Saturday 25 December 2021

পশ্চিমা অর্থনীতিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্ট

২৫শে ডিসেম্বর ২০২১

করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণের কারণে পশ্চিমা দুনিয়ায় ক্রিসমাসের আগে আগে ৪ হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। মানুষের মৃত্যুর মহামারি যতটা, তার চাইতে বেশি সম্পদের মহামারি। অপ্রতুল এবং যথেচ্ছ সমাধানের কারণে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মারাত্মক চাপের মাঝে পড়েছে। এই যথেচ্ছ সমাধানগুলিকে জোরপূর্বক বাস্তবায়নের চেষ্টা মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করছে এবং জনমনে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই পড়েছে প্রশ্নের মুখে। করোনা মহামারি বিশ্বের জনগণকে ধ্বসে পড়া পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করছে।


করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের সংক্রমণের কারণে পশ্চিমা দুনিয়ায় ক্রিসমাসের আগে আগে ৪ হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। ওয়েবসাইট ‘ফ্লাইটএওয়্যার’এর বরাত দিয়ে ‘বিবিসি’ বলছে যে, ফ্লাইট বাতিলের এক চতুর্থাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। ক্রিসমাসের আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রে বাতিল হয়েছে ৬’শ ৮৯টা ফ্লাইট; ক্রিসমাসের দিন আরও ৭’শ বাতিলের অপেক্ষায়। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, অনেক ফ্লাইট ক্রু এবং অপারেশনসএর সাথে জড়িত লোকজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে; অথবা তাদের নিজেদেরকে কোয়ার‍্যান্টাইন করতে হয়েছে। যদিও গবেষকেরা বলেছেন যে, ওমিক্রন আগের ভ্যারিয়্যান্টগুলির চাইতে বেশি প্রাণনাশী নয়, তথাপি এর সংক্রমণ করতে পারার সক্ষমতা অনেক বেশি থাকায় অনেকেই চিন্তা পড়েছেন। ‘ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান’এর এসোসিয়েট প্রফেসর হ্যালি প্রেসকট ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে বলছেন যে, যখন একইসাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়ে যায়, তখন এদের মাঝে স্বল্প শতাংশ মানুষও যদি হাসপাতালে যায়, সেটাও মেডিক্যাল ব্যবস্থাকে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলার জন্যে যথেষ্ট।

ক্রিসমাসের ঠিক আগে আগে ব্রিটেনের রেস্টুর‍্যান্টগুলি ওমিক্রন ভ্যারিয়্যান্টের কারণে মারাত্মক সমস্যায় পতিত হয়েছে। ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকা বলছে যে, গত বসন্তের পর থেকে সবচাইতে খারাপ অবস্থায় পড়েছে তারা। ‘অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্স’ বা ‘ওএনএস’ বলছে যে, ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে রেস্টুর‍্যান্টগুলিতে বসা খদ্দেরের সংখ্যা ১৪ শতাংশ কমেছে। ওমিক্রনের কারণে ব্রিটিশরা এখন বাইরে গিয়ে খাচ্ছে কম; এবং বাসায় বসে কাজ করছে বেশি। লন্ডনে এই অবস্থা সবচাইতে খারাপ; সেখানে খদ্দেরের সংখ্যা কমেছে ১৮ শতাংশ। ‘ওএনএস’ আরও বলছে যে, বাসা থেকে কাজ করতে বলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই সপ্তাহে ২ শতাংশ বেড়ে ১৪ শতাংশে ঠেকেছে। ব্রিটেনের আঞ্চলিক শহরগুলিতে বেচাকেনা ভালো চললেও লন্ডনে বেচাকেনা ২৯ শতাংশ কমে গেছে। কনসালট্যান্সি কোম্পানি ‘অক্সফোর্ড ইকনমিক্স’এর অর্থনীতিবিদ এন্ড্রু গুডউইন বলছেন যে, যদিও সরকার বেশিরভাগ বিধিনিষেধ ক্রিসমাসের আগে চালু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তথাপি জনগণের মাঝেই সাবধানতা অবলম্বণ করার প্রবণতা বেড়েছে; এর উপর রয়েছে অবাধে চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা। তিনি মনে করছেন যে, এগুলির কারণে ব্রিটেনের জিডিপি ডিসেম্বর মাসে কমবে।

অপরদিকে আটলান্টিকে ওপাড়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডেরাল রিজার্ভ’ বলছে যে, মার্কিন অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় চার দশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে যে, গত নভেম্বরে ব্যক্তিগত খরচার হিসেবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ; যা ১৯৮২ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ। গত অক্টোবরে এটা ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ। নভেম্বরে জনগণের খরচ বাড়লেও আয় সেই তুলনায় বাড়েনি। খরচ বেড়েছে দশমিক ৬ শতাংশ; আয় বেড়েছে দশমিক ৪ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ধরে বেকার ভাতা দাবি করা মানুষের সংখ্যা ডিসেম্বরে দাঁড়িয়েছে ১৮ লক্ষ ৫৯ হাজারে। মহামারির মাঝে এটা সর্বনিম্ন সংখ্যা হলেও সংখ্যাটা যথেষ্টই বড়। কারণ এর বাইরেও অনেকেই রয়েছে যারা বেকারত্বের এই সংজ্ঞার মাঝে না পড়লেও কোনমতে সংসার চালাচ্ছে।

‘বিবিসি’ বলছে যে, ওমিক্রন ঠেকাতে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইতালি, স্পেন এবং গ্রিসে মাস্ক পড়ে বাইরে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উত্তর স্পেনের কাতালোনিয়াতে রাত্রিকালীন কারফিউ বলবত করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসে চলছে কঠোর লকডাউন। জার্মানিতে ২৮ ডিসেম্বর থেকে প্রাইভেট গণজমায়েত ১০ জনের বেশি করা যাবে না; নাইট ক্লাবগুলিও বন্ধ থাকবে। ফুটবল খেলা হবে দর্শকবিহীন মাঠে। পর্তুগালে ২৬শে ডিসেম্বর থেকে বার এবং নাইট ক্লাবগুলি বন্ধ হচ্ছে; আর ৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাসা থেকে কাজ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ সংস্থার প্রধান এন্থনি ফাউচি বলছেন যে, ক্রিসমাসের সময় মানুষ বেশি ঘোরাঘুরি করলে পুরোপুরি ভ্যাকসিন নেয়া থাকলেও সংক্রমণ বাড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি’র হিসেবে বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৫৩ লক্ষ মানুষ করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেছে; আক্রান্ত হয়েছে কমপক্ষে ২৭ কোটি ৯০ লক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ই ডিসেম্বর অফিশিয়ালি করোনায় মৃতের সংখ্যা ৮ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। গত ২রা অক্টোবরে তা ৭ লক্ষ ছাড়িয়েছিল। অর্থাৎ ৭৫ দিনে বা প্রায় আড়াই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মারা গেছে ১ লক্ষ মানুষ। প্রতিদিন গড়ে এই সংখ্যা ১ হাজার ৩’শ ৩৩ জন। ২০২০ সালের মার্চের শুরু থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯ মাসে মৃত্যু হয়েছিল ৭ লক্ষ মানুষের। অর্থাৎ এই সময়ের মাঝে গড়ে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২’শ ২৮ জন; যা কিনা গত আড়াই মাসের চাইতে কম! অথচ প্রথম ১৯ মাসের তুলনায় শেষ আড়াই মাসে বেশিরভাগ মানুষই ভ্যাকসিনের আওতায় এসেছে। ‘ব্লুমবার্গ’এর প্রতিবেদনে দেখানো হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ কমপক্ষে একবার ভ্যাকসিন নিয়েছে; ৬২ শতাংশ মানুষকে পুরোপুরিভাবে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। এর মাঝে ২০ শতাংশ আবার বুস্টার ডোজও পেয়েছে। ইইউতে ৭০ শতাংশ মানুষকে দেয়া হয়ে পুরোপুরি ভ্যাকসিন; ২৬ শতাংশ বুস্টারও পেয়েছে। মাল্টিবিলিয়ন ডলারের এই ভ্যাকসিন ব্যবস্থাও মৃত্যুর মিছিল কমাতে পারছে না। থামাতে পারছে না অর্থনৈতিক নিম্নগতি।

পশ্চিমা দেশগুলিতে ভ্যাকসিন নেয়ার বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে যেমন প্রতিবাদ হয়েছে, তেমনি করোনার কারণে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপের বিরুদ্ধেও হয়েছে বিক্ষোভ। রাষ্ট্রগুলি কোন সমাধান দিতে পারেনি তাদের জনগণকে, যার মাধ্যমে সংক্রমণ বা মৃত্যু কমানো যেতে পারতো। অথচ পরীক্ষামূলক বিধিনিষেধের যাঁতাকলে পরে জনগণের আর্থিক অবস্থা হয়েছে করুণ। ভ্যাকসিনের ডোজ বৃদ্ধি করার পরেও মেলেনি কাংক্ষিত ফলাফল। অথচ এর ফলে কিছু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি প্রচুর লাভ করেছে; তাদের গুটিকয়েক শেয়ারহোল্ডার লাশের মিছিলের উপর হয়েছে বিলিয়নায়ার। ওমিক্রন মানুষের জীবন নিচ্ছে কম; কিন্তু দুই বছর ধরে থেকে থেকে বিধিনিষেধের পর পশ্চিমা অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টাটুকুকে ধ্বসিয়ে ফেলছে। মানুষের মৃত্যুর মহামারি যতটা, তার চাইতে বেশি সম্পদের মহামারি। অপ্রতুল এবং যথেচ্ছ সমাধানের কারণে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মারাত্মক চাপের মাঝে পড়েছে। এই যথেচ্ছ সমাধানগুলিকে জোরপূর্বক বাস্তবায়নের চেষ্টা মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করছে এবং জনমনে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই পড়েছে প্রশ্নের মুখে। করোনা মহামারি বিশ্বের জনগণকে ধ্বসে পড়া পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করছে।

No comments:

Post a Comment