Wednesday 31 August 2022

ইউক্রেন যুদ্ধের ছয় মাস… বৈশ্বিক প্রভাব, যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ

০১লা সেপ্টেম্বর ২০২২
 
জুন ২০২২। ডনবাসে ইউক্রেনিয় সেনারা ফরাসি নির্মিত 'সীজার' আর্টিলারি থেকে গোলাবর্ষণ করছে। যুদ্ধ শুরুর ছয় মাসের মাঝে যুদ্ধটা একে অপরের ক্ষতি বাড়ানোর যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। উভয় পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক; কিন্তু কেউই বড় রকমের কোন বিজয় ছিনিয়ে নেবার মতো অবস্থানে নেই।

২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। যুদ্ধ শুরুর ছয় মাস পর এই যুদ্ধের প্রভাব এখন বিশ্বব্যাপী প্রতিফলিত হচ্ছে। ‘দ্যা ইকনমিস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধ শুরুর ছয় মাসের মাঝে যুদ্ধটা একে অপরের ক্ষতি বাড়ানোর যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। উভয় পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক; কিন্তু কেউই বড় রকমের কোন বিজয় ছিনিয়ে নেবার মতো অবস্থানে নেই। ইউক্রেনিয়ান জেনারেল দিমিত্রো মারচেঙ্কোর মতে, বছর শেষ হবার আগেই ইউক্রেনের দক্ষিণের খেরসন শহর তাদের দখলে চলে আসবে। কিন্তু এহেন উচ্চাকাংক্ষা বাস্তবায়ন যে কঠিন হবে, তা সহজেই অনুমেয়। অপরদিকে যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে; যদিও ইউক্রেনের গম রপ্তানি শুরু হবার কারণে যুদ্ধের শুরুতে ইউরোপে খাবারের মূল্য যতটা বেড়ে গিয়েছিল, সেই অবস্থা থেকে তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। তথাপি যুদ্ধ দীর্ঘ হবার সম্ভাবনাটাই বেশি।

সামরিক পরিস্থিতির ছয় মাস

ছয় মাসের যুদ্ধ থেকে পাঁচটা সামরিক শিক্ষা নিয়েছে ‘আল জাজিরা’। প্রথমতঃ যুদ্ধের আগে পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা রুশ সামরিক বাহিনীকে যেভাবে দেখতেন, এখন বোঝা যাচ্ছে যে, তাদের সেই বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ ভুল ছিল। যুদ্ধের প্রথম দিকে রুশ বিমান বাহিনী আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। এর ফলশ্রুতিতে রুশ সেনাবাহিনীর গাড়ির সাড়িগুলি ইউক্রেনের বিমান ও ড্রোনের আক্রমণের শিকার হয়েছে। বাহিনীগুলির মাঝে সমন্বয়হীনতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সেনাদের রসদ এবং খাবার ফুরিয়ে যাবার পর দীর্ঘ গাড়ির সাড়িগুলির উপর ইউক্রেনিয়দের হামলা মনে করিয়ে দেয় যে, প্রথম দিনেই ইউক্রেনিয়দের যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাবার যে আশা রুশরা করেছিল, তা কতটা ভুল ছিল। বাহিনীগুলির কর্মকান্ডকে বশে আনতে গিয়ে উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসাররা ফ্রন্টলাইনের একেবারে কাছে গিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন। আর একইসাথে রুশ যোগাযোগ ব্যবস্থার অত্যন্ত খারাপ অবস্থার কারণে ইউক্রেনের ইন্টেলিজেন্স খুব সহজেই রুশ জেনারেলদের অবস্থানের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারকে ইউক্রেনিয়রা টার্গেট করে হত্যা করতে সক্ষম হয়। কয়েক মাস যুদ্ধের পর রুশরা তেমন সফলতা না পেয়ে কৌশল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। নতুন টার্গেট হয় ইউক্রেনের পূর্বের ডোনেতস্ক অঞ্চল; যেখানে পরিকল্পনামাফিক যুদ্ধ করে তারা যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে সেভেরোডোনেতস্ক শহরের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। তবে দক্ষিণের বন্দর শহর ওডেসার দিকে রুশ আক্রমণ ইউক্রেনিয়দের প্রতিরোধের মুখে সফল হয়নি। তারা ধীরে ধীরে পিছু হটে গিয়ে নীপার নদীর উপরে খেরসন শহরে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়।

দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউক্রেনিয়রা বিরাট সুবিধা পায় পশ্চিমাদের সরবরাহ করা বড় সংখ্যক শক্তিশালী ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহে। একইসাথে তুর্কি ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোনগুলি ইউক্রেনের আর্টিলারির জন্যে নিখুঁতভাবে টার্গেট খুজে দেয়। এর ফলে রুশ সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ রাডার, কমান্ড ও কন্ট্রোল ইউনিটগুলিকে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হয়। এতে রুশ সেনাবাহিনীর সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক যুদ্ধ করতে ইউক্রেনে আবির্ভূত হয়। এরা ইউক্রেনের বাহিনীকে যথেষ্ট সহায়তা দিলেও ভাষার ভিন্নতা এদের সফলতা কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ থেকে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র আসতে থাকে, যা ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে নিতে সহায়তা দেয়। এগুলির মাঝে ছিল বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ, নিখুঁতভাবে আঘাত করার মতো আর্টিলারি, আর্টিলারি রকেট, এবং রুশ নির্মিত ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান, যেগুলি ইউক্রেনিয়রা খুব স্বল্প ট্রেনিংএর মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। তবে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সেই অস্ত্রগুলিই দিয়েছে, যেগুলি দিয়ে ইউক্রেনিয়রা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমিগুলিকে রক্ষা করতে পারবে; দূরপাল্লার রকেট সরবরাহ করা থেকে তারা বিরত থাকে। পশ্চিমারা যুক্তি দেয় যে, তারা রুশদের সহ্যের সীমাকে অতিক্রম করতে চায় না; যে পরিস্থিতিতে তারা হয়তো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে আগ্রহী হতে পারে। আর ছয় মাসে যদিও ইউক্রেনিয়রা রুশ আক্রমণের দ্রুতিকে একেবারেই থামিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, তথাপি নিজেদের সামরিক ক্ষতিকে ইউক্রেনের পক্ষে পুষিয়ে নেয়া দুষ্কর। বিশেষ করে হারানো মানবসম্পদ ইউক্রেনের পক্ষে প্রতিস্থাপন করা একেবারেই সম্ভব নয়। নিজেদের রসদ যখন একেবারেই শেষের পথে, তখন ইউক্রেন পশ্চিমা সহায়তার উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।

যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত 'হিমারস' আর্টিলারি রকেট। ব্যবহার করে ইউক্রেনিয়রা নিখুঁতভাবে দূরবর্তী টার্গেটগুলিকে ধ্বংস করতে পারছে। যুদ্ধক্ষেত্রে কে কার কতো বেশি ক্ষতিসাধন করতে পারছে সেটার উপরেই যখন এগিয়ে থাকা নির্ভর করতে শুরু করেছে, তখন ‘হিমারস’ প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই ব্যবস্থার উপর দূর থেকে হামলা করতে পারছে। এর ফলশ্রুতিতে রুশরা বড় কোন আক্রমণে যাবার উদ্দেশ্যে কোন একটা স্থানে যথেষ্ট পরিমাণে রসদ জমা করতে সক্ষম হচ্ছে না। একারণেই রসদের অভাবে রুশদের একটার পর একটা আক্রমণ বারংবার থেমে যাচ্ছে।


তৃতীয়তঃ বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ‘হিমারস’ আর্টিলারি রকেট যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনিয়দেরকে এগিয়ে দিয়েছে। ‘এম-১৪২’ ‘হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম’ বা ‘হিমারস’ নামে পরিচিত অস্ত্রটা হলো ট্রাকের উপর বহণ করা ছয়টা রকেট আর্টিলারি লঞ্চার। একেকটা রকেটের পাল্লা প্রায় ১৫ থেকে ৯২ কিঃমিঃ পর্যন্ত; যেখানে বেশিরভাগ আর্টিলারির পাল্লা সাধারণতঃ ৪০ কিঃমিঃএর ভেতর থাকে। তবে বিশেষ ধরণের রকেট ব্যবহার করে ‘হিমারস’এর পাল্লা প্রায় ১’শ ৫০ কিঃমিঃ পর্যন্ত নেয়া যায়। ‘হিমারস’ ব্যবহার করে ইউক্রেনিয়রা নিখুঁতভাবে দূরবর্তী টার্গেটগুলিকে ধ্বংস করতে পারছে। যুদ্ধক্ষেত্রে কে কার কতো বেশি ক্ষতিসাধন করতে পারছে সেটার উপরেই যখন এগিয়ে থাকা নির্ভর করতে শুরু করেছে, তখন ‘হিমারস’ প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই ব্যবস্থার উপর দূর থেকে হামলা করতে পারছে। এর ফলশ্রুতিতে রুশরা বড় কোন আক্রমণে যাবার উদ্দেশ্যে কোন একটা স্থানে যথেষ্ট পরিমাণে রসদ জমা করতে সক্ষম হচ্ছে না। একারণেই রসদের অভাবে রুশদের একটার পর একটা আক্রমণ বারংবার থেমে যাচ্ছে। ‘হিমারস’এর লঞ্চার গাড়ি ব্যবহার করে বড় আকারের একটা ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া যায়, যেটাকে বলা হয় ‘এডভান্সড ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম’ বা ‘এটাকমস’। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৩’শ কিঃমিঃ পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত এই ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে রাজি হয়নি।

চতুর্থতঃ উভয় পক্ষই গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ও গোলাবারুদের ক্ষেত্রে সরবরাহ ঘাটতিতে রয়েছে। রুশরা পুরোনো আর্টিলারি ব্যবহার করছে, যেগুলির নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত করার সক্ষমতা বেশ খানিকটা কম। আবার এমন কিছু ক্ষেপণাস্ত্র তারা ভূমির টার্গেটের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, যেগুলি সেই কাজের জন্যে ডিজাইন করা হয়নি। এগুলি বলে দিচ্ছে যে, রুশরা গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহ ঘাটতির মাঝে পড়েছে। অপরদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনিয়রা বাণিজ্যিক ড্রোন ব্যবহার করে আকাশ থেকে গোলাবারুদ ফেলেছে। এটা ইউক্রেনিয়দের উদ্ভাবনী শক্তিকে দেখালেও বলে দিচ্ছে যে, যুদ্ধবিমান ও অস্ত্রসজ্জিত ড্রোনের ঘাটতিতে রয়েছে তারা। তবে পশ্চিমারা চিন্তায় রয়েছে যে, ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে গিয়ে তাদের নিজেদের কিছু বিশেষ অস্ত্রের স্টকে টান পড়ে যাচ্ছে। কারণ উৎপাদন ও সরবরাহের মাঝে দেখা দিয়েছে ঘাটতি। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমারা কোন যুদ্ধে জড়ালে সেই অস্ত্রগুলির ঘাটতি তাদেরকে মারাত্মকভাবে ভোগাবে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রে মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতি ও আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে অনেকেই বলা শুরু করেছেন যে, বাইডেন প্রশাসনের উচিৎ বিদেশে যুদ্ধের দিকে মনোযোগ না দিয়ে দেশের মানুষের সেবায় মনোনিবেশ করা। অপরদিকে রুশরা প্রশিক্ষিত সেনার অভাবের মাঝে থাকলেও ইউক্রেনের যুদ্ধকে ‘যুদ্ধ’ বা বলে ‘বিশেষ সামরিক অপারেশন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা দিলে হয়তো আরও মানুষকে সামরিক বাহিনীতে যোগদান করানো সম্ভব হবে; কিন্তু তা হবে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্যে রাজনৈতিক আত্মহননের শামিল। এমতাবস্থায় হাঁপিয়ে ওঠা উভয় পক্ষই তাদের ফোকাসকে ইউক্রেনের দক্ষিণে খেরসন শহরের দিকে নিয়ে এসেছে।

 
খেরসন শহর এখন যুদ্ধের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। ইউক্রেনিয়রা নীপার নদী থেকে যে খালের মাধ্যমে রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপে পানি সরবরাহ করা হয়, সেই খালের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। ২০১৪ সালে রুশরা ক্রিমিয়া দখল করে নিলে ইউক্রেনিয়রা এই খালের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল; যা কিনা ক্রিমিয়ার কৃষি ও শিল্পের মোট পানির ৮৫ শতাংশের যোগান দিতো। এখন এই খালের উভয় পাড় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার পর রুশরা আবারও ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে। এই খালের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্যে যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।

পঞ্চমতঃ খেরসন শহর এখন যুদ্ধের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। শহরটা একইসাথে সমুদ্র ও নদীবন্দর; যা রুশরা গত মার্চ মাসে দখলে নেয়। নীপার নদীর পশ্চিমে অবস্থিত শহরটা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের সাথে দু’টা সেতু দিয়ে সংযুক্ত। সাম্প্রতিক সময়ে এই নদীর উপর দিয়ে নোভা কাখোভকা শহরে অবস্থিত সেতু ইউক্রেনিয়রা ধ্বংস করে ফেলার পর খেরসন শহরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে রুশদেরকে এই দু’টা সেতুর উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে। ইউক্রেনিয়রা খেরসনের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নীপার নদী দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট চালু করতে চাইছে। আর একইসাথে ইউক্রেনিয়রা নীপার নদী থেকে যে খালের মাধ্যমে রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপে পানি সরবরাহ করা হয়, সেই খালের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। ২০১৪ সালে রুশরা ক্রিমিয়া দখল করে নিলে ইউক্রেনিয়রা এই খালের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল; যা কিনা ক্রিমিয়ার কৃষি ও শিল্পের মোট পানির ৮৫ শতাংশের যোগান দিতো। এখন এই খালের উভয় পাড় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার পর রুশরা আবারও ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে। এই খালের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্যে যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এছাড়াও খেরসনের নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করছে রুশরা ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরের দিকে এগুতে পারবে কিনা। ওডেসা বন্দরের উপর সমুদ্রের দিক থেকে একটা উভচর হামলার পরিকল্পনা রুশরা আপাততঃ স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ এই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিতে হলে স্থলের দিক থেকে ঘিরে ফেলা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু রুশরা স্থলের দিক থেকে ওডেসা থেকে বেশ কিছুটা দূরে রয়েছে।

‘আল জাজিরা’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এই মুহুর্তে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ডোনেতস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চল ছাড়াও দক্ষিণের বেশকিছু অঞ্চল রুশদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এমতাবস্থায় রুশদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কতটুকু পেলে তারা এই যুদ্ধে ‘বিজয়’ হয়েছে বলে ঘোষণা দেবে। পশ্চিমাদের এক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এক দশকে আফগানিস্তানে যত সেনা হারিয়েছিল, রুশরা তার চাইতে বেশি সেনা ইউক্রেনে হারিয়েছে মাত্র ছয় মাসে! রুশদের রেলওয়ে লাইন এবং গাড়ির বহরের উপর চোরাগুপ্তা হামলা হচ্ছে; যা কিনা সময়ের সাথে সাথে আরও বাড়বে। ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে এখন সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সামনের ছয় মাস…

অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর জেনারেল মিক রায়ান ‘এবিসি নিউজ’এর এক লেখায় আগামী ছয় মাসে ইউক্রেনের যুদ্ধ কোন দিকে যেতে পারে, সেব্যাপারে কয়েকটা সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছেন। প্রথম সম্ভাবনা হলো, যুদ্ধক্ষেত্রে এবং রাজনৈতিক দিক থেকে উভয় পক্ষই থমকে থাকতে পারে; যেখানে কোন পক্ষই হয়তো বড় কোন বিজয় পাবে না। একে অপরকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে দুর্বল করার চেষ্টা চালাতে থাকবে এবং বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরির চেষ্টা করবে। তবে এই স্থিতাবস্থা রুশদের পক্ষে যাবে; কারণ তুলনামূলকভাবে ইউক্রেনের চাইতে রাশিয়ার মানবসম্পদ বেশি ও অর্থনীতির আকার বড়। অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও রুশরা তাদের জ্বালানি বিভিন্ন দেশের কাছে বিক্রি করে আয় করতে পারছে। কিন্তু ইউক্রেনের অর্থনীতি ছোট হয়ে আসছে এবং এই অর্থনীতি নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন। অপরদিকে রুশরা মনে করছে যে, ইউরোপের সরকারগুলি জনগণের চাপের মাঝে পড়বে। এর মাঝে তারা হয়তো ইউক্রেনকে চাপের মাঝে ফেলে যুদ্ধের একটা উপসংহার টানতে চাইবে। তবে রুশদের সাথে ছাড় দিয়ে শান্তিচুক্তি করাটা ইউক্রেনের সরকারের জন্যে যথেষ্ট কঠিন হবে।

দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, দুই পক্ষের মাঝে কোন একজন এগিয়ে যেতে পারে। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, রুশরা তাদের আক্রমণে যাবার শক্তি অনেকটাই হারিয়েছে। আর গত কয়েক সপ্তাহের মাঝে ‘হিমারস’ রকেট ব্যবহার করে ইউক্রেন কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। যদি ইউক্রেন সামনের দিনগুলিতে বড় কোন এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়, তাহলে পশ্চিমাদের মাঝে ইউক্রেনকে সমর্থনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। কারণ এতে পশ্চিমারা মনে করতে পারবে যে, ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়ায় ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া বর্তমানের অস্ত্রের ঘাটতি পূরণে সামরিক উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে; যদিও সেটা পুরোপুরিভাবে নির্ভর করবে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী কতটা এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারছে বা কত বড় রুশ বাহিনীকে ধ্বংস করতে পারছে তার উপর।

তৃতীয় সম্ভাবনা হলো, কোন একটা পক্ষ হঠাৎ করেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক দিক দিয়ে বড় কোন বিজয় পেয়ে যেতে পারে; যেটার উপর ভর করে সে এরপর থেকে শুধু এগিয়েই যাবে। উদাহরণ হিসেবে, যুদ্ধরত দেশগুলির মাঝে কোন দেশের জাতীয় নেতার যদি মৃত্যু হয় অথবা তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়; অথবা হঠাৎ করেই যদি তাদের সেনাদের মনোবল পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়ে; অথবা অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক বড় কোন ঘটনা সংঘটিত হলো। যদি এহেন কোন ঘটনা ইউক্রেনের ভাগ্যে ঘটে, তাহলে ইউক্রেনের মাটিতে পশ্চিমা সেনা মোতায়েন না করে রুশদের অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না। এতে ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যাহত হবে এবং চীনের নিজস্ব বিশ্বাসকে শক্তিশালী করবে যে, পশ্চিমারা নিম্নগামী। এরকম পরিস্থিতিতে অনেক পশ্চিমা সরকার মারাত্মক চাপের মাঝে পড়বে।

জেনারেল মিক রায়ান বলছেন যে, যদি এমন কোন ঘটনা রাশিয়ার ভাগ্যে ঘটে, তাহলে এতে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের বিজয়ই হবে না, রুশরা মনে করতে শুরু করবে যে, এতদিন পশ্চিমাদের হুমকির যে ব্যাপারটা রুশ সরকার তাদের জনগণকে বলেছে, তা প্রকৃতপক্ষে সত্যি। এতে রুশদের মাঝে বিরক্তির উদ্রেক হতে পারে এবং আরও ভয়ংকর একটা রাশিয়া সামনে আসতে পারে।

 
রাশিয়া এখন ইউক্রেনের ১০ থেকে ২০ শতাংশ ভূমি দখলে রেখেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানেই রয়েছে ইউক্রেনের ৯০ শতাংশ জ্বালানি এবং বেশিরভাগ সমুদ্রবন্দর। কাজেই ইউক্রেনের জন্যে কোন ভূমি হারানোটাই সমীচিন নয়। এই অঞ্চলগুলি হারালে ইউক্রেন পশ্চিমাদের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন থাকবে।

যুদ্ধ কতটা দীর্ঘ হতে পারে?

‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পাদক ডন সাবাগ মনে করছেন যে, যুদ্ধ আরও কমপক্ষে এক বছর স্থায়ী হতে পারে; কারণ কোন পক্ষই বড় কোন বিজয় ছিনিয়ে নেবার সক্ষমতা দেখাতে পারছে না। ইউক্রেন চাইছে খেরসনের নিয়ন্ত্রণ নিতে, কিন্তু একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গোপনে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ইউক্রেনিয়দের প্রকৃতপক্ষে সেই সক্ষমতা নেই। ইউক্রেনিয়রা আপাততঃ দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং শত্রুর ফ্রন্টলাইনের পিছনে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের ব্যবহার করে হামলার উপর নির্ভর করতে চাইছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক বলছেন যে, এতে রুশদের মাঝে সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এর ফলে রুশরা তো খেরসন ছেড়ে চলে যাবে না। আর বর্তমানে রুশরা তাদের দখল করা এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাতেই বেশি ব্যস্ত থাকছে। সামনের শীতকাল নিয়ে সকলেই চিন্তা করছে। ইউক্রেনিয়রা মনে করছে যে, শীতকালে রুশরা ইউক্রেনের উপর চাপ বাড়াতে দেশটার জ্বালানি নেটওয়ার্কের উপর হামলা করতে পারে। তবে এর পরের বসন্তকালটাকে উভয় পক্ষই আক্রমণে যাবার সময় হিসেবে দেখবে। তাই সেসময়ের আগে উভয় পক্ষই তাদের রসদের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে চাইবে। অপরদিকে পশ্চিমাদেরকে নিশ্চিত হতে হবে যে, তারা ইউক্রেন যুদ্ধে কি দেখতে চায়। তারা কি ইউক্রেনকে বিজয়ী দেখতে চায়, নাকি শুধু রুশদেরকে ঠেকিয়ে রাখা দেখতে চায়? তারা এতকাল ইউক্রেনকে অনেক সমরাস্ত্র দিলেও রুশদেরকে ঠেলে দেশ থেকে বের করে দিতে পারার মতো অস্ত্র কখনোই দেয়নি।

‘ভোক্স’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধের দীর্ঘতা মাসের সংখ্যায় মাপা সম্ভব নাও হতে পারে; অর্থাৎ তা হতে পারে কয়েক বছরব্যাপী। উভয় পক্ষই এখনও মনে করছে যে, তারা যুদ্ধের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে সক্ষম। একারণে কেউই এখনও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছাড় দিতে ইচ্ছুক নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় কারুর লক্ষ্য থাকে না; যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় হলো রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের একটা পদ্ধতি। ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো এনা এশফোর্ড বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেমন দেখা গেছে যে, এক পক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে জিতে গেছে এবং সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়েছে – এমন ঘটনা ইতিহাসে খুব বেশি নেই। ইউক্রেন যুদ্ধও ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ের ব্যতিক্রম হবে না। ইউক্রেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে হারিয়ে দেয়াটা এখন রাশিয়ার সক্ষমতার বাইরে। কাজেই এটা মোটামুটিভাবে ধরেই নেয়া যায় যে, যুদ্ধের শেষটা হবে আলোচনার টেবিলে; যেখানে কোন পক্ষই প্রথমে যা চেয়েছিল তা পুরোপুরিভাবে পাবে না। তবে কিছু ব্যাপার নির্ধারণ করবে এই যুদ্ধের স্থায়িত্ব; যেমন – ইউক্রেন এবং রাশিয়াতে জনমত; উভয় দেশের অর্থনীতির উপরে চাপ; এবং ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাবার পিছনে পশ্চিমা দেশগুলির সক্ষমতা। এটা পরিষ্কার যে, রাশিয়া প্রথমে যে লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তা অর্জনে সে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ইউক্রেন জিতে গেছে। ইউক্রেনের শহরগুলির ধ্বংস হওয়া, তার শিল্পগুলিতে ধ্বস, কৃষিজমি ভস্ম হয়ে যাওয়া, বিরাট জনসংখ্যার মৃত্যু ও বাস্তুচ্যুতি – এগুলি ইউক্রেনকে মারাত্মক ক্ষতির মাঝে ফেলেছে। ইউক্রেনকে আবারও নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলে একদিকে যেমন রাশিয়াকে ব্যাপক ছাড় দিতে হবে, তেমনি পশ্চিমা দেশগুলিকেও ইউক্রেনের পূনর্গঠনের জন্যে বড় রকমের দায়িত্ব নিতে হবে।

যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাব

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের জনগণের অনেকেই পশ্চিমা-ঘেঁষা হবার পক্ষেই ছিল। কিন্তু পশ্চিমারা এব্যাপারে খুব একটা নিশ্চিত ছিল না। যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমারা ইউক্রেনের ব্যাপারে তাদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে যাচ্ছে। যেমন ইউক্রেনকে ইইউএর অংশ করে নেবার পদ্ধতি শুরু হয়েছে; যা কিনা ইউক্রেন অনেকদিন ধরে অনুরোধ করলেও ইইউ মানতে চায়নি। যুদ্ধ ইউক্রেনকে পশ্চিমাদের আরও নিকটে নিয়ে গেছে। অপরদিকে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের দূরত্ব বহু বছরের জন্যে বেড়ে গেছে। এর ফলশ্রুতিতে রাশিয়া বাকি বিশ্বে নতুন বন্ধু খুঁজছে; যেমন চীনের কাছে জ্বালানি বিক্রি করা, অথবা ইরানের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা। ইরান যেহেতু কয়েক দশক ধরেই পশ্চিমা অবরোধের মাঝে রয়েছে এবং অবরোধকে কিভাবে বাইপাস করা যায়, সেটা শিখেছে; তাই রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে সেটা শিখতে চাইছে।

খাদ্যসংকট - প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে আফ্রিকায় খাদ্যসংকটের ইস্যুটাকে নিয়ে আসা হয়েছে। আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় মোট খাদ্যের অর্ধেক গম থেকে উৎপন্ন হয়। অথচ দেশটা তার চাহিদার ৮০ শতাংশ গম আমদানি করে। খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি পুরো নাইজেরিয়াতে মানুষের নিরাপত্তাহীনতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০২৩ সালে নাইজেরিয়াতে সাধারণ নির্বাচনের আগে সরকার যদি অবস্থার উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রেসিডেন্টকে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হতে পারে। আর আফ্রিকার সবচাইতে জনবহুল দেশে রাজনৈতিক কলহ সৃষ্টি হলে সেটার প্রভাব পুরো পশ্চিম আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ভারত, রাশিয়া ও চীন - ভারতের সাথে রাশিয়ার গভীর সম্পর্ক বহুকাল ধরেই। আর যুক্তরাষ্ট্রও ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে দেখতে চায় বলে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করেনি। এতে ভারতের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে। এর মাঝে অনেকেই ভারতের নিজস্ব স্বার্থকে সমুন্নত রাখার কথা বলতে থাকে এবং পশ্চিমা দ্বিমুখী নীতিকেও আলোচনায় নিয়ে আসে। তারা রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানির ফলশ্রুতিতে পশ্চিমাদের সমালোচনাকে ভালো চোখে দেখেনি। কিন্তু সমস্যা হলো, রাশিয়া যদি চীনের আরও কাছে যেতে শুরু করে, সেটা ভারতের স্বার্থের বিপক্ষে চলে যেতে পারে। এবং এতে ভারত কূটনৈতিক দিক থেকে সমস্যার মাঝে পড়ে যেতে পারে। তবে ভারত যেহেতু বহু স্বার্থের যোগফল, তাই ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতের সামনে নতুন সুযোগও তৈরি করেছে। উল্টোদিকে মার্কিন কংগ্রেসের স্পীকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর উত্তেজনা শুরু হলে তাইওয়ানও চীনের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধের ব্যাপারে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, সেটা নিয়ে চিন্তা শুরু করেছে।

তুরস্ক, ইউক্রেন ও রাশিয়া - ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, অদ্ভুত একটা পরিস্থিতিতে রয়েছে তুরস্ক। ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক একদিকে যেমন ইউক্রেনকে সমর্থন দিচ্ছে, তেমনি তারা চেষ্টা করছে রাশিয়াকে না ক্ষেপাতে। তারা কিয়েভের কাছে ড্রোন বিক্রি করেছে; কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধে যোগ দেয়নি। উভয় পক্ষের সাথে সম্পর্ক রাখার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইউক্রেনের গম রপ্তানির জন্যে কাজ করেছেন এবং তার এই অবস্থানকে বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য বলে জাহির করেছেন। তবে ২০২৩ সালের নির্বাচন যখন কাছে চলে এসেছে, তখন অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, তিনি তার এই অবস্থানকে কতটা ধরে রাখতে পারবেন।

 
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা 'গ্লোবাল টাইমস'এ প্রকাশিত মার্কিনীদের সমালোচনামূলক কার্টুন। যে ব্যাপারটা মার্কিনীদেরকে ভাবাচ্ছে তা হলো, তাদের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া এবং চীন এখন আরও কাছাকাছি চলে এসেছে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইউরোপের সাথে আরও শক্তিশালী বন্ধুত্ব তৈরি করতে।

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন - আটলান্টিকের ওপাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বৈরিতা যখন চীনের দিকে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় অনেকেই মার্কিনীদের ফোকাস রাশিয়ার দিকে নিয়ে গিয়েছে; যদিও চীনকে কেউই হিসেব থেকে বাদ দেয়নি। যে ব্যাপারটাতে সকলেই নিশ্চিত হয়েছেন তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র এখনোও ইউরোপের নিরাপত্তার কেন্দ্রে রয়েছে। ইউরোপের কৌশলগত স্বাতন্ত্রের যে কথাগুলি শুরু হয়েছিল, তা বর্তমান বাস্তবতায় যৌক্তিকতা পাচ্ছে না। তবে যে ব্যাপারটা মার্কিনীদেরকে ভাবাচ্ছে তা হলো, তাদের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া এবং চীন এখন আরও কাছাকাছি চলে এসেছে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইউরোপের সাথে আরও শক্তিশালী বন্ধুত্ব তৈরি করতে।

ইউরোপ ও জ্বালানি সংকট - যুদ্ধের কারণে ইউরোপ সবচাইতে চাপের মাঝে পড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধের আগে যেখানে রাশিয়া ছিল ইউরোপের সবচাইতে বড় জ্বালানি সরবরাহকারী, এখন তারা হঠাত করেই রুশ জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে উঠেপড়ে লেগেছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ ইউরোপের একাত্মতাকে প্রশ্নের মাঝে ফেলেছে। ইইউএর মাঝে যখন সকলকেই জ্বালানি খরচ কমাতে বলা হচ্ছে, তখন সদস্যদেশগুলির মাঝেই কেউ কেউ বলছে যে, এটা তাদের উপর জুলুম হচ্ছে। কারণ সকলে রুশ গ্যাসের উপর সমানভাবে নির্ভরশীল নয়। যুদ্ধের কারণে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিতে যাচ্ছে। আর ন্যাটো তার পূর্ব সীমানায় সৈন্যের সংখ্যাও বৃদ্ধি করছে।

মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দা - ‘ডয়েচে ভেলে’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল। করোনা লকডাউনের পর আন্তর্জাতিক সরবরাহে জটলা সৃষ্টি হওয়ায় যেমন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, তেমনি করোনা লকডাউনের মাঝে জ্বালানির ব্যবহার শূণ্যের কোঠায় চলে যাবার পর হঠাত করেই চাহিদা আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। আর যেহেতু ইউক্রেন ও রাশিয়া মিলে আন্তর্জাতিক বাজারে এক চতুর্থাংশ গমের সরবরাহ করতো, তাই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের হার বাড়াতে শুরু করেছে। মূল চিন্তাটা হলো, যদি অর্থ ঋণ নেয়া কঠিন হয়ে যায়, তাহলে মানুষ কম খরচ করবে। এতে করে চাহিদা কমবে এবং পণ্যের মূল্যও কমে আসবে। তবে এর আরেকটা অর্থ হলো ধীরে চলা অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দেয়া। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবে না; তারা গম বা জ্বালানি উৎপাদনও করতে পারবে না। তাই তারা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে মন্দা থেকেও বাঁচাতে পারবে না।

পশ্চিমাদের বিভক্তি - ‘ডয়েচে ভেলে’র প্রতিবেদনে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধকে অনেকেই পশ্চিমাদের একাত্মতা হিসেবে দেখলেও বিশ্লেষণে সেখানে বিভেদ ফুটে ওঠে। রাশিয়ার উপর সকল অবরোধেই পশ্চিমারা একত্রে ছিল; শুধুমাত্র জ্বালানির ক্ষেত্রে অবরোধ আরোপ করতে গিয়েই পশ্চিমাদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কারণ জার্মানিসহ ইউরোপের কিছু দেশ রুশ গ্যাসের উপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। যুদ্ধের প্রথম ছয় মাসে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানির আয় কমেনি; বরং বেড়েছে। জার্মানি এবং ফ্রান্স যুদ্ধের আগ থেকেই রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপে আগ্রহী ছিল না। বিশেষ করে শীতকালে রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা জার্মানির নীতিকে বাকি ইউরোপের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থানে রেখেছিল।

অবরোধ অকার্যকর - রাশিয়ার উপর অবরোধ অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকারিতা হারিয়েছে; কারণ চীন এবং ভারতের মতো কিছু বড় দেশ রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বৃদ্ধি করেছে। একইসাথে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে পশ্চিমা দেশগুলির মূল্যস্ফীতি কমাবার ব্যাপারে আগ্রহী হয়নি। ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই রাশিয়ার উপর অবরোধ রাশিয়াকে যতটা না বিপদে ফেলেছে, তার চাইতে সামনের শীতকালে রুশ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় ইউরোপকে, বিশেষ করে জার্মানিকে বেশি ত্রাসের মাঝে ফেলেছে।

 
মার্চ ২০২২। মার্কিন কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি। ইউক্রেনের সামনে এখন অস্ত্র, অর্থ এবং অন্যান্য সহায়তার জন্যে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া কোন পথই খোলা নেই। এখন উভয় পক্ষই আলোচনায় বসার আগে নিজেদের অবস্থানকে আরও সুসংহত করতে চাইছে। তবে আলোচনা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করছে যুদ্ধের ব্যাপারে পশ্চিমারা কি ভাবছে সেটার উপর। যদি পশ্চিমা দেশগুলিতে জনমত যুদ্ধের বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে পশ্চিমা নেতারা আলোচনায় বসার জন্যে ইউক্রেনের উপর চাপ সৃষ্টি করবে।

যুদ্ধ শেষ হতে পারে কিভাবে?

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম মাসে রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল পুরো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নেয়া এবং কিয়েভে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানো। রুশরা ভেবেছিল তারা কয়েক দিনের মাঝেই যুদ্ধ শেষ করে ফেলবে; মাসের পর মাস যুদ্ধ করার কথা তারা চিন্তাও করেনি। সৈন্যদের মাঝে অনেকেই যুদ্ধের বিজয়ের পরে প্যারেড করার জন্যে পোষাকও সাথে নিয়েছিল! কিন্তু রাশিয়ার দ্রুত বিজয় পাবার চিন্তাটা প্রথম মাসেই ধূলায় মিশে যায়।

ইউক্রেনের কাছে বিজয় বলতে কি বোঝায়? ইউক্রেনিয়রা কি মনে করছে যে, তারা পূর্বাঞ্চলের ডনবাস এবং দক্ষিণের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ পূনর্দখল করতে পারবে? রাশিয়া এখন ইউক্রেনের ১০ থেকে ২০ শতাংশ ভূমি দখলে রেখেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানেই রয়েছে ইউক্রেনের ৯০ শতাংশ জ্বালানি এবং বেশিরভাগ সমুদ্রবন্দর। কাজেই ইউক্রেনের জন্যে কোন ভূমি হারানোটাই সমীচিন নয়। এই অঞ্চলগুলি হারালে ইউক্রেন পশ্চিমাদের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন থাকবে। ইউক্রেন এখনও বলছে যে তারা রাশিয়ার সাথে আলোচনায় আগ্রহী নয়। কিন্তু ইউক্রেনের সমস্যা বাড়ছেই। যুদ্ধের শুরুতে ইউরোপের দেশগুলি ইউক্রেনের শরণার্থী নিতে যতটা আগ্রহী ছিল, এখন ব্যাপক মূল্যস্ফীতির পর তারা আর ততটা আগ্রহী নয়।

ইউক্রেনের সামনে এখন অস্ত্র, অর্থ এবং অন্যান্য সহায়তার জন্যে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া কোন পথই খোলা নেই। এবং সেই আঙ্গিকেই তারা শুধুমাত্র রাশিয়ার ক্ষতি বৃদ্ধি করাতেই মনোনিবেশ করেছে। তারা হয়তো আশা করছে যে, রাশিয়ার জন্যে যুদ্ধের ব্যয় বহণ করা খুব কঠিন হয়ে গেলে একসময় রাশিয়া নিজেই যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইবে। এখন উভয় পক্ষই আলোচনায় বসার আগে নিজেদের অবস্থানকে আরও সুসংহত করতে চাইছে। তবে আলোচনা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করছে যুদ্ধের ব্যাপারে পশ্চিমারা কি ভাবছে সেটার উপর। যদি পশ্চিমা দেশগুলিতে জনমত যুদ্ধের বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে পশ্চিমা নেতারা আলোচনায় বসার জন্যে ইউক্রেনের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। অপরদিকে রাশিয়া হয়তো নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মাঝে যুদ্ধ শেষ করার ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। এর মাঝে তারা তাদের দখলীকৃত এলাকার পরিধি বৃদ্ধি করতে এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করতে চাইবে।

Saturday 27 August 2022

ব্রিটেনের অর্থনীতিতে ধ্বস আসন্ন?

২৭শে অগাস্ট ২০২২
 
ফেব্রুয়ারি ২০২২। লন্ডনে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাবার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের অর্থনৈতিক অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ নামের ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাংক্ষা বাস্তবায়নে ব্রিটেন যেভাবে ব্রেক্সিটের দিকে এগিয়েছে, করোনার দুর্যোগের পর বৈশ্বিক জ্বালানি সমস্যার কারণে সেই চিন্তাগুলি খুব দ্রুতই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।


ব্রিটেনের ‘অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস’এর এক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মাঝে দেশটার অর্থনীতি শূণ্য দশমিক ১ সঙ্কুচিত হয়েছে। অথচ এবছরের প্রথম তিন মাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল শূণ্য দশমিক ৮ শতাংশ। বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ বলছে যে, সামনের দিনগুলিতে অর্থনীতিতে ধ্বস নামার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে করোনার প্রণোদনা শেষ হয়ে যাবার সাথে সাথে খুচরা বাজারে ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়া দায়ী। ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’এর পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে যে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সাল শেষ হবার আগেই ব্রিটেনের অর্থনীতি মন্দার মাঝে পড়তে যাচ্ছে। টানা ছয় মাস অর্থনীতির নিম্নগতিকেই অর্থনৈতিক মন্দা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের বার ও রেস্তোঁরার মালিকরা বলছেন যে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের এখনই মন্দার অনুভূতি হচ্ছে। মানুষ বাড়ি থেকে কম বের হচ্ছে; জীবনযাত্রার খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এছাড়াও পোলট্রি থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল, সকল কিছুরই মূল্য বেড়ে গেছে; উল্টোদিকে তাদের ক্রেতারা খরচ কমাতে চাইছে। এমতাবস্থায় ব্যবসাগুলি এখন কোনমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে।

‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনে জ্বালানির মূল্য এতটাই বেড়েছে যে, নাগরিকেরা তাদের খরচের হিসেব রাখতে হিমসিম খাচ্ছেন। তাদের জ্বালানির মিটারের ব্যালান্স দেখতে দেখতেই শূণ্যের কোঠায় চলে যাচ্ছে। রান্না করার মাঝেই কারো কারো জ্বালানি চলে যাচ্ছে। আর যারা রাষ্ট্রীয় সহায়তা নিয়ে বেঁচে আছে, তাদের হাতে এখন বিদ্যুতের বিল পরিশোধের পর বাড়িভাড়া দেয়ার অর্থও থাকছে না। ২৬শে অগাস্ট ব্রিটেনের জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বলে যে, নাগরিকদের বাৎসরিক জ্বালানি খরচ ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। অথচ গত এপ্রিল মাসেই জ্বালানি খরচ বেড়েছে ৫৪ শতাংশ! এর ফলশ্রুতিতে গড়পড়তা একেকটা বাড়ির জ্বালানি খরচ ২ হাজার ৩’শ ডলার থেকে বেড়ে প্রায় ৪ হাজার ২’শ ডলার হতে চলেছে। সর্বশেষ এই মূল্যবৃদ্ধি অক্টোবরের প্রথম দিন থেকে কার্যকর হতে চলেছে। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এই খরচ আরও বেড়ে ৪ হাজার ৭’শ ডলার অতিক্রম করবে! ‘জি-৭’ বা বিশ্বের সবচাইতে ধনী ৭টা দেশের গ্রুপের মাঝে ব্রিটেনের মূল্যস্ফীতি সবচাইতে বেশি। আর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে কয়েক মাস ধরেই দেশজুড়ে রেল শ্রমিক, ডাকবিভাগের শ্রমিক, বন্দরের শ্রমিক, আইনজীবী, এমনকি পরিচ্ছন্ন কর্মীরাও ধর্মঘটে নেমেছে। জুলাই মাসে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্রিটেনের মূল্যস্ফীতি গিয়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ১ শতাংশে; যা কিনা ৪০ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ!

‘এসএন্ডপি গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্স’ এবং ‘সিবিআই’এর যৌথ এক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, জুলাই থেকে অগাস্ট মাসের মাঝে ব্রিটেনের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর যতটা দ্রুত উৎপাদন হারিয়েছে, তা ২০০৯ সালের পর থেকে দেখা যায়নি। ‘এসএন্ডপি’এর এসোসিয়েট ডিরেক্টর ‘দ্যা গার্ডিয়ান’কে বলছেন যে, ২০২০ সালের মে মাসে করোনার লকডাউনের পর থেকে উৎপাদন সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। অগাস্ট মাসে ব্রিটেনের বেসরকারি খাত অর্থনৈতিক স্থবিরতার আরও কাছাকাছি গিয়েছে। দেশটার সেবা খাত সামান্য ভালো করায় পুরো অর্থনীতি এখনও ধ্বসে যায়নি। ‘সিবিআই’এর অর্থনীতিবিদ আলপেশ পালেহা বলছেন যে, কারখানাগুলি যখন কাঁচামালের উচ্চমূল্য, সরবরাহ পেতে দেরি হওয়া ইত্যাদি সমস্যার মাঝে রয়েছে, তখন অর্থনৈতিক মন্দা হাজির হয়েছে; কাজেই বছরের বাকি মাসগুলিতে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক হবে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি এখন ব্যাংকের উচ্চ সুদের মাঝেও পড়তে হচ্ছে কারখানাগুলিকে। সুদের হার বর্তমানে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালের বসন্তে ৪ শতাংশ হবার পূর্বাভাস দিচ্ছে কেউ কেউ।

ব্রিটিশ এনজিও ‘ক্রিশ্চিয়ান্স এগেইনস্ট পভার্টি’র জন টেইলর ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলছেন যে, যে মানুষগুলি কখনোই ঋণদায়গ্রস্ত ছিল না, এখন তারা ঋণের মাঝে পড়ে যাচ্ছে। অনেকেই তাদের কাছের মানুষকে হারিয়েছে; মানসিক বিপর্যয়ের মাঝে রয়েছে; তারা জানে না যে কিভাবে তারা তাদের পরবর্তী বিল পরিশোধ করবে, অথবা কিভাবে তারা বেঁচে থাকার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য ক্রয় করতে পারবে। ‘জোসেফ রাউনট্রি ফাউন্ডেশন’এর গত মে মাসের গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, ১০ লক্ষ ব্রিটিশ পরিবার জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নতুন করে অতিরিক্ত ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে। ফাউন্ডেশনের প্রধান অর্থনীতিবিদ রেবেকা ম্যাকডোনাল্ড বলছেন যে, এরকম দারিদ্র্য পরিস্থিতি তারা গত কয়েক দশকে দেখেননি। ব্রিটিশ সরকার বলছে যে, তারা আসছে শীতে সকল পরিবারকে ৪’শ ৭০ ডলার করে দেবে; কিন্তু অনেকেই বলছেন যে, এটা অন্ততঃ এর দ্বিগুণ পরিমাণ হওয়া উচিৎ।

‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ বলছে যে, কয়েক শতকের জনসংখ্যা বৃদ্ধির পর এখন জন্মহার কমে যাওয়ায় ব্রিটেনের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলিতে করদাতার সংখ্যাও কমতে যাচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে নতুন সমস্যাগুলি। জ্বালানি কোম্পানি ‘ইডিএফ’এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ফিলিপ কোমারেট ‘বিবিসি’কে বলছেন যে, ব্রিটিশ সরকার যদি জনগণকে জ্বালানি খরচ পোষাতে আরও সহায়তা না দেয়, তাহলে ব্রিটেনের অর্ধেক মানুষ শীতকালে ‘জ্বালানি দারিদ্র্য’র মাঝে পড়বে। এর অর্থ হলো, জ্বালানির খরচ পরিবারের ব্যয়ের ১০ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে। নতুন হিসেব বলছে যে, করোনার লকডাউনের কারণে ২০২০ সালে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে ৩’শ বছরের মাঝে সবচাইতে বড় ধ্বস নেমেছিল। এখন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ৪০ বছরের মাঝে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পদত্যাগের পর পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ নামের ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাংক্ষা বাস্তবায়নে ব্রিটেন যেভাবে ব্রেক্সিটের দিকে এগিয়েছে, করোনার দুর্যোগের পর বৈশ্বিক জ্বালানি সমস্যার কারণে সেই চিন্তাগুলি খুব দ্রুতই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে নিতে বিপুল সামরিক সহায়তা দিচ্ছে ব্রিটেন। তবে আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০২৩ সালে আফ্রিকায় আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি, মধ্যপ্রাচ্য ও ইন্দোপ্যাসিফিকে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি, উত্তর ও পূর্ব ইউরোপের নিরাপত্তায় নেতৃত্ব দেয়া, ইত্যাদির মতো ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর ভূরাজনৈতিক চিন্তাগুলি বাস্তবায়নের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

Saturday 20 August 2022

জলবায়ু পরিবর্তনের যাতাকলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে ইউরোপ

২১শে অগাস্ট ২০২২

০৯ই অগাস্ট ২০২২। জার্মানির বিনগেনের কাছে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া রাইন নদী। ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি এবং ফ্রান্স এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। দু’টা ব্যাপারে কেউই এখন নিশ্চিত নয়; এর প্রথমটা হলো আবহাওয়া; আর দ্বিতীয়তা হলো সামাজিক স্থিতি। জ্বালানির মূল্যস্ফীতির সাথে যুক্ত হয়েছে পরিবেশগত বিপর্যয়, যা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির মূল স্তম্ভ অর্থনীতিকে আঘাত করেছে। সামনের শীতকালে জার্মান সরকারের জ্বালানি ব্যবস্থাপনা সকলেই পরিমাপ করবে। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবার কারণে সরকারের কার্যক্রম কতটা ভালো হলে মানুষের চোখে তা ভালো ঠেকবে, তা বলা কঠিন। কারণ যে কেউ যে কোন সুযোগে সরকারের সমালোচনা করতে পারে, অথবা রাজনৈতিক অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে।


‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, ইউরোপের রাইন নদীর পানি রেকর্ড নিচে নেমে গেছে। আর ব্রিটেনে চলছে ৮০ বছরের মাঝে সবচাইতে মারাত্মক খরা; যেখানে টেমস নদীর উৎস শুকিয়ে গেছে। ইউরোপের নদীপথগুলি খুবই নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে। একজন ডাচ ক্যাপ্টেন পিটার ক্লীরেবুটস বলছেন যে, সাধারণতঃ যেখানে জাহাজের নিচে ২ মিটারের বেশি পানি থাকে, সেখানে এখন কিছু স্থানে মাত্র ৪০ সেন্টিমিটার পানি থাকছে। এমতাবস্থায় জাহাজ নদীতে আটকে যাওয়ার ভয় থাকছে। একারণে জাহাজের মালামাল কমিয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মাল বহণ করতে হচ্ছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, ইউরোপের এবারের খরা ৫’শ বছরের মাঝে সবচাইতে মারাত্মক খরা হিসেবে দেখা দিতে পারে। ইতালি থেকে ব্রিটেন পর্যন্ত ইউরোপের প্রায় ৪৭ শতাংশ ভূমিই এই খরার মাঝে পড়েছে। এর মাঝে ১৭ শতাংশ মারাত্মক খরার মাঝে রয়েছে। ফ্রান্সের মৎস্য সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা স্টেফানে মার্টি ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, একটা ব্যাপার আরেকটার সাথে যুক্ত। এবছরে পাহাড়ে তুষার কম পড়ার কারণে পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া নদীগুলিতেও পানি কম। পীরেনীজ পর্বতমালায় পানিবিদ্যুত উৎপাদন করার জন্যে তৈরি করা হ্রদগুলি থেকে পানি ছেড়ে দেয়া হয়েছে যাতে করে নদীগুলিতে কিছু পরিমাণ পানি অন্ততঃ থাকে। বিশ্বের বাকি সকল এলাকার তুলনায় ইউরোপে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে সবচাইতে বেশি হারে। বৃষ্টি না হবার কারণে ফ্রান্সে ভুট্টার আবাদ গত বছরের তুলনায় সাড়ে ১৮ শতাংশ কম হবার সম্ভাবনা রয়েছে। ফরাসি আবহাওয়া বিভাগ বলছে যে, জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চাইতে ৮৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। জার্মানির ‘টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ’এর প্রফেসর মিরান্ডা শ্রুয়ার্স ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, ২০১৮ সালের খরাকে অনেকেই ৫’শ বছরে একবার হবার মতো খরা বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এখন এরকম খরা দ্বিতীয়টা হাজির হয়েছে। সেই খরার কারণে কৃষিখাতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছিল। করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের উপর এই খরা হাজির হবার অর্থ হলো কয়লা, তেল, গ্যাসের মূল্যের সাথেসাথে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যও আরও বৃদ্ধি পাবে। ইউরোপ শুধু জ্বালানি নিয়ে চিন্তা করেছে; কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে যে, পানি ব্যবস্থাপনাতে অনেকটাই ঘাটতি রয়ে গেছে। আর যেহেতু এখন বোঝা যাচ্ছে যে, এধরণের খরা খুব ঘনঘনই আসার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই ইউরোপকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে।

‘হামবুর্গ পোর্ট কনসালটিং’এর হার্টমুট বেয়ার জার্মানির অভ্যন্তরীণ নৌপথ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি ‘ডয়েচে ভেলে’কে বলেন যে, ২০১৮ সালে রাইন নদীর পানি এরকমই নিচে নেমে গিয়েছিল। তখনকার মতো এবারও বিভিন্ন বিকল্প পদ্ধতিতে রাইনের নৌপরিবহণের কাজ করতে হবে। একটা জাহাজের মালামাল তিনি-চারটা জাহাজে করে বহণ করতে হবে। ইউরোপের বহু শিল্প নদীপথের সুবিধা নেয়ার জন্যে রাইন নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে। কয়লা, খনিজ, তেল, বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল, ইত্যাদি নদীপথেই পরিবাহিত হয়। রাইনে পানি কমে যাবার কারণে শিল্পগুলি এখন তিন থেকে চারগুণ বেশি খরচে কাঁচামাল পরিবহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আর যেহেতু সীমিত সংখ্যক জাহাজ দিয়েই পরিবহণ করতে হচ্ছে, সেকারণে পরিবহণের জন্যে যথেষ্ট সংখ্যক জাহাজও পাওয়া যাচ্ছে না। খরচের হিসেব করলে নদীপথে যদি ১ ইউরো খরচ হয়, রেলপথে খরচ হবে ২ ইউরো, আর সড়কপথে ৪ ইউরো।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের অনেক কোম্পানি রুশ কয়লা বাদ দিয়ে সমুদ্রপথে কয়লা আমদানি করছে; যা কিনা পরবর্তীতে নদীপথে শিল্পাঞ্চল পর্যন্ত যাচ্ছে। রাইন নদী দিয়ে বছরে ৩০ কোটি টন পণ্য পরিবাহিত হয়। জার্মানির ৮০ শতাংশ নৌপরিবহণ রাইন দিয়ে হয়।

‘ডয়েচে ভেলে’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, জার্মানির নদীপথে যখন যথেষ্ট পানি থাকে, তখন বড় আকারের জাহাজগুলি ৫ হাজার টন পর্যন্ত মালামাল বহণ করতে পারে। তুলনামূলকভাবে, রেলপথে একটা রেলগাড়ি গড়ে ৩ হাজার টন পর্যন্ত মাল বহণ করতে পারে; আর একটা ট্রাক বহণ করতে পারে গড়ে মাত্র ২৩ টন। আর এই মুহুর্তে জার্মানিতে নদীপথের বিকল্প হিসেবে রেলপথ এবং সড়কপথের অতিরিক্ত মালামাল বহণের সামর্থও নেই। এছাড়াও করোনা মহামারির পর থেকে ট্রাকের ড্রাইভারের সংকট চলছে; আর সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনিয়ান ট্রাক ড্রাইভাররা অনেকেই যুদ্ধের কারণে দেশে ফেরত চলে গেছে।

হার্টমুট বেয়ার বলছেন যে, ২০১৮ সালের খরার সময়ে অনেকেই মনে করেছিলেন যে, এরকম খরা হয়তো ১০ বছরে একবার আসতে পারে। কিন্তু ৪ বছরের মাথাতেই এরকম খরা আবারও হাজির হয়েছে। সামনের দিনগুলিতে জাহাজ কোম্পানিগুলি হয়তো নদীতে পানির গভীরতার কথা চিন্তা করে অপেক্ষাকৃত কম ‘ড্রাফট’ বা গভীরতার জাহাজ তৈরি করবে। উৎপাদন খরচ কমাবার জন্যে এতকাল শিল্পগুলি কাঁচামাল জমা করে রাখতো না; দরকার হলে সাথেসাথে অর্ডার করতো। এখন খুব সম্ভবতঃ তাদেরকে বেশকিছু কাঁচামাল জমা করে রাখার দিকে যেতে হবে। আর জার্মান সরকারও হয়তো নদীগুলিকে আরও বেশি করে ড্রেজিং করার উদ্যোগ নেবে; যাতে করে খরার মাঝেও নদীতে যথেষ্ট পরিমাণ পানি থাকতে পারে। তবে এই কাজটা করতে যেমন সময় লাগবে, তেমনি বাজেট নিয়ে টানাপোড়েনও থাকবে। এছাড়াও পরিবেশের ব্যাপারটাও চিন্তা করতে হবে।

ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানি এবং ফ্রান্স এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্বালানির মূল্যস্ফীতির সাথে যুক্ত হয়েছে পরিবেশগত বিপর্যয়, যা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির মূল স্তম্ভ অর্থনীতিকে আঘাত করেছে। ‘স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি অব বার্লিন’এর প্রফেসর আলরিক ব্রুকনার ‘আল জাজিরা’কে বলছেন যে, দু’টা ব্যাপারে কেউই এখন নিশ্চিত নয়; এর প্রথমটা হলো আবহাওয়া; আর দ্বিতীয়তা হলো সামাজিক স্থিতি। বর্তমান জার্মান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় জনগণ চেয়েছিল যে, জার্মানি খনিজ জ্বালানির ব্যবহার থেকে বের হয়ে আসবে। কিন্তু জার্মানির নীতি প্রণয়ণে দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। কাজেই সামনের শীতকালে জার্মান সরকারের জ্বালানি ব্যবস্থাপনা সকলেই পরিমাপ করবে। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবার কারণে সরকারের কার্যক্রম কতটা ভালো হলে মানুষের চোখে তা ভালো ঠেকবে, তা বলা কঠিন। কারণ যে কেউ যে কোন সুযোগে সরকারের সমালোচনা করতে পারে, অথবা রাজনৈতিক অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে।

Wednesday 17 August 2022

তালিবানের এক বছর… কেমন আছে আফগানিস্তান?

১৭ই অগাস্ট ২০২২
 
কান্দাহার, অক্টোবর ২০২১। মারাত্মক অপুষ্টিজনিত সমস্যায় আক্রান্ত আফগান শিশু। আফগানিস্তানের মানবিক বিপর্যয় না থামিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াতে দেশটার নারীস্বাধীনতা নিয়ে ব্যাপক রিপোর্টিং আদর্শিক দেউলিয়াত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। অপরদিকে আফগান নারীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানের উপর অবরোধ বজায় রাখা এবং ৭ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ আটকে রাখার মার্কিন সিদ্ধান্ত কতটা মানবিক, অথবা পশ্চিমা আদর্শের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা আলোচনা হতেই পারে। তালিবানরা আফগানিস্তানে কোন আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতি করতে না পারলেও পশ্চিমা আদর্শ যে আফগানিস্তানে তার দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করেছে, তা দুই কোটির বেশি ক্ষুধার্ত আফগানের চেহারায় পরিষ্কার।

এক বছর আগে ২০২১এর অগাস্টে কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের উপর হেলিকপ্টার ওড়া এবং এর পরবর্তীতে কাবুল বিমান বন্দরে মার্কিন সামরিক বিমানের চাকা ধরে মানুষের বিমানে আরোহণের চেষ্টার দৃশ্যগুলি তিন দশক আগে বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার সাথে তুলনা করা চলে। প্রায় দুই দশক তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর সেখান থেকে মার্কিন বাহিনীর পলায়নের ঘটনাটা সাম্প্রতিক সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির একটা ছিল। এক বছর কেমন চলছে তালিবানদের শাসন? কেমন আছে আফগানিস্তানের মানুষ?

সকল প্রতিবেদনেই আফগানিস্তানের চরম অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং মানবিক বিপর্যয়ের কথা আসছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানের হাসপাতালে অসুস্থ্য শিশুদের অসুস্থতার মূল কারণই হলো অপুষ্টি। কারণ এই শিশুদের পরিবারগুলি সকলেই ভীষণ দরিদ্র্য। তথাপি প্রতিবেদনের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল আফগানিস্তানে মহিলাদের অধিকার। দেশটাতে মেয়েদেরকে সেকুলার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার কথা বলা হয়। মহিলাদেরকে রাতের বেলায় রাস্তায় ঘোরার ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বিশেষ করে তালিবানরা নিয়ম করে দিয়েছে যে, মহিলারা কোন পুরুষ সঙ্গী ছাড়া রাস্তায় ঘুরতে পারবে না। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, তালিবানরা কাতারে আলোচনার সময় যেসকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলি তারা রাখেনি; যেমন, মহিলারা প্রেসিডেন্ট ছাড়া যেকোন অফিসে যেকোন কাজ করতে পারবে; মহিলারা ইচ্ছামতো তাদের জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারবে। কিন্তু এখন সেখানকার চাকুরির বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণ ১৬ শতাংশ কমে গেছে। সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং ইরানকে ইসলামিক রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে বলা হয় যে, আফগানরাও সেই দেশগুলির মতো হতে চায়।

মার্কিন মিডিয়া ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এক বছর আগে বিদেশী মিডিয়ার মহিলা সাংবাদিকদের যতটা কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হয়েছে, এখন তা যথেষ্টই শিথিল করা হয়েছে। কাবুলের বেশকিছু মহিলা কাপড় পড়ার উপর তালিবানদের আরোপ করা নিয়ন্ত্রণ মানছে না। আর তালিবানরাও এখন তাদের বিরুদ্ধে ততটা কঠোর হচ্ছে না। মহিলাদেরকে তালিবানরা স্বাস্থ্য, মানবিক কাজ, শিক্ষার মতো কর্মকান্ডে জড়িত থাকতে দিচ্ছে। তবে আগে তারা সরকারি মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও এখন তা পারছেন না।

তবে ‘বিবিসি’র প্রতিবেদনে এটাও বলা হয় যে, যুদ্ধের কারণে দেশটার গ্রামাঞ্চলে যেখানে মানুষ বহুকাল ধরে দৈনন্দিন কোন কর্মকান্ডই সম্পাদন করতে পারেনি, সেখানে এখন স্বস্তি ফিরে এসেছে। যদিও দেশটার অর্থনৈতিক দুর্দশার ব্যাপারে সকলেই একমত, তথাপি দেশটার গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাঝে তালিবানদের যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে। ‘সিএনএন’বলছে যে, এক বছর আগে কাবুলে যেমন অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছিল, সেটা এখন নেই; জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে মানুষের জীবনযাত্রার মান যথেষ্টই নিচে নেমে গেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানের অর্ধেক মানুষই চরম ক্ষুধার মাঝে রয়েছে। আর ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে দেশটার ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকবে বলে সেখানে বলা হয়। এর কারণ হিসেবে রয়েছে দেশটার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ; দেশটার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ যুক্তরাষ্ট্র আটকে দিয়েছে; এছাড়াও রয়েছে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি। কাবুলের বাজারে অনেক পণ্য রয়েছে; কিন্তু বেশিরভাগ মানুষেরই তা কেনার সামর্থ্য নেই।

‘সিএনএন’ বলছে যে, আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলের জনগণ যথেষ্টই খুশি যে মার্কিনীরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে; এবং যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে নারীস্বাধীনতার মতো ইস্যুগুলি ততটা গুরুত্বপূর্ন নয়। তবে প্রতিবেদনে তালিবানদের অধীনে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা বলা হয়। কেউ কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। দুই দশক ধরে মার্কিনীরা যখন আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন জনগণ মার্কিনীদেরকে দখলদারি বাহিনী হিসেবে দেখেছে; কিন্তু সেসময় মহিলারা ইচ্ছামতো তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারতো। নারীস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা কর্মীদেরকে গত এক বছরের মাঝে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। তালিবানরা এখন পশ্চিমা মিডিয়াকে রিপোর্টিং করতে দিচ্ছে, কারণ তারা দেখাতে চাইছে যে, সেখানে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে; জননিরাপত্তা রয়েছে। এছাড়াও তারা বলতে চাইছে যে, সেখানে দারিদ্র্য এখন মারাত্মক একটা ইস্যু; যাতে করে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের রিজার্ভের অর্থ ফেরত দেয়; এবং সেখানে যেন স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছাতে পারে।

মারাত্মক আর্থিক সমস্যা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। গত ১৫ই মার্চ বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানের শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান কমেছে; কিন্তু নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নের কারণে গ্রামাঞ্চলে তা বেড়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় প্রাথমিক স্কুলে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের উপস্থিতিই বেড়েছে। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্যে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বেড়েছে। যাদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন, বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার সহায়তায় তাদের মাঝে প্রায় ৯৪ শতাংশ সেবা পাচ্ছে।

তালিবানরা এক বছরে কতটা সফল হয়েছে সেটা হিসেব করতে হলে মার্কিনীর দুই দশকে কতটা সফল হয়েছে, সেটাও তুলনায় নিয়ে আসতে হবে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, মার্কিন নিয়ন্ত্রণের সময়ে একটা বড় অংশ মানুষ চাকুরি করতো সরকারি সংস্থা এবং নিরাপত্তা সেক্টরে; যখন দেশে জানমালের নিশ্চয়তা ছিল না একেবারেই। এখন সেই চাকুরিগুলি নেই। সেসময় প্রতি বছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশ থেকে আসতো; যা কিনা বাজেটের প্রায় ৭৫ শতাংশ ছিল। এই সাহায্য হঠাত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছে। ভুলে গেলে চলবে না যে, তালিবানরা এমন একটা দেশ পেয়েছে, যা ছিল যুদ্ধের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং বিদেশী সহায়তার উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। মার্কিনীরা আফগানিস্তান ত্যাগের সময় আফগান মহিলাদেরকে তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে এসেছিল। কাজেই আফগানিস্তানের মানবিক বিপর্যয় না থামিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াতে দেশটার নারীস্বাধীনতা নিয়ে ব্যাপক রিপোর্টিং আদর্শিক দেউলিয়াত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। অপরদিকে আফগান নারীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানের উপর অবরোধ বজায় রাখা এবং ৭ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ আটকে রাখার মার্কিন সিদ্ধান্ত কতটা মানবিক, অথবা পশ্চিমা আদর্শের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা আলোচনা হতেই পারে। তালিবানরা আফগানিস্তানে কোন আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতি করতে না পারলেও পশ্চিমা আদর্শ যে আফগানিস্তানে তার দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করেছে, তা দুই কোটির বেশি ক্ষুধার্ত আফগানের চেহারায় পরিষ্কার।

Monday 15 August 2022

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি কি শুধুই সোনার হরিণ?

১৫ই অগাস্ট ২০২২

 
অগাস্ট ২০২২। সিয়েরা লিওনের রাস্তায় বিক্ষোভ। সিয়েরা লিওন ও ইকুয়েডরের বিক্ষোভের খবরগুলি জনগণের অস্থিরতা প্রকাশের একটা মাধ্যমের কথা বলছে, যার ফলশ্রুতিতে সরকারগুলি আইন শৃংখলা বজায় রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। অপরদিকে তা শ্রীলঙ্কাতে সরকারের পতন ডেকে এনেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একদিকে যেমন কেউ সমাধান দিতে পারছে না, অপরদিকে সমস্যার কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস বা ইউক্রেন যুদ্ধের উল্লেখও মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছে না। অর্থনৈতিক মুক্তি এখন সোনার হরিণ ছাড়া আর কিছুই নয়।


গত ১০ই অগাস্ট পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রীটাউনের রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের সাথে নিরাপত্তারক্ষীদের মারাত্মক সংঘর্ষে ৬ জন পুলিশসহ কমপক্ষে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ ছিল ব্যাপক মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি। সংঘর্ষের পর থেকে দেশটায় কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফ্রীটাউনের একজন ব্যবসায়ী ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, সরকারের ভাষ্য হলো, অর্থনৈতিক দৈন্যতার জন্যে করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধই দায়ী। কিন্তু দেশটায় বেকারত্বও তো অত্যধিক। যুবকদের মাঝে অসন্তোষ অনেক বেশি।

সিয়েরা লিওনের এই বিক্ষোভ সেই দেশের বা আফ্রিকার কোন সমস্যাও নয়; একটা বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের অনেক দেশেই অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কার খবরগুলি দুনিয়াব্যাপী প্রচার হয়েছে। জুন মাস থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরে পুলিশের সাথে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বিক্ষোভকারীদের মূল দাবি ছিল জ্বালানির মূল্য কমানো এবং কৃষিজ দ্রব্যের মূল্যের উপর লাগাম টানা। বিক্ষোভের মূল আয়োজক ছিল দেশটার আদিবাসীদের সংগঠন ‘কনফেডারেশন অব ইন্ডিজেনাস ন্যাশনালিটিজ অব ইকুয়েডর’। রাজধানী কুইটোতেও হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকারীরা টায়ার জ্বালিয়ে এবং গাছের গুঁড়ি ও মাটি ফেলে রাজধানী শহরে ঢোকার রাস্তা আটকেছে। ২০২০ সাল থেকে দেশটায় ডিজেলের মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। করোনা মহামারি থেকে বাঁচতে গিয়ে দেশটা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ‘আইএমএফ’এর কাছ থেকে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। তদুপরি দেশটায় অস্থিরতা চরমে উঠেছে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জলবায়ুগত উন্নয়ন বিষয়ক অঙ্গসংগঠন ‘ইকোসক’এর প্রেসিডেন্ট কলিন কেলাপাইল ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর সাথে এক সাক্ষাতে বলেন যে, করোনা মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দুনিয়াব্যাপী জাতিসংঘের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও শিশুদের জন্যে শিক্ষা নিশ্চিতের কর্মকান্ড যতটুকু সফলতা পেয়েছিল, তা এখন উল্টো দিকে ধাবিত হচ্ছে; যা এর আগে কখনও ঘটেনি। পশ্চিমা দেশগুলি এখন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থায়ন করছে; একারণে ২০৩০ সালের মাঝে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণের যে টার্গেট নির্ধারণ করেছিল, তার জন্যে অর্থায়ন পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন যে, দারিদ্রের মতো চ্যালেঞ্জগুলি আরও আগে থেকেই ছিল। তিনি মনে করিয়ে দেন যে, একজন ক্ষুধার্ত মানুষ হলো একজন উত্তেজিত মানুষ। শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন যে, খাদ্য এবং জ্বালানি না পাওয়ার কারণে জনগণের ক্রোধ সামনে চলে আসতে পারে। তবে কেলাপাইল স্বীকার করেন যে, করোনা মহামারির আগে থেকেই বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে অর্থায়ন কমছিল; এবং উন্নয়নশীল দুনিয়াতে প্রযুক্তি, বিশেষ করে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগের অপ্রতুলতা বিদ্যমান ছিল। বিশ্বের দরিদ্র্ দেশগুলি আরও বেশি করে ঋণের বোঝার নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক দারিদ্র্যের কথা বললে ভারতকে বাদ দিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। ২০২১ সালে ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’এর এক গবেষণায় বলা হয় যে, করোনা মহামারির ফলশ্রুতিতে ভারতে দৈনিক ২ ডলারের কম আয়ের মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে! এই সংখ্যাটা পুরো বিশ্বের দারিদ্র্য বৃদ্ধির সংখ্যার ৬০ শতাংশ! সেই গবেষণায় আরও বলা হয় যে, ভারতের মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৩ কোটি ২০ লক্ষ কমে গেছে। এটাও সারা দুনিয়ার ৬০ শতাংশ। ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে ডেনমার্কের ‘রসকিল্ডা ইউনিভার্সিটি’র এসোসিয়েট প্রফেসর সোমদীপ সেন ‘আল জাজিরা’র এক লেখায় মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, স্বাধীনতা দিবসে ভারতের উল্লসিত হবার কিছুই নেই। একদিকে যেমন দেশটার হিন্দুত্ববাদী সরকারের ইসলাম বিদ্বেষী নীতি মানবাধিকার ইস্যুকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তেমনি ভুল নীতি অনুসরণ করার কারণে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। করোনা মহামারির আগেই ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯৭৫-৭৬ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। জুন মাসে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুবকদের মাঝে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ৪৪ শতাংশ। দেশটার মুদ্রা রুপীর মূল্যমানের পতনও আমদানি-নির্ভর সেক্টরগুলি দুর্দশার কারণ হতে যাচ্ছে।

কিন্তু অর্থনৈতিক দুর্দশা শুধুমাত্র দরিদ্র্ দেশগুলিতেই নয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলির জনগণও অর্থনৈতিক দৈন্যতার মাঝে রয়েছে। ব্রিটেনের ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, ব্রিটেনের ট্রেড ইউনিয়ন, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ভাড়াটিয়াদের সংগঠন এবং রাজনীতিবিদেরা একত্রিত হয়ে দেশব্যাপী আন্দোলনে নেমেছে। তাদের অভিযোগ হলো সরকার জনগণের জীবনধারণের খরচ কমাতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তারা ইতোমধ্যেই ৩ লক্ষ স্বাক্ষর যোগাড় করেছে; এবং দেশব্যাপী ৫০টা র‍্যালী করবে তারা। যোগাযোগ শ্রমিকদের সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি ডেইভ ওয়ার্ড বলছেন যে, রাষ্ট্রের সামনে কোন না কোন একটা সমস্যা থাকবেই; আর সবসময়ই শ্রমিকদেরকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হয়। ধনীরা সর্বদাই চেষ্টা করছে যাতে করে শ্রমিকদের কাছ থেকে কম খরচে বেশি কাজ আদায় করে নেয়া যায়। এই ধনীরাই এখন অর্থনৈতিক সমস্যার মাঝ থেকে মুনাফা করে নিতে চাইছে; যখন লাখো মানুষ দারিদ্র্যের মাঝে পতিত হচ্ছে।

 
বৈরুতের ব্যাংকের অভ্যন্তরে বন্দুক হাতে বাসাম আল-শেখ হুসেইন। লেবাননে ব্যাংকারদের জিম্মি করার ঘটনা এবং সেই কাজের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন দেখিয়ে দেয় যে, প্রচলিত আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কতটা কমেছে। দারিদ্রের ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ এবং আইনের শাসনে ধ্বস পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাকে শুধুমাত্র মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মাঝেই ফেলেনি, অনেক ক্ষেত্রেই অকার্জকর করে ফেলেছে; যা মানুষের মাঝে পরিবর্তনের আকাংক্ষাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।

গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্ব মিডিয়াতে লেবাননের অস্থিরতার খবর এসেছে নিয়মিত। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, লেবাননের নিজস্ব মুদ্রা ৯০ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে দেশটার ৮০ শতাংশ মানুষ এখন দারিদ্র্যের মাঝে রয়েছে। এরকমই একটা পরিস্থিতিতে গত ১১ই অগাস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতের একটা ব্যাংকে বাসাম আল-শেখ হুসেইন নামের এক ব্যক্তি অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে নিজের একাউন্ট থেকে অর্থ উঠাবার দাবি করে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, লেবাননের ব্যাংকগুলির উপর সরকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বলে দিয়েছে যে, মানুষ ব্যাংক থেকে কত অর্থ তুলতে পারবে। হুসেইনের ভাই বলেন যে, তার ব্যাংক একাউন্টে ২ লক্ষ ১০ হাজার ডলার রয়েছে। অথচ তার বাবার চিকিৎসার খরচ সে বহণ করতে পারছিল না। কারণ ব্যাংকাররা তাকে অর্থ দিতে গড়িমসি করছিল। তাই হুসেইন এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। শেষ পর্যন্ত হুসেইনকে ৩৫ হাজার ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। লেবাননের জনগণের মাঝে সেই ব্যক্তি হিরো হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, অনেকেই মনে করছে যে, তাদের সংসার চালাতে তাদেরকেও হুসেইনের মতোই কাজ করতে হবে। এখন কোন ঘটনা এটাকে উস্কে দেবে, সেটাই দেখার বিষয়।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একদিকে যেমন কেউ সমাধান দিতে পারছে না, অপরদিকে সমস্যার কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস বা ইউক্রেন যুদ্ধের উল্লেখও মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছে না। অর্থনৈতিক মুক্তি এখন সোনার হরিণ ছাড়া আর কিছুই নয়। মুক্ত বাজার অর্থনীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করলেও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশকেই আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল করেছে। এর ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে যেকোন অস্থিরতাই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক দৈন্যতার জন্ম দিয়েছে। দেশে দেশে বিক্ষোভ এবং সহিংসতা বৃদ্ধির সাথে সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জ্বালানি সমস্যার সম্পর্ক থাকলেও শুধুমাত্র এগুলিই যে অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণ নয়, তা জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিদের কথায় পরিষ্কার। একদিকে ভারতের দারিদ্রের পরিসংখ্যানগুলি যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ঔপনিবেশিক শাসন-পরবর্তী গত সাত দশকের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তেমনি ব্রিটেনের শ্রমিকদের ধনী শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, আয় বৈষম্য নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। সিয়েরা লিওন ও ইকুয়েডরের বিক্ষোভের খবরগুলি জনগণের অস্থিরতা প্রকাশের একটা মাধ্যমের কথা বলছে, যার ফলশ্রুতিতে সরকারগুলি আইন শৃংখলা বজায় রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। অপরদিকে তা শ্রীলঙ্কাতে সরকারের পতন ডেকে এনেছে। তবে লেবাননে ব্যাংকারদের জিম্মি করার ঘটনা এবং সেই কাজের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন দেখিয়ে দেয় যে, প্রচলিত আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কতটা কমেছে। দারিদ্রের ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ এবং আইনের শাসনে ধ্বস পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাকে শুধুমাত্র মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মাঝেই ফেলেনি, অনেক ক্ষেত্রেই অকার্জকর করে ফেলেছে; যা মানুষের মাঝে পরিবর্তনের আকাংক্ষাকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।

Saturday 13 August 2022

ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির সমঝোতা কি দুনিয়ার জন্যে স্বস্তি বয়ে নিয়ে আসবে?

১৩ই অগাস্ট ২০২২
 
ইউক্রেনের বন্দরে অপেক্ষা করছে খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ। যেহেতু কৃষ্ণ সাগরের খাদ্যশস্য রপ্তানির সমঝোতার কারণে খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা এখনই দূরীভূত হয়ে যাচ্ছে না এবং রাশিয়া যেহেতু এই সমঝোতার দীর্ঘমেয়াদী নিশ্চয়তা দেয়নি, তাই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের জন্যে এখনই উল্লসিত হবার মতো কিছু ঘটেনি। অপরদিকে দরিদ্র দেশগুলির জনগণের সামনে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির চাপ ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের মাঝে কৃষ্ণ সাগরের শস্য রপ্তানির সমঝোতা খুব কমই অর্থ বয়ে আনবে।


গত ২২শে জুলাই ইস্তাম্বুলে তুরস্ক এবং জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় ইউক্রেনের আটকে পড়া খাদ্যশস্য বিশ্বের বাজারে রপ্তানি করার জন্যে রাশিয়ার সাথে সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুযায়ী চার মাসের জন্যে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ইউক্রেনের বন্দরগুলিতে অনেকগুলি জাহাজ প্রায় ৫ লক্ষ টন শস্য এবং ভোজ্যতেল নিয়ে অপেক্ষা করছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, প্রথমতঃ এই সমঝোতার ফলে ইউক্রেন শস্য বিক্রি করে অতি দরকারী অর্থ পাবে; দ্বিতীয়তঃ এই শস্য দুনিয়ার সবচাইতে দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলগুলিতে সরবরাহ করা যাবে; তৃতীয়তঃ এটা ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝে প্রথম কূটনৈতিক পদক্ষেপ। অনেকেই এই চুক্তিকে বিশাল একটা বিজয় হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল ‘একে পার্টি’ এবং ওয়াশিংটনে জো বাইডেনের মার্কিন প্রশাসন এই পদক্ষেপকে বৈশ্বিক মানবতার জন্যে একটা বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে চাইছে। তবে অনেকেই এই সমঝোতাকে দ্রুত সফল হিসেবে দেখানোর ব্যাপারে প্রশ্ন তুলছেন।

সমঝোতার ঠিক আগে আগেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ রাশিয়ার উপর অবরোধের ব্যাপ্তিকে পরিবর্তন করেছে। ১৪ই জুলাই মার্কিন বাণিজ্য দপ্তর খাদ্যশস্য, কৃষি যন্ত্রপাতি, ঔষধ ও মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির উপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়। এর পাঁচদিন পর ইইউ কিছু ব্যাংকের উপর থেকে অবরোধ সরিয়ে নেয়, যারা রাশিয়ার সাথে খাদ্যশস্য, সার ও অন্যান্য কৃষিজ দ্রব্যের বাণিজ্যের সাথে জড়িত।

ব্রাসেলস ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ বা ‘আইসিজি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, ২৩শে জুলাই ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এই শস্য রপ্তানির সমঝোতাকে রাশিয়া তার যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখতে চায় না। আর এই সমঝোতায় রাজি হবার পুরষ্কার হিসেবে জাতিসংঘ রাশিয়ার সাথে আলাদাভাবে আরেকটা চুক্তি করেছে, যা মোতাবেক রাশিয়াও তার শস্য এবং রাসায়নিক সার পশ্চিমা অর্থনৈতিক অবরোধ এড়িয়ে বিশ্ব বাজারে বিক্রি করতে পারবে। ক্রেমলিন এই চুক্তিকে রাশিয়ার জন্যে একটা বড় বিজয় হিসেবেই দেখছে।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় ইউক্রেনের পার্লামেন্ট সদস্য ওলেকসি গোঞ্চারেঙ্কো বলছেন যে, এই সমঝোতার পরেও সকলকে রুশ ‘ব্ল্যাকমেইল’ মোকাবিলা করতেই হবে। তার মতে, যদি পশ্চিমারা হুমকি দেয় যে, শস্য রপ্তানি বন্ধ করে দিতে চাইলে পশ্চিমারা কৃষ্ণ সাগরের রুশ নৌবহরকে ধ্বংস করে দেবে, শুধুমাত্র তাহলেই রাশিয়া হয়তো এই সমঝোতাকে বাস্তবায়িত হতে দেবে। তিনি ইউক্রেনের জন্যে পশ্চিমাদের আরও অস্ত্র সরবরাহের মাঝেই শস্য রপ্তানির সমুদ্রপথ খোলা রাখার সমাধান দেখছেন। ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পীস’এর এক লেখায় রুশ বিশ্লেষক আলেক্সান্দ্রা প্রোকোপেঙ্কো বলছেন যে, এই সমঝোতা রাশিয়ার জন্যে অনেক সুবিধা বয়ে আনলেও রাশিয়া বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, একটা বিষয়ে ছাড় দেয়ার অর্থ এই নয় যে, তারা পুরো ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থানকে নরম করেছে। মস্কো যেকোন সময়েই এই সমঝোতা থেকে বের হয়ে যেতে পারে। তবে অবরোধকে বাইপাস করার মাধ্যমে রাশিয়া তার নিজস্ব কৃষিখাতের জন্যে যন্ত্রপাতি আমদানির চেষ্টা করতে পারে। ২০২১ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার ৭৫ শতাংশ কৃষি যন্ত্রপাতি জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস থেকে আসতো।

গবেষণা সংস্থা ‘গ্রো ইন্টেলিজেন্স’এর জ্যেষ্ঠ গবেষক জনাথন হাইন্স ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’কে বলছেন যে, প্রথম জাহাজে করে লেবাননে যে ২৬ হাজার টন ভুট্টা রপ্তানি করা হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে ২ কোটি টন শস্যের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ। তুচ্ছ পরিমাণ সরবরাহের অর্থ হলো এর ফলশ্রুতিতে বিশ্বের বাজারে খাদ্যশস্যের মূল্য কমে যাচ্ছে না; অথবা বৈশ্বিক খাদ্য সমস্যার সমাধানও দ্রুতই হয়ে যাচ্ছে না। আর ইউক্রেনে আটকে পড়া বেশিরভাগ শস্যই হলো জীবজন্তুর খাবার; মানুষের খাবার নয়। এই পরিস্থিতি আফগানিস্তান এবং সোমালিয়ার মতো অঞ্চলের মানুষের ক্ষুধাকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেবে। ঐসব দেশে মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্য এবং জ্বালানি মানুষের সামর্থের বাইরে চলে গেছে। লেবাননের ‘বেকা ফারমার্স এসোসিয়েশন’এর প্রধান ইব্রাহিম তারচিচি বলছেন যে, ইউক্রেনের শস্য হয়তো এখানকার বাজারে শস্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করবে। কিন্তু ২০১৯ সালের পর থেকে লেবাননের অর্থনীতি কমপক্ষে ৫৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে! দেশের নিজস্ব মুদ্রার মান এতটাই কমে গেছে যে, এখানকার তিন চতুর্থাংশ মানুষই এখন দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করছে। আর এর মূলে রয়েছে দেশটার রাজনৈতিক কোন্দল এবং মারাত্মক দুর্নীতি। এমতাবস্থায় ইউক্রেনের শস্য আমদানি এখানকার অর্থনীতিতে তেমন কোন প্রভাব ফেলবে না। তারচিচি মনে করছেন যে, ব্যবসার খরচ যতদিন বৃদ্ধি পাবে, আর মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমতে থাকবে, ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবে না। মানবাধিকার সংস্থা ‘মার্সি কোর’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আটার মূল্য ২’শ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে! বিশ্বব্যাংকের ১’শ ৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণের উপর ভর করে দেশটা ৬ থেকে ৯ মাসের জন্যে শস্য কিনছে। ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি কোন চ্যারিটি নয়। কাজেই মানবিক চাহিদা নয়, বরং যেখানে ভালো মূল্য পাওয়া যাবে, সেখানেই এই শস্য বিক্রি হবে। একারণেই প্রথমে শস্য পাওয়াটা নির্ভর করবে মানবিকতার উপর নয়, বরং ব্যবসায়িক স্বার্থের উপর।

ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়েই শস্য রপ্তানির সমঝোতা থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ এড়াবার সুবিধা নিতে চাইছে; কেউই এখানে চ্যারিটি করছে না। অপরদিকে ‘আইসিজি’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, তুরস্কের ক্ষমতাসীন ‘একে পার্টি’ আশা করছে যে, ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির সমঝোতা তাদের জন্যে ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে। তবে অন্যরা মনে করছে যে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান পররাষ্ট্রনীতির সফলতা দেখিয়ে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে মানুষের দৃষ্টি সড়াতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ তাদের নিজ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে রাশিয়াকে ছাড় দিয়েছে। কিন্তু যেহেতু এই সমঝোতার কারণে খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা এখনই দূরীভূত হয়ে যাচ্ছে না এবং রাশিয়া যেহেতু এই সমঝোতার দীর্ঘমেয়াদী নিশ্চয়তা দেয়নি, তাই যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের জন্যে এখনই উল্লসিত হবার মতো কিছু ঘটেনি। অপরদিকে দরিদ্র দেশগুলির জনগণের সামনে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির চাপ ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের মাঝে কৃষ্ণ সাগরের শস্য রপ্তানির সমঝোতা খুব কমই অর্থ বয়ে আনবে।

Friday 5 August 2022

ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর… মার্কিন অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলাফল

০৫ই অগাস্ট ২০২২
 
অগাস্ট ২০২২। চীন থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হচ্ছে তাইওয়ানকে উদ্দেশ্য করে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্পীকার ন্যান্সি পেলোসিকে তাইওয়ান যেতে মানা করার এখতিয়ার না থাকলেও সামরিক বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি পেলোসির তাইওয়ান সফরে বাধা সৃষ্টি করতে পারতেন; যা তিনি করেননি। তিনি পেলোসির সাথে দ্বন্দ্ব চাননি; বরং চীনের সাথে দ্বন্দ্বকেই তিনি বেছে নিয়েছেন।

অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন কংগ্রেসের স্পীকার এবং ডেমোক্র্যাট দলের প্রবীণ নেতা ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের উত্তেজনা চরমে উঠেছে। চীনা সামরিক বাহিনী তাইওয়ানকে ঘিরে বিশাল আকারের সামরিক মহড়া শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই চীন কয়েক দশকে প্রথমবারের মতো তাইওয়ানের উপর দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাই যেকোন যুদ্ধ না হবার ব্যাপারে মত দিলেও উত্তেজনা সংক্রমিত হবার ব্যাপারটাকে সকলেই ভীতির চোখে দেখছেন।

জাপান সফরের সময় তিনি তার তাইওয়ান সফরের পক্ষে এই বলে যুক্তি দেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে একঘরে করে ফেলার চীনা পরিকল্পনার বিরোধী। তার তাইওয়ান সফরের মাধ্যমে তিনি প্রমান দিতে চাইছেন যে, চীন মার্কিনীদেরকে তাইওয়ান সফরে বাধা দিতে পারবে না। তবে তিনি অত্র অঞ্চলের স্থিতি পরিবর্তনের পক্ষে নন। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, চীন এখন যেধরনের সামরিক উত্তেজনা তৈরি করেছে, সেটা যদি তারা পরবর্তী সময়েও করতে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, অত্র অঞ্চলের স্থিতাবস্থায় পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে তাইওয়ানের আকাশসীমায় আন্তর্জাতিক জাহাজ এবং বিমানের চলাচল বন্ধ করে অবরোধের মহড়া সত্যিকার অর্থেই একটা বড় পরিবর্তন। আর এই মহড়া চলছে পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবাণিজ্য রুটের উপর; যেখান থেকে দুনিয়ার বেশিরভাগ সেমিকন্ডাকটরের সরবরাহ আসে। ব্যবসার সাথে জড়িত যেকেউই চাইবে যাতে এধরনের উত্তেজনা বেশিদিন স্থায়ী না হয়।

পেলোসির তাইওয়ান সফর ছিল ২৫ বছরের মাঝে সেখানে সর্বোচ্চ মার্কিন রাজনৈতিক সফর। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘এশিয়া সোসাইটি’র প্রধান কেভিন রাড ‘এবিসি নিউজ’কে বলছেন যে, পেলোসির সফরের ফলে তাইওয়ানের নিরপত্তা বৃদ্ধি পেলো কিনা, সেব্যাপারে তিনি একেবারেই নিশ্চিত নন। বিশেষ করে এই সফরের পর চীন সামরিক ও অর্থনৈতিক যেসব পদক্ষেপ নেবে, তা তাইওয়ানের জন্যে ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এছাড়াও পেলোসির সফরের কারণে অত্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয়েছে। তিনি হয়তো তাইওয়ানের সাথে একাত্মতা এবং মানবাধিকার বিষয়ে তার বক্তব্যগুলিকে তুলে ধরতে সেখানে যেতে পারেন; যেগুলি তার ব্যক্তিগত আদর্শিক রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তার তাইওয়ান সফর ছিল অবিবেচকের কাজ। আজকের এই উত্তেজনাগুলি একসময় যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের সাথে সামরিক সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। আর ঠিক একারণেই চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে কৌশলগত প্রতিযোগিতাকে নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরি।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রধান ইয়ান ব্রেমার ‘জি-জিরো মিডিয়া’র এক বিশ্লেষণে বলছেন যে, এই মুহুর্তে কেউই হয়তো তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে কথা হোক সেটা চাননি। নিঃসন্দেহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও চাননি। অন্ততঃ এখন তো নয়ই; বিশেষ করে এই বছরেই যখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে শি জিনপিং তৃতীয়বারের মতো দায়িত্ব পাবার চেষ্টা করছেন। ন্যান্সি পেলোসি প্রথমে তার এশিয়া সফরসূচিতে তাইওয়ানের নামটা লিখিত আকারে দেয়া থেকেও বিরত ছিলেন। সফরের দুই সপ্তাহ আগে হোয়াইট হাউজ জানতে পারে যে, পেলোসি তাইওয়ান সফর করতে চাইছেন। এই খবরটা তখনও মিডিয়াতে আসেনি। তবে হোয়াইট হাউজ থেকে পেলোসির কাছে চিঠি দিয়ে তাইওয়ান সফরের ব্যাপারে মানা করার ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যায়। বাইডেন হয়তো সমস্যায় পড়েছেন যে, পেলোসিকে যেতে দেয়ার অর্থ হলো দলের উপর বাইডেনের প্রভাব নেই; অপরদিকে পেলোসিকে যেতে মানা করার অর্থ হলো বাইডেন তাইওয়ান নীতিতে দুর্বল। এছাড়াও চীনের দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, পেলোসির সফরের ব্যাপারে চীনকে একটা শক্ত প্রত্যুত্তর দিতেই হবে; নাহলে চীনা নেতৃত্ব তাদের জনগণের সামনে হেয় হবে। একারণেই চীন বারংবার এই সফরের বিরোধিতা করেছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র বারংবার চীনকে হুমকি দিয়েছে যাতে চীন মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে না যায়। উদাহরণস্বরূপ, দু’মাস আগেই যুক্তরাষ্ট্র চীনকে হুমকি দিয়েছে যাতে চীন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ না করে এবং রাশিয়ার উপর অবরোধ না ভাঙ্গে। চীন এই হুমকিতে অত্যন্ত অখুশি হলেও তারা মোটামুটিভাবে মার্কিনীদের কথা শুনেছে। তবে তাইওয়ানের ইস্যু চীনের কাছে পুরোপুরিভাবে আলাদা।

 
অগাস্ট ২০২২। মার্কিন কংগ্রেসের স্পীকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ানে। ৮২ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদের অভিজ্ঞতা নিতান্তই কম নয়। কিন্তু রশ্ন হলো, স্পীকার নিজে কি তার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করেননি? উচ্চ পদে আসীন হয়ে তার বোঝা উচিৎ ছিল যে, তাইওয়ান সফর করাটা তাইওয়ানের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার জন্যে ভালো হবে কিনা; অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাইওয়ানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালো হবে কিনা। পেলোসি এই ব্যাপারগুলি চিন্তা করেননি।

ন্যান্সি পেলোসির জন্ম ১৬ই মার্চ ১৯৪০। ৮২ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদের অভিজ্ঞতা নিতান্তই কম নয়। জন্মের পর থেকেই তিনি রাজনীতি দেখছেন। তার বাবা থমাস দালেস্রান্দো জুনিয়র ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের একজন কংগ্রেসম্যান। ১৯৭৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির সদস্য নির্বাচিত হবার মাধ্যমে পেলোসির নির্বাচিত হওয়া শুরু। ১৯৮৭ সালে ৪৭ বছর বয়সে তিনি নির্বাচিত হয়ে কংগ্রেসে পদার্পণ করেন। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো এবং ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো তিনি কংগ্রেসের স্পীকার নির্বাচিত হন।

মার্কিন রাজনীতিতে এক ব্যক্তি কি ইচ্ছে করলেই অন্য দেশের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে পারেন? এখানে প্রেসিডেন্টের কি কিছুই করার ছিল না; নাকি তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার অবস্থান ধরে রাখতে গিয়ে বৈশ্বিক অস্থিরতার মাঝে আরেকটা অস্থিরতাকে মেনে নিয়েছেন? কেভিন রাড বলছেন যে, মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুযায়ী কংগ্রেসের স্পীকার যেকোন স্থানে যেতে পারেন। এখানে হোয়াইট হাউজের বাধা দেয়ার তেমন কিছুই নেই। বরং এখানে প্রশ্ন হলো, স্পীকার নিজে কি তার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করেননি? উচ্চ পদে আসীন হয়ে তার বোঝা উচিৎ ছিল যে, তাইওয়ান সফর করাটা তাইওয়ানের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার জন্যে ভালো হবে কিনা; অথবা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাইওয়ানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালো হবে কিনা। পেলোসি এই ব্যাপারগুলি চিন্তা করেননি। ব্রেমার বলছেন যে, বাইডেনের পেলোসিকে তাইওয়ান যেতে মানা করার এখতিয়ার না থাকলেও সামরিক বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তিনি পেলোসির তাইওয়ান সফরে বাধা সৃষ্টি করতে পারতেন; যা তিনি করেননি। তিনি পেলোসির সাথে দ্বন্দ্ব চাননি; বরং চীনের সাথে দ্বন্দ্বকেই তিনি বেছে নিয়েছেন। অপরদিকে চীন খুব সম্ভবতঃ তাদের পার্টি কংগ্রেসে তাইওয়ানে কে যেতে পারবে এবং কি করতে পারবে, সেব্যাপারে তাদের নীতির পরিবর্তন করবে; যা আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধিতে অনেক বেশি প্রভাব রাখবে। ফলাফলস্বরূপ, সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের ক্ষেত্রগুলিকে তা আরও অনেক বেশি বাড়িয়ে দেবে। অন্ততঃপক্ষে রাশিয়ার সাথে ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝে কেউই এমনটা চায়নি।

Tuesday 2 August 2022

কঙ্গো… পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার আরও একটা ব্যর্থতা

০২রা অগাস্ট ২০২২
 
জুলাই ২০২২। কঙ্গোলিজরা হামলা করছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ঘাঁটিতে। বিক্ষোভকারীরা বলছে যে, জাতিসংঘ 'এম২৩' বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। শান্তিরক্ষীদের কাজ সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা হলেও সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত জীবন হারাচ্ছে। আফ্রিকাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে রুয়ান্ডাকে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করছে প্রায় তিন দশক ধরে। এমতাবস্থায় জাতিসংঘের পক্ষে রুয়ান্ডা সমর্থিত ‘এম২৩’ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

জুলাইএর শেষে মধ্য আফ্রিকার দেশ ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের উপর শতশত মানুষ হামলা করে। হামলাকারীরা নর্থ কিভু এবং সাউথ কিভু প্রদেশের কয়েকটা শহরে শান্তিরক্ষীদের ঘাঁটিতে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। সহিংসতায় তিনজন শান্তিরক্ষী সেনাসহ কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। জুলাই মাসের শুরু থেকেই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে সুসংগঠিতভাবে গণআন্দোলন শুরু হয়। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ হলো, ২২ বছর ধরে শান্তিরক্ষী বাহিনী কঙ্গোর মাটিতে থাকার পরেও কেন কঙ্গোলিজরা শান্তিতে নেই; কেন তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই? শান্তিরক্ষীদের মূল কাজটাই ছিল যেখানে সাধারণ মানুষকে ‘এম২৩’সহ বিভিন্ন অস্ত্রধারী গ্রুপগুলির হাত থেকে রক্ষা করা, সেখানে এই অভিযোগ জাতিসংঘের কার্যক্ষমতাকে যথেষ্টই প্রশ্নবিদ্ধ করে। কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে এই মুহুর্তে ১’শরও বেশি অস্ত্রধারী গ্রুপ রয়েছে। জাতিসংঘের মিশন থাকা সত্ত্বেও এই গ্রুপগুলি নিজেদের অবস্থানকে দিনদিন শক্তিশালী করছে। বিক্ষোভকারীরা বলছে যে, জাতিসংঘ যখন বলছে যে, তাদের কাছে ‘এম২৩’ বিদ্রোহীদের দমন করার মতো শক্তি নেই, তখন শান্তিরক্ষী চলে যাক। আর তারা না যাবার আগ পর্যন্ত বিক্ষোভ চলবে বলে বলেন অনেকে।

জাতিসংঘের ব্যর্থতা কি সামরিক না রাজনৈতিক?

বর্তমান সমস্যার মূল হিসেবে অনেকেই কঙ্গোর ‘এম২৩’ বিদ্রোহী গ্রুপের পুনরুত্থানকে দায়ী করেছেন। ‘এম২৩’ গত নভেম্বর মাস থেকে নতুন করে আগ্রাসী অভিযানে বের হয়েছে। ২০১৩ সালের পর থেকে এই গ্রুপ বেশ চুপচাপই ছিল। ‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে মানবাধিকার সংস্থা ‘এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’এর গবেষক জঁ-মোবের সেঙ্গা বলছেন যে, জাতিসংঘ কঙ্গোর ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করার জন্যে কাজ করেছে এবং সেখানে গণতান্ত্রিক নির্বাচন করার পিছনেও প্রচেষ্টা ছিল তাদের। এছাড়াও ২০১৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদের ম্যান্ডেট নিয়ে জাতিসংঘ ‘ফোর্স ইন্টারভেনশন ব্রিগেড’ তৈরি করে; যাদের কাজ ছিল আক্রমণে গিয়ে কঙ্গোর বিদ্রোহী গ্রুপগুলিকে অস্ত্র ছাড়তে বাধ্য করা। এই ব্রিগেড ২০১৩ সালে ‘এম২৩’ বিদ্রোহী গ্রুপকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে তাদের সাফল্যের সাথে ব্যার্থতার সংখ্যা মোটেই কম নয়। যেকারণে এর আগেও জাতিসংঘের বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষোভ করেছে। জাতিসংঘ সমস্যার মূল নিয়ে তারা কাজ করেনি। যেমন সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে তারা কাজ করেনি; শুধুমাত্র সামরিক দিকটাই তারা দেখেছে। ১৯৯৪ সালের গণহত্যায় জড়িতরা প্রায় তিন দশক ধরে নিঃসঙ্কোচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মাঝে রুয়ান্ডা, উগান্ডা এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকেরাও রয়েছে। এই ভয়াবহ অপরাধগুলির প্রায় কোন ধরণের জবাবদিহিতাই ছিল না; আর সেকারণেই তারা এই একই কাজ বারংবার করেছে। ২০১৩ সালে ‘এম২৩’ জাতিসংঘের ব্রিগেডের কাছে সামরিকভাবে পরাজিত হলেও তাদের কর্মকান্ডের জন্যে তাদের কোন জবাবদিহিতা করতে হয়নি। যেকারণে তারা আবারও ফিরে এসেছে।

কঙ্গোতে বর্তমানে জাতিসংঘের প্রায় ১৬ হাজার সেনা রয়েছে। এদের বেশিরভাগই এসেছে পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে। ‘মনুস্কো’ নামে পরিচিত এই মিশনের বাৎসরিক বাজেট ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। গত বছর এই মিশনের স্থায়িত্ব আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। কঙ্গোর এই পরিস্থিতি বুঝতে হলে কয়েকটা বিষয় নিয়ে আলোচনা আবশ্যিক। জাতিসংঘের ব্যর্থতার সাথে যুক্ত রয়েছে এই অঞ্চলের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া। আর রাজনৈতিক সমাধানের সাথে যুক্ত রয়েছে আশেপাশের দেশগুলি, বিশেষ করে রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি এবং উগান্ডার রাজনীতি। এই রাজনীতির এক অংশে রয়েছে জাতিগত বিদ্বেষ; আর অপর অংশে রয়েছে বৃহৎ শক্তিদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের স্বার্থের দ্বন্দ্ব।

 
মধ্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গো খনিজ সম্পদের দিক থেকে অত্যন্ত ধনী একটা দেশ। কিন্তু দেশের মানুষ এই খনিজ সম্পদের সুবিধা কখনোই পায়নি। বরং পশ্চিমা শক্তিদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বলি হয়েছে এখানকার জনগণ। ঔপনিবেশিক শক্তিরা এই অঞ্চল ত্যাগ করলেও এখানকার জনগণ এখনও উপনিবেশ হিসেবেই জীবনযাপন করছে।

একসময় এই অঞ্চল বেলজিয়ামের উপনিবেশ হলেও ফ্রান্সের সাথে বেলজিয়ামের সম্পর্কের কারণে এখানে ফ্রান্সের প্রভাব রয়েছে বরাবরই। ঔপনিবেশিক শক্তিরা এখানে জাতিগত বিভেদকে কাজে লাগিয়েছে প্রায় শতবর্ষ ধরে। রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি এবং কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে রয়েছে হুটু এবং টুটসি জাতির বসবাস। এর মাঝে টুটসির সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষের মতো; হুটুর সংখ্যা এর প্রায় ছয় গুণ। তবে সংখ্যালঘু হলেও টুটসিরা রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী; যার একটা প্রধান কারণ হলো ঔপনিবেশিক শক্তিরা টুটসিদেরকে শিক্ষিত করেছে এবং তাদেরকে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দিয়েছে। ১৯৬০এর দশকে এই দেশগুলির স্বাধীনতা ঘোষণার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ হুটুরা ক্ষমতা নিয়ে নেয় এবং টুটসিদের উপর অত্যাচার শুরু করে। রুয়ান্ডা থেকে অনেক টুটসি পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে পালিয়ে যায়। এসময়েই শুরু হয় এই অঞ্চলের পরবর্তী ইতিহাস; যা গণহত্যার সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে।

কঙ্গোর ইতিহাসকে একদিকে যেমন হুটু ও টুটসিদের বিদ্বেষের কাহিনী থেকে আলাদা করা যাবে না; তেমনি একজন বিশেষ ব্যাক্তির সামরিক ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার থেকে আলাদা করা যাবে না। এই ব্যক্তি হলেন রুয়ান্ডার বর্তমান প্রেসিডেন্ট পল কাগামি।

রুয়ান্ডার গণহত্যা - পল কাগামির ক্ষমতায় আরোহণের পথ

রুয়ান্ডার টুটসি রাজ পরিবারে জন্ম নেয়া পল কাগামি ১৯৭০এর দশকে এক মিলিশিয়া গ্রুপের অংশ হিসেবে তাঞ্জানিয়ার সহায়তায় পার্শ্ববর্তী দেশ উগান্ডার সরকারকে উৎখাতে অংশ নেন। কাগামি ছিলেন রুয়ান্ডা থেকে উৎখাত হওয়া সংখ্যালঘু টুটসি জনগোষ্ঠীর একজন। তিনি উগান্ডাতেই তার পড়াশোনা শেষ করেছেন; যা একসময় ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। টুটসি যোদ্ধাদের সহায়তায় ইয়োওয়েরি মুসেভেনি উগান্ডার ক্ষমতায় আসেন। সেসময় থেকেই মুসেভেনির সাথে কাগামির সখ্যতা। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসেভেনির প্রত্যক্ষ সহায়তায় টুটসি যোদ্ধারা রুয়ান্ডার অভ্যন্তরে হামলা করে। প্রথমে কাগামি এই বাহিনীর সদস্য ছিলেন না; কারণ সেসময় কাগামি যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসের ফোর্ট লিভেনওয়ার্থএ কমান্ড এন্ড জেনারেল স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। রুয়ান্ডার এই গৃহযুদ্ধে টুটসি ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিওটিক ফ্রন্ট’ বা ‘আরপিএফ’এর বিরুদ্ধে রুয়ান্ডার হুটু সরকারকে সামরিক সহায়তা দিয়েছিল পার্শ্ববর্তী দেশ কঙ্গো এবং সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স। কাগামি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেই ‘আরপিএফ’এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় ‘আরুশা একর্ডস’এর মাধ্যমে রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। চুক্তি অনুযায়ী ‘আরপিএফ’কে রুয়ান্ডার রাজনীতিতে যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থান দেয়া হয়। সামরিক বাহিনীর অফিসারদের কমপক্ষে অর্ধেক আসতে হবে ‘আরপিএফ’ থেকে। আর পুরো সামরিক বাহিনীর ৪০ শতাংশ সদস্য আসতে হবে ‘আরপিএফ’ থেকে। ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে ‘আরুশা একর্ডস’কে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় আড়াই হাজার সেনার মাঝে সবচাইতে বড় গ্রুপ ছিল দেশটার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি বেলজিয়ামের।

পরের বছর ১৯৯৪এর ৬ই এপ্রিল রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালি বিমানবন্দরে অবতরণের ঠিক আগে একটা ভিআইপি বিমানকে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত করা হয়। বিমানের আরোহীদের মাঝে ছিলেন বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সিপ্রিয়েন নিতায়ামিরা এবং রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা; উভয়েই ছিলেন হুটু। মার্কিন এবং ব্রিটিশ তদন্ত রিপোর্ট বলে যে, হুটুদের মাঝে উগ্রপন্থীরাই তাদের নিজেদের হুটু প্রেসিডেন্টদ্বয়কে হত্যা করে; যাতে করে টুটসিদের উপর গণহত্যা চালানো যায়। অপরদিকে ফরাসি এবং বেলজিয়ান রিপোর্ট বলে যে, টুটসি ‘আরপিএফ’ যোদ্ধারাই ঐ বিমান ভূপাতিত করেছিল। তবে এই ঘটনার পরপরই রুয়ান্ডার হুটু সামরিক অফিসার থিওনেস্তে বোগোসোরার অধীনে সেনারা তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করে এবং টুটসিদের উপর হামলা শুরু করে। শুরু হয় ভয়াবহ গণহত্যা।

 
রুয়ান্ডার গণহত্যায় নিহত মানুষের মাথার খুলি। ১৯৯৪ সালের গণহত্যাটা কাগামিকে তার ক্ষমতার ভিত শক্ত করতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। তবে এর ফলশ্রুতিতে ফ্রান্সের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তার ফলাফল ভোগ করতে বাধ্য হয় পার্শ্ববর্তী দেশ কঙ্গো। কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে রুয়ান্ডা এবং উগান্ডা ভয়াবহ ভূমিকা নেয়; যার ফলশ্রুতিতে কঙ্গোতে ৩০ থেকে ৭৬ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তথাপি এই দ্বন্দ্ব এখনও শেষ হয়নি; যার ফলাফল দেখা যাচ্ছে কঙ্গোতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মাঝে।


১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুলাইএর মাঝে মাত্র ১’শ দিনে মধ্য আফ্রিকার ছোট্ট দেশ রুয়ান্ডাতে ৮ লক্ষের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়; যা কিনা স্বল্প সময়ে হত্যাযজ্ঞের সকল রেকর্ডকে ভেঙ্গে ফেলে। নিহতদের বেশিরভাগই ছিল টুটসি। ছুরি-চাপাতি বা লাঠি-বাঁশ ব্যাবহার করে বা ঘরের ভেতরে পাকরাও করে ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হুটু জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু টুটসিদের হত্যা করে।

চার মাস পর ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে গণহত্যা মোটামুটি বন্ধ হলে ‘আরুশা একর্ডস’ অনুযায়ী রুয়ান্ডার নতুন সরকার গঠিত হয়। নিহত প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানার রাজনৈতিক দল ‘এমআরএনডি’কে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। আর এই শূণ্যস্থান পুরণ করে কাগামির দল ‘আরপিএফ’। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, টুটসিরা মারাত্মক গণহত্যার শিকার হলেও টুটসিদের দল ‘আরপিএফ’এর ক্ষমতা কিন্তু বৃদ্ধি পায়। কাগামি হন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী। আর প্রেসিডেন্ট হন প্যাস্তুর বিজিমুনগু, যিনি একজন হুটু হয়েও ‘আরপিএফ’এর সদস্য ছিলেন। সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব, পররাষ্ট্রনীতি এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকায় কাগামি প্রকৃতপক্ষে রুয়ান্ডার ক্ষমতায় চলে আসেন। ১৯৯৪ সালের বাকি বছরগুলিতে পশ্চিমা দেশগুলি থেকে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সহায়তা প্রদান করা হয়।

রুয়ান্ডার সরকারে ‘আরপিএফ’এর সদস্যদের সাথে হুটুদের দ্বন্দ্বের জের ধরে দেশব্যাপী ক্ষমতা দখলের হিরিক পড়ে যায়। এমনকি দেশের বাইরেও তা সংক্রমিত হয়। কাগামির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সেথ সেন্দাসোঙ্গা ১৯৯৮ সালের মে মাসে কেনিয়াতে এক হামলায় নিহত হন। ২০০০ সালে হুটু প্রেসিডেন্টের সাথে দ্বন্দ্বের পর কাগামি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন। রুয়ান্ডার সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট হতে হলে শুধুমাত্র মন্ত্রীসভা এবং পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেলেই যথেষ্ট; গণভোটের প্রয়োজন নেই। কাগামি খুব সহজেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে কাগামি রুয়ান্ডার নতুন সংবিধান রচনা করেন; যা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন প্রতি ৭ বছরের জন্যে; দেশের রাজনীতিতে হুটু বা টুটসি কেউই নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে থাকতে পারবে না; জাতিগত পরিচয়ের কোন রাজনৈতিক দল রাজনীতি করতে পারবে না। ২০০৯ সালে মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এই সংবিধানে গণহত্যা বন্ধ করার কথা বলে প্রকৃতপক্ষে একটা একদলীয় শাসনের প্রবর্তন করা হয়। প্রতিবেদনের কথাগুলি প্রকৃতই সত্য; কারণ ২০২২ সালেও কাগামি ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।

কঙ্গো এবং পল কাগামি

পল কাগামি ক্ষমতা নিয়েই পার্শ্ববর্তী দেশ জায়ারএর (বর্তমান নাম ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো বা ডিআর কঙ্গো) পূর্বে বাস করা টুটসি গ্রুপগুলিকে সামরিক সহায়তা দিতে থাকেন এবং কঙ্গোর অভ্যন্তরে হুটু শরণার্থী শিবিরগুলির উপর হামলা করেন। কারণ এই হুটুরা কাগামির ক্ষমতা ধরে রাখার পিছনে হুমকি হিসেবে কাজ করছিল। বিশেষ করে রুয়ান্ডার প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের সমর্থকরা কঙ্গো থেকে রুয়ান্ডার অভ্যন্তরে হামলা করছিলো। এরপর কাগামি কঙ্গোর ফরাসি সমর্থিত একনায়ক মোবুটু সেসে সেকোকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। লরেন্ট কাবিলার নেতৃত্বে কঙ্গোর বিদ্রোহী গ্রুপকে কাগামি এবং উগান্ডার মুসেভেনি সমর্থন দেন। তবে কাবিলা কঙ্গোর ক্ষমতা নেবার পরপরই কাগামির সাথে শত্রুতা শুরু হয়। কাগামি অভিযোগ করেন যে, কঙ্গো থেকে বিদ্রোহীরা রুয়ান্ডার ভেতর হামলা করছে। জবাবে কাগামি কঙ্গোর অভ্যন্তরে ‘র‍্যালি ফর কঙ্গোলিজ ডেমোক্র্যাসি’ বা ‘আরসিডি’ গ্রুপকে সমর্থন দিতে শুরু করেন। শুধুমাত্র এঙ্গোলা, নামিবিয়া এবং জিম্বাবুয়ের সরাসরি সমর্থনের কারণে লরেন্ট কাবিলা ক্ষমতাচ্যুত হওয়া থেকে বেঁচে যান। তবে এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় এবং ২০০৩ সাল পর্যন্ত রেডক্রসের হিসেবে ৩০ থেকে ৭৬ লক্ষ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধের কারণে মৃত্যুবরণ করে। ২০০১ সালের জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী কাগামি এবং উগান্ডার মুসেভেনি কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলের নর্থ কিভু ও সাউথ কিভু অঞ্চলের খনিজ সম্পদের মালিক হবার চেষ্টা করেছেন। কঙ্গোর প্রচুর মূল্যবান খনিজ রুয়ান্ডা হয়ে বাইরের দুনিয়াতে বিক্রি হয়েছে।

২০০১ সালে রুয়ান্ডা ঘোষণা দেয় যে, কঙ্গো থেকে রুয়ান্ডার সকল সেনা সরে এসেছে। এর বিনিময়ে কাগামির সমর্থিত ‘আরসিডি’ লরেন্ট কাবিলার ছেলে জোসেফ কাবিলার সাথে কঙ্গোর ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেয়। তদুপরি কাগামি অভিযোগ করতে থাকেন যে, হুটু বিদ্রোহীরা এখনও কঙ্গোর ভূমি ব্যবহার করে রুয়ান্ডায় হামলা করছে। অপরদিকে কঙ্গোর সরকার বলে যে, হুটুদের কথা বলে কাগামি পুরো অঞ্চলে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর এক বিশ্লেষণে বলা হয় যে, ২০০৫ থেকে ২০০৯ সালের মাঝে লরেন্ট নেকুন্দার নেতৃত্বে কঙ্গোর টুটসিদের গ্রুপকে কাগামি সমর্থন দিয়েছেন; আর ২০১২ সাল থেকে বসকো নেতাগান্দার অধীনে ‘মার্চ ২৩ মুভমেন্ট’ বা ‘এম২৩’কে সমর্থন দিয়েছেন তিনি। ২০১০ সালে জাতিসংঘের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, কঙ্গোর অভ্যন্তরে রুয়ান্ডার সেনাবাহিনী মারাত্মক মানবাধিকার লংঘনের কাজে জড়িত ছিল। আর ২০১২ সালে জাতিগংঘের ফাঁস হওয়া এক গোপন রিপোর্টে বলা হয় যে, রুয়ান্ডার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস কাবারেবে প্রকৃতপক্ষে ‘এম২৩’এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন!

২০১৯ সালে ফেলিক্স শিসেকেদি কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও রুয়ান্ডার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। ২০২০ সালেও কাগামির বিরুদ্ধে কঙ্গোর অভ্যন্তরে রুয়ান্ডার সেনা মোতায়েন রাখার অভিযোগ রয়েছে। আর ২০২১ সালের নভেম্বরে ‘এম২৩’ নতুন করে আভিযান শুরু করলে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়।

 
১৯৯৪ সাল। রুয়ান্ডাতে ফরাসি সেনা। ১৯৯০ সালে টুটসি বিদ্রোহী গ্রুপ ‘আরপিএফ’ রুয়ান্ডায় হামলা শুরু করলে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়াঁ মিতেরাঁর সরকার রুয়ান্ডা সরকারকে সহায়তা করার জন্যে ৬’শ প্যারাট্রুপার সেনা পাঠায়। এই সেনারা টুটসি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ চালিয়ে নেয় এবং ১৯৯৪ সালে টুটসিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলার সময় ফরাসি সেনারা হুটু শরণার্থীদেরকে সুরক্ষা দেয়; যাদের মাঝে মানবাধিকার লংঘনকারীরা ছিল বলেও অভিযোগ ওঠে।

ফ্রান্সের চক্ষুশূল কাগামি

নিহত হবার আগ পর্যন্ত রুয়ান্ডার হুটু প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানাএর সাথে ফ্রান্সের যথেষ্ট সখ্যতা ছিল। ১৯৯০ সালে টুটসি বিদ্রোহী গ্রুপ ‘আরপিএফ’ রুয়ান্ডায় হামলা শুরু করলে তৎকালীন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়াঁ মিতেরাঁর সরকার রুয়ান্ডা সরকারকে সহায়তা করার জন্যে ৬’শ প্যারাট্রুপার সেনা পাঠায়। এই সেনারা টুটসি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ চালিয়ে নেয় এবং ১৯৯৪ সালে টুটসিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলার সময় ফরাসি সেনারা হুটু শরণার্থীদেরকে সুরক্ষা দেয়; যাদের মাঝে মানবাধিকার লংঘনকারীরা ছিল বলেও অভিযোগ ওঠে। ‘আরপিএফ’ রুয়ান্ডার ক্ষমতা নেবার পর ফ্রান্সের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ৬ মাস লাগে। তারপরেও দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল না; কাগামির সরকার অভিযোগ করতে থাকে যে, ফ্রান্স গণহত্যাকারীদের সহায়তা দিয়েছে। এরপর ২০০৬ সালে ফরাসি এক বিচারপতি একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেন, যেখানে বলা হয় যে, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামি ১৯৯৪ সালে দুই প্রেসিডেন্টের বিমান ভূপাতিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কাগামি সরকারের ৯ জন সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়। রুয়ান্ডা সাথেসাথেই ফ্রান্সের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তবে ২০০৮-০৯ সালের দিকে কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারও পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি গণহত্যার পর থেকে প্রথম ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে রুয়ান্ডা সফর করেন। সফরকালে তিনি স্বীকার করেন যে, ১৯৯৪ সালে ফ্রান্স অনেক বড় ভুল করেছে। পরের বছর কাগামিও প্যারিস সফর করেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছের বন্ধু কাগামি

গত ২৫শে জুলাই ‘রয়টার্স’এর এক খবরে বলা হয় যে, মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রধান রবার্ট মেনেনডেজ মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেনের কাছে লেখা এক চিঠিতে রুয়ান্ডাকে মার্কিন আর্থিক সহায়তার ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানান। চিঠিতে বলা হয় যে, রুয়ান্ডা সরকারের বিরুদ্ধে পার্শ্ববর্তী দেশ কঙ্গোর অভ্যন্তরে ‘এম২৩’ বিদ্রোহী যোদ্ধাদের সহায়তা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমতাবস্থায় মার্কিন সরকার যদি রুয়ান্ডাকে সহায়তা দেয়া চালিয়ে যায়, তাহলে অনেকেই ধরে নিতে পারে যে, রুয়ান্ডার এহেন কর্মকান্ডে মার্কিনীদের সমর্থন রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০২১ সালে ১’শ ৪৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র রুয়ান্ডার সবচাইতে বড় সহযোগী রাষ্ট্র। এই সহায়তার একটা অংশ যাচ্ছে জাতিসংঘ মিশনে রুয়ান্ডার সেনাদের অংশ নেয়ার প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক্যাল সহায়তা হিসেবে। রুয়ান্ডার একনায়ক পল কাগামি গত ২২ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট এবং প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি রুয়ান্ডার বাস্তবিক শাসনকর্তা। সিনেটর মেনেনডেজ কাগামি সরকারের সমালোচনা করলেও গত তিন দশকের বেশি সময় ধরেই রুয়ান্ডার সাথে মার্কিনীদের সখ্যতা কমেনি এক বিন্দুও।

পল কাগামির বিরুদ্ধে গণহত্যায় অংশ নেবার অভিযোগ রয়েছে; তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ কঙ্গোর অভ্যন্তরে বহু বছর ধরে সেনা মোতায়েন রেখেছেন এবং সেখানে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে নিয়েছেন। তথাপি দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কাগামি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা পশ্চিমাদের, বিশেষ করে মার্কিনীদের যথেষ্টই খুশি করেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে পল কাগামি প্রেসিডেন্ট হবার সময় রুয়ান্ডার মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৬’শ ৩১ ডলার; যা ২০২০ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ২’শ ১৪ ডলারে। কাগামি রুয়ান্ডাকে উন্মুক্ত বাজার করে দেন এবং দেশকে সিঙ্গাপুর হিসেবে তৈরি করার কথা বলেন। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনসহ অনেকেই পল কাগামির সরকারের এহেন মুক্ত বাজার অর্থনীতির ভুয়সী প্রশংসা করেন। তবে এই উন্নয়ন শুধুমাত্র রাজধানী শহরের কিছু মানুষই ভোগ করেছে। বেশিরভাগ সম্পদই স্বল্প সংখ্যক মানুষের হাতে চলে গেছে।

 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার স্ত্রীর সাথে রুয়ান্ডার একনায়ক পল কাগামি। ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পর থেকে রুয়ান্ডা ইংরেজী ভাষাভাষী দুনিয়া, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের বেশ কাছাকাছি গিয়েছে। কাগামি গত ২২ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট এবং প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি রুয়ান্ডার বাস্তবিক শাসনকর্তা। তদুপরি রুয়ান্ডার সাথে মার্কিনীদের সখ্যতা কমেনি এক বিন্দুও।

১৯৯৪ সালের গণহত্যার পর থেকে রুয়ান্ডা ইংরেজী ভাষাভাষী দুনিয়া, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের বেশ কাছাকাছি গিয়েছে। ব্রিটেন রুয়ান্ডাকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে; আর যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে সামরিক সহায়তা ও উন্নয়ন অর্থায়ন। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন কাগামিকে বর্তমান সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একজন বলে আখ্যা দেন। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও কাগামি সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কারের ভূয়সী প্রসংসা করে এই বলেন যে, রুয়ান্ডা হলো আন্তর্জাতিক সহায়তা কাজে লাগাবার ক্ষেত্রে সকলের জন্যে উদাহরণস্বরূপ। ব্লেয়ার রুয়ান্ডার সরকারের উপদেষ্টারূপেও কাজ করেছেন। এখানেই শেষ নয়। ২০০৯ সালে ইংরেজী ভাষাভাষী না হয়েও মোজাম্বিকের পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে রুয়ান্ডা ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১২ সালে রুয়ান্ডা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যও নির্বাচিত হয়।

তবে ২০১২ সালের নভেম্বরে কঙ্গোর ‘এম২৩’ বিদ্রোহীদের সহায়তা দানের জন্যে ব্রিটিশ সরকার রুয়ান্ডার জন্যে ২১ মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তা স্থগিত করে। জার্মানিও তাই করে। যুক্তরাষ্ট্রও রুয়ান্ডার সামরিক সহায়তা স্থগিত করে। তবে ২০১৩ সালের পর থেকে এই সহায়তাগুলি আবারও দেয়া শুরু হয়। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র রুয়ান্ডার সবচাইতে বড় সহায়তাকারী দেশ।

পশ্চিমাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব

মধ্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গো খনিজ সম্পদের দিক থেকে অত্যন্ত ধনী একটা দেশ। কিন্তু দেশের মানুষ এই খনিজ সম্পদের সুবিধা কখনোই পায়নি। বরং পশ্চিমা শক্তিদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের বলি হয়েছে এখানকার জনগণ। ঔপনিবেশিক শক্তিরা এই অঞ্চল ত্যাগ করলেও এখানকার জনগণ এখনও উপনিবেশ হিসেবেই জীবনযাপন করছে। রুয়ান্ডার গণহত্যায় ৮ লক্ষাধিক মানুষের লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন পল কাগামি; যিনি তার দেশকে ফ্রান্সের কোল থেকে বের করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কোলে নিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ উগান্ডা কাগামিকে ক্ষমতায় যেতে বিশাল সহায়তা দিয়েছে। ১৯৯৪ সালের গণহত্যাটা কাগামিকে তার ক্ষমতার ভিত শক্ত করতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। তবে এর ফলশ্রুতিতে ফ্রান্সের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়, তার ফলাফল ভোগ করতে বাধ্য হয় পার্শ্ববর্তী দেশ কঙ্গো। কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে রুয়ান্ডা এবং উগান্ডা ভয়াবহ ভূমিকা নেয়; যার ফলশ্রুতিতে কঙ্গোতে ৩০ থেকে ৭৬ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তথাপি এই দ্বন্দ্ব এখনও শেষ হয়নি; যার ফলাফল দেখা যাচ্ছে কঙ্গোতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মাঝে। আফ্রিকাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে রুয়ান্ডাকে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করছে প্রায় তিন দশক ধরে। এমতাবস্থায় জাতিসংঘে রুয়ান্ডা সমর্থিত ‘এম২৩’ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর ফ্রান্স তার শক্তি হারাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। আফ্রিকাতে ফ্রান্সের অবস্থানগুলি দখলে নিতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার অসারতার জানান দিচ্ছে ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের দ্বন্দ্বের বলি কঙ্গো ও রুয়ান্ডার লাখো মানুষের লাশ।

……………………………………………………



সূত্র -

‘Why are there protests against UN peacekeepers in DR Congo?’ in Inside Story, Al-Jazeera, 29 July 2022 (https://youtu.be/hP-U3sKyfBs)

‘America’s secret role in the Rwandan genocide’ in The Guardian, 12 September 2017

‘U.S. senator questions aid to Rwanda over human rights, role in Congo’ in Reuters, 26 July 2022

‘Rethinking the Rwandan Narrative for the 25th Anniversary’, by Gerald Caplan in Genocide Studies International, 2018

‘The Rwanda Crisis: History of a Genocide’ by Gerald Prunier, 1999

‘The Responsibility to Protect and the Duty to Prevent Genocide: Lessons to be Learned from the Role of the International Community and the Media During the Rwandan Genocide and the Conflict in the Former Yugoslavia’ by Jeremy Sarkin and Carly Fowler, in Suffolk Transnational Law Review, 2010

‘Hutus 'killed Rwanda President Juvenal Habyarimana'’ in BBC News, 12 January 2010

‘A Thousand Hills: Rwanda's Rebirth and the Man Who Dreamed it’ by Stephen Kinzer, 2008

‘Silent Accomplice: The Untold Story of France's Role in the Rwandan Genocide’ by Andrew Wallis, 2007

‘Paul Kagame And Rwanda: Power, Genocide and the Rwandan Patriotic Front’ by Colin Waugh, 2004

‘Rwanda's Leaders Vow to Build a Multiparty State for Both Hutu and Tutsi’ in The New York Times, 07 September 1994

‘Ex-Rwandan Minister Killed in Kenya’ in Associated Press, 17 May 1998

‘Report of the Panel of Experts on the Illegal Exploitation of Natural Resources and Other Forms of Wealth of the Democratic Republic of the Congo’, United Nations, 12 April 2001

‘Kagame elected Rwandan president’ in BBC News, 17 April 2000

‘The power of horror in Rwanda’, Human Rights Watch, 11 April 2009

‘Rwandans Led Revolt in Congo’ in The Washington Post, 09 July 1997

‘Review of Congo war halves death toll’ in Associated Press, 20 January 2010

‘Delayed UN report links Rwanda to Congo genocide’ in The Guardian, 01 October 2010

‘GDP per capita, PPP (current international $) – Rwanda’, World Bank, 2020

‘Rwanda's Economic Miracle’ in National Review, 13 December 2010

‘Tracking Rwanda's ICT ambitions’ in The New Times, 27 May 2012

‘Paul Kagame: Rwanda's redeemer or ruthless dictator?’ in The Daily Telegraph, 22 July 2010

‘Whispering truth to power: The everyday resistance of Rwandan peasants to post-genocide reconciliation’ by S. Thomson in African Affairs, 2011

‘Kabila Accuses Rwanda of Trying to Profit from Congo Chaos’ in Voice of America, 30 October 2009

‘Averting Proxy Wars in the Eastern DR Congo and Great Lakes’, International Crisis Group, 23 January 2020

‘Rwanda defence chief leads DR Congo rebels, UN report says, in BBC News, 17 October 2012

‘Shake Hands with the Devil: The Failure of Humanity in Rwanda’ by Romeo Dallaire, 2005

‘Securing Human Rights?: Achievements and Challenges of the UN Security Council’ by Bardo Fassbender, 2011

‘France's shame?, in The Guardian, 11 January 2007

‘France issues Rwanda warrants’ in BBC News, 23 November 2006

‘Rwanda cuts relations with France’ in BBC News, 24 November 2006

‘Kabuye's release not condition for resuming ties with France-Museminali’ in The New Times, 25 November 2008

‘On Visit to Rwanda, Sarkozy Admits 'Grave Errors' in 1994 Genocide’ in The New York Times, 25 February 2010

‘Rwanda's Kagame pays 'reconciliation visit' to France’ in BBC News, 12 September 2011

‘The end of the west's humiliating affair with Paul Kagame’ in The Guardian, 25 July 2012

‘Blair takes on unpaid role as Rwanda advise’ in The Guardian, 18 January 2008

‘Rwanda joins the Commonwealth’ in The Daily Telegraph, 29 November 2009

‘UK stops £21m aid payment to Rwanda’ in BBC News, 30 November 2012

‘The Effects of the Exit From Budget Support In Rwanda’, German Institute for Development Evaluation, February 2008

‘Obama accused of failed policy over Rwanda's support of rebel group’ in The Guardian, 11 December 2012