Wednesday 15 April 2020

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জাপানের সিদ্ধান্তহীনতা দেশটার চিন্তাগত পরাধীনতাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে

১৬ই এপ্রিল ২০২০


জাপানে জরুরি অবস্থা জারি করা হলেও কর্তৃপক্ষ নাগরিকদেরকে বাড়িতে থাকতে এবং সামাজিক দূরত্ব রাখতে ‘অনুরোধ’ করতে পারবে মাত্র। কিন্তু কেউ যদি এই ‘অনুরোধ’ না মানে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনীদের লিখে দেয়া এই সংবিধান করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মাঝেও জাপানকে ভোগাচ্ছে। প্রতিনিয়তই জাপান সরকারকে চিন্তা করতে হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গেলে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর আঘাত আসবে কিনা। জাপানের সংবিধান এই ব্যাপারটাকেই পবিত্র করে রেখেছে।

নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৪ই এপ্রিল জাপানে একদিনে সর্বোচ্চ ১৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর একদিনে ৪’শ ৭৭ জনের মাঝে সংক্রমণ পাবার পরে সর্বমোট সংক্রমণের সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। টোকিওতে একদিনে ১’শ ৬১ জন, ওসাকায় ৫৯ জন, ফুকুওকাতে ৩৩ জনের মাঝে ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত জাপানে মোট ৮ হাজার ১’শ ৬১ জন আক্রান্তের মাঝে টোকিওতেই পাওয়া গেছে ২ হাজার ৩’শ ১৯ জন। এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১’শ ৭৩ জনে। এই তিনটা ‘প্রিফেকচার’ বা অঞ্চলেই গত সপ্তাহে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন প্রিফেকচারে স্কুল, রেস্তোঁরা, সমাজসেবা সংস্থা, চাইল্ড কেয়ার হোম, ইত্যাদি সংস্থায় একজন বা একাধিক আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে আরও অনেকজনের আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে বলে জানাচ্ছে ‘জাপান টাইমস’। সাপ্পোরোতে একটা হাসপাতাল থেকে ২৫ জন মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। তবে অনেকেই বলছেন যে, জাপানে জরুরি অবস্থা এসেছে অনেক দেরিতে। এবং কেউ কেউ বলছেন যে, একারণে জাপানকে কড়া মূল্য দিতে হবে।

জাপানের ‘কিয়োদো নিউজ’এর এক জরিপ বলছে যে, ৮০ শতাংশ জনগণ মনে করছেন যে, সরকারের জরুরি অবস্থা ঘোষণা অনেক দেরিতে এসেছে। সরকারের সমর্থনও ৫ শতাংশ কমে ৪০ শতাংশে এসেছে। কিয়োটোর দোশিশা ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির প্রফেসর নোরিকো হামা সরকারের সমালোচনা করে বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে টুইটারে তার কুকুরের সাথে অন্তরঙ্গ ছবি এবং তার চা খাওয়ার ছবি প্রকাশ করছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে তিনি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। সাধারণ মানুষের গভীর অর্থনৈতিক সমস্যাকে তিনি বুঝতেই পারছেন না। ১ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পরেও অনেকেই বলছেন যে, তা এই দুর্যোগ মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। আক্রান্ত জনগণ খুঁজে তাদেরকে নগদে ২ হাজার ৮’শ ডলার করে দেবার সিদ্ধান্ত হলেও অনেকেই বলছেন যে, অন্য দেশের মতো সকল নাগরিককেই এই অর্থ দেবার ব্যবস্থা করা উচিৎ।

  

১৫ই এপ্রিল জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক টাস্ক ফোর্সের রিপোর্টের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ জানাচ্ছে যে, কোন সাবধানতা অবলম্বণ করা না হলে করোনাভাইরাসের কারণে জাপানে ৪ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। টাস্ক ফোর্সের সদস্য হোক্কাইডো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হিরোশি নিশিউরা বলছেন যে, বিপদ এড়াতে হলে বর্তমানে চলমান জরুরি অবস্থার মাঝে মানুষে মানুষে সরাসরি যোগাযোগ ৮০ শতাংশ কমাতে হবে। সরকারি গবেষকেরা বলছেন যে, প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ মানুষের ভেন্টিলেটর দরকার পড়ার মতো খারাপ অবস্থা হতে পারে। জাপানের বার্তা সংস্থা ‘এনএইচকে’ বলছে যে, ৯টা প্রিফেকচারে ইতোমধ্যেই ইমার্জেন্সি বেডের সংখ্যা অপ্রতুলতার দিকে ধাবমান। মেডিক্যাল কর্মীদের ‘পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট’ বা ‘পিপিই’ স্বল্পতার কারণে ওসাকা শহরের সরকার নাগরিকদের কাছে নিজেদের ওয়াটারপ্রুফ কোট দান করতে আহ্বান জানিয়েছে। ডাক্তাররা সেখানে ডাস্টবিনের উপরে ব্যবহার করা প্লাস্টিক গায়ে পরিধান করছেন। শহরের কাপড় তৈরি করার কারখানাগুলিকে পিপিই তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছে ওসাকা সরকার। টোকিওর ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মিয়েকো নাকাবায়াশি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সরকারের সমালোচনা করে বলেন যে, সরকারের পদক্ষেপ নিতে দেরি হবার কারণে ডাক্তাররা ভীতি নিয়ে কাজ করছেন। আর সরকার যথেষ্ট সংখ্যায় টেস্ট করতে দিচ্ছে না এখনও।

জাপান সরকারের বরাত দিয়ে ‘নিকেই এশিয়ান রিভিউ’ বলছে যে, জাপানের ৪৭টা প্রিফেকচারের মাঝে ৪৩টা প্রিফেকচারেই করোনাভাইরাসে বেশি অসুস্থ্য মানুষকে সেবা দেয়ার জন্যে আইসিইউ বেডের স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। মাত্র চারটা প্রিফেকচার - টোকিও, ওকাইয়ামা, ফুকুওকা এবং ওকিনাওয়াতে দরকারের চাইতে বেশি আইসিইউ আছে বলে বলে বলা হচ্ছে। জাপানে মাথাপিছু আইসিইউ বেডের সংখ্যা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় কম। ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনলজি ইনফর্মেশন’র হিসেবে প্রতি লাখ জনগণের জন্যে জাপানে রয়েছে ৫টা করে আইসিইউ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে লাখে ৩৫টা; জার্মানিতে ৩০টা; ফ্রান্স ও ইতালিতে ১২টা; স্পেনে ১০টা। বেশি বয়সের মানুষের জন্যে আইসিইউতে থাকাটা খুব বেশি কষ্টকর। জাপানে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি বলেই সেখানে আইসিইউএর সংখ্যা কম রাখা হয়েছে।



জাপানের মেইজি ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের প্রাক্তন প্রফেসর লরেন্স রেপেটা ‘জাপান টাইমস’এর এক লেখায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন জরুরি অবস্থা জারি করতে জাপানের এতো সময় কেন লেগে গেল। এপ্রিলের ৭ তারিখে টোকিওসহ ৬টা প্রিফেকচারে জরুরি অবস্থা জারি করার জন্যে মার্চ মাসে পরিবর্তন করা ‘নিউ ইনফ্লুয়েঞ্জা স্পেশাল মেজার্স এক্ট’ নামের আইন ব্যবহার করা হয়। জাপানের সর্বমোট ৪৭টা ‘প্রিফেকচার’এর মাঝে ৭টাতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। তবে এই আইনের অধীনে প্রিকেফচারের গভর্নররা নাগরিকদেরকে বাড়িতে থাকতে এবং সামাজিক দূরত্ব রাখতে ‘অনুরোধ’ করতে পারবে মাত্র। কিন্তু কেউ যদি এই ‘অনুরোধ’ না মানে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। তাহলে কেন জাপানের কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের বাধ্য করতে পারলো না? প্রফেসর রেপেটা বলছেন যে, এক্ষেত্রে তিনটা কারণ থাকতে পারে। প্রথমতঃ জাপানের জনগণ অফিশিয়াল ‘অনুরোধ’কে বাধ্যবাধকতা হিসেবেই দেখে। দ্বিতীয়তঃ জাপানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মানদন্ড বেশ শক্ত। আর তৃতীয়তঃ জাপানের বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলিই ক্ষমতাসীন লিবারাল ডেমোক্র্যাট পার্টির অর্থায়ন করে। লকডাউন করলে এই ব্যবসাগুলিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচাইতে বেশি। তবে এর বাইরেও বড় একটা কারণ হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের লিখে দেয়া জাপানের শান্তিবাদী সংবিধানকে কেউ অবমূল্যায়ন করতে সাহস দেখায়নি, এবং পরিবর্তন করতেও এগিয়ে আসেনি। করোনাভাইরাসের সুযোগে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের কিছু রাজনৈতিক মিত্র চাইছিলো সংবিধানকে পরিবর্তন করে নিতে; কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।

১২ই এপ্রিল জাপানের সবচাইতে উত্তরের হোক্কাইডো প্রিফেকচারে পুনরায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয় বলে জানাচ্ছে ‘কিওদো নিউজ’। এক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকায় কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে তিন সপ্তাহের জরুরি অবস্থা জারি করে ১৯শে মার্চ তা তুলে ফেলা হয়; স্কুলগুলিকে খুলে দেয়া হয় এবং জনসমাগমের অনুমতিও দেয়া হয়। কিন্তু এবারে আবারও ৬ই মে পর্যন্ত স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং জরুরি দরকার ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে মানা করা হয়েছে। হোক্কাইডোর এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন যেন জাপান সরকারের সিদ্ধান্তহীনতারই সারসংক্ষেপ। জাপান এখনও নিশ্চিত নয় যে, তার কি করা উচিৎ। নিজেদের সংবিধান নিয়েও একটা অনিশ্চয়তা জাপানকে প্রায় দুই দশক ধরে ঘিরে রেখেছে; যা কিনা জাপানের সকল চিন্তাকে প্রভাবিত করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনীদের লিখে দেয়া এই সংবিধান করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মাঝেও জাপানকে ভোগাচ্ছে। প্রতিনিয়তই জাপান সরকারকে চিন্তা করতে হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গেলে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর আঘাত আসবে কিনা। জাপানের সংবিধান এই ব্যাপারটাকেই পবিত্র করে রেখেছে। জনগণকে বাধ্য করার মতো কোন সিদ্ধান্তই সরকার সহজে নিতে পারছে না। অন্যদিকে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে জনগণের আস্থাও হারাতে হচ্ছে সরকারের। বিশ্বযুদ্ধের সাড়ে সাত দশক পেরুলেও রাষ্ট্রচিন্তার দিক থেকে জাপান এখনও অনেকটাই পরাধীন থেকে গিয়েছে।

2 comments:

  1. Japan should follow the rule "Necessity knows nothing". That's why Donald Trump is so damn care and aggressive that he showed us the modern piracy theory, though its not getting that much when it comes to the people residing in US.

    ReplyDelete
    Replies
    1. As a matter of fact, what Japan should or shouldn't do matters little in front of an obligation to abide by the constitution.... without following the constitution, this current nation-state would cease to exist... a complete rewriting of a new constitution is required to be able to control its own destiny... for now, that seems a bit too far fetched... may be Japan is waiting for something...

      Delete