের কি হবে?

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর এক লেখায় সিনিয়র ফেলো কেমাল কিরিশচি এবং ‘ইস্তাম্বুল য়িলদিজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি’র ফুলিয়া মেমিসোগলু বলছেন যে, মার্কিনীরা আফগানিস্তান ছেড়ে গেলে একটা বড় ধরনের উদ্বাস্তু পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। তারা বলছেন যে, ২০১৫ সালে সিরিয়া যুদ্ধের কারণে লাখো উদ্বাস্তু যখন ইউরোপমুখে যাত্রা করে, তখন ইইউএর ভিতই নড়ে গিয়েছিল। সেটা মূলতঃ হয়েছিল ২০১১ সালে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর ইরাক এবং সিরায়াতে ব্যাপক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং তাতে বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে বাস্তুহারা হতে হয়। আফগানিস্তান থেকে মার্কিনীরা সড়ে আসার পর যদি এমনই কোন উদ্বাস্তু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও দুর্বল হবে।

‘দি আটলান্টিক’এর এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, যে আফগানরা যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছে, তাদেরকে ভুলে যাওয়া উচিৎ হবে কি? উত্তরে বলা হচ্ছে যে, বিভিন্ন দেশে জনবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেয়ার এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষে মার্কিনীদের সমর্থন দেয়া লাখো মানুষ নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে মার্কিনীদের কাছে সাহায্য চায়। জেরাল্ড ফোর্ডের রিপাবলিকান সরকার যখন ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ভিয়েতানামীকে উদ্ধ্বার করে নিয়ে আসার জন্যে কংগ্রেসের কাছে ৩’শ মিলিয়ন ডলার চায়, তখন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটদের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। সেসময় বিরোধিতাকারী ডেমোক্র্যাটদের মাঝে ছিলেন ডেলাওয়্যার রাজ্যের ৩২ বছর বয়সী সিনেটর জো বাইডেন। তিনি বলেছিলেন যে, মার্কিন সেনাদের সরিয়ে আনার জন্যে তিনি যেকোন আকারের বাজেটের পক্ষপাতি ছিলেন; কিন্তু ভিয়েতনামীদের সরিয়ে আনার জন্যে নয়। প্রেসিডেন্ট ফোর্ড তার জবাবে বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র একসময় হাঙ্গেরিয়ান, কিউবান, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ইহুদীদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দিয়েছিল। এখানে ভিয়েতনামীদেরকে কেন অন্য চোখে দেখা হবে? ডেমোক্র্যাটরা এতেও তাদের অবস্থান থেকে নড়েনি। বাইডেন সিনেটে তার বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, দক্ষিণ ভিয়েতনামের এক লক্ষ কেন, একটা মানুষকেও বের করে নিয়ে আসার দায়বদ্ধতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ঠিক ভিয়েতনামের মতোই ১৭ হাজার আফগান যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাবার জন্যে লাইন ধরে আছে। এই ব্যক্তিরা বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে কতটা সহায়তা পাবে, তা এখন কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

গত ১৬ই এপ্রিল প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার জন্যে আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা ১৫ হাজারের মাঝে নিয়ন্ত্রিত রেখে নির্দেশ স্বাক্ষর করেন। আবার এই ১৫ হাজারের মাঝে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কতজন আসতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করা আছে। মূলতঃ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন ইতিহাসের সর্বনিম্ন এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছিলেন। বাইডেন এর মাধ্যমে সাড়ে ৬২ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেবার পরিকল্পনা বাতিল করলো। তবে হোয়াইট হাউজ বলছে যে, ১৫ই মেএর মাঝে আরও বড় একটা সংখ্যার অনুমোদন দিতে পারেন বাইডেন। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, গত ফেব্রুয়ারি মাসেই বাইডেন পরবর্তী অর্থ বছরের জন্যে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১ লক্ষ ২৫ হাজার করতে চেয়েছিলেন। ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য আলেক্সান্দ্রিয়া অকাসিও কর্তেজ এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। বাইডেন অভিবাসীদের আসতে দেবেন, সেই আশাতেই জনগণ তাকে ভোট দিয়েছিল। আরেক ডেমোক্র্যাট প্রমিলা জয়পাল বাইডেনের এই সিদ্ধান্তকে বিবেকহীন বলে আখ্যা দিয়েছেন। রিপাবলিকানরা বলছেন যে, ২০২২ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভালো করার উদ্দেশ্য নিয়েই বাইডেন অভিবাসী আসা কমাতে চাইছেন।

মধ্য এশিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাটা আসলে কি?

মধ্য এশিয়াকে বাদ দিয়ে আফগানিস্তানের চিন্তা করাটা ঠিক নয়। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার স্থলবেষ্টিত দেশগুলির সমুদ্রে পৌঁছাবার করিডোর হিসেবে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের এক গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে; যা কিনা যুদ্ধের কারণে কখনোই বাস্তবায়িত করা যায়নি। পাকিস্তানের গোয়াদর সমুদ্রবন্দর থেকে চীনের সীমানা পর্যন্ত নির্মাণাধীন ‘চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর’ বা ‘সিপেক’এর সাথে আফগানিস্তানকে যুক্ত করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সম্পদকে সমুদ্র পর্যন্ত নিয়ে আসার চিন্তা করছেন পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও মধ্য এশিয়ার খনিজ সম্পদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা হলো চীন। ‘ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম’এর হিসেবে চীনের মোট গ্যাস আমদানির প্রায় ৩৮ শতাংশই আসে মধ্য এশিয়ার দেশ তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তান থেকে। একইসাথে মধ্য এশিয়ার রেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে চীনারা ইউরোপের সাথে বাণিজ্য করছে। একারণে মধ্য এশিয়ায় চীনা বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে। আর বিনিয়োগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়াতে রুশ প্রভাবকে চীন অনেকটাই প্রতিস্থাপিত করছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘নিউলাইন্স ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি এন্ড পলিসি’র ডিরেক্টর কামরান বোখারি ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক লেখায় বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলের মাঝে মধ্য এশিয়া একটা অন্ধকার কূপের মতো; যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি খুবই কম। তিনি মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। মধ্য এশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বৈশ্বিক নেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের চাবি হতে পারে। মার্কিনীদের ছেড়ে আসার পর আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতাকে ধরে রাখতে বিশেষ করে কাজাকস্তানের কথা বলছেন তিনি। তার মতে, ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে কাজাকস্তান একইসাথে তুরস্ক এবং ইরানের উচ্চাকাংক্ষাকে ব্যালান্স করতে কাজ করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পর...

বিশ্বের সবচাইতে বড় সামরিক শক্তি নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র দুই দশকে আফগানদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। উল্টো এই দুই দশকে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও মার্কিন সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা হ্রাসে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে আফগানিস্তান। দুই দশক পাহাড়ের পাদদেশে তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর তারা হঠাত করেই আবিষ্কার করেছে যে, চীন ও রাশিয়ার সাথে ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার জন্যে তারা প্রস্তুত নয়। প্রফেসর ফাইজ জালান্দ বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়েছে; কিন্তু কেউ তো আর পরাজয় স্বীকার করে না। মার্কিন ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থানের পর আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা রাখার স্বার্থ থাকবে পাকিস্তান, তুরস্ক এবং রাশিয়ার। পাকিস্তান চাইছে আফগানিস্তানের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার সাথে যুক্ত হতে। এতে পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক। মধ্য এশিয়ার দেশগুলিও আফগানিস্তানের মাঝ দিয়ে ভারত মহাসাগরে পৌঁছাতে চাইছে। ফলশ্রুতিতে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার সাথে তুরস্ক ও পাকিস্তানের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা বাড়বে। তবে আফগানিস্তানকে স্থিতিশীল দেখাটা রাশিয়ার জন্যেও নিরাপত্তার প্রশ্ন; যা এই দেশগুলিকে একটা সমঝোতার দিকে হাঁটাবে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে না জড়িয়ে মধ্য এশিয়াতে এই শক্তিগুলির মাঝে একটা ব্যালান্স দেখতে চাইবে।

Saturday 1 May 2021

মার্কিন প্রভাব বলয় থেকে বের হবার পথে তুরস্ক?

০১লা মে ২০২১

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১৯১৫ সালের আর্মেনিয় হত্যাকান্ডকে ‘গণহত্যা’র স্বীকৃতি দেয়ার পর এটা নিশ্চিত যে, বাইডেন প্রশাসনের নীতি শুধু তুর্কি সরকার নয়, রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ককেই কাছের বন্ধু হিসেবে দরকার মনে করছে না। এতে সন্দেহাতীতভাবেই তুরস্কের জনগণের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি হৃদ্যতাবোধ যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাও বাতাসে মিলিয়ে যাবে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসা ছাড়া তুরস্কের সামনে কোন পথই খোলা থাকছে না।

গত ২৪শে এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১৯১৫ সালের আর্মেনিয় হত্যাকান্ডকে ‘গণহত্যা’র স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক নিম্নগামী রয়েছে। সেই ব্যর্থ অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল বলে তুর্কিরা অভিযোগ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া থেকে ‘এস ৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে ‘এফ ৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রকল্প থেকে বাদ দেয়। সিরিয়াতে কুর্দি মিলিশিয়া গ্রুপ ‘ওয়াইপিজি’কে সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়ার পরেও যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে অব্যাহত সহায়তা দেয়ায় তুরস্কের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের উপরেও যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এছাড়াও মার্কিন আদালতে তুর্কি সরকারি ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে মামলা চলা নিয়েও চলছে বাকবিতন্ডা। জো বাইডেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হবার আগেই নির্বাচনী প্রচারণার সময়েই তুরস্কের সরকার, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগানের কঠোর সমালোচনা করেছেন। ডেমোক্র্যাট সরকারের আমলে দুই দেশের সম্পর্ক যে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে, এটা প্রায় জানাই ছিল।

বাইডেনের ঘোষণার পর তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, তুরস্কের অতীতের ব্যাপারে অন্য কারুর কাছ থেকে তুর্কিদের শিখতে হবে না। শুধুমাত্র জনসমর্থন আদায়ের জন্যে এধরনের চেষ্টাকে তুরস্ক পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বাইডেনের ‘বিশাল ভুল’কে শুধরে নিতে বলা হয়। একইসাথে বলা হয় যে, এর মাধ্যমে এমন এক ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, যা সারিয়ে নেয়া কঠিন। ‘জার্মান মার্শাল ফান্ড অব দ্যা ইউনাইটেড স্টেটস’এর আঙ্কারা ডিরেক্টর ওজগুর উনলুহিসারচিকলি ‘এরাব নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলছেন যে, বাইডেনের ঘোষণা বেশিরভাগ তুর্কির কাছেই দ্বিমুখী নীতি হিসেবে দেখা দিয়েছে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একইসাথে বলা যায় যে, তুরস্কে মার্কিন বিরোধী চিন্তা যতটা খারাপ হওয়া সম্ভব ইতোমধ্যেই তা হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন যে, প্রতিশোধ হিসেবে তুরস্ক আফগানিস্তানের শান্তি আলোচনায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে; সিরিয়াতে নতুন করে সামরিক অভিযান চালাতে পারে; অথবা তুরস্কের মাটিতে ন্যাটোর ইনচিরলিক বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন বিমান ওঠানামায় নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। তবে এখনও পর্যন্ত তুরস্কের বড় কোন প্রত্যুত্তর না দেয়া দেখে মনে হচ্ছে যে, হয় তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরেকটা সংঘাতে জড়াতে চাইছে না; অথবা আরেকটা সংঘাত বহণ করার সক্ষমতা তুরস্কের নেই।

আর্মেনিয়রা বাইডেনের ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও কিছুদিন আগেই নাগোর্নো কারাবাখ ছিটমহল নিয়ে আর্মেনিয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করা আজেরবাইজান ব্যাপারটাকে অন্যভাবে দেখেছে। বাইডেনের ঘোষণার চারদিন পর মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব এন্টনি ব্লিনকেনের সাথে এক টেলিফোন আলাপে আজেরি প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ বলেন যে, দেশটার নেতৃত্ব এবং জনগণ বাইডেনের ঘোষণায় ‘উদ্বিগ্ন’। তবে আজেরবাইজানের সরকারি বার্তাসংস্থা ‘আজেরতাগ’ বলছে যে, ফোনালাপে তারা আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধের পর পুনর্বাসন কর্মকান্ড এবং গ্যাস পাইপলাইনে মার্কিন সরকারের সমর্থন নিয়েই বেশি কথা বলেছেন।

ওয়াশিংটনে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত হাসান মুরাত মেরকান ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক পত্রিকা ‘আল মনিটর’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের বিরোধের অনেক জায়গা থাকলেও তিনি দুই দেশের মাঝে সহযোগিতার ভবিষ্যৎ দেখতে পান। তিনি সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলির উপরই বেশি গুরুত্ব দিতে ইচ্ছুক। বিশেষ করে আফগানিস্তান এবং সিরিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তিনি দুই দেশের সহযোগিতার সুযোগ দেখছেন। অপরদিকে আঙ্কারাতে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস জেফরি তুরস্কের ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে দেয়া এক সাক্ষাতে বলছেন যে, যদিও দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক বর্তমানে ‘খুব একটা কাছাকাছি নয়’, ছয় মাসের মাঝে নিশ্চিত যে, সম্পর্কের উন্নয়ন হবে। সিরিয়ার কুর্দি ‘ওয়াইপিজি’ মিলিশিয়াদেরকে সন্ত্রাসী আক্ষ্যা দেয়ার পরেও যুক্তরাষ্ট্র আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সহযোগী হিসেবে নিয়েছে তাদেরকে; যা কিনা তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মতবিরোধের একটা বড় জায়গা। অন্যদিকে ‘এস ৪০০’ এবং ‘এফ ৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান ইস্যুগুলি দুই দেশের সম্পর্ককে আরও কলুষিত করেছে। জেমস জেফরি সম্পর্ককে আগের অবস্থানে ফেরত নিতে পারার কথা বলেননি; তবে সম্পর্ক মেরামত সম্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন।

তুরস্কের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর এবং তুর্কি প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা গুলনার আইবেত ব্রিটেনের ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় বলছেন যে, পরিবর্তিত বিশ্বে তুরস্ককে সাথে না রেখে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তিনি বলছেন যে, আর্মেনিয়া নিয়ে তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বিরোধ শুধুমাত্র দুই দেশের সরকারের বিরোধ নয়। বিষয়টা তুরস্কের জনগণের কাছেও খুবই সংবেদনশীল। একসময় তুরস্কের বন্ধুত্ব হারাবার ভয়েই ওয়াশিংটনের লবিং গ্রুপগুলির কথা শোনেনি মার্কিন সরকার। এখন পরিবর্তিত এবং অনিশ্চিত বিশ্বে দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ক আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিৎ।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রেসিডেন্ট ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন প্রধান ফোকাস হলো চীন। একারণেই মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অবস্থানকে কমিয়ে আনতে চাচ্ছে। যেহেতু সেখানে এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ তেমন নেই, তাই তার হারাবারও খুব বেশি কিছু নেই। একারণেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র এখন এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, যা আগে নেয়া কষ্টকর ছিল। এই নীতির অংশ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তুরস্কের গুরুত্ব কমে গেছে। এখন তুরস্ককে নিজের পক্ষে রাখার তেমন কোন কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নেই। অপরপক্ষে তুর্কি নেতৃত্ব এবং বুদ্ধিজীবিরা জোর দিয়ে বলতে চাইছে যে, তুরস্ককে ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্ব নেতৃত্বকে ধরে রাখতে পারবে না; তাই দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। তবে যে ব্যাপারটাতে সকলেই একমত তা হলো, বাইডেন প্রশাসনের নীতি শুধু তুর্কি সরকার নয়, রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ককেই কাছের বন্ধু হিসেবে দরকার মনে করছে না। এতে সন্দেহাতীতভাবেই তুরস্কের জনগণের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি হৃদ্যতাবোধ যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাও বাতাসে মিলিয়ে যাবে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসা ছাড়া তুরস্কের সামনে কোন পথই খোলা থাকছে না।