Friday 3 December 2021

রাশিয়া কি ইউক্রেন আক্রমণ করবে?

৪ঠা ডিসেম্বর ২০২১

 

ইউক্রেন বলছে রাশিয়া তার সীমানায় ৯০ হাজারেরও বেশি সেনা মোতায়েন করেছে। রাশিয়া যেমন গত এপ্রিলে সামরিক শক্তি মোতায়েন করে হুমকি তৈরি করার মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আলোচনায় আনতে পেরেছিল, ঠিক সেটাই তারা আবারও করতে চাইছে। রাশিয়া চাইছে ইউরোপ তাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিক। কিন্তু রাশিয়াকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার অর্থ হলো ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অবান্তর হয়ে যাওয়া।


২রা ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ‘অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি এন্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ’ বা ‘ওএসসিই’র এক অনুষ্ঠানে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেনএর সাথে বৈঠকের আগে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন যে, ইউরোপ হয়তো সামরিক সংঘাতের দুঃস্বপ্নের দিকে ফেরত যেতে চলেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ল্যাভরভ ইউরোপের সাথে নতুন নিরাপত্তা চুক্তি করার প্রস্তাব দেন; যার মূল স্তম্ভ হলো ন্যাটোর পূর্বদিকে সম্প্রসারণ রোধ করা। তিনি আরও বলেন যে, ন্যাটো দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে রাশিয়ার সীমানার কাছে পোল্যান্ড এবং রোমানিয়াতে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সামরিক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ‘বিবিসি’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, এই বৈঠক এমন সময়ে হলো, যখন ইউক্রেন বলছে যে, রাশিয়া ইউক্রেনের সীমানার কাছে ৯০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। মস্কো বলছে যে, ইউক্রেনের উপর হামলা করার কোন উদ্দেশ্য তাদের নেই; উল্টো ইউক্রেনেই তাদের পূর্ব সীমানায় সামরিক শক্তি মোতায়েন করছে, যেখানে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে ২০১৪ সাল থেকে ডনবাস অঞ্চলে যুদ্ধ চলছে। বৈঠকের পর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ব্লিনকেন বলছেন যে, ইউক্রেনের সাথে সংঘাতে জড়ালে রাশিয়াকে মারাত্মক পরিণতি গুণতে হবে।

উভয় পক্ষের উত্তেজক বক্তব্যের মাঝে উত্তেজনা প্রশমণের কথাও আসছে। রুশ উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ রুশ বার্তা সংস্থাকে বলছেন যে, দুই দেশের প্রেসিডেন্টের মাঝে আলোচনা চাইছেন তারা; যদিও এখনও আলোচনার সিডিউল ঠিক হয়নি। তিনি আরও বলেন যে, দুই নেতার এই বৈঠক খুবই জরুরি; কারণ সমস্যাগুলি ঘনীভূত হচ্ছে। ব্লিনকেনও দুই প্রেসিডেন্টের আলোচনার ব্যাপারে আশাবাদী।

এন্টনি ব্লিনকেন বলছেন যে, ইউক্রেন রাশিয়ার জন্যে কোন হুমকি নয়; বরং একমাত্র হুমকি হলো ইউক্রেনের প্রতি রাশিয়ার হুমকি। কিন্তু ৩০শে নভেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক বিনিয়োগ সন্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে, ইউক্রেনে দূরপাল্লার অস্ত্র মোতায়েন রাশিয়ার জন্যে ‘লাল দাগ’ অতিক্রম করার মতোই ঠেকবে। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে, ইউক্রেনের মাটিতে কোন আক্রমণাত্মক অস্ত্র মোতায়েন করা হলে তা ৭ থেকে ১০ মিনিটের মাঝে মস্কোতে হামলা করতে পারবে। আর হাইপারসনিক অস্ত্র ব্যবহার করলে তা মাত্র ৫ মিনিটের মাঝেই মস্কো পৌঁছাবে। তিনি পোল্যান্ড এবং রোমানিয়াতে ‘ঈজিস এশোর’ ব্যলিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, এই ব্যবস্থার মাঝে ‘মার্ক ৪১’ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার ব্যবস্থা রয়েছে; যার মাধ্যমে শুধুমাত্র বিমান বা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রই নয়, একই ব্যবস্থা ব্যবহার করে ‘টোমাহক’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও ছোঁড়া সম্ভব। ‘ঈজিস’ হলো মার্কিন নৌবাহিনীর ‘আরলেই বুর্ক-ক্লাস’ ডেস্ট্রয়ারগুলিতে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা ‘মার্ক ৪১’ ক্ষেপণাস্ত্র উড্ডয়ন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মাল্টিপারপাস এই ব্যবস্থার মাধ্যমে একইসাথে বিমান ধ্বংসী, সাবমেরিন ধ্বংসী এবং জাহাজ ধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও ভূমির টার্গেট ধ্বংস করার জন্যে তৈরি করা ‘টোমাহক’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও বহণ করা যায়; যার পাল্লা ১৩’শ থেকে আড়াই হাজার কিঃমিঃ পর্যন্ত। পুতিন ন্যাটোকে পোল্যান্ড বা রোমানিয়ার মতো ইউক্রেনেও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করার ব্যাপারে সাবধান করেন। তিনি বলেন যে, এমতাবস্থায় মস্কোর সামনে একটাই পথ খোলা থাকবে; আর তা হলো, শত্রুর বিরুদ্ধে একই ধরনের একটা হুমকি তৈরি করা। আর সেটা করার সক্ষমতা বর্তমানে রাশিয়ার রয়েছে।

 

রোমানিয়াতে ২০১৬ সালে 'ঈজিস এশোর' ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা হয়। রাশিয়া বলছে যে, এই ব্যবস্থা থেকে একইসাথে 'টোমাহক' ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও মোতায়েন করা সম্ভব। চীনকে নিয়ন্ত্রণ করাই যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য, তখন ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় রাশিয়ার সাথে পিছিয়ে পরাটাও যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে পারছে না। পূর্ব ইউরোপে অত্যাধুনিক অস্ত্র মোতায়েন করাটা যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি নয়, বরং সামরিক দুর্বলতাকেই তুলে ধরে। কারণ এই অস্ত্রের সাথে রিজার্ভ এবং ন্যাশনাল গার্ডের সেনাদের মোতায়েন করে ইউরোপ থেকে শক্তিশালী ইউনিটগুলি সরিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করা হচ্ছে।


মার্কিন সামরিক বাহিনী বর্তমানে ব্যবহৃত অস্ত্রকে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করতে চাইছে; যার মাধ্যমে সাধারণ একটা অস্ত্র কৌশলগত অস্ত্রে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। গত অক্টোবরে মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘লকহিড মার্টিন’ নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ‘প্রিসিশন স্ট্রাইক মিসাইল’ বা ‘পিআরএসএম’এর পঞ্চম পরীক্ষা চালিয়েছে। সামরিক ম্যাগাজিন ‘আর্মি টেকনলজি’ বলছে যে, এবারে তারা সেনাবাহিনী এবং ম্যারিন কোরের ব্যবহৃত হাল্কা রকেট আর্টিলারির ব্যবস্থাটাকে ব্যবহার করেছে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার জন্যে। ‘হাই মোবিলিটি রকেট আর্টিলারি সিস্টেম’ বা ‘হিমারস’ নামে পরিচিত ১৬ টন ওজনের এই রকেট আর্টিলারি ব্যবস্থাকে ‘সি ১৩০’ সামরিক পরিবহণ বিমানে করে পরিবহণ করা সম্ভব। ‘পিআরএসএম’ হলো এমন একটা ক্ষেপণাস্ত্র, যা বর্তমানে মার্কিন সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত সর্বোচ্চ ৩’শ কিঃমিঃ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ‘এমজিএম ১৪০ এটাকমস’এর পাল্লাকে দ্বিগুণ করার জন্যে ডেভেলপ করা হচ্ছে। একটা ‘সি ১৩০’ বিমান ব্যবহার করে এরকম একটা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাকে যেকোন স্থানে খুব দ্রুত মোতায়েন করা সম্ভব; যেখান থেকে তা ৫’শ কিঃমিঃএর অধিক পাল্লার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারবে। গত ফেব্রুয়ারিতে রোমানিয়ার সেনাবাহিনী ‘হিমারস’ রকেট আর্টিলারির প্রথম চালানটি পায় বলে বলছে রোমানিয়ার মিডিয়া ‘এগারপ্রেস’। ২০১৮ সালে পোল্যান্ডও ৫৬টা ‘হিমারস’ অর্ডার করে। এই রকেট ব্যবস্থাগুলি একাধারে যেমন বিমানে করে যেকোন স্থানে মোতায়েন করা সম্ভব, তেমনি এগুলি থেকে ৩’শ কিঃমিঃ পাল্লার ‘এটাকমস’ ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও ভবিষ্যতে ৫’শ কিঃমিঃএর বেশি পাল্লার ‘পিআরএসএম’ও ছোঁড়া সম্ভব। মার্কিন সেনাবাহিনীর অফিসার মেজর ব্রেনান ডেভেরাউ ‘ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন’এর প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন ‘ওয়ার অন দ্যা রক্স’এর এক লেখায় রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলায় পূর্ব ইউরোপে ‘হিমারস’ মোতায়েনের কথা বলেন। তার মতে, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার সাথে সাথে খুব স্বল্প বিনিয়োগেই যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে ডিটারেন্ট তৈরি করতে পারবে।

রুশ এবং মার্কিন কর্মকর্তারা উত্তেজক মন্তব্য করলেও উভয় পক্ষই দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আলোচনা দেখতে চাইছে। একে অপরকে সামরিক শক্তি মোতায়েনের জন্যে অভিযুক্ত করলেও কেউই যুদ্ধ চাইছে না। তথাপি রাশিয়া যেমন গত এপ্রিলে সামরিক শক্তি মোতায়েন করে হুমকি তৈরি করার মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আলোচনায় আনতে পেরেছিল, ঠিক সেটাই তারা আবারও করতে চাইছে। রাশিয়া চাইছে ইউরোপ তাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিক। কিন্তু রাশিয়াকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়ার অর্থ হলো ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অবান্তর হয়ে যাওয়া। চীনকে নিয়ন্ত্রণ করাই যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য, তখন ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় রাশিয়ার সাথে পিছিয়ে পরাটাও যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে পারছে না। পূর্ব ইউরোপে অত্যাধুনিক অস্ত্র মোতায়েন করাটা যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি নয়, বরং সামরিক দুর্বলতাকেই তুলে ধরে। কারণ এই অস্ত্রের সাথে রিজার্ভ এবং ন্যাশনাল গার্ডের সেনাদের মোতায়েন করে ইউরোপ থেকে শক্তিশালী ইউনিটগুলি সরিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মোতায়েন করা হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment