Friday 1 April 2022

যুক্তরাষ্ট্র কি আসলেই চাইছে যে ইউক্রেন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জয়ী হোক?

০২রা এপ্রিল ২০২২

লুহানস্ক, পূর্ব ইউক্রেন, ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০২২। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই জানে যে, ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে রুশ বাহিনীকে ইউক্রেন থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব নয়; তবে দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়াকে ইউক্রেনে আটকে রাখা সম্ভব। ট্যাংক, আর্টিলারি এবং যুদ্ধবিমান সরবরাহ করে হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের কোন আশা ইউক্রেনকে দেখাতে ইচ্ছুক নয় যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ রুশ বাহিনীর ইউক্রেন ত্যাগই চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র!

 
মার্কিন মিডিয়া ‘এনবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ইউক্রেনকে যথেষ্ট যুদ্ধ সহায়তা না দেয়ার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন কূটনীতিবিদ এবং সামরিক কর্মকর্তারা। অনেকেই বলছেন যে, বাইডেন প্রশাসন রাশিয়াকে উস্কে দেয়ার ভয়ে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করা থেকে বিরত থেকেছে। অনেক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটন গত জানুয়ারি মাসে ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ফেব্রুয়ারি মাসে রুশ হামলা শুরু হবার পর ‘স্টিঙ্গার’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান জেনারেল জ্যাক কীন রিপাবলিকান ঘরানার টিভি চ্যানেল ‘ফক্স নিউজ’কে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল মিশন হওয়া উচিৎ ছিল ইউক্রেনিয়ানদের সহায়তা দিয়ে রুশ বাহিনীকে হারিয়ে তাদেরকে ইউক্রেন থেকে বিতাড়িত করা। কিন্তু আপাতঃদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে, পুতিন যুদ্ধে হেরে যাক! কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে যে, পুতিন হেরে গেলে এমন কিছু করবেন, যা যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। জেনারেল কীন বলছেন যে, তিনি তার সূত্রে জেনেছেন যে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকিকে যুক্তরাষ্ট্র উপদেশ দিয়েছে যাতে ইউক্রেন রাশিয়াকে কিছু ছাড় দিয়ে একটা যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে ফেলে। জেলেন্সকি ট্যাংক চাইছেন রুশ হামলা আটকাতে নয়; বরং প্রতিআক্রমণ করে হারানো ভূমি ফিরে পেতে। তিনি ‘মিগ’ ফাইটার বিমান চাইছেন ট্যাঙ্কগুলিকে রক্ষা করতে; আর বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চাইছেন ‘মিগ’গুলিকে রক্ষা করতে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে এগুলির কোনটাই দিতে চাইছে না।

‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’এর এক লেখায় মারগারিতা খিওসতোভা, ওলগা লাইমার এবং দেনিস দাভিদেঙ্কোসহ ইউক্রেনের চারজন কর্মকর্তা ইউক্রেনের জন্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিততে কি কি দরকার এবং সেগুলি কোথা থেকে পাওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা বলছেন যে, পশ্চিমারা ইউক্রেনকে এতদিন পর্যন্ত যেসব অস্ত্র দিয়েছে, সেগুলি রুশ বাহিনীকে আটকে দিয়েছে। কিন্তু এখন রুশ বাহিনীকে ইউক্রেনের মাটি থেকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে ইউক্রেনের দরকার আক্রমণাত্মক অস্ত্র। কারণ শুধুমাত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়। আর যুদ্ধ যদি লম্বা হয়, তাহলে রুশরা নিজেদেরকে পুনর্বিন্যাস করতে পারবে; সামরিক শক্তিকে বৃদ্ধি করতে পারবে; এবং অর্থনৈতিক অবরোধের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। কাজেই ইউক্রেনের জন্যে খুব দ্রুত অস্ত্রের প্রয়োজন। ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষের ট্যাংক ধ্বংস করা গেলেও প্রতিআক্রমণ করা সম্ভব নয়। এজন্যে দরকার ট্যাংক এবং অন্যান্য সাঁজোয়া যান। পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া এবং চেক রিপাবলিকের কাছে এই মুহুর্তে সোভিয়েত ডিজাইনের কয়েক’শ ‘টি-৭২’ ট্যাংক রয়েছে। এছাড়াও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির কাছে শত শত সোভিয়েত আমলের সাঁজোয়া যান রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রও তাদের নিজেদের ‘এম-২ ব্র্যাডলি’ ফাইটিং ভেহিকল এবং ‘হামভি’ আর্মার্ড ভেহিকল দিতে পারে; যাদের সাথে তারা ‘জ্যাভেলিন’ ক্ষেপণাস্ত্রও সরবরাহ করতে পারে। আর যেহেতু রুশ সেনারা এখন বিভিন্ন শহরের চারিপাশে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে, সেক্ষেত্রে তাদেরকে উৎখাত করতে প্রয়োজন আর্টিলারি। ন্যাটো দেশগুলি ইউক্রেনকে সোভিয়েত ডিজাইনের ‘ডি-২০’ ১৫২ মিঃমিঃ কামান, ‘২এস১’ ১২২ মিঃমিঃ সেলফপ্রপেল্ড আর্টিলারি এবং বিভিন্ন ক্যালিবারের আর্টিলারি রকেট দিতে পারে। এছাড়াও বুলগেরিয়ার কাছে রয়েছে গোটা ২০এর মতো ‘টচকা-ইউ’ স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র; যেগুলি ইউক্রেন বেশ সফলতার সাথে যুদ্ধে ব্যবহার করেছে। তবে লেখকদের সবচাইতে বড় দাবি ছিল যুদ্ধবিমানের। তারা বলছেন যে, পোল্যান্ড এবং বুলগেরিয়ার কাছে যে ‘মিগ-২৯’ ফাইটার বিমানগুলি রয়েছে, সেগুলি ইউক্রেন পাবার জন্যে জোর দাবি জানিয়ে আসছে। এই বিমানগুলি রুশ বোমারু বিমানকে প্রতিহত করতে পারবে। এছাড়াও তারা বলছেন যে, মার্কিন বিমান বাহিনী বর্তমানে তাদের ‘এ-১০ ওয়ার্থগ’ গ্রাউন্ড এটাক বিমানগুলিকে রিটায়ার করিয়ে দিচ্ছে। এগুলি যখন মার্কিনীদের কোন কাজেই আসবে না, তাহলে তারা কেন ইউক্রেনকে এগুলি দিচ্ছে না? ইউক্রেনের পাইলটরা খুব স্বল্প সময়ের মাঝেই এগুলি কিভাবে চালাতে হয়, তা শিখে নেবে। এছাড়াও তারা গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ যন্ত্রপাতি এবং রাতে যুদ্ধ করার জন্যে নাইট ভিশন যন্ত্রপাতি চেয়েছেন।

ইউক্রেনের থিংকট্যাঙ্ক ‘নিউ ইউরোপ সেন্টার’এর প্রতিষ্ঠাতা আলিওনা গেটমানচুক ‘দ্যা আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় প্রায় একই ধরনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলছেন যে, কয়েক বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে উস্কে দেয়া হবে মনে করে ইউক্রেনকে ‘জ্যাভেলিন’ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করতে চায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে যে, দুর্বল ইউক্রেনই পুতিনকে উস্কে দিয়েছে। পশ্চিমারা এখনও ইউক্রেনকে দরকারমতো অস্ত্র সরবরাহ করতে চাইছে না। কেউ কেউ হাসিতামাশার মাঝে বলছেন যে, ইউক্রেনকে সবচাইতে বেশি অস্ত্র দিচ্ছে রাশিয়া! কারণ দখল করার মাধ্যমে ইউক্রেনিয়ানরা বহু রুশ অস্ত্র পাচ্ছে; যা পশ্চিমা অস্ত্রের সরবরাহের তুলনায় অনেক বেশি।

মার্কিন ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস মারফি বাইডেন প্রশাসনকে সমর্থন দিয়ে বলছেন যে, ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর যেকোন দেশের চাইতে বেশি সহয়তা দিয়েছে; এবং অত্যন্ত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র মস্কোর বিরুদ্ধে কাউকে সরাসরি অস্ত্র দেয়নি। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিআইএ’র প্রাক্তন কর্মকর্তা মার্ক পলিমেরোপলোস ‘এনবিসি’কে বলছেন যে, এটা ঠিক যে বাইডেন প্রশাসন ধীরে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, ইউক্রেন যা চাইবে সেটাই দেয়া উচিৎ হবে না। বরং ‘সিআইএ’ এবং মার্কিন স্পেশাল অপারেশন্সএর কর্মকর্তারা যেটা ভালো মনে করছেন, সেগুলিই ইউক্রেনকে দেয়া উচিৎ; কারণ তারাই বুঝবেন যে, ইউক্রেনের কি প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই জানে যে, ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে রুশ বাহিনীকে ইউক্রেন থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব নয়; তবে দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়াকে ইউক্রেনে আটকে রাখা সম্ভব। ট্যাংক, আর্টিলারি এবং যুদ্ধবিমান সরবরাহ করে হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের কোন আশা ইউক্রেনকে দেখাতে ইচ্ছুক নয় যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ রুশ বাহিনীর ইউক্রেন ত্যাগই চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র! বিশ্বব্যবস্থা ধরে রাখতে হিমসিম খাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানে মূল লক্ষ্য হলো চীনকে নিয়ন্ত্রণ। এমতাবস্থায় চীনের সমর্থনে ইউক্রেনে হেরে যাওয়া বা জিতে যাওয়া রাশিয়া নয়; অথবা ন্যাটো সীমানায় যুদ্ধংদেহী রাশিয়াও নয়; বরং ইউক্রেনের কাদায় লম্বা সময়ের জন্যে আটকে যাওয়া রাশিয়াই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অধিক শ্রেয়।

No comments:

Post a Comment