Tuesday 23 December 2014

রাইজিং সান ওভার দ্যা ইন্ডিয়ান ওশান!

২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

বিখ্যাত মানুষের ছেলেমেয়েদের মানুষ হতে না পারার উদাহরণ অনেক আছে। কিন্তু শিক্ষিত মানুষেরা সাধারণত তাদের সন্তানদের স্বল্পশিক্ষিত করে রাখতে চান না। এই ব্যাপারটা যখন পুরো সমাজের মাঝে সঞ্চালিত হয়, তখন দেখা যায় যে একটা শিক্ষিত সমাজের মাঝে জন্ম নেয়া শিশুরা সবাই ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। ঠিক একইভাবে, সমাজের সর্বোচ্চ শিক্ষার পরিধি যখন বেশ সমৃদ্ধ হয়, তখন সেই সমাজে জন্ম নেয়া এবং শিক্ষা নেয়া মানুষের শিক্ষার পরিধিও বাড়ে। উর্ধগামী একটা সমাজে জন্মানো শিশুরা উর্ধে ওঠার জন্যেই প্রস্তুতি নিতে থাকে। যেই সমাজ সর্বদা নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে নিজেদের জীবনব্যবস্থাকে উন্নত করেছে, সেখানে উন্নতির মাপকাঠি সবসময় উর্ধগামী হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এক জিনিশ দু'বার আবিষ্কার করার দরকার হয় না; একবার করা হলে পরমুহূর্ত থেকেই সেটার উন্নততর কিছু একটা তৈরির জন্যে গবেষণা শুরু হয়ে যায়। এভাবে সমাজে জ্ঞানের পরিধি দিন দিন বাড়তেই থাকে। আর একবার একটা পর্যায়ে পৌঁছে যাবার পরে পিছনে আর ফিরে তাকাতে হয় না। এই জ্ঞানের পরিধি একেকটা সমাজের ক্ষেত্রে একেক রকম বলেই কেউ এগিয়ে অথবা কেউ পিছিয়ে আছে। আর যে একবার এগিয়ে যায়, তাকে নতুন করে কিছু উদ্ভাবন করতে হয় না। যুদ্ধ-বিগ্রহ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পিছিয়ে পড়লেও সেখানে জ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়ে না। দুর্যোগের পরপরই আবারো ঠিক যেখানে থেমেছিল, সেখান থেকেই শুরু হয় তাদের জ্ঞানের অগ্রযাত্রা। সমাজের চিন্তাধারার ক্ষেত্রেও এই ব্যাপরটাই হয়। একবার এগিয়ে গেলে কেউ পিছনে ফিরে যেতে চায় না; এটাই নিয়ম। এতগুলি কথা কেন লিখলাম? এখন সে কথাতেই আসি।


আইজেএন হোসো তৈরি হয় ১৯২২ সালে। জাপানের তৈরি প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ। তখনকার সময় এই জাহাজ প্রমাণ দিয়েছিল জাপান কতদূর এগিয়েছে। বহুবছর এধরনের জাহাজ বানাবার চর্চা না থাকলেও এই জ্ঞান একেবারে গিলে ফেলার নয়।

৯০ বছরের ইতিহাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিরা আমেরিকা এবং তার মিত্রদের কাছে হেরে গিয়েছিল। যুদ্ধের আগেই অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল যে আমেরিকার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পাওয়ারকে জাপানের পক্ষে টেক্কা দেওয়া সম্ভব ছিল কিনা। জাপানি নৌবাহিনী প্রধান ইসোরোকু ইয়ামামোতো নিজেই বিশ্বাস করেননি যে জাপান আমেরিকাকে যুদ্ধে হারাতে পারবে। তবু সেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার আগে জাপান তাদের জ্ঞান-বুদ্ধির ক্ষেত্রে একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যেটার উপরে ভর করেই তারা সাহস পেয়েছিল আমেরিকার মতো সম্পদশালী দেশের বিরূদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার। সম্পদের ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলেও সেসময় জ্ঞান-বুদ্ধিতে জাপানিরা আমেরিকা থেকে খুব বেশি একটা পিছিয়ে ছিল বললে ভুল হবে। জাপানি রাজকীয় নৌবহরের প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'আইজেএন হোশো' অপারেশনে আসে ১৯২২ সালে। মার্কিন প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'ইউএসএস ল্যাংলি' সার্ভিসে আসে ১৯২০ সালে। ১৯১২ সালে ল্যাংলি তৈরি হয়েছিল কয়লাবাহী জাহাজ হিসেবে; পরে সেটাকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজে রূপ দেওয়া হয়। অন্যদিকে হোসো প্রথম থেকেই ডিজাইন করা হয়েছিল বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ হিসেবে। ব্রিটিশদের প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'এইচএমএস আর্গাস' অপারেশনাল হয়েছিল ১৯১৮ সালে। সেসময় এ ধরনের জাহাজ ছিল এই দেশগুলির জ্ঞান-বুদ্ধির শিখরের প্রমাণ। ব্যাপারটা আজও তাই। প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের একটা পর্যায়ে পৌঁছাতে না পারলে এধরনের জাহাজ তৈরির চিন্তা করাটাই কঠিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রমাণ করেছিল যে এধরনের জাহাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রদর্শনে কতটা অপরিহার্য। আর একারণেই যুদ্ধে হেরে যাবার পরে জাপানিদের এধরনের জাহাজ বানানোর ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমেরিকানরা জাপানিদের সংবিধান তৈরি করে দিয়েছিল এই ব্যাপারগুলিকে মাথায় রেখেই। তারা জানতো যে জ্ঞান-বুদ্ধিতে জাপান এমন একটা পর্যায়ে উঠে গেছে যে আটকে রাখা না হলে খুব শিগগিরই জাপানি ডকইয়ার্ডগুলি আবারো বিমানবাহী জাহাজ তৈরি শুরু করবে। জাপানিরা আরেকটা যুদ্ধ চায়নি বলেই আমেরিকানদের তৈরি করা সংবিধান মেনে চলেছে এতকাল।

জাপানি নৌবহরের ১৪,০০টনের 'ওসুমি-ক্লাস'-এর এই জাহাজগুলি প্রথম জানান দেয় জাপানের 'যুদ্ধ-বিরোধী' সংবিধানের অবাস্তবতার
সাংবিধানিক পরিবর্তন

সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে জাপান তাদের প্রতিরক্ষার জন্যে আমেরিকার উপরেই নির্ভর করেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন সেনা, নৌ, বিমান ও ম্যারিন বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি জাপানেই। শীতল যুদ্ধের পর থেকে আমেরিকানরা পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে - প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে - বেশি ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় জাপান থেকে তাদের সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগটাই সরিয়ে নিয়েছে; এখনো নিচ্ছে। তারা পরিবর্তিত বিশ্বে জাপানকে তাদের নিরাপত্তার অংশীদার মেনে নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানকে আরও বেশি সক্রিয় হবার পেছনে মত দিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপাখ্যান ভুলে তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাপানকে আরও বেশি অগ্রগামী ভূমিকা নিতে বলছে। শীতল যুদ্ধের পর থেকে এই অঞ্চলে মার্কিন নীতিতে চীনের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় জাপানের সাহায্য মার্কিনীদের জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আর সারা বিশ্বে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত সম্পদের উপরে যে চাপ পড়েছে, সেটা কমিয়ে কমিয়ে আনতেও জাপানের সক্রিয় হাত দেখতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সক্রিয়তার অংশ হিসেবে জাপান তাদের 'প্যাসিফিস্ট' সংবিধানে পরিবর্তন আনতে পিছপা হচ্ছে না। এই পরিবর্তন কারো কারো কাছে দরকারী মনে হলেও প্রতিবেশী চীন এবং কোরিয়াকে তাদের বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত মনে করিয়ে দিচ্ছে।

১৯,০০০টনের ‘হাইয়ূগা-ক্লাস’-এর দু’টি জাহাজ তৈরি করার সময় অনেকেই আওয়াজ তুলেছিলেন, কিন্তু জাপানি নৌবাহিনী কথার মারপ্যাঁচে বেরিয়ে গিয়েছে আবারো

চুপি চুপি যা হয়েছে

সংবিধানের পরিবর্তন তো মাত্র হলো। এর আগের কিছু ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়। যে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের কথা দিয়ে আলোচনার শুরু, সেই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজেই ফেরত যাচ্ছি। এই ধরনের জাহাজ একটা 'এগ্রেসিভ প্ল্যাটফর্ম' হিসেবে পরিচিত। সাধারণত দূরদেশে যুদ্ধ করার দরকার হয় যাদের, তাদেরই এধরনের জাহাজের প্রয়োজন বেশি। তার মানে হলো, যাদের আন্তর্জাতিক নীতি যতটা এগ্রেসিভ, বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের প্রয়োজনীয়তাও তাদের কাছে বেশি। পাওয়ার প্রজেকশনের এটা মোক্ষম অস্ত্র। এক্ষেত্রে অর্থনীতি অবশ্য বড় একটা ভূমিকা রাখে, কারণ এই ধরনের জাহাজ যথেষ্ট দামী। আর এগুলিকে অপারেট করার বার্ষিক খরচও অনেক অর্থনীতির ধরাছোঁয়ার বাইরে। ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ এবং ইটালিয়ানরা ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনীর মালিক। পররাষ্ট্র নীতির কারণেই এই দেশগুলি আগের চাইতে বেশি ঝুঁকছে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের দিকে। এই ধরনের জাহাজের বেশ কাছাকাছি কিছু জাহাজ রয়েছে উভচর অভিযান চালাবার জন্যে, যেই জাহাজগুলি দেখতে অনেক ক্ষেত্রেই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো, যদিও বাস্তবে সেটা নয়। তবে যেটা বাস্তব তা হলো এই জাহাজগুলি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতোই এগ্রেসিভ প্ল্যাটফর্ম। এর আগে একটা পোস্টে এই জাহাজগুলি নিয়ে লিখেছিলাম, তাই এখানে সেগুলি নিয়ে লিখছি না। তবে জাপানের কথা হচ্ছে বিধায় কথা না বলেও পারছি না। সংবিধানকে পাশ কাটিয়েই জাপান ১৯৯৫ সাল থেকে নৌবাহিনীর জন্যে কিছু জাহাজ বানিয়েছে; যেমন - ১৪,০০০ টনের ‘ওসুমি-ক্লাস’-এর ‘ল্যান্ডিং ট্র্যান্সপোর্ট ডক'। এই ক্লাসের তিনটি জাহাজ বানাবার পরে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল,কারণ জাহাজগুলি দেখতে ছোটখাটো বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো। জাপান তখন বলেছিল যে এগুলি ‘ল্যান্ডিং শিপ ট্যাঙ্ক’;জাপান থেকে দূরে ব্যবহারের জন্য নয়। এরপরে ২০০৬ সালে বানানো শুরু করে ১৯,০০০টনের ‘হাইয়ূগা-ক্লাস’-এর দু’টি জাহাজ;যেগুলিও বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো। এরপরে ২০১২ সালে শুরু হয়েছে ২৭,০০০টনের ‘ইজুমো-ক্লাস’-এর দু’টি জাহাজের কাজ। আগে বানানো যেকোন জাহাজের চাইতে এগুলি অনেক অনেক বড়! এবারেও জাপানি নৌবাহিনীর ওই একই কথা - এগুলি আসলে 'হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার'। এরই মাঝে জাপানি নৌবহরে যুক্ত হয়েছে ১৫,০০০টনের ৩টি ও ২৫,০০০টনের দু’টি সরবরাহ বা সাপ্লাই জাহাজ। উপরে বর্ণিত এত্ত বড় বড় জাহাজের বিতর্কের গভীরে এই সাপ্লাই জাহজগুলি হারিয়েই গেছে। খুব কম লোকই প্রশ্ন করেছে যে এই জাহাজগুলি কি বানানো হয়েছে জাপানের উপকূল প্রহরায় সহায়তা দিতে,নাকি ভারত মহাসাগর পর্যন্ত পাহারা দিতে? এই সাপ্লাই জাহাজগুলি জাপানি নৌবাহিনীর পা অনেক লম্বা করে দিয়েছে। অনেকেই বলবে যে জাপানের সম্পূর্ণ বাণিজ্য সমুদ্র-নির্ভর; কাজেই নৌবাহিনীর দূর দেশে যেতে হতেই পারে - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপান ঠিক যে কথাগুলি ব্যবহার করেছিল নিজেদের নৌশক্তি বৃদ্ধির সময়। চীন যেমন তার তেলের জন্যে এবং অনেক বাণিজ্যের জন্যে মালাক্কা প্রণালী এবং ভারত মহাসাগরীয় সমুদ্রপথের উপরে নির্ভরশীল, ঠিক তেমনি জাপানিরাও একই সমুদ্রপথের উপরে নির্ভরশীল। আর দু'টি দেশের মাঝে সম্পর্ক আজকাল তেমন মধুর যাচ্ছে না। চীনা নৌবাহিনী আজকের আলোচনার অংশ নয়, তাই এখানে চীন নিয়ে বেশি কিছু লিখলাম না। তবে এটা বলতে বাধা নেই যে চীনারাও মালাক্কা প্রণালীর বদলি কোন সাপ্লাই রুট খুঁজতে খুঁজতে ভারত মহাসাগর তথা বঙ্গোপসাগরের দিকেই তাকাচ্ছে। কাজেই দু'টি দেশের জাতীয় নিরাপত্তাই তাদেরকে হাজির করছে ভারত মহাসাগরে। চীনের জন্যে এটা নতুন হলেও জাপানের জন্যে কিন্তু নতুন নয়।
০৯ এপ্রিল ১৯৪২ঃ জাপানি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের বিমান ব্রিটিশ বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস হার্মিস-এর উপরে বিমান হামলার পর ডুবে যাচ্ছে হার্মিস। এই জায়গাটা শ্রীলংকার কাছাকাছি।


অতীতেও যুদ্ধ দেখেছে ভারত মহাসাগর

১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে জাপানী নৌবহরের সবচাইতে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের বহর ভারত মহাসাগরে ব্রিটিশ নৌবহরের খোঁজে ঢুঁ মেরে যায়। মাত্র কয়েক দিনের এই ভিজিটে ছয়টি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের এই নৌবহর শ্রীলঙ্কার কলম্বো এবং ত্রিঙ্কোমালীসহ বঙ্গোপসাগরের আশেপাশে হামলা চালায়। ব্রিটিশদের একটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজসহ ৮টি যুদ্ধজাহাজ ও ২৩টি বাণিজ্য জাহাজ এই হামলায় ডুবে যায়; ধ্বংস হয় ৪০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান। এখানে বলা গুরুত্বপূর্ণ যে জাপানিদের এই নৌবহর এসেছিল সদ্য অধিকৃত ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) থেকে, সরাসরি জাপান থেকে নয়। মানে এখানে সাপ্লাই ঘাঁটি হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে জাপানিরা ব্যবহার করেছিল। যুদ্ধের বাকি সময়ে আর কোন শক্তিশালী জাপানি নৌবহর এই দিকে আসেনি ঠিকই কিন্তু জাপানি সাবমেরিনগুলি পুরো ভারত মহাসাগরেই বিচরণ করেছে এবং অনেক জাহাজ ডুবিয়েছে। এই ঘাঁটিগুলি না থাকলে ভারত মহাসাগরে অভিযান চালানো জাপানিদের জন্যে কঠিন হতো। এখানেই নৌবাহিনী 'পা লম্বা' করার কথাটা এসে যাচ্ছে, যেটা উপরে উল্লেখ করেছিলাম। সাপ্লাই জাহাজের সহায়তায় কোন ঘাঁটি ছাড়াই ভারত মহাসাগরে অনেকদূর পর্যন্ত টহল দেওয়া সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত মহাসাগরে জাপানি নৌবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট - ব্রিটিশ সমুদ্রপথের ক্ষতিসাধন করা, যেটা মূলত জাপানি সাবমেরিনগুলি করার চেষ্টা করেছে। জাপানের তেল, লোহা, এলুমিনিয়াম, রাবার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই যেত প্রধানত মালেশিয়া-ইন্দোনেশিয়া এলাকা থেকে। তাই ভারত মহাসাগর তাদের জন্যে ছিল অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজকের কথা চিন্তা করলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। জাপান এবং চীন উভয়েরই বেশিরভাগ তেল আসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। কাজেই বর্তমানে উভয়েই এই এলাকার উপরে ভীষণভাবে নির্ভরশীল। কাজেই এই দুই দেশের এই এলাকায় এসে প্রতিদ্বন্দিতামূলক অবস্থানে আসার চিন্তা করাটা অমূলক হবে না।

২৭,০০০টনের 'ইজুমো-ক্লাস'-এর দু'টি জাহাজ তৈরি হচ্ছে। অনেকেই অনেক কিছুর গন্ধ পাচ্ছেন। কিন্তু প্যাসিফিস্ট সংবিধান আর নেই। কাজেই এখন কোন কিছুরই ছুতো নেই আর।

সমুদ্রপথের ঝুঁকি ও নিরাপত্তা

উপরে জাপানি নৌবাহিনীর বর্তমান কয়েকটি জাহাজের কথা বলেছি যেগুলি অনেককে ভাবাচ্ছে। কিন্তু কেন ভাবাচ্ছে, সেটাও বোঝার ব্যাপার রয়েছে। এই জাহাজগুলি কিন্তু বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ নয়; এগুলির কোনটি থেকেই ফিক্সড উইং বিমান ওঠানামা করতে পারবে না; শুধু হেলিকপ্টার ওঠানামা করবে। তাহলে কেন চিন্তিত সবাই? কারণ এই জাহাজগুলি একে একে সবার ধৈর্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। ২৭,০০০টনের 'ইজুমো-ক্লাস' জাহাজগুলি তারা একবারে তৈরি করেনি; ধীরে ধীরে জাহাজের আকার বাড়িয়েছে। প্রতিবারেই কথা উঠেছে; আর প্রতিবারেই কথার মারপ্যাঁচে জাপানিরা বের হয়েছে সেখান থেকে। এভাবে গুটি গুটি পায়ে এগুনোর পুরোটাই হয়েছে জাপানের প্যাসিফিস্ট সংবিধান বহাল থাকা অবস্থায়। আর সাম্প্রতিক সময়ের সাংবিধানিক পরিবর্তন এ অবস্থায় কতটা প্রভাব ফেলে সেটাই দেখার বিষয়। জাপানি নৌবহর পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী নৌবহরের একটি। চারটা বিরাট 'হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার' ও তিনটা 'ডক ল্যান্ডিং শিপ' ছাড়াও তাদের ডেস্ট্রয়ার এবং ফ্রিগেট রয়েছে ৪৩টি। এই বহর কতটা বড়, সেটার ধারণা দিচ্ছি অন্য নৌবহরের আকৃতির ধারণা দিয়ে - ব্রিটিশ রয়েল নেভির ডেস্ট্রয়ার এবং ফ্রিগেট রয়েছে ১৯টি, ফ্রান্সের রয়েছে ২১টি, স্পেনের রয়েছে ১১টি, ইটালির রয়েছে ১৫টি। আর এই এলাকার কাছাকাছি চীনের রয়েছে কমপক্ষে ৬৫টি, কোরিয়ার ২২টি, আর ভারতের রয়েছে ২৪টি। ডেস্ট্রয়ার এবং ফ্রিগেট হচ্ছে এই যুগে সমুদ্রে কর্তৃত্ব করার প্রধান অস্ত্র। এগুলিকে সাহায্য করার জন্যে ছোট ফ্রিগেট বা কর্ভেটেরও গুরুত্ব থাকে। এগুলি সমুদ্রপথ পাহাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে এসকর্ট করা পর্যন্ত সকল কার্যক্রমে জড়িত থাকে; একেবারে ওয়ার্কহর্স যাকে বলে আরকি। যার সমুদ্রপথ যত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে, সে এই ধরনের জাহাজ তত বেশি রাখতে চাইবে - এটাই স্বাভাবিক। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে কে নিজের সমুদ্রপথকে ভবিষ্যতে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে, সেটাই দেখার ব্যাপার হচ্ছে।

২৫,০০০টনের 'মাশু-ক্লাস'-এর এই সাপ্লাই জাহাজগুলি জাপানি নৌবহরের পা অনেক লম্বা করবে।

এখানেই জ্ঞান-বুদ্ধি

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সে কথা দিয়েই শেষ করবো। জ্ঞান-বুদ্ধির ক্ষেত্রে একটা পর্যায়ে জাপান পৌঁছে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই। সেখান থেকে অনেক কিছুই শিক্ষা নিয়েছে তারা। আমরা এখনও প্যাসিফিস্ট জাপানের চেহারাটাই দেখতে বেশি ভালোবাসি। তাই বিশ্বযুদ্ধের শিক্ষা বলতে আমরা হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসস্তূপকেই মনে করি। স্ট্র্যাটেজিক শিক্ষা নিয়ে কোন চিন্তাই আমাদের মনে আসে না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এই যে আমাদেরকে কোন চিন্তা না দিয়েই জাপান পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী নৌবহরের একটি তৈরি করেছে। এই বহর তৈরি করতে অর্থনৈতিকভাবেও তাদেরকে তেমন বেগ পেতে হয়নি; সামরিক ক্ষেত্রে জিডিপি-এর মাত্র ১% খরচ করছে জাপান। ভারত করছে ২.৫%; কোরিয়া ২.৮%। জাপান আগামীকালই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে না পারলেও তারা চাইলে সেটা তুলনামূলকভাবে অল্প সময়েই অর্জন করতে পারবে। হাজার হোক, ৯২ বছর আগে যারা এই ধরনের জাহাজ তৈরি করেছে, তাদের জন্যে খুব বেশি কষ্ট হবার কথা নয়। এখানেই সেই জ্ঞান-বুদ্ধির কথা আসছে। নতুন করে খুব কম জিনিসই তাদের উদ্ভাবন করতে হবে। আর বিমানবাহী জাহাজের কাছাকাছি গোছের কিছু জাহাজ বানিয়ে ফেলে অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও তারা ঘাটতি কমিয়ে এনেছে। এখন শুধু গুরুত্ব বুঝে এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো।

তবে এগুলির মানে এই নয় যে আগামীকালই আমরা যুদ্ধ দেখতে শুরু করবো। বরং আরও একটা স্নায়ু যুদ্ধের আবির্ভাব হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যেখানে ফোকাল পয়েন্ট হবে ভারত মহাসাগর। চীনের সাথে সাথে 'রাইজিং সান'-কে ভারত মহাসাগরে আবির্ভূত হতে দেখলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। অর্থনৈতিকভাবে চীন এবং জাপান যেভাবে দক্ষিণ এশিয়াতে প্রতিযোগিতাতে লিপ্ত হয়েছে, তাতে স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে গরম এই এলাকার তাপমাত্রা আরও কয়েক ডিগ্রী বেড়ে গেছে। সকলেই অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেই ফুল স্টপ দিয়ে দিচ্ছেন। তাপমাত্রা বাড়লে সেখানে যে পেশী শক্তির আবির্ভাব শুরুর সম্ভাবনাও তৈরি হয়, সেটা অনেকেই মাথায় রাখেননি। হয়তো জাপানের বহু যুগের প্যাসিফিস্ট চিন্তাধারা তাদের চিন্তাকে মুহূর্তেই ঠান্ডা করে দিচ্ছে। তবে সেই ঠান্ডা চিন্তা থেকে বের হবার সময় এখনই।

রাইজিং সান ওভার দ্যা ইন্ডিয়ান ওশান; ফারেনহাইট রাইজিং!

Friday 12 December 2014

সুন্দরবনের তেলে সন্বিত ফিরবে আমাদের?

১২ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবনের জীববৈচিত্র হুমকির মুখে ফেলেও যদি আমাদের সন্বিত ফেরে আরকি




মাত্র কিছুদিন আগেই গত অগাস্টে মাওয়ার কাছে পিনাক-৬ লঞ্চডুবির সময় একটা ইমার্জেন্সিডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির কথা বলেছিলাম। এরপরে আবার অক্টোবর মাসে ঢাকা কারওয়ান বাজার বাণিজ্যিক এলাকার বিএসইসি ভবনে দ্বিতীয়বারের মতো আগুন লাগলো মনে করিয়ে দিল সেই একই কথা। কিন্তু এই একই কথা কতবার মনে করিয়ে যেতে হবে, সেটাই এখন প্রশ্ন। ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট যে একটা আলাদা কাজ, সেটাই এখনো আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। ঠিক এই কারণেই রিসোর্স জোগার করতে করতেই আমাদের মূল্যবান সময় অপচয় হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো এভাবে ঝরে যাচ্ছে নিষ্পাপ প্রাণ, কখনো বা ধংস হয়ে যাচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যতা। সুন্দরবনের তেলবাহী জাহাজের দুর্ঘটনা আমাদের বহুকাল চোখে ঠুলি পড়ে থাকার ফলাফল মাত্র।

গোপালগঞ্জের ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র, যার জন্যে ফার্নেস অয়েল নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সুন্দরবনের মাঝ দিয়ে। গ্যাসের অপ্রতুলতায় বিদ্যুত উতপাদনে ফার্নেস অয়েলের উপরে নির্ভরতা বাড়ছে। আর একই সাথে বাড়ছে নদীপথ এবং পরিবেশের উপরে হুমকি।


তেল কাহিনী

ফার্নেস অয়েল বা হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও) হলো অপরিশোধিত তেল শোধন করার পরে প্রাপ্ত অনেকগুলি তেলের মধ্যে একটি। রিফাইনারিতে অপরিশোধিত তেল প্রসেস করলে সবচেয়ে হাল্কা তেলগুলি প্রথমে একে একে আলাদা হয়ে যায় - যেমন কেরোসিন, পেট্রোল, ডিজেল। ঘনত্বের হিসাবে এগুলিকে ১ নম্বর থেকে ৬ নম্বর তেল পর্যন্ত ক্লাসিফাই করা হয়, যেখানে ১ নম্বর হলো সবচাইতে হাল্কা আর ৬ নম্বর হলো সবচাইতে ভারি। ফার্নেস অয়েল হচ্ছে ৬ নম্বর তেল, যেটা একেবারে গাদের মতো। এটার নিচে থাকে শুধু আলকাতরা। প্রথম দিকের তেলগুলি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দিলেও আস্তে আস্তে বাতাসে মিলিয়ে যায়। আর অন্যদিকে ৬ নম্বর তেল গরম না করলে পাইপের মধ্যে দিয়ে নেওয়াই যায় না। এসব কারণে উপরের দিকের তেলগুলি ছোট যানবাহনে ব্যবহার করা গেলেও নিচের দিকের তেলগুলি তাপ দেওয়া ছাড়া যেহেতু ব্যবহার করা যায় না, তাই সেগুলি শুধুমাত্র বড় ইঞ্জিনের জন্যে প্রযোজ্য - যেমন পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং বড় জাহাজ। এই তেলে অত্যন্ত ক্ষতিকর সালফারের পরিমাণ অনেক বেশি। সালফার বেশি থাকার কারণে একে হাই সালফার ফুয়েল অয়েলও (এইচএসএফও) বলে। আর ব্যবহারের ক্ষেত্র কম হওয়ার কারণে এই তেলের দামও কম। কিছুদিন আগেই বিপিসি ২০১৫ সালের জন্য বিদেশ থেকে ফার্নেস অয়েল আমদানির চুক্তি করেছে, যেখানে অপেক্ষাকৃত কম সালফারের লো সালফার ফুয়েল অয়েলের আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনে ডুবে যাওয়া জাহাজটিতে ছিল হাই সালফার ফুয়েল অয়েল, যা এটা নিয়ে যাচ্ছিল গোপালগঞ্জের পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্যে। মংলা বন্দরে যেসব সমুদ্রগামী জাহাজ ভিড়ছে, সেগুলিও কিন্তু এই ফার্নেস অয়েলেই চলে। জাহাজের ভিতরে একেবারে তলায় পড়ে থাকে বলে এই তেলকে বাংকার তেলও বলে। একেকটি জাহাজে শুধুমাত্র নিজের চলার জন্যেই এরকম প্রচুর পরিমাণ তেল থাকে। কাজেই এই ধরনের দুর্ঘটনা বারে বারে ঘটার সম্ভাবনা কেউই উড়িয়ে দিতে পারবে না। কিছুদিন আগেও আরও একটি জাহাজ দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল; কিন্তু সেটা সিমেন্ট ক্লিংকারবাহী হবার কারণে পরিবেশের উপরে সেটার প্রভাব কম। কিন্তু বিদ্যুত উতপাদনের গুরুত্ব বাড়ার সাথে সাথে জ্বালানি তেলের গুরুত্বও যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে তেলবাহী জাহাজের দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। গ্যাসের রিজার্ভ কমে যাবার কারণে তেল-পুড়ানো পাওয়ার প্ল্যান্টের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। গাদের মতো এই ফার্নেস অয়েল জাহাজ ছাড়া পরিবহণ খুবই দুরূহ। কাজেই অচিরেই জাহাজের সংখ্যা কমানোর কোন পদ্ধতি দেখি না। এটা মোটামুটি ঠিক যে আমরা আমাদের ভাগ্যের উপরেই চড়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমরা শুধু দোয়া করছিলাম যেন বড় কোন দুর্ঘটনা না হয়। কিন্তু এভাবে আমরা নিজেদের কদিন বাঁচাতে পারি, সেটার উত্তর আজ আমরা পেয়ে গেছি।

সুন্দরবনের মাঝ থেকে এই ২৩-তলা সমান উঁচু সাইলো বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। এই স্থাপনা এখানে জন্ম দেবে নতুন কর্মযজ্ঞের। এই স্থাপনা সুন্দরবনের কফিনে শেষ পেরেকগুলির মধ্যে একটি।


পসুর নদী - আর. আই. পি.

দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান শহর খুলনা এবং যশোর তৈরি হবার পিছনে সুন্দরবনের পসুর নদীর উপরে সমুদ্রবন্দরের গুরুত্বই সবচাইতে বেশি। সমুদ্রবন্দরের স্থান নাব্যতার কারণে বারে বারে পরিবর্তন হলেও সেটা পসুর নদীর উপরেই রয়েছে। এই নদীটা সুন্দরবনকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। প্রতিদিন এখানে জাহাজ আসছে মালামাল নিয়ে। এই বন্দরের উপরে নির্ভর করেই এখানে গড়ে উঠেছে কয়েকটি সিমেন্ট কারখানা। পসুর নদীতে যত জাহাজ চলে, তার সবচাইতে বেশি হলো ক্লিংকারবাহী জাহাজ। মংলার উত্তরে এই একই নদীর উপরে রামপালে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র এখানে কয়লাবাহী জাহাজের আনাগোনার সূচনা করবে। প্রতিদিন ১০,০০০ টন কয়লার যোগান দিতে কি-রকম সংখ্যক জাহাজের এই নদী ব্যবহার করতে হবে, তা সহজেই অনুমেয়। মংলা বন্দরের সাথেই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) তৈরি করছে ১ লক্ষ টন ক্ষমতার ফুয়েল ডিপো। খুলনায় তৈরি হচ্ছে নতুন তেলভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট। এগুলি তেলবাহী জাহাজের আসাযাওয়া আরও বাড়াবে। এখন পর্যন্ত মংলায় তৈরি হয়েছে তিনটি এলপিজি বটলিং প্ল্যান্ট; আরও তৈরি হতে যাচ্ছে। খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে রেলপথ, যা কর্মযজ্ঞ বাড়াবে বৈ কমাবে না। মংলা বন্দরের উপরে নির্ভরশীল তিনটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা বা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড) - সৈয়দপুর, ঈশ্বরদী এবং মংলা। এগুলির ব্যবসার পরিধি বাড়ছে; তাই বাড়ছে কনটেইনার জাহাজের সংখ্যা। বড় কনটেইনার জাহাজ বন্দরের জেটিতে আনার জন্যে করা হচ্ছে ড্রেজিং। সরকারের সিদ্ধান্তে মংলা বন্দর দিয়ে খাদ্য আমদানীর একটা বড় অংশ এখন আসছে। কাজেই বেড়েছে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজের সংখ্যা। মংলা বন্দরের ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণে জয়মনিরখোল এলাকা হলো অফিশিয়ালি সুন্দরবনের বাউন্ডারি। এখানেই শেলা নদী মুখ, যার দক্ষিণ পাড়ে গহীন বন আর উত্তর পাড়ে তৈরি হচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তরের ৫০,০০০ টন ধারণক্ষমতার বিশাল অত্যাধুনিক সাইলো (খাদ্য গুদাম)। মংলা থেকে জয়মনিরখোল পর্যন্ত কিছুই ছিল না; রাস্তার অবস্থা ছিল করুন; নদী-খালের উপরে ছিল না সেতু। এই সাইলো নির্মাণের কারণে এখানে বিদ্যুত লাইন বসানো ছাড়াও তৈরি হচ্ছে রাস্তা এবং সেতু। এই অবকাঠামো এখানে জন্ম দেবে নতুন কর্মযজ্ঞের। এখানকার প্রায় পুরো এলাকাতেই এখন সাইন বোর্ডের বন্যা। এখানে খুলনা শিপইয়ার্ড-এর দ্বিতীয় ইউনিটসহ একাধিক জাহাজ নির্মাণ শিল্প বসার কথা রয়েছে। মোটকথা, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে শুরু করে জয়মনিরখোল পর্যন্ত পুরো এলাকাটাই খুব দ্রুত শিল্পাঞ্চলে রূপ নিতে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা সুন্দরবন রক্ষায় পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে গেছি প্রায়। কাজেই সুন্দরবন রক্ষায় যা চোখের পানি ফেলার, তা এখনি ফেলে নেওয়া ভালো হবে। 

ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষত্র পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দরকে মংলার প্রতিদ্বন্দী হিসেবে তৈরি করে দিতে পারতো, এবং একই সাথে সুন্দরবনকে বাঁচার একটা সুযোগ করে দিতে পারতো, যদি আমাদের পলিসিমেকাররা বরিশাল-পটুয়াখালী এলাকাকে খুলনা-যশোরের সাথে ব্যালান্স করার কথা চিন্তা করতে পারতেন।


পায়রা বন্দর - সুন্দরবনের রক্ষাকর্তা হতে পারে কি?

চেষ্টা করলে হয়তো রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র, খাদ্য অধিদপ্তরের সাইলো আর বিপিসি-র ফুয়েল ডিপো পায়রা সমুদ্রবন্দরের পাশে করা যেতে পারতো। এই কয়েকটি স্থাপনা মংলা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্যকে পায়রায় স্থানান্তর করতো। সরকারী সিদ্ধান্ত খুব সহজেই জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে পসুর নদী থেকে সরিয়ে বরিশাল-পটুয়াখালী এলাকায় নিয়ে আসতে সক্ষম। এক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন সহ যেসব জটিলতা তৈরি হতো, তা হয়তো সদিচ্ছা থাকলে উতড়ানো সম্ভবও হতো। ভোলার শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্র এবং নির্মাণাধীন বিদ্যুত কেন্দ্র যথেষ্ট সাহায্য করতো এক্ষেত্রে। পটুয়াখালীতে চীনের সহায়তায় তৈরি হচ্ছে আরও একটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র। কয়েক বছরের মাঝে পদ্মা সেতু তৈরি হইয়ে গেলে সেটা পায়রার জন্যে তৈরি করতো আরও সুযোগের। এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি দাঁড়াতো - মংলা এবং পায়রা বন্দরের ব্যালান্স নিয়ে। একটির উত্থান অপরটির অবনতি ডেকে আনতো। বরিশাল-পটুয়াখালীকে প্রাধান্য দিতে হতো খুলনা-যশোরের উপর। সেই সিদ্ধান্তের জন্যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা কতটুকু প্রস্তুত ছিলেন, সেটা চিন্তা করার বিষয়। সুন্দরবনকে রক্ষা করাটা আমাদের পলিসিমেকারদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মাঝে পড়ে বলে মনে হয়নি কখনো। পায়রাকে নিয়ে এগুনো গেলে পসুরকে পুরোপুরি রক্ষা হয়তো করা যাবে না; তবে স্যালাইন দিয়ে কিছুদিন বেশি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলেও হতে পারে।

বিএসইসি ভবনে আবারো আগুন লাগে অক্টোবর ২০১৪। ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে আমাদের শিক্ষা পুরো হয়েছে কি?


দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বলতে কি শুধু বন্যা-জলোচ্ছ্বাস বোঝায়?

শুরুতেই বলছিলাম ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট-এর কথা। আমাদের দেশে দুর্যোগের সংজ্ঞা যে খুব ছোট, সেটা সুন্দরবনে জাহাজডুবির পরে সেখানে বিআইডব্লিউটিএ-এর কর্মকর্তাদের অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে দেখেই বোঝা গেছে। ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট বলতে এখনো বন্যা-ঝড়ের মাঝেই আমরা আটকে আছি। মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ যে একেবারে কম ভয়াবহ নয়, সেটা আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হবার কারণে আমরা সেইদিকেই চোখ রেখেছি সর্বদা। আর অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার কারণে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের সম্ভাবনাও অপেক্ষাকৃত কম ছিল। তবে গত দুই দশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে দ্রুত অগ্রগতির সাথে সাথে যেসব ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলির জন্যে আমরা নিজেদের তৈরি করতে পারিনি। নদীতে জাহাজের সংখ্যা আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গেছে, কিন্তু তার সাথে পাল্লা দিয়ে তৈরি হয়নি মনিটরিং এজেন্সিগুলি। জাহাজ তৈরি হচ্ছে যথেচ্ছভাবে, যাত্রী নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত, ফিটনেসবিহীন জাহাজ চলছে, নদীর পানি দূষণ করছে জাহাজের বর্জ্য, নদীর মাঝে পার্ক করে রাখা হচ্ছে জাহাজ, সঠিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই চলছে জাহাজ, চলাচলের সময় ঠিক করে দেয়ার পরেও কেউ মানছেনা কেউ দেখার নেই। কাজেই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। আর দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়লেও সেটার জন্যে প্রস্তুতি নেই আমাদের। এটা ঘটলে এদের দায়িত্ব; ওটা ঘটলে ওদের দায়িত্ব - এগুলি ছেড়ে দায়িত্ব একজনকেই দিতে হবে। তাকে দিতে হবে পলিসি এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাকআপ। দুর্যোগের সময় ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সিকে ক্ষমতা দিতে হবে অন্য যেকোন রিসোর্স ব্যবহার করতে পারার। বিদ্যুত উতপাদন ও সঞ্চালন, গ্যাস সঞ্চালন, পানি সরবরাহ, সড়ক, রেল এবং নদীপথের গুরুত্বপূর্ণ রুট, স্টেশন ও সেতু, বন্দর ব্যবস্থাপনা, টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ ও সাইবার সিকিউরিটি, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও স্ট্র্যাটেজিক স্থাপনা, পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান, প্রধান পর্যটন কেন্দ্র - এগুলি সবকিছুই ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই, আবার ডিসাসটার ম্যানেজমেন্টের চিন্তার ভেতরেও আনতে হবে। এর যেকোনটির ক্ষতিই দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। আর এই হুমকি যে কারুর কাছ থেকেই আসতে পারে- সেটা দেশের ভেতরেও হতে পারে, এমনকি বাইরেও হতে পারে। কাজেই এগুলিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। 

দেশের প্রতিটি স্থাপনা এখন টাকার অঙ্কে অনেক মূল্যবান। দেশের প্রতিটি মানুষের মূল্য অনেক বেশি; এখন আমরা আর ফকিরের দেশ নই - একেকটা মানুষ দেশের অর্থনীতিতে তাদের জীবদ্দশায় অনেক অবদান রাখে। একেকটি মানুষ একেকটি জীবন্ত কারখানা। এদের প্রত্যেকের অবদানের উপরেই দেশের অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত। কাজেই তাদের জীবনের মূল্য যেমন দিতে হবে, তেমনি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনারই নিরাপত্তা দিতে হবে। তৈরি রাখতে হবে ডিসাসটার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সিকে, যাতে যেকোন দুর্যোগ সবচাইতে দ্রুততার সাথে মোকাবিলা করা যায়; মানুষের জানমালের সর্বনিম্ন ক্ষতির মাঝেই যেন দুর্যোগ ম্যানেজ করা যায়। আর বেঁচে থাকার পরিবেশ না থাকলে বেঁচে থাকারি বা মানে কি? আস্তাকুঁড়ে বসবাসের কোন মানে হয় না। অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে আমরা পরিবেশের দিকে না তাকালে অচিরেই এদেশ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অব্যবহার্য হয়ে পড়বে। আর সেটার জন্যে দায়ী থাকবো আমরাই। নিজেদের সন্তানদের বিদেশ পাঠিয়ে দায়মুক্তির চাইতে বরং আমাদের ভাবা উচিত সন্তানদের এই দেশে বসবাসের জন্যে নিজেদের দায়িত্বটুকু কিভাবে আমরা পালন করতে পারি।