Saturday 23 April 2016

বাংলাদেশের নৌশক্তি ঠেকাতে মরিয়া ভারত

২৩ এপ্রিল ২০১৬




যখন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্যে সাবমেরিন কেনার কথা প্রকাশ হলো, তখন এদেশের বহুল বিক্রিত কিছু পত্রিকায় সাবমেরিনের বিরুদ্ধে লেখা শুরু হলো। নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীকে টার্গেট করা ওই মহল কি চাইছে, সেটা বুঝতে কষ্ট ছিল না বলেই তখন সাবমেরিনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছু লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। বাংলাদেশের নৌবাহিনীর সাবমেরিন কেনার ব্যাপারে পার্শ্ববর্তী দেশের কিছু বলার থাকতে পারে কি? কিন্তু তারা ঠিক সেটাই তখন করেছিলেন। ২০১৩-এর ডিসেম্বরে ভারতীয় নৌবাহিনীর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘দ্যা টাইমস অব ইন্ডিয়া’ প্রশ্ন করে, “Why would Bangladesh need submarines? This decision by the government there and the ongoing strife in the country is a matter of concern for us”. এভাবে তারা তাদের চিন্তার কথাই শুধু জানান দেননি, এদেশে কারা তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন, তাদের মুখোশ উন্মোচনেও তারা সাহায্য করেছেন।


দিল্লীতে চিন্তায় আছেন অনেকে...
২০১৫-এর ফেব্রুয়ারীতে ‘দ্যা ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনে এক লেখায় বাংলাদেশের ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীর পরিকল্পনা নিয়ে লিখেন Wikistrat-এর গবেষক পুষন দাস। সাবমেরিন সম্পর্কে তিনি লিখেন, “The addition of offensive vessels like submarines, however, suggests that Dhaka still views India and Myanmar’s interest in the region as a threat or that it wants to harness capabilities that will help it to be taken a serious regional player”. পরিষ্কারভাবেই দিল্লী এখন চিন্তা করতে শুরু করেছে যে বাংলাদেশ দিল্লীর কথা মোতাবেক চলছে না। যদি এখানে পরিষ্কার না হয় যে দিল্লীতে অনেকে বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন, তাহলে “based on its envisaged “Force Goal 2030,” the possible rise of a regional naval power in the Bay of Bengal is sure to ruffle a few feathers in New Delhi” – এই কথাগুলি সেটা একেবারেই খোলাসা করে দিচ্ছে। সাবমেরিন ক্রয়ের ঘোষণা দিল্লীকে নাড়া দিয়েছে এটা নিশ্চিত। তবে এর মাঝেই বাংলাদশকে নিচু করতেও সুযোগ ছাড়েননি পুষন দাস। তিনি বলেন, “Dhaka is supposed to have approached India to help provide it with two submarines sometime in 2013. The Indian Navy, itself down to historically low submarine numbers, was in no position to meet the request. The Indian recommendation was to approach Russia, but China was willing and able to step in and meet the demand”. এই কথাগুলি উপরের কথাগুলির সাথে সাংঘর্ষিক। যদি বাংলাদেশের নৌশক্তি ভারতে জন্যে চিন্তার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে ভারত কেন চাইবে বাংলাদেশ সাবমেরিন কিনুক? আর বাংলাদেশই বা কেন ভারতের কাছে ছুটে যাবে সাবমেরিনের জন্যে? যেখানে ভারত থেকে কোন ধরনের সামরিক অস্ত্র কেনার কোন নীতিই নেই বাংলাদেশের, সেক্ষেত্রে এধরনের উদ্ভট দাবি ভারতীয় হীনমন্যতাকেই সম্মুখে নিয়ে আসে।

আর ভারত যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় সফল হচ্ছে না, সেটা পুষন দাসের সুপারিশসমূহ দেখলেই বোঝা যায়। তিনি সুপারিশ করেন, “When the Bangladesh Navy eventually does acquire the capability to operate in the air, surface and under water it will be of paramount importance for India to engage and develop ties to not only better gauge Bangladesh’s intent but also to create a regional ally instead of a competitor. Any other outcome has the potential to produce a naval competition in the Bay of Bengal that Bangladesh can ill afford and India certainly does not need”. এই কথাগুলির মাধ্যমে পুষন বলছেন যে, বাংলাদেশকে আটকাতে না পারলে বরং পক্ষে রাখার চেষ্টা করাটাই ভারতের জন্যে উত্তম। যৌথ মহড়ার আয়োজন করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে অধীনে রাখার কথা তিনি বলেছেন। তবে তিনি শেষে এ-ও বলে দিচ্ছেন যে ভারতকে বঙ্গোপসাগরে বন্ধু হিসেবে না পেলে বাংলাদেশের বিপদ হবে। এই কথার মাঝে দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে ভারতের পিছে চলার এবং না মানলে বিপদের হুমকি দিচ্ছেন।
 
আটলান্টিকের ওপাড় থেকে লবিং
পুষন দাস সরাসরি ভারতের হয়ে লিখলেও ভারতের পক্ষের বিভিন্ন লবি অন্য স্থান থেকেও লেখা পকাশ করছে, যা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করছে। ২০১৫-এর ডিসেম্বর মাসে কানাডার Center for International Maritime Security (CIMSEC)-এর পক্ষ থেকে পল প্রাইস বঙ্গোপসাগরের ম্যারিটাইম ব্যালান্স নিয়ে একটা লেখা লিখেন। তার লেখার ধরনটাও ছিল পুষনের মতোই। প্রথমে তিনি “But the maritime capabilities of the People’s Republic of Bangladesh, a country that occupies a geopolitically interesting location between South Asia and Southeast Asia, merits some attention.”- এই কথাগুলির মাধ্যমে পাঠকের দৃষ্টি টেনে আনেন বাংলাদেশের দিকে। আর শেষ করেন, “it is clear that this country does not receive sufficient attention in analyses of South Asian security. An emergent Bangladesh is unlikely to challenge India for supremacy in the Bay of Bengal, but it could tip the balance of power one way or the other in the struggle between China and India. Accordingly, other powers with a stake in Asia should keep an eye on Bangladesh’s fleet expansion and modernization.” – এই কথাগুলি দিয়ে। এখানেও পুষনের মতোই বাংলাদেশকে ছোট করার চেষ্টা করেন তিনি। বাংলাদেশের সামরিক জাহাজ নির্মাণের পরিকল্পনাকে হাস্যস্পদ প্রমাণ করতে তিনি বলে যে, বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণের সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতা হচ্চে ১৯৮৭ সালে থাইল্যান্ডের একটা ফিশিং ট্রলার আটক করে সেটা মডিফাই করে স্যালভেজ ভেসেলে রূপান্তর করা! এটা বিশ্বাস করা অবান্তর যে ওরকম একটা আন্তর্জাতিক ইন্সটিটিউটে বসে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে এতোটা কম জানেন এবং সেই স্বল্পজ্ঞান নিয়েই তিনি লিখতে বসেছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে। শুধু এই স্যালভেজ ভেসেলই নয়, তিনি এ-ও বলেন যে, “Claims of ‘dominion’ over those waters, coupled with a few heavy-handed confrontations, could be sufficient to jeopardize relations between Bangladesh and India at a time when the latter loans the former an average of almost $1 billion a year for infrastructure projects”. এই কথাগুলির মানে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, বাংলাদেশ “প্রতিবছর ভারতের কাছ থেকে গড়ে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ” নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে! আর এই ঋণ বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশ বিপদে পড়ে যাবে! এটাও তিনি না জেনে লিখেছেন, সেটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার লেখাতে বরং দিল্লীর চিন্তাবিদদের ছায়া পাওয়া যায়। দিল্লীর পলিসি অনুসরণ করেই প্রাইস এখানে বাংলাদেশকে হুমকি প্রদান করছেন।

দুর্বল রাষ্ট্র অন্যের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে
বিশাল, কিন্তু কৌশলগত দিক থেকে দুর্বল রাষ্ট্র* হবার কারণে ভারত অনেক সমস্যায় রয়েছে। এর উপরে অভ্যন্তরীন সমস্যার কারণে ভেতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে মরছে ভারত। ভারতের এই অবস্থার কথা এখন সারা বিশ্ব জানে; তাই ভূরাজনৈতিক পূর্বাভাষে অনেকেই সামনের দিনগুলিতে ভারতের অস্তিত্ব দেখতে পান না। কারণ তারা বুঝতে পারছেন যে ভারতের দুর্বলতার সুযোগ নিতে কেউ কেউ কার্পণ্য করবে না, বিশেষত এর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি। তবে আপাততঃ ভারত টিকে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে। মোদীর বারাক ওবামাকে জড়িয়ে ধরার পর থেকে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের লক্ষ্য যে এক, সেটা বুঝতে খুব কষ্ট করতে হয় না। দুর্বল রাষ্ট্র হবার কারণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক বছরে ভারতের সবচাইতে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০১৬ সালে বঙ্গোপসাগরে অনুষ্ঠেয় ‘এক্সারসাইজ মালাবার’ অনুষ্ঠিত হবে ফিলিপাইন সাগরে। এর ঘোষণা মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের কমান্ডার নিজেই দিয়েছেন দিল্লী সফরে এসে। নিজের কাজে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ব্যবহার করছে; আর ভারত নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে। প্যাসিফিকে ভারতীয় নৌশক্তি যাওয়া মানে হলো যুক্তরাষ্ট্র এখন অরও সহজে তার সামরিক শক্তিকে ‘অপেক্ষাকৃত কম দরকারী’ এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে তাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মোতায়েন করতে পারবে। এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলি যে মুসলিম দেশগুলি, সেটা আজ সবারই জানা। অর্থাৎ ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে। ঠিক একই নীতির অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগরে তথা ভারত মহাসাগরে নৌশক্তি হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঠেকানোর চেষ্টায় রয়েছে ভারত। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে অক্ষম এই বিশাল রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার নিজের পতনকে ত্বরান্বিত করছে মাত্র।



*পড়ুনঃ “শক্তিশালী ভারতের ভয়” – সাম্প্রতিক দেশকাল, ০১ অক্টোবর ২০১৫

Monday 18 April 2016

ঢাকার ভূকৌশলগত গুরুত্ব – আমরা কতটুকু বুঝি?

১৮ই এপ্রিল ২০১৬

 
ঢাকা যে ভূকৌশলগত দিক থেকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তিনটি প্রধান নদীকে একত্রে চিন্তায় না নিয়ে আসলে বোঝা সম্ভব নয়। ঢাকা উপদ্বীপ হচ্ছে হৃতপিন্ড, আর নদীগুলি হচ্ছে ধমনী; নৌযান ও পণ্য হচ্ছে হৃতপিন্ডের দ্বারা ধমনীর মাঝ দিয়ে পাম্প করা রক্ত!


ঢাকা শহরের গুরুত্ব নিয়ে কাউকে একটা রচনা লিখতে বললে তিনি কি কি লিখবেন? তিনি অবশ্যাবশ্যই শহরটির অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঢাকা শহরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়েছিল কি এইসব কারণে; নাকি অন্য কোন কারণে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ হবার পরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি যোগ হয়েছে এই লিস্টে? উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে মরুভূমির মাঝে পানির উতস না থাকলে সেখানে শহর হয় না। আমাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে এমন কিছু ব্যাপার ঘেঁটে দেখতে হবে, যেগুলি ভূমন্ডলের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলির অন্যতম, যেমন ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, জলবায়ু, ইত্যাদি, যেগুলি কিনা আমাদের আলোচনাতে আসা বেশিরভাগ বিষয়বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করে; যে বিষয়গুলি ভূকৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

শক্তির কেন্দ্র

ঢাকা বলতে আমরা শুধু ঢাকা শহর বলে ফুলস্টপ দিলে ভুল করবো। ঢাকা হলো এর আশেপাশের পুরো এলাকা, যেখানে রয়েছে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং আশেপাশের এলাকা। এই বৃহত্তর ঢাকা অবস্থিত তিনটি বিশাল নদীর মাঝখানের এক উপদ্বীপে। এর পশ্চিমে রয়েছে যমুনা নদী, যা ব্রহ্মপুত্র নদের মূল প্রবাহ, দক্ষিণে রয়েছে পদ্মা বা গঙ্গা নদী, আর পূর্বে রয়েছে মেঘনা নদী, যা সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীর সম্মিলিত প্রবাহ। নাব্যতা দেওয়া গেলে যমুনা নদী দিয়ে একটি জাহাজ ভারতের আসাম রাজ্য হয়ে আরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত যেতে পারবে। অন্তত একসময় সেটা কিন্তু স্বাভাবিকই ছিল। পদ্মা নদী দিয়ে একটি জাহাজ একসময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং উত্তর প্রদেশ হয়ে দিল্লী যেতে পারতো। এখন সেটা ফারাক্কার কৃত্রিম বাঁধের ফলে সম্ভব হয় না। সুরমা আর কুশিয়ারা নদীর মাধ্যমে ঢাকা যুক্ত ছিল সিলেট, মেঘালয়, আসাম এবং ত্রিপুরার সাথে। আবার ঢাকার সাথে ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক শহরগুলির রয়েছে চমতকার যোগাযোগ। শুধু তা-ই নয়। মেঘনা অববাহিকার মাধ্যমে সমুদ্রের সাথে রয়েছে সরাসরি যোগাযোগ। এই পুরো এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টিপাত কমতে থাকে গঙ্গা নদী দিয়ে উত্তর-পশ্চিমে যেতে থাকলে। এই এলাকার বেশিরভাগ অঞ্চলই নদী-বিধৌত সমভূমি, যার ফলশ্রুতিতে এখানকার মাটি স্বাভাবিকভাবেই খুব উর্বর। বৃষ্টিপাতের কারণে এখানে প্রচুর ফসল ফলে, যার কারণে এখানে জনসংখ্যা বেশি। অর্থাৎ অনেক বড় জনসমষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা রয়েছে এই তিন নদী অববাহিকার। এই নদী অববাহিকার উতপাদিত পণ্যের সাথে সমুদ্রের যোগাযোগের দরজা হচ্ছে ঢাকা। এভাবে ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং জলবায়ুগত কারণে তিন নদীর মাঝের এই এলাকার শক্তিশালী অবস্থান এখানে একটি শহর চেয়েছিল।

প্রাচীনকাল থেকেই ঢাকা অঞ্চল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের দুয়ার হলেও এখানে একটা শহর স্থাপনের গুরুত্ব মুঘল সাম্রাজ্যের আমলারাই বুঝেছিলেন। আর তাঁরা এ-ও বুঝেছিলেন যে এখানে শহর প্রতিষ্ঠা না করলে ভারত মহাসাগরে নতুন আসা ইউরোপিয়ানরা এখানকার কর্তৃত্ব নেবার চেষ্টা করবে। সপ্তদশ শতকে মুঘল সম্রাটের সাথে ইস্তাম্বুলে আসীন মুসলিম বিশ্বের খলিফার বেশ নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রে ইউরোপিয়ানদের অভিপ্রায় সম্পর্কে মুঘল সম্রাট জানতেন। ঢাকার কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে মুঘলরা এই অতি গুরুত্বপূর্ণ নদী অববাহিকা ইয়রোপিয়ানদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। হাজার হোক, সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর ৬০%-এর বেশি খরচ দিত বাংলা। আর ঢাকা দাঁড়িয়ে ছিল বাংলা, তথা সমগ্র উত্তর ভারত আর আসামের চাবি হিসেবে। ঢাকার নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, সে এই তিন নদীর অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ করবে। বৃটিশরা এখানে এসে ঠিকই বুঝেছিল যে তারা ঢাকা এতো সহজে নিতে পারবে না। অন্তত নিজেরা এখানে শক্তিশালী না হতে পারলে ঢাকার কৌশলগত শক্তিকে তাদের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। ঠিক একারণেই ঢাকার এই কর্তত্বপূর্ণ অবস্থানকে বাইপাস করার লক্ষ্যে বৃটিশরা কোলকাতা, সূতানটী ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করে নতুন ব্যবসাকেন্দ্র কোলকাতা। বাংলার নবাবের রাজধানী তখন ছিল মুর্শিদাবাদ। কোলকাতায় অবস্থানের ফলে মুর্শিদাবাদে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করাটা বৃটিশদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছিল।

ঢাকার মৃত্যু

আস্তে আস্তে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে ব্রিটিশরা বাংলার নবাবীত্ব পেয়ে গেলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত শক্তি হিসেবে ঢাকার মৃত্যু ঘটে। চার’শ বছর আগে মুঘলরা যে চিন্তা করে ঢাকাকে এখানকার কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন, সেট আবারও বাস্তবায়ন শুরু হয় বিংশ শতাব্দীতে এসে। ব্রিটিশরা দেশ বিভাগের সময়ে ঢাকাকে বাংলা বিভাগ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিল সফলভাবে। কিন্তু যেটা নিয়ে বেশিরভাগ মহলেই বিতর্ক হয় না তা হলো ঢাকার শক্ত ভূকৌশলগত প্রাকৃতিক অবস্থান আর কোলকাতার কৃত্রিম রাজনৈতিক অবস্থান। ব্রিটিশ ভারতে কোলকাতা ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক কেন্ত্র ছিল ১৯০৯ সাল পর্যন্ত, যার পরে সেটা দিল্লীতে চলে যায়। তবে অর্থনৈতিক দিক থেকে কোলকাতা সবার উপরেই থাকে বাংলার গুরুত্বের জন্য। কারণ বাংলা ছিল পুরো ভারতের আসল শক্তি। তবে কৃত্রিম স্থানে অবস্থানের জন্যে কোলকাতার পক্ষে পুরো বাংলা এবং আসামের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কোলকাতা থেকে আসাম পর্যন্ত সামরিক রসদ যেতে জাহাজগুলিকে কোলকাতা থেকে সুন্দরবনের মাঝে দিয়ে খুলনা, গাবখান চ্যানেল, বরিশাল, চাঁদপুর, আরিচা, সিরাজগঞ্জ, চিলমারী হয়ে আসাম যেতে হতো। অথচ ঢাকা থেকে সেটা আরও কতো সহজে হতে পারতো, যদি ব্রিটিশরা কোলকাতার স্থানে ঢাকাকে রাজধানী করতো। আসলে বাংলাকে শক্তিশালী রাখার পক্ষপাতি তারা ছিল না বলেই প্রাকৃতিক সকল শক্তি এখান থেকে সড়িয়ে দিয়েছিল তারা। পরবর্তীতে সেই লাইনেই তারা ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ করে মূলত বাংলাকে, তথা তিন নদীর কৌশলগতভাবে শক্তিশালী অববাহিকাকে দুই ভাগ করেছিল।
  
মীর জুমলার মতো লোকেরা অর্ধেক ভর্তি গ্লাসকে অর্ধেক খালি হিসেবে দেখেছিলেন, এবং বাকিটা ভরার জন্যে উদগ্রীব ছিলেন সবসময়। তাঁরা ঢাকার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝেছিলেন।

আবার বেঁচে ওঠার চিন্তা

মুঘলরা যখন ঢাকাকে রাজধানী বানিয়েছিল, তখন ঢাকায় স্থাপন করা হয় লালবাগ কেল্লা। এটা শুধু কোন দর্শনীয় স্থান নয়, এটা ছিল কৌশলগত অবস্থানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দুর্গ, যার হাতে ছিল পুরো বাংলার নিয়ন্ত্রণের চাবি। কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ঢাকার আশেপাশের নদীগুলির জন্যে। যারা প্রাণভয়ে ঘুমাতে পারেন না, তাদের কাছে ঢাকা হচ্ছে তিন নদীর মাঝে নিরাপদ এক স্থান, যেটাকে দখল করা কঠিন। আর অন্যদের কাছে ঢাকা হচ্ছে এমন এক কৌশলগত ঘাঁটি, যেটার উপর নির্ভর করে পুরো বাংলা শুধু নয়, পুরো উত্তর ভারত, এমনকি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ব্যাপারটা হচ্ছে অর্ধেক গ্লাস পানির মতো – অর্ধেক ভর্তি, না অর্ধেক খালি? মীর জুমলা ঢাকাকে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে বিশাল রিভারাইন ফোর্স গঠন করে আসাম আক্রমণ করেছিলেন। আর শায়েস্তা খান এই ঢাকাকে ব্যবহার করেই চট্টগ্রাম দখল করে বাংলার শাসনের অধীনে এনেছিলেন। তাঁরা গ্লাসকে সবসময় অর্ধেক খালি হিসেবেই দেখেছিলেন; তাই গ্লাস পুরোপুরি ভরার চিন্তায় বিভোর ছিলেন; মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলেন না। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মুঘলদেরকে সমুদ্র হাতছানি দিয়ে ডাকেনি। তাই তারা উত্তাল বঙ্গোপসাগরে ইউরোপিয়ানদের চ্যালেঞ্জ করেননি। মুঘলরা ম্যারিটাইম দেশ হিসেবে বাংলাকে চিন্তা করেননি। তবে চার’শ বছর পর আমরা অনেক দেরীতে হলেও এ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছি।

 
 
লালবাগ কেল্লাকে শুধুমাত্র দর্শনীয় স্থান হিসেবে চিন্তা না করে আমাদের আজ চিন্তা করতে হবে যে কোন চিন্তার উপরে নির্ভর করে এই কেল্লা নির্মিত হয়েছিল? এই কেল্লার ইট-পাথরের মাঝেই রয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর।

এর আগে একটি লেখায় রিভারাইন ফোর্স নিয়ে লিখেছি। এই পুরো রিভারাইন ফোর্সের কেন্দ্রবিন্দুতে ঢাকা। আর এই শক্তিকে বুঝতে হলে ঢাকাকে চিন্তা করতে হবে হৃতপিন্ড হিসেবে, আর প্রধান নদীগুলিকে চিন্তা করতে হবে ধমনী হিসেবে; নদীর নৌযানগুলি এবং তাদের পরিবহণ করা পণ্যকে রক্ত হিসেবে। হৃতপিন্ড না থাকলে ধমনী যেমন শুকিয়ে যাবে; তেমনি ধমনী না থাকলে হৃতপিন্ডের অস্তিত্বই প্রশ্নের সন্মুখীন হবে। এই হৃতপিন্ডই রক্ত পাম্প করবে ধমনী বরাবর; আর ধমনী সেটাকে নিয়ে সজোরে ফেলবে সমুদ্রে, যেখানে হবে এই শক্তির আসল বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা নিয়ে নতুন রচনা লেখার এটাই সময়। লালবাগ কেল্লার বিল্ডিংগুলিকে আবার নতুন করে বুঝতে হবে আমাদের। কারণ সেই পুরোনো ইট-পাথরের মাঝেই রয়েছে আমাদের শক্তির সূত্র।