Saturday 28 November 2020

‘আরসেপ’ বাণিজ্য চুক্তি... ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন?

২৯শে নভেম্বর ২০২০

‘আরসেপ’ অত্র অঞ্চলের ভূরাজনৈতিকে পরিবর্তিত করেনি। এখনও এই অঞ্চলের বেশিরভাগ পণ্য তৈরি হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বকে টার্গেট করেই। এশিয়ার দেশগুলি নিজেদের মাঝে পণ্যের ‘কম্পোনেন্ট’ বা অংশবিশেষ নিয়ে বাণিজ্য করে, যাতে পশ্চিমা বাজারে ‘ফিনিশড প্রডাক্ট’ বা সর্বশেষ পণ্য আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়। সেই লক্ষ্যে ‘আরসেপ’ সেই সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে মাত্র।

গত ১৫ই নভেম্বর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক জোট ‘এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস’ বা ‘আসিয়ান’এর ১০টা দেশ সহ এশিয়া প্যাসিফিকের মোট ১৫টা দেশ পৃথিবীর সবচাইতে বড় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠন করে আলোচনায় উঠে এসেছে।‘রিজিওনাল কম্প্রিহেন্সিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ’ বা ‘আরসিইপি’ বা ‘আরসেপ’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই জোটের সদস্যদেশগুলির মাঝে পৃথিবীর প্রায় ৩০ শতাংশ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের মাঝে পড়েছে ২’শ ২০ কোটি মানুষ, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় একতৃতীয়াংশ; এর ২৬ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি গোটা বিশ্বের ২৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর বাণিজ্য চুক্তি এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের চাইতেও এই চুক্তি বড়। স্বাক্ষর করা দেশগুলির মাঝে চীন ছাড়াও মার্কিন প্রভাব বলয়ে থাকা দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানও রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কমনওয়েলথ এবং ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তার অংশ অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। তবে জোটের বাইরে থাকা দেশগুলির মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। এরকম বিরল ঘটনার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আসলে কতটুকু?

২০১২ সালে আলোচনা শুরুর পর থেকে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত ‘ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ’ বা ‘টিপিপি’ থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই বের হয়ে আসার ঘোষণা দেবার পর থেকেই ‘আরসেপ’এর গুরুত্ব বেড়ে যায়। ওবামা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘টিপিপি’ নিয়ে যখন কথা চলছিল, তখনই প্রতিদ্বন্দ্বী চুক্তি হিসেবে ‘আরসেপ’এর আবির্ভাব হয়। ‘বিবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, ‘আরসেপ’ প্রকৃতপক্ষে ‘টিপিপি’র মতো শুল্ক কর্তনের দিকে যায়নি। তবে এর আকার এটাকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে; বিশেষ করে এর মাঝে চীন থাকার কারণে পুরো জোটের একত্রিত জিডিপি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। যদিও চীন এতকাল অনেক দেশের সাথেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছে, এবারই প্রথম চীন বহুপাক্ষিক কোন বাণিজ্য চুক্তির মাঝে ঢুকেছে। চীনা প্রধানমন্ত্রী লী কিচিয়াং বলেন যে, আট বছর ধরে দরকষাকষির পর বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে একটা আশার সঞ্চার হয়েছে। তিনি এই চুক্তিকে ‘বহুপাক্ষিকতা এবং মুক্ত বাণিজ্যে’র বিজয় বলে উল্লেখ করেন।

‘সিএনবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, এই চুক্তি চীনের জন্যে একটা ভূরাজনৈতিক বিজয়; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যখন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি নিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে সরে আসছিল। এটা এখনও পরিষ্কার নয় যে, হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বী নতুন কোন বড় বাণিজ্য চুক্তির দিকে এগুবে কিনা। সিটি ব্যাঙ্কের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সিটি রিসার্চ’ তাদের এক প্রতিবেদনে বলছে যে, অর্থনৈতিকভাবে এই চুক্তি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই গুরুত্ব বহন করছে এর কূটনৈতিক বার্তা। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের মাঝে এই চুক্তি বার্তা দিচ্ছে যে, পূর্ব এশিয়া মুক্ত বাণিজ্যের জন্যে প্রস্তুত রয়েছে। আর চীন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে বলে যা অনেকে মনে করছিল, তা আসলে ঠিক নয়। এছাড়াও এটা এখন বোঝা যাচ্ছে যে, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র অথবা শুধুমাত্র চীনের সাথে থাকার পক্ষপাতি নয়। এই ব্যাপারটা দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা চুক্তি রয়েছে। 

ভারত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার ফলে স্বাক্ষরকারী অনেক দেশের কাছেই নতুন শুল্কমুক্ত এলাকার গুরুত্ব বেশকিছুটা কমে গেছে। সদস্য দেশগুলির জন্যে চুক্তিকে এড়িয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট পদ্ধতি রাখার ফলে এটা অত শক্তিশালী চুক্তি নয়। তথাপি চুক্তিটা অনেককেই মনে করাবে যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে পারস্পরিক সহযোগিতায় অধিকতর বিশ্বাসী। ‘আরসেপ’এর কারণে চীন এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হবে না; কারণ চীন ইতোমধ্যেই অত্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু।

ভারতও এই চুক্তির আলোচনায় অংশ নেয়; তবে গত বছর কমদামি চীনা পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাবার ভয়ে ভারত এই চুক্তির আলোচনা থেকে নিজেকে উঠিয়ে নেয়। ‘ক্যাপিটাল ইকনমিক্স’এর জ্যেষ্ঠ এশিয়া অর্থনীতিবিদ গ্যারেথ লেদার বলছেন যে, চুক্তিতে ভবিষ্যতে ভারতের ফিরে আসার জন্যে দুয়ার খোলা রাখা হয়েছে। জাপানিরাই মূলতঃ ভারতকে চেয়েছিল চীনের অর্থনৈতিক আকৃতিকে ব্যালান্স করতে। তবে হিমালয়ের পাদদেশে চীনের সাথে ভারতের দ্বন্দ্বের ফলে এই চুক্তিতে থাকাটা ভারতের জন্যে কঠিন হয়ে যায়। ‘সিটি রিসার্চ’ বলছে যে, ‘আরসেপ’এ না থাকার কারণে ভারত বিরাট একটা সুযোগ হারিয়েছে; ভারত এখন এই জোটের প্রতিদ্বন্দ্বী উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে নিজেকে শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবে না।

তবে অনেকেই বলছেন যে, এই চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির জন্যে বড় কোন সুবিধা নিয়ে আসবে না; আর এর বাস্তবায়ন অনেক বছর লেগে যাবে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ‘আরসেপ’ ‘টিপিপি’র মতো শক্তিশালী চুক্তি নয়; এর বাধ্যবাধকতা বেশ অনেকটাই কম। সদস্য রাষ্ট্রগুলির নিজেদের নীতি এবং ভর্তুকি দেয়ার চিন্তা থেকে বের হয়ে আসার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ‘আরসেপ’এর সদস্য দেশগুলির মাঝে ইতোমধ্যেই দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি ছিল। ‘আসিয়ান’এর দেশগুলির মাঝে মোট বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যেই শুল্কবিহীনভাবে হয়ে থাকে। তবে ‘দ্য ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’এর বৈশ্বিক প্রধান অর্থনীতিবিদ সায়মন ব্যাপটিস্ট বলছেন যে, ‘আরসেপ’এর যে দেশগুলির মাঝে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই, সেই দেশগুলির মাঝে বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। ‘এইচএসবিসি’র হিসেবে ২০৩০ সালের মাঝে ‘আরসেপ’এর দেশগুলির একত্রিত জিডিপি দাঁড়াবে বিশ্বের ৫০ শতাংশ। চুক্তির আগ থেকেই গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে, তা চুক্তির পরেও অব্যহত থাকবে।

‘আরসেপ’ অত্র অঞ্চলের ভূরাজনৈতিকে পরিবর্তিত করেনি। এখনও এই অঞ্চলের বেশিরভাগ পণ্য তৈরি হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বকে টার্গেট করেই। এশিয়ার দেশগুলি নিজেদের মাঝে পণ্যের ‘কম্পোনেন্ট’ বা অংশবিশেষ নিয়ে বাণিজ্য করে, যাতে পশ্চিমা বাজারে ‘ফিনিশড প্রডাক্ট’ বা সর্বশেষ পণ্য আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়। সেই লক্ষ্যে ‘আরসেপ’ সেই সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে মাত্র। ভূরাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘স্ট্রাটফর’এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রজার বেকার বলছেন যে, ভারত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার ফলে স্বাক্ষরকারী অনেক দেশের কাছেই নতুন শুল্কমুক্ত এলাকার গুরুত্ব বেশকিছুটা কমে গেছে। সদস্য দেশগুলির জন্যে চুক্তিকে এড়িয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট পদ্ধতি রাখার ফলে এটা অত শক্তিশালী চুক্তি নয়। তথাপি চুক্তিটা অনেককেই মনে করাবে যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে পারস্পরিক সহযোগিতায় অধিকতর বিশ্বাসী। ‘আরসেপ’এর কারণে চীন এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হবে না; কারণ চীন ইতোমধ্যেই অত্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। অপরদিকে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল না থেকে নিজস্ব একটা প্রভাব বলয় তৈরি করতে চাইছে জাপান; যার অংশ হিসেবে জাপান এই চুক্তির অংশ হয়েছে।

Sunday 22 November 2020

ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বলি হতে চলেছে ইথিওপিয়া?

২২শে নভেম্বর ২০২০
সুদান এবং এরিত্রিয়া ইতোমধ্যেই অংশ নিচ্ছে বলে বলেন তিনি। ইথিওপিয়াসহ হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের জন্যেই কিছুদিনের মাঝেই এখানে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিরা জড়াবে।



ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা জাতিসংঘের এক গোপন ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলছে যে, ইথিওপিয়ার সেনারা দেশটার উত্তরের তিগ্রে অঞ্চলে সামরিক অভিযানে ব্যাপক বাধার সন্মুখীন হচ্ছে, যদিও সরকারি বাহিনী বলছে যে, তারা হুমেরা, দানশা, শিরারো, আলামাতা এবং শিরে সহ বেশ কয়েকটা শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ইথিওপিয়ার সরকারি মুখপাত্র রেদওয়ান হুসেইন বলেন যে, সরকারি বাহিনী তিগ্রের মূল শহর মেকেল্লের অভিমুখে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সুদান ও এরিত্রিয়ার সীমান্তে পশ্চিমের শহর হুমেরাতে এবং দক্ষিণের শহর আলামাতাতে ব্যাপক সংঘাত হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। ইথিওপিয়ার বিমান বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালাচ্ছে। তিগ্রেতে টেলিযোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ায় এবং সাংবাদিকদের যেতে বাধা দেয়ায় তথ্য সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংঘাতে কয়েক’শ মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ৪ঠা নভেম্বর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ৩৬ হাজার মানুষ পার্শ্ববর্তী সুদানে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও তিগ্রে অঞ্চলের মাঝেই অনেকে ঘরছাড়া হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ঘোষণা দেন যে, ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী তিগ্রের রাজধানী মেকেল্লের দিকে রওয়ানা হয়েছে এবং তারা বিদ্রোহী ‘তিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা ‘টিপিএলএফ’এর নেতৃবৃন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। ‘টিপিএলএফ’ ১১ কোটি মানুষের ইথিওপিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হলেও এর মূল ভিত্তি তিগ্রে অঞ্চলের ৬০ লক্ষ তিগ্রেদের মাঝে। ১৯৯১ সালে বামপন্থী মেনজিসটু হাইলেমারিয়ামএর সরকারকে উৎখাত করে ‘টিপিএলএফ’এর গেরিলারা ক্ষমতা নেয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত তারা ছিল ক্ষমতাসীন দল, যাদেরকে সরিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ অরোমো এবং আমহারাদের নেতৃত্বে আবি আহমেদ ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আরোহণ করেন।

‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ‘টিপিএলএফ’ এর আগেও কয়েকবার ইথিওপিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাবার হুমকি দিয়েছিল। অগাস্ট মাসে ‘টিপিএলএফ’এর নেতা দেব্রেতসিওন গেব্রেমাইকেল বলেন যে, তারা কখনোই তাদের কষ্টার্জিত স্বশাসনের অধিকার ছেড়ে দেবেন না। সেপ্টেম্বর মাসে করোনা মহামারির কারণ দেখিয়ে ইথিওপিয়া সরকার জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেবার পর ‘টিপিএলএফ’এর তত্বাবধানে তিগ্রে অঞ্চলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকেই আদ্দিস আবাবা সরকারের সাথে ‘টিপিএলএফ’এর সম্পর্কের ব্যাপক অবণতি হয়। অক্টোবর মাসে ইথিওপিয়ার সরকার তিগ্রে অঞ্চলের সাথে সম্পর্ক স্থগিত করে এবং সংসদে তিগ্রের বাজেট স্থগিত করা হয়। ইথিওপিয়ার সরকার বলে যে, মেকেল্লের এক সেনা ঘাঁটিতে হামলা করে ‘টিপিএলএফ’এর সদস্যরা অস্ত্র ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করার পর থেকেই এই সামরিক মিশন শুরু করা হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, দ্রুত যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা নেই; কারণ তিগ্রের সেনারা খুব শীঘ্রই মেকেল্লে শহরের পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নেবে। এই পাহাড়ি অঞ্চল রক্ষা করা অপেক্ষাকৃত সহজ বলেই সেখানে ইথিওপিয়ার সরকারি বাহিনীর দ্রুত সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ইউনিটগুলি শহরগুলিকে বাইপাস করে মেকেল্লে রওয়ানা হচ্ছে। আর মিলিশিয়া এবং আধাসামরিক বাহিনীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইউনিটগুলি পরবর্তীতে এই শহরগুলির নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করছে; এবং এরাই তিগ্রেদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ইথিওপিয়ার সরকারি বাহিনী যত এগুবে, তাদের সাপ্লাই লাইন গেরিলা আক্রমণের শিকার হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে। অর্থাৎ ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী ‘টিপিএলএফ’কে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলেও সংঘাত নাও থামতে পারে। 

সরকারি বাহিনী তিগ্রের মূল শহর মেকেল্লের অভিমুখে রয়েছে।  তারা হুমেরা, দানশা, শিরারো, আলামাতা এবং শিরে সহ বেশ কয়েকটা শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সুদান ও এরিত্রিয়ার সীমান্তে পশ্চিমের শহর হুমেরাতে এবং দক্ষিণের শহর আলামাতাতে ব্যাপক সংঘাত হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। ইথিওপিয়ার বিমান বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা চালাচ্ছে।


‘বিবিসি’ বলছে যে, ইথিওপিয়ার প্রতিবেশী এরিত্রিয়া মূলতঃ তিগ্রেদের পছন্দ করে না। তিগ্রেরা বলছে যে, এরিত্রিয়ার বাহিনী ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীকে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে। ১৯৯৮ সালে এরিত্রিয়ার সাথে ইথিওপিয়ার সীমান্ত যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, যা যুদ্ধ মূলতঃ তিগ্রের সাথে সীমানা নিয়েই। তিগ্রের আঞ্চলিক সরকারের অসহযোগিতার কারণে সীমান্তবর্তী শহর বাদমে নিয়ে দুই দেশের দ্বন্দ্বের সুরাহা হয়নি।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল রেইনর প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ এবং ‘টিপিএলএফ’এর নেতা দেব্রেতসিওন গেব্রেমাইকেলএর সাথে কথা বলার পর উভয় পক্ষেরই সামরিক ফলাফল পাবার দিকে আশাবাদী হবার আশংকা রয়েছে বলে মতামত দেন। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, পূর্ব আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের মাঝে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইথিওপিয়া। এবং এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আবি আহমেদের সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ১৯শে নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আফ্রিকা বিষয়ক সহকারি সচিব তিবর নাগি সাংবাদিকদের বলেন যে, ইথিওপিয়ার এই সংঘাত দুই দেশের মাঝে সংঘাত নয়; বরং একটা দেশের একটা অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে। তাই এর ফলাফল হিসেবে যা তারা আশা করেছিল, সেটাই হচ্ছে।

তিগ্রেদের নেতা গেব্রেমাইকেল বলছেন যে, তারা যুদ্ধ চান না। তবে তাদের সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া এবং স্পেশাল ফোর্স যুদ্ধ জয়ের জন্যে প্রস্তুত রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এখানে বাইরের শক্তিদের জড়িত হবার সম্ভাবনা বাড়বে। বিশেষ করে নীল নদের উপর ইথিওপিয়ার ‘গ্র্যান্ড রেনেসাঁস ড্যাম’ প্রকল্প এবং নদীর পানির হিস্যা নিয়ে ইথিওপিয়ার সাথে মিশর এবং সুদানের যখন দ্বন্দ্ব চলছে, তখন ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরীণ কলহ আঞ্চলিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। ‘দ্যা ইস্ট আফ্রিকান’ বলছে যে, ২০শে নভেম্বর আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সাইরিল রামাফোসা মোজাম্বিক, লাইবেরিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার তিনজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে সদস্য করে একটা মিশন ইথিওপিয়াতে পাঠাবার ঘোষণা দেবার পরদিন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রীর অফিশিয়াল টুইটার একাউন্ট থেকে বলা হয় যে, ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে মধ্যস্ততা করতে আফ্রিকান ইউনিয়নের মিশনের ইথিওপিয়া আসার খবরটা বানোয়াট। হর্ন অব আফ্রিকা বিশ্লেষক রশিদ আবদি 'বিবিসি’কে বলছেন যে, এই যুদ্ধ ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক। সুদান এবং এরিত্রিয়া ইতোমধ্যেই অংশ নিচ্ছে বলে বলেন তিনি। ইথিওপিয়াসহ হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের জন্যেই কিছুদিনের মাঝেই এখানে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিরা জড়াবে। আবদি আরও বলেন যে, ইথিওপিয়া যদি তিগ্রের কারণে সোমালিয়ার যুদ্ধ থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়, তাহলে সোমালিয়াতেও এর প্রভাব পড়বে। এছাড়াও জাতিগত কারণে ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকলে জাতিরাষ্ট্র ইথিওপিয়ার অস্তিত্বই হুমকির মাঝে পড়ে যাবে। অপরদিকে জাতিসংঘ বলছে যে, ইথিওপিয়ার ৭০ লক্ষ মানুষ খাদ্য সহায়তার উপর নির্ভরশীল, যার মাঝে তিগ্রের ৬ লক্ষ। এই অঞ্চল পঙ্গপালের আক্রমণেও জর্জরিত। ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে দুর্বল মানুষগুলিই সবচাইতে ঝুঁকিতে পড়ছে। 

Friday 20 November 2020

'ভূরাজনৈতিক ভূমিকম্প ২০২০'

২০শে নভেম্বর ২০২০ 

 


 


আলহামদুলিল্লাহ!
আমার চতুর্থ বই প্রকাশিত হলো।
 
'ভূরাজনৈতিক ভূমিকম্প ২০২০ - করোনা দুর্যোগে আদর্শিক সংকট এবং বিপর্যস্ত বিশ্ব ব্যবস্থা'


















বই-এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা এই বর্ণনা থেকে পাওয়া যাবে -


-----------------------------------------------------------------------------------------------

"
২০২০ সালকে সংজ্ঞায়িত করেছে করোনাভাইরাসের মহামারি। ভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা উঠেছে চরমে। এই ভূরাজনৈতিক খেলায় আগের খেলোয়াড়রাই মাঠে রয়েছে। তবে২০১৯ সালের হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার সাথে করোনাভাইরাস মিশ্রিত হওয়ায় পরিস্থিতি হয়েছে বেসামাল। এবং তা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার অতি ভঙ্গুর পরিস্থিতিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ২০২০ সালে সবচাইতে বড় ভূমিকম্প ছিল এটাই; যা কিনা পশ্চিমা আদর্শের ভিতকেই দুর্বল করে ফেলেছে। এর আগের কোন দুর্যোগেই এমনটা ঘটেনি। ভূমিকম্পের মতোই দুর্বল স্তম্ভগুলিকে এই দুর্যোগ আক্রমণ করেছে; অতি দুর্বলগুলিকে ধ্বসিয়ে ফেলেছে। অনেক স্থানেই তৈরি হয়েছে ফাঁটল; যেখানে নতুন ধরনের দুর্যোগের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।

২০২০ সাল ছিল ভূরাজনৈতিক ভুমিকম্পের বছর; কারণ তা যুক্তরাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে কোন জাতিরাষ্ট্র, সেব্যাপারটাকে সামনে আনেনি। বরং পশ্চিমা জীবনব্যবস্থা কতদিন সমাধানহীন অবস্থায় দুনিয়ার নেতৃত্ব দিতে পারবে, সেই প্রশ্নকে সামনে এনেছে। প্রশ্নটা এখন আর জাতিরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়; এটা এখন একটা আদর্শিক প্রশ্ন। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই পশ্চিমা আদর্শ থেকে আসা জাতিরাষ্ট্রের চিন্তাটাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। অনেকগুলি জাতিরাষ্ট্রই অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে; বাকিগুলি জাতিরাষ্ট্রের বাউন্ডারি না মেনেই চলছে দেদারসে। জঙ্গলের নিয়মে চলছে বিশ্ব; যা সভ্য দুনিয়ার দিকে ইঙ্গিত দেয় না। এই পরিস্থিতি মানুষকে নতুন সমাধান খুঁজতে মরিয়া করে তুলবে।"


-----------------------------------------------------------------------------------------------


আপাততঃ বইটি কুরিয়ারের মাধ্যমে ডেলিভারির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যারা অর্ডার করতে ইচ্ছুক, তারা নিচের ফেসবুক পেইজে পুরো ঠিকানা এবং ফোন নম্বরসহ 'ইনবক্স' করুন। পেমেন্ট করতে হবে বিকাশে। ডেলিভারি চার্জ ফ্রি। অর্থাৎ বইএর মূল্যের বাইরে কোন চার্জ দিতে হবে না।  

https://www.facebook.com/k360bd/ 
 
 -----------------------------------------------------------------------------------------------
 
 

 

 
 লেখক - আহমেদ শরীফ

প্রকাশক - মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম, ড্রিমস পাবলিকেশনস, টাঙ্গাইল

প্রথম প্রকাশ - অক্টোবর ২০২০

প্রচ্ছদ - তৌহিদুল ইসলাম

মুদ্রণ - এস আর প্রিন্টার্স

পৃষ্ঠা সংখ্যা - ৪২৪; হার্ড কভার 

মূল্য - ৯০০/- (নয়শত টাকা মাত্র) 

ISBN : 978-984-34-9520-4
 -------------------------------------------------------------------------------
লেখকের প্রথম বই তিনটা না পেয়ে থাকলে এই লিঙ্ক থেকে ঘুরে আসুন - 
 

'বঙ্গোপসাগর আসলে কার? বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান'
 
 

Saturday 14 November 2020

ককেশাসের পর কি সিরিয়ার যুদ্ধ পুনরায় শুরু হচ্ছে?

১৫ই নভেম্বর ২০২০
অক্টোবর ২০২০। ইদলিবের কাছে সামরিক ঘাঁটি ছেড়ে যাচ্ছে তুর্কি সেনাবাহিনী। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এই ঘাঁটিগুলি ছেড়ে আসার অর্থ এই নয় যে, তুরস্ক অস্ত্র অঞ্চলে নিজেদের অবস্থানকে কমাচ্ছে; বরং এর মাধ্যমে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর আভাস পাওয়া যায়।

গত ২৬শে অক্টোবর সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে রুশ বিমান হামলায় সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ৫০ জনের বেশি সদস্য নিহত হয়। সিরিয়ার যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন যে, এই হামলা হয়েছে জেবেল আল দোয়াইলা এলাকায়, যেখানে ‘ফাইলাক আল শাম’ নামের বিদ্রোহী গ্রুপের সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে। এই গ্রুপটা তুর্কি সমর্থিত গ্রুপগুলির মাঝে সবচাইতে বড়। সাম্প্রতিক সময়ে রুশদের বেশিরভাগ বিমান হামলার উদ্দেশই ছিল কৌশলগত ‘এম৪’ হাইওয়ের আশপাশ থেকে বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে সরানো; কিন্তু দোয়াইলার হামলার উদ্দেশ্য ছিল পুরোপুরি আলাদা। হামলার ভয়াবহতা দেখে অনেকেই ধারণা করছেন যে, এই হামলার পিছনে শুধুমাত্র সিরিয়া নয়, আরও বড় ভূরাজনীতি জড়িত। তুরস্ক এবং রাশিয়া বর্তমানে লিবিয়া, ককেশাস এবং সিরিয়াতে ভিন্ন পক্ষ সমর্থন করে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ‘আল জাজিরা’ তাদের এক বিশ্লেষণে বলছে যে, এই হামলা খুব সম্ভবতঃ ককেশাসে আজেরবাইজানের পক্ষে তুরস্কের জড়ানোর সাথে সম্পর্কিত। রাশিয়া ককেশাস এবং মধ্য এশিয়ার অঞ্চলকে তার নিজের প্রভাবের মাঝে মনে করে থাকে। সেখানে তুরস্কের জড়ানোটা রাশিয়া ভালো চোখে দেখেনি। ২০২০এর মার্চে তুরস্ক এবং রাশিয়া সিরিয়ার ইদলিবে একটা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল, যা এতকাল মোটামুটিভাবে বহাল থাকলেও বিভিন্ন আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে তুরস্কের জড়াবার পর এই যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে ১০ই অক্টোবর ককেশাসে আজেরবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মাঝে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হবার পর সিরিয়ার যুদ্ধের কৌশলগত গুরুত্ব বেড়ে গেছে।

ইউরেশিয়া বিশ্লেষক এসরেফ ইয়ালিনকিলিচলি তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে বলছেন যে, এই বিমান হামলার মাধ্যমে রাশিয়া খুব সম্ভবতঃ তুরস্ককে বার্তা দিতে চাইছে যে ককেশাসে তুরস্কের জড়ানোটা রাশিয়া পছন্দ করছে না। দুই দেশ অর্থনৈতিকভাবে নিবিঢ় সম্পর্ক রাখলেও লিবিয়া, সিরিয়া এবং ককেশাসের ব্যাপারে দুই দেশের ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। তিনি বলেন যে, সিরিয়ার ঘটনাগুলি তুরস্ক এবং রাশিয়ার সম্পর্কের মূল ভিত্তি হতে যাচ্ছে; সেখানে দুই দেশের মাঝে সংঘাত শুরু হলে পুরো সম্পর্কই টানাপোড়েনে পড়বে। তুর্কি বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, লিবিয়া এবং ককেশাসে রাশিয়া এবং ফ্রান্স এক পক্ষে থেকেছে, যদিও দুই দেশের মাঝে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। লিবিয়াতে জেনারেল হাফতারকে এবং ককেশাসে আর্মেনিয়াকে তারা সমর্থন দিয়েছে। অপরদিকে সিরিয়াতে রাশিয়া বাশার সরকারকে সরাসরি সমর্থন দিলেও ফ্রান্স সেক্ষেত্রে অতটা আগায়নি। তবে ২০১৭ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ বলেন যে, বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার উপযুক্ত উত্তরসুরী কে হবে, সেব্যাপারে তারা নিশ্চিত হতে পারছেন না; তাই বাশারকে ক্ষমতা থেকে সরাবার কোন প্রাধান্য তাদের নীতির মাঝে নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে রুশদের বেশিরভাগ বিমান হামলার উদ্দেশই ছিল কৌশলগত ‘এম৪’ হাইওয়ের আশপাশ থেকে বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে সরানো; কিন্তু দোয়াইলার হামলার উদ্দেশ্য ছিল পুরোপুরি আলাদা। হামলার ভয়াবহতা দেখে অনেকেই ধারণা করছেন যে, এই হামলার পিছনে শুধুমাত্র সিরিয়া নয়, আরও বড় ভূরাজনীতি জড়িত। 


বিমান হামলার সপ্তাখানেক আগে ১৯শে অক্টোবর ইদলিবে একটা সামরিক ঘাঁটি খালি করা শুরু করে তুরস্ক। মোরেক এলাকায় ঘাঁটিসহ বেশ কয়েকটা ঘাঁটি বাশার বাহিনীর অধিকৃত অঞ্চলের একেবারে মাঝখানে। যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে তুরস্কই এই ঘাঁটিগুলিকে বাশার বাহিনীর অধিকৃত অঞ্চলের মাঝে রেখেছিল। ৩রা নভেম্বর নাগাদ এই ঘাঁটি পুরো খালি করা হয়। ৯ই নভেম্বর নাগাদ তুর্কি বাহিনী শের মুঘার, মার হাত্তাত, ক্বাবতান আল জাবাল এবং শেইখ আকিল ঘাঁটিগুলি খালি করা শুরু করেছে। সিরিয়ান মিডিয়া ‘এনাব বালাদি’ বলছে যে, ১৫ই অক্টোবর তুরস্ক ঘাঁটি সরাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আরও বলছে যে, তুরস্ক হয়তো বাশার বাহিনীর অধিকৃত অঞ্চলের মাঝে সকল ঘাঁটিই খালি করতে যাচ্ছে। তুর্কি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওমরান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’এর গবেষক মাআন তালআ বলছেন যে, ঘাঁটি খালি করার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয় যে, তুরস্ক সামনের দিনগুলিতে সংঘাত বৃদ্ধির আশঙ্কা করছে। বাশার বাহিনী খুব সম্ভবতঃ রুশ সহায়তায় নতুন অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে; যার প্রস্তুতি হিসেবে তুরস্ক তার বাহিনীগুলিকে নতুন করে বিন্যাস করছে। তিনি বলছেন যে, সরিয়ে নেয়া বাহিনীগুলিকে তুরস্ক বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নতুন করে মোতায়েন করে কিনা, সেটা দেখার বিষয় হবে। ‘আল মনিটর’এর এক লেখায় তুর্কি কলামিস্ট ফেহিম তেস্তেকিন বলছেন যে, এই ঘাঁটিগুলি ছেড়ে আসার অর্থ এই নয় যে, তুরস্ক অত্র অঞ্চলে নিজেদের অবস্থানকে কমাচ্ছে; বরং এর মাধ্যমে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর আভাস পাওয়া যায়।

যেসময় তুরস্ক ইদলিবের আশেপাশে ঘাঁটি খালি করছে, সেই সময় সিরিয়াতে ঢুকছে আরও তুর্কি সেনা। তুরস্কের পত্রিকা ‘মিলিয়েত’ বলে যে, গত ১৫ই অক্টোবর তুরস্কের সামরিক বাহিনীর ৭০টা গাড়ির একটা বহর ইদলিবে ঢোকে, যে বহরের মাঝে ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারিও ছিল। একইসাথে পত্রিকাটা বলে যে, ইদলিবের দক্ষিণ দিকে তুরস্ক নতুন একটা সামরিক ঘাঁটি তৈরির কাজ শুরু করেছে। এর একদিন আগেই বাশার বাহিনীর হামলায় দু’জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনাগুলি কয়েক মাসের অপেক্ষাকৃত শান্ত পরিবেশকে বিঘ্নিত করছিল।

২০২০ সালের শুরুতে ইদলিবে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারের বাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে তুরস্ক সরাসরি বিদ্রোহীদের পক্ষ নেয়। যুদ্ধের ফলে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ গৃহহারা হয়ে তুরস্কের সীমান্তে আরও লাখো উদ্বাস্তুর সাথে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ‘ডেইলি সাবাহ’ ব্যাখ্যা দিয়ে বলছে যে, বাশার বাহিনীর আক্রমণ তুরস্ক অভিমুখে আরও উদ্বাস্তু তৈরি করছে, এই পরিস্থিতিটাই তুরস্কের ইদলিবে সেনা পাঠাবার ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ‘আল মনিটর’এর ‘তুর্কি পালস’এর কলামিস্ট সেলিম ইদিজএর মতে, রাশিয়া এবং তুরস্কের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে কিছু বিদ্রোহী গ্রুপের সংজ্ঞার ব্যাপারে। ২০১৭ সালে রাশিয়া এবং তুরস্ক একটা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার শর্ত ছিল কিছু বিদ্রোহী গ্রুপকে তুরস্ক ভেঙ্গে ফেলবে, যাদেরকে রাশিয়া ‘উগ্রপন্থী’ বলে মনে করে। এই গ্রুপগুলির মাঝে সবচাইতে বড় গ্রুপ হলো ‘হায়াত তাহরির আল শাম’ বা ‘এইচটিএস’। তুরস্ক যে ১১টা গ্রুপকে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে, তার মাঝে ‘এইচটিএস’ নেই। সেলিম ইদিজ বলছেন যে, তুরস্ক হয় ‘এইটিএস’কে ভাংতে পারছে না বা ভাংতে চায় না। তিনি আরও বলেন যে, ইদলিবে সর্বশেষ রুশ হামলা খুব সম্ভবতঃ পুতিনের সতর্কবাণী ছিল।



‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর বিশ্লেষক দারীন খলিফা ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, মস্কো বিদ্রোহী গ্রুপের ব্যাপারে তাদের দাবি বাস্তবায়ন হবার আগ পর্যন্ত আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেবে, যা মোটামুটি জানাই ছিল। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের মাঝে যুদ্ধবিরতির যে সমঝোতা ছিল, তার মাঝে প্রধান শর্ত ছিল সিরিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী কয়েকটা বিদ্রোহী গ্রুপকে তুরস্ক ভেঙ্গে ফেলবে। এরকম অবান্তর শর্তের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। সেলিম ইদিজ বলছেন যে, যুদ্ধবিরতির পর রাশিয়া এবং তুরস্ক ফ্রন্টলাইন বরাবর যৌথ প্যাট্রোলের ব্যবস্থা করে। এই প্যাট্রোল প্রকৃতপক্ষে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিতে পারেনি; শুধুমাত্র সকলকে একটা ধারণা দিয়েছে যে, সিরিয়াতে রাশিয়া এবং তুরস্ক একত্রে কাজ করছে। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে যৌথ প্যাট্রোল বন্ধ হয়ে গেছে, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, যুদ্ধবিরতির শেষ অতি সন্নিকটে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউট’এর ডিরেক্টর চার্লস লিস্টার মনে করছেন যে, এই মুহুর্তে বড় কোন যুদ্ধ হয়তো আসন্ন নয়, তবে আঙ্কারা এই হামলাকে একেবারেই এড়িয়ে যাবে, এটা ভাবা ভুল হবে। রুশ হামলার পরদিনই সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলি বাশার বাহিনীর উপর শত শত রকেট নিক্ষেপ করে। এই রকেটগুলির মাঝে কোন একটা যদি অতি গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থাপনার উপর গিয়ে পড়ে, অথবা এই আক্রমণগুলি যদি নিজে থেকেই চলতে থাকে, তাহলে এই সহিংসতা একটা অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। দারীন খলিফা বলছেন যে, রুশদের সাথে তুর্কিদের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল দরকষাকষির জন্যে ব্যবহৃত হতে থাকবে। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিয়ে বলছে যে, গত মার্চের যুদ্ধবিরতির সময় দুই পক্ষের সমঝোতায় বলা ছিল যে, বাশার বাহিনী হামলা করলে তুরস্কের অধিকার থাকবে সর্বশক্তি দিয়ে প্রত্যুত্তর দেবার।

লিবিয়া এবং ককেশাসে প্রক্সি যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর তুরস্ক এখন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রটা তাই নতুন করে জেগে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইদলিবে তুরস্কের ঘাঁটিগুলির পুনর্বিন্যাস এবং নতুন করে সৈন্য সমাবেশ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সিরিয়ার স্থিতাবস্থা নিয়ে তুরস্ক খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। অপরদিকে লিবিয়া এবং ককেশাসে তুরস্ককে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মোকাবিলার পর সিরিয়াতে তুরস্কের প্রভাব কমাতে নতুন করে সচেষ্ট হতে পারে রাশিয়া। ইদলিবে রাশিয়ার সাম্প্রতিক বিমান হামলা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সিরিয়ার যুদ্ধবিরতি কতটা দুর্বল ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়তো ককেশাসের ফয়সালাই সিরিয়ার ফ্রন্টলাইনকে কয়েক মাসের জন্যে থামিয়ে রেখেছিল। তুরস্ক এবং রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বলি হচ্ছে সিরিয়ার লাখো মানুষ। শীতকাল এবং করোনাভাইরাসের কারণে এই ঘরছাড়া মানুষগুলির অবস্থা হয়তো আরও শোচনীয় হতে চলেছে। 

Friday 13 November 2020

আজেরবাইজানের যুদ্ধজয় এবং অতঃপর...

১৪ই নভেম্বর ২০২০
আজেরবাইজান এবং তুরস্কের পতাকা নিয়ে আজেরবাইজানের রাজধানী বাকুতে উল্লাস করছে মানুষ। ককেশাসে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু রাষ্ট্র আর্মেনিয়াকে সহায়তা না দেয়ায় মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে কি বার্তা গেলো, তা এখন আলোচ্য বিষয়। শুশার মসজিদ নিয়ে জাতিগত দ্বন্দ্বই বলে দিচ্ছে যে, আজেরবাইজানের জয় এখনও শুধুমাত্র সামরিক। অপরদিকে বৃহত্তর মধ্য এশিয়াতে কৌশলগত জয়ের ফসল গিয়েছে তুরস্কের ঘরে, যা তুরস্ককে আরও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির দিকে ঠেলবে।

১২ই নভেম্বর তুরস্কের পত্রিকা ‘ডেইলি সাবাহ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, নাগোর্নো কারাবাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শুশাতে ২৮ বছর পর মসজিদ থেকে আজান দেয়া হয়। সোশাল মিডিয়াতে এক ভিডিওতে দেখা যায় যে, শুশার ঐতিহাসিক ইউখারি গোভহার আগা মসজিদের মিনার থেকে একজন আজেরি সেনাসদস্য আজান দিচ্ছে। ২৭শে সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া আজেরবাইজানের সাথে আর্মেনিয়ার যুদ্ধ ১০ই নভেম্বর রুশ মধ্যস্ততায় থামার পর এখানকার ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনগুলি আলোচনায় আসছে।

শুশা শহর কারাবাখের রাজধানী স্তেপানাকার্ট থেকে মাত্র ১০ কিঃমিঃ দূরে এবং শুশা স্তেপানাকার্টএর প্রায় ২ হাজার ফুট বেশি উচ্চতায়। স্তেপানাকার্টএর সাথে আর্মেনিয়ার যোগাযোগের রাস্তার উপর অবস্থিত শুশা; আর তাই শুশার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার অর্থ হলো স্তেপানাকার্টএর নিয়ন্ত্রণ নেয়া। ৮ই নভেম্বর আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিইয়েভ শুশা পুণর্দখলের ঘোষণা দেন। শহরটা আজেরিদের নিয়ন্ত্রণে যাবার কারণেই আর্মেনিয়া যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দেন যে, উভয় পক্ষ ‘সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি’তে সম্মত হয়েছে, যা অত্র অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী সমঝোতার দিকে যাবার সম্ভাবনা তৈরি করবে। তিনি আরও বলেন যে, উভয় পক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলি ধরে রাখবে এবং রুশ শান্তিরক্ষী সেনারা দুই পক্ষের মাঝে অবস্থান নেবে। রুশ সেনারা নাগোর্নো কারাবাখের সাথে আর্মেনিয়ার যোগাযোগের জন্যে একটা করিডোর নিয়ন্ত্রণে রাখবে। রুশ বার্তা সংস্থাগুলি বলছে যে, মোট ১ হাজার ৯শ ৬০ জন রুশ সেনা এবং ৯০টা সাঁজোয়া যান শান্তিরক্ষায় মোতায়েন হবে।

ফরাসি বার্তাসংস্থা ‘এএফপি’ বলছে যে, যুদ্ধবিরতির পর আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে বিক্ষুব্ধ জনতা পার্লামেন্ট ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেবার চেষ্টা করে এবং বিভিন্ন অফিস ভাংচুর করে। আর্মেনিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকল পাশিনিয়ান এক ঘোষণায় বলেন যে, সার্বিক সামরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে একটা ‘অকল্পনীয় যন্ত্রণাদায়ক’ চুক্তি স্বাক্ষরে তিনি বাধ্য হয়েছেন। অপরদিকে আজেরবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিইয়েভ বলছেন যে, একটা ‘লৌহ হস্ত’ পাশিনিয়ানকে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করেছে। তিনি এই চুক্তিকে আর্মেনিয়ার ‘আত্মসমর্পণ’ বলে আখ্যা দেন। আলিইয়েভ বলেন যে, একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মাঝে কারাবাখের একটা বড় এলাকা থেকে আর্মেনিয়া সেনা প্রত্যাহার করতে সম্মত হয়েছে। আর আজেরবাইজানের বন্ধুরাষ্ট্র তুরস্ক যুদ্ধবিরতি ধরে রাখতে সহায়তা দেবে।

শুশার মসজিদের ইতিহাসের সাথে অত্র অঞ্চলের সংঘাতের গভীরতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ‘ইউরেশিয়ানেট’ বলছে যে, এই মসজিদের কাজ শেষ হয় ১৮৮৫ সালে। সোভিয়েত আমলে মসজিদটাকে জাদুঘর হিসেবে আখ্যা দিয়ে নামাজ আদায় বন্ধ করে দেয়া হলেও ১৯৮৮ সালে আবার নামাজ আদায় শুরু হয়। ১৯৯২ সালের ৮ই মে শুশা শহর আর্মেনিয়দের হাতে চলে যাবার পর থেকে এই মসজিদ থেকে আজান প্রচার হয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে আর্মেনিয়রা ইরানিদের সহায়তায় এই মসজিদ মেরামত করে জাদুঘর হিসেবে জনসাধারণের জন্যে খুলে দেয়। তবে এই মসজিদের মেরামত আজেরিরা ভালো চোখে দেখেনি। আর্মেনিয়রা কারাবাখ দখল করে নেবার পর কারাবাখের ৬ লাখের বেশি আজেরি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। শুশার এক শিক্ষক নুনে হাকোবিয়ান মসজিদখানা মেরামতের পর মন্তব্য করেন যে, তিনি এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটাকে পছন্দ করেন; তবে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন যে, এই মসজিদখানা তৈরি হয়েছে খ্রিস্টান ভূমিতে। আরটার পোগোসিয়ান নামের আরেক ব্যক্তি মন্তব্য করেন যে, কারাবাখের কর্তাব্যক্তিরা এই মসজিদের মেরামত চাইলেও জনগণ চায় না। তারা মনে করে যে, এখানে একটা মসজিদ থাকলে মুসলিমরা কোন এক সময় মনে করবে যে, এই ভূমি মুসলিমদের। শুশার আর্মেনিয়দের কথায় অত্র অঞ্চলে আর্মেনিয় এবং আজেরিদের মাঝে দ্বন্দ্ব কতটা গভীর, তার প্রমাণ মেলে। উভয় পক্ষের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলি। মসজিদটা মেরামত করে কারাবাখের আর্মেনিয়রা ঘোষণা দেয় যে, আজেরিরা আর্মেনিয়দের ইতিহাস ধ্বংস করলেও আর্মেনিয়রা তার উল্টোটা করেছে। অপরদিকে আজেরিরা বলছে যে, আর্মেনিয়রা মসজিদখানা মেরামত করে এটাকে ‘পারস্যের মসজিদ’ বলে আখ্যা দিচ্ছে, যা কিনা এখান থেকে আজেরিদের ঐতিহ্য মুছে ফেলার একটা চক্রান্ত। কারাবাখের মন্ত্রী আরতাক গ্রিগোরিয়ান বলছেন যে, ইরানি প্রকৌশলীরা সহায়তা করতে এসে এই মসজিদকে ‘পারস্যের মসজিদ’ বলেই আখ্যা দিয়েছে; তাই তারাও সেটাই বলছেন। দুই পক্ষের কথাগুলি জাতিগত চরম মেরুকরণেরই উদাহরণ, যা অত সহজে পরিবর্তনীয় নয়। আজেরিরা নিজেদেরকে তুর্কি জাতির অংশ বলে মনে করলেও পারসিক আখ্যা দেয়াটা তাদের পছন্দনীয় নয়।

কমপক্ষে ১৩’শ মানুষ এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে বলছে বার্তাসংস্থাগুলি; যদিও অনেকেই এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে বলে বলছেন। এই হত্যাযজ্ঞ প্রায় তিন দশক ধরে চলা যুদ্ধাবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। তুর্কি ও ইস্রাইলি মনুষ্যবিহীন ড্রোন এবং বাকুর তেল বিক্রির অর্থে কেনা বিপুল অস্ত্রের সমাহার আজেরবাইজানকে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে একচ্ছত্র প্রাধান্য দিলেও তুরস্কের সমর্থন ব্যাতীত আজেরিদের পক্ষে এতদিন যুদ্ধ চালিয়ে নেয়া সম্ভব ছিল না। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে আর্মেনিয়রা সহায়তা চাইলেও পুতিন সরাসরিই বলে দেন যে, শুধুমাত্র আর্মেনিয়া আক্রান্ত হলেই রুশরা আর্মেনিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়াবে; কারাবাখ যেহেতু আজেরবাইজানের এলাকা বলে স্বীকৃত, তাই সেখানকার যুদ্ধে রুশরা জড়াবে না। আজেরবাইজানকে তুরস্কের সরাসরি সমর্থনই শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত করে যে, রাশিয়া যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন ব্যতীত অন্য কোন ভূমিকা নেয়নি। এই যুদ্ধ শেষ হলো রাশিয়া এবং তুরস্কের ভূমিকায়; যা কিনা ‘ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপ’কে অর্থহীন করে ফেলেছে। সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র নীরব থেকে তুরস্ককে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় একদিকে মিনস্ক গ্রুপের সদস্য ফ্রান্সের প্রভাব যেমন আরও কমলো, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র যে এই অঞ্চল নিয়ে তেমন মাথা ঘামাবে না, সেব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেলো। প্রধানমন্ত্রী পাশিনিয়ানের পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের খুঁটিও দুর্বল হলো; যা রাশিয়াকে খুশিই করবে। তবে ককেশাসে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু রাষ্ট্র আর্মেনিয়াকে সহায়তা না দেয়ায় মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের কাছে কি বার্তা গেলো, তা এখন আলোচ্য বিষয়। শুশার মসজিদ নিয়ে জাতিগত দ্বন্দ্বই বলে দিচ্ছে যে, আজেরবাইজানের জয় এখনও শুধুমাত্র সামরিক। অপরদিকে বৃহত্তর মধ্য এশিয়াতে কৌশলগত জয়ের ফসল গিয়েছে তুরস্কের ঘরে, যা তুরস্ককে আরও আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির দিকে ঠেলবে।

Sunday 8 November 2020

ফকল্যান্ডস দাবি করে আর্জেন্টিনা কি আবারও ব্রিটেনকে চাপের মুখে ফেলতে পারবে?

০৯ই নভেম্বর ২০২০
১৯৮২ সালের ঘটনা থেকে ব্রিটেন শিক্ষা নিয়েছে; কৌশলগত ম্যাজেলান প্রণালী এবং ড্রেইক প্যাসেজের পাহাড়াদার ফকল্যান্ডসের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটেন দ্বিতীয়বার ছাড়তে রাজি নয়। তবে এজন্য ব্রিটেন খুব বেশি একটা শক্তি খরচ করতে রাজি নয়।


গত ৬ই নভেম্বর আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আটলান্টিকের ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জে আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়ানোর দ্বিশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। আর্জেন্টিনা দাবি করে যে, ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জ স্বাভাবিকভাবেই আর্জেন্টিনার, যা ব্রিটিশরা জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে। আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ডসকে ‘মালভিয়ান্স’ বলে ডাকে। আর্জেন্টিনার কূটনীতিক হোজে লুইস ফার্নান্দেজ এক বার্তায় বলেন যে, এবারের এই অনুষ্ঠান আলাদা কোনকিছু নয়। আর্জেন্টিনা বহুকাল থেকেই এই দ্বীপগুলির উপর তাদের দাবির কথা জানিয়ে আসছে। ১৮১০ সালে স্পেনের রাজার কাছ থেকে আর্জেন্টিনা এই দ্বীপগুলি পায়, যা ব্রিটিশরা ১৮৩৩ সালে দখল করে নিয়েছিল। আর্জেন্টিনার মালভিয়ান্স সেক্রেটারি ড্যানিয়েল ফিলমাস বলেন যে, এই অনুষ্ঠান আর্জেন্টিনার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ আমেরিকার মিডিয়া ‘মেরকোপ্রেস’ বলছে যে, ৭ই নভেম্বর আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেলিপ সোলা জার্মান দূতাবাসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২১ সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের ডেকে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে আর্জেন্টাইনরা বলে যে, ব্রিটেন যখন ইইউ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তখন ইউরোপিয় দেশগুলির উচিৎ ফকল্যান্ডসএর উপর আর্জেন্টিনার অধিকারকে সমর্থন করা। ব্রিটেনের সাথে আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ডস নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা এমন সময়ে শুরু হয়েছে, যখন দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আর্জেন্টিনার ফাইটার জেট ক্রয়ের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। আর্জেন্টাইন মন্ত্রী আগুস্তিন রসি লন্ডনের এহেন সিদ্ধান্তকে ‘সাম্রাজ্যবাদী দাম্ভিকতা’ বলে আখ্যা দেন। দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে আটলান্টিক মহাসগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাবার পথের উপর অবস্থিত ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জের কৌশলগত গুরুত্ব যথেষ্ট। ব্রিটিশরা প্রায় দু’শ বছর ধরে কৌশলগত এই দ্বীপ দখলে রেখেছে। পানামা খাল চালুর পর থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণে ম্যাজেলান প্রণালী এবং ড্রেইক প্যাসেজ দিয়ে বর্তমানে বাণিজ্যিক জাহাজ তেমন যাতায়াত করে না। তবে সামরিক জাহাজের জন্যে এই পথ আখনও গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে ভবিষ্যতের কোন সম্ভাব্য যুদ্ধে দুই মহাসাগরের মাঝে যাতায়াতের জন্যে এই পথ ব্যবহৃত হতে পারে। ইউরোপিয় দেশগুলি এই পথকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাবার বিকল্প পথ হিসেবে দেখে।

বিরোধপূর্ণ দুই শতক

ব্রিটেনের ‘দ্যা এক্সপ্রেস’ পত্রিকা মনে করিয়ে দিয়ে বলছে যে, দুই দেশের মাঝে ফকল্যান্ডস নিয়ে দ্বন্দ্ব ১৮ শতক থেকেই। ১৯৮২ সালে ব্রিটিশদের অধীনে থাকা এই দ্বীপপুঞ্জকে আর্জেন্টিনা সৈন্য পাঠিয়ে দখল করে নেয়। আর্জেন্টিনার দক্ষিণ উপকূল থেকে এই দ্বীপের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৬’শ কিঃমিঃ। ৩ হাজার ৩’শ ৫৪ জন মানুষের বাস এই দ্বীপে ১৯৮২ সালে যুদ্ধের সময় আর্জেন্টাইনরা বেশ কিছু মানুষকে সেখানে বসতি স্থাপন করতে দিয়েছিল। ব্রিটিশ সেনারা সাড়ে ১২ হাজার কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিয়ে এসে দ্বীপ পুনর্দখলের পর তাদেরকে আর্জেন্টিনায় ফেরত দিয়ে আসে।

ফকল্যান্ডসএর ইতিহাস জুড়েই রয়েছে ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা। ১৭৬৪ সালে ফরাসি ক্যাপ্টেন লুই আঁতোয়া ডে বোগেনভিল ইস্ট ফকল্যান্ডসএ পোর্ট লুই নামে একটা ঘাঁটি স্থাপন করেন। এরপর ১৭৬৬ সালে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন জন ম্যাকব্রাইড সনডার্স আইল্যান্ডে পোর্ট এগমন্ট নামে একটা ঘাঁটি স্থাপন করে। তবে একই বছরেই ফরাসিরা স্পেনের কাছে তাদের ঘাঁটি হস্তান্তর করে ফেলে। পরের বছর ১৭৬৭ সালে স্প্যানিশরা এই ঘাঁটির নামকরণ করে পুয়ের্তো সলেদাদ। তবে তখনও তারা ফকল্যান্ডসে ব্রিটিশ ঘাঁটি সম্পর্কে অবহিত ছিল না। ১৭৭০ সালে স্প্যানিশরা যখন বুঝতে পারে যে, সেখানে ব্রিটিশ একটা ঘাঁটি রয়েছে, তখন তারা ব্রিটিশ ঘাঁটি পোর্ট এগমন্ট দখল করে নেয়। ১৭৭১ সালে ঘাঁটিটা ব্রিটনের হাতে ছেড়ে দেবার মাধ্যমে স্প্যানিশরা সুপারপাওয়ার ব্রিটেনের সাথে যুদ্ধ এড়ায়। ব্রিটিশরা তাদের সার্বভৌমত্বের একটা সাইনবোর্ড রেখে দিয়ে ১৭৭৪ সালের মাঝে দ্বীপ থেকে নিজেদের ঘাঁটি সরিয়ে নেয়। ফরাসী সম্রাট ন্যাপোলিয়নের সাথে ব্রিটিশদের যুদ্ধ শুরুর পর স্পেন ফ্রান্সের অধীনে চলে গেলে ব্রিটিশরা রিও ডেলা প্লাটা বা আর্জেন্টিনা আক্রমণ করে। ১৮১০ সালে ব্রিটিশ সহায়তায় রিও ডেলা প্লাটাতে বিদ্রোহ শুরু হয়। এর ফলে ১৮১১ সালের মাঝে স্প্যানিশরা ফকল্যান্ডস ছেড়ে যায়। ১৮১৬ সালে আর্জেন্টিনা নামে নতুন দেশের ঘোষণা দেয়া হয়। নতুন দেশ আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আটলান্টিকে স্পেনের দখলে থাকা সকল দ্বীপই নিজের বলে দাবি করে। ১৮২৩ সালে আর্জেন্টিনা এক জার্মান নাগরিক লুই ভারনেটকে ফকল্যান্ডসের এলাকায় মৎস্য সম্পদের দেখাশুনার দায়িত্ব দেয়। কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয় যখন নতুন উদ্দমী দেশ যুক্তরাষ্ট্র এখানে হস্তক্ষেপ করে। ১৮৩১ সালে ভারনেট দু’টা মার্কিন মাছ ধরার জাহাজ আটক করলে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে। মার্কিন নৌবাহিনীর অফিসার সিলান ডানকানের নেতৃত্বে যুদ্ধজাহাজ ‘লেক্সিংটন’ এই দ্বীপের কর্তৃত্বকে ধ্বংস করে দ্বীপের উপর কোন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে অবৈধ ঘোষণা করে। এই ঘটনাই ব্রিটিশকে সরকারকে জাগিয়ে তোলে। সেবছরের ডিসেম্বরে ক্যাপ্টেন জেমস অনস্লোর নেতৃত্বে দু’টা ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ‘ক্লিও’ এবং ‘টাইন’ এসে দ্বীপের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৩৩ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা ফকল্যান্ডসের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নৌবাহিনীর এশিয়া স্কোয়াড্রন দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে দেশে ফেরত যাবার সময় ফকল্যান্ডসএর উপকূলে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়। এই যুদ্ধ দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে আটলান্টিক মহাসাগরের যোগাযোগ পথ নিয়ন্ত্রণে ফকল্যান্ডসকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
মে ২০১৯। ফ্রান্সের নৌবাহিনী থেকে রিটায়ার করা ‘সুপার এটেনডার্ড’ পৌঁছেছে আর্জেন্টিনায়। যুদ্ধবিমানের জন্যে আর্জেন্টিনা সারা বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। কিন্তু ব্রিটেনের কূটনৈতিক দক্ষতাকে পাশ কাটাবার মতো সক্ষমতার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। 


আর্জেন্টিনার পুনর্জাগরণের চেষ্টা?

১৯৮২ সালের এপ্রিলে আর্জেন্টিনার সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন রোজারিও’এর মাধ্যমে ফকল্যান্ডস দখল করে নেয়। সেসময় ফকল্যান্ডসের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল ১’শ জনেরও কম সেনা এবং নাবিক। ফকল্যান্ডসএর বেসামরিক নাবিকদের মাঝ থেকে ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত ছিল নিরাপত্তার জন্যে। ব্রিটিশরা সাড়ে ১২ হাজার কিঃমিঃ পথ পেরিয়ে ফকল্যান্ডসে এসে যুদ্ধ করে জয়লাভ করে। তবে যুদ্ধে আর্জেন্টাইন বিমান বাহিনীর আক্রমণে ব্রিটিশদের বেশ কয়েকটা জাহাজ ধ্বংস হয়। বিমান আক্রমণকে আটকাবার জন্যে ব্রিটিশ রয়াল নেভি তার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের ‘হ্যারিয়ার’ ফাইটার বিমানগুলিকে ব্যবহার করেছিল। তবে আর্জেন্টিনার হাতে ফরাসি নির্মিত সুপারসনিক ‘মিরাজ’ যুদ্ধবিমান ছাড়াও ছিল মার্কিন নির্মিত ‘এ৪ স্কাইহক’ এবং ফরাসি নির্মিত ‘সুপার এটেনডার্ড’ যুদ্ধবিমান। ‘সুপার এটেনডার্ড’ যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপিত ফরাসি ‘এক্সোসেট’ জাহাজধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে কয়েকটা ব্রিটিশ জাহাজ ধ্বংস হয়। এই যুদ্ধের ফলে একটা ব্যাপার সবসময়ের জন্যে পরিবর্তন হয়ে যায়; আর তা হলো, ব্রিটিশরা আর কখনোই ফকল্যান্ডসের নিরাপত্তাকে হাল্কাভাবে নিতে পারবে না। ফকল্যান্ডসে ব্রিটিশরা একদিকে যেমন বেশি সামরিক শক্তি মোতায়েন রাখছে, তেমনি তারা নিশ্চিত করছে যে, আর্জেন্টিনার হাতে যেন ১৯৮২এর মতো বিমান শক্তি না যায়। আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ব্রিটেনের রয়েছে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা; আর সেই নিষেধাজ্ঞা কতটা সফল, তা পরবর্তী ঘটনাগুলিই বলে দেয়।

তিন দশক আগের আর্জেন্টিনার বিমান বাহিনী আজ মৃতপ্রায়। নতুন যুদ্ধবিমান কেনার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরলেও কেউই আর্জেন্টিনাকে বিমান দিতে চাইছে চাইছে না। ব্রিটেনের ‘দ্যা এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ২০১৩ সালে আর্জেন্টিনা স্পেনের কাছ থেকে ১৬টা পুরোনো ফরাসি নির্মিত ‘মিরাজ এফ১’ সুপারসনিক ফাইটার বিমান কেনার চুক্তি করে। স্পেনের দক্ষিণে ব্রিটিশ অধিকৃত জিব্রালটার নিয়ে স্পেনের যে নীতি রয়েছে, সেই নীতির মতোই আর্জেন্টিনার ফকল্যান্ডস নীতি। তবে এই চুক্তি ব্রিটেনের কূটনৈতিক চাপে বাতিল হয়ে যায়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মাঝে আর্জেন্টিনা ইস্রাইল থেকে ১২টা পুরোনো ‘কাফির সি১’ ফাইটার বিমান ক্রয়ের চেষ্টা করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই বিমানে ব্যবহৃত ‘জে৭৯’ ইঞ্জিন আর্জেন্টিনার কাছে বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় এটাও ভেস্তে যায়। যুক্তরাষ্ট্র চায়নি ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ককে খারাপ করে ফেলতে। তবে তা নিঃসন্দেহে মার্কিনীদের কূটনৈতিক দিক থেকে সুবিধা দিয়েছে। ‘রয়টার্স’এর এক খবরে বলা হচ্ছে যে, ২০১৫ সালে আর্জেন্টিনা সুইডেন থেকে ২৪টা অত্যাধুনিক ‘সাব জেএএস৩৯ গ্রিপেন’ ফাইটার বিমান কেনার চেষ্টা করলেও তা তেমন কোন আলোচনা ছাড়াই বাতিল হয়ে যায়। এই বিমানে রাডারসহ ৩০ শতাংশ যন্ত্রাংশ ব্রিটিশদের হবার কারণে এই বিমান আর্জেন্টিনায় রপ্তানিতে ব্রিটিশ সরকারের বাধা নিশ্চিত ছিল। বিমানের ব্রিটিশ যন্ত্রাংশ অন্য দেশের যন্ত্রাংশ দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রশ্নও আসেনি। ২০১৭ সালে ফরাসিরা আর্জেন্টিনার কাছে ফরাসি নৌবাহিনী থেকে রিটায়ার করা ৫টা ‘সুপার এটেনডার্ড’ ফাইটার বিক্রি করছে বলে ঘোষণা দেন ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে হেনরি গুইনার্দ। কিন্তু ২০১৮ সালের মাঝে কয়েকটা বিমান দেবার কথা থাকলেও ২০১৯ সালের মে মাসে প্রায় দুই বছর পরে বিমানগুলি আর্জেন্টিনা পৌঁছে; তাও আবার আধুমিকায়ন ছাড়া।

আর্জেন্টিনার সর্বশেষ চেষ্টাটা ছিল দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ‘এফএ৫০’ সুপারসনিক ফাইটার জেট ক্রয়। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আইআইচএস জেন্স’ বলছে যে, ব্রিটিশ সরকার এটাও আটকে দিয়েছে। কোরিয়ান কোম্পানি ‘কেএআই’এর এক চিঠিতে বলা হয় যে, এই বিমানে ব্রিটিশ নির্মিত ছয়টা যন্ত্রাংশ রয়েছে; যেকারণে কোরিয়ার পক্ষে এই বিমান আর্জেন্টিনার কাছে বিক্রি করা সম্ভব নয়। আর্জেন্টিনা ২০১৫ সাল থেকেই চীন থেকে যুদ্ধবিমান কিনতে পারে বলে শোনা যাচ্ছিলো; কিন্তু সেটাও এতদিনে কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।
ফকল্যান্ডসে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি ‘মাউন্ট প্লীজ্যান্ট’। আর্জেন্টিনার জন্যে এই ঘাঁটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। তবে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ এখন ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত মহাসাগর এবং তৎসংলগ্ন পূর্ব এশিয়া নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত; কারণ চীনের উত্থানের পর থেকেই সেখানেই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বেশি। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ব্রিটেন ফাঁকা স্থানগুলিকে পূর্ণ করতে মরিয়া; দক্ষিণ আটলান্টিকের মতো এলাকায় আটকে থাকার সময় কোথায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর? 


সাড়ে ১২ হাজার কিঃমিঃ পেরিয়ে নিরাপত্তা

ব্রিটিশরা ফকল্যান্ডসের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ১৯৮২ সালের যুদ্ধের পর থেকে সেখানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে। ১ হাজারের বেশি সৈন্য এবং নাবিক এখন সেখানকার নিরাপত্তা দিচ্ছে বলে বলছে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ম্যাগাজিন ‘ফোর্সেস নেটওয়ার্ক’। ১৯৯০এর দশক থেকে সেখানে ৪টা ‘টর্নেডো এফ৩’ যুদ্ধবিমান মোতায়েন ছিল। ১৭ বছর পর ২০০৯ সালে এই বিমানগুলিকে প্রতিস্থাপন করে ৪টা অত্যাধুনিক ‘টাইফুন’ ফাইটার। দক্ষিণ আমেরিকার মিডিয়া ‘মেরকোপ্রেস’ বলছে যে, এই বিমানগুলিকে ফকল্যান্ডসে পৌঁছাতে সহায়তা দেয় ১০টা বিমান; যার মাঝে ছিল ৬টা রিফুয়েলিং বিমান, ৩টা সার্চ রেসকিউ বিমান এবং ১টা ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান। স্প্যানিশ ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণ আটলান্টিকে ব্রিটিশ এসেনশন দ্বীপ থেকেও বিমানগুলি সহায়তা নেয়। ১৮ ঘন্টার এই ফ্লাইটে মোট ৭ বার আকাশে জ্বালানি নিতে হয়েছিল বিমানগুলিকে। ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লীডার পিট মরগান বলেন যে, ‘টাইফুন’ বিমানগুলি মোতায়েন করার মিশন ‘অপারেশন টাইফুন টেম্পেস্ট ট্রেইল’ ব্রিটেনের সামরিক বাহিনীর বিশাল দূরত্বে কৌশলগত মিশনে যাবার সক্ষমতাকে তুলে ধরে।

ফকল্যান্ডসের বর্তমান নিরাপত্তায় রয়েছে রয়াল নেভির একটা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল। বছরের ছয় মাস ব্রিটিশ এন্টার্কটিক প্যাট্রোল জাহাজ ‘প্রোটেক্টর’ এই অঞ্চলে থাকে। একটা ফ্রিগেট বা ডেস্ট্রয়ার এবং একটা সাপ্লাই জাহাজ মাঝে মাঝে দক্ষিণ আটলান্টিকে প্যাট্রোল দিতে আসে। ১৯৮২এর যুদ্ধের পর দ্বীপে ‘মাউন্ট প্লিজ্যান্ট’ নামে একটা নতুন বিমান ঘাঁটি তৈরি করা হয়। সেখানে ১৬টা ফাইটার বিমান রাখার জন্যে দুর্ভেদ্য বাঙ্কার নির্মাণ করা হয়েছে। এই ঘাঁটিতে একটা ‘এ৪০০এম’ পরিবহণ বিমান সর্বদা থাকছে, যা দ্বীপের আশেপাশে আকাশ প্যাট্রোল দেয়। আর প্রতি সপ্তাহে দুইবার একটা ‘ভয়েজার’ ট্যাঙ্কার পরিবহণ বিমান ফকল্যান্ডস এবং ব্রিটেনের মাঝে যাতায়াত করে। এই বিমান পথিমধ্যে পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগালের দাকারে জ্বালানি নিলেও বিরতি না নিয়েই ফকল্যান্ডসে অবতরণ করার রেকর্ডও রয়েছে। সামরিক ঘাঁটির দক্ষিণেই নতুন একটা বন্দরও নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে বড় বাণিজ্যিক জাহাজও ভিড়তে পারে। দ্বীপের বিমান প্রতিরক্ষা নিশ্চিতে একটা বিমান ধ্বংসী ‘র‍্যাপিয়ার’ ক্ষেপণাস্ত্রের ইউনিটও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, ব্রিটিশ ‘এসটিউট ক্লাস’এর পারমাণবিক সাবমেরিনগুলি দক্ষিণ আটলান্টিকে টহল দেয়; যদিওবা সেই তথ্য নিশ্চিতভাবে জানা দুষ্কর। ১৯৮২ সালে ব্রিটিশ সাবমেরিনের টর্পেডোর আঘাতে আর্জেন্টিনার যুদ্ধজাহাজ ‘জেনারেল বেলগ্রানো’ ডুবে গেলে ৩’শ ২৩ জন নাবিক প্রাণ হারায়। এরপর আর্জেন্টিনার নৌবাহিনী আর ব্রিটিশদের চ্যালেঞ্জ দিতে বন্দর থেকে বের হয়নি। সেই ইতিহাস এখনও ব্রিটিশদের শক্তি যোগায়।

ফকল্যান্ডসে অবস্থিত ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর ‘টাইফুন’ ফাইটার বিমানগুলিকে এড়িয়ে দ্বীপের উপর হামলা করার সামরিক ক্ষমতা থেকে আর্জেন্টিনা এখন বহুদূরে। থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘গ্লোবাল রিস্ক ইনসাইট’ বলছে যে, আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ডস দাবি করে তার জনগণকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে দৃষ্টি সড়াবার চেষ্টা করছে মাত্র। অপরদিকে ১৯৮২ সালের ঘটনা থেকে ব্রিটেন শিক্ষা নিয়েছে; কৌশলগত ম্যাজেলান প্রণালী এবং ড্রেইক প্যাসেজের পাহাড়াদার ফকল্যান্ডসের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটেন দ্বিতীয়বার ছাড়তে রাজি নয়। তবে এজন্য ব্রিটেন খুব বেশি একটা শক্তি খরচ করতে রাজি নয়। যুদ্ধবিমানের জন্যে আর্জেন্টিনা সারা বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। কিন্তু ব্রিটেনের কূটনৈতিক দক্ষতাকে পাশ কাটাবার মতো সক্ষমতার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি না করার শর্ত যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইস্রাইল বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলিকে ব্রিটেনের সাথে কূটনৈতিক দরকষাকষির সুযোগ দিয়েছে। তথাপি এই ঘটনাগুলি বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনের রাজনৈতিক প্রভাবের একটা উদাহরণ হিসেবে কাজ করে। এই মুহুর্তে দক্ষিণ আটলান্টিকে দৃষ্টি দেবার মতো সময় ব্রিটেনের নেই। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ এখন ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত মহাসাগর এবং তৎসংলগ্ন পূর্ব এশিয়া নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত; কারণ চীনের উত্থানের পর থেকেই সেখানেই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বেশি। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথেসাথে ব্রিটেন ফাঁকা স্থানগুলিকে পূর্ণ করতে মরিয়া; দক্ষিণ আটলান্টিকের মতো এলাকায় আটকে থাকার সময় কোথায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর? 

Friday 6 November 2020

‘কোয়াড’ এবং ‘এক্সারসাইজ মালাবার ২০২০’ ... কার জন্যে কি বার্তা?

০৬ই নভেম্বর ২০২০
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ এবং ‘কোয়াড’এর মূল লক্ষ্য হলো ইন্দোপ্যাসিফিককে চীনা প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। এই লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরে নৌমহড়া শুধু চীনের জন্যেই নয়, চীনকে বন্ধু ভাবা যেকোন রাষ্ট্রের জন্যেই বার্তা। ঘটনাপ্রবাহই বলে দিচ্ছে যে, বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এখন আরও এক ধাপ এগুলো, যেখানে সামনের দিনগুলিতে অস্ত্রের ঝনঝনানি আরও বৃদ্ধি পাবে।


৩রা নভেম্বর থেকে বঙ্গোপসাগরে শুরু হয়েছে যৌথ নৌমহড়া ‘এক্সারসাইজ মালাবার ২০২০’; যেখানে অংশ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতের নৌবাহিনী। ‘মালাবার’এর ২৪তম এই আয়োজনে এবার যোগ দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। আর করোনাভাইরাসের বাস্তবতাকে সামনে রেখে মহড়ার নিয়মকানুনে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০২০এর এই মহড়ার এটা হলো প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ অনুষ্ঠিত হবে নভেম্বরের শেষে। এই মহড়ায় অংশ নিচ্ছে মার্কিন নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ‘জন এস ম্যাককেইন’, অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘বালারাট’, জাপানের নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ‘ওনামি’, ভারতীয় নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ‘রণবিজয়’, ফ্রিগেট ‘শিভালিক’, সাপ্লাই জাহাজ ‘শক্তি’, সাবমেরিন ‘সিন্ধুরাজ’ এবং একটা ‘পি৮আই’ এন্টিসাবমেরিন বিমান। মার্কিন সামরিক বাহিনীর পত্রিকা ‘নেভি টাইমস’ কোন রাখঢাক না রেখেই বলছে যে, এই মহড়ার আয়োজন করা হয়েছে চীনকে টার্গেট করে। চীনকে টার্গেট করা হয়েছে ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনা প্রভাব মোকাবিলার উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বিস্তারে ভারত যখন বিচলিত, তখন এই চার দেশের মাঝে তৈরি হয়েছে ‘কোয়াড’ নামের এক কৌশলগত জোট।

‘জাপান টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে ‘এক্সারসাইজ মালাবার ২০২০’কে সরাসরি ‘কোয়াড’এর সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কিছুদিন আগেই টোকিওতে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতের শীর্ষ কূটনীতিকেরা মিলিত হয়েছিলেন ‘কোয়াড’এর অংশ হিসেবে। যদিও সেই বৈঠক থেকে বিশেষ কোন ঘোষণা আসেনি, তথাপি এটা চীনের প্রতি একটা বার্তা হিসেবেই সকলে দেখেছেন। যদিও এই মহড়াকে অফিশিয়ালি ‘কোয়াড’এর অংশ বলে ঘোষণা দেয়া হয়নি, তবুও বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, এই মহড়া মূলতঃ ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের সামরিক এবং কূটনৈতিক প্রভাবকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যেই আয়োজন করা হয়েছে। ধীরে ধীরে এই মহড়াকে হয়তো ‘কোয়াড’এর অংশ বলেই বলা হবে। এই মহড়ায় ১৩ বছরের মাঝে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া অংশ নিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেইনল্ডস এক বার্তায় বলেন যে, এই মহড়ার মাধ্যমে ভারতের সামরিক বাহিনীর সাথে অস্ট্রেলিয়ার আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ভারতীয় পত্রিকা ‘ইকনমিক টাইমস’ও এই মহড়াকে ‘কোয়াড মালাবার’ বলে আখ্যা দিচ্ছে। ভারতের জন্যে এই মহড়া এমন এক সময়ে এলো, যখন চীনের সাথে হিমালয়ের পাদদেশে সংঘাতের পর ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির একটাও ভারতকে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। উল্টো এই সময়ের মাঝে চীনের সাথে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং নেপালের সম্পর্কোন্নয়ন হয়েছে।

ভারতীয় চিন্তাবিদেরা এহেন পরিস্থিতিতে ভারতের অসহায়ত্বকে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। ভারতের ‘দ্যা প্রিন্ট’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক শেখর গুপ্ত বলছেন যে, বহুদিন ধরেই ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগী হয়নি; আর সেই সুযোগেই চীন দক্ষিণ এশিয়াতে তার অবস্থান শক্ত করে নিয়েছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশের ঐকান্তিক সহায়তায় ভারত তার উত্তরপূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের দমনে বিরাট সাফল্য পেয়েছে; অথচ প্রতিদানে ভারত তার নাগরিকত্ব আইন পাস করার পর বিরাট এক মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশী’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবার কথা বলেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কোন্নয়ন কঠিন হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। একই সময়ে চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিয়েছে। এছাড়াও চীনারা বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং নেপালেও বিনিয়োগ করে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে। এরই মাঝে ‘আইএমএফ’এর হিসেবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়কে ভারতের চাইতে বেশি হবে বলে ঘোষণা করা হলে ভারতীয়দের মাঝে অনেকেই ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। যদিও শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের মাথাপিছু আয় ভারতের কয়েক গুণ, তথাপি সেটা ভারতীয়দের চিন্তার কারণ ছিলোনা কখনোই। কিন্তু বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের খবরটা পত্রপত্রিকায় আসার সাথেসাথেই ভারতীয়রা চিন্তিত হয়ে গিয়েছেন। শেখর গুপ্তের কথায় বোঝা যায় যে, ভারত সরকার বাংলাদেশকে তাদের অতি কাছের বন্ধু বললেও বাস্তবতা অতটা সহজ নয়। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ছাড়াও চীন থেকে বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের ব্যাপারটাও ভারত ভালো চোখে দেখে না। বিশেষ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে সাবমেরিন কেনার ব্যাপারটা ভারতীয় চিন্তাবিদেরা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। এর উপরে আবার বাংলাদেশের কক্সবাজারে চীনা সহায়তায় তৈরি হচ্ছে স্থায়ী সাবমেরিন ঘাঁটি, যা ‘এশিয়া টাইমস’ বলছে যে, ভারতের সাথে চীনের উত্তেজনাকে আরও উস্কে দেবে।

ভারতের ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকা বলছে যে, গত অগাস্টে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে নীতিগতভাবে অস্ট্রেলিয়াকে ‘মালাবার’ মহড়ায় আমন্ত্রণ জানাবার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, হিমালয়ের পাদদেশে লাদাখে চীনের সাথে ভারতের সংঘাত এই সিদ্ধান্তের পিছনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। ‘মালাবার’ এবং ‘কোয়াড’এর যোগসূত্র এখানেই। থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর সিঙ্গাপুর অফিসের সিনিয়র ফেলো আলেক্সান্ডার নেইল ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, ‘কোয়াড’এর কর্মকান্ড আটকে থাকার মূল কারণ ছিল ভারত; যারা ঐতিহাসিকভাবেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অংশ ছিল। আর এখন এই জোটের সামনে চলে আসাটাও হয়েছে ভারতের জন্যেই, যারা এখন চীনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে।
 

অক্টোবর মাসেই মার্কিন উপপররাষ্ট্র সচিব স্টিফেন বিগান এবং পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও দক্ষিণ এশিয়া ঘুরে মার্কিন ‘ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’তে যোগ দেয়ার জন্যে দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানান। বাংলাদেশ থেকে সরাসরিই বলে দেয়া হয় যে, বাংলাদেশ কোন নিরাপত্তা জোটে যুক্ত হবে না। এর প্রায় দু’সপ্তাহ পরেই ‘এক্সারসাইজ মালাবার’এর তৃতীয় দিনে ৫ই নভেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পাঁচটা জাহাজ কমিশনিং করা হয়; যার মাঝে তিনটা ছিল চীনা নির্মিত। এর আগেও ১৮ই জুন হিমালয়ে ভারতের সাথে চীনের সংঘাতের চরম অবস্থায় বাংলাদেশ একটা চীনা নির্মিত কর্ভেট কমিশনিং করে।


অক্টোবর মাসেই মার্কিন উপপররাষ্ট্র সচিব স্টিফেন বিগান এবং পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও দক্ষিণ এশিয়া ঘুরে যান। সফরকালে তারা মার্কিন ‘ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’তে যোগ দেয়ার জন্যে দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানান। বাংলাদেশ থেকে সরাসরিই বলে দেয়া হয় যে, বাংলাদেশ কোন নিরাপত্তা জোটে যুক্ত হবে না। আর মার্কিনীদের এই কৌশলের অধীনে বাংলাদেশ কোন অস্ত্র কিনতেও অগ্রহী নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়। এর প্রায় দু’সপ্তাহ পরেই ‘এক্সারসাইজ মালাবার’এর তৃতীয় দিনে ৫ই নভেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পাঁচটা জাহাজ কমিশনিং করা হয়; যার মাঝে তিনটা ছিল চীনা নির্মিত। এর আগেও ১৮ই জুন হিমালয়ে ভারতের সাথে চীনের সংঘাতের চরম অবস্থায় বাংলাদেশ একটা চীনা নির্মিত কর্ভেট কমিশনিং করে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ এবং ‘কোয়াড’এর মূল লক্ষ্য হলো ইন্দোপ্যাসিফিককে চীনা প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। এই লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরে নৌমহড়া শুধু চীনের জন্যেই নয়, চীনকে বন্ধু ভাবা যেকোন রাষ্ট্রের জন্যেই বার্তা। ঘটনাপ্রবাহই বলে দিচ্ছে যে, বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এখন আরও এক ধাপ এগুলো, যেখানে সামনের দিনগুলিতে অস্ত্রের ঝনঝনানি আরও বৃদ্ধি পাবে।

Monday 2 November 2020

‘সাইবার যুদ্ধ’ ... এটাই কি যুদ্ধের ভবিষ্যৎ?

০২রা নভেম্বর ২০২০
সারা বিশ্ব এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত থাকার কারণে তথ্য চুরি করা, ব্যবসায়িক ক্ষতি করা, জননিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটানো, নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, ইত্যাদি কর্মকান্ড এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এর সাথে রাজনৈতিক লক্ষ্য যুক্ত হওয়াতেই ‘সাইবার যুদ্ধ’ শব্দগুচ্ছের অবতারণা, তা সে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ হোক, বা মহানবী (সাঃ)এর অপমানের প্রতিশোধই হোক। ‘যুদ্ধ’ না করেও এই ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা এমন এক যুদ্ধাবস্থার জন্ম দিচ্ছে যে, তা ‘যুদ্ধ’এর সংজ্ঞাকেই চ্যালেঞ্জ করছে। 



গত ১৩ই অক্টোবর নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরিকসেন সোরেইডে ঘোষণা দেন যে অগাস্ট মাসে নরওয়ের পার্লামেন্টে সাইবার হামলার পিছনে দায়ী হলো রাশিয়া। তিনি কোন প্রমাণ দেখানো ছাড়াই বলেন যে, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নরওয়ের সরকার ধারণা করতে পারছে যে, এই হামলা রাশিয়াই করেছে। মস্কো অবশ্য এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে এবং বলে যে, এটা একটা মারাত্মক এবং ইচ্ছাকৃত উস্কানি। অসলোতে রুশ দূতাবাস থেকে বলা হয় যে, রাশিয়ার ইন্টারনেটের বিরুদ্ধে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হামলা হয়; কিন্তু তা রাশিয়াকে কখনোই অধিকার দেয়না হামলার উৎস যেই দেশে, সেই দেশের নেতৃত্বকে কোন বাছবিচার ছাড়াই অভিযুক্ত করার। সেপ্টেম্বরে নরওয়ের সরকার বলে যে, কয়েকজন কর্মকর্তার ইমেইল একাউন্ট হ্যাকিং হয়েছে এবং কিছু তথ্য ডাউনলোড করা হয়েছে। তবে সমস্যার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা তারা জনসম্মুখে আনেননি। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, নরওয়ের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে ভালো যাচ্ছে না। গত অগাস্টে নরওয়ে রুশ এক কূটনীতিবিদকে গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগে বহিষ্কার করে। রাশিয়াও এর প্রতিবাদে নরওয়ের এক কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। ২০১৮ সালে নরওয়ে সরকার এক রুশ নাগরিককে গোয়েন্দাবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার করলেও পরে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দেয়। এবছরের শুরুতেই নরওয়ের সামরিক ইন্টেলিজেন্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, রাশিয়া নরওয়েতে প্রভাব বিস্তারের অপারেশন চালাচ্ছে; যার মাধ্যমে সরকার, নির্বাচন পদ্ধতি এবং মিডিয়ার উপর জনগণের আস্থা কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু নরওয়েই নয়, অন্যান্য দেশও সাইবার হামলার জন্যে অন্য রাষ্ট্রকে, বিশেষ করে রাশিয়া এবং চীনকে অভিযুক্ত করছে। গত জানুয়ারি মাসে জার্মানিতে চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল সহ কয়েক’শ রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে অনলাইনে প্রকাশ করে দেয়া হয়। আর গত বছর অস্ট্রেলিয়ার সাইবার ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি অভিযোগ করে যে, চীন অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টে হ্যাকিং করে ঢোকার চেষ্টা করেছে। চীন অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। ঘটনাগুলি বর্তমান বিশ্বে চলা এই ‘সাইবার যুদ্ধ’কেই হাইলাইট করছে। এর বর্তমানে এবং ভবিষ্যৎ এখন আলোচনার বিষয়বস্তু।

গত ১৯শে অক্টোবর মার্কিন এবং ব্রিটিশ সরকার একটা রুশ হ্যাকিং দলের বিরুদ্ধে লম্বা অভিযোগ দায়ের করে। ‘স্যান্ডওয়ার্ম’ নামে পরিচিত ছয় সদস্যের এই হ্যাকিং গ্রুপের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়, তা মাঝে রয়েছে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ গ্রিডে হামলা, ২০১৭ সালে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর নির্বাচনে জেতার সময় অনলাইনে প্রভাব বিস্তার, ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় অলিম্পিকের সময় সাইবার হামলা, এবং ২০১৮ সালে ব্রিটেনের সলসবুরিতে নার্ভ গ্যাস আক্রমণের সময় তদন্তের উপর নজরদারি। এছাড়াও ২০১৬ সালে ‘ফ্যান্সি বেয়ার’ নামে একই গ্রুপ মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের আগে হিলারি ক্লিন্টন এবং ডেমোক্র্যাটিক জাতীয় কমিটির ইমেইল হ্যাকিং করেছিল বলে বলা হয়। অভিযোগে রুশ ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ‘জিআরইউ’এর অংশ এই গ্রুপের অফিস মস্কোর বাইরে খিমিকিতে ২২ কিরোভা স্ট্রীটের এক নীল রঙের কাঁচের সুউচ্চ ভবনে রয়েছে বলে বলা হয়। “দ্যা টাওয়ার” নামে পরিচিত সেই ভবনে কাজ করা এই গ্রুপ ‘ইউনিট ৭৪৪৫৫’ নামে পরিচিত। লম্বা সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের সমন্বয়ে গঠিত ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এবং গুগল, ফেইসবুক, সিসকো এবং টুইটারের সাথে যৌথভাবে তদন্ত করে মার্কিন অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই অভিযোগ পেশ করে। ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সাথে সাক্ষাতে ‘জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি’র স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রফেসর থমাস রিড বলেন যে, অভিযোগপত্রের বিষদ বিবরণ দেখে মনে হচ্ছে যে, ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ রুশ ইন্টেলিজেন্সের ভেতরকার বহু ব্যাপার সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল; বিশেষ করে যেসকল তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, সেই তথ্যগুলি এখন আর গোপনীয় মনে করা হচ্ছে না বলেই প্রকাশ করা হয়েছে। নিজেদের কর্মকান্ড গোপন রাখার জন্যে ‘ইউনিট ৭৪৪৫৫’ হয়তো অনেক চেষ্টাই করেছে; তথাপি কিছু ক্ষেত্রে তারা যথেষ্টই অদূরদর্শিতা দেখিয়েছে। ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ‘বেলিংক্যাট’এর আরিক টোলার বলছেন যে, ছয়জনের মাঝে তিনজনই তাদের গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন একই ঠিকানা থেকে। এই ঠিকানাই সেই ইউনিটকে নির্দেশ করে। এই একই ঠিকানায় মোট ৪৭ জন লোক তাদের গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে। হয়তো এরা সকলেই ‘জিআরইউ’এর হ্যাকার দলের সদস্য। 
 
১৯শে অক্টোবর মার্কিন এবং ব্রিটিশ সরকার একটা রুশ হ্যাকিং দলের বিরুদ্ধে লম্বা অভিযোগ দায়ের করে। অভিযোগপত্রের বিষদ বিবরণ দেখে মনে হচ্ছে যে, ‘ফাইভ আইজ’ ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ রুশ ইন্টেলিজেন্সের ভেতরকার বহু ব্যাপার সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল; বিশেষ করে যেসকল তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, সেই তথ্যগুলি এখন আর গোপনীয় মনে করা হচ্ছে না বলেই প্রকাশ করা হয়েছে।


পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যেই এই সাইবার হামলাকে ‘সাইবার যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন এবং সেই লক্ষ্যে নিজেদের প্রস্তুতি বৃদ্ধি করার কথা বলছেন। গত ৩০শে সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ কর্মকর্তা জেনারেল নিক কার্টার ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘পলিসি এক্সচেঞ্জ’এর এক আলোচনায় দাবি করেন যে, রাশিয়া এবং চীন সাইবার আক্রমণ, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো এবং ব্যাপক গোয়েন্দাবৃত্তির মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলির উপর “রাজনৈতিক যুদ্ধ” চালাচ্ছে। এর লক্ষ্য হলো, অফিশিয়ালি কোন সংঘাতে না জড়িয়েই পশ্চিমা দেশগুলির ইচ্ছাশক্তিকে ভেঙ্গে ফেলা। তিনি আরও বলেন যে, ব্রিটেনের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি যুদ্ধে যাবার জন্যে প্রস্তুত নয়; তথাপি তারা সামরিক সংঘাতের সংজ্ঞার ঠিক বাইরে থেকে অপারেশন চালিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে। তিনি উদাহরণ হিসেবে ২০১৭ সালে ইউক্রেনের ব্যাংক এবং জ্বালানি কোম্পানির উপর রুশ হামলার অভিযোগকে টেনে আনেন। একইসাথে তিনি স্যাটেলাইট সিস্টেমকে সমস্যা ফেলার জন্যে বেইজিংএর প্রকল্পগুলির উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন যে, তাদের শত্রুদের যুদ্ধ ছাড়া জয়লাভের এই কৌশলকে হারানো খুবই কঠিন; কারণ তা পশ্চিমা চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ‘স্বাধীনতা’কে খর্ব না করে মোকাবিলা করা যাবে না। জেনারেল কার্টার রাশিয়া এবং চীনকে এক কাতারে ফেললেও কেউ কেউ এই দুই দেশের কর্মকান্ডকে আলাদা করে দেখছেন। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর প্রবীন সাংবাদিক ডেভিড স্যাঙ্গার মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর সাথে এক সাক্ষাতে রাশিয়া এবং চীনের সাইবার কর্মকান্ডের মাঝে পার্থক্য করতে গিয়ে বলেন যে, রুশরা হলো ‘টর্নেডোর মতো’, আর চীনারা হলো ‘জলবায়ু পরিবর্তন’এর মতো। তিনি আরও বলেন যে, চীনারা বিশ্বব্যাপী নিজেদের একটা ভালো প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে চায়; যেকারণে তারা সাইবার যুদ্ধের মাঝে শুধু গোয়েন্দাবৃত্তিকেই প্রধান্য দিচ্ছে। তারা এই যুদ্ধের ‘লাল দাগ’ অতিক্রম করতে চায় না। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড্যানিয়েল ওয়াগনার ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’এর এক লেখায় বলছেন যে, চীন ইতোমধ্যেই সাইবার যুদ্ধের দিক দিয়ে পশ্চিমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে গেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য দেশের করার মতো তেমন কিছুই নেই। তারা সর্বোচ্চ চীনাদের মতো করেই নিজেদের কর্মপদ্ধতিকে গোছাতে পারে যাতে চীনের সমকক্ষ হওয়া যায়। এর অর্থ হলো খবরের পিছনে গোপনে সাইবার যুদ্ধ চালিয়ে নেয়া, যা ইতোমধ্যেই ভবিষ্যতের যুদ্ধকে সংজ্ঞায়িত করছে।

সাইবার যুদ্ধের পরিধি অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে এবং প্রতিদিনই নতুন নতুন জায়গা এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই অভিযোগ করেছে যে, রাশিয়া এবং চীন পশ্চিমা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এবং মেডিক্যাল গবেষণা সংস্থার ভেতর হ্যাকিং করে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে। ভারতীয় থিংকট্যাঙ্ক ‘অবজার্ভার রিচার্চ ফাউন্ডেশন’এর এক প্রতিবেদনে সাইবার নিরাপত্তাকে ভারতের পারমাণবিক স্থাপনাগুলির নিরাপত্তার একটা প্রধান স্তম্ভ বলে উল্লেখ করা হয়। পারমাণবিক স্থাপনার অন্যান্য নিরাপত্তার সাথে সাথে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ হুমকি মাথায় রেখেই সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে বলা হয়। সাইবার হামলাকে একটা প্রতিবাদ বা প্রতিআক্রমণের পদ্ধতি হিসেবেও দেখা শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগেই ফ্রান্সে রাসূল (সাঃ)কে বিদ্রুপ করা নিয়ে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর বক্তব্যের পর মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ফ্রান্সের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সাইবার হামলা শুরু হয়। কোন রাষ্ট্র এই হ্যাকিংএ সরাসরি সমর্থন না দিলেও তা মুসলিম বিশ্বের আবেগের একটা বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

পুঁজিবাদী বিশ্বে অর্থসম্পদের গুরুত্ব যেহেতু সর্বোচ্চ, তাই অর্থসম্পদ আহরণ এবং তার দখল নিয়ে প্রতিযোগিতাই হয়ে গিয়েছে দুনিয়ার মানুষের মূল কর্মকান্ড। এই প্রতিযোগিতায় অপরের আর্থিক ক্ষতি করা এবং একইভাবে বিপক্ষের হামলা থেকে নিজের অর্থসম্পদ রক্ষা করাও হয়ে গিয়েছে একটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য অর্জনে সাইবার যুদ্ধ সবচাইতে কম খরচের যুদ্ধ; কারণ এতে কোন বিশাল সৈন্যবাহিনী পুষতে হয়না; আর নিজের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনাও কম থাকে। আর করোনাভাইরাসের মহামারি এবং বৈশ্বিক মন্দার মাঝে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সামরিক হামলার চাইতে কম নয়। তবে অর্থসম্পদ বাঁচাতে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে পশ্চিমারা তাদের আদর্শের পবিত্র স্তম্ভ ‘স্বাধীনতা’কেই বিসর্জন দিচ্ছে। ‘স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করতে গিয়ে স্বাধীনতা খর্বের পরিকল্পনাগুলি পশ্চিমা আদর্শের ভিতে আঘাত করছে। আর অপরদিকে সারা বিশ্ব এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত থাকার কারণে তথ্য চুরি করা, ব্যবসায়িক ক্ষতি করা, জননিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটানো, নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, ইত্যাদি কর্মকান্ড এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এর সাথে রাজনৈতিক লক্ষ্য যুক্ত হওয়াতেই ‘সাইবার যুদ্ধ’ শব্দগুচ্ছের অবতারণা, তা সে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ হোক, বা মহানবী (সাঃ)এর অপমানের প্রতিশোধই হোক। ‘যুদ্ধ’ না করেও এই ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা এমন এক যুদ্ধাবস্থার জন্ম দিচ্ছে যে, তা ‘যুদ্ধ’এর সংজ্ঞাকেই চ্যালেঞ্জ করছে।

Sunday 1 November 2020

ককেশাসের যুদ্ধের এক মাস ...

০১লা নভেম্বর ২০২০
'লাচিন করিডোর' বা গিরিপথ। কৌশলগত ‘লাচিন করিডোর’ হাতছানি দিচ্ছে আজেরিদের কাছে; এর পর রয়েছে ‘কারাবাখের হৃদয়’ শুশা। এই দুই টার্গেটের কোন একটা আজেরিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তুরস্ক আর রাশিয়ার মাঝে বর্তমান স্থিতাবস্থা যে আরও চাপের মাঝে পড়বে, তা নিশ্চিত।


২৭শে সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে এক মাসের উপর হয়ে গেলো ককেশাসের যুদ্ধে থামেনি। অক্টোবরের ১০, ১৮ এবং ৩০ তারিখে তিনটা যুদ্ধবিরতির চেষ্টা বিফলে গিয়েছে। আজেরিরা বলছে যে, নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চল মুক্ত করার আগ পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিকভাবে নাগোর্নো কারাবাখ অঞ্চল আজেরবাইজানের ভূখন্ড বলেই স্বীকৃত। ১৯৯০এর দশকে আর্মেনিয়রা সামরিকভাবে কারাবাখ দখল করে সেখানে ‘রিপাবলিক অব আর্তসাখ’ নামের একটা রাষ্ট্র ঘোষণা করে, যাকে বিশ্বের আর কোন দেশই স্বীকৃতি দেয়নি। অন্যদিকে আর্মেনিয়ার সাথে সামরিক চুক্তি থাকলেও রাশিয়া বলছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আর্মেনিয়ার মূল ভূখন্ড হামলার শিকার না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আর্মেনিয়ার পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করবে না। অপরদিক তুরস্ক আজেরবাইজানকে সরাসরি রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে, যা যুদ্ধে আজেরিদের এগিয়ে থাকতে ব্যাপক সহায়তা দিয়েছে। তুরস্কের সামরিক বিশেষজ্ঞরাও খুব সম্ভবতঃ আজেরিদেরকে উপদেশ দিয়ে সহায়তা করছেন। তবে অনেক হুমকি সত্ত্বেও তুরস্ক আজেরবাইজানে সরাসরি সেনা পাঠানো থেকে বিরত থেকেছে, যা কিনা ককেশাসে রাশিয়া বা অন্য কোন তৃতীয় দেশের সরাসরি জড়িত হওয়ার পেছনে ‘ডিটারেন্ট’ হিসেবে কাজ করেছে। এই সুযোগটা নিয়েই আজেরিরা বিগত বছরগুলিতে তেল বিক্রির অর্থে কেনা বিপুল সামরিক শক্তিকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করে কারাবাখের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু অঞ্চল মুক্ত করে নিয়েছে। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে দেখানো হচ্ছে যে, ২৭শে অক্টোবর নাগাদ কারাবাখের দক্ষিণে ইরানের সাথে সীমানার পুরোটাই এখন আজেরিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এক মাস রক্তক্ষরণের পর এই যুদ্ধ কোথায় এসে পৌঁছেছে? এই যুদ্ধের শেষই বা কোথায়?

যুদ্ধে সর্বশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী আজেরবাইজানকে সকল বিশ্লেষকেরাই এগিয়ে রেখেছেন। ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় সাংবাদিক সেবাস্টিয়ান রোবলিন বলছেন যে, কারাবাখের দক্ষিণের পুরোটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবার পর আজেরিরা খুব সম্ভবতঃ উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে; টার্গেট কৌশলগত ‘লাচিন করিডোর’ গিরিপথ। এই করিডোর হলো কারাবাখের রাজধানী স্তেপানাকার্ট (যাকে আজেরিরা বলে খানকেন্দি) এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর শুশার সাথে আর্মেনিয়ার মূল ভূখন্ডের যোগাযোগের মূল রাস্তা। ১৯৯২ সালে কারাবাখের সাথে আর্মেনিয়ার একটা কৌশলগত লাইফলাইন নিশ্চিত করতেই এই করিডোর দখল করে নেয় আর্মেনিয়রা। এবারের যুদ্ধে ২২শে অক্টোবর নাগাদ ইরানের সীমানায় আরাস নদী বরাবর পশ্চিমে এগুনোর পর আজেরিরা হাকারি নদীর সংযোগস্থলে পৌঁছে যায়। এই নদীর অববাহিকাই উত্তরে গিয়ে মিলেছে ‘লাচিন করিডোর’এর সাথে। অত্র অঞ্চলের পাহাড়ি বাস্তবতার কারণেই যোগাযোগের পথগুলি বেশ স্বল্প পরিসরের মাঝে সীমাবদ্ধ। এই করিডোরের উপর চাপ কমাতে আজেরবাইজানের সর্বদক্ষিণে আর্মেনিয়ার সীমানার কাছাকাছি আর্মেনিয়রা প্রতিআক্রমণ শুরু করে। আর এই অঞ্চলটা এমন একটা স্থানে, যেখানে আক্রমণ চালাতে গেলে আর্মেনিয়ার মূল ভূখন্ডের উপর নির্ভর করেই করতে হবে। আজেরিরা যদি এই করিডোরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, অথবা করিডোরের উপর সামরিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে সামনের শীতকালে কারাবাখের আর্মেনিয়রা মারাত্মক সমস্যায় পড়বে। তবে রোবলিন এও বলছেন যে, এই করিডোরের উপর চাপ পড়লে নাগোর্নো কারাবাখে যদি মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়, তাহলে তা রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশের জন্যে এই যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণ তৈরি করতে পারে। রাশিয়া লাচিন করিডোরের পশ্চিমে তেগ শহরের কাছে একটা সামরিক ক্যাম্প বসিয়েছে এই করিডোরের উপর নজরদারির জন্যে। 


তুর্কি মিডিয়া ‘টিআরটি ওয়ার্ল্ড’এর সাথে সাক্ষাতে ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিংট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর বিশ্লেষক রাউফ মামাদভ বলেন যে, দুই দেশের যুদ্ধে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শহর এখন লাচিন এবং শুশা। গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলগুলি দখলে নিয়ে আজেরিরা চাইবে দক্ষিণে কৌশলগত লাচিন এবং উত্তরে কারবাহাল এলাকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আজেরিদের কাছে শুশা হলো কারাবাখের হৃদয়। এই শহরটা যদি আজেরিরা সময়মত নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে, তাহলে তারা তা আলোচনার টেবিলে ব্যবহার করতে পারে; অবশ্য যদি আর্মেনিয়রা আলোচনায় রাজি থাকে। আজেরিরা ইতোমধ্যেই লাচিন থেকে আর্টিলারি দূরত্বে রয়েছে। বাকুর থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘তোপচুবাশভ সেন্টার’এর ডিরেক্টর রুসিফ হুসেইনভ বলছেন যে, লাচিন হলো কারাবাখ এবং আর্মেনিয়ার মাঝে সেতু; আর শুশা হলো এমন এক উঁচু জায়গা, যা নিয়ন্ত্রণে থাকলে পুরো কারাবাখই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিনি বলেন যে, লাচিন বা শুশার একটাও যদি আজেরিরা দখলে নিতে পারে, তা হবে এই যুদ্ধের মোড় ঘোড়ানো ঘটনা। আর দু’টাই যদি আজেরিদের কাছে চলে যায়, তবে যুদ্ধও শেষ হয়ে যেতে পারে। হুসেইনভ বলছেন যে, আর্মেনিয়রা এতকাল আলোচনা মেনে না নেয়ায় আজেরিরা এখন পুরো কারাবাখ পুনরুদ্ধারের পথেই হাঁটছে। আর সেটা সম্ভব না হলে তারা হয়তো লাচিন করিডোর এবং শুশার নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করবে। লাচিন করিডোর হারালে কারাবাখের বেঁচে থাকা কঠিন হবে।

তবে যুদ্ধ শেষের কথা বলতে গেলে শক্তিশালী দেশগুলির কথাও আলোচনায় আনতে হবে। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুলের প্রকাশনা ‘রাশিয়া ম্যাটার্স’এ এক লেখায় জ্যেষ্ঠ গবেষক মাইকেল কফম্যান বলছেন যে, আজেরবাইজানকে তুরস্ক সরাসরি সমর্থন দেয়ায় যে প্রশ্নটা সামনে এসেছে তা হলো, রাশিয়া তার আশেপাশের দেশগুলির সাথে যে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে, সেই অনুযায়ী রাশিয়া নিরাপত্তা দিতে সক্ষম কিনা। তিনি আরও বলছেন যে, এই যুদ্ধ দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ‘গ্রেট পাওয়ার’ এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলি অনেক সময়ই অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশগুলির উপর নিজেদের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দিতে চাইলেও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় তা সর্বদা সাফল্য পায় না।

তিনটা ব্যর্থ যুদ্ধবিরতির চেষ্টার পরেও জেনেভায় আলোচনায় বসেছেন আর্মেনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহরাব মেনাতসাকানিয়ান এবং আজেরবাইজানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেইহুন বায়রামভ। তবে এই আলোচনার সফলতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর। যখন আজেরিরা যুদ্ধে এগিয়ে রয়েছে এবং বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, তারা যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবে, তখন আলোচনার গুরুত্ব কমে যায় বৈকি। কৌশলগত ‘লাচিন করিডোর’ হাতছানি দিচ্ছে আজেরিদের কাছে; এর পর রয়েছে ‘কারাবাখের হৃদয়’ শুশা। তবে এই দুই টার্গেটের কোন একটা আজেরিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে তুরস্ক আর রাশিয়ার মাঝে বর্তমান স্থিতাবস্থা যে আরও চাপের মাঝে পড়বে, তা নিশ্চিত।