১৬ই এপ্রিল ২০২২
‘রয়টার্স’ বলছে যে, ইউক্রেনে পাঠানো যুদ্ধাস্ত্রগুলিকে প্রতিস্থাপন করতে এবং ইউক্রেনের মাটিতে দীর্ঘ যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিতেই মার্কিন কর্মকর্তারা গত ১৩ই এপ্রিল প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলির সাথে বৈঠকে বসেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘স্টিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের বড় সংখ্যায় সরবরাহ এবং সেগুলির ব্যাপক সফলতার পর এই অস্ত্রগুলির স্টক পূর্বের স্থানে নিয়ে আসার জন্যে ওয়াশিংটনে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। মার্কিন কোম্পানি ‘রেথিয়ন’ এবং ‘লকহীড মার্টিন’ একত্রে ‘জ্যাভেলিন’ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে; আর ‘স্টিংগার’ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে ‘রেথিয়ন’। মার্কিন কর্মকর্তারা ঘোষণা দিয়েছেন যে, ওয়াশিংটন ইউক্রেনকে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছে; যার মাঝে রয়েছে ৭ হাজার ‘জ্যাভেলিন’ এবং ২ হাজার ‘স্টিংগার’।
‘জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর হ্যাল ব্র্যান্ডস ‘ব্লুমবার্গ’এর এক লেখায় বলছেন যে, যখন পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়া নতুন করে আক্রমণে যাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক সক্ষমতা হারাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে সমরাস্ত্র এবং অর্থ সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র ‘গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার’ হিসেবে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ লম্বা হবার সাথে সাথে তা যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতাগুলিকে সামনে নিয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতে ‘গ্রেট পাওয়ার’দের মাঝে যেকোন সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রকে অপ্রস্তুত করে ফেলছে। মার্কিনীরা মনে করেছিল যে, রুশরা খুব দ্রুতই পুরো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে; তখন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনিয়ানদেরকে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সহায়তা দেবে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনিয়ানদের ব্যাপক সফলতা একেবারে হঠাত করেই বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের চাহিদা তৈরি করে ফেলেছে। এখন পশ্চিমা দেশগুলির সামনে দু’টা অপশন খোলা রয়েছে। প্রথমতঃ ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ বাড়ানো; এবং দ্বিতীয়তঃ নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্যে সীমিত অস্ত্রের স্টকগুলিকে রক্ষা করা। হ্যাল ব্র্যান্ডস বলছেন যে, পূর্ব ইউক্রেনের খোলা সমতলভূমিতে ইউক্রেনিয়ানদের চোরাগুপ্তা হামলা করার সুযোগ কম। এমতাবস্থায় ইউক্রেনের যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের প্রয়োজন হবে, তা যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত নতুন করে তৈরি করে দিতে সক্ষম হবে না।
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ বা ‘সিএসআইএস’এর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক ক্যানসিয়ান এক লেখায় বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এমন অবস্থানে পৌঁছেছে, যখন সম্ভাব্য কোন যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্রের স্টক ঠিক রাখতে গিয়ে ইউক্রেনকে কম সরবরাহ করতে বাধ্য হবে। তিনি আশংকা করছেন যে, ইউক্রেনিয়ানরা যুদ্ধক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা নিয়ে আসতে পারার আগেই তাদের ‘জ্যাভেলিন’এর সরবরাহ থেমে যেতে পারে। ক্যানসিয়ানের হিসেবে ১৯৯৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন সেনাবাহিনী সর্বমোট ৩৭ হাজার ৭’শ ৩৯টা ‘জ্যাভেলিন’ ডেলিভারি পেয়েছে। প্রতি বছরে ট্রেনিংএর জন্যে যত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেটার সংখ্যা বাদ দিলে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জ্যাভেলিন’এর স্টক দাঁড়াবে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজারের মতো। এর ৭ হাজার যদি ইউক্রেনকে দেয়া হয়, তা মার্কিনীদের মোট ‘জ্যাভেলিন’এর এক তৃতীয়াংশ হবে। এখনও দুই তৃতীয়াংশ স্টক যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকলেও মার্কিন সামরিক নেতৃত্ব উত্তর কোরিয়া, ইরান অথবা রাশিয়ার সাথে কোন সম্ভাব্য যুদ্ধে ‘জ্যাভেলিন’এর যথেষ্ট সরবরাহ পাবে কিনা, সেব্যাপারে নিশ্চিত থাকবে না। এর ফলশ্রুতিতে এই দেশগুলির সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধে তারা তাদের পরিকল্পনা পাল্টাতে বাধ্য হবে।
‘জ্যাভেলিন’ একবার অর্ডার করলে প্রথম ডেলিভারে পেতে ৩২ মাস সময় লাগতে পারে। এতদিন বছরে গড়ে ১ হাজার করে ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ পেলেও সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজারও পাওয়া সম্ভব। তবে সেই হারে সরবরাহ পেতে হলে উৎপাদন কমপক্ষে এক বছর ধরে চলতে হবে। এর অর্থ হলো ইউক্রেনকে সরবরাহ করা ‘জ্যাভেলিন’গুলিকে প্রতিস্থাপিত করতে গেলে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ বছর লেগে যাবে। অপরদিকে ‘স্টিংগার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহের অবস্থা আরও শোচনীয়। ২০০৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র মোট ১১ হাজার ৬’শ ‘স্টিংগার’ ডেলিভারি পেয়েছে। ট্রেনিংএর জন্যে ব্যবহার করার পর হয়তো ৮ হাজারের মত অবশিষ্ট থাকতে পারে। ইউক্রেনকে ২ হাজার দেয়ার অর্থ হলো মোট স্টকের এক চতুর্থাংশ। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে প্রতিস্থাপন করতে গেলে কমপক্ষে ৫ বছর লেগে যাবে। আরেকটা সমস্যা হলো, পেন্টাগন ‘স্টিংগার’এর প্রতিস্থাপক খুঁজছে; যা এখনও প্রস্তুত নয়। এমতাবস্থায় নতুন করে ‘পুরোনো’ প্রযুক্তিতে তারা বিনিয়োগ করতে চাইবে না।
ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ বা ‘আইআইএসএস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রুশদের অপারেশনাল ইউনিটগুলিতে মোট ২ হাজার ৮ ট্যাংক এবং ১৩ হাজার অন্যান্য সাঁজোয়া যান রয়েছে। আর স্টক করে রাখা আছে আরও প্রায় ১০ হাজার ট্যাংক এবং সাড়ে ৮ হাজার অন্যান্য সাঁজোয়া যান। এর বিপরীতে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স থেকে জানা যাচ্ছে যে, রুশরা যুদ্ধে প্রায় ১৩’শ ট্যাংক এবং সাঁজোয়া যান হারিয়েছে। এর অর্থ হলো, রুশ খুব দ্রুতই ট্যাংক বা সাঁজোয়া যানের স্বল্পতায় পড়ে যাচ্ছে না। তবে রুশরা নিঃসন্দেহে দক্ষ যোদ্ধার স্বল্পতায় রয়েছে। মার্ক ক্যানসিয়ান বলছেন যে, ক্ষতি পোষাতে রুশরা দুর্বল ট্রেনিংএর সেনাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে আসবে; যাদের মনোবল থাকবে কম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রুশদের জনবল যোগাড়ের চ্যালেঞ্জ আর ইউক্রেনিয়ানদের ‘জ্যাভেলিন’এর সরবরাহের চ্যালেঞ্জের মাঝে কোনটা জিতবে?
‘পলিটিকো’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের একটা চ্যালেঞ্জ হলো, এগুলির অনেক ছোট ছোট যন্ত্রাংশ রয়েছে, যেগুলি কয়েক’শ কোম্পানি সরবরাহ করে থাকে। এরা আবার সেগুলি উৎপাদন করতে গিয়ে ‘রেয়ার আর্থ ম্যাটেরিয়াল’ এবং বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রাংশ বিভিন্ন উৎস থেকে যোগাড় করে থাকে। ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট’এর সিনিয়র ফেলো উইলিয়াম গ্রীনওয়াল্ট বলছেন যে, এই কোম্পানিগুলি স্টক মার্কেটে নিজের অবস্থান দুর্বল হবার ভয়ে সুনির্দিষ্ট অর্ডার ব্যাতীত কোন বিনিয়োগ করবে না। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপিয় বন্ধুরা নিশ্চয়তা চাইছে যে, ইউক্রেনকে তারা যেসব বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে, সেগুলি যুক্তরাষ্ট্র প্রতিস্থাপন করে দেবে। এমতাবস্থায় যে ব্যাপারটা পরিষ্কার তা হলো, ‘গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার’ বলে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে ইউক্রেনের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ একদিকে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী ‘গ্রেট পাওয়ার’ রাশিয়াকে আটকে রাখার একটা মোক্ষম সুযোগ, তেমনি নিজেদের অস্ত্র উৎপাদন সক্ষমতার চ্যালেঞ্জের কারণে রাশিয়াকে ইউক্রেনে আটকে রাখাটাই তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একমাত্র অপশন।
ভিন্ন প্রসঙ্গঃ
ReplyDeleteযদি আমেরিকার রাজনৈতিক ক্ষমতার বিনাশ হয় তবে কি মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইস্রাএলের পতন হবে?
ইস্রাইলকে তৈরি করেছিল ব্রিটেন। ইস্রাইলের কনসেপ্টটাই ব্রিটিশ। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিরা বেশিরভাগই ইস্রাইল তৈরির বিরোধিতা করেছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকে ইস্রাইলের নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যায়। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করে যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ইস্রাইলকে ধ্বংস করবে না। এটাই ইস্রাইলের রক্ষা কবচ। ইস্রাইলের কোন স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ নেই, যা সে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। কাজেই তার যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।
Deleteসাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার সম্পদ কমিয়ে ফেলাতে সেখানে তার প্রভাব অনেকটাই কমে গেছে। একারণেই ইস্রাইল আরব দেশগুলির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ইস্রাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে। আর আরব দেশগুলি ইরানের কথা চিন্তা করে ইস্রাইলকে বন্ধু হিসেবে দেখছে। অর্থাৎ ইস্রাইল এবং ইরান এখানে একই সমীকরণের দুই পাশ মাত্র। এই সমীকরণের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যকে পশ্চিমারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এখানে মূল খেলোয়াড় যুক্তরাষ্ট্র হলেও ব্রিটেনের অনেক বড় প্রভাব রয়েছে। আরব দেশগুলির অনেকগুলিরই গুরুত্বপূর্ণ আমলারা ব্রিটিশ নাগরিক অথবা ব্রিটিশ সমর্থিত।
ইস্রাইল তৈরির কনসেপ্ট নিয়ে জানতে নিচের এই লেখাটা পড়তে পারেন -
https://koushol.blogspot.com/2016/07/gulshan-79-ideological-furuncle.html