Monday 4 April 2022

শ্রীলংকার ভবিষ্যৎ কি?

০৪ঠা এপ্রিল ২০২২

শ্রীলংকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্যে মানুষের লাইন। শ্রীলংকার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর ভিত্তি করে। দেশটার অর্থনীতি পর্যটন খাত এবং রেমিট্যান্স থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে থাকার কারণে জনগণের খরচ বাড়তে থাকে। দেশের রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস খাত এবং পর্যটনমুখী হোটেল ব্যবসাও আমদানিনির্ভর থাকে। রপ্তানি বাড়লেও আমদানির সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেনি কখনোই। ২০১৬ সালে দেশটার পর্যটন শিল্প যখন বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছিল, তখনও দেশের আমদানি ব্যয় মেটাতে না পেরে সরকার ‘আইএমএফ’এর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল।

 
ভারত মহাসাগরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যপথের উপর অবস্থিত শ্রীলংকার সমস্যা যেন হিমালয়সম হয়ে দাঁড়িয়েছে! দেশটায় মারাত্মক মূল্যস্ফীতি চলছে। তদুপরি অর্থ দিয়েও মানুষ তাদের দরকারি জিনিস কিনতে পারছে না। বিশেষ করে আমদানিকৃত যেকোন জিনিসই দুর্লভ হয়ে গেছে। আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্যে যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা দেশটার হাতে নেই। চরম অসন্তোষে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। জরুরি অবস্থা এবং কারফিউ দিয়েও বিক্ষোভ থামানো যাচ্ছে না। সরকারের সকল মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে পার্লামেন্টের সকল দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মন্ত্রীসভা তৈরি করার জন্যে, যাতে করে সমস্যার একটা সমাধান পাওয়া যায়। একসময় দক্ষিণ এশিয়াতে শ্রীলংকাকে সকলের জন্যে মডেল হিসেবে দেখানো হতো। দেশটার মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় ৪ হাজার ডলার; যা কিনা আশেপাশের দেশগুলির প্রায় দ্বিগুণ! দেশটার শিক্ষার হার প্রায় ১’শ ভাগ। ২ কোটি ২০ লক্ষ জনসংখ্যার দেশটার জিডিপি প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের মতো। অথচ বারংবার দেশটাকে দেউলিয়া অবস্থান থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে ‘আইএমএফ’এর সরণাপন্ন হতে হয়েছে। শ্রীলংকার সমস্যার গভীরে যেতে হলে দেশটার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের যথেষ্ট বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

‘দ্যা ইকনমিক টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২০ সালে ‘আইএমএফ’ শ্রীলংকাকে প্রতিশ্রুত ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের মাঝে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দেয়ার পর ঋণের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এতে শ্রীলংকা করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হিমসিম খেয়ে ওঠে। এর ফলশ্রুতিতে ২০২১এর ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীলংকা সরকার পুঁজি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেয়; যার মাঝে ছিল ছয় মাসের মাঝে রপ্তানির অর্থ দেশে ফেরত নিয়ে আসা; রপ্তানি আয়ের কিছু অংশকে রুপিতে পরিবর্তন করে নেয়া; বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের কিছু অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য করা। এই পদক্ষেপগুলির উদ্দেশ্য ছিল ‘আইএমএফ’এর ঋণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং করোনার কারণে পর্যটন শিল্পে ভাটা পড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার যে ঘাটতি পড়েছে, সেটাকে কিছুটা পুষিয়ে নেয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল যে, এর মাধ্যমে শ্রীলংকা বিদেশী ঋণের উপর নির্ভর না করে নিজস্ব সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা বাড়াবে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে আরও একটা লক্ষ্য অর্জিত হবে, তা হলো ‘আইএমএফ’এর শর্তের বেড়াজাল থেকে মুক্ত থাকা। শ্রীলংকার প্রতিমন্ত্রী অজিত নিভাদ কাব্রাল বলেন যে, সরকার আশা করছে যে, ২০২১ সালে দেশের মোট রপ্তানি আয় এবং রেমিটান্স মিলে আসবে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলার; আর দেশ থেকে বের হবে মোট ২৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে দেশে ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত থাকবে। কিন্তু বছর শেষে এই হিসেব পুরোপুরি উল্টে যায়।

 
বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণে ভূস্বর্গ বানিয়েছে শ্রীলংকা। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেষ্টা শ্রীলংকাকে উন্মাদ করেছে। রপ্তানি, পর্যটন এবং রেমিট্যান্স থেকে শ্রীলংকা কম উপার্জন করেনি। কিন্তু উন্নততর লাইফস্টাইলও এতে পেয়ে বসেছে দেশটাকে। আমদানি করা জিনিসের প্রতি আগ্রহ দেশটার জনগণের কাছে স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করা থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর ফলশ্রুতিতে দেশটার উপর ‘আইএমএফ’এর মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

পর্যটন শিল্পে ধ্বস এবং রেমিট্যান্স আয়ে হুন্ডি

দেশটার পর্যটন কর্তৃপক্ষ ফেব্রুয়ারি মাসে জানায় যে, ২০২১ সালে পর্যটন শিল্প প্রায় ৬’শ ৩৪ মিলিয়ন ডলার আয় করে। শ্রীলংকার ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ বলছে যে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে যেখানে দেশটাতে মাত্র ১৭’শ পর্যটক এসেছিল, সেখানে ডিসেম্বর মাসে তা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৯০ হাজারে। আর পুরো বছরে এসেছিল ২ লক্ষের কিছু কম। গত জানুয়ারিতেও ৮২ হাজারের উপর পর্যটক এসেছিল। কিন্তু এটা খুশি হবার কোন খবর নয়; কারণ পর্যটন খাতে শ্রীলংকার আয় ২০১৮ সালে ছিল ৪ বিলিয়ন ডলারের উপর। সেবছর সেদেশে ২০ লক্ষাধিক পর্যটক এসেছিল। তবে ২০১৯ সালে সন্ত্রাসী হামলার পর আয় ৩ দশমিক ৬ বিলিয়নে নেমে আসে। আর ২০২০ সালে করোনার কারণে তা ৭’শ মিলিয়নের নিচে নেমে যায়! অর্থাৎ ২০১৮ সালের তুলনায় পর্যটন খাতে শ্রীলংকার আয় এখন ছয় ভাগের এক ভাগেরও কম!

শ্রীলংকা সরকার আশা করছিল যে, ২০২২ সালে দেশটায় ১০ লক্ষের বেশি পর্যটক আসবে। কিন্তু সেই আশা এখন ধুলোয় মিশে গেছে! ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, গত মার্চ মাসে শ্রীলংকার পর্যটন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেয় যে, ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে তাদের পর্যটন শিল্প আরও এক দফা সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে। কারণ রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকেই তাদের সবচাইতে বেশি পর্যটক এসে থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীলংকায় মোট পর্যটকের মাঝে প্রায় ১৬ শতাংশ এসেছিল রাশিয়া থেকে।

অপরদিকে ২০২১ সালে রেমিট্যান্স আয় একেবারেই পড়ে যায়। ‘রয়টার্স’ বলছে যে, গত বছর রেমিট্যান্স আয় ছিল প্রায় সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার; যা ছিল দশ বছরের মাঝে সর্বনিম্ন! শ্রীলংকার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ভেরিটে রিসার্চ’ বলছে যে, রেমিট্যান্স আয় কমার মূল কারণ হলো সরকার অলিখিতভাবে ডলারের বিপরীতে রুপির মূল্য ২’শ থেকে ২’শ ৩এ নিয়ন্ত্রণ করেছে। অথচ খোলা বাজারে তখন এক ডলারে প্রায় আড়াই’শ রুপি পাওয়া যেতো। এর ফলে বেশিরভাগ প্রবাসী শ্রীলংকান হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে থাকে। তবে সমস্যা হলো যখন দেশটার পর্যটন শিল্প শিখরে ছিল এবং রেমিট্যান্সও ভালো আসছিল, তখনও দেশটাকে বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে দেউলিয়াত্বের মাঝে পড়ে ‘আইএমএফ’এর দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এর অর্থ হলো, মূল সমস্যা পর্যটন বা রেমিট্যান্স খাতে নয়; অন্য কোথাও।

 
স্বাধীনতার পর থেকে শ্রীলংকাকে মোট ১৬ বার 'আইএমএফ'এর দ্বারস্থ হতে হয়েছে। প্রতিবারই ‘আইএমএফ’ দেশটার সরকারের উপর কঠিন শর্তারোপ করেছে, যা জনগণের জন্যে বয়ে এনেছে ভোগান্তি। কিন্তু এতে দেশটার অর্থনৈতিক সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আসেনি। বিদেশীদের কাছে ঋণের জন্যে হাত পেতেই চলতে হয়েছে দেশটাকে। বহু বছর তামিল টাইগারদের সাথে গৃহযুদ্ধের মাঝে ‘আইএমএফ’ দেশটার উপর নিয়ন্ত্রণ রেখেছে; যুদ্ধও চলেছে যুগের পর যুগ। অর্থাৎ শ্রীলংকা কখনোই স্বাধীন হতে পারেনি।


আমদানি নির্ভরতা শেষ পর্যন্ত ‘আইএমএফ’এর কাছে নিয়ে গেলো শ্রীলংকাকে

গত জানুয়ারি মাসে শ্রীলংকার রপ্তানি উন্নয়ন সংস্থা জানায় যে, ২০২১ সালে দেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল প্রায় সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল রপ্তানি টার্গেটের চাইতেও বেশি। কিন্তু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে যেখানে শ্রীলংকার মাসিক বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় সাড়ে ৫’শ মিলিয়ন ডলার, তা ২০২১এর ডিসেম্বরে এসে দাঁড়ায় ১ বিলিয়ন ডলারেরও উপর। এর মূল কারণ হলো, রপ্তানি বাড়ার হার যেখানে ছিল প্রায় ২০ শতাংশ, সেখানে আমদানি বেড়েছিল প্রায় ৪৭ শতাংশ হারে। গত ডিসেম্বরে শ্রীলংকা প্রায় ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল; যা ছিল দেশটার ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ আমদানি।

শ্রীলংকার পত্রিকা ‘ইকনমি নেক্সট’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, দেশটার আমদানি ব্যয় আগের বছরের ১৬ বিলিয়নের তুলনায় সাড়ে ২৮ শতাংশ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে। এই আমদানি দেশের জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ। করোনার আগে ২০১৯ সালেও আমদানি ছিল ২০ বিলিয়নের চাইতে কম। এর ফলশ্রুতিতে দেশটার বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। সরকার গাড়ি আমদানির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় গাড়ি আমদানির ব্যয় ২০১৯ সালে ৮’শ ১৬ মিলিয়ন ডলার থেকে মাত্র ১৩ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তবে সার্বিকভাবে যেহেতু আমদানি ব্যয় কমানো সম্ভব হচ্ছে না, তাই রপ্তানি বৃদ্ধি করেও বাণিজ্য ঘাটতি কমানো অথবা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এই মুহুর্তে পর্যটন শিল্পের অবস্থা খারাপ রয়েছে। কিন্তু পর্যটন শিল্প ভালো হলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে না। কারণ যারা পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত, তারা খরচ বাড়াবে এবং ফলশ্রুতিতে আমদানি বাড়তে থাকবে। হোটেলগুলিও জরুরি মেরামতের কাজগুলি করবে এবং তাদের ঋণ ফেরত দিতে থাকবে। এর ফলে আরও বিনিয়োগ হবে এবং আমদানি বাড়বে। ব্যাংকগুলি যদি সরকারি বন্ড কেনে, সেটাও ব্যবহৃত হবে সরকারি কর্মচারিদের বেতন দিতে; যা কিনা আবারও আমদানি বাড়াবে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এই সমস্যার মূলে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রুপি ছাপানো। যখন অর্থনীতে যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা আসছিলো না এবং সরকার যথেষ্ট আয় করতে পারছিলো না, তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় রুপি ছাপানো বৃদ্ধি করার। এতে মারত্মক মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে। ঋণের উপর সুদের হার কম থাকায় বিনিয়োগ বেড়েছে এবং প্রচুর যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। ফলশ্রুতি যন্ত্রপাতি আমদানি ২ দশমিক ১ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৮ বিলিয়নে উঠে গেছে। শিল্পের জন্যে ক্যাপিটাল গুডসএর আমদানি সাড়ে ৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৪ বিলিয়নে পৌঁছেছে। কন্সট্রাকশন দ্রব্যের আমদানি বেড়ে ১ বিলিয়ন থেকে হয়েছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। খাদ্যদ্রব্য আমদানিতে খরচ হয়েছে দেড় বিলিয়ন ডলার। মোট ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার; যা আগের বছর ছিল ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। বিরাট পরিবর্তন এসেছে জ্বালানি আমদানিতে। আড়াই বিলিয়ন ডলার থেকে জ্বালানি আমদানি ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে উঠে গেছে। এই মুহুর্তে মোট আমদানির ১৮ শতাংশ জ্বালানি; রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের জন্যে আমদানি করা কাপড় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ; যন্ত্রপাতি ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ; খাদ্য বাদে অন্যান্য ভোগ্যপণ্য সাড়ে ১০ শতাংশ; খাদ্যদ্রব্য ৮ শতাংশ; ঔষধ ও মেডিক্যাল দ্রব্য ৪ শতাংশ।

শ্রীলংকার রাজাপক্ষে সরকার শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার কাছে হার মেনেছে। ফলশ্রুতিতে সরকার গত ১৪ই মার্চ ‘আইএমএফ’এর সাথে আলোচনায় বসে। ক্ষমতা নেবার পর থেকে ‘আইএমএফ’এর কঠিন শর্তের বেড়াজাল এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শ্রীলংকার ঋণদাতা দেশ ভারত এবং চীন অন্যদিকে ব্যস্ত। এর আগেই শ্রীলংকা সরকার রুপির মূল্য কমিয়ে ঋণ নেয়াকে আরও কঠিন করে দেয়। এই পদক্ষেপ ‘আইএমএফ’এর প্রেসক্রিপশনের মাঝে থাকায় অনেকেই ধারণা করে যে, সরকার খুব সম্ভবতঃ আবারও ‘আইএমএফ’এর কাছে যাচ্ছে। মার্চ মাস নাগাদ দেশটার বৈদেশিক রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। অথচ এবছরেই তাদের ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ফেরত দিতে হবে। এর মাঝে জুলাই মাসে ফেরত দিতে হবে ১ বিলিয়ন ডলারের বন্ড।

 
গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং তার ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে। মাহিন্দা রাজাপক্ষের জাতীয়তাবাদী সরকার ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ করে শ্রীলংকাকে যুদ্ধের শৃংখল থেকে মুক্ত করলেও অর্থনৈতিক শৃংখল থেকে মুক্ত করার ফর্মূলা রাজাপক্ষেদের হাতে ছিল না; এখনও নেই। রাজাপক্ষেদের জাতীয়তাবাদী আবেগের চিন্তাগুলি অনেকের কাছে আকর্ষনীয় মনে হলেও তা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যায়না। ভেড়ার পালের মতো বাকিদের অনুসরণ করার বাইরে শ্রীলংকার হাতে কিছুই করার নেই। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনই যেন শ্রীলংকার সামনে একমাত্র আশা।

জন্মের পর থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার পিছনে ছুটেছে শ্রীলংকা

‘সিএনবিসি’র এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, শ্রীলংকার অর্থনীতির করুণ দশা আজকের নয়। অর্থাৎ এই সমস্যার গভীরতা যথেষ্ট। ২০১৬ সালে দেশটার বৈদেশিক রিজার্ভ মারাত্মক নেমে গেলে সরকার ‘আইএমএফ’এর কাছে ঋণের জন্যে যেতে বাধ্য হয়। ‘আইএমএফ’এর শর্ত মেনে শ্রীলংকার সরকার দেড় বিলিয়ন ডলার ঋণ পায়। সেই বছরের শেষ নাগাদ দেশটার বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। এমনকি সরকার নিজেই বলতে পারছিলো না যে, দেশটার মোট ঋণ আসলে কত। বৈদেশিক ঋণ ফেরত দেয়ার লক্ষ্যে সরকার ‘আইএমএফ’এর ফর্মূলায় মূল্য সংযোজন কর বৃদ্ধি করে। ২০১৮ সালে চীন শ্রীলংকাকে আরও ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেয়। ভারতের কাছ থেকে ঋণ না পেয়ে শ্রীলংকা বাংলাদেশের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে।

১৫ বছরের মাঝে দেশটার সবচাইতে মারাত্মক আর্থিক সমস্যার মাঝে ২০১৯ সালে গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং তার পরিবারবর্গ ক্ষমতায় আসে। তাদের প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল কর কমানো। মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা ছাড়াও সরকার বহু ক্ষেত্রে বিপুলভাবে কর কর্তন করে। সরকারের যুক্তি ছিল যে, কর কমালে বিনিয়োগ বাড়বে এবং অর্থনীতি চাঙ্গা হবে; জিডিপি বাড়বে। এর মাধ্যমে যেসব ক্ষেত্রে কর পাওয়া যেতো না, তারাও কর দেয়ার সামর্থ্য অর্জন করবে। কিন্তু ২০১৯ সালে সন্ত্রাসী হামলা এবং ২০২০ সালে করোনার লকডাউনের কারণে শ্রীলংকার অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। আর রাজাপক্ষে সরকার ‘আইএমএফ’এর শর্ত বাস্তবায়নে গড়িমসি করায় ‘আইএমএফ’ ঋণ দেয়া বন্ধ করে দেয়। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পোষাতে না পেরে সরকার রুপি ছাপাতে থাকে। এতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।

২০১৯ সাল থেকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে গোতাবায়া রাজাপক্ষে সরকার জনগণের উপর কর কমানো থেকে সরে আসতে চায়নি। এর ফলশ্রুতিতে সরকারের রাজস্ব নিম্নগামী হয় এবং বৈদেশিক ঋণ ফেরত দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শ্রীলংকার সমস্যা শুধু রাজাপক্ষের পরিবার নয়। কারণ ২০১৯ সালে তারা ক্ষমতায় আসার আগেও দেশটার অর্থনীতি ধুঁকে ধুঁকে চলছিল। শ্রীলংকার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর ভিত্তি করে। দেশটার অর্থনীতি পর্যটন খাত এবং রেমিট্যান্স থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে থাকার কারণে জনগণের খরচ বাড়তে থাকে। দেশের রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস খাত এবং পর্যটনমুখী হোটেল ব্যবসাও আমদানিনির্ভর থাকে। রপ্তানি বাড়লেও আমদানির সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেনি কখনোই। ২০১৬ সালে দেশটার পর্যটন শিল্প যখন বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছিল, তখনও দেশের আমদানি ব্যয় মেটাতে না পেরে সরকার ‘আইএমএফ’এর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল। ‘আইএমএফ’এর শর্ত পূরণে দেশের মানুষের উপর কর বৃদ্ধি করে সরকার। ‘আইএমএফ’ দেশটার রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য উদারীকরণের উপর চাপ দিলেও আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে কখনোই উপদেশ দেয়নি, যা কিনা সর্বদাই দেশটার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাবার মূল কারণ ছিল। স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা না করে আমদানিনির্ভর অর্থনীতি হবার কারণে শ্রীলংকার অর্থনীতি আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে ওঠানামা করেছে। করোনার লকডাউন উঠে যাবার পর আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে যায়, তখন শ্রীলংকার আমদানি ব্যয়ও বাড়তে থাকে। আমদানি ব্যয় মেটাতে শ্রীলংকার সরকার বৈদেশিক ঋণের দিকে ঝুঁকে যায়। এর মাঝে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জ্বালানির মূল্য আরেকবার বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও পর্যটন শিল্প আরেকবার ধ্বসের মুখে পড়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেষ্টা শ্রীলংকাকে উন্মাদ করেছে। রপ্তানি, পর্যটন এবং রেমিট্যান্স থেকে শ্রীলংকা কম উপার্জন করেনি। কিন্তু উন্নততর লাইফস্টাইলও এতে পেয়ে বসেছে দেশটাকে। আমদানি করা জিনিসের প্রতি আগ্রহ দেশটার জনগণের কাছে স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা করা থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর ফলশ্রুতিতে দেশটার উপর ‘আইএমএফ’এর মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘দ্যা ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় থামিল ভেনথান আনান্থাভিনায়াগান মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, স্বাধীনতার পর থেকে মোট ১৬ বার ‘আইএমএফ’এর দ্বারস্থ হতে হয়েছে শ্রীলংকাকে। প্রতিবারই ‘আইএমএফ’ দেশটার সরকারের উপর কঠিন শর্তারোপ করেছে, যা জনগণের জন্যে বয়ে এনেছে ভোগান্তি। কিন্তু এতে দেশটার অর্থনৈতিক সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আসেনি। বিদেশীদের কাছে ঋণের জন্যে হাত পেতেই চলতে হয়েছে দেশটাকে। বহু বছর তামিল টাইগারদের সাথে গৃহযুদ্ধের মাঝে ‘আইএমএফ’ দেশটার উপর নিয়ন্ত্রণ রেখেছে; যুদ্ধও চলেছে যুগের পর যুগ। অর্থাৎ শ্রীলংকা কখনোই স্বাধীন হতে পারেনি। অন্ততঃ পৃথিবীর প্রধান সমুদ্রপথের উপর অবস্থিত এই দ্বীপ দেশের উপর পশ্চিমারা কখনোই নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে রাজি ছিল না। মাহিন্দা রাজাপক্ষের জাতীয়তাবাদী সরকার ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ করে শ্রীলংকাকে যুদ্ধের শৃংখল থেকে মুক্ত করলেও অর্থনৈতিক শৃংখল থেকে মুক্ত করার ফর্মূলা রাজাপক্ষেদের হাতে ছিল না; এখনও নেই। রাজাপক্ষেদের জাতীয়তাবাদী আবেগের চিন্তাগুলি অনেকের কাছে আকর্ষনীয় মনে হলেও তা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যায়না। ভেড়ার পালের মতো বাকিদের অনুসরণ করার বাইরে শ্রীলংকার হাতে কিছুই করার নেই। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনই যেন শ্রীলংকার সামনে একমাত্র আশা।

4 comments:

  1. ধন্যবাদ। ভারত জরুরী ভিত্তিতে শ্রীলঙ্কায় চাল, তেল পাঠাচ্ছে। চীন এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় কোন ধরনের সাহায্য পাঠাচ্ছে কি? চীন কিভাবে শ্রীলঙ্কার বন্দরের মালিকানা পেল?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এর চাইতে বড় প্রশ্ন হলো শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধ কিভাবে হঠাত করে শেষ হয়ে গেল? তিনি দশকের যুদ্ধ মাত্র দেড় বছরের মাঝে শেষ হয়ে গেল কেন? যেখানে এই যুদ্ধকে জিইয়ে রাখার বহু স্বার্থ ছিল বড় বড় শক্তিদের। এটা প্রমাণ করে যে, একসময় বিশ্বটা যেভাবে চলছিল, এখন সেভাবে চলছে না। যুদ্ধ শেষ না হলে চীনের মতো একটা দেশ শ্রীলংকার মতো কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটা সমুদ্রবন্দর করে ফেলবে, এটা কল্পনা বাইরে ছিল। শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পর ভারত মহাসাগরকে নিয়ে সকলকে নতুন করে চিন্তা করতে হয়েছে।

      শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়া নিয়ে এই লেখাটা পড়তে পারেন -
      https://koushol.blogspot.com/2016/02/sri-lanka-navy-war-lesson.html

      Delete
  2. আমার আরেকটা প্রশ্ন হচ্ছে যে চীনের মতো একটা দেশ শ্রীলংকার মতো কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটা সমুদ্রবন্দর কিভাবে বানাতে পারল এবং তার পরিচালনা নিজেদের হাতে রাখতে পারল??? ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দয়া করে উপরের কমেন্টটা পড়ুন।

      Delete