Monday 18 April 2022

‘জিরো কোভিড’ নীতি নিয়ে চীন কোনদিকে এগুচ্ছে?

১৮ই এপ্রিল ২০২২

‘জিরো কোভিড’ নীতি থেকে সড়ে আসলে শি জিনপিংএর সরকারকে ভুল স্বীকার করতে হবে; যা হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। তাই তারা এখন পর্যন্ত তাদের সাফল্যগুলিকেই হাইলাইট করে যাচ্ছে। ফলাফলস্বরূপ, সারা দুনিয়ার ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ক্যাপিটাল’ চীনের ‘জিরো কোভিড’ নীতির দিকেই সকলে চেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।


চীনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শহর সাংহাই এবং এর আশেপাশের এলাকায় করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন চলছে। এপ্রিলের শুরুতে দৈনিক সংক্রমণ ২০ হাজারে পৌঁছে গেলে ৪ঠা এপ্রিল থেকে পুরো সাংহাই শহরের আড়াই কোটি মানুষকেই অনির্দিষ্ট কালের জন্যে লকডাউনের মাঝে ফেলে দেয়া হয়। ‘বিবিসি’ বলছে যে, সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে যে, জনগণ বাসা থেকে অনলাইনে দরকারি জিনিসপত্র অর্ডার করতে পারবে; আর সরকারি স্বেচ্ছাসেবকরা সেগুলি মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দেবে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রথম সপ্তাহ থেকেই ডেলিভারি সার্ভিসগুলি চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছে না। ডেলিভারির লোকদের মাঝেই অনেকে লকডাউনের বিধিনিষেধে আটকা পড়ে গেছে। ‘উইবো’ সোশাল মিডিয়াতে সরকারি ভিডিও মেসেজের নিচেই অনেকে মন্তব্য করছেন যে, দ্রুত ডেলিভারি সমস্যার সমাধান করা উচিৎ। কেউবা সেখানে লিখেছেন যে, প্রথমবারের মতো তিনি অনাহারে থাকছেন। সাংহাই মিউনিসিপ্যাল কমিশনের ডিরেক্টর লিউ মিন স্বীকার করেছেন যে, খাদ্যের যথেষ্ট মজুত থাকা সত্ত্বেও তারা ডেলিভারি দিতে সক্ষম হচ্ছেন না। সাংহাইএর ভাইস মেয়র চেন টং ৭ই এপ্রিল বলেন যে, তারা জনগণের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সাংহাই এবং অন্যান্য শহরে ‘জিরো কোভিড’ নীতির প্রয়োগ

পশ্চিমাদের ভুল নীতি স্বীকার না করেই ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, বাকি বিশ্বের দেশগুলি ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের সাথে জীবনযাপন করার নীতিতে এগুলেও চীনারা এখনও ভাইরাসকে সমূলে উৎপাটন করার নীতিতে এগুচ্ছে। এর আগে উহান এবং শিয়ান শহরে তারা বেশ সফলতার সাথে কোভিড নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও সাংহাইতে তারা হিমসিম খাচ্ছে। প্রথমতঃ সাংহাই তাদের সবচাইতে বড় শহর। আর দ্বিতীয়তঃ এবারের সংক্রমণের ব্যাপ্তি আগের চাইতে অনেক বেশি। সাংহাই হলো চীনের অর্থনৈতিক ইঞ্জিন। কাজেই সাংহাইএর লকডাউনের প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাপী সকলেই চিন্তিত। বিশ্বের ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ক্যাপিটাল’ বলে খ্যাত চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তেমনি চীনা সরকারের ‘জিরো কোভিড’ নীতিও ব্যাপক সমালোচনার মাঝে পড়ছে। ইতোমধ্যেই সাংহাইয়ে জনগণের মাঝে অসন্তোষের বিভিন্ন রিপোর্ট চীনের নিয়ন্ত্রিত সোশাল মিডিয়াকে ছাপিয়ে বাইরে চলে আসছে।

‘সিএনএন’ বলছে যে, এর আগে মার্চ মাসে শেনজেন শহরে এক সপ্তাহের লকডাউন প্রয়োগের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ রোধ করেছিল চীনা সরকার। এরপর ১০ই এপ্রিল ১ কোটি ৮০ লক্ষ জনসংখ্যার গুয়াংঝু শহরে ৩৭ জনের মাঝে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর পুরো শহরের সকলকে বাধ্যতামূলক কোভিড পরীক্ষার মাঝে নিয়ে আসা হয়। উত্তর পূর্বাঞ্চলের জিলিন প্রদেশেও ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণ বেড়েছে। প্রথম সংক্রমিত হওয়া উহান শহরে ট্রেনে চড়তে গেলে কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট দেখাতে হয়। বেইজিংএর কিছু ‘হাই রিস্ক’ অঞ্চলেও মানুষের চলাচল বেশ নিয়ন্ত্রিত করে ফেলা হয়েছে। হংকংএর ‘সিটি ইউনিভার্সিটি’র এসোসিয়েট প্রফেসর নিকোলাস থমাস বলছেন যে, এটা নিশ্চিত যে, সাংহাইতে লকডাউন প্রয়োগের আগেই সেখান থেকে করোনাভাইরাস অন্য স্থানে সংক্রমিত হয়েছে। ছোট এলাকাগুলি লকডাউনের মাঝে আনা সহজ হলেও সাংহাই শহরের অভিজ্ঞতা বলছে যে, বাকি বড় শহরগুলিতেও প্রয়োজনে একই নীতি প্রয়োগ হতে পারে। তবে সাংহাই লকডাউনের সবচাইতে বড় ফলাফল হবে চীনা কোভিড ব্যবস্থাপনার উপর জনগণের বিশ্বাসকে নতুন করে তৈরি করার চ্যালেঞ্জ। এটা না করা গেলে ভবিষ্যতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সরকারি চেষ্টাগুলির সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। 

সাইংহাইতে স্বেচ্ছাসেবকরা জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যোগাড় করছে। ইতোমধ্যেই সাংহাই শহরে লকডাউনের মাঝে থাকা জনগণের একাংশ পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। খাবারের সংকটে অনেক মানুষ ‘বারটারিং’ বা পণ্য অদলবদলের দিকে ধাবিত হয়েছে। জনরোষের মুখে চীনা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। কোভিড ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়াও সরকারের ভাষ্যকেই অনেকে অবিশ্বাস শুরু করেছে।


খাদ্য সংকট এবং জনরোষ

‘দ্যা গার্ডিয়ান’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, সাংহাই এবং এর আশেপাশের অঞ্চলের বাৎসরিক জিডিপি পুরো চীনের প্রায় ৪০ শতাংশ; যা ১৭ই এপ্রিল নাগাদ কোন না কোন প্রকারের লকডাউনের মাঝে রয়েছে। ইতোমধ্যেই সাংহাই শহরে লকডাউনের মাঝে থাকা জনগণের একাংশ পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। খাবারের সংকটে অনেক মানুষ ‘বারটারিং’ বা পণ্য অদলবদলের দিকে ধাবিত হয়েছে। জনরোষের মুখে চীনা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। কোভিড ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়াও সরকারের ভাষ্যকেই অনেকে অবিশ্বাস শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই জনগণের প্রতিবাদের কিছু ভিডিও চীনা সোশাল মিডিয়াতে আপলোড করা হয়েছে। চীনা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি ভিডিওগুলি নামিয়ে ফেলতে সক্ষম হলেও সেগুলি আবারও পশ্চিমা সোশাল মিডিয়াতে আপলোড করা হয়েছে। তবে পশ্চিমা সোশাল মিডিয়া চীনে এখন নিষিদ্ধ।

‘উইচ্যাট’ সোশাল মিডিয়াতে দু’জন লোকের ফোনালাপের রেকর্ড বেশ ভাইরাল হয়েছে। সাংহাই শহরের ৮২ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ ইউ ওয়েনমিং কিছুদিন আগেই করোনা পজিটিভ হয়েছেন। তিনি তার এলাকার চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকে ফোন করে বলেন যে, তার বাড়িতে কোন খাবার নেই এবং তার সকল ঔষধও শেষ হয়ে গিয়েছে; এখন তিনি কি করবেন? তিনি কি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করবেন? পার্টি নেতা ঝাং ঝেন বৃদ্ধের বারংবার পীড়াপীড়িতে বিরক্ত হয়ে বলেন যে, তিনি তার উচ্চপদস্থদের এব্যাপারে অবহিত করেছেন; এর বাইরে তিনি আর কিছুই করতে পারবেন না। ঝাং বলছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে সহায়তার জন্যে অনুরোধের সংখ্যা বেশ বেড়ে গেছে। কিন্তু তার উচ্চপদস্থরা তাকে কোন সহায়তাই দিচ্ছেন না। তিনি যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ এই কাজ করবেন; সম্ভব না হলে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দেবেন। বৃদ্ধ ওয়েনমিংএর মতো সাধারণ মানুষের বিভিন্ন বক্তব্য সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে সামনে চলে আসছে। প্রচন্ড চাপের মুখে ৫৫ বছর বয়সী একজন পাবলিক হেলথ কর্মকর্তা চিয়ান ওয়েনশিয়ং নিজের অফিসে আত্মহত্যা করেন। চীনা কর্মকর্তারা ঘটনাটাকে স্বীকার করে নিয়ে বলছেন যে, ভদ্রলোক ১৪ই এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং উপ প্রধানমন্ত্রী সুন চুনলান মানুষের হতাশাজনক চিন্তাভাবনাকে অতিক্রম করার শক্তি অর্জন করার কথা বলেছেন, যাতে করে সরকারের ‘জিরো কোভিড’ নীতিকে সফল করা সম্ভব হয়। সরকার তাদের কোভিড নীতিকেই বিশ্বসেরা বলে আখ্যা দিচ্ছে। ‘শিনহুয়া’ সংবাদ সংস্থা জানাচ্ছে যে, শি জিনপিং তার এক ভাষণে বলেন যে, শীতকালীন অলিম্পিকে অংশ নেয়া কিছু বিদেশী এথলেট মন্তব্য করেছেন যে, যদি কোভিড নিয়ন্ত্রণে কাউকে গোল্ড মেডেল দেয়ার কথা বলা হয়, তাহলে সেটা চীনই পাবে। 

শি জিনপিংকে স্বীকার করতে হবে যে, এর আগে মাত্র দু’টা ভাইরাসকে দুনিয়া থেকে সরানো সম্ভব হয়েছিল। এর একটা হলো ‘স্মলপক্স’ এবং অপরটা হলো ‘রিন্ডারপেস্ট’; এটা নিশ্চিত যে, ‘সার্স কোভ-২’ এরকম তৃতীয় একটা ভাইরাস হবে না। শেষবার “মানুষের প্রকৃতিকে জয় করতে হবে” বলে যে চেষ্টা করা হয়েছিল, তা মারাত্মক ফলাফল বয়ে এনেছিল- এই চিন্তাটা কোনভাবেই মুছে ফেলা যাবে না।


বয়বৃদ্ধদের ভ্যাকসিন দেয়া নিয়ে বিতর্ক

‘ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো’র প্রফেসর জেইন ডুকেট বলছেন যে, সাংহাইএর নাগরিকরা চিন্তাও করতে পারেনি যে, সেখানে খাবার এবং অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ঘাটতি তৈরি হতে পারে। আর এগুলির লজিস্টিকসে সমস্যা হলে জনগণের মাঝ থেকে লকডাউনে ছাড় দেয়ার জন্যে চাপ আসতে থাকবে। আবার ছাড় দিলেও সংক্রমণ থামানোতে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। কাজেই চীনা সরকার এক্ষেত্রে উভয় সংকটে রয়েছে; এর যেকোন একটাতে সমস্যা হলেই জনরোষ তৈরি হতে পারে। এর মাঝে আবার বেশি বয়স্কদের ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়েও রয়েছে জটিলতা। চীনা সরকারের হিসেবে ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত ৬৫ বছরের উর্ধ্বে জনগণের মাঝে ৯ কোটি ২০ লক্ষ এখনও ভ্যাকসিনের তিন ডোজ পাননি। আবার ৮০ বছরের উর্ধ্বে ২ কোটি মানুষও পুরোপুরিভাবে ভ্যাকসিন পাননি। জনসংখ্যার এই অংশটারই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বেশি অসুস্থ্য হওয়া বা মৃত্যুর সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এবং বিশেষ করে চীনা নেতা শি জিনপিং দেশটার কোভিড ব্যবস্থাপনা নিয়ে এবছরের শেষের দিকে ২০তম জাতীয় কংগ্রেসে চাপের মাঝে পড়তে পারেন বলে মনে করছেন ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান ডিয়েগো’র ভিক্টর শিহ।

পশ্চিমারাও যে তাদের লকডাউনের নীতিতে ভুল করেছে, সেটা নিয়ে কথা না বলেই মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর সিনিয়র ফেলো ইয়ানঝং হুয়াং বলছেন যে, চীনের উচিৎ সকলকে একত্রে বাড়িতে আটকে না রেখে শুধুমাত্র যারা বৃদ্ধ, তাদেরকে তিন ডোজের ভ্যাকসিন দেয়া এবং তাদের জন্যে এন্টিভাইরাল ঔষধ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবার ব্যবস্থা করা। একইসাথে তাদের উচিৎ পশ্চিমা ভ্যাকসিন নিজেদের দেশে প্রয়োগের ব্যবস্থা করা। 


করোনা মহামারির লকডাউন তুলে নেবার পর থেকে চলেছে আন্তর্জাতিক সাপ্লাই জট। এরপর ২০২১ সাল থেকেই চলছে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্যস্ফীতি; যার সাথে ২০২২ সালে যোগ হয়েছে খাদ্যশস্যের বাজারে ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব। এই সকল কিছুর উপর যুক্ত হয়েছে চীনের লকডাউন; যা কিনা বর্তমান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার অসারতার প্রকৃষ্ঠ প্রমাণ। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব এখন এমন এক দিকে ধাবিত হচ্ছে যে, মানুষ যেকোন বিকল্প বিশ্বব্যবস্থাকে ট্রায়াল দিতে রাজি থাকবে।


‘জিরো কোভিড’এর ভবিষ্যৎ এবং এর ভূরাজনৈতিক প্রভাব

‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’এর ‘সাউ সুয়ি হোক স্কুল অব পাবলিক হেলথ’এর এসোসিয়েট প্রফেসর এলেক্স কুক ‘সিএনএন’কে বলছেন যে, যেহেতু ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্ট খুব সহজে ছড়ায় এবং এটা খুব একটা প্রাণঘাতী নয়, সেহেতু এটা একবার ছড়িয়ে পড়লে আগের ভ্যারিয়্যান্টগুলির মতো নিয়ন্ত্রণ করাটা কঠিন। এতকাল চীনারা ‘জিরো কোভিড’ নীতিতে ব্যাপক সাফল্য পেলেও সেই একই কৌশল ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের ক্ষেত্রে কতটা সফল হতে পারে, সেটা অনিশ্চিত। ‘নিকেই এশিয়া’র এক লেখায় ‘চায়না মানি নেটওয়ার্ক’এর নিনা শিয়াং মত দিচ্ছেন যে, মহামারি নিয়ন্ত্রণ প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর ক্ষমতার প্রতি একটা চ্যলেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। তিনি বলছেন যে, আড়াই বছর হয়ে গেলো সামনা সামনি কূটনীতি এবং জনগণের মাঝে আদানপ্রদান প্রায় বন্ধ। এটা অনেক ক্ষেত্রেই একসময়কার চীনের ‘কালচারাল রেভোলিউশন’এর মতো হয়ে উঠছে; যখন চীনারা সারা দুনিয়া থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। এখন পশ্চিমাদের সাথে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মাঝে চীনারা ক্রমান্বয়েই নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছে। শি জিনপিংকে স্বীকার করতে হবে যে, এর আগে মাত্র দু’টা ভাইরাসকে দুনিয়া থেকে সরানো সম্ভব হয়েছিল। এর একটা হলো ‘স্মলপক্স’ এবং অপরটা হলো ‘রিন্ডারপেস্ট’; এটা নিশ্চিত যে, ‘সার্স কোভ-২’ এরকম তৃতীয় একটা ভাইরাস হবে না। শেষবার “মানুষের প্রকৃতিকে জয় করতে হবে” বলে যে চেষ্টা করা হয়েছিল, তা মারাত্মক ফলাফল বয়ে এনেছিল- এই চিন্তাটা কোনভাবেই মুছে ফেলা যাবে না।

পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা অথবা পশ্চিমা চিন্তাধারা অনুসরণ করা এশিয়রা এখন বুঝতে পারছেন যে, লকডাউনের মতো স্ববিধ্বংসী নীতি অনুসরণ করাটা ভুল। যদিও তারা কেউই স্বীকার করতে চাইছেন না যে, পশ্চিমারা ভুল করেছে। এখন সেই ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’ ভিতের উপর গড়ে ওঠা পশ্চিমা সমাধানগুলিই তারা চীনকে গ্রহণ করতে বলছেন। স্বভাবতই চীনারাও করোনা নিয়ন্ত্রণে পশ্চিমাদের ব্যর্থতাকে মাথায় রেখেই পশ্চিমা উপদেশ উড়িয়ে দিয়েছে। তবে সাংহাই লকডাউন দেখিয়ে দিচ্ছে যে, চীনারা উহানে যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল, সেই একই পদ্ধতি সাংহাইএর মতো একটা শহরে প্রয়োগ করাটা কতটা কঠিন। বিশেষ করে সেটা যখন অতি সংক্রমণ প্রবণ এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্ট। ‘জিরো কোভিড’ নীতি থেকে সড়ে আসলে শি জিনপিংএর সরকারকে ভুল স্বীকার করতে হবে; যা হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। তাই তারা এখন পর্যন্ত তাদের সাফল্যগুলিকেই হাইলাইট করে যাচ্ছে। ফলাফলস্বরূপ, সারা দুনিয়ার ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ক্যাপিটাল’ চীনের ‘জিরো কোভিড’ নীতির দিকেই সকলে চেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। করোনা মহামারির লকডাউন তুলে নেবার পর থেকে চলেছে আন্তর্জাতিক সাপ্লাই জট। এরপর ২০২১ সাল থেকেই চলছে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্যস্ফীতি; যার সাথে ২০২২ সালে যোগ হয়েছে খাদ্যশস্যের বাজারে ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব। এই সকল কিছুর উপর যুক্ত হয়েছে চীনের লকডাউন; যা কিনা বর্তমান পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার অসারতার প্রকৃষ্ঠ প্রমাণ। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব এখন এমন এক দিকে ধাবিত হচ্ছে যে, মানুষ যেকোন বিকল্প বিশ্বব্যবস্থাকে ট্রায়াল দিতে রাজি থাকবে।

No comments:

Post a Comment