Tuesday 5 April 2022

অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব উঠানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় চীন

০৫ই এপ্রিল ২০২২

সেপ্টেম্বর ২০১৯। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়িএর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার স্বারক আদানপ্রদান করছেন সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমায়া মানেলে। অস্ট্রেলিয়া যেমন দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেছে, তেমনি চীনও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ছোট দ্বীপ দেশগুলিকে জাতিসংঘে তাইওয়ানের পক্ষে ভোট দিতে দেখে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সেই অঞ্চলে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে।

 
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ দেশ সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের সাথে চীনের নিরাপত্তা আলোচনা চলছে কিনা, সেব্যাপারে গত ২৯শে মার্চ সেদেশের প্রধানমন্ত্রী মানাসেহ সোগাভারে পার্লামেন্টে বলেন যে, রাষ্ট্র হিসেবে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ কার সাথে আলোচনা করবে, সেব্যাপারে অন্য দেশের মন্তব্য করাটা খুবই অপমানজনক। এর অর্থ হলো এই দেশের নেতৃত্ব রাষ্ট্র পরিচালনায় অক্ষম। এর আগে ২৪শে মার্চ অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার ডাটন সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের সাথে চীনের সম্ভাব্য নিরাপত্তা চুক্তির ব্যাপারে বলেন যে, অস্ট্রেলিয়া থেকে ২ হাজার কিঃমিঃ দূরে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে কোন সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হলে অস্ট্রেলিয়া খুবই চিন্তিত হবে। তিনি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলিকে চীনের কর্মকান্ড সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকার জন্যে আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, অস্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলি যে আদর্শকে আলিঙ্গন করে, চীনাদের কর্মকান্ড সেই আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, সম্ভাব্য এই চুক্তির একটা খসড়া কে বা কারা সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে এই মন্তব্য এসেছে। সম্ভাব্য সেই চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চীনা পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনী সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে আইন শৃংখলা রক্ষা, দুর্যোগের সময়ে ত্রাণসহায়তা দেয়া, এবং সেদেশে চীনা নাগরিক ও চীনা প্রকল্প রক্ষায় মোতায়েন করা যাবে। আর উভয় দেশ তাদের পার্লামেন্টের কাছে আরও বিস্তৃত আকারে নিরাপত্তা সহযোগিতার জন্যে প্রস্তাব পাঠাবে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, সেই প্রস্তাবে চীনা যুদ্ধজাহাজ সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের নৌঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে।

সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের পুলিশ ও জাতীয় নিরাপত্তা সচিব ক্যারেন গালোকালে ‘রয়টার্স’কে বলেন যে, চীনের সাথে তার দেশের আইন শৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে একটা চুক্তি হয়েছে। এবং আরও বিস্তৃত ক্ষেত্রে চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা চলছে। আর এধরণের চুক্তি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সাথে যেমন রয়েছে তেমনই হবে। পদ্ধতিগতভাবেই সেই চুক্তিকে মন্ত্রীসভার অনুমতি নিতে হবে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৮ সাল থেকে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে শান্তি শৃংখলা রক্ষার জন্যে অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনের অনুমতি দিয়ে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে এর আগে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে পুঁজি করে ২০০৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সেখানে অস্ট্রেলিয়ার সামরিক বাহিনী মোতায়েন ছিল। সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের পুলিশ মন্ত্রী এন্থনি ভেকে বলেন যে, ১৮ই মার্চ চীনের পাবলিক সিকিউরিটি মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ওয়াং শিয়াওহংএর সাথে তিনি এক ভার্চুয়াল বৈঠকের পর একটা সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই সমঝোতা বিশ্বকে দেখিয়ে দেয় যে, সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ তাদের নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের জন্যে যেকোন দেশের সাথেই সহযোগিতা করতে উচ্ছুক।

 
নভেম্বর ২০২১। সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে অস্ট্রেলিয়ার সেনা। ‘স্বাধীন দেশ’ হিসেবে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ যখন তাইওয়ানকে আলিঙ্গন করেছে, তখন অস্ট্রেলিয়া দ্বীপ দেশটাকে ‘স্বাধীন’ হিসেবেই আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু যখন তারা অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থের বাইরে গিয়ে চীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তখনই অস্ট্রেলিয়া দেশটার ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এবং দেশটার ‘সার্বভৌমত্ব’কে তুচ্ছজ্ঞান করছে।


সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ কি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ?

প্রধানমন্ত্রী সোগাভারে পার্লামেন্টে কথা বলার সময় চাপের মুখে তিনি বলেন যে, চীনের সাথে চুক্তি এখন স্বাক্ষর করার জন্যে প্রস্তুত। তিনি অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলি অস্বীকার করেন; যেখানে বলা হয় যে, সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ চাপের মুখে চীনের কাছে নতি স্বীকার করেছে। অস্ট্রেলিয়ার ‘নিউজ কর্পোরেশন’এর এক কলামে এও লেখা হয় যে, দরকার হলে এই চুক্তি থামাতে অস্ট্রেলিয়ার উচিৎ সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে সামরিক অগ্রাসন চালিয়ে সেখানকার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। সোগাভারে বলেন যে, অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াতে এহেন কথাগুলি অপমানজনক এবং তা অস্ট্রেলিয়ার সাথে সম্পর্ককে দুর্বল করে। সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্যে যেকোন দেশকেই আমন্ত্রণ জানাবে। আর নিজের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে তিনি বলেন যে, চীনকে সামরিক ঘাঁটি তৈরিতে আহ্বান করার কোন ঘটনাই ঘটেনি। আর এর আগে অস্ট্রেলিয়াও আহ্বান করার পর সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে নৌঘাঁটি তৈরি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। তবে তিনি সপ্তাখানেক আগে দেশের পূর্বাঞ্চলে তেমোতুতে একটা প্যাট্রোল বোটের জেটি বানাবার অস্ট্রেলিয়ান প্রস্তাবকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন। সোগাভারে বলছেন যে, নিরাপত্তা সহযোগী হিসেবে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড সর্বদাই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ থাকবে। তবে তিনি এও বলেন যে, সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের উচিৎ হবে দেশের নিরাপত্তার জন্যে সহযোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা। তিনি অভিযোগ করে বলেন যে, কিছু লোক রয়েছে যারা বিদেশী এজেন্ট; যারা গোপনীয়তাকে অস্বীকার করে এবং সরকারকে দুর্বল করতে চায়। তার দেশ জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন সহযোগী খুঁজবে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান সাংবাদিকদের বলেন যে, সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতার উদ্দেশ্য হলো জনগণের জানমাল রক্ষা করা। এর বাইরে মিডিয়াতে যা বলা হচ্ছে, সেগুলি মূলতঃ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

তবে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিবিদেরা এই চুক্তিকে মেনে নিতে পারছেন না। অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যারেন এন্ড্রুজ সাংবাদিকদের বলেন যে, প্রশান্ত মহাসাগর হলো অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব উঠান। এই অঞ্চলের যেকোন দ্বীপে যেকোন ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার জন্যে চিন্তার কারণ। অপরদিকে অস্ট্রেলিয়ার বিরোধী দলের উপনেতা রিচার্ড মার্লেস দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন যাতে তিনি নিশ্চিত করেন যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপ দেশগুলি যেন স্বাভাবিকভাবেই শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়াকেই একমাত্র নিরাপত্তা সহযোগী হিসেবে চিন্তা করে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ইতোমধ্যেই এব্যাপারে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নের সাথে ফোনালাপ করেছেন বলে অস্ট্রেলিয়ার সরকার বলে।

সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ তাইওয়ানের সাথে তাদের সম্পর্ক কর্তন করে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে মনোযোগী হলে এর প্রতিক্রিয়ায় গত নভেম্বরে সেদেশের রাজধানী হোনিয়ারাতে ব্যাপক সহিংসতা দেখা দেয় এবং সেই ছুতোয় অস্ট্রেলিয়া সেখানে ২’শ সেনা মোতায়েন করে। এই সেনা মোতায়েনের আইনী স্তম্ভ ছিল ২০১৮ সালের চুক্তি। তবে সেসময়েই চীন সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের পুলিশকে সরঞ্জাম এবং ট্রেনিং দেয়ার প্রস্তাব দেয়। চীনের সাথে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবেই অস্ট্রেলিয়া গত বছর ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘অকাস’ চুক্তি করে। যুক্তরাষ্ট্রও ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা দেয় যে, প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের সামরিক অবস্থানকে নিয়ন্ত্রণ করতে তারা সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে দূতাবাস খুলবে। 

নভেম্বর ২০২১। সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের প্রধানমন্ত্রী সোগাভারে অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে প্যাট্রোল বোটের ডেলিভারি নিচ্ছেন। কয়েক দশকের অস্ট্রেলিয় সহায়তা দেশটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। কাজেই এখন অস্ট্রেলিয়ার সহযোগিতার ব্যাপারে প্রশ্ন আসছে, এবং তারা অন্য অপশন খুঁজছে।


‘চেকবুক কূটনীতি’

‘আল জাজিরা’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, গত বছর অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে ৪৯ মিলিয়ন ডলার খরচে দ্বিতীয় একটা প্যাট্রোল বোট দিয়েছে এবং নতুন একটা জেটি তৈরি করছে। সরকারি কর্মচারিদের বেতন, পুলিশের কর্মকান্ড, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ মোকাবেলার জন্যে দেশজুড়ে রেডিও নেটওয়ার্ক তৈরিতে আরও সাড়ে ১৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে অস্ট্রেলিয়া। গত বছর চীনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর কিছু লোক হামলা করে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করলে পুলিশ রাবার বুলেট ছুঁড়ে জনগণকে ছত্রভঙ্গ করে। এই ঘটনার জেরে বিরোধী দল পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনে। সরকারের বিরোধীরা অভিযোগ করে যে, চীন সরকার পার্লামেন্ট সদস্যদের মাঝে অর্থ বিলি করে অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করার জন্যে, যদিও এর সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেনি। সরকার বলছে যে, যারা সহিংসতা উস্কে দিয়েছিল, তারাই এধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ দাঁড় করিয়েছে।

গত নভেম্বরে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের সহিংসতার পিছনে দেশটার মালাইতা প্রদেশের নেতৃত্বের ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। মালাইতার নেতৃত্ব খোলাখুলিভাবেই অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে এবং চীনের বিপক্ষে কথা বলে থাকে। মালাইতা প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ড্যানিয়েল সুইদানিএর উপদেষ্টা তালিফিলু বলছেন যে, সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের মানুষ অস্ট্রেলিয়দের ব্যাপারে খুব ভালো দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে। অপরদিকে চীনারা এখানে গাছ কাটছে, খনি উন্নয়ন করছে এবং মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে; যেগুলির কারণে দেশটার পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে এবং সেখানে চীন বিরোধী চিন্তা বাড়ছে। তবে চীনারা যেহেতু সরাসরি সরকারের লোকদের পকেটে অর্থ দিচ্ছে, সেহেতু অস্ট্রেলিয়া দ্রুত সেখানে প্রভাব হারাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘লোয়ি ইন্সটিটিউট’এর রিসার্চ ফেলো মিহাই সোরা বলছেন যে, উন্নয়ন সহায়তা দিয়েও অস্ট্রেলিয়া সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র নিরাপত্তা সহযোগী হতে পারেনি। এতে প্রমাণ হয় যে, সেখানকার নিরাপত্তার কিছু দিক রয়েছে যা অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়; এবং শুধুমাত্র অর্থ সহায়তা দিয়ে অস্ট্রেলিয়া সেই দ্বীপ দেশটার একমাত্র সহযোগী হতে পারবে না। সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের সরকার মনে করেছে যে, উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে চীন তাইওয়ানের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেকারণে তারা তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। আর প্রধানমন্ত্রী সোগাভারে জানেন যে, তার দেশে জনসমর্থন রয়েছে যে, নিরাপত্তার জন্যে তার দেশ শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ার উপরেই নির্ভরশীল না থাকুক। মেলবোর্নের ‘লা ট্রোব ইউনিভার্সিটি’র শিক্ষক মাইকেল ওকীফ বলছেন যে, সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের দিক থেকে দেখলে, কয়েক দশকের অস্ট্রেলিয় সহায়তা দেশটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। কাজেই এখন অস্ট্রেলিয়ার সহযোগিতার ব্যাপারে প্রশ্ন আসছে, এবং তারা অন্য অপশন খুঁজছে। আর চীন দেখতে পাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তাদের নাগরিকদেরকে রক্ষা করছে। একই আঙ্গিকে, সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে চীনারা যখন তাদের নাগরিক এবং বিনিয়োগের উপর হামলা হতে দেখছে, তখন তারাও সেই অনুযায়ী এগুচ্ছে।

সুইদানিএর উপদেষ্টা তালিফিলু অস্ট্রেলিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ অনুসরণ করতে বলছেন। যুক্তরাষ্ট্র মালাইতা প্রদেশে বিভিন্ন এনজিওকে ২৫ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে, যারা কৃষি, বনজ সম্পদ এবং মৎস্য সম্পদ ব্যবহারে জনগণকে অর্থায়ন করছে। এভাবে অস্ট্রেলিয়াও যদি জনগণকে সরাসরি অর্থ সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করে, তাহলে তারা বিরোধী দলের পক্ষে ভোট দেবে, যারা কিনা অস্ট্রেলিয়াকে ভালোবাসে এবং তাইওয়ানকেও পছন্দ করে। অপরদিকে মাইকেল ওকীফ বলছেন যে, অস্ট্রেলিয়ার উচিৎ হবে চীনের সকল কর্মকান্ডকে হুমকি হিসেবে না দেখে বরং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীনের সাথে সমান্তরালে কাজ করা।


তাইওয়ান প্রণালি থেকে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ…

অস্ট্রেলিয়ার ভূকৌশলগত অবস্থান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হবার কারণেই ‘অকাস’ চুক্তির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া একাধারে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অতি সংবেদনশীল প্রযুক্তি পেতে চলেছে, তেমনি তা ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তাটাকেও শক্তিশালী করেছে। তবে এহেন কৌশলগত চুক্তি চীনের জন্যে হুমকি হবার কারণেই চীনও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার সহযোগিতার মাঝে নিরাপত্তাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অস্ট্রেলিয়া যেমন দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেছে, তেমনি চীনও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ছোট দ্বীপ দেশগুলিকে জাতিসংঘে তাইওয়ানের পক্ষে ভোট দিতে দেখে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সেই অঞ্চলে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। অস্ট্রেলিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপ দেশগুলিকে তার ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে এতকাল। যার ফলাফল হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার নিজ উঠানে তাইওয়ান এবং চীনের মাঝে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আর একই সূত্রে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে থাকা জনগণের মাঝে চীন বিরোধী চিন্তার জেরে চীনা নাগরিক এবং বিনিয়োগের উপর হামলা শেষ পর্যন্ত চীনকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে নিরাপত্তা সহযোগী হিসেবে টেনে নিয়ে এসেছে। তাইওয়ান প্রণালিতে অস্ট্রেলিয়ার যুদ্ধজাহাজ চীনের জন্যে যেমন হুমকি তৈরি করেছে, ঠিক তেমনই হুমকি এখন অস্ট্রেলিয়া দেখতে পাচ্ছে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে; যার ভূকৌশলগত অবস্থান অস্ট্রেলিয়ার জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। ‘স্বাধীন দেশ’ হিসেবে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ যখন তাইওয়ানকে আলিঙ্গন করেছে, তখন অস্ট্রেলিয়া দ্বীপ দেশটাকে ‘স্বাধীন’ হিসেবেই আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু যখন তারা অস্ট্রেলিয়ার স্বার্থের বাইরে গিয়ে চীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তখনই অস্ট্রেলিয়া দেশটার ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এবং দেশটার ‘সার্বভৌমত্ব’কে তুচ্ছজ্ঞান করছে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপ দেশ সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের সাথে চীনের নিরাপত্তা চুক্তি বেইজিংএর নীতির ক্ষেত্রে একটা নতুন অধ্যায়; যা কিনা ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের সাথে পশ্চিমা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’এর স্বার্থের দ্বন্দ্বকে আরও ঘনীভূত করবে। এতে অত্র অঞ্চলে অস্থিরতা এবং সংঘাতের সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।

2 comments:

  1. সলোমোন দ্বীপপুঞ্জের সাথে চীনের নিরাপত্তা চুক্তি হচ্ছে কিন্তু সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ অস্ট্রেলিয়া থেকে ২০০০ কিমি দূরে। তাহলে সলোমোন দ্বীপপুঞ্জে চীনের সামরিক ও বেসামরিক উপস্থিতি অস্ট্রেলিয়ার জন্য কি কি কারণে NATIONAL THREAT হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে তা যদি বিস্তারিত বলতেন বা ব্যাখ্যা করতেন। অনেক ধন্যবাদ অনেক কিছুই জানতে পারলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. গত ডিসেম্বরের এই লেখাটা পড়ুন -
      https://koushol.blogspot.com/2021/12/why-australia-sent-troops-to-solomon-islands.html

      Delete