Monday 27 April 2020

করোনাভাইরাসের সুযোগে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বাড়াচ্ছে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’

২৮শে এপ্রিল ২০২০

এপ্রিল মাসে দক্ষিণ আমেরিকার কাছে সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে ব্রিটিশ রয়াল নেভির জাহাজ ‘ফোর্দ’। ব্রিটেনের সামরিক সক্ষমতা সর্বদাই প্রশ্নের মুখে। কিন্তু এই ছোট্ট সক্ষমতাকে ব্যবহার করেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ বিশ্বব্যাপী তার প্রভাবকে বৃদ্ধি করতে চাইছে; যখন করোনা দুর্যোগে সকলেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত; যখন সকলেই যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের সংঘাত নিয়ে চিন্তিত।

ব্রিটেনের ‘স্কাই নিউজ’ এক প্রতিবেদনে বলছে যে, ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর মাঝে ১’শর কম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও প্রায় ১৩ হাজার সেনা এই মুহুর্তে কোয়ার‍্যান্টিনে রয়েছেন, অথবা বাড়িতে থেকে কাজ করছেন, যা কিনা ব্রিটেনের পুরো সামরিক বাহিনীর ৯ শতাংশ। এদের মাঝে কারুর হয়তো উপসর্গ দেখা দিয়েছে; কারুর হয়তো পরিবারের সদস্য আক্রান্ত; অথবা পরিবারের দুর্বল কোন সদস্যকে সহায়তা দেয়ার জন্যে বাড়িতে রয়েছেন। দক্ষিণ আটলান্টিকে ব্রিটিশ উপনিবেশ ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জে কমপক্ষে ১১ জন সামরিক সদস্য করোনা আক্রান্ত বলে জানা গিয়েছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সাইপ্রাস দ্বীপে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটিতেও কমপক্ষে দুইজন সেনার মাঝে করোনার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। তবে ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে যে, তারা ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর কতজন আক্রান্ত হলো, তার হিসেব তারা নিয়মিতভাবে দেবেন না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝে নিজ দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও এটা নিশ্চিত যে বিশ্বব্যাপী ব্রিটেনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাগুলি থেমে থাকেনি। করোনাভাইরাসের মাঝে বহু দেশ যখন শুধুমাত্র নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, তখন সারাবিশ্বে সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ তার প্রভাব বৃদ্ধি করে চলেছে।

মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত মহাসাগর

২৬শে এপ্রিল ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন যে, গত ১০ই এপ্রিল প্রায় সাত মাসে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান উত্তর ইরাকের তুক খুর্মা এলাকায় আইসিস টার্গেটের উপর বোমাবর্ষণ করে। রয়াল এয়ার ফোর্সের দু’টা ‘টাইফুন’ বিমান বোমাবর্ষণে কয়েকটা বিল্ডিং ধ্বংস করে। এতে সহায়তা দেয় রয়াল এয়ার ফোর্সেরই আরেকটা মনুষ্যবিহীন ‘রিপার’ ড্রোন। এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসে শেষবার আইসিসের বিরুদ্ধে ব্রিটিশরা বিমান হামলা করেছিল। ব্রিটেনের ‘মর্নিং স্টার’ পত্রিকা জানাচ্ছে যে, ব্রিটিশদের এই হামলার এক সপ্তাহ আগেই গত ৩রা এপ্রিল ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডমিনিক রাব জাতিসংঘের ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরতিতে সমর্থন দেন। শান্তিবাদী এনজিও ‘পিস প্লেজ ইউনিয়ন’ অভিযোগ করে বলছে যে, ব্রিটিশ সরকার করোনাভাইরাসের আড়ালে চুপিসারে বোমাবর্ষণের কথা ঘোষণা করছে, যখন সকল মিডিয়ার দৃষ্টি মহামারির দিকে। ব্রিটিশ এই হামলার মাত্র চার দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হয়েছিলেন। হামলার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেস বলছেন যে, ব্রিটিশদের প্রতিরক্ষা কখনও ঘুমায় না। এবং তারা নিজেদের মানুষকে রক্ষা করতে যা করা দরকার তা-ই করবে।

ইরাকে হামলার দিনই ব্রিটিশ রয়াল নেভির ফ্রিগেট ‘আরগিল’ প্লাইমাউথের নৌঘাঁটি ছেড়ে যায়; উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত মহাসাগর। জাহাজটার নেতৃত্বে থাকা কমান্ডার এন্ড্রু আইন্সলি ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্যা নিউজ’কে বলেন যে, এক বছরের কম সময় আগেই ‘আরগিল’ নয় মাসের মিশন শেষ করে দেশে ফিরেছিল। এবারে সাত মাসের মিশনে জাহাজটা মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে। ২০০২ সাল থেকে জাহাজটা পঞ্চম বারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে; আর গত এক বছরের মাঝে এটা দ্বিতীয়বার। মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে ব্রিটেনের ফ্রিগেট ‘মনট্রোজ’ ছাড়াও চারটা মাইনহান্টার এবং একটা সাপ্লাই জাহাজ মোতায়েন রয়েছে। মার্চ মাসেই ডেস্ট্রয়ার ‘ডিফেন্ডার’ মধ্যপ্রাচ্যে মিশন শেষে দেশে ফিরে আসে। ‘আরগিল’ এই ‘ডিফেন্ডার’এর স্থান নিতে যাচ্ছে। ২৩শে এপ্রিল রয়াল নেভির এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, সারাবিশ্ব লকডাউনে থাকলেও পারস্য উপসাগরে ব্রিটিশ মাইনহান্টারগুলি সমুদ্রপথ নিরাপদ রাখতে সর্বদা সমুদ্রে টহল দিয়ে যাচ্ছে। উপসাগরে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করতে দু’টা মাইনহান্টার কুয়েতের নৌবাহিনীর সাথে একটা মহড়ায় অংশ নেয়। এর আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ওমানের সাথে যৌথ মহাড়ায় অংশ নেয় ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজগুলি।

২৪শে এপ্রিল ‘নেভাল টেকনলজি’ ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, রয়াল নেভি তাদের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’কে সমুদ্রে ট্রেনিংএর জন্যে পাঠাতে চাইছে। সেই উদ্দেশ্যে সকল ক্রুকেই করোনাভাইরাস টেস্টিং এবং ১৪ দিনের কোয়ার‍্যান্টিনের মাঝ দিয়ে যেতে হবে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন যে, মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ এবং ফরাসী বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘শার্ল দ্য গল’এ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর এমন একটা সময়ে ব্রিটেনের জন্যে তার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের ট্রেনিং কতটা জরুরি। রয়াল নেভির কর্মকর্তারা বলছেন যে, সকল ধরনের প্রস্তুতিই তাদের থাকবে, যাতে সেই ধরনের কোন সমস্যা না হয়। মূলতঃ রয়াল নেভি ডিসেম্বর ২০২০এ নতুন এই জাহাজটার অপারেশনাল হবার সময় নির্ধারণ করেছে। সেই টাইমলাইন নিশ্চিত করতে গেলে মে মাসের শুরু থেকে প্রথম দফা ট্রেনিং শুরু করতে হবে। এরপর এবছরেই শেষবারের মতো ট্রেনিং সম্পন্ন করে মার্কিন ম্যারিন কোরের সাথে ‘এক্সারসাইজ জয়েন্ট ওয়ারিয়র’এ অংশ নেয়ার মাধ্যমে জাহাজটা অপারেশনাল হবার সার্টিফিকেট পাবে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এই টাইমলাইন পিছিয়ে ২০২১ সালে চলে যেতে পারে। গত বছরের নভেম্বরে দিল্লীতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ডমিনিক এসকুইথ ঘোষণা দেন যে, ৭০টা বিমান বহণে সক্ষম যুদ্ধজাহাজ ‘কুইন এলিজাবেথ’এর প্রথম অপারেশনাল এলাকা হবে ভারত মহাসাগর। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটেন তার প্রভাব বাড়াবার কথা ভেবেই করোনাভাইরাসের লকডাউনের মাঝেই এই যুদ্ধজাহাজকে কর্মক্ষম করতে ট্রেনিং মিশনের আয়োজন করছে।
  
ফেব্রুয়ারি মাসে ভিয়েতনাম সফরে ব্রিটিশ রয়াল নেভির সার্ভে জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’। ‘এন্টারপ্রাইজ’ জাহাজটাকে যুদ্ধজাহাজের পর্যায়ে রাখবেন না অনেকেই। কিন্তু এই জাহাজটার মাধ্যমে ব্রিটেন পূর্ব এশিয়াতে তার প্রভাব ধরে রাখার কাজ করছে; বিশেষ করে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির সময়।

ইন্দো-প্যাসিফিক

গত জানুয়ারিতে ব্রিটেন ‘আসিয়ান’এর (এসোসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস) সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে জাকার্তায় একটা অফিস খুলেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে যে, বর্তমান সম্পর্ককে পুঁজি করে আসিয়ান এবং এর সদস্য রাষ্ট্রগুলির সাথে সহযোগিতার নতুন পথ বের করাই এই মিশনের কাজ। ব্রিটেনের সাথে আসিয়ানের বাৎসরিক বাণিজ্যের পরিমাণ এখন প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আসিয়ান দেশগুলি থেকে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ব্রিটেনে পড়াশুনা করছে। আর এখানকার ব্রিটিশ কাউন্সিল ৩৬ হাজার ইংরেজি শিক্ষক তৈরি করেছে। ‘নিকেই এশিয়ান রিভিউ’এর এক লেখায় বলা হচ্ছে যে, ব্রিটেনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ের মাধ্যমে আসিয়ান কৌশলগতভাবে লাভবান হতে পারে। ‘এশিয়া টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে ‘আসিয়ান’ সদস্য রাষ্ট্রগুলি নিজেদের নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে হিমসিম খাবে। তাদেরকে বাধ্য করা হবে যেকোন একদিকে হেলে যেতে। এমতাবস্থায় অত্র অঞ্চলে ব্রিটেনের উপস্থিতিকে অনেকেই স্বাগত জানাতে পারেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব এশিয়া সফর শুরু করার সময় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডমিনিক রাব বলেন যে, ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’কে কর্মে পরিণত করার এটাই সময়। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রচুর সুযোগ রয়েছে; আর ব্রিটেনের বার্তা হলো, ব্রিটেন বাণিজ্যের জন্যে উন্মুক্ত। এই সফরে রাব অস্ট্রেলিয়া থেকে জাপানে যান; আর এরপর সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া হয়ে সফর শেষ করেন। এই অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অংশ; আর সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং ব্রুনাইএর সাথে ব্রিটেনের নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে। ‘ফাইভ পাওয়ার ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট’এর সূত্র ধরে সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ সামরিক অবস্থান রয়েছে, যেটাকে ব্যবহার করে এই অঞ্চলে ব্রিটেন তার কৌশলগত স্বার্থ দেখাশুনা করে।

রয়াল নেভির সার্ভে জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ অনেকদিন ধরেই পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রে টহল দিচ্ছে; কিন্তু তা মিডিয়াতে খুব বেশি একটা আসেনি। গত নভেম্বরে জাহাজটা সিঙ্গাপুরে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সেরে সেখান থেকে ডিসেম্বরে জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া সফর করে। তবে পথে ৭ই ডিসেম্বর জাহাজটা চীন এবং তাইওয়ানের মাঝের তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে গিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতিকে হাইলাইট করে; যা মিডিয়াতে প্রচারিত হয়। এই জাহাজটা ডিজাইন করা হয়েছে সারা বিশ্বের সমুদ্রে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করার জন্যে। এই তথ্য ব্রিটেনের সামরিক এবং বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়। জাহাজটা প্রায় সারা বছরই ব্রিটেন থেকে দূরে থাকতে পারে। জাহাজের কনসেপ্টের সাথেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’কে যুক্ত করা হয়েছে। জানুয়ারিতে আবারও সিঙ্গাপুরে ভ্রমণ শেষ করে ১৯শে ফেব্রুয়ারি ‘এন্টারপ্রাইজ’ ভিয়েতনামের হাই ফং বন্দরে এক সপ্তাহের শুভেচ্ছা সফর করে। চীনা সার্ভে জাহাজের সাথে যখন ভিয়েতনামের নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ নিয়মিত সেখানে ব্রিটিশ সার্ভে জাহাজের জন্যে ভিয়েতনামের বন্দর উন্মুক্ত। ৯ই মার্চ জাহাজটা পুনরায় সিঙ্গাপুরে আসে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে। রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শেষে প্রায় দেড় মাস পর ২১শে এপ্রিল জাহাজটা সিঙ্গাপুর ছেড়ে যায়। ‘এন্টারপ্রাইজ’ জাহাজটাকে যুদ্ধজাহাজের পর্যায়ে রাখবেন না অনেকেই। কিন্তু এই জাহাজটার মাধ্যমে ব্রিটেন পূর্ব এশিয়াতে তার প্রভাব ধরে রাখার কাজ করছে; বিশেষ করে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির সময়।
  
ইংলিশ চ্যানেলে ব্রিটিশ অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ‘টাইন’ রুশ ‘স্টেরাগুশি-ক্লাস’ ফ্রিগেটের উপর নজর রাখছে। মার্চের শেষে রাশিয়ার ৭টা যুদ্ধজাহাজ ইংলিশ চ্যানেলের মাঝ দিয়ে যাওয়া শুরু করে। ইউরোপের নরওয়েতে ‘কোল্ড রেসপন্স’ মহড়া দেয়ার মাধ্যমে ব্রিটেন করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মাঝেও রাশিয়াকে জবাব দিতে বাধ্য করেছে।

ইউরোপ


মার্চ মাসে নরওয়ের অতিশীতল উত্তরাঞ্চলে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী ‘কোল্ড রেসপন্স ২০২০’ নামের মহড়ায় অংশ নেয়। অনেকগুলি দেশের প্রায় ১৫ হাজার সেনা এই মহড়ায় অংশ নেয়। তবে করোনাভাইরাসের লকডাউনের কারণে মহড়াটা সংক্ষিপ্ত করে ১১ই মার্চে শেষ করে দেয়া হয়। ব্রিটেনের সামরিক মিডিয়া ‘ফোর্সেস নেটওয়ার্ক’ জানাচ্ছে যে, প্রায় ২ হাজার ব্রিটিশ সেনা এই মহড়ায় অংশ নেয়। সরাসরি রাশিয়ার কথা বলা না হলেও নরওয়েকে নিরাপত্তা দেয়ার এই মহড়া যে রাশিয়াকে কেন্দ্র করেই তা বুঝতে বাকি থাকে না।

মার্চের শেষে রাশিয়ার ৭টা যুদ্ধজাহাজ ইংলিশ চ্যানেলের মাঝ দিয়ে যাওয়া শুরু করে। রুশ জাহাজগুলির মাঝে ছিল ৫টা ফ্রিগেট, ২টা ল্যান্ডিং শিপ; এবং এগুলির সহায়ক অক্সিলারি জাহাজ। ব্রিটিশ নৌবাহিনী জরুরি ভিত্তিতে তাদের ৯টা জাহাজকে সমুদ্রে প্রেরণ করে রুশ জাহাজগুলির উপর নজরদারি করার জন্যে। ব্রিটিশ জাহাজগুলির মাঝে ছিল ৪টা ফ্রিগেট, ২টা অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল, একটা সার্ভে জাহাজ এবং দু’টা সাপ্লাই জাহাজ। অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল ‘টাইন’এর এক্সিকিউটিভ অফিসার লেফটেন্যান্ট নিক ওয়ার্ড বলেন যে, বাকি সামরিক বাহিনী যেহেতু মহামারি ঠেকাতে ব্যস্ত, এখন এটা তাদের দায়িত্ব যে, ব্রিটেনের নিরাপত্তাকে তুলে ধরা। সামরিক বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, রাশিয়া খুব সম্ভবতঃ ‘কোল্ড রেসপন্স’ মহড়ার জবাব হিসেবেই এতগুলি জাহাজ ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে পার করিয়েছে।

পশ্চিম আফ্রিকা
সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিম আফ্রিকায় সংঘাত ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মালি থেকে এই সংঘাত এখন পার্শ্ববর্তী নিজের এবং বুরকিনা ফাসোকে ধরে বসেছে। আর সাত বছর আগে মালিতে ফরাসীরা সামরিক হস্তক্ষেপের পর থেকে সেখান থেকে বের হতে পারছে না তারা। মালিতে ফ্রান্সের রয়েছে ৫ হাজার সৈন্য। আর ইতোমধ্যেই সেখানে প্রায় ২’শ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীর মৃত্যু হয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে, পশ্চিম আফ্রিকায় ফ্রান্সের এই যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান যুদ্ধের মতো চিরতরে আটকে যাবার মতো দশা হয়েছে। এই অবস্থাটাই ব্রিটেনকে সুযোগ করে দিয়েছে আফ্রিকায় ফ্রান্সের প্রাক্তন ঔপনিবেশিক এলাকায় হস্তক্ষেপ করার। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, পশ্চিম আফ্রিকায় ব্রিটেন তার সামরিক উপস্থিতিকে অনেকটা বৃদ্ধি করতে চাইছে। মালিতে এবছরেই আড়াই’শ ব্রিটিশ সেনা মোতায়েন করার কথা রয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার ‘সাহেল’ অঞ্চলে ব্রিটিশ সেনারা পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে আফ্রিকান সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। সেনেগালে ৩০ জন ব্রিটিশ সেনা ক্যামেরুন, মরক্কো, নাইজেরিয়াসহ কয়েকটা পশ্চিম আফ্রিকার দেশের স্পেশাল ফোর্সের সেনাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সেনাগালে ব্রিটিশ সেনা অফিসার মেজর জন হাউজ বলছেন যে, ব্রিটেনের নিজস্ব স্বার্থেই তারা এই অঞ্চলে বেশি করে জড়িত হচ্ছেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ‘স্পেশালাইজড ইনফ্যান্ট্রি গ্রুপ’এর ব্রিগেডিয়ার গাস ফেয়ার মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, সেটা ব্রিটেনের ক্ষেত্রে হবে না। কারণ ব্রিটেন তার সার্বভৌম শক্তিকে সরাসরি এখানে জড়াতে চাইছে না। ব্রিটেন চাইছে অত্র এলাকার দেশগুলিই তাদের সমস্যার সমাধান করুক।

ব্রিগেডিয়ার ফেয়ারের কথায় এটা পরিষ্কার যে, ব্রিটেন সাহেলে তার অবস্থানকে দৃঢ়তর করলেও সেই দেশগুলির দায়িত্ব সে নিতে চাইছে না। তবে তার প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টাটাও সে অব্যহত রাখতে চাইছে। ৭ই এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মালির পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় জাতিসংঘে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত জেমস রসকো মালিতে গত তিন মাসের ঘটনাবলির ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, মালিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সকল পক্ষ তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে না। তবে পশ্চিম আফ্রিকার খারাপ পরিস্থিতির মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সেখানে এক কোটি ৩৮ লক্ষ মানুষ খাদ্যাভাবে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই লক্ষ্যে ব্রিটেন তার পার্টনারদের মাধ্যমে পশ্চিম আফ্রিকাতে তার সহায়তা বৃদ্ধি করছে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের কথাতেও বোঝা যাচ্ছে যে, সাহেলে ব্রিটেন সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইলেও ব্যর্থতার দায় অন্যের উপরে চাপাতে চাইছে। অর্থাৎ পশ্চিম আফ্রিকার, বিশেষ করে ফরাসী ভাষাভাষী প্রাক্তন ফরাসী ঔপনবেশিক এলাকার দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে নিতে ইচ্ছুক নয়।
  
রয়াল নেভির একমাত্র হসপিটাল জাহাজ ‘আরগাস’। ২রা এপ্রিল জাহাজটা ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির উদ্দেশ্যে প্লাইমাউথ ছেড়ে যায়। মধ্য আমেরিকার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে প্রভাব ধরে রাখতেই ব্রিটেন করোনা দুর্যোগের মাঝেও জাহাজটাকে ক্যারিবিয়ানে পাঠিয়েছে।

মধ্য আমেরিকা

২রা এপ্রিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অক্সিলারি জাহাজ ‘আরগাস’ ক্যারিবিয়ানে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলির উদ্দেশ্যে প্লাইমাউথ ছেড়ে যায়। ক্যারিবিয়ানে হারিকেন সিজন মোকাবিলা এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সহায়তা দেবার জন্যে জাহাজটা সেখানে যাচ্ছে বলে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বলছেন। ব্রিটিশ মিডিয়া ‘কর্নওয়াল লাইভ’ বলছে যে, এই জাহাজটা ব্রিটেনের একমাত্র হসপিটাল জাহাজ। প্লাইমাউথের লেবার এমপি লিউক পলার্ড বলছেন যে, যদিও এই জাহাজটাকে ক্যারিবিয়ানে পাঠানোটা সঠিক সিদ্ধান্ত, তদুপরি জনগণ জিজ্ঞেস করবে যে, দেশের একমাত্র হসপিটাল জাহাজটা লন্ডনের পাশে না থেকে কেন দূর দেশে যাচ্ছে। পলার্ড বলছেন যে, এটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ব্রিটেনের কাছে যথেষ্ট সংখ্যক জাহাজ নেই। তবে তার মতে, ব্রিটেনের পক্ষে জিব্রালটার, ফকল্যান্ডস এবং ক্যারিবিয়ানের মতো উপনিবেশগুলিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। ‘দ্যা ম্যারিটাইম এক্সিকিউটিভ’এর এক প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যে, এই জাহাজটায় ৭০ বেডের একটা হাসপাতাল থাকা সত্তেও এটা সশস্ত্র জাহাজ হবার কারণে এটাকে অফিশিয়ালি হসপিটাল জাহাজ বলা হয় না। ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণের সময় এই জাহাজটাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। মধ্য আমেরিকার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে প্রভাব ধরে রাখতেই ব্রিটেন করোনা দুর্যোগের মাঝেও জাহাজটাকে ক্যারিবিয়ানে পাঠিয়েছে।

দক্ষিণ আমেরিকা

ব্রিটেনের ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এবছরের শুরুতেই ব্রিটিশ রয়াল নেভির প্যাট্রোল জাহাজ ‘ফোর্দ’ দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশ ফকল্যান্ডস দ্বীপপুঞ্জে তার স্থায়ী মিশন শুরু করে। এপ্রিলের শুরুতেই জাহাজটা ফকল্যান্ডসের ১৩’শ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে টহল দিয়ে আসে। ২০শে এপ্রিল আর্জেন্টিনার সর্বদক্ষিণাঞ্চলের সচিব আন্দ্রেস দাখারি এক বিবৃতিতে ফকল্যান্ডসকে আলোচনায় নিয়ে আসেন। তিনি বলেন যে, সারা বিশ্ব যখন স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থায় রয়েছে, তখন ব্রিটেন দক্ষিণ আটলান্টিকে তার সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে। দক্ষিণ আটলান্টিকের সামরিকীকরণের দিকেই ঝুঁকছে ব্রিটেন। রয়াল নেভির এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, জাহাজটা দক্ষিণ আটলান্টিকে ব্রিটিশ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার নিক সইয়ারকে সহ দুই ডজন সৈন্য, বিমান বাহিনীর সদস্য এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বহণ করে সাউথ জর্জিয়াতে নিয়ে যায়। আর্জেন্টিনার সচিবের কথার জবাব দিতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ এডমিরাল এলান ওয়েস্ট বলেন যে, ঐ সচিবের উচিৎ ‘মুখ ঘুরিয়ে লুকানো’ এবং ‘চুপ থাকা’। ‘দ্যা নিউজ’এর সাথে সাক্ষাতে ১৯৮২ সালের ফকল্যান্ডস যুদ্ধে অংশ নেয়া এই এডমিরাল বলেন যে, আর্জেন্টিনার সচিব অস্ত্রের ভাষায় কথা বলছেন। আর যদি আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আটলান্টিকে শান্তিই চায়, তাহলে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলার কথা নয়।

করোনা দুর্যোগের মাঝেও ব্যস্ত রয়েছে ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’

ইউরোপের নরওয়েতে ‘কোল্ড রেসপন্স’ মহড়া দেয়ার মাধ্যমে ব্রিটেন করোনাভাইরাসের দুর্যোগের মাঝেও রাশিয়াকে জবাব দিতে বাধ্য করেছে। দক্ষিণ আমেরিকাতে আর্জেন্টিনাকেও কথা বলাচ্ছে ব্রিটেন। সেনাবাহিনীর ১৩ হাজার সেনা কর্মক্ষেত্রে যোগ না দিতে পারলেও পশ্চিম আফ্রিকার প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশে সেনা মোতায়েনে অটল ব্রিটেন। লন্ডনে যখন করোনাভাইরাসে হাজারো মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, তখন রয়াল নেভির একমাত্র হসপিটাল জাহাজ যাচ্ছে ক্যারিবিয়ানে। মহামারির কারণে জাতিসংঘের ডাকা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরতিতে সমর্থন দিয়েও ইরাকে বিমান হামলা করেছে ব্রিটেন। ভারত মহাসাগরে নতুন করে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ করাটাও থেমে থাকেনি। করোনা সংক্রমণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে তুচ্ছ করেই ব্রিটেন তার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে প্রস্তুত করছে ট্রেনিংএর জন্যে, যাতে সময়তো সেটাকে ভারত মহাসাগরে প্রেরণ করা যায়। পূর্ব এশিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে রয়াল নেভির সার্ভে জাহাজ; আর ব্রিটেনের কূটনীতিকে জাগিয়ে রাখছে সেখানে, যখন সকলেই লকডাউনে ঘরের ভেতর। ব্রিটেনের সামরিক সক্ষমতা সর্বদাই প্রশ্নের মুখে। কিন্তু এই ছোট্ট সক্ষমতাকে ব্যবহার করেই ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ বিশ্বব্যাপী তার প্রভাবকে বৃদ্ধি করতে চাইছে; যখন করোনা দুর্যোগে সকলেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত; যখন সকলেই যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের সংঘাত নিয়ে চিন্তিত। গত ফেব্রুয়ারি মাসে করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যাপী মহামারি দেখা দেয়ার ঠিক আগে আগেই ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডমিনিক রাব পূর্ব এশিয়া সফর করে এই বার্তাই দিয়ে গেছেন।


No comments:

Post a Comment