Friday 10 December 2021

বাইডেন এবং পুতিনের বৈঠক … ছাড় দেয়ার প্রবণতা নেই কেন?

১১ই ডিসেম্বর ২০২১

পুতিন বাইডেনকে আলোচনায় বসিয়ে রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ শক্তি হিসেবে দেখাতে চাইছেন। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন রাশিয়াকে আরেকটা সমমানের শক্তি হিসেবে দেখতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। অন্ততঃ একসাথে দু’টা শক্তির বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে জড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে যে চ্যালেঞ্জিং হবে, সেব্যাপারে কারুরই সন্দেহ নেই।

গত ৭ই ডিসেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন যে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার উপর এমন সকল অর্থনৈতিক অবরোধ আসবে, যা কিনা ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পরও রাশিয়ার উপর আরোপ করা হয়নি। দুই ঘন্টার রূদ্ধদ্বার এই বৈঠকের পর হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে বৈঠকের আলোচ্য বিষয়াবলির উল্লেখ করা হয়। বাইডেন একইসাথে বলেন যে, রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির জন্যে যে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন তৈরি করেছে, সেটা চালু করার আশাও পুতিন ছেড়ে দিতে পারেন, যদি তিনি ইউক্রেন আক্রমণে এগিয়ে যান। অপরদিকে ক্রেমলিন থেকে বলা হচ্ছে যে, পুতিন বাইডেনকে বলেন যে, পূর্ব ইউরোপ এবং বিশেষ করে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের সামরিক অবস্থান রাশিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মাঝে ফেলেছে; যেটাকে তারা ‘লাল দাগ’ হিসেবে বলছেন। তবে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, এটা এখনই বলা যাচ্ছে না যে, এই বৈঠক ইউক্রেনের উত্তেজনা প্রশমণে কতটা ভূমিকা রাখবে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, পুতিন তার উদ্দেশ্যকে পরিষ্কার করেননি। যেকারণে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না যে, রাশিয়া কি আসলেই আগামী বছরের শুরুতে ইউক্রেন আক্রমণ করে বসবে, নাকি পশ্চিমাদের কাছ থেকে নিজেদের দাবিগুলি আদায়ের লক্ষ্যেই রাশিয়া একটা সমস্যা তৈরি করেছে। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা বলছেন যে, বর্তমানে রাশিয়া ইউক্রেনের সীমানায় প্রায় ৭০ হাজার সেনা মোতায়েন রেখেছে; যা সামনের দিনগুলিতে ১ লক্ষ ৭৫ হাজারে উঠতে পারে।

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর পশ্চিমা দেশগুলি রাশিয়ার উপর যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার চাপে রাশিয়া ক্রিমিয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়নি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, এবারে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অবরোধের কথা চিন্তা করছে, তার মাঝে রয়েছে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে রুশ কোম্পানিগুলির জন্যে পুঁজি যোগাড় করা কঠিন করে ফেলা; এবং রুশ রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া। আরও কঠিন শাস্তি হিসেবে রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে বের করে দেয়ার কথাও বলা হচ্ছে। তবে ইউরোপিয়রা এই শাস্তির ব্যাপারে একমত নন; তারা বলছেন যে, এটা করা হলে রাশিয়ার প্রত্যুত্তরও যথেষ্ট কঠিন হতে পারে।

মার্কিনীরা বলছে যে, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করে নেয়ার সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে আড়াই বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এর মাঝে রয়েছে আকাশ নিরাপত্তার রাডার, কাউন্টার আর্টিলারি রাডার, ড্রোন, যোগাযোগ ব্যবস্থার যন্ত্রপাতি, নৌবাহিনীর জন্যে প্যাট্রোল বোট, এবং ‘জ্যাভেলিন’ ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। তবে ইউক্রেনে মার্কিন সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে কোন আলোচনা নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন যে, ইউক্রেনকে রক্ষা করতে না পারলে তা রাশিয়ার সামনে পশ্চিমা দুর্বলতাকেই তুলে ধরবে বলে অনেকেই মনে করবে; বিশেষ করে চীন এই ধারণা পোষণ করবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সিনেটের সামনে বলেন যে, রাশিয়া ক্ষেপে যেতে পারে মনে করে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া অনেক অস্ত্রই স্টোর করে রেখেছে। তবে চাপের মুখে পড়লে ইউক্রেন হয়তো তাদের ‘জ্যাভেলিন’ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি কাজে লাগাতে পারে।

৭ই ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব এন্টনি ব্লিনকেন ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’এর এক ফোরামে বলেন যে, রাশিয়ার সাথে সমস্যাটা আসলে ইউক্রেনের চাইতেও বড়। আন্তর্জাতিক সীমানাকে যে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যাবে না, এব্যাপারে দুনিয়ার নিয়মকানুনকে রক্ষা করার ব্যাপারটা এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সংস্থা ‘সিআইএ’এর ডিরেক্টর উইলিয়াম বার্নস একই ফোরামে বলেন যে, আগামী কয়েক মাসের মাঝে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সীমানায় জলা জায়গাগুলি জমে বরফ হলে গেলেই পুতিন হয়তো তার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। পুতিন মনে করছেন যে, জার্মানি চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের রিটায়ারমেন্টের পর কিছুটা বিক্ষিপ্ত রয়েছে। আর ফ্রান্সও আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। আর গত দুই বছরের তুলনায় রাশিয়ার বর্তমান অর্থনীতি বেশ ভালো; বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি রাশিয়াকে একটা সুযোগ দিচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ বাইডেনের অবরোধের হুমকিকে উড়িয়ে দিয়েই বলেন যে, রাশিয়ার জন্যে অবরোধ নতুন কিছু নয়। তিনি আরও বলেন যে, রুশ সেনারা রুশ ভূমিতেই রয়েছে; তারা কারুর জন্যেই হুমকি নয়।

‘এএফপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, যদিও অনেকেইর ধারণা পুতিন রাশিয়ার কূটনৈতিক ক্ষতি করে ইউক্রেন আক্রমণ করবেন না; তথাপি ওয়াশিংটনে অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন যে, এবার পুতিন হয়তো ধোঁকা দিচ্ছেন না। ‘কার্নেগি মস্কো সেন্টার’এর তাতিয়ানা স্তানোভায়া মনে করছেন যে, পুতিন পুরো হিসেবই পাল্টে দিয়েছেন। কাজেই এবার হয়তো রাশিয়া এখন মরিয়া কোন পদক্ষেপই নেবে। অপরদিকে বাইডেন যখন বলেছেন যে, তিনি কারুর ‘লাল দাগ’ মানবেন না, তখন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ব্লিনকেনকে বলছেন যে, রাশিয়া ন্যাটোর কাছ থেকে নিশ্চয়তা চাইছে যে, ন্যাটো রাশিয়ার সীমানার আরও বেশি কাছে আসার চেষ্টা করবে না। স্তানোভায়া মনে করছেন যে, পুতিন হয়তো বলতে চাইছেন যে, ন্যাটো তাকে এই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না দিলে তিনি ইউক্রেনে হামলা করবেন। তবে ইউক্রেনকে যে ন্যাটোর ভেতর ঢোকানো হচ্ছে না, সেব্যাপারে পশ্চিমারা একমত। আর ইউক্রেনকে রক্ষায় মার্কিন সেনা মোতায়েনের ব্যাপারটাও মার্কিন কর্মকর্তারা নাকচ করে দিয়েছেন। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি দিয়ে রাশিয়াকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে? নাকি ইউক্রেনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে দেশটার উপর রাশিয়ার আক্রমণকে বৈধতা দেবে? মার্কিন ইন্টেলিজেন্স এখনও নিশ্চিত নয় যে, পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করবেন কিনা। কিন্তু যেব্যাপারে সকলেই একমত তা হলো, পুতিন বাইডেনকে আলোচনায় বসিয়ে রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ শক্তি হিসেবে দেখাতে চাইছেন। ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন রাশিয়াকে আরেকটা সমমানের শক্তি হিসেবে দেখতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। অন্ততঃ একসাথে দু’টা শক্তির বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে জড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে যে চ্যালেঞ্জিং হবে, সেব্যাপারে কারুরই সন্দেহ নেই।

No comments:

Post a Comment