Thursday 22 September 2022

ন্যান্সি পেলোসির আর্মেনিয়া সফরের গুরুত্ব কতটুকু?

২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
বর্তমান অস্ত্রবিরতির উপরে কেউই আস্থা রাখতে পারছে না। আজেরবাইজান যখন রুশদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করছে এবং তুরস্কের সহায়তায় ইইউতে গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে ভূরাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চাইছে, তখন আর্মেনিয়রাও অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝোঁকার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্মেনিয়ার সাথে আজেরবাইজানের দুই দিনের যুদ্ধ এবং পেলোসির আর্মেনিয়া সফর ককেশাসে আরেক দফা উত্তেজনার দ্বার উন্মুক্ত করলো।



মার্কিন কংগ্রেসের স্পীকার ন্যান্সি পেলোসি গত ১৮ই সেপ্টেম্বর আজেরবাইজান ঘুরে এসেছেন। তার এই সফরের সময়টা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; কারণ মাত্র কিছুদিন আগে ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর আজেরবাইজান তার প্রতিবেশী দেশ আর্মেনিয়ার সাথে দুই দিনের একটা সীমান্ত যুদ্ধ শেষ করেছে। সফরকালে তিনি সাম্প্রতিক যুদ্ধকে আর্মেনিয়ার উপর আজেরবাইজানের ‘বেআইনী এবং মারাত্মক হামলা’ বলে উল্লেখ করেন; যদিও উভয় পক্ষই এই যুদ্ধ শুরুর জন্যে অপরপক্ষকে দায়ী করেছে। পেলোসি বলেন যে, আজেরবাইজানের যে ‘হামলা’য় প্রায় ২’শত মানুষের প্রাণ গেছে, তার ব্যাপারে তিনি বলিষ্ঠভাবে নিন্দা জানাচ্ছেন। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, পেলোসি যখন এই কথাগুলি বলছিলেন, তখন তার পাশে ছিলেন আর্মেনিয়ার পার্লামেন্টের স্পীকার আলেন সিমোনিয়ান; যিনি আজেরবাইজানের সাথে সামরিক দ্বন্দ্বে রাশিয়ার সহয়তা না পাওয়ায় নাখোশ হয়েছেন। রুশ বার্তা সংস্থা ‘ইন্টারফ্যাক্স’ বলছে যে, তিনি এর আগের সপ্তাহে রুশদের সাথে সামরিক চুক্তিকে গুলি করতে না পারা পিস্তলের সাথে তুলনা করেছেন; যা কিনা দরকারের সময়ে কাজে লাগে না। উল্লেখ্য যে, অর্থোডক্স খ্রিস্টান আর্মেনিয়া রাশিয়ার অনেক পুরোনো বন্ধু এবং রাশিয়ার সাথে আর্মেনিয়ার সামরিক চুক্তি রয়েছে, যা মোতাবেক আর্মেনিয়ার উপর সামরিক হামলা হলে রাশিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কথা। এর আগে গত অগাস্টেই ৮২ বছর বয়সী প্রবীন রাজনীতিবিদ পেলোসি তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাইওয়ান সফর করে চীনাদেরকে ক্ষেপিয়েছেন। এখন তার আর্মেনিয়া সফরকে অনেকেই দেখছেন রাশিয়ার একটা পুরোনো বন্ধুকে ওয়াশিংটনের দিকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা হিসেবে; বিশেষ করে মস্কো যখন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভীষণভাবে ব্যস্ত।

ন্যান্সি পেলোসি বলেন যে, আজেরবাইজান যে এই যুদ্ধ শুরু করেছিল, সেব্যাপারে কথা বলাটা প্রয়োজন। তার এই কথায় আজেরবাইনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, আজেরবাইজানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন এবং অন্যায্য যে অভিযোগ তিনি করেছেন, তা মেনে নেয়া যায় না। এই ঘটনা আর্মেনিয়ার সাথে আজেরবাইজানের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। বক্তব্যে আরও বলা হয় যে, পেলোসি সর্বদাই আর্মেনিয়া-ঘেঁষা একজন রাজনীতিবিদ বলে পরিচিত। আর তিনি তার সফরসঙ্গী হিসেবে তেমনই কংগ্রেস সফস্যদেরকে নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, বক্তব্যে আরও বলা হয় যে, পেলোসি ন্যায়ের কথা বললেও আজেরি এলাকা আর্মেনিয়রা যে প্রায় ৩০ বছর ধরে দখলে রেখেছিল এবং আজেরিদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালানো ছাড়াও তাদেরকে জোরপূর্বক বাড়িঘরছাড়া করেছিল, সেব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি। পেলোসির বক্তব্যে অত্র এলাকায় শান্তির পরিবর্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে। ‘রয়টার্স’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, পেলোসি যেভাবে আজেরবাইজানকে যুদ্ধের জন্যে দায়ী করেছেন, তা ওয়াশিংটনের অফিশিয়াল বক্তব্যের বিপরীতে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন এক বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেন এবং পরবর্তীতে ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভকে ফোন করে অস্ত্রবিরতি বাস্তবায়ন করার অনুরোধ করেন এবং আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়ার সাথে সমস্যার সমাধান করার কথা বলেন।

বাকুর থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার অব এনালিসিস অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স’এর ফরিদ শাফিইয়েভ ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, পেলোসি আর্মেনিয়ায় এসেছেন মূলতঃ আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনে আর্মেনিয়দের সমর্থন পেতে। ক্যালিফোর্নিয়াতে তার নির্বাচনী এলাকায় আর্মেনিয়দের প্রভাব যথেষ্টই বেশি। অপরদিকে ইয়েরেভানের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘রিজিওনাল স্টাডিজ সেন্টার’এর ডিরেক্টর রিচার্ড জিরোগোসিয়ান ‘পলিটিকো’কে বলছেন যে, ককেশাসে মার্কিনীরদের ফোকাস বৃদ্ধি শুধু ভূরাজনৈতিক কারণে নয়, আদর্শিক কারণেও। এটা শুধু রাশিয়ার কারণে নয়, আর্মেনিয়ার কারণেও। পেলোসির সফর হয়তো মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের একটা শুরু। 

প্রায় তিন দশক আর্মেনিয়ার সাথে সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও ২০২০ সালের যুদ্ধের পর থেকে আজেরবাইজান তার নিজস্ব সামরিক সক্ষমতার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। সেপ্টেম্বরের দুই দিনের যুদ্ধ আজেরবাইজানকে একটা ধারণা দিয়েছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে রুশরা আর্মেনিয়াকে রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা নিতে পারে।

আফগানিস্তানে মার্কিনীদের অবস্থানের সময় আজেরবাইজান যুক্তরাষ্ট্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসেবে কাজ করেছে। আজেরবাইজানের আকাশসীমা ব্যবহার করে মার্কিনীর আফগানিস্তানে সেনা আনানেয়া করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আজেরবাইজানের সবচাইতে কাছের বন্ধু হলো তুরস্ক। ২০২০ সালে আর্মেনিয়ার সাথে ৪৪ দিনের যুদ্ধে জয়ের পিছনে আজেরবাইজানকে সবচাইতে বেশি সহায়তা দিয়েছিল তুরস্ক। অপরদিকে রাশিয়া ককেশাস এলাকাকে তার নিজের উঠান মনে করে থাকে। আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানের সীমানায় যুদ্ধবিরতি পাহাড়া দেয়ার দায়িত্ব হলো রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর। তবে ২০১৮ সালে ‘ভেলভেট রেভোলিউশন’এর মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী নিকল পাশিনিয়ানের সরকারকে পশ্চিমারা গণতান্ত্রিক উত্থানের ফলাফল হিসেবেই দেখেছে। পেলোসি তার সফরের সময় আর্মেনিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে মার্কিন সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেন।

পেলোসির সফরের ব্যাপারে আজেরবাইজের বন্ধু তুরস্ক কঠোর বার্তা দিয়েছে। ১৯শে সেপ্টেম্বর তুর্কি ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতে এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, পেলোসির একপেশে বক্তব্যগুলি আর্মেনিয়ার সাথে আজেরবাইজানের কূটনীতিকে ‘স্যাবোটাজ’ করেছে; যেকারণে এই বক্তব্যগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। একইসাথে তিনি ওয়াশিংটনকে আহ্বান জানান তারা যেন পরিষ্কার করে যে, পেলোসির কথাগুলি মার্কিন সরকারের বক্তব্য কিনা। অপরদিকে মস্কোতে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন যে, পেলোসি ঢোল পিটিয়ে তার আগমণ জানান দিয়েছেন। এমনটা না করে বরং চুপচাপ কার্যকর পদক্ষেপ নিলে আর্মেনিয়া এবং আজেরবাইজানের সংকটের সমাধান মিলতে পারে।

‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে পেলোসির সফরের সময়ে অনেকেই প্রকাশ্যে রাশিয়া বিরোধী বার্তা দেয়। কেউ কেউ পুতিনের ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড নামিয়ে ফেলে। রুশ সাংবাদিকদেরকেও হেনস্তা হতে হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে। আর্মেনিয়দের মাঝে অনেকেই মনে করা শুরু করেছে যে, রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব আর্মেনিয়াকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে আজেরবাইজান তুরস্কের সহায়তায় দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে। এমতাবস্থায় অনেকেই ওয়াশিংটনের দিকে ঝুঁকতে চাইছে।

প্রায় তিন দশক আর্মেনিয়ার সাথে সামরিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও ২০২০ সালের যুদ্ধের পর থেকে আজেরবাইজান তার নিজস্ব সামরিক সক্ষমতার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। সেপ্টেম্বরের দুই দিনের যুদ্ধ আজেরবাইজানকে একটা ধারণা দিয়েছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে রুশরা আর্মেনিয়াকে রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা নিতে পারে। বর্তমান অস্ত্রবিরতির উপরে কেউই আস্থা রাখতে পারছে না। আজেরবাইজান যখন রুশদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করছে এবং তুরস্কের সহায়তায় ইইউতে গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে ভূরাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চাইছে, তখন আর্মেনিয়রাও অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝোঁকার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্মেনিয়ার সাথে আজেরবাইজানের দুই দিনের যুদ্ধ এবং পেলোসির আর্মেনিয়া সফর ককেশাসে আরেক দফা উত্তেজনার দ্বার উন্মুক্ত করলো।

2 comments:

  1. বাংলাদেশী লেখকরা মনে করেন যে দুনিয়ার সব ইস্যু গুরুত্বপূর্ন শুধু বাংলাদেশ ইস্যু ছাড়া। মায়ানমার নিয়ে চীন-ভারত-রাশিয়া-আমেরিকা-জাপানের চিন্তা, মায়ানমারের সাথে থাইল্যান্ড এর সম্পর্ক, বাংলাদেশ এর হাতে সামরিক-বেসামরিক অপশন কি কি থাকতে পারে এসব নিয়ে আপনাদের লেখার কোন সময় নেই কারন আপনাদের দৃষ্টিতে ইহা গুরুত্বপুর্ন না। অথচ বাংলাদেশ সমস্যায় পড়লে যে আপনারাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা হিসাবের বাইরে।

    আমি এটাও জানি এই মন্তব্যের পরে আপনি বেশ কিছু পুরানা article এর লিঙ্ক দিয়ে দেবেন। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখুন, আপনি নিজেই বললেন যে, বাংলাদেশ আমার কাছে কোন ইস্যু নয়; আবার বললেন যে, আমি পুরোনো লিংক দেবো আপনাকে। যদি বাংলাদেশ নিয়ে লেখা না-ই হয়, তাহলে তো লিঙ্ক দেয়ারই প্রশ্ন ছিল না।

      যাই হোক, আপনি এই ব্লগে নতুন বলে হয়তো আপনার এমনটা মনে হচ্ছে। এই ব্লগের প্রথম দিকের প্রায় সব লেখাই ছিল বাংলাদেশ নিয়ে। আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলি নিয়ে লেখাগুলি একসময় এখানে পোস্ট করা হতো না। এটা শুরু করা হয় ২০২০ সাল থেকে।

      যাই হোক, আপনাকে "বঙ্গোপসাগর আসলে কার?" বইটা পড়ার অনুরোধ করবো। এটা পুরোটাই বাংলাদেশ নিয়ে।
      https://koushol.blogspot.com/2019/12/bongoposagor-asole-kaar.html

      Delete