Friday 22 April 2022

আল-আকসার সহিংসতা মুসলিমদের নেতৃত্বের শূণ্যতাকেই তুলে ধরে

২৩শে এপ্রিল ২০২২

 
২০১৪ সাল থেকে শুরু করে নবম বারের মতো ইস্রাইলি সেনারা আল-আকসা মসজিদে হামলা করলো। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, ২০২১এর মে মাসে ১১ দিনের ইস্রাইলি হামলায় যেমন আড়াই’শ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল, তেমনই কোন সহিংসতার দিকে পরিস্থিতি ধাবিত হচ্ছে কিনা।


২২শে এপ্রিল ইস্রাইলি অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদে ইস্রাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় ৩ জন সাংবাদিকসহ বেশ ক’জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট বলছে যে, ৩১ জন আহতের মাঝে ১৪ জনকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকদের বরাত দিয়ে ‘আল জাজিরা’ বলছে যে, শুক্রবার ভোরে ইস্রাইলি বাহিনী আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে ঢুকে রাবার বুলেট এবং স্টান গ্রেনেড ছুঁড়ে। জবাবে ফিলিস্তিনি তরুণরা ইস্রাইলি সেনাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেন নিক্ষেপ করে। ইস্রাইলি নিরাপত্তা বাহিনী বলছে যে, তারা ফজরের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত মসজিদ কম্পাউন্ডে ঢোকেনি; এবং তারা ইটপাটকেল ছোঁড়ার জবাব দিতেই সেখানে ঢুকেছিল। কিন্তু এই সংঘর্ষ হঠাত ঘটেনি। প্রায় মাসখানেক ধরেই সহিংসতায় বহু ফিলিস্তিনি হতাহত হয়েছে। ২১শে এপ্রিলও ভোরে ফজরের নামাজে পরপরই ইস্রাইলি বাহিনী রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস এবং পিপার স্প্রে ছুঁড়ে কমপক্ষে ৩০ জন মুসল্লীকে আহত করে। জবাবে ফিলিস্তিনি তরুণরা পেট্রোল বোমা এবং পাটকেল নিক্ষেপ করে। ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে নবম বারের মতো ইস্রাইলি সেনারা আল-আকসা মসজিদে হামলা করলো। মার্চে মাসেই জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ইস্রাইলি হামলায় ২৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়; বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ১৪ জন ইস্রাইলিও নিহত হয়। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, ২০২১এর মে মাসে ১১ দিনের ইস্রাইলি হামলায় যেমন আড়াই’শ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল, তেমনই কোন সহিংসতার দিকে পরিস্থিতি ধাবিত হচ্ছে কিনা।

‘আল জাজিরা’ বলছে যে, রমজান মাসে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের মাঝে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের ভিতরে ‘আল কিবলি’ মসজিদে ঢুকে পড়লে ফিলিস্তিনিরা তাদেরকে লক্ষ্য করে পাটকেল নিক্ষেপ করে। উগ্র ইহুদিরা সাম্প্রতিক সময়ে তাদের দাবি পরিবর্তন করে ফেলেছে। এখন তারা তাদের ‘পাসওভার’ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করার জন্যে মসজিদে ঢুকে উপাসনা করতে চাইছে। ১৯৬৭ সালে জর্দানের সাথে ইস্রাইলের সমঝোতা অনুযায়ী আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের ভেতরে কোন অমুসলিম উপাসনা করতে পারবে না। ১৫ই এপ্রিল ‘পাসওভার’এর প্রথম দিনে ইস্রাইলি বাহিনী মসজিদ কম্পাউন্ডে ঢুকে ১’শ ৫৮ ফিলিস্তিনিকে আহত করে এবং ৪’শ জনকে গ্রেপ্তার করে।

২০শে এপ্রিল সন্ধ্যার সময় হাজারখানেক উগ্রপন্থী ইহুদি ‘আরবদের মৃত্যু চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল করে দামাস্কাস গেইট এবং পুরোনো জেরুজালেমের মুসলিমদের বসতির দিকে ধাবিত হলে ইস্রাইলি পুলিশ তাদেরকে বাধা দেয়। ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেন যে, নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই তিনি পুলিশকে বাধা দিতে বলেছেন। তিনি ইস্রাইলি পুলিশের কাজকে আরও কঠিন করতে বা তাদেরকে নিরাপত্তাহীনতার মাঝে ফেলতে চান না। মিছিলে নেতৃত্ব দেয়া উগ্রবাদী পার্লামেন্ট সদস্য বেন গাভির বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’কে বলেন যে, তিনি কোন অবস্থাতেই তার লক্ষ্য থেকে সড়বেন না। তিনি প্রশ্ন করেন যে, কোন আইনে তাকে দামাস্কাস গেইট যেতে বাধা দেয়া হচ্ছে? তার কথায়, “কিছু ইহুদি কখনোই হামাসের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না”।

একই সময়ে ২১শে এপ্রিল এক সপ্তাহে দ্বিতীয় দিনের মতো ইস্রাইলি যুদ্ধবিমান গাজা উপত্যকায় বোমাবর্ষণ করেছে। ইস্রাইলিরা বলছে যে, তাদের টার্গেট ছিল মাটির নিচে রকেট ইঞ্জিন তৈরি করার কারখানা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে যে, হামলায় মধ্য গাজার আল-বুরাইজ শরণার্থী ক্যাম্পে কয়েকটা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 
আরব দেশগুলি এবং তুরস্ক যখন ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিযোগিতা করছে, তখন ফিলিস্তিনিদের উপর দখলদার ইস্রাইলি বাহিনী এবং অবৈধ বসতি স্থাপনকারী উগ্রপন্থী ইহুদিদের হামলা বন্ধ করার কে রয়েছে? ফিলিস্তিনিরা যখন বছরের পর বছর এতিম শিশুর মতো যখন মার খাচ্ছে, তখন তা কেবল বৈশ্বিকভাবে মুসলিমদের নেতৃত্বশূণ্যতাকেই তুলে ধরে। আল-আকসায় নতুন করে সহিংসতা বিশ্বব্যাপী মুসলিমদেরকে নেতৃত্ব খোঁজায় মরিয়া করে তুলবে, যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।

‘মিডলইস্ট মনিটর’এর এক লেখায় মার্কিন বামপন্থী রাজনীতিবিদ বার্নি স্যান্ডার্সের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে সহযোগী আব্দেররাহমানি আমর বলছেন যে, ইউক্রেন এবং ফিলিস্তিনের ব্যাপারে পশ্চিমারা বীভৎস দ্বিমুখী নীতি প্রদর্শন করছে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পর পশ্চিমা দেশগুলিতে যেমন রুশ পণ্য বয়কটকে বিরাট একটা ইস্যু করা হয়েছে, ঠিক তার উল্টোটা করা হয়েছে যখন ফিলিস্তিনে অবৈধ ইস্রাইলি দখলদারিত্ব এবং গাজার উপর সামরিক হামলা বন্ধে যখন ইস্রাইলি পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছিল। সেই আবদনে ইস্রাইলকে আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য করার কথা বলা হয়েছিল; ঠিক সেই কথাটাই এখন রুশ পণ্য বয়কটের ক্ষেত্রে ইইউ, ন্যাটো এবং বেশিরভাগ পশ্চিমা লিবারাল সংস্কৃতির দেশ জোর গলায় বলছে। এপ্রিল মাসেই মার্কিন কংগ্রেসম্যান লী জেলডিন ও ৪৬ জন কংগ্রেস সদস্য ‘ইস্রাইল এন্টি বয়কট এক্ট’ নামের একটা আইন নিয়ে এসেছে; যা নিশ্চিত করবে যে, কেউ যেন কখনোই ইস্রাইলকে বা ইস্রাইলি পণ্যকে বয়কট করার প্রস্তাব নিয়ে আসতে না পারে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে ইস্রাইলের পক্ষে সমর্থন কতটা শক্ত, তার প্রমাণ হলো ২৭টা মার্কিন অঙ্গরাজ্যে আইন করা হয়েছে যাতে করে কেউই ইস্রাইলের বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক দিতে না পারে। এই আইনগুলি অনেক ক্ষেত্রেই সেসব ব্যবসাকে টার্গেট করেছে, যারা ইস্রাইলের বসতি স্থাপনের ব্যবসায়িক পার্টনার হতে চায়না। আমর বলছেন যে, পশ্চিমারা একদিকে যেমন রাশিয়াকে শত্রু এবং ইস্রাইলকে বন্ধু মনে করছে, তেমনি ইউক্রেনিয়ানদেরকে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপিয় হবার কারণে এবং ফিলিস্তিনিদেরকে শ্বেতাঙ্গ না হওয়ায় ও তৃতীয় বিশ্বের আরব জাতির অংশ হওয়ায় আলাদা করে দেখেছে। এছাড়াও মার্কিন সরকার তাদের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের অন্য দেশের অঞ্চল দখল করাকে খারাপ চোখে দেখেছে; কিন্তু মার্কিনীদের বন্ধু দেশ হলে তারা তাদের লিবারাল আদর্শকে পিছনে ফেলে দিয়েছে।

‘ডেইলি সাবাহ’ বলছে যে, ১৯শে এপ্রিল তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়িপ এরদোগান ইস্রাইলি প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগকে ফোন করে বলেন যে, সহিংসতায় ৪’শ ফিলিস্তিনি আহত হওয়ায় তিনি ব্যাথিত হয়েছে; এবং তিনি ইস্রাইলকে সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেন। এরদোগানের কথাগুলি বলে দিচ্ছে যে, আরব দেশগুলি এবং তুরস্ক যখন ইস্রাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিযোগিতা করছে, তখন ফিলিস্তিনিদের উপর দখলদার ইস্রাইলি বাহিনী এবং অবৈধ বসতি স্থাপনকারী উগ্রপন্থী ইহুদিদের হামলা বন্ধ করার কে রয়েছে? ফিলিস্তিনিরা যখন বছরের পর বছর এতিম শিশুর মতো যখন মার খাচ্ছে, তখন তা কেবল বৈশ্বিকভাবে মুসলিমদের নেতৃত্বশূণ্যতাকেই তুলে ধরে। আল-আকসায় নতুন করে সহিংসতা বিশ্বব্যাপী মুসলিমদেরকে নেতৃত্ব খোঁজায় মরিয়া করে তুলবে, যার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। অপরদিকে, যদিও পশ্চিমাদের দ্বিমুখী ও বর্ণবৈষম্যমূলক নীতি প্রকৃতপক্ষে নতুন কিছু নয়, তথাপি তা বর্তমান ভেঙ্গে পড়া বিশ্বব্যবস্থার অসারতা প্রমাণে যথেষ্ট।

4 comments:

  1. যতদিনে না আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থা পুরোপুরি ভাবে ভেঙে পড়ছে ততদিন কিছু হভে বলে মনে হয়না৷ ক্যাপিটালিজম -লিবরালিজম - ডেমোক্রেসি, পশ্চিমা যা করে সেটাই সর্বসেরা -এই সব ডিলিউসনাল চিন্তা ভাবনা থেকে, হীনমন্যতা থেক্স বের হয়ে এসে নতুন আদর্শিক পলিটিকাল দোমেইন না যতদিনে খাড়া হচ্ছে ততদিন এইরকমই চলবে৷
    ইসরায়েল -পশ্চিমারা যাই করবে তাইঠিক।

    ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্যবস্থা হিসেবে ক্যাপিটালিজম এখন নামমাত্র রয়েছে। কারণ ব্যবস্থার বেশিরভাগ স্তম্ভই এখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত; যেমন - গণতন্ত্র, মুক্ত বাজার অর্থনীতি, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন, ইত্যাদি সবগুলিই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যক্তিস্বাধীনতাও সমস্যায় পড়েছে জাতিগত বৈষম্যের কারণে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় বর্ণবাদ এখন স্বাভাবিক ব্যাপার।

      যে ব্যাপারটা এখনও ঝুলে আছে তা হলো বাকি বিশ্বের মানুষের কাছে বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার প্রয়োজনের চিন্তাটা এবং সেখানে অপশন খোঁজার চেষ্টাটা। একটা বিকল্প ব্যবস্থা স্থাপিত হলে মানুষ সেটা গ্রহণ করবে; সেটা পছন্দ করেই হোক, আর বাধ্য হয়েই হোক। একারণেই বেশি গ্রুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হবে সম্ভাবনাটা, এর গ্রহণযোগ্যতা নয়। আর এজন্যেই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের সংকট ভূরাজনীতিতে এতটা গুরুত্বপূর্ণ। ইস্রাইল বা যুক্তরাষ্ট্র এটা বুঝতে পারলেও তাদের আসলে করার কিছুই নেই। তারা তাদের অমানুষিক কর্মকান্ডগুলিকে অব্যাহত রেখে পরিবর্তনকে ডেকে নিয়ে আসবে।

      Delete
  2. কিন্তু মুস্লিমেরা বুঝতে পারছে না, এখনো দুনিয়া/ক্যাপিটালিজম নিয়েই ব্যস্ত।
    *"ইস্রাইল বা যুক্তরাষ্ট্র এটা বুঝতে পারলেও তাদের আসলে করার কিছুই নেই।"
    এরা এমন ভাবে ঘটনা গুলো তুলে ধরছে,এমন যেন তারাই দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে৷ খুব দুঃখজনক অবস্থা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. তারা সকলে হয়তো সমাধানের পদ্ধতির ব্যাপারে খুব বেশি জ্ঞান রাখেন না। তবে তারা সমাধানের প্রয়োজনের ব্যাপারে সন্দেহাতীতভাবেই একমত। এতিমের মতো মার খেতে খেতে একসময় প্রয়োজনের ইস্যুটা অটোমেটিক্যালি চলে আসবে। কারণ মানুষের কাছে সকল নেতার মুখোশ খুলে গেছে।

      আর হ্যাঁ, কেউ নিজের খারাপ অবস্থা স্বীকার করে না; এটাই স্বাভাবিক। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার আগেও কেউ টের পায়নি।

      Delete