Tuesday 19 April 2022

ইউক্রেনের রণক্ষেত্র কি যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের বিদায় ঘন্টা বাজাচ্ছে?

১৯শে এপ্রিল ২০২২

রুশরা ‘কম্বাইন্ড আর্মস’ অপারেশনে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু রুশরা ‘কম্বাইন্ড আর্মস’ বুঝতে পারার জন্যে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা রাখে। রুশ বাহিনী হয়তো ভেবেছিল যে, ইউক্রেনিয়ানরা যুদ্ধ করবে না; আর ইউক্রেনের যথেষ্ট সংখ্যক কর্মকর্তা হয়তো রাশিয়ার পক্ষে চলে যাবে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ট্যাংকের বিদায় এখনই হচ্ছে না। হয়তো কিছু সময়ের জন্যে ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রগুলি এগিয়ে আছে।

 
ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ সেনাবাহিনীর বড় সংখ্যক ট্যাংক ধ্বংস হবার খবরে অনেকেই চিন্তা করতে শুরু করেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ট্যাংকের বিদায় কি খুবই সন্নিকটে কিনা। বিশেষ করে পশ্চিমাদের সরবরাহকৃত ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সাফল্যের খবরে কেউ কেউ টাংকের দরকার নিয়েই প্রশ্ন করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ম্যারিন কোর ট্যাংক ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীও তাদের ট্যাংকের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমিয়ে ফেলেছে। ডাচ সেনাবাহিনী তাদের সবগুলি ট্যাংক বিক্রি করে দিয়েছে। ডাচ প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইট ‘ওরিক্স’এর স্টাইন মিতজার এবং তার দল ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে হিসেব করেছে যে, রুশরা ইউক্রেনে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২ হাজার ৯’শ ৯২টা সামরিক গাড়ি হারিয়েছে; যার মাঝে ১৫’শ ৮১টা ধ্বংস হয়েছে। অক্ষত অবস্থায় ইউক্রেনিয়ানদের হাতে পড়েছে ১১’শ ২১টা। এই সংখ্যার মাঝে ট্যাংক রয়েছে ৫’শ ১৯টা; যার মাঝে ২’শ ৬৩টা ধ্বংস হয়েছে; ২’শ ৭টা অক্ষত অবস্থায় ধরা পড়েছে। এছাড়াও ৯’শ ৬২টা অন্যান্য সাঁজোয়া যান এর মাঝে রয়েছে। এই বিরাট সংখ্যক সাঁজোয়া যানের ক্ষয়ক্ষতি কি ট্যাংকের কনসেপ্ট বাতিল হয়ে যাবার কারণে, নাকি রুশদের অক্ষমতার কারণে?

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’র ডিরেক্টর পল সার ‘বিজনেস ইনসাইডার’কে বলছেন যে, তার ধারণা, ট্যাংক ভবিষ্যৎ যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের ভূমিকা থেকে পিছনের ভূমিকায় চলে যাবে। রাশিয়ার সাথে কোন সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ যুদ্ধে ন্যাটোর উচিৎ হবে দূরপাল্লার আর্টিলারি এবং ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ট্যাংকগুলিকে ঘায়েল করে এরপর নিজেদের ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হওয়া। ইতিহাসবিদ জেরেমি ব্ল্যাক তো মনে করছেন যে, ভবিষ্যতে ট্যাংক আকাশে এবং ভূমিতে মনুষ্যবিহীন ড্রোনের জন্যে মাদারশিপ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। ট্যাংককে ঘায়েল করার অস্ত্রগুলি যত শক্তিশালী হচ্ছে, ট্যাংক ততই ছোট ভূমিকায় চলে যাচ্ছে।

তবে অনেকেই এই যুক্তির সাথে একমত নন। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’এর জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক স্কট বস্টন ‘ইয়াহু নিউজ’কে বলছেন যে, ট্যাংকের দিন যে শেষ হয়ে যায়নি, তা সবচাইতে বড় প্রমাণ হলো, ইউক্রেনিয়ানরা এখন পশ্চিমাদের কাছ থেকে ট্যাংক চাইছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকি আবেদন করেছেন যাতে পশ্চিমারা তাদের ২০ হাজার ট্যাংকের মাঝ থেকে ১ শতাংশ ইউক্রেনকে দিয়ে দেয় বা ইউক্রেনের কাছে বিক্রি করে। তবে ইউক্রেনে রুশ ট্যাংক ধ্বংস হয়েছে বেশি কারণ রাশিয়া আক্রমণে রয়েছে। ইউক্রেন যখন আক্রমণে যাবে, তখন ইউক্রেনেরও অনেক ট্যাংক ধ্বংস হবার খবর আসবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ইউক্রেনের সেনারা রুশদের সাপ্লাই লাইনে হামলা করছে। যেকারণে রুশ ট্যাংক ইউনিটগুলি সময়মতো জ্বালানি পাচ্ছে না। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, অনেক রুশ ট্যাংক তাদের সেনারা অক্ষত অবস্থায় ফেলে রেখে গিয়েছে, যেগুলি ইউক্রেনের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বস্টন বলছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক সেনাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে বর্মাবৃত পরিবহণ প্রয়োজন। আর অপরদিকে পদাতিক সেনারা ট্যাংকগুলিকে রক্ষা করে। এখানেই ‘কম্বাইন্ড আর্মস’এর চিন্তাটার বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটা না হলে যুদ্ধক্ষেত্রে অন্য সকল জিনিসের মতো ট্যাংকও অদরকারি হয়ে যাবে।

মার্কিন সেনাবাহিনীর ‘ওয়েস্ট পয়েন্ট’ একাডেমির শিক্ষক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ডেভিড জনসন ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’এর প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রক্স’এর এক লেখায় ট্যাংকের ইতিহাস ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধই প্রথমবার নয় যে, ট্যাংকের বিদায়ঘন্টা নিয়ে অনেকে কথা বলেছেন। এর আগে ১৯৭৩ সালে রুশ ‘স্যাগার’ ক্ষেপণাস্ত্রের কারণে ইস্রাইলের ট্যাংকগুলি বাতিল মনে হয়েছিল। ২০০৬ সালে লেবাননে হিযবুল্লাহর হাতে রুশ ‘কর্নেট’ ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা ইস্রাইলি ‘মেরকাভা’ ট্যাংক ধ্বংস হবার পরেও একই কথা বলা হয়েছিল। বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংক ব্যবহারের কৌশলটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা ডেভেলপ করেছিল; যেখানে ট্যাংক এবং যুদ্ধবিমান একত্রে একটা ইউনিট হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে গতি নিয়ে এসেছিল। ১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের ‘ইয়োম কিপ্পুর’ যুদ্ধে ইস্রাইলের বিমানগুলিকেও বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়েছিল; যেকারণে তাদের বিমানগুলি ট্যাংকগুলিকে সহায়তা দিতে পারেনি। তবে ইস্রাইলিরা ‘স্যাগার’ ক্ষেপণাস্ত্রের সমাধান বের করেছিল। মর্টার, আর্টিলারি এবং পদাতিক সেনা শত্রুপক্ষের ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে ঘায়েল করে ফেলে ট্যাংকগুলিকে রক্ষা করেছে। আর ২০০৬ সালে লেবাননের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ইস্রাইলিরা ট্যাংককে সুরক্ষা দিতে ‘ট্রফি’ নামে ‘একটিভ প্রোটেকশন সিস্টেম’ ডেভেলপ করে; যার মাধ্যমে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র ট্যাংকে আঘাতের আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি এবং আকাশ থেকে মনুষ্যবিহীন ড্রোন ট্যাংকের উপর থেকে আক্রমণ করছে, যে অংশটায় বর্ম সবচাইতে কম থাকে। এটার সমাধান এখনও কেউ দিতে পারেনি। কর্নেল জনসন বলছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের শুরুতেই প্রশ্ন করতে হবে যে, পদাতিক সেনাদেরকে বর্ম দিয়ে রক্ষা করার প্রয়োজনটা এখনও রয়েছে কিনা। যদি সেটা থাকে, তাহলে ট্যাংক থাকবে।

মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল এইচ আর ম্যাকমাস্টার ‘বিজনেস ইনসাইডার’কে বলছেন যে, তিনি মনে করেন না যে, যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক বাহিনীকে সহায়তা দিতে কাছে থেকে গোলা নিক্ষেপের চাহিদাটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কোন একটা অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত এনে দিতে পারে না। শহুরে অঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা বাহিনীর বিরুদ্ধে সাফল্য পেতে হলে কমান্ডারকে পদাতিক সেনার সাথে ট্যাংক, আর্টিলারি এবং বিমানের সমন্বয় সাধন করতে হবে। ম্যাকমাস্টারের ধারণা, রুশরা ‘কম্বাইন্ড আর্মস’ অপারেশনে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। তবে ‘আমেরিকান মিলিটারি ইউনিভার্সিটি’র ‘এজ’ ম্যাগাজিনের এক লেখায় প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা ওয়েস ও’ডনেল মনে করছেন যে, একটা সামরিক বাহিনী ‘কম্বাইন্ড আর্মস’এ পারদর্শী হলে তাদের কাছে ট্যাংকের গুরুত্ব থাকবে। রুশরা ‘কম্বাইন্ড আর্মস’ বুঝতে পারার জন্যে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা রাখে। আর তাদের প্রযুক্তিও বেশ ভালো। হয়তো এখানে অন্য কোন কারণ থাকতে পারে। ‘র‍্যান্ড’এর স্কট বস্টন বলছেন যে, ইউক্রেনে রুশ বাহিনী হয়তো ভেবেছিল যে, ইউক্রেনিয়ানরা যুদ্ধ করবে না; আর ইউক্রেনের যথেষ্ট সংখ্যক কর্মকর্তা হয়তো রাশিয়ার পক্ষে চলে যাবে। একারণেই রুশরা হয়তো তাদের পরিকল্পনা করার সময়ে ভুল করেছে। যে ব্যাপারটায় সকলেই একমত তা হলো, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ট্যাংকের বিদায় এখনই হচ্ছে না। হয়তো কিছু সময়ের জন্যে ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রগুলি এগিয়ে আছে।

2 comments:

  1. যুদ্ধে আক্রমনকারীদের জন্য ট্যাংক যতটা দরকারী আক্রমনের শিকারীদের জন্য ততটা অত্যাবশ্যক নয়। বর্তমান যুদ্ধে পদাতিক বাহিনীর ভূমিকাও কমে যাচ্ছে, সবই ম্যাকানাইজ হয়ে যাচ্ছে। সৈন্যরা ভারী বর্ম পড়ে কতক্ষন সম্মুক রনাংগনে টিকে থাকবে? আর আগামীতে সম্মূক রনাংগন বলে কিছু থাকলে তো? সুতরং বর্ম আচ্ছাদিত সাজোয়া বহরের ভূমিকা বরং আগামীতে আরও ব্যাপক হবে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে স্মার্ট ট্যাংক ও সাজোয়া বহরের আবির্ভাব এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। হয়তো এই যুদ্ধেই তা দেখতে পেয়ে যাব আমরা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বর্তমানে ট্যাংকের যে কনসেপ্ট অনুসরণ করা হচ্ছে, সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের তৈরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শিক্ষা থেকে ব্যাটলফিল্ড মোবিলিটি তৈরি করাটাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ব্রিটিশ আর ফরাসিরা শেষ পর্যন্ত জার্মানদের অনুসরণ করেছে; রুশ এবং মার্কিনীরাও অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে। এই কনসেপ্টের মূলে রয়েছে ট্যাংক এবং যুদ্ধবিমানের সমন্বয়। কোন একটা ব্যর্থ হলে এই কৌশল কাজ করবে না।

      তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইস্রাইলি এবং আমেরিকানরা ট্যাংকের কনসেপ্টকে আরও কিছুটা পরিবর্তন করেছে। এর কারণ ছিল পদাতিক বাহিনীর হাতে নতুন নতুন ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্রের বিশাল বহর; সাথে বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রের ডেভেলপমেন্ট। অস্ত্রের ব্যাপারগুলি টেকনিক্যাল; এগুলির সমাধান কোনটা কিছু আগে হয়েছে; কোনটা কিছুদিন পরে এসেছে। তবে কনসেপ্ট পরিবর্তিত হয়নি। এখনও সেই কনসেপ্টই আছে; কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে মাত্র। এখানেই ডেভেলপড হয়েছে 'কম্বাইন্ড আর্মস'এর কনসেপ্ট। ট্যাংকের বিরুদ্ধে যেসকল অস্ত্র রয়েছে, সেগুলিকে মোকাবিলা করবে পদাতিক, আর্টিলারি এবং বিমান। অপরদিকে মেশিন গানের গুলি থামাতে পদাতিককে সরাসরি সহায়তা দেবে ট্যাংক। সরাসরি সমর্থন বা 'ডিরেক্ট গানফায়ার সাপোর্ট' ছাড়া পদাতিক বাহিনীর পক্ষে শত্রুর পরিখা বা শক্তিশালী অবস্থান জয় করা সম্ভব নয়। কাজেই আপাততঃ ট্যাংক থাকছে।

      শত্রুর পরিখা বা শক্তিশালী অবস্থান দখল করাটা আক্রমণ বা প্রতিরোধের উপর নির্ভর করছে না। কারণ যারা প্রতিরোধ করবে, তাদেরকেও ভূমি পুনরুদ্ধার করতে হলে প্রতিআক্রমণে যেতে হবে। কাজেই একটা প্রতিরোধকারী বাহিনীর জন্যেও আক্রমণ করা জরুরি এবং সেখানে ট্যাংক জরুরি।

      আর পদাতিক বাহিনী বাতিল হবার প্রশ্নই ওঠে না। ভূমির নিয়ন্ত্রণ নেয়া যুদ্ধ করার একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর সেটা যন্ত্র দিয়ে করা যাবে না। কারণ ভূমিতে মানুষ থাকে; মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মানুষ লাগবে। অর্থাৎ পদাতিক বাহিনী থাকবে।

      পদাতিক নিয়ে একটা পুরোনো লেখা পড়তে পারেন -
      https://koushol.blogspot.com/2015/08/king-of-battlefield.html

      Delete