Friday 17 December 2021

নতুন জার্মান পররাষ্ট্রনীতি… কতটা বাস্তবসম্মত?

১৭ই ডিসেম্বর ২০২১

পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে যৌথ সংবাদ সন্মেলন করছেন নতুন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক এবং পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিবিগনিউ রাউ। ইইউএর মাঝে পোল্যান্ডের অবস্থান শক্তিশালী ইইউএর বিরুদ্ধে। কারণ শক্তিশালী ইইউএর মাঝে পোল্যান্ড শক্তিশালী জার্মানিকে দেখতে পাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ইউরোপের লিবারাল আদর্শের দেশগুলির মাঝে এখনও অবিশ্বাস বিদ্যমান। ইইউএর ভঙ্গুর এই পরিস্থিতিতে নতুন জার্মান কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সফলতা কতটুকু হতে পারে, তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নয়।

 
জার্মানির নতুন কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বিভিন্ন ইউরোপিয় দেশ ভ্রমণ করা শুরু করেছেন। ‘গ্রীন পার্টি’র নেতা হিসেবে ভ্রমণের শুরুতেই তিনি বলেন যে, জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলাকে তিনি পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাধান্য দেবেন। কারণ ভবিষ্যতের কোন সমস্যাই মানবজাতির জন্যে জলবায়ু সমস্যার চাইতে বড় নয়। এর আগের সকল জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো তিনিও প্যারিস দিয়ে তার যাত্রা শুরু করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, ফ্রান্সের চাইতে কাছের বন্ধু নেই জার্মানির। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছেন যে, প্যারিস এবং ব্রাসেলসে ইইউ এবং ন্যাটোর হেডকোয়ার্টার্স সফরে তিনি বেলারুশ এবং ইউক্রেনের ব্যাপারে ইউরোপের নীতির একাত্মতা নিয়ে কথা বলেন। প্যারিস সফরে তিনি চীনা মহিলা টেনিস খেলোয়াড় পেং শুইএর ইস্যুতে একাত্মতা ছাড়াও বেইজিংএ শীতকালীন অলিম্পিক কূটনৈতিকভাবে বর্জনের বিষয়ে আলোচনা করেন। বেয়ারবক পরিষ্কারভাবেই উল্লেখ করেন যে, ইউরোপ যেসকল আদর্শিক স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলিকে ভেঙ্গে যেতে দিতে পারে না; বিশেষ করে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার।

তবে বেয়ারবকের পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ সফর অতটা মধুর ছিলনা। বেয়ারবক পোল্যান্ডের বার্তা সংস্থা ‘টিভিপি’কে বলেন যে, দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পোল্যান্ডে জার্মানির কর্মকান্ডের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা, দায়িত্ব নেয়া এবং ক্ষতিপূরণের ব্যাপারগুলি রয়েছে। দুই দেশের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে তোলাকে তিনি ঐতিহাসিক কাজ বলে আখ্যা দেন। পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিবিগনিউ রাউ বলেন যে, পোল্যান্ডের জনগণের চিন্তায় সুবিচারের ব্যাপারটা প্রোথিত হতে হলে অনেকগুলি ইস্যুর সমাধান প্রয়োজন। তিনি বলেন যে, পোল্যান্ড নতুন সরকারের কাছ থেকে দায়িত্ব স্বীকার এবং ক্ষতিপূরণ চায়। পোলিশ মিডিয়া ‘এনএফপি’ বলছে যে, ওয়ারশ সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে বার্লিনের কাছ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ চাইলেও এর আগের এঙ্গেলা মার্কেলের সরকার এর কোন আইনী ভিত্তি নেই বলে প্রত্যাখ্যান করে। এছাড়াও পোল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত পোল্যান্ডের আইনকে ইইউএর আইনের উপরে স্থান দেয়ার পর থেকে ইইউএর সাথে পোল্যান্ডের যে টানাপোড়েন চলছে, সেব্যাপারেও বেয়ারবক আলোচনা করেন। তবে তিনি ওয়ারশ সফরে সাংবাদিকদের এব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি। অপরদিকে পোলিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাউ রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প বাতিল করে দেয়ার দাবি জানান। ‘এনএফপি’ বলছে যে, পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন দলের চেয়ারম্যান ইয়ারোস্লাভ কাচিনস্কি ইইউএর আরও শক্তিশালীকরণকে জার্মানির আরও শক্তিশালী হওয়া হিসেবে দেখছেন। তিনি ৫ই ডিসেম্বর ইউরোপের ডানপন্থী নেতা ফ্রান্সের মারিন লা পেন এবং হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবানকে নিয়ে বৈঠক করেন।

মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’এর সাথে এক সাক্ষাতে জার্মান ‘সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ বা ‘এসপিডি’র পররাষ্ট্রনীতির মুখপাত্র নিলস শ্মিড বলেন যে, ‘এসডিপি’, ‘গ্রীন পার্টি’ এবং ‘ফ্রি ডেমোক্র্যাটস’ বা ‘এফডিপি’এর নতুন কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি আগের নীতিকেই এগিয়ে নেবে; বড় রকমের পরিবর্তনের আশংকা নেই। ইউরোপ এবং আন্তআটলান্টিক নীতির ব্যাপারে সকলের ঐকমত্য রয়েছে। নতুন ক্ষেত্র হিসেবে তিনি ইন্টারনেট কোম্পানিগুলিকে শৃংখলার মাঝে আনা, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ‘ফাইভ জি’ এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো নতুন প্রযুক্তিকে নিয়মের অধীনে আনতে, এমনকি মহামারি নিয়ন্ত্রণে এবং নতুন ঔষধ ডেভেলপ করতে তিনি ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার উপর গুরুত্ব দেন। তবে তিনি বলেন যে, সবচাইতে বড় পরিবর্তনটা আসতে পারে চীন নীতির ক্ষেত্রে। এর মূল কারণ হলো চীন ইউরোপের জন্যে যেমন হুমকি, তেমনি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা ছাড়াও পুরো বিশ্বব্যবস্থাকেই সমস্যায় ফেলে দিয়েছে।

জার্মান থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’ বা ‘ডিজিএপি’র প্রধান নির্বাহী ক্যাথরিন ক্লুভার এশব্রুক এক লেখায় বলছেন যে, নতুন জার্মান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি এঙ্গেলা মার্কেলের সুযোগসন্ধানী এবং মার্কেন্টিলিস্ট পররাষ্ট্রনীতি থেকে অনেক আলাদা হতে চলেছে। তিনি বলছেন যে, জার্মান সরকার যুক্তরাষ্ট্র এবং সমমনা দেশগুলিকে একত্রিত করে চীনের উপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে, যাতে তারা অর্থনৈতিক ভ্যালু চেইনগুলিকে ঠিক রেখেই মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনগুলিকে রক্ষা করতে পারে। তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইউরোপের নিয়মকানুন এবং স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করার ক্ষমতার উপর জোর দেবে; যেমন প্রযুক্তি, সাইবারস্পেস এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রে। তবে সেটা সম্ভব হবে যদি জার্মানি নিজেদের ডিজিটাল এবং ডাটা সক্ষমতাকে দ্রুত উন্নত করতে সক্ষম হয়। আর জলবায়ুভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নেতৃত্ব পেতে গেলে জার্মানিকে অভ্যন্তরীণ জলবায়ু লক্ষ্য ঠিক এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে তিন দলের কোয়ালিশনের মাঝে পার্থক্যগুলি লক্ষ্যনীয় এবং কিছু ক্ষেত্রে নীতি পরিষ্কার নয়; যেমন রাশিয়া এবং তুরস্কের ক্ষেত্রে নীতির স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে; প্রতিরক্ষানীতিও একেবারেই উচ্চাভিলাসী নয়। জিডিপির ৩ শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করার কথা বলা হয়েছে; তবে কোন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই বাজেট ব্যবহৃত হবে, তা নিশ্চিত করে বলা হয়নি। আগামী বছর জার্মানি প্রথমবারের মতো তার জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ করতে যাচ্ছে; যেখানে সরকার হয়তো বাধ্য হবে জার্মানির নিজস্ব স্বার্থগুলিকে উল্লেখ করতে। এর মাধ্যমে জার্মানি হয়তো অবশেষে একটা ‘স্বাভাবিক’ পররাষ্ট্রনীতির খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে।

ব্রাসেলসের ‘সেন্টার ফর রাশিয়া ইউরোপ এশিয়া স্টাডিজ’এর প্রতিষ্ঠাতা থেরেসা ফ্যালন সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে, জার্মানি তার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী চীনের ব্যাপারে যে আদর্শিক নীতিতে যেতে চলেছে, সেটা খুব সহজে বাস্তবায়নযোগ্য। ‘ডয়েচে ভেলে’ বলছে যে, এঙ্গেলা মার্কেলের সরকারও ক্ষমতা নেয়ার শুরুতে আদর্শিক কথা বলে তিব্বতের দালাই লামার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল; পরে বাস্তবতা মেনে নিয়ে চীনের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে নেয়ার নীতিতে এগিয়েছে। বিশ্লেষকেরা জার্মানির নতুন কোয়ালিশন সরকারের চীন নীতি নিয়ে আলোচনা করলেও জার্মানির সীমানাতেই যে বড় সমস্যা রয়েছে, তা নিয়ে খুব একটা কথা বলছেন না। ইইউএর মাঝে পোল্যান্ডের অবস্থান শক্তিশালী ইইউএর বিরুদ্ধে। কারণ শক্তিশালী ইইউএর মাঝে পোল্যান্ড শক্তিশালী জার্মানিকে দেখতে পাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ইউরোপের লিবারাল আদর্শের দেশগুলির মাঝে এখনও অবিশ্বাস বিদ্যমান। ইইউএর ভঙ্গুর এই পরিস্থিতিতে নতুন জার্মান কোয়ালিশন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সফলতা কতটুকু হতে পারে, তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নয়।

No comments:

Post a Comment