Friday 2 September 2022

ইরাক… সহিংস ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে

০৩রা সেপ্টেম্বর ২০২২
 
মুকতাদা আল-সদরের অস্ত্রধারী সমর্থকরা গাড়িতে টহল দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকের রাজনীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নেয়ার সাথেসাথে সহিংস রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও বেড়েছে। ইরাকের অভ্যন্তরে ইরানের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে আল-সদর যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক বন্ধু দেশগুলি, যেমন তুরস্ক ও সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে উদ্যোগী হবেন; যা কিনা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা আল-কাধিমি বর্তমানে করছেন। অর্থাৎ আল-সদরকেও আঞ্চলিক নির্ভরশীলতার রাজনীতির মাঝেই ঘুরপাক খেতে হচ্ছে; যা ক্রমেই আরও সহিংস ও অনিশ্চিত হচ্ছে।


ইরাকের জনপ্রিয় শিয়া নেতা মুকতাদা আল-সদরের সমর্থকেরা অনেকদিন ধরে দেশের পার্লামেন্ট ভবন দখল করে রাখার পর ২৯শে অগাস্ট আল-সদর ঘোষণা দেন যে, তিনি রাজনীতি ছেড়ে দিচ্ছেন। তার এই ঘোষণার সাথেসাথে মারাত্মক সহিংসতা শুরু হয়। তবে পরদিন আল-সদর আবারও জনসমক্ষে এসে তার সমর্থকদের পার্লামেন্ট ভবন ছেড়ে দিতে বললে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। তবে অনেকেই বলছেন যে, মূল সমস্যার সমাধান না হওয়ায় নতুন করে সহিংসতা শুরু হবার আংশকা রয়ে গিয়েছে।

জাতিসংঘের মহাসচিবের বরাত দিয়ে তার মুখপাত্র স্তেফান দুজাররিক সাংবাদিকদের বলেন যে, রাষ্ট্র হিসেবে ইরাকের অস্তিত্বই এখন হুমকির মাঝে পড়েছে। একইদিনে ইরাকে জাতিসংঘ মিশনের এক বিবৃতিতে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির কর্মকান্ড চালু রাখার গুরুত্ব তুলে ধরা ছাড়াও ইরাকের সংবিধানকে সমুন্নত রাখার কথা বলা হয়। জাতিসংঘের এই বিবৃতিগুলিতে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, ইরাকের সমস্যা দেশটার রাষ্ট্রীয় পরিচয়কে হুমকির মাঝে ফেলেছে। পার্লামেন্ট ভবন দখল এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির প্রতি অনাস্থা পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইরাকের বর্তমান সমস্যা কোন সাধারণ সমস্যা নয়; বরং এটা দেশটার সাংবিধানিক, তথা অস্তিত্বগত সমস্যা; যা জাতিসংঘ বুঝতে পারলেও কোন সমাধান দিতে অক্ষম।

ইরাকের বর্তমান দ্বন্দ্ব মার্কিনীদের তত্ত্বাবধানে ২০০৩ সালের পর তৈরি করা সংবিধান নিয়ে। এক পক্ষ চাইছে সেই সাংবিধানিক গণতন্ত্রের সমঝোতাকে ধরে রাখতে; আর অপর পক্ষে রয়েছে মুকতাদা আল-সদরের সমর্থকরা; যারা ইরাকের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুরোপুরি পরিবর্তন চাইছে। বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে যে, মুকতাদা আল-সদরের দল ২০২১এর অক্টোবরের নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন পায়। তবে অনেক দিনের চেষ্টার পরেও তারা একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ্য সরকার গঠনে ব্যর্থ হবার পর গত জুন মাসে আল-সদরের নির্দেশে তার দলের পার্লামেন্টারিয়ানরা পদত্যাগ করে। এরপর জুলাই মাসে আল-সদরের সমর্থকেরা পার্লামেন্ট ভবন দখল করে। আপাততঃ আল-সদরএর আহ্বানে তার সমর্থকেরা পার্লামেন্ট ভবন ছেড়ে আসলেও সমস্যার সমাধান যেহেতু হয়নি, তাই সহিংসতা আবারও দেখা দিতে পারে। মুকতাদা আল-সদর ইরাকের অভ্যন্তরে যেকোন বিদেশী হস্তক্ষেপের বিরোধী।

দোহা ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘এরাব সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড পলিসি স্টাডিজ’এর ওয়াশিংটন উইংএর ফেলো জেইদন আলকিনানি এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, নতুন করে নির্বাচন দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। কারণ জাতিগত ভিত্তির উপরে তৈরি করা সংবিধানই সমস্যা। যারা ২০০৩ সালের পরে দেশের সংবিধান রচনা করেছিল, তাদের অনেকেই এখনও গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছে। কাজেই সংবিধানে পরিবর্তন আনতে গেলেও সেই একই ব্যক্তিগুলি তাদের প্রভাব খাটাবে। আল-সদর হিসেব করেই আন্দোলনে নেমেছিলেন। কারণ তিনি জানেন যে, ইরাকের বর্তমান ব্যবস্থার জনগণের মাঝে অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। মানুষের চাকুরি নেই; দরকারি সেবা পাওয়া যাচ্ছে না; দুর্নীতি ভয়াবহ আকারে ঠেকেছে। আল-সদর একইসাথে জাতিগত বিভেদকে দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে না রেখে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের আহ্বান করছেন।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট’এর ফেলো বিলাল ওয়াহাব ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, এটাই প্রথমবার নয় যে আল-সদর রাজনীতি ছেড়েছেন। রাজনীতি থেকে বের হয়ে যাবার ঘোষণা দেবার মাত্র একদিন পরেই নিজের সমর্থকদের পার্লামেন্ট ছাড়তে নির্দেশ দিয়ে তিনি রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি যথেষ্ট প্রভাবশালী একজন নেতা, এবং হয়তো তার আরও উচ্চাকাংক্ষাও রয়েছে। জেইদন আলকিনানি বলছেন যে, পশ্চিমা মিডিয়ায় অনেকেই বলা শুরু করেছে যে, ইরাকের অভ্যন্তরে ইরানের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে আল-সদরই যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একমাত্র আশা।

২০০৩ সালে মার্কিনীরা ইরাক দখল করে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেছে, তা জনগণের আস্থা হারিয়েছে। বর্তমান এই ব্যবস্থাটা ইরাকের প্রধান তিনটা জাতিগত গ্রুপকে ভিত্তি করে তৈরি করা। প্রথমতঃ শিয়া, যারা দক্ষিণাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ্য; দ্বিতীয়তঃ দেশের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলের সুন্নি আরব গ্রুপ; এবং তৃতীয়তঃ দেশের উত্তরাঞ্চলের কুর্দি গ্রুপ। বিলাল ওয়াহাব মত দিচ্ছেন যে, আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর থেকে সুন্নি এলাকাগুলি অনেক ক্ষেত্রেই শিয়া মিলিশিয়ারা নিয়ন্ত্রণ করছে। আর উত্তরাঞ্চলে কুর্দিদের মাঝে বিভেদের কারণে কুর্দিদের রাজনৈতিক শক্তিও কমে গেছে। এমতাবস্থায় শিয়ারা হয়তো মনে করতে শুরু করেছে যে, প্রথমবারের মতো পুরো ইরাক শিয়াদের নিয়ন্ত্রণে আসবে। এই নিয়ন্ত্রণের জন্যে শিয়াদের দুই গ্রুপের মাঝে বিবাদ শুরু হয়েছে। একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান ইরাকের রাজনীতিকে দুই দিকে টানছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র হঠাত করেই ইরাকের রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। অপরদিকে ইরানও পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় ইরাকে উস্কানিমূলক কিছু করতে চাইছে না। এর মাঝে দু’টা আন্তর্জাতিক ইস্যু ইরাকের রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। প্রথমতঃ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে তেল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে ইরাকের অর্থনীতিতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। আর দ্বিতীয়তঃ আইসিসের পতনের পর ইরাকের রাজনৈতিক গ্রুপগুলি এখন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারছে। আইসিসের পরাজয়ের পর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াগুলি ২০১৯ সালে রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রত্যাশী বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালিয়ে ৮'শ মানুষকে হত্যা এবং ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষকে আহত করেছিল। আলকিনানি অবশ্য বলছেন যে, বর্তমান সমস্যায় ইরানের ভূমিকা আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্টই কম। এর একটা কারণ হতে পারে ২০২০এর জানুয়ারিতে মার্কিন ড্রোন হামলায় আইআরজিসির প্রাক্তন জেনারেল কাসেম সুলাইমানির মৃত্যুর পর থেকে ইরাকের মিলিশিয়াদের উপর ইরানের প্রভাব কমে যাওয়া।

২০০৩ সালের পর মার্কিনীরা যে ইরাকের জন্ম দিয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের স্বার্থের বেড়াজালে বন্দী। রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর আস্থাহীনতাই মুকতাদা আল-সদরএর জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। কিন্তু আল-সদর নিজেও বুঝতে পারছেন যে, বাইরের প্রভাব থেকে ইরাককে মুক্ত করাটা কতটা কঠিন। সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকের রাজনীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নেয়ার সাথেসাথে সহিংস রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও বেড়েছে। ইরাকের অভ্যন্তরে ইরানের প্রভাবকে ব্যালান্স করতে আল-সদর যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক বন্ধু দেশগুলি, যেমন তুরস্ক ও সৌদি আরবের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে উদ্যোগী হবেন; যা কিনা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা আল-কাধিমি বর্তমানে করছেন। অর্থাৎ আল-সদরকেও আঞ্চলিক নির্ভরশীলতার রাজনীতির মাঝেই ঘুরপাক খেতে হচ্ছে; যা ক্রমেই আরও সহিংস ও অনিশ্চিত হচ্ছে।

2 comments:

  1. ইরাকের কিছু শিয়া ব্যক্তিদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। উনারা আমাকে বলেছেন যে মুক্তাদা আল সদর এর কোনো জনপ্রিয়তা বলে ইরাকে নেই। সে নাকি পিছনের দরজা দিয়ে আমেরিকার সাথে আতাত করে কাজ করে। তাদের কাছে জানতে চাইলাম তাহলে সদরের এত জনপ্রিয়তা কেন দেখি? উত্তরে প্রায় সকলে বলে যে তার জনপ্রিয়তা পশ্চিমা মিডিয়াতে বাড়িয়ে দেখানো হয় এবং সদরের সশস্ত্র বাহিনী অনেকটা জোর করে ইরাকি শিয়াদের সমর্থন আদায় করে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করি যে ইরাকের শিয়ারা মূলত কার দ্বারা প্রভাবিত? তারা ইরানের কথা বলে এবং তাদের কাজে সেটা আমি দেখেছিও। তারা এটাও দাবী করে যে ইরাক এখন অনেক নিরাপদ কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়াতে বলা হয় ইরাক অনিরাপদ। সংসদ ঘেরাও এর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে উনারা বলেছেন যে আমেরিকা সবুজ সংকেত দিয়েই ইহা করিয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার কথাগুলি উভয় দিকেদিয়েই সত্য। মার্কিনীরা যেহেতু মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যাচ্ছে (অথবা অনেকটাই গিয়েছে) তাই তারা এমন কিছু ব্যক্তিকে দেখতে চাইছে, যারা ইরানকে ব্যালান্স করে রাখবে। অপরদিকে মুকতাদাকে ক্ষমতায় দেখতে চাইছে না ইরানপন্থীরা। কারণ ইরানের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা মুকতাদাকে (এবং এর আগে তার বাবা) শিয়া নেতৃত্বের প্রতিযোগী বলে দেখে। যেটা বুঝতে হবে সেটা হলো, ইরানের ক্ষমতাসীনরা মূলতঃ পারসিক; শুধুমাত্র শিয়া নয়। তুর্কি শিয়া এবং আরব শিয়াদের উপর ইরানের প্রভাব একইরকম নয়। যেকারণে ইরানের আজেরবাইজান প্রদেশের উপর ইরানের সবসময় খেয়াল রাখতে হয়; যেখানে তুর্কি এবং ইস্রাইলিরাও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে থাকে।

      ইরান আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী। তবে ইরানের কর্মকান্ডগুলি যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যস্ত রাখার কাজটা করে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগীদের পক্ষে যায়।

      এই বিষয়ে নিচের লেখাটা পড়তে পারেন। ব্রিটিশরা কেন ইরানের ব্যাপারে মার্কিনীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে ...
      https://koushol.blogspot.com/2021/11/what-is-irans-goal.html

      Delete