Saturday 26 February 2022

রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ… পশ্চিমা নেতৃত্বের বিশ্ব ব্যবস্থা ধ্বসে পড়েছে

২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০২২

যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন রাশিয়াকে অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিলেও পশ্চিমা সমর্থিত ইউক্রেন সরকারকে রক্ষা করতে সামরিক বাহিনী প্রেরণ না করে আন্তর্জাতিক আইনকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেয়নি; যা বন্ধু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। রাশিয়া নিশ্চয়ই ভুল করেছে; কিন্তু তার পিছনে সবচাইতে বড় ইন্ধন যুগিয়েছে আফগানিস্তান পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা এবং পশ্চিমাদের মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। রাশিয়াকে চীনের সমর্থন বলে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে; অর্থাৎ ধ্বসে পড়েছে পশ্চিমা নেতৃত্বের বিশ্বব্যবস্থা।

 
প্রায় দু’লক্ষ রুশ সেনা যখন ইউক্রেনের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে, তখন অনেকগুলি প্রশ্ন আলোচনায় আসছে। ইউক্রেনের যুদ্ধে পশ্চিমাদের জড়াবার সম্ভাবনা কতটুকু? ইউক্রেনে রাশিয়ার পরিকল্পনাটা আসলে কি? এই যুদ্ধে চীনের স্বার্থই বা কতটুকু? বিশ্বব্যাপী এই যুদ্ধের প্রভাবই বা কতটুকু হতে পারে? পশ্চিমারা যখন বলছে যে, নিরাপত্তার ব্যাপারে তাদের ব্যাখ্যাটাই সঠিক, তখন রাশিয়া এবং চীন ভিন্ন কথা বলছে। ২৪শে ফেব্রুয়ারি চীনা মুখপাত্র বলেন যে, মিডিয়াতে ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার ‘আগ্রাসন’এর কথা বলা হচ্ছে। অথচ যখন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান এবং ইরাকে ঢোকার জন্যে কারুর কাছ থেকে অনুমতি নেয়নি, তখন কেন এই শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়নি? তখন আন্তর্জাতিক আইন বা জাতিসংঘের অনুমতি কেন নেয়া হয়নি? চীনাদের এই কথাগুলি বুঝিয়ে দেয় যে, পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ আইনের শাসন এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ‘সিবিএস নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, গত তিন দশকে কেউ ইউরোপে সংঘাতের কথা চিন্তা করেনি; যা এখন পরিবর্তিত হয়ে গেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন বলেছেন যে, ইউক্রেনকে কেউ সহায়তা দিতে আসলে মারাত্মক পরিণতি হবে, তখন এটা জেনে রাখা ভালো যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছে যে, তারা ইউক্রেনকে রক্ষায় সৈন্য মোতায়েন করবে না। পশ্চিমারা রাশিয়ার উপর যে অবরোধ দিতে চলেছে, তা ইরানের উপর দেয়া অবরোধের চাইতে কিছুটা কম; যদিও তা যেকোন ‘গ্রেট পাওয়ার’এর উপর দেয়া সর্বোচ্চ অবরোধ। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেসকল অর্থনৈতিক অবরোধের কথা যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সেগুলি বাস্তবায়ন ইউরোপের জন্যে খুবই কষ্টের হবে। জ্বালানি এবং কৃষিজ পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি আরও প্রকট হবে এবং এর ফলশ্রুতিতে ইউরোপ আগামী এক বছরে তার জিডিপির কমপক্ষে ১ শতাংশ হারাতে পারে। অপরদিকে চীন রাশিয়ার উপর অবরোধের সমালোচনা করলেও তারা সেই অবরোধ এড়াতে চেষ্টা নাও করতে পারে।

মার্কিন কনসালট্যান্সি কোম্পানি ‘গ্যালাপ’এর সাথে কথা বলতে গিয়ে মার্কিন ভূরাজনৈতিক চিন্তাবিদ জর্জ ফ্রীডম্যান বলছেন যে, পুতিন হয়তোবা মনে করেছিলেন যে, হামলার ভয় দেখিয়ে তিনি পশ্চিমাদের কাছ থেকে তার দাবিগুলি আদায় করে নেবেন। বিশেষ করে জার্মানির ভিন্নমতকে তিনি হয়তো তার দাবি আদায়ের স্তম্ভ হিসেবে নিয়েছিলেন; সেটা হয়নি। ন্যাটোকে পূর্বদিকে আর বর্ধিত করা হবে না, সেটা লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দেয়ার যে দাবি পুতিন করেছিলেন, সেটা যে যুক্তরাষ্ট্র মানবে না, সেটা পুতিন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন। এখন হামলা করে পুতিন কিছুই পেলেন না। ন্যাটোর পূর্বদিকের সীমানা সীমিত করার দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। ফ্রীডম্যান ইউক্রেন সমস্যায় চীনের স্বার্থকে তুলে ধরে বলেন যে, রাশিয়া এবং চীন একে অপরকে সামরিকভাবে কোন সহায়তা দিতে না পারলেও রাশিয়ার উপর অবরোধের মাঝে চীন হয়তো রাশিয়াকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু চীনের সাম্প্রতিক রিয়েল এস্টেট সেক্টরের সমস্যার পর তারা রাশিয়াকে কতটা আর্থিক সহায়তা দিতে পারবে, তা নিশ্চিত নয়। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছাকাছি দু’টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে বার্তা দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র দু’টা শক্তিকে একত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর ‘রবার্ট স্ট্রাউস হুপে চেয়ার’ রবার্ট ডি ক্যাপলান ‘দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলছেন যে, ইউক্রেন নিয়ে যুদ্ধ হলেও মূল ইস্যু হলো পশ্চিমাদের একাত্মতা; যেখানে জার্মানি হলো ইউরোপের মাঝে প্রধান সমস্যা। ইউক্রেনে ভীষণভাবে আটকে গেলেও ন্যাটোর মাঝে যেকোন ধরনের ভাঙ্গন ধরাতে পারাটা পুতিনের জন্যে বিজয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর পশ্চিমাদের কোন অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ছিল না। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলস্বরূপ রাশিয়া এবং চীন পশ্চিমাদের কাছে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। এছাড়াও ইউক্রেনের মতোই পূর্ব এশিয়ায় রয়েছে তাইওয়ান ইস্যু। যদি কখনও এটা বোঝা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে চীনের আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে পারবে না বা বাঁচাবে না, তাহলে জাপান থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সকল মার্কিন বন্ধু দেশ চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। তিনি মনে করছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে ভেতর থেকে ভেঙ্গে গিয়েছিল, রাশিয়ার ক্ষেত্রেও সেটাই হতে পারে। তথাপি এর অনেকটাই নির্ভর করছে পশ্চিমা দেশগুলি, রাশিয়া এবং চীন কিভাবে তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। স্বল্প মেয়াদে অনেক কিছুই নির্ভর করবে ন্যাটো কতদিন তার এই মুহুর্তের একাত্মতাকে ধরে রাখতে পারবে, সেটার উপর। ক্যাপলান মনে করছেন যে, সামনের দিনগুলিতে বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ইউরেশিয়াকে নিয়ে প্রতিযোগিতা আরও গভীর হবে। এর অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা এবং চীনা স্বার্থের দ্বন্দ্ব হতে পারে। ইরান এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে থাকতে পারে; কারণ ইরান একইসাথে যেমন মধ্য এশিয়ায় ঢোকার পথ, তেমনি তা ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত।

সামরিক হামলার ভয় দেখিয়ে দাবি আদায়ের রুশ প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে; যার ফলশ্রুতিতে ইউক্রেনে সীমিত পরিসরে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা ছাড়া পুতিনের কাছে আর কোন উপায়ই ছিল না। তবে ইউরোপের অনৈক্য লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। জার্মানি যেখানে রাশিয়াকে তার অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে চায়, ফ্রান্স সেখানে চাইছে ইউরোপের উপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাতে। উল্টোদিকে ব্রিটেন চাইছে রাশিয়ার সাথে দ্বন্দ্বকে জিইয়ে রাখতে। পোল্যান্ড যেখানে রাশিয়াকে হুমকি মনে করে, সেখানে বুলগেরিয়া থেকে হাঙ্গেরি পর্যন্ত বলকানের দেশগুলি অর্থোডক্স চার্চের অনুসারী রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক নয়। ন্যাটো সদস্য তুরস্কও ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়ের সাথেই সম্পর্ক রেখে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন রাশিয়াকে অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিলেও পশ্চিমা সমর্থিত ইউক্রেন সরকারকে রক্ষা করতে সামরিক বাহিনী প্রেরণ না করে আন্তর্জাতিক আইনকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেয়নি; যা বন্ধু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। রাশিয়া নিশ্চয়ই ভুল করেছে; কিন্তু তার পিছনে সবচাইতে বড় ইন্ধন যুগিয়েছে আফগানিস্তান পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা এবং পশ্চিমাদের মাঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। রাশিয়াকে চীনের সমর্থন বলে দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে; অর্থাৎ ধ্বসে পড়েছে পশ্চিমা নেতৃত্বের বিশ্বব্যবস্থা।

Sunday 20 February 2022

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতাকেই তুলে ধরে

২০শে ফেব্রুয়ারি ২০২২

বিশ্বশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি যে ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যখন বলছে যে, তাদের শক্তির মূল উৎস হলো তাদের মিত্র এবং সহযোগীরা, তখন সেটা প্রমাণ করার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। এটা পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক নীতি আঞ্চলিক বাস্তবতাকে পরিবর্তন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া কোন পথই খোলা নেই।

 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন গত ১১ই ফেব্রুয়ারি তাদের বহুল প্রতীক্ষিত নতুন ইন্দোপ্যাসিফিক কৌশলের নীতিপত্র প্রকাশ করে। নীতিপত্র প্রকাশের দিনক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন করছেন অনেকেই। কারণ সপ্তাহান্তের ছুটি শুরুর ঠিক আগে শুক্রবার বিকেলে এই নীতিপত্র প্রকাশ করার ঘন্টাখানেক পর মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিলেন ইউক্রেন নিয়ে। তিনি চীনকে হুশিয়ার করে বলেন যে, রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করলে চীন যদি রাশিয়াকে সমর্থন দেয়, তাহলে তাদেরকে এর মূল্য দিতে হবে। নীতিপত্রে চীনকে পরিবর্তনের চেষ্টা না করে অত্র অঞ্চলের বাস্তবতাকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে নিয়ে আসার কথা বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এবং সহযোগীদের, বিশেষ করে ইইউ, আসিয়ান, ন্যাটো, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং কোয়াড জোটের সাথে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। এক জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’ বলছে যে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতি নয়; তবে সেখানে চীনের আগ্রাসী নীতিকে একটা সমস্যা বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এটা এখন পরিষ্কার যে, চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’ আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় মার্কিন থিংকট্যাংক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর ডিরেক্টর ক্রিস্টোফার প্রেবল বলছেন যে, ইউরোপে ইউক্রেনকে ঘিরে যখন এতবড় একটা বিরোধ চলছে, ঠিক সেই সময়ে তারা নীতিপত্রটা প্রকাশ করলো; যা খুবই অদ্ভূত। এরকম একটা সময়ে বোঝা কষ্টকর হচ্ছে যে, বাইডেন প্রশাসন কি ভেবে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ না করে দুনিয়ার একটা অংশ নিয়ে নীতিপত্র প্রকাশ করলো। পুরো নীতিপত্রে চীনের নাম এসেছে খুবই কম; মূলতঃ চীন কোন কোন আন্তর্জাতিক আইন ভেঙ্গেছে, সেগুলিই শুধু বলা হয়েছে। কিন্তু এই অঞ্চলে চীন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা একেবারেই উল্লেখ করা হয়নি। এটা পড়লে ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের ব্যাপারটা একটা ‘ব্ল্যাক হোল’এর মতো মনে হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। অর্থাৎ ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের কোন অস্তিত্বই যেন নেই! নীতিপত্রে ইন্দোপ্যাসিফিক যুক্তরাষ্ট্রের কতবড় বাণিজ্য সহযোগী সেটা বলা হয়েছে; অথচ এর মাঝে চীনের সাথে বাণিজ্যই যে সবচাইতে বেশি, সেটা উল্লিখিত হয়নি। তিনি বলছেন যে, আর মাধ্যমে এই নীতিপত্রের দৃষ্টিভঙ্গিখানা বোঝা যায়। ট্রাম্প প্রশাসন যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা বলেছিল যে, যতক্ষণ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন যুক্তরাষ্ট্র অত্র অঞ্চলে চীনের দাবিগুলিকে মেনে নেবে না। কিন্তু এখন বাইডেন প্রশাসনের নীতিখানা কি? তারা কি ইন্দোপ্যাসিফিকে চীনের গুরুত্বকে এড়িয়ে যেতে চাইছে?

‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর ফেলো জ্যাক কুপার বলছেন যে, হয়তো বাইডেন প্রশাসন সকলকে মনে করিয়ে দিতে চাইছে যে, তাদের এশিয়া নীতিই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নীতি। কিন্তু এই নীতিপত্রে গত দশ বছরে যা বলা হয়েছে, এর বাইরে নতুন কোনকিছুই আসেনি; বরং প্রশ্ন হলো, এই নীতির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র কি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার তিন স্তম্ভের প্রথম স্তম্ভ হলো নিরাপত্তা। নিরাপত্তার অংশ হিসেবে ‘সমন্বিত ডিটারেন্স’ বলে যা বলা হয়েছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে নতুন কিছু নয়। বরং ‘সমন্বিত’ বলে সেখানে সামরিক নিরাপত্তার ব্যাপারটার গুরুত্ব কমিয়ে ফেলা হয়েছে। দ্বিতীয় স্তম্ভ অর্থনীতির অংশ হিসেবেও যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইন্দোপ্যাসিফিকে নতুন কোন বাণিজ্য চুক্তির জন্ম দিতে পারেনি। যেগুলি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেগুলি একটাও কার্যকর হয়নি। আর তৃতীয় স্তম্ভ আদর্শ অত্র অঞ্চলে যে কাজ করছে না, তা নিশ্চিত। বাইডেনের গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠকে ইন্দোপ্যাসিফিকের ১০টা দেশের মাঝ থেকে মাত্র ৩টা দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। চীনকে মার্কিন সরকার যখন একুশ শতকের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ বলছে, তখন নীতিপত্রে আরও শক্তিশালী কিছু পদক্ষেপ অবশ্যই থাকা উচিৎ ছিল। বিশেষ করে অর্থনৈতিক স্তম্ভের ক্ষেত্রে নীতি সবচাইতে দুর্বল। চীন যখন আঞ্চলিক দেশগুলির সাথে বাণিজ্যের দিক থেকে সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে চাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র যেন বাউন্ডারির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কুপার বলছেন যে, এশিয়ায় অনেকেই বলছেন যে, ইউক্রেনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত অবস্থানে থাকা উচিৎ যাতে তা চীনের জন্যে একটা শিক্ষা হিসেবে আসে। কিন্তু তারা কেউই আবার চাইছে না যে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে এশিয়া থেকে দূরে থাকুক। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার কোন অঞ্চলকেই অধিক গুরুত্ব দিতে পারছে না।

চীনা মিডিয়া ‘সিজিটিএন’এর এক লেখায় মস্কোভিত্তিক মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এন্ড্রু করিবকো বলছেন যে, নতুন এই নীতি আসলে কিছু ইচ্ছার প্রতিফলন মাত্র। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে এর কতগুলি বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মূলতঃ এই নীতিপত্রের প্রতিরক্ষার দিকটাই হয়তো বেশি প্রাধান্য পাবে। অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, নীতিপত্রে অনেক কিছুই বলা হচ্ছে; তবে এগুলি বাস্তবায়নে অত্র অঞ্চলের দেশগুলির কি ধরনের সুবিধা হবে, সেটা দেখানোটা বেশি জরুরি।

ক্রিস্টোফার প্রেবল বলছেন যে, এই নীতিপত্রে যেসব কথা বলা হয়েছে সেগুলি বাস্তবে রূপ দিতে দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে মার্কিনীদের যে মূল্য দিতে হবে এবং কষ্ট সহ্য করতে হবে, সেব্যাপারে মার্কিন জনগণ একমত নয়। ‘সমন্বিত ডিটারেন্স’এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কি চীনা ছাত্রদের বাধা দিতে পারবে? যুক্তরাষ্ট্র কি অস্ট্রেলিয়ার সরকারকে চীনা আর্থনৈতিক আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে ভর্তুকি দিতে পারবে? নীতিপত্রে যতকিছু করা হবে বলে বলা হয়েছে, মার্কিন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই কাজগুলি করার জন্যে অর্থায়ন কিভাবে যোগাড় করা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন তিনি। বিশ্বশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি যে ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যখন বলছে যে, তাদের শক্তির মূল উৎস হলো তাদের মিত্র এবং সহযোগীরা, তখন সেটা প্রমাণ করার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। প্রেবল, কুপার বা করিবকোর কথায় এটা পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক নীতি আঞ্চলিক বাস্তবতাকে পরিবর্তন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া কোন পথই খোলা নেই।

Saturday 12 February 2022

কর্ণাটকের হিযাব বিতর্ক মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের দায়িত্ব না নেবার প্রবণতাকেই দেখিয়ে দেয়

১২ই ফেব্রুয়ারি ২০২২

মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের মাঝে কেউই ভারতের সাথে শত্রুতা চাইছে না। আর বিজেপি সরকারের কাছে এটা অজানা নয় যে, সেকুলার চিন্তার অনুসারী হওয়ায় কোন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশই ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুদের পক্ষে দাঁড়াবে না। এমতাবস্থায় ভারতের মুসলিমদের জন্যে মুসকান খানের মতো বলিষ্ঠ প্রতিবাদই যেন একমাত্র আশা; আর বাকি মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের জন্যে লজ্জা। এই ঘটনাগুলি মুসলিম বিশ্বের জনগণের মাঝে নেতৃত্বের হাহাকারকে প্রবলতর করবে এবং পরিবর্তনের আকাংক্ষাকে আরও গভীরতা দেবে।


ভারতের দক্ষিণের কর্ণাটক রাজ্যে হিযাব নিয়ে বিতর্ক এখন শুধু ভারতের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। সোশাল মিডিয়ার বদৌলতে আন্তর্জাতিক সীমানা পার হবার কারণে এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। বিষয়টা মাত্র কিছুদিন হলো মিডিয়াতে আসলেও এর সূত্রপাত হয়েছে আরও আগেই। ২০২১এর ডিসেম্বরে কর্ণাটকের উদুপিতে একটা কলেজে ছয়জন মুসলিম ছাত্রীকে ক্লাসে ঢোকার আগে তাদের মাথার হিযাব খুলে ফেলতে বলা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ বলে যে, ছাত্রীরা কলেজ ক্যাম্পাসে হিযাব পড়তে পারবে; তবে ক্লাসরুমে নয়। কলেজের প্রিন্সিপাল বলেন যে, শিক্ষকের জন্যে ছাত্রীদের চেহারা দেখতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ; আর ছাত্রদের একজনকে যেন অপরজন থেকে আলাদা করে না দেখা হয়, সেজন্য কলেজ ইউনিফর্ম রয়েছে। ছাত্রীরা হিযাবের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। এরপর ৪ঠা জানুয়ারি উগ্র ডানপন্থী হিন্দু গ্রুপগুলির সমর্থনে কিছু হিন্দু ছাত্র গেরুয়া রঙের শাল পড়ে একই রাজ্যের কোপ্পাতে পাল্টা প্রতিবাদ শুরু করে। তাদের দাবি ছিল যে, যদি মুসলিম মেয়েদেরকে হিযাব পড়তে দেয়া হয়, তাহলে তাদেরকেও ক্লাসরুমে গেরুয়া শাল পড়তে দেয়া হোক। পরদিন ম্যাঙ্গালোরের ‘পম্পেই কলেজ’এও হিন্দু শিক্ষার্থীরা একই রকমের প্রতিবাদ শুরু করে।

এরপর ১৪ই জানুয়ারি উদুপি কলেজের মুসলিম ছাত্রীদেরকে হিযাব পড়ার কারণে ক্লাসে ঢুকতে বারণ করা হয়। ৩রা ফেরুয়ারি কুন্ডাপুর সরকারি কলেজের ছাত্রীরা তাদের মুখের উপরে গেট বন্ধ করে দেয়ার পর তারা কর্তৃপক্ষকে ক্লাস করতে দেয়ার অনুরোধ জানায়। পরদিন মহীশূরে উদুপি এবং ম্যাঙ্গালোরের ছাত্রীদের সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। ৭ই ফেব্রুয়ারি ভারতের নিম্নবর্ণের দলিত শ্রেণীর হিন্দুরা মুসলিম মেয়েদের হিযাব পড়ার পক্ষে প্রতিবাদ করে। এই সময়েই গেরুয়া পরিহিত উগ্রবাদী হিন্দুদের সাথে হিযাবের সমর্থনে মুসলিমদের দ্বন্দ্বের মাঝেই মান্দিয়া জেলায় একজন হিযাব পরিহিত মুসলিম তরুণী কলেজের বাইরে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেয়া হিন্দু ছাত্রদের দ্বারা উত্তক্ত হবার মুহুর্তে হাত উঁচিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করে উঠলে সেই ঘটনার ভিডিও সারা দুনিয়াব্যাপী সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে যায়। মেয়েটির একা হিন্দুদের বড় একটা গ্রুপের সামনে দাঁড়িয়ে শক্ত অবস্থান নেয়া সকলেই অবাক করে। এই সাহসী প্রতিবাদের পর মুসকান খান নামের মেয়েটি হিযাবের পক্ষে আন্দোলনে প্রধান অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়।

কর্ণাটনের উত্তেজনা ইতোমধ্যেই খুব দ্রুতই সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘বিবিসি’ বলছে যে, কোলকাতা, চেন্নাই এবং হায়দ্রাবাদে শতশত মানুষ কর্ণাটকের হিযাবের উপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। বিভিন্ন স্থানে হিন্দু মুসলিমদের মাঝে ঢিল নিক্ষেপ এবং অগ্নিসংযোগের খবরও পাওয়া গেছে। শিভামজ্ঞা জেলায় কিছু হিন্দু ছাত্র নিজেরদের কলেজে গেরুয়া পতাকাও উত্তোলন করে। কর্ণাটকের শিক্ষামন্ত্রী নাগেশ বিসি বলছেন যে, হিযাবের পক্ষে এই অন্দোলন পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তিনি এই অন্দোলনের পিছনে ‘পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া’র ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করেন।

১১ই ফেব্রুয়ারি কর্ণাটকের হাই কোর্ট ৫টা নির্দেশনা দেয়। প্রথমতঃ সেকুলার রাষ্ট্র হিসেবে ভারতে যেকোন ধর্মের সম্প্রদায়ের ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। তবে ক্লাসরুমে হিযাব পড়ার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা রয়েছে কিনা এবং সেটা ভারতের সংবিধানে কতটা অনুমতি দিয়েছে, সেটা আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। দ্বিতীয়তঃ সবগুলি পিটিশনের রায় না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রদেরকে ক্লাসরুমে হিযাব বা গেরুয়া শাল পড়তে বারণ করা হয়েছে। তৃতীয়তঃ এই নির্দেশনা শুধুমাত্র ঐসব কলেজের জন্যে, যেখানে ড্রেস কোড দেয়া রয়েছে। চতুর্থতঃ ধর্মের নামে কাউকেই বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে দেয়া যাবে না। পঞ্চমতঃ আন্দোলন এবং প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার চাইতে ছাত্ররা যদি ক্লাসে ফিরে যায়, সেটাই হবে তাদের জন্যে মঙ্গল। ইউনিফর্মের ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্তের মাত্র ছয়দিন আগে ৫ই ফেব্রুয়ারি কর্ণাটকের রাজ্যসরকার এক আদেশের মাধ্যমে রাজ্যের সকল স্কুল কলেজে ইউনিফর্ম পড়া বাধ্যতামূলক করে। ‘ডেকান হেরাল্ড’ বলছে যে, এর একদিন আগেই রাজ্যসরকার বলেছিল যে, তারা হিযাব এবং গেরুয়া কোনটারই পক্ষে নয়। রাজ্যসরকারের কর্মকর্তারা বলছে যে, যারা কলেজে হাজিরা দেবে না, তাদেরকে পরীক্ষা দিতে দেয়া হবে না। রাজ্যসরকারের এই নির্দেশের বৈধতার ব্যাপারে নির্দেশনা চেয়ে আদালতে পিটিশন করা হয়েছে।

ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও কর্ণাটকের ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বিবৃতি দিয়েছেন অনেকে। পাকিস্তান সরকার ইসলামাবাদে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাকিস্তান সরকারের উদ্বিগ্নতার কথা জানিয়েছে। ৮ই ফেব্রুয়ারি নোবেল পুরষ্কার জয়ী মালালা ইউসুফজাই এক বিবৃতিতে আপাতদৃষ্টে হিযাব আন্দোলনের পক্ষে কথা বললেও, তিনি উল্লেখ করেন যে, মহিলাদের কম কাপড় বা বেশি কাপড় পড়ার ব্যাপারে বিতর্কের পক্ষপাতি নন। অর্থাৎ তিনি হিযাব পড়া বা না পড়ার আলোচনার সমর্থক নন। ১১ই ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ‘অফিস অব ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’এর দূত রাশাদ হুসাইন এক টুইটার বার্তায় কর্ণাটক রাজ্যসরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন যে, কর্ণাটক রাজ্যের ধর্মীয় কাপড়চোপড়ের ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া উচিৎ নয়। এতে ছাত্রীদের ধর্মীয় অধিকার খন্ডিত হচ্ছে। পরদিন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী সাংবাদিকদের বলেন যে, ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য দেশের মন্তব্য করা উচিৎ নয়।

ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতা অমিত মালভিয়া ভারতীয় সংবাদ সংস্থা ‘এএনআই’কে বলেন যে, ইরান এবং তুরস্কতে যেখানে হিযাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে, সেখানে ভারতে মেয়েদেরকে হিযাবের পিছনে লুকানো হচ্ছে। ২০১৮ সালে কেরালা হাই কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, স্কুলের কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নেবে কি ইউনিফর্ম পড়তে হবে। ২০১৯ সালে কেরালাতেই একটা মুসলিম শিক্ষা সংস্থা হিযাব পড়া নিষিদ্ধ করেছিল। বিজেপির সমালোচনাকারী কংগ্রেসের কেরালার এমপি হিসেবে রাহুল গান্ধীর তো এগুলি জানা থাকার কথা। তিনি বলেন যে, হিযাবের কথা বলে মুসলিম মেয়েদেরকে সমাজ থেকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। ১০ই ফেব্রুয়ারি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উত্তর প্রদেশে এক নির্বাচনী ভাষণে বলেন যে, তার সরকার তিন তালাকের নিয়ম বাতিল করে মুসলিম মহিলাদের মুক্ত করেছে।

‘সিএনএন’ বলছে যে, অনেক মুসলিম মহিলার কাছেই হিযাব বিশ্বাসের একটা অংশ। অপরদিকে অনেক পশ্চিমা দেশেই হিযাব বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভারতে প্রকাশ্যে হিযাব পড়ার উপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, যা পশ্চিমা কিছু দেশে আরোপ করা হয়েছে। তবে কর্ণাটকে হিযাব নিষিদ্ধ করার গভীরতা অনেক। কর্ণাটকের বিজেপি সরকার ইতোমধ্যেই মুসলিমদের কুরবানির জন্যে পশু বেচা এবং জবাই করা নিষিদ্ধ করেছে। সেখানে হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলিম বা খ্রিস্টান হওয়াটাও অনেক কঠিন করে দেয়া হয়েছে। তদুপরি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, আগামী বছর সেখানে রাজ্যসভার নির্বাচনের আগে আগে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে।

ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশটাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদের উপর অত্যাচার বেড়েছে। একইসাথে বেড়েছে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিভাজন। চীনের বিরুদ্ধে কৌশলগত মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্ব যথেষ্ট; যেকারণে ভারতের উপর সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির কথা বলে চাপ সৃষ্টি করে ওয়াশিংটন দিল্লীর সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না। অপরদিকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের মাঝে কেউই ভারতের সাথে শত্রুতা চাইছে না। আর বিজেপি সরকারের কাছে এটা অজানা নয় যে, সেকুলার চিন্তার অনুসারী হওয়ায় কোন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশই ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুদের পক্ষে দাঁড়াবে না। এমতাবস্থায় ভারতের মুসলিমদের জন্যে মুসকান খানের মতো বলিষ্ঠ প্রতিবাদই যেন একমাত্র আশা; আর বাকি মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের জন্যে লজ্জা। এই ঘটনাগুলি মুসলিম বিশ্বের জনগণের মাঝে নেতৃত্বের হাহাকারকে প্রবলতর করবে এবং পরিবর্তনের আকাংক্ষাকে আরও গভীরতা দেবে।

Monday 7 February 2022

মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্র দেশ কাতারের বড় কূটনৈতিক কর্মকান্ডের উদ্দেশ্য কি?

০৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২২

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে ওয়াশিংটনে বৈঠক করছেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। কাতারের বিশাল হাইড্রোকার্বন সম্পদকে ব্যবহার করে পশ্চিমারা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখছে। ইউরোপে কাতারের এলএনজি সরবরাহ করে রুশ গ্যাসকে প্রতিস্থাপন করার বাইডেনের পরিকল্পনাও এরই অংশ। ছোট্ট কাতারের বিরাট আকারের কূটনৈতিক কর্মকান্ডও মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের স্বার্থকেই রক্ষা করেছে। তবে অর্ধশতাব্দী আগে সূক্ষ্ম ব্রিটিশ পরিকল্পনায় তৈরি কাতারের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ ব্রিটেনেরও প্রভাব বৃদ্ধি।

 
গত ২৭শে জানুয়ারি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, কাতার এবং তুরস্ক আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালিবান সরকারের সাথে কাবুল বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে। এর চারদিন পর ৩১শে জানুয়ারি কাতার বলে যে, তাদের সাথে তালিবান সরকারের এক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে যারা চলে যেতে চায়, তাদের জন্যে নতুন করে কাতার এয়ারওয়াজের চার্টার করা বিমানের ফ্লাইট চালু করা হবে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিনীদের পলায়নের পর থেকে কয়েক মাস ধরে তালিবানদের সাথে সমঝোতা না হওয়ায় এই ফ্লাইট বন্ধ ছিল। এই চুক্তির ফলে আফগানিস্তানে আটকে পড়া হাজারো পশ্চিমা নাগরিক এবং আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীকে সহায়তা দেওয়া হাজারো আফগানদেরকে দেশ থেকে সরিয়ে ফেলা যাবে। কাতারের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান আল থানি ওয়াশিংটনে মার্কিন মিডিয়া ‘এক্সিওস’এর সাথে এক সাক্ষাতে এই কথাগুলি প্রকাশ করেন। উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সাথে ওয়াশিংটন সফর করছিলেন। শেখ তামিম হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের সময়ে ওয়াশিংটন সফর করা মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম নেতা। সফরকালে বাইডেন কাতারকে ন্যাটোর বাইরে ১৭টা প্রধান মিত্র দেশের মাঝে একটা বলে ঘোষণা দেন। ‘আল মনিটর’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নিতে কাতারের বড় ভূমিকার জন্যেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন কাতারকে এই সন্মাননা দিয়েছেন। এর মাঝে কাতারের সবচাইতে বড় ভূমিকা ছিল আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পলায়নের সময় দোহার সমর্থন। মার্কিনীদের সাথে তালিবানদের আলোচনার মূল মাধ্যমই ছিল কাতার। নিজেদের আকারের তুলনায় কাতারের বিশাল কূটনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে দেশটা নাম সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক আলোচনায় উঠে আসছে।

গত ২২শে জানুয়ারি বার্তাসংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলে যে, বাইডেন শেখ তামিমকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই আমন্ত্রণের একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলা হলে পশ্চিমা অবরোধের মুখে রাশিয়া যদি ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের জ্বালানি সমস্যাকে কিভাবে মোকাবিলা করবে। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, মার্কিন সরকারের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আমোস হোকস্টাইন প্রধানতম তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি উৎপাদনকারী কোম্পানি এবং দেশের সাথে আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কাতার হলো বিশ্বের সবচাইতে বড় এলএনজি উৎপাদনকারী দেশগুলির একটা। তবে দেশটার বেশিরভাগ এলএনজিই পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে রপ্তানি হয়ে থাকে। অপরদিকে ইইউএর দেশগুলি তাদের ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহের জন্যে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল; যেকারণে ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপের দেশগুলিকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে একত্রিত করতে পারছে না।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ইন্সটিটিউট’এর এক লেখায় ‘কাতার ইউনিভার্সিটি’র এসোসিয়েট প্রফেসর নিকোলে কোজানভ বলছেন যে, বাইডেনের এবং তামিমের পরিকল্পনা সফল হলে কাতার ইউরোপের গ্যাসের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিতে পারে; যার ফলশ্রুতিতে কাতার অনেক ক্ষেত্রেই রাশিয়াকে প্রতিস্থাপিত করতে পারবে। ২০২১এর শেষের দিকে ব্রিটেনের জ্বালানি সংকটের সময় কাতার পূর্ব এশিয়ায় এলএনজি পাঠানো স্থগিত করে ব্রিটেনকে সহায়তা দেয়। এর ফলে ব্রিটেন কাতারকে সন্মাননা জানিয়ে ‘দুর্যোগের সময়ের সরবরাহকারী’ বলে আখ্যা দেয় এবং একটা গোপন চুক্তি করে। ওয়াশিংটনের সাথে কাতারের সখ্যতা বাড়লে তা কাতারকে বাড়তি নিরাপত্তা দেবে। প্রায় তিন বছর ধরে কাতারকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি অবরোধ দিয়ে রেখেছিল; যা কিনা কাতারকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ট করতে অনুপ্রাণিত করবে।

 
অতি ক্ষুদ্র কাতারকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করার মাধ্যমে ব্রিটেন একটা পশ্চিমা নির্ভরশীল রাষ্ট্র জন্ম দিয়েছিল। এখনও দেশটার বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে ব্রিটেন এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকেরা কাজ করছে। ব্রিটেনে কাতারের বিশাল বিনিয়োগও রয়েছে। ছোট্ট দেশটার উপর অপর পশ্চিমা বন্ধু সৌদি আরবের হুমকির কারণে কাতার সর্বদাই পশ্চিমা সামরিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল।

২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রধান সামরিক ঘাঁটি সৌদি আরবের ‘প্রিন্স সুলতান এয়ার বেইস’ থেকে কাতারের আল উদাইদ বিমান ঘাঁটিতে সরিয়ে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রকে এই ঘাঁটি দেয়ার মাধ্যমে কাতার তার বড় প্রতিবেশী সৌদি আরব থেকে নিজেকে রক্ষা করে। তবে কাতারের এই চিন্তা নতুন নয়। ঊনিশ শতক থেকেই কাতারের আল থানি পরিবার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আগ্রাসন থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে ব্রিটেনকে আলিঙ্গন করে। ১৯১৬ থেকে কাতারের নিরাপত্তা ছিল ব্রিটেনের হাতে। ১৯৭১ সালে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে কাতারের ঘোষণা দেয় ব্রিটেন। সেসময় থেকে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবসময়ই ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল রয়েছে কাতার। মাত্র ৩ লক্ষ জনগণের কাতারের পক্ষে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ একটা অবাস্তব চিন্তাই বটে। সামরিক বাহিনী এবং সরকারি বহু কাজে বিদেশীদের উপর নির্ভর করে কাতার। দেশটায় ২৩ লক্ষ মানুষের বিশাল এক বিদেশী কর্মীদল কাজ করে, যারা সেদেশের নাগরিকদেরকে সংখ্যালঘিষ্ঠ করে ফেলেছে। ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘চ্যাটহ্যাম হাউজ’এর এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, নিজের নিরাপত্তাহীনতাকে কাটাতেই কাতার বাস্তবতাকে পুঁজি করে তার কূটনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রাধান্য দিয়েছে; যাতে করে পশ্চিমাদের কাছে কাতারের গুরুত্ব অনেক বেশি থাকে। একারণেই মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বিভিন্ন সংঘাতে কাতার মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা নিয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, কাতার তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন স্থানে জঙ্গীগোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছে। তবে কাতার জঙ্গীগোষ্ঠীদের সাথে সম্পর্ক রাখার কারণেই মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা নিতে পেরেছে। উদাহরণ হিসেবে তালিবানের সাথে আলোচনায় কাতারের মধ্যস্ততা উল্লেখযোগ্য।

অতি ক্ষুদ্র কাতারকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি করার মাধ্যমে ব্রিটেন একটা পশ্চিমা নির্ভরশীল রাষ্ট্র জন্ম দিয়েছিল। এখনও দেশটার বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে ব্রিটেন এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকেরা কাজ করছে। ব্রিটেনে কাতারের বিশাল বিনিয়োগও রয়েছে। ছোট্ট দেশটার উপর অপর পশ্চিমা বন্ধু সৌদি আরবের হুমকির কারণে কাতার সর্বদাই পশ্চিমা সামরিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল। এলএনজি রপ্তানি করে অর্জিত বিপুল অর্থ পশ্চিমা অস্ত্র কেনায় ব্যবহৃত হলেও সেগুলি চালনা করার মতো জনবল কাতারের নেই। স্বল্প জনসংখ্যার কারণে কাতারকে তার সামরিক এবং সরকারি জনবলের অনেকটাই বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হয়। আবার কাতারের বিশাল হাইড্রোকার্বন সম্পদকে ব্যবহার করে পশ্চিমারা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখছে। ইউরোপে কাতারের এলএনজি সরবরাহ করে রুশ গ্যাসকে প্রতিস্থাপন করার বাইডেনের পরিকল্পনাও এরই অংশ। ছোট্ট কাতারের বিরাট আকারের কূটনৈতিক কর্মকান্ডও মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের স্বার্থকেই রক্ষা করেছে। তবে অর্ধশতাব্দী আগে সূক্ষ্ম ব্রিটিশ পরিকল্পনায় তৈরি কাতারের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ ব্রিটেনেরও প্রভাব বৃদ্ধি।