Thursday 16 December 2021

ভারত কি ৫০ বছর আগে এই বাংলাদেশই চেয়েছিল?

১৬ই ডিসেম্বর ২০২১

১৬ই ডিসেম্বর ২০২১। বাংলাদেশের বিজয় দিবস প্যারেডে অংশ নিচ্ছে ভারতীয় সামরিক কনটিনজেন্ট। বাংলাদেশকে স্বাধীনতা পেতে সহায়তা দেবার ৫০ বছর পর ভারত দেখতে পাচ্ছে যে, আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা নিঃসন্দেহে ভারতের প্রভাবকে প্রতিস্থাপন করছে। নিজের প্রভাব ধরে রাখতে দিল্লীকে হিসেব করতে হচ্ছে যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে বাস্তবতা মেনে নিয়ে তারা বাংলাদেশকে আলিঙ্গন করবে, নাকি শত্রুতা সৃষ্টি করে নিজেদের দুর্বল ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে? এই উভয় সংকটই বলে দিচ্ছে যে, ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে সামনের দিনগুলিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

 
১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবসের ৫০তম বার্ষিকীতে অতিথি হয়ে আসেন ভারতের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ। এর আগে একই বছরের মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে এসেছিলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের সামরিক কনটিনজেন্ট ভারতের সামরিক প্যারেডে অংশ নিয়েছে। আর ভারতের সামরিক কনটিনজেন্ট বাংলাদেশের বিজয় দিবস প্যারেডে অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের কর্মকর্তারা বারংবার বলছেন যে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তথাপি দুই দেশের মাঝে ইস্যুগুলিকে নিয়ে আলোচনা করলে সম্পর্কের গভীরতার ক্ষেত্রে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। অর্থশতক আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময় ভারত সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল। ভারত চেয়েছিল পাকিস্তানকে দুই ভাগ করে দুর্বল করতে এবং এর একাংশকে নিজের প্রভাবে নিয়ে আসতে। ৫০ বছর আগে ভারত যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়েছিল, সেই লক্ষ্য কি বাস্তবায়ন হয়েছে? ভারত কি আজ বাংলাদেশে তার স্বার্থগুলিকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছে? বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে ভারতের বিবৃতির জবাবে বাংলাদেশ থেকে যখন বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ তার নাগরিকদের মাঝে কাউকে সংখ্যালঘু হিসেবে দেখে না, তখন দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রশ্ন হলো, এই পার্থক্য দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে কতটা প্রভাব রাখবে?

সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি যখন দুই দেশের মাঝে দেয়াল গড়ছে

বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুদের অনুষ্ঠান দূর্গাপুজার পুজামন্ডপে হামলার পরদিন ১৪ই অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি সাংবাদিকদের বলেন যে, তারা বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হামলার খবর পেয়েছেন, যা তাদেরকে দুশ্চিন্তা দিয়েছে। একই দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হিন্দুদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা ও প্রতিনিধিদের সাথে পুজার শুভেচ্ছা জানানোর অনুষ্ঠানে বলেন যে, ভারতকে সাবধান থাকতে হবে যে, সেখানেও যাতে এমন কোনকিছু যেন না করা হয়, যা বাংলাদেশের উপরেও প্রভাব ফেলে এবং বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আঘাত আসে। ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্যা টেলিগ্রাফ’ বলছে যে, শেখ হাসিনা এমন সময়ে কথাগুলি বলেছেন, যখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ্য বাংলাদেশে এমন একটা ধারণা জন্মেছে যে, ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতা নেবার পর থেকে ভারতের মুসলিমদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের নতুন নাগরিকত্ব আইন, যার মাধ্যমে আসামে অগুণিত বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমকে বেআইনী বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে এবং ‘আর্টিকেল ৩৭০’ পরিবর্তনের মাধ্যমে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের বিশেষ স্ট্যাটাস বাতিল করে সেখানে অন্য অঞ্চলের হিন্দুদের বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা বাংলাদেশে মুসলিম বিরোধী কর্মকান্ড বলে পরিচিতি পেয়েছে।

২০২০এর অগাস্টে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবু ধাবিতে মধ্যপ্রাচ্যের ‘গালফ নিউজ’এর সাথে এক সাক্ষাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন যে, তিনি বুঝতে পারছেন না যে, ভারত কেন তাদের দেশে নাগরিকত্ব আইনের সূচনা করেছে। কারণ এটার কোন প্রয়োজন ছিল না। তিনি আরও বলেন যে, এই আইনের কারণে ভারতের জনগণ অনেক সমস্যায় পতিত হয়েছে। ভারতের ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ পত্রিকা বলছে যে, ভারতের নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশে যথেষ্ট অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টে এই আইন পাসের পর থেকে তিনজন বাংলাদেশী মন্ত্রী তাদের ভারত সফর বাতিল করেছেন বলে পত্রিকাটা। প্রতিবেদনে পরিষ্কার করে বলা হয় যে, এই নাগরিকত্ব আইনের লক্ষ্য হলো ডিসেম্বর ২০১৪এর আগে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে অত্যাচারিত হয়ে বিতাড়িত হওয়া হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদেরকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া। এই আইনে বাংলাদেশের নাম রাখার কারণে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বিরক্তি প্রকাশ করেছেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতৃবৃন্দের বারংবার আসাম রাজ্যে নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল ‘বেআইনী অভিবাসী’কে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলায় ২০১৯ সাল থেকে দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। পত্রিকাটা আরও বলে যে, নাগরিকত্ব আইনের ব্যাপারটা শেখ হাসিনা প্রথমবার সেবছরের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে এবং দ্বিতীয়বার অক্টোবরে নতুন দিল্লীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামনে নিয়ে আসেন।

 
ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আসছে ভারতীয় পিঁয়াজ। ২০২০এর সেপ্টেম্বরে ভারত বাংলাদেশে পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পুনরায় শুরু করতে অনুরোধ জানানো হয়। ভারতের এহেন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে পিঁয়াজের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায় এবং সরকারকে বহু দেশ থেকে পিঁয়াজ আমদানি করে ভর্তুকি দিয়ে বাজারে বিক্রি করতে হয়। ভারতে বিজেপির মতো একটা উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকারের অবির্ভাব এমন সময়ে ঘটেছে, যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে অনেকগুলি অপশন হাজির হয়েছে; যা কিনা গত পাঁচ দশকে কখনোই আসেনি। সম্পর্কোন্নয়নের পাতলা চাদরের নিচে ঢাকা পড়ে রয়েছে গভীর সন্দেহ।

ভ্যাকসিন, পিঁয়াজ, পানি, সীমান্ত হত্যা… সমস্যা বিস্তর; কিন্তু সমাধান নেই

২০২১এর ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে আরেক টানাপোড়েন শুরু হয় দুই দেশের মাঝে। ভারতের ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘সেরাম ইন্সটিটিউট’এর প্রধান নির্বাহী আদার পুনাওয়ালা বলেন যে, ভারতের সকলে ভ্যাকসিন পাবার পরেই অন্যদের কাছে ভ্যাকসিন বিক্রি করা হবে। ‘ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এই বক্তব্য বাংলাদেশে অস্থিরতার জন্ম দেয়; কারণ এর আগের বছরেই বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে অক্সফোর্ড এবং ‘এসট্রাজেনেকা’র ডেভেলপ করা ৩ কোটি ভ্যাকসিন কেনার জন্যে চুক্তি করে। অনেকেই সেসময় ভারতকে অনির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী বলে আখ্যা দিতে থাকে। পরবর্তীতে পুনাওয়ালা বাংলাদেশে ভ্যাকসিন রপ্তানি ব্যাহত হবে বলে ঘোষণা দিলেও ব্যাপারটা দুই দেশের সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জের মাঝে ফেলে। প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এটাই ভারতের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রথম উদাহরণ নয়। ২০২০এর সেপ্টেম্বরে ভারত বাংলাদেশে পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পুনরায় শুরু করতে অনুরোধ জানানো হয়। ভারতের এহেন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে পিঁয়াজের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে যায় এবং সরকারকে বহু দেশ থেকে পিঁয়াজ আমদানি করে ভর্তুকি দিয়ে বাজারে বিক্রি করতে হয়। ২০২০এর ডিসেম্বরে দুই দেশের মাঝে ভার্চুয়াল বৈঠকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং পরিবহণ করিডোর নিয়ে কথা হয়; কিন্তু তিস্তা নদীর পানি বন্টনের ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’এর সিনিয়র ফেলো জয়ীতা ভট্টাচার্য বলছেন যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পানি বন্টনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে। তিস্তার পানির ব্যাপারে এই রাজ্য তাদের অবস্থান না পাল্টালে বাংলাদেশের সাথে পানি বন্টন করা কঠিন।

‘ডয়েচে ভেলে’ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ভারত যখন বাংলাদেশের সাথে তিস্তা সমস্যা সমাধান করতে পারছে না, তখন একই নদীতে ১ বিলিয়ন ডলারের সেচের প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে চীন। পানি সমস্যা ছাড়াও দুই দেশের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলি করে মানুষ হত্যা করার ব্যাপারটাও বাংলাদেশের জনগণের কাছে অসহনীয় একটা ব্যাপার হিসেবে ঠেকছে। একই সময়ে চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্য বা ৮ হাজার ২’শ পণ্যের জন্যে চীনের বাজারে শুল্কমুক্তভাবে ঢোকার অনুমতি দিয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের অনেকগুলি অবকাঠামো প্রকল্পে চীনারা বিনিয়োগ করেছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘দ্যা উইলসন সেন্টার’এর বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলছেন যে, নাগরিকত্ব আইনের কারণে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝে চীনারা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের জন্যে সুবিধা করে দিয়ে ঢাকার আরও কাছাকাছি যেতে চাইছে। পাকিস্তানও চাইছে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে। ২০২০এর জুলাই মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। ঘটনাটা ভারতকে বড় কোন দুশ্চিন্তায় না ফেললেও ভারতীয় মিডিয়াতে এর ফলাও করে প্রচার বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্ভাব্য সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে ভারতীয়তের অস্বস্তিকেই দেখিয়ে দেয়।

 
বাংলাদেশের সামরিক শক্তির উন্নয়নের ব্যাপারে ভারতীয়রা সর্বদাই সন্দেহ প্রকাশ করেছে; যদিও বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ভারতের সামরিক শক্তির সাথে তুলনা করার পর্যায়ে নেই। ভারতে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে, কেন বাংলাদেশের সাবমেরিন দরকার। ভারতে অনেকেই মনে করেছেন যে, বাংলাদেশের কাছে সাবমেরিন বিক্রির মাধ্যমে চীন ভারতকে কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলছে।

বাংলাদেশের অস্ত্র ক্রয়ে ভারত খুশি হতে পারে না কেন?

বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক যতই মধুর বলা হোক না কেন, বাংলাদেশের সামরিক শক্তির উন্নয়নের ব্যাপারে ভারতীয়রা সর্বদাই সন্দেহ প্রকাশ করেছে; যদিও বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ভারতের সামরিক শক্তির সাথে তুলনা করার পর্যায়ে নেই। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীন থেকে ২টা সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়ার পর ভারতীয় চিন্তাবিদদের প্রতিক্রিয়া ছিল উল্লেখ করার মতো। ভারতের ‘ডব্লিউআইওএন’ টেলিভিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বাংলাদেশের কাছে সাবমেরিন বিক্রির মাধ্যমে চীন ভারতকে কৌশলগতভাবে ঘিরে ফেলছে; কারণ একইসাথে ভারতের পূর্বে পাকিস্তানে চীনের শক্ত অবস্থান রয়েছে। সেখানে বলা হয় যে, চীনারা এমন এক অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে, যেটা ভারত নিজের প্রভাবের অন্তর্গত বলে মনে করে। ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক জয়দেব রানাদে বলছেন যে, সাবমেরিন হলো এমন একটা যুদ্ধাস্ত্র, যার মূল ব্যবহার হলো চুপিসারে হত্যা করা। এটা সাধারণতঃ জলদস্যু পাকরাও করতে বা উপকূল টহলে ব্যবহৃত হয় না। তিনি বলেন যে, ভারত সরকার এটাকে বিপদ হিসেবে না দেখলেও এটা একটা চিন্তার কারণ হবে অবশ্যই। কারণ বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনার সাথেসাথে বঙ্গোপসাগরের নৌশক্তির ব্যালান্স পাল্টে গেছে; যদিও সাবমেরিনগুলি পুরোনো। তবে রানাদে মনে করেন না যে, যতক্ষণ ঢাকার সরকার ভারতের বন্ধু, ততক্ষণ ভারতের কোন দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে।

ভারতে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন যে, কেন বাংলাদেশের সাবমেরিন দরকার; যখন দেশটার সাথে ভারত এবং মিয়ানমার কোন দেশেরই সমুদ্রসীমার বিরোধ নেই। ভারতীয় মিডিয়া ‘ক্যাচ নিউজ’এর সাথে সাক্ষাতে বাংলাদেশে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন যে, বাংলাদেশ বিভিন্ন ছুতোতে সাবমেরিন কিনতে চাইতে পারে; আর চীনও কম দামে বিক্রয় করার সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। তার ধারণা ২০১৩ সাল থেকে যখন বাংলাদেশ সরকার সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা শুরু করে, তখন থেকেই ভারতীয় কর্মকর্তারা হয়তো বাংলাদেশের কাছে জানতে চেয়েছেন যে, তারা কেন সাবমেরিন কিনতে চাইছেন। তার ধারণা যদিও বাংলাদেশের হাতে সাবমেরিন ভারতের ইন্টেলিজেন্সের জন্যে একটা আলাদা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, তথাপি তিনি মনে করেন না যে, এটা ভারতের জন্যে হুমকি। তবে তিনি বলছেন যে, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব কমাতে অর্থনৈতিকভাবে চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় ভারত পারবে না। আর যেহেতু বহুকাল যাবত বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে ভারতকে শত্রু হিসেবে দেখা হয়েছে, তাই সামরিক দিক থেকেও ভারতের পক্ষে বাংলাদেশে চীনকে প্রতিস্থাপন করা কঠিন।

ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিবাল ভারতের ‘সংসদ টিভি’র সাথে সাক্ষাতে বলেন যে, বাংলাদেশের সাবমেরিন কেনাটা ভারতের জন্যে নতুন এক চ্যালেঞ্জের শুরু। বাংলাদেশ যদি রাশিয়া থেকে সাবমেরিন ক্রয় করতো, তাহলে তা ভারতের জন্যে চিন্তার কারণ হতো না। তবে তিনি মনে করেন না যে, সাবমেরিনগুলি বাংলাদেশের কোন কৌশলগত লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে। তিনি মনে করেন না যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভারতের সাথে মিল থাকবেই; তবে চিন্তার ব্যাপার হলো, যেখানে ভারতের সাথে চীনের সম্পর্ক ভালো নয়, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার একটা দেশ চীনের স্বার্থের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছে। এতে বাংলাদেশ এবং ভারতের মাঝে আন্তর্জাতিক ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বিনা সিক্রি বলেন যে, বাংলাদেশ এবং ভারতের জনগণের মাঝে সম্পর্ক এতটাই গভীর যে, তা চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তিনি মনে করছেন যে, ভারতের উচিৎ বাংলাদেশকে সরাসরিই বলা যে, বাংলাদেশের স্বার্থ হওয়া উচিৎ ভারতের পাশে থাকা; অন্য কোন দেশকে এখানে যুক্ত করে নতুন করে সমীকরণ তৈরি না করা। ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সোসাইটি ফর পলিসি স্টাডিজ’এর ডিরেক্টর প্রাক্তন নৌবাহিনী কমোডোর উদয় ভাস্কর বলেন যে, যে মুহুর্তে কাছাকাছি কোন সাবমেরিন থাকবে, সেই মুহুর্ত থেকে একটা নৌবাহিনীর কাজ হয় সেই সাবমেরিনের উপর তথ্য যোগাড় করা। সেই সাবমেরিন একটা বন্ধু বা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের হোক না কেন, সেটার উপর নজরদারি করাটা একটা দায়িত্ব।

 
মার্চ ২০২১। করোনা মহামারিতে মালদ্বীপকে সহায়তা দেয়ার জন্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল দল মালদ্বীপে। ভারতের কাছে না পেয়ে শ্রীলংকা বাংলাদেশের কাছ থেকে দুই’শ মিলিয়ন ডলারের মুদ্রা ঋণ পেয়েছে। এই কর্মকান্ডগুলি বাংলাদেশের জনগণের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষারই প্রতিফলন।

ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের আভাস


ভারতে বিজেপির মতো একটা উগ্র হিন্দুত্ববাদী সরকারের অবির্ভাব এমন সময়ে ঘটেছে, যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে অনেকগুলি অপশন হাজির হয়েছে; যা কিনা গত পাঁচ দশকে কখনোই আসেনি। সম্পর্কোন্নয়নের পাতলা চাদরের নিচে ঢাকা পড়ে রয়েছে গভীর সন্দেহ। ভারতের কাছে না পেয়ে শ্রীলংকা বাংলাদেশের কাছ থেকে দুই’শ মিলিয়ন ডলারের মুদ্রা ঋণ পেয়েছে। আবার মালদ্বীপকে করোনা সহায়তা প্রদান করেছে বাংলাদেশ। এই কর্মকান্ডগুলি বাংলাদেশের জনগণের ভূরাজনৈতিক আকাংক্ষারই প্রতিফলন। হিমালয়ের পাদদেশে লাদাখে চীনের সাথে সামরিক উত্তেজনার মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান দেখে অবাক হয়েছে ভারত। বাংলাদেশ সেসময় শুধু ভারতের পাশে দাঁড়ানো থেকে বিরতই থাকেনি; চীনের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে সম্পর্কোন্নয়নও করেছে। একই সময়ে বাংলাদেশের অবস্থান নেপালকেও সুযোগ দিয়েছে ভারতের সাথে কালাপানি সীমানা নিয়ে দ্বন্দ্বে শক্ত অবস্থান নিতে। শুধু তাই নয়, পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছে এমনভাবে, যাতে বাংলাদেশকে দোষারোপ করার কোন পদ্ধতিই ভারতের কাছে ছিল না। কারণ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে থাকার কথা বলে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে। এমনকি বাংলাদেশের সাবমেরিনকে ব্যালান্স করতে মিয়ানমারকে রুশ নির্মিত একটা পুরোনো সাবমেরিনও দিয়েছে। আবার মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজগুলির জন্যে সমুদ্রের গভীরে বাংলাদেশের সাবমেরিন খুঁজে পাবার সুবিধার্থে ভারতে নির্মিত সোনার যন্ত্রও বিক্রি করেছে। ভারত চেয়েছিল মিয়ানমারে তার প্রভাব বৃদ্ধির মাধ্যমে শুধু চীনকেই নয়, বাংলাদেশকেও ব্যালান্স করতে। তবে যে ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার তা হলো, ভারতের পক্ষে এখন বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করা ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশকে স্বাধীনতা পেতে সহায়তা দেবার ৫০ বছর পর ভারত দেখতে পাচ্ছে যে, আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা নিঃসন্দেহে ভারতের প্রভাবকে প্রতিস্থাপন করছে। এখানে পাকিস্তানের ভূমিকা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তানের প্রভাব কমাতে গিয়েই ভারত বাংলাদেশের প্রভাবকে মেনে নিতে বাধ্য হবে। এমতাবস্থায় নিজের প্রভাব ধরে রাখতে দিল্লীকে হিসেব করতে হচ্ছে যে, আঞ্চলিক নিরাপত্তার ব্যাপারে বাস্তবতা মেনে নিয়ে তারা বাংলাদেশকে আলিঙ্গন করবে, নাকি শত্রুতা সৃষ্টি করে নিজেদের দুর্বল ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করবে? এই উভয় সংকটই বলে দিচ্ছে যে, ভারত মহাসাগরের ভূরাজনীতিতে সামনের দিনগুলিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment