Saturday 25 April 2020

করোনা দুর্যোগের মাঝে চীনের সামনে এখন উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক

২৫শে এপ্রিল ২০২০   

ভারত মহাসাগরে রয়েছে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আইজেনহাওয়ার’। এই জাহাজগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ভাসমান সার্বভৌমত্ব। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির অবক্ষয় অত্র অঞ্চলের ব্যালান্সকে সমস্যায় ফেলবে। এতে মার্কিন ‘বিশ্ব ব্যবস্থা’ যেমন হুমকির মাঝে পড়বে, তেমনি ভারত মহাসাগরে ব্যালান্সিং শক্তি হিসেবে অন্য দেশের আসার পথ উন্মুক্ত হবে।

উন্মুক্ত মহাসাগরে চীনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ

১৪ই এপ্রিল ভারতীয় নৌবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমনের মাঝেও তাদের ‘ইস্টার্ন নেভাল কমান্ড’এর অধীনে থাকা অন্ধ্র প্রদেশের ভিশাখাপত্নমে অবস্থিত ‘আইএনএস দেগা’ বিমান ঘাঁটি দিন রাত ২৪ ঘন্টা চালু রয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয় যে, তাদের ‘৩১১ নেভাল এয়ার স্কোয়াড্রন’এর ‘ডরনিয়ার ২২৮’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমানগুলি সর্বদা সমুদ্রের উপর দিয়ে টহল দিচ্ছে। আর একইসাথে নৌবাহিনীর অন্যান্য বিমানগুলিকেও যেকোন মিশনের জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এই বিবৃতি এমন সময়ে এলো, যখন ৮ই এপ্রিল থেকে চীনা নৌবাহিনীর বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘লিয়াওনিং’ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অজানা মিশনে বের হয়েছে। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর মাঝে যেখানে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আর কোন দেশের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজই অপারেট করছে না, তখন চীনা নৌবাহিনীর এই মিশন অনেককেই চিন্তিত করেছে। মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’এ ৮’শর বেশি নাবিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর জাহাজখানা এখন মার্কিন ঘাঁটি গুয়ামে বসে রয়েছে। আরেকটা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘রোনাল্ড রেগ্যান’ও করোনা সংক্রমণের কারণে জাপানের ইয়োকোসুকা নৌঘাঁটিতে বসে রয়েছে। এপ্রিলের শুরুতে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন রাজ্যে অবস্থিত ব্রেমারটন নৌঘাঁটিতে বসে থাকা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘নিমিতজ’এও করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে বলে মিডিয়াতে রিপোর্ট এসেছে।

১৩ই এপ্রিল ‘লিয়াওনিং’ জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপ এবং তাইওয়ানের মাঝে অবস্থিত ‘মিয়াকো প্রণালী’ অতিক্রম করে তাইওয়ানের পূর্ব উপকূল ঘেঁষে দক্ষিণ চীন সাগরের দিকে যাত্রা করে। কিন্তু ২২শে এপ্রিল জাহাজখানা দিক পরিবর্তন করে তাইওয়ান এবং ফিলিপাইনের মাঝে অবস্থিত বাশি চ্যানেল পার হয়ে পূর্বদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে যাত্রা করে বলে বলছে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। জাহাজটার মিশন সম্পর্কে কেউই কিছু বলতে পারছেন না। জাহাজটা প্রশান্ত মহাসাগরেই থাকবে, নাকি ইন্দোনেশিয়ার প্রণালীগুলি পার হয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আসবে তা পরিষ্কার নয়। জাহাজটার সাথে রয়েছে দু’টা ডেস্ট্রয়ার, দু’টা ফ্রিগেট এবং একটা সাপ্লাই জাহাজ। ক’দিন আগেই দক্ষিণ চীন সাগরে মালয়েশিয়ার সাথে চীনের উত্তেজনার ঘটনা ঘটেছে। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলির অবর্তমানে অত্র এলাকায় মার্কিন শক্তিশালী ইউনিট হলো এম্ফিবিয়াস এসল্ট জাহাজ ‘আমেরিকা’, যা কিনা অত্যাধুনিক ‘এফ-৩৫বি লাইটনিং’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান বহণ করছে। মালয়েশিয়ার সাথে উত্তেজনার সময় ‘আমেরিকা’ এবং এর সাথে মার্কিন ও অস্ট্রেলিয় মোট তিনটা যুদ্ধজাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরে ছুটে যায়। এরপর ২৪শে এপ্রিল এই গ্রুপে থাকা ডেস্ট্রয়ার ‘ব্যারি’ একমাসে দ্বিতীয়বারের মতো চীন এবং তাইওয়ানের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে যাতায়াত করে। চীনকে উত্তক্ত্য করার এই পদ্ধতি এর আগে বহুবার অনুসরণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এবারে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলির অনুপস্থিতিতে চীনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের সমুদ্রে মিশন শুরু করাটা অন্য ধরনের উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে, যা এর আগে কখনোই ঘটেনি।
 
ড্রাইডকে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘নিমিতজ’। মার্কিন নৌবাহিনীর ১১টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থাকলেও এই মুহুর্তে মাত্র ২টা পুরোপুরি কর্মক্ষম রয়েছে। ভারত মহাসাগরে রয়েছে ‘আইজেনহাওয়ার’ এবং পাঁচ মাসের মিশন থেকে ফিরে বন্দরে না ভিড়ে আটলান্টিকে ঘুরছে ‘হ্যারি ট্রুম্যান’।

চাপের মুখে মার্কিন নৌশক্তি


মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগরে প্রায় পাঁচ মাসের মিশন শেষ করে দেশে ফেরত গেলেও বন্দরে না ভিড়ে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘হ্যারি ট্রুম্যান’কে আপাততঃ আটলান্টিক মহাসাগরে থাকতে বলা হয়েছে। মার্কিন নৌবাহিনীর দ্বিতীয় নৌবহরের প্রধান ভাইস এডমিরাল উডি লুইস বলেন যে, তারা এখনও জানেন না যে এই জাহাজের মিশন কি হতে পারে। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিন বলছে যে, এই জাহাজটাকে প্রশান্ত মহাসাগরে পাঠানো হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের এশিয়া-কেন্দ্রিক চিন্তার অংশ হিসেবে চীনা অধিপত্যবাদকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার কারণে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দু’টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছিল। ‘হ্যারি ট্রুম্যান’ জাহাজটাকে সেখান থেকেই সরিয়ে আনা হয়েছে। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলির গুরুত্ব তুলে ধরে সাংবাদিকদের বলেন যে, বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের রয়েছে বিশাল আক্রমণ এবং প্রতিরক্ষা সক্ষমতা; এটাকে যেকোন স্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। তিনি বলেন যে, এই জাহাজগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ভাসমান সার্বভৌমত্ব।

মার্কিন নৌবাহিনীর ১১টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। এর মাঝে ৩টা জাহাজ দীর্ঘ সময়ের জন্যে ড্রাইডকে থাকবে। ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ এবং ‘জন সি স্টেনিস’ বর্তমানে ‘রিফুয়েলিং এন্ড কমপ্লেক্স ওভারহল’এর মাঝে রয়েছে, যা শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যাবে। ‘জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ’ গত ফেব্রুয়ারিতে ২৮ মাসের জন্যে ‘ড্রাইডকিং প্ল্যান্ড ইনক্রিমেন্টাল এভেইল্যাবিলিটি’ নামের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ঢুকেছে। সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের ‘জেরাল্ড আর ফোর্ড’ এখনও টেস্টিং পর্যায়ে রয়েছে; এর অপারেশনে আসতে আরও কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। পশ্চিম উপকূলে ‘কার্ল ভিনসন’ ১৪ মাসের রক্ষণাবেক্ষণের পর মাত্র পানিতে নেমেছে; পুরোপুরিভাবে সার্ভিসে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন। ‘আব্রাহাম লিংকন’ গত জানুয়ারিতেই সান ডিয়েগোতে ফেরত এসেছে। অন্য বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের অভাব থাকায় ‘লিংকন’ জাহাজের ক্রুদের ১০ মাস মিশনে থাকতে হয়েছিল। করোনা ইস্যুতে জাপানে বসে রয়েছে ‘রোনাল্ড রেগ্যান’ এবং গুয়ামে বসে আছে ‘থিওডোর রুজভেল্ট’। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে মিশনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকা ‘নিমিতজ’এও করোনা সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছে বলে মিডিয়ায় খবর আসে। তাই এখন ‘নিমিতজ’ এবং এর নিরাপত্তায় থাকা জাহাজগুলির মোট ৮ হাজার নাবিককে করোনাভাইরাসের টেস্ট এবং কোয়ার‍্যান্টিনের মাঝ দিয়ে যেতে হচ্ছে। সুতরাং এই মুহুর্তে ১১টা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মাঝে মাত্র ২টা পুরোপুরি কর্মক্ষম রয়েছে। ভারত মহাসাগরে রয়েছে ‘আইজেনহাওয়ার’ এবং পাঁচ মাসের মিশন থেকে ফিরে বন্দরে না ভিড়ে আটলান্টিকে ঘুরছে ‘হ্যারি ট্রুম্যান’।
 
চীনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ 'লিয়াওনিং'। ভারত এটা বুঝতে পারছে যে, চীন তার সমুদ্রপথের নিরাপত্তা দিতে ভারত মহাসাগরে পদার্পণ করবেই। আর একারণেই চীনা বিমানবাহী জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে খবর পাওয়া মাত্রই ভারতীয় বিমান বঙ্গোপসাগরের উপর মহড়া দেয়া শুরু করেছে। অন্যদিকে চীনও মেনে নিচ্ছে যে, ভারত মহাসাগরে ভারতের প্রভাব থাকবেই; তাই ভারতের সাথে তার প্রতিযোগিতা অনিবার্য।

চিন্তিত ভারত

জানুয়ারি মাসে ভারতের নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল কারামবির সিং বলেছিলেন যে, ভারত মহাসাগরে যেকোন সময়ে সাত থেকে আটটা চীনা যুদ্ধজাহাজ অপারেট করে। ভারতের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত ভূরাজনীতি বিষয়ক কনফারেন্স ‘রাইসিনা ডায়ালগ’এ কথা বলতে গিয়ে এডমিরাল সিং আরও বলেন যে, কেউ যদি ভারতের এলাকায় অপারেট করতে চায়, তাহলে তাকে আগে ভারতকে জানাতে হবে। এডমিরাং সিংএর চিন্তার কারণ শুধু চীনা নৌবাহিনীর আনাগোণা নয়। ভারত মহাসাগরে চীনারা সবচাইতে বেশি সহায়তা পাচ্ছে পাকিস্তানের কাছ থেকে। ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে যে, গত জানুয়ারিতে পাকিস্তানের উপকূলে চীনাদের সাথে যৌথ সামরিক মহড়া ‘সী গার্ডিয়ান ২০২০’এর সময় চীনা যুদ্ধজাহাজগুলি পাকিস্তানের করাচি বন্দরেই অবস্থান নিয়েছিল। একটা ডেস্ট্রয়ার, একটা ফ্রিগেট, একটা সাপ্লাই জাহাজ এবং একটা সাবমেরিন রেসকিউ জাহাজসহ ৫টা চীনা জাহাজ এই মহড়ায় অংশ নেয়। আর এই মহড়াকে কাছে থেকে উপলব্ধি করার জন্যে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘বিক্রমাদিত্য’কে আরব সাগরে মোতায়েন করে। চীনা নৌবাহিনীর এই জাহাজগুলি হলো ৩৪তম এসকর্ট টাস্ক ফোর্সের অংশ। জানুয়ারির ২০ তারিখের দিকে জাহাজগুলি কৌশলগত বাব-এল মান্ডেব প্রণালীর পাশে জিবুতিতে তাদের নৌঘাঁটিতে পৌঁছায়।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে চীনারা মেডিক্যাল সহায়তা দেবার কারণে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজের প্রভাব ধরে রাখতে ব্যাপক চাপের মাঝে পড়েছে ভারত। এপ্রিলের ১৫ তারিখ থেকে ভারতের দক্ষিণের তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুর বিমান ঘাঁটি থেকে বঙ্গোপসাগরে মাসব্যাপী মহড়া শুরু করেছে ভারতীয় বিমান বাহিনী। বিমান থেকে বিমানে রিফুয়েলিং বা জ্বালানি সরবরাহে সক্ষম ‘ইলিউশিন ৭৮এমকেআই’ বিমান এই ঘাঁটিতে মোতায়েন করা হয়েছে বলে বলছে অনলাইন প্লেন স্পটাররা। নিরাপত্তা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘আইএইচএস জেনস’ বলছে যে, ২০শে জানুয়ারি ভারতীয় বিমান বাহিনী এই ‘থাঞ্জাভুর’ ঘাঁটিতে ‘সুখোই-৩০এমকেআই’ বিমানের ‘২২২তম স্কোয়াড্রন’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ভোধন করে। দক্ষিণ ভারতে সুখোই বিমানের একমাত্র এই স্কোয়াড্রন সুপারসনিক জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ‘ব্রাহমোস’ বহণে সক্ষম। রুশ নির্মিত ২৮ফুট লম্বা এবং আড়াই টন ওজনের প্রায় ৩’শ কিঃমিঃ পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রকে যেকোন জাহাজের জন্যেই ধ্বংস করাটা কঠিন। আর এর ২’শ কেজি ওয়ারহেডের পক্ষে বিশাল জাহাজও ঘায়েল করা সম্ভব। ২০২১ সালের মাঝে এই স্কোয়াড্রনে ১৮টা সুখোই মোতায়েন করার কথা রয়েছে; যার মাঝে ৮টা বিমান ব্রাহমোস বহণ করতে পারবে। করোনা পরিস্থিতিতে চীনা নৌবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধিই খুব সম্ভবতঃ থাঞ্জাভুরে মহড়ার কারণ। বিমান থেকে বিমানে রিফুয়েলিং করতে পারলে থাঞ্জাভুরের সুখোই বিমানগুলি ভারত মহাসাগরের একটা বড় এলাকা টহল দিতে পারবে। ভারতীয় নৌবাহিনীর মার্কিন নির্মিত ম্যারিটাইম দূরপাল্লার প্যাট্রোল বিমান ‘পি-৮আই নেপচুন’ বিমানও নিয়মিত টহল দিচ্ছে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে। ১৪ই এপ্রিল ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুততার সাথে এই বিমানগুলিতে ব্যবহারের জন্যে ভারতের কাছে ১০টা ‘হারপুন’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১৬টা সাবমেরিন-ধ্বংসী ‘মার্ক ৫৪’ লাইটওয়েট টর্পেডো বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। ২৪শে এপ্রিল ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারতের সামরিক নেতৃবৃন্দের সাথে জরুরি বৈঠক করেন। তিনি হুঁশিয়ারি দেন যে, করোনাভাইরাস ঠেকাতে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যস্ততার মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিরা যেন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি না করতে পারে। বৈঠকে জম্মু-কাশ্মিরের বর্তমান অবস্থা আলোচনা করা ছাড়াও চীনের সাথে ভারতের সীমানা এবং ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনের আনাগোণা বৃদ্ধি নিয়ে কথা হয় বলে বলছে ভারতের গণমাধ্যম ‘পিটিআই’। বৈঠকে অভিযোগ করে বলা হয় যে, পাকিস্তান গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বরাবর যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে এবং ভারতী অধিকৃত কাশ্মিরে জঙ্গীদের ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এর ক’দিন আগেই জম্মু-কাশ্মিরের পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল দিলবাগ সিং অভিযোগ করেন যে, পাকিস্তান করোনা আক্রান্ত জঙ্গীদের ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে যাতে এখানকার মানুষও করোনা আক্রান্ত হয়। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দিলবাগ সিংকে সমর্থন করে একটা বিবৃতিও দেয়া হয়।
 
ভারতীয় নৌবাহিনীর মার্কিন নির্মিত ‘পি-৮আই’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান। ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুততার সাথে এই বিমানগুলিতে ব্যবহারের জন্যে ভারতের কাছে ‘হারপুন’ জাহাজ-ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং সাবমেরিন-ধ্বংসী ‘মার্ক ৫৪’ লাইটওয়েট টর্পেডো বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে।

গত বছরের মে মাসেই ভারতীয় নৌবাহিনী ফ্রান্সের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘শার্ল দ্য গল’এর সাথে যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। প্রায় একইসাথে ভারতীয়রা জাপানের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘ইজুমো’ এবং অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজের সাথে যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। কিন্তু সেই সময়গুলি ছিল ভারতের জন্যে অপেক্ষাকৃত ভালো সময়; শক্তিশালী বন্ধুরা ছিল ভারতকে সহায়তা দেবার জন্যে। এখন করোনা দুর্যোগের কারণে ১১টা মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মাঝে মাত্র ২টা সমুদ্রে অপারেশনে রয়েছে; আর তন্মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে ভারত মহাসাগরে রয়েছে একটা। আরব সাগরের কাছাকাছি রয়েছে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আইজেনহাওয়ার’। এছাড়াও জানুয়ারি থেকে এই অঞ্চলে মোতায়েন রয়েছে এম্ফিবিয়াস এসল্ট জাহাজ ‘বাটান’। চীনা বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ভারত মহাসাগরে ঢুকুক বা না ঢুকুক, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ইতোমধ্যেই তা রাজত্ব করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। বিশাল মার্কিন নৌবহরের এই অসহায়ত্ব ভারতকেও বিচলিত করেছে। একারণেই ভারত চাইছে চীনের পথ অনুসরণ করে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নিজের আঞ্চলিক প্রভাবকে দ্রুত ঝালাই করে নিতে।

চীনের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি’র এসোসিয়েট প্রফেসর ঝাও ইয়ি বেইজিংএ ভারতীয় সাংবাদিকদেরকে সরাসরিই বলেন যে, চীন ভারত মহাসাগরকে নিরাপদ রাখতে ভারতের বিশেষ ভূমিকাকে মেনে নেয়। তবে ভারত মহাসাগরের মতো উন্মুক্ত এক মহাসাগরকে ভারতের ‘উঠান’ বলাটা একেবারেই সমীচিন নয়। সুইডিশ সাংবাদিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক বার্টিল লিন্টনার ‘এশিয়া টাইমস’এর এক লেখায় বলছেন যে, চীন চাইছে না যে কোন একটা শক্তি ভারত মহাসাগরকে নিয়ন্ত্রণ করুক। চীনের জ্বালানি, খনিজ এবং রপ্তানি পণ্যের মূল সমুদ্রপথ এখন ভারত মহাসাগর। আর তাই এই সমুদ্রপথের নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা না করাটাই বরং বেইজিংএর জন্যে হ্রস্বদৃষ্টির পরিচায়ক হবে। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির মাঝে চীনের এই প্রচেষ্টা শুধু চলছেই না, বাড়তেও পারে। লিন্টনারের কথা ধরেই বলা যায় যে, ভারত এটা বুঝতে পারছে যে, চীন তার সমুদ্রপথের নিরাপত্তা দিতে ভারত মহাসাগরে পদার্পণ করবেই। আর একারণেই চীনা বিমানবাহী জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে খবর পাওয়া মাত্রই ভারতীয় বিমান বঙ্গোপসাগরের উপর মহড়া দেয়া শুরু করেছে। অন্যদিকে চীনও মেনে নিচ্ছে যে, ভারত মহাসাগরে ভারতের প্রভাব থাকবেই; তাই ভারতের সাথে তার প্রতিযোগিতা অনিবার্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক অবস্থান মানেই হলো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ‘ব্যবস্থা’ বজায় থাকা। ভারত-চীনের প্রতিযোগিতার মাঝে অত্র অঞ্চলের ছোট দেশগুলি ব্যালান্সিং পাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই চেয়ে থাকবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির অবক্ষয় এই ব্যালান্সকে সমস্যায় ফেলবে। এতে মার্কিন ‘বিশ্ব ব্যবস্থা’ যেমন হুমকির মাঝে পড়বে, তেমনি ভারত মহাসাগরে ব্যালান্সিং শক্তি হিসেবে অন্য দেশের আসার পথ উন্মুক্ত হবে। তবে এই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতেই অত্র অঞ্চলের দেশগুলি নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করতে পারে। এতে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির সাথেসাথে সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে।

No comments:

Post a Comment