Wednesday 29 December 2021

মালদ্বীপে পৌঁছেছে বাংলাদেশ?

৩০শে ডিসেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩শে ডিসেম্বর মালদ্বীপের পার্লামেন্টে শেখ হাসিনা এক বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনার এই সফরটা বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্যেই শুধু নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্যেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এতকাল দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলি একমাত্র ভারতের প্রভাবের মাঝে থেকেই নিজেদের নীতি নির্ধারণ করেছে। এই প্রথমবারের মতো এই সমীকরণে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

 
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিসেম্বরে দ্বিতীয়ার্ধে ছয় দিনের জন্যে মালদ্বীপ সফর করে এসেছেন। দ্বৈত কর বাতিল করে বাণিজ্য সহজীকরণ, কারাবন্দী বিনিময়, বাংলাদেশ থেকে মেডিক্যাল প্রফেশনাল নেয়া এবং যুব উন্নয়ন বিষয়ে কয়েকটা সমঝোতা স্বারক এই সফরে স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়াও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মালদ্বীপকে ১৩টা সামরিক গাড়ি উপহার দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফরের মাঝে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ, ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল নাসিম, পার্লামেন্ট স্পিকার মোহামেদ নাশীদ এবং প্রধান বিচারপতি আহমেদ মুতাসিম আদনানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ২৩শে ডিসেম্বর মালদ্বীপের পার্লামেন্টে শেখ হাসিনা এক বক্তব্য রাখেন। এই সফরটা বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্যেই শুধু নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্যেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এতকাল দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলি একমাত্র ভারতের প্রভাবের মাঝে থেকেই নিজেদের নীতি নির্ধারণ করেছে। এই প্রথমবারের মতো এই সমীকরণে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

গত ১৩ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ফ্রিগেট ‘আবু উবাইদাহ’ চট্টগ্রাম ছেড়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ সফর করা। শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনীর ওয়েবসাইট বলছে যে, জাহাজটা ১৮ই ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে পৌঁছায় এবং ২০শে ডিসেম্বর কলম্বো ছেড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরের সময় জাহাজটা সেখানেই ছিল; যদিও জাহাজটা মিডিয়াতে তেমন একটা আসেনি। তবে মালদ্বীপে বাংলাদেশের সামরিক সফর এটাই প্রথম নয়। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক মালদ্বীপ সফরের সময় ৭টা সামরিক পিকআপ ট্রাক উপহার হিসেবে প্রদান করেছিলেন।

তবে এখনও পর্যন্ত মালদ্বীপ অনেক দিক থেকেই ভারতের প্রভাবের মাঝেই রয়েছে। পুরো মালদ্বীপ জুড়ে ভারত ১০টা স্বল্প পাল্লার উপকূলীয় রাডার বসিয়েছে মালদ্বীপের সমুদ্রসীমার উপর নজরদারি করার জন্যে। ২০০৬ সালে ভারত মালদ্বীপকে ৪৬ মিটার লম্বা একটা প্যাট্রোল বোট দেয়। ২০১৩ সালে ভারত মালদ্বীপকে দু’টা ‘ধ্রুভ’ হেলিকপ্টার উপহার দেয়। ২০১৯ সালের আরও একটা প্যাট্রোল বোট দেয় ভারত। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের সাথে মালদ্বীপের নৌঘাঁটি ডেভেলপ করার ব্যাপারে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক মালদ্বীপের ‘উথুরু থিলা ফালহু’ নৌঘাঁটি ডেভেলপ করার জন্যে ভারত মালদ্বীপকে ৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা দেবে। ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ বলছে যে, ভারত মালদ্বীপে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্যে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে। এছাড়াও করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতেও ভারত মালদ্বীপকে আড়াই’শ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে। ‘ভ্যাকসিন মৈত্রী’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভারত মালদ্বীপকে ২ লক্ষ ডোজ করোনা ভ্যাকসিন প্রদান করেছে।

ভারতের সাথে মালদ্বীপের সম্পর্ক প্রভাব বিস্তারের হলেও মালদ্বীপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের। মালদ্বীপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কতটা গভীর, তা কয়েকটা ঘটনার মাঝেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। সমুদ্রের পানির মাঝে বসবাস করলেও মালদ্বীপে খাবারের পানির অভাব রয়েছে। প্রতিটা দ্বীপের রয়েছে আলাদা বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে সমুদ্রের পানি থেকে সুপেয় পানি তৈরির যন্ত্র আগুন লেগে নষ্ট হয়ে গেলে পুরো পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় ধ্বস নামে। প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের খাবারের পানিটুকুও না থাকায় দেশটাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। এরকমই এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মালদ্বীপের সহায়তায় এগিয়ে আসে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘সমুদ্র জয়’ ১ লক্ষ লিটার খাবার পানি এবং ৫টা মোবাইল পানিশোধন প্ল্যান্ট নিয়ে রওয়ানা দেয় মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে। সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে ৩ হাজার কিঃমিঃএর বেশি সমুদ্রপথ মাত্র ৪ দিনে পাড়ি দিয়ে মালেতে পৌঁছে জাহাজখানা।

 
মার্চ ২০২১। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মেডিক্যাল দল মালদ্বীপে। ভারতের সাথে মালদ্বীপের সম্পর্ক প্রভাব বিস্তারের হলেও মালদ্বীপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের।


মালদ্বীপ অতি ছোট একটা দ্বীপ দেশ। দেশটার অতি জরুরি সেবার অনেককিছুই নিজেদের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। এর মাঝে রয়েছে প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল সেবা। বাংলাদেশের মেডিক্যাল প্রফেশনালরা মালদ্বীপে সার্ভিস দিচ্ছেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারিতে মালদ্বীপের অর্থনীতিতে ধ্বস নামার সাথেসাথে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ‘সমুদ্র অভিযান’ ১’শ টনের সাহায্য নিয়ে মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। এই সাহায্যের মাঝে ছিল ২০ হাজার সেট পিপিই, ৫ হাজার হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ৯’শ ৬০টা সেফটি গ্লাস এবং ৪০ কার্টন জরুরি ঔষধ। এছাড়াও ৮৫ টন খাবার ছিল জাহাজে। এর পরের মাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটা পরিবহণ বিমানে করে ১১ জন ডাক্তারকে মালদ্বীপে পাঠানো হয়। ২০২১ সালের মার্চে মালদ্বীপের জনগণের মাঝে ভ্যাকসিনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ‘সি ১৩০’ পরিবহণ বিমানে করে সামরিক বাহিনীর ২৩ জন মেডিক্যাল প্রফেশনালকে মালদ্বীপে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশের প্রায় এক লক্ষ কর্মী মালদ্বীপের হুলহুমালে দ্বীপ তৈরিতে অংশ নিচ্ছে; যেখানে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের থাকার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্প হলো মালদ্বীপের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রকল্প। দুই দশকের বেশি সময় ধরে এই দ্বীপ উন্নয়নের কাজ চলছে। তবে এই দ্বীপ উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ কম নয়। মালদ্বীপে কোন নদী নেই; যেকারণে পলিমাটি জমে মালদ্বীপের ভূমির পরিধি বাড়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। তাই মালদ্বীপ অন্য দেশ থেকে মাটি আমদানি করে হুলহুমালে দ্বীপ তৈরি করছে। এই জায়গাটাতেই মালদ্বীপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল এক দশকের বেশি সময় ধরে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত আহমেদ সারীর বাংলাদেশের নৌপরিবহণ মন্ত্রী শাহজাহান খানের কাছে বাংলাদেশ থেকে মাটি আমদানি করার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। একই বছরের অগাস্টে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত বলেন যে, তার দেশ প্রতি বছর ৪ লক্ষ টন মাটি আমদানি করছে; যার তিন চতুর্থাংশ আসছে ভারত থেকে। তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশের নদীর পলিমাটি ভারতের মাটি থেকে উত্তম হওয়ায় তার দেশ বাংলাদেশ থেকে মাটি আমদানিতে বেশি আগ্রহী। ২০১৬ সালের এপ্রিলে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত মোহামেদ আসিম বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকে আবারও মাটি আমদানির কথা বলেন। সর্বশেষ ২০২০এর নভেম্বর মাসে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের সাথে এক ফোনালাপে আবারও মাটি আমদানি করার ইচ্ছার কথা মনে করিয়ে দেন। কিন্তু এক দশকের বেশি সময় পরেও বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে মাটি রপ্তানি হয়নি। যেহেতু বাংলাদেশের পলিমাটি দিয়ে ভারতের মাটিকে প্রতিস্থাপিত করার কথা ছিল, তাই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন খুব একটা সহজ ছিল না মোটেই। বলাই বাহুল্য যে, মালদ্বীপকে ভারত তার নিজস্ব প্রভাবের অধীন দেশ বলে মনে করে। এখানে বাংলাদেশ বা অন্য কোন দেশের প্রভাব বিস্তারকে ভারত ভালো চোখে দেখবে না। কিন্তু হয়তো এখন সেই ব্যাপারটাই ঘটতে যাচ্ছে, যা কিনা ভারত এত বছর আটকে রেখেছিল।

 
ডিসেম্বর ২০২১। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ 'আবু উবাইদাহ' শ্রীলংকার কলম্বো বন্দরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরের সময় জাহাজটা সেখানেই ছিল; যদিও জাহাজটা মিডিয়াতে তেমন একটা আসেনি। ভারত, শ্রীলংকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং আরও কিছু দেশ এতকাল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সফর তালিকায় ছিল; মালদ্বীপ ছিল না। জাহাজটার মালদ্বীপ সফর হয়তো 'কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ'এর ম্যারিটাইম অপারেশনেরই একটা রিহার্সাল। এটা পরিষ্কার যে, ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি শুধুমাত্র ভারতকেন্দ্রিক আর থাকছে না।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘আবু উবাইদাহ’ মালদ্বীপ সফরে গিয়েছে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করার জন্যে নয়। ভারত, শ্রীলংকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং আরও কিছু দেশ এতকাল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সফর তালিকায় ছিল; মালদ্বীপ ছিল না। ২০২১ সালের অগাস্টে শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে ‘কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ’ বা ‘সিএসসি’ নামের একটা নিরাপত্তা সহযোগিতা জোটের মাঝে বাংলাদেশের নাম চলে এসেছে। ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ বলছে যে, ২০১১ সালে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোটাবায়া রাজাপক্ষের প্রচেষ্টায় শুরু করা এই জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের সমুদ্র নিরাপত্তায় ভারতের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে কয়েক বছর মালদ্বীপের সাথে ভারতের সম্পর্কের কিছুটা টানাপোড়েন চলায় এই কনক্লেভের কর্মকান্ড স্থগিত হয়ে যায়। ২০২০ সালে এই কর্মকান্ড আবারও নতুন উদ্যমে শুরু হয়; এর নামকরণটাও এবারেই আসে। এবারে গোটাবায়া রাজাপক্ষে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট। সেবছরের নভেম্বরে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকে শ্রীলংকার প্রস্তাবে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ সেইশেল এবং মরিশাসের সাথে সাথে বাংলাদেশকেও এই জোটে ‘পর্যবেক্ষক’ হিসেবে ঢোকানো হয়। এর আগে ২০১৪ সালে সেইশেল এবং মরিশাস ‘অতিথি’ দেশ হিসেবে উপস্থিত ছিল। তবে সবচাইতে বড় ঘটনাটা ঘটে যায় ২০২১ সালের উপ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকে। এখানেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায় যে নতুন তিনটা রাষ্ট্রকে স্থায়ী সদস্য হিসেবে জোটে ঢোকানো হবে। এর সাথে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আরেকটা ঘটনা ঘটে যায়; যা কিনা এই জোটের গুরুত্বকে বাড়িয়ে তোলে। ‘সিএসসি’এর অধীনে ভারত, শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের অংশগ্রহণে একটা ‘ফোকাসড অপারেশন’ চালনা করা হয়। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, এই অপারেশনে তিন দেশের নৌশক্তি অংশ নেয়। ভারতের ‘মনোহর পারিকার ইন্সটিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ এন্ড এনালিসিস’এর গবেষক গুলবিন সুলতানা ‘ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এক লেখায় বলছেন যে, প্রথমবারের মতো এই কনক্লেভের অধীনে একটা সামরিক অপারেশন করা হলো। এর মাধ্যমে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্যান্য ম্যারিটাইম নিরাপত্তা জোট, যেমন ‘ইন্ডিয়ান ওশান রিম এসোসিয়েশন’এর সাথে কলম্বো কনক্লেভের একটা পার্থক্য হয়ে গেলো। তিনি মনে করছেন যে, ভারত মহাসাগরে এই জোট একটা গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা পদক্ষেপ হিসেবে সামনে আসতে যাচ্ছে; যার গুরুত্ব আরও বাড়তে যাচ্ছে সেইশেল, মরিশাস এবং বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে।

মালদ্বীপ শুধুমাত্র বাংলাদেশী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের একটা উৎস হিসেবেই ছিল এতকাল। তবে এই অবস্থানের পরিবর্তন হতে চলেছে। গত ১৯শে নভেম্বর থেকে দুই দেশের মাঝে সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হয়েছে। বাণিজ্য সহজীকরণের জন্যে দুই দেশের মাঝে সরাসরি জাহাজ চলাচলের ব্যাপারেও ঐকমত্য হয়েছে ইতোমধ্যেই। এই প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত হলে হয়তো বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে পলিমাটি রপ্তানিও সম্ভব হতে পারে। আর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ‘বিআইডিএস’এর এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন যে, মালদ্বীপ বাংলাদেশের কাছে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ চেয়েছে; এবং বাংলাদেশ সেটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। এর আগে বাংলাদেশ শ্রীলংকাকে আড়াই’শ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে; যখন দেশটা ভারতের কাছ থেকে ঋণ পায়নি। আর ‘কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ’ এমন সময়ে ম্যারিটাইম অপারেশনকে এই জোটের অন্তর্ভুক্ত করলো, যখন শ্রীলংকার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এই জোটের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ঢুকতে যাচ্ছে। হয়তো অতি শিগগিরই বাংলাদেশের যুদ্ধজাহাজগুলিকে মালদ্বীপ, সেইশেল এবং মরিশাস পর্যন্ত সমুদ্রে টহল দিতে দেখা যাবে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ ’আবু উবাইদাহ’র মালদ্বীপ সফর হয়তো এরকম অপারেশনেরই একটা রিহার্সাল। এটা পরিষ্কার যে, ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতি শুধুমাত্র ভারতকেন্দ্রিক আর থাকছে না।

5 comments:

  1. মিডিয়ায় ফোকাস ছিলনা কিন্তু অনেক অজানা বিষয় তুলে এনেছেন। ধন্যবাদ।
    আচ্ছা কোন একটা অঞ্চল জুড়ে একটা দেশের নৌবাহিনীর জাহাজ টহল দেবার সাথে সেই দেশের প্রভাব বৃদ্ধির সম্পর্ক কিভাবে জড়িত? অর্থাৎ বাংলাদেশের জাহাজ টহল দেবার সাথে বাংলাদেশের প্রভাব কিভাবে বৃদ্ধি পায়?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ আপনার উঠানে টহল দেয়ার কারণে আপনার ভূমি দু'শ বছরের জন্যে ব্রিটিশ উপনিবেশ হয়ে গিয়েছিল। আশা করা যায় সেটা ভোলেননি। আর যুক্তরাষ্ট্রের কথা আর কি বলবো? হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে অন্য দেশের সমুদ্রসীমায় ঢুকলে কেউ বাধা দেয় কিনা, সেটা নিয়ে আবার "ফ্রিডম অব ন্যাভিগেশন" রিপোর্ট প্রকাশ করে। আরও ছোট পরিসরে বললে লিবিয়ার উপকূলে তুরস্কের যুদ্ধজাহাজ টহল দেয়ার কারণে লিবিয়ার সরকারের কাছে তুরস্কের সাহায্য পৌঁছাতে পারছে; নাহলে ফরাসি বা গ্রিক যুদ্ধজাহাজ সেগুলি দখলে নিয়ে নিতো। আবার লেবাননের উপকূলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজের টহল দেয়ার ব্যাপারটা বাংলাদেশের প্রভাবের অধীন থাকতো যদি টহল দেয়ার জন্যে অর্থায়ন জাতিসংঘ না করতো।

      ভারতের যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশের আশেপাশে নিয়মিত ঘোরাফিরা করলে কি আপনার সমস্যা হয়? নাকি সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই মনে করেন?

      Delete
    2. ভারত বাংলাদেশ নৌসীমানায় অবৈধ অস্ত্র বা মাদক আদান প্রদান বা জলদস্যুতা এমন পর্যায়ে পৌছায়নি যে নিয়মিত টহল দিতে হবে। বাংলাদেশ এমন কোন কৃত্তিম দ্বীপ নির্মাণ করছেওনা বা বে অফ বেংগলে চায়না বা পাকিস্তানের সাবমেরিনের আনাগোনাও মিডিয়ায় দৃষ্টিগোচর হয়নি। তাই বাংলাদেশের মত মুসলিম প্রতিবেশী দেশের নৌসীমানার আশেপাশে ভারতের যুদ্ধ জাহাজ নিয়মিত টহল দেয়া দুই দেশের সম্পর্কে অহেতুক বিরক্তি/উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। ভারতের বরং মালদ্বীপ, মরিশাস, সিসিলি এসব অঞ্চলের আশেপাশে টহল দেয়ার কথা ঠিক যেভাবে সে ভুটানকে স্থলে সাপোর্ট দিচ্ছে।

      তুরস্কের যুদ্ধ জাহাজ নিয়মিত টহল না দিলে লিবিয়ার উপকূল থেকে কিভাবে ফ্রান্স তুরস্কের কার্গো জাহাজ কোন যুক্তিতে দখল করে নিত?

      Delete
    3. প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে ছুতোর অভাব হয় না। ছুতো তৈরিও করা যায়। জলদস্যুতার কথা বলে ব্রিটিশরা পারস্য উপসাগরের তীরে বন্দর শহরগুলির নিরাপত্তা দেয়ার চুক্তি করেছিল। এরপর একসময় সেই শহরগুলিকে আলাদা দেশ হিসেবে রূপ দেয়। সেই দেশগুলি এখনও আছে। সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুতার কথা বলে পশ্চিমা দেশগুলি বাব এল বান্ডেব প্রণালির আশেপাশে নৌটহল শুরু করে। জলদস্যুতা এখন নেই বললেই চলে। কিন্তু টহল আছে; নৌঘাঁটি আছে। আরও নতুন নতুন নৌঘাঁটিও হচ্ছে।

      আসল কথা হলো, এসব ব্যাপার যুক্তি দিয়ে হয় না। যার ইচ্ছা এবং সামর্থ্য আছে, তার কাছে যুক্তি কোন ব্যাপার নয়।

      আর তুরস্কের সাথে ফ্রান্সের ঘটনাটা আপনি সম্ভবতঃ জানেন না। এখানে একটা লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি। গুগল সার্চ করে আরও অনেক পাবেন।
      https://www.reuters.com/article/us-nato-france-turkey-analysis-idUSKBN2481K5

      Delete
  2. আসল কথা হলো, এসব ব্যাপার যুক্তি দিয়ে হয় না। যার ইচ্ছা এবং সামর্থ্য আছে, তার কাছে যুক্তি কোন ব্যাপার নয়।-- আপনি যথার্থ বলেছেন। অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete