Thursday 28 April 2022

যুক্তরাষ্ট্র কি ইউক্রেন যুদ্ধকে চালিয়ে নিতে পারবে?

২৯শে এপ্রিল ২০২২

২৫শে এপ্রিল ২০২২। রাশিয়ার ব্রিয়ান্সক শহরের দু'টা জ্বালানি তেলের ডিপোতে প্রায় একই সময়ে বিস্ফোরণ ঘটে। ডনবাসের যুদ্ধের ধরণের কারণেই উভয় পক্ষ একে অপরের লজিস্টিকসের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলির উপর হামলা করতে থাকবে। উভয় পক্ষই অপরের ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি করতে চাইছে। এর অর্থ হলো, উভয় পক্ষের জন্যেই যুদ্ধের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন।


২৫শে এপ্রিল ইউক্রেন রেলওয়েজের প্রধান ওলেক্সান্দর কামিশিন এক ‘টেলিগ্রাম’ বার্তায় বলেন যে, রুশরা এক ঘন্টার ব্যবধানে ইউক্রেনের পাঁচটা রেলস্টেশনে হামলা করেছে। এই হামলার মাধ্যমে এটা পরিষ্কার যে, রুশরা ইউক্রেনের রেল নেটওয়ার্ককে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করছে। ‘পলিটিকো’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই আক্রমণের মাত্র দু’দিন আগেই ইউক্রেন পোল্যান্ডের সাথে সীমান্ত রেলওয়ে ব্যবহার সহজীকরণের ব্যাপারে একটা সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। ইউক্রেনের সমুদ্রবন্দরগুলি যখন রুশ অবরোধের মাঝে রয়েছে, তখন এই চুক্তি ইউক্রেনে মালামাল আনানেয়ার পিছনে অনেক বড় সহায়তা দেবে। ইউক্রেন তার পুরো পরিবহণ ব্যবস্থাকে সমুদ্রবন্দর থেকে সরিয়ে রাস্তা, রেলওয়ে এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথের দিকে নিয়ে আসতে হিমসিম খাচ্ছে। ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শামিহাল বলছেন যে, পোল্যান্ডের সাথে সমঝোতা রেলের মাধ্যমে ইউক্রেনের বহির্বাণিজ্যকে বহুগুণে বাড়াতে সহায়তা দেবে। তবে পোল্যান্ডের সীমানা দিয়ে রেলযোগাযোগ যে ইউক্রেনের পূর্বে ডনবাসে যুদ্ধের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা ইউক্রেনের রেল ব্যবস্থার উপর রুশ হামলাই বলে দিচ্ছে।

লজিস্টিকসের উপর পাল্টাপাল্টি হামলা

তবে উভয় পক্ষই ডনবাসের যুদ্ধে লজিস্টিকসের গুরুত্ব বুঝতে পেরে একে অপরের গুরুত্বপুর্ণ সাপ্লাই ব্যবস্থার উপর হামলা করছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ২৭শে এপ্রিল ইউক্রেনের সীমানায় অবস্থিত তিনটা রুশ অঞ্চলে ভোর বেলায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইউক্রেনের সীমানা থেকে ৪০ কিঃমিঃএর কম দূরত্বে থাকা বেলগোরদ শহরের একটা গোলাবারুদের স্টোরে আগুন লেগেছে বলে বলেন বেলগোরদের গভর্নর ভিয়াচিস্লাভ গ্লাদকভ। এই একই শহরে কিছুদিন আগেই দু’টা হেলিকপ্টার একটা জ্বালানি তেলের ডিপোতে হামলা করে বলে সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশ করা ভিডিওতে দেখা যায়। রুশরা ইউক্রেনকে সেই হামলার জন্যে দায়ী করলেও ইউক্রেন তা স্বীকার করেনি। বেলগোরদ ছাড়াও ইউক্রেন সীমানা থেকে প্রায় ১’শ ৬০ কিঃমিঃ দূরে কুর্স্ক অঞ্চলের গভর্নর রোমান স্টারোভোইত বলছেন যে, সেখানেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছে। তিনি বলেন যে, খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনের ড্রোন হামলা ঠেকাতে রুশ বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রের গোলাবর্ষণের শব্দ ছিলো সেগুলি। কোন ক্ষয়ক্ষতি সেখানে হয়নি। তবে পার্শ্ববর্তী ভরোনেজ অঞ্চলের দুই জায়গায় বিস্ফোরণ হয়েছে বলে বলেছে রুশ বার্তা সংস্থা ‘তাস’। এর আগে ইউক্রেনের রেলওয়ের উপর রুশ হামলার দিন, অর্থাৎ ২৫শে এপ্রিল ইউক্রেনের সীমানা থেকে ১’শ ৫০ কিঃমিঃ দূরে রুশ শহর ব্রিয়ান্সক হামলার শিকার হয়। শহরের দু’টা বেসামরিক ও সামরিক জ্বালানি তেলের ডিপোতে প্রায় একইসাথে বিশাল বিস্ফোরণ হয়। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে সাবেক মার্কিন ম্যারিন কোর সদস্য এবং থিংকট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর ফেলো রব লী বলেন যে, ভিডিও ফুটেজগুলি দেখে মনে হচ্ছে যে, এই বিস্ফোরণগুলি খুব সম্ভবতঃ ইউক্রেনের হামলা। ইউক্রেনের সীমানা থেকে দূরত্ব দেখে বলা যায় যে, এই হামলায় ইউক্রেনিয়ানরা হয় ‘টচকা-ইউ’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অথবা তুর্কি নির্মিত ‘বায়রাকতার টিবি-২’ ড্রোন ব্যবহার করে করেছে। ইউক্রেনিয়ানরা যদি এটা করে থাকে, তাহলে তারা রুশ সাপ্লাই লাইনকে সমস্যায় ফেলার জন্যেই এটা করেছে। এর আগে ১২ই এপ্রিল ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বেলগোরদের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা রেলসেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছবি দেখে অনেকেই ধারণা করছেন যে, সেটা কোন বিস্ফোরণের কারণে হতে পারে; যার পিছনে কোন স্যাবোটাজ জাতীয় কর্মকান্ড থাকতে পারে। রুশরা ডনবাসে তাদের সামরিক কর্মকান্ড চালিয়ে নিতে রেলওয়ের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। রাশিয়ার ভেতরে পূর্ববর্তী কোন হামলার দায় ইউক্রেনিয়ানরা স্বীকার না করলেও ২৭শে এপ্রিল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পদোলিয়াক এক বার্তায় বলেন যে, যদি রুশরা ইউক্রেনের মানুষ হত্যা করে যেতে থাকে, তাহলে রুশ কর্মকান্ডে সহায়তাকারী ডিপোগুলি যেসব অঞ্চলে রয়েছে, সেই অঞ্চলগুলিকেও হিসেব দিতে হবে। তিনি সরাসরিই বলেন যে, বেলগোরদ এবং ভরোনেজ অঞ্চলের ডিপোগুলিকে ধ্বংস করাটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তারা তাদের কর্মফল ভোগ করছে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, এই ঘটনাগুলি রুশ সামরিক লজিস্টিকসের দুর্বলতাগুলিকে তুলে ধরেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষের টার্গেট করা লজিস্টিকস নেটওয়ার্ক। উভয় পক্ষই ডনবাসের যুদ্ধের গুরুত্ব বুঝতে পারছে। যুদ্ধ দীর্ঘ হতে থাকলে লজিস্টিকসের উপর হামলার ক্ষেত্রে রুশরা অবশ্যই এগিয়ে থাকবে, যদি ইউক্রেন তাদের সাপ্লাই লাইনগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে না পারে এবং আরও উন্নয়ন করতে সক্ষম না হয়। ডনবাসে যেপক্ষ ভালোভাবে সাপ্লাই পাবে, তাদেরই জয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকবে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দি আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ডনবাসের যুদ্ধের ধরণের কারণেই উভয় পক্ষ একে অপরের লজিস্টিকসের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলির উপর হামলা করতে থাকবে। ইউক্রেনের রেলস্টেশনগুলির উপর হামলায় রুশরা নিখুঁত নিশানায় হামলা করেছে, যেখানে হয়তো আকাশ থেকে ছোঁড়া অস্ত্র অথবা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘ হতে থাকলে লজিস্টিকসের উপর হামলার ক্ষেত্রে রুশরা অবশ্যই এগিয়ে থাকবে, যদি ইউক্রেন তাদের সাপ্লাই লাইনগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে না পারে এবং আরও উন্নয়ন করতে সক্ষম না হয়। ডনবাসে যেপক্ষ ভালোভাবে সাপ্লাই পাবে, তাদেরই জয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, অবশেষে মার্কিন সরকার তাদের নীতিতে পরিবর্তন এনে ইউক্রেনকে আক্রমণে যাবার মতো অস্ত্র দিতে শুরু করেছে। এর আগে ট্রেনিং দেয়ার সমস্যার কথা বলে জো বাইডেনের প্রশাসন ইউক্রেনকে অনেক অস্ত্রই দিতে চায়নি। এখন তারা সেটাই করছে। প্রতিবেদনে ইউক্রেনের জন্যে শুধুমাত্র সোভিয়েত আমলের অস্ত্র যোগাড় করতে নিষেধ করা হয়; কারণ সেই অস্ত্রগুলি একসময় গোলাবারুদের অভাবের মাঝে পড়ে যাবে। কাজেই ইউক্রেনকে পশ্চিমা নির্মিত অস্ত্র, বিশেষ করে ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমান, ইস্রাইলের ‘আয়রন ডোম’এর মতো বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নিখুঁতভাবে টার্গেট করতে পারা ‘হিমার্স’ রকেট সিস্টেম, এবং ‘এনএসএম’ ও ‘হারপুন’এর মতো জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা উচিৎ।

 
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের যুদ্ধে সরাসরি না জড়িয়েও এর ফলাফলের অনেকটাই ভোগ করছে। করোনা মহামারির পর ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মাঝে যখন মার্কিন জনগণই তাদের সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে, তখন ইউক্রেনের জন্যে কত বিলিয়ন ডলারের সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র বরাদ্দ দিতে সক্ষম হবে, তা প্রশ্নাতীত নয়। এই ব্যাপারগুলি পৃথিবীর অন্য আরেক প্রান্তে আরেকটা যুদ্ধে জড়াবার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতাকে যথেষ্টই খর্ব করেছে।

যুদ্ধের অর্থায়ন আসবে কোত্থেকে?

কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে এই যুদ্ধের অর্থায়নের ক্ষেত্রে। ২১শে এপ্রিল এবং ২৫শে এপ্রিলের নিরাপত্তা সহায়তা যোগ করার পর ইউক্রেনের জন্যে মার্কিন সহায়তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। অথচ যুদ্ধ এখন পর্যন্ত মাত্র দু’মাস চলেছে। অনেকেই মনে করছেন যে, এই যুদ্ধ কয়েক বছর স্থায়ী হতে পারে; কারণ কোন পক্ষই হারতে চাইছে না। ২৮শে এপ্রিল ওয়াশিংটনে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বলেন যে, ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্যে এর আগে কংগ্রেসের কাছ থেকে চাওয়া ১৪ বিলিয়ন ডলারের প্যাকেজকে বৃদ্ধি করে ৩৩ বিলিয়ন ডলার করার চেষ্টা চলছে; যার মাঝে ২০ বিলিয়ন ডলারই থাকবে সামরিক সহায়তা; আর বাকিটা অর্থনৈতিক এবং মানবিক সহায়তা। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, তারা তাদের ‘জি-৭’ সহযোগী দেশগুলির কাছ থেকে একই রকমের সহায়তা আশা করছেন। এই সহায়তা দেয়ার জন্যে মার্কিনীরাই আসলে কতটা প্রস্তুত, তা নিয়েই প্রশ্ন থাকছে।

২৭শে এপ্রিল ‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্যাপক মূল্যস্ফীতির ফলাফলস্বরূপ ২০২২ সালে জ্বালানি তেলের জন্যে মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্যে বরাদ্দকৃত বাজেটের চাইতে ৩ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ হতে চলেছে; যার জন্যে কংগ্রেসের কাছে অর্থ চাওয়া হয়েছে। মার্কিন সরকার পেন্টাগনের ২০২৩ সালের বাজেট ৪ শতাংশ বা ৩০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি করে ৮’শ ১৩ বিলিয়ন ডলার করতে চাইছে। তবে অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, বাজেটে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটা ঠিকমতো সমন্বয় করা হয়নি। অপরদিকে ‘সিএনবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ১ লক্ষ ডলার আয় করা ব্যক্তিরাও মূল্যস্ফীতির কারণে দৈনন্দিন খরচ, বিশেষ করে মুদিপণ্য এবং জ্বালানি তেলের খরচ বহণে হিমসিম খাচ্ছে। তাদের আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ চলে যায় বাড়িভাড়া দিতে; এরপর রয়েছে গাড়ির দেনা শোধ; জ্বালানি তেল; ক্রেডিট কার্ডের বিল। সকল কিছুরই মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বলছেন অনেকে। ‘এক্সপেরিয়ান’এর এক জরিপের উল্লেখ করে বলা হচ্ছে যে, ৭১ শতাংশ মার্কিন জনগণ মনে করছে না যে, তাদের ‘পে-চেক’ মূল্যস্ফীতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে। অপরদিকে ২৯ শতাংশ বলছে যে, তারা বর্তমান মাসে কোনমতে তাদের খরচ মেটাতে পারবে; আর আরও প্রায় একই সংখ্যক মানুষ বলছে যে, পরের মাসে তাদের বাজেটের চাইতে খরচ বেশি হবে। ‘লেনডিং ক্লাব’এর আরেক জরিপ বলছে যে, প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ ‘পে-চেক’এর উপর ভর করে চলছে।

ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষের লজিস্টিকস নেটওয়ার্ক টার্গেটের অর্থ হচ্ছে উভয় পক্ষই অপরের ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি করতে চাইছে। এর অর্থ হলো, উভয় পক্ষের জন্যেই যুদ্ধের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন। ‘দি আটলান্টিক কাউন্সিল’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনকে শুধুমাত্র কোনমতে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে বাইডেন প্রশাসন এতদিন যেসব অস্ত্র দিয়েছে, সেগুলি দীর্ঘ যুদ্ধের জন্যে মোটেই যথেষ্ট নয়; বিশেষ করে ডনবাসের সমতলভূমিতে যুদ্ধ করতে গেলে যার কাছে গোলাবর্ষণের সক্ষমতা বেশি থাকবে, জেতার সম্ভাবনা তারই বেশি থাকবে। ওয়াশিংটন শেষ পর্যন্ত ১৫৫ মিঃমিঃ আর্টিলারি, ওয়েপন লোকেটিং রাডার, ‘সুইচব্লেইড’ এবং ‘ফিনিক্স ঘোস্ট’ সুইসাইড ড্রোন ইত্যাদি অস্ত্র ইউক্রেনকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও মার্কিন অর্থনীতির উপর চাপ সামলে নিয়ে ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু সহায়তা দিতে সক্ষম? ইউক্রেনের প্রতিদ্বন্দ্বী তালিবানের মতো কোন সংগঠন নয়, বরং রাশিয়ার মতো পারমাণবিক শক্তিধর একটা ‘গ্রেট পাওয়ার’। রাশিয়াকে ইউক্রেনে হারাতে যে অর্থায়নের প্রয়োজন, তা মাত্র দুই মাসেই পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডনবাসের যুদ্ধে যেসব অস্ত্রের দরকার পড়ছে, সেগুলি হবে আরও বেশি দামী। এছাড়াও রয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনীর অস্ত্রের স্টকের প্রশ্ন। মার্কিনীরা ডনবাসের যুদ্ধ শুরুর আগেই তাদের নিজেদের সামরিক বাহিনীর এক তৃতীয়াংশ ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং এক চতুর্থাংশ ‘স্টিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করেছে; যেগুলির স্টক তৈরি করতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বছর লেগেছিল। মোটকথা, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের যুদ্ধে সরাসরি না জড়িয়েও এর ফলাফলের অনেকটাই ভোগ করছে। করোনা মহামারির পর ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মাঝে যখন মার্কিন জনগণই তাদের সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে, তখন ইউক্রেনের জন্যে কত বিলিয়ন ডলারের সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র বরাদ্দ দিতে সক্ষম হবে, তা প্রশ্নাতীত নয়। এই ব্যাপারগুলি পৃথিবীর অন্য আরেক প্রান্তে আরেকটা যুদ্ধে জড়াবার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতাকে যথেষ্টই খর্ব করেছে।

Monday 25 April 2022

ইউক্রেন যুদ্ধের দায় আসলে কার?

২৫শে এপ্রিল ২০২২
 

ইয়ান ব্রেমার সমালোচনা করেছেন জন মিয়ার্সহাইমারের। কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে তারা একমত। মিয়ার্সহাইমার যুদ্ধের দায় পশ্চিমাদের উপর দিচ্ছেন; আর ব্রেমার এই পরিস্থিতিতে আসার জন্যে পশ্চিমাদের দায়বদ্ধতাকে তুলে ধরেছেন। পশ্চিমা দায়বদ্ধতার মূল ব্যাপারটাতে উভয়েই একমত হলেও তারা কেউই পশ্চিমা লিবারাল মিডিয়াতে ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্যে সরাসরি পশ্চিমাদেরকে দায়ী করতে পারছেন না।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ১১ দিন আগে ১৩ই ফেব্রুয়ারি মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল ‘এনবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত প্রভাবের অধীনে থাকা দেশগুলির বেশিরভাগই ন্যাটোর অধীনে চলে আসে। এর ফলে রাশিয়া তার প্রভাব এবং ভৌগোলিক বাফারের বেশিরভাগটাই হারিয়ে ফেলে। ৫টা ন্যাটো সদস্য দেশের আবার রাশিয়ার সাথে সীমানা রয়েছে; আর অনেক দেশেই এখন মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে। রাশিয়াতে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফাউল ‘এনবিসি’কে বলেন যে, যদি রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক হামলা করে, তাহলে সেটা ন্যাটোর পূর্ব দিকে সম্প্রসারণের কারণে নয়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মনে করেন যে, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার আশেপাশের স্লাভিক অঞ্চলগুলিকে অযাচিতভাবে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। ম্যাকফাউল মনে করছেন যে, পুতিন হিসেব করে চলার মতো ব্যক্তি নন; তিনি বরং ইতিহাস বইতে তার নাম লেখাতে চাইছেন। ম্যাকফাউলের কথাগুলি অনেককিছুই এড়িয়ে যায়; যা ইউক্রেন যুদ্ধের দায়বদ্ধতা খুঁজে বের করার জন্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার পরদিন ২৫শে ফেব্রুয়ারি মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল ‘সিবিএস শিকাগো’র সাথে এক সাক্ষাতে ‘শিকাগো ইউনিভার্সিটি’র এসোসিয়েট প্রফেসর এবং ‘শিকাগো কাউন্সিল অন গ্লোবাল এফেয়ার্স’এর ফেলো পল পোস্ট বলেন যে, ক্রেমলিনের কাছের লোকগুলি পশ্চিমাদের একেবারেই বিশ্বাস করে না। রুশ জনগণের মাঝে কিছু রয়েছে যারা রুশ সাম্রাজ্যকে পুনপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। আর এই লোকগুলিকেই এখন ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বাস করছেন। তবে পল পোস্ট তার টেলিভিশন সাক্ষাতে কিছু তথ্য এড়িয়ে গেছেন; যেগুলি তিনি যুদ্ধ শুরুর এক মাস আগে ১৬ই জানুয়ারি টুইটারে এক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। তিনি তার বিশ্লেষণে বলেছিলেন যে, ইউক্রেনে যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কারণ পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা বহুদিন থেকেই এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎবাণী করছিলেন। ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনে কিন্তু যুদ্ধ চলছে। আর ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে যারা এ বিষয়ে লেখালেখি করেছেন, তাদের কাছে ইউক্রেনের যুদ্ধ কোন অবাক হবার বিষয় নয়। কারণ তাদের বেশিরভাগই ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে ইউক্রেনকে সম্ভাব্য সংঘাতের কারণ হিসেবে দেখেছেন।

২০১৩ সালের শেষে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের মাইদান স্কয়ারে ইইউএর পক্ষে ‘ইউরোমাইদান’ আন্দোলনকে রাশিয়া শুধু ইউক্রেনে প্রভাব হারানো হিসেবেই দেখেনি; সেটাকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার ক্ষমতার প্রতি হুমকি হিসেবেই দেখেছেন। পুতিন ‘ইউরোমাইদান’ আন্দোলনকে দেখেছেন একটা পশ্চিমা ষড়যন্ত্র হিসেবে; যার মাধ্যমে পশ্চিমারা রাশিয়ার একজন বন্ধুকে সড়িয়ে দিয়ে রাশিয়ার প্রভাব কমাতে এবং ন্যাটোর পূর্বদিকে সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে চায়।


‘ভোক্স’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৯১ সালে ইউক্রেনিয়ানরা যখন ৯২ শতাংশ ভোটে নতুন রাষ্ট্র তৈরির ইচ্ছা ব্যক্ত করে, তখন থেকেই পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা বলতে শুরু করেন যে, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সীমান্ত ভবিষ্যতে একটা সংঘাতের কারণ হবে। ইউক্রেনের ইউরোপ ঘেঁষা পশ্চিমাংশের জনগণ, পূর্বের রাশিয়া ঘেঁষা জনগণ, ক্রিমিয়া উপদ্বীপের প্রতিযোগিতামূলক এলাকা এবং রুশ প্রভাব থেকে বের হয়ে যাওয়া প্রাক্তন সোভিয়েত এলাকাগুলির উপর রুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে রূপ দিতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছিলেন। বাস্তবায়িত হতে ২০ বছর লাগলেও সেই ভবিষ্যৎবাণী ঠিকই বাস্তবে রূপ নেয়। ২০১৩ সালের শেষের দিকে রুশ সমর্থিত ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। এবং ২০১৪এর ২২শে ফেব্রুয়ারি ইয়ানুকোভিচ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় রাশিয়া দ্রুতবেগে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নিয়ে সেটাকে রুশ অঞ্চল বলে ঘোষণা দেয়। একই বছর পূর্ব ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী অঞ্চলে রুশ প্ররোচনায় মারাত্মক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ২০১৩ সালের শেষে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের মাইদান স্কয়ারে ইইউএর পক্ষে ‘ইউরোমাইদান’ আন্দোলনকে রাশিয়া শুধু ইউক্রেনে প্রভাব হারানো হিসেবেই দেখেনি; সেটাকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার ক্ষমতার প্রতি হুমকি হিসেবেই দেখেছেন। পুতিন ‘ইউরোমাইদান’ আন্দোলনকে দেখেছেন একটা পশ্চিমা ষড়যন্ত্র হিসেবে; যার মাধ্যমে পশ্চিমারা রাশিয়ার একজন বন্ধুকে সড়িয়ে দিয়ে রাশিয়ার প্রভাব কমাতে এবং ন্যাটোর পূর্বদিকে সম্প্রসারণ নিশ্চিত করতে চায়। ২০১৪ সালের মার্চে পুতিন বলেন যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার পশ্চিমা পার্টনাররা ‘লাইন ক্রস’ করেছেন। ‘ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো’র সেভা গুনিতস্কির মতে, পুতিন যেকোন রুশ বিরোধী আন্দোলনের পিছনে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ রয়েছে বলে মনে করেন। পুতিনের ধারণা যে, পশ্চিমারা ইউক্রেনের মতোই ‘সাবভার্সন’এর মাধ্যমে রাশিয়ারও নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। ‘ভোক্স’এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২১এর জুলাই মাসে পুতিন ৫ হাজার শব্দের এক লম্বা লেখায় ব্যাখ্যা দেন যে, ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদ প্রকৃতপক্ষে অন্তসারশূণ্য; এবং ইউক্রেন সবসময় রাশিয়ারই অংশ ছিল। আর পশ্চিমা ঘেঁষা ইউক্রেন রুশ ফেডারেশনের অস্তিত্বের জন্যে হুমকি। তিনি ইউক্রেনিয়ান জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া রাষ্ট্রকে ব্যাপক ধ্বংসী অস্ত্রের সাথে তুলনা দেন।

 



ইউক্রেন যুদ্ধের জন্যে পশ্চিমাদের কোন দায় নেই… পশ্চিমা মিডিয়া অন্ততঃ সেটাই বলতে চায়

পল পোস্ট ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী সংঘাতের সম্ভাবনা, যা পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা বারংবার বলেছেন, সেব্যাপারে কেন ‘সিবিএস’এর সামনে কথা বলেননি? কারণ পশ্চিমা মিডিয়া ইউক্রেনের ইস্যুটাকে শুধুমাত্র ভ্লাদিমির পুতিনের উপরেই চাপাতে চাইছে। কেউ যদি এই চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক কোনকিছু বলে, তবে তাকে মিডিয়া আনঅফিশিয়ালি বয়কট করছে। সবচাইতে বড় উদাহরণ হলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সনামধন্য মার্কিন লেখক ‘শিকাগো ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর জন মিয়ার্সহাইমার। মিয়ার্সিহাইমার ২০১৫ সালের জুনে ‘ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো’র এলামনাইএর সামনে এক ভাষণে বলেন যে, ২০১৪ সালে ইউক্রেনে তৈরি হওয়া সংঘাতের জন্যে পশ্চিমারাই দায়ী। তিনি সরাসরিই বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে তার সাথে একমত হবার মতো খুব কম লোকই রয়েছে; যাদের মাঝে রয়েছেন স্টিফেন এফ কোহেন এবং হেনরি কিসিঞ্জার। মিয়ার্সহাইমারের ভাষণের পাঁচ বছর পর কোহেন ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেন; অপরদিকে কিসিঞ্জার এখন ৯৮ বছরের বয়োবৃদ্ধ।

মিয়ার্সহাইমার তার ব্যাখ্যায় বলেন যে, ইউক্রেন খুবই খারাপভাবে বিভক্ত একটা দেশ। ২০০৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল দেখিয়ে তিনি বলেন যে, ইউক্রেনের পশ্চিমের ইউক্রেনিয়ান ভাষাভাষী বেশিরভাগ মানুষ যেখানে ভিক্টর ইয়ুশচেংকোকে ভোট দিয়েছিল, সেখানে পূর্বের বেশিরভাগ রুশ ভাষাভাষী মানুষই ভোট দিয়েছিল ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে। ২০১০ সালের নির্বাচনেও টিমোশেংকোকে ভোট দিয়েছে দেশের পশ্চিমের লোকেরা; আর পূর্বাঞ্চলে ৬০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশের উপর ভোট পেয়েছিলেন ইয়ানুকোভিচ। ২০১৫ সালের মে মাসে ‘ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট’এর এক জরিপে দেখানো হয় যে, ইউক্রেনের পশ্চিমের বেশিরভাগ শহরের ৬০ শতাংশ থেকে ৯২ শতাংশ মানুষ ইইউতে যোগদানের পক্ষে; অপরদিকে পূর্ব ও দক্ষিণের মিকোলায়িভ, খারকিভ, ওডেসা, নিপ্রো, খেরসনএর মতো শহরগুলিতে অর্ধেকের বেশি মানুষ ইইউতে যোগদানের পক্ষে নয়। ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্ব এই প্রেক্ষাপটের উপরেই চলছে। আর একইসাথে জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলির রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টিতে বাধা দিয়েছে।

মিয়ার্সহাইমার বলছেন যে, পশ্চিমা এবং রুশদের মাঝে দ্বন্দ্বের মূল কারণ হলো, পশ্চিমারা চেয়েছে ইউক্রেনকে রাশিয়ার বলয় থেকে বের করে এনে পশ্চিমা ছাঁচের মাঝে নিয়ে আসতে; অপরদিকে রাশিয়া বলেছে যে, তারা সেটা বন্ধ করতে সম্ভব সকল কিছুই করবে। পশ্চিমারা তিনটা কৌশলে ইউক্রেনকে নিজেদের বলয়ে আনতে চেষ্টা করেছে; প্রথমতঃ ন্যাটো সামরিক জোটে ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানানো; দ্বিতীয়তঃ ইইউএর অর্থনৈতিক জোটে ইউক্রেনকে ঢোকানো; এবং তৃতীয়তঃ ‘অরেঞ্জ রেভোলিউশন’এর মাধ্যমে ইউক্রেনকে গণতান্ত্রিক বানানো। কিন্তু সমস্যা হলো, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাকে পুতিন বা চীনের শি জিনপিংএর মতো নেতারা সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা হিসেবে দেখে। এই কথার পিছনে সত্য রয়েছে; কারণ পশ্চিমারা মনে করছে যে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা পশ্চিমা ঘেঁষা হবে। অর্থাৎ এখানে ‘এক ঢিলে দুই পাখি শিকার’ করছে পশ্চিমারা।

২০০৪ সালে দ্বিতীয় দফায় রাশিয়ার সীমানায় বল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়াকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মিয়ার্সহাইমার বলছেন যে, রাশিয়া ১৯৯০এর দশক থেকেই ন্যাটোর পূর্বদিকে সম্প্রসারণের প্রতিবাদ করলেও তারা এব্যাপারে কিছু করার সক্ষমতা রাখেনি; আর রাশিয়ার সীমানায় বল্টিক রাষ্ট্রগুলি যথেষ্ট ছোট বিধায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে এদের ভূমিকা খুব বেশি কিছু হবে না। কিন্তু ২০০৮ সালের ৩রা এপ্রিল ন্যাটোর বুখারেস্ত বৈঠকে বলা হয় যে, ন্যাটো ইউক্রেন এবং জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র হবার ইচ্ছাকে স্বাগত জানাবে। ন্যাটোতে সমঝোতা হয়েছে যে, এই দেশগুলি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র হবে। পুতিন এবং ক্রেমলিনের অন্যান্যদের বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয় যে, ন্যাটোর এই ঘোষণাকে রাশিয়া মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখেছে। আর এর ফলশ্রুতিতে এর পরের অগাস্টে রাশিয়া জর্জিয়ায় সামরিক হামলা করে বসে।

সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। ক্রুশ্চেভ যথেষ্ট ঠান্ডা মাথার মানুষ ছিলেন এবং তিনি বুঝতেন যে, পারমাণবিক যুদ্ধ বলতে কি বোঝায়। একারণেই কিউবা সমস্যার সমাধানে সোভিয়েতরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ২০২২ সালে সমস্যা হলো, পুতিন ক্রুশ্চেভের মতো এতটা ঠান্ডা মাথার নন। আর ক্রুশ্চেভের ক্ষেত্রে যেমন একা সিদ্ধান্ত নেয়াটা অনেক কঠিন ছিল, পুতিনের ক্ষেত্রে সেটা ততটা কঠিন নয়। কারণ ক্রেমলিনের উপর ক্রুশ্চেভের যে নিয়ন্ত্রণ ছিল, পুতিনের নিয়ন্ত্রণ তার চাইতে অনেক বেশি।


১৯৬২ সালে কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘটনার সাথে ইউক্রেন যুদ্ধের সম্পর্ক

২০১৫ সালে মিয়ার্সহাইমার ঠিকই বুঝেছিলেন যে, তার কথাগুলি পশ্চিমারা পছন্দ করবে না। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু পর বেশিরভাগ পশ্চিমা মিডিয়াই মিয়ার্সহাইমারকে বয়কট করে। আর ভিন্ন মত দেয়ার কারণে চীনা সরকারি মিডিয়া ‘সিজিটিএন’ও তাকে আমন্ত্রণ জানায়। ১৭ই এপ্রিল এমনই এক সাক্ষাতে তিনি বলেন যে, ন্যাটোর নীতিকে দোষারোপ না করে পশ্চিমা মিডিয়া পুতিনকেই দোষারোপ করছে। তিনি বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম গোলার্ধে ‘মনরো ডকট্রাইন’ মেনে চলছে; যার অর্থ হলো পশ্চিম গোলার্ধের দেশগুলির নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করার অধিকার নেই। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন যে, ১৯৬২ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করেনি যে, কিউবার স্বাধীনতা রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেপণাস্ত্র কিউবায় মোতায়েন করার। যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম গোলার্ধে যে নীতি অনুসরণ করেছে, ঠিক একই রকমের নীতি রুশরা অনুসরণ করেছে ইউক্রেনে। তবে পশ্চিমাদের মাঝে অনেকেই মনে করেন যে, ন্যাটোর পূর্বদিকে সম্প্রসারণ রাশিয়ার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি নয়। কিন্তু পশ্চিমারা কি চিন্তা করে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং পুতিন এবং তার আশেপাশের লোকেরা কি চিন্তা করছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। পুতিনের সাথে কি আচরণ করা হবে, সেটা সাবধানে চিন্তা করা উচিৎ; কারণ তার হাতে হাজার হাজার পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। মিয়ার্সহাইমার বলছেন যে, একদিকে যুক্তরাষ্ট্র যেমন ইউক্রেনে রাশিয়াকে হারাতে চাইছে এবং রুশ অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে চাইছে, তেমনি রাশিয়াও চাইছে সামরিক বিজয়। উভয় পক্ষই জিততে চাইছে। এমতাবস্থায় শান্তি কিভাবে আসবে, তা চিন্তা করাটা কঠিন। অনেকেই ধারণা করছেন যে, ইউক্রেনের এই যুদ্ধ কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

মার্কিন অনলাইন মিডিয়া ‘দ্যা রিকাউন্ট’এর সাথে এক সাক্ষাতে ‘এনবিসি’র প্রেসিডেন্সিয়াল ইতিহাসবিদ মাইকেল বেশলস বলছেন যে, ১৯৬২ সালে কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের সময় সোভিয়েত নেতা ছিলেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। ক্রুশ্চেভ যথেষ্ট ঠান্ডা মাথার মানুষ ছিলেন এবং তিনি বুঝতেন যে, পারমাণবিক যুদ্ধ বলতে কি বোঝায়। একারণেই কিউবা সমস্যার সমাধানে সোভিয়েতরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ২০২২ সালে সমস্যা হলো, পুতিন ক্রুশ্চেভের মতো এতটা ঠান্ডা মাথার নন। আর ক্রুশ্চেভের ক্ষেত্রে যেমন একা সিদ্ধান্ত নেয়াটা অনেক কঠিন ছিল, পুতিনের ক্ষেত্রে সেটা ততটা কঠিন নয়। কারণ ক্রেমলিনের উপর ক্রুশ্চেভের যে নিয়ন্ত্রণ ছিল, পুতিনের নিয়ন্ত্রণ তার চাইতে অনেক বেশি। বেশলস বলছেন যে, ১৯৯০এর দশকে পশ্চিমারা রাশিয়ার গণতন্ত্রায়ন না করে ভুল করেছে; যার ফলশ্রুতিতে পুতিনের মতো নেতার আবির্ভাব হয়েছে।

১১ই মার্চ ‘দ্যা ইকনমিস্ট’এর এক লেখায় মিয়ার্সহাইমার তার মতামতগুলিকে লিপিবদ্ধ করেন। তার কথাগুলি অনেকেই যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন; ফলাফলস্বরূপ পশ্চিমা লিবারালদের মাঝে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। একারণেই প্রায় এক মাস পর ৮ই এপ্রিল মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রধান ইয়ান ব্রেমার ‘জিজিরো মিডিয়া’তে মিয়ার্সহাইমারের যুক্তিগুলি খন্ডনের চেষ্টা করেন। তবে মিয়ার্সহাইমারের বেশিরভাগ যুক্তিকেই তিনি এড়িয়ে যান। প্রথমতঃ মিয়ার্সহাইমারের কথা যে, পশ্চিমারা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন যুদ্ধের জন্যে দায়ী – এটাকে ব্রেমার পুরোপুরিভাবে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন যে, পশ্চিমাদের কোন কর্মকান্ডই পুতিনকে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করেনি। পুতিন নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; এবং এর জন্যে দায় “একমাত্র” তার। দ্বিতীয়তঃ মিয়ার্সহাইমার বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র রুশ ‘লাল দাগ’ উপেক্ষা করেই ইউক্রেনকে রুশ সীমানায় পশ্চিমাদের দূর্গ হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছে। ব্রেমার এর সমালোচনা করে বলছেন যে, রুশ হুমকির কারণেই ইউক্রেনের জনগণ পশ্চিমাদের দিকে ঝুঁকেছে; এখানে পশ্চিমা কৌশলীদের কোন ভূমিকা নেই। অর্থাৎ রাশিয়ার নিজস্ব হুমকির কারণেই ইউক্রেন পশ্চিম ঘেঁষা হয়েছে। তবে ব্রেমারের সমালোচনাগুলিকে সরাসরি নেয়া যাবে না; কারণ এই কথাগুলি তিনি উদ্দেশ্য ছাড়া বলেননি।
 

১৯৯৫। রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলতসিনের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ইয়েলতসিনের মতো পশ্চিমা ঘেঁষা রাষ্ট্রপ্রধান থাকার সময়েও পশ্চিমা কাঠামোর মাঝে রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্তির কোন প্রয়াসই দেখা যায়নি। ন্যাটো এবং ‘জি৭’এর আলোচনায় রাশিয়াকে বসতে দিয়ে আলোচনা শুনতে দেয়া হয়েছে; কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে কোন ক্ষমতাই দেয়া হয়নি। রাশিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অপমানজনক নীতির কারণেই শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ওয়াশিংটনের দ্বিমুখী নীতিগুলিকে রাশিয়া অনুসরণ করেছে।


ঠান্ডা যুদ্ধের পর পশ্চিমারা রাশিয়ার প্রতি যে আচরণ করেছে, তা কতটুকু সঠিক ছিল?

মিয়ার্সহাইমারের সমালোচনার তিন দিন আগে ৫ই এপ্রিল ইয়ান ব্রেমার ‘জিজিরো মিডিয়া’র আরেক আলোচনায় বলেন যে, ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হবার পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি যখন ইইউএর অংশ হয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চাইছিল, তখন রাশিয়া কি পেয়েছে? তারা পেয়েছে পশ্চিমা প্রেসক্রিপশন; যেগুলির অনেকগুলিরই রাশিয়ার বাস্তবতার সাথে কোনরূপ সম্পর্ক ছিল না। বেসরকারিকরণ করতে গিয়ে রাশিয়ার সকল সম্পদ মাত্র কয়েকটা মানুষের হাতে দিয়ে দেয়া হয়েছে। রাশিয়ার উন্নয়নের জন্যে প্রকৃতপক্ষে কোন পরিকল্পনাই ছিল না। এমনকি বরিস ইয়েলতসিনের মতো পশ্চিমা ঘেঁষা রাষ্ট্রপ্রধান থাকার সময়েও পশ্চিমা কাঠামোর মাঝে রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্তির কোন প্রয়াসই দেখা যায়নি। ন্যাটো এবং ‘জি৭’এর আলোচনায় রাশিয়াকে বসতে দিয়ে আলোচনা শুনতে দেয়া হয়েছে; কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে কোন ক্ষমতাই দেয়া হয়নি। জার্মানি এবং জাপানের সাথে পশ্চিমারা যুদ্ধে জিতেছিল। কিন্তু হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ ছাড়াই সহজে জয়লাভের কারণে রাশিয়ার দায় কেউ নিতে চায়নি। ঠান্ডা যুদ্ধের পর যে শান্তির সময়টা পশ্চিমারা পেয়েছিল, সেটা রক্ষার জন্যে তারা খরচ করতে রাজি হয়নি। তারা এটাকে ‘ফ্রি মানি’ হিসেবে দেখেছে। রাশিয়া যদি রাষ্ট্র হিসেবে কোন কারণে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের কোন দায় নেই। এরপর ব্রেমার সবচাইতে মারাত্মক কথাগুলি বলছেন। পশ্চিমারা রাশিয়াকে কিছুই না দিয়ে বঞ্চিত এবং অপমান করেছে; এবং একইসাথে নিজেদের আদর্শ থেকেই সড়ে এসেছে। ২০০৮ সালে ইউক্রেন এবং জর্জিয়াকে ন্যাটোর মাঝে আনার সিদ্ধান্ত নেয় ন্যাটো। যার ফলশ্রুতিতে অগাস্টে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করে বসে। মার্কিন নেতৃবৃন্দ তখন অনেক কথা বললেও জর্জিয়াকে কোন সামরিক সহায়তা দেয়নি; রাশিয়ার উপরেও কোন অর্থনৈতিক অবরোধ দেয়নি। এরপর ২০১৪ সালে যখন রাশিয়া ক্রিমিয়া এবং ডনবাস নিজেদের করে নেয়, তখনও মার্কিনীরা তেমন কিছুই করেনি। রাশিয়ার উপর সীমিত কিছু অবরোধ দিয়েছে; এবং ইউক্রেনকে খুবই নগন্য পরিমাণ অস্ত্র দিয়েছে। ক্রিমিয়া দখল থাকা এবং ডনবাসে যুদ্ধ চলার মাঝেই রাশিয়া ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করে এবং পশ্চিমারা সেখানে যোগ দেয়। খেলা দেখার জন্যে এবং পুতিনের সাথে আলোচনার জন্যে বেশ কয়েকজন পশ্চিমা নেতা রাশিয়ায় গমন করেন। এই ঘটনাগুলির কারণে রাশিয়া ধারণা করেছে যে, তাদের উপর পশ্চিমারা যেসকল অযাচিত আচরণ করেছে, সেগুলির ব্যাপারে রুশরা কিছু করলে পশ্চিমারা খুব বেশি কিছু করবে না।

তদুপরি, ব্রেমার রাশিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অপমানজনক নীতি এবং বিশ্বব্যাপী ওয়াশিংটনের দ্বিমুখী নীতিকে তুলে ধরছেন, যেগুলিকে রাশিয়া অনুসরণ করেছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বারাক ওবামা হোয়াইট হাউজের সংবাদ সন্মেলনে বলেছিলেন যে, রাশিয়া কোন ‘গ্রেট পাওয়ার’ নয়; তারা বড়জোর একটা আঞ্চলিক শক্তি, এবং তারা এখন নিম্নগামী। কথাগুলি যতটাই সত্য হোক না কেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই কথাগুলি বলা একেবারেই সমীচিন হয়নি বলে বলছেন ব্রেমার। কারণ এই কথাগুলি পুতিনের কাছে এমন সময়ে গিয়েছে, যখন তিনি মনে করছিলেন যে, কয়েক দশক ধরে পশ্চিমারা রাশিয়াকে অপমান করেছে। এছাড়াও রুশরা মার্কিন দ্বিমুখী নীতিগুলিকে কপি করেছে। যেমন ক্রিমিয়াকে দখল করতে গিয়ে যে কথাগুলি তারা বলেছে, তার অনেকগুলিই মার্কিনীরা বলেছিল কসভোকে স্বীকৃতি দেয়ার সময়; যদিও সেগুলি ছিল প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন। রুশরা মনে করেছে যে, মার্কিনীরা এগুলি করতে পারলে তারাও পারবে। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ইউক্রেনের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল যে, ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে পাওয়া পারমাণবিক অস্ত্রগুলিকে ফেরত দিয়ে দেয়ার পর পশ্চিমারা ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখন্ডতার নিশ্চয়তা দেবে! ব্রেমার বলছেন যে, এই প্রতিশ্রুতির মূল্য এক টুকরা কাগজের মূল্যের সমানও ছিল না! ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের সময় মার্কিনীরা এই ডকুমেন্ট নিয়ে কোন কথাই বলেনি! ২০২২ সালেই বা তারা সেই ডকুমেন্ট নিয়ে কথা বলবে কেন? আর ইরাক এবং আফগানিস্তানে মার্কিনীদের হাতে মারাত্মক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলির পর যুক্তরাষ্ট্র কি বলতে পারে যে, তারা মুক্ত দুনিয়ার নেতৃত্বে রয়েছে? আর রাশিয়াও এই উদাহরণগুলি দিয়েই বলবে যে, কেউই সত্যি কথা বলছে না; তারাই বা বলবে কেন? ব্রেমার বলছেন যে, তিনি যুদ্ধের জন্যে পুতিনকেই দায়ী করবেন। তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে, এই পরিস্থিতিতে আসার জন্যে পশ্চিমারা তাদের দায় এড়াতে পারে না।

পশ্চিমা স্বার্থ বনাম রুশ স্বার্থ

ইয়ান ব্রেমার সমালোচনা করেছেন জন মিয়ার্সহাইমারের। কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে তারা একমত। মিয়ার্সহাইমার যুদ্ধের দায় পশ্চিমাদের উপর দিচ্ছেন; আর ব্রেমার এই পরিস্থিতিতে আসার জন্যে পশ্চিমাদের দায়বদ্ধতাকে তুলে ধরেছেন। মিয়ার্সহাইমার রাশিয়ার নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন যে, রুশরা মার্কিনীদের নীতিকেই অনুসরণ করেছে। ব্রেমারও বলছেন যে, পশ্চিমারা রাশিয়াকে অপমান করেছে এবং ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের পর মার্কিনীরা দুনিয়ার নেতৃত্ব হারিয়েছে। এমতাবস্থায় রাশিয়া মনে করেছে যে, তারা মার্কিনীদের মতোই দ্বিমুখী আচরণ করলে সমস্যার কিছু নেই। পশ্চিমা দায়বদ্ধতার মূল ব্যাপারটাতে উভয়েই একমত হলেও তারা কেউই পশ্চিমা লিবারাল মিডিয়াতে ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্যে সরাসরি পশ্চিমাদেরকে দায়ী করতে পারছেন না। একারণেই পল পোস্ট টুইটারে যা বলছেন, তা ‘সিবিএস’এ এসে বলতে পারছেন না। মিডিয়া বরং রাশিয়াতে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল ম্যাকফাউলএর মতো একপেশে বক্তব্যই পছন্দ করছে। তবে ইতিহাসবিদ মাইকেল বেশলসএর কথাগুলি ফেলে দেয়ার মতো নয়, যখন তিনি বলছেন যে, ১৯৬২ সালে ক্রুশ্চেভ যত সহজে পারমাণবিক যুদ্ধ এড়িয়েছিলেন, পুতিন সেটা নাও করতে পারেন; বিশেষ করে পশ্চিমারা যদি পুতিনের উপর অনেক বেশি চাপ প্রয়োগ করে, তাহলে তার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। মিয়ার্সহাইমারও বলছেন যে, পুতিনের মতো একটা মানুষের সাথে বুঝেশুনে কথা বলা উচিৎ, কারণ তার কয়েক হাজার পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। যে ব্যাপারটা নিয়ে কেউই আলোচনা করছেন না তা হলো পশ্চিমারা এবং রুশরা সকলেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে পুরো দুনিয়াকে মহা বিপদের মাঝে ফেলে দিয়েছে। এই আলোচনাটাই পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প খোঁজার জন্যে যথেষ্ট।

Saturday 23 April 2022

ব্রিটেন আবারও ভারতকে কাছে টেনে নিতে চাইছে কেন?

২৪শে এপ্রিল ২০২২

বরিস জনসন নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠকের সময় বলেন যে, তারা স্বাধীন, মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আইনের শাসন রয়েছে এমন ব্যবস্থা ইন্দোপ্যাসিফিকে দেখতে চান। জনসন নিঃসন্দেহে এর মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতের সহযোগিতাকেই বুঝিয়েছেন। তবে তার ভারত সফর যে অর্থনৈতিক কারণেই ছিল, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

২২শে এপ্রিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ভারত সফরে বলেন যে, তিনি এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উভয় দেশের আলোচনাকারীদেরকে বলেছেন যে, আগামী অক্টোবরে দিওয়ালি পূজার আগেই যেন দুই দেশের মাঝে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যায়। ভারতের সাথে ব্রিটেনের মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে গত জানুয়ারি মাস থেকে, যখন ব্রিটিশ বণিজ্যমন্ত্রী এন-ম্যারি ট্রেভেলায়ান নতুন দিল্লীতে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পিযুশ গয়ালের সাথে প্রথম দফা আলোচনা শেষ করেন। ভারতের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর অত্যন্ত কঠিন কাজ হলেও বরিস জনসনের সরকার সেদিকেই পুরো শক্তি নিয়োগ করেছে। এবং এই লক্ষ্য জনসনের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা ভারতের সাথে ইউক্রেন ও রাশিয়া ছাড়াও অন্যান্য সাংঘর্ষিক ইস্যুতে ব্যাপক ছাড় দেয়ার মানসিকতার মাঝেই পরিষ্কার হয়ে যায়।

‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির কোন অগ্রগতি না হওয়ায় ২০২২ সালে ভারতের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিই হবে ব্রিটিশ সরকারের জন্যে সবচাইতে বড় আলোচনা। কিন্তু সমস্যা হলো, ভারতে বহু স্বার্থের গ্রুপ রয়েছে, যারা বিভিন্ন দিক থেকে হুমকির মাঝে থাকে। ইইউ বহুকাল যাবত ভারতের সাথে কোন একটা সমঝোতায় পৌঁছাবার চেষ্টা করছে। অস্ট্রেলিয়াও এক দশক ধরে ভারতের সাথে চুক্তির চেষ্টা করে সফল হয়নি। দিল্লী সরকারের ক্রয়নীতি এবং সেবার বাণিজ্য সর্বদাই ছিল আলোচনার মাঝে কঠিনতম বাধা। তথাপি ২০৫০ সালের মাঝে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবার সম্ভাবনা থাকায় ভারত ব্রিটেনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৯ সালে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ছিল প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। ব্রিটেন মনে করছে যে, ভারতে ব্রিটেনের রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ করা ছাড়াও মুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ২০৩৫ সাল নাগাদ প্রতি বছরেই ৩৬ বিলিয়ন ডলার করে বাড়ানো সম্ভব। ব্রিটেন চাইছে ভারত ব্রিটেনের কাছ থেকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং সেবা আমদানি করুক।

ইউক্রেন ইস্যুতে বরিস জনসন নরেন্দ্র মোদির সাথে আলোচনা করেছেন। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা ‘এএনআই’ জানাচ্ছে যে, জনসন বলেন যে, রাশিয়ার ব্যাপারে ভারতের অবস্থান ভালোভাবে জানা রয়েছে এবং এটাও নিশ্চিত যে, সেটার পরিবর্তন হবে না। রাশিয়ার সাথে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, এবং সেটা সকলেই শ্রদ্ধা করে। তিনি বলেন যে, ইউক্রেনের ব্যাপারে সারা দুনিয়ারই অনেক কিছু করার রয়েছে। ভারত ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের বুচা শহরের গণহত্যার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ভারত রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কর্মকান্ডে বেশ ক’বার হস্তক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করেছে যে, রাশিয়া কি করছে এবং তার উদ্দেশ্যই বা কি। উভয় নেতাই যৌথভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধ দ্রুত বন্ধের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভারত সফরে গুজরাটে ব্রিটিশ কোম্পানি ‘জেসিবি’র কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে জনসন বুলডোজারের সাথে ছবি তুলে ভারতজুড়ে বিতর্ক তৈরি করেছেন। কারণ মাত্র কিছুদিন আগেই ‘জেসিবি’র বুলডোজার ব্যবহার করেই মুসলিমদের বাড়িঘর ভাঙ্গা হয়েছে। অনেকেই ‘জেসিবি’র কারখানা পরিদর্শনের দিনক্ষণ নির্ধারণের সমালোচনা করেছেন। ‘ইন্ডিয়া টুডে’ জনসনের এই ছবি তোলা নিয়ে বলে যে, ভারতে এই মুহুর্তে কি বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে, সেব্যাপারে তিনি একেবারেই ‘বধির’এর মতো আচরণ করেছেন! মানবাধিকার সংস্থা ‘এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ এই ইস্যুতে জনসনের চুপ থাকার ব্যাপক সমালোচনা করে।

বরিস জনসনের কথা এবং কাজে এটা পরিষ্কার যে, তিনি ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্দেশ্যে এমন কোন ইস্যুকে প্রাধান্য দিতে ইচ্ছুক নন, যা বিজেপি সরকার পছন্দ করবে না। পলাতক ভারতীয় ব্যবসায়ী বিজয় মালিয়া এবং নীরব মোদিকে ভারতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আস্বস্ত করা ছাড়াও শিখদের স্বাধীন খালিস্তান আন্দোলন যেন ব্রিটেনকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে যেতে না পারে, সেব্যাপারেও তিনি ভারতকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’ বলছে যে, গান্ধীনগরে জনসন স্বামীনারায়ন অক্ষরধাম মন্দিরে গিয়ে গোলাপের পাপড়িও ছিটিয়ে এবং মন্দিরে শ্রী নীলকান্ত ভার্নির মূর্তিতে পূজাও দিয়ে এসেছেন!

ব্রেক্সিট, করোনা মহামারি, লকডাউন, জ্বালানি সমস্যা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পর ব্রিটিশ অর্থনীতিকে পুনরায় দাঁড় করানো যে এখন লন্ডনের প্রধান লক্ষ্যগুলির একটা, তা এখন পরিষ্কার। একারণেই তিনি রাশিয়ার সাথে ভারতের দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে ‘বৈধতা’ দেয়া ছাড়াও ‘জেসিবি’ কারখানা পরিদর্শন করে এবং মন্দিরে পূজা দিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদীদেরকেই খুশি করতে চেয়েছেন। বৈশ্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তা বাস্তবায়নে ব্রিটেনের লিবারাল আদর্শ আপাতত খাঁচার ভেতরেই থাকছে।


সফরকালে দুই দেশের মাঝে ৬টা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বার্তায় এই সমঝোতাগুলির ব্যাপারে বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে। এগুলির মাঝে পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে দুই দেশের একত্রে কাজ করার ইচ্ছা ছাড়াও বায়ুশক্তির ব্যাপারে ব্রিটিশ কোম্পানি ‘অফশোর রিনিউয়েবল এনার্জি ক্যাটাপাল্ট’এর সাথে ভারতীয় সরকারি কোম্পানির সমঝোতা, শেভেনিং স্কলারশিপ প্রকল্পের অধীনে ভারতীয় ছাত্রদেরকে বিনা খরচে ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিষয়ে এক বছরের মাস্টার্স ডিগ্রিতে পড়াশোনা, এবং ব্রিটিশ কোম্পানি ‘ওয়ান ওয়েব’এর সাথে ‘নিউ স্পেস ইন্ডিয়া লিমিটেড’এর কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রেরণের প্রকল্পের ব্যাপারে সমঝোতা হয়।

এছাড়াও দুই দেশ প্রতিরক্ষার ব্যাপারে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে; যার মাধ্যমে ব্রিটেন আশা করছে যে, ভারতের নিজস্ব সামরিক শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে রাশিয়ার অস্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা কমানো। সেই লক্ষ্যে বরিস জনসন বলেন যে, ব্রিটেন শুধুমাত্র ভারতে রপ্তানির জন্যে উন্মুক্ত সাধারণ রপ্তানি লাইসেন্সের ব্যবস্থা করছে; যাতে করে ভারতে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানিতে সময় ক্ষেপণ না হয়। জনসন বলেন যে, নতুন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কয়েক দশকের নিরাপত্তা সহযোগিতাকেই শুধু এগিয়ে নেবে না, মোদির ‘মেইক ইন ইন্ডিয়া’ চিন্তাটাকেও এগিয়ে নেবে। অস্ট্রেলিয়ার ‘এবিসি নিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, শুধুমাত্র ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের সাথে এই লাইসেন্স সুবিধা ভোগ করছে।

বরিস জনসন নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠকের সময় বলেন যে, তারা স্বাধীন, মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আইনের শাসন রয়েছে এমন ব্যবস্থা ইন্দোপ্যাসিফিকে দেখতে চান। জনসন নিঃসন্দেহে এর মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতের সহযোগিতাকেই বুঝিয়েছেন। তবে তার ভারত সফর যে অর্থনৈতিক কারণেই ছিল, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ব্রেক্সিট, করোনা মহামারি, লকডাউন, জ্বালানি সমস্যা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পর ব্রিটিশ অর্থনীতিকে পুনরায় দাঁড় করানো যে এখন লন্ডনের প্রধান লক্ষ্যগুলির একটা, তা এখন পরিষ্কার। একারণেই তিনি রাশিয়ার সাথে ভারতের দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে ‘বৈধতা’ দেয়া ছাড়াও ‘জেসিবি’ কারখানা পরিদর্শন করে এবং মন্দিরে পূজা দিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদীদেরকেই খুশি করতে চেয়েছেন। বৈশ্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তা বাস্তবায়নে ব্রিটেনের লিবারাল আদর্শ আপাতত খাঁচার ভেতরেই থাকছে।

Friday 22 April 2022

আল-আকসার সহিংসতা মুসলিমদের নেতৃত্বের শূণ্যতাকেই তুলে ধরে

২৩শে এপ্রিল ২০২২

 
২০১৪ সাল থেকে শুরু করে নবম বারের মতো ইস্রাইলি সেনারা আল-আকসা মসজিদে হামলা করলো। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, ২০২১এর মে মাসে ১১ দিনের ইস্রাইলি হামলায় যেমন আড়াই’শ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল, তেমনই কোন সহিংসতার দিকে পরিস্থিতি ধাবিত হচ্ছে কিনা।


২২শে এপ্রিল ইস্রাইলি অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদে ইস্রাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় ৩ জন সাংবাদিকসহ বেশ ক’জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট বলছে যে, ৩১ জন আহতের মাঝে ১৪ জনকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের বরাত দিয়ে ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, শুক্রবার ভোরে ইস্রাইলি বাহিনী আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে ঢুকে রাবার বুলেট এবং স্টান গ্রেনেড ছুঁড়ে। জবাবে ফিলিস্তিনি তরুণরা ইস্রাইলি সেনাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেন নিক্ষেপ করে। ইস্রাইলি নিরাপত্তা বাহিনী বলছে যে, তারা ফজরের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত মসজিদ কম্পাউন্ডে ঢোকেনি; এবং তারা ইটপাটকেল ছোঁড়ার জবাব দিতেই সেখানে ঢুকেছিল। কিন্তু এই সংঘর্ষ হঠাত ঘটেনি। প্রায় মাসখানেক ধরেই সহিংসতায় বহু ফিলিস্তিনি হতাহত হয়েছে। ২১শে এপ্রিলও ভোরে ফজরের নামাজে পরপরই ইস্রাইলি বাহিনী রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস এবং পিপার স্প্রে ছুঁড়ে কমপক্ষে ৩০ জন মুসল্লীকে আহত করে। জবাবে ফিলিস্তিনি তরুণরা পেট্রোল বোমা এবং পাটকেল নিক্ষেপ করে। ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে নবম বারের মতো ইস্রাইলি সেনারা আল-আকসা মসজিদে হামলা করলো। মার্চে মাসেই জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ইস্রাইলি হামলায় ২৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়; বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ১৪ জন ইস্রাইলিও নিহত হয়। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, ২০২১এর মে মাসে ১১ দিনের ইস্রাইলি হামলায় যেমন আড়াই’শ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল, তেমনই কোন সহিংসতার দিকে পরিস্থিতি ধাবিত হচ্ছে কিনা।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, রমজান মাসে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের মাঝে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের ভিতরে ‘আল কিবলি’ মসজিদে ঢুকে পড়লে ফিলিস্তিনিরা তাদেরকে লক্ষ্য করে পাটকেল নিক্ষেপ করে। উগ্র ইহুদিরা সাম্প্রতিক সময়ে তাদের দাবি পরিবর্তন করে ফেলেছে। এখন তারা তাদের ‘পাসওভার’ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করার জন্যে মসজিদে ঢুকে উপাসনা করতে চাইছে। ১৯৬৭ সালে জর্দানের সাথে ইস্রাইলের সমঝোতা অনুযায়ী আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের ভেতরে কোন অমুসলিম উপাসনা করতে পারবে না। ১৫ই এপ্রিল ‘পাসওভার’এর প্রথম দিনে ইস্রাইলি বাহিনী মসজিদ কম্পাউন্ডে ঢুকে ১’শ ৫৮ ফিলিস্তিনিকে আহত করে এবং ৪’শ জনকে গ্রেপ্তার করে।

২০শে এপ্রিল সন্ধ্যার সময় হাজারখানেক উগ্রপন্থী ইহুদি ‘আরবদের মৃত্যু চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল করে দামাস্কাস গেইট এবং পুরোনো জেরুজালেমের মুসলিমদের বসতির দিকে ধাবিত হলে ইস্রাইলি পুলিশ তাদেরকে বাধা দেয়। ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেন যে, নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই তিনি পুলিশকে বাধা দিতে বলেছেন। তিনি ইস্রাইলি পুলিশের কাজকে আরও কঠিন করতে বা তাদেরকে নিরাপত্তাহীনতার মাঝে ফেলতে চান না। মিছিলে নেতৃত্ব দেয়া উগ্রবাদী পার্লামেন্ট সদস্য বেন গাভির বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’কে বলেন যে, তিনি কোন অবস্থাতেই তার লক্ষ্য থেকে সড়বেন না। তিনি প্রশ্ন করেন যে, কোন আইনে তাকে দামাস্কাস গেইট যেতে বাধা দেয়া হচ্ছে? তার কথায়, “কিছু ইহুদি কখনোই হামাসের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না”।

একই সময়ে ২১শে এপ্রিল এক সপ্তাহে দ্বিতীয় দিনের মতো ইস্রাইলি যুদ্ধবিমান গাজা উপত্যকায় বোমাবর্ষণ করেছে। ইস্রাইলিরা বলছে যে, তাদের টার্গেট ছিল মাটির নিচে রকেট ইঞ্জিন তৈরি করার কারখানা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে যে, হামলায় মধ্য গাজার আল-বুরাইজ শরণার্থী ক্যাম্পে কয়েকটা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 
আরব দেশগুলি এবং তুরস্ক যখন ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিযোগিতা করছে, তখন ফিলিস্তিনিদের উপর দখলদার ইস্রাইলি বাহিনী এবং অবৈধ বসতি স্থাপনকারী উগ্রপন্থী ইহুদিদের হামলা বন্ধ করার কে রয়েছে? ফিলিস্তিনিরা যখন বছরের পর বছর এতিম শিশুর মতো যখন মার খাচ্ছে, তখন তা কেবল বৈশ্বিকভাবে মুসলিমদের নেতৃত্বশূণ্যতাকেই তুলে ধরে। আল-আকসায় নতুন করে সহিংসতা বিশ্বব্যাপী মুসলিমদেরকে নেতৃত্ব খোঁজায় মরিয়া করে তুলবে, যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।

‘মিডলইস্ট মনিটর’এর এক লেখায় মার্কিন বামপন্থী রাজনীতিবিদ বার্নি স্যান্ডার্সের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে সহযোগী আব্দেররাহমানি আমর বলছেন যে, ইউক্রেন এবং ফিলিস্তিনের ব্যাপারে পশ্চিমারা বীভৎস দ্বিমুখী নীতি প্রদর্শন করছে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পর পশ্চিমা দেশগুলিতে যেমন রুশ পণ্য বয়কটকে বিরাট একটা ইস্যু করা হয়েছে, ঠিক তার উল্টোটা করা হয়েছে যখন ফিলিস্তিনে অবৈধ ইস্রাইলি দখলদারিত্ব এবং গাজার উপর সামরিক হামলা বন্ধে যখন ইস্রাইলি পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছিল। সেই আবদনে ইস্রাইলকে আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য করার কথা বলা হয়েছিল; ঠিক সেই কথাটাই এখন রুশ পণ্য বয়কটের ক্ষেত্রে ইইউ, ন্যাটো এবং বেশিরভাগ পশ্চিমা লিবারাল সংস্কৃতির দেশ জোর গলায় বলছে। এপ্রিল মাসেই মার্কিন কংগ্রেসম্যান লী জেলডিন ও ৪৬ জন কংগ্রেস সদস্য ‘ইস্রাইল এন্টি বয়কট এক্ট’ নামের একটা আইন নিয়ে এসেছে; যা নিশ্চিত করবে যে, কেউ যেন কখনোই ইস্রাইলকে বা ইস্রাইলি পণ্যকে বয়কট করার প্রস্তাব নিয়ে আসতে না পারে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে ইস্রাইলের পক্ষে সমর্থন কতটা শক্ত, তার প্রমাণ হলো ২৭টা মার্কিন অঙ্গরাজ্যে আইন করা হয়েছে যাতে করে কেউই ইস্রাইলের বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক দিতে না পারে। এই আইনগুলি অনেক ক্ষেত্রেই সেসব ব্যবসাকে টার্গেট করেছে, যারা ইস্রাইলের বসতি স্থাপনের ব্যবসায়িক পার্টনার হতে চায়না। আমর বলছেন যে, পশ্চিমারা একদিকে যেমন রাশিয়াকে শত্রু এবং ইস্রাইলকে বন্ধু মনে করছে, তেমনি ইউক্রেনিয়ানদেরকে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপিয় হবার কারণে এবং ফিলিস্তিনিদেরকে শ্বেতাঙ্গ না হওয়ায় ও তৃতীয় বিশ্বের আরব জাতির অংশ হওয়ায় আলাদা করে দেখেছে। এছাড়াও মার্কিন সরকার তাদের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের অন্য দেশের অঞ্চল দখল করাকে খারাপ চোখে দেখেছে; কিন্তু মার্কিনীদের বন্ধু দেশ হলে তারা তাদের লিবারাল আদর্শকে পিছনে ফেলে দিয়েছে।

‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, ১৯শে এপ্রিল তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান ইস্রাইলি প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগকে ফোন করে বলেন যে, সহিংসতায় ৪’শ ফিলিস্তিনি আহত হওয়ায় তিনি ব্যাথিত হয়েছে; এবং তিনি ইস্রাইলকে সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেন। এরদোগানের কথাগুলি বলে দিচ্ছে যে, আরব দেশগুলি এবং তুরস্ক যখন ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিযোগিতা করছে, তখন ফিলিস্তিনিদের উপর দখলদার ইস্রাইলি বাহিনী এবং অবৈধ বসতি স্থাপনকারী উগ্রপন্থী ইহুদিদের হামলা বন্ধ করার কে রয়েছে? ফিলিস্তিনিরা যখন বছরের পর বছর এতিম শিশুর মতো যখন মার খাচ্ছে, তখন তা কেবল বৈশ্বিকভাবে মুসলিমদের নেতৃত্বশূণ্যতাকেই তুলে ধরে। আল-আকসায় নতুন করে সহিংসতা বিশ্বব্যাপী মুসলিমদেরকে নেতৃত্ব খোঁজায় মরিয়া করে তুলবে, যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। অপরদিকে, যদিও পশ্চিমাদের দ্বিমুখী ও বর্ণবৈষম্যমূলক নীতি প্রকৃতপক্ষে নতুন কিছু নয়, তথাপি তা বর্তমান ভেঙ্গে পড়া বিশ্বব্যবস্থার অসারতা প্রমাণে যথেষ্ট।

Wednesday 20 April 2022

ফিনল্যান্ড রাশিয়ার জন্যে কতবড় হুমকি?

২১শে এপ্রিল ২০২২

মার্চ ২০২২। লন্ডনে ব্রিটিশ নেতৃত্বে 'জয়েন্ট এক্সপিডিশনারি ফোর্স'এর বৈঠক। ন্যাটোতে যোগদানের আগেই সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সাথে সহযোগিতাকে বহুদূরে এগিয়ে নিয়ে গেছে; যা কিনা চিন্তাগত মিল না থাকলে হতো না। এই দুই দেশের লিবারাল সমাজ বাকি ইউরোপের সাথে এতটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, এটা বিশ্বাস করাটা কঠিন যে, ন্যাটো এবং এই দুই দেশ আলাদা কিছু। ন্যাটোর ‘আর্টিকেল ৫’ বলছে যে, একটা ন্যাটো সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে বাকিরা সরাসরি সহায়তা দেবে। সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড এই আর্টিকেলের অংশ নয়; তবে তারা সেখান থেকে খুব বেশি দূরেও নয়।

 
ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরু হবার পর থেকে উত্তর ইউরোপের নরডিক অঞ্চলের সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের আলোচনা শোনা যাচ্ছে। এই দুই দেশ ন্যাটোতে যোগদান করবে কিনা সেই প্রশ্নের চাইতে এদের ন্যাটোতে যোগদানের প্রেক্ষাপট এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে এর প্রভাব বুঝতে পারাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, একদিকে ফিনল্যান্ড যেমন ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে দ্রুত অগ্রগামী হতে চাইছে, অন্যদিকে সুইডেন চিন্তাভাবনা করে সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। গত ১৩ই এপ্রিল সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা এন্ডারসনের সাথে যৌথ সংবাদ সন্মেলনে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন বলেন যে, ইউক্রেনে রুশ হামলা ফিনল্যান্ডের নিরাপত্তা কৌশলকে নতুনভাবে দেখতে বাধ্য করেছে। তিনি বলেন যে, কোন সময় বেঁধে না দিলেও ফিনল্যান্ড কয়েক মাস নয়, বরং কয়েক সপ্তাহের মাঝে ন্যাটোতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। অপরদিকে সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী এন্ডারসন বলেন যে, সুইডেন তার স্বার্থের জন্যে কোনটা ভালো, সেব্যাপারে যথেষ্ট চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নেবে। পরদিন ১৪ই এপ্রিল রুশ সিকিউরিটি কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেন যে, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে রাশিয়া বল্টিক সাগরে আগের সমঝোতা বাতিল করে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করবে। ১২ই এপ্রিল ‘ফিনিস বিজনেস পলিসি ফোরাম’এর প্রকাশিত এক জরিপে বলা হচ্ছে যে, দেশের ৮৪ শতাংশ জনগণ রাশিয়াকে ফিনল্যান্ডের প্রতি বড় হুমকি বলে মনে করছে। ৬০ শতাংশ মানুষ ন্যাটোতে যোগ দেয়ার পক্ষপাতি; যেখানে গত বছর অক্টোবরে তা ছিল মাত্র ২৬ শতাংশ।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ন্যাটোতে যোগদানের আগেই সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সাথে সহযোগিতাকে বহুদূরে এগিয়ে নিয়ে গেছে; যা কিনা চিন্তাগত মিল না থাকলে হতো না। এই দুই দেশের লিবারাল সমাজ বাকি ইউরোপের সাথে এতটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, এটা বিশ্বাস করাটা কঠিন যে, ন্যাটো এবং এই দুই দেশ আলাদা কিছু। ন্যাটোর ‘আর্টিকেল ৫’ বলছে যে, একটা ন্যাটো সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে বাকিরা সরাসরি সহায়তা দেবে। সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড এই আর্টিকেলের অংশ নয়; তবে তারা সেখান থেকে খুব বেশি দূরেও নয়। ১৯৯৪ সালে এই দুই দেশ ন্যাটোর ‘পার্টনারশিপ ফর পীস’ প্রকল্প এবং ১৯৯৭ সালে ‘ইউরো আটলান্টিক পার্টনারশিপ কাউন্সিল’এর অংশ হয়। উভয় দেশই ন্যাটোর ‘পার্টনারশিপ ইন্টারঅপারাবিলিটি ইনিশিয়েটিভ’এর অধীনে আফগানিস্তান, বলকান এবং ইরাকে সেনা পাঠিয়েছিল।

নরওয়েতে সদ্য সমাপ্ত হওয়া ন্যাটোর বিশাল সামরিক মহড়া ‘কোল্ড রেসপন্স ২০২২’এ সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড অংশ নেয়। এই দুই দেশের সেনারা মহড়ায় ন্যাটোর সেনাদের শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাদেরকে অতি ঠান্ডা আবহাওয়ায় যুদ্ধ করার জন্যে প্রশিক্ষণ দেয়। এছাড়াও নরডিক অঞ্চল এবং বল্টিক সাগরের নিরাপত্তা দিতে ব্রিটিশ নেতৃত্বে তৈরি করা ‘জয়েন্ট এক্সপিডিশনারি ফোর্স’ বা ‘জেইএফ’এর সদস্য হিসেবে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড নাম লেখায় ২০১৭ সালে। ‘জেইএফ’এর অধীনেও ২০১৯ সালে বল্টিক ও উত্তর সাগরে বড় আকারের মহড়া হয়, যেখানে এই দুই দেশ অংশ নেয়। গত মার্চ মাসে লন্ডনে ‘জেইএফ’এর বৈঠক ছাড়াও বল্টিক সাগরে সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সুইডেন অংশ নেয়।

তথাপি রাশিয়ার সাথে সরাসরি সীমানা এবং দীর্ঘ সংঘাতের ইতিহাসের কারণে ফিনল্যান্ডের ইতিহাস বেশকিছুটা আলাদা; যদিও সেখানে বাকি নরডিক দেশ নরওয়ে এবং সুইডেনকে আলাদা করে দেখাটা কঠিন।

ফিনল্যান্ড – নারী শাসিত সমাজ, নাকি অন্য কিছু?

ফিনল্যান্ডের লিবারাল চিন্তার রাজনৈতিক পরিমন্ডলে যেকেউ মহিলাদের দাপট দেখতে পাবে। দেশটার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ২০১৯ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তার ক্যাবিনেটে তার ‘সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ ছাড়াও রয়েছে আরও চারটা কোয়ালিশন দলের মন্ত্রী। ক্যাবিনেটের ১৯ জন মন্ত্রীর মাঝে ১২ জনই মহিলা; যাদের বেশিরভাগের বয়সই ৪০ বছরের নিচে! ইতোমধ্যেই তার ক্যাবিনেট সদস্যরা মন্ত্রীপদে বহাল থেকে ৮ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন; এবং একজন এখনও অন্তঃসত্ত্বা! ‘সেন্টার পার্টি’র ৩২ বছর বয়সী প্রধান কাত্রি কুলমিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রী। দলে তাকে প্রতিস্থাপন করা ব্যক্তিটিও একজন মহিলা। আইনমন্ত্রী হয়েছেন ৫৬ বছর বয়সী সুইডিশ ভাষাভাষী অভিজ্ঞ আনা হেনরিকসন; যিনি ‘সুইডিশ পিপলস পার্টি’র উপপ্রধান। বামপন্থী ‘লেফট এলায়েন্স’এর প্রধান ৩২ বছর বয়সী লি এন্ডারসন শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন ‘গ্রীন লীগ’এর প্রধান ৩৫ বছর বয়সী মারিয়া ওহিসালো। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, মারিনের ক্যাবিনেটের মাত্র ৩৭ শতাংশ পুরুষ হবার কারণে লিঙ্গবৈষম্য তৈরি হচ্ছে! কিন্তু আসলেই কি ফিনল্যান্ডের নীতি মহিলা রাজনীতিবিদেরা নিয়ন্ত্রণ করছে? ফিনল্যান্ডের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, দেশটার দীর্ঘমেয়াদী নীতির উপর স্বল্প সময়ের জন্যে নির্বাচিত এই রাজনীতিবিদদের প্রভাব যথেষ্টই কম। যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, রাষ্ট্রের ভিত এই রাজনীতিবিদেরা নন। দেশটার লিবারাল সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক চিন্তাগুলি, বিশেষ করে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কঠোর নীতিগুলি সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। ফিনল্যান্ডের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং দীর্ঘমেয়াদী নীতি সংঘাতের ভূরাজনীতি, বিশেষ করে রাশিয়ার সাথে সংঘাত দ্বারা যথেষ্টই প্রভাবিত।

 

রাশিয়ার সাথে ফিনল্যান্ডের বিশাল সীমানা হাজারো হ্রদে পরিপূর্ণ হওয়ায় রাশিয়া থেকে আক্রমণ করে ফিনল্যান্ডের জমি দখল করাটা একেবারেই অবাস্তব। একইসাথে দেশটার অতিশীতল আবহাওয়া এবং দেশের মানুষের যুদ্ধ করার সক্ষমতা দেশটাকে দখলের জন্যে অনুপযুক্ত করে তোলে; যেটা সোভিয়েতরা টের পেয়েছে।

ফিনল্যান্ডের ভূকৌশলগত অবস্থান

ফিনল্যান্ডের পশ্চিমে রয়েছে বথনিয়া উপসাগর; যার পশ্চিমে রয়েছে সুইডেন। উত্তর পশ্চিমে রয়েছে সুইডেন এবং নরওয়ে। পূর্বের প্রায় পুরোটাই রাশিয়া। আর দক্ষিণে রয়েছে ফিনল্যান্ড উপসাগর; যার ওপাড়ে রয়েছে এস্তোনিয়া। দক্ষিণ পূর্বে কারেলিয়ান যোযক পার হয়ে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং বন্দর সেইন্ট পিটার্সবার্স। এই সরু যোযকের পশ্চিমে ফিনল্যান্ড উপসাগর এবং পূর্বে লাদোগা হ্রদ। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এই যোযকের পুরোটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দখল করে নেয়। রাশিয়া এখনও এটার মালিক। রাশিয়ার হাতে থাকলে এই যোযক সেইন্ট পিটার্সবার্গকে স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ দেয়।

দেশটার বেশিরভাগ মানুষ উপকূলীয় সমতলে বসবাস করে। এখানে বার্লি, রাই এবং আলুর চাষ হলেও উত্তর মেরুর বেশ কাছে হওয়ায় এখানে কৃষির সম্ভাবনা সর্বদাই একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মাঝে সীমাবদ্ধ। ২ লক্ষাধিক মানুষ বাস করে এমন ৫টা শহর রয়েছে ফিনল্যান্ডে। এছাড়াও আরও ১’শ ৭টা ছোট শহর রয়েছে। বেশিরভাগ শহরই উপকূলের পাশে এবং কোন না কোন বড় কারখানাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। উপকূলীয় অঞ্চলে আরও রয়েছে ১ লক্ষ ৮০ হাজার দ্বীপ; যার বেশিরভাগ সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মূল ভূখন্ডের মাঝে। ৫৫ লক্ষ মানুষের দেশ ফিনল্যান্ড; যেখানে প্রতি বর্গ কিঃমিঃএ ইইউএর মাঝে সবচাইতে কম লোকের বসবাস।

দেশটার ‘লেইক ডিসট্রিক্ট’ বা হ্রদ অঞ্চল দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত। পুরো ফিনল্যান্ডে ৫৬ হাজারের বেশি হ্রদ রয়েছে; যেগুলি বিভিন্ন হিমবাহের বরফ গলা পানি থেকে সৃষ্ট! সবচাইতে বেশি হ্রদ রয়েছে ‘লেইক ডিসট্রিক্টে’। সবচাইতে বড় সাইমা হ্রদকে একটা খালের মাধ্যমে ফিনল্যান্ড উপসাগরের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। এই খাল দিয়ে হ্রদ অঞ্চলের কাঠ বার্জে করে পরিবহণ করা হয়। ইইউএর মাঝে সবচাইতে বেশি কাঠ উৎপাদন করে ফিনল্যান্ড। দেশটার ৮০ শতাংশ ভূমিই মূলতঃ বনভূমি। তবে নদী, হ্রদ এবং জলাভূমি যোগ করলে মোট জলাভূমি দেশটার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। দেশটার সর্বউত্তরে রয়েছে ল্যাপল্যান্ড এলাকা, যেখানে অক্টোবরের শুরু থেকে মে মাসের শুরু পর্যন্ত শীতকাল থাকে। শীতকালে উত্তরাঞ্চল সূর্য দেখেনা; আর গ্রীষ্মকালে সূর্য অস্তই যায়না! এখানকার বেশিরভাগ নদীই পুরোপুরিভাবে বরফে ঢাকা। স্বল্প সময়ের গ্রীষ্মকালে এখানকার বরফ গলে বিশাল জলাভূমি তৈরি করে।

সমুদ্রসোতের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে শীতকাল এবং গ্রীষ্মকালের সময় সমান। হেলসিনকিতে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা গড়ে ১৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মতো থাকে। তবে শীতকালে তা গড়ে শূণ্যের নীচে ৫ ডিগ্রীর মতো থাকে। তারপরেও অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তুষারপাত হয় এবং দেশটার অপাক্ষাকৃত উষ্ণ উপকূলীয় অঞ্চলও বছরে ৩ থেকে ৪ মাস বরফাচ্ছাদিত থাকে। দেশটায় তেমন কোন বড় পাহাড় না থাকলেও উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলের এলাকাকে ‘বিপজ্জনক’ বলে বলা হয়। সর্বোচ্চ পাহাড় মাত্র ১৩’শ মিটার উঁচু।

ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূল মাত্র ৮০ কিঃমিঃ চওড়া ফিনল্যান্ড উপসাগরের উপর কর্তৃত্ব করছে। একারণেই সেইন্ট পিটার্সবার্গ থেকে বের হওয়া যেকোন রুশ জাহাজের উপর ফিনল্যান্ড নজর রাখতে পারে এবং দরকার বিশেষে সেগুলিকে হুমকিতেও ফেলতে পারে। সেইন্ট পিটার্সবার্গ থেকে রাশিয়ার জাহাজের মহাসমুদ্রে পৌঁছাবার জন্যে বৈরী ফিনল্যান্ড একটা বড় হুমকি। সেকারণেই রাশিয়া সর্বদা চায় ফিনল্যান্ড অন্ততঃ তার বিরুদ্ধে না যাক। কারেলিয়ান যোযক সেইন্ট পিটার্সবার্গের নিরাপত্তা জন্যে গুরুত্বপূর্ণ; যেকারণে রাশিয়া যুদ্ধ করে এই অঞ্চল দখল করেছিল। তবে রাশিয়ার সাথে ফিনল্যান্ডের বিশাল সীমানা হাজারো হ্রদে পরিপূর্ণ হওয়ায় রাশিয়া থেকে আক্রমণ করে ফিনল্যান্ডের জমি দখল করাটা একেবারেই অবাস্তব। একইসাথে দেশটার অতিশীতল আবহাওয়া এবং দেশের মানুষের যুদ্ধ করার সক্ষমতা দেশটাকে দখলের জন্যে অনুপযুক্ত করে তোলে; যেটা সোভিয়েতরা টের পেয়েছে।

ফিনল্যান্ড – যাকে কেউই চায়নি

ন্যাপোলিয়নের সময় ঊনিশ শতকের শুরুতে রুশরা চাইছিল যে, সুইডেন ব্রিটিশ রয়াল নেভিকে বল্টিক সাগরে ঢুকতে বাধা দিক। সুইডেন সেটা করতে রাজি না হওয়ায় ১৮০৮ সালে সুইডেনের কাছ থেকে রুশরা ফিনল্যান্ড নামের এলাকাটা দখল করে নেয়। পরের বছর ফিনিসরা রাশিয়ার অধীনত্ব মেনে নেয়। গ্র্যান্ড ডাচি অব ফিনল্যান্ড নামে রাশিয়ার অধীনে একটা রাজ্য গঠিত হয়। ফিনল্যান্ডের অঞ্চলগুলি রাশিয়ার সাথে পরবর্তী চুক্তিগুলির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। তবে ফিনল্যান্ড স্বাধীন ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়লে জার্মানরা ফিনল্যান্ডের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। এরপর জার্মান এবং রাশিয়ায় ক্ষমতা নেয়া সোভিয়েতদের সমর্থকদের মাঝে ফিনল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ চলে, যার মাঝ দিয়ে দেশটার স্বাধীন অস্তিত্বের আলোচনার শুরু। এখানে ব্রিটিশ বা ফরাসিদের কোন ভূমিকা ছিল না; কারণ তারা ফ্রান্সের রণাঙ্গনে ব্যস্ত ছিল। তবে ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের মাধ্যমে ফিনল্যান্ড থেকে জার্মান সেনারা চলে যায়। ১৯১৯ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ এবং ফরাসি মিত্রশক্তি যুদ্ধ শুরু করে। সেসময় তাদের ফোকাস ছিল রাশিয়ার উত্তরাঞ্চল এবং এস্তোনিয়া; ফিনল্যান্ড নয়। ব্রিটিশরা এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়ার জন্ম দিলেও ফিনল্যান্ড কারুর কাছেই গুরুত্ব পায়নি। রাশিয়ায় ক্ষমতা নেয়া বলশেভিকরা ১৯২০ সালে ফিনল্যান্ডকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যদিও তারা এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়াকে দখল করে নিয়েছিল। অর্থাৎ তখন পর্যন্ত ফিনল্যান্ড রাশিয়ার কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। এই হিসেবটা অবশ্য খুব অল্প সময়ের মাঝেই পাল্টে যায়, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদেরকে সংগঠিত করে ক্রমেই আগ্রাসী হতে থাকে। এসময়েই রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল ফিনল্যান্ড রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে দেখতে থাকে।

১৯৩৯-৪০ সালের 'উইন্টার' যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ফিনল্যান্ডের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সোভিয়েতরা ফিনল্যান্ডের বৈরী আবহাওয়া, কঠিন ভূপ্রকৃতি এবং ফিনিস সেনাদের দৃঢ়তার ব্যাপারে একটা ধারণা পায়।


রাশিয়ার সাথে ফিনল্যান্ডের সম্পর্ক অবিশ্বাসের

তবে জন্মের পর থেকেই ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষা চিন্তাটা ছিল রাশিয়াকে ঘিরে। রাশিয়ার সাথে দেশটার ১৩’শ ৪০ কিঃমিঃএর বিশাল স্থলসীমানা রয়েছে। আর এই পুরো সীমানা জুড়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ করেছে ফিনল্যান্ড। ১৯৩৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ‘উইন্টার’ যুদ্ধ বলে পরিচিত সংঘাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে বসে। এসময় ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা ফিনিসদের কোন সহায়তা দেয়নি। তবে প্রচন্ড শীতের মাঝে তিন মাস যুদ্ধের পর উভয় পক্ষই যুদ্ধ শেষ করতে বাধ্য হয়। ফিনল্যান্ডের অফিশিয়াল হিসেবে সেই যুদ্ধে প্রায় ২৬ হাজার মানুষ নিহত হয় এবং আরও প্রায় ৪৪ হাজার হয় আহত। সোভিয়েতরা যুদ্ধে সাড়ে ৪৮ হাজার মৃত এবং দেড় লক্ষাধিক আহত ও শীতে অসুস্থ হওয়ার কথা স্বীকার করে। তবে পরবর্তী রুশ গবেষকেরা মৃতের সংখ্যাকে ৫৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার বলে দাবি করেছেন। আরও কিছু গবেষণায় এই সংখ্যা ১ লক্ষাধিক বলেও উল্লেখ করা হয়। যুদ্ধে সোভিয়েতরা ১ হাজারের বেশি ট্যাংক এবং ২’শর বেশি যুদ্ধবিমান হারায়। এই যুদ্ধে ফিনল্যান্ডের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সোভিয়েতরা ফিনল্যান্ডের বৈরী আবহাওয়া, কঠিন ভূপ্রকৃতি এবং ফিনিস সেনাদের দৃঢ়তার ব্যাপারে একটা ধারণা পায়। ১৯৪১ সালে জার্মানরা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার পরে ফিনল্যান্ড জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েতদের সাথে এই যুদ্ধে ফিনিশরা আরও ৬৩ হাজার মানুষ হারায়; এছাড়াও আরও দেড় লক্ষাধিক হয় আহত। অপরদিকে সোভিয়েতরা হারায় আড়াই লক্ষাধিক সেনা; এবং আরও সাড়ে ৫ লক্ষের বেশি আহত ও শীতে অসুস্থ্য হয়। যুদ্ধে ফিনিসরা গড়ে সাড়ে ৪ লক্ষ সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন রেখেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ফিনল্যান্ডের সোভিয়েত বিরোধী অবস্থান তাদেরকে পরবর্তীতে ভুগিয়েছে; কারণ ১৯৪৫ সালে জার্মানি যুদ্ধে হেরে যায়। বিজয়ী সোভিয়েতদের কাছে ফিনিসরা ভাইবর্গ বন্দর শহর সহ বেশকিছু ভূমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৮ বছরের মাঝে ৩’শ মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়। এছাড়াও সমরাস্ত্র তৈরি এবং রাখার ব্যাপারে ফিনল্যান্ডের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ছিল; যেমন ফিনল্যান্ডের নৌবাহিনীতে কোন সাবমেরিন থাকতে পারবে না। এছাড়াও রাজধানী হেলসিনকির দক্ষিণে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পোরক্কালা উপদ্বীপ ৫০ বছরের জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে লীজ দিতে বাধ্য হয় ফিনল্যান্ড। এই উপদ্বীপ রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর থেকে বের হওয়া যেকোন জাহাজের ফিনল্যান্ড উপসাগর অতিক্রম করার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। পোরক্কালা থেকে মাত্র ৮০ কিঃমি দক্ষিণে রয়েছে এস্তোনিয়ার টালিন বন্দর; এই দুয়ের মাঝ দিয়ে রাশিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ গিয়েছে। তবে সোভিয়েতরা ১৯৫৬ সালেই এই উপদ্বীপ ফিনল্যান্ডের কাছে ফিরিয়ে দেয়।

ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষা চিন্তা


পুরো ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝে ফিনল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নকে তুষ্ট করেই চলেছে। তবে পশ্চিমের সাথে তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর হয়েছে। ১৯৯০ সালে জার্মানির একত্রীকরণ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ফিনল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৭ সালের যুদ্ধের বাধ্যবাধকতাসমূহকে বাতিল বলে ঘোষণা দেয়। ততদিনে ফিনল্যান্ডের লিবারাল নীতির কারণে পশ্চিমারা ব্যাপারটাকে খারাপ চোখে দেখেনি। ফিনল্যান্ড সাবমেরিন রাখার নীতি পরিবর্তন করলেও এখনও তারা কোন সাবমেরিন ক্রয়ের পরিকল্পনা করেনি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার সাথে উত্তেজনার মাঝে ব্যাপারটা আলোচিত হচ্ছে।

রাশিয়ার সাথে ফিনল্যান্ডের বিশাল সীমানা রক্ষা করতে ফিনিসরা কিছু নীতির পক্ষে, যা কিনা পশ্চিমা লিবারাল চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক। ১৯৯৯ সালে ‘অটোয়া কনভেশন’এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং ভারত ব্যাতীত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এন্টি-পার্সোনেল মাইন বা একজন মানুষ হত্যা বা আহত করার মতো ক্ষমতার মাইন তৈরি, ব্যবহার, স্টক বা রপ্তানি না করার ব্যাপারে সম্মত হয়। ২০১১ সালে পশ্চিমা দেশগুলির মাঝে শেষ দেশ হিসেবে ফিনল্যান্ড এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, দেশটার অনেকেই রাশিয়ার সাথে তাদের বিশাল স্থলসীমানা রক্ষার্থে মাইনকে অতি প্রয়োজনীয় হিসেবে দেখে। ২০১৮ সালে তৎকালীন ফিনিস প্রতিরক্ষামন্ত্রী জুসসি নিনিস্তো সাংবাদিকদের বলেন যে, ফিনল্যান্ড নিজেদের মতো করে ‘বাউন্ডিং মাইন’ ধরণের একটা মাইন ডেভেলপ করছে, যা রিমোট কন্ট্রোলে কাজ করবে। ট্রিগার টিপলে এই মাইন মাটি থেকে লাফ দিয়ে উপরে উঠে গিয়ে বহু বুলেটে বিভক্ত হয়ে মাটিতে থাকা শত্রুদের সকলকে একত্রে ঘায়েল করবে। তিনি বলেন যে, দেশের জরুরী প্রয়োজনে ‘অটোয়া কনভেনশন’এর মত চুক্তিগুলি অদরকারি কাগজ হয়ে যেতে পারে।

ফিনল্যান্ডে সকল পুরুষদের সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দেয়া বাধ্যতামূলক। দেশটার সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা মাত্র ২০ হাজারের মতো; যা যুদ্ধের সময় বহুগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ১৯৯৫ সালে ফিনল্যান্ড প্রথমবারের মতো তাদের সেনাবাহিনীতে মহিলাদের রিক্রুট করা আরম্ভ করে। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে সার্ভিস হলো ঐচ্ছিক। গড়ে প্রতিবছর মোট রিক্রুটের প্রায় আড়াই শতাংশ থাকে মহিলা। ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিনিস্তো এক টেলিভিশন সাক্ষাতে বলেন যে, ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষার একটা মূল স্তম্ভ হলো সম্ভাব্য যুদ্ধের সময় ২ লক্ষ ৮০ হাজার সেনার একটা বাহিনী তৈরি করতে পারার মতো সক্ষমতা তৈরি করা। আর সেটা নিশ্চিত করতে শুধু পুরুষদের সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক রিক্রুট করলেই হবে না; মহিলাদেরকেও এই পরিকল্পনার মাঝে আনতে হবে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, নিনিস্তো ফিনল্যান্ডের সামরিক বাহিনীতে মহিলাদের ভূমিকা নিয়ে নতুন একটা আলোচনার জন্ম দিয়েছেন; যা দেশটার নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। তবে দেশটার পুরো সমাজেই নারী নির্যাতনের পরিস্থিতি ভয়াবহ। লিবারাল সমাজ হলেও দেশটার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জরিপের হিসেবে ফিনল্যান্ডের ৩৫ বছরের নিচে সকল মহিলার অর্ধেকের বেশি কোন না কোন প্রকারের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। একারণে সামরিক বাহিনীতে মহিলাদের সার্ভিস দেয়ার বিষয়টা আলোচনার উর্ধ্বে নয়।

‘স্ট্যাটিস্টা’র হিসেবে ফিনল্যান্ডের ১৯ বছরের নীচে জনসংখ্যা সাড়ে ১১ লক্ষ; ২০ থেকে ৩৯ বছরের জনসংখ্যা ১৩ লক্ষ ৮০ হাজার; ৪০ থেকে ৫৯ বছরের জনসংখ্যাও ১৩ লক্ষ ৮০ হাজার; আর ৬০ বছরের অধিক বয়সের জনসংখ্যা ১৬ লক্ষ ৩৩ হাজার। অর্থাৎ দেশটায় বৃদ্ধ মানুষ বেশি। ০ দশমিক ০২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাওয়া জনসংখ্যার যে এই দশা হবে, তা অবশ্য অনুমেয়। বয়সভিত্তিক জনসংখ্যার এই হিসেবে যুদ্ধ করার জন্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী হবে ২০ থেকে ৩৯ বছর বয়সের। এর সাথে ১৫ থেকে ১৯ এবং ৪০ থেকে ৫০ বছরের কিছু মানুষও থাকবে। তাহলে দেশের যুদ্ধ করার সক্ষমতার মানুষ ২০ লক্ষের মত হতে পারে। এর মাঝে মহিলা বাদ দিলে শুধু ১০ লক্ষ পুরুষের মাঝ থেকেই ২ লক্ষ ৮০ হাজার সৈন্যের বাহিনী তৈরি করতে হবে; যা খুব একটা সহজ কাজ না হলেও অসম্ভব নয়। ২ লক্ষ ৮০ হাজার সেনার একটা বাহিনী যেকোন রুশ হামলার জন্যে মারাত্মক প্রতিরোধ হিসেবে দাঁড়াবে।

ফিনল্যান্ডের বিমান বাহিনীর 'এফএ-১৮' যুদ্ধবিমানের ডানার নিচে দু'টা দূরপাল্লার 'জেএএসএসএম' ক্ষেপণাস্ত্র। ২০১১ সালের অক্টোবরে মার্কিন সরকার ১’শ ৯৩ মিলিয়ন ডলারে ফিনল্যান্ডের কাছে ‘জেএএসএসএম’ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করার অনুমতি দেয়। ফিনিসরা এখন ২১ শতকের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আশেপাশের সকল সমুদ্রপথ রাশিয়ার জন্যে বন্ধ করে দিতে সক্ষম।


ফিনল্যান্ডের যুদ্ধ প্রস্তুতি, ২০০৭-২০১২

২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বেশিরভাগ মানুষই জানে না যে, ছোট্ট জনসংখ্যার ফিনল্যান্ডের রয়েছে ইউরোপের সবচাইতে বড় আর্টিলারি বাহিনী এবং সবচাইতে উন্নত আকাশ সার্ভেইল্যান্স ব্যবস্থাগুলির একটা। এছাড়াও দেশটার সামরিক ইন্টেলিজেন্স, স্পেশাল ফোর্স এবং সাইবার প্রতিরক্ষা বহু দেশ থেকে উন্নততর। তবে রাশিয়ার সাথে ফিনল্যান্ডের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে সেসময় থেকেই। ফিনল্যান্ড ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ‘এফএ-১৮’ যুদ্ধবিমানে ব্যবহার করার জন্যে আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য দূরপাল্লার ‘এজিএম-১৫৮ জেএএসএসএম’ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার অনুরোধ করে; যুক্তরাষ্ট্র তখন তা প্রত্যাখ্যান করে। তবে ২০০৮ সালের মার্চে জর্জিয়াতে রুশ সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়া এবং এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের জর্জিয়া এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার প্রস্তাবের পর জুলাই মাসে মার্কিন সরকার ফিনল্যান্ডের কাছে ৪’শ ৩৫ মিলিয়ন ডলারে ৩’শ অত্যাধুনিক দূরপাল্লার রাডার গাইডেড ‘এমরাম’ আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়; যদিও ‘টেকনিক্যাল’ কারণে এর ডেলিভারি ২০১২এর আগে হয়নি।

রাশিয়া ইতোমধ্যেই ২০০৮ সালের অগাস্টে জর্জিয়ায় সামরিক হামলা করে; যা ফিনল্যান্ডের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের নীতিকে আরও পরিবর্তন করার অজুহাত দেয়। ২০১১ সালের অক্টোবরে মার্কিন সরকার ১’শ ৯৩ মিলিয়ন ডলারে ফিনল্যান্ডের কাছে ‘জেএএসএসএম’ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করার অনুমতি দেয়। ৩’শ ৭০ কিঃমিঃ পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্র বেশিরভাগ রাডারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে টার্গেটে আঘাত হানতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্র এই অস্ত্র এর আগে ন্যাটোর কোন সদস্য রাষ্ট্রকেও দেয়নি! ২০১৮ সালের মার্চে ফিনিস বিমান বাহিনীর ‘এফএ-১৮’ যুদ্ধবিমান থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্রের টেস্ট ফায়ারিং করা হয়। ২০১২ সালের মার্চে এই বিক্রি নিশ্চিত হবার পরপরই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফিনল্যান্ডের ন্যাটোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং আরও সামরিক সরঞ্জাম কেনাকাটার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ‘পলিটিকো’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এটা ফিনল্যান্ডকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী ডিটারেন্ট দিয়েছে। ফিনিস নিরাপত্তা বিশ্লেষক চার্লি স্যালোনিয়াস পাস্তারনাক ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে এক প্রতিবেদনে বলেন যে, ফিনিসরা এখন ২১ শতকের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আশেপাশের সকল সমুদ্রপথ রাশিয়ার জন্যে বন্ধ করে দিতে সক্ষম। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের পিছনে ২০০৮ সালে রাশিয়ার জর্জিয়া আক্রমণ এবং ২০০৯ সালে বড় সামরিক মহড়ার কথা উল্লেখ করেন। ২০১০ সাল থেকে ন্যাটো উত্তর ইউরোপে কতগুলি সামরিক মহড়া করেছে, সেটার হিসেব রাখাটাই কঠিন হয়ে যায়। সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডকে বাদ দিয়ে ন্যাটোর উত্তরাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। একারণেই ন্যাটো এই দুই দেশের সাথে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে নরওয়ে, যে কিনা ন্যাটোর সদস্য। নরওয়ের সাথে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ঘনঘন সামরিক মহড়া দিচ্ছে। পুতিন যত বেশি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন, ফিনল্যান্ডের ডানপন্থীরা তত শক্তিশালী হচ্ছে এবং দেশটার প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেবার কথা বলছে।

আরও অস্ত্র এবং সামরিক বাজেট বৃদ্ধি, ২০১৪-বর্তমান

২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ফিনল্যান্ড ২’শ ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচে ডাচ সেনাবাহিনীর ১’শ ‘লেপার্ড-২এ৬’ ট্যাংক কিনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মার্কিন থিংকট্যাংক ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ১৯৮৪ থেকে ১৯৯০ সালের মাঝে ফিনল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে ১’শ ৬০টা ‘টি-৭২এম১’ ট্যাংক কেনে। এগুলি ২০০৩ সালের পর জার্মান সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কেনা ১’শ ২৪টা ‘লেপার্ড-২এ৪’ ট্যাংক দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। স্টকে থাকা ১’শটা ‘লেপার্ড-২এ৪’ ট্যাংককে ডাচ সেনাবাহিনীর ট্যাংক দিয়ে প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনা ছিল। তবে কিছুদিন পরেই বোঝা যায় যে, ফিনিসরা আসলে পুরোনো ট্যাংক প্রতিস্থাপন করছিল না; তারা ট্যাংকের সংখ্যা দ্বিগুণ করে ২’শতে নিয়ে যাচ্ছিলো। ফিনল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর ওয়েবসাইট বলছে যে, ২০২১এর ডিসেম্বরে ফিনিসরা জার্মান কোম্পানি ‘ক্রাউস-মাফেই ওয়েগমান’এর সাথে ১১ মিলিয়ন ডলার খরচে সবগুলি ‘লেপার্ড-২’ ট্যাংক উন্নয়নের চুক্তি করে। এর ফলে ফিনিস ট্যাংকগুলি নতুন হাই এক্সপ্লোসিভ ফ্র্যাগমেন্টেশন গোলা নিক্ষেপ করতে সক্ষম হবে। এই প্রকল্প ফিনিসরা নিয়েছে সুইডেনের সাথে সমন্বয় করে; যাতে দরকারে দুই দেশের মাঝে গোলাবারুদ আদানপ্রদান সম্ভব হয়।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিনীরা ঘোষণা দেয় যে, তারা ৬’শ ২২ মিলিয়ন ডলারে ফিনল্যান্ডের কাছে ১’শ ১২টা ‘হারপুন’ জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১’শ ১৩ মিলিয়ন ডলারে ৬৮টা ‘ইএসএসএম’ বিমান ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করছে। প্রায় আড়াই’শ কিঃমিঃ পাল্লার ‘হারপুন ব্লক ২ প্লাস ইআর’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ফিনল্যান্ডের ‘হামিনা ক্লাস’ মিসাইল বোটগুলিতে ‘আরবিএস-১৫’ ক্ষেপণাস্ত্রের স্থলাভিষিক্ত হবে। এছাড়াও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ভূমি থেকে নিক্ষেপণযোগ্য হিসেবে রাখা হবে। নতুন ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ফিনল্যান্ড সরু সমুদ্রপথের উপর রুশ জাহাজের বিরুদ্ধে নতুন হুমকি তৈরি করতে পারবে। একই বছরের জুলাই মাসে ফিনল্যান্ড ঘোষণা দেয় যে, তারা ইস্রাইলের কাছ থেকে ‘গ্যাব্রিয়েল’ জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র কিনবে। প্রায় ২’শ মিলিয়ন ডলারে কেনা এই ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘ইএসএসএম’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ভবিষ্যৎ ৪টা ‘স্কোয়াড্রন ২০২০’ কর্ভেটে বসানো হবে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি বল্টিক এবং ফিনল্যান্ড উপসাগরে ফিনল্যান্ডের নৌসক্ষমতাকে অনেক বাড়িয়ে দেবে।

২০২১এর সেপ্টেম্বরে ফিনিস প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পার্লামেন্টের সামনে একটা রিপোর্ট পেশ করে; যেখানে বলা হয় যে, ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষা আবহ বেশ থমথমে এবং অনিশ্চিত। ফিনল্যান্ডের পাশে আর্কটিক অঞ্চলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর ফিনিসরা চিন্তিত যে, রুশরা ফিনল্যান্ডের আশেপাশের এলাকায় বিশাল সমরশক্তি মোতায়েন রেখেছে। প্রতিবেদনে পুরো ফিনল্যান্ড জুড়ে প্রতিরক্ষা কাঠামো তৈরির কথা বলা হয়; বিশেষ করে আঞ্চলিক ইউনিট গঠনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়, যেখানে রিজার্ভ সেনাদের যথেষ্ট ভূমিকা থাকবে। আঞ্চলিকভাবে ফিনল্যান্ডের আশেপাশের দেশগুলির সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলা হয় যে, ‘নরডিক ডিফেন্স কোঅপারেশন’, ইইউ, ন্যাটো, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির সাথে ফিনল্যান্ডের সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। ন্যাটো এবং ইইউএর সাথে সামরিক মহড়া এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা নিরসনে অংশ নেয়ার কথাও বলা হয়।

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে ফিনল্যান্ড তার প্রতিরক্ষার পিছনে খরচ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। পাঁচ দলের কোয়ালিশন সরকার আগামী চার বছরের সামরিক বাজেট ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি করার ঘোষণা দিয়েছে। অতিরিক্ত খরচের মাঝে থাকবে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে বিভিন্ন অস্ত্র এবং বন্দুক; ১’শ ৭৭ মিলিয়ন ডলারে সীমানা পাহাড়ার জন্যে আকাশে সার্ভেইল্যান্সে সক্ষম ইন্টেলিজেন্স। ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আনত্তি কাইক্কোনেন বলেন যে, ইউরোপে যুদ্ধ শুরুর কারণে ফিনল্যান্ডের নিরাপত্তা আবহ পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। একারণেই প্রতিরক্ষা বাজেট যথেষ্ট বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ‘ডিফেন্স পোস্ট’ বলছে যে, গত ১২ই এপ্রিল ফিনিস সেনাবাহিনী ঘোষণা দেয় যে, তারা প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার খরচে ১ থেকে ২ হাজার ছোট আকৃতির ইন্টেলিজেন্স ড্রোন ক্রয় করতে যাচ্ছে।

ফিনল্যান্ডের প্রতিবেশী দেশ নরওয়ের বিমান বাহিনীর 'এফ-৩৫' স্টেলথ যুদ্ধবিমান। ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষার পিছনে বিনিয়োগের সবচাইতে বড় ঘোষণা আসে ২০২১এর ডিসেম্বরে; যখন ফিনল্যান্ড ঘোষণা দেয় যে, তারা মার্কিন ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান কিনতে যাচ্ছে।


ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষার পিছনে বিনিয়োগের সবচাইতে বড় ঘোষণা আসে ২০২১এর ডিসেম্বরে; যখন ফিনল্যান্ড ঘোষণা দেয় যে, তারা মার্কিন ‘এফ-৩৫’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান কিনতে যাচ্ছে। ‘এয়ার ফোর্স ম্যাগাজিন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, গত ১১ই ফেব্রুয়ারি ফিনল্যান্ড ৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে ৬৪টা ‘এফ-৩৫’ বিমান কেনার ব্যাপারটা নিশ্চিত করেছে। এই প্রকল্পে ফিনিস প্রতিরক্ষা শিল্প বিমানের কিছু অংশ তৈরি করবে এবং ২০২৬ থেকে শুরু করে ২০৩০ সালের মাঝে বিমানগুলির ডেলিভারি পাবে তারা। এই বিমানগুলি ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা ৫৭টা ‘এফএ-১৮’ বিমানকে প্রতিস্থাপিত করবে।

ফিনল্যান্ড ইউক্রেনকে ব্যপকভাবে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। ‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ফিনল্যান্ড তাদের যুদ্ধকালীন সামরিক সদস্যের সংখ্যাকে সাড়ে তিন লক্ষ থেকে আড়াই লক্ষে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করার কারণে প্রায় ১ লক্ষ কালাশনিকভ রাইফেল অদরকারি হয়ে পড়েছে। এই রাইফেলগুলি এখন ইউক্রেন যাচ্ছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী আনত্তি কাইক্কোনেন বলছেন যে, ইউক্রেনে রুশ হামলার পর ফিনল্যান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে উন্নয়ন করতে ইস্রাইল থেকে বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ক্রয় করতে যাচ্ছে। গত ৫ই মার্চ কাইক্কোনেন ফিনিস মিডিয়া ‘ওয়াইএলই’র সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, ‘এফ-৩৫’ যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্তের পরে এটা আরেকটা বড় খরচের খাত। ইস্রাইলের ‘আইএআই’ এবং ‘রাফায়েল’ কোম্পানি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রির জন্যে প্রতিযোগিতা করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ফিনল্যান্ডের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি বলেন যে, যদিও তাদের সীমান্ত এলাকা শান্তিপূর্ণই রয়েছে, তথাপি তাদের নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করাটা খুবই প্রয়োজন। মহামারির কারণে ফিনল্যান্ডের রিজার্ভ সেনারা তাদের ট্রেনিং থেকে বঞ্চিত হয়েছে; যা এখন নিশ্চিত করা হবে। কাইক্কোনেন দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, পশ্চিমা দেশগুলির সাথে ফিনল্যান্ডের সম্পর্ক এতটাই গভীর যে, যদি ফিনল্যান্ড আক্রান্ত হয়, তাহলে ইইউএর সদস্য দেশগুলি নিঃসন্দেহে ফিনল্যান্ডকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে। তিনি বলেন যে, ব্রিটেনের সাথে নিরাপত্তার ব্যাপারে ফিনিসরা আলোচনা করছে। এর একদিন আগেই ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তো ওয়াশিংটন সফর করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে কথা বলেন। আলোচনার মাঝেই বাইডেন সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালেনা এন্ডারসনকে ফোন করে কথা বলেন; যা ফিনল্যান্ডের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুইডেনের গুরুত্বকে তুলে ধরে। ‘ওয়াইএলই’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তারা জনমত জরিপ করে পেয়েছে যে, দেশের ৫৩ শতাংশ জনগণ ন্যাটোতে যোগদানের পক্ষে।

ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষার জন্যে নরওয়ে ও সুইডেনের উপর নির্ভরশীলতা

বাইডেন ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনার মাঝেই সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন, কারণ ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষার কথা বলতে গেলে সুইডেনের কথা আসবেই; সাথে আসবে নরওয়ের কথা। ২০২১এর সেপ্টেম্বরে ফিনল্যান্ড সুইডেনের সাথে একটা সামরিক চুক্তি করে, যার মাঝে বলা হয় যে, দুই দেশ তাদের পদাতিক বাহিনীর জন্যে যেসকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনবে, সেগুলি একে অপরের সাথে মিল রেখে কিনবে। ‘আর্মি টেকনলজি’ বলছে যে, এই চুক্তির পাঁচ মাস আগে দুই দেশ এব্যাপারে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছিল। এছাড়াও ২০২১এর জুলাই মাসে ফিনল্যান্ড ১৬ মিলিয়ন ডলার খরচে ফিনিস কোম্পানি ‘প্যাট্রিয়া গ্রুপ’এর কাছ থেকে পদাতিক সেনাদের ব্যবহৃত লেজার ও ইনফ্রারেড টার্গেটিং যন্ত্র এবং রাতের বেলায় যুদ্ধ করার জন্যে নাইট ভিশন গগলস অর্ডার করে। ‘প্যাট্রিয়া’র মালিকানার অর্ধেক ফিনিস সরকারের; বাকি অর্ধেক নরওয়ের ‘কংসবার্গ’ কোম্পানির। ‘প্যাট্রিয়া গ্রুপ’এর ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে যে, কোম্পানিটার সাথে ফিনল্যান্ডের সম্পর্ক অনেক পুরোনো এবং যথেষ্ট গভীর। ১৯৬০এর দশক থেকে ফিনল্যান্ডের নৌবাহিনীর জাহাজগুলির ডিজেল ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে তারা। ১৯৯০এর দশক থেকে ফিনিস বিমান বাহিনীর ব্যবহৃত ‘এফএ-১৮’ ফাইটার বিমান, ‘হক মার্ক৫১’ ট্রেনিং বিমান, ‘এনএইচ ৯০’ হেলিকপ্টার, ‘কাসা সি-২৯৫এম’ পরিবহণ বিমান এবং ‘গ্রোব জি-১১৫ই’ ট্রেনিং বিমানগুলিকে তারা রক্ষণাবেক্ষণ করছে। এছাড়াও ‘প্যাট্রিয়া’ ফিনল্যান্ডের বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী এবং বর্ডার গার্ডের বেসিক পাইলট ট্রেনিংএর দায়িত্বে রয়েছে। ‘প্যাট্রিয়া’র মালিকানায় থাকা ‘নাম্মো’ নামের কোম্পানি নরওয়ের সাথে যৌথভাবে গোলাবারুদ ও রকেট মোটর তৈরি করে। নরওয়ের ‘কংসবার্গ এভিয়েশন মেইনটেন্যান্স’ কোম্পানির অর্ধেক শেয়ার ‘প্যাট্রিয়া’র হাতে।

নভেম্বর ২০১৮। নরওয়েতে মহড়ায় অংশ নিচ্ছে ফিনল্যান্ডের সেনারা। ফিনল্যান্ড আজ প্রায় পুরোপুরিভাবেই পশ্চিমা সমাজের অন্তর্গত। তার সামরিক বাহিনীও পশ্চিমাদের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করছে। লিবারাল চিন্তার ফিনল্যান্ড পশ্চিমাদের যতটা কাছের, বহুকাল রুশ প্রভাবে থাকা ইউক্রেন ততটা কাছের নয়। ইউক্রেনকে পশ্চিমারা রক্ষা না করলেও ফিনল্যান্ডের প্রশ্নটা ভিন্ন; দেশটা ন্যাটোতে যোগদান করুক, আর না করুক। অর্থনৈতিক এবং সামরিক উভয় দিক থেকেই ফিনল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ রাশিয়ার জন্যে কাম্য নয়। তবে শক্তিশালী ফিনল্যান্ড বল্টিক সাগরে রুশ নৌবাহিনীকে বন্দরের মাঝে আটকে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনকে বিরাট সহায়তা দিতে পারে।


ফিনল্যান্ড - ভূকৌশলগত সজারু

ফিনল্যান্ডকে কেউ চায়নি। রাশিয়াও একসময় ফিনল্যান্ডকে গুরুত্ব দেয়নি। তবে এই পরিস্থিতি দ্রুতই পাল্টে যায়। ভূপ্রকৃতি, আবহাওয়া এবং দেশটার জনগণের যুদ্ধ করার সক্ষমতা ফিনল্যান্ডকে ভূকৌশলগত সজারুতে রূপান্তরিত করেছে; যা রাশিয়া টের পেয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। কিন্তু বল্টিক সাগরের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের উপর নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে থাকার কারণে ফিনল্যান্ডকে প্রতিবেশী রাশিয়া এড়িয়ে যেতে পারছে না। ফিনল্যান্ডের অবস্থান রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গ সমুদ্রবন্দরের জন্যে এবং রুশ জাহাজ চলাচলের জন্যে হুমকি। অপরদিকে রাশিয়ার মতো বিশাল দেশের পাশে ফিনল্যান্ডের জন্ম হবার কারণে দেশটাকে সর্বদাই হুমকির মাঝে থাকতে হয়েছে। রাশিয়া তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ফিনল্যান্ডকে অন্ততঃ তার বিপক্ষে দেখতে চায় না। রাশিয়া তার স্বার্থকে হাসিল করতে একবার ফিনল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ করেছে। তবে সেই যুদ্ধ জিততে হয়েছে বিরাট খরচের বিনিময়ে; রাশিয়া নিঃসন্দেহে সেটা ভুলেনি।

ফিনল্যান্ডের জন্মের সময় ব্রিটিশরা সহায়তা না দিলেও সাম্প্রতিককালে ব্রিটিশ এবং মার্কিনীরা নিজের রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে ফিনল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার খুঁজে পেয়েছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করেই গত পনেরো বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ন্যাটো ফিনল্যান্ডকে সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করছে; যা রাশিয়া হুমকি হিসেবে দেখেছে। তবে একইসাথে পশ্চিমা দেশগুলি বল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া ছাড়াও পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, এমনকি ইউক্রেনকেও সহায়তা দিয়েছে। এগুলির মাঝে ইউক্রেনকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রাশিয়া একেবারেই নিতে পারেনি। রাশিয়াকে হয়তো হিসেব করতে হয়েছে যে, কোন দেশটার ন্যাটোর মাঝে যাওয়াটা রাশিয়ার জন্যে অপেক্ষাকৃত বেশি হুমকির। সেই হিসেবে বল্টিক রাষ্ট্রগুলি এবং ফিনল্যান্ডের তুলনায় ইউক্রেন বড় হুমকি ছিল। একারণেই রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করেছে; বাকিগুলিকে বাদ রেখে। সেই হিসেবে ফিনল্যান্ডে রুশ হামলার সম্ভাবনা খুবই কম। অন্ততঃ ইউক্রেনে রুশ সামরিক বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর ফিনল্যান্ডের মতো আরেকটা দেশ আক্রমণ পুতিনের জন্যেও অবাস্তব ব্যাপার।

ফিনল্যান্ড আজ প্রায় পুরোপুরিভাবেই পশ্চিমা সমাজের অন্তর্গত। তার সামরিক বাহিনীও পশ্চিমাদের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করছে। লিবারাল চিন্তার ফিনল্যান্ড পশ্চিমাদের যতটা কাছের, বহুকাল রুশ প্রভাবে থাকা ইউক্রেন ততটা কাছের নয়। ইউক্রেনকে পশ্চিমারা রক্ষা না করলেও ফিনল্যান্ডের প্রশ্নটা ভিন্ন; দেশটা ন্যাটোতে যোগদান করুক, আর না করুক। তথাপি ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদান করবে কিনা, সেটা রাশিয়ার জন্যে প্রভাব ধরে রাখার প্রশ্ন। আর ফিনল্যান্ড ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ন্যাটোর উপর নিরাপত্তাগত দিক থেকে এতটাই নির্ভরশীল হয়ে গেছে যে, দেশটাকে আর পশ্চিম থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না। ফিনল্যান্ড প্রতিদিনই শক্তিশালী হচ্ছে। ভূকৌশলগত সজারু ফিনল্যান্ডকে আক্রমণ করা যেমন অবান্তর হয়ে যাচ্ছে, তেমনি পশ্চিমা ঘেঁষা ফিনল্যান্ড বল্টিক সাগরে রাশিয়ার সমুদ্রপথের নিরাপত্তাকে ক্রমেই হুমকির মাঝে ফেলে দিচ্ছে। অন্ততঃ মার্কিন ‘জেএএসএসএম’ এবং ‘হারপুন’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি রুশ জাহাজের জন্যে বিরাট হুমকি। রাশিয়ার পক্ষে তার আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখাটা ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক এবং সামরিক উভয় দিক থেকেই ফিনল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ রাশিয়ার জন্যে কাম্য নয়। তবে শক্তিশালী ফিনল্যান্ড বল্টিক সাগরে রুশ নৌবাহিনীকে বন্দরের মাঝে আটকে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনকে বিরাট সহায়তা দিতে পারে।



সূত্র –

‘Finland’ in Britannica (https://www.britannica.com/place/Finland/Plant-and-animal-life)
‘Finland Geography’ in Country Reports (https://www.countryreports.org/country/Finland/geography.htm)
‘A Frozen Hell : The Russo-Finnish Winter War of 1939-1940’ by William R Trotter (1991)
‘Finland at War: The Winter War 1939-40’ by Vesa Nenye, Peter Munter and Toni Wirtanen (2015)
‘Finland at War: The Continuation and Lapland Wars 1941-45’ by Vesa Nenye, Peter Munter, Toni Wirtanen and Chris Birks (2016)
‘The Baltic States from 1914 to 1923: The First World War and the Wars of Independence’ by Lt. Col. Andrew Parrott in Baltic Defence Review No. 8 Vol 2/2002
‘Total population of Finland from 2016 to 2021, by age group’ at Statista (https://www.statista.com/statistics/521152/population-of-finland-by-age/)
‘Raytheon delays AMRAAM deliveries to Finnish Air Force’ in Airforce Technology, 03 September 2012
‘Finland tones up its security muscles’ in Politico, 19 September 2012 (https://www.politico.eu/article/finland-tones-up-its-security-muscles/)
‘Long-Term Development Key to Sustained Air Defence Capability’ in Finnish Defence Forces (https://puolustusvoimat.fi/en/web/ilmavoimat/development_of_finlands_air_defense_capability)
‘Valmet Corporation (Valmet Oy)’ in Encyclopedia (https://www.encyclopedia.com/books/politics-and-business-magazines/valmet-corporation-valmet-oy)
‘Finland Buys One Hundred Tanks from the Netherlands’ in Atlantic Council, 22 January 2014
‘US approves $735 million sale to Finland of Harpoon anti-ship and ESSM air defense missiles’ in The Defense Post, 06 February 2018
‘Finland develops 'bounding' mine as military deterrence’ in Reuters, 08 March 2018
‘Finland has second thoughts about its women soldiers’ in BBC, 03 July 2018
‘Finland to acquire Israel’s Gabriel anti-ship missile system’ in The Defense Post, 06 July 2018
‘The Finnish Defence Forces has received the total delivery of the Main Battle Tank Leopard 2A6’ in Finnish Defence Forces, 25 October 2019 (https://maavoimat.fi/en/-/puolustusvoimat-on-vastaanottanut-kaikki-leopard-2a6-taistelupanssarivaunut)
‘Marin's Government deviated from the principle of gender equality’ in University of Helsinki, 20 December 2019 (https://researchportal.helsinki.fi/en/publications/marins-government-deviated-from-the-principle-of-gender-equality)
‘Firepower and interoperability of the Army MBTs Leopard 2 to improve’ in Finnish Defence Forces, 07 December 2021 (https://maavoimat.fi/en/-/firepower-and-interoperability-of-the-army-mbts-leopard-2-to-improve)
‘Senop to supply laser sights and image intensifiers to Finland’ in Army Technology, 08 July 2021
‘Finland and Sweden sign arrangement for joint procurement of weapons’ in Army Technology, 06 September 2021
‘Finnish government publishes defence report’ in Janes, 14 September 2021 (https://www.janes.com/defence-news/news-detail/finnish-government-publishes-defence-report)
‘Finnish Defence Forces to Upgrade Leopard 2 Main Battle Tank Fleet’ in The Defense Post, 10 December 2021
‘Finland Formalizes Deal for 64 Block 4 F-35s’ in Air Force Magazine, 11 February 2022
‘Finland buying Israeli air defence weapons’ in YLE, 05 March 2022 (https://yle.fi/news/3-12345358)
‘Today I welcomed President Niinistö of Finland to the White House to talk about European security’. (https://twitter.com/POTUS/status/1499907464623501332)
‘Audit clears Finnish F-35 buy amid rising spending on pandemic, Ukraine’ in Defense News, 28 March 2022
‘Finland to Spend $15M on New Surveillance Drones’ in The Defence Post, 12 April 2022
‘Finland and Sweden pursue unlinked NATO membership’ in Defense News, 15 April 2022
‘Patria's Successful Strategic Partnership with the Finnish Air Force’ (https://www.patriagroup.com/services/strategic-defence-partnership-concept/strategic-partnership-with-the-finnish-air-force)

Tuesday 19 April 2022

ইউক্রেনের রণক্ষেত্র কি যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের বিদায় ঘন্টা বাজাচ্ছে?

১৯শে এপ্রিল ২০২২

রুশরা ‘কম্বাইন্ড আর্মস’ অপারেশনে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু রুশরা ‘কম্বাইন্ড আর্মস’ বুঝতে পারার জন্যে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা রাখে। রুশ বাহিনী হয়তো ভেবেছিল যে, ইউক্রেনিয়ানরা যুদ্ধ করবে না; আর ইউক্রেনের যথেষ্ট সংখ্যক কর্মকর্তা হয়তো রাশিয়ার পক্ষে চলে যাবে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ট্যাংকের বিদায় এখনই হচ্ছে না। হয়তো কিছু সময়ের জন্যে ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রগুলি এগিয়ে আছে।

 
ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ সেনাবাহিনীর বড় সংখ্যক ট্যাংক ধ্বংস হবার খবরে অনেকেই চিন্তা করতে শুরু করেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ট্যাংকের বিদায় কি খুবই সন্নিকটে কিনা। বিশেষ করে পশ্চিমাদের সরবরাহকৃত ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সাফল্যের খবরে কেউ কেউ টাংকের দরকার নিয়েই প্রশ্ন করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ম্যারিন কোর ট্যাংক ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীও তাদের ট্যাংকের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমিয়ে ফেলেছে। ডাচ সেনাবাহিনী তাদের সবগুলি ট্যাংক বিক্রি করে দিয়েছে। ডাচ প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইট ‘ওরিক্স’এর স্টাইন মিতজার এবং তার দল ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে হিসেব করেছে যে, রুশরা ইউক্রেনে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২ হাজার ৯’শ ৯২টা সামরিক গাড়ি হারিয়েছে; যার মাঝে ১৫’শ ৮১টা ধ্বংস হয়েছে। অক্ষত অবস্থায় ইউক্রেনিয়ানদের হাতে পড়েছে ১১’শ ২১টা। এই সংখ্যার মাঝে ট্যাংক রয়েছে ৫’শ ১৯টা; যার মাঝে ২’শ ৬৩টা ধ্বংস হয়েছে; ২’শ ৭টা অক্ষত অবস্থায় ধরা পড়েছে। এছাড়াও ৯’শ ৬২টা অন্যান্য সাঁজোয়া যান এর মাঝে রয়েছে। এই বিরাট সংখ্যক সাঁজোয়া যানের ক্ষয়ক্ষতি কি ট্যাংকের কনসেপ্ট বাতিল হয়ে যাবার কারণে, নাকি রুশদের অক্ষমতার কারণে?

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’র ডিরেক্টর পল সার ‘বিজনেস ইনসাইডার’কে বলছেন যে, তার ধারণা, ট্যাংক ভবিষ্যৎ যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের ভূমিকা থেকে পিছনের ভূমিকায় চলে যাবে। রাশিয়ার সাথে কোন সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ যুদ্ধে ন্যাটোর উচিৎ হবে দূরপাল্লার আর্টিলারি এবং ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ট্যাংকগুলিকে ঘায়েল করে এরপর নিজেদের ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হওয়া। ইতিহাসবিদ জেরেমি ব্ল্যাক তো মনে করছেন যে, ভবিষ্যতে ট্যাংক আকাশে এবং ভূমিতে মনুষ্যবিহীন ড্রোনের জন্যে মাদারশিপ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। ট্যাংককে ঘায়েল করার অস্ত্রগুলি যত শক্তিশালী হচ্ছে, ট্যাংক ততই ছোট ভূমিকায় চলে যাচ্ছে।

তবে অনেকেই এই যুক্তির সাথে একমত নন। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক স্কট বস্টন ‘ইয়াহু নিউজ’কে বলছেন যে, ট্যাংকের দিন যে শেষ হয়ে যায়নি, তা সবচাইতে বড় প্রমাণ হলো, ইউক্রেনিয়ানরা এখন পশ্চিমাদের কাছ থেকে ট্যাংক চাইছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি আবেদন করেছেন যাতে পশ্চিমারা তাদের ২০ হাজার ট্যাংকের মাঝ থেকে ১ শতাংশ ইউক্রেনকে দিয়ে দেয় বা ইউক্রেনের কাছে বিক্রি করে। তবে ইউক্রেনে রুশ ট্যাংক ধ্বংস হয়েছে বেশি কারণ রাশিয়া আক্রমণে রয়েছে। ইউক্রেন যখন আক্রমণে যাবে, তখন ইউক্রেনেরও অনেক ট্যাংক ধ্বংস হবার খবর আসবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ইউক্রেনের সেনারা রুশদের সাপ্লাই লাইনে হামলা করছে। যেকারণে রুশ ট্যাংক ইউনিটগুলি সময়মতো জ্বালানি পাচ্ছে না। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, অনেক রুশ ট্যাংক তাদের সেনারা অক্ষত অবস্থায় ফেলে রেখে গিয়েছে, যেগুলি ইউক্রেনের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বস্টন বলছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক সেনাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে বর্মাবৃত পরিবহণ প্রয়োজন। আর অপরদিকে পদাতিক সেনারা ট্যাংকগুলিকে রক্ষা করে। এখানেই ‘কম্বাইন্ড আর্মস’এর চিন্তাটার বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটা না হলে যুদ্ধক্ষেত্রে অন্য সকল জিনিসের মতো ট্যাংকও অদরকারি হয়ে যাবে।

মার্কিন সেনাবাহিনীর ‘ওয়েস্ট পয়েন্ট’ একাডেমির শিক্ষক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডেভিড জনসন ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’এর প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রক্স’এর এক লেখায় ট্যাংকের ইতিহাস ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধই প্রথমবার নয় যে, ট্যাংকের বিদায়ঘন্টা নিয়ে অনেকে কথা বলেছেন। এর আগে ১৯৭৩ সালে রুশ ‘স্যাগার’ ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে ইস্রাইলের ট্যাংকগুলি বাতিল মনে হয়েছিল। ২০০৬ সালে লেবাননে হিযবুল্লাহর হাতে রুশ ‘কর্নেট’ ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা ইস্রাইলি ‘মেরকাভা’ ট্যাংক ধ্বংস হবার পরেও একই কথা বলা হয়েছিল। বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক ব্যবহারের কৌশলটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা ডেভেলপ করেছিল; যেখানে ট্যাংক এবং যুদ্ধবিমান একত্রে একটা ইউনিট হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে গতি নিয়ে এসেছিল। ১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ‘ইয়োম কিপ্পুর’ যুদ্ধে ইস্রাইলের বিমানগুলিকেও বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়েছিল; যেকারণে তাদের বিমানগুলি ট্যাংকগুলিকে সহায়তা দিতে পারেনি। তবে ইস্রাইলিরা ‘স্যাগার’ ক্ষেপণাস্ত্রের সমাধান বের করেছিল। মর্টার, আর্টিলারি এবং পদাতিক সেনা শত্রুপক্ষের ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ঘায়েল করে ফেলে ট্যাংকগুলিকে রক্ষা করেছে। আর ২০০৬ সালে লেবাননের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ইস্রাইলিরা ট্যাংককে সুরক্ষা দিতে ‘ট্রফি’ নামে ‘একটিভ প্রোটেকশন সিস্টেম’ ডেভেলপ করে; যার মাধ্যমে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র ট্যাংকে আঘাতের আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এবং আকাশ থেকে মনুষ্যবিহীন ড্রোন ট্যাংকের উপর থেকে আক্রমণ করছে, যে অংশটায় বর্ম সবচাইতে কম থাকে। এটার সমাধান এখনও কেউ দিতে পারেনি। কর্নেল জনসন বলছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের শুরুতেই প্রশ্ন করতে হবে যে, পদাতিক সেনাদেরকে বর্ম দিয়ে রক্ষা করার প্রয়োজনটা এখনও রয়েছে কিনা। যদি সেটা থাকে, তাহলে ট্যাংক থাকবে।

মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল এইচ আর ম্যাকমাস্টার ‘বিজনেস ইনসাইডার’কে বলছেন যে, তিনি মনে করেন না যে, যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক বাহিনীকে সহায়তা দিতে কাছে থেকে গোলা নিক্ষেপের চাহিদাটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কোন একটা অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত এনে দিতে পারে না। শহুরে অঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা বাহিনীর বিরুদ্ধে সাফল্য পেতে হলে কমান্ডারকে পদাতিক সেনার সাথে ট্যাংক, আর্টিলারি এবং বিমানের সমন্বয় সাধন করতে হবে। ম্যাকমাস্টারের ধারণা, রুশরা ‘কম্বাইন্ড আর্মস’ অপারেশনে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। তবে ‘আমেরিকান মিলিটারি ইউনিভার্সিটি’র ‘এজ’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা ওয়েস ও’ডনেল মনে করছেন যে, একটা সামরিক বাহিনী ‘কম্বাইন্ড আর্মস’এ পারদর্শী হলে তাদের কাছে ট্যাংকের গুরুত্ব থাকবে। রুশরা ‘কম্বাইন্ড আর্মস’ বুঝতে পারার জন্যে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা রাখে। আর তাদের প্রযুক্তিও বেশ ভালো। হয়তো এখানে অন্য কোন কারণ থাকতে পারে। ‘র‍্যান্ড’এর স্কট বস্টন বলছেন যে, ইউক্রেনে রুশ বাহিনী হয়তো ভেবেছিল যে, ইউক্রেনিয়ানরা যুদ্ধ করবে না; আর ইউক্রেনের যথেষ্ট সংখ্যক কর্মকর্তা হয়তো রাশিয়ার পক্ষে চলে যাবে। একারণেই রুশরা হয়তো তাদের পরিকল্পনা করার সময়ে ভুল করেছে। যে ব্যাপারটায় সকলেই একমত তা হলো, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ট্যাংকের বিদায় এখনই হচ্ছে না। হয়তো কিছু সময়ের জন্যে ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রগুলি এগিয়ে আছে।