Tuesday 29 March 2022

ইউক্রনের যুদ্ধ কি সত্যিই গণতন্ত্র রক্ষার জন্যে লড়াই?

২৯শে মার্চ ২০২২

ইউক্রেনের যুদ্ধকে বাইডেন গণতন্ত্রের লড়াই তকমা দেয়ায় পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা ভুল ধরেছেন। কিন্তু সেটাও তো বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দৈন্যতাকে আলোচনায় নিয়ে এসে বিকল্পের সন্ধান করার অনুপ্রেরণা যোগায়। সেক্ষেত্রে পুতিনের ক্ষমতায় থাকা উচিৎ বা অনুচিত এই কথাগুলি আলোচনায় এনে মিডিয়া গণতন্ত্রের সমস্যাগুলিকে আড়াল করে আসল আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছে; যা হলো, এই বিশ্ব পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলা উচিৎ কি উচিৎ নয়। যদি উচিৎ হয়, তাহলে কার নেতৃত্ব জাতীয় স্বার্থ জ্বলাঞ্জলি দিয়ে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ বাস্তবায়িত হবে; আর যদি উচিৎ না হয়, তাহলে কোন ব্যবস্থা এর বিকল্প হওয়া উচিৎ?

গত ২৭শে মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ সফরের সময় তার ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে বলেন যে, ‘ঈশ্বরের কসম! এই লোকটা ক্ষমতায় থাকতে পারে না!’ কথাগুলি বলার প্রায় সাথেসাথেই হোয়াইট হাউজ থেকে বলা হয় যে, বাইডেন অবশ্যই পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার কথা বলছিলেন না। বাইডেনের অভ্যন্তরীণ সমালোচকেরা বলতে শুরু করেছেন যে, বাইডেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করতে চাইছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ এই সুযোগে বলেন যে, এটা দায়িত্বশীল বক্তব্য নয়। বরং তিনিই এর চাইতে ভালো কূটনীতি চালাতে পারেন। তবে অনেকেই পুতিনের ক্ষমতায় না থাকার ব্যাপারে বাইডেনের কথাগুলিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করলেও তারা হয়তো খেয়াল করছে না যে, এর আগে বাইডেন যখন ইউক্রেনের যুদ্ধকে গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, সেটার গুরুত্ব ছিল আরও সুদূরপ্রসারী।

মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ‘ইউরেশিয়া গ্রুপ’এর প্রধান ইয়ান ব্রেমার বলছেন যে, বাইডেন হয়তো তার লিখিত ভাষণের বাইরেই আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিলেন যে, পুতিনের ক্ষমতায় থাকা উচিৎ নয়। সেটা হয়তো আবেগের কথাই ছিল। এর গুরুত্ব কিছুটা কমই হবে; কারণ পুতিনকে প্রতিস্থাপিত করার মতো সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। এই একই যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সাথে সংঘর্ষ এড়াবার জন্যে ইউক্রেনের উপর ‘নো-ফ্লাই জোন’ করতে বা ইউক্রেনকে রক্ষা করতে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করতে চাইছে না। কথাগুলি বরং ক্রেমলিনের তথ্যযুদ্ধে সহায়তা দেবে। তবে এর আগে যখন তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধকে গণতন্ত্রের জন্যে যুদ্ধ বলেছেন, তখন সেটা আবেগতাড়িত হয়ে বললেও এর ছায়া পড়বে বিশ্বব্যাপী। বাইডেন বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটা নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রয়োজন। রাশিয়াকে ‘জি২০’ বের করে দেয়া উচিৎ। বাইডেন সম্ভবতঃ ইউক্রেনের যুদ্ধের গুরুত্বকে বাড়াবার জন্যেই গণতন্ত্র বাঁচাবার সংগ্রাম বলেছেন। কিন্তু তার বোঝা উচিৎ ছিল যে, বিশ্বের বেশিরভাগ গণতান্ত্রিক দেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নেই। ১’শ ৪১টা দেশ জাতিসংঘে রাশিয়ার নিন্দা করলেও শুধুমাত্র ধনী দেশগুলি রাশিয়ার উপর অবরোধের পক্ষে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা নিরপেক্ষ থেকেছে; চীন পুরোপুরিভাবে রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে। বাইডেন অবশ্যই চাইবেন না রাশিয়া এবং চীনের সাথে একটা ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হোক; কারণ এতে সকলেই, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখন বিশ্বের সামনে গণতন্ত্রের মডেল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামনের নির্বাচনে যেই হারবে সেই বলবে যে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। বাইডেনের কথাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব কমাতে ইন্ধ্বন যোগাবে।

ওবামা প্রশাসনের সময়কার মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিআইএ’র প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত প্রধান মাইকেল মোরেল মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল ‘সিবিএস’কে বলেন যে, বাইডেন যখন বলেন যে, পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হবে, সেটা ছিল একটা মস্তবড় ভুল, যা তার উপরে কেউ চাপিয়ে দেয়নি। এতে নিজ দেশে পুতিনের হাত শক্তিশালী হয়েছে। এতে পুতিনের বিরুদ্ধে যেকোন বিরোধীদের একত্রিত হওয়াটা কঠিন হয়ে যায়। কোন রুশ নাগরিকই চাইবে না যে, রাশিয়া প্রধান শত্রু দেশের প্রেসিডেন্ট বলে দিক যে, তার নেতৃত্ব কেমন হওয়া উচিৎ। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হওয়া উচিৎ আরও ছোট পরিসরে; অর্থাৎ দাবি হওয়া উচিৎ রাশিয়ার ইউক্রেন ছাড়ার; এবং রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করার যাতে করে পুতিন এহেন কাজ আবারও না করেন। গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের কথাগুলি চীনাদেরকে রাশিয়ার কাছে নিয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, মার্কিনীদের অনেক বন্ধু রয়েছে যারা একনায়ক; এদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দাঁড়ানোটা তখন কঠিন হয়ে যায়।

ভারতীয় মিডিয়া ‘এনডিটিভি’র এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, বাইডেনের গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করার কথাগুলি কতটা সততার উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত; এবং কতটা দ্বিমুখী নীতি এখানে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ার হাইড্রোকার্বনের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্র এখন সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকছে। কারণ নিজের দেশে জ্বালানির মূল্যের স্বল্প বৃদ্ধিও বাইডেন প্রশাসনের জন্যে ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। অথচ এর আগে সৌদি আরবের মানবাধিকার ইস্যুতে, বিশেষ করে ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যার ঘটনায়, বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবের উপর চাপ প্রয়োগ করেছে। এরপর রয়েছে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো, যার উপর যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। অথচ এখন জ্বালানির বিকল্প খুঁজতে গিয়ে একটা উচ্চপদস্থ মার্কিন প্রতিনিধিদল ভেনিজুয়েলার রাজধানী কারাকাস ঘুরে এসেছে। ‘এনডিটিভি’ বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং গণতান্ত্রিক আদর্শের মাঝে সাংঘর্ষিক অবস্থান নতুন নয়; তবে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে তার পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রাখার কথা বলেছেন। যদিও অনেকেই বলেছেন যে, এটা মূলতঃ চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যেই বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন।

গত ডিসেম্বরে বাইডেনের ডাকা গণতন্ত্র শীর্ষবৈঠকের মাঝে আমন্ত্রিত দেশগুলির ৩০ শতাংশেরই গণতান্ত্রিক আদর্শ রক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এমনকি ভারতীয় সরকারের গণতান্ত্রিক রেটিংও সাম্প্রতিক সময়ে নিম্নগামী ছিল। ‘এনডিটিভি’র প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে এটা হাস্যকর যে এই একই যুক্তরাষ্ট্র মাত্র কয়েক মাস আগেই আফগান জনগণকে তালিবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। বহুকাল যাবতই যুক্তরাষ্ট্র মিশর, সৌদি আরব, বাহরাইন, আরব আমিরাত এবং অন্যান্য দেশের অগণতান্ত্রিক সরকারগুলিকে সমর্থন দিয়ে গেছে। পৃথিবী দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবার কারণে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতে বাধ্য হয়েছে। যখন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন হামলার নিন্দা প্রস্তাবে রুশ ভেটো দেয়ার সমালোচনা করছে, তখন তারা ভুলে যাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একসময় গ্রেনাডা, নিকারাগুয়া এবং পানামার উপর মার্কিন হামলা এবং লেবাননে ইস্রাইলের আগ্রাসনের নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে। ইয়েমেন, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য দেশের মানুষজন মার্কিন সরবরাহকৃত অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত মার্কিন বন্ধুদের দ্বারা হামলার শিকার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে, কোন একটা দেশ মিথ্যা কারণ দেখিয়ে অন্য দেশে আগ্রাসন চালাতে পারে না। অথচ হাস্যকর যে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রচুর মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছে। ‘এনডিটিভি’ বলছে যে, এটা বাস্তব সত্য যে, পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয় একটা দেশের জাতীয় স্বার্থ দ্বারা; গণতন্ত্রের আকাশকুসুম চিন্তা দ্বারা নয়, যদিও অনেকে সেটাই চাইতে পারে। ভারতীয় কর্মকর্তারাও বলছেন যে, ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়াকে সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্তটা ভারত পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই তার জাতীয় স্বার্থেই নিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে বাইডেন যখন বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রয়োজন, তখন তিনি বর্তমান বিশ্ব অব্যবস্থায় সুপারপাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটা বিকল্প সমাধান তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ইউক্রেনের যুদ্ধকে বাইডেন গণতন্ত্রের লড়াই তকমা দেয়ায় পশ্চিমা চিন্তাবিদেরা ভুল ধরেছেন। এতে মার্কিন বন্ধুরাও ব্যাপক সমালোচনা করছে। কিন্তু সেটাও তো বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দৈন্যতাকে আলোচনায় নিয়ে এসে বিকল্পের সন্ধান করার অনুপ্রেরণা যোগায়। সেক্ষেত্রে পুতিনের ক্ষমতায় থাকা উচিৎ বা অনুচিত এই কথাগুলি আলোচনায় এনে মিডিয়া গণতন্ত্রের সমস্যাগুলিকে আড়াল করে আসল আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছে; যা হলো, এই বিশ্ব পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলা উচিৎ কি উচিৎ নয়। যদি উচিৎ হয়, তাহলে কার নেতৃত্ব জাতীয় স্বার্থ জ্বলাঞ্জলি দিয়ে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ বাস্তবায়িত হবে; আর যদি উচিৎ না হয়, তাহলে কোন ব্যবস্থা এর বিকল্প হওয়া উচিৎ?

No comments:

Post a Comment