Monday 12 February 2024

মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় দুর্যোগ – প্রতিবেশী বাংলাদেশের সামনে অপশন

১২ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের হাতে আটক হওয়া অকটেন এবং সয়াবিন তেলের বিশাল চালান। চোরাচালানের ধরণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, রাখাইনের এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলি লজিস্টিক্যাল সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে সরকারের কাছ থেকে দখল করা যানবাহণ চালাবার জন্যে পেট্রোল বা অকটেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং নৌযান চালানোর জন্যে ব্যবহৃত ডিজেল এবং বিদ্রোহী সেনাদের খাবার রান্নার জন্যে খাবার তেল এবং মসলা-জাতীয় পণ্যের সরবরাহের ব্যাপক ঘাটতি দৃশ্যমান।


তেল, পিঁয়াজ, আদা, রসুন!

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্তে গোলাগুলি, গুলিতে হতাহত মানুষ, সীমান্ত ছাড়িয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টার ও রকেট, শতশত মিয়ানমার সামরিক সদস্যের বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বা বিজিবির কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ, বিজিবির হাতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বেসামরিক ব্যাক্তির গ্রেপ্তার, ইত্যাদি সংবাদ হেডলাইন হয়েছে। তবে অপেক্ষাকৃত কম জানাজানি হয়েছে মিয়ানমার সীমান্তে চোরাচালানের ধরণ পরিবর্তনের গল্প। যে ব্যাপারটা এতকাল জানাই ছিলো তা হলো, মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে ইয়াবা, গাঁজা, ক্রিস্টাল মেথ ইত্যাদি মাদক। আর এর পেমেন্ট হয় ভারতের সাথে কুষ্টিয়া ও যশোর সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণের মাধ্যমে। তবে এবার মিয়ানমারের মাদকের পেমেন্ট দেয়া হচ্ছে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়েই – বিভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে। এই পণ্যের মাঝে প্রথমেই রয়েছে জ্বালানি তেল (অকটেন এবং ডিজেল), খাবার তেল (সয়াবিন), এবং আরও কিছু মসলা-জাতীয় খাবার; যেমন পিঁয়াজ, আদা, রসুন। ডিসেম্বর-জানুয়ারির মাঝে একমাসে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে সাড়ে ৭ টনের বেশি অকটেন এবং প্রায় ৪ টনের মতো সয়াবিন তেল। গত ২৫শে ডিসেম্বর একদিনে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের হাতে ধরা পড়েছে ১৮'শ লিটার অকটেন, ৩৭'শ লিটার সয়াবিন তেল এবং ১'শ ৩৬ লিটার ডিজেল।

এই মালামালগুলি মিয়ানমারে কাদের হাতে যাচ্ছে? মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপির ৩'শ ৩০ জন সদস্যের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার কাহিনীই বলে দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত এখন কাদের দখলে। মিয়ানমারের সরকারি এই সেনারা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে পালাতে পারেনি; তাই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। আর তাদের সংখ্যা বলে দিচ্ছে যে, বিদ্রোহী গ্রুপের সামরিক শক্তি কতটুকু। তবে একইসাথে চোরাচালানের ধরণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, রাখাইনের এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলি লজিস্টিক্যাল সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে সরকারের কাছ থেকে দখল করা যানবাহণ চালাবার জন্যে পেট্রোল বা অকটেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং নৌযান চালানোর জন্যে ব্যবহৃত ডিজেল এবং বিদ্রোহী সেনাদের খাবার রান্নার জন্যে খাবার তেল এবং মসলা-জাতীয় পণ্যের সরবরাহের ব্যাপক ঘাটতি দৃশ্যমান। ব্যাপারটা এমন নয় যে, রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই ঘাটতিগুলি ছিল না। বরং মিয়ানমার সরকার নিজস্ব লজিস্টিকস ব্যবস্থায় এই ঘাটতিগুলি পূরণ করতে পারতো। বিদ্রোহীরা রাখাইনের বড় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিলেও লজিস্টিকসের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই; যা কিনা যুদ্ধের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।

রাখাইনে বিদ্রোহী গ্রুপের হাতে দখল হওয়া সেনাবাহিনীর বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। যেকোন সশস্ত্র বিদ্রোহ বা ইনসার্জেন্সিকে এগিয়ে নিতে হলে যে শর্তগুলি পূরণ আবশ্যকীয়, তার মাঝে একটা হলো বাইরের কোন শক্তির সমর্থন। এই সমর্থন হতে হবে রাজনৈতিক, সামরিক, আর্থিক এবং লজিস্টিক্যাল। বাইরের সমর্থন ছাড়া যেকোন সশস্ত্র সংগ্রাম বেশিদূর এগুতে পারে না।




সশস্ত্র বিদ্রোহ বা ইনসার্জেন্সির স্বরূপ

যেকোন সশস্ত্র বিদ্রোহ বা ইনসার্জেন্সিকে এগিয়ে নিতে হলে যে শর্তগুলি পূরণ আবশ্যকীয়, তার মাঝে একটা হলো বাইরের কোন শক্তির সমর্থন। এই সমর্থন হতে হবে রাজনৈতিক, সামরিক, আর্থিক এবং লজিস্টিক্যাল। বাইরের সমর্থন ছাড়া যেকোন সশস্ত্র সংগ্রাম বেশিদূর এগুতে পারে না। একারণেই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি হয় বাইরের সমর্থনে সংগ্রাম শুরু করে অথবা কোন এক সময় বাইরের সমর্থন খোঁজে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন বিদ্রোহীদেরকে কোণঠাসা করে ফেলতে উদ্যত হয়, তখন বিদ্রোহীরা বাইরের, বিশেষ করে রাষ্ট্রের সীমান্তের সাথে লাগোয়া অন্য রাষ্ট্রগুলির সমর্থন চায়। সেই রাষ্ট্র হয় জাতিরাষ্ট্রের সীমানার কনসেপ্টকে মেনে চলে অথবা সেটাকে ভেঙ্গে ফেলে। ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফালিয়ান চুক্তির আওতায় লিপিবদ্ধ করা জাতিরাষ্ট্রের কনসেপ্টগুলির একটা হলো, একটা রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সীমানাকে মেনে চলবে এবং সেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।

এই কনসেপ্টগুলি অনুযায়ী জাতিরাষ্ট্রের বাউন্ডারিগুলি আজও পরিচালিত হলেও নিয়মগুলিকে নিয়মিতই বাঁকানো হয়েছে। তবে সেটা মূলতঃ সম্ভব হয়েছে জাতিরাষ্ট্রের কনসেপ্টগুলিকে লালন-পালন করা শক্তিশালী দেশগুলির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির মদদ ছাড়া বাকি রাষ্ট্রগুলি জাতিরাষ্ট্রের কনসেপ্টগুলিকে বাঁকানোর সাহস করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উসমানি খিলাফত থেকে আলাদা হবার জন্যে আরবদেরকে সামরিক সহায়তা দিয়েছিল ব্রিটেন। 'লরেন্স অব এরাবিয়া' নামে মুভি তৈরি করে এই ব্যাপারটাকে পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা দেয়া হয়েছিলো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময় ভারতের পিছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ এবং ব্রিটেনের পরোক্ষ মদদ ছিলো। ১৯৮০এর দশকে আফগান মুজাহিদদের সহায়তা দেয়া পাকিস্তানের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের মদদ ছিলো। শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহীদের ভারতীয় সমর্থনের পিছনে ইউরোপিয়দের মদদ ছিলো। ভিয়েতনাম যুদ্ধে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিদ্রোহীদের পিছনে উত্তর ভিয়েতনামের সরাসরি সমর্থন সম্ভব হয়েছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে। ১৯৬০এর দশকে নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা বিদ্রোহীদেরকে বড় কোন রাষ্ট্র সরাসরি মদদ না দিলেও ক্যাথোলিক সংগঠনগুলির মাধ্যমে পরোক্ষ মদদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড এবং আরও কিছু দেশ।

তবে এক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী দেশগুলির অবস্থান হয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সীমান্ত হলো লজিস্টিক্যাল সহায়তা পাবার একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এছাড়াও রাষ্ট্রের যদি সমুদ্রসীমা থাকে, তাহলে বিদ্রোহীরা সেই সমুদ্রসীমা ব্যবহার করেও লজিস্টিক্যাল সহায়তা পেতে পারে। যেমন, শ্রীলংকার তামিল বিদ্রোহীরা গভীর সমুদ্রে অবস্থান করা জাহাজ থেকে ছোট ছোট বোটে করে সাপ্লাই আনার ব্যবস্থা করতো। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে বিমান পথেও এটা সম্ভব। যেমন, বায়াফ্রা যুদ্ধের সময় নাইজেরিয়ার সামরিক বাহিনী বায়াফ্রা অঞ্চলের সমুদ্রসীমা দখলে নিয়ে নিলে বিমানের মাধ্যমে সহায়তা দেয়া হতো। এতে সাপ্লাই নিয়ে অবতরণের সময় নাইজেরিয় বাহিনীর গুলিতে বহু পরিবহণ বিমান ভূপাতিত হয়েছিল।



মিয়ানমারের ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহগুলির বেশিরভাগই অনেক পুরোনো। এই লেখার উদ্দেশ্য নয় এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ। বরং এখানে যে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, বিদ্রোহী গ্রুপগুলির কে কার কাছ থেকে রাজনৈতিক এবং লজিস্টিক্যাল সহায়তা পাচ্ছে, সেটা খুঁজে দেখা। কারণ এই সহায়তা দেয়ার পিছনে একটা রাষ্ট্রের কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হয়। মিয়ানমার একটা কৃত্রিম রাষ্ট্র; যা ব্রিটিশরা তৈরি করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। এই রাষ্ট্রের বাউন্ডারিগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে করে আশেপাশের রাষ্ট্রগুলির সাথে এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। মিয়ানমারের আয়তন বিশাল; কিন্তু সীমান্তবর্তী এলাকার সাথে রাজধানী এবং এর আশেপাশের এলাকাগুলির যোগাযোগ দুর্গম। দেশের একটা বড় অঞ্চল বনভূমি এবং পাহাড়ি; যার মাঝ দিয়ে গিয়েছে প্রচুর নদনদী। প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে মিয়ানমারে সারাবছর ধরে স্থল পরিবহণ বেশ কঠিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিয়ানমার ছিল জাপানি বাহিনীর সাথে ব্রিটিশ এবং তার মিত্রদের একটা ফ্রন্ট। প্রায় চার বছর ধরে মিয়ানমারে যুদ্ধ চলেছে। যুদ্ধে শত্রুর গুলির চাইতে বেশি সেনা হতাহত হয়েছে মিয়ানমারের বৈরী পরিবেশের কারণে। এটা সবচাইতে খারাপ যুদ্ধক্ষেত্রগুলির মাঝে একটা বলে ইতিহাতে পরিচিত। উভয় পক্ষই দুই লক্ষাধিক সেনা হারিয়েছে। আর বার্মিজরা হারিয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ।


রাখাইন প্রদেশের লজিস্টিক্যাল বাস্তবতা

মিয়ানমারের বাকি অংশ থেকে আরাকান বা রাখাইন ভৌগোলিকভাবে আলাদা। এর কারণ হলো আরাকান পর্বত; যা কিনা হিমালয়ের একটা শাখা। প্রায় সাড়ে ৯'শ কিঃমিঃ লম্বা এই পর্বতের সর্বোচ্চ উচ্চতা ১০ হাজার ফুট। এই পর্বতের মাঝ দিয়ে যাবার রাস্তা মাত্র দু'টা। মূলতঃ এই দু'টা রাস্তার মাধ্যমেই রাখাইন রাজ্য বাকি মিয়ানমারের সাথে যুক্ত। রাজধানী নে-পি-দো থেকে সড়কপথে রাখাইনের মূল শহর সিতওয়ে (প্রাক্তন আকিয়াব) যাওয়া যায় এই দুই পথের একটা দিয়ে। সাধারণ হিসেবে সাড়ে ৬'শ কিঃমিঃ এই রাস্তা পাড়ি দিতে ১৪ ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। প্রাক্তন রাজধানী রেঙ্গুন (যা ১ হাজার কিঃমিঃ দূরে) থেকে সড়কপথে সিতওয়ে আসতে লাগে কমপক্ষে সাড়ে ১৮ ঘন্টা। এর মাঝে আবার রাখাইন রাজ্যে রয়েছে বড় কয়েকটা নদী; যেগুলির উপর দিয়ে সেতুর সংখ্যা সীমিত। এই দুর্গম পরিবহণ ব্যবস্থার কারণে রাখাইনের সাথে বাকি মিয়ানমারের মূল যোগাযোগ হয় সমুদ্রপথে। রাখাইনের রয়েছে ৪'শ কিঃমিঃএর বেশি লম্বা সমুদ্রতট; যেখানে রয়েছে কয়েকটা সুমুদ্রবন্দর। রাখাইনের সিতওয়ে এবং কিউকপিউ বন্দরে জাহাজ আসে রেঙ্গুন থেকে। মাঝে মাঝে জাহাজগুলি নাফ নদী দিয়ে মংডু পর্যন্তও যায়। এসব কারণেই ১৯৯০এর দশক থেকে মিয়ানমার তার নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে সক্রিয় হয়েছে। আন্তর্জাতিক অবরোধ এবং নিজস্ব সামরিক ইন্ডাস্ট্রির সক্ষমতার কারণে মিয়ানমার তার নৌবাহিনীর বেশিরভাগ জাহাজ নিজেরাই তৈরি করেছে। রাখাইন রাজ্যকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই নৌসক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সেনা এবং রসদ পরিবহণ করার জন্যে মিয়ানমার নৌবাহিনীর ৮টার মতো পুরোনো সেনা পরিবহণ এবং ৫টা মালামাল পরিবহন জাহাজ রয়েছে। এই জাহাজগুলি রাখাইনের বন্দরগুলিতে ভিড়তে পারে। তবে বন্দরের বাইরে সমুদ্রতট ব্যবহার করে রসদ নামাবার জন্যে মিয়ানমার নৌবাহিনীর হাতে রয়েছে পুরোনো ১০টা ল্যান্ডিং ক্রাফট; এবং ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মাঝে নিজেদের দেশে তৈরি করা ২৬টা ল্যান্ডিং ক্রাফট। নতুন ২৬টা ল্যান্ডিং ক্রাফট একত্রে ৬৪টা সাঁজোয়া যান বহণে সক্ষম। তবে রাখাইনকে নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমারের সবচাইতে বড় পদক্ষেপ ছিল প্রায় ১৫ হাজার টনের বিশাল উভচর যুদ্ধজাহাজ 'মোয়াত্তামা'। ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অবরোধকে হাসিঠাট্টার খোরাক বানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু রাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়া এই জাহাজটা মিয়ানমারকে হস্তান্তর করে। এই জাহাজ একসাথে ৩৫টার মতো সামরিক গাড়ি, সাড়ে ৩'শ সেনা এবং ২টা ল্যান্ডিং ক্রাফট বহণ করে। তবে স্বল্প দূরত্বের জন্যে এই জাহাজ আরও অনেক বেশি সেনা বহণ করতে পারে। সেনা এবং রসদ বহণের সক্ষমতা ছাড়াও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর হাতে রয়েছে ৫টা ফ্রিগেট, ৩টা কর্ভেট, ৪টা ওপিভি; যেগুলি দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রে টহল দিতে সক্ষম। এর বাইরেও তাদের রয়েছে উপকূলের কাছাকাছি টহল দেয়ার মতো বহু ছোট ছোট প্যাট্রোল বোট। এই জাহাজগুলি অন্ততঃ কাগজে কলমে হলেও রাখাইনের উপকূলকে অবরোধ দেয়ার সক্ষমতা রাখে। রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির সমুদ্রপথে বাইরে থেকে সহায়তা পেতে হলে মিয়ানমার নৌবাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে হবে। আর সেটা কষ্টকর হলে রাখাইনের সাথে যে দেশগুলির স্থল সীমান্ত রয়েছে, সেই দেশগুলির সরাসরি বা পরোক্ষ সহায়তা চাইবে। কারণ আরাকান পর্বত পারি দিয়ে মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল ঘুরে রাখাইনে খুব কমই রসদ আসা সম্ভব। আর বাস্তবতা হলো, রাখাইনের সাথে স্থলসীমান্ত রয়েছে শুধুমাত্র বাংলাদেশের। উত্তরে বাংলাদেশ, পূর্বে আরাকান পর্বত, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর – এর মাঝেই হলো রাখাইন।

রাখাইনের কিউকপিউ-তে চীন একটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে; যেখানে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা তেলের জাহাজগুলি তেল খালাস করবে এবং এই তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে পৌঁছাবে। এর ফলে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত মালাক্কা প্রণালিকে বাইপাস করে চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করতে পারবে। যদিওবা এর পরিমাণ চীনের চাহিদার তুলনায় তেমন কিছুই নয়; তথাপি 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতার মাঝে এর গুরুত্ব যথেষ্ট। চীন এই প্রকল্পগুলি হাতে নেবার পর থেকেই রাখাইনে গণহত্যা শুরু হয়েছে এবং এর স্বাভাবিক ফলাফল হলো সশস্ত্র বিদ্রোহ; যা এখন চীনা প্রকল্পগুলিকে হুমকির মাঝে ফেলেছে। 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতাতে চীনকে 'ব্যাকফুটে' রাখতে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে যাতে করে বাংলাদেশ তার নীতি পরিবর্তন করে রাখাইনের বিদ্রোহীদের লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট নিশ্চিত করে; অথবা অন্ততঃ নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে সীমানার কিছু অংশ ইয়াবার বিনিময়ে জ্বালানি তেলের বাণিজ্যকে চলতে দেয়। বলাই বাহুল্য যে, এতে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ হতে বাধ্য।


রাখাইনের জাতীয়তাবাদ এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

রাখাইন রাজ্যে রয়েছে বহু উগ্র জাতীয়তাবাদী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শুধু ১৯৪২ সালেই রাখাইনের জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের হাতে প্রায় ৪০ হাজার মুসলিম নিহত হয়। ১৯৭০-এর দশকে একবার; ১৯৯০এর দশকে আরেকবার; এবং ২০১৬এর পর থেকে রাখাইনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর পাশবিক হামলার সময় এই জাতীয়তাবাদীরা সরাসরি অংশ নেয় এবং মুসলিমদের ধনসম্পদ দখলে যথেষ্ট পারদর্শীতা দেখায়। সেসময় অবশ্য বিশ্বব্যাপী রাখাইনের মুসলিমদের পক্ষে খুব কমই সহমর্মীতা দেখা গিয়েছিল। জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, থাইল্যান্ডের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলি মিয়ানমারকে পৃথিবীর সবচাইতে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ-কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিলো। কথাসর্বস্ব সহমর্মীতাকে ছাপিয়ে মিয়ানমারে মার্কিন-সমর্থিত গণতন্ত্রকামীদের ক্ষমতায় নিয়ে আসাটা বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। চীনের সীমান্ত রাষ্ট্র মিয়ানমারে একটা মার্কিন-সমর্থিত রাষ্ট্রের অবস্থান ভূরাজনৈতিক দিক থেকে হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ। সেসময় কেউই রাখাইনের মুসলিমদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়নি; কারণ এতে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টাটা পিছিয়ে যেতে পারে। ১৯৯১ সালে মার্কিন-সমর্থিত গণতন্ত্রী নেতা অং সান সু-কি-কে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার পর সু-কি তার পুরষ্কারকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগান ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক আদালতে। রাখাইনের মুসলিমদের উপর গণহত্যার ব্যাপারটাকে তিনি কতটা সুন্দরভাবে সমর্থন দিয়েছেন, তা ইতিহাস হয়ে রয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আবারও ক্ষমতা দখল করলে যে গণতান্ত্রিক বিদ্রোহ শুরু হয়, সেই বিদ্রোহের পক্ষে পশ্চিমা দেশগুলিকে বেশ সোচ্চার দেখা গেছে। অর্থাৎ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পাশবিকতা নয়, বরং পশ্চিমা দেশগুলির স্বার্থই ঠিক করেছে যে মিয়ানমারের কোন ব্যাপারটা সকলে গুরুত্ব দেবে।

জন্মের পর থেকে সাত দশক ধরে মিয়ানমারের বহু রাজ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে। এই বিদ্রোহগুলিকে সমর্থ দিচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলি। মিয়ানমারের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরেই দেশটার স্থলসীমানার বিশাল অংশ মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না; এখনও নেই। এই অঞ্চলগুলি শাসন করে বিদ্রোহী গ্রুপগুলি। এদের রয়েছে নিজস্ব অর্থনীতি, সামরিক বাহিনী এবং আইন ব্যবস্থা। অর্থাৎ মানচিত্রের মিয়ানমার, আর বাস্তবিক মিয়ানমার এক নয়। শক্তিশালী দেশগুলি, বিশেষ করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন মিয়ানমারের অঞ্চলটাতে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতেই প্রচুর সম্পদশালী এই দেশটার এমন অবস্থা করে রেখেছে। রাখাইনে বরং এরূপ সশস্ত্র বিদ্রোহ নতুন; কারণ রাখাইন চীনের সীমানায় নয়। রাখাইনের গুরুত্ব বাড়তে থাকে যখন রাখাইনের উপকূলে গ্যাসের খনি আবিষ্কৃত হয়। ২০১৩ সালে এই খনি থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের কুনমিং প্রদেশে গ্যাস রপ্তানি শুরু হয়। একইসাথে রাখাইনের কিউকপিউ-তে চীন একটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে; যেখানে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা তেলের জাহাজগুলি তেল খালাস করবে এবং এই তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে পৌঁছাবে। এর ফলে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত মালাক্কা প্রণালিকে বাইপাস করে চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করতে পারবে। যদিওবা এর পরিমাণ চীনের চাহিদার তুলনায় তেমন কিছুই নয়; তথাপি 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতার মাঝে এর গুরুত্ব যথেষ্ট। চীন এই প্রকল্পগুলি হাতে নেবার পর থেকেই রাখাইনে গণহত্যা শুরু হয়েছে এবং এর স্বাভাবিক ফলাফল হলো সশস্ত্র বিদ্রোহ; যা এখন চীনা প্রকল্পগুলিকে হুমকির মাঝে ফেলেছে।

রাখাইনে সশস্ত্র বিদ্রোহ সেখানে ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ চীনা প্রকল্পগুলির প্রতি সরাসরি হুমকি। সেখানে যেকোন প্রকারের অরাজকতা এবং নাশকতা চীনকে বিচলিত করবে এবং 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতায় চীনকে চাপের মাঝে ফেলবে। রাখাইনের ভৌগোলিক বাস্তবতায় সেখানকার বিদ্রোহীদের বাংলাদেশের স্থলসীমানার উপর নির্ভর করা ছাড়া খুব বেশি অপশন নেই। কারণ সমুদ্রপথ মিয়ানমার নৌবাহিনীর দখলে। বাংলাদেশ হলো রাখাইনের সবচাইতে কাছের ভূমি যেখানে যেকোন লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট পাওয়া সম্ভব; অন্ততঃ কাগজে-কলমে হলেও। এই কাগজে-কলমের ব্যাপারটা বাস্তবে রূপ পাবে কিনা, সেটা নির্ভর করবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র-নীতির উপর। 'গ্রেট পাওয়ার' প্রতিযোগিতাতে চীনকে 'ব্যাকফুটে' রাখতে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে যাতে করে বাংলাদেশ তার নীতি পরিবর্তন করে রাখাইনের বিদ্রোহীদের লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট নিশ্চিত করে; অথবা অন্ততঃ নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে সীমানার কিছু অংশ ইয়াবার বিনিময়ে জ্বালানি তেলের বাণিজ্যকে চলতে দেয়। বলাই বাহুল্য যে, এতে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ হতে বাধ্য। আবার পশ্চিমারা এটাও চাইছে যে, রাখাইনের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা যে সেখানকার সকল মুসলিমকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে চাইছে, সেই ব্যাপারটাও বাংলাদেশ যেন 'নরম' দৃষ্টিতে দেখে; অর্থাৎ এই উগ্র জাতীয়তাবাদীদেরকে বাংলাদেশ যেন 'মুসলিম-বিদ্বেষী' বলে আখা না দেয়। কাজেই রাখাইনের অস্থিরতা মূলতঃ চীন এবং বাংলাদেশকে কেন্দ্র করেই।



................................................


সূত্রঃ 



'মাদকের বিনিময়ে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে তেল, চাল, ডাল!’, সময় টিভি, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪,

‘Rise in fuel, edible oil smuggling to Myanmar prompts urgent action in Cox's Bazar’, The Business Standard, 17 January 2024

‘One held with 1,500 litres of oil while smuggling to Myanmar’, Dhaka Tribune, 13 December 2023

‘Waging Insurgent Warfare: Lessons from the Vietcong to the Islamic State’ by Seth G. Jones, 2017

‘War of the Flea: The Classic Study of Guerilla Warfare’ by Robert Taber, 2002

‘The Evolution of a Revolt’ by T E Lawrence, Army Quarterly and Defence Journal, October 1920

‘Out of the Mountain: The Coming Age of the Urban Guerilla’ by David Kilcullen, 2013

‘Afghanistan the Bear Trap: The Defeat of a Superpower’ by Mohammad Yousaf and Mark Adkin, 2001

‘The World was Going Our Way: The KGB and the Battle for the Third World’ by Christopher Andrew and Vasili Mitrokhin, 2005

‘Biafra: The Nigerian Civil War 1967-1970’ by Peter Baxter, 2019

‘Defeat into Victory’ by Field Marshal Sir William Slim, 1956

‘BGB takes 100 fleeing Myanmar border guards to Teknaf’ in BDNews24, 08 February 2024

‘Myanmar rebel group claims control of India border town’ in BBC, 15 January 2024

‘Myanmar Gives China Green Light to Proceed with Strategic Seaport’ in The Maritime Executive, 31 December 2023

‘Why is Myanmar’s new deep-sea port such hot property?’ in The Interpreter, Lowy Institute, 22 November 2023