Friday 3 April 2020

করোনাভাইরাস - সুইডেনে কোন লকডাউন নেই কেন?

৪ঠা এপ্রিল ২০২০
ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে লকডাউনের মাঝ দিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার পর লকডাউন ভাঙ্গার বহু উদাহরণ দেখা গেছে। সুইডেন সেই পথে হাঁটতেই নারাজ। সুইডেন ইউরোপের সবচাইতে বেশি লিবারাল চিন্তার রাষ্ট্র বলেই পরিচিত। ব্যক্তিস্বাধীনতার নিরাপত্তা দেয়াকে সুইডিশরা পবিত্র দায়িত্ব হিসেবেই দেখে। করোনাভাইরাস ইস্যু শুধুমাত্র দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সুইডিশরা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সমাজের দুর্বলদের সুরক্ষা দেবার উপরে স্থান দিচ্ছে।


পশ্চিমা দেশগুলির মাঝে প্রায় সবগুলি দেশই নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ‘লকডাউন’এর পথে হাঁটলেও সুইডেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সুইডেনের স্কুল, রেস্তোঁরা, শপিং মল, বার, সিনেমা হল এবং স্কি রেজর্টের মতো জায়গাগুলি এখনও খোলা রয়েছে। ট্রেন-বাস চলছে সমানে। শুধুমাত্র ৫০ জনের বেশি মানুষের জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং রেস্তোঁরায় দূরত্ব বজায় রেখে বসতে বলা হয়েছে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সুইডেন এবং ডেনমার্কের মাঝে ‘ওরেসুন্ড’ সেতু পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে, কেননা সেতুর দক্ষিণের ডেনমার্ক তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। তবে সুইডেন এই সেতুর উত্তর দিক খোলাই রেখেছে। সেখানে এখনও মানুষ হাত ধরাধরি করে রাস্তায় হাঁটছে। খোলা স্থানে পিকনিক এবং বারবিকিউ চলছে; স্কেটিং এবং খেলার মাঠে খেলাও চলছে বেশ। কেউই মাস্ক পড়ছে না। সুইডেনের এই নীতির পিছনে চিন্তাগুলি এখন আলোচনার বিষয় হয়ে গেছে।

৩রা এপ্রিল পর্যন্ত সুইডেনে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬ হাজার ১’শ ৩১; এর মাঝে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩’শ ৫৮ জন। এখন পর্যন্ত প্রতি লাখের মাঝে আক্রান্ত হয়েছে ৬১ জন। ব্রিটেনে এটা ৫৭ জন; জার্মানিতে ১০৮ জন; ফ্রান্সে ৮৮ জন; নরওয়েতে ৯৯ জন; ডেনমার্কে ৬৭ জন; ফিনল্যান্ডে ২৯ জন। অর্থাৎ সুইডেন যে করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ, তা বলা যাচ্ছে না।

‘ইউগভ’ নামের এক গবেষণা সংস্থার এক নিয়মিত গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, ২৬টা দেশের মাঝে সুইডেনের মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার ব্যাপারে সবচাইতে কম ভীতির মাঝে রয়েছে। ২৯শে মার্চের ফলাফল বলছে যে, মাত্র ৩১ শতাংশ সুইডিশ আক্রান্ত হবার ব্যাপারে খুব বেশি বা কিছুটা ভীত। এর বিপরীতে এই সংখ্যাটা ইতালিতে ৭২ শতাংশ, ফ্রান্সে ৭০ শতাংশ, ব্রিটেনে ৬১ শতাংশ, স্পেনে ৫০ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৯ শতাংশ, নরওয়েতে ৪৮ শতাংশ, ডেনমার্কে ৪২ শতাংশ এবং ফিনল্যান্ডে ৩৯ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলিতে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তবে সুইডেনের মানুষ নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করলেও পরিসংখ্যান বলছে অন্যরকম।

‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, মানুষ সম্ভবতঃ একেকটা দেশের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রকাশ করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা হচ্ছে যে, মালয়েশিয়ায় ৪৫ জন করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেছে; আর ভিয়েতনামে একজনও মারা যায়নি। অথচ দুই দেশই ভাইরাস প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলস্বরূপ, মালয়েশিয়াতে ৯০ শতাংশ জনগণ সংক্রমণের ভয়ে রয়েছে; ভিয়েতনামে এই সংখ্যা ৮৯ শতাংশ। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ বলছে যে, সুইডেনের রাস্তার পরিস্থিতি দেখে দেশের মানুষের মাঝে কোন ভীতি না আসাটাই স্বাভাবিক। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী স্তেফান লোফুয়েন সুইডিশদেরকে ‘প্রাপ্তবয়স্ক’দের মতো আচরণ করতে বলেন এবং ‘উদ্বেগ বা গুজব’ ছড়াতে মানা করেন। সুইডেনের প্রধান রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এন্ডার্স তেগনেল বলছেন যে, লকডাউন করলে পুরো ব্যবস্থাটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। মাসের পর মাস লকডাউন অসম্ভব। বরং কিছুদিন পরপর কঠোর সিদ্ধান্তে যেতে হবে; আর সেটা চালাতে হবে যতটা সম্ভব স্বল্প সময়ের জন্যে। তেগনেলের কথাগুলিই সুইডিশরা মেনে নিয়েছে। সুইডেনে গত ৩’শ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উপর দেশের মানুষের অগাধ বিশ্বাস জন্মেছে; যেকারণে বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন, জনগণ তা-ই মেনে চলছে।

‘আল জাজিরা’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সুইডেনের এই নীতির ফলে দেশটার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকে নিম্নস্তরের মানুষগুলি মৃত্যুঝুঁকির মাঝে পড়ে যাচ্ছে। এদের মাঝে অনেকেই মনে করছেন যে, সুইডিশ সরকার এই মানুষগুলিকে করোনাভাইরাসের ফ্রন্টলাইনে ছেড়ে দিয়েছে। সুইডেনের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন না যে, শিশুরা এই রোগের শক্তিশালী বাহক। তাই সুইডেনের অনেক স্কুল এখনও খোলা রয়েছে। নোবেল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কার্ল হেনরিক হেলডিন-সহ সুইডেনের দুই হাজার মেডিক্যাল প্রফেশনালের স্বাক্ষরসহ এক চিঠিতে সুইডেনের এহেন নীতির সমালোচনা করে বলা হয় যে, এই নীতি সুইডেনকে মারাত্মক দুর্যোগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তবে এই নীতির পক্ষেও রয়েছেন অনেকে। সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পিটার নিলসন বলছেন যে, বাকি বিশ্বে রাজনীতিবিদেরা লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিলেও সুইডেনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীও সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর। তারা বলছেন যে, অনির্দিষ্টকালের জন্যে লকডাউন চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। আর এই মহামারী আবারও ফিরে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেনা। অতীতের বিভিন্ন রোগের সংক্রমণের ইতিহাস বলছে যে, সকলেরই উচিৎ মহামারীর দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বারের মতো সংক্রমণকে এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

সুইডেনের ‘কারোলিন্সকা ইন্সটিটিউট’এর গবেষক সেসিলিয়া সোডারবার্গ নাউক্লের বলছেন যে, সরকার মনে করছে যে, এই মহামারিকে তারা রুখতে পারবে না; সুতরাং তারা মানুষকে মরতে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর মানুষ অন্ধভাবে সরকারের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছে। তিনি মনে করছেন যে, কিছুদিনের মাঝেই স্টকহোমে ইতালির মতো আইসিইউএর ভয়ঙ্কর অপ্রতুলতা দেখা দেবে। আর তখন কিছুই করার থাকবে না। নাউক্লেরের সমালোচনাগুলি অমূলক নয়; কারণ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকে সুইডেনের নিম্নস্তরের মানুষগুলিই থাকবে মৃত্যুঝুঁকিতে। সুইডেনের জনগণের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করার আরেকটা কারণ রয়েছে; তারা সুইডেনের স্বাধীনচেতা আদর্শকে তুলে ধরে রাখতে অনড় রয়েছেন। নিজ উদ্যোগে সুইডেনের স্পোর্টস ক্লাবগুলি তাদের যুব কর্মকান্ডগুলি থামিয়ে দিলে দেশটার পাবলিক হেলথ এজেন্সির ডিরেক্টর জেনারেল ইহোহান কার্লসন ক্লাবগুলিকে এই কর্মকান্ড পুনরায় শুরু করার জন্যে আহ্বান জানান। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে লকডাউনের মাঝ দিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার পর লকডাউন ভাঙ্গার বহু উদাহরণ দেখা গেছে। সুইডেন সেই পথে হাঁটতেই নারাজ। সুইডেন ইউরোপের সবচাইতে বেশি লিবারাল চিন্তার রাষ্ট্র বলেই পরিচিত। ব্যক্তিস্বাধীনতার নিরাপত্তা দেয়াকে সুইডিশরা পবিত্র দায়িত্ব হিসেবেই দেখে। করোনাভাইরাস ইস্যু শুধুমাত্র দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সুইডিশরা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সমাজের দুর্বলদের সুরক্ষা দেবার উপরে স্থান দিচ্ছে।

1 comment:

  1. তথাকথিত Free, Liberal, Capitalist দেশের নেতারা dilemmaয় ভুগছেন, যদিও পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের জনগণ অজ্ঞতায় ভুগছে, বিশেষত দুই বাংলার মানুষেরা এক্ষেত্রে পুরস্কারের দাবি রাখে।

    ReplyDelete