Sunday 17 April 2022

শেহবাজ শরীফ কি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ককে মেরামত করতে পারবেন?

১৭ই এপ্রিল ২০২২

পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ এবং তার ভাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। নওয়াজ শরীফের পরিবারের প্রাক্তন ইতিহাস শেহবাজ শরীফের ব্যাপারে পাকিস্তানীদেরকে খুব বেশি আপ্লুত করার কথা নয়। বরং পাকিস্তানের জনগণের মাঝে মার্কিন বিরোধী চিন্তার উপর ভিত্তি করেই যেহেতু ইমরান ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি পাকিস্তানকে কয়েক দশক ধরে নিয়ন্ত্রণ করলেও একুশ শতকে চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতের ভূমিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার ক্রান্তিলগ্নে মস্কো ও বেইজিংএর ব্যাপারে পাকিস্তানের ‘নিরপেক্ষ’ নীতি মার্কিনীদের দুশ্চিন্তায় রাখছে।

 
পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতা হারাবার আগে এবং পরে বারংবার বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে ষড়যন্ত্র করেছে। তিনি বলেছেন যে, তিনি পাকিস্তানের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অংশ হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতেই রাশিয়া সফর করার কারণে ওয়াশিংটন তার উপরে ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ইমরানের পক্ষে এই ষড়যন্ত্রের পিছনে যেমন কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেখানো কঠিন, তেমনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মুসলিম লীগ মনোনীত নতুন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের পক্ষেও দুই দেশের মাঝে সম্পর্ককে পুরোপুরিভাবে মেরামত করাটা কঠিন। তবে ইমরানের প্রস্থানের পর পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কিছুটা ভালো হবার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে।

‘আল জাজিরা’র সাথে কথা বলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘টাফট ইউনিভার্সিটির’র প্রফেসর আয়েশা জালাল বলছেন যে, পাকিস্তানের শাসকরা এর আগে বহুবার নিজের ঘর সামাল দিতে না পেরে বিদেশী ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। তারা সমস্যার সমাধান না করতে পেরে সেটার দায় বিদেশের উপরে দিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকেরা এধরণের কথার উপর নির্ভর করেছেন কারণ দেশটার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহুদিন যাবতই টানাপোড়েনের মাঝ দিয়ে চলেছে। ফলশ্রুতিতে নতুন প্রধানমন্ত্রী এবং সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের প্রধান কাজ হবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককে মেরামত করা। ১৩ই এপ্রিল মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিংকেন এক বার্তায় শেহবাজ শরীফকে অভিন্দন জানিয়ে বলেন যে, দুই দেশের মাঝে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতা অব্যহত থাকবে বলে তিনি আশা করেন। শরীফও একই দিনে এক টুইটার বার্তায় বলেন যে, তার দেশ অন্যান্য দেশের সাথে পারস্পরিক সন্মান ও সমতার ভিত্তিতে সম্পর্কোন্নন করতে থাকবে। তবে প্রশ্ন হলো, বাইডেন প্রশাসনের কাছে পাকিস্তান এখন কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’এর এক লেখায় নতুন দিল্লীর ‘জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি’র নাজির আহমেদ মীর বলছেন যে, গত কয়েক দশক ধরেই যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের মাঝে সম্পর্কটা আদান প্রদানের মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের কাছ থেকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বিশেষ করে আফগানিস্তানের ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়েছে; আর এর বিনিময়ে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বারংবার অভিযোগ করেছেন যে, তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ পাকিস্তান তাদের সাথে যথেষ্ট সহযোগিতা করছে না এবং তালিবানের মতো অস্ত্রধারী গোষ্ঠীকে নিজ দেশে আশ্রয় দিয়েছে। অপরদিকে ইসলামাবাদ বলেছে যে, পাকিস্তান মার্কিন ড্রোন হামলার শিকার হয়েছে এবং মার্কিন নেতৃত্বে আফগানিস্তানের যুদ্ধে জড়িয়ে তাদের বিশাল ক্ষতির সন্মুখীন হতে হয়েছে। আরেক মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশন’এর ফেলো মাদিহা আফজাল মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করে পাকিস্তানের জন্যে নিরাপত্তা সাহায্য বন্ধ করে দিলে দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক আরও নিচে নেমে যায়। তবে ২০১৯এর মাঝামাঝি ইমরান খানের ওয়াশিংটন সফরের পর ওয়াশিংটনের সাথে ইসলামাবাদের সম্পর্ক ভালোর দিকে ফেরত আসে। কারণ সেই সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নতুন লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া। সেটা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে তালিবানদের সাথে মার্কিনীরা আলোচনায় বসছিলো; আর পাকিস্তান সেখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা রাখছিলো।

২০২১এর জুনে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর সাথে এক সাক্ষাতে ইমরান খান বলেন যে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কটা একপেশে ছিল। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করছিল যে, তারা পাকিস্তানকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে; কাজেই পাকিস্তানের উচিৎ যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুযায়ী চলা। ইমরান বলেন যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটা সমতার সম্পর্ক চাইছিলেন, যার মাঝে যথেষ্ট অর্থনৈতিক সুযোগও থাকবে পাকিস্তানের জন্যে। মাদিহা আফজাল বলছেন যে, জো বাইডেনের প্রশাসন ক্ষমতা নেবার পর থেকে ওয়াশিংটনের কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব যথেষ্টই কমে গেছে। কারণ গত অগাস্টেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে গেছে। চীনকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে মার্কিনীদের কাছে এখন ভারতের গুরুত্বই বেশি। তবে ঐতিহাসিকভাবেই পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কেন্দ্রে ছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। ইমরান খান ক্ষমতা নেবার পর থেকে সেনাবাহিনীর নীতির সাথে খাপ খাইয়েই চলেছেন। উভয়েই পাকিস্তানের ‘স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি’র উপর গুরুত্ব দিয়েছে; যার মাধ্যমে পাকিস্তান সকল দেশের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। কিন্তু গত কয়েক মাসের মাঝে বেইজিং এবং মস্কোর সাথে ইমরান সরকারের সখ্যতা বৃদ্ধি পেলেও সেই হিসেবে ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন হয়নি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সর্বদাই ওয়াশিংটনের সাথে ভালো সম্পর্ক চেয়েছে। ওয়াশিংটনকে বাদ দিয়ে বেইজিংএর সাথে সম্পর্কোন্নয়ন সেনাবাহিনী চায়নি।

আয়েশা জালাল বলছেন যে, ওয়াশিংটন এবং বেইজিংএর সাথে সম্পর্ক ব্যালান্স করে চলার নীতিটা ইমরান খানের নীতি নয়; এটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতি। কিন্তু পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির এই ব্যালান্স সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ‘সিএনবিসি’র সাথে কথা বলতে গিয়ে ওয়াশিংটনের ‘অলব্রাইট স্টোনব্রিজ গ্রুপ’এর ডিরেক্টর জেমস শোয়েমলেইন বলছেন যে, ইমরান খান পাকিস্তানের ঐতিহাসিক ওয়াশিংটন কেন্দ্রিক নীতিকে পরিবর্তন করে চীনকে আলিঙ্গন করেছেন; যা পাকিস্তানের জন্যে খুবই বিপজ্জনক। কারণ পাকিস্তান চীনে রপ্তানি করতে চাইলেও বাস্তবে পাকিস্তানের রপ্তানি যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে।

‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’এর ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’এর ডিরেক্টর ইকবাল সিং সেভেয়া বলছেন যে, পাকিস্তান এই মুহুর্তে দেউলিয়াত্ব ঘোচাতে ‘আইএমএফ’এর ২৩তম সহায়তা প্যাকেজের মাঝে রয়েছে। দেশের মুদ্রাস্ফীতি এখন ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। শেহবাজ শরীফ খুব সম্ভবতঃ ‘আইএমএফ’এর কাছ থেকে আরও ঋণের দিকে ধাবিত হবেন। আর এর ফলশ্রুতিতে ‘আইএমএফ’এর কঠিন শর্ত পূরণে আর্থিক খাতের পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে পাকিস্তানকে; একইসাথে কর বৃদ্ধি করা এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার দিকে যেতে হবে সরকারকে। আর শেহবাজ শরীফের সরকারকে হয়তো এই কঠিন কাজটা করতে হবে ভর্তুকি বজায় রেখেই।

নওয়াজ শরীফের পরিবারের প্রাক্তন ইতিহাস শেহবাজ শরীফের ব্যাপারে পাকিস্তানীদেরকে খুব বেশি আপ্লুত করার কথা নয়। বরং পাকিস্তানের জনগণের মাঝে মার্কিন বিরোধী চিন্তার উপর ভিত্তি করেই যেহেতু ইমরান ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি পাকিস্তানকে কয়েক দশক ধরে নিয়ন্ত্রণ করলেও একুশ শতকে চীনকে নিয়ন্ত্রণে ভারতের ভূমিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার ক্রান্তিলগ্নে মস্কো ও বেইজিংএর ব্যাপারে পাকিস্তানের ‘নিরপেক্ষ’ নীতি মার্কিনীদের দুশ্চিন্তায় রাখছে।

2 comments:

  1. কোট -আনকোট নিরপেক্ষ নীতি!!!
    আইএমএফ কাছে ঋন নেওয়ার পর কি দেশটা দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. একটা দেশ দেউলিয়া হলেই 'আইএমএফ'এর কাছে যায়। কারণ 'আইএমএফ' যেসব শর্ত দেয়, তা একটা স্বাধীন দেশের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। একটা দেউলিয়া দেশই এসব শর্ত মেনে নিতে পারে।

      Delete