Sunday 24 February 2019

পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ‘গানবোট ডিপ্লোম্যাসি’র নেপথ্যে...

২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ 
ইজিয়ান সাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে গ্রীস এবং তুরস্কের যে বিরোধ রয়েছে, তা আসলে বহু বছরের ইতিহাসের ফলাফল। ইজিয়ানের দ্বীপগুলি গ্রীসের দখলে চলে যাবার কারণেই তুরস্ক সমুদ্রসীমা থেকে বঞ্চিত। দ্বীপ দখলের সেই খেলায় ইউরোপিয়রা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে; আর দেখিয়ে দিয়েছে যে, জোর যার, সম্পদ তার। 




পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সাম্প্রতিককালে খণিজ সম্পদকে কেন্দ্র করে এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সাগরের পানির নিচে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল এক সম্ভার আবিষ্কৃত হবার পর থেকে অত্র এলাকার দেশগুলি- তুরস্ক, লেবানন, ইস্রাইল, মিশর, গ্রীস এবং সাইপ্রাসের মাঝে শুরু হয়েছে এক প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার মাঝে অতি গুরুত্ব পাচ্ছে দেশগুলির সমুদ্রসীমা। সমুদ্রসীমা উপকূল থেকে কত কিঃমিঃ পর্যন্ত প্রসারিত হবে, সেটা আলোচনাতে প্রাধান্য পেলেও আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো উপকূলের মালিকানা নির্ধারণ। অর্থাৎ যে উপকূলের উপরে ভিত্তি করে সেই সমুদ্রসীমা আঁকা হবে, সেই উপকূলের মালিকানা নিয়েই এখনও বিরোধ শেষ হয়নি। এখানে মূল বিরোধের জায়গা হলো পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দ্বীপগুলি। এই দ্বীপগুলির মালিকানা নিয়ে বিরোধ আছে বলেই সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের সমাধান হচ্ছেনা। দ্বীপগুলির মালিকানা নিয়ে বিরোধ মূলতঃ তুরস্ক এবং গ্রীসের। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে দেশগুলি অত্র অঞ্চলে নৌ-শক্তি বৃদ্ধি করছে এবং বিভিন্ন মিডিয়াতে সেখানকার ‘গানবোট ডিপ্লোম্যাসি’ প্রাধান্য পাচ্ছে। এই দ্বীপগুলির মালিকানার একটা ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে ধারণা করা যেতে পারে যে কেন আজকের এই বিরোধ চলছে।

ইউরোপিয়রা যেভাবে গ্রীসকে আলাদা দেশ হিসেবে তৈরি করলো...

আধুনিককালের গ্রীস একসময় তুর্কী উথমানি খিলাফতের অধীনে ছিল। পঞ্চদশ শতকের শেষ নাগাদ বর্তমান গ্রীসের মূল ভূখন্ড এবং ইজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলির প্রায় পুরোটাই উথমানি শাসনের অধীনে চলে আসে। শুধুমাত্র ক্রীট এবং সাইপ্রাস দ্বীপ দু’টা ভেনিসের অধীনে রয়ে যায়। ভেনিস বর্তমানে ইতালির অধীনে হলেও ঊনিশ শতকে ইতালির একত্রীকরণের আগ পর্যন্ত ভেনিস আলাদা রাষ্ট্র ছিল। উথমানিরা ভেনিসের হাত থেকে সাইপ্রাস দখল করে নেয় ১৫৭১ সালে এবং ক্রীট দখল করে ১৬৭০ সালে। গ্রীকরা ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী হবার কারণে রাশিয়ার একপ্রকার ধর্মীয় প্রভাব ছিল গ্রীসের উপর। রাশিয়া নিজের শক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেবার সাথে সাথে উথমানি শাসনের অধীনে থাকা পূর্ব ইউরোপের অর্থোডক্স চার্চের অনুসারীদের নেতৃত্ব নেবার চেষ্টা করতে থাকে। এভাবে পূর্ব ইউরোপে বিভিন্ন যুদ্ধ এবং বিদ্রোহে রাশিয়া সরাসরি ইন্ধন যোগায়। ইউরোপের অন্যান্য শক্তিগুলি – ব্রিটেন, ফ্রান্স,আস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী, এবং পরবর্তীতে ইতালি – সর্বদাই চেয়েছে ইউরোপে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটাতে। সেই হিসেবে সবগুলি শক্তিরই লক্ষ্য ছিল উথমানিদের থেকে অঞ্চল কেড়ে নেয়া। তবে এই কাড়াকাড়ির মাঝে ইউরোপের শক্তিরা নিজেদের মাঝেও প্রতিযোগিতা করেছে। যেমন পূর্ব ইউরোপে ভূমি দখলের জন্যে রাশিয়া প্রতিযোগিতা করেছে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাথে। আবার ব্রিটেন ও ফ্রান্স চেয়েছে যেন রুশরা ভূমধ্যসাগরের উপকূলে চলে না আসে। রাশিয়াকে স্থলবেষ্টিত রাখাটা ব্রিটিশ-ফরাসীদের কৌশলের অংশ ছিল সর্বদাই; এখনও তা-ই।

উথমানিদের হাত থেকে ভূমি দখলের সেই প্রতিযোগিতায় ব্রিটেন-ফ্রান্স গ্রীসের নিয়ন্ত্রণ নেবার ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে অগ্রগামী ভূমিকা নিয়ে ফেলে। তবে তা সম্পূর্ণ হতে ঊনিশ শতক শেষ হয়ে যায়। ইউরোপের দেশগুলি গ্রীকদেরকে বহুবার ব্যবহার করেছে উথমানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। যখনই উথমানিরা ইউরোপিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়েছে, তখনই গ্রীকরা বিদ্রোহ শুরু করেছে, অথবা ইউরোপিয়ানদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেবার চেষ্টা করেছে।

- অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে রিগাস ফেরাইওস (১৭৫৭-১৭৯৮) নামের এক গ্রীকের হাত ধরেই উথমানিদের থেকে গ্রীসের আলাদা হবার কর্মকান্ড শুরু হয়। ফরাসী বিপ্লবের মতো কিছু একটা করে উথমানি রাজ্য ভেঙ্গে ফেলার উদ্দেশ্যে তিনি ১৭৯৩ সালে ফরাসী জেনারেল ন্যাপোলিয়ন বোনাপার্টের সহায়তা চান। তিনি চাইছিলেন বলকানের খ্রিষ্টানদেরকে উথমানি খিলাফত থেকে আলাদা করে ফেলা। পরবর্তীতে ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে গ্রীসে যে বিদ্রোহ হয়েছিল, তা ফেরাইওস-এর চিন্তাকে উপজীব্য করেই।

- ১৮১৪ সালে ওডেসাতে (বর্তমান ইউক্রেনের অংশ; তৎকালীন রাশিয়ার অংশ) তিনজন গ্রীক মিলিত হয়ে ‘ফিলিকা এটেরিয়া’ বা ‘সোসাইটি অব ফ্রেন্ডস’ নামের একটা গোপন সংস্থা গঠন করে। এদের মাঝে নিকোলাস স্কুফাস আসেন বর্তমান গ্রীসের এপিরাস এলাকা থেকে; ইমানুইল জানথোস আসেন ইতালি থেকে; আথানাসিওস শাকালভ আসেন প্যারিস থেকে। পরে আন্তোনিওস কমিজোপাউলোস যোগ দেন মস্কো থেকে।

- ১৮১৪ থেকে ১৮১৭ পর্যন্ত এই সিক্রেট সোসাইটির সদস্যসংখ্যা সীমিত থাকলেও ১৮১৮ থেকে ১৮২১-এর মাঝে ‘ফিলিকা এটেরিয়া’র ব্যাপ্তি পুরো বলকানে ছড়িয়ে পড়ে। সদস্যদের মাঝে গ্রীক ছাড়াও সার্বরাও ছিল, যারা অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী। রুশ সেনাবাহিনীর অফিসার আলেক্সান্দ্রোস ইপসিলান্তিস সামরিক বিদ্রোহের নেতৃত্ব নেন ১৮২০ সালে।

- ১৮২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলকানে বিদ্রোহ শুরু হলে উথমানি সেনাবাহিনীর বড় একটা অংশ সেখানে ব্যস্ত হয়ে যায়, যেই সুযোগে গ্রীসের দক্ষিণের পিলপনেসাস-এ বিদ্রোহ শুরু হয় মার্চে।

- ১৮২৬ সালের মাঝে উথমানি সেনাবাহিনী গ্রীকদের বিরুদ্ধে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলে ইউরোপিয় দেশগুলি একত্রে সরাসরি যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। ১৮২৭ সালের নভেম্বরে নাভারিনোর নৌযুদ্ধে উথমানি নৌবাহিনীকে পরাজিত করে ব্রিটিশ-ফরাসি-রুশ যৌথ নৌবাহিনী। একইসাথে ১৮২৮ সালের অগাস্টে ফরাসী সেনাবাহিনীর প্রায় ১৫ হাজার সৈন্য পিলপনেসাস-এ অবতরণ করে গ্রীকদের পক্ষে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে।

- ১৮৩০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডন প্রোটোকলের মাধ্যমে গ্রীসকে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর ১৮৩২ সালের লন্ডন কনফারেন্সে (ইউরোপিয়রা ইস্তাম্বুল ডাকতো না) ইউরোপিয়ান শক্তিরা গ্রীসের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়।

- সেই সীমানায় উত্তর গ্রীসের থেসালি, এপিরাস, মেসিডোনিয়া এবং থ্রেস অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ইজিয়ান সাগরের পূর্ব দিকের বেশিরভাগ দ্বীপও সেই সীমানার মাঝে পড়েনি। ক্রীট এবং সাইপ্রাসও ছিল না; দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জও ছিল না। বর্তমান তুরস্কের উপকূলে অবস্থিত থাসস, লিমনস, সামোথরাকি, লেসবস, চিয়স, সারা, সামোস, আর্মেনিসটিস দ্বীপগুলিও গ্রীসের ছিল না। এই সবগুলি দ্বীপই বর্তমান গ্রীস-তুরস্কের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  
১৮৩২ সালে ইউরোপিয় পরিকল্পনা মোতাবেক আধুনিক গ্রীসের জন্ম। ১৮৩২ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত গ্রীসের সীমানা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়েছে। অনেকগুলি যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে গ্রীস ইজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলিকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছে। তবে আসল কথা হলো, ইউরোপিয় শক্তিরা চেয়েছিল ইউরোপের মাটি থেকে মুসলিম শাসনের শেষ অংশটুকু মুছে ফেলতে। 


গ্রীস যেভাবে বড় হতে থাকলো...

১৮৩২ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভৌগোলিকভাবে গ্রীস বড় হয়েছে। এই পুরো সময়ের মাঝে গ্রীসের মানচিত্র অগুণিতবার পরিবর্তিত হয়েছে। মানচিত্র স্থলভাগে যেমন পরিবর্তিত হয়েছিল, তেমনি সমুদ্রেও হয়েছিল; বিশেষ করে ইজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলিতে। এই দ্বীপ দখলের প্রতিযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল গ্রীসের নৌবাহিনী।

- গ্রীক স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েই ব্রিটিশরা গ্রীসের জন্যে নৌবাহিনী তৈরি করে দেয়। ১৮২৫ সালে ব্রিটিশরা দু’টা ফ্রিগেট অর্ডার করে আমেরিকা থেকে। ‘হোপ’ এবং ‘লিবারেটর’ নাম দিয়ে জাহাজদু’টা তৈরি করা হয়। ‘হোপ’ ১৮২৬ সালের শেষে গ্রীসে এসে পোঁছায়; এবং এর নামকরণ করা হয় ‘হেলাস’, যা কিনা উথমানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

- স্বাধীনতার পর ১৮৫৫ সালে গ্রীকরা ব্রিটেন থেকে ৪টা লৌহ-নির্মিত বাষ্পীয় ইঞ্জিন-চালিত ‘স্টিমশিপ’ ক্রয় করে।

- ১৮৬৬ সালে ক্রীট দ্বিপকে উথমানি খিলাফত থেকে আলাদা করে গ্রীসের অংশ করার জন্যে সেখানে বিদ্রোহ শুরু হয়। কিন্তু গ্রীক নৌবাহিনী সেখানে তেমন কোন সহায়তা না করতে পারায় গ্রীকরা শক্তিশালী নৌবহরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করে।

- গ্রীক নৌবাহিনীর পোরস নৌঘাঁটিতে ফরাসীদের তত্ত্বাবধানে নতুন নৌবাহিনী গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৮৮৫ সালে ফ্রান্স থেকে ‘হাইড্রা-ক্লাস’এর ৩টা লৌহ-নির্মিত ‘আয়রনক্ল্যাড’ অর্ডার করা হয়। এর প্রতিটা জাহাজ ছিল ৪,৮০০ টনের এবং ২৬টা করে কামান ও ৩টা টর্পেডো টিউব ছিল। ১২-ইঞ্চি বর্ম দ্বারা আবৃত ছিল জাহাজগুলি।

- ১৮৯৭ সালে ক্রীট দ্বীপকে আবারও গ্রীসের সাথে একত্রীকরণের জন্যে যুদ্ধ শুরু হলে সেই যুদ্ধে এই জাহাজগুলি পুরো ইজিয়ান সাগরে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তবে স্থলযুদ্ধে গ্রীসের পরাজয় হলেও ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে ক্রীট দ্বীপ উথমানি খিলাফত থেকে আলাদা হয়ে যায়।

- ১৮৯৭ সালের যুদ্ধে পর ব্রিটিশ নেতৃত্বে গ্রীক নৌবাহিনীর আরেক দফা উন্নয়ন শুরু হয়। ১৯০৯ সালে ইতালি থেকে একটা ১০ হাজার টনের ক্রুজার কেনা হয়। ১৯১০ সাল থেকে গ্রীক নৌবাহিনী ব্রিটিশদের কৌশল অনুযায়ী প্রস্তুত হতে থাকে।

- অন্যদিকে ১৯১১-১২ সালে ইতালি আফ্রিকায় লিবিয়াকে উথমানিদের থেকে আলাদা করে ফেলার লক্ষ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সেই যুদ্ধের মাঝে ইতালি পূর্ব ভূমধ্যসাগরে দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। এই দ্বীপগুলির মাঝে রয়েছে রোডস (সবচাইতে বড়), কস, পাতমোস, এবং আরও ১২টা প্রধান দ্বীপ। এরপর এই দ্বীপগুলি আর উথমানিদের হাতে ফেরত আসেনি। ১৯২৩ সালে এই দ্বীপগুলিকে গ্রীসের হাতে তুলে দেয়া হয়। ইতালির সাথে যুদ্ধে উথমানিদের দুর্বল করা হয়।

- যেখানে ১৯১২ সালের ১৮ই অক্টোবর উথমানিদের সাথে ইতালির যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়, সেখানে প্রায় একইসাথে বলকানের সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো, বুলগেরিয়া এবং গ্রীস একত্রে ‘বলকান লীগ’ গঠন করে ৮ই অক্টোবর থেকে ১৭ই অক্টোবরের মাঝে উথমানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ ঘোষণার পিছনে ইউরোপিয় শক্তিরা কলকাঠি নেড়েছে। অর্থাৎ কোন বিরতি ছাড়াই ইউরোপিয়রা পরপর দু’টা যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করে উথমানিদের।

- এই বলকান যুদ্ধে গ্রীক নৌবাহিনী উথমানি নৌবাহিনীকে দার্দানেলিস প্রণালীতে অবরুদ্ধ করে ফেলে। ১৯১২ সালের ডিসেম্বরে ‘এলি’-এর যুদ্ধে গ্রীক নৌবাহিনী উথমানি নৌবাহিনীকে পরাজিত করে। এই যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে গ্রীকরা পূর্ব ইজিয়ান সাগরে (বর্তমান তুরস্কের উপকূল ঘেঁষে) লেসবস, চিয়স, লেমনস এবং সামোস দ্বীপ দখল করে ফেলে।

- ১৯১৩-এর জানুয়ারিতে আবারও উথমানি নৌবাহিনী দার্দানেলিস থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে। এবার লেমনস-এর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে উথমানিরা আবারও দার্দানেলিসে ফিরে যায়। ইজিয়ান সাগর রয়ে যায় গ্রীকদের নিয়ন্ত্রণে।

- ১৯১৫-১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ-ফরাসী নৌবাহিনী দার্দানেলিস প্রণালীতে গ্যালিপোলি অপারেশনের সময় দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জকে নোঙ্গরের জন্যে ব্যবহার করে। সেসময় ছোট আরেকটা দ্বীপ, ‘কাস্তেলোরিতসো’- যা কিনা ইতালিয়রা ১৯১২ সালের যুদ্ধে দখল করেনি- সেটাকে ফরাসীরা দখল করে। এই দ্বীপটা বর্তমান তুরস্কের উপকূল থেকে মাত্র ২ কিঃমিঃ দূরে! আবার দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জের অংশ হলেও এই দ্বীপটা বাকি দ্বীপগুলি থেকে মোটামুটি দূরে। সবচাইতে বড় দ্বীপ রোডস থেকে ১২৫ কিঃমিঃ দূরে।

- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালে সিভরেসের চুক্তিতে কাস্তেলোরিতসো দ্বীপকে ফরাসীরা ইতালির কাছে হস্তান্তর করে।

- ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা কাস্তেলোরিতসো দ্বীপ দখল করে। তবে কয়েক দিনের মাঝেই ইতালিয়রা পুনরায় এই দ্বীপ দখল করে নেয়। ঐ বছরেরই মে মাসে ক্রীট দ্বীপ দখল করার জন্যে জার্মান-ইতালিয় বাহিনী দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জকে ব্যবহার করে।

- ১৯৪৩-এর সেপ্টেম্বরে ইতালি মিত্রপক্ষে যোগ দিলে ব্রিটিশরা কাস্তেলোরিতসো দ্বীপ আবারও দখল করে নেয়। তবে বাকি দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ জার্মানদের হাতেই থাকে।

- ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পুরো দোদেকানিজ ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়।

- ১৯৪৭ সালে ইতালির সাথে সাক্ষরিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শান্তি চুক্তি মোতাবেক দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ গ্রীসকে দিয়ে দেয়া হয়। এর মাঝে কাস্তেলোরিতসো দ্বীপও ছিল।
গ্রীসের ডানপন্থীরা পুরো ইজিয়ান সাগর, ইস্তাম্বুল, দার্দানেলিস প্রণালি, সাইপ্রাস এবং বর্তমান তুরস্কের পুরো পশ্চিম উপকূল জুড়ে 'গ্রেটার গ্রীস' স্থাপনের স্বপ্ন দেখে। এই চিন্তার পিছনে রয়েছে 'মেগালি আইডিয়া' নামের এক ধারণা। ইউরোপিয় শক্তিদের হাতে বর্তমান গ্রীসের জন্মের পর থেকে গ্রীসের পররাষ্ট্রনীতি এই চিন্তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। 



গ্রীসের ডানপন্থী উত্থানের নেপথ্যে...

গ্রীসের ডানপন্থী গ্রুপগুলি দেশটার স্বাধীনতার পর থেকেই ‘মেগালি আইডিয়া’ নামের এক চিন্তাকে লালন করতে থাকে। ১৮৪৪ সালে প্রথম এই চিন্তাটা আলোতে আসে বলে জানা যায়। এই চিন্তার মূলে রয়েছে প্রাচীন বাইজ্যানটাইন সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান ঘটানো। সে অনুযায়ী তারা চাইছিলো যে, কন্সটান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল), ইজিয়ান সাগরের সকল দ্বীপ, সাইপ্রাস দ্বীপ, বর্তমান তুরস্কের সম্পূর্ণ পশ্চিম উপকূল এবং দার্দানেলিস প্রণালি গ্রীসের হবে। এই চিন্তাখানাই ইউরোপিয় শক্তিগুলি ব্যবহার করেছে উথমানিদের বিরুদ্ধে গ্রীসকে লেলিয়ে দিতে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপর গ্রীকরা নতুন রাষ্ট্র তুরস্কের বেশকিছু অংশ দখল করে নিলেও পরে ১৯২৩ সালের লাউস্যান চুক্তি মোতাবেক সেগুলি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এর মাঝে বর্তমান তুরস্কের মূল ভূখন্ডের ‘আইওনিয়া’ এবং ‘ইস্ট থ্রেস’ ছিল। এর মাঝে ইস্ট থ্রেস ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এটা দার্দানেলিস প্রণালির পশ্চিম পাড় পুরোটার নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ব্রিটিশরা গ্রীকদের হাতে অনেক অঞ্চলই দেখতে চেয়েছে; তবে ইস্তাম্বুল এবং দার্দানেলিস প্রণালি তারা গ্রীকদের হাতে দিতে চায়নি। কারণ এটা তারা বুঝতে পেরেছিল যে, যদি রুশরা কখনও ইস্তাম্বুল এবং দার্দানেলিস-এর উপর হামলা করে বসে, তাহলে ছোট্ট রাষ্ট্র গ্রীসের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না। আর তেমন কিছু ঘটলে ভূমধ্যসাগরে ব্রিটিশদের অবস্থান তো দুর্বল হবেই; একইসাথে সুয়েজ খালের উপরে ব্রিটিশ নজরদারিও বন্ধ হয়ে যাবে রুশ চাপে পড়ে। কাজেই গ্রীক ডানপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করাটা ব্রিটিশদের জন্যে জরুরি ছিল।

  
১৮৭৮ সালে ব্রিটিশরা রাশিয়ার ভয় দেখিয়ে সাইপ্রাসে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। এরপর ১৯৬০ সালে সাইপ্রাসকে স্বাধীনতা দিয়ে দেয়। কিন্তু ১৯৭৪ সালে মার্কিন-সমর্থিত গ্রীক ডানপন্থী সরকার দ্বীপটাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে গেলে তুরস্ক সাইপ্রাসের উত্তর অংশ দখল করে ফেলে। তুরস্ক-গ্রীসের স্থিতাবস্থার মাঝেই দ্বীপটাতে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি রয়ে গেছে। 


সাইপ্রাস যেভাবে ভাগাভাগি হলো...

উথমানি খিলাফতকে ধ্বংস করতে চারিদিক থেকে আক্রমণ করছিল রাশিয়া, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী, ব্রিটেন-ফ্রান্স, এবং শেষে ইতালি। রাশিয়ার সাথে উথমানিদের অনেকগুলি যুদ্ধের শেষ যুদ্ধটা ছিল ১৮৭৭-৭৮-এর। এই যুদ্ধের শেষে রুশ আগ্রাসনের ভয় দেখিয়ে ব্রিটেন উথমানিদের কাছ থেকে সুবিধা নেবার চেষ্টা করে।

- ১৮৭৮ সালের ৪ঠা জুন ব্রিটেন উথমানিদের সাথে গোপন এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ‘সাইপ্রাস কনভেনশন’ নামের এই চুক্তি মোতাবেক রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে কৃষ্ণ সাগরের দক্ষিণের কৌশলগত দার্দানেলিস প্রণালী এবং ইস্তাম্বুলকে মুক্ত রাখতে ব্রিটেন সাইপ্রাসে সামরিক ঘাঁটি করে। তবে দ্বীপের মালিকানা তখনও উথমানিদের হাতেই থাকে।

- সেই সময় থেকে ব্রিটেনের পূর্ব ভূমধ্যসাগর নিয়ন্ত্রণের ফর্মুলা হলো সাইপ্রাস।

- ১৯১৪ সালের ২রা অগাস্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষে যোগ দেয় উথমানিরা। এর ফলশ্রুতিতে ৫ই নভেম্বর ব্রিটেন অফিশিয়ালি সাইপ্রাস নিজের দখলে নিয়ে নেয়।

- ১৯৬০ সালে ব্রিটেন সাইপ্রাসকে স্বাধীন বলে স্বীকৃতি দেয়। তবে সেখানে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলি থেকেই যায়।

- নতুন দেশ সাইপ্রাসের জনসংখ্যার ৭৭ শতাংশ গ্রীক এবং ১৮ শতাংশ তুর্কী; তাই নির্বাচনে গ্রীকরাই সরকার গঠন করে। তুর্কীরা সেসময় সাইপ্রাসের বিভাজন দাবি করতে থাকে।

- ১৯৬৭ সালে গ্রীসে মার্কিন-সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে ডানপন্থীরা ক্ষমতায় আসে এবং গ্রীসের পুনএকত্রীকরণের চিন্তাগুলিকে আবারও সামনে আনতে থাকে। ১৯৭৪ সালের ১৫ই জুলাই গ্রীক সরকার সাইপ্রাসে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় এবং ১০ হাজার সৈন্য পাঠায়।

- এর পাঁচ দিন পর ২০শে জুলাই তুরস্ক সাইপ্রাসের উত্তর অংশ আক্রমণ করে বসে। তবে এতকিছুর মাঝেও সেই দ্বীপে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলি ঠিকই থেকে যায়। তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের কথার বিরুদ্ধে সাইপ্রাসে হামলা করায় ১৯৭৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস তুরস্কের উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

- সেই সময় থেকে সাইপ্রাস দুই ভাগে বিভক্ত – উত্তর সাইপ্রাস তুর্কীদের হাতে; দক্ষিণ সাইপ্রাস গ্রীকদের হাতে; আর মাঝে ব্রিটিশরা। গ্রীক-তুর্কী স্থিতাবস্থা সাইপ্রাসে ব্রিটিশদের সামরিক ঘাঁটি থাকার ব্যাপারে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মার্কিন-সমর্থিত ডানপন্থী গ্রীকদের হাতে চলে গেলে সাইপ্রাসে ব্রিটিশ ঘাঁটি রাখা নিঃসন্দেহে কঠিন হয়ে পড়তো।
তুরস্কের উপকূল থেকে মাত্র দুই কিঃমিঃ দূরে ছোট্ট দ্বীপ কাস্তেলোরিতসো গ্রীকরা কখনোই দখল করেনি। কিন্তু ইউরোপিয় শক্তিরা দ্বীপটাকে গ্রীসের অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৪৭ সালে। এই দ্বীপের কারণে তুরস্কের সমুদ্রসীমা কতটুকু হবে, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। 



তুরস্কের সমুদ্রসীমা আসলে কতটুকু?

মানচিত্র বলছে যে, বর্তমান তুরস্কের প্রায় ৮ হাজার কিঃমিঃ-এর বিশাল উপকূল রয়েছে। কৃষ্ণ সাগর, ইজিয়ান সাগর এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগর জুড়ে রয়েছে এই উপকূল। কিন্তু এই উপকূলের বেশিরভাগ অঞ্চলেই তুরস্ক সমুদ্রসীমার নিয়ন্ত্রণে নেই। গ্রীক নিয়ন্ত্রিত বেশিরভাগ দ্বীপেরই অবস্থান তুরস্কের উপকূলের ঠিক পাশে। ১৮৩২ সাল থেকে উসমানিরা ইজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলি হারাতে থাকে, এবং এটা পরবর্তীতে সৃষ্ট রাষ্ট্র তুরস্কের সময়েও অব্যাহত থাকে। ১৯৪৭ সালে দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ দিয়ে দেয়া হয় গ্রীকদের হাতে। এরপর ১৯৭৪-এ সাইপ্রাসের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছিল গ্রীসের হাতে, যখন তুর্কীরা সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু সেই সামরিক হস্তক্ষেপ যে দ্বীপটাতে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিগুলি রক্ষা করা ছাড়া তেমন কিছু করেনি, তা এখন তুরস্কের সমুদ্রসীমা দেখলেই বোঝা যায়।

তুরস্কের সমুদ্রসীমা যে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তা হলো –

- ১৮২১-৩২ সালের মাঝে ইউরোপিয় শক্তিদের সহায়তায় গ্রীসের জন্ম। ইউরোপিয় শক্তিগুলি পুরো বলকানে জাতীয়বাদ উস্কে দিয়ে উথমানিদের অধীনে থাকা পুরো বলকান অঞ্চলকে টুকরো টুকরো করে ছোট ছোট রাষ্ট্রে ভাগ করে ফেলে, যেগুলি ইউরোপিয় শক্তিগুলির প্রভাবে পরিচালিত হতে থাকে।

- ১৮৭৮ সালে রুশদের সাথে উথমানিরা যুদ্ধে পরাজিত হলে রুশদের জুজু দেখিয়ে ব্রিটিশরা সাইপ্রাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

- ১৮৯৭ সালে গ্রীসের সাথে যুদ্ধে উথমানিরা জয়লাভ করলেও ইউরোপিয় শক্তিরা জোরপূর্বক ক্রীটকে উথমানি খিলাফত থেকে আলাদা করে গ্রীসের অধীন করে।

- ১৯১১-১২ সালে ইতালির সাথে যুদ্ধে উথমানিরা দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ হারায়।

- ১৯১২-১৩ সালের বলকান যুদ্ধের সময় ইউরোপিয়দের সহায়তায় গ্রীক নৌবাহিনী এতটাই শক্তিশালী হয়ে যায় যে, গ্রীক নৌবহর পরপর দু’টা নৌযুদ্ধে উথমানি নৌবহরকে পরাজিত করে দার্দানেলিসের মাঝে অবরোধ করে রাখে। এই সুযোগে গ্রীকরা পূর্ব ইজিয়ান সাগরে (বর্তমান তুরস্কের উপকূল ঘেঁষে) লেসবস, চিয়স, লেমনস এবং সামোস দ্বীপ দখল করে ফেলে।

- ১৯১৪-১৮ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান এবং পরাজয়ের কারণে উথমানি শাসনের পতন হয় এবং ইউরোপিয় শক্তিরা উথমানি সাম্রাজ্য ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে অনেকগুলি দেশের জন্ম দেয়, যার মধ্যে রয়েছে বর্তমান তুরস্ক। ইউরোপিয়দের নিজ হাতে তৈরি বিধায় তুরস্ক ইউরোপিয়দের মেপে দেয়া মানচিত্রতে খুশি থাকতে বাধ্য হয়। পূর্ব ভূমধ্যসাগরের প্রায় সকল এলাকা তুর্কীদের হাতছাড়া হয়ে যায়।

- ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসীরা দোদেকানিজ-এর অংশ ‘কাস্তেলোরিতসো’ দ্বীপ দখল করে নেয়।

- ১৯৪৭ সালে ‘কাস্তেলোরিতসো’ দ্বীপসহ দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ গ্রীসের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

- ১৯৬০ সালে সাইপ্রাসকে স্বাধীন দেশ ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯৭৪ সালে মার্কিন-সমর্থিত গ্রীক ডানপন্থীদের সহায়তায় সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হলে তুরস্ক সাইপ্রাসে সৈন্য পাঠায়। এই সুবাদে বর্তমান সাইপ্রাসের উত্তর অংশ তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।


গ্রীক নৌবাহিনীর 'আয়রনক্ল্যাড' হাইড্রা। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে হাইড্রা-ক্লাসের তিনটা জাহাজ ফ্রান্স থেকে কেনে গ্রীস। এই জাহাজগুলি ইজিয়ান সাগর নিয়ন্ত্রণে এবং ইজিয়ানের দ্বীপগুলি দখলে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল। সেই দখল করা দ্বীপগুলির কারণে এখন তুরস্ক সমুদ্রসীমা এবং সমুদ্র সম্পদ থেকে বঞ্চিত। এতেই প্রমাণ হয় যে জোর যার, সম্পদ তার। 


জোর যার, সম্পদ তার...

এই ঘটনাগুলির কারণে ইজিয়ান সাগরের বেশিরভাগ অঞ্চলই তুরস্কের নিয়ন্ত্রণের বাইরে পড়ে যাচ্ছে; সেটা যে পদ্ধতিতেই হিসেব করা হোক না কেন। এই দ্বীপগুলিতে সামরিক স্থাপনা না থাকলেও সমুদ্রসীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে দ্বীপগুলি গ্রীসের বিরাট সুবিধা করেছে; আর ইজিয়ান সাগরে নৌ-কর্তৃত্ব ধরে রাখতে দ্বীপগুলি গ্রীসকে সহায়তা করছে। কৌশলগত দার্দানেলিস প্রণালি তুরস্কের অধীনে থাকলেও এই দ্বীপগুলির কারণে দার্দানেলিসের পথের নিয়ন্ত্রণ গ্রীসের সাথে ভাগাভাগি করতে হয়েছে।

গ্রীসের নিয়ন্ত্রণ থেকে সবচাইতে দূরে রয়েছে দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জ এবং সাইপ্রাস দ্বীপ। দোদেকানিজ দ্বীপগুলির নিয়ন্ত্রণ নেয়া গ্রীসের জন্যে কঠিন ছিল বিধায় ইউরোপিয় শক্তিরা নিজেরা এগুলির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গ্রীসের কাছে হস্তান্তর করে। আর কাছাকাছি হওয়ায় তুরস্কের জন্যে সাইপ্রাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়া সহজ হলেও ইউরোপিয় এবং মার্কিন শক্তির কারণে তুরস্ক সাইপ্রাসের উত্তর অংশ নিয়েই খুশি থাকতে বাধ্য হয়েছে। আর দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিতে গেলে পুরো পশ্চিমা বিশ্বই হয়তো তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উঠে পড়ে লাগতো। তাই তুরস্কের কাছে পশ্চিমাদের কথা শোনা ছাড়া গতি নেই। এই দ্বীপগুলি নিজের অধীনে না থাকায় তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরের বেশিরভাগ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সম্পদ আহরণ থেকে বঞ্চিত।

তুরস্ক এবং গ্রীস উভয়েই জানে যে এই এলাকার দ্বীপমালা এবং সমুদ্রসীমা কি করে নির্ধারিত হয়েছে। প্রথমতঃ পশ্চিমা শক্তিদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এখানে কিছুই করা যায়নি। দ্বিতীয়তঃ সামরিক শক্তির মাধ্যমেই সকল কিছুর সুরাহা হয়েছে। যার গায়ের জোর রয়েছে, সে-ই সেখানে জয়ী হয়েছে। আর সমুদ্রে জোর খাটানোর উপায় একটাই – নৌ-শক্তির বৃদ্ধি। তুরস্ক এবং গ্রীস উভয়েই তাদের নৌ-শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমুদ্র সম্পদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে। এক্ষেত্রে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক যতটা না শক্তি দেখাতে পারছে, গ্রীস ততটা পারছে না বলেই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা সেই সহায়তা দিতে না পারলেও ইস্রাইল এবং মিশর সেই সহায়তা দিচ্ছে গ্রীসকে। মিশর-সৌদি গ্রুপ এখন পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মুখোমুখি হয়েছে তুরস্কের। গ্রীক গ্রুপগুলি তুরস্কের ‘গানবোট ডিপ্লোম্যাসি’এর সমালোচনা করলেও সেটা ছাড়া যে তুরস্কের সামনে কোন রাস্তা খোলা নেই, তা ইতিহাসই বলে দিচ্ছে। তুরস্ক নিয়মিতভাবেই গ্রীক নিয়ন্ত্রিত দ্বীপগুলির আশেপাশে, এমনকি সেগুলির উপর দিয়ে সামরিক বিমান উড়িয়ে বার্তা দিচ্ছে যে, গায়ের জোরে তৈরি করা নিয়মগুলি ভাঙতেও গায়ের জোরই যে লাগবে, সেটা তারা বুঝতে পারছেন।



Tuesday 12 February 2019

যুক্তরাষ্ট্র কি যুক্তরাষ্ট্রই থাকবে?

১২ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ 

১৭৮৩ সাল থেকে ১৮৫৩ সালের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখন্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়েছে।  ফ্রান্স, স্পেন এবং মেক্সিকো থেকে ভূখন্ড নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভৌগোলিকভাবে বড় হয়েছে। তবে ভৌগোলিক পরিবর্তন হলেও রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিত পরিবর্তিত হয়নি। 


নির্দিষ্ট ভূখন্ড কি রাষ্ট্রের সংজ্ঞার অন্তর্গত? 

একটা রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় ভূমি বা ভূখন্ড কতটা গুরুত্বপূর্ণ? ভূখন্ড নির্দিষ্টকরণ না হলে কি রাষ্ট্র হবে, নাকি হবে না? একটা রাষ্ট্রের ভিত্তির সংজ্ঞার মাঝে কি তার ভূখন্ডের মানচিত্রও পড়ে? ভূখন্ড বা মানচিত্রে পরিবর্তন হলে সেই রাষ্ট্রের সংজ্ঞা কি আগের মতোই থাকবে, নাকি নতুন কোন রাষ্ট্র হিসেবে সেটাকে দেখতে হবে? যে জিনিসগুলি দিয়ে একটা রাষ্ট্রকে অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়, তার মাঝে কি তার ভূখন্ডের মানচিত্রও পড়ে? এই প্রশ্নগুলি সমাজে অপ্রচলিত বললেও অত্যুক্তি হয় না। বর্তমানে মানচিত্র বা ভূখন্ডকে একটা রাষ্ট্রের ভিতের সাথে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে যে, রাষ্ট্র তৈরির আগেই সকলে ভূখন্ড নিয়ে ভাবতে থাকেন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, এখানে যে ব্যাপারটা ধরে নেয়া হচ্ছে, তা হলো – একটা রাষ্ট্র আসলে তৈরিই হয় ভূখন্ড হিসেবে অন্য ভূখন্ড থেকে আলাদা হবার কারণে। এরসাথে জাতিগত ব্যাপারটাকে যোগ করলে দেখা যাবে যে, একটা জাতি একটা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বাস করে বলেই সেই ভূখন্ড নির্দিষ্টকরণের মাঝেই তাদের আলাদা একটা রাষ্ট্র গঠনের অনুপ্রেরণা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, জাতিগতভাবে নিজেদেরকে আলাদা করে দেখাবার ‘টেরিটোরিয়াল’ উদ্দেশ্য থেকেই একটা রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে। ব্যাপারটা অনেকটা জঙ্গলের জীবজন্তুর মতোই হয়ে যাচ্ছে। বন্য প্রাণীরাও নিজেদের এলাকা আগলে রাখে অন্যদের থেকে রক্ষা করার জন্যে। বাইরের কেউ সেখানে প্রবেশ করতে গেলেই তারা আক্রমণ করে। আপাতঃদৃষ্টে বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাখানাও জঙ্গলের মতোই। শুনতে খারাপ লাগলেও তা আসলে কিছুটা পাশবিক প্রকৃতির।

কিন্তু জাতি এবং নির্দিষ্ট ভূখন্ডের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে একটা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দেয়া যাবে না। কোরিয়া উপদ্বীপের কথাই ধরা যাক। উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণের মাঝে জাতিগত কোন পার্থক্য নেই; তারপরেও তারা আলাদা। এক্ষেত্রে দুই কোরিয়াকে আলাদা করে রাখা হয়েছে চিন্তাগত কারণে – উত্তর কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক; দক্ষিণ কোরিয়া পুঁজিবাদী। একসময় এই ব্যাপারটা কিউবা এবং ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। তবে মূল কথা হলো, এই রাষ্ট্রগুলি সংজ্ঞায়িত হয়েছে রাষ্ট্রের চিন্তার উপরে ভিত্তি করে; তার জাতিগত বা ভৌগোলিক নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে নয়। তাহলে বিশ্বের বাকি দেশগুলি কেন চিন্তার ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র নয়? উত্তর সহজ – সকলেই একই চিন্তার মাঝে রয়েছে। সেই একই চিন্তার মাঝে পাশবিক প্রবৃত্তিগুলিকে লালন করেই বর্তমান বিশ্বের জাতিগত ভৌগোলিক বাউন্ডারিগুলি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই সীমানাগুলি আসলে কতটা শক্ত ভিতের উপরে?

ভৌগোলিক আকার এবং নাগরিকত্ব – দু’টা উদাহরণ

রাষ্ট্রগুলির সীমানার ভিত দেখতে হলে রাষ্ট্রের সীমানার ইতিহাস দেখতে হবে। যেমন ১৯৩০ সালে ঢাকায় জন্ম নেয়া একটা মানুষের জাতীয়তা কি সর্বদা একই ছিল? ১৯৪৬ সালে তার জাতীয়তা কি পরিবর্তিত হয়েছিল? ১৯৪৭ সালে তার জাতীয়তা কি ছিল? ১৯৭২ সালে? লোকটার পারিবারিক ইতিহাস তো পরিবর্তিত হয়নি; তার ভৌগোলিক অবস্থানও আগের মতোই রয়েছে। তারপরেও তার জাতীয়তা কি পরিবর্তিত হয়নি? যদি পরিবর্তিত হয়েই থাকে, তাহলে কিসের ভিত্তিতে হলো সেটা? আরেকটা উদাহরণ দেয়া যাক।

জার্মান কারা? যারা বর্তমানে জার্মানি নামের রাষ্ট্রের ভূখন্ডের অন্তর্গত তারা? নাকি অন্য রাষ্ট্রের মাঝে বসবাসকারীরাও জার্মান বলে পরিগণিত হতে পারে? আর যদি রাষ্ট্র হিসেবে জার্মানির অন্তর্গত মানুষকেই বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে কোন কালের জার্মানির কথা বলা হবে, তা-ও কিন্তু সংজ্ঞায়িত করে ফেলতে হবে। হ্যাঁ, অনেকেই শুধু বর্তমানের কথাই বলবেন। কিন্তু যে ব্যক্তির ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মান নাগরিকত্ব ছিল, কিন্তু ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে যাবার পর তার শহরটা যদি পোল্যান্ডের অধীনে চলে গিয়ে থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তির জাতীয়তার কি হবে? আর এই ব্যক্তির জাতীয়তা তার বাকি জীবনে যে একই থাকবে, তার নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে?

ব্রিটিশ কলোনির মাত্র ১৩টা রাজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৭৮৩ সালের এই মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে যে, শুধুমাত্র আটলান্টিকের পাড়ে কিছু অঞ্চল জুড়েই ছিল যুক্তরাষ্ট্র।  


যুক্তরাষ্ট্রের আকারের ইতিহাস –

সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলা যাক। ১৭৮৩ সালে ব্রিটেনের অধীনে থাকা ব্রিটিশ নর্থ আমেরিকার ১৩টা রাজ্য ব্রিটেন থেকে আলাদা হয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করে। এই রাজ্যগুলি ছিল –

১। ম্যাসাচুসেটস,

২। নিউ হ্যাম্পশায়ার,

৩। রোড আইল্যান্ড,

৪। কানেকটিকাট,

৫। নিউ ইয়র্ক,

৬। নিউ জার্সি,

৭। পেনসিলভানিয়া,

৮। ডেলাওয়্যার,

৯। ম্যারিল্যান্ড,

১০। ভার্জিনিয়া,

১১। নর্থ ক্যারোলাইনা,

১২। সাউথ ক্যারোলাইনা এবং

১৩। জর্জিয়া।

এর বাইরে দক্ষিণ এবং পশ্চিমের ভূখন্ড ছিল ফ্রান্স ও স্পেনের অধীনে; উত্তর ছিল ব্রিটেনের অধীনে। ২০ বছর পর ১৮০৩ সালে পশ্চিমের লুইসিয়ানা নামের বিশাল এলাকা যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের কাছ থেকে কিনে নেয়। এরও ১৮ বছর পর ১৮২১ সালে দক্ষিণের ফ্লোরিডাকে যুক্তরাষ্ট্র কিনে নেয় স্পেনের কাছ থেকে। আরও ২৪ বছর পর ১৮৪৫ সালে টেক্সাসকে যুক্তরাষ্ট্র দখল করে নেয়। পরের বছর ১৮৪৬ সালে উত্তর-পশ্চিমের ওরেগন অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র পেয়ে যায় কানাডার সাথে সীমানা নির্ধারণ করার মাধ্যমে। এরও দুই বছর পর ১৮৪৮ সালে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের পর গুয়াদেলুপ হিদালগো চুক্তির মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত পশ্চিমের বিরাট এলাকা যুক্তরাষ্ট্র নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এভাবে মাত্র ৭০ বছরের ভেতর যুক্তরাষ্ট্র আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী কিছু এলাকা থেকে দুই মহাসাগরের মধ্যবর্তী বিশাল ভূখন্ডের মালিক হয়ে যায়। তবে এতেও সন্তুষ্ট থাকেনি যুক্তরাষ্ট্র। ১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনে নেবার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইউরেশিয়ার সীমানায় পৌঁছে যায়। ১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপ, ফিলিপাইন এবং ক্যারিবিয়ানস-এ পুয়ের্তো রিকো দখল করে নেয়।

এই সময়ের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকারও পরিবর্তন হতে থাকে। প্রথমে পতাকায় থাকে ১৩টা তারা; অর্থাৎ ১৩টা রাজ্য। ১৮৯৫ সালে তারার সংখ্যা হয় ১৫; ১৮০৩ সালে হয় ১৭; ১৮১৩ সালে ১৮; ১৮১৮ সালে ২০; ১৮২২ সালে ২৪; ১৮৩৭ সালে ২৬; ১৮৬১ সালে ৩৪; ১৮৬৫ সালে ৩৬; ১৮৬৭ সালে ৩৭; ১৮৭৭ সালে ৩৮; ১৯১২ সালে ৪৮; ১৯৫৯ সালে ৪৯; ১৯৬০ সালে ৫০। অর্থাৎ নিয়মিত বিরতিতে ভূখন্ডের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে পতাকার ডিজাইনে পরিবর্তন হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাজ্যের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০-এ।
  
মার্কিন জাতীয় পতাকার বিবর্তন। ১৩টা রাজ্যের জন্যে ছিল ১৩টা তারা। সেই তারার সংখ্যা এখন ৫০। কিন্তু কে নিশ্চয়তা দিতে পারে যে এই তারা বা রাজ্যের সংখ্যা বাকি সময়ও একই থাকবে? 


ভৌগোলিক পরিবর্তনের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু পরিবর্তিত হয়েছে?

রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিত গড়ার সময় যা যা বলা হয়েছিল, তার অনেকটাই এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে; আবার বেশকিছু ব্যাপার পরিবর্তনও হয়েছে। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র মূলতঃ নিজেকে আমেরিকার আশেপাশেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। এই ব্যাপারখানা পরিবর্তিত হতে থাকে যখন ১৮৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাউন্ডারির মাঝে আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত পুরো এলাকা চলে আসে। উত্তর আমেরিকাতে ভূখন্ড বাড়াবার সুযোগ কমতে থাকলে ঊনিশ শতকের শেষের দিকে কিছু চিন্তাবিদেরা যুক্তরাষ্ট্রকে তার উপকূল থেকে দূরে পাঠাতে থাকে। হাওয়াই, ফিলিপাইন এবং পুয়ের্তো রিকো দখল করা এই চিন্তারই ফসল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে ১৯১৭ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের মাটিতে যুদ্ধে যোগদান করে। দেরিতে হলেও এই যুদ্ধ আমেরিকাকে ইউরোপের মাটিতে রাজনৈতিক ভিত গাড়তে সহায়তা করে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের মাটিতে শক্তভাবেই গেড়ে বসে। যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইউরোপের হাতেই বিশ্বের বেশিভাগ অঞ্চলের ক্ষমতা ছিল, তাই ইউরোপকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আসলে সেটাই ছিল ইউরোপের হাত থেকে ক্ষমতা আটলান্টিকের ওপাড়ে চলে যাবার মুহুর্ত। ইউরোপীয় সাম্রাজ্য থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যের সূচনা তখন থেকেই।

ভূখন্ডগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই পরিবর্তিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী তার প্রভাবেরও পরিবর্তন হয়েছে। একসময় যেখানে ইউরোপের আশেপাশেও ভিড়তো না যুক্তরাষ্ট্র, এখন সেই যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের ‘রক্ষাকবচ’ ন্যাটোর নেতৃত্বে। জাপান-কোরিয়ার নিরাপত্তায় এখনও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফিলিপাইনকে কলোনি হিসেবে না রাখলেও সেদেশের নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই ছিল বহুকাল; এখনও অনেকাংশেই তাই। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামে রয়েছে বিশাল সামরিক ঘাঁটি। মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকাতেও রয়েছে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া এবং পাকিস্তান-আফগানিস্তানে রয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এগুলি কোনটাই যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমারেখার মাঝে না থাকলেও সবখানেই মার্কিন সামরিক সদস্যরা মোতায়েন রয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। সকলে মার্কিন নাগরিক হতে পারে না; কিন্তু সকলেই মার্কিন নাগরিক হতে চায়। তারা চায় নির্দিষ্টভাবে বলে দেয়া মার্কিন রাজনৈতিক সীমানার মাঝে বসবাস করতে। কোন সীমানা? এখন যেই সীমানা রয়েছে সেই সীমানা; ১৭৮৩ সালের সীমানা নয়। তবে রাষ্ট্র কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রই।

এই আলোচনার শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় ভূখন্ডগত নির্দিষ্টতার প্রয়োজনীয়তা থেকে। ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা মানুষটার পরিচয় যেহেতে বারংবার পরিবর্তিত হয়েছে, তাই এটা বলা যেতেই পারে যে তার পরিচয় বাকি সময়ের জন্যেও নির্দিষ্ট হয়ে যায়নি। জার্মান নাগরিকের ভৌগোলিক অবস্থানও ইতিহাসের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। রাষ্ট্রের বাউন্ডারি পরিবর্তিত হবার কারণে তার জাতিগত পরিচয় নিয়েও শুরু হয়েছে সংশয়। আর মার্কিন সীমানা কবে যে নির্দিষ্ট ছিল, তা বলা কঠিন। মার্কিন রাষ্ট্র তার নিরাপত্তার বাউন্ডারি আঁকতে গিয়ে তার ভৌগোলিক সীমানার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বাকি বিশ্বের ভূখন্ডকেও এর মাঝে ধরে নিয়েছে। এই উদাহরণগুলি ভৌগোলিক নির্দিষ্টকরণকে রাষ্ট্রের সংজ্ঞার মাঝে ফেলে না। একটা রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভৌগোলিক দিক থেকে বড়ও হতে যেতে পারে; আবার জার্মানির মতো ছোটও হয়ে যেতে পারে। আর এই ছোটবড় হবার মাঝ দিয়ে কেউ সেই রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেতেও পারে; আবার নাগরিকত্ব হারাতেও পারে। 

যুক্তরাষ্ট্র ভৌগোলিকভাবে যত বড় হয়েছে, তার রাজ্যের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫০টা রাজ্যের সংযুক্তিতেই যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কখনও যদি এতে বিযুক্তি আসে, তাহলে দেশটার নাম কি যুক্তরাষ্ট্রই থাকবে? 


ভবিষ্যতের যুক্তরাষ্ট্র কেমন হবে?

জার্মানির জন্ম ১৮৭১ সালে। ১৯১৪ সালে বড় হবার নিমিত্তে তারা যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু যুদ্ধে হেরে ১৯১৮ সাল নাগাদ বরং আরও ছোট হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আবারও বড় হবার আশা করলেও ১৯৪৫ সাল নাগাদ আরও ছোট হয়ে যায় জার্মানি। ১৯৮৯ সালে আবার কিছু অংশ পূনএকত্রিকরণ হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম ১৭৭৬ সালে; ব্রিটেনের ১৩টা রাজ্য নিয়ে। এখন সেই রাজ্যের সংখ্যা ৫০; এবং আকারে অনেক বড়। কিন্তু কেউ আসলে এই ছোটবড় থাকার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। অন্ততঃ ইতিহাস থেকে সেটাই ধারণা করা যায়। রাষ্ট্রের শক্তি কমতে থাকলে তার ভৌগোলিক আকৃতিতেও পরিবর্তন আসতে পারে। বাইরের শক্তিরা তার ভূখন্ড থেকে অংশবিশেষ কেড়ে নিতে চাইবে। আমেরিকাও সময়ের বিবর্তনে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়ার কাছ থেকে ভূখন্ড কেড়ে নিয়ে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের আকৃতি পেয়েছে। বাকি বিশ্বে তার প্রভাবও বাড়িয়েছে অন্যদের প্রভাবকে খর্ব করে। বর্তমান বিশ্বে মার্কিন প্রভাব কমার সাথেসাথে একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক আকার-আকৃতি নিয়েও প্রশ্ন আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সংজ্ঞার মাঝে তো ৫০টা রাজ্য নেই; দেশটার জন্ম যেহেতু মাত্র ১৩টা রাজ্য নিয়ে। তাই কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে ভবিষ্যতে কখনোই বিযুক্তির মাধ্যমে দেশটার রাজ্যের সংখ্যা কমে যাবে না। বরং যে প্রশ্নটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে তা হলো – তখনও কি যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্তরাষ্ট্রই ডাকা হবে?

Friday 1 February 2019

মার্কিন দুনিয়ায় পরিবর্তনের হাওয়া



 ০১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আলহামদুলিল্লাহ!
আমার প্রথম বই প্রকাশিত হলো।

'মার্কিন দুনিয়ায় পরিবর্তনের হাওয়া - সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সুপারপাওয়ারের বাস্তবতা'

ইনশাআল্লাহ এবারের বই মেলায় বইখানার মোড়ক উন্মোচিত হতে যাচ্ছে।









বই-এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা এই বর্ণনা থেকে পাওয়া যাবে -


-----------------------------------------------------------------------------------------------

"যুক্তরাষ্ট্র এখনও সুপারপাওয়ার। দুর্বল হলেও এখনও ভূরাজনীতির অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সুপারপাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়েছে। গত ২৮ বছরে সুপারপাওয়ারের কোন চ্যালেঞ্জার না থাকা সত্ত্বেও এই সময়ের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক, কূটনৈতিক, আদর্শিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমেছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাও এখন প্রশ্নাতীত নয়।

লেখকের ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলি বই আকারে প্রকাশের চিন্তাটা এসেছে একটা ‘বার্ডস আই ভিউ’ পাবার ইচ্ছে থেকে। লেখাগুলি আঞ্চলিকভাবে সাজালে বিশ্বব্যাপী সুপারপাওয়ারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব খর্ব হবার আভাস পাওয়া যায়। বিশ্বের ভাগ্য-নির্ধারকের ভূমিকা থেকে বিশ্ব-বাস্তবতাকে মেনে নেবার মতো অবস্থানে নেমে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাস্তবতা এখন আর সুপারপাওয়ারের তৈরি করা খেলার মাঠ যে নয়, তা গত দুই বছরের ঘটনাবলি দেখিয়ে দেয়।

গত দুই বছরে ‘মার্কিন দুনিয়া’ ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে মেনে চলেছে। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, বাস্তবতা যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্ন নীতির ব্যাপারে বাধ্য করেছে। বিশ্বের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আর কতদিন থাকবে? আর বর্তমান সুপারপাওয়ারের স্থলাভিষিক্তই বা কে হতে পারে?"

-----------------------------------------------------------------------------------------------






আশা রাখি বইখানা আপাততঃ বই মেলার "অমৃত অন্বেষা" স্টলে পাওয়া যাবে। অন্য স্টলেও বইখানা রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

'মার্কিন দুনিয়ায় পরিবর্তনের হাওয়া - সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সুপারপাওয়ারের বাস্তবতা'

লেখক - আহমেদ শরীফ

প্রকাশক - মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম,
                 ড্রিমস পাবলিকেশনস, আবহাওয়া অফিস রোড, আকুর টাকুর পাড়া, টাঙ্গাইল

প্রথম প্রকাশ - জানুয়ারি ২০১৯

প্রচ্ছদ - তৌহিদুল ইসলাম

বানান সমন্বয় - আযাদ কামাল

লিপি বিন্যাস - আনোয়ার পারভেজ

মুদ্রণ - ওমাসিস প্রেস, কাঁটাবন, ঢাকা

পৃষ্ঠা সংখ্যা - ৩২৬; হার্ড কভার 

মূল্য - ৪৫০/- (চারশত পঞ্চাশ টাকা মাত্র) 


ISBN : 978-984-34-6437-8


-----------------------------------------------------
আপডেট - ১৮ই অক্টোবর ২০১৯

বইটা এখন রকমারি ডট কম-এ পাওয়া যাচ্ছে - 
 https://www.rokomari.com/book/184641/markin-duniyar-poribortoner-haoya--samprotik-vurajnoitik-poristhiti-ebong-superpowerer--bastobota

---------------

একইসাথে যেকোন জেলা শহরে বই পৌঁছে দেয়া যাবে। নিচের ফেসবুক পেইজে ইনবক্স-এ ঠিকানা এবং ফোন নম্বর পাঠিয়ে দিন; বই পৌঁছে যাবে ইনশাআল্লাহ। 
https://web.facebook.com/k360bd/ 

---------------

এছাড়াও বইটা ঢাকার 'বেঙ্গল বই'-এর লালমাটিয়া সেন্টার-এ পাওয়া যাচ্ছে। 
1/3 Block D, Lalmatia
1209 Dhaka, Bangladesh

https://web.facebook.com/Bengalboidhaka/


--------------- 

ঢাকা এবং চট্টগ্রামের 'বাতিঘর'-এও বইখানা পাওয়া যাচ্ছে। সিলেটের স্টোরেও খুব শিগগিরই পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

বাতিঘর ঢাকা
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবন, ১৭ ময়মনসিংহ রোড, বাংলা মোটর
ঢাকা ১০০০
ফোন ০২ ৯৬৩৫৩৩৯; ০১৯৭৩৩০৪৩৪৪
বাতিঘর চট্টগ্রাম
প্রেসক্লাব ভবন, ১৪৬/১৫১ জামাল খান রোড, চট্টগ্রাম ৪০০০
ফোন ০৩১ ২৮৬৯৩৯১; ০১৭৩৩০৬৭০০৫
facebook.com/baatigharCTG
বাতিঘর সিলেট
গোল্ডেন সিটি কমপ্লেক্স
৬৮২ পূর্ব জিন্দাবাজার, সিলেট ৩১০০
ফোন ০১৯১১৫০৯৬৯৬
facebook.com/baatigharSYL

-----------------

বইটি ঢাকার শাহবাগের 'পাঠক সমাবেশে'-এও ডিসপ্লেতে রয়েছে।
https://web.facebook.com/PscltdDhaka

------------------------ 



বইটি ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান এবং কল্যানপুরে Bookends-এর তিনটি স্টোরে পাওয়া যাচ্ছে। খুব শিগগিরই যমুনা ফিউচার পার্কের স্টোরেও পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। 
https://web.facebook.com/Bookendsbd/ 

-----------------------------