Sunday 19 April 2020

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে নিয়ে মার্কিন-ব্রিটিশ দ্বন্দ্ব করোনা-পরবর্তী নতুন ভূরাজনৈতিক সংঘাতের ইঙ্গিত

২০শে এপ্রিল ২০২০



যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় নিজের প্রতিপত্তি হারিয়েছে বলেই অর্থায়ন করতে চাইছে না। অন্যদিকে ব্রেক্সিট-পরবর্তী ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ প্রতিষ্ঠার চিন্তায় বিভোর ব্রিটেন তার অর্থায়ন বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানটাকে কেড়ে নিতে চাইছে। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্ব করোনা-পরবর্তী ভূরাজনৈতিক সংঘাতের একটা শক্তিশালী ইঙ্গিত।
    


গত ১৪ই এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে না পারার অভিযোগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্যে অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন যে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপারে আগাম সতর্কতা দিতে পেরেছে কিনা, সেব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদন আসার আগ পর্যন্ত দুই থেকে তিন মাসের জন্যে অর্থায়ন স্থগিত করা হয়েছে। সংস্থাটার ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে তিনি ব্যাপক অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তথ্য গোপন করার অভিযোগ করেন। ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’ বা ‘ডব্লিউএইচও’ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মূলতঃ জাতিসংঘের একটা অঙ্গ সঙ্গঠন। জাতিসংঘের মহাসচিত এন্টোনিও গুতেরেজ বলেন যে, বিশ্বব্যাপী ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাবার সময় অর্থায়ন বন্ধ করা একেবারেই উচিৎ হয়নি। তবে এর আগে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনের ব্যাপারেও অনিয়মের অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বন্ধ করার হুমকি দিয়েছিল। মোটকথা জাতিসংঘের সংস্থাগুলির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে বেশ খারাপই যাচ্ছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রই এতকাল যাবত জাতিসংঘের বাজেটের সবচাইতে বড় অংশটা দিয়ে এসেছে। ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মহানুভবতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল কিনা, সেব্যাপারে তার যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। তিনি সংস্থাটার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। তিনি বলেন যে, সংস্থাটার গাফলতির জন্যে এই ভাইরাসকে ঠেকাতে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি সংস্থাটার ‘চীন-কেন্দ্রিকতা’র সমালোচনা করেন। গত ২৪শে জানুয়ারি তিনি নিজেই এক টুইটার বার্তায় করোনাভাইরাস নিয়ে চীনের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। আবার ১০ই জানুয়ারিতেই ডব্লিউএইচও এই রোগের মানুষ থেকে মানুষে ছড়াবার সম্ভাবনার কথা বলে। যুক্তরাষ্ট্র এখন ডব্লিউএইচওএর সংস্কার চাইছে। তাহলে ট্রাম্প কেন এখন এই সংস্থার অর্থায়ন বন্ধ করতে চাইছেন? আর কেনই বা তিনি চীনকে এই অভিযোগের সাথে যুক্ত করতে চাইছেন? উত্তরটা করোনাভাইরাসের মাঝে নয়; ভূরাজনীতির মাঝে রয়েছে।

‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর এক লেখায় ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়ন কিভাবে হয়। সংস্থার ৫১ শতাংশ অর্থ আসে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলির কাছ থেকে; ১৬ শতাংশ আসে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা থেকে; ১৩ শতাংশ আসে দাতা ফাউন্ডেশনগুলি থেকে; ৯ শতাংশ করে আসে বিভিন্ন এনজিও এবং বিভিন্ন পার্টনারশিপ থেকে। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলির কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে ডব্লিউএইচওকে অর্থায়ন করার। সেই হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে ১’শ ১৬ মিলিয়ন ডলার; চীনের বাধ্যবাধকতা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৭ মিলিয়ন ডলার; জাপানের ৪১ মিলিয়ন ডলার; জার্মানির ২৯ মিলিয়ন; ব্রিটেনের ২২ মিলিয়ন; ফ্রান্সের ২১ মিলিয়ন; ইতালির ১৬ মিলিয়ন; ব্রাজিলের ১৪ মিলিয়ন। কিন্তু প্রভাবশালী দেশগুলি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়াতে বাধ্যবাধকতার অনেক বেশি অর্থায়ন করে। একারণেই সর্বোচ্চ ৪’শ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের মাধ্যমে সংস্থার প্রায় ১৫ শতাংশই দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় ১০ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থায়নকারী হলো ধনকুবের বিল গেটসএর ‘বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রাক্তন সুপারপাওয়ার ব্রিটেন। সর্বোচ্চ ২০ জন অর্থায়নকারীর মাঝে ৬টা হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন; আর একটা হলো রাষ্ট্র গুচ্ছ (ইয়রোপিয়ান কমিশন); বাকি ১৩টা জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র। দেশগুলির মাঝে প্রথম স্থানে যুক্তরাষ্ট্র; ব্রিটেন দ্বিতীয়; জার্মানি ও জাপান তৃতীয় ও চতুর্থ; কুয়েত ও সুইডেন পঞ্চম ও ষষ্ঠ। যুক্তরাষ্ট্র তার বাধ্যবাধকতার প্রায় ৪ গুণ অর্থায়ন করে; ব্রিটেন অর্থায়ন করে বাধ্যবাধকতার ১০ গুণ; জার্মানি ৬ গুণ; জাপান ৪ গুণ; অস্ট্রেলিয়া ৪ গুণ; কানাডা ৩ গুণ; কোরিয়া ৩ গুণ। আর কুয়েত, সুইডেন, নরওয়ে, সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের প্রায় পুরোটাই স্বেচ্ছায় দিয়ে থাকে; বাধ্যবাধকতা থেকে নয়। তবে এই স্বেচ্ছায় অর্থায়ন আবার দেশগুলি নির্দিষ্ট করে বলে দেয় যে কোথায় ব্যয় করতে হবে। অর্থাৎ অর্থায়নকারী দেশগুলি নিজেদের স্বার্থ বিচারেই ঠিক করে দেয় যে বিশ্ব স্বাস্থ্যের কোন সেক্টরে এবং বিশ্বের কোন অঞ্চলে বা দেশে এই অর্থ যাবে। চীন এবং ফ্রান্স বাধ্যবাধকতার চাইতে খুব কমই অতিরিক্ত অর্থায়ন করে। এটা ধরেই নেয়া যায় যে, ডব্লিইএইচওতে যারা বেশি অর্থায়ন করবে, এই সংস্থাতে তাদের প্রতিপত্তিই বেশি থাকবে; কারণ অর্থায়নকারী দেশগুলি নিজেদের স্বার্থ বিচারেই এই অর্থায়ন করে থাকে; মানবতা বিচারে নয়।

ব্রিটেন তার বৈদেশিক সাহায্যগুলিকে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির একটা অংশ হিসেবে দেখে; এবং এক্ষেত্রে নিজেদেরকে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় দেখতে চায় তারা। এপ্রিলের শুরুতে ব্রিটেন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী প্রায় আড়াই’শ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করার কথা জানায়। ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক সহায়তা বিষয়ক মন্ত্রী এন-ম্যারি ট্রেভেলায়ান বলেন যে, বিশ্বের সবচাইতে গরীব দেশগুলিকে অর্থায়নের মাধ্যমে করোনাভাইরাস যাতে ব্রিটেনে ফেরত না আসতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে চাইছে তার সরকার। ব্রিটেন বিশ্বব্যাপী তার বিশেষজ্ঞদেরকে এবং অর্থায়নকে কাজে লাগিয়ে এই রোগের দ্বিতীয়বারের মতো ব্রিটেনে আগমণ বাধাগ্রস্ত করতে চায়। সেই হিসেবে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ব্রিটেন প্রায় ১’শ ৬২ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করার ঘোষণা দেয়। এর মাঝে ৮১ মিলিয়ন ডলার যাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায়; যা কিনা এই সংস্থায় চীনের পুরো এক বছরের অর্থায়নের চাইতে বেশি। ৬২ মিলিয়ন ডলার যাবে রেডক্রসের কাছে; যারা তা যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে শরনার্থীদের জন্যে ব্যয় করবে। এর মাঝে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী। এর বাইরে আরও ২৫ মিলিয়ন ডলার যাবে আরও কিছু সংস্থা এবং চ্যারিটির কাছে।
   

ঘেব্রেইসাসের নির্বাচিত হওয়াটা কিছুটা নোংড়া প্রতিযোগিতার অংশ ছিল। ঘেব্রেইসাস বলেন যে, ব্রিটেনের প্রার্থীর সমর্থকেরা ঔপনিবেশিক চিন্তা দিয়ে তাকে সমস্যায় ফেলতে চাইছে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে একজন প্রার্থী আসুক এটা তারা চাইছে না। ‘উন্নত বনাম উন্নয়নশীল’ দেশের রাজনীতিকে পুঁজি করেই ঘেব্রেইসাস তার সাফল্য পেয়েছেন। পাকিস্তানের প্রার্থী বাদ পড়ে যাওয়ায় এবং তার বিরুদ্ধে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে ব্রিটিশ প্রার্থী থাকায় ঘেব্রেইসাস এহেন কথাগুলি বলতে পেরেছেন।



কে এই ঘেব্রেইসাস?

একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও ব্রিটেনের সেটা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্তমান ডিরেক্টর জেনারেলের ব্যাপারেও মার্কিন এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের রয়েছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। ৫৫ বছর বয়সী তেদ্রোস আধানম ঘেব্রেইসাস একজন ইথিওপিয়ান রাজনীতিবিদ। জাতিগতভাবে তিগ্রে হবার কারণে তিনি সমাজের এলিট শ্রেণীর অংশ। তাই তার জন্ম বর্তমান এরিত্রিয়াতে হলেও ইথিওপিয়ার শাসক গোষ্ঠীর অংশ হয়ে যান। জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ হলেও ঐতিহাসিকভাবে ইথিওপিয়ার শাসক শ্রেণী এসেছে তিগ্রেদের থেকে। প্রায় ২১ বছর টানা ক্ষমতায় থাকা মেলেস জেনাউইএর সরকারে ২০০৫ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ঘেব্রেইসাস। এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইথিওপিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন তিনি। ১৯৯০এর দশকে ব্রিটেন থেকে ঘেব্রেইসাস স্বাস্থ্য বিষয়ে ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০১৬ সালের মে মাসে ঘেব্রেইসাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের পদের জন্যে নির্বাচনে অংশ নেবার কথা ঘোষণা করেন। তবে এটা বলাই বাহুল্য যে, এই নির্বাচনে অংশ নেয়াটা ঘেব্রেইসাসের ব্যক্তিগত কোন ইচ্ছা বাস্তবায়ন নয়। এতবড় সংস্থার প্রধানের পদটা সবসময়েই বিশ্বরাজনীতির অংশ। এখানে নিঃসন্দেহেই শক্তিশালী দেশগুলির স্বার্থ জড়িত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের পদের জন্যে নির্বাচন প্রতি ৫ বছরে অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে। ‘গ্লোবাল হেলথ নাউ’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। প্রথমে ২০১৭এর জানুয়ারিতে সংস্থাটার ‘এক্সিকিউটিভ বোর্ড’এর ১৪০তম সভায় মোট ৬ জন প্রার্থীর মাঝ থেকে তিনজনকে গোপন ভোটের মাধ্যমে ফাইনালিস্ট ঘোষণা করা হয়। ঘেব্রেইসাস ছাড়া বাকিরা হলেন ব্রিটেনের ডেভিড নাবারো এবং পাকিস্তানের সানিয়া নিশ্তার। বাদ পড়ে যান ইতালি, ফ্রান্স এবং হাঙ্গেরির প্রার্থীরা। এরপর একই বছরের মে মাসে ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলির ৭০তম সভায় জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলি গোপনে ভোট দেয় তাদের পছন্দনীয় প্রার্থীকে। প্রথম ভোটে কেউ দুই তৃতীয়াংশ বা ৯৮টা ভোট না পেলে সর্বনিম্ন ভোট পাওয়া প্রার্থী বাদ হয়ে যান এবং বাকি দু’জনের মাঝে দ্বিতীয় দফায় প্রতিযোগিতা হয়। গোপনে ভোটাভুটি হওয়া এই সেসনের কোন রেকর্ড না রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে সদস্যদেশগুলির। প্রথম দফা ভোটে ঘেব্রেইসাস ৯৫ ভোট পান এবং পাকিস্তানের প্রার্থী বাদ হয়ে যান। দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটিতে ঘেব্রেইসাস পান ১’শ ৩৩ ভোট, এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশ প্রার্থী পান ৫০টা ভোট। ব্রিটেনের ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ঘেব্রেইসাসের নির্বাচিত হওয়াটা কিছুটা নোংড়া প্রতিযোগিতার অংশ ছিল। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথএর প্রফেসর ম্যাথিউ কাভানাউ বলছেন যে, স্বাস্থ্য বিষয়টা আসলে রাজনৈতিক। ঘেব্রেইসাস তার পদ পেয়েছেন তার রাজনৈতিক দক্ষতার কারণেই। ইথিওপিয়ার সরকারে থাকার সময় ঘেব্রেইসাস দেশটার স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আনলেও মানবাধিকার ইস্যুতে তার সরকারের রেকর্ড মোটেই ভালো ছিল না। নির্বাচনের মাঝেই অভিযোগ উঠে যে, ঘেব্রেইসাস মন্ত্রী থাকার সময়ে ইথিওপিয়াতে কলেরার প্রাদুর্ভাবের তথ্য গোপণ করেছিলেন। ‘কোয়ার্টজ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ২০০৬, ২০০৯ এবং ২০১১ সালে ইথিওপিয়াসহ পুরো পূর্ব আফ্রিকাতেই কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়; যার ফলশ্রুতিতে কয়েক’শ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সোমালিয়া, সাউথ সুদান এবং কেনিয়া কলেরা সংক্রমণের কথা ঘোষণা করলেও ইথিওপিয়া এটাকে ডায়রিয়া বলে চালিয়ে দেয়। ঘেব্রেইসাস এই অভিযোগের জবাব দেন রাজনৈতিকভাবে। তিনি বলেন যে, ব্রিটেনের প্রার্থীর সমর্থকেরা ঔপনিবেশিক চিন্তা দিয়ে তাকে সমস্যায় ফেলতে চাইছে। উন্নয়নশীল দেশ থেকে একজন প্রার্থী আসুক এটা তারা চাইছে না। ‘উন্নত বনাম উন্নয়নশীল’ দেশের রাজনীতিকে পুঁজি করেই ঘেব্রেইসাস তার সাফল্য পেয়েছেন। পাকিস্তানের প্রার্থী বাদ পড়ে যাওয়ায় এবং তার বিরুদ্ধে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে ব্রিটিশ প্রার্থী থাকায় ঘেব্রেইসাস এহেন কথাগুলি বলতে পেরেছেন।
  
সংস্থাটা প্রথম থেকেই রাজনৈতিক সংস্থা ছিল; মানবাধিকার সংস্থা নয়। আর এর ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচনের পদ্ধতিও শক্তিশালী দেশগুলি মিলেই ঠিক করেছিল; যাদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রই নেতৃত্ব দিয়েছিল। মার্কিন সরকারের অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণাতে এটা এখন পরিষ্কার যে, এই সংস্থা এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করছে না। আর অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়ন বাড়াবার সিদ্ধান্ত বলে দিচ্ছে যে, ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের ছেড়ে যাওয়া শূণ্যস্থানে বসতে চাইছে।



বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা অস্বচ্ছ সংস্থা

নির্বাচন থেকে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেশিরভাগ কাজকর্মের মাঝেই স্বচ্ছতা নেই। ২০১৯ সালের মে মাসে ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক বছরে শুধুমাত্র ট্রাভেল খরচ বাবদ ১’শ ৯২ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। যেখানে সংস্থাটা এক বছরে এইডস এবং হেপাটাইটিসএর পিছনে খরচ করেছে ৭১ মিলিয়ন ডলার; ম্যালেরিয়ার পিছনে ৬১ মিলিয়ন ডলার; যক্ষ্মার পিছনে ৫৯ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সংস্থার সবচাইতে বড় রোগ প্রতিরোধক প্রোগ্রামগুলির চাইতে স্টাফদের ট্রাভেলের পিছনেই বেশি খরচ হচ্ছে। সংস্থার তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল মার্গারেট চ্যান একাই ২০১৫ সালে ট্রাভেলের পিছনে ৩ লক্ষ ৭০ হাজার ডলার খরচ করেন। ডব্লিউএইচওএর এসেম্বলিতে পাঁচ বছরের জন্যে ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচিত করা ছাড়াও ৩ বছরের জন্যে ‘এক্সিকিউটিভ বোর্ড’এর ৩৪ জন সদস্য নির্বাচন করা হয়। এই বোর্ডই ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচনের জন্যে ফাইনালিস্টদের নির্বাচন করে। অর্থাৎ বোর্ড কাউকে বাদ দিয়ে দিলে সে মূল নির্বাচন থেকেই বাদ পড়ে যাবে। অন্যভাবে দেখলে, এই ৩৪ জনই ঠিক করে দিয়েছিলেন যে, ইথিওপিয়া, ব্রিটেন এবং পাকিস্তানের প্রার্থীরা আসেম্বলির কাছে ভোট চাইতে পারবেন। এই ৩৪ জনের ৭ জন আফ্রিকা থেকে, ৬ জন আমেরিকা থেকে, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া থেকে ৩ জন, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া থেকে ৮ জন, উত্তর পূর্ব আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৫ জন, এবং পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে ৫ জন। এতগুলি অঞ্চলের মাঝে নিজের প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের লোক বসাবার ক্ষমতা খুব দেশেরই আছে।

প্রকৃতপক্ষে ২০১৭ সালের আগে কখনোই ডব্লিউএইচওএর ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচিত ব্যক্তি ছিলেন না! সংস্থার ‘এক্সিকিউটিভ বোর্ড’ ডিরেক্টর জেনারেলের নাম দিয়ে দিতো। সদস্য দেশগুলির এসেম্বলি শুধু সেই ব্যক্তির নাম অনুমোদন দিতো মাত্র। ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত অনেকেই বহুদিন ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। দ্বিতীয় ডিরেক্টর জেনারেল ব্রাজিলের মার্কোলিনো গোমেজ চানডাউ এই পদে ছিলেন ২০ বছর; তৃতীয়জন ডেনমার্কের হাফদান মাহলার পদে ছিলেন ১৫ বছর; চতুর্থজন জাপানি হিরোশি নাকাজিমা ছিলেন ১০ বছরের জন্যে। ২০০৭ সাল থেকে ১০ বছরের জন্যে আসীন ছিলেন হংকংএর মার্গারেট চ্যান। এর মাঝে নরওয়ের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গ্রো হারলেম ব্রুন্টলান্ড ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন ১৯৯৮ থেকে ২০০২ পর্যন্ত। সংস্থাটা প্রথম থেকেই রাজনৈতিক সংস্থা ছিল; মানবাধিকার সংস্থা নয়। আর এর ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচনের পদ্ধতিও শক্তিশালী দেশগুলি মিলেই ঠিক করেছিল; যাদের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রই নেতৃত্ব দিয়েছিল। মার্কিন সরকারের অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণাতে এটা এখন পরিষ্কার যে, এই সংস্থা এখন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করছে না। আর অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়ন বাড়াবার সিদ্ধান্ত বলে দিচ্ছে যে, ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের ছেড়ে যাওয়া শূণ্যস্থানে বসতে চাইছে।

ডব্লিউএইচওএর ব্যর্থতার বহু হিসেব রয়েছে, যেগুলির কারণে কোন ডিরেক্টর জেনারেলকে পদচ্যুত হতে হয়নি। সংস্থার হিসেবে ২০১৭ সালে বিশ্বে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা ছিল ৯০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ১১ লক্ষ! এর মাঝে ৬৪ লক্ষ ছিল নতুন রোগী! আর এক বছরে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১২ থেকে ১৪ লক্ষ! এছাড়াও সংস্থার ২০১৮ সালের হিসেবে এক বছরে এইচআইভি এইডসে মৃতের সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষ ৭০ হাজার থেকে ১১ লক্ষ! এরপর রয়েছে ম্যালেরিয়া। সংস্থার ২০১৭ সালের হিসেবে এক বছরে ম্যালেরিয়াতে বিশ্বব্যাপী ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়! ডেঙ্গুতে প্রতিবছর আক্রান্ত হচ্ছে ৩০ কোটি থেকে ৪০ কোটি মানুষ! দুই দশকে ডেঙ্গুর সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েছে ১৫ গুণ! এক বছরেই মৃত্যুবরণ করছে ২০ হাজারের বেশি মানুষ! ২০১৪ থেকে ২০১৬এর মাঝে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ! প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ লক্ষ লাশের পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়েই ডব্লিউএইচও তার ‘সফলতা’র কথা বর্ণনা করছে। ছোটখাটো সমালোচনা হয়েছে; কিন্তু কেউ অর্থায়ন বন্ধ করার হুমকি দেয়নি। করোনাভাইরাস পশ্চিমা বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। এই ভাইরাস পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতিকে মহাবিপদে ফেলেছে; তাই এর গুরুত্ব এতো বেশি। যক্ষ্মা বা এইডস বা ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু বা ইবোলার কারণে পশ্চিমের কোন কারখানার চাকা বন্ধ হয়নি। তাই বছরে ২০ থেকে ২৫ লক্ষ মরদেহও কাউকে নিজের অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি। বরং এই রোগগুলিকে শক্তিশালী দেশগুলি প্রভাব বিস্তারের ছুতো হিসেবে দেখেছে। এখন সেই প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রের যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রয়েছে। চীনের নাম খুব বেশি প্রচারিত হলেও ডব্লিউএইচওএর নিয়ন্ত্রণ কিন্তু চীনের হাতে নয়। বিশ্বের ৩৪টা দেশের ‘এক্সিকিউটিভ বোর্ড’কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটা আদর্শিক শক্তির কাজ। যুক্তরাষ্ট্র এই সংস্থায় নিজের প্রতিপত্তি হারিয়েছে বলেই অর্থায়ন করতে চাইছে না। অন্যদিকে ব্রেক্সিট-পরবর্তী ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ প্রতিষ্ঠার চিন্তায় বিভোর ব্রিটেন তার অর্থায়ন বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানটাকে কেড়ে নিতে চাইছে। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্ব করোনা-পরবর্তী ভূরাজনৈতিক সংঘাতের একটা শক্তিশালী ইঙ্গিত।


No comments:

Post a Comment