Saturday 26 June 2021

ইথিওপিয়া... ধ্বসে পড়া বিশ্বব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ

২৭শে জুন ২০২১
২২শে জুন ২০২১। ইথিওপিয়ার তিগ্রে অঞ্চলে বিমান হামলায় ৬৪ জন নিহত হয়। তবে ইথিওপিয়ার সরকার ঘটনার দায় পুরোপুরি অস্বীকার করে। আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ হর্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারাবার ভয়ে পশ্চিমা দেশগুলি ইথিওপিয়ার সংঘাতকে থামাতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আসলে ইথিওপিয়া ধ্বসে পড়া বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।


২৫শে জুন মানবাধিকার সংস্থা ‘ডকটর্স উইথআউট বর্ডার্স’ বা ‘এমএসএফ’এর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, তাদের তিনজন কর্মীকে দেশটার গৃহযুদ্ধ আক্রান্ত তিগ্রে অঞ্চলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ইথিওপিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, তিগ্রে অঞ্চলের আবি আদ্দি শহরে ‘তিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা ‘টিপিএলএফ’ বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলারা তাদেরকে অপহরণ করে হত্যা করেছে। ‘ডয়েচে ভেলে’র এক খবরে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, গত মার্চ মাসে ‘এমএসএফ’এর ত্রাণ কর্মীরা আক্রমণের শিকার হয়, যখন তারা অভিযোগ করে যে, তারা ইথিওপিয়ার সেনাদেরকে বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডে জড়িত হতে দেখেছে। ‘এমএসএফ’এর কর্মী হত্যার কয়েকদিন আগেই ২২শে জুন তিগ্রে অঞ্চলের তোগোগার বাজার এলাকায় বিমান হামলায় ৬৪ জনের প্রাণহানি হয় এবং ১’শ ৮০ জন আহত হয়। ঘটনাস্থলে এম্বুলেন্স যেতেও বাধা দেয় ইথিওপিয়ার সেনারা। তবে ইথিওপিয়ার সরকার ঘটনার দায় পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করে। গত নভেম্বরে শুরু হওয়া ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশ এরিত্রিয়ার সেনারা ইতোমধ্যেই ইথিওপিয়ার পক্ষে তিগ্রেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধ এমন এক সময়ে চলছে, যখন নীল নদের উপর বাঁধ দেয়াকে কেন্দ্র করে ভাটির দেশ মিশর ও সুদানের সাথে ইথিওপিয়ার সম্পর্কের ব্যাপক অবণতি হয়েছে। এমতাবস্থায় অতি দরিদ্র এই দেশটায় সংঘাত নিরসণ এবং অসহায় মানুষের জীবন রক্ষার্থে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলির ভূমিকা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তেমনি জাতিগতভাবে বিভক্ত ইথিওপিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা হচ্ছে।

‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর আফ্রিকা বিশ্লেষক কনর ভ্যাসি বলছেন যে, হর্ন অঞ্চলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো ইথিওপিয়া। এই অঞ্চলের সংঘাতপূর্ণ সোমালিয়া, সুদান এবং দক্ষিণ সুদানে ইথিওপিয়ার সেনা মোতায়েন রয়েছে। পশ্চিমারা এই অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইথিওপিয়াকে মূল স্তম্ভ হিসেবে দেখে। তবে দেশটার বর্তমান অবস্থা পশ্চিমা দেশগুলিকে ইথিওপিয়ার উপর নির্ভর করাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দেশটা অস্থির থাকলে সুদানের সাথে সীমান্ত সমস্যা এবং নীল নদের উপর বাঁধের ব্যাপারে বিরোধের নিষ্পত্তি কঠিন হয়ে যাবে। আর সাড়ে ১১ কোটি জনসংখ্যার একটা দেশ অস্থির হওয়াটা পুরো অঞ্চলের জন্যেই চ্যালেঞ্জ। পশ্চিমারা মনে করছে যে, তারা যদি প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের সরকারের উপর বেশি চাপ সৃষ্টি করে, তবে তারা হর্ন অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব হারাবে। সেকারণেই ইথিওপিয়ার সরকারি বাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারটাকে পশ্চিমারা তেমন কঠোরভাবে দেখছে না। দেশটায় চীন, রাশিয়া এবং তুরস্ক তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইছে। তাই পশ্চিমারাও চাইছে না নিজেদের প্রভাব ছেড়ে দিতে।

সুদানের মন্ত্রী ইয়াসির আব্বাস বলছেন যে, ইথিওপিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধ আদ্দিস আবাবার সরকারকে ভাটির দেশগুলির সাথে সমঝোতা ছাড়াই নীল নদের উপর বাঁধের প্রকল্পের কাজকে এগিয়ে নিতে আরও বেশি একরোখা করেছে। এমতাবস্থায় সুদান চাইছে যে, জাতিসংঘ এব্যাপারে অগ্রগামী ভূমিকা নিক। ১৫ই জুন আরব লীগের দোহা বৈঠকে আরব দেশগুলিও মিশর ও সুদানের পক্ষে একই দাবি জানায়। মন্ত্রী আব্বাস সাংবাদিকদের সামনে ইথিওপিয়ার বর্তমান সরকারের তিগ্রে অঞ্চলে সামরিক অভিযানের ব্যাপক সমালোচনা করেন। দুই দেশের মাঝে অবিশ্বাস এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে বলে উল্লেখ করেন। সুদান সরকারের জবাবে ইথিওপিয়ার সরকার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলে যে, আফ্রিকান ইউনিয়নের নেতৃত্বে যে আলোচনা চলছে, সেই আলোচনাকে নষ্ট করতেই মিশর এবং সুদান জাতিসংঘকে এই সমস্যায় জড়িত হতে বলছে এবং এখানে আরব দেশগুলিকে ডেকে নিয়ে আসছে।

‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইয়ান ব্রেমার প্রশ্ন করছেন যে, ইথিওপিয়া তার বর্তমান কাঠামোতে আদৌ একটা রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে পারবে কিনা। ১৯৯১ সাল থেকে ইথিওপিয়ার ক্ষমতা ছিল তিগ্রেদের হাতে, যারা জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ। ২০১৮ সালের পর থেকে অরোমো এবং আমহারা জাতিগোষ্ঠির মানুষেরা ক্ষমতায় আসে, যারা কিনা জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ। তবে প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়ার মতোই ইথিওপিয়াতেও বহুকালের একনায়কতন্ত্র শেষ হবার পর সকল জাতিগোষ্ঠিই নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান হতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ক্ষমতা নেবার প্রায় সাথে সাথেই দেশটাতে জাতিগত সংঘাত শুরু হয়ে যায়। ঠিক এসময়েই তিগ্রেরা নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ইথিওপিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাবার কথা বলতে শুরু করে। ইথিওপিয়ার সরকারি সেনারা তিগ্রে অঞ্চলে সামরিক অপারেশন শুরু করে; এবং সেখান থেকে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবরাখবর আসতে থাকে। যে পশ্চিমারা একসময় আবি আহমদেকে গণতন্ত্রের ঝান্ডাবাহক হিসেবে দেখেছে এবং তাকে নোবেল পুরষ্কার দিয়েছে, তারাই এখন তার কর্মকান্ডের সমালোচনা করছে। জাতিসংঘের হিসেবে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ তিগ্রে জনগণ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে। শুধু ইথিওপিয়া নয়, পার্শ্ববর্তী এরিত্রিয়ার সেনারাও তিগ্রেদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে; এবং ‘রয়টার্স’ বলছে যে, তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে যে তারাও তিগ্রেদেরকে না খাইয়ে মারার চেষ্টা করছে। এমতাবস্থায় ইথিওপিয়া জাতিগত বিভেদের উপর ভিত্তি করে লেখা সংবিধানের উপর নিজেদের ভৌগোলিক অখন্ডতাকে টিকিয়ে রাখতে পারবে কি? দেশটা কিন্তু তার ইতিহাসে রাজতন্ত্র, সামরিক একনায়ক, সাংবিধানিক গণতন্ত্র সকল কিছুই দেখেছে।

ইথিওপিয়ার জটিল সমস্যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বর্তমান বিশ্ব নিয়মহীনভাবে চলছে। ‘আল মনিটর’ বলছে যে, মে মাসের শেষ সপ্তাহে মিশর এবং সুদান ‘গার্ডিয়ান অব দ্যা নাইল’ নামে একটা বড়সড় যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। যদিও উভয় দেশের সরকার বলছে যে, এই মহড়ার সাথে নীল নদের উপর ইথিওপিয়ার বাঁধের কোন সম্পর্ক নেই; তথাপি কথা থেকেই যাচ্ছে। মিশরের ‘নাসের হাই মিলিটারি একাডেমি’র অধ্যাপক মেজর জেনারেল নাসর সালেম বলছেন যে, এই মহড়া ইথিওপিয়া সহ মিশরের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যেকোন দেশের জন্যে একটা বার্তা। ইথিওপিয়াকে ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপারে নাসর সালেমের কথাগুলিকে ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরীণ বিভেদের সাথে যুক্ত করতেই হবে। আফ্রিকান ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার নীল নদের বাঁধের আলোচনায় জড়িত হবার ব্যাপারে ইথিওপিয়া এবং আরব দেশগুলির বিরোধ লক্ষ্যণীয়। আবার আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ হর্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারাবার ভয়ে পশ্চিমা দেশগুলি ইথিওপিয়ার সংঘাতকে থামাতে কঠোর পদক্ষেপও নিচ্ছে না। আসলে ইথিওপিয়া ধ্বসে পড়া বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

Wednesday 23 June 2021

বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ছে কেন?

২৪শে জুন ২০২১
ছবিঃ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সামরিক বাহিনীর গণহত্যা চালাবার ফলে ১১ লক্ষ মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের কাছে এই শরণার্থীদের ফেরত যাওয়া সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ; দেশটাতে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমাদের নিষ্ক্রিয় অবস্থান মিয়ানমারকে শক্তিশালী করছে। তবে শুধু মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘের ভোটাভুটিই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বেশকিছু ইস্যুতে বাংলাদেশের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আলোচনায় এসেছে।


গত ১৮ই জুন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার নিয়ে ভোটাভুটি হয়ে গেল। পরিষদ ভোটাভুটির মাধ্যমে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে গণতান্ত্রিক নির্বাচন মেনে নিতে বলে এবং রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে আহ্বান জানায়। ১’শ ১৯টা ভোট পড়ে পরিষদের রেজোলিউশনের পক্ষে; বিপক্ষে ভোট দেয় শুধুমাত্র বেলারুশ। তবে আরও ৩৬টা দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে। বিরত থাকা দেশগুলির মাঝে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে রয়েছে চীন, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, আলজেরিয়া। ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের বরাত দিয়ে ‘ইকনমিক টাইমস’ জানাচ্ছে যে, ভারত সরকার মনে করছে যে, মিয়ানমারের প্রতিবেশীদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা উচিৎ। রেজোলিউশনে সেটা উঠে না আসার কারণেই ভারত ভোটদানে বিরত থাকে। ভারত এবং চীন ছাড়াও মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, নেপাল এবং ভুটানও ভোটদানে বিরত থাকে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় যে, রেজোলিউশনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টা সঠিকভাবে প্রতিফলিত না হওয়ায় তারা ভোট দেয়নি। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যদিও সাধারণ পরিষদের রেজোলিউশন মানার কোন বাধ্যবাধকতা নেই, এবং সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটির তুলনায় ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতা বেশি, তথাপি নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া এবং চীনের ভেটো দেয়ার এখতিয়ার রয়েছে বিধায় সেখান থেকে মিয়ানমার ইস্যুতে কোন রেজোলিউশন পাস করানো কঠিন। ভোটাভুটিতে গণতন্ত্র রক্ষার মতো আদর্শিক ইস্যু মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলির বাস্তবতার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সামরিক বাহিনীর গণহত্যা চালাবার ফলে ১১ লক্ষ মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের কাছে এই শরণার্থীদের ফেরত যাওয়া সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ; দেশটাতে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা নয়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, রেজোলিউশনে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কোন সুপারিশ বা কর্মকান্ডই ছিল না। এমনকি শরণার্থীদের নিরাপদে প্রত্যাবাসনের জন্যে উপযোগী পরিবেশ তৈরি করার বিষয়েও কোন কথাই সেখানে বলা হয়নি। জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন যে, রেজোলিউশনে বাংলাদেশ অসন্তুষ্ট এবং এর মাধ্যমে একটা ভুল বার্তা দেয়া হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনকিছু না বলায় তা মিয়ানমারকে শক্তিশালী করছে। শুধু মিয়ানমার বিষয়ে ভোটাভুটিই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বেশকিছু ইস্যুতে বাংলাদেশের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আলোচনায় এসেছে।

মে মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার সাথে ২’শ মিলিয়ন ডলারের মুদ্রা বিনিময়ের চুক্তি করে। এই চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমপরিমাণ শ্রীলঙ্কার মুদ্রা নিজেদের কাছে রাখবে; বিনিময়ে শ্রীলঙ্কাকে ডলার দেবে। শ্রীলঙ্কা সরকারের ব্যাপক ডলার ঘাটতির এই সময়ে এটা প্রকৃতপক্ষে একটা বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ। ভারতীয় পত্রিকা ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ বাংলাদেশের এই কর্মকান্ডকে দেশটার উঠতি অর্থনীতির ফলাফল হিসেবে উল্লেখ করে একটা প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি দুই দশক ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে এবং এখন দেশটার মাথাপিছু আয় ভারতের চাইতে বেশি। মাথাপিছু আয় ভারতের যখন ১৯’শ ৪৭ ডলার, তখন বাংলাদেশের তা ২২’শ ২৭ ডলার। পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় আরও কম; ১৫’শ ৪৩ ডলার। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকা বলছে যে, করোনা মহামারির কারণে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার আয় এবং রিজার্ভ একেবারেই কমে গেছে। ফলশ্রুতিতে দেশটা তার বৈদেশিক ঋণ ফেরত দিতে হিমসিম খাচ্ছে। এবছরের এপ্রিল মাসে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারে; যা এবছরের বৈদেশিক ঋণ শোধ করতেই চলে যাবার কথা। ২০২০ সালের মে মাসে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ভারতের কাছে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের মুদ্রা বিনিময়ের অনুরোধ করেছিলেন; ভারত এক বছরেও সেটা নিশ্চিত করেনি। অপরপক্ষে বাংলাদেশ মাত্র দুই মাসের মাঝে এই অর্থের সংকুলানের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১০ সালে ৯ বিলিয়ন থেকে ২০২১ সাল নাগাদ ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

সকলেই বাংলাদেশকে পাশে চাইছে

অস্ট্রেলিয়ার প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ একটা অতি দরিদ্র দেশ থেকে আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশে পরিণত হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, নিজেদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশকে কি ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ করাবে, তা এখন আলোচ্য বিষয়। শক্তিশালী দেশগুলি বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘কোয়াড’এ যোগ দেয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের জের ধরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিবাদকে তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বাংলাদেশ আদৌ কখনোই ‘কোয়াড’এ যোগ দেবে বলে যেমন মনে হচ্ছে না, তেমনি চীনের হুমকির সামনেও বাংলাদেশ নত হবার সম্ভাবনা নেই; যদিও চীন বাংলাদেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সহযোগী। শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেয়ার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এখনও পরিষ্কার নয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। তবে সেখানে ধারণা করা হয় যে, এর সাথে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সরকারের সাথে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছাবার একটা প্রচেষ্টা থাকতে পারে।

‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’ একইসাথে বলছে যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির আরেকটা ফলফল হলো দেশটার সামরিক শক্তির বৃদ্ধি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ চীনের বাইরেও পশ্চিমা দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে। তুরস্কের কাছ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারে আর্মার্ড ভেহিকল এবং রকেট লঞ্চার কিনেছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলি বাংলাদেশের কাছে উন্নত প্রযুক্তির ফাইটার বিমান বিক্রির জন্যে লবিং করছে। তবে চীন থেকে কেনা সাবমেরিনের পর ম্যারিটাইম অঙ্গনে আর কি ধরনের সক্ষমতা যুক্ত হতে পারে, সেব্যাপারটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার সরকারকে ভারত মহাসাগরে শুধুমাত্র পুরাতন সহযোগীদের উপর নির্ভর না করে বাংলাদেশের সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা ব্যাপারে সচেষ্ট হতে বলা হয়।
ছবিঃ ঢাকায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ দূত জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে। বাংলাদেশ এখন এমন একটা অবস্থানে পৌঁছেছে যে, চীন ছাড়াও পশ্চিমা দেশগুলি দেশটার সাথে সম্পর্কোন্নয়নে তৎপর হচ্ছে। শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্ক নয়, বাংলাদেশের সাথে কৌশলগত এবং সামরিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্রতী হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলি।


অর্থনৈতিক সম্পর্ক থেকে কৌশলগত সম্পর্কের দিকে

শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়। অনেক দেশের চিন্তাবিদেরাই বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে তাদের সাথে রাখার জন্যে আলোচনা শুরু করেছেন। কানাডার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জিওপলিটিক্যাল মনিটর’এর এক লেখায় বলা হয় যে, বাংলাদেশ এখন এমন একটা অবস্থানে পৌঁছেছে যে, চীন ছাড়াও পশ্চিমা দেশগুলি দেশটার সাথে সামরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে তৎপর হচ্ছে। ভারতের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের জন্যে মার্কিন নেতৃত্বে ‘ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ বা ‘আইপিএস’এ যোগ দেয়া কঠিন হবে; কারণ তাতে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সমস্যায় পড়তে পারে। সেখানে আরও বলা হয় যে, বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা নির্ভরশীলতা থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের দূরে থাকাটা সম্ভব নয়। তবে সামনের দিনগুলিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ কোন পথে যেতে পারে, সেব্যাপারে ‘ওআরএফ’ প্রতিবেদনে পুরোপুরি অজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। ‘ইউনিভার্সিট অব টেক্সাস, অস্টিন’এর নিরাপত্তা ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রক্স’এর এক লেখায় অনুমান করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের পরবর্তী ৫০ বছরের ইতিহাস নির্ধারিত হবে বাংলাদেশ কিভাবে ভারত এবং চীনের সাথে সম্পর্ককে ব্যালান্স করে, সেটার উপর।

২০২০এর মার্চে ফরাসি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লি বাংলাদেশ সফর করেন। একই বছরের সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব মার্ক এসপার ফোন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কথা বলে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে কথা বলেন। পরের মাসে, অক্টোবরে মার্কিন উপপররাষ্ট্র সচিব স্টিফেন বাইগান ঢাকা সফর করে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘আইপিএস’এর অংশ হবার আমন্ত্রণ দিয়ে যান। এরপর এবছরের এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ দূত হিসেবে প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব জন কেরি ঢাকা সফর করেন। একই মাসে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেংহি ঢাকা সফর করেন। প্রায় একইসাথে বাংলাদেশ চীনের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে ‘ইমারজেন্সি ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি’তে যোগ দেয়। গত বছর অক্টোবরে বাংলাদেশ তুরস্কের ‘ষষ্ঠ ডিফেন্স পোর্ট টারকি’ নামের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিরক্ষা মেলায় যোগ দেয়। এর মাধ্যমে তুরস্ক বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চাহিদা বোঝার চেষ্টা করে। শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্ক নয়, বাংলাদেশের সাথে কৌশলগত এবং সামরিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্রতী হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলি। বাংলাদেশ তার বেশিরভাগ অস্ত্র চীন এবং রাশিয়া থেকেই কিনে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা অস্ত্রের দিকে ঝোঁকার একটা প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। এক্ষেত্রে উন্নততর প্রযুক্তি যোগাড় এবং নতুন ধরনের সক্ষমতা যোগ করার দিকে আগ্রহী বাংলাদেশ। বেশিরভাগ অস্ত্রের সাথেই প্রযুক্তি কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাশিয়া থেকে কেনা বহুসংখ্যক ‘এমআই ১৭১’ হেলিকপ্টারের মেইনটেন্যান্সের জন্যে ওভারহলিং কারখানা তৈরি করা হয় ইউক্রেনের সহযোগিতায়। চীনের কাছ থেকে কেনা ‘এফ ৭’ ফাইটার বিমান এবং ‘পিটি ৬’ প্রশিক্ষণ বিমানের ওভারহলিং কারখানাও স্থাপন করা হয়েছে।
ছবিঃ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্যে কেনা তুরস্কের তৈরি ‘টি ৩০০ টাইগার’ মাল্টিপল রকেট লঞ্চার। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশকে অন্ততঃ এটা বুঝিয়েছে যে, তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহিঃশক্তির হাত থেকে নিরাপদ নয়। এই সমস্যাই বাংলাদেশকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণিত করেছে।


বাংলাদেশে পশ্চিমাদের অস্ত্র বাণিজ্য

এমনই এক পরিস্থিতিতে তুরস্ক যখন দক্ষিণ এশিয়াতে তার প্রভাব বৃদ্ধিতে ব্যস্ত, তখন বাংলাদেশের সাথে তুরস্কের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক দ্রুতই এগুচ্ছে। ২০শে জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ক থেকে কেনা ‘টি৩০০ টাইগার’ মাল্টিপল রকেট লঞ্চারের ’৫১তম এমএলআরএস রেজিমেন্ট’এ অন্তর্ভুক্তির উদ্ভোধন করেন। তুরস্কের কাছ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শতাধিক ‘অতোকার কোবরা’ আর্মার্ড ভেহিকল ক্রয় করেছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জার্মান কোম্পানি ‘রেইনমেটাল’ থেকে অত্যাধুনিক ‘উরলিকন জিডিএফ০০৯ স্কাইগার্ড’ অটোম্যাটিক এয়ার ডিফেন্স কামান কিনে ’৪৮ এয়ার ডিফেন্স আর্টিলারি রেজিমেন্ট’এ অন্তর্ভুক্ত করে। একই বছর সেনাবাহিনী অস্ট্রিয়া থেকে ৪টা ‘ডায়ামন্ড ডিএ ৪০এনজি’ প্রশিক্ষণ বিমানের ডেলিভারি পায়। এর আগে ইউরোপের এয়ারবাস থেকে সেনাবাহিনী ‘সি ২৯৫ডব্লিউ’ পরিবহণ বিমান কেনে। সার্বিয়া থেকে সেনাবাহিনী ৩৬টা ‘নোরা বি৫২’ ১৫৫মিঃমিঃ সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি এবং ৮টা ‘বিওভি এম১১’ আর্মার্ড ভেহিকল কেনে।

এছাড়াও ১০ই জুন বিদায়ী বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল মশিহুজ্জামান সারনিয়াবাত এক বিদায়ী ভাষণে ঘোষণা দেন যে, বাংলাদেশ জার্মানির ‘গ্রোব এয়ারক্রাফট’ কোম্পানির কাছ থেকে প্রযুক্তি সহ ২৪টা ‘জি ১২০টিপি’ কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালে তৈরি প্রশিক্ষণ বিমান ক্রয় করার চুক্তি করেছে। তিনি একইসাথে সামনের দিনগুলিতে বিমান বাহিনীতে পশ্চিমা প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তির আভাস দেন। জার্মান বিমানগুলি চীনে তৈরি ‘পিটি ৬’ বিমানকে প্রতিস্থাপন করবে। বাংলাদেশ ব্রিটেনের রয়াল এয়ার ফোর্সের কাছ থেকে ৫টা ‘সি ১৩০জে সুপার হারকিউলিস’ পরিবহণ বিমান ক্রয় করেছে; যেগুলির ডেলিভারি এখনও চলছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ বরিশালে বিমান বাহিনীর জন্যে ইতালির ‘লিওনার্ডো’ কোম্পানির তৈরি অত্যাধুনিক ‘ক্রনোজ’ ‘মাল্টি ফাংশন ৩ডি’ রাডার ইউনিট উদ্ভোধন করেন। এর আগে একই কোম্পানি থেকে একটা ‘আরএটি ৩১ডিএল’ দূরপাল্লার রাডারও কেনা হয়। অথচ ২০১৫ সালেই কক্সবাজারে বিমান ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার সময় সেখানে চীনে তৈরি ‘ওয়াইএলসি ৬’ রাডার স্থাপন করা হয়েছিল। ‘লিওনার্ডো’ কোম্পানি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীকে ‘এডব্লিউ ১৩৯’, ‘এডব্লিউ ১১৯’ এবং ‘এডব্লিউ ১০৯’ হেলিকপ্টার সরবরাহ করেছে। বহুকাল ধরে রাশিয়া ছিল বাংলাদেশের মূল হেলিকপ্টার সরবরাহকারী। কয়েক বছর আগে চেক রিপাবলিক থেকে বিমান বাহিনী ৩টা ‘এল ৪১০ টারবোলেট’ স্বল্পপাল্লার পরিবহণ বিমান কেনে।

২০১৯ সালে ইন্দোনেশিয়ার সহযোগিতায় নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা নারায়নগঞ্জ ডকইয়ার্ডে কম্পোজিট স্পিডবোট তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়। এই প্রযুক্তির মূল সরবরাহকারী হলো সুইডিশ কোম্পানি ‘নর্থ সী বোটস’এর ইন্দোনেশিয়ান সাবসিডিয়ারি ‘পিটি লুনডিন’। নৌবাহিনীর জন্যে ‘ডর্নিয়ার ২২৮এনজি’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান কেনা হয় জার্মানির ‘রুওয়াগ এভিয়েশন’এর কাছ থেকে। প্রথম দু’টা কেনার পর আরও দু’টা আর্ডার করা হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে ৬টা ফ্রিগেট তৈরির প্রকল্প নেয়া হয়েছে; যার জন্যে প্রযুক্তি সহযোগী এখনও নির্ধারিত হয়নি। হল্যান্ড, তুরস্ক, চীনসহ অনেক দেশই এই প্রকল্পে প্রযুক্তি সহযোগী হতে চাইছে। নৌবাহিনীর বর্তমান ফ্রিগেটগুলির বেশিরভাগই চীনে নির্মিত। বিমান বাহিনীর জন্যে অত্যাধুনিক মাল্টিরোল ফাইটার বিমান সরবরাহ করতে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বেশ প্রতিযোগিতা চলেছে। এর বাইরেও সেনাবাহিনীর জন্যে ১৫৫মিঃমিঃ হাউইটজার, এটাক হেলিকপ্টার, বিমান বাহিনীর জন্যে মধ্যম পাল্লার এয়ার ডিফেন্স ক্ষেপণাস্ত্র, মনুষ্যবিহীন ড্রোন, নৌবাহিনীর এন্টি সাবমেরিন হেলিকপ্টার, লজিস্টিক জাহাজ, হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার, ইত্যাদি অনেক কিছুরই সরবরাহকারী হতে চাইছে পশ্চিমারা। তারা মূলতঃ চীন এবং রাশিয়ার অস্ত্রকেই প্রতিস্থাপিত করতে চাইছে। এখানে কৌশলগত উদ্দেশ্য ছাড়াও বিপুল অংকের অস্ত্র বাণিজ্যও জড়িত।

কি চাইছে বাংলাদেশ?

অর্থনৈতিক লক্ষ্যই যে একটা রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হতে পারে না, তা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনাতে পরিষ্কার। কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন শক্তিশালী দেশগুলিকে প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী করবে মাত্র। বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক লক্ষ্যকে পরিষ্কারভাবে না বলার কারণে প্রতিটা শক্তিশালী দেশই চাইছে ঢাকায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে। আর যেহেতু প্রতিটা দেশের কৌশলগত চিন্তায় ইন্দোপ্যাসিফিক এখন শীর্ষে রয়েছে, তাই বাংলাদেশ কোন পক্ষে থাকবে, তা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার হয়ে দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ আপাত দৃষ্টিতে কোন পক্ষকেই সরাসরি সমর্থন দিতে চাইছে না। কিন্তু সমস্যা হলো, ভূরাজনীতিতে নিরপেক্ষ বলে কিছু নেই। নিরপেক্ষ অর্থ হলো কোন একটা পক্ষে না যাওয়া; এর ফলে যে পক্ষের সহায়তা দরকার বেশি সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর অপর পক্ষ হয় লাভবান। কাজেই এক পক্ষ বাংলাদেশকে পাশে চাইবে; অপর পক্ষ চাইবে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ থাকুক। এই মুহুর্তে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশকে নিজের পাশে না পাওয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে একটা বড় ক্ষতি এবং সুপারপাওয়ারের বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখার প্রতি চ্যালেঞ্জ।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ, বিশেষ করে পশ্চিমাদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা বাংলাদেশকে হতাশ করেছে। সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে গিয়ে বাংলাদেশ বড় পশ্চিমা শক্তির, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির অধীনে যেতে চাইছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশকে অন্ততঃ এটা বুঝিয়েছে যে, তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহিঃশক্তির হাত থেকে নিরাপদ নয়। এই সমস্যাই বাংলাদেশকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু পশ্চিমাদের শর্তযুক্ত সামরিক সরঞ্জামের ফাঁদেও পড়তে চাইছে না বাংলাদেশ। ইন্দোপ্যাসিফিকের অতি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকার সুবিধা বাংলাদেশ কতটুকু নিতে পারবে, তা নির্ভর করবে না যে বাংলাদেশ কতটা সফলতার সাথে চীন এবং ভারতের মাঝে বা চীন এবং পশ্চিমাদের মাঝে ব্যালান্স করতে পারে; বরং পশ্চিমা আদর্শিক শক্তিগুলিকে একে অপরের সাথে ব্যালান্সে রাখতে পারবে। কাজটা অসম্ভব না হলেও আদর্শিক কোন অবস্থানে আসীন হওয়া ছাড়া তা অর্জন সম্ভব নয়।

Wednesday 16 June 2021

বাইডেন এবং পুতিনের বৈঠকের ফলাফল কি?

১৭ই জুন ২০২১
এই বৈঠক রেগ্যান এবং গরবাচেভের বৈঠকের মত কিছু ছিল না। বরং যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মূল ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঝে একটা সাইড বৈঠক। বৈঠকের আগেও বোঝা যাচ্ছিল যে, এখান থেকে তেমন কিছু আসবে না। বৈঠকে মুখে যা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে; কারণ এখন পর্যন্ত বাইডেন সেব্যাপারে কোন শক্ত পদক্ষেপ দেখাতে পারেননি। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসাটা এখন মোটেই সহজ নয়। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ধরে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। অন্য একটা দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ করাটা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের একার অধিকার ছিল। এখন আরেকটা শক্তিকে একই কাজ করা থেকে বিরত করতে পারার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে কিনা, সেব্যাপারে এখন কেউই নিশ্চিত নয়।


১৬ই জুন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মাঝে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। আলোচনায় তারা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং কূটনীতি নিয়ে আন্তরিক আলোচনা করেছেন। তবে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, তারা মূলতঃ যেখানে শুরু করেছিলেন, সেখানেই বৈঠক শেষ করেছেন। অর্থাৎ মানবাধিকার, সাইবার হামলা, নির্বাচনে হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিরোধ যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। সবচাইতে বড় অগ্রগতি ছিল যে, দুই দেশ তাদের রাষ্ট্রদূতদেরকে অপরের রাজধানীতে পাঠাবার ব্যাপারে একমত হয়েছে এবং অবশিষ্ট পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চুক্তির ব্যাপারে তারা আবারও কাজ শুরু করতে চাইছেন। বৈঠকের পর সংবাদ সন্মেলনে বাইডেন বলেন যে, পুতিনের কর্মকান্ড পরিবর্তন হবার ব্যাপারে তিনি মোটেই আত্মবিশ্বাসী নন। তিনি বলেন যে, সারা বিশ্ব যদি পুতিনের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তবেই কেবল তার কর্মকান্ডে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে তিনি কোনকিছুর ব্যাপারেই নিশ্চিত নন। সন্মেলনে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যায়ের পক্ষে উপস্থাপন করলেও পুতিনের কর্মকান্ডকে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি নীতি থেকে খুব বেশি আলাদা করে দেখছেন না। মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র পুতিনের বিরুদ্ধে যতটা সোচ্চার হয়েছে, নিজেদের কর্মকান্ডকে ততটাই ঢেকে রেখেছে।

সংবাদ সন্মেলনে বাইডেন প্রশ্ন করেন যে, এমন যদি হতো যে, বাকি বিশ্ব মনে করছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এমন একটা রাষ্ট্র যা অন্য দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে, এবং সেটা সকলে জানতো? যুক্তরাষ্ট্র যদি রাশিয়ার মতো কর্মকান্ডে জড়িত হতো, তবে কেমন হতো? বাইডেন এই মন্তব্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে একটা নম্র এবং ভদ্র শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইলেও বাস্তবতা অন্যরকম। ‘কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটি’র এক গবেষণাপত্রে ডোভ লেভিন বলেন যে, ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৮৯এর মাঝে যুক্তরাষ্ট্র মোট ৬২ বার বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। এর বেশিরভাগই ছিল গোপন অপারেশন। আর ব্যাপারটা এমন নয় যে, যে প্রার্থী বেশি গণতন্ত্রী তাকেই মার্কিনীরা সমর্থন দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র তার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে, যে মার্কিন স্বার্থকে বেশি দেখবে। উদাহরণস্বরূপ, গায়ানাতে ১৯৬৮ সালের নির্বাচনে লিন্ডন জনসনের মার্কিন সরকার বামপন্থী গণতন্ত্রী চেড্ডি জাগানকে হারাতে গিয়ে ফোর্বস বার্নহ্যামকে সমর্থন দেয়। বার্নহ্যাম মার্কিন সহায়তায় ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে জেতেন এবং ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত একনায়ক হিসেবে দেশ শাসন করে যান। মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ সর্বদাই গণতন্ত্রের উপরে স্থান পেয়েছে। একারণেই বামপন্থী গণতন্ত্রীদেরকে যুক্তরাষ্ট্র ঠেকাতে চেয়েছে সর্বদা।

নিউ ইয়র্কের ‘সিটি ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর পিটার বেইনার্ট মার্কিন পত্রিকা ‘দ্যা আটলান্টিক’এর এক লেখায় বলছেন যে, মার্কিন জনগণ জানে না যে যুক্তরাষ্ট্র কত দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। তারা অনেকেই পছন্দ করবে যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করুক। কিন্তু এই অবস্থাটা বিপজ্জনক; কারণ ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে মার্কিন হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রকে প্রসার করার চাইতে ক্ষতিগ্রস্তই করেছে বেশি। ১৯৯৬ সালে রুশ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেতসিন আবারও জিততে চাইছিলেন। কিন্তু মারাত্মক অব্যাবস্থাপনায় রাশিয়ায় বেকারত্ব তখন চরমে; মুদ্রাস্ফীতির কারণে নাভিশ্বাস উঠেছে জনগণের। ইয়েলেতসিনের জনসমর্থন ছিল মাত্র ৬ শতাংশ! অথচ কমিউনিজম থেকে সদ্য পরিবর্তিত রাশিয়াতে গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে বিল ক্লিনটনের মার্কিন সরকার ইয়েলেতসিনের চাইতে ভালো কোন লোক খুঁজে পায়নি। মার্কিন সরকারের লবিংএর ফলশ্রুতিতে আইএমএফ রাশিয়াকে ১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেয়। ইয়েলেতসিন তার নির্বাচনী প্রচারণায় এই ফান্ড থেকেও খরচ করেছিলেন বলে জানা যায়। বিল ক্লিনটনের নির্বাচনী সহযোগী রিচার্ড ড্রেসনারসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ওয়াশিংটন থেকে মস্কো পাঠানো হয় নির্বাচনে ইয়েলেতসিনকে সহায়তা দেয়ার জন্যে। ইয়েলেতসিন নির্বাচনে জেতেন। ‘ওইসিডি’র নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল যেন নির্বাচনে অনিয়মের কথা প্রকাশ না করে, তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। এর অনেকদিন পর নির্বাচন পর্যবেক্ষক মাইকেল মেডোক্রফট বলেন যে, তার উপর চাপ সৃষ্টির কারণে তিনি অনিয়মের খবর প্রকাশ করতে পারেননি। ৫ লক্ষ ভোটারের চেচনিয়াতে ভোট দিয়েছিল ১০ লক্ষ মানুষ; তাও আবার সেখানে রুশদের ব্যাপক অত্যাচারের পরেও চেচেনরা নাকি ইয়েলেতসিনের পক্ষে ৭০ শতাংশ ভোট দিয়েছিল! সেসময় মস্কোতে মার্কিন দূতাবাসে কাজ করা থমাস গ্রাহাম মত দেন যে, অনিয়মের চাইতে ফলাফল বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল; তাই অনিয়মের ব্যাপারটা সকলেই এড়িয়ে গেছেন।

‘বিবিসি’ তাদের বিশ্লেষণে বলছে যে, বাইডেন বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যা চাইছে, রাশিয়া যদি তা না করে, তবে ওয়াশিংটন এর প্রত্যুত্তর দেবে। কিন্তু কিভাবে সেই প্রত্যুত্তর আসতে পারে, সেব্যাপারে সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে। ভ্লাদিমির পুতিনও হয়তো এই ব্যাপারটা নিয়েই চিন্তা করবেন যে, বাইডেন কথা এবং কাজের মাঝে পার্থক্য কতটা হতে পারে। বাইডেন হয়তো দুনিয়াকে একটা বার্তা দিতে চাইছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবারো ফিরে এসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করতে চাইছেন। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর ‘জি জিরো মিডিয়া’র এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মাঝে বিরোধের মূল যায়গা একটাই। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে যে, সে এখনও বৈশ্বিক সুপারপাওয়ার; অপরদিকে রাশিয়া দ্বিতীয় সাড়ির একটা শক্তি হিসেবে নিজেকে দেখতে চাইছে না। মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, এই বৈঠক রেগ্যান এবং গরবাচেভের বৈঠকের মত কিছু ছিল না। বরং যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মূল ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঝে একটা সাইড বৈঠক। বৈঠকের আগেও বোঝা যাচ্ছিল যে, এখান থেকে তেমন কিছু আসবে না। বৈঠকে মুখে যা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে; কারণ এখন পর্যন্ত বাইডেন সেব্যাপারে কোন শক্ত পদক্ষেপ দেখাতে পারেননি। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসাটা এখন মোটেই সহজ নয়। বিশ্লেষকদের কথায় যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ধরে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। অন্য একটা দেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ করাটা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের একার অধিকার ছিল। এখন আরেকটা শক্তিকে একই কাজ করা থেকে বিরত করতে পারার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে কিনা, সেব্যাপারে এখন কেউই নিশ্চিত নয়।

Sunday 13 June 2021

টুইটারের সাথে বিরোধ … নাইজেরিয়ার আস্তিত্বের সংকট?

১৩ই জুন ২০২১

২০১৭ সাল। নাইজেরিয়ার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের বায়াফ্রা অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন। পশ্চিম আফ্রিকায় নাইজেরিয়া সবচাইতে বড় এবং সম্পদশালী দেশ হলেও তার কৃত্রিম সীমানা তাকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করে রেখেছে। এই দুর্বলতা তাকে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল রেখেছে; যা আজও দৃশ্যমান। পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে দেশটার আশেপাশের অস্থিরতা নাইজেরিয়াকে টেনে নিলেও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে নাইজেরিয়া ভূরাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়নি; বরং পশ্চিমাদের নিজস্ব দ্বন্দ্বের শিকারে পরিণত হয়েছে।

 
১২ই জুন নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারি ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে এক টিভি ভাষণে দেশের উত্তর পূর্বে এবং দক্ষিণ পূর্বে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবণতির কথা স্বীকার করেন। ‘সিএনএন’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, গত ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৮’শর বেশি স্কুল ছাত্রীকে অপহরণ করা হয়েছে। বুহারি একইসাথে দেশের দারিদ্র্য এবং যুবকদের বেকারত্বের কথা উল্লেখ করেন এবং এসব সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। তবে বুহারির সমস্যা কমছে না; বরং বাড়ছে। ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে বুহারির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে; যেখানে ‘বুহারিকে অবশ্যই যেতে হবে’ লেখা প্লাকার্ড দেখায় মানুষ। প্রতিবাদকারীরা বুহারির কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করে; বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘টুইটার’কে নাইজেরিয়াতে বন্ধ করার সমালোচনা করে তারা। গত ৪ঠা জুন নাইজেরিয়ার সরকার সেদেশে টুইটার বন্ধ করে এই বলে যে, টুইটারকে ব্যবহার করে এমন কিছু কর্মকান্ড চালানো হচ্ছে, যা কিনা নাইজেরিয়ার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করতে পারে।

অনেকেই ধারণা করছেন যে, নাইজেরিয়ায় টুইটারকে বন্ধ করার পিছনে ১লা জুনের বুহারির টুইট বার্তার সম্পর্ক থাকতে পারে। সেই বার্তায় প্রেসিডেন্ট বুহারি দেশের দক্ষিণ পূর্বের বিচ্ছন্নতাকামী সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবার হুমকি দেন, যারা সেখানে নির্বাচন অফিসসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে। টুইটার বুহারির এই বার্তা মুছে ফেলে বলে যে, এই বার্তা টুইটারের নিয়মকানুন লঙ্ঘন করেছে। বুহারি ১৯৬০এর দশকে দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে ‘বায়াফ্রা’ অঞ্চলে ঘটে যাওয়া গৃহযুদ্ধের কথাই স্মরণ করেছিলেন; এবং সেই অঞ্চলে এরকম কোন বিচ্ছন্নতাবাদী আন্দোলন আবার যেন না দেখা দেয়, তিনি সেব্যাপারে সতর্ক করেন। ‘আল জাজিরা’র এক লেখায় নাইজেরিয়ার সাংবাদিক ফিসায়ো সোইয়োমবো মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ২০২০এর অক্টোবরে মার্কিন টেকনলজি কোম্পানি টুইটারের প্রধান নির্বাহী জ্যাক ডরসি এক টুইটার বার্তায় নাইজেরিয়ার ‘এন্ডসার্স’ আন্দোলনে বিটকয়েনের মাধ্যমে অর্থ দেবার জন্যে আনুরোধ করেন। সোইয়োমবো বলছেন যে, জ্যাক ডরসির এই টুইট বার্তার পরেই বোঝা গিয়েছিল যে, টুইটার নাইজেরিয়ার সরকারের সাথে সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে। টুইটার ছাড়া এই আন্দোলন হয়তো সম্ভব হতো না। ‘এন্ডসার্স’ হলো একটা আন্দোলন, যার মাধ্যমে নাইজেরিয়ার পুলিশের ‘স্পেশাল এন্টি রবারি স্কোয়াড’ বা ‘সার্স’কে ভেঙ্গে ফেলার দাবি জানানো হয়। ‘কোয়ার্টজ আফ্রিকা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০২০এর ১৩ই অক্টোবর পর্যন্ত ‘হ্যাশট্যাগ’এর মাধ্যমে টুইটারে ২ কোটি ৮০ লক্ষ বার ছড়ায় এই আন্দোলনের বার্তা। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেয়াপলসে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করার পর সোশাল মিডিয়াতে ফ্লয়েডের উপর অত্যাচারের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে পুলিশের সাথে দাঙ্গা শুরু হয়। নাইজেরিয়াতেও ফ্লয়েডের সূত্র ধরেই আন্দোলন হয়েছে। ২০২০এর ৩রা অক্টোবর টুইটারে একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায় যে, খুব সম্ভবতঃ ‘সার্স’ পুলিশ সদস্যরা নাইজেরিয়ার এক তরুণকে গুলি করছে। এর ফলশ্রুতিতে পুরো দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে বুহারির সরকারের দমনপীড়নের পদ্ধতি পরিস্থিতিকে আরও বেশি আশান্ত করে।

নাইজেরিয়া সরকারের তথ্যমন্ত্রী লাই মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন যে, নাইজেরিয়ার দক্ষিণ পূর্বের বিচ্ছন্নতাবাদী নেতা নামদি কানুর বিপজ্জনক টুইট বার্তা টুইটার কখনও মুছে না। কানু বিদেশে বসবাস করে নাইজেরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির উপর হামলা করার নির্দেশ দিচ্ছেন। নামদি কানু হলেন নাইজেরিয়ার দক্ষিণ পূর্বের ইগবো জাতি অধ্যুষিত বিচ্ছন্নতাবাদী ‘বায়াফ্রা’ এলাকার ‘ইন্ডিজেনাস পিপল অব বায়াফ্রা’ বা ‘আইপিওবি’এর নেতা; যিনি ১৯৬০এর দশকে ব্যর্থ হওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দলনকে জিইয়ে রেখেছেন। ২০১৫ সালে তিনি একবার গ্রেপ্তার হন; দু’বছর পর তাকে ছেড়েও দেয়া হয়। সাংবাদিক সোইয়োমবো বলছেন যে, দেশের দক্ষিণ পূর্বের কিছু অঞ্চল ছাড়া ইহুদী ধর্মের অনুসারী নামদি কানুর তেমন অনুসারী নেই। কিন্তু কানুর ব্যাপারে বুহারি সরকারের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার সূত্র ধরে নাইজেরিয়ার প্রায় ৪ কোটি টুইটার ব্যবহারকারীকেই অন্ধকারে নিপতিত করে দেয়াটা দেশব্যাপী বিক্ষোভ ডেকে এনেছে।

নাইজেরিয়া সরকার বলছে যে, টুইটার যদি নাইজেরিয়াতে অপারেট করতে চায়, তাহলে তাকে নাইজেরিয়াতে লাইসেন্স নিতে হবে। ‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভারত এবং নাইজেরিয়ার মতো বড় দুই দেশেই টুইটার সমস্যা পড়েছে। অথচ নিজেদের ব্যবসার সম্প্রসারণ চাইলে দুই দেশেই টুইটারের অপারেট করার কোন বিকল্প নেই। ভারত সরকার গত কয়েক মাস ধরেই টুইটারের সাথে বাকস্বাধীনতা বিষয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে। কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনের সাথেও মার্কিন সোশাল মিডিয়া কোম্পানিগুলির দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

‘ডয়েচে ভেলে’র সাথে কথা বলতে গিয়ে নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল্লাহি মোহামেদ কোলি বলেন যে, টুইটার নাইজেরিয়ার বিপক্ষে যারা কাজ করছে, তাদেরকে শক্তি যোগাচ্ছে। ‘আইপিওবি’ ছাড়াও আরও অনেক সংগঠন টুইটারকে কাজে লাগিয়ে নাইজেরিয়ার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে। টুইটার নাইজেরিয়াতে অফিস খোলা, রেজিস্টার করা, নাইজেরিয়ার আইন মানা, বা ট্যাক্স প্রদান করতে চাইছে না; যা নাইজেরিয়ার স্বার্থের বিরুদ্ধে। মোহামেদ কোলির কথাগুলি নাইজেরিয়ার সরকারের কথাগুলিকেই প্রতিফলিত করে। বায়াফ্রা গৃহযুদ্ধের অর্ধশতবর্ষ পরেও নাইজেরিয়া নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে লড়াই করছে। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কৃত্রিম ভৌগোলিক সীমানাকে রক্ষা করতে গিয়ে নাইজেরিয়ার নেতৃত্ব নিজ জনগণকেও দূরে ঠেলে দিয়েছে; দেশকে করেছে আরও দুর্বল। টুইটারের মতো মার্কিন টেকনলজি কোম্পানিগুলি নাইজেরিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ ব্রিটিশ কমনওয়েলথের দেশগুলির সাথে আইনগত দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে; যা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং কর্পোরেট আদর্শকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বায়াফ্রা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ডসহ কিছু ক্যাথোলিক খ্রিস্টান দেশ এবং সংস্থা বায়াফ্রাকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সহায়তা দিয়েছিল। প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়া সবচাইতে বড় সহায়তা পেয়েছিল ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। পশ্চিম আফ্রিকায় নাইজেরিয়া সবচাইতে বড় এবং সম্পদশালী দেশ হলেও তার কৃত্রিম সীমানা তাকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করে রেখেছে। এই দুর্বলতা তাকে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল রেখেছে; যা আজও দৃশ্যমান। পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে দেশটার আশেপাশের অস্থিরতা নাইজেরিয়াকে টেনে নিলেও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে নাইজেরিয়া ভূরাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়নি; বরং পশ্চিমাদের নিজস্ব দ্বন্দ্বের শিকারে পরিণত হয়েছে।

Wednesday 9 June 2021

জিব্রালটার প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু?

১০ই জুন ২০২১
১৯৭০এর দশকে স্পেন মরক্কো ছেড়ে আসলেও মরক্কোর উত্তর উপকূলে কয়েকটা বন্দরকে স্পেন ছিটমহল হিসেবে রেখে দেয়। ভবিষ্যতে জিব্রালটার প্রণালীর দক্ষিণ উপকূল নিয়ন্ত্রণে এই ছিটমহলগুলি ইউরোপের জন্যে কাজে দিতে পারে। ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মতো জনবিরোধী সিদ্ধান্তও মরক্কোর সরকার নিয়েছে পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি পাবার জন্যে। তবে এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপের সাথে মরক্কোর সম্পর্ক টানাপোড়েনের মাঝে পড়েছে। যদিও মরক্কোর সাথে ইউরোপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা কম, তথাপি মরক্কোর উত্তর উপকূলে স্পেনের ছিটমহলগুলি যখন হাজারো শরণার্থীর জোয়ারে ভেসে যাবার উপক্রম, তখন এই ছিটমহলগুলির সামনের দিনগুলিতে ইউরোপের ‘ব্রিজহেড’ হিসেবে থাকার সম্ভাবনা প্রশ্নের মুখে পড়ে।



মে এবং জুন মাসে হঠাত করেই উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কোর সাথে ইউরোপের, বিশেষ করে স্পেন এবং জার্মানির সম্পর্ক নিম্নমুখী হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমগুলি এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে বিতর্কিত পশ্চিম সাহারার কথা বললেও এর ভূরাজনৈতিক গভীরতা যথেষ্ট। এই গভীরতার একটা ধারণা পাওয়া যাবে মরক্কোর সাথে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ইতিহাস এবং বর্তমানে তাদের মাঝে সম্পর্কের দিকে তাকালে। তবে একইসাথে তাকাতে হবে মরক্কোর অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত অবস্থানের দিকে। মরক্কোর ব্যাপারগুলিকে কোন অবস্থাতেই ভূরাজনৈতিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিব্রালটার প্রণালীকে বাদ দিয়ে চিন্তা করা যাবে না।

পশ্চিম সাহারার সমস্যা ঔপনিবেশিক সময়ের

সপ্তদশ শতক থেকে স্পেন মরক্কোর উপকূলে কয়েকটা ছিটমহল উপনিবেশ হিসেবে দখল করে নেয়। ঊনিশ শতকের শেষ দিক থেকে পশ্চিম আফ্রিকার পুরোটাই ইউরোপিয় ঔপনিবেশিকদের অধীনে চলে যায়। ১৯০৬ সালে মরক্কোর সরকারের দুর্বলতার কারণ দেখিয়ে মরক্কোর দখল নিয়ে জার্মানি এবং ফ্রান্সের মাঝে দ্বন্দ্ব বাধলে ব্রিটেনের মধ্যস্ততায় মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ নেয় ইউরোপিয়রা। ১৯১২ সালে মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় স্পেন এবং ফ্রান্সের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফ্রিকায় নিজেদের উপনিবেশ থাকা অঞ্চলগুলিকে ইউরোপিয়রা নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী বিভক্ত করে অনেকগুলি নতুন রাষ্ট্র তৈরি করে। পশ্চিম আফ্রিকায় একইভাবে তৈরি করা হয় মরক্কো, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া এবং অন্যান্য দেশ। ফরাসিরা ১৯৫৬ সালে মরক্কো ছেড়ে যায়। মরক্কোর দক্ষিণ অঞ্চল ছিল স্পেনের অধিকারে; অন্যদিকে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলগুলি ছিল ফরাসিদের অধীনে। এই দেশগুলির সীমানাও ঔপনিবেশিকরা তৈরি করে; যা পরবর্তীতে বহু ধরনের সংঘাতের জন্ম দেয়। এরকমই একটা দ্বন্দ্ব হলো পশ্চিম সাহারার দ্বন্দ্ব। মরক্কোর দক্ষিণের পশ্চিম সাহারা অঞ্চলটা ছিল স্পেনের উপনিবেশ; যার নাম ছিল ‘রিও ডে অরো’। আঞ্চলিকভাবে অঞ্চলটা সাহরাউই নামে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে স্পেন এই অঞ্চল ছেড়ে যাবার সময় রিও ডে অরো অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করে নতুন তৈরি করা দুই দেশ মরক্কো এবং মৌরিতানিয়ার মাঝে বিতরণ করে। এরপরই সাহরাউই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেয়া পলিসারিও ফ্রন্টের সাথে মৌরিতানিয়া এবং মরক্কোর যুদ্ধ শুরু হয়। চার বছর যুদ্ধ করার পর ১৯৭৯ সালে মৌরিতানিয়া তাদের অংশ ছেড়ে দিয়ে পশ্চিম সাহারা ত্যাগ করে। কিন্তু মরক্কো যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে মরক্কোকে সামরিক সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র; আর পলিসারিওকে সোভিয়েত অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দেয় আলজেরিয়া এবং লিবিয়া। পলিসারিওর সকল অস্ত্রসস্ত্রই আলজেরিয়া হয়ে আসে এবং আলজেরিয়াকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেই পলিসারিও মরক্কোর সামরিক বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে যায়।। ১৯৮০এর দশকে মরক্কো পশ্চিম সাহারার মাঝ বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত ২ হাজার ৭’শ কিঃমিঃ লম্বা বালুর দেয়াল তৈরি করে। এই দেয়ালের ফলে যুদ্ধ মরক্কো সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে; এবং পলিসারিওর সামরিক জয় পাবার আশা স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হলে পশ্চিম সাহারার যুদ্ধও শেষ হয়ে যায়; এবং একটা যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। জাতিসংঘের একটা মিশনের মাধ্যমে এই যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করা হয়; যেখানে মরক্কো সরকারের অধীনে রয়েছে পশ্চিমের অংশ; আর পলিসারিওর হাতে রয়েছে আলজেরিয়ার সীমানা ঘেঁষে পূর্বের অংশ। এই সমস্যার একটা মূল ভিত্তি হলো কে এই সংঘাতকে কিভাবে দেখছে।

পশ্চিম সাহারার যুদ্ধ মরক্কোর সাথে অনেক দেশের সম্পর্ক নির্ধারণ করেছে। আরব দেশগুলি মরক্কোর পক্ষে থেকেছে; অন্যদিকে আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশই পলিসারিওর পক্ষ নিয়েছে। যুদ্ধের ফলে আলজেরিয়ার সাথে মরক্কোর সম্পর্ক বরাবরই খারাপ রয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলি সাহরাউই রিপাবলিককে স্বীকৃতি দিলে ১৯৮৪ সালে মরক্কো আফ্রিকান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যায়। তবে তিন দশক পর ২০১৭ সালে মরক্কো আবারও আফ্রিকান ইউনিয়নে প্রবেশ করে। ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, আফ্রিকার দেশগুলি মূলতঃ অর্থনৈতিক কারণেই মরক্কোর আফ্রিকান ইউনিয়নে ঢোকাকে সমর্থন করেছে। মরক্কো সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকার দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে; যার উদ্দেশ্যই ছিল আফ্রিকান ইউনিয়নে ঢোকার পথ প্রসারিত করা। ৩৯টা দেশ মরক্কোর পক্ষে ভোট দেয়; তবে ৯টা বিপক্ষে থাকে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, বিপক্ষে ভোট দেয়া দেশগুলি মূলতঃ আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশ। সাহরাউইএর ব্যাপারে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অবস্থান দেখলে বোঝা যাবে যে, বিপক্ষে ভোট দেয়া দেশগুলির মাঝে খুব সম্ভবতঃ দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, এঙ্গোলা থাকতে পারে। কারণ এই দেশগুলি মরক্কোর আফ্রিকান ইউনিয়নে যোগ দেয়ার সরাসরি বিরোধিতা করেছিল।
 
পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর তৈরি করা বালির দেয়াল। ১৯৮০এর দশকে মরক্কো ২ হাজার ৭’শ কিঃমিঃ লম্বা বালুর দেয়াল তৈরি করে। এই দেয়ালের ফলে যুদ্ধ মরক্কো সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে; এবং পলিসারিওর সামরিক জয় পাবার আশা স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হলে পশ্চিম সাহারার যুদ্ধও শেষ হয়ে যায়; এবং একটা যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তবে মরক্কোর প্রায় ২ লক্ষ সদস্যের সেনাবাহিনী পশ্চিম সাহারায় ব্যস্ত থেকে জিব্রালটার এবং স্প্যানিশ ছিটমহলগুলি থেকে যে দূরে থাকছে, সেব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি চিন্তিত হবার কথা নয়। 


স্পেনের সাথে দ্বন্দ্ব

মে মাসের মাঝামাঝি হঠাত করেই মরক্কো থেকে স্পেনের ছিটমহল সেউতাতে ৮ হাজার শরণার্থী ঢুকে পড়ে। স্পেন বলছে যে, মরক্কো তার সীমানা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে; যার ফলে হাজার হাজার শরণার্থী সেউতায় ঢুকেছে। সাধারণতঃ শরণার্থীদের নিয়ন্ত্রণে মরক্কো স্পেনকে যথেষ্ট সহায়তা করে থাকে। ‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এপ্রিল মাসে স্পেন পশ্চিম সাহারার পলিসারিওর নেতা ব্রাহিম ঘালিকে স্পেনের এক হাসপাতালে করনোভাইরাসের চিকিৎসার জন্যে ভর্তি করে। মরক্কো বলছে যে, স্পেন মরক্কোকে না জানিয়ে পশ্চিম সাহারা পলিসারিওর নেতাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। অনেকেই বলছেন যে, এর প্রতিশোধ হিসেবেই মে মাসে মরক্কোর নিরাপত্তা বাহিনী কিছু সময়ের জন্যে শরণার্থীদের উপর থেকে তাদের নজরদারি সরিয়ে ফেলে; যার ফলশ্রুতিতে হাজারো শরণার্থী সেউতায় ঢুকে পড়ে। একই সময়ে স্পেনের পক্ষ থেকে পশ্চিম সাহারা নিয়ে বিবৃতি আসতে থাকে। স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাঞ্চা গোঞ্জালেজ লায়া বলেন যে, স্পেন পশ্চিম সাহার ব্যাপারে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করবে। স্পেন চায় সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান।

৬ই জুন মরক্কোর সরকার ঘোষণা দেয় যে, মরক্কো স্পেনের সাথে সমুদ্রে যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, ইউরোপে বসবাসকারী প্রায় ৩০ লক্ষ মরক্কোর নাগরিকের বেশিরভাগই স্পেন হয়ে মরক্কো যেতো। তবে মরক্কো সরকার ফরাসি এবং ইতালিয় বন্দরগুলির সাথে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক রাখবে বলে বলেছে। কারণ হিসেবে মরক্কোর সরকার করোনাভাইরাসের কথা বললেও অনেকেই মনে করছেন যে, এর সাথে দুই দেশের মাঝে চলমান উত্তেজনার সম্পর্ক থাকতে পারে।

‘আল জাজিরা’ জানাচ্ছে যে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ইউরোপিয় আদালতে মরক্কোর সাথে ইইউএর বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে শুনানি হয়। পলিসারিওর পক্ষ থেকে এই চুক্তির বিরোধিতা করে ইইউএর কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল। পলিসারিও বলছে যে, মরক্কো পশ্চিম সাহারার সম্পদ লুন্ঠন করছে; যার মাঝে রয়েছে রক ফসফেট, কৃষিদ্রব্য এবং পশ্চিম সাহারার উপকূলের মৎস্যসম্পদ। অনেকেই মনে করছেন যে, এই বছরের শেষের দিকে আদালয়ের যে রায় আসবে, তা পলিসারিওর পক্ষে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। ইইউ আদালতের রায় মরক্কোর বিপক্ষে গেলে মরক্কোর সাথে ইইউএর সম্পর্কে নতুন করে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।

জার্মানির সাথে দ্বন্দ্ব

মরক্কো ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এবং যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার ১১ দিনের মাথায় ২০২০এর ২১শে ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জার্মানির রাষ্ট্রদূত ক্রিসটফ হিউসগেন পশ্চিম সাহারা নিয়ে একটা রুদ্ধদ্বার বৈঠকের ডাক দেন। তার উপস্থাপনায় হিউসগেন বলেন যে, পশ্চিম সাহারার সমস্যার মূলে রয়েছে মরক্কো। হিউসগেন পলিসারিওর সামরিক দুর্বলতার অবস্থান উল্লেখ করেন। পলিসারিও যুদ্ধবিরতি ভাঙলেও তিনি এর জন্যে মরক্কোকে দায়ি করেন। আর পলিসারিও যদি আশাহত হয়, তবে তারা উগ্রবাদী হয়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ২০১৯ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত হিসেবে প্রাক্তন জার্মান প্রেসিডেন্ট কোহলারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, কোহলার অসুস্থ হয়ে যাবার পর থেকে কথাবার্তা থেমে গেছে। জার্মানি চাইছে যে, পশ্চিম সাহারা নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হোক এবং রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান হোক। জার্মান রাষ্ট্রদূত তার মার্কিন বন্ধুদেরকে শক্ত অবস্থান নেবার কথা বলেন।

পশ্চিম সাহারার বিষয়ে জাতিসংঘে জার্মানির বৈঠক ডাকার কারণ দেখিয়ে চার মাস পর ২০২১এর মে মাসের শুরুতে মরক্কো বার্লিনে তার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে। ২০২০এর শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পশ্চিম সাহারাতে মরক্কোর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়ার পরেও মরক্কোর বিরুদ্ধে জার্মানির অবস্থানের ব্যাপক সমালোচনা করে মরক্কো। মরক্কো ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সেই স্বীকৃতি পেয়েছিল। এক বিবৃতিতে মরক্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে যে, জার্মানি গঠনমূলক সমাধানের পথে না হেঁটে ধংসাত্মক মনোভাব দেখাচ্ছে। একইসাথে মরক্কো বলে যে, জার্মানি মরক্কোর প্রভাব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সর্বদা; বিশেষ করে লিবিয়া ইস্যুর কথা উল্লেখ করা হয়। ২০২০এর জানুয়ারিতে বার্লিনে লিবিয়া নিয়ে আলোচনায় মরক্কোকে বাদ দেয়ার জন্যে জার্মান সরকারকে অভিযুক্ত করা হয়। ‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, গত মার্চে মরক্কো সরকার তাদের সরকারি দপ্তরগুলিকে জার্মান দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে নির্দেশ দেয়।

‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে স্প্যানিশ সাংবাদিক ইগনাসিও সেমব্রেরো বলছেন যে, মরক্কো চাইছে যে, ইইউ এবং প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তি স্পেনের উপর চাপ সৃষ্টি করে পশ্চিম সাহারার উপর মরক্কোর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নেয়া। তবে আপাততঃ ইইউ এব্যাপারে মরক্কোকে স্বীকৃতি দেবে বলে মনে করছেন না সেমব্রেরো; অন্ততঃ প্রকাশ্যে নয়। মরক্কো এবং জার্মানির অর্থনৈতিক সম্পর্ক কিন্তু বেশ ভালো। মরক্কোর সপ্তম বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী হলো জার্মানি। এছাড়াও ২০২০ সালেই জার্মানির কাছ থেকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ এবং অনুদান পেয়েছে মরক্কো।
 
২০১৮ সাল। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর সাথে মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ। মরক্কোর নিরাপত্তা চিন্তায় ইউরোপ সবসময়ই রূঢ় বাস্তবতা; কারণ ইউরোপ মরক্কোকে ভূমধ্যসাগরে ঢোকার পশ্চিম দরজার দক্ষিণ পাল্লা হিসেবে দেখে। একারণেই বিংশ শতকে ইউরোপিয় উপনিবেশ হওয়া থেকে বাঁচতে পারেনি মরক্কো; যার ফলশ্রুতিতে বর্তমান মরক্কো অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তবে নির্ভরশীলতা একমুখী নয় মোটেই; কারণ ইউরোপিয়রাও মরক্কোতে তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা চায়।  


ইউরোপের উপর মরক্কোর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা

মরক্কো হলো পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফসফেট উৎপাদক। রক ফসফেট খনিজ থেকে ফসফেট সার তৈরি হয়। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথেসাথে ফসফেট সারের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টন রক ফসফেট উৎপাদন হয়; যার প্রায় এক তৃতীয়াংশই মরক্কোতে উৎপাদিত হয়। তবে পুরো দুনিয়ার প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টন রক ফসফেট রিজার্ভের মাঝে শুধু মরক্কো এবং পশ্চিম সাহারাতেই পাওয়া গেছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টন। মরক্কোর প্রায় সকল রক ফসফেট উৎপাদন করে সরকারি মালিকানার কোম্পানি ‘ওসিপি’। ১৯৭৬ সালে পশ্চিম সাহারা মরক্কো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেবার পর থেকে সেখানকার ‘বৌ ক্রা’ এবং ‘লাইউনি’ খনি থেকে ফসফেট উত্তোলন শুরু হয়। বর্তমানে ‘ওসিপি’র প্রায় ৮ শতাংশ উৎপাদন পশ্চিম সাহারার এই খনি থেকে আসে।

‘আইএইচএস মার্কিট’এর হিসেবে বিশ্বের প্রায় অর্থেক রক ফসফেটের ব্যবহারকারী হলো চীন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপ মিলে প্রায় এক চতুর্থাংশ ব্যবহার করে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য এবং আমেরিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশ ফসফেটের গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা। যদিও অর্থের হিসেবে ফসফেট এবং আনুসাঙ্গিক পণ্য মরক্কোর সবচাইতে বড় রপ্তানি পণ্য নয়, তথাপি বিশ্বব্যাপী শস্য উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে ফসফেট মরক্কোকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে।

‘ওইসি’র হিসেবে মরক্কোর সবচাইতে বড় রপ্তানি বাজার হলো স্পেন; যেখানে প্রায় ২৩ শতাংশ রপ্তানি হয়। এরপর প্রায় ২০ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফ্রান্স; ৪ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ইতালি; সাড়ে ৩ শতাংশ নিয়ে চতুর্থ স্থানে জার্মানি। এছাড়াও ইউরোপের দেশগুলির মাঝে ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম এবং রাশিয়া মরক্কোর গুরুত্বপূর্ণ বাজার। ইউরোপের বাইরে রয়েছে ভারত, তুরস্ক, চীন এবং জাপান। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির সাথে মরক্কোর নির্ভরশীলতা ফসফেট নিয়ে নয়; গাড়ি, ইনসুলেটেড তার এবং গার্মেন্টস পণ্যের মতো তৈরি পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করে মরক্কো; যা কিনা ইউরোপের উপর মরক্কোকে নির্ভরশীল করেছে। মরক্কোতে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ফ্রান্স এবং স্পেন এগিয়ে আছে। মরক্কোর মাটিতে ফরাসি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ‘রেনো’ এবং ‘পোঁজো’ বিনিয়োগ করেছে।

মরক্কোর বিশাল সাড়ে তিন হাজার কিঃমিঃ লম্বা উপকূল সামুদ্রিক মাছের একটা বড় উৎস; অথচ মরক্কোর নিজের সক্ষমতা নেই গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ করার। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ‘এফএও’এর হিসেবে মরক্কোর বাৎসরিক সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এবং চাষ প্রায় ১৫ লক্ষ টন; যা আফ্রিকার বৃহত্তম এবং বিশ্বে ১৭তম। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ মৎস্য আহরণ এবং চাষের উপর নির্ভরশীল। প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয় মৎস্য রপ্তানি করে; যার বেশিরভাগটাই যায় ইউরোপে। ১৯৯৬ সালে ইইউএর সাথে চুক্তি অনুযায়ী মরক্কো তার দেশের উপকূলে ইইউএর, বিশেষ করে স্পেনের জাহাজগুলিকে মাছ ধরার অনুমতি দেয়। এর বিনিময়ে মরক্কো ইইউএর কাছ থেকে বাৎসরিক অর্থ সহায়তা পায়। ২০১৬ সালে মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ পশ্চিম সাহারার দাখলা উদ এদদাহাব উপকূল অঞ্চলে বিভিন্ন মৎস্যজাতীয় চাষের প্রকল্প উদ্ভোধন করেন। এই প্রকল্পগুলিতে ইউরোপিয় দেশগুলি ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। ২০১৯ সালে ইইউ মরক্কোর সাথে এক চুক্তি করে; যার মাধ্যমে পশ্চিম সাহারা উপকূলে ইইউ মাছ ধরার অনুমতি পায়। ‘এএফপি’র হিসেবে চার বছরের এই চুক্তির মাধ্যমে মরক্কো ইইউ থেকে ১’শ ৫৩ মিলিয়ন ইউরো পাবে। ইইউএর পার্লামেন্টে পাস হওয়া এই চুক্তির বিপক্ষে রয়েছে পশ্চিম সাহারার লবিং গ্রুপ। পলিসারিওর উপদেষ্টা নূর বকর ‘আরএফআই’কে বলছেন যে, ইউরোপের আদালতে তারা সকল প্রকারের চেষ্টা চালাবেন মরক্কোর সাথে এই চুক্তি বাতিল করতে। ইউরোপিয়ান কমিশনের হিসেবে ২০১৯ সালে মরক্কো পশ্চিম সাহারা থেকে ৫’শ ২৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যের মৎস্য এবং কৃষিজ পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করে।

পশ্চিম সাহারার ফসফেট ইউরোপের সাথে বাণিজ্যে বড় কোন ইস্যু না হলেও মরক্কো ইইউএর উপর অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্টই নির্ভরশীল। আর সেই হিসেবে ইউরোপের আদালতে পশ্চিম সাহারার অভিযোগ মরক্কোর জন্যে বিরক্তির ব্যাপার হতে পারে। তবে মরক্কো যেমন ইইউএর উপর নির্ভরশীল, তেমনি মরক্কোতে বড় বিনিয়োগও ইইউএর দেশগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মরক্কোর বিরুদ্ধে ইইউ আদালতের যেকোন সিদ্ধান্ত ইউরোপিয় কোম্পানিগুলিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মরক্কোর ৩২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির বিপরীতে আমদানি হলো প্রায় ৪৯ বিলিয়ন ডলার। আমদানি এবং রপ্তানির মাঝে বড় ব্যবধান দেশটার অর্থনীতিকে ব্যাতিব্যস্ত রেখেছে। এমতাবস্থায় মরক্কোও এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে যাবে না, যা কিনা দেশটার অর্থনীতিকে আরও চাপের মাঝে ফেলবে।

জিব্রালটার প্রণালী উত্তর ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার সাথে ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার সংযোগপথ। একসময় প্রাকৃতিক কারণে মরক্কোর উপকূলে বড় বন্দর নির্মাণ কঠিন হলেও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথেসাথে মরক্কোর উপকূলে বড় বড় সমুদ্রবন্দর তৈরি হতে থাকে। এর ফলে জিব্রালটার প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ বহুকাল জিব্রালটার এবং স্পেনের উপর নির্ভরশীল হলেও এখন মরক্কোও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। একারণেই মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী দেশগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। 


ভূকৌশলগত দিক থেকে মরক্কোর অতি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান

মরক্কো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ভৌগোলিক অবস্থান ধরে রেখেছে, যা কিনা ভূকৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মরক্কোর উত্তর উপকূল জিব্রালটার প্রণালির দক্ষিণ কূল নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯০৬ সালে মরক্কোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী ইউরোপিয় দেশগুলি ব্রিটেনের একটা শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ব্রিটেন বলেছিল যে, মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ যার কাছেই যাক না কেন, জিব্রালটারের উল্টো পাসে মরক্কোর উত্তর উপকূলে কোন বন্দরে দুর্গ তৈরি করা যাবে না। ব্রিটেন বিশেষ করে খেয়াল রেখেছিল জার্মানি যেন মরক্কোর উপর প্রভাব বিস্তার করে সেখানে একটা নৌঘাঁটি করে ফেলতে না পারে। এটা জিব্রালটারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্রিটেনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৭০এর দশকে স্পেন মরক্কো ছেড়ে আসলেও মরক্কোর উত্তর উপকূলে কয়েকটা বন্দরকে স্পেন ছিটমহল হিসেবে রেখে দেয়। ভবিষ্যতে জিব্রালটার প্রণালীর দক্ষিণ উপকূল নিয়ন্ত্রণে এই ছিটমহলগুলি ইউরোপের জন্যে কাজে দিতে পারে। এগুলির মাঝে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেউতা এবং মেলিলা। সেউতার পাশেই মরক্কোর তাঞ্জিয়ার এবং তাঞ্জিয়ার মেড জিব্রালটারের উল্টো দিকে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।

জিব্রালটার প্রণালী উত্তর ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার সাথে ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার সংযোগপথ। ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি এই প্রণালীর মধ্য দিয়ে যাওয়া বাণিজ্যপথের উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। ফ্রান্সের আটলান্টিক উপকূলের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের সংযোগও জিব্রালটারের মাধ্যমে। তাই এই সংযোগপথের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে ইউরোপিয়দের কাছে মরক্কোর গুরুত্ব সর্বদাই বেশি ছিল। একসময় প্রাকৃতিক কারণে মরক্কোর উপকূলে বড় বন্দর নির্মাণ কঠিন হলেও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথেসাথে মরক্কোর উপকূলে বড় বড় সমুদ্রবন্দর তৈরি হতে থাকে। এর ফলে জিব্রালটার প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ বহুকাল জিব্রালটার এবং স্পেনের উপর নির্ভরশীল হলেও এখন মরক্কোও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। একারণেই মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী দেশগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও মরক্কো হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের মাঝে অবস্থিত একটা দরজা। এর মাঝ দিয়ে মার্কিন সামরিক বিমানগুলি উড়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া আসা করে। মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলিও এই পথে ভূমধ্যসাগর এবং মধ্যপ্রাচ্যে যায়। কাজেই মার্কিনীরাও মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ রাখতে মরক্কোর নিয়ন্ত্রণ চায়।

মরক্কো নিজের অবস্থানকে ব্যবহার করে আফ্রিকার গ্যাস ইউরোপে রপ্তানি করতে চাইছে। আলজেরিয়া থেকে একটা পাইপলাইনের মাধ্যমে মরক্কো হয়ে গ্যাস রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপে। আরেকটা পাইপলাইনের মাধ্যমে নাইজেরিয়ার গ্যাস ইউরোপে রপ্তানি করতে চাইছে মরক্কো। এই পাইপলাইনগুলি নিয়ে মরক্কোর সাথে আলজেরিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে।

মরক্কোর সাথে পশ্চিম আফ্রিকার অন্যান্য দেশের সড়ক যোগাযোগের একমাত্র পথ হল পশ্চিম সাহারার মাঝ দিয়ে যাওয়া একটা মাত্র রাস্তা। ২০২০এর নভেম্বরে প্রায় দু’শ মালবাহী ট্রাক মৌরিতানিয়ার সীমানায় আটকে থেকে অভিযোগ করে যে, মিলিশিয়ারা রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। এরপরই মরক্কো এই রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে পশ্চিম সাহারার দক্ষিণে মৌরিতানিয়ার সীমানায় গুরগেরাত বাফার জোনে সেনা মোতায়েন করে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’এর রিকার্ডো ফাবিয়ানি ‘আল জাজিরা’কে বলেন যে, নতুন করে শুরু হওয়া এই উত্তেজনার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে। আলজেরিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তর মরক্কোর এই সামরিক মিশনের সমালোচনা করে বিবৃতি দেয়।
 
২০১৩ সাল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ। মরক্কোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহুকালের। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ভূমধ্যসাগরে ঢোকার একটা পথ হলো জিব্রালটার। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখতে মরক্কো একটা দরজার মতো। আরব দেশগুলিও সেকারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাবার জন্যে মরক্কোর এই ‘দরজা’ খোলা দেখতে চায়। ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচতেই মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়েছিল।  

মরক্কোর যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক রাজনীতি

মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পুরোনো বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি হবার সময়েই মরক্কোর সুলতান মোহাম্মদ বেন আব্দেল্লাহ ১৭৭৭ সালে ব্রিটেনের চোখ রাঙ্গানো উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ১৭৮৬ সালে মরক্কোর করা বন্ধুত্বের চুক্তি এখনও বলবত রয়েছে। ১৯০৬ সালে ইউরোপিয় শক্তিরা মরক্কোর দখল নেবার সময় যুক্তরাষ্ট্র এর বিরোধিতা করেছিল। ১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পরের বছরেই মরক্কোর রাজা পঞ্চম মোহাম্মদ ওয়াশিংটন সফর করেন। পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় হাসানও কয়েকবার ওয়াশিংটন সফর করেন। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবেই থাকে। ১৯৯৯ সাল থেকে পরবর্তী রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে তার পূর্ববর্তীদের নীতি অনুসরণ করেন। ১৯৮৭ সালে মরক্কোর সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের দেশের বিমান ঘাঁটিগুলি ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় মার্কিন সামরিক অপারেশন চালাতে মরক্কোর বিমান ঘাঁটিগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পলিসারিওর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মরক্কোকে সামরিক সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এই সামরিক সহায়তার পিছনে অর্থায়ন সৌদি আরব করে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। ওয়াশিংটনে মরক্কোর পক্ষে শক্তিশালী লবিং গ্রুপ থাকায় পশ্চিম সাহারা ইস্যুতে মার্কিন সরকার মরক্কোকে সরাসরি সমর্থন না করলেও যুক্তরাষ্ট্র মূলতঃ মরক্কোর পক্ষেই থাকে। মার্কিনীরা পশ্চিম সাহার জন্যে মরক্কোর অধীনে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে লবিং করতে থাকে।

২০১৯ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোর কাছে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যে ২৫টা ‘এফ ১৬ ব্লক ৭২’ ফাইটার বিমান বিক্রয়ের অনুমোদন দেয়; এবং আরও প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারে বর্তমানে মরক্কোর বিমান বাহিনীতে থাকা ২৩টা ‘এফ ১৬’ বিমানকে আপগ্রেড করার কথা বলে। একই বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর মরক্কোর কাছে আরও ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়। ‘ডিফেন্স নিউজ’ বলছে যে, এর মাঝে ছিল ‘এফ ১৬’ যুদ্ধবিমানে ব্যবহারের জন্যে ৫ হাজার ৮’শ ‘মার্ক ৮২’ বোমা, ৩’শ ‘মার্ক ৮৪’ বোমা, ১’শ ৫টা ‘জেডিএএম’ বোমার কিট, ১’শ ৮০টা ‘জিবিইউ ১০’ বোমার কিট, ৪ হাজার ১’শ ২৫টা ‘জিবিইউ ১২’ বোমার কিট। এছাড়াও ৪’শ টা লঞ্চার সহ ২ হাজার ৪’শটা ‘টিওডব্লিউ’ ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এক বছরের মাঝে মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের অস্ত্র কেনার অনুমোদন পায়।

২০২০এর ১০ই ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর সার্বভোমত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। পরদিনই যুক্তরাষ্ট্র মরক্কোর কাছে আরও ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির ঘোষণা দেয়। ‘রয়টার্স’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এই অস্ত্রের মাঝে রয়েছে চারটা ‘এমকিউ ৯বি সী গার্ডিয়ান’ ড্রোন এবং ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘পেইভওয়ে’ ও ‘জেডিএএম’ বোমা। এই অস্ত্রগুলি পশ্চিম সাহারা নিয়ে পুনরায় সংঘাত শুরু হলে মরক্কোকে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে রাখবে।

জিব্রালটার প্রণালী নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র বনাম ইউরোপ

মরক্কোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহুকালের। যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ভূমধ্যসাগরে ঢোকার একটা পথ হলো জিব্রালটার। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ধরে রাখতে মরক্কো একটা দরজার মতো। আরব দেশগুলিও সেকারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাবার জন্যে মরক্কোর এই ‘দরজা’ খোলা দেখতে চায়। ইউরোপের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচতেই মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়েছিল। মরক্কোর নিরাপত্তা চিন্তায় ইউরোপ সবসময়ই রূঢ় বাস্তবতা; কারণ ইউরোপ মরক্কোকে ভূমধ্যসাগরে ঢোকার পশ্চিম দরজার দক্ষিণ পাল্লা হিসেবে দেখে। একারণেই বিংশ শতকে ইউরোপিয় উপনিবেশ হওয়া থেকে বাঁচতে পারেনি মরক্কো; যার ফলশ্রুতিতে বর্তমান মরক্কো অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তবে নির্ভরশীলতা একমুখী নয় মোটেই; কারণ ইউরোপিয়রাও মরক্কোতে তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা চায়।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব ইউরোপের সাথে দরকষাকষিতে মরক্কোকে শক্ত ভিত্তি দেয়। একারণেই ১৯৭০এর দশক থেকে সামরিক শক্তি দিয়ে পশ্চিম সাহারাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেও মরক্কোর উপর কোন অবরোধ কেউ দিতে পারেনি। উল্টো পলিসারিওর সাথে যুদ্ধে মরক্কো যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্র পেয়েছে। তবে মরক্কোর প্রায় ২ লক্ষ সদস্যের সেনাবাহিনী পশ্চিম সাহারায় ব্যস্ত থেকে জিব্রালটার এবং স্প্যানিশ ছিটমহলগুলি থেকে যে দূরে থাকছে, সেব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি চিন্তিত হবার কথা নয়। পশ্চিম সাহারার ফ্রন্টলাইন অনেকদিন ঠান্ডা থাকার পর আবারও উত্তপ্ত হচ্ছে; যা মূলতঃ পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থারই ফলাফল। সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা মরক্কোর উপর ইউরোপের চাপ বৃদ্ধির পিছনে বড় কারণ। ইস্রাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের মতো জনবিরোধী সিদ্ধান্তও মরক্কোর সরকার নিয়েছে পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি পাবার জন্যে। তবে এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপের সাথে মরক্কোর সম্পর্ক টানাপোড়েনের মাঝে পড়েছে। যদিও মরক্কোর সাথে ইউরোপের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা কম, তথাপি মরক্কোর উত্তর উপকূলে স্পেনের ছিটমহলগুলি যখন হাজারো শরণার্থীর জোয়ারে ভেসে যাবার উপক্রম, তখন এই ছিটমহলগুলির সামনের দিনগুলিতে ইউরোপের ‘ব্রিজহেড’ হিসেবে থাকার সম্ভাবনা প্রশ্নের মুখে পড়ে। জিব্রালটার প্রণালীর উভয় উপকূল নিয়ন্ত্রণে রাখা ইউরোপের জন্যে ততক্ষণই কঠিন, যতক্ষণ যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী হাতে মরক্কোর নিরাপত্তার দায়ভার নিতে পারবে। সাম্প্রতিক সময়ে মরক্কোর জন্যে বিপুল সামরিক সহায়তা ইউরোপের জন্যে সেই বার্তা বহণ করে।

Friday 4 June 2021

জার্মানি কেন নিজস্ব ভূরাজনৈতিক কৌশল প্রণয়ন করছে?

০৪ঠা জুন ২০২১

জার্মানরা বুঝতে পারছে যে, ঠান্ডা যুদ্ধের পর তৈরি করা বিশ্বব্যবস্থা এখন পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়ছে। তাই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে অনুসরণ করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন গত্যন্তর নেই। তবে ২০৪০ সালের কৌশল বলে দিচ্ছে যে, ন্যাটো, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে জার্মানি এখনও এককভাবে নিজের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এগুবার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়।


জার্মান সরকার সাম্প্রতিক সময়ে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা ২০২১ সালে ইন্দোপ্যাসিফিকে তাদের নৌবাহিনীর একটা ফ্রিগেট মোতায়েন করবে। ২০০২ সালের পর থেকে এশিয়ার সমুদ্রে জার্মান নৌবাহিনী প্রথমবারের মতো আনাগোণা করবে। কিন্তু জার্মানির ইন্দোপ্যাসিফিকে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণের উদ্দেশ্য কি? অনেকেই বলছেন যে, এটা চীনের প্রতি একটা বার্তা। আবার কেউ কেউ বলছেন যে, এটা জার্মানির বন্ধুদের প্রতিই একটা বার্তা। তবে এখানে প্রথম প্রশ্ন হলো, এটা কি জার্মান কৌশলগত চিন্তায় কোন পরিবর্তনের প্রতিফলন কিনা।

জার্মানির কৌশলগত চিন্তায় পরিবর্তন কেন?

জার্মানির রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা কিভাবে চিন্তা করছেন, তার একটা সম্যক ধারণ পাওয়া যাবে ২০১৭ সালে ফাঁস হওয়া একটা গোপন দলিল থেকে। জার্মান পত্রিকা ‘ডের স্পাইজেল’ জার্মান সেনাবাহিনীর প্ল্যানিং অফিসের ১’শ ২ পৃষ্ঠার ২০৪০ সাল পর্যন্ত কৌশলগত ভবিষ্যৎবাণীর এই দলিল ফাঁস করে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি প্রথমবারের মতো এরকম একটা দলিল তৈরি করেছে। পত্রিকাটা বলছে যে, এই দলিল লেখা হয়েছিল ২০১৫ সালের দিকে। ২০৪০ সাল পর্যন্ত ভূরাজনৈতিক ঘটনাবলীকে মোটামুটি ছয়টা সম্ভাবনার মাঝে আলোচনা করা হয়। প্রথম দু’টা সম্ভাবনাই মূলতঃ ইইউএর সমস্যা নিয়ে; যেখানে বলা হচ্ছে যে, ইইউ ব্যাপক সমস্যার মাঝে থাকলেও আটলান্টিকের ওপাড়ের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক রাখার মাধ্যমে কোনমতে টিকে থাকবে। এর মাঝে জার্মানির নিরাপত্তার ফোকাস থাকবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সহায়তায় শান্তি রক্ষার কাজ করা।

তৃতীয় সম্ভাবনাটা হলো পশ্চিমা দুনিয়ায় উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়া; যার কেন্দ্রে থাকবে জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং সন্ত্রাসবাদ। চতুর্থ সম্ভাবনা হলো ইউরোপ এবং চীনে অর্থনৈতিক মন্দা। জার্মানির প্রধান দুই বাজার হলো এগুলি। সুতরাং এদের মন্দা মানেই জার্মানিও অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক হুমকিতে পড়বে।

পঞ্চম সম্ভাবনা হলো পশ্চিমের সাথে পূর্বের প্রতিযোগিতার বৃদ্ধি। এখানে পশ্চিম বলতে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো হয়েছে; ইইউকে বাদ দিয়ে চিন্তা করা হয়েছে। অপরদিকে পূর্বকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে চীন এবং রাশিয়া হিসেবে। তবে এই উত্তেজনা বড় কোন সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে তারা মনে করছেন না। তাদের ধারণা, বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রগুলি যুদ্ধ এড়িয়ে যাবে। এই দ্বন্দ্বে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ হয়তো রাশিয়ার পক্ষ নিতে পারে।

ষষ্ঠ সম্ভাবনাটা হলো সবচাইতে মারাত্মক। তারা বলছেন যে, এটার মানে হলো ইইউ পুরোপুরি ভেঙ্গে যাবে; এবং একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক নেতৃত্বকে ধরে রাখতে পারবে না। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং তা থামাবার ক্ষমতা পশ্চিমা দুনিয়ার কারুরই থাকবে না।

এই বিশ্লেষণের অর্থ হলো, জার্মানরা মনে করছে যে, সামনের দিনগুলি আরও অনেক বেশি অনিশ্চিত হবে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জিওপলিটিক্যাল ফিউচার্স’ বা ‘জিপিএফ’এর বিশ্লেষণে জার্মানির সমস্যাগুলিকে সহজভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা ইইউএর মাঝে ফাঁটল ধরায়। অর্থনৈতিক চাপে পড়ে একেক দেশ একেকভাবে চিন্তা করতে থাকে। এই ফাঁটল আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে যখন সিরিয়া যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার শরণার্থী ইউরোপে প্রবেশ করতে থাকে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি শরণার্থীদেরকে তাদের দেশের উপর দিয়ে যেতে দেয়; কারণ শরণার্থীরা পশ্চিম ইউরোপেই যেতে চাইছিল। এরপর ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নিলে ন্যাটোর মাঝে ফাঁটল দেখা দেয়। জার্মানি রাশিয়ার গ্যাসের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল; অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে জার্মানি যাতে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা না রাখে। জার্মানির উল্টো পথে হাঁটছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলই; যারা রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের উপর বেশি নির্ভরশীল হতে থাকে।

‘জিপিএফ’ বলছে যে, ইউরোপে জাতীয়তাবাদ বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করবে; যা জার্মানির রপ্তানিভিত্তিক অর্থনীতিকে আঘাত করবে। অর্থাৎ এতে ইইউএর কাঠামো ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকবে। জার্মানি ইইউএর মাঝে ছিল শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে নয়। জার্মানরা মনে করেছে যে, ইইউএর ভেতরে থাকার মাধ্যমে জার্মানি ইউরোপের মাটিতে তার অপর প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে সংঘাত এড়াতে পারবে। অপর এই প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ফ্রান্স। অপরদিকে ২০১৪ সালের পর থেকে জার্মানি বুঝতে শুরু করে যে, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে নিজের স্বার্থ হিসেবে আর চিন্তা করা যাবে না। কাজেই নিজের স্বার্থ অনুযায়ী কৌশল ঠিক করার সময় এসেছে। তবে ‘জিপিএফ’ বলছে যে, জার্মানরা নিজেদেরকে অনিরাপদ ভাবা শুরু করলে তারা নিজেদের সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করবে; যা কিনা যুক্তরাষ্ট্র অনেকদিন থেকেই চাইছে।

 
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের দ্বন্দ্বে নিশ্চিতভাবে কোন পক্ষ নিতে জার্মানি বাধ্যবাধকতার মাঝে পড়তে চাইছে না; বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো জার্মানি নিজস্ব স্বকীয়তা পেতে চাইছে। তথাপি অদূর ভবিষ্যতে জার্মানি হয়তো ইন্দোপ্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্বে জড়াবে না; বরং জার্মানি নিজের অর্থনৈতিক শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই মোতায়েন করছে।



জার্মানরা কিভাবে তাদের সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চাইছে?

ব্রিটিশ ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় জার্মানির পটসড্যাম ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর ম্যাক্সিমিলিয়ান টেরহাল বলছেন যে, ১৯৪৯ সালে যে চিন্তা নিয়ে ন্যাটো গঠিত হয়েছিল, সেটারই একটা পরিবর্তিত ধরন নিয়ে একুশ শতকের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। ১৯৪৯ সালে যেখানে বলা হয়েছিল যে, ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে ভেতরে রাখার জন্যে এবং একইসাথে রাশিয়াকে বাইরে রাখা এবং জার্মানিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে। এখন ২০২০এর দশকে এসে কথাগুলির প্রথম দুই অংশ এক রেখে শুধু জার্মানির স্থানে চীনকে বসাতে করতে হবে। তিনি বলছেন যে, চীনারা তাদের প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে ইউরোপিয় ইউনিয়নের দুর্বল দেশগুলিকে টার্গেট করছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের মহামারির মাঝে ইতালি এবং গ্রিসের চীনা বিনিয়োগের লোভের মাঝে পড়ে যাবার কথা বলছেন তিনি। তার মতে জার্মানির উচিত হবে ইইউএর এহেন দুর্বল সময়ে ইউরোপের নেতৃত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো যে, চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে ইউরোপের দরকার রয়েছে। টেহহাল রাশিয়াকে ইউরোপের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন; এবং মনে করছেন যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে কোন সংঘাতে জড়িয়ে পরে, তাহলে রাশিয়া ইউরোপের সিমানায় নিজের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নেবে। তখন যারা রাশিয়ার শক্তি কমে গেছে বলে বলছেন, তারা দু’বার চিন্তা করতে বাধ্য হবেন। তিনি ইউরোপের সকল দেশের সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করার পক্ষপাতি। এভাবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপের ব্যাপারে আগ্রহী করে রাখতে চাইছেন এবং একইসাথে রুশ হুমকিকে মোকাবিলা করার কথা বলছেন। দুনিয়ার উপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্ব ধরে রাখতে ইউরোপকে একত্রিত হতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রকেও সাথে রাখতে হবে বলে বলছেন তিনি। আর সেই আঙ্গিকে বিশ্বব্যাপী চলমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে বাস্তবতা ধরে এঙ্গেলা মার্কেলের পর জার্মানির নতুন চ্যান্সেলরকে ইউরোপের নেতৃত্ব দেবার চেষ্টা করতে হবে।

জার্মান সামরিক বাহিনীর ক্রয় পরিদপ্তরের কর্মকর্তা ডমিনিক ঊল্লার্স অবশ্য ইউরোপের একমত হবার ব্যাপারে অতটা আশাবাদী নন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যখন তার শক্তিকে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করছে, তখন ইউরোপকে যেমনি আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে, তেমনি ইউরোপের প্রধান দেশগুলিকেও আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে। 'ওয়ার অন দ্যা রকস' ম্যাগাজিনের এক লেখায় তিনি উদাহরণস্বরূপ গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত জার্মান সরকারের ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলকে টেনে নিয়ে আসেন। তিনি বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মানিতে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে সেই আলোকে নিজস্ব স্বার্থের উপর ভিত্তি করে কৌশল প্রণয়ন করাটা কারুর কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু জার্মানি এখন সেই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকেই তার কৌশল প্রণয়নের কেন্দ্রে রেখেছে। ইউরোপে চীনাদের অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার জার্মানির অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতি হুমকি হওয়ায় জার্মানি ইউরোপে চীনাদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। অপরদিকে ইন্দোপ্যাসিফিকের ৪’শ কোটি মানুষের বিশাল বাজার এবং সেখানকার বিশাল জনশক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শিল্প অবকাঠামো জার্মানির অর্থনৈতিক স্বার্থকে ধরে রাখার জন্যে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অত্র অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথগুলির নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জ জার্মানির নিরাপত্তার জন্যে হুমকি। একারণেই জার্মানি তার অর্থনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করতে ইন্দোপ্যাসিফিকে নৌবাহিনীর একটা জাহাজ পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে জার্মানি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক আইনকে রক্ষা করার ব্রত নিয়ে অন্যান্য ইউরোপিয় দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একই লক্ষ্যে কাজ করবে, তেমনি একইসাথে নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করতে নিজস্ব কৌশল বাস্তবায়ন করবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের দ্বন্দ্বে নিশ্চিতভাবে কোন পক্ষ নিতে জার্মানি বাধ্যবাধকতার মাঝে পড়তে চাইছে না; বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো জার্মানি নিজস্ব স্বকীয়তা পেতে চাইছে। তথাপি অদূর ভবিষ্যতে জার্মানি হয়তো ইন্দোপ্যাসিফিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্বে জড়াবে না; বরং জার্মানি নিজের অর্থনৈতিক শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই মোতায়েন করছে।

 
আফগানিস্তানে কৌশলগত ব্যর্থতা জার্মান নেতৃত্বের প্রতি জার্মান সেনাদের বিশ্বস্ততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একারণেই জার্মান সেনাদের মাঝে উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ বা ‘এএফডি’র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আফগানিস্তান মিশনের কারণেই জার্মানরা এখন প্রশ্ন করছে যে, প্রতি বছর ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে একটা সামরিক বাহিনী পোষার অর্থ কি? জার্মান সরকারের কাছে এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।


জার্মান সামরিক বাহিনী … ন্যাটোর অধীনে কতদিন?

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে জার্মান সেনাদের থাকার মেয়াদ আরও ১০ মাস বাড়িয়ে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত করা হয়েছে। জার্মানরা প্রশ্ন করছে যে, এই মিশন আসলে কতটা সফল হয়েছে? এই মিশনের পিছনে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। প্রায় ১৩’শ জার্মান সেনা আফগানিস্তানে মোতায়েন রয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৯ জন সেনা সেখানকার সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছে। ‘ইউনিভার্সিটি অব পটসড্যাম’এর প্রফেসর সোনকা নাইতজেল বলছেন যে, আফগানিস্তানে যাবার পিছনে জার্মানদের কোন কৌশলগত চিন্তাই ছিল না। তারা অন্ধভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে অনুসরণ করেছে। তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোডার সেপ্টেম্বর ১১এর ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহমর্মিতা দেখাতে আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করেছিল। চিন্তাটা ছিল এমন যে, ছয় মাসের মাঝেই সেই সেনাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। পরবর্তীতে চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল মনে করেছেন যে, আফগানিস্তানে সৈন্য রাখার মাধ্যমে জার্মানি ন্যাটো, জাতিসংঘ এবং ইইউএর মাঝে নিজের প্রভাব ধরে রাখছে। তাই সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত পিছাতে পিছাতে দুই দশকে ঠেকেছে। আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত জার্মান সেনাদেরকে বলা হয়েছে যে, তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা তাদের দায়িত্ব নয়। অন্যদিকে বহুজাতিক বাহিনীর কমান্ডাররা যুদ্ধ করতে গিয়ে জার্মান সেনাদেরকে পাশে না পেয়ে তাদেরকে ভিতু বলে আখ্যা দিয়েছে।

জার্মানরা তাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি মুছে ফেলার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। তাই সৈন্যদেরকে যুদ্ধ করতে বলার মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জার্মান নেতৃবৃন্দ নিতে পারছে না। জার্মানরা ন্যাটো মিশনে গিয়েছে; কিন্তু তাদের ইতিহাসের ভয়ে তারা ন্যাটোর লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেনি। তারা ন্যাটোর মাঝে সর্বদাই ‘কিছুটা জড়িত’ থেকেছে। একারণেই আফগানিস্তানের কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলিতেও জার্মানরা অংশগ্রহণ করতে পারেনি; তাদেরকে দ্বিতীয় সাড়ির গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। নাইতজেল বলছেন যে, আফগানিস্তানে কৌশলগত ব্যর্থতা জার্মান নেতৃত্বের প্রতি জার্মান সেনাদের বিশ্বস্ততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একারণেই জার্মান সেনাদের মাঝে উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ বা ‘এএফডি’র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নাইতজেল বলছেন যে, আফগানিস্তান মিশনের কারণেই জার্মানরা এখন প্রশ্ন করছে যে, প্রতি বছর ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে একটা সামরিক বাহিনী পোষার অর্থ কি? জার্মান সরকারের কাছে এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।

জার্মান সামরিক বাহিনীর ওয়েবসাইট বলছে যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৭’শ জার্মান সেনা মোতায়েন রয়েছে। এদের সকলেরই মিশন হলো শান্তিরক্ষা করা। আফগানিস্তানে ন্যাটোর অধীনে মিশন ছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার মালিতে ফরাসিদের সহায়তা করার জন্যে জাতিসংঘের অধীনে ৯’শ জার্মান সেনা মোতায়েন রয়েছে সেখানে। মোটকথা এই সবগুলির কোনটাই জার্মানির নিজস্ব মিশন নয়। কিন্তু জার্মান নেতৃত্ব মনে করছে যে, ন্যাটো এবং জাতিসংঘের অধীনে এই মিশনগুলি আন্তর্জাতিকভাবে জার্মানির প্রভাব ধরে রাখার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ।

নতুন জার্মান প্রতিরক্ষানীতি … কতটুকু বাস্তব?

২০১৬ সালে জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক শ্বেতপত্রেও প্রায় একই ধরনের চিন্তার উল্লেখ রয়েছে। জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল এই শ্বেতপত্রের ভূমিকায় লেখেন যে, সাম্প্রতিক বছরগুলি দেখিয়ে দেয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গঠন করা ইউরোপিয় ব্যবস্থা যত সফলই হোক না কেন, এই সফলতা চিরস্থায়ী নয়। একুশ শতকে ইউরোপে সামরিক শক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সীমানা পরিবর্তন হবে; এটা কেউ চিন্তাই করেনি। প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘আর্মি টেকনলজি’র এক প্রতিবেদনে শ্বেতপত্রের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এতকাল জার্মানি তার সামরিক শক্তিকে ন্যাটোর অধীনেই মোতায়েন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের পরিস্থিতি জার্মানদেরকে সক্রিয় প্রতিরক্ষানীতি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে। একসময় জার্মানি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশন ছাড়া, অথবা ন্যাটোর কাঠামোর বাইরে সামরিক বাহিনী পাঠানো থেকে দূরে থেকেছে। এখন ন্যাটোর বাইরে অন্য কোন স্থানে সামরিক শক্তি মোতায়েনকে জার্মানরা স্বাভাবিক হিসেবে চিন্তা করতে শুরু করেছে।

শ্বেতপত্রে জার্মানির সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়। ২০২৩ সালের মাঝে সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১৪ হাজার ৩’শ বৃদ্ধি করতে চাইছে জার্মানি। তবে জার্মানির সামরিক বাহিনী বহুদিন ধরে কম বাজেটের উপর চলার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৪ সালে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, নৌবাহিনীর বেশিরভাগ সাবমেরিন সার্ভসের বাইরে রয়েছে; সেনাবাহিনীর ‘বক্সার’ আর্মার্ড ভেহিকলগুলির ৪০ শতাংশেরও কম কর্মক্ষম রয়েছে; নৌবাহিনীর ৪২টা ‘এনএইচ ৯০’ হেলিকপ্টারের মাঝে মাত্র ৭টা ওড়ার মতো অবস্থায় রয়েছে। এই হেলিকপ্টার ক্রয়ের প্রকল্প এতটাই সমস্যার মাঝে পতিত হয়েছে যে, ২’শ হেলিকপ্টার ক্রয়ের লক্ষ্য থাকলেও এখন কেনা হচ্ছে মাত্র ৮২টা। সামরিক বাজেট যতটা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, তা প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। আর নতুন ভূরাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তা কতটুকু বাস্তবমুখী হবে, তা প্রশ্ন করাই যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মানরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে। ইইউএর মাঝে জার্মানির অবস্থান মূলতঃ অর্থনৈতিক কারণে মনে হলেও সেটাও আসলে ফ্রান্সের সাথে সংঘাত এড়াবার জন্যে। কিন্তু একুশ শতকে পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থা জার্মানিকে বাস্তবতা শেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীন যখন ইউরোপের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে, তখন ইউরোপের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হিমসিম খাচ্ছে জার্মানি। উল্টো রাশিয়ার গ্যাসের উপর জার্মান নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে বার্লিনের নেতৃত্বকে। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে বড় কোন যুদ্ধের আশংকামুক্ত থাকায় জার্মান সামরিক বাজেটে কৃপণতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে মরচে পড়া জার্মান অস্ত্রসস্ত্রের উপর। আর ন্যাটোকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে আফগানিস্তানের যুদ্ধে অর্থহীনভাবে জড়িয়ে পড়াকে রাজনৈতিকভাবে বৈধতা দিতে গিয়ে জার্মানিতে উগ্র জাতিয়তাবাদের উত্থান হচ্ছে। জার্মানরা বুঝতে পারছে যে, ঠান্ডা যুদ্ধের পর তৈরি করা বিশ্বব্যবস্থা এখন পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়ছে। তাই ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে অনুসরণ করা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন গত্যন্তর নেই। তবে ২০৪০ সালের কৌশল বলে দিচ্ছে যে, ন্যাটো, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে জার্মানি এখনও এককভাবে নিজের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এগুবার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়।

Tuesday 1 June 2021

‘ওয়ান চাইল্ড’ থেকে ‘থ্রি চাইল্ড’ ... কোন পথে চীন?

০২রা জুন ২০২১ 
‘ওয়ান চাইল্ড’ নীতির কারণে চীনে যেমন অবিবাহিত মধ্যবয়সী পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি শহরাঞ্চলে বেশি খরচের ভয়ে মহিলারা একের বেশি সন্তান নিতে না চাওয়ায় ‘টু চাইল্ড’ এবং ‘থ্রি চাইল্ড’ নীতির সফলতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অর্থনীতিকে এতটা প্রাধান্য দেয়ার পরেও চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। মানুষের প্রবৃত্তিকে এড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়ার ফলশ্রুতিতে সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতি, সবগুলিই এখন ঝুঁকির মাঝে পড়েছে; যা সামনের দিনগুলিতে চীনের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।


গত ৩১শে মে চীন ঘোষণা করেছে যে, চীনা দম্পতিরা এখন থেকে সর্বোচ্চ তিনজন সন্তান গ্রহণ করতে পারবেন। চীনা বার্তা সংস্থা ‘শিনহুয়া’ জানাচ্ছে যে, পলিটব্যুরোর বৈঠকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন। মে মাসের শুরুতে প্রকাশিত আদম শুমারিরতে দেখা যায় যে, ২০২০ সালে চীনে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ শিশু জন্ম নিয়েছে; যা কিনা ২০১৬ সালে ছিল ১ কোটি ৮০ লক্ষ। ১৯৬০এর দশকের পর থেকে এটা সর্বনিম্ন সংখ্যা। ২০১৬ সালে চীনা সরকার তাদের ‘ওয়ান চাইল্ড’ নীতিতে পরিবর্তন এনে দম্পতিদেরকে দু’টা সন্তান গ্রহণ করতে অনুমতি দেয়। সেই অনুমতির পর থেকে দুই বছরের জন্যে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও তা আবারও অবনতির দিকে যেতে থাকে। চার বছরের মাথায়ই চীনা সরকার সেই নীতিতে দ্বিতীয়বারের মতো পরিবর্তন আনলো। ১৯৭৯ সালে চীনা সরকার নিয়ম করেছিল যে, চীনা দম্পতিরা একটার বেশি সন্তান গ্রহণ করতে পারবে না। যে পরিবার এই নিয়ম মানেনি, তাদেরকে জরিমানা এবং চাকুরিচ্যুত করা ছাড়াও গর্ভপাতে বাধ্য করা হয়েছিল। বারংবার নীতি পরিবর্তনের একদিকে যেমন অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তেমনি তা চীনের তথা বিশ্বের ভূরাজনীতিতেও ভূমিকা রাখবে।

‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনের ‘ওয়ান চাইল্ড’ নীতির কারণে দেশটাতে পুরুষ মহিলার অনুপাতে মারাত্মক ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। বেশিরভাগ পরিবারই একটা সন্তান নেবার ব্যাপারে ছেলে সন্তানকে গুরুত্ব দিতে থাকে। ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’এর প্রফেসর মু ঝেং বলছেন যে, চীনা সরকারের এই নীতির ফলে আর্থসামাজিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নিচের ঘরে জন্ম নেয়া পুরুষরা বিয়ের জন্যে পাত্রী পেতে ব্যর্থ হয়। বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা ‘রয়টার্স’ বলছে যে, পরিবর্তিত নিয়ম চীনের একেক অঞ্চলে একেকভাবে প্রতিফলিত হবে। বড় শহরগুলিতে জীবনযাত্রার খরচ বেশি হওয়ায় অনেক মহিলাই আরেকটা সন্তান গ্রহণ করতে দু’বার চিন্তা করবে; অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের মানুষ খরচের চাইতে পরিবারের রীতিকেই বেশি গুরুত্ব দেবে। এতে নতুন ধরনের আর্থসামাজিক সমস্যার জন্ম হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন যে, যেহেতু কয়েক দশকে চীনের অর্থনীতির আকার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই চীনের জনসংখ্যা কমে যাবার ব্যাপারটা সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ চীনের অর্থনীতিকে বড় করতে যথেষ্ট সংখ্যক নবীন জনগণ পাওয়া যাবে না; বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়বে প্রতিনিয়ত। ২০১০ সালে যেখানে জনসংখ্যার ৯ শতাংশ ছিল ৬৫ বছরের উপর; সেখানে ২০২০ সালে তা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশে। চীনা সরকার জনগণের অবসরে যাবার বয়স বাড়িয়ে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে পারে।

‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীনের বাজারভিত্তিক অর্থনীতি সেদেশে ব্যাপকহারে বেশ্যাবৃত্তির জন্ম দিয়েছে। যদিও চীনে বেশ্যাবৃত্তি বেআইনী, তথাপি জনসংখ্যার মাঝে মহিলার সংখ্যা কম হওয়ায় এবং বহু মানুষ শহরের শিল্পাঞ্চলে কাজের জন্যে চলে আসার কারণে বেশ্যাবৃত্তিকে থামানো যাচ্ছে না। ‘হাফিংটন পোস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ‘হ্যাপি এনডিং’এর নামে সেখানে বেশ্যাবৃত্তি চলছে। কিছু শহরে ম্যাসাজ পার্লারের নামে চলছে বেশ্যাবৃত্তি। ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে বেশ্যাবৃত্তির ব্যাপক প্রসার হচ্ছে। চীনে এখন মানুষ বিক্রি না হলেও মানুষ ভাড়ায় পাওয়া যাচ্ছে!
 
২০১৬ সালে উইঘুরে প্রতি এক লক্ষ জনগণের মাঝে ৫০ জনকে বন্ধ্যা করে ফেলা হচ্ছিল; ২০১৮ সাল নাগাদ তা পাঁচ গুণ বেড়ে প্রতি লক্ষে ২’শ ৪৩এ গিয়ে দাঁড়ায়! অথচ পুরো চীনের জন্যে এই সংখ্যা হলো এক লক্ষে মাত্র ৩৩ জন! অর্থাৎ পুরো চীনের তুলনায় উইঘুরে বন্ধ্যাত্ব ৭ গুণেরও বেশি! চীনা সরকারের জনহার নিয়ন্ত্রণের নীতি পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিলে উইঘুরের মত বিদ্রোহী অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সরকারি চেষ্টাকে বৈধতা দেয়া কঠিন হবে।


‘সিএনএন’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, কিছু সমালোচক প্রশ্ন করছেন যে, চীনা সরকার কেন তাদের দম্পতিদের সর্বোচ্চ তিনটা সন্তান নিতে অনুমতি দিচ্ছে? কেন তারা এটা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিচ্ছে না? এর উত্তর হয়তো চীনের পশ্চিমের মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়ান বা উইঘুর প্রদেশের নীতিতে পাওয়া যাবে। সেখানে চীনা সরকার মুসলিমদের জন্ম হার মারাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৬ সালে উইঘুরে প্রতি এক লক্ষ জনগণের মাঝে ৫০ জনকে বন্ধ্যা করে ফেলা হচ্ছিল; ২০১৮ সাল নাগাদ তা পাঁচ গুণ বেড়ে প্রতি লক্ষে ২’শ ৪৩এ গিয়ে দাঁড়ায়! অথচ পুরো চীনের জন্যে এই সংখ্যা হলো এক লক্ষে মাত্র ৩৩ জন! অর্থাৎ পুরো চীনের তুলনায় উইঘুরে বন্ধ্যাত্ব ৭ গুণেরও বেশি! শিনজিয়াং সরকারের হিসেবে ২০১৭ সালে সেখানে জন্ম হার ছিল প্রতি হাজারে প্রায় ১৬ জন; ২০১৮ সালে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় প্রতি হাজারে প্রায় ১১ জনেরও কম। অর্থাৎ এক বছরের মাঝে জন্মহার প্রায় ৩৩ শতাংশ কমে গেছে! শিনজিয়াং সরকার বলছে যে, এটা তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি বাস্তবায়নের ফলাফল। অনেকেই বলছেন যে, চীনা সরকারের জনহার নিয়ন্ত্রণের নীতি পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিলে উইঘুরের মত বিদ্রোহী অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সরকারি চেষ্টাকে বৈধতা দেয়া কঠিন হবে।

‘ওয়ান চাইল্ড’ নীতির কারণে চীনে যেমন অবিবাহিত মধ্যবয়সী পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি শহরাঞ্চলে বেশি খরচের ভয়ে মহিলারা একের বেশি সন্তান নিতে না চাওয়ায় ‘টু চাইল্ড’ এবং ‘থ্রি চাইল্ড’ নীতির সফলতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অধিক সংখ্যক বৃদ্ধ মানুষ এবং কমসংখ্যক নবীন কর্মক্ষম মানুষ চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আগের মতো এগিয়ে নিতে পারবে কিনা, সেব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলিকে প্রাধান্য দিয়েই ১৯৭৯ সালে ‘ওয়ান চাইল্ড’ নীতিতে যায় চীন; আবার ২০২১ সালে এসে অর্থনৈতিক কারণেই ‘থ্রি চাইল্ড’ নীতির সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অর্থনীতিকে এতটা প্রাধান্য দেয়ার পরেও চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নয়। সন্তান নেবার ক্ষেত্রে শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য যেমন নতুন সামাজিক অসঙ্গতির জন্ম দেবে, তেমনি উইঘুরের মতো মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৈষম্যমূলক নীতি বাস্তবায়নের কারণে রাজনৈতিক সমস্যাও কম হবে না। অর্থনৈতিক কারণেই চীনারা পুরুষ সন্তানকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে; এখন বিয়ের জন্যে কনে পাবার সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় এবং প্রবৃত্তিকে পরিতৃপ্ত করার আর কোন আইনী পদ্ধতি না থাকায় সেদেশে বেশ্যাবৃত্তি থামানো যাচ্ছে না। মানুষের প্রবৃত্তিকে এড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়ার ফলশ্রুতিতে সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতি, সবগুলিই এখন ঝুঁকির মাঝে পড়েছে; যা সামনের দিনগুলিতে চীনের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।