Wednesday 31 August 2022

ইউক্রেন যুদ্ধের ছয় মাস… বৈশ্বিক প্রভাব, যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ

০১লা সেপ্টেম্বর ২০২২
 
জুন ২০২২। ডনবাসে ইউক্রেনিয় সেনারা ফরাসি নির্মিত 'সীজার' আর্টিলারি থেকে গোলাবর্ষণ করছে। যুদ্ধ শুরুর ছয় মাসের মাঝে যুদ্ধটা একে অপরের ক্ষতি বাড়ানোর যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। উভয় পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক; কিন্তু কেউই বড় রকমের কোন বিজয় ছিনিয়ে নেবার মতো অবস্থানে নেই।

২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। যুদ্ধ শুরুর ছয় মাস পর এই যুদ্ধের প্রভাব এখন বিশ্বব্যাপী প্রতিফলিত হচ্ছে। ‘দ্যা ইকনমিস্ট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধ শুরুর ছয় মাসের মাঝে যুদ্ধটা একে অপরের ক্ষতি বাড়ানোর যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। উভয় পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক; কিন্তু কেউই বড় রকমের কোন বিজয় ছিনিয়ে নেবার মতো অবস্থানে নেই। ইউক্রেনিয়ান জেনারেল দিমিত্রো মারচেঙ্কোর মতে, বছর শেষ হবার আগেই ইউক্রেনের দক্ষিণের খেরসন শহর তাদের দখলে চলে আসবে। কিন্তু এহেন উচ্চাকাংক্ষা বাস্তবায়ন যে কঠিন হবে, তা সহজেই অনুমেয়। অপরদিকে যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে; যদিও ইউক্রেনের গম রপ্তানি শুরু হবার কারণে যুদ্ধের শুরুতে ইউরোপে খাবারের মূল্য যতটা বেড়ে গিয়েছিল, সেই অবস্থা থেকে তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। তথাপি যুদ্ধ দীর্ঘ হবার সম্ভাবনাটাই বেশি।

সামরিক পরিস্থিতির ছয় মাস

ছয় মাসের যুদ্ধ থেকে পাঁচটা সামরিক শিক্ষা নিয়েছে ‘আল জাজিরা’। প্রথমতঃ যুদ্ধের আগে পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা রুশ সামরিক বাহিনীকে যেভাবে দেখতেন, এখন বোঝা যাচ্ছে যে, তাদের সেই বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ ভুল ছিল। যুদ্ধের প্রথম দিকে রুশ বিমান বাহিনী আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। এর ফলশ্রুতিতে রুশ সেনাবাহিনীর গাড়ির সাড়িগুলি ইউক্রেনের বিমান ও ড্রোনের আক্রমণের শিকার হয়েছে। বাহিনীগুলির মাঝে সমন্বয়হীনতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সেনাদের রসদ এবং খাবার ফুরিয়ে যাবার পর দীর্ঘ গাড়ির সাড়িগুলির উপর ইউক্রেনিয়দের হামলা মনে করিয়ে দেয় যে, প্রথম দিনেই ইউক্রেনিয়দের যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাবার যে আশা রুশরা করেছিল, তা কতটা ভুল ছিল। বাহিনীগুলির কর্মকান্ডকে বশে আনতে গিয়ে উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসাররা ফ্রন্টলাইনের একেবারে কাছে গিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন। আর একইসাথে রুশ যোগাযোগ ব্যবস্থার অত্যন্ত খারাপ অবস্থার কারণে ইউক্রেনের ইন্টেলিজেন্স খুব সহজেই রুশ জেনারেলদের অবস্থানের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারকে ইউক্রেনিয়রা টার্গেট করে হত্যা করতে সক্ষম হয়। কয়েক মাস যুদ্ধের পর রুশরা তেমন সফলতা না পেয়ে কৌশল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। নতুন টার্গেট হয় ইউক্রেনের পূর্বের ডোনেতস্ক অঞ্চল; যেখানে পরিকল্পনামাফিক যুদ্ধ করে তারা যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে সেভেরোডোনেতস্ক শহরের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। তবে দক্ষিণের বন্দর শহর ওডেসার দিকে রুশ আক্রমণ ইউক্রেনিয়দের প্রতিরোধের মুখে সফল হয়নি। তারা ধীরে ধীরে পিছু হটে গিয়ে নীপার নদীর উপরে খেরসন শহরে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়।

দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউক্রেনিয়রা বিরাট সুবিধা পায় পশ্চিমাদের সরবরাহ করা বড় সংখ্যক শক্তিশালী ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহে। একইসাথে তুর্কি ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোনগুলি ইউক্রেনের আর্টিলারির জন্যে নিখুঁতভাবে টার্গেট খুজে দেয়। এর ফলে রুশ সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ রাডার, কমান্ড ও কন্ট্রোল ইউনিটগুলিকে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হয়। এতে রুশ সেনাবাহিনীর সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক যুদ্ধ করতে ইউক্রেনে আবির্ভূত হয়। এরা ইউক্রেনের বাহিনীকে যথেষ্ট সহায়তা দিলেও ভাষার ভিন্নতা এদের সফলতা কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ থেকে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র আসতে থাকে, যা ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে নিতে সহায়তা দেয়। এগুলির মাঝে ছিল বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ, নিখুঁতভাবে আঘাত করার মতো আর্টিলারি, আর্টিলারি রকেট, এবং রুশ নির্মিত ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান, যেগুলি ইউক্রেনিয়রা খুব স্বল্প ট্রেনিংএর মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। তবে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সেই অস্ত্রগুলিই দিয়েছে, যেগুলি দিয়ে ইউক্রেনিয়রা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমিগুলিকে রক্ষা করতে পারবে; দূরপাল্লার রকেট সরবরাহ করা থেকে তারা বিরত থাকে। পশ্চিমারা যুক্তি দেয় যে, তারা রুশদের সহ্যের সীমাকে অতিক্রম করতে চায় না; যে পরিস্থিতিতে তারা হয়তো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে আগ্রহী হতে পারে। আর ছয় মাসে যদিও ইউক্রেনিয়রা রুশ আক্রমণের দ্রুতিকে একেবারেই থামিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, তথাপি নিজেদের সামরিক ক্ষতিকে ইউক্রেনের পক্ষে পুষিয়ে নেয়া দুষ্কর। বিশেষ করে হারানো মানবসম্পদ ইউক্রেনের পক্ষে প্রতিস্থাপন করা একেবারেই সম্ভব নয়। নিজেদের রসদ যখন একেবারেই শেষের পথে, তখন ইউক্রেন পশ্চিমা সহায়তার উপরে পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।

যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত 'হিমারস' আর্টিলারি রকেট। ব্যবহার করে ইউক্রেনিয়রা নিখুঁতভাবে দূরবর্তী টার্গেটগুলিকে ধ্বংস করতে পারছে। যুদ্ধক্ষেত্রে কে কার কতো বেশি ক্ষতিসাধন করতে পারছে সেটার উপরেই যখন এগিয়ে থাকা নির্ভর করতে শুরু করেছে, তখন ‘হিমারস’ প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই ব্যবস্থার উপর দূর থেকে হামলা করতে পারছে। এর ফলশ্রুতিতে রুশরা বড় কোন আক্রমণে যাবার উদ্দেশ্যে কোন একটা স্থানে যথেষ্ট পরিমাণে রসদ জমা করতে সক্ষম হচ্ছে না। একারণেই রসদের অভাবে রুশদের একটার পর একটা আক্রমণ বারংবার থেমে যাচ্ছে।


তৃতীয়তঃ বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ‘হিমারস’ আর্টিলারি রকেট যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনিয়দেরকে এগিয়ে দিয়েছে। ‘এম-১৪২’ ‘হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম’ বা ‘হিমারস’ নামে পরিচিত অস্ত্রটা হলো ট্রাকের উপর বহণ করা ছয়টা রকেট আর্টিলারি লঞ্চার। একেকটা রকেটের পাল্লা প্রায় ১৫ থেকে ৯২ কিঃমিঃ পর্যন্ত; যেখানে বেশিরভাগ আর্টিলারির পাল্লা সাধারণতঃ ৪০ কিঃমিঃএর ভেতর থাকে। তবে বিশেষ ধরণের রকেট ব্যবহার করে ‘হিমারস’এর পাল্লা প্রায় ১’শ ৫০ কিঃমিঃ পর্যন্ত নেয়া যায়। ‘হিমারস’ ব্যবহার করে ইউক্রেনিয়রা নিখুঁতভাবে দূরবর্তী টার্গেটগুলিকে ধ্বংস করতে পারছে। যুদ্ধক্ষেত্রে কে কার কতো বেশি ক্ষতিসাধন করতে পারছে সেটার উপরেই যখন এগিয়ে থাকা নির্ভর করতে শুরু করেছে, তখন ‘হিমারস’ প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই ব্যবস্থার উপর দূর থেকে হামলা করতে পারছে। এর ফলশ্রুতিতে রুশরা বড় কোন আক্রমণে যাবার উদ্দেশ্যে কোন একটা স্থানে যথেষ্ট পরিমাণে রসদ জমা করতে সক্ষম হচ্ছে না। একারণেই রসদের অভাবে রুশদের একটার পর একটা আক্রমণ বারংবার থেমে যাচ্ছে। ‘হিমারস’এর লঞ্চার গাড়ি ব্যবহার করে বড় আকারের একটা ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া যায়, যেটাকে বলা হয় ‘এডভান্সড ট্যাকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম’ বা ‘এটাকমস’। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৩’শ কিঃমিঃ পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত এই ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে রাজি হয়নি।

চতুর্থতঃ উভয় পক্ষই গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ও গোলাবারুদের ক্ষেত্রে সরবরাহ ঘাটতিতে রয়েছে। রুশরা পুরোনো আর্টিলারি ব্যবহার করছে, যেগুলির নিখুঁতভাবে টার্গেটে আঘাত করার সক্ষমতা বেশ খানিকটা কম। আবার এমন কিছু ক্ষেপণাস্ত্র তারা ভূমির টার্গেটের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, যেগুলি সেই কাজের জন্যে ডিজাইন করা হয়নি। এগুলি বলে দিচ্ছে যে, রুশরা গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহ ঘাটতির মাঝে পড়েছে। অপরদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনিয়রা বাণিজ্যিক ড্রোন ব্যবহার করে আকাশ থেকে গোলাবারুদ ফেলেছে। এটা ইউক্রেনিয়দের উদ্ভাবনী শক্তিকে দেখালেও বলে দিচ্ছে যে, যুদ্ধবিমান ও অস্ত্রসজ্জিত ড্রোনের ঘাটতিতে রয়েছে তারা। তবে পশ্চিমারা চিন্তায় রয়েছে যে, ইউক্রেনকে সরবরাহ করতে গিয়ে তাদের নিজেদের কিছু বিশেষ অস্ত্রের স্টকে টান পড়ে যাচ্ছে। কারণ উৎপাদন ও সরবরাহের মাঝে দেখা দিয়েছে ঘাটতি। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমারা কোন যুদ্ধে জড়ালে সেই অস্ত্রগুলির ঘাটতি তাদেরকে মারাত্মকভাবে ভোগাবে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রে মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতি ও আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে অনেকেই বলা শুরু করেছেন যে, বাইডেন প্রশাসনের উচিৎ বিদেশে যুদ্ধের দিকে মনোযোগ না দিয়ে দেশের মানুষের সেবায় মনোনিবেশ করা। অপরদিকে রুশরা প্রশিক্ষিত সেনার অভাবের মাঝে থাকলেও ইউক্রেনের যুদ্ধকে ‘যুদ্ধ’ বা বলে ‘বিশেষ সামরিক অপারেশন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা দিলে হয়তো আরও মানুষকে সামরিক বাহিনীতে যোগদান করানো সম্ভব হবে; কিন্তু তা হবে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্যে রাজনৈতিক আত্মহননের শামিল। এমতাবস্থায় হাঁপিয়ে ওঠা উভয় পক্ষই তাদের ফোকাসকে ইউক্রেনের দক্ষিণে খেরসন শহরের দিকে নিয়ে এসেছে।

 
খেরসন শহর এখন যুদ্ধের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। ইউক্রেনিয়রা নীপার নদী থেকে যে খালের মাধ্যমে রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপে পানি সরবরাহ করা হয়, সেই খালের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। ২০১৪ সালে রুশরা ক্রিমিয়া দখল করে নিলে ইউক্রেনিয়রা এই খালের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল; যা কিনা ক্রিমিয়ার কৃষি ও শিল্পের মোট পানির ৮৫ শতাংশের যোগান দিতো। এখন এই খালের উভয় পাড় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার পর রুশরা আবারও ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে। এই খালের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্যে যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।

পঞ্চমতঃ খেরসন শহর এখন যুদ্ধের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। শহরটা একইসাথে সমুদ্র ও নদীবন্দর; যা রুশরা গত মার্চ মাসে দখলে নেয়। নীপার নদীর পশ্চিমে অবস্থিত শহরটা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের সাথে দু’টা সেতু দিয়ে সংযুক্ত। সাম্প্রতিক সময়ে এই নদীর উপর দিয়ে নোভা কাখোভকা শহরে অবস্থিত সেতু ইউক্রেনিয়রা ধ্বংস করে ফেলার পর খেরসন শহরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে রুশদেরকে এই দু’টা সেতুর উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে। ইউক্রেনিয়রা খেরসনের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নীপার নদী দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট চালু করতে চাইছে। আর একইসাথে ইউক্রেনিয়রা নীপার নদী থেকে যে খালের মাধ্যমে রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপে পানি সরবরাহ করা হয়, সেই খালের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। ২০১৪ সালে রুশরা ক্রিমিয়া দখল করে নিলে ইউক্রেনিয়রা এই খালের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল; যা কিনা ক্রিমিয়ার কৃষি ও শিল্পের মোট পানির ৮৫ শতাংশের যোগান দিতো। এখন এই খালের উভয় পাড় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার পর রুশরা আবারও ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে। এই খালের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্যে যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এছাড়াও খেরসনের নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করছে রুশরা ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরের দিকে এগুতে পারবে কিনা। ওডেসা বন্দরের উপর সমুদ্রের দিক থেকে একটা উভচর হামলার পরিকল্পনা রুশরা আপাততঃ স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ এই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিতে হলে স্থলের দিক থেকে ঘিরে ফেলা ছাড়া গতি নেই। কিন্তু রুশরা স্থলের দিক থেকে ওডেসা থেকে বেশ কিছুটা দূরে রয়েছে।

‘আল জাজিরা’র বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, এই মুহুর্তে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ডোনেতস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চল ছাড়াও দক্ষিণের বেশকিছু অঞ্চল রুশদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এমতাবস্থায় রুশদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কতটুকু পেলে তারা এই যুদ্ধে ‘বিজয়’ হয়েছে বলে ঘোষণা দেবে। পশ্চিমাদের এক হিসেবে বলা হচ্ছে যে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এক দশকে আফগানিস্তানে যত সেনা হারিয়েছিল, রুশরা তার চাইতে বেশি সেনা ইউক্রেনে হারিয়েছে মাত্র ছয় মাসে! রুশদের রেলওয়ে লাইন এবং গাড়ির বহরের উপর চোরাগুপ্তা হামলা হচ্ছে; যা কিনা সময়ের সাথে সাথে আরও বাড়বে। ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে এখন সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সামনের ছয় মাস…

অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর জেনারেল মিক রায়ান ‘এবিসি নিউজ’এর এক লেখায় আগামী ছয় মাসে ইউক্রেনের যুদ্ধ কোন দিকে যেতে পারে, সেব্যাপারে কয়েকটা সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছেন। প্রথম সম্ভাবনা হলো, যুদ্ধক্ষেত্রে এবং রাজনৈতিক দিক থেকে উভয় পক্ষই থমকে থাকতে পারে; যেখানে কোন পক্ষই হয়তো বড় কোন বিজয় পাবে না। একে অপরকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে দুর্বল করার চেষ্টা চালাতে থাকবে এবং বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরির চেষ্টা করবে। তবে এই স্থিতাবস্থা রুশদের পক্ষে যাবে; কারণ তুলনামূলকভাবে ইউক্রেনের চাইতে রাশিয়ার মানবসম্পদ বেশি ও অর্থনীতির আকার বড়। অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও রুশরা তাদের জ্বালানি বিভিন্ন দেশের কাছে বিক্রি করে আয় করতে পারছে। কিন্তু ইউক্রেনের অর্থনীতি ছোট হয়ে আসছে এবং এই অর্থনীতি নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন। অপরদিকে রুশরা মনে করছে যে, ইউরোপের সরকারগুলি জনগণের চাপের মাঝে পড়বে। এর মাঝে তারা হয়তো ইউক্রেনকে চাপের মাঝে ফেলে যুদ্ধের একটা উপসংহার টানতে চাইবে। তবে রুশদের সাথে ছাড় দিয়ে শান্তিচুক্তি করাটা ইউক্রেনের সরকারের জন্যে যথেষ্ট কঠিন হবে।

দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, দুই পক্ষের মাঝে কোন একজন এগিয়ে যেতে পারে। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, রুশরা তাদের আক্রমণে যাবার শক্তি অনেকটাই হারিয়েছে। আর গত কয়েক সপ্তাহের মাঝে ‘হিমারস’ রকেট ব্যবহার করে ইউক্রেন কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। যদি ইউক্রেন সামনের দিনগুলিতে বড় কোন এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়, তাহলে পশ্চিমাদের মাঝে ইউক্রেনকে সমর্থনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। কারণ এতে পশ্চিমারা মনে করতে পারবে যে, ইউক্রেনকে সহায়তা দেয়ায় ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া বর্তমানের অস্ত্রের ঘাটতি পূরণে সামরিক উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে; যদিও সেটা পুরোপুরিভাবে নির্ভর করবে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী কতটা এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারছে বা কত বড় রুশ বাহিনীকে ধ্বংস করতে পারছে তার উপর।

তৃতীয় সম্ভাবনা হলো, কোন একটা পক্ষ হঠাৎ করেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক দিক দিয়ে বড় কোন বিজয় পেয়ে যেতে পারে; যেটার উপর ভর করে সে এরপর থেকে শুধু এগিয়েই যাবে। উদাহরণ হিসেবে, যুদ্ধরত দেশগুলির মাঝে কোন দেশের জাতীয় নেতার যদি মৃত্যু হয় অথবা তাকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়; অথবা হঠাৎ করেই যদি তাদের সেনাদের মনোবল পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়ে; অথবা অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক বড় কোন ঘটনা সংঘটিত হলো। যদি এহেন কোন ঘটনা ইউক্রেনের ভাগ্যে ঘটে, তাহলে ইউক্রেনের মাটিতে পশ্চিমা সেনা মোতায়েন না করে রুশদের অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না। এতে ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যাহত হবে এবং চীনের নিজস্ব বিশ্বাসকে শক্তিশালী করবে যে, পশ্চিমারা নিম্নগামী। এরকম পরিস্থিতিতে অনেক পশ্চিমা সরকার মারাত্মক চাপের মাঝে পড়বে।

জেনারেল মিক রায়ান বলছেন যে, যদি এমন কোন ঘটনা রাশিয়ার ভাগ্যে ঘটে, তাহলে এতে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের বিজয়ই হবে না, রুশরা মনে করতে শুরু করবে যে, এতদিন পশ্চিমাদের হুমকির যে ব্যাপারটা রুশ সরকার তাদের জনগণকে বলেছে, তা প্রকৃতপক্ষে সত্যি। এতে রুশদের মাঝে বিরক্তির উদ্রেক হতে পারে এবং আরও ভয়ংকর একটা রাশিয়া সামনে আসতে পারে।

 
রাশিয়া এখন ইউক্রেনের ১০ থেকে ২০ শতাংশ ভূমি দখলে রেখেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানেই রয়েছে ইউক্রেনের ৯০ শতাংশ জ্বালানি এবং বেশিরভাগ সমুদ্রবন্দর। কাজেই ইউক্রেনের জন্যে কোন ভূমি হারানোটাই সমীচিন নয়। এই অঞ্চলগুলি হারালে ইউক্রেন পশ্চিমাদের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন থাকবে।

যুদ্ধ কতটা দীর্ঘ হতে পারে?

‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পাদক ডন সাবাগ মনে করছেন যে, যুদ্ধ আরও কমপক্ষে এক বছর স্থায়ী হতে পারে; কারণ কোন পক্ষই বড় কোন বিজয় ছিনিয়ে নেবার সক্ষমতা দেখাতে পারছে না। ইউক্রেন চাইছে খেরসনের নিয়ন্ত্রণ নিতে, কিন্তু একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গোপনে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ইউক্রেনিয়দের প্রকৃতপক্ষে সেই সক্ষমতা নেই। ইউক্রেনিয়রা আপাততঃ দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং শত্রুর ফ্রন্টলাইনের পিছনে স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের ব্যবহার করে হামলার উপর নির্ভর করতে চাইছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক বলছেন যে, এতে রুশদের মাঝে সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এর ফলে রুশরা তো খেরসন ছেড়ে চলে যাবে না। আর বর্তমানে রুশরা তাদের দখল করা এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাতেই বেশি ব্যস্ত থাকছে। সামনের শীতকাল নিয়ে সকলেই চিন্তা করছে। ইউক্রেনিয়রা মনে করছে যে, শীতকালে রুশরা ইউক্রেনের উপর চাপ বাড়াতে দেশটার জ্বালানি নেটওয়ার্কের উপর হামলা করতে পারে। তবে এর পরের বসন্তকালটাকে উভয় পক্ষই আক্রমণে যাবার সময় হিসেবে দেখবে। তাই সেসময়ের আগে উভয় পক্ষই তাদের রসদের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে চাইবে। অপরদিকে পশ্চিমাদেরকে নিশ্চিত হতে হবে যে, তারা ইউক্রেন যুদ্ধে কি দেখতে চায়। তারা কি ইউক্রেনকে বিজয়ী দেখতে চায়, নাকি শুধু রুশদেরকে ঠেকিয়ে রাখা দেখতে চায়? তারা এতকাল ইউক্রেনকে অনেক সমরাস্ত্র দিলেও রুশদেরকে ঠেলে দেশ থেকে বের করে দিতে পারার মতো অস্ত্র কখনোই দেয়নি।

‘ভোক্স’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধের দীর্ঘতা মাসের সংখ্যায় মাপা সম্ভব নাও হতে পারে; অর্থাৎ তা হতে পারে কয়েক বছরব্যাপী। উভয় পক্ষই এখনও মনে করছে যে, তারা যুদ্ধের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে সক্ষম। একারণে কেউই এখনও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছাড় দিতে ইচ্ছুক নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় কারুর লক্ষ্য থাকে না; যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় হলো রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের একটা পদ্ধতি। ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর সিনিয়র ফেলো এনা এশফোর্ড বলছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেমন দেখা গেছে যে, এক পক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে জিতে গেছে এবং সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়েছে – এমন ঘটনা ইতিহাসে খুব বেশি নেই। ইউক্রেন যুদ্ধও ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ের ব্যতিক্রম হবে না। ইউক্রেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে হারিয়ে দেয়াটা এখন রাশিয়ার সক্ষমতার বাইরে। কাজেই এটা মোটামুটিভাবে ধরেই নেয়া যায় যে, যুদ্ধের শেষটা হবে আলোচনার টেবিলে; যেখানে কোন পক্ষই প্রথমে যা চেয়েছিল তা পুরোপুরিভাবে পাবে না। তবে কিছু ব্যাপার নির্ধারণ করবে এই যুদ্ধের স্থায়িত্ব; যেমন – ইউক্রেন এবং রাশিয়াতে জনমত; উভয় দেশের অর্থনীতির উপরে চাপ; এবং ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাবার পিছনে পশ্চিমা দেশগুলির সক্ষমতা। এটা পরিষ্কার যে, রাশিয়া প্রথমে যে লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তা অর্জনে সে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ইউক্রেন জিতে গেছে। ইউক্রেনের শহরগুলির ধ্বংস হওয়া, তার শিল্পগুলিতে ধ্বস, কৃষিজমি ভস্ম হয়ে যাওয়া, বিরাট জনসংখ্যার মৃত্যু ও বাস্তুচ্যুতি – এগুলি ইউক্রেনকে মারাত্মক ক্ষতির মাঝে ফেলেছে। ইউক্রেনকে আবারও নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলে একদিকে যেমন রাশিয়াকে ব্যাপক ছাড় দিতে হবে, তেমনি পশ্চিমা দেশগুলিকেও ইউক্রেনের পূনর্গঠনের জন্যে বড় রকমের দায়িত্ব নিতে হবে।

যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাব

‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের জনগণের অনেকেই পশ্চিমা-ঘেঁষা হবার পক্ষেই ছিল। কিন্তু পশ্চিমারা এব্যাপারে খুব একটা নিশ্চিত ছিল না। যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমারা ইউক্রেনের ব্যাপারে তাদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে যাচ্ছে। যেমন ইউক্রেনকে ইইউএর অংশ করে নেবার পদ্ধতি শুরু হয়েছে; যা কিনা ইউক্রেন অনেকদিন ধরে অনুরোধ করলেও ইইউ মানতে চায়নি। যুদ্ধ ইউক্রেনকে পশ্চিমাদের আরও নিকটে নিয়ে গেছে। অপরদিকে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের দূরত্ব বহু বছরের জন্যে বেড়ে গেছে। এর ফলশ্রুতিতে রাশিয়া বাকি বিশ্বে নতুন বন্ধু খুঁজছে; যেমন চীনের কাছে জ্বালানি বিক্রি করা, অথবা ইরানের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা। ইরান যেহেতু কয়েক দশক ধরেই পশ্চিমা অবরোধের মাঝে রয়েছে এবং অবরোধকে কিভাবে বাইপাস করা যায়, সেটা শিখেছে; তাই রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে সেটা শিখতে চাইছে।

খাদ্যসংকট - প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে আফ্রিকায় খাদ্যসংকটের ইস্যুটাকে নিয়ে আসা হয়েছে। আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় মোট খাদ্যের অর্ধেক গম থেকে উৎপন্ন হয়। অথচ দেশটা তার চাহিদার ৮০ শতাংশ গম আমদানি করে। খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি পুরো নাইজেরিয়াতে মানুষের নিরাপত্তাহীনতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০২৩ সালে নাইজেরিয়াতে সাধারণ নির্বাচনের আগে সরকার যদি অবস্থার উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রেসিডেন্টকে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হতে পারে। আর আফ্রিকার সবচাইতে জনবহুল দেশে রাজনৈতিক কলহ সৃষ্টি হলে সেটার প্রভাব পুরো পশ্চিম আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ভারত, রাশিয়া ও চীন - ভারতের সাথে রাশিয়ার গভীর সম্পর্ক বহুকাল ধরেই। আর যুক্তরাষ্ট্রও ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে দেখতে চায় বলে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করেনি। এতে ভারতের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে। এর মাঝে অনেকেই ভারতের নিজস্ব স্বার্থকে সমুন্নত রাখার কথা বলতে থাকে এবং পশ্চিমা দ্বিমুখী নীতিকেও আলোচনায় নিয়ে আসে। তারা রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানির ফলশ্রুতিতে পশ্চিমাদের সমালোচনাকে ভালো চোখে দেখেনি। কিন্তু সমস্যা হলো, রাশিয়া যদি চীনের আরও কাছে যেতে শুরু করে, সেটা ভারতের স্বার্থের বিপক্ষে চলে যেতে পারে। এবং এতে ভারত কূটনৈতিক দিক থেকে সমস্যার মাঝে পড়ে যেতে পারে। তবে ভারত যেহেতু বহু স্বার্থের যোগফল, তাই ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতের সামনে নতুন সুযোগও তৈরি করেছে। উল্টোদিকে মার্কিন কংগ্রেসের স্পীকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর উত্তেজনা শুরু হলে তাইওয়ানও চীনের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধের ব্যাপারে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, সেটা নিয়ে চিন্তা শুরু করেছে।

তুরস্ক, ইউক্রেন ও রাশিয়া - ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, অদ্ভুত একটা পরিস্থিতিতে রয়েছে তুরস্ক। ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক একদিকে যেমন ইউক্রেনকে সমর্থন দিচ্ছে, তেমনি তারা চেষ্টা করছে রাশিয়াকে না ক্ষেপাতে। তারা কিয়েভের কাছে ড্রোন বিক্রি করেছে; কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধে যোগ দেয়নি। উভয় পক্ষের সাথে সম্পর্ক রাখার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইউক্রেনের গম রপ্তানির জন্যে কাজ করেছেন এবং তার এই অবস্থানকে বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য বলে জাহির করেছেন। তবে ২০২৩ সালের নির্বাচন যখন কাছে চলে এসেছে, তখন অনেকেই প্রশ্ন করছেন যে, তিনি তার এই অবস্থানকে কতটা ধরে রাখতে পারবেন।

 
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা 'গ্লোবাল টাইমস'এ প্রকাশিত মার্কিনীদের সমালোচনামূলক কার্টুন। যে ব্যাপারটা মার্কিনীদেরকে ভাবাচ্ছে তা হলো, তাদের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া এবং চীন এখন আরও কাছাকাছি চলে এসেছে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইউরোপের সাথে আরও শক্তিশালী বন্ধুত্ব তৈরি করতে।

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন - আটলান্টিকের ওপাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বৈরিতা যখন চীনের দিকে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় অনেকেই মার্কিনীদের ফোকাস রাশিয়ার দিকে নিয়ে গিয়েছে; যদিও চীনকে কেউই হিসেব থেকে বাদ দেয়নি। যে ব্যাপারটাতে সকলেই নিশ্চিত হয়েছেন তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র এখনোও ইউরোপের নিরাপত্তার কেন্দ্রে রয়েছে। ইউরোপের কৌশলগত স্বাতন্ত্রের যে কথাগুলি শুরু হয়েছিল, তা বর্তমান বাস্তবতায় যৌক্তিকতা পাচ্ছে না। তবে যে ব্যাপারটা মার্কিনীদেরকে ভাবাচ্ছে তা হলো, তাদের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া এবং চীন এখন আরও কাছাকাছি চলে এসেছে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইউরোপের সাথে আরও শক্তিশালী বন্ধুত্ব তৈরি করতে।

ইউরোপ ও জ্বালানি সংকট - যুদ্ধের কারণে ইউরোপ সবচাইতে চাপের মাঝে পড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যুদ্ধের আগে যেখানে রাশিয়া ছিল ইউরোপের সবচাইতে বড় জ্বালানি সরবরাহকারী, এখন তারা হঠাত করেই রুশ জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে উঠেপড়ে লেগেছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ ইউরোপের একাত্মতাকে প্রশ্নের মাঝে ফেলেছে। ইইউএর মাঝে যখন সকলকেই জ্বালানি খরচ কমাতে বলা হচ্ছে, তখন সদস্যদেশগুলির মাঝেই কেউ কেউ বলছে যে, এটা তাদের উপর জুলুম হচ্ছে। কারণ সকলে রুশ গ্যাসের উপর সমানভাবে নির্ভরশীল নয়। যুদ্ধের কারণে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিতে যাচ্ছে। আর ন্যাটো তার পূর্ব সীমানায় সৈন্যের সংখ্যাও বৃদ্ধি করছে।

মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দা - ‘ডয়েচে ভেলে’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল। করোনা লকডাউনের পর আন্তর্জাতিক সরবরাহে জটলা সৃষ্টি হওয়ায় যেমন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, তেমনি করোনা লকডাউনের মাঝে জ্বালানির ব্যবহার শূণ্যের কোঠায় চলে যাবার পর হঠাত করেই চাহিদা আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। আর যেহেতু ইউক্রেন ও রাশিয়া মিলে আন্তর্জাতিক বাজারে এক চতুর্থাংশ গমের সরবরাহ করতো, তাই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের হার বাড়াতে শুরু করেছে। মূল চিন্তাটা হলো, যদি অর্থ ঋণ নেয়া কঠিন হয়ে যায়, তাহলে মানুষ কম খরচ করবে। এতে করে চাহিদা কমবে এবং পণ্যের মূল্যও কমে আসবে। তবে এর আরেকটা অর্থ হলো ধীরে চলা অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দেয়া। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবে না; তারা গম বা জ্বালানি উৎপাদনও করতে পারবে না। তাই তারা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে মন্দা থেকেও বাঁচাতে পারবে না।

পশ্চিমাদের বিভক্তি - ‘ডয়েচে ভেলে’র প্রতিবেদনে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধকে অনেকেই পশ্চিমাদের একাত্মতা হিসেবে দেখলেও বিশ্লেষণে সেখানে বিভেদ ফুটে ওঠে। রাশিয়ার উপর সকল অবরোধেই পশ্চিমারা একত্রে ছিল; শুধুমাত্র জ্বালানির ক্ষেত্রে অবরোধ আরোপ করতে গিয়েই পশ্চিমাদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কারণ জার্মানিসহ ইউরোপের কিছু দেশ রুশ গ্যাসের উপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। যুদ্ধের প্রথম ছয় মাসে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানির আয় কমেনি; বরং বেড়েছে। জার্মানি এবং ফ্রান্স যুদ্ধের আগ থেকেই রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপে আগ্রহী ছিল না। বিশেষ করে শীতকালে রুশ গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা জার্মানির নীতিকে বাকি ইউরোপের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থানে রেখেছিল।

অবরোধ অকার্যকর - রাশিয়ার উপর অবরোধ অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকারিতা হারিয়েছে; কারণ চীন এবং ভারতের মতো কিছু বড় দেশ রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বৃদ্ধি করেছে। একইসাথে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে পশ্চিমা দেশগুলির মূল্যস্ফীতি কমাবার ব্যাপারে আগ্রহী হয়নি। ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই রাশিয়ার উপর অবরোধ রাশিয়াকে যতটা না বিপদে ফেলেছে, তার চাইতে সামনের শীতকালে রুশ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় ইউরোপকে, বিশেষ করে জার্মানিকে বেশি ত্রাসের মাঝে ফেলেছে।

 
মার্চ ২০২২। মার্কিন কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি। ইউক্রেনের সামনে এখন অস্ত্র, অর্থ এবং অন্যান্য সহায়তার জন্যে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া কোন পথই খোলা নেই। এখন উভয় পক্ষই আলোচনায় বসার আগে নিজেদের অবস্থানকে আরও সুসংহত করতে চাইছে। তবে আলোচনা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করছে যুদ্ধের ব্যাপারে পশ্চিমারা কি ভাবছে সেটার উপর। যদি পশ্চিমা দেশগুলিতে জনমত যুদ্ধের বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে পশ্চিমা নেতারা আলোচনায় বসার জন্যে ইউক্রেনের উপর চাপ সৃষ্টি করবে।

যুদ্ধ শেষ হতে পারে কিভাবে?

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম মাসে রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল পুরো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নেয়া এবং কিয়েভে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানো। রুশরা ভেবেছিল তারা কয়েক দিনের মাঝেই যুদ্ধ শেষ করে ফেলবে; মাসের পর মাস যুদ্ধ করার কথা তারা চিন্তাও করেনি। সৈন্যদের মাঝে অনেকেই যুদ্ধের বিজয়ের পরে প্যারেড করার জন্যে পোষাকও সাথে নিয়েছিল! কিন্তু রাশিয়ার দ্রুত বিজয় পাবার চিন্তাটা প্রথম মাসেই ধূলায় মিশে যায়।

ইউক্রেনের কাছে বিজয় বলতে কি বোঝায়? ইউক্রেনিয়রা কি মনে করছে যে, তারা পূর্বাঞ্চলের ডনবাস এবং দক্ষিণের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ পূনর্দখল করতে পারবে? রাশিয়া এখন ইউক্রেনের ১০ থেকে ২০ শতাংশ ভূমি দখলে রেখেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানেই রয়েছে ইউক্রেনের ৯০ শতাংশ জ্বালানি এবং বেশিরভাগ সমুদ্রবন্দর। কাজেই ইউক্রেনের জন্যে কোন ভূমি হারানোটাই সমীচিন নয়। এই অঞ্চলগুলি হারালে ইউক্রেন পশ্চিমাদের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন থাকবে। ইউক্রেন এখনও বলছে যে তারা রাশিয়ার সাথে আলোচনায় আগ্রহী নয়। কিন্তু ইউক্রেনের সমস্যা বাড়ছেই। যুদ্ধের শুরুতে ইউরোপের দেশগুলি ইউক্রেনের শরণার্থী নিতে যতটা আগ্রহী ছিল, এখন ব্যাপক মূল্যস্ফীতির পর তারা আর ততটা আগ্রহী নয়।

ইউক্রেনের সামনে এখন অস্ত্র, অর্থ এবং অন্যান্য সহায়তার জন্যে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া কোন পথই খোলা নেই। এবং সেই আঙ্গিকেই তারা শুধুমাত্র রাশিয়ার ক্ষতি বৃদ্ধি করাতেই মনোনিবেশ করেছে। তারা হয়তো আশা করছে যে, রাশিয়ার জন্যে যুদ্ধের ব্যয় বহণ করা খুব কঠিন হয়ে গেলে একসময় রাশিয়া নিজেই যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইবে। এখন উভয় পক্ষই আলোচনায় বসার আগে নিজেদের অবস্থানকে আরও সুসংহত করতে চাইছে। তবে আলোচনা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করছে যুদ্ধের ব্যাপারে পশ্চিমারা কি ভাবছে সেটার উপর। যদি পশ্চিমা দেশগুলিতে জনমত যুদ্ধের বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে পশ্চিমা নেতারা আলোচনায় বসার জন্যে ইউক্রেনের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। অপরদিকে রাশিয়া হয়তো নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মাঝে যুদ্ধ শেষ করার ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। এর মাঝে তারা তাদের দখলীকৃত এলাকার পরিধি বৃদ্ধি করতে এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করতে চাইবে।

No comments:

Post a Comment