Wednesday 28 September 2022

ইরানে সহিংসতার ঝড়… শুধুই হিজাব বিতর্ক, না অন্য কিছু?

২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অনেকদিন ধরেই নাজুক। পশ্চিমা অবরোধের কারণে ইরানে অনেক পণ্যই দুর্লভ। স্থবির অর্থনীতির কারণে বেকারত্ব পরিস্থিতি চরমে উঠেছে; দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে অনেকগুলি বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সরকার শক্তহাতে বিক্ষোভ দমন করেছে। অর্থাৎ জনগণের সমস্যাগুলির সমাধান হয়নি। মাহসা আমিনিই ইরানের জনগণের রাস্তায় বিক্ষোভের একমাত্র কারণ নয়; হিজাব তো নয়ই।

মাহসা আমিনি নামে ইরানের ২২ বছর বয়সী এক মহিলা ইরানের ‘নৈতিক পুলিশ’এর হাতে গ্রেপ্তার হবার পর তাদের জিম্মায় থাকার সময় নিহত হওয়ায় সারা ইরান জুড়ে বিক্ষোভ চলছে। কমপক্ষে ৪১ জনের মৃত্যুর খবর ইরানের মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। যদিও অনেকেই এই সংখ্যাকে অনেক বেশি বলে বলছেন। পশ্চিমা মিডিয়াগুলি বলছে যে, আমিনি ‘সঠিক পোষাক’ না পড়ায় ইরানের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। অনেক প্রতিবেদনেই এখানে হিজাব পড়ার ব্যাপারটাকে তুলে আনা হয়। অর্থাৎ আমিনি হিজাব পড়ার সময় তার মাথার চুল কিছুটা বের হয়ে ছিল বলে পশ্চিমা মিডিয়ার খবরে বলা হয়; যা কিনা তার অপরাধ ছিল। কিন্তু অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ইরানের মহিলারা অনেকেই হিজাব পড়ার সময় চুল বের করে রাখেন; যেসব ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হয় না। একারণে ইরানের এই বিক্ষোভ কি আসলে হিজাব নিয়ে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এখানে রাজনৈতিক ইস্যুগুলিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকেই।

২০১৮ সাল থেকে ইরানের মহিলারা স্টেডিয়ামে খেলা উপভোগ করতে পারছে বলে বলছে পশ্চিমা বার্তা সংস্থাগুলি। সেবছরের জুন মাসে স্পেনের সাথে ফুটবল খেলা উপভোগ করতে তেহরানের আজাদি স্টেডিয়ামে ৪ হাজার মহিলাকে ঢুকতে দেয়া হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে মহিলারা স্টেডিয়ামে খেলা উপভোগ করছেন; যেখানে নিজেদেরকে কঠোরভাবে ঢেকে চলার নিয়ম বেশ খানিকটাই উপেক্ষিত। মাত্র কিছুদিন আগেও ২৫শে অগাস্ট ‘সিএনএন’এর খবরে বলা হয় যে, তেহরানের স্টেডিয়ামে শ’পাঁচেক মহিলা তেহরানের ‘এস্তেঘলাল এফসি’র খেলা দেখার জন্যে স্টেডিয়ামে গিয়েছেন। স্টেডিয়ামে মহিলা দর্শকদের ছবিগুলিই বলে দেয় যে, ইরানে হিজাবের নিয়ম ততটা কঠোর নয়, যতটা কঠোর বলে পশ্চিমা মিডিয়া আমিনির হত্যাকান্ডের পর প্রচার করেছে।

২০২২এর ফেব্রুয়ারি মাসে তেহরানে ভারতীয় দূতাবাসের বাইরে স্বল্প কিছুসংখ্যক ছাত্রছাত্রী প্লাকার্ড হাতে ভারতের কর্ণাটকে মহিলাদের হিজাব পড়ার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। তারা বলে যে, হিজাব পড়তে না দেয়াটা মানুষের মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক এবং একইসাথে তা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপ্রসূত। এই প্রতিবাদের খবরটা ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘ফারস নিউজ’ এবং ‘প্রেস টিভি’তে প্রচার করা হয়। প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিবিদ ভিভেক কাটজু ‘ফার্স্টপোস্ট’ পত্রিকার এক লেখায় ইরানের সরকারের সমালোচনা করে বলছেন যে, খরবটা যখন ইরানের সরকারি মিডিয়াই প্রচার করেছে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, এই প্রতিবাদের পিছনে সরকারের সমর্থন ছিল। ইরান সরকার ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে কথা বলছে এই বলে যে, হিজাব পড়াটা হলো একজন মহিলার পোষাক পড়ার স্বাধীনতার অংশ। অথচ নিজেদের দেশে হিজাব না পড়ার জন্যে অত্যাচারের শিকার হতে হচ্ছে; প্রতিবাদ করলে মারাত্মক পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। ভিভেক কাটজু প্রকৃতপক্ষে বলছেন যে, ধর্মীয় কারণে নয়, বরং রাজনৈতিক কারণে ইরান সরকার কর্ণাটকের হিজাব ইস্যুতে কথা বলেছে। ঠিক একই ব্যাপারটা ইরানের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ হিজাব পড়তে বাধ্য করার ব্যাপারটা ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতার একটা অংশ।

ভারতীয় কলামিস্ট প্রাভীন স্বামী ‘দ্যা প্রিন্ট’ পত্রিকার এক লেখায় ইরানের গত এক’শ বছরের ইতিহাসে মহিলাদের অধিকার নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। পশ্চিমা ঘেঁষা রাজ পরিবারের সময় ইরানের মহিলাদের হিজাব পড়ার উপর বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হয়। এমনকি সরকার মহিলাদেরকে হিজাব ছেড়ে দিতে প্রণোদনা দেয়। রাজ পরিবারের মহিলারাও এক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়েছেন। সরকার বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো; যেখানে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে বলা হতো, তারা যেন তাদের স্ত্রীদেরকে সেখানে নিয়ে আসে। কিন্তু আমলাদের মাঝে অনেকেই নিজেদের স্ত্রীদেরকে নিয়ে আসতে চাইতেন না; বরং কিছু মহিলা স্বল্প সময়ের জন্যে এই আমলাদের জন্যে স্ত্রীর ভূমিকা নিতেন। অর্থাৎ আমলারা ভাড়া খাটানো স্ত্রী নিয়ে পার্টিতে আসতেন। অনেক মহিলাই হিজাব ছেড়ে দেননি। তারা হিজাব ছেড়ে দেয়াকে কাপড় খুলে উলঙ্গ হবার সাথে তুলনা করতেন। তবে সেই হিজাব পড়া মহিলাদের মাঝে অনেকেই রাজ পরিবারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বড়সড় প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রাভীন স্বামী বলছেন যে, এখন ইরানে ইসলামি গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে; অথচ সেই রাজ পরিবারের অত্যাচারের মতোই মহিলাদেরকে আবারও প্রতিবাদ করতে হচ্ছে। হিজাব পড়তে বাধ্য করুক, আর না করুক, ইরানের মহিলারা সুষ্ঠু বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

 
২৫শে অগাস্ট ২০২২। তেহরানের স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা উপভোগ করছেন ইরানের মহিলারা। স্টেডিয়ামে মহিলা দর্শকদের ছবিগুলিই বলে দেয় যে, ইরানে হিজাবের নিয়ম ততটা কঠোর নয়, যতটা কঠোর বলে পশ্চিমা মিডিয়া আমিনির হত্যাকান্ডের পর প্রচার করেছে। জনগণকে ইসলামের সংস্কৃতিতে শিক্ষিত করতে ব্যর্থ সরকার যখন জোরপূর্বক হিজাব পড়তে বাধ্য করছে, তখনই মূল সমস্যাটা তৈরি হয়েছে। যখন ইরানের বহু মহিলাই রস্তায়, এমনি স্টেডিয়ামে হিজাবের নিয়মনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তখন আমিনির বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড সরকারের অনেকগুলি ব্যর্থতার মাঝে একটা হয়ে দেখা দিয়েছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি-জিরো মিডিয়া’র এক লেখায় ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্ববিরোধী দিকগুলিকে তুলে ধরা হয়। প্রথমতঃ ইরান একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র; যার গণতান্ত্রিক কর্মকান্ড আবার ধর্মীয় নীতিনির্ধারকেরা নিয়ন্ত্রণ করেন। এই নীতিনির্ধারকেরা, যারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নন, তারাই ঠিক করে দেন যে, কারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। এই ব্যবস্থার মাঝেই ইরানের নির্বাচনগুলি বেশ ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়; যা কিনা আশেপাশের আরব দেশগুলিতে কখনোই দেখা যায়না। দ্বিতীয়তঃ ইরানের সরকার বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রবিরোধী বিক্ষোভকে কঠোর হস্তে দমন করেছে। কিন্তু এরপরও দেশটাতে বড় আকারের বিক্ষোভ প্রায় নিয়মিতই হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ইরান সরকার মহিলাদের কাপড়ের ব্যাপারে বিভিন্ন আইনী নোটিশ দিচ্ছে। অথচ একইসাথে মহিলারা রাস্তায় এবং অনলাইনে এই আইনগুলির বিরুদ্ধে কথা বলছে। তৃতীয়তঃ ইরানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা বড় অংশ হলো পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে কথা বলা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার যখন ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসেন, তখন ইরান ইউরোপিয় দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নে অগ্রগামী হয়; যারা কিনা ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল।

সৌদি সাংবাদিক আমাল আব্দুলআজিজ আল-হাজ্জানি ‘আশরাক আল-আওসাত’ পত্রিকার এক লেখায় মানবাধিকারের ব্যাপারে শুধু ইরানের সরকার নয়, আরব এবং পশ্চিমা সরকারগুলিরও সমালোচনা করেছেন। তিনি প্রশ্ন করছেন যে, যদি ইরানের মতো এমন ঘটনা সৌদি আরবে ঘটতো, তাহলে পশ্চিমা মিডিয়া সেটা কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতো? পশ্চিমা মিডিয়া সর্বদাই একেকটা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে একেকভাবে কভারেজ দিয়েছে। আর পশ্চিমা দেশগুলি যখন ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করছে, তখন তারা একইসাথে ইরানের সাথে জেনেভাতে আলোচনায় বসছে, যাতে করে ইরান সরকারের উপর থেকে অবরোধ উঠে যেতে পারে। হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে নিন্দা জানানো হলেও ইরান জানে যে, সেই নিন্দার প্রকৃতপক্ষে কোন মূল্য নেই। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আদর্শ বলে কোনকিছু নেই; রয়েছে শুধুই স্বার্থ।

ইরান বলছে যে, ইরানের এই সহিংসতা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনেই হচ্ছে। এর পিছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে; কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরাসরিই বিক্ষোভকারীদের সমর্থন দিয়েছে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, এই বিক্ষোভ জনগণ করছে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে। ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অনেকদিন ধরেই নাজুক। পশ্চিমা অবরোধের কারণে ইরানে অনেক পণ্যই দুর্লভ। স্থবির অর্থনীতির কারণে বেকারত্ব পরিস্থিতি চরমে উঠেছে; দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে অনেকগুলি বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সরকার শক্তহাতে বিক্ষোভ দমন করেছে। অর্থাৎ জনগণের সমস্যাগুলির সমাধান হয়নি। মাহসা আমিনিই ইরানের জনগণের রাস্তায় বিক্ষোভের একমাত্র কারণ নয়; হিজাব তো নয়ই। জনগণকে ইসলামের সংস্কৃতিতে শিক্ষিত করতে ব্যর্থ সরকার যখন জোরপূর্বক হিজাব পড়তে বাধ্য করছে, তখনই মূল সমস্যাটা তৈরি হয়েছে। যখন ইরানের বহু মহিলাই রাস্তায়, এমনকি স্টেডিয়ামে হিজাবের নিয়মনীতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তখন আমিনির বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড সরকারের অনেকগুলি ব্যর্থতার মাঝে একটা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের জন্যে পশ্চিমাদের মৌখিক সমর্থন একদিকে যেমন ইরানের সরকারের কর্মকান্ডকে বৈধতা দেবে, অন্যদিকে আগেরগুলির মতোই এবারের বিক্ষোভকেও অমানবিকভাবে দমনে প্রণোদনা দেবে।

No comments:

Post a Comment