Sunday 3 April 2022

ভারত কি যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু, নাকি রাশিয়ার বন্ধু?

০৩রা এপ্রিল ২০২২

০১লা এপ্রিল ২০২২। দিল্লীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ।  ভারত চীনকে পছন্দ না করলেও চীনের বন্ধু দেশ রাশিয়াকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছে না। এতে পরিষ্কার যে, নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী সরকার যুক্তরাষ্ট্রের যত কাছের বন্ধুই হোক না কেন, ভারতের সেকুলার বাস্তবতাগুলি থেকে দিল্লীর নেতৃত্বের বের হয়ে আসাটা কঠিন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েই মোদির উগ্রবাদী সরকার যখন গণতান্ত্রিক আদর্শগুলিকে পদদলিত করেছে, তখন ইউক্রেনে গণতন্ত্র রক্ষায় ভারতের অংশ নেয়ার আশা করাটা অর্থহীন।

 
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এখন পৃথিবীর অনেক দেশই তাদের শীর্ষ কূটনীতিকদেরকে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে পাঠাচ্ছে। ৩১শে মার্চ রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ভারত সফরে এসে যথেষ্ট সন্মানই পেয়েছেন। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, ল্যাভরভ দিল্লী সফরে শুধু ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরএর সাথেই দেখা করেননি, তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথেও সাক্ষাৎ করতে পেরেছেন। ল্যাভরভকে এই সন্মান দেয়া হয়েছে যখন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব লিজ স্ট্রস এবং চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ি সেটা পাননি। ল্যাভরভ জয়শংকরের সাথে সাক্ষাতে বলেছেন যে, ইউক্রেনের ব্যাপারটা শুধু ইউক্রেন নিয়ে নয়, বরং বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে। তিনি বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের সকল স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতি অনুসরণ করতে বাধ্য করেছে। আর পশ্চিমারা এখন সকল ইস্যুকে ইউক্রেন সমস্যার সাথে যুক্ত করে কথা বলতে চাইছে। তার কথায়, পশ্চিমারা যখন রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধকে গণতন্ত্র আর একনায়কতন্ত্রের মাঝে লড়াই বলে আখ্যা দিচ্ছে, তখন তারা গোপন করে যাচ্ছে যে, পশ্চিমারাই যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্রে রেখে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি এও বলেন যে, ইউক্রেন এখন বুঝতে পারছে যে, ন্যাটোতে যোগদান করাটা কোন অপশন নয়। ল্যাভরভ তার কথাগুলিকে শক্ত ভিত দিতে সাংবাদিকদেরকে বলেন যে, অনেক বছর আগে রাশিয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্যে ভারত, চীন এবং অন্যান্য দেশের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার এবং ইউরোর বদলে নিজস্ব জাতীয় মুদ্রা ব্যবহার করার কথা বলা শুরু করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা আরও গুরুত্ব পাবে বলে বলেন তিনি। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ল্যাভরভ দিল্লী সফর করার আগেই বেইজিং ঘুরে এসেছেন; যেখানে তিনি ‘বহু মেরুর গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা’র কথা বলেন, যেখানে সুবিচার নিশ্চিত হবে।

‘রয়টার্স’ বলছে যে, ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার পর থেকে ভারত রাশিয়া থেকে কমপক্ষে ১ কোটি ৩০ লক্ষ ব্যারেল তেল কিনেছে; যেখানে পুরো ২০২১ সালে ভারত রাশিয়া থেকে কিনেছিল ১ কোটি ৬০ লক্ষ ব্যারেল তেল। আন্তর্জাতিক বাজারে পশ্চিমা দেশগুলি যখন রুশ তেল কেনা থেকে বিরত থাকছে, তখন ভারত মূল্যছাড়ের সুযোগ নিয়ে বিপুল পরিমাণ তেল কিনছে। ‘ব্লুমবার্গ’ বলছে যে, রাশিয়া ভারতকে যুদ্ধের আগের মূল্যে তেল সরবরাহ করছে। বিভিন্ন খবরে বলা হচ্ছে যে, ভারত এবং রাশিয়া পশ্চিমা অবরোধ এড়িয়ে নিজেদের মাঝে বাণিজ্য চালিয়ে নিতে ভারতীয় রূপির উপর ভিত্তি করে একটা ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘দ্যা হিন্দু’ পত্রিকা বলছে যে, রাশিয়া এবং ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা দুই দেশের মাঝে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে লেনদেনের সমস্যা দূরীকরণের জন্যে বৈঠক করেছে। তারা এমন কিছু ব্যাংকের কথা বলছেন, যেগুলি পশ্চিমা অবরোধে কোন সমস্যায় পতিত হবে না।

ল্যাভরভের দিল্লী সফরের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে দিল্লী সফরের সময় মার্কিন উপ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা দালীপ সিং ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার উপর দেয়া অর্থনৈতিক অবরোধকে কোন দেশ যদি এড়াতে চায়, তাহলে সেই দেশকে এর ফলাফল বহণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না যে কোন দেশ ডলার ভিত্তিক ব্যবস্থাকে বাইপাস করে রুবলকে শক্তিশালী করুক; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু এবং সহযোগী দেশগুলির কাছ থেকে ওয়াশিংটন এটা আশা করে না। দালীপ সিং বলেন যে, চীনের সাথে জোটে রাশিয়া সর্বদাই দুর্বল সদস্য হিসেবে থাকবে। রাশিয়ার সাথে পার্টনারশিপে চীন যতটা এগিয়ে থাকবে, সেটা ভারতের জন্যে ততটাই সমস্যার কারণ হবে। চীনের সাথে ভারতের যদি কোন দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে কেউই এটা আশা করতে পারে না যে রাশিয়া ভারতকে রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে আসবে। তবে সিং কিছুদিন আগেই রাশিয়া থেকে ভারতের ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার সময় রুপি এবং রুবলের আদানপ্রদানের ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি। মার্কিন আইন অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু দেশের কাছ থেকে কেউ কিছু কিনলে যুক্তরাষ্ট্র সেই দেশের উপর অবরোধ আরোপ করতে পারে। সেই হিসেবে ‘এস-৪০০’ কেনার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর অবরোধ দিলেও ভারতের উপর অবরোধ দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। কারণ চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সহযোগী। ‘নিউজউইক’এর এক প্রতিবেদনে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, গত ২২শে মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন যে, ইউক্রেন ইস্যুর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কোয়াড’ জোটে সহযোগী দেশ ভারতের অবস্থান দোদুল্যমান হয়ে গিয়েছে।

 
৩১শে মার্চ ২০২২। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরের সাথে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রাস। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ইউরোপের সিদ্ধান্তহীনতাকে তুলে ধরে ভারতের সিদ্ধান্তকেই ন্যায্যতা দিয়ে এসেছেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন যে, আগের মতোই ভারতের সেই ‘তৃতীয় ব্লক’এ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুরো পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাই যখন ধ্বসে পড়ছে, তখন ব্রিটেনের এই প্রচেষ্টা কতটুকু শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত, তা প্রশ্ন করা যেতেই পারে।

প্রায় একই সময়ে দিল্লী সফর করা ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রাস ইউক্রেনের ব্যাপারটাকে গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই বললেও তিনি ভারতের সাথে সুর মিলিয়েই কথা বলেছেন। দালীপ সিংএর কথার পুরো উল্টো ভাষায় তিনি সাংবাবিকদের বলেন যে, তিনি বলে দেবেন না যে ভারতের কি করতে হবে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া সমস্যার পর ইউরোপ রাশিয়ার উপর অবরোধ দেয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি; এখন সকলে এর ফলাফল দেখতে পাচ্ছে। অপরদিকে জয়শংকর বলেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল এখনও অনেকটাই দেখতে বাকি রয়েছে। এখন পর্যন্ত জ্বালানি এবং খাদ্যশস্যের মূল্যের উপর এর প্রভাব পড়েছে। সামনের দিনগুলিতে আর্থিক লেনদেন এবং লজিস্টিকস যদি সমস্যায় পতিত হয়, তাহলে তা বাকি বিশ্বের জন্যে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে।

‘বিবিসি’র এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে, বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা ভারত সফরে এসে ভারতকে তাদের পক্ষে নেবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভারত এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকতে চাইছে। ভারতের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক বেশ গভীর এবং ভারতের বেশিরভাগ অস্ত্র রাশিয়া থেকে কেনা। ভারতের এই অবস্থান দেশটাকে সমস্যা নিরসনে অপ্রত্যাশিতভাবে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে সামনে নিয়ে আসতে পারে। ল্যাভরভ ইতোমধ্যেই বলেছেন যে, দিল্লীর মধ্যস্ততার ব্যাপারে মস্কোর কোন আপত্তি নেই। অপরদিকে দিল্লী থেকে বলা হয়েছে যে, ভারতও শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে প্রস্তুত।

ঠান্ডা যুদ্ধের সময় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য হিসেবে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছিল; যদিও ভারতের সেকুলার কংগ্রেস সরকারের সাথে পশ্চিমের, বিশেষ করে ব্রিটেনের সম্পর্ক ছিল গভীর। ভারতের বিমান এবং নৌবাহিনীর বহু যুদ্ধসরঞ্জামই ছিল ব্রিটেনে তৈরি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ব্লকের বাইরে তৃতীয় একটা ব্লকে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছিল ভারত, যার উপর ব্রিটেনের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল যথেষ্ট। সেসময়েই ভারতে রুশ নির্মিত অস্ত্রের ভিত্তি তৈরি হয়েছে, যে বাস্তবতা থেকে ভারত আজ অবধি বের হতে পারছে না। তবে ঠান্ডা যুদ্ধের পর, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উগ্র ডানপন্থী বিজেপি সরকার ক্ষমতা নেবার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সখ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ‘এপাচি’ এবং ‘শিনুক’ হেলিকপ্টার, ‘সি-১৭’ এবং ‘সি-১৩০জে’ পরিবহণ বিমান, ‘পি-৮আই’ ম্যারিটাইম প্যাট্রোল বিমান, ‘এমএইচ-৬০আর’ সাবমেরিন ধ্বংসী হেলিকপ্টার, ‘এম-৭৭৭’ আর্টিলারি হাউইটজারসহ আরও অনেক অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে; যেগুলি মূলতঃ হিমালয়ের পাদদেশে এবং ভারত মহাসাগরে চীনা প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘কোয়াড’ সামরিক জোটের সদস্য হিসেবে ভারত আঞ্চলিকভাবে চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিচ্ছে, তথাপি ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার ‘তৃতীয় ব্লক’এর সদস্য হিসেবে চিন্তা করা থেকে ভারত সরে আসছে না। ভারত চীনকে পছন্দ না করলেও চীনের বন্ধু দেশ রাশিয়াকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছে না। এতে পরিষ্কার যে, নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী সরকার যুক্তরাষ্ট্রের যত কাছের বন্ধুই হোক না কেন, ভারতের সেকুলার বাস্তবতাগুলি থেকে দিল্লীর নেতৃত্বের বের হয়ে আসাটা কঠিন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েই মোদির উগ্রবাদী সরকার যখন গণতান্ত্রিক আদর্শগুলিকে পদদলিত করেছে, তখন ইউক্রেনে গণতন্ত্র রক্ষায় ভারতের অংশ নেয়ার আশা করাটা অর্থহীন। অপরদিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রাস ইউরোপের সিদ্ধান্তহীনতাকে তুলে ধরে ভারতের সিদ্ধান্তকেই ন্যায্যতা দিয়ে এসেছেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন যে, আগের মতোই ভারতের সেই ‘তৃতীয় ব্লক’এ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুরো পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাই যখন ধ্বসে পড়ছে, তখন 'গ্লোবাল ব্রিটেন'এর এই প্রচেষ্টা কতটুকু শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত, তা প্রশ্ন করা যেতেই পারে।

1 comment:

  1. জাতিরাষ্ট্রগুলি নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
    বোঝাই যাচ্ছে ইউ এস ক্ষমতার আধিপত্য এ কতটা মরিচা ধরেছে।
    এদিকে ইউকে ঘোলা জলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

    ReplyDelete