Tuesday 22 July 2014

ফরাসী সামরিক কূটনীতি কি নতুন কিছু?

২২ জুলাই ২০১৪



দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকা যে অপার শক্তিশালী হয়ে দেখা দেয়, সেটা মেনে নিতে কিছুটা হলেও কষ্ট হচ্ছিল এতোদিনের বিশ্বকর্তা বৃটেন আর ফ্রান্সের। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধের পর থেকেই বৃটেন আর ফ্রান্স বুঝতে পারে যে চাবি হাতবদল হয়ে গেছে। ১৯৬০-এর দশকে এসে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানুষের স্বাধীনচেতা অনুভূতি চাড়া দিয়ে উঠে; সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে একই সাথে। এই দুটি ঔপনিবেশিক শক্তি ছাড়াও বাকি দেশগুলিও তাদের উপনিবেশ গুটিয়ে ফেলতে শুরু করে; দিন বদলের হাওয়া লেগেছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই আন্দোলন দমন করতে যেয়ে তারা বুঝতে পারে যে তাদের সামরিক বাহিনীর গঠনে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। সামনের দিনগুলিতে এইরকম গেরিলা যুদ্ধের সম্মুখীন তাদের হতেই হবে। তখন থেকেই পরিবর্তন শুরু হলেও ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরূদ্ধে স্নায়ূযুদ্ধই ছিল তাদের প্রাধান্য। সোভিয়েত পতনের সাথে সাথে বিরাট আকৃতির যুদ্ধের সম্ভাবনা কমতে থাকে। আর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদার হামলার পর থেকে গেরিলা-টাইপের যুদ্ধের সম্ভাবনাই বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বাকিরাও তাদের সামরিক বাহিনীতে আনে পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে ফ্রান্স।

মালির রাজধানী বামাকো-তে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর 'সি-১৭' পরিবহণ বিমান থেকে ফরাসী সেনাবাহিনীর 'ভিএবি' আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) নেমে আসছে। ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ ইউনিটই আকাশপথে পরিবহণ করা সম্ভব।


ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনী দ্রুতিই যেখানে এখন একমাত্র চাহিদা
ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীর গঠন জানান দিয়ে দেয় যে তারা কোন ধরনের মিশনকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের এই বাহিনী তৈরি করেছে। একসময় আমরা সেনাবাহিনীর ডিভিশনকেই প্রধান ইউনিট হিসেবে জানতাম; ডিভিশনের মধ্যে থাকবে কয়েকটি করে ব্রিগেড, রেজিমেন্ট; সেগুলির মাঝে থাকবে কয়েকটি করে ব্যাটালিয়ন (উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে রয়েছে ৮টা ডিভিশন)। কিন্তু মজার ব্যাপার যে এখন ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ইউনিট হলো ব্রিগেড। তাদের অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যত চিন্তা তাদেরকে বলে দিচ্ছে যে সামনের দিনগুলিতে বড় আকারের যুদ্ধ (যেখানে ডিভিশনের পর ডিভিশন সৈন্য দরকার হবে) কমে যাচ্ছে। ১০ থেকে ২০ হাজার সৈন্যের ডিভিশনের যায়গায় প্রধান ফর্ম্যাশন হয়ে যাচ্ছে ৩ থেকে ৬ হাজার সৈন্যের ব্রিগেড বা রেজিমেন্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের দরকার হবে ছোট আকারের বাহিনী, যা খুব দ্রুত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মোতায়েন করা যাবে। আর সেই বাহিনী অনেক কম শক্তি নিয়েও তার কাজ হাসিল করে নিতে পারবে, কারণ এই বাহিনীর পেছনে বিমান, স্যাটেলাইট ছাড়াও যত ধরণের উন্নত প্রযুক্তি আছে সবকিছুই থাকবে। এই কম শক্তির সেনাবাহিনীর গঠন খুঁটিয়ে দেখলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হবে। 

ফরসী সেনাবাহিনীর 'এমএক্স-১০আরসি' আর্মার্ড কার। যেখানেই দ্রুত সৈন্য পাঠানো দরকার, সেখানেই ট্যাঙ্কের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে এই দ্রুতগামী সাঁজোয়া গাড়িগুলি। ১৫ টনের এই গাড়িগুলি বিমানে পরিবহন করা সম্ভব।


ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর এখন মোটামুটিভাবে ৮টা ফাইটিং ব্রিগেড রয়েছে। এর মধ্যে দুটা হলো আর্মার্ড ব্রিগেড, ২টা মেকানাইজড ব্রিগেড, ২টা লাইট আর্মার্ড ব্রিগেড, ১টা প্যারাশুট ব্রিগেড ও ১টা মাউন্টেন ব্রিগেড। এর বাইরেও অবশ্য আরো ৪টা বিভিন্ন সাপোর্ট ব্রিগেড ও স্পেশাল ফোর্সের ১টা ব্রিগেড ও ৩টা রেজিমেন্ট রয়েছে। দ্রুত পৃথিবীর যেকোন জায়গায় পাঠাতে এই বাহিনীকে এভাবে গঠন করা হয়েছে। এখানে দুটা মাত্র আর্মার্ড ব্রিগেড রয়েছে; যার একেকটিতে ১০০ থেকে ১২০টার মতো এএমএক্স-৫৬ লেক্লার্ক ট্যাঙ্ক রয়েছে। এই ট্যাঙ্কগুলি ৫৪-৫৭টন ওজনের। এছাড়াও ট্যাঙ্কের সাথে সাপোর্ট দেবার জন্যে রয়েছে জিটিসি সেলফ-প্রপেল্ড আর্টিলারি; এগুলি ৪২ টন ওজনের। এই হেভি ইকুইপমেন্টের জন্যে এই ইউনিটগুলি (আর্মার্ড ব্রিগেড) বিমানে করে পৃথিবীর কোথাও পাঠানো যাচ্ছে না; জাহাজ ছাড়া গতি নেই। কাজেই যেখানে ট্যাংক ছাড়া যুদ্ধ করা সম্ভব হবে না, সেখানে জাহাজের সাহায্য নিতে হবে; সময় বেশি লাগবে। কিন্তু যেখানে সময় কম, আর ট্যাঙ্ক ছাড়াও কাজ হাসিল করা সম্ভব, সেখানে পুরো ইউনিটই আকাশপথে চালান করার পদ্ধতি রাখা হয়েছে। মেকানাইজড আর লাইট আর্মার্ড ব্রিগেডগুলি এমনই। এগুলিতে লেক্লার্ক ট্যাংকের জায়গায় রাখা হয়েছে এএমএক্স-১০আরসি আর্মার্ড কার (১৫টন) আর ইআরসি-৯০ আর্মার্ড কার (৮টন)। আর জিটিসি সেলফ-প্রপেল্ড আর্টিলারির স্থলাভিষিক্ত হয়েছে সীজার সেলফ-প্রপেল্ড আর্টিলারি, যার ওজন ১৮টন। আর্মার্ড আর মেকানাইজড সবগুলি ইউনিটেই রয়েছে ভিএবি আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি), আর ভিবিসিআই ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভেহিকল (আইএফভি)।ভিএবি-এর ওজন ১৪টন আর ভিবিসিআই-এর ওজন ২৬টন। এই সবগুলি গাড়িই বিমানে করে স্থানান্তর সম্ভব। প্যারাশুট আর মাউন্টেন ব্রিগেডগুলি আরও অনেক হাল্কা। ইউরোপের যেকোন যুদ্ধের ময়দানে এই হাল্কা ইউনিট খুব বেশি কিছু করতে পারবে না। তার মানে এটাই যে ফ্রান্স ইউরোপে বড় কোন যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রায় উড়িয়েই দিয়েছে। এখন তাদের কূটনীতি পৃথিবীর এমন সকল জায়গাকে ঘিরে যেখানে কোন একটা দ্বন্দে জয় পেতে খুব বেশি ভারি যন্ত্রপাতির দরকার হবে না। ফ্রান্সের চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু যে এখন আফ্রিকা, সেটা বুঝতে খুব বেশি হিসেব কষতে হয় না। প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ফ্রান্স এই এলাকার অনেকগুলি দেশকে ভালোভাবেই চেনে। আর তারা এ-ও দাবি করে যে তারাই এই এলাকায় সবচেয়ে দক্ষতার সাথে অপারেট করতে পারবে। আফ্রিকাতে তারা একাধিক যায়গায় তাদের পা-রাখার পথ খোলা রেখেছে। যেকোন আন্তর্জাতিক দ্বন্দে তারা এই পথ ব্যবহার করবে। 

আফ্রিকার পুলিশম্যান এখন কি করছে?
ফরাসীদেরকে আফ্রিকার পুলিশম্যান বললে দোষ হবে নাতারা গত অর্ধ-শতাব্দীতে এতবার আফ্রিকাতে তাদের প্রাক্তন উপনিবেশগুলিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে যে, তাদের আফ্রিকাতে আসা-যাওয়াটা প্রায় গা-সওয়াই হয়ে গেছে। আর সুপার-পাওয়ার না হবার কারণে ফরাসীরা খুব বেশী ডেউ তৈরি না করেই বারংবার তাদের কাজ করে গেছে আফ্রিকাতে। মার্কিনীদের পক্ষে অবশ্যই এত্ত সহজে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব ছিল না। আমেরিকার সামরিক কার্যকলাপ ফলাও করে হেডলাইন হলেও ফ্রান্সের অভিযানগুলি কেন যেন ছোট অভিযান হিসেবেই কভার করা হয়েছে। অথচ জাতসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হবার পুরো ফায়দাটা কিন্তু তারা নিয়েছে। আফ্রিকাতে এতবার আসা-যাওয়া করলেও বেশিরভাগক্ষেত্রেই জাতিসংঘের অনুমতি তাদের নিতে হয়নি। আফ্রিকানরাই প্রথমে সুযোগ করে দিয়েছে ফরাসীদের। আফ্রিকাতে গণতন্ত্রের চর্চা খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতোসেসব দেশে বারংবার সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ফরাসীদেরকে হস্তক্ষেপের সুযোগ দিয়েছে। একই ব্যাপার ঘটিয়েছে ঘন ঘন গৃহযুদ্ধ। চাদ, গ্যাবন, সেনেগাল-এর মতো দেশে তারা স্থায়ীভাবে রয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতিতে আফ্রিকা অনেক বড় স্থান করে রেখেছে। তাদের সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। 

২০১২ সালের অক্টোবরের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যাচ্ছে চাদ-এর রাজধানী নিজালমিনাতে ফরাসী বিমান বাহিনীর দু'টা 'মিরাজ এফ-১সিআর' এবং দু'টা 'মিরাজ-২০০০' জঙ্গী বিমান। পরের বছরে মালি-এর যুদ্ধে এই ঘাঁটি বিরাট ভূমিকা রাখে।


মরুভূমিতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ!
পূর্ব আফ্রিকার হর্ন অব আফ্রিকা’ এলাকাটা এখন বেশ গরম। সোমালিয়া এখানে একটা প্রায় সরকার-বিহীন এলাকা (দেশ বলা দুষ্কর)এখানে বহুদিন ধরে গেড়ে বসে আছে আস্ত্রধারী আল শাবাব গোষ্ঠি। আল-কায়েদার সাথেও এদের আঁতাত রয়েছে বলে জানা যায়। এই এলাকায় কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া, এবং অন্যান্য দেশে বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসী হামলার জন্যে এরা দায় স্বীকার করেছে। এদের বিরূদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র; আর সেই যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হচ্ছে জিবুতি, যা একটা ফ্রেঞ্চ উপনিবেশ। এর কিছুটা পশ্চিমে সাব-সাহারান আফ্রিকাতে প্রায় পুরোটাই মরু অঞ্চল। এই বিশাল এলাকায় কোন ধরনের সরকারই কাজ করে না। এই দেশগুলির হাজার হাজার মাইল সীমানা রক্ষা করা অসম্ভব। অত্যন্ত গরীব হওয়ায় এই দেশগুলির সমস্যা আরও বেশি প্রকট। এই এলাকায় আল-কায়েদা সমর্থিত অনেক অস্ত্রধারী গোষ্ঠী রয়েছে। এদেরকে মোকাবিলা করার জন্য আমেরিকা যেমন উঠে পড়ে লেগেছে, তেমনি ফ্রান্সও খুব বেশি পিছিয়ে নেই। মার্কিনীরা এখানকার খুব বেশি দেশে তাদের সৈন্য মোতায়েনের সাহস পায়নি জনরোষ সৃষ্টি হতে পারে ভেবে। তবে ফ্রেঞ্চরা এখানে রয়েছে বেশ অনেকদিন ধরেই। ১৯৮৩ সাল থেকে থাকলেও ১৯৮৬ সালে চাদ-এর সাথে গাদ্দাফীর লিবিয়ার যুদ্ধের সময় ফরাসীরা এখানে একেবারে গেড়ে বসে প্রেসিডেন্ট হিসেন হাব্রের হাত ধরে। লিবিয়ার সাথে চাদের যুদ্ধের শেষে, এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতে চাদ-লিবিয়ার সীমান্ত সমস্যা মিটমাট হয়ে যাবার পরেও ফ্রেঞ্চরা এখানে রয়ে যায়। অপারেশেন ইপারভিয়ে সেই ৮৬-তে শুরু হয়ে এখনো চলছে। ফরাসীদের কাছে চাদ মরুভূমির মাঝে একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো। ফরাসী বিমান বাহিনীর ৬ থেকে ৮টা ফাইটার বিমান চাদের রাজধানী নিজালমিনাতে সবসময়ই থাকে। এই ঘাঁটি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ২০১৩ সালে মালি-এর যুদ্ধের সময় হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের পিছনে থাকার নীতি
চাদ থেকে দক্ষিণে গ্যাবনের রাজধানী লিব্রেভিলে ফ্রান্সের ছোট একটা সেনাদল স্থায়ীভাবে রয়েছে বহুকাল ধরে। আবার আফ্রিকার পশ্চিম উপকুলে সেনেগালের রাজধানী ডাকার-এও ফ্রান্সের একটা ঘাঁটি ছিল ৫০ বছর ধরে; ২০১০ সালে ঘাটিটি ছেড়ে দেয়ার কথা দেয় ফ্রান্স। কিন্তু সন্ত্রাস বিরোধী মিশনের গুরুত্ব তুলে ধরে ফ্রেঞ্চরা ডাকারে রয়েই যায়। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, সিয়েরা লিওন আর কুট-ডে-ভোয়া (আইভোরি কোস্ট) এই দেশগুলিতেও ফ্রান্সের সামরিক উপস্থিতি বহু বছর ধরে থেকে-থেকে রয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার মরুভূমি অঞ্চলে আল-কায়েদা সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে মোকাবিলা করতে ফ্রান্সের এই ঘাঁটিগুলির অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা ঠিকমতোই জানে। আর আফ্রিকাতে তাদের অনভিজ্ঞতার কারণেও তারা এখানে ফ্রান্সের পিছনে থাকতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। আমেরিকানরা বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে গোয়েন্দা বিমান ও ড্রোন পাঠিয়েছে। ফরাসী বাহিনীকেও তারা বিভিন্ন মিশনে লজিস্টিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে। তবে নিজেরা সরাসরি সংঘাতে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকছে। সেই কাজটা আফ্রিকানদের আর ফরাসীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে তারা।

'অপারেশন সেরভাল'- ফরসীরা দূরত্বকে জয় করেছে।


‘অপারেশন সেরভাল’
২০১২ সালে মালি-এর গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়। সরকার-বিরোধী এমএনএলএ বিদ্রোহীরা দেশের বেশিরভাগ এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেবার পর সরকারের অবস্থা বেসামাল হয়ে পড়ে। ঠিক এই সময়ে লিবিয়া যুদ্ধের পর সেখান থেকে প্রচুর অস্ত্রের যোগান পাওয়া ইসলামিক জঙ্গীরা এমএনএলএ-এর বিরূদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই নতুন ইসলামিক সসস্ত্র গোষ্ঠীরা মালি-এর বেশিরভাগ এলাকা সরকারী বাহিনী ও এমএনএলএ-এর কাছ থেকে খুব দ্রুত দখলে নিয়ে সেখানে কঠোর শারিয়া আইন জারি করে। ঠিক যখন মনে হচ্ছিল যে আল-কায়েদা সমর্থিত এই জঙ্গীরা মালি-এর রাজধানীও আয়ত্তে নিয়ে নেবে, ঠিক তখনই ২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসে ফরাসীরা জাতিসংঘের ম্যান্ডেট পেয়ে মালি-তে রওয়ানা হয়। ফ্রান্সের প্রথম উদ্দেশ্যই ছিল জঙ্গীদের জানান দেওয়া যে তারা এখানে এসেছে। শুরু হলো অপারেশন সেরভাল ফ্রেঞ্চ স্পেশাল ফোর্সের গ্যাজেল হেলিকপ্টারগুলি হামলা চালায় জঙ্গীদের অগ্রবর্তী বাহিনীর উপরে। ঠিক তার পরপরই ফ্রান্স থেকে ৩,৫০০ কিঃমিঃ উড়ে এসে ৪টা রাফাল জঙ্গীবিমান মালির উত্তরে গাও শহরে বোমাবর্ষণ করে, যেখানে ছিল জঙ্গীদের হেডকোয়ার্টার্স । মালির উত্তরের আলজেরিয়া আর মরক্কো এই মিশনে তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ায়। বিমানগুলি বোমাবর্ষণ শেষ করে ১,৩০০ কিঃমিঃ দূরে চাদ-এর নিজালমিনাতে গিয়ে অবতরণ করে, আর বাকি অপারেশনে সেখান থেকেই কাজ চালায়। এই দূরত্বে হামলা করে ফ্রান্স তাদের হাত কতটুকু লম্বা, সেটার একটা প্রমাণ দিল। নিজালমিনাতে আগে থেকেই ফ্রান্সের ২টা মিরাজ এফ-১সিআর গোয়েন্দা বিমান আর ৪টা মিরাজ ২০০০ ফাইটার বিমান ছিল, যেগুলি এর পর থেকে যুদ্ধে অংশ নেয়। সেনেগালের ডাকারে অবস্থিত ফরাসী নৌবাহিনীর ৫টা আটলান্টিক গোয়েন্দা বিমানও উড়ে আসে ফরাসী বাহিনীকে ইন্টেলিজেন্স সরবরাহ করার জন্যে। কমপক্ষে ৫টি ফ্রেঞ্চ  এয়ার-রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার বিমান এই অপারেশনে অংশ নেয়, যার কারণেই ফরাসীরা মূলত দূরত্বকে জয় করতে পেরেছে। 

পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ডাকারে অবস্থিত ঘাঁটি থেকে ফরাসী নৌবাহিনীর 'আটলান্টিক' গোয়েন্দা বিমান মালি-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে।


আর বিমান হামলার পরপরই শুরু হয় ফরাসী সেনাবাহিনীর আগমণ। ফ্রান্স এবং মালির রাজধানী বামাকো-এর মাঝে ৩,৫০০ কিঃমিঃ লম্বা একটা এয়ার ব্রিজ তৈরি করে ফেলা হয়। ফ্রান্সের বিমান বাহিনীর পরিবহণ বিমানগুলি ব্যবহার হবে এটা তো জানা কথা। তবে যখন যখন ১০টা দেশ থেকে ২৫টারও বেশি পরিবহণ বিমান এই কাজে যোগ দেয়, তখন আলাদাভাবে তাকাতে হবে পুরো ব্যাপারটার দিকে। এটা হলো কালেকটিভ সিকিউরিটি-এর একটা অংশ। ফ্রান্স মাঠে যুদ্ধ করবে ঠিকই; কিন্তু বাকিরাও যে যেভাবে পারে, তাকে সাহায্য করবে। এতগুলি দেশের সাহায্য না পেলে সৈন্যসমাবেশ করতে ফরাসী বিমান বাহিনীর অনেক বেশি সময় লেগে যেত। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই ২৫টিরও বেশি বিমানের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল মাত্র ৫টি। এই পরিবহণ বিমান ছাড়াও এয়ার-রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার এবং গোয়েন্দা বিমান সরবরাহ করেও ফ্রান্সকে সাহায্য করেছে কয়েকটি দেশ। ফ্রান্সের নৌবাহিনীর একটি জাহাজ পশ্চিম আফ্রিকার ডাকার বন্দরে এসে কয়েকশ সৈন্য নামায়; যারা বিমানযোগে চলে আসে মালি-তে। তবে দ্রুত অভিযানের সাফল্যের বেশিরভাগটাই পাবে ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনী। তারা তাদের সেনাবাহিনীকে তৈরিই করেছিল এই আদতে। মাটিতে নামার সাথে সাথে তাদের গতি সেটা প্রমাণ করে। তাদের দ্রুতগামী লাইট আর্মার্ড ও পদাতিক ইউনিটিগুলির সামনে জঙ্গীরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। তার উপরে আকাশের পুরো আধিপত্ত ছিল ফ্রেঞ্চদের হাতে। নিজালমিনা থেকে উড়ে আসা রাফাল আর মিরাজ-২০০০ জঙ্গী বিমান ছাড়াও ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল সেনাবাহিনীর গ্যাজেলটাইগার এটাক হেলিকপ্টারগুলি। জানুয়ারীর ১১ তারিখে অভিযান শুরুর পর থেকে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে মালি-এর বেশিরভাগ এলাকা ফ্রান্সের সমর্থনপুষ্ট মালি-এর সরকারী বাহিনীর দখলে চলে আসে। এরপর দখলকৃত এলাকায় নিরাপত্তা দেওয়ার পরবর্তী কাজ শুরু হয়। ২০১৩-এর জুলাই পর্যন্ত এই মিশনে ফ্রান্সের ৭জন সৈন্য নিহত হয়। মালিয়ান বাহিনী আর আফ্রিকার অন্যান্য সাহায্যকারী দেশের ১৪৪জন সৈন্য নিহত  হয়। অপরদিকে জঙ্গীদের ৬০০ থেকে ১,০০০ নিহত হয়। 

মালি-এর রাস্তায় ফরাসী সাঁজোয়া যান। বেশিরভাগ মালিয়ানরাই ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ সমর্থন করেছিল, যা ছিল ফ্রান্সের কূটনীতির বিরাট এক সাফল্য।


সাফল্য আগে থেকেই লেখা ছিল কি?
ফ্রেঞ্চরা অভিনযানে নামার দুসপ্তাহের মাঝেই মালি-তে অবতরণ করা শুরু করে আফ্রিকার ৯টা দেশের সমন্বয়ে গঠন করা প্রায় ৭,৫০০ সৈন্যের এক বাহিনী। যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে এদেরও বড় একটা অবদান ছিল। এরপরে জুলাই মাস থেকে ফ্রেঞ্চ আর আফ্রিকান বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হওয়া শুরু করে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী, যার সদস্যসংখ্যা ১২,০০০ ছাড়িয়ে যাবার কথা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ এই মিশনে ১,৬০০ সৈন্য পাঠিয়েছে। ফ্রান্স মালি থেকে বেশিরভাগ সৈন্য সরিয়ে নিলেও ১,০০০ সৈন্য রেখে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও আশেপাশের দেশগুলিতে (নিযের-এর রাজধানী নিয়ামি-তে এবং বুরকিনা ফাসো-এর রাজধানী উগাডুগু-তে) গোয়েন্দা বিমান ও ড্রোন-এর জন্য ঘাঁটি গেড়েছে এই সংঘাতের জের ধরে। জাতিসংঘ মিশনের চোখ-কান এখন এই বিমান ও ড্রোন। আফ্রিকার সন্মিলিত বাহিনী আলাদা আলাদাভাবে মালি-তে অবতরণ করেছিল। তারা ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর মত দ্রুত সাফল্য পাবার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আর জাতিসংঘের মিশন তো বরাবরের মতোই বেশ ঢিলেঢালাভাবে এগোয়। জাতিসংঘের উপরে ভরসা করলে মালিয়ানরা হয়তো অন্য একটা ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতো। আফ্রিকানরা প্রায় ৭,৫০০ সৈন্য যোগার করেছে; জাতিসংঘ জোগাড় করছে ১২,০০০-এরও বেশি; যার তুলনায় ফ্রান্সের বাহিনী ছিল অনেক ছোট। এখানেই ফ্রান্সের সামরিক সাফল্য; তারা অতি দ্রুত এই কাজটা করতে পেরেছে। তারা মাত্র হাজার চারেক সৈন্যই ব্যবহার করেছে; তবে মালি-কে বাঁচিয়ে দেবার জন্যে সেটাই যথেষ্ট ছিল। এই মিশনের মাধ্যমে ফ্রান্সের বাহিনী তাদের কূটনীতিতে এক বিরাট ভূমিকা রাখলো। বেশিরভাগ মালিয়ানরাই মনে করছেন যে ফ্রান্সের হস্তক্ষেপ না হলে তাদের দেশ আল-কায়েদা জঙ্গীদের হাতে চলে যেত। মালিয়ানদের এই সম্মতি ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদের একটা অনেক বড় সাফল্য। প্রথমেই বলেছি যে ফ্রান্স তাদের সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলেছে ঠিক এই ধরণের মিশনের জন্যেই। আর তাদের আফ্রিকার মরুতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ (বিমান ঘাঁটি) খোঁজার কাজটা পুরো সাফল্য এনে দিয়েছে এবারে। চাদের রাজধানী নিজালমিনা-তে ফ্রান্সের ফাইটার বিমানগুলি না থাকলে ফ্রান্সের এই মিশন সফল  হতো না। ফ্রান্সের এই সাফল্য বহুদিন ধরে লালন করা সামরিক নীতি আর তাদের আফ্রিকা নীতির উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল; যদিও শেষ মুহূর্তে মালিয়ানদের সম্মতির ব্যাপারটা আগে থেকে বলা মুশকিল ছিল। তবে তাদের বাহিনীর পুরো গঠনটাই কিন্তু তাদের কূটনীতিকে সমর্থন করে। এক্ষেত্রে তাদের রাজনীতিবিদদের দূরদর্শীতাকে প্রশংসা করতেই হয়। শুধুমাত্র বর্তমান সরকার নয়, অতীতের সকল সরকারই ফ্রান্সের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টা একইভাবে লালন করে গেছে। এই কারণেই ফ্রান্স এই মিশনের জন্য ছিল প্রস্তুত। তারা অন্য দেশের সার্বভৌমত্বকে কতটা উপরে তুলে ধরবে সেটা সবসময়ই বিতর্কের বিষয় হবে। ফ্রান্স তাদের উপনিবেশ ছেড়ে এলেও সেখানে তাদের পুলিশি প্রহড়া দেবার দায়িত্বখানা ভুলে যায়নি! কিন্তু নিজের দেশের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে তাদের সামনে চিন্তা করার প্রবণতাটা আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে একটা উদাহরণস্বরূপ।

Wednesday 16 July 2014

বিশ্বব্যাপী নৌ-কূটনীতির গুরুত্ব বাড়ছে কি?

১৬ জুলাই ২০১৪



বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৌবহর দেখে একটা ধারণা কিন্তু নেওয়া সম্ভব যে তাদের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হতে পারে। কারণ নৌবহর হলো এমন একটা জিনিস যেটা সমুদ্রে ভেসে যেতে পারে বহুদূর; যেখানে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা তাদের দাবি করে, সেখানেই গিয়ে হাজির হতে পারে। এজন্যেই পররাষ্ট্রিনীতিতে পরাক্রমশালী দেশগুলি বরাবরই শক্তিশালী নৌবহর তৈরিতে মনোনিবেশ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত অনেক দেশ এই লিস্টের মধ্যে থাকলেও শেষ পর্যন্ত মার্কিনীরাই একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছে এই ক্ষেত্রে। আর নৌবহর চেনারও কিছু উপায় আছে! একটা নৌবহরের কিছু জাহাজ দেখলেই একটা ধারণা করে নেওয়া সম্ভব তাদের নৌবহরের প্রধান কাজ কি। ঠিক এই ধরণেরই কিছু জাহাজের সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা এখানে করবো; যা পরবর্তী আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে আরকি।


পররাষ্ট্রনীতির সাথে যুদ্ধজাহাজের ধরণের সম্পর্ক

একটা দেশের নৌবহর পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে তখনই, যখন সেই নৌবহর অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে গিয়ে কোন মিশন শেষ করে আসতে পারবে। এই ধরণের দূরবর্তী মিশন চালাতে একটা নৌবহরের তিন ধরণের জাহাজের কথা আলাদাভাবে বলতে হবে ১) বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, ২) উভচর বাহিনী এবং ৩) সরবরাহকারী জাহাজ। এই জাহাজগুলিকে রক্ষা করার জন্যে আরও অন্যান্য জাহাজও লাগে, যেমন ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, সাবমেরিন, মাইনসুইপার, ইত্যাদি। এই জাহাজগুলি অবশ্য অনেক দেশেরই থাকে। শুধুমাত্র একা একা এই ধরণের জাহাজগুলি পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিতে পারে না; তাদেরকে প্রথমে বলা ঐ তিন ধরনের জাহাজের অন্তত একটি বা দুটির সাহায্য নিতে হবে। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ দেশ থেকে অনেক দূরে নিজেদের বাহিনীর উপরে বিমান প্রতিরক্ষা দেবে আর শত্রুপক্ষের বাহিনীকে আক্রমণ করবে। এটা না থাকলে অন্য দেশের বিমান বাহিনী নিজেদের নৌবহরের বারোটা বাজাবে। উভচর বাহিনী দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে শত্রুভাবাপন্ন কোন দেশের সমুদ্রসৈকতে জোর করে অবতরণ করতে পারবে, আর স্থলযুদ্ধের মাধ্যমে শেষ করতে পারবে যুদ্ধ। এই বাহিনী না থাকলে নৌবহরকে শুধুমাত্র উপকূলে ঘুরাঘুরি করেই দেশে ফেরত যেতে হবে। সরবরাহকারী জাহাজ দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে নিজেদের নৌবহরকে সমুদ্রে টিকে থাকতে সহায়তা করবে। এই জাহাজগুলি না থাকলে নৌবহরকে মিশন শেষ না করেই দেশে ফেরত আসতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ঐ তিন ধরনের জাহাজে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানকে মোকাবিলা করতে যেয়ে তারা এই জাহাজগুলির বিশেষজ্ঞ বনে গেছে। আর যুদ্ধের শেষে এই জাহাজগুলিকে তারা ডিজাইনের দিক থেকে আরও অনেক বেশি কর্মক্ষম করেছে। 

চীনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'লিয়াওনিং'। চীনা নৌ-কূটনীতি এখন দ্রুত ভারত মহাসাগরে বিস্তৃত হচ্ছে।

বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ

১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধের শেষে মার্কিনীদের ধারেকাছেও কেউ ছিল না; এখনো অনেকটা নেই বললেই চলে। বিশ্বযুদ্ধের শেষে হাজার হাজার যুদ্ধজাহাজ রাতারাতি অদরকারি হয়ে পড়ে। তখন অনেক দেশই ব্রিটিশ আর মার্কিনীদের থেকে নৌবহর সাজানোর সরঞ্জামাদি পেয়েছিল। কেউ কেউ পেয়েছিল বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ অথবা উভচর মিশনে যাবার মতো যুদ্ধজাহাজ। ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও যুদ্ধ শেষ হবার পরে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মালিক হয়েছিল হল্যান্ড (১৯৪৮), ব্রাজিল (১৯৫৬), আর্জেন্টিনা (১৯৫৮), ভারত (১৯৫৭) ও স্পেন (১৯৬৭)এই পুরোনো জাহাজগুলিকে তারা বেশ অনেকদিন সার্ভিসে রেখেছিল; অর্জন করেছে এইরকম জাহাজ পরিচালনা করার দক্ষতা। সেই দক্ষতা আজ পর্যন্ত ধরে রেখেছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ব্রাজিল, ভারত ও স্পেন এরা পুরোনো জাহাজকে নতুন জাহাজ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছে। বাকিরা অর্থনীতির ভারে বাধ্য হয়েছে তাদের নৌবাহিনীর নীতিতে পরিবর্তন আনতে। ইটালি (১৯৮৫) ও থাইল্যান্ড (১৯৯৭) নতুন করে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মালিক হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য একটা ব্যাপার হচ্ছে খরচ। একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ কেনা আর পরিচালনা করার মতো অর্থনীতি খুব বেশি দেশের নেই। থাইল্যান্ডে তাদের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ চাক্রি নারুয়েবেট নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কারণ সেটা কেনার পরবর্তীতে দেশের দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনায় অংশ নেয়া ছাড়া কোন কাজেই আসেনি; পররাষ্ট্রনীতিতে সাহায্য করা তো বহুদূর! স্পেন তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে ২০১৩ সালে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ প্রিনসিপে ডে এস্তুরিয়াস ডিকমিশন করে দিতে বাধ্য হয়েছে; তবে অন্য আরেকটি (হুয়ান কার্লোস ১) তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন, ভারত এরা সবাই তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ব্যবহার করেছে। সোভিয়েট ইউনিয়ন তাদের প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে ১৯৭৫ সালে। রাশিয়া সেই নৌবহরের কিছুটা পেলেও সেটাকে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যবহার করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। এর একটা বড় কারণ হলো আন্তর্জাতিক বিবাদে রাশিয়া যে পক্ষে থেকেছে, সেই পক্ষে নৌশক্তি দিয়ে রাশিয়াকে সাহায্য করার মতো কোন দেশ ছিল না। আর রাশিয়ার একার পক্ষেও সমুদ্রে তেমন কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। অপরদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন এরা সকলে একত্রে একপক্ষে থেকেছে; একে অপরকে পরিপূর্ণ করেছে। একের দুর্বলতা অন্যে ঢেকে দিয়েছে। আর তার সাথে অপার শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্র তো রয়েছেই। চীন বর্তমানে ব্যাপক চেষ্টা চালাচ্ছে নৌশক্তিকে পররাষ্ট্রনীতির একটা দিক হিসেবে ব্যবহার করতে। আর এই কারণেই চীন ইউক্রেন থেকে সোভিয়েত সময়ের অর্ধসমাপ্ত একটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করে ২০১২ সালে লিয়াওনিং নামে কমিশন করেছেএতক্ষণ যেই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের কথা বললাম, সেগুলি মার্কিন নৌবাহিনীর ডজনখানেক বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে বহু পিছিয়ে। আসলে মার্কিনিদের উভচর নৌবহরে ১০টার মতো জাহাজ আছে যেগুলি উপরের বেশিরভাগ দেশের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে অনেক বড় এবং বেশি শক্তিশালী। এগুলিকে আমেরিকানরা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বলেই না! উভচর এই নৌবহর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ব্যাপারটা পৃথিবীর অনেক দেশ বুঝতে পেরে সেই দিকেই এগুচ্ছে।

ব্রিটিশ 'উভচর এসল্ট শিপ' এইচএমএস ওশান। দেখতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো হলেও এটাকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বলা হয় না।



উভচর বাহিনী

মার্কিন নৌবাহিনী উভচর যুদ্ধে অবিসংবাদিত নেতৃত্ব পেয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে। তারা নতুন নতুন থিওরি আবিষ্কার করেছে; নতুন নতুন প্রযুক্তির জন্ম দিয়েছে, যা এখন পৃথিবীর সকলে উভচর যুদ্ধের বাইবেল হিসেবে দেখে। তাদের তৈরি করা এই বাইবেলের সমুদ্রগামী সবচেয়ে ছোট উভচর যুদ্ধজাহাজ হচ্ছে ল্যান্ডিং শিপ ট্যাঙ্ক (Landing Ship Tank or LST)এই জাহাজগুলি সমুদ্র সৈকতে উঠে যায়; সামনের বিরাট একটা দরজা খুলে ভেতর থেকে ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য রসদ সরাসরি ভূমিতে নেমে আসে। এই জাহাজগুলি বেশ বড় (৩,০০০ থেকে ৮,০০০টন) হলেও এদের সমস্যা হচ্ছে রসদ উঠানামা করতে এদের প্রধানত সৈকতে উঠে আসতে হয় (যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি জাহাজগুলি অবশ্য এর চাইতে আরও বেশি কার্যকর)পররাষ্ট্রনীতিতে সবসময় সৈকতে উঠে কাজ করার সুযোগ থাকে না। সেদিক থেকে ল্যান্ডিং ট্র্যান্সপোর্ট ডক (Landing Transport Dock or LPD) অনেক বেশি কার্যকরী। এই জাহাজগুলি সকল সৈন্য এবং রসদ ছাড়াও ল্যান্ডিং ক্রাফট এবং উভচর যান বহন করে; যেগুলি জাহাজের পেছনের ডক থেকে সরাসরি পানিতে নেমে আসে। এরা আবার হেলিকপ্টারও বহন করতে পারে। এভাবে বিশাল (৮,০০০-২৫,০০০টন) এই জাহাজগুলি উপকূলের কিছুটা দূরে থেকেই সৈন্য ও রসদ উঠানামা করতে পারে। ২০০ থেকে ১,০০০ পর্যন্ত সৈন্য বহন করতে পারে এই ধরণের জাহাজ। এই এলপিডি-গুলি একটা দেশের নৌবহরকে দূরের দেশে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখতে সহায়তা করতে পারে। একই রকমের জাহাজ ল্যান্ডিং শিপ ডক (Landing Ship Dock or LSD) যেগুলি কিছু কম সৈন্য নেয় ল্যান্ডিং ক্রাফট বেশি নেবার জন্য। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই অবশ্য এগুলি ব্যবহার করে। এরও উপরে যে জাহাজগুলি আছে সেগুলির চেহারা অনেকটাই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো। এগুলিকে সাধারণভাবে বললে উভচর এসল্ট শিপ (Amphibious Assault Ship) বলা যায়। এরা প্রচুর সৈন্য ও রসদ বহন করা ছাড়াও হেলিকপ্টার এবং অনেক ক্ষেত্রে ফাইটার বিমান বহন করতে পারে। এই ধরনের যে জাহাজগুলির পিছনে ডক রয়েছে, সেগুলি ল্যান্ডিং হেলিকপ্টার ডক (Landing Helicopter Dock or LHD; Landing Helicopter Assault or LHA); আর যেগুলির ডক নেই, সেগুলি ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম হেলিকপ্টার (Landing Platform Helicopter or LPH) এগুলি যথেষ্ট বড় (১৮,০০০-৪৫,০০০টন) এবং ব্যয়বহূল জাহাজ। অনেক দেশই আলাদাভাবে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ আর উভচর বাহিনী রাখতে পারছে না বাজেটে সঙ্কুলান না হওয়ায়। তারা এই ধরনের উভচর এসল্ট শিপ-এর দিকে যাচ্ছে। এতে এক জাহাজ কয়েক ধরনের মিশন নিতে পারছে। যুক্তরাজ্য (১টি LPH), ফ্রান্স (৩টি LHD), স্পেন (১টি LHD), দক্ষিণ কোরিয়া (১টি LPH) এই পথেই এগিয়েছে। রাশিয়া (২টি LHD) এবং অস্ট্রেলিয়াও (২টি LHD) ভবিষ্যতে এগুচ্ছে সেদিকে। এই জাহাজগুলি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে পুওর ম্যানস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার! তবে এখানে সবচাইতে বড় ব্যাপার হলো, এই দেশগুলি তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় শক্তি প্রদর্শনকে প্রাধান্য দিয়েছে বলেই এই জাহাজগুলি বানিয়েছে বা ক্রয় করেছে। আর যারা উভচর এসল্ট শিপ’-ও যোগার করতে পারেনি, তারা অন্তত ল্যান্ডিং ট্র্যান্সপোর্ট ডক’ (Landing Transport Dock or LPD)-এর দিকে অগ্রসর হয়েছে। সিঙ্গাপুর (৪টি), ইন্দোনেশিয়া (৪টি), আলজেরিয়া (১টি তৈরি হচ্ছে), হল্যান্ড (২টি), চিলি (১টি), পেরু (২টি তৈরি হচ্ছে), ফিলিপাইন (২টি অর্ডারে করেছে) এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আরও বেশ কিছু দেশ একই লাইনে চিন্তা ভাবনা করছে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ডও নিজেদের মতো কিছু জাহাজ বানিয়েছে; তবে তাদের উদ্দেশ্যও কিন্তু উপরের বাকি সবার মতোই। আবার এদের চাইতে বড় নৌবহরগুলিও এই ধরনের (LPD) জাহাজের দিকে ঝুঁকেছে অথবা তৈরি করা অব্যহত রেখেছে ব্রিটেন (৫টি), ফ্রান্স (১টি), ব্রাজিল (১টি), চীন (৩টি), ইটালি (৩টি), ভারত (১টি), অস্ট্রেলিয়া (১টি)। 

ইন্দোনেশিয়ার 'ম্যাকাসার-ক্লাস' 'ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম ডক'। নৌ-কূটনীতিতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ আর 'উভচর এসল্ট শিপের' পরেই এই ধরনের জাহাজের স্থান।



নতুন অর্থনীতি

৩০-৪০ বছর আগের সাথে তুলনা করলে আজকে পৃথিবীর অনেক দেশই কিন্তু একটা মোটামুটি অর্থনীতির অধিকারী। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এই দেশগুলি খুব বেশিদিন হয়নি অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। আর অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে জাতীয় নিরাপত্তাও নিজেদের সমুদ্রসীমা অতিক্রম করেছে। একসময় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন আর ফ্রান্স ছাড়া অন্য কোন দেশের হাতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ, উভচর এসল্ট শিপ’ (Amphibious Assault Ship)  এবং ল্যান্ডিং ট্র্যান্সপোর্ট ডক’ (Landing Transport Dock or LPD) ছিল না। এখন মোটামুটিভাবে ১৪-১৫টা দেশের কাছেই এই ধরনের যুদ্ধজাহাজ রয়েছে; আরও বেশকিছু দেশ এগুলি পেতে চলেছে অচিরেই। ২০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে একটা যুদ্ধজাহাজ কিনতে পারার মতো অর্থনীতি এখন অনেক দেশের। এরা সবাই এখন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তাদের প্রভাবের ন্যায্য হিস্যা চাইছে। আর ন্যায্য হিস্যা চাইতে গেলে সেইধরণের উপকরণও যে দরকার, সেটা বুঝেছে অনেকেই। 

জাপানি নৌবহরের ১৪,০০টনের 'ওসুমি-ক্লাস'-এর এই জাহাজগুলি প্রথম জানান দেয় জাপানের 'যুদ্ধ-বিরোধী' সংবিধানের অবাস্তবতার


জাপানি নৌবাহিনীর ১৯,০০টনের 'হাইয়ূগা-ক্লাস' "হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার", যাকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বললে দোষ হয় না।




জাপান

আমরা সবাই চীনকে নিয়ে কথা বলতেই ব্যাস্ত। চীনের নৌবহরের জাহাজগুলি আজকাল ভারত মহাসাগরে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেউ একবারও চিন্তা করে দেখিনি যে চীন সমুদ্রে এগুতে থাকলে তার প্রতিবেশী জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়াও থেমে রইবে না। গত বিশ বছরে কোরিয়া তাদের নৌবাহিনীর বিশাল উন্নতি করেছে। আর দশ-পনর বছরের মাঝেই কোরিয়ার নৌবহর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অনেকটা প্রভাব বিস্তার করবে। তবে সেই প্রভাব জাপানের ধারেকাছেও হবে কিনা সেটা দেখার বিষয় হবে। যেখানে কোরিয়া তাদের জিডিপি-এর ২.৮% সামরিক খাতে খরচ করছে, সেখানে জাপান করছে মাত্র ১%। অথচ তারপরেও জাপানের সামরিক বাজেট (৪৯ বিলিয়ন ডলার) কোরিয়ার (৩৪ বিলিয়ন ডলার) চাইতে অনেক বেশি। এই ১%-এর সামরিক বাজেটেই জাপান পৃথিবীর সবচাইতে বড় নৌবহরের একটির মালিক! এর অর্থ হচ্ছে, প্রায় তেমন কোন পরিশ্রম ছাড়াই জাপান এই নৌবহর অর্জন করতে পারছে। তাদের সামনে এগুনোর পথে সবচাইতে বড় বাধা ছিল তাদের সংবিধান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিনীদের প্রণীত এ যুদ্ধ-বিরোধী সংবিধান জাপানীরা প্রায় অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে বহু বছর। এই সংবিধান জাপানের সামরিক বাহিনীকে জাপানের বাইরে কোথাও মোতায়েনে বাধা দিয়েছে; আক্রমণাত্মক কোন অস্ত্র (যেমন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ) তৈরিতে বাধা দিয়েছে। তবে মার্কিনীরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছিল যে এই পরিবর্তিত বিশ্বে জাপানের আরও বেশী কার্যকর ভূমিকা নেওয়া উচিত। তারাও চাইছিল যে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের উপরে নির্ভরশীল না থেকে নিজেদের প্রতিরক্ষা যেন নিজেরাই দেখা শুরু করে। জাপানের সংবিধানের সেই বাধা অল্প কিছুদিন আগেই উঠে গেছে। এটা চীনের জন্যে অনেক বড় একটা ভীতির খবর। পুরাতন সংবিধানকে পাশ কাটিয়েই জাপান ১৯৯৫ সাল থেকে নৌবাহিনীর জন্যে এমন কিছু জাহাজ বানানোর প্রস্তুতি নিয়েছে, যা প্রতিবেশী দেশগুলিকে চিন্তিত করেছে। ওসুমি-ক্লাস-এর ল্যান্ডিং ট্র্যান্সপোর্ট ডক’ (Landing Transport Dock or LPD) গোছের তিনটি জাহাজ বানাবার পরে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল, কারণ ১৪,০০০টন এই জাহাজগুলি দেখতে ছোটখাটো বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো। জাপান তখন বলেছিল এগুলি ল্যান্ডিং শিপ ট্যাঙ্ক; জাপান থেকে দূরে ব্যবহারের জন্য নয়। এরপরে ২০০৬ সালে বানানো শুরু করে ১৯,০০০টনের হাইয়ূগা-ক্লাস-এর দুটি জাহাজ; যেগুলিকে জাপান হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার বললেও সেগুলিকে প্রায় পুরোপুরিই বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বলা চলে। যদি এটাও কম হয়ে যায়, তাহলে ২০১২ সালে শুরু হয়েছে আরও দুটা জাহাজের কাজ। ২৭,০০০টনের ইজুমো-ক্লাস-এর এই দুটি জাহাজ এর আগে বানানো যেকোন জাহাজের চাইতে অনেক অনেক বড়!  এবারেও জাপানি নৌবাহিনীর ওই একই কথা - এগুলি আসলে ‘হেলিকপ্টার ডেস্ট্রয়ার’এসবই হয়েছিল সংবিধানের আর্টিকেল-৯-কে পাশ কাটিয়ে। এখন এর চাইতেও আরও বড় ও শক্তিশালী জাহাজ বানাতে জাপানের কোন বাধাই থাকলো না। উত্তর কোরিয়া আর চীন জাপানকে উঠতে সাহায্য করছে। এই দুই দেশের সামরিক প্রস্তুতি জাপানিদের নৌবহর বৃদ্ধিতে, আর সংবিধান সংশোধনে উদ্বুদ্ধ করেছে। 

জার্মান ফ্রিগেট 'এমডেন' ও আমেরিকান ডেস্ট্রয়ার 'শোউপ'-কে সমুদ্রে সাপ্লাই দিচ্ছে ফ্রেঞ্চ সাপ্লাই জাহাজ 'মার্ন'। পারস্পরিক সহযোগিতার কারণে আমেরিকা ও তার মিত্ররা সমুদ্রে অনেক বেশি শক্তিশালী



সাপ্লাই চেইন

এরই মাঝে জাপানি নৌবহরে যুক্ত হয়েছে ১৫,০০০টনের ৩টি ও ২৫,০০০টনের দুটি সরবরাহ বা সাপ্লাই জাহাজ। উপরে বর্ণিত এত্ত বড় বড় জাহাজের বিতর্কের গভীরে এই সাপ্লাই জাহজগুলি হারিয়েই গেছে। খুব কম লোকই প্রশ্ন করেছে যে এই জাহাজগুলি কি বানানো হয়েছে জাপানের উপকূল প্রহরায় সহায়তা দিতে, নাকি ভারত মহাসাগর পর্যন্ত পাহারা দিতে? যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বেশ কিছু দেশ  তাদের নৌবহরের আকৃতির অনুপাতে অনেক বেশি এবং বড় সাপ্লাই জাহাজ রাখে, যেমন যুক্তরাজ্য (৮টি), ফ্রান্স (৪টি), ইটালি (৩টি), স্পেন (২টি), জার্মানি (১১টি), হল্যান্ড (১টি), অস্ট্রেলিয়া (২টি), কানাডা (২টি)বিভিন্ন মিশনে এরা একজন আরেকজনকে পরিপূর্ণ করছে। একজন হয়তো পাঠাচ্ছে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ; আরেকজন পাঠাচ্ছে ফ্রিগেট; আরেকজন সাপ্লাই জাহাজ। এভাবে একত্রে তারা খুব দ্রুত একটা শক্তিশালী নৌবহরের জন্ম দিচ্ছে। এটা হচ্ছে তাদের কালেকটিভ সিকিউরিটি-এর একটা অংশ। 

বাংলাদেশ নৌবাহিনী ফ্রিগেট বিএনএস ওসমান ভূমধ্যসাগরে জাতিসঙ্ঘ মিশনে অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশের নৌ-কূটনীতি সবে শুরু হয়েছে। আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাথে সাথে নৌবহরেও ব্যাপক পরিবর্তন দেখার সম্ভাবনা রয়েছে।



কে কোথায়? আমরা কোথায়?

এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের ইউরোপীয় এবং অন্যান্য মিত্ররা একত্রে সহজেই ভারত মহাসাগরে অথবা পারস্য উপসাগরে অথবা ভূমধ্যসাগরে তাদের নৌবহর পাঠিয়ে দিচ্ছে, এবং অনেকদিন সেখানে রাখতেও পারছে। এদের সাথে যোগ দিতে অথবা এদেরকে চ্যালেঞ্জ করতে যোগ দিয়েছে বা অচিরেই যোগ দিচ্ছে চীন, জাপান, ভারত ও কোরিয়া। এদের মাঝে চলবে প্রধান প্রতিযোগিতা। এর মাঝে ছোট ছোট অনেক নৌবাহিনী তাদের স্থান খুঁজে নিচ্ছে; নেবে। তাদের মাঝেও থাকবে প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশও আছে তাদের ছোট্ট নৌবহর নিয়ে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী দুটি জাহাজ (একটি ফ্রিগেট ও একটি প্যাট্রোল জাহাজ) ভূমধ্যসাগরে জাতিসঙ্ঘের মিশনে মোতায়েন রেখেছে ২০১০ সাল থেকে। উপরে যে ধরনের জাহাজ নিয়ে আলোচনা করেছি, সেগুলি কেনার বা বানাবার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাংলাদেশের এখনো হয়নি; তবে অচিরেই হতে চলেছে। ইউরোপীয় দেশগুলি বাজেটের ঘাটতির কারণে তাদের নৌবহরের আকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। অন্যদিকে এশিয়াতে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে নৌবহরের আকৃতি বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সমুদ্রসীমা, খনিজ সম্পদ, প্রতিবেশী রাজনীতি, ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে নৌবাহিনীর গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। নৌবাহিনী হতে চলেছে কূটনীতির একটা অংশ। সামনের বছরগুলিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিই বলে দেবে যে আগামী ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশের নৌ-কূটনীতি বঙ্গোপসাগরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি ভারত মহাসাগর এবং অন্যান্য সমুদ্রেও তার অবস্থান খুঁজবে।