Monday 19 September 2022

ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের সাথে দ্বন্দ্বে লজিস্টিক্যাল সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

১৯শে সেপ্টেম্বর ২০২২
 
ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের লজিস্টিকস ব্যবস্থা কার্যকারিতার দিকে ফোকাস না দিয়ে কম বাজেটে কম বিনিয়োগে কর্মসম্পাদনের দিকে মনোযোগী হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক বাহিনীকে সর্বনিম্ন খরচায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বড় কোন শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামলে এই লজিস্টিকস ব্যবস্থা কেমন কাজ করবে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে মার্কিন সাপ্লাই ব্যবস্থা বেসামরিক সরবরাহকারীদের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অনেক বেশি কঠিন হতে পারে।

বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্বের পিছনে মূল কারণ হিসেবে সকলেই প্রযুক্তিকে ধরে নিলেও এখানে লজিস্টিকসের গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা পশ্চিমা চিন্তাবিদদের কাছে অজানা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিকে সারা বিশ্বে জাহির করতে এবং বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের শতশত সামরিক ঘাঁটিকে বাস্তবিকভাবে কার্যক্ষম রাখতে লজিস্টিকসই মূল ভূমিকা রেখেছে। মার্কিন সামরিক শক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো লজিস্টিকস। বাকি বিশ্বের চাইতে মার্কিনীদের অবস্থান এক্ষেত্রে বেশ কিছুটা অন্যরকম। কারণ মার্কিনীরা সারা দুনিয়াতে পুলিশম্যানের দায়িত্ব পালন করলেও তাকে সেটা করতে হচ্ছে নিজেদের দেশ থেকে হাজারো মাইল দূরে। নিজেদের দেশের দুই পাশে দুই মহাসাগর পরিবেষ্টিত হওয়ায় তা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে সুসংহত করলেও সারা দুনিয়ার পুলিশম্যান হবার জন্যে তা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। হাজার মাইল দূরে গিয়ে নিজেদের সেনাদের লজিস্টিকসের সমস্যাগুলি মেটানো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এক ব্যাপার। আর সেই চ্যালেঞ্জ ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে একভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হলেও এখন ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার বাস্তবতায়, বিশেষ করে ইন্দোপ্যাসিফিকে, নতুন করে সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে।

লজিস্টিকসের বাস্তবতা

মার্কিন বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা মাইকেল ট্রিম্বল এবং ‘ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স’এর কর্মকর্তা জোবি টার্নার ‘দ্যা স্ট্র্যাটেজি ব্রিজ’এর এক লেখায় বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে লজিস্টিকসের কারণে বাকি দুনিয়ার সামরিক বাহিনী থেকে মার্কিনীরা এগিয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং আফগানিস্তানে স্বল্প সময়ের জন্যে নিজেদের লজিস্টিকস সমস্যার মাঝে পড়লেও কোন শত্রু দীর্ঘ সময়ের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক লজিস্টিকসকে সমস্যায় ফেলতে পারেনি। তবে তারা বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সুবিধার কিছু দুর্বলতাও রয়েছে; যেগুলি অনেকেই আলোচনা করছেন না। এই দুর্বলতাগুলি সাম্প্রতিক সময়ে সামনে চলে এসেছে; বিশেষ করে করোনাভাইরাসের লকডাউন এবং এর পরবর্তী সাপ্লাই চেইন সমস্যা শুরুর পর থেকে। তারা বলছেন যে, মার্কিন সামরিক লজিস্টিকসের তিনটা প্রধান বাস্তবতার মাঝে একটা হলো মার্কিন সামরিক বাহিনী উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহণ পর্যন্ত বেসামরিক সরবরাহকারীদের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। এছাড়াও তারা আরও বলেন যে, দু’টা বাস্তবতা অনেকেই ভুলে যায়; যা কিনা যুদ্ধক্ষেত্রে জয়পরাজয় নির্ধারণ করে ফেলতে পারে। প্রথমতঃ লজিস্টিকস হলো বাস্তবিকপক্ষে এমন কিছু বস্তুর সরবরাহ, যা কিনা দেখা যায়, শোনা যায় এবং অনুভব করা যায়। অর্থাৎ সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাদের হাতে সরবরাহ পৌঁছে দিতে হবে; যা সৈন্যরা ব্যবহার করবে। দ্বিতীয়তঃ লজিস্টিকসের মূল বিষয় হলো মানুষের জন্যে সরবরাহ। যদিও সৈন্যরা যুদ্ধ করার জন্যে অস্ত্রসস্ত্র ব্যবহার করে, তথাপি মানুষ হিসেবে তারা খাদ্য, বস্ত্র এবং অন্যান্য চাহিদার উপর নির্ভরশীল; যেগুলি সরবরাহ না করতে পারলে সৈন্যরা যুদ্ধ করতে পারবে না; এমনকি শত্রুর বুলেটের আঘাত ছাড়াও মারা যেতে পারে। তবে যে প্রকারের সরবরাহই হোক না কেন, মার্কিনীরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, তাদের সাপ্লাই ব্যবস্থার উপর কেউ আক্রমণ করবে না। মূলতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিনীরা যেসকল শত্রুর মোকাবিলা করেছে, তাদের কেউই যুক্তরাষ্ট্রের লজিস্টিক্যাল ব্যবস্থার উপর হামলা করার মতো সক্ষম ছিল না। আর বেসামরিক সরবরাহকারীদের উপর নির্ভরশীল এই লজিস্টিকস ব্যবস্থা শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে মোটেই প্রস্তুত নয়।

ইন্দোপ্যাসিফিকে নতুন চিন্তা এবং লজিস্টিকসের নতুন চ্যালেঞ্জ

মার্কিন ম্যারিন কোরের ‘ফোর্স ডিজাইন ২০৩০’এর মূল চিন্তাটা হলো বাহিনীকে ইন্দোপ্যাসিফিকের দ্বীপগুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া, যাতে করে চীনারা তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের বহর ব্যবহার করে কোন বড় আকারের ক্ষতি করতে না পারে। অর্থাৎ বাহিনী ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে যাবার ফলে তাদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিও হবে কম। মার্কিন বন্ধুদের হাতে থাকা সেই দ্বীপগুলিকে ব্যবহার করে মার্কিনীরা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে চীনাদের সামরিক টার্গেটে আঘাত হানতে পারবে। তবে ম্যারিন কোরকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে ফেললে প্রতিটা গ্রুপকে ভালোমতো সরবরাহ করাটা খুবই কঠিন কাজ হয়ে যেতে পারে বলে অনেকেই বলছেন। ‘দ্যা ইউরেশিয়ান টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বাহিনীকে ছড়িয়ে দেয়ার এই চিন্তাটায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্বের ব্যাপারটা চিন্তা করা হয়নি। পেন্টাগনের জন্যে ‘দ্যা র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর করা ভার্চুয়াল যুদ্ধ মহড়ায় মার্কিন এবং তাইওয়ানি বাহিনী চীনাদের সাথে পুরোপুরিভাবে হেরেছে। এর কারণ হলো চীনারা কাছাকাছি হবার কারণে তাদের মূল ভূখন্ড থেকে সাপ্লাই নিয়ে এসে তাদের ক্ষতিগুলিকে দ্রুতই পুষিয়ে উঠতে পেরেছে; যা কিনা মার্কিনীরা পারেনি। এখানে মূল সমস্যা হলো, যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দূরবর্তী একটা যুদ্ধক্ষেত্রে অনায়াসে সরবরাহ পাঠানো কঠিন হয়ে যেতে পারে।
 
ম্যারিনদের পরিকল্পনার মূলে রয়েছে ছোট জাহাজ দ্বারা সরবরাহের প্রাপ্তি। জাপান, কোরিয়া এবং ফিলিপাইনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন দ্বীপগুলিকে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে; যেখানে মার্কিনীরা আগে থেকেই বিভিন্ন সাপ্লাই জমা করে রাখবে। মার্কিন সামরিক রসদ সরবরাহকারী জাহাজগুলি চীনা ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মাঝে এসে কিভাবে তাদের মালামাল নামাবে, তা চিন্তার বিষয়।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা স্টিমসন সেন্টার’এর এক আলোচনায় মার্কিন ম্যারিন কোরের উপপ্রধান জেনারেল এরিক স্মিথ বলেন যে, ইন্দোপ্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জগুলি হলো বাজে ধরণের গোপন জিনিস, যেগুলি নিয়ে কেউই কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। এখানে মূল চ্যালেঞ্জ হলো দৌড়ে পিছিয়ে পড়া। এই মুহুর্তে মার্কিন ম্যারিন কোরের যুদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যথেষ্ট লজিস্টিক্যাল সক্ষমতা নেই। ম্যারিনরা এখন বিশাল জাহাজগুলি সাপ্লাই দিয়ে ভরার জন্যে ৩০ দিন অপেক্ষা করতে পারবে না। ম্যারিনদের পরিকল্পনার মূলে রয়েছে ছোট জাহাজ দ্বারা সরবরাহের প্রাপ্তি। জাপান, কোরিয়া এবং ফিলিপাইনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন দ্বীপগুলিকে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে; যেখানে মার্কিনীরা আগে থেকেই বিভিন্ন সাপ্লাই জমা করে রাখবে। তবে এই দ্বীপগুলিতে মার্কিন ম্যারিন কোরের সহায়তায় জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের যে পরিকল্পনা তাদের রয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন এখনই সম্ভব নয়। আর মার্কিন সামরিক রসদ সরবরাহকারী জাহাজগুলি চীনা ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মাঝে এসে কিভাবে তাদের মালামাল নামাবে, তা চিন্তার বিষয়।

মার্কিন বন্ধুদের কাছ থেকে লজিস্টিক্যাল সহায়তা নেয়ার চিন্তাগত চ্যালেঞ্জ

ম্যারিন কোর পরিকল্পনা করছে যে, অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাদে বাকি সাপ্লাইগুলি তারা মার্কিন বন্ধু দেশগুলির থেকেই নেয়ার ব্যবস্থা করবে। এটা মার্কিনীদের অনেকেই পছন্দ না করলেও জেনারেল এরিক স্মিথ বলছেন যে, এর মাধ্যমে দূরবর্তী সাপ্লাই চেইনের উপরে নির্ভরশীলতা কমবে। এই পরিকল্পনার মাঝে রয়েছে ‘লাইট এম্ফিবিয়াস ওয়ারশিপ’ বা ‘এলএডব্লিউ’ নামের ছোট উভচর জাহাজ, যেগুলি ৮০ থেকে ১’শ জনের ছোট গ্রুপে ম্যারিন সেনাদের বিভিন্ন দ্বীপে নামিয়ে দিতে পারবে এবং তাদেরকে সেখানে সকল ধরণের সরবরাহ দেবে। যেখানে মার্কিনীরা যুদ্ধ করবে, সেখান থেকে যতটুকু সম্ভব সাপ্লাই যোগাড় করার চিন্তাটা নতুন নয়। তবে এর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে জনমতের কিছুটা অভাব রয়েছে।

মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন জেনারেল কার্টার বি ম্যাগ্রুডার তার ‘রিকারিং লজিস্টিক প্রবলেমস, এজ আই হ্যাভ অবজার্ভড দেম’ বইতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মার্কিনীদের সাপ্লাই যোগাড় করার শিক্ষাগুলির কথা বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশদের অনুকরণে মার্কিনীরা ইতালিয় সরবরাহকারী এবং ইঞ্জিনিয়ারদেরকে ব্যবহার করে রেললাইন এবং সেতু নির্মাণ করেছিল। এরপর কোরিয়া যুদ্ধের সময় মার্কিনীরা কোরিয় মাছের হ্যাচারি থেকে বিপুল পরিমাণে মাছ কেনে। আর একই সময়ে জাপানিরা মার্কিনীদের জন্যে বিপুল পরিমাণে হার্ডওয়্যার যন্ত্রপাতি ‘রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং’এর মাধ্যমে তৈরি করে দিয়ে সময় এবং খরচ বাঁচিয়ে দেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়েও জাপানিদের এই সহায়তা অব্যহত ছিল। জেনারেল ম্যাগ্রুডার বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য দেশ থেকে সাপ্লাই নেবার ব্যাপারে ভিন্ন মতামত রয়েছে। ব্রিটিশরা নিজেদের দেশে সম্পদের অভাবের কারণে উপনিবেশের সম্পদের উপর নির্ভর করেছে। কিন্তু মার্কিনীরা নিজস্ব সম্পদের উপর নির্ভরশীল থাকার কারণে অন্য কারুর সম্পদ ব্যবহারে খুব একটা আগ্রহী ছল না। অনেক মার্কিনীই মনে করে যে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকিদের পণ্য নিম্নমানের। তবে এই যুক্তি যথেষ্টই দুর্বল হয়ে যায়, যখন জাপান এবং কোরিয়া মার্কিনীদেরকে সরবরাহ করতে গিয়ে মার্কিন স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী বিভিন্ন জিনিস উৎপাদন করতে শুরু করে।

 
ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে লজিস্টিকস কিভাবে চলবে, সেটার একটা কাঠামো বিদ্যমান। দু’জায়গাতেই সম্ভাব্য যুদ্ধক্ষেত্র মূলতঃ স্থলে। যেকারণে সেনাবাহিনী সেই অঞ্চলের কমান্ডে থাকে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাপ্লাই আসার পর সেটা বন্টনের দায়িত্ব সেনাবাহিনীই নিয়ে নেয়। কিন্তু ইন্দোপ্যাসিফিকে সমস্যা হলো, এখানকার বেশিরভাগ এলাকাই সমুদ্র। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেই দায়িত্ব নৌবাহিনীর নেয়ার কথা। কিন্তু ইন্দোপ্যাসিফিকের মাঝে এই সাপ্লাই বন্টনের দায়িত্ব নৌবাহিনীকে যেমন দেয়া হয়নি; তেমনি যুদ্ধের সময়ে সেটা কিভাবে কাজ করবে, সেটা নিয়েও কেউই মাথা ঘামায়নি।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর লজিস্টিকসের সংস্কৃতির চ্যালেঞ্জ

মার্কিন সেনাবাহিনীর লজিস্টিক্যাল কর্মকর্তা এবং সেনাবাহিনীর একাডেমিতে শিক্ষক ক্যাপ্টেন ফ্রেড ব্রাউন ‘ওয়েস্ট পয়েন্ট’ একাডেমির ‘মডার্ন ওয়ার ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় বলছেন যে, মার্কিন সেনাবাহিনীতে কয়েকটা সংস্কৃতিগত সমস্যা রয়েছে; যা কিনা লজিস্টিকসকে সর্বদা সমস্যায় জর্জরিত রাখছে। প্রথমতঃ শান্তির সময়ে লজিস্টিকসের জনবলের ট্রেনিংএর জন্যে সময় বের করা যায় না; কাজেই লজিস্টিকসের কোন মহড়া হয় না। কারণ তখন বিভিন্ন ফর্মেশন কমান্ডাররা লজিস্টিকসের মহড়ার চাইতে তাদের যুদ্ধক্ষেত্রের মহড়াকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এর ফলস্বরূপ যখন হঠাৎ করেই সেনাবাহিনীকে কোথাও মোতায়েন করা হয়, তখন লজিস্টিকস ইউনিটগুলি একেবারেই অপ্রস্তুত থাকে। দ্বিতীয়তঃ লজিস্টিকসের ক্ষেত্রে চাহিদা নির্ধারিত হয় কতটুকু স্টক অবশিষ্ট আছে সেটার উপর ভর করে। ফর্মেশন কমান্ডাররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্টক ফুরাবার অনেক আগেই নতুন করে সাপ্লাইএর অর্ডার দিয়ে বসেন এবং সেগুলি ঐ মুহুর্তেই ডেলিভারি প্রত্যাশা করেন। শুধু তাই নয়, লজিস্টিকস অফিসাররা সাধারণতঃ হয় ফর্মেশনের কমান্ডারের অধীনে জুনিয়র অফিসার। কাজেই চাহিদার ব্যাপারটা কোন প্রশ্ন না করেই তাকে বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফর্মেশন কমান্ডাররা লজিস্টিকসের অফিসারদের সাথে কথা বলে তাদের চাহিদা ঠিক করেন না কখনোই। যেকারণে সাপ্লাইয়ের যে অংশটা স্টকে ঘাটতি পড়েছে, যা জানা যায় ঠিকই; কিন্তু কোন অংশ যদি অতিরিক্ত রয়ে যায়, তাহলে সেটা আর জানা সম্ভব হয় না এবং তা অব্যবহৃত থাকে। তৃতীয়তঃ লজিস্টিকস যে সর্বদাই শত্রুর আক্রমণ ছাড়াই নির্বিঘ্নে চলতে পারবে তা কিন্তু নয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে মার্কিন সেনা সদস্যরা যুদ্ধক্ষেত্রেই নিজেদের চেষ্টায় তাদের ট্রাকগুলিকে বর্মাবৃত করেছিল এবং সেগুলির উপর অস্ত্র বসিয়েছিল সাপ্লাই মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে। কিন্তু সেই শিক্ষাগুলি সেনাবাহিনী নেয়নি। ২০০৩ সালে ইরাকে ৫০৭তম মেইনটেন্যান্স কোম্পানির গাড়ি বহরে হামলায় ১১ জন সেনা নিহত হয়েছিল। সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যা শেখে, তা শান্তিকালীন সময়ে ভুলে যায়। সামনের দিনগুলিতে লজিস্টিকসের উপর শত্রুর হামলা হলে আবারও বিপদে পড়তে হতে পারে। চতুর্থতঃ নতুন কোন প্রযুক্তি আসার সাথেসাথেই সেনাবাহিনী সেটা বাহিনীর অন্তর্গত করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। কেউই চিন্তা করে না যে, সেটা কতটুকু ব্যবহার করা সম্ভব হবে। যেকারণে কিছুদিন পরেই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে সকলেই বিমুখ হয়ে পড়ে এবং একসময় সেটা সকলেই ভুলে যায়। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ফর্মেশনগুলি বেশ ভালো করে। কিন্তু লজিস্টিকস ইউনিটগুলির নতুন প্রযুক্তির ব্যাপারে ট্রেনিং নেয়ার সময়ও নেই। আর ফর্মেশন কমান্ডাররাও কখনোই চান না যে লজিস্টিকসের জনবল ট্রেনিংএ ব্যস্ত থাকুক। অথবা যখন তারা ট্রেনিংএ ব্যস্ত থাকবে, তখন তাদের জন্যে অতিরিক্ত জনবলের ব্যবস্থা করার ব্যাপারেও কেউই ইচ্ছুক নয়। কারণ এতে করে ফর্মেশনগুলিতেই জনবলের সংকট হতে পারে।

ইন্দোপ্যাসিফিকে লজিস্টিকসের কাঠামোগত সমস্যা

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিনীরা ইন্দোপ্যাসিফিকে লজিস্টিকসের ব্যাপারে তেমন কোন চিন্তা করেনি। বিশেষ করে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের ভেতরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সাপ্লাই কিভাবে নেয়া হবে, তা নিয়ে কেউই চিন্তা করেনি। মূল সমস্যাটা শুরু হয় কৌশলগত সাপ্লাই পৌঁছাবার পর। কৌশলগত সাপ্লাই হলো যেগুলি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জাহাজে বা বিমানে করে পৌঁছায়। সেখান থেকে ঐ অঞ্চলের বাকি এলাকাগুলিতে সেই সাপ্লাই কি করে পৌঁছাবে, সেখানেই চ্যালেঞ্জ। ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে লজিস্টিকস কিভাবে চলবে, সেটার একটা কাঠামো বিদ্যমান। দু’জায়গাতেই সম্ভাব্য যুদ্ধক্ষেত্র মূলতঃ স্থলে। যেকারণে সেনাবাহিনী সেই অঞ্চলের কমান্ডে থাকে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাপ্লাই আসার পর সেটা বন্টনের দায়িত্ব সেনাবাহিনীই নিয়ে নেয়। কারণ ভূমির উপর দিয়ে পরিবহণ করতে গেলে সেটা রেলগাড়ি বা ট্রাকের মাধ্যমে করতে হবে; যা কিনা সেনাবাহিনীর দায়িত্বের মাঝে পড়ে। কিন্তু ইন্দোপ্যাসিফিকে সমস্যা হলো, এখানকার বেশিরভাগ এলাকাই সমুদ্র। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেই দায়িত্ব নৌবাহিনীর নেয়ার কথা। কিন্তু ইন্দোপ্যাসিফিকের মাঝে এই সাপ্লাই বন্টনের দায়িত্ব নৌবাহিনীকে যেমন দেয়া হয়নি; তেমনি যুদ্ধের সময়ে সেটা কিভাবে কাজ করবে, সেটা নিয়েও কেউই মাথা ঘামায়নি। যদি সেখানে লজিস্টিকসের জন্যে ব্যবহার করা জাহাজের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতেও দেয়া হয়, সেটাও তো নির্দিষ্ট করেই দিতে হবে। নৌবাহিনী মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাপ্লাই কিভাবে ইন্দোপ্যাসিফিকে আসবে, সেটা নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু সেই সাপ্লাইয়ের বন্টনের ক্ষেত্রে কে বেশি গুরুত্ব পাবে, সেটা নির্দিষ্ট নয়। যেমন, বিমান বাহিনী সাধারণতঃ সাপ্লাইয়ের একটা বড় অংশ পায়। বিমান বাহিনীর সাপ্লাইগুলি কে কিভাবে বন্টন করবে? ইন্দোপ্যাসিফিকে নিজেদের সাপ্লাই কতটা প্রয়োজন, সেটা কেউই যেমন সংগঠিতভাবে হিসেব করতে পারছে না, তেমনি কে সাপ্লাইয়ের কতটা পাবে, সেটার ব্যাপারেও কোন কনসেপ্ট নেই।

 
৪৬টা জাহাজ রয়েছে পরিবহণ দপ্তরের ‘ম্যারিটাইম এডমিনিস্ট্রেশন’ বা ‘মারাড’এর অধীনে। এগুলি অনেক ক্ষেত্রেই ৩০ বছরের বেশি পুরোনো। 'মারাড' একটা মহড়া দিয়েছিল পরীক্ষা করার জন্যে যে, হঠাত করে নির্দেশ দিলে কয়টা পরিবহণ জাহাজ সমুদ্রে যেতে পারে। এর ফলাফল ছিল খুবই খারাপ। মাত্র ৪০ শতাংশ জাহাজ সমুদ্রে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

মার্কিনীদের সমুদ্র পরিবহণের সংকট

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড বাজেটারি এসেসমেন্টস’ বা ‘সিএসবিএ’র ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের পুরো ম্যারিটাইম শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব মালিকানায় থাকা পরিবহণ জাহাজগুলির অবস্থা সঙ্গীন, অপদিকে বেসরকারি শিপইয়ার্ডগুলি, যারা জাহাজ তৈরি করার অর্ডার পাচ্ছে, তাদের অবস্থাও ভালো নয়। এছাড়াও যারা এই পরিবহণ জাহাজগুলি পরিচালনা করবে, তারাও খুব ভালো নেই। যুক্তরাষ্ট্রকে যদি কোন বড় আকারের সামরিক মিশনে যেতে হয়, তাহলে মার্কিন জাহাজগুলি পেন্টাগনের রসদপাতি এবং জ্বালানি পরিবহণের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে না। এই মুহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র যদি কোন সংঘাতে জড়ায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ড থেকে মালামাল পরিবহণ করতে হবে দুই সংস্থার জাহাজে; ৪৬টা জাহাজ, যা কিনা পরিবহণ দপ্তরের ‘ম্যারিটাইম এডমিনিস্ট্রেশন’ বা ‘মারাড’এর অধীনে; আর ১৫টা জাহাজ, যা কিনা ‘মিলিটারি সীলিফট কমান্ড’ বা ‘এমএসসি’র অধীনে। দ্বিতীয় ধাপে মালামাল নেয়ার জন্যে ওয়াশিংটনকে নির্ভর করতে হবে মার্কিন মালিকানায় থাকা বেসরকারি পরিবহণ জাহাজের উপরে। এছাড়াও বিদেশী জাহাজও মার্কিন সরকার চার্টার করতে পারে।

মার্কিন সরকারের অধীনে থাকা জাহাজগুলি অনেক ক্ষেত্রেই ৩০ বছরের বেশি পুরোনো। আর এদের ক্রুরাও অনেক ক্ষেত্রেই বয়সের ক্ষেত্রে তরুণ নয়। সকল জাহাজ একত্রে চালাতে গেলে লোকবল বর্তমানে ২ হাজার কম রয়েছে। এছাড়াও শিপইয়ার্ডগুলিতেও সক্ষমতার ব্যাপক অভাব রয়েছে। মার্কিন মালিকায়া থাকা বেসরকারি জাহাজের সংখ্যাও কমে গেছে। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় সরকারের কর নীতি, বিদেশী শিপিং লাইনের সাথে পেরে না ওঠা এবং পরিবর্তিত বৈশ্বিক অর্থনীতি। ২০২০এর জানুয়ারিতে ‘মারাড’এর কর্মকর্তা প্রাক্তন রিয়ার এডমিরাল মার্ক বুজবি এক সিম্পোজিয়ামে বলেন যে, তারা একটা মহড়া দিয়েছিলেন পরীক্ষা করার জন্যে যে, হঠাত করে নির্দেশ দিলে কয়টা পরিবহণ জাহাজ সমুদ্রে যেতে পারে। এর ফলাফল ছিল খুবই খারাপ। মাত্র ৪০ শতাংশ জাহাজ সমুদ্রে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়াও ‘সিএসবিএ’র প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সরকারি সকল জাহাজ কার্যকর করা গেলেও আরও ৫ লক্ষ বর্গফুট জায়গার ঘাটতি থাকবে, যা কিনা মার্কিন বা বিদেশী বেসরকারি জাহাজ দিয়ে পুরণ করতে হবে। এছাড়াও নিজেদের বাহিনীর জন্যে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ করতে যত জাহাজ প্রয়োজন, তার মাঝে মাত্র ১০ শতাংশ এখন মার্কিন সরকারের কাছে রয়েছে। পেন্টাগনকে আরও ৭৬টা জ্বালানিবাহী ট্যাংকার জাহাজ চার্টার করতে হবে। আর এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে; কারণ এক দশকের মাঝেই সরকারি বেশিরভাগ জাহাজ রিটায়ার করিয়ে দিতে হবে। আর ম্যারিন কোর সামনের দিনে যে নতুন নীতির দিকে এগুচ্ছে, তাতে জ্বালানি আরও বেশি প্রয়োজন হবে। এর সমাধান হিসেবে প্রতিবেদনে মার্কিন সরকারকে আরও জাহাজ কেনার এবং মার্কিন মালিকানায় আরও বেসরকারি জাহাজ আনার ব্যবস্থা করতে বলা হয়।

‘ডিফেন্স নিউজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সকল রসদপাতি পরিবহণ করতে ৩’শ জাহাজের পাঁচ মাস লেগেছিল। শুধু তাই নয়, এরপরেও বহু অভিযোগ ছিল। ‘আমেরিকান সোসাইটি অব নেভাল ইঞ্জিনিয়ার্স’এর এক অনুষ্ঠানে কংগ্রেসম্যান রব উইটম্যান বলেন যে, এই মুহুর্তে তাইওয়ান ইস্যুতে কোন জরুরি প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো প্রথম ধাপে দ্রুত রসদপাতি ইন্দোপ্যাসিফিকে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু জাহাজের সংখ্যা এবং বয়সের কারণে পরের ধাপে রসদ পাঠানো খুবই কঠিন হয়ে যাবে। চীনকে মোকাবিলায় অনেক কিছুকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু লজিস্টিকসকে একেবারেই আমলে নেয়া হয়নি। অপরদিকে নৌবাহিনী যখন পুরোনো জাহাজ কেনার কথা বলছিল, সেখানেও ছিল অনেক সমস্যা। যেমন, বেসামরিক জাহাজ, যেগুলিতে গাড়ি বহণ করা হয়, সেগুলির ভেতরে প্রায় অর্ধেক জায়গাতেই সামরিক গাড়ি বহণ করা যায় না। কারণ হয় ডেকগুলি সামরিক ভাড়ি গাড়ি বহণের জন্যে যথেষ্ট মজবুত নয়; অথবা ছাদ অতিরিক্ত নিচু; অথবা গাড়ি ঘোরাবার স্থান খুব কম; অথবা গাড়ি ওঠানামার জন্যে র‍্যাম্পগুলি খুবই খাড়া। শুধু তাই নয়, পুরোনো জাহাজগুলিকে যেকোন সময় দরকারে ডাকার জন্যে সরকার ১৮ বছর ধরে বেসারকারি কোম্পানিকে প্রতি বছর ৫ মিলিয়ন ডলার করে অর্থায়ন করে এবং এরপর তারা সেগুলিকে পুরোপুরি কিনে ফেলে। এই সমস্যাগুলিকে মাথায় রেখেই গত জুন মাসে মার্কিন কংগ্রেস ২০২৩ সাল থেকে ১০টা নতুন জাহাজ মার্কিন শিপইয়ার্ডগুলিতে তৈরি করার জন্যে বিল পাস করেছে। একেকটা জাহাজে দেড় লক্ষ বর্গফুট জায়গা থাকবে এবং একেকটা জাহাজের জন্যে খরচ হবে প্রায় ৩’শ ৩০ মিলিয়ন ডলার। একটা শিপইয়ার্ড কাজ করলে বছরে একটা করে জাহাজ ডেলিভারি দেবে। আর সকল শিপইয়ার্ড একত্রে কাজ করলে ১৫ বছরে ৪০টা জাহাজ তৈরি সম্ভব। তবে সেখানে কংগ্রেসের কাছ থেকে অর্থায়ন এখনও নিশ্চিত নয়। অপরদিকে পুরোনো জাহাজ কিনতে গিয়ে একেকটা জাহাজে খরচ হচ্ছে ৪৫ মিলিয়ন ডলার। কংগ্রেসম্যান উইটম্যান মনে করছেন যে, শেষ পর্যন্ত কিছু নতুন এবং কিছু পুরাতন জাহাজ কিনেই হয়তো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

‘নিকেই এশিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর মনে করছে যে, এশিয়াতে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে জ্বালানি ও রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে বিরাট ঘাটতি রয়েছে। গত এপ্রিল মাসে কংগ্রেসের কাছে দেয়া ‘প্যাসিফিক ডিটারেন্স ইনিশিয়েটিভ’ বা ‘পিডিআই’এর অধীনে এক প্রকল্প পরিকল্পনায় বলা হচ্ছে যে, ইন্দোপ্যাসিফিকে কোনপ্রকার যুদ্ধাবস্থার মাঝে সামরিক বাহিনীকে সাপ্লাই দিয়ে কর্মক্ষম রাখা কঠিন হবে। ‘পিডিআই’এর অধীনে পেন্টাগন ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের মাঝে ২৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে চাইছে; যার মাঝে ১ বিলিয়ন ডলার রাখা হয়েছে লজিস্টিকসের জন্যে। যেকোন যুদ্ধের মাঝে চীনারা ইন্দোপ্যাসিফিকে মার্কিন সামরিক সাপ্লাই আসতে বাধা দেবে। মার্কিন পরিবহণ এবং ট্যাঙ্কার বিমানগুলি নিঃসন্দেহে চীনাদের আক্রমণের শিকার হবে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, একারণে আগে থেকেই অত্র এলাকায় রসদপাতি, জ্বালানি, মেডিক্যাল দ্রব্যাদি এবং খাবার যথেষ্ট পরিমাণে মজুদ করে রাখতে হবে। জাপানের টোকিও এবং ইওয়াকুনির কাছে মার্কিন ঘাঁটিগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে জেট ফুয়েল মজুদের কথা বলা হয়েছে। এগুলি জ্বালানিবাহী জাহাজ পৌঁছাবার আগ পর্যন্ত কাজে লাগবে।

যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে যে, চীনাদেরকে সময় দিলে তারা সামনের দিনগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, সামরিক দিক থেকেও অতিক্রম করে যাবে। একারণেই চীনারা প্রস্তুত হবার আগেই যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। লজিস্টিকস কোন ‘গ্ল্যামারাস’ কাজ নয়; তাই কেউই এটার পিছনে সময় ব্যয় করতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখার কোন সুযোগই নেই। ইতিহাসে জয়ের পিছনে লজিস্টিকস ভালো থাকার অনেক উদাহরণ রয়েছে। তবে লজিস্টিকসের জন্যেই কেউ জিতেছে, তেমনটা হয়তো কেউ দেখাতে পারবে না। তথাপি লজিস্টিকস ভালো না থাকার কারণে হারতে হয়েছে, এমন উদাহরণ রয়েছে বহু। ‘দ্যা র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ঠান্ডা যুদ্ধের পর থেকে গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের লজিস্টিকস ব্যবস্থা কার্যকারিতার দিকে ফোকাস না দিয়ে কম বাজেটে কম বিনিয়োগে কর্মসম্পাদনের দিকে মনোযোগী হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক বাহিনীকে সর্বনিম্ন খরচায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বড় কোন শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামলে এই লজিস্টিকস ব্যবস্থা কেমন কাজ করবে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে মার্কিন সাপ্লাই ব্যবস্থা বেসামরিক সরবরাহকারীদের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অনেক বেশি কঠিন হতে পারে। মার্কিন সামরিক বাহিনী চিন্তাগত, সংস্কৃতিগত, কাঠামোগত এবং জাহাজের সংখ্যার সমস্যাগুলিকে কতটা শুধরে নিতে পারবে, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও যে ব্যাপারটা নিশ্চিত তা হলো, মার্কিনীদের কাছে এখন নিজেদের প্রস্তুতি নয়, বরং চীনের সাথে প্রস্তুতির প্রতিযোগিতার দৌড় এবং সেই দৌড়ের টাইমলাইন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঘড়ির কাঁটা দ্রুত সংঘাতের দিকেই এগুচ্ছে।



সূত্রঃ

‘Asymmetric Advantage or Achilles Heel: Logistics in the U.S. Military’ by Michael Trimble and Jobie Turner, in The Strategy Bridge, 14 June 2022

‘America’s ‘Dirty Secret’- USMC General Admits ‘Wicked’ Logistics Problems In Western Pacific To Battle China’ in The Eurasian Times, 19 June 2022

‘The Four Logistics Dilemmas Awaiting the Army on the Modern Battlefield’ by Captain Fred Brown in Modern War Institute at West Point, 29 November 2018

‘The Problem of Intra-Theater Lift: Moving Things Around in the Pacific Area of Responsibility’ in The RAND Corporation, 06 September 2022

‘Lethal and Effective: Marine Corps Force Design 2030 and U.S. – Japan Defense Cooperation’ in The Henry L Stimson Center, 16 June 2022

‘Recurring Logistic Problems: As I have Observed Them’ by General Carter B Magruder, 1991

‘Military and Defense-Related Supply Chains’ in The RAND Corporation, 22 June 2021

‘U.S. lacks Asian logistics support for armed conflict: Pentagon’ in Nikkei Asia, 04 May 2022

‘Report: U.S. Sealift Lacks Personnel, Hulls, National Strategy’ in USNI News, 14 February 2020

‘House defense bill calls for US-built ships to modernize strategic sealift fleet’ in Defense News, 24 June 2022

No comments:

Post a Comment