Saturday 23 April 2022

ব্রিটেন আবারও ভারতকে কাছে টেনে নিতে চাইছে কেন?

২৪শে এপ্রিল ২০২২

বরিস জনসন নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠকের সময় বলেন যে, তারা স্বাধীন, মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আইনের শাসন রয়েছে এমন ব্যবস্থা ইন্দোপ্যাসিফিকে দেখতে চান। জনসন নিঃসন্দেহে এর মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতের সহযোগিতাকেই বুঝিয়েছেন। তবে তার ভারত সফর যে অর্থনৈতিক কারণেই ছিল, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

২২শে এপ্রিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ভারত সফরে বলেন যে, তিনি এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উভয় দেশের আলোচনাকারীদেরকে বলেছেন যে, আগামী অক্টোবরে দিওয়ালি পূজার আগেই যেন দুই দেশের মাঝে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যায়। ভারতের সাথে ব্রিটেনের মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে গত জানুয়ারি মাস থেকে, যখন ব্রিটিশ বণিজ্যমন্ত্রী এন-ম্যারি ট্রেভেলায়ান নতুন দিল্লীতে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পিযুশ গয়ালের সাথে প্রথম দফা আলোচনা শেষ করেন। ভারতের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর অত্যন্ত কঠিন কাজ হলেও বরিস জনসনের সরকার সেদিকেই পুরো শক্তি নিয়োগ করেছে। এবং এই লক্ষ্য জনসনের জন্যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা ভারতের সাথে ইউক্রেন ও রাশিয়া ছাড়াও অন্যান্য সাংঘর্ষিক ইস্যুতে ব্যাপক ছাড় দেয়ার মানসিকতার মাঝেই পরিষ্কার হয়ে যায়।

‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির কোন অগ্রগতি না হওয়ায় ২০২২ সালে ভারতের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিই হবে ব্রিটিশ সরকারের জন্যে সবচাইতে বড় আলোচনা। কিন্তু সমস্যা হলো, ভারতে বহু স্বার্থের গ্রুপ রয়েছে, যারা বিভিন্ন দিক থেকে হুমকির মাঝে থাকে। ইইউ বহুকাল যাবত ভারতের সাথে কোন একটা সমঝোতায় পৌঁছাবার চেষ্টা করছে। অস্ট্রেলিয়াও এক দশক ধরে ভারতের সাথে চুক্তির চেষ্টা করে সফল হয়নি। দিল্লী সরকারের ক্রয়নীতি এবং সেবার বাণিজ্য সর্বদাই ছিল আলোচনার মাঝে কঠিনতম বাধা। তথাপি ২০৫০ সালের মাঝে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবার সম্ভাবনা থাকায় ভারত ব্রিটেনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৯ সালে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ছিল প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। ব্রিটেন মনে করছে যে, ভারতে ব্রিটেনের রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ করা ছাড়াও মুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে দুই দেশের মাঝে বাণিজ্য ২০৩৫ সাল নাগাদ প্রতি বছরেই ৩৬ বিলিয়ন ডলার করে বাড়ানো সম্ভব। ব্রিটেন চাইছে ভারত ব্রিটেনের কাছ থেকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং সেবা আমদানি করুক।

ইউক্রেন ইস্যুতে বরিস জনসন নরেন্দ্র মোদির সাথে আলোচনা করেছেন। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা ‘এএনআই’ জানাচ্ছে যে, জনসন বলেন যে, রাশিয়ার ব্যাপারে ভারতের অবস্থান ভালোভাবে জানা রয়েছে এবং এটাও নিশ্চিত যে, সেটার পরিবর্তন হবে না। রাশিয়ার সাথে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে, এবং সেটা সকলেই শ্রদ্ধা করে। তিনি বলেন যে, ইউক্রেনের ব্যাপারে সারা দুনিয়ারই অনেক কিছু করার রয়েছে। ভারত ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের বুচা শহরের গণহত্যার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ভারত রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কর্মকান্ডে বেশ ক’বার হস্তক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করেছে যে, রাশিয়া কি করছে এবং তার উদ্দেশ্যই বা কি। উভয় নেতাই যৌথভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধ দ্রুত বন্ধের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। ‘ব্লুমবার্গ’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ভারত সফরে গুজরাটে ব্রিটিশ কোম্পানি ‘জেসিবি’র কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে জনসন বুলডোজারের সাথে ছবি তুলে ভারতজুড়ে বিতর্ক তৈরি করেছেন। কারণ মাত্র কিছুদিন আগেই ‘জেসিবি’র বুলডোজার ব্যবহার করেই মুসলিমদের বাড়িঘর ভাঙ্গা হয়েছে। অনেকেই ‘জেসিবি’র কারখানা পরিদর্শনের দিনক্ষণ নির্ধারণের সমালোচনা করেছেন। ‘ইন্ডিয়া টুডে’ জনসনের এই ছবি তোলা নিয়ে বলে যে, ভারতে এই মুহুর্তে কি বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে, সেব্যাপারে তিনি একেবারেই ‘বধির’এর মতো আচরণ করেছেন! মানবাধিকার সংস্থা ‘এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ এই ইস্যুতে জনসনের চুপ থাকার ব্যাপক সমালোচনা করে।

বরিস জনসনের কথা এবং কাজে এটা পরিষ্কার যে, তিনি ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্দেশ্যে এমন কোন ইস্যুকে প্রাধান্য দিতে ইচ্ছুক নন, যা বিজেপি সরকার পছন্দ করবে না। পলাতক ভারতীয় ব্যবসায়ী বিজয় মালিয়া এবং নীরব মোদিকে ভারতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আস্বস্ত করা ছাড়াও শিখদের স্বাধীন খালিস্তান আন্দোলন যেন ব্রিটেনকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে যেতে না পারে, সেব্যাপারেও তিনি ভারতকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’ বলছে যে, গান্ধীনগরে জনসন স্বামীনারায়ন অক্ষরধাম মন্দিরে গিয়ে গোলাপের পাপড়িও ছিটিয়ে এবং মন্দিরে শ্রী নীলকান্ত ভার্নির মূর্তিতে পূজাও দিয়ে এসেছেন!

ব্রেক্সিট, করোনা মহামারি, লকডাউন, জ্বালানি সমস্যা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পর ব্রিটিশ অর্থনীতিকে পুনরায় দাঁড় করানো যে এখন লন্ডনের প্রধান লক্ষ্যগুলির একটা, তা এখন পরিষ্কার। একারণেই তিনি রাশিয়ার সাথে ভারতের দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে ‘বৈধতা’ দেয়া ছাড়াও ‘জেসিবি’ কারখানা পরিদর্শন করে এবং মন্দিরে পূজা দিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদীদেরকেই খুশি করতে চেয়েছেন। বৈশ্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তা বাস্তবায়নে ব্রিটেনের লিবারাল আদর্শ আপাতত খাঁচার ভেতরেই থাকছে।


সফরকালে দুই দেশের মাঝে ৬টা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বার্তায় এই সমঝোতাগুলির ব্যাপারে বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে। এগুলির মাঝে পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে দুই দেশের একত্রে কাজ করার ইচ্ছা ছাড়াও বায়ুশক্তির ব্যাপারে ব্রিটিশ কোম্পানি ‘অফশোর রিনিউয়েবল এনার্জি ক্যাটাপাল্ট’এর সাথে ভারতীয় সরকারি কোম্পানির সমঝোতা, শেভেনিং স্কলারশিপ প্রকল্পের অধীনে ভারতীয় ছাত্রদেরকে বিনা খরচে ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিষয়ে এক বছরের মাস্টার্স ডিগ্রিতে পড়াশোনা, এবং ব্রিটিশ কোম্পানি ‘ওয়ান ওয়েব’এর সাথে ‘নিউ স্পেস ইন্ডিয়া লিমিটেড’এর কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রেরণের প্রকল্পের ব্যাপারে সমঝোতা হয়।

এছাড়াও দুই দেশ প্রতিরক্ষার ব্যাপারে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে; যার মাধ্যমে ব্রিটেন আশা করছে যে, ভারতের নিজস্ব সামরিক শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে রাশিয়ার অস্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা কমানো। সেই লক্ষ্যে বরিস জনসন বলেন যে, ব্রিটেন শুধুমাত্র ভারতে রপ্তানির জন্যে উন্মুক্ত সাধারণ রপ্তানি লাইসেন্সের ব্যবস্থা করছে; যাতে করে ভারতে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানিতে সময় ক্ষেপণ না হয়। জনসন বলেন যে, নতুন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কয়েক দশকের নিরাপত্তা সহযোগিতাকেই শুধু এগিয়ে নেবে না, মোদির ‘মেইক ইন ইন্ডিয়া’ চিন্তাটাকেও এগিয়ে নেবে। অস্ট্রেলিয়ার ‘এবিসি নিউজ’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, শুধুমাত্র ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের সাথে এই লাইসেন্স সুবিধা ভোগ করছে।

বরিস জনসন নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠকের সময় বলেন যে, তারা স্বাধীন, মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আইনের শাসন রয়েছে এমন ব্যবস্থা ইন্দোপ্যাসিফিকে দেখতে চান। জনসন নিঃসন্দেহে এর মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতের সহযোগিতাকেই বুঝিয়েছেন। তবে তার ভারত সফর যে অর্থনৈতিক কারণেই ছিল, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ব্রেক্সিট, করোনা মহামারি, লকডাউন, জ্বালানি সমস্যা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পর ব্রিটিশ অর্থনীতিকে পুনরায় দাঁড় করানো যে এখন লন্ডনের প্রধান লক্ষ্যগুলির একটা, তা এখন পরিষ্কার। একারণেই তিনি রাশিয়ার সাথে ভারতের দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে ‘বৈধতা’ দেয়া ছাড়াও ‘জেসিবি’ কারখানা পরিদর্শন করে এবং মন্দিরে পূজা দিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদীদেরকেই খুশি করতে চেয়েছেন। বৈশ্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় ‘গ্লোবাল ব্রিটেন’ চিন্তা বাস্তবায়নে ব্রিটেনের লিবারাল আদর্শ আপাতত খাঁচার ভেতরেই থাকছে।

1 comment:

  1. ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে হয়েছে৷ এতে ডেমোক্রেসি, সংখ্যালঘুর অধিকার, মানবাধিকার লঙ্ঘন এই সব বিষয় যে ভূমিকা রাখে না এটা স্পষ্ট।
    এতে করে স্পষ্ট ক্যাপিটালিস্টিক দেশগুলো শুধু মাত্র টাকা নিয়ে ভাবিত, একমাত্র এটাই ম্যাটার করে। অন্যকিছু শুধু বুলি আওড়ানো ছাড়া কিছুই নয়৷
    সত্যি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অনেক কিছুই পরিষ্কার করে দিল।

    ReplyDelete